সামাজিক উপযোগিতার কথা ভেবে সৃষ্টিশীল লেখক লেখেন না: জাকির তালুকদারের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Oct 31, 2013 12:18:44 PM

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত বই: কুরসিনামা- নান্দনিক, মুসলমানমঙ্গল- রোদেলা প্রকাশনী, কল্পনা চাকমা ও রাজার সেপাই- ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ , কবি ও কামিনী-প্রকৃতি, হা-ভাতভূমি- শ্রাবণ প্রকাশনী, চলনবিলের রূপকথা-জোনাকী প্রকাশনী,পিতৃগণ- রোদেলা প্রকাশনী, ছায়া বাস্তব-অনিন্দ্য প্রকাশ, মায়ের জন্য ভালোবাসা-মুক্তদেশ প্রকাশন, বাছাই গল্প- জয়তী, যোজনগন্ধা-গদ্যপদ্য, রবীন্দ্রনাথ : ‘রাজা’-মূর্ধণ্য, গল্প পাঠ-শ্রাবণ প্রকাশনী, হাঁটতে থাকা মানুষের গান-ঐতিহ্য , বহিরাগত-রোদেলা প্রকাশনী, বাংলাদেশের গল্প-নান্দনিক ।

দুপুর মিত্র: আপনি কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন?

জাকির তালুকদার: কিশোর বয়স থেকে ছড়া লিখতে শুরু করি। মেডিক্যালের ছাত্র থাকা অবস্থায় অনেক ছড়া লিখেছি। ছড়ার বইও বেরিয়েছে। সেই সময় কিছু গল্প লেখারও মকসো করেছি। এমনকি একটি মঞ্চনাটকওলিখেছিলাম। তবে যাকে বলে পুরোপুরি পেশাদার ভঙ্গিতে কথাসাহিত্যে কাজ শুরু করা- তা শুরু হয়েছে ১৯৯৬ সাল থেকে।

দুপুর মিত্র: আপনার সবচেয়ে সফল কাজ কোনটা?

জাকির তালুকদার: এটি তো পাঠকরা বলবেন। তবে একেক পাঠক এক-একটি লেখার কথা বলেন। কেউ বলেন আমার বাছাই গল্পগুলির কথা, কেউ বলেন মুসলমানমঙ্গল-এর কথা, কেউ বলেন পিতৃগণ-এর কথা, কেউবাকুরসিনামা-র কথা। বোদ্ধারাও বলেন। তাদের মধ্যেও ভিন্নতা আছে।

আর আমার ধারণা হচ্ছে সবচেয়ে সফল লেখাটি এখনো আমার লেখা হয়ে ওঠেনি হয়তো।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লেখায় আপনি সুনির্দিষ্টভাবে কোন সমস্যায় বেশি পড়েন?

জাকির তালুকদার: সময় বের করা। একটানা কাজ করার মতো সময় না পাওয়া। বারবার লেখার কাজে বাধাগ্রস্ত হওয়া। বাংলাদেশের সব লেখকের বোধহয় এই অসুবিধা ভোগ করতে হয়।

দুপুর মিত্র: লেখার সময় আপনি কি শিডিউল করেন?

জাকির তালুকদার: লেখার সময় আমি আসলে একটানা লিখতে চাই। সারাদিন লিখতে চাই। সন্ধ্যায় আড্ডা বা অন্য কোনো বিনোদনে যেতে চাই। পরদিন সকাল থেকে আবারও লিখতে বসতে চাই।

দুপুর মিত্র: আপনি কি কম্পিউটারে লিখেন?

জাকির তালুকদার: হ্যাঁ। এই প্রযুক্তিটা না এলে আমার গদ্য লেখার জন্য যে কী পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম বেড়ে যেত তা ভাবতেও শিউরে উঠি।

দুপুর মিত্র: গল্প আর উপন্যাসের ভেতর আপনার পছন্দ কোনটাতে বেশি?

জাকির তালুকদার: আমার পক্ষপাত গল্পের দিকে। অবশ্য পাঠকের পক্ষপাত উপন্যাসের দিকে।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লেখার সাথে ধৈর্য্যরে সর্ম্পক আছে কি?

জাকির তালুকদার: সব লেখার সঙ্গেই ধৈর্য্যেরে সম্পর্ক রয়েছে। তবে উপন্যাসের সঙ্গে আকার এবং আয়তনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে বলে সেখানে ধৈর্য্যেরে পরিমাণ বেশি দরকার হয়। তাছাড়া উপন্যাসের চরিত্র বা পাত্র-পাত্রীরসংখ্যা সাধারণত অনেক হয়ে থাকে। ঘটনা নানাদিকে এগিয়ে যায়। সবগুলির মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করার জন্য লেখককে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হয়। আনুপাতিক হারে ধৈর্য্য বেশি প্রয়োজন হয়।

দুপুর মিত্র: লেখার আগে কি আপনি আউটলাইন করেন?

জাকির তালুকদার: সাধারণত লিখিত কোনো আউটলাইন থাকে না। মনের মধ্যেই সেটি বিকশিত হতে থাকে। তবে মুসলমানমঙ্গল এবং পিতৃগণ লেখার সময় মাঝামাঝি জায়গায পৌঁছানোর পরে লিখিত আউটলাইন করেনিয়েছিলাম।

দুপুর মিত্র: আপনার গদ্যশৈলী কি আলাদা? কিভাবে এটা আলাদা?

