"কবিতায় পরীক্ষা নিরীক্ষা কি কবিতাকে নষ্ট করে দেয় । আদৌ কি তার উপভোগ্যতা থাকে ?" অনলাইন আলোচনা। আয়োজনে ক্ষেপচুরিয়াস-অলস দুপুর অনলাইন আলোচনা প্রকল্প

Post date: Jan 26, 2013 1:44:38 PM

আলোচক: সুশান্ত কর, পীযূশ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, অত্রি ভট্টাচার্য্য, দুপুর মিত্র, ইয়াসিন ফিদা হুসেন, নবেন্দু বিকাশ রায়, মিলন চ্যাটার্জি, আব্দুল্লাহ্ জামিল, পৃথা রায়চৌধুরী,অসীম মজুমদার, অমিতাভ রক্ষিত, ও অমিতাভ প্রহারাজ।

সুশান্ত কর: পরীক্ষাতো পাশ করবার জন্যে শুধু পরীক্ষকের সামনেই দিতে হয়! তিনি উপভোগ না করলেও মার্ক একটা দিয়েই দেন। আপত্তি কিসে? ভালোই তো! কিন্তু তার পর, পরীক্ষার্থী সেটি বাকি জীবনে কাজে লাগাতে পারলেন কিনা, পাঠক টানতে পারলেন কিনা, সে অন্য ব্যাপার। তবে পরীক্ষাতে চাপানো সিলেবাস, মুখস্থ ইত্যাদি ব্যাপারও থাকে কিন্তু। এখানে কবি পুরোপুরি তিনি নন কিন্তু? তাই না? আমার যা মনে হয়।

পীযূশ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময় নতুন কিছু করার পক্ষে,করতে গিয়ে ঠিকথাক না উতরোলে ঝাড়ও খায় কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভাবনার গতিশীলতা টা বজায় থাকে। এক্সপেরিমেন্তেষণ হলেই কবিতা উপভোগ্য হবেনা,একথায় সত্যতা নেই..তবে লাগলে তুক ,না লাগলে তাক,এর মত ব্যাপার,আর কি?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: সামগ্রিকভাবে কোন কবিতাই নষ্ট নয় বলে আমি মনে করি, যদি কবিতা মানে কিছু লাইনের সমষ্টি নয় বরং এক বিরাট শিল্প - এইভাবে ধরা যায় ! আর, পরীক্ষা-নীরিক্ষা? কাকে পরীক্ষা বলে চিহ্নিত করব, কাকে নয়? এহ বাহ্য, আমি চিহ্নিত করবার কে? প্রায়-ই দেখেছি, এই ফেসবুকে অধিকাংশ লোক ভালো কবিতার নীচে লিখে দ্যান "পরীক্ষা ভালো লাগল" । এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই তথাকথিত পরীক্ষা অন্ততঃ এক বা দুই দশকের পুরনো রচনারীতি অথবা কনটেন্টের আপ্রোচ ! সুতরাং স্পষ্টতঃ - এই বক্তব্য আসছে অজ্ঞানতা থেকে । এক হিসেবে ভাবলে প্রতিটি কবিতাই পরীক্ষা - সুতরাং কবিতা নষ্ট হবে না অটুট থাকবে না সমৃদ্ধ হবে - এইটুকু বোঝবার জন্যেও পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়ে যাওয়া উচিত। এমন অনেকানেক কবিতা এখন-ও পোস্ট ক'রা যায়, যার উপরে কবির নাম ও নীচে রচনাকাল না লিখলে অবলীলাক্রমে অধিকাংশ পাঠক লিখে দেবে যে - এটি পরীক্ষা, সাম্প্রতিক পরীক্ষা । যেমন - রঞ্জন মৈত্রের এই কবিতাটি -

