আমি যা বলতে চাই তা গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি: পূরবী বসুর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 16, 2012 10:43:21 AM

প্রকাশিত বই: জীবন ও যৌবনের গল্প, ধলেশ্লরী মিসিসিপি, নিরুদ্ধ সমীরণ, দিনরাত্রির ছায়াঘর, আজন্ম পরবাসী, নারী ভাবনা, নারীবাদী গল্প, নোবেল বিজয়ী নারী : গৃহ কর্মে সংগ্রামে, জোছনা করেছে আড়ি, নারীতুমি নিত্য (নারীবাদী গল্প সংকলন), নামে কী আসে যায়, নারী সৃষ্টি ও বিজ্ঞান, গল্প সমগ্র (১), (২)

দুপুর মিত্র: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে স্নাতক। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল কলেজ অব পেনসিলভানিয়া থেকে প্রাণ-রসায়নে এম.এস. এবং ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরি থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে পিএইচডি। নিউ ইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারে গবেষণা এবং কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছেন। আমি নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র বলে আপনাকে এই প্রশ্নটা করছি যে বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে সাহিত্যে ঝুকলেন কি করে বা কেন?

পূরবী বসু: বিজ্ঞানে পড়াশোনা করা শুরু করার অনেক আগে থেকেই সাহিত্যে ঝোঁক ছিল আমার।

দুপুর মিত্র: আপনার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে গল্পের বইয়ের সংখ্যাই বেশি। নারীবাদী গল্প, জীবন ও যৌবনের গল্প, গল্প সমগ্র-১, গল্প সমগ্র-২, নারীতুমি নিত্য (নারীবাদী গল্প সংকলন) ইত্যাদি। তার মানে ধরে নেওয়া যায় গল্পের দিকে আপনার টানটা বেশি। ঠিক কি কারণে বলবেন কি?

পূরবী বসু: আমার সকল প্রবন্ধ-নিবন্ধের, অনুবাদের ও সম্পাদিত বই একত্রিত করলে গল্পের বই-এর মোট সংখ্যায় চাইতে খুব কম হবে বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, আপনি ঠিক-ই বলেছেন, গল্পের দিকে আমার টানটা একটু বেশি। তার প্রধাণ কারণ, নানান আঙ্গিকে, নানান ভঙ্গিতে, মানুষের অন্তর্জগতের বিচিত্র সব ভাবনা ও তাদের বাহ্যিক কর্মকান্ডের স্ববিরোধিতা যার অনেকটাই বিশ্লেষনযোগ্য নয়, আমি গল্পের মাধ্যমে আমার কল্পনা জুড়ে প্রকাশ করতে পারি। সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু কিছু বিষয় ও বাস্তবতা যা মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে বা করতে উদ্যত হয় বলে আমার নজর কাড়ে, প্রধানত সেসব বিষয় বা সমস্যা নিয়েই আমি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লিখে থাকি। আর লিখি আমার নিজের জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা যার কিছুটা হলেও সার্বজনীন একটা আবেদন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় কথা, আমি যা বলতে চাই তা গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আমার মনে হয়, ছোটগল্প এখনো একটি বিশাল অকর্ষিত ভূমি, যাকে একই ফসল বা ফলনের জন্যেও নানানভাবে কর্ষণ করা চলে। গল্প লেখার মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ যথেষ্ট বেশি। একটি গল্প লিখতে বসে অন্য কারো কাছ থেকে কোন তথ্য যেমন ধার করতে হয় না, উল্লেখিত উপাত্তের যথার্থতা যাচাই করারও তেমন প্রয়োজন হয় না। এখানে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন, আমার চলাচলের পরিধি অবারিত। আমার নিজের লেখা গল্প আমার আপন, নিজের সন্তানের মতো, যার জন্মের শুরু আমার মধ্যেই, যা অঙ্কুরিত হয়েছে আমার-ই রক্তমাংসে-চেতনায়, যা কোন ধারাবাহিকতার বর্ধিত কলেবর নয়-নয় আজকের বিশেষ কোন অস্তিত্ব বা স্থাপনার ওপর আরো একটি প্রলেপ বা সংযোজন।

দুপুর মিত্র: নারী ভাবনা নিয়ে আপনার একটি বই রয়েছে। আপনি ব্র্যাক-এ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকও ছিলেন। বাংলাদেশের নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে আপনার কি আলাদা ভাবনা আছে? সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

