রাইসুর লেখাগুলো 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী' হয়ে যাচ্ছে: কবি সুশান্ত করের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 11, 2012 6:04:39 AM

সুশান্ত কর। কবি ও গদ্য লেখক। প্রকাশিত বই: সুশান্ত করের কবিতা-১৯৮৬।

    

দুপুর মিত্র: প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে কলকাতায় সাহিত্য কি সত্যি প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়ে উঠতে পেরেছে?

সুশান্ত কর:  'কলকাতা' নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। এতো আজ নয়, মমতা একে লন্ডন করে তুলতে চাইছেন। বিলেতিরা এই নগরের নির্মাণে আর যেসব দেশি-বিদেশি সভ্যতার অবদান ছিল, সেগুলো ভুলিয়ে দিয়ে কেবল নিজেদের কথাই মনে রেখেছিল, এবং আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছিল। সেটি এরকম যে লন্ডন-আর কলকাতার মাঝে যেন নেই কোনও বন্দর। আমাদের ভাষাতে বিলেত বলে একটা কথা আছে, কিন্তু অবচেতনে বিলেত মানে কিন্তু কেবলই লন্ডন। তেমনি আমাদের অবচেতনে 'কলকাতা'র নির্মাণ এমনভাবে করা হলো, যেন এর বাইরে আর বাংলা নেই। অনেকেই সেই বাংলার সন্ধান করে চলেছেন,শুরু থেকেই এটা ছিল। এখনো আছে। কিন্তু এটা সবার কাজকর্ম নিয়ে বলা যাবে না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, কলকাতা একদিন তারাশঙ্করের কাজ কর্মকেও আঞ্চলিক সাহিত্য বলত। কারণ বিলেতিরা লন্ডনের বাইরের বিশেষ করে আইরিশ স্কটিশ সাহিত্য সম্পর্কে এমনটাই বলত। যেদিন, 'কলকাতার সাহিত্য' বলে বাংলাতে আলাদা কোনও শব্দ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে না, সেদিন বলতে পারব কাজটা সারা হয়েছে।

দু: তাহলে কলকাতার সাহিত্য এই শব্দটি একটি বিশেষ সাহিত্যকে নির্দেশ করে , যার সাথে আপনার দ্বিমত আছে। কেন এই দ্বিমত, আর সেই সাহিত্যের চরিত্রটাই বা কেমন ?

সু: জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে দেশ, আনন্দবাজার যা করে। বাজারের চাহিদা মনে রেখে সাহিত্য নির্মাণের ফরমায়েশি কারিগর তৈরি করে।

        এবারে , অমন বাজারের সাহিত্য তো সব ভাষাতেই সত্য। আমাদের দেশে রেলে চরলে আপনি যেকোনো ষ্টেশনে হিন্দিতে খুব রঙ চঙে সাজানো প্রচ্ছদের মোটা আকারের উপন্যাসের গিজ গিজ করতে দেখবেন। অন্য ভাষাতেও দেখা যাবে, কিন্তু হিন্দিতে প্রচুর। এগুলোর নির্মাণ পদ্ধতি আপনাকে হাসাবার পক্ষে যথেষ্ট । ঐ তৃতীয় শ্রেণির সিনেমার থেকে এগুলো আলাদা নয়। আগে থেকে ঠিক হয়ে যায়, ক'টা চুম্বন, ক'টা খুন থাকবে ইত্যাদি। বাংলাসাহিত্যে বটতলার বিরুদ্ধেও ওই একই অভিযোগ ছিল। কিন্তু দেশ আনন্দ বাজারের ব্যাপারটি কিন্তু অনন্য।

