কবিতা যদি যথার্থ কবিতাই হয়ে ওঠে, তাহলে দুই বাংলার কবিতাই আমার কাছে সমান: পৃথা রায় চৌধুরীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 18, 2013 5:09:10 PM

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে? যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা অবশ্যই সমাজে একটি বিশেষ ভুমিকা রাখে। বিভিন্ন সময়ের কবিতায়, সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে ধরা পড়ে। যেমন, তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বা নারীপুরুষের সামাজিক অবস্থান, তৎকালীন অপরাধের চিত্র বা সে হোক না কেন, বিশ্বের টালমাটাল অবস্থা ও যুদ্ধের চালচিত্র।

সমাজের সমস্ত অপরাধ যেমন আমরা সশরীরে কোথাও উপস্থিত থেকে দমন করতে পারি না বা নিদেনপক্ষে প্রতিবাদটুকু করতে অক্ষম হই, সেখানে এক কবির কলম অবশ্যই পারে গর্জে উঠতে, তার নিজস্ব প্রতিবাদী ভাষায়... কবিতায়।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

পৃথা রায় চৌধুরী: কোনো কবির দ্বারা প্রভাবিত হইনি তো কখনো। কবিদের কবিতা পড়ে ভালো লাগলে, একবারের বেশি দুবার, বা তারও বেশিবার পাঠ করেছি, কিন্তু টা শুধুই নিজের ভালোলাগা মেটাতে। প্রভাবিত হবার মতো, অতো কবিতা আমি পড়িই নি যে কোনোদিন। আসলে এমন একটা জায়গায় মানুষ হয়েছি, ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যে (অধুনা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে), যেখানে কবিতা চর্চার খুব সুযোগ কোনোদিন ছিল না। পছন্দের কবিদের লেখা এখন পড়ে ফেলতে চেষ্টা করি হাতে পেলেই।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: প্রকৃত কবি হতে হয় না, কবি জন্মায়। এই দেখুন না, যখন আমাকে অনেকে সম্বোধন করেন “কবি” বলে, মনে মনে শঙ্কিত হই। কারণ, এখানেই ওঠে সেই হয়ে ওঠার প্রশ্ন। একটাই কারণ, কবিতার বিশেষ ব্যাকরণ নিয়ে কেউ কোনোদিন আমায় প্রশিক্ষণ দেন নি। যেটুকু শিখেছি, নিজের মায়ের কাছ থেকে... উনি বাংলারই প্রফেসার ছিলেন এক কলেজে। প্রকৃত কবি সামান্য বাগানের মালী থেকে শুরু করে, গ্রামের বুড়ো বটের তলায় বসা কোনো পাগল, বা নৌকা বাওয়া কোনো মাঝিও হতে পারে। তাদের কবিতা ভেতর থেকে উঠে আসে, সেখানে জটিলতা নেই... যদিও তাদের লেখা কোথাও প্রকাশ পায় না; তাই তারা কবি “হয়ে ওঠে না”।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: এ বড়ো কঠিন প্রশ্ন। সাধারণ মানুষ সচরাচর কবিতাকে ভয় পেয়ে থাকেন। ভাবেন, কিছু “আঁতেল” ভিনগ্রহের বাসিন্দা, তাঁদের পণ্ডিতি ফলিয়েছেন। অথচ, কবিতা বলতে আমি বুঝি, নিজের নিজের সূক্ষ্ম থেকে সুক্ষতর অনুভুতিকে নিজের মতো ছোট ছোট কথামালায়, মেদহীন ভাবে সাজিয়ে ফেলা, যা কিনা, শব্দ বা বাক্যবাহুল্য বর্জিত। অবশ্যই কবিতা মানে শুধু এটুকু নয়, কবিতা উপলব্ধির জিনিস, একে বর্ণনা করে বোঝানো অসম্ভব।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: এখন কবিতার বদলে কিছু কবি জটিল থেকে জটিলতর ধাঁধা লিখে ফেলছেন বলে আমি মনে করি। সে কবিতা বুঝতে বেলা গড়িয়ে যায়, তবু তার তল পাই না। কবিতায় রহস্য থাকেই, কিন্তু রহস্যের নামে খোলা যাবে না এমন জট দিয়ে দিলে, সে কবিতা পড়ে সুখ কোথায়? আরেকটি প্রবণতা হল, কবি যে বিষয় নিয়ে শিক্ষালাভ করেছেন (সকলেই সাহিত্য পড়েননি), সেই বিষয়কে আধার করে, কবিতা লিখে ফেলছেন। ফলে, যারা বিষয়টি নিয়ে ওয়াকিবহাল নন, তারা পড়ছেন বিপদে। প্রবণতাই যদি ধরেন, ইদানীং চারিদিকে সিরিজ লেখার ধুম পড়ে গেছে, (আমি নিজেও লিখেছিলাম এককালে)... কিন্তু, কয়েকটা বাদে, বাকিগুলো একই ধরনের ক্লিশে শব্দ ও ব্যঞ্জনায় ভরে থাকছে।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