স্টিরিও

-------

যদি কোনদিন বাজি স্টিরিওফোনিক

মনে করো আলতো দুপুরে ফিলিপসের পরিষেবা

তোমার একলা ঘর, সমস্ত দেওয়াল থেকে না-হওয়া

ভ্রমনে সব তাকিয়ে রয়েছে, পিলুর দূরবীন মনে করো ।

যদি বাজি, যেন জ্যোৎস্নায় দৌড়ই হাতি, পিছে পিছে জনসাধারন

ভীষন নেমেই ঝর্ণা শুই শবাসনে

অসীম বরফরাজ্যে খালি গায়ে ঘুরি

দূরবীনে জল লেগে যাবে

কারন তুমি তো জানতে স্টিরিও এক গরিষ্ট ছলনা

বিশুদ্ধ জেনেছিলে রাগিনীর ব্যবহার-কাল

জানতে, যে বাজনা ছিল আর যে সব

বাজনা হবে, হতে পারে, দুই দিক ছুঁয়েছে গোধূলি

আমি সেই ছলনার নিজস্ব

স্টিরিও খুঁড়ে পেয়েছি সড়ক, আর নিংড়ে পাঠাই ডাক

হাত ধরো, দেওয়াল পৌঁছনোর আগে ফিলিপস

পৌঁছনোর আগে বেলাবেলি খালিগলা পৌঁছে যেতে চাই

অথচ রচনাকাল উল্লেখ করলে বোঝা যায় - এই কবিতা অন্ততঃ দুই দশক অথবা তার-ও পুরনো ! সুতরাং পরীক্ষা শব্দটা আপেক্ষিক ! যদিও, সুশান্তদা যে আকাদেমিক অর্থে পরীক্ষাকে নিয়েছেন - আমি তার সম্পূর্ন বিরোধী ! উনি পরীক্ষা বলতে মূল্যায়ন বুঝিয়েছেন। আমি পরীক্ষার ইংরাজী চালু প্রতিশব্দ বুঝি এখানে - Experimentation.

দুপুর মিত্র: ফর্মের পরীক্ষা চলে, স্টাইলের পরীক্ষা চলে, কোন ফর্মে কোন স্টাইলে আপনি প্রাণকে ধরে রাখবেন। যেমন লং মার্চে লাগে রণ কৌশল। আর বিপ্লবীরা এক একটি প্রাণ। সাহিত্যের বিষয় হল প্রাণ এই প্রাণকে কোন কৌশলে সামনে দাড় করাবেন তার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই পারে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: "কবিতা"র নির্মান যেকোনভাবেই এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্টের কোন ধারা যদি বেশি চর্চ্চা হয় তখন তা হয়ে ওঠে ধারা বা উপধারা। নতুন নতুন সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন বা পুরনো ধারা/উপধারায় কন্ট্রিবিউট করাটাই কবির অন্যতম স্বার্থকতা।

নবেন্দু বিকাশ রায়: তাহলে দ্যাখা যাচ্ছে সবাই more or less সহমত। আলোচনা ক'রে আর লাভ কি?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: আলোচনার জ্বালানী কি শুধুই মতান্তর নবেন্দু?

নবেন্দু বিকাশ রায়: একটা বিষয় বলতে চাই। প্রশ্নটা শুধু পরীক্ষা নিয়ে নয়। নিরীক্ষা নিয়েও বটে। এই নিরীক্ষণ কার? কবির? না সমকালীন পাঠকের?

অত্রি, নয়তো কি? সবাই একমত হয়ে পড়লে তো... boring

অত্রি ভট্টাচার্য্য: বাহ ! ভালো পয়েন্ট । আমি নীরিক্ষা অংশটার কথাও তুলব ভাবছিলাম। তো, এখানেই তো একটা মতান্তরের সূত্রপাত হয়ে গেল। তুমি সুশান্তদা-র দেওয়া "পরীক্ষা"-র কনসেপ্ট মানছ না - আমার-ই মত।

নবেন্দু বিকাশ রায়: হুঁ দ্যাখো, অনেক কবিতাই পড়ি যেগুলো পড়তে গিয়ে বারবার এই কথাটাই মনে হয় যে বেশী experiment কবিতাটার সর্বনাশ করেছে। কিন্তু এই 'বেশী'টা কে ঠিক ক'রে দেবে? সমকালীন পাঠক, অনেক্ষেত্রেই দ্যাখা গ্যাছে লেখা ও লেখকের প্রগতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। ফলে লেখককে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। আবার দ্যাখা গ্যালো সেই লেখকই এক শতক পরে বিখ্যাত হয়ে গেলেন। তাকে আভা গার্দ ইত্যাদি বলা হলো। উল্টো দিকে সমসময় ও পরে আরও popular হয়েছেন এমন মানুষও আছেন। ফলে পাঠক নিশ্চয়ই এই নিরীক্ষণের অধিকারী হতে পারেন না। হ্যাঁ, অবশ্যই তার একটা নিরীক্ষণের অধিকার থাকবেই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। Kind of a lesser right.

