কোনো একটা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই তো প্রবাহিত হচ্ছি: তানিম কবিরের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 12, 2014 5:02:41 PM

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে? যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

তানিম কবির: টোটাল কবিতার কথা জানি না। তবে সমাজে ভূমিকা রাখার জন্য সামাজিক কবিতা লেখার লোক আছে। যাদের কাজ সামাজিক কবিতা লিইখা সমাজকে কবিতার অপরাপর নৈরাজ্য থেকে মুক্ত রাখা। সমাজ যেহেতু প্রায় সব পক্ষেরই একটা সামাজিক ভূমিকা দেখতে চায়, তাই কবিতার কাছ থেকেও সে সেটা আদায় কইরা নিতে চায়, এবং পারেও। ভূমিকা উৎপাদনের জন্য সমাজে নিয়োগপ্রাপ্ত কবিরাও থাকেন। ফলে, সমাজে ভূমিকা না রাখার সুযোগ নাই কবিতার।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

তানিম কবির: আমি ওই ওই কবির দ্বারা বেশি প্রভাবিত, প্রভাবিত করার জন্য যারা নিজেদের কবিতারে শুধুমাত্র একটা বলনভঙ্গিই স্রেফ বানাইয়া ফেলেন নাই। যাদের প্রভাবই আমারে প্রভাবিত হওয়া থেইকা রক্ষা করার চেষ্টা করে, তাদের দ্বারাই আমি বেশি প্রভাবিত।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি? কবিতা কি?

তানিম কবির: বিষয়টা নিয়া তেমন কিছু ভাবি নাই আমি। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়, জন্মগতভাবে যে যতটা কবিসুলভ, যার যতটা কবিত্ব— ধীরে ধীরে সেসব কাটাইয়া ওঠাটাই যারযার কবি হইয়া ওঠা। আর এটা যারা পারলো না, তাদেরটা আমার কাছে ‘কবি হয়ে থাকা’।

কবি হয়ে ওঠা আর কবি হয়ে থাকা উভয় পক্ষ সাধারণত যা লিইখা থাকেন, সেগুলাই কবিতা।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

তানিম কবির: মূল প্রবণতা অত্যন্ত গম্ভীর। আর সার্বিক অন্যান্য প্রবণতাগুলোরে লিখিত অন্ধকারও বলা যাইতে পারে। কবিদের মধ্যে এমন একটা কিছু লিখবার বা ভাববার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা থাকে, যা দেখা যায় নাই (অন্তত নিজে সে দেখে নাই), যা কখনো ছিলই না, এবং যা হবার নয়। বাংলা কবিতা বলতে এখানে শুধুমাত্র বাংলাদেশের কবিতার কথাই বলা হইলো।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

তানিম কবির: করেই হয়তো, আমি খুব বুঝেশুনে দেখিনি কোনোটাকে। কোনো একটা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাতেই তো প্রবাহিত হচ্ছি, টের পাচ্ছি না। এই টের না পাওয়াটারে বড় ও পর্যাপ্ত আন্দোলন বলে মনে হয় আমার। তবে রাজপথের আন্দোলনকারী কয়েকজনের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। কোথাও কোথাও লেখা ছাপতে না দেওয়া ছাড়া আর কোনোভাবে ওই আন্দোলন চালু থাকে কিনা, তা আমি জানতে পারি নাই।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন? সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

তানিম কবির: অনেকভাবেই কবিতা লিখি। তবে সবচেয়ে কমন হচ্ছে; একটা কোনো শুরু যেটা আমার অজ্ঞাতেই হয়, সেই অজ্ঞাত শুরুর ক্রমবিস্তারটা ঘুরে দেখার ভঙ্গিতে কবিতা লেখা।

সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা বলতে কী বোঝায়? বাংলা কবিতাও কি সেটার অন্তর্ভুক্ত নয়? নাকি সমসাময়িক ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া কবিতার কথা জানতে চাওয়া হচ্ছে! যাই হোক, আমার কোনো মন্তব্য নাই।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