পৃথা রায় চৌধুরী: সাহিত্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি মনে করি না, সাহিত্যের কোনও আন্দোলন জীবনকে বাদ দিয়ে হয়েছে। জীবন যেমন বিবর্তিত হয়ে চলেছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে কবিতাও বিবর্তিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। একটা আন্দোলন কখনোই কবিতাকে আমূল পরিবর্তিত করতে সক্ষম নয়। বিবর্তন সম্ভব, পরিবর্তন নয়। এটা আমার ব্যক্তিগত মত।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। লিখতে ইচ্ছে হলে লিখি, এটুকুই জানি।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা শুধু বাংলায় বিবরতনশীল নয়, বিশ্বব্যাপী কাব্যিক বিবর্তন চলছে।

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

পৃথা রায় চৌধুরী: লেখালেখি শুরু সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। তখন ছোটোখাটো কবিতা (ছড়া বলাই শ্রেয়) ও গল্প নিয়ম করে স্কুল ম্যাগাজিনে লিখতাম। এভাবেই লিখতে লিখতে এখানে এসে পৌঁছেছি।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা লেখার সঠিক কোনও কারণ কোনোদিন খুঁজতে চাইনি। ধরুন, নানান কাজের মাঝে মাথার ভেতর একটা কবিতা পোকা হঠাৎ নড়েচড়ে উঠলেই, লিখে ফেলতে হয় আমাকে; নাহলে, সেই কাব্যি পোকার নড়াচড়া রীতিমতো অশান্ত করে তোলে। সে ভারি করুণ অবস্থা, অন্য কোনও কাজ তখন ঠিকঠাক করে উঠতে পারি না। ব্যাপারটা হলো, কবিতা লিখতে হবে বলে কোনোদিন লিখতে বসিনি, কবিতা পায়, তাই কবিতা করি (লিখি)।

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা লেখার বিষয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনেই ছড়িয়ে আছে। সুখ, দুঃখ, কোনও রোজনামচায় ব্যবহৃত জিনিস, বাতিল কোনো কিছু, অথবা সমাজে ঘটে যাওয়া যে কোনো বিপর্যয়... এ সমস্তই, কবিতার বিষয় হতে পারে। এদের মধ্যে যে এসে মনের কড়া নাড়ে, সেই হয় আমার বিষয়।

দুপুর মিত্র: একটি কবিতা লিখতে আপনার কেমন সময় লাগে?