পূরবী বসু: নারীদের, বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের প্রসবকালীন জটিলতা এবং তাদের এই বিশেষ জরুরি অবস্থার সময় বাড়ির কর্তাদের সিদ্ধান্তহীনতা, স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যের অভাব ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থকর্মীর অপ্রতুলতা আমায় বড়-ই ব্যথিত করে। শুধু মা বা শিশুর মৃত্যু-ই নয়, অনেক নারী এইে ধরণের নারকীয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাবার পরে, শারীরিকভাবে বেঁচে থাকলেও সমাজ ও পরিবারের লোকদের চোখের আড়ালে বহুরকম যন্ত্রণা ও সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে যায়। কেউ কেউ এমন করুণ ও নির্জীবভাবে জীবন ধারণ করে যে দেখলে মনে হয়, এই শারীরিক ও মানসিক কষ্টের জন্যে তারা নিজেরাই যেন দায়ী। আর এই অহেতুক অপরাধবোধ থেকেই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েও মুখ বুজে মেনে নেয় কেউ কেউ।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর বেশ কয়েকটিই অনেক দিন ধরে সরকারের জাতীয় স্বাস্থনীতি এবং বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার অনুমোদিত বেশ কিছু স্বাস্থ-পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদেশের অনেকগুলো মৌলিক অথচ সহজেই আরোপ করা সম্ভব, এমন কিছু স্বাস্থ-শিক্ষা ও সচেতনতা এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত স্বাস্থ-বিষয়ক ক্রিয়াকর্ম, ব্র্যাকের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা ও সফলতা অর্জন করেছে।

দুপুর মিত্র: গল্প লিখেন কেন?

পূরবী বসু: গল্পের মাধ্যমে নিজের কথা চারপাশের পরিচিত চরিত্রদের মধ্য দিয়ে সহজ করে বলতে পারি যাতে করে সেসব নীতিকথার মতো না শোনায়। গল্পের বিভিন্নরকম প্রকাশ ও ফর্ম আমায় আকর্ষণ করে। গল্প নিয়ে ল্যাবরেটরিতে এক্সপেরিমেন্ট করার মতো বিভিন্নরকম এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টাও করি মাঝে মাঝে। কোন একটি বিশেষ পদ্ধতি বা বিশেষ ধরনের ভাষা সব্রকম গল্পের জন্যে উপযোগী আমি মনে করি না। প্রতিটি গল্প-ই স্বতন্ত্র, এবং তাই প্রতিটি গল্প-ই একান্তভাবে আমার আগ্রহ ও মনোযোগ দাবী করে। প্রতিটি গল্পের-ই ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা থাকে, এর উপস্থাপনায়, বিন্যাসে, চরিত্র নির্মানে।

দুপুর মিত্র: গল্প লিখতে আপনি কাদেরকে বেশি অনুসরণ করেন এবং কেন?

পূরবী বসু: সচেতনভাবে কোন বিশেষ লেখককে কখনো নয়। তবে আমার অগ্রজ এবং অনুজ অনেক প্রিয় গল্পকার রয়েছেন যাদের গল্প পড়তে ভালবাসি, আমার গল্পের ওপর যাদের মন্তব্য ও সমালোচনা মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং মাঝে মাঝে কিছু পরামর্শ গ্রহণ করি। এমন অনেক গল্পকার ও বুদ্ধিজীবী-ই আছেন, যাঁরা হয়তো প্র্ত্যক্ষে বা পরোক্ষে আমায় গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত করেন, যেমন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সাদ কামালী, আবুল হাসনাত, খালেদ হায়দার, নাহার মনিকা।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের গল্পকে আপনার বেশি ভাল লাগে এবং কেন?

পূরবী বসু: অনেকের গল্প-ই ভাল লাগে, নাম বলে তাদের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িকা কাদের গল্প আপনার বাজে মনে হয় এবং কেন?

পূরবী বসু: সমসাময়িককালে কারো কোন বাজে গল্প আমি পড়িনি। গল্প লেখার প্রচেষ্টাটি-ই একটি শুভ উদ্যোগ, একটি নান্দনিক প্রয়াস। এখানে “বাজে” কিছুর অস্তিত্ব থাকার কথা নয়।

দুপুর মিত্র: আমরা প্রচুর পরিমাণ রাশিয়ার ফিকশন পড়ার পরও যাদু বাস্তবতার পৃথিবীতে গল্পকে নিয়ে গিয়েছি। এটা কেন?