তানিম কবির: বিভিন্ন পর্যায়ে আমার লেখালেখি বিভিন্ন সময়ে শুরু:

একদমই প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন এলাকার ছেলেপুলেদের সংগঠিত করে নামাজ পড়তে নিয়ে যাইতাম আমি। তখন নামাজ পড়ার ব্যাপারে যেন তারা উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে প্রথম কবিতা লিখি। কবিতার নাম ছিল ‘নামাজের আহ্বান’। তখন মনে হয় ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি।

এরপর এই শতাব্দির শুরুর দিকে প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিনে প্রথমবারের মতো আমার কোনো লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কিছুদিন আমি আলপিনে লিখতাম। বিভাগীয় সম্পাদক সুমন্ত আসলাম সেগুলার কোনো কোনোটা ছাপতেন। সেগুলা ছিল পড়লে হাসি আসে, এমন সব লেখা।

তারপর প্রেমে পড়লাম, এবং পৃথিবীর মূল সিরিয়াসনেস যে অন্যখানে অবস্থানরত, সে ব্যাপারে ধারণা পাইলাম, সে কারণে তখন রম্যরচনা ছাইড়া ‘সিরিয়াস’ কিছু লিখতে চাইলাম। যেটা পড়লে আর হাসি পাবে না কারো। গল্প লিখতে শুরু করলাম। সেসব গল্পও ওই প্রথম আলোরই একটা পাঠক পাতা, যেটার নাম ছিল বন্ধুসভা, ওইখানে ছাপা হইছিল কিছু।

গল্প লিখতে লিখতেই মূলত জানতে পারি এই যে গল্প লিখি, যেগুলা পত্রিকায় ছাপা হয়— এগুলা নাকি আসলে ‘মূলধারা’র গল্প না। কেননা মূলধারার গল্প কোনো পত্রিকায় ছাপা হইতে পারে না। সেগুলা প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে লিটলম্যাগাজিনে ছাপাইতে হয়। সেসময় সরকার আশরাফ সম্পাদিত কাগজ নিসর্গের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা সংখ্যা হাতে পাই।

আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী চেতনায় রীতিমত দাউদাউ করে জ্বলে উঠি, ফেনীতে, অন্যান্য আরো যারা লেখক ছিলেন তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মিটিং ও পাঠচক্র করি। সিরিয়াস হয়ে ঘুরে বেড়াই। নিজেও ছোটকাগজ সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিই। ওইসময় নিজের বা নিজেদেরই কোনো একটা কাগজের জন্য ২০০৪ সালে প্রথম আমি ‘সিরিয়াস’ কবিতা লিখি। কবিতার নাম ছিল ‘বনলতার বুক’।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

তানিম কবির: মনের সুখে। সেই মন কখনো আমার একলারটাই, আবার কখনো বা আরো অনেকের। উদ্দেশ্য সাধনেও আমি কবিতা লিখি, লিখি একে-তাকে মেয়েদের মুগ্ধ করার প্রয়াসে বা অপপ্রয়াসেও।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

তানিম কবির: কমন যেসব বিষয় অনেকদিন আগে থেকেই কবিতা লেখার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে জারি আছে— সেসবের অনুসরণ প্রাথমিক ও প্রায় একাডেমিক একটা প্রয়োজনরূপে (দরকার) ঠিক আছে। কবিতা লেখার প্রস্তুতি হিসেবে সেটা যথেষ্টও।

কিন্তু প্রত্যেকেই যেহেতু ‘স্রেফ কবিতা’ লিইখা সাইরা নিজের কবিতাটাই লিখতে চায়, কবিতায় নিজেরেই রোপণ করতে চায়— ফলে, প্রাথমিক প্রস্তুতির পর যার যার মতো প্রত্যেকেই তার নিজের প্রস্তুতিক্ষেত্র নিজেই আয়োজন করে। সে আয়োজন ভণ্ডুল করে, বিনির্মাণ করে।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভালো লাগে এবং কেন?