পৃথা রায় চৌধুরী: সবই নির্ভর করে, সেই কবিতা পোকা কতোখানি জোরে কামড় দিয়েছে, তার ওপর। ১০ মিনিটেও লিখে ফেলেছি কখনো, আবার আধঘণ্টাও সময় লেগেছে অনেক সময়। তবে, একটা লেখা এর বেশি সময় নিয়ে আমি কখনোই লিখিনি। দীর্ঘ কবিতা আমি লিখি না, তাই এর বেশি সময় লাগার কথাও নয়।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা লিখতে প্রস্তুতি? কবিতা এলে, শুধু তাকে লিখে ফেলার জন্য সময়টুকু বের করা হল আমার কাছে প্রস্তুতি। এর বাইরে তো তেমন কিছু দেখি না।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: এভাবে কি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা সমীচীন হবে? ভালো লাগে অনেকের কবিতাই, কিন্তু নামোল্লেখ করার সময় ভুলবশতঃ কারো নাম না বলা হলে তার ভেতরে খারাপ লাগা তৈরি হবে। চিরকালীন ভালো লাগার স্থান অধিকার করে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম। সঙ্গে চরমতম প্রিয় কবিদের মধ্যে রয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

পৃথা রায় চৌধুরী: এ প্রশ্নের উত্তর দেবো না আমি, কারণ কোনো কবিরই সব কবিতা ভালো বা খারাপ আমি বলতে পারি না। কারুর কবিতাকে খারাপ বলার আগে, প্রশ্ন করি নিজেকেই, যে আমি নিজে যা লিখি, তা সবার কাছে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে তো?

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: এভাবে দশকের নিরিখে কবিতাকে কোনোদিন ভাগ করে দেখিনি। তবে, সামান্য কথায় যদি বলতে হয়, নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু শক্তিশালী কলমের আঁচড়ে কাব্যিক বিবর্তন প্রকট হয়ে উঠেছিল।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

পৃথা রায় চৌধুরী: কবিতা যদি যথার্থ কবিতাই হয়ে ওঠে, তাহলে দুই বাংলার কবিতাই আমার কাছে সমান। দুই বাংলার সামান্য কয়েকটা শব্দের তফাৎ আছে। তাই বাংলাদেশের কবিতায় আমার অজানা ওখানকার কোনো শব্দ ব্যবহার করা হলে, তার মানেটুকু আমি কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিই। এটুকুই তফাৎ আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েছে, এর বেশি কিছু নয়।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে? লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

পৃথা রায় চৌধুরী: ব্লগ তো সাহিত্যের ক্ষেত্রে এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ। এমন বহু কবি আছেন, যারা এই ব্লগ থেকেই নিজের প্রাপ্য পরিচিতি পাচ্ছেন। লিটলম্যাগের চেয়ে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ, এ কথা বলবো না। দুটোরই নিজস্ব স্থান রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, সাহিত্যকে আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে ব্লগের মাধ্যমে। এই যে আপনি আমাকে নিজের ব্লগের জন্য এই প্রশ্ন কটি করলেন, এ সবের উত্তর খুব তাড়াতাড়ি বহু মানুষ পড়ে ফেলতে পারবেন, এই ই-প্রযুক্তির কল্যাণে। লিটলম্যাগ হলে, ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়তো। আবার উল্টোদিক থেকে যদি দেখি, লিটলম্যাগ এখনো সমান গৌরবান্বিত, কি বলুন তো?... পাঠক বা কবি, বারংবার নিজের বইপত্রের মধ্যে থেকে লিটলম্যাগটি হাতে তুলে যখন খুশি পাঠ করতে পারবেন। ইন্টারনেট কানেকশান না থাকলেও, আমার ইচ্ছা অনুযায়ী সমস্ত লেখা আমার হাতের মুঠোয়। এছাড়া, এখনো কাগুজে ছাপার অক্ষরের নিজস্ব মাহাত্ম্য বহাল আছেই, ঠিক আগের মতো।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

পৃথা রায় চৌধুরী: দৈনিকে সাহিত্যের স্থান এখনো আগের মতোই, আমার মতে পাঠক সংখ্যা যদিও কমে যাচ্ছে। কারণ... এই বৈমাত্রেয় ভাই---- ব্লগ।