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: সাহিত্যে সিন্ডিকেশনের ভূমিকাকে যদি এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনি তাহলে বলা যায় এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে ধারা বা উপধারা নির্মানে সিন্ডিকেশনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের ভূমিকাই বিদ্যমান।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: আমি খুব বেশী পোয়েটিক্স বুঝি না। না দেশী, না বিদেশী ! তবু, আমার মনে হয় যে - সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এই নিরীক্ষকের একটি শ্রেনী, সুস্থ ও সাহিত্যের দিকের (মানে পাঠকের দিকের নন) শ্রেনী বোধহয় গড়ে ওঠা উচিত ছিল - যারা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা পরীক্ষার পোটেনশিয়ালসহ নিরীক্ষণ ক'রে সমসাময়িক অনুসিদ্ধান্তগুলিকে ডকুমেন্টেড করবে - যাতে, মহাসিন্ধুর ওপারে গিয়ে পুনর্মূল্যায়িত (বা প্রথমবার প্রকৃত মূল্যায়িত, বা নিরীক্ষা) হয় কোন কবিকে। সমকালেই যেন তাকে চিনে ফ্যালা যায়। এখন জীবনানন্দকে চেনার জন্য তো আগে তার আশেপাশের ইতিহাসকে জ্যান্ত করে তুলতে হবে। ওতেই তো কবিতার অর্ধেক আকাশ কমে যায় !

নবেন্দু বিকাশ রায়: ফিদা অবশ্যই, কিন্তু এখানে একটা কথা বলার আছে। সিন্ডিকেশন কিন্তু অনেক ধরণের হয়। যে সিন্ডিকেশন আসলে একটা কর্পোরেশন সে কিন্তু এক্সপেরিমেন্ট করবে তার কর্পোরেট ইন্টারেস্টের তাগিদে। সাহিত্যের তাগিদে নয়। সে টিন এজার দের জন্য কাগজ বার করবে, চটুল জোক্স্ ছাপাবে... ঠিকই তো করবে। সে তো তার বানিজ্যিক দিকটাই আগে দেখবে। নয়ত সে চলবে কি করে! কিন্তু নন-কর্পোরেট সিন্ডিকেটগুলোর এস্পেরিমেন্ট সাহিত্যের জন্যই করা হয়... বা সবসময় সেটাও নয়। সেফলি বলা যায় তাদের ইন্টারেস্ট আর যাই হোক না কেন কমার্সিয়াল নয়।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: আলোচনার সুবিধায় এখানে কমার্শিয়াল সিন্ডিকেটকে বরং বাইরে রাখি। নন-কর্পোরেট সিন্ডিকেট কবিতার এক্সপেরিমেন্ট বা নির্মাণে কি ভূমিকা রেখেছে তাই দেখবার বিষয়।

মিলন চ্যাটার্জি: কবিতা -- সমালোচনা অর্থাৎ সম আলোচনার ধার ধারে না বলেই তো মনে হয় । কবি যখন লেখেন তখন তাঁর মাথায় আফটার এফেক্ট কি হবে সে নিয়ে যদি চিন্তা খেলা করে তবে কবিতা আদৌ কবিতা হয় কি ? ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু কবিতা লেখা হয় বৈকি যাকে প্রতিকবিতা বলা যায় । কবির ভাষ্য যদি অন্য লোকে কাঁটাছেঁড়া করে তবে কবিই জানেন কেমন লাগে , যদিও কবির তাতে কিছুই আসে যায় না । কবি লেখেন তাঁর তখনকার হৃদয় ও মনন দিয়ে । আর কবির লেখা সমকালেই সঠিক মূল্যায়িত হবে সেটাও সর্বদা হয়না , সত্যি বলতে কি হয় না বললেই চলে । নিরীক্ষক থাকুন, কিন্তু সেই নিরীক্ষা হওয়া উচিৎ নিরপেক্ষতার সঙ্গে । রামের সাথে যদুর বন্ধুত্ব এই নিরীক্ষায় প্রভাব ফেলে এটাও সত্য আর সেটা কবিতার সঠিক মূল্যায়নের প্রতিবন্ধক । অধুনা কিছু কবিতায় এক্সপেরিমেন্ট বলে যাকে আমরা মনে করছি সেই লেখা আগেই হয়ে গেছে । এক্ষেত্রে রূপা দাসগুপ্ত, মহাদেববাবু, বিনয় মজুমদার, জলধি হালদার এদের কবিতা এমনকি মলয়দার লেখা পড়লেই বোঝা যায় আমরা আসলে চর্বিত চর্বণ করছি । তবে এই নিরীক্ষাকে কি যুগোপযোগী বলা উচিৎ ! একই শব্দের পুনঃপুনঃ ব্যবহার, কিছু আরোপিত তৎসম শব্দকে বিন্যাস করাই কি কবিতার নতুন ফরমেশন ? আমার তো মনে হয় না । প্রকৃত আলোচনাই বা ক'জন করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাদের কাছ থেকে আমরা জানতে চাই তারা মন্তব্য করেন দশটা কমেন্ট পরার পরে ! এটা কি গা বাঁচানো নয় ! আবার কেউ কেউ যদি আলোচনা করেনও তাহলে যদি সেটা পিঠ চুলকনো না হয় তবে দলবদ্ধভাবে রোষের শিকার হন । আলোচক গঠনমূলক আলোচনা করলেও সেটাকে মেনে চলার ক্ষেত্রেও একটা নিঃসঙ্কোচ অ্যাডাপ্টেশন দরকার যার সময় ও ঔদার্য অনেকেরই নেই । তবুও মনে হয় কবিতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা কবিতার স্বাস্থ্য'র পক্ষেই ভালো, শুধু পড়ার পরিধি বাড়াতে হবে তবেই সেই নিরীক্ষা এনে দিতে পারে নতুন আলোর দিশা । নিরীক্ষা যদি গতানুগতিক হয়ে যায়, হয়ে যায় কেবলমাত্র বিন্যাস-সমবায় তবে সেই নিরীক্ষার ঠিকানা হয় পাঠকের বিস্মৃতিতে ।