        আমার জানা নেই, এমন ব্যাপার ভারতের আর কোনও ভাষাতে আছে কিনা। ওরাও, ওই একই ব্যাপার করে, কিন্তু মধ্যবিত্ত বনেদীদের কথা মাথাতে রেখে। তাতে মাঝেমধ্যে বিপ্লব-টিপ্লবের টক-ঝালও মেশানো থাকে। কিন্তু এগুলো সাহিত্যের নিষ্ঠা থেকে উঠে আসে না, আসে সম্পাদকীয় দপ্তরের ফরমায়েশ অনুযায়ী। আমি নামোল্লেখ করব না, এমন লেখককেও, জানি, যিনি দেশে লিখবার আগে তাঁর রুচি, শৈলী যা ছিল, দেশের প্রথম প্রকাশেই দেখলাম--একেবারেই প্যাকেজ উপস্থাপন। সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো। বাংলাটাও অতি অবশ্যই হতে হবে বনেদি কলকাতার লোকে যেমন কথা বলে এবং সেক্সি। সম্প্রতি তো এক লেখিকা দেখলাম, সেক্সি শব্দটা যে আমরা সহজে নিতা পারি না এও বুঝি, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক উন্নাসিকতা। তা বেশ, সেই একই দেশের লেখিকা, বাণী বসু, সম্প্রতি বললেন, বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর ভালো লাগে না। কেননা এ ভাষাতে প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দ। এবং 'পানি' 'বাসা'র মতো প্রচুর অচেনা শব্দে অর্থোদ্ধারে অসুবিধে হয়। এই ভদ্রমহিলা, শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের পূর্বোত্তরকেও জানেন না। এগুলো ব্রাত্য। সেই কবেকার বুড়ূচণ্ডীদাসে 'পানি' শব্দটি রয়েছে। তিনি সেগুলোও জানেন কিনা সন্দেহ। এগুলোও পরিত্যাজ্য। 'বরণীয়' সুসংস্কৃত শব্দটি হচ্ছে 'সেক্সি'। আমার অবশ্য সেক্সিতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু 'চেনা' (মূত্র)তেও সমান আদরের দাবি। বাকি 'দেশে'র কথা জানেন সবাই। কিন্তু যেটি জানেন না, ভারতে যেমন 'কলকাতা'র মতো শহর নেই, তেমনি 'দেশে'র মতো কাগজ নেই। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

দু: এরকম একটি জায়গায় আপনাদের ভূমিকাটা কি বা এখনও কোন ধরণের লড়াইকে সামনে নিয়ে আসছেন?

সু: একটি ভাষার এমন একটি সবার থেকে আলাদা মর্যাদার গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হয়ে ওঠার কোনও বিদেশি বা বিলেতি ঐতিহ্য আছে কিনা, আমার জানা নেই। কিন্তু, আপনি যদি হিন্দিতে দেখেন তবে পাবেন না, অসমিয়াতেও না। একেতো শিল্প বা সাহিত্য করতে হলে আপনাকে কলকাতার লোক হতে হবে এমন কোনও ধারণা নেই। আপনি তিনসুকিয়ার লোক হয়েও হিন্দির বা নেপালির বা অসমিয়ার লেখক হতে পারেন, আপনাকে লক্ষ্ণৌ বা দার্জিলিং বা গুয়াহাটির লোক হতে হবে না। তার উপর অমন একটি কাগজ পুরো মেধার জগতে আধিপত্য করে না। সুতরাং আপনি 'দেশে'র বাইরেও 'দেশ' পাবেন। 'দেশে'র মতো হয়ে উঠার দৌঁড় পাবেন, কলকাতার মতো হয়ে উঠার দৌঁড় পাবেন। আমি যার জন্যে কলকাতাকে প্রতিষ্ঠান বললাম, খুব সংক্ষেপে ধারণা দিতে সাম্প্রতিক অনুষ্টূপের একটি ছোট সম্পাদকীয় তথ্য দিই। তাতে অসমের ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বলা হয়েছে , ১৯৬১তে ১৯শে মে হাইলাকান্দিতে ১১ জন শহীদ হন। ৫০ বছর পরেও, এরা এই তথ্য দিতে পারেন না, যে ঘটনাটি শিলচরে হয়েছিল। আর ১১ জুন হাইলাকান্দিতে যারা মারা গিয়েছিলেন দাঙ্গাতে, তারা আন্দোলনটির বিরোধিতা করতে গিয়েছিলেন। অনুষ্টুপের মতো কাগজ নিশ্চয়ই দেশের বিরোধী শিবির। কর্পোরেট বাণিজ্যের বিরোধিতা করে। কিন্তু জনতার কাগজ হয়ে উঠতে পারে কি? ৪০০টাকা দিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত বেকার ছেলেটি নিশ্চয় অনুষ্টুপ কিনে পড়তে হয়। তখন সে ব্যর্থ হয়, কাগজটি বৌদ্ধিক-বনেদীদের কাগজ হয়েই থাকে। কিন্তু সেই 'কলকাতা' প্রাতিষ্ঠানিকতার টানে, আমাদের পূর্বোত্তরের অনেক প্রতিষ্ঠানবিরোধীর কাছে অনুষ্টুপ এক অনুকরণীয় কাগজ। আমাদের ওদের মতো হতে হবে--দেশ কিম্বা অনুষ্টুপ। এতে বাকি বাংলার বৌদ্ধিক স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। তার আরও প্রচুর আর্থ-রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। সেগুলো আপাতত থাক। লড়াইটা নিয়ে লিখছি।