পূরবী বসু: আমি সবসময় বৈচিত্র্য পছন্দ করি- বিশেষত সাহিত্য পাঠে – সাহিত্য রচনায়। সাহিত্যের দিগন্তটা যতটা খুলে প্রসারিত করা যায় ততটাই ভালো। রাশিয়ার ফিকশন পড়ে কল্পনার জগৎ যেমন উন্মোচিত হয়েছে, যাদু-বাস্তবতার গল্প-ও তেমনি চিন্তার ও কল্পনার পরিধি বাড়িয়েছে আমাদের। তবে যাদুবাস্তবতা, আমার মনে হ্য়, সাহিত্যে তেমন নতুন কোন পদ্ধতি বা প্রকাশ নয়। এর অস্তিত্ব বহুদিনের – এই আমাদের দেশেও। তফাৎ, তখণ, এই বিশেষ শব্দটি, যা প্রধানত ল্যাটিন আমেরিকা থেকে পরে আমরা ধার করেছি, ব্যবহার করা হতো না। মানে সেইসব গল্পগুলোকে যাদু বাস্তবতার গল্প বলা হতো না। তা নইলে সৈয়দ শামসুল হকের “রক্ত গোলাপ” বা জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের “গোলাপের নির্বাসন” (আশ্চর্য্য, দুটো গল্পের শিরোনামেই যে “গোলাপ” শব্দটির উপস্থিতি রয়েছে, সেটা এর আগে কখনো খেয়াল করিনি) অর্ধ শতাব্দী আগেই রচিত হয়েছিল। এগুলো কি যাদুবাস্তবতার গল্প নয়?

দুপুর মিত্র: আমি গল্প লিখতে চাইলে আপনি কি করার পরামর্শ দিবেন এবং কেন?

পূরবী বসু: প্রচুর গল্প ও উপন্যাস পড়ুন। ক্লাসিক ও আধুনিক দুটো-ই। আশেপাশের মানুষদের এবং নিজেকে নিঃশ্চুপে, বিনা মন্তব্যে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।

দুপুর মিত্র: কলকাতা ও ঢাকার কথাসাহিত্যের ফারাকটা কোথায়?

পূরবী বসু: ফারাকটা যতটা না বাস্তবে রয়েছে, তার চেয়েও বেশি সৃষ্টি করা হয়েছে - হচ্ছে। প্রায়শঃ-ই কৃত্রিমভাবে। কলকাতার কথাসাহিত্যের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, সেই সাহিত্য থেকে সমগ্র বাংলার সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় অর্থাৎ মুসলমানন সমাজ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারি না আমারা (ওখানকার মাত্র কয়েকজন মুসলমান লেখকের লেখা ছাড়া)। বাংলাদেশের কথাসাহিত্য প্রধানত মুসলমান সমাজ ঘিরে আবর্তিত হলেও সেখানে অন্যান্য জনগনের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়। এছাড়া, ভাষার ব্যাপারটা তো রয়েছেই। সাহিত্যে যেমন ধীরে ধীরে মুখের ভাষা উঠে আসে, দুই বাংলার সাহিত্যের ভাষা ব্যবহারেও তাই কিছুটা ফাড়াক থাকবেই। কিন্তু কেবল স্বাতন্ত্র বা বিচ্ছিন্নিতা তৈরি করার জন্যে কৃত্রিমভাবে ভাষা নির্মানের ও গণমাধ্যমে তা চালু করার প্রচেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই না। বহমান নদীর মতো ভাষা তার নিজস্ব গতিতেই বাঁক পরিবর্তন করবে। সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার বহুদিন ধরেই গৃহিত। এমন কি বর্ননাতেও কিছু কিছু বিছিন্ন আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগ নতুনত্বের মাত্রা যোগ করতে পারে। কখনো কখোনো তার প্রয়োজন-ও রয়েছে। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে সমস্ত দেশ-জুড়ে একক কোন আঞ্চলিক ভাষার অস্তিত্ব নেই, মান বাংলার - বিশেষ করে লিখিত আকারে প্রমিত বাংলার বিকল্প কিছু থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না। ব্যাকরণবদ্ধ (চলমান) প্রমিত বাংলাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নিজের ভাষা বলে গ্রহণ করতে বা স্বীকার করে নিতে তাই আমার লজ্জা হয় না।