আব্দুল্লাহ্ জামিল: কবিতায় নতুনত্ব আনতে হবে। যতদূর সম্ভব বহুল ব্যবহৃত উপমা, উদাহরণ, বাক্য ইত্যাদি বরজন করতে হবে। তা না হলে সেই কবিতায় পাঠক কোনো আনন্দ পাবে না। কিন্তু তাই বলে পরীক্ষানিরীক্ষার নামে কবিতার ব্যাবচ্ছেদ যেনো না করা হয়। তাতে কবিতা ব্যথিত হবে।

পৃথা রায়চৌধুরী: কবিতার পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় - কি ধরণের নিরীক্ষা ? সেই খাড়া বডি থোড় আর থোড় বডি খাড়া ? যদি তাই হয় তবে বলতেই হচ্ছে সেই কবিতা সময় নষ্ট করে কেন পড়বো , সে তো আগেই লেখা হয়ে গেছে । আজকাল দেখি কিছু কঠিন শব্দ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েই কবিতা লেখা হচ্ছে । ভালো করে দেখলে দেখা যাচ্ছে সেই একই শব্দের বারংবার ব্যবহার করেই কবি লিখে চলেছেন । সঙ্গে কিছুটা ধোঁয়াশা মেশানো বাক্য যার ভেতর বেশীরভাগই অসমাপিকা ক্রিয়া ! যাকে ঢাকার জন্য কিছু ডট ব্যবহার করা হচ্ছে যদিও ডটের বা যতি'র ব্যবহার আরো মনোযোগ দাবী করে । এই ধরণের নিরীক্ষা কবিতা উপভোগ্যতা নিঃসন্দেহে নষ্ট করে দেয় । আবার এরই ভেতর লেখা হচ্ছে কিছু অনবদ্য কবিতা যার রেশ থেকে যাচ্ছে পড়ার বহুক্ষণ পরেও । কবিতা আদৌ কবিতা হচ্ছে কিনা সেই মূল্যায়ন তাৎক্ষণিকভাবে করা সম্ভব নয় হয়তো সেই মূল্যায়ন হবে পরে । তবে আমারও মনে হয় কবিতা লিখতে গেলে আমাদের পূর্ববর্তী কবিদের লেখার সাথে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন । তাহলেই বুঝতে পারবো আমি বা আমরা যা লিখছি সেটা আসলে নিরীক্ষা না গতানুগতিক অনুসরণ ।

অসীম মজুমদার: না তা করে না। তবে মুশকিল হয় নামি কেউ করলে গ্রহণ আর অচেনা কারও হাতে হলেই ধীক্ষার। ছি ছি এটা বাংলা কবিতার আসুক।