        কলকাতাতেই অনেকেই কলকাতাকে মৃত নগরী ভেবে মানসিক প্রবাস নিয়ে রেখেছেন আমি জানি। সাম্প্রতিক কালের উত্তরাধুনিকেরা (অমিতাভগুপ্তরা দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা আধুনিকোত্তরবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে এই নামে এক আন্দোলন চালাচ্ছেন।) তাই করছেন। এর আগেও বা এর পাশেও সেরকম উদ্যোগ প্রচুর হয়েছে। হাংরি ছিল, মার্ক্সবাদীরা বিশেষ করে নকশাল ধারার লোকেরা রয়েছেন। অনেকেই আমার নিজেরও ব্যক্তিগত বন্ধু। এই সমস্ত আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব আমাদের পূর্বোত্তরে চিরদিন পড়েছিল। এখনো পড়ে। কলকাতা প্রতিষ্ঠানটিতো এখানেও তাঁর সমস্ত ধরণের প্রবণতা নিয়ে সক্রিয়। আমাদের মেধা এবং চিন্তাকে শাসন করে। হয় আপনি, 'দেশে'র লেখক হোন, তবে বিশাল প্রশ্নাতীত ভাবে দারুণ লেখক, নতুবা 'অনুষ্টুপ', 'অমৃতলোকে'র লেখক হোন, নিদেন পক্ষে এদের মতো হোন। ওদের মতো ভাবুন, ওদের মতো কাজ করুন। 'দেশে'র আশীর্বাদ গুটি কয় লেখকের শিরেই পড়েছে, এদের বাজার হয় নি, তাই তারা আমাদের বাজারের লেখক নন, নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হয়েছে। অবাণিজ্যিক সাময়িক কাগজ তাদেরকেও করতে হয়েছে, লিখতে হয়েছে-সেগুলোর প্রচারও অনুষ্টুপ বা কৃত্তিবাসের মতো হয় নি। ষাটের দশকে কৃত্তিবাস পুরস্কার প্রাপক কবি শান্তনু ঘোষ যখন পরে লেখাই ছেড়ে দেন তখন বুঝি, আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন। কলকাতার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার তত্বও আমাদের খুব কাজ দেয় নি। এটা আমার চিন্তা। কেন বলি।

     এই যেমন ধরুন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস 'হবিগঞ্জের জ্বালালি কইতর...ডানা ভেঙ্গে পড়লেন গিয়ে কইলকাত্তার উপর"---এই গানের কলিতেই আমাদের আর্তনাদ সবচে' ভালো প্রকাশ পেয়েছে। কেন?

