সৃষ্টিশীল কোন কিছুর ক্ষেত্রে আউটলাইন শব্দটা খুব একটা যুতসই নয়: মুস্তাইন সুজাতের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 6, 2014 4:14:05 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন?

মুস্তাইন সুজাত: আজকের কাগজের ‘সুবর্ণসভা’য় প্রথম লিখি, ছদ্মনামে । প্রায় বছর দশ আগে। তারপর থেকে অনেক জায়গাতে লিখেছি, নিজ নামেই। আর লিখবোই এরকম একটা ইচ্ছা নিয়ে যখন শুরুটা, তা’ওতো হয়ে গেলো বেশ কিছুদিন ।

দুপুর মিত্র: আপনার সবচেয়ে সফল কাজ কোনটা?

মুস্তাইন সুজাত: আসলে এ ভাবনাটা কখনো আসে নি । কারন নিজেই নিজের সাফল্যের মূল্যায়ন, বরাবরই আমার কাছে গৌণ একটা কাজ, প্রতিক্ষেত্রেই । তাছাড়া লেখকের বেলায় সফলতা মূল্যায়নের চাবিকাঠি তো আর তাদের হাতে থাকে না, থাকে পাঠকদের হাতে । আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমি লিখছি এবং লেখাটা চালিয়ে যেতে চাই ।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লেখায় আপনি সুনির্দিষ্টভাবে কোন সমস্যায় বেশি পড়েন?

মুস্তাইন সুজাত: সবে মাত্র শুরু করেছি একটা, এখনো তেমন কোন সমস্যায় পড়িনি ।

দুপুর মিত্র: লেখার সময় আপনি কি শিডিউল করেন?

মুস্তাইন সুজাত: লেখালেখি আমার কাছে এক ধরনের ভিতরের তাড়না, যা সহসাই আসে-যায়, শিডিউল কিংবা নিয়মের থোরাই কেয়ার করে ?

দুপুর মিত্র: আপনি কি কম্পিউটারে লিখেন?

মুস্তাইন সুজাত: আসলে, কাগজে লেখা আমার কাছে এক অন্যরকম ভালোলাগা । এখন অবশ্য কম্পিউটারে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি ।

দুপুর মিত্র: গল্প আর উপন্যাসের ভেতর আপনার পছন্দ কোনটাতে বেশি?

মুস্তাইন সুজাত: লেখার ক্ষেত্রে যদি বলেন, আপাদত গল্প নিয়েই পড়ে আছি । একটা উপন্যাসের খসরাও শুরু করেছি মাত্র । আর পড়ার ক্ষেত্রে সব, যারতাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস-কবিতা-নাটক কিছুই বাদ দেই না । বাছ বিচারের খুব একটা ধার ধারি না ।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লেখার সাথে ধৈর্য্যের সম্পর্ক আছে কি?

মুস্তাইন সুজাত: শুধু উপন্যাস কেন, সব ক্ষেত্রেই বোধয় ধৈর্য নামক বস্তুটির খুব প্রয়োজন ।

দুপুর মিত্র: লেখার আগে কি আপনি আউটলাইন করেন?

মুস্তাইন সুজাত: আউটলাইনের প্রশ্ন আসে তখনই যখন একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ফরমেটে কোন কিছু দাঁড় করাতে চাইবেন কেউ। সৃষ্টিশীল কোন কিছুর ক্ষেত্রে আউটলাইন শব্দটা খুব একটা যুতসই নয়, আমি মনে করি। আমি স্রেফ আমার মত করে কোন একটা ঘটনাকে দেখার চেষ্টা করি । লিখতে শুরু করি, ব্যাস একটা কিছু দাঁড়িয়েও যায় শেষে ।

দুপুর মিত্র: আপনার গদ্যশৈলী কি আলাদা? কিভাবে এটা আলাদা?

মুস্তাইন সুজাত: আসলেই কি আলাদা ?

তবে হ্যাঁ, লেখার ক্ষেত্রে যা হয়, একেক জনের লেখার ধরন একেক রকম, শৈলী একেক ধাঁচের। এক্ষেত্রে চারপাশের সামগ্রিক অবস্থা-বাস্তবতা, লেখকের মননের উপর অনেকটা প্রভাব ফেলে। সময়ের হিসেবেই ধরুন না যেমন, তিরিশ-ষাট-নব্বই-প্রতিটা জায়গাতেই কিন্তু এক একটা বাঁক নিয়েছে গদ্য-কবিতা-গল্প যাই বলেন না কেন ? প্লট-বিষয়-শৈলী সব কিছুই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে ।

আমার মতে, ব্যক্তি লেখক তখনই আলাদা হয়ে উঠেন যখন পূর্বসব লেখার প্রভাব-টভাব ছাপিয়ে নিজের স্বতন্ত্র সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ ঘটান তাঁর লেখনীতে ।