তানিম কবির: ভালোলাগা তার ব্যাকগ্রাউন্ড ডিটেইলকে ইনেক্টিভ করতে না পারলে সেটা যেন পর্যাপ্ত ভালোলাগাই না। ফলে ভালো কাদের কবিতা লাগে এই মর্মে কারো কারো নামোল্লেখ করা সম্ভব হইলেও, কেন ভালো লাগে সে বর্ণনায় আমি যেতে চাই না, বা পারিও না।

এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে আমি আসলে কারো নামও নিবো না।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

তানিম কবির: সমসাময়িক অনেকের কবিতাই আমার খারাপ লাগে। অনেকের কবিতা পড়েই মনে হয়, টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকার খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। তাতেও আপত্তি ছিল না। বা আপত্তি তো আসলে ফাইনালি কোনোকিছুতেই নাই। কিন্তু, যেন তারা একটা কিছুকে, বা ওইপর্যন্ত একটা দাগ টেনে দিয়ে দাগের ভিতরকার বিষয়গুলোকেই কবিতা হিসেবে চিনতে, জানতে, এমনকি চেনাতে বা জানাতে চায়। এইতো রুচির এই শৃঙ্খলাইজেশন আমারে কষ্ট দেয়।

কবিতা কারটা খারাপ লাগে সেটা ঢালাওভাবে বলা যায় না, এভাবে তার বা তাদের নাম বলাটা তার বা তাদের প্রতি অবিচার হয়ে যাবে। লেখক কম্যুনিটিতে স্যাঁতস্যাতে আবেগচর্চার পাশাপাশি স্পষ্টবাদিতার নামে সংবেদনবিরোধী কার্যকলাপেরও বিরোধী আমি।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

তানিম কবির: ফারাকটা ভাষায়। ওইখানে ভারতীয় বাংলা ভাষায় কবিতা লিখিত হয়। এখানে হয় বাংলাদেশীয় বাংলা ভাষায়। এদেশের নামের সাথে ‘বাংলা’ শব্দটা না থাকলে বিষয়টা আরো নিরপেক্ষভাবে দেখা যাইতো। আসলে এই ফারাক থাকা বা না-থাকারে আমরা অনেকে অযথাই ইমোশনালি নিই। বাস্তব সত্যিটাও তো কম ইমোশনের না। দুই বাংলার এই ফারাক বা পার্থক্যরে একটা আলাদা সৌন্দর্য বলেও মনে হয় আমার।

তবে কবিতার এই পার্থক্য দুই বাংলার সংবাদপত্রের ভাষাগত পার্থক্যের তুলনায় নিতান্তই নগন্য। পেশাগত কারণে পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরকে এদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভাষাদান করতে গিয়ে টের পেয়েছি, তা অন্য যেকোনো ভাষার অনুবাদের চেয়ে কম পরিশ্রমের নয়!

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

তানিম কবির: তা তো দিচ্ছেই!

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

তানিম কবির: ব্লগ কিংবা অনলাইন কেন্দ্রিক যেকোনো প্ল্যাটফর্মকে লিটলম্যাগের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আমার। কেননা এসব প্ল্যাটফর্ম জাতীয় দৈনিক ও লিটলম্যাগের বস্তাপচা সাহিত্য সম্পাদকদের কাছে আটকে থাকা লেখকদের আত্মমর্যাদাবোধরে লেখকদের কাছে ফিরাইয়া দিতে পারছে।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

তানিম কবির: সাহিত্যরে দেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা আছে দৈনিকের। কিন্তু ঢাকাস্থ গ্রুপিং ও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের মতো হীনস্বার্থে সুযোগটির চরম অপচয় ঘটান স্বয়ংসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকগণ। অন্যান্য পর্যবেক্ষণ চেপে যাওয়াই ভালো।