        তারতো তেমন হবার কথা ছিল না! ইনি কেবল গায়ক সুরকার ছিলেন না। অত্যন্ত উঁচুদরের কবি এবং গদ্য লেখকও ছিলেন। বাংলা অসমিয়া দুই ভাষাতেই লিখেছেন। অসমিয়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদ, বিষ্ণু রাভা, ফণি শর্মাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। ভূপেন হাজারিকার তিনি অন্যতম ভাবগুরু। এটা অসমিয়ারাই এখনো বলেন। অসমিয়ারাও এবারে তাঁর জন্ম শতবর্ষ পালন করছেন। তাঁকে কইলকাত্তার উপর গিয়ে পড়তে হয় কেন?

        কারণ, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ততটাই ধরতে পেরেছিলেন, যতটা তাঁর তখনকার রাজনৈতিক বোধ ধরতে দিয়েছিল। শুধু তাঁর নয়, তাঁর সমস্ত সহকর্মীরা (প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষ) যতটা ভাবতে পেরেছিলেন। সে ভাবনাগুলো উপর থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। আমার এক সাম্প্রতিক লেখাতে আমি একটি বাক্য ব্যবহার করেছি এরকম,"ওদের যদি বিলেত আছে, আমাদের তবে সোভিয়েত'"--ব্যক্তিগত ভাবে হেমাঙ্গ অসম তথা পূর্বোত্তরকে পরদেশ বলে ভাবতে পারেন নি। তাঁর বাল্যের সিলেট অসমেরই জেলা ছিল। তাঁর মতো, যারাই তখন শিল্প সাহিত্য করছিলেন রাজনীতির ভেতরে বা বাইরে তাদের রচনার একটি সাধারণ গুণ ছিল এই যে এগুলো পূর্বোত্তরের সাহিত্য বলে চেনা যেত। অশোক বিজয় রাহা, শুরুতে তাঁর সহকর্মী হলেও বেশিদিন ছিলেন না। রাহার কবিতাগুলো পড়ুন। কিম্বা সুরেশ চক্রবর্তীর উপন্যাস নারীশক্তির কথা আমার মনে পড়ছে। হেমাঙ্গ আজীবন পূর্বোত্তরের মাটিতে তাঁর শিল্পের রসদ সন্ধান করেছেন। অসমিয়া ভাষাটাও ভালোই রপ্ত করেছিলেন। আচ্ছা, আমি কি বেশি বকছি?

দু: দাদা আজ আমাকে উঠতে হচ্ছে। কিছু প্রশ্ন করে রাখছি। ১.সুবিধা বা খ্যাতি প্রাপ্তির আশায় খ্যাতি পাওয়া এক বিষয়, আর লেখালেখি করে কলকাতার সাহিত্য বলে আমার মোটা দাগে যা চিনি , তা নাড়িয়ে দেওয়া আরেক বিষয়। সেটা করা হয়ে উঠেছি কি ? হলে সেটা কেমন? ২. বাংলাদেশের কবিতাতেও কি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জায়গাটা খুঁজে পান। বা পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের কবিতার কি ধরণের ফারাক তৈরি হয়েছে, হলে সেটা কি প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে না ভৌগোলিক কারণেই। ৩. আপনাকে যদি বলা হয় প্রতিষ্ঠান বিরোধী কবিতা বা সাহিত্য কোনগুলো , তাহলে আপনি কোন বৈশিষ্ট্যগুলো সামনে আনবেন?