জাকির তালুকদার: প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তেমনই আমিও আলাদা। তাই আমার গদ্যশৈলীও আলাদা। কিভাবে আলাদা? তা জানতে হলে আপনাকে আমার গদ্যশৈলীর সাথে অন্য যে কোনো লেখকের গদ্যশৈলীর তুলনাকরে দেখতে হবে।

দুপুর মিত্র: নিজের কোন কাজটির জন্য খুব তৃপ্ত বোধ করেন?

জাকির তালুকদার: তৃপ্তির আয়ুষ্কাল তো সর্বোচ্চ আধাঘণ্টা। কোনো একটা লেখা শেষ করার পর একটা সিগারেট আর এক কাপ চা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই তৃপ্তি শেষ হয়ে যায়।

দুপুর মিত্র: আপনি কি বিশেষ কোনও পাঠককে সামনে রেখে লিখেন না বিশেষ অডিয়েন্সেকে?

জাকির তালুকদার: না। কখনোই না।

দুপুর মিত্র: সাহিত্যের কি সামাজকি বাধ্যবাধকতা আছে? এ নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

জাকির তালুকদার: সাহিত্য সৃষ্টির সময় লেখক একক এবং স্বয়ম্ভু। কিন্তু ছাপা হয়ে গেলে তা সমাজের সম্পত্তি হয়ে যায়। সমাজ তার উপযোগিতা অনুযায়ী কোনো লেখাকে গ্রহণ করে বা বর্জন করে। এইভাবেই সাহিত্যসামাজিক। তবে সামাজিক উপযোগিতার কথা ভেবে সৃষ্টিশীল লেখক লেখেন না। সেকথা ভেবে লেখেন কলামিস্টরা, সাংবাদিকরা।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখার কক্ষ নিয়ে কিছু বলুন?

জাকির তালুকদার: প্রায় দুই যুগ ধরে লিকলেও আমার লেখার কোনো আলাদা ঘর ছিল না। সম্প্রতি হয়েছে। সেখানে আমার লাইব্রেরি, লেখার টেবিল, চেয়ার আর একটা দোলনা চেয়ার। বড় শান্তি লাগে সেই ঘরে ঢুকলে।

দুপুর মিত্র: আপনি কি বেশি পড়া পছন্দ করেন?

জাকির তালুকদার: খুব পছন্দ করি। সম্ভব হলে দিন-রাত পড়তে চাই। এমনকি লেখার চাইতেও পড়া ঢের আরাম এবং আনন্দের কাজ।

দুপুর মিত্র: আপনি কি গল্প খুব দ্রুত শেষ করতে পছন্দ করেন?

জাকির তালুকদার: আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, একটি গল্পের প্রথম শব্দটি লেখার পর তা শেষ হতে এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। কয়েকটি গল্প বেশি ভুগিয়েছে। যেমন টানাবাবা গল্পটি লিখতে পাক্কা দেড়মাসসময় লেগেছিল।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লিখতে আপনি সাধারণত কতটুকু সময় নেন?

জাকির তালুকদার: এর তো ভাই কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নাই। কোনোটা শেষ হতে তিন মাস লেগেছে, কোনোটার জন্য ব্যয়িত হয়েছে ছয় বছর।

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোনও গল্প বা উপন্যাসের কিভাবে শুরু করতে জোর দেন? চরিত্র না বাক্য? না কোনও ডায়ালগকে?

জাকির তালুকদার: চরিত্র এবং পরিবেশকে। ডায়লগ- কখনোই নয়।

দুপুর মিত্র: লেখে ফেলার পর কি আপনার কখনও এমন হয়েছে যে পুরো লেখাই মানে গল্প বা উপন্যাসকে আপনাকে নতুন করে লিখতে হয়েছে?

জাকির তালুকদার: প্রত্যেক লেখককেই কম-বেশি এই কাজ করতে হয়েছে। আমাকেও।

দুপুর মিত্র: লেখার আগে আপনি কি সমাপ্তি ঠিক করে রাখেন?

জাকির তালুকদার: না। খুব আবছা একটা দিগন্তরেখা থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটি উপন্যাসের সমাপ্তির সাথে মেলে না।

দুপুর মিত্র: আপনি শেষ পৃষ্ঠা লেখার আগেই কিভাবে গল্প বা উপন্যাসের শেষটা ঠিক করেন?

জাকির তালুকদার: উপন্যাসের গতিধারা বা চরিত্র নির্ধারণ করে সেটা।

দুপুর মিত্র: লেখালেখিকে কি সংগ্রাম মনে হয় আপনার?

জাকির তালুকদার: অল্পকিছু সুবিধাভোগীর কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের সব মানুষের জীবন মানেই তো সংগ্রাম। বাঁচার জন্য সংগ্রাম, সম্মানজনক জীবনের জন্য সংগ্রাম, অসাম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আমার জীবনও তোসংগ্রামই। কাজেই লেখালেখিকে সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ কোথায়?

দুপুর মিত্র: লেখার পর আপনি সাধারণত কোন বন্ধুর সাথে শেয়ার করেন?

জাকির তালুকদার: আমি আমার লেখা নিয়ে গল্প করতে ভালোবাসি না। এমনকি আমার সামনে কেউ আমার লেখা পড়ছে, এটা দেখলে খুব অস্বস্তি হয়। সেই কারণে লেখার পর সেটা নিয়ে কারো সঙ্গেই আসলে শেয়ার করা হয়না। লেখা চূড়ান্ত রূপ পেয়ে গেলে তা সোজাসুজি ছাপা হয়ে পাঠকের কাছে চলে যায়।