লেখার ক্ষেত্রে আমি পাঠককে কুষ্ঠ কাঠিন্য শব্দের প্রয়োগ কিংবা ঘোরানো পেঁচানো ঘটনার অন্দরে ঠেলে অগ্নি পরীক্ষা দেওয়াতে রাজি নই কোনভাবেই । লেখা হবে প্রাঞ্জল, সহজ-সরল, বোধগম্য এবং অবশ্যই হবে মাদকতায় ভরপুর । কিন্তু হ্যাঁ, লেখায় শব্দের কারুকাজ থাকবে, বুননের শৈল্পিক ছোঁয়া থাকবে । তবে গল্প বা উপন্যাসের শুরুটা এমন হবে যেন পাঠকে শেষ লাইন পর্যন্ত নিয়ে যায় এক টানে । ঐ যে মাদকতা !

দুপুর মিত্র: নিজের কোন কাজটির জন্য খুব তৃপ্ত বোধ করেন?

মুস্তাইন সুজাত: জীবনে অতৃপ্তি খুব একটা নেই বলেই আমি সদাতৃপ্ত সব কাজে । লেখালেখির ক্ষেত্রে, কোন একটা গল্প যখন কারো কাছ থেকে প্রশংসিত হয় ভালোলাগে । এক ধরনের পরম তৃপ্ততা বলা যায় একে, যা সামনে এগোতে অনুপ্রাণিত করে ।

দুপুর মিত্র: আপনি কি বিশেষ কোনও পাঠককে সামনে রেখে লিখেন না বিশেষ অডিয়েন্সকে?

মুস্তাইন সুজাত: আমি আমাকেই ধারণ করে লেখি কিংবা লেখার চেষ্টা করি । তবে অবশ্যই পাঠক একটা বড় ফ্যাক্ট । যত যে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত কিন্তু পাঠকের কাছেই ফিরতে হয় লেখককে। আমার কাছে ‘বিশেষ কোন’ বলতে কিছু নেই, পাঠকসকলই সামনে, পাঠকসকলই আমার অডিয়েন্স ।

দুপুর মিত্র: সাহিত্যের কি সামাজিক বাধ্যবাধকতা আছে? এ নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

মুস্তাইন সুজাত: আপনার প্রশ্নটাকে আমি একটু অন্যভাবে দেখবো প্রথমে । ঠিক বাধ্যবাধকতা নয় দায়বদ্ধতা শব্দটা বসিয়ে নিতে চাই সেক্ষেত্রে । প্রতিটা মানুষেরই সমাজের প্রতি অলিখিত দায়বদ্ধতা থাকে । আর সাহিত্য তো সমাজেরই প্রতিরূপ, তাই’না ? বিশেষ করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা যা দেখি, অনেক সার্থক গল্প-উপন্যাস কিন্তু সমাজকে আবর্তেই সৃষ্টি । এক কালোত্তীর্ণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝির’ দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়, ধীবর সমাজের নিত্যদিনের অদ্ভুত চিত্রায়ন । সম্মোহিতের মত পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক অচ্যুত সমাজে; পাঠক ভাবেন, হায় এমনও বিচিত্র মানুষের জীবন হয় ?

সদা বিরাজিত জীর্ণতা-ক্লেশ, একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার কিংবা বাঁচতে না পারার যে তীব্র হাহাকার তা কিন্তু সব সমাজেই দেখা যায়, অবশ্য সুক্ষ্ম নিরীক্ষণে । আমাদের ধীবর, নিম্ন কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামীন সমজের দৈনন্দিন টানাপূরণ যেসব পাঠকদের অদেখা, এমনকি ভাবনার বাইরে, তাদের সামনে এর সঠিক রুপায়ন লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরাটাও কিন্তু এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই ।

তবে সাহিত্যচর্চার মত সৃজনশীল ক্ষেত্রটা সামাজিক বাধ্যবাধকতা মুক্ত থাকাই ভালো ।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখার কক্ষ নিয়ে কিছু বলুন?

মুস্তাইন সুজাত: এখনো একাডেমিক পড়ালেখা নামক আজব ট্রেনে চেপেই ছুটছি । শুধু স্টেশনে স্টেশনে যাত্রা বিরতি ক্ষণিকের । সেই ২০০৩ থেকে দেশের বাইরে বাইরে, তাও এই একাডেমিক পড়ালেখার খাতিরেই ।

বেশিরভাগ সময় আমার ল্যাবে কাটে, তখন ল্যাবই বনে যায় লেখার কক্ষ । চারপাশের সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত আর আমি ব্যস্ত লেখালেখিতে, হর হামেশাই এরকম হয় । এই যে আপনার সাথে চলছে আমার আলাপন, তাও কিন্তু ল্যাবে বসেই ।

দুপুর মিত্র: আপনি কি বেশি পড়া পছন্দ করেন?