সু: কিন্তু তাঁর রাজনীতি ঐ 'ভাই-ভাই' তত্ত্বের বাইরে বেরুতে পারে নি। সামাজিক পরিচিতিগুলোর যে বৈচিত্র্যকে নিয়ে তাঁর আজীবনের কাজ ছিল, তাঁর দ্বন্দ্ব-জটিলতাগুলোকে তাঁর দলীয় রাজনীতি তখন সঠিকভাবে সমাধান করতে পারেনি। ষাটের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি এবং ভূপেন হাজারিকা যে হারাধন রংমনের গান গেয়ে গোটা অসমে ভাষাউগ্রজাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইটা লড়লেন। সেই মাটির সমস্যাকে মোকাবিলা করে নি। তাই দেখা গেল আশিতে তিনি কলকাতা থেকে একই উদ্যোগ নিতে ছুটে আসছেন, কিন্তু ভূপেন আসছেন না। তাঁর তখন শিবির বদল হয়েছে। মজা হলো, দু'জনেই তখন কলকাতা প্রবাসী। এবং ভূপেন যে কলকাতা প্রবাসী হলেন তাঁর পেছনেও কিন্তু শুরুতে হেমাঙ্গের অনুপ্রেরণা ছিল। পরে দেখা গেল হেমাঙ্গ কলকাতাতেই থেকে গেলেন, ভূপেন মুম্বাই অব্দি চলে গেলেন। এগুলো কি কোন ইঙ্গিত দেয় না? ঠিক আছে, আপনি উঠুন... আমি লিখে রাখছি।

  

        'কলকাতার সাহিত্য' ধারণাটি আছে আমাদের অবচেতনে, অনেকেই এর অস্তিত্বে প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না। এ বোধহয়, বাংলাদেশের জনপ্রিয় শব্দ। কারণ ওদেশেও 'এপার' বললে কলকাতা -এমন একটা ধারণা আছে। বাকি আঠারো জেলা বা ত্রিপুরা বা পূর্বোত্তরের কথাটা অনেকেই মনে রাখেন না। কিন্তু পূর্বোত্তরতো আমাদের কাছে এক জীবন্ত বাস্তবতা। তাই আমাদের বয়ানে বলবার সময়, 'বাংলা সাহিত্য'ই প্রচলিত শব্দ। যদিও অবচেতনে সবাই জানে তার অর্থ, কলকাতার সাহিত্য,ওখানে স্বীকৃত সাহিত্য। ধরুন কাউকে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলা সাহিত্যের কিছু কবি লেখকদের নাম নিতে বহু নিবিষ্ট পাঠকদেরও বলুন, আমি নিশ্চিত তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দিয়েই শুরু করুন কিম্বা ভগীরথ মিশ্র দিয়ে শেষ অব্দি আমাদের কারও নাম তেমন নেবেন না। অথচ, অশোক বিজয় রাহা, মৃণাল কান্তি দাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা সাম্প্রতিক শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, পিযুষ রাউত, বিজিৎ ভট্টাচার্য, মলয় কান্তি দে, দেবীপ্রসাদ সিংহ, দেবব্রত দেব, দেবাশিস তরফদার, প্রবুদ্ধ সুন্দর কর, অমিতাভ দেব চৌধুরী, স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্যদের নাম নেবেন না। নিশ্চয়ই সাহিত্যের নিবিষ্ট লেখক পাঠকের অনেকে এদের চেনেন, এদের সঙ্গে কাজ করেন। সে কেবল পশ্চিম বাংলা নয়, বাংলাদেশেও। কিন্তু এরা কেউ সেই অর্থে নাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানি না, এরা সেরকম কিছু উদ্যোগও নেন নি। হ্যাঁ, যদি নাড়িয়ে দেবার কথা বলেন তবে সম্প্রতি রণজিৎ দাশের নাম নেওয়া যেতে পারে, কিম্বা তপোধীর ভট্টাচার্য, কিম্বা বিকাশ সরকারের নামও নেওয়া যেতে পারে। সব্বাই ভালো লেখক। কিন্তু সেগুলো কতটা সাহিত্যের জোরে, আর কতটা অন্যান্য উদ্যোগের জন্যে; সেটি এখনো বিচার করবার সময় হয় নি। একটা সময় কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা অশোক বিজয় রাহাও নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রণজিৎ যদিও মূলত ছোট কাগজের লেখক দীর্ঘ তিনদশক ধরে কলকাতা প্রবাসী, অনেকে জানেনও না, তিনি মূলত শিলচরের লোক। তপোধীর পশ্চিম বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন। প্রচুর গদ্য লিখেছেন এবং উত্তরাধুনিকতার তাত্ত্বিক ভিত্তির তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই সেদিনও গেল নভেম্বরে আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখেছি তপোধীর যে কবিতাও লেখেন জেনে বহু বাংলার অধ্যাপক অবাক হয়ে গেছেন। অথচ, আমাদের কাছে তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি কবি। বিকাশ সরকার 'দেশ'কাগজের নিয়মিত লেখক সম্প্রতি যদিও তাঁর উঠে আসা উত্তর বাংলা এবং অসমেরই ছোট কাগজ এবং দৈনিকগুলোতে লিখে ।