সুশান্ত কর: আমার পরীক্ষা শব্দটিতে সিলেবাস, মুখস্থ ইতাদি শব্দ ছিল দেখে অত্রি। বিষয়টিকে স্কুল পরীক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে ভেবে নিলেন? আমার মনে হয় আমার উপস্থাপনাতে গণ্ডগোল ছিল। হ্যা, আমি সেরকম একটা অর্থ করেছি বটে, কিন্তু যাকে বলে ল্যাবোরেটরির পরীক্ষা সেটিও আমি ভুলে থাকিনি। সেটিও কিন্তু নিরীক্ষকের অপেক্ষা রাখে। নতুন লেখা শুরু করেছেন যিনি তিনিও কিন্তু নিরন্তর এমন পরীক্ষা এবং নিরীক্ষার প্রক্রিয়াতে থাকেন। কারণ লিখতে লিখতেই তিনি ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হন, তাকে আয়ত্ব করেন এবং বেরিয়ে আসেন। এবং তাই তাঁর সমকালীন এবং পূর্বসূরীদের দেখিয়ে পড়িয়ে হয়ে উঠল কিনা তা জেনে নেবার উদ্বেগ একটা থাকে । এগুলো স্থাভাবিক। একটা আগে অজানা ছন্দ আয়ত্ব করবেন, একটা নতুন ব্যঞ্জনা দিতে চাইছেন, দেবেন কিনা, দিলে দাঁড়ালো কিনা--সে চূড়ান্ত বিচারটা না হয় স্থানান্তর কালান্তরের নিরীক্ষক/ পাঠক করবেন, কিন্তু তখনকার মতো কেউ যাচাই করবেন পরীক্ষার্থীর এই একটা আকাঙ্খা থাকেই। সেই যে অংশটি নিয়ে কবির উদ্বেগ ----তখনই কিন্তু কবিতাটা না দাঁড়াবার , বিরক্ত করবার একটা সম্ভাবনা থাকেই। কখনো বা এই বিরক্তি উৎপাদনেরই নাম হয় আন্দোলন। একটা কথা মনে হয় মানতেই হবে যে কবি যখন পরীক্ষা করছেন, তখন তিনি সমগ্র কবিতাটা নিয়ে ভাবছেন না। এই যেমন ধরুন তিনি ভাবছেন স্বরবৃত্তটা ঠিক ঠাক হলো কিনা। কিম্বা ছন্দের সমস্ত আয়োজনকে জেনে বুঝে ভেঙ্গে ফেলা গেলো কিনা। ঠিক এরই জন্যে আমি ষাটের আন্দোলনকারিদের নাম নেবো কেন, সত্যেন্দ্রনাথকে যত বড় ছন্দের যাদুকর বলা হয়, ততো বড় কবি কিন্তু এখনো নয়। বহু কবি আছেন আজীবন পরীক্ষার্থী থেকে যান, কাছের জনকেই তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষক না নিরীক্ষক ভেবে বসেন--- কী আর করা যাবে! এখন এর মানে এই নয় যে প্রবীণ কবিরা আর পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন না, নিশ্চয়ই করবেন। নতুন ভাব, নতুন বিষয় সব সময়েই নতুন প্রশ্নের মুখে ফেলেই দেয় একজন সৃজনী ব্যক্তিত্বকে। তাই সিলেবাস তাঁর প্রথম যৌবনের থেকে আলাদা হয়। কিন্তু কারো কারো তা হয় না। এটা আমার মনে হয় হয় এর জন্যে যে তাদের কবিতা লিখবার ইচ্ছেতো থাকে, কিন্তু সত্যি সত্যি লিখবার সারবস্তু আর কিছু থাকে না। অর্জন করেন না। এগুলো যেকোন লেখক-শিল্পীর বেলাই সত্য।

অমিতাভ রক্ষিত: সে কি কথা? পরীক্ষা নিরীক্ষা না হলে তো আমরা আজ-ও দ্বিপদি বা ত্রিপদিতে কবিতা লিখতাম (আর কবি সম্মেলনে শ-য়ে শ-য়ে কবি একের পর এক স্বরচিত দ্বিপদি আবৃত্তি করলে ভেবে দেখুন কিরকম ঘুম পেত)! আজকে বিশেষ করে মধুসূদনের জন্মদিনে এই "প্রেমিস"-টা যেন কেমন লাগছে। নিশ্চয়-ই জানেন যে তিনি বাংলার "ব্ল্যাংক ভার্স"-এর জন্ম দিয়েছিলেন ঠাকুর পরিবারের একজনের সঙ্গে বাজী ধরে (তিলোত্তমাসম্ভব)। কাজেই অন্যান্য শিল্পের মতন-ই, কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা একেবারে অতি অবশ্য...

অমিতাভ প্রহারাজ: " বহু কবি আছেন আজীবন পরীক্ষার্থী থেকে যান, কাছের জনকেই তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষক না নিরীক্ষক ভেবে বসেন--- কী আর করা যাবে!" ..... "তাদের কবিতা লিখবার ইচ্ছেতো থাকে, কিন্তু সত্যি সত্যি লিখবার সারবস্তু আর কিছু থাকে না। অর্জন করেন না।"....... সুশান্তবাবুর এই দুটি বাক্যে বেশ ধুয়াধার ভাবনার রসদ আছে...