মুস্তাইন সুজাত: পড়াশুনার বিকল্পতো কেবল পড়াশুনাই । পড়াশোনার উদ্দেশ্য যদি জীবনবোধ থেকে শেখা হয়, তবে পড়াশুনা শব্দটা আমার কাছে কেবল বইপত্রে সীমাবদ্ধ নয় । মানুষের সাথে মেলামেশা, তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু গ্রহন করে নিজের মধ্যে সংক্রমণ এবং ধারন-সবই পড়াশোনার অংশ । তবে বইপত্র বেশি পড়া অপছন্দের নয় । পড়তে ভালো লাগে আমার ।

দুপুর মিত্র: আপনি কি গল্প খুব দ্রুত শেষ করতে পছন্দ করেন?

মুস্তাইন সুজাত: আসলে সময়ের হিসেবে তো কোন গল্প লেখা হয়ে উঠে না, তবে এক বসায় শুরু-শেষ এরকমটা হয় প্রায়ই ।

দুপুর মিত্র: উপন্যাস লিখতে আপনি সাধারণত কতটুকু সময় নেন?

মুস্তাইন সুজাত: এখনো শেষ দিতে পারি নি কোন উপন্যাসের । তাই সময়ের হিসাব নিরূপণ দুঃসাধ্য এখুনি ।

আপনি সাধারণত কোনও গল্প বা উপন্যাসের কিভাবে শুরু করতে জোর দেন? চরিত্র না বাক্যকে? না কোনও ডায়ালগকে?

কোন গল্পে চরিত্রের রূপায়ন, আবার কোন গল্পে একটা সামগ্রিক আইডিয়া মুখ্য হয়ে উঠে । বাক্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে।বাক্যের গঠনশৈলী, নির্মাণকলা, সঠিক শব্দের প্রয়োগে চরিত্র কিংবা বিষয় ভিন্ন মাত্রা পায়। কোন কোন গল্পে ডায়ালগ মুখ্য হয়ে উঠে, তা চরিত্রের খাতিরেই। মূলত চরিত্র কিংবা আইডিয়া যাই হোক- তাতে মিশে যেতে হয় একাকার হয়ে । তবেই কিছুর সৃষ্টি ।

লেখে ফেলার পর কি আপনার কখনও এমন হয়েছে যে পুরো লেখাই মানে গল্প বা উপন্যাসকে আপনাকে নতুন করে লিখতে হয়েছে?

এরকমটা হয় নি এখনো। রিসার্চের ক্ষেত্রে আমাদের একটা টার্ম আছে টিউন করে ‘বাঁক নেয়া’ বলে। গল্প লিখতে গিয়েও মাঝে মাঝে এটা আমি অনুধাবন করি। আগে লেখা একটা গল্প যখন দ্বিতীয়-তৃতীয়বার দেখি, প্রতিবারই কিছুটা পরিবর্তন-পরিবর্ধন আসে। শেষটায় দেখা গেল অন্য একটা বাঁকে মোড় নিয়েছে সমাপ্তি। আমি গল্পকে ঘষামাজা করি, কাটাছেড়া করি যতক্ষণ না আরও বেশি পোক্ত হয় ভালোলাগায়।

দুপুর মিত্র: লেখার আগে আপনি কি সমাপ্তি ঠিক করে রাখেন?

মুস্তাইন সুজাত: আমি কেবল মূল চরিত্র, বিষয় কিংবা ঘটনাকে প্রাধান্য দেই লেখার শুরুতে । সঠিক চিত্রায়নে লিখতে লিখতেই একটা সমাপ্তিতে পৌঁছে যায় গল্প। আমি নই গল্পই আমাকে নিয়ে যায় সমাপ্তিতে ।

দুপুর মিত্র: লেখালেখিকে কি সংগ্রাম মনে হয় আপনার?

মুস্তাইন সুজাত: সংগ্রাম শব্দটা শুনলেই কেন যেন আমি বুবু’র (দাদী) মুখে শোনা একাত্তরের কাহিনীতে ঢুকে যাই। বুবু সংগ্রাম বলতেন একাত্তরের যুদ্ধকে । সব কিছু খুইয়ে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার যে শেষ প্রচেষ্টা, নিজেকে রক্ষার যে শেষ আস্ফালন কিংবা অস্তিত্বের উপর বার বার আঘাত-বুবুর কথায় সংগ্রাম সেই । লেখালেখির ক্ষেত্রটাও কি এরকম কিছু ?

দুপুর মিত্র: লেখার পর আপনি সাধারণত কোন বন্ধুর সাথে শেয়ার করেন?

মুস্তাইন সুজাত: তা করি বৈকি । আমার খুব কাছের দু’একজনকে দেখাই । মন্তব্যও আসে বিরূপ । মেনে নেই । অনেক সময় লেখা গল্পের নামকরণ নিয়েও তাদের মতামতকে প্রাধান্য দেই । আমি বিশ্বাস করি, একজন পাঠকই সবচেয়ে বড় সমালোচক ।

অলস দুপুর এবং আপনাকে ধন্যবাদ ।