        আমার কাছে তাই মনে হয়, কলকাতাতো আমাদের হবে না, সংগত কারণেই এটা হবে না। যদিও, অনেকে মনে করেন, ভালো লিখলে সাহিত্যে জায়গা পাওয়া কঠিন কিছু না--সে যে জায়গারই হোন। কিন্তু বাংলার অধ্যাপক হিসেবে আমি যখন দেখি আমাদের কোনও লেখকের লেখা পড়াতে পাই না, প্রাসঙ্গিক উল্লেখও করা অসম্ভব হয়ে পড়ে আমার কাছে এই বাস্তবতা অসহ্য ঠেকে। এটি আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তাঁর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কেমন হতো, যদি বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য বলে কোনও কিছু কোনোদিনই পড়তে পেত না আপনাদের দেশের ছাত্ররা? তাই, আমার কাছে প্রতিষ্ঠানের ধারণাটি অন্যরকম। কলকাতার বন্ধুরা যেমন করেন সেরকম হবে না। আমাদের কেবল কিছু বিজ্ঞাপন শূন্য সাময়িক কাগজ নির্ভর সাহিত্য করলে চলবে না। দৈনিক কাগজ থেকে শুরু করে আমাদের নিজস্ব সমস্ত বৌদ্ধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে--এগুলো ছাড়া আমরা দেশ কাগজের বিরুদ্ধে অভিমান জানাতে পারি, কিন্তু তার বাজারকেও ঠেকাতে পারিনা, না পারি, 'নগর কলকাতা' সম্পর্কে মোহটাকে প্রতিহত করতে। এই নিয়ে আমার এক সাম্প্রতিক লেখা এখানে পড়তে পারেনঃhttp://sushantakar40.blogspot.in/2012/04/blog-post_22.html

সুশান্ত....Sushanta....: ।। ছোট কাগজের পূর্বোত্তর এবং দুটো মাটির ঘড়ার গল্প ।।sushantakar40.blogspot.com

রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছেন,আমারও এই দীক্ষাঃ স্বাজাত্যের অহমিকার থেকে মুক্তি দানের শিক্ষাই আজকের দিনের প্রধান শিক্ষা !

        বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে আমার কথা বলবার অধিকার তেমন নেই। আমি যেখানে থাকি সেখানে থেকে কলকাতার ভালো সাহিত্য মেলাই দুষ্কর, আর বাংলাদেশের সাহিত্য তো দূর অস্ত। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে বাংলাদেশের সাহিত্য আসেও না তেমন। আমার মূল নিবাস শিলচর সেখানে, আজকাল মেলে কিছু কিছু। কিন্তু সে শহরে আমার আজকাল যাতায়াত কম। কিন্তু আন্তর্জাল, আমার মতে সাহিত্যের চেহারা পালটে দিতে যাচ্ছে। এই যে কলকাতা কেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার এক উলম্ব চেহারা এর সঙ্গে মুদ্রাযন্ত্রের এবং প্রকাশনা বাণিজ্যের একটি স্বার্থ আছে। এটি আমাদের ভাষাকেও নিয়ন্ত্রিত করেছে। এই যেমন ধরুন, মান ভাষা উপভাষার তর্ক -এগুলো তো এর আগে ছিল না। এর পরেও থাকবে না। কারণ এখন আন্তর্জালে লোকে উপভাষাতে আড্ডা দিচ্ছে, বানান শুদ্ধি নিয়েও ভাবছে না, লিপি ঐক্য নিয়েও না। ইতিহাস স্মরণ করুন, পুঁথির যুগে আমাদের অভিধান,ব্যাকরণ ছিল না। পাঁচ ছ'টি লিপি ছিল। কপিরাইটের কোনও বালাই ছিল না। এগুলো সবই ছাপা বইয়ের যুগের ধারণা। আন্তর্জাল এগুলোকে আবার প্রত্যাহ্বানের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এবং আপনার সঙ্গে আমার আলাপ কিম্বা যোগাযোগকেও অত্যন্ত সহজ করে দিচ্ছে। এখন সাহিত্যের ভূগোল তার আনুভূমিক চেহারাতে ফিরে যাচ্ছে। এই যুগে বাংলাদেশের সাহিত্য একেবারে কিছু জানি না বলবার উপায় নেই। যেটি দেখি, ওখানেও এখনো ঐ কলকাতার মতোন হয়ে উঠবার প্রবণতা আছে। আমি, এমন মুসলমান কবিকে জানি যিনি তাঁর লেখাতে আর্বি-ফারসি শব্দ প্রায় ব্যবহার করেনই না, ইসলামী অনুষঙ্গও প্রায়ই বাদ দেন, অথচ লক্ষ্মী,শ্মশান ইত্যাদি প্রায় থাকেই। অবশ্যই এটি মূল প্রবণতা নাও হতে পারে, কিন্তু তসলিমার প্রবণতাকে কী বলব। সেতো এক দু'জন নন। কলকাতাতে স্বীকৃত হবার মোহ, এবং না হতে পারবার আক্ষেপ আছে অনেকের। কিন্তু বিপরীত ধারাও আছে। যেমন অনেকেই ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটা মান ভাষা দাঁড় করিয়ে তাতে সাহিত্য করবার কথা বলছেন, বা করছেন। আপনাদের দেশের ভাষাশুদ্ধি নিয়ে সাম্প্রতিক সরকারি নির্দেশকে এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। আমাদের অসমেও কেউ কেউ সিলেটি কাগজ করতে চাইলে জোর করে বন্ধ করিয়ে দেবার বেসরকারি উদ্যোগও দেখা গেছে। কিন্তু আমি কি সত্যি প্রতিষ্ঠান বিরোধী সাহিত্য বলে কিছু চিহ্নিত করতে চাই? প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লড়াইটা আমার মতে সাহিত্য অতিরিক্ত লড়াই। তাই, দেখবেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী যে কোনও তাত্ত্বিক অবস্থানের লেখককে তাঁর তাত্ত্বিক চিন্তার জন্যে আপনার পছন্দ না হলেও লেখক হিসেবে আপনি তাঁকে অস্বীকার করতে পারছেন না। রবীন্দ্রনাথকে তাই উড়িয়ে দেওয়া গেল না। চেষ্টা হয়েছিল। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সামাজিক অবস্থান এক ছিল না। এক ছিলনা , বুদ্ধদেব বসু আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবস্থান। আপনি কি কাউকে কবি হিসেবে নাকচ করতে পারছেন? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে আপনি কাকে ধরবেন আর কাকে ছাড়বেন? সেরকম কিছু সম্ভব? যে সাহিত্য সাহিত্যের জন্যে-তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী। দেশ কাগজে বেরুলেও প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সে বাণিজ্যকে মুখ্য করে না, না করে যৌনতা কিম্বা দারিদ্র্যকে না কোনও তত্ত্বপ্রস্থানকে সে একাধারে আঞ্চলিক এবং বিশ্বজনীন। সে নকল করে কিছুই হয় না, না আঞ্চলিক না বিশ্বজনীন। কিন্তু তাঁর সত্ত্বার যে দ্বান্দ্বিক চেহারা তাকে সে সাহিত্য বহির্ভূত কোনও কারণেই গোপন করে না। সেরকম লেখক কলকাতাতেও লিখতে পারেন, পারেন হবিগঞ্জেও কিম্বা করিমগঞ্জেও লিখতে পারেন। লিখতে পারেন না--এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠানের, তাঁর বাণিজ্যিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সে এই ধারণাটিকে শক্ত করে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লড়াইটা তারই জন্যে। আমার নিজেরতো মনে হয়, আপনারাও সেরকমই কিছু কাজ করছেন।

 লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আপনাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে একটা লেখাও পেয়ে গেলাম। http://dupurmitra.wordpress.com/2011/এখানে দেখলাম,আপনারা আল মাহমুদ, ফরহাদ মজহার নিয়ে সমস্যায় পড়ে গেছেন, তাঁদের লেখা ছাপবেন কিনা। সে পুরোনো কথা, এখন কী ভাবেন জানি না। এও কিন্তু সাহিত্য অতিরিক্ত প্রাতিষ্ঠানিকতাই, বা আপনাদের মতো করে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এঁদেরকে কবি হিসেবে কি আর অস্বীকার করা যাবে? তাঁরাও তাদের মতো করে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতাই করে গেছেন। ফরহাদ মজহারেরতো আমি ব্যক্তিগত ফ্যান হয়েই গেছি নিয়মিত পড়ছি । গদ্য পদ্য দুইই। তেমনি আমি নাম করতে পারি, মাসুদ খান, মুজিব মেহেদী, সুব্রত অগাষ্টিন গোমেজ, ব্রাত্য রাইসু। এরা প্রায় প্রত্যেকে বাংলাদেশের কাব্যভাষা নির্মাণের চেষ্টা করছেন বলেই আমার মনে হয়। রাইসুর লেখাগুলো 'প্রতিষ্ঠান বিরোধী' হয়ে যাচ্ছে। মানে তাঁর প্রতিটি লেখাই মনে হয় যে উদ্দেশ্য পূর্ণ, সেগুলো কালের বিচারের অপেক্ষাতে দাঁড়াচ্ছে গিয়ে। তেমনি রওশন আরা মুক্তা ভালো লিখছেন, লিখছেন মেঘ। মেঘের কবিতাকে, বাংলাদেশের বলে আলাদা চেনা যাচ্ছে না, সেটি কতদূর স্বাস্থ্যকর হবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, অবশ্য তিনি লিখছেনও বেশিদিনের নয়।যদিও গল্পগুলোকে চেনা যায়। সরদার ফারুক পড়ছি। পড়ছি ফয়সল অভি। কামরুজ্জামানের গল্প পড়ি, ভালোই লেখেন মনে হয়। যদিও একটা কথা বলে ফেলি, আপনারা যারা কবিতা গল্প লেখেন তাদের মতো নিবিড় নয় আমার পাঠ। সুতরাং আমার মন্তব্য একেবারেই শিশুসুলভ। আমার কাজ মূলত এই প্রতিষ্ঠানের সমাজতত্ত্ব বলতে পারেন। সে কীভাবে সাহিত্য,ভাষা,বৌদ্ধিক আবহকে নিয়ন্ত্রণ করে তার তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক। সেটিও ফরহাদ মজহার যেভাবে ভাবেন তার থেকে অনেক নিম্নমানের। আমাকে ইনি ভাবান, কেননা, তিনিও বাংলাদেশের এক নিজস্ব ভাবজগতের সন্ধানে আছেন, আমিও আছি পূর্বোত্তরের সন্ধানে। তাঁর ;ভাবান্দোলন' বইটা পড়তে পাই নি এখনো এই আমার আক্ষেপ।

        কলকাতার কারো, থেকে ভাবনার ঋণ নেবার থেকে আমি বাংলাদেশের কারো থেকে নেয়াটা অত্যন্ত গৌরবের বলে ভাবব। কারণ, আমরা মূলত বাংলাদেশেরই লোক, তা আমাদের পূর্ব প্রজন্ম তিন দশক আগেই আসুন আর তিনশ বছর আগে। আমাদের নদীগুলো এখনো বাংলাদেশেরই উপর দিয়ে বয়।