কবিতায় ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির প্রয়োগ সম্ভব: তুষার গায়েনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 22, 2012 8:10:46 AM

প্রকাশিত বই: নীলভবহ্রদ (বর্ণবোধ প্রকাশনী, ১৯৯৭), বৃষ্টির অন্তর ত্রাস (নিসর্গ, ২০০৩), দ্বিমেরুযোজন (শুদ্ধস্বর, ২০১২), Postmodern Bangla Poetry 2003 ( কাব্যসংকলন, যৌথ সম্পাদনা: সমীর রায়চৌধুরী এবং কামরুল হাসানের সাথে, হাওয়া ঊনপঞ্চাশ, ২০০৩)

দুপুর মিত্র: সাহিত্যের ছোট কাগজ একবিংশ-র ২৫ বছর পূর্তি: কালের ছাঁকনি অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা এমন লেখায় আপনি বলেছেন- সম্পাদক হিসেবে খোন্দকার আশরাফ কখনও কোনো তরুণ কবিকে বোঝাতে চেষ্টা করেননি যে কী ধরনের কবিতা লেখা শ্রেয় অথবা তাদের কবিতার শক্তি ও দূর্বলতা কোথায় এবং কিভাবেই বা তাকে উন্নীত করে নেওয়া যাবে — যেমনটা বুদ্ধদেব বসু, সিকান্দার আবু জাফর অথবা আহসান হাবীব করতেন বলে শুনেছি; তবুও তিনি সম্পাদক হিসাবে সমকালে কেন শ্রেষ্ঠ সে প্রশ্ন আসতেই পারে। এর উত্তর: খোন্দকারের রয়েছে বিশেষ কাব্যরুচি ও পাকা জহুরীর চোখ যিনি স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া অনেক অবাঞ্ছিতের ভিড় থেকে সুন্দর ফুলটিকে সনাক্ত করে তুলে আনতে পারেন। কবিতা কী এবং কী নয় সেই উপলব্ধির গভীরতা এবং নিরন্তর সেই উপলব্ধিকে প্রকাশ করে যাওয়ার নিমোর্হ দৃঢ়তাই তাঁকে এবং একবিংশকে দিয়েছে এই আসন।

কিন্তু তার বিরুদ্ধেও অনেক কথা শোনা যায়। এবং সেটা এরকম যে বুদ্ধদেব বসু,সিকান্দার আবু জাফর অথবা আহসান হাবীবের সাথে তার তুলনা অনেকের কাছে হাস্যকরই বটে। এ নিয়ে কিছু বলবেন কি?

তুষার গায়েন: আপনার প্রশ্নগুলো কবিতার অন্দরমহল (কবিতার স্বরূপ, তার সৃষ্টি ও নির্মান কৌশল এবং ভূত-ভবিষ্যত) নিয়ে যতটা না আগ্রহী তার থেকে বেশি আগ্রহী কবিতার বহিরাঙ্গন, মানে সমকালের কাব্যরাজনীতি ও তার পরিপার্শ্ব নিয়ে। আমার আগ্রহ অবশ্য কবিতার অন্দরমহল নিয়ে। তবুও যথাসম্ভব আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করছি।

‘একবিংশ’-র ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমার ঐ লেখায় ‘একবিংশ’পত্রিকা ও তার সম্পাদকের একটা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। আমি ‘একবিংশ’ পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক ও খোন্দকার আশরাফ হোসেনের বন্ধু হিসেবে তাঁর যে সমালোচনা করেছি এবং যে ঔদার্যের সাথে তিনি তা গ্রহন করেছেন, তা একালে বিরল। সত্যি কথা বলতে গেলে ঐ আলোচনায় আমি অত্যন্ত নির্মোহভাবে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের শক্তি ও দূর্বলতা চিহ্নিত করেছি এবং পরিশেষে সমকালে (আশি ও আশি পরবর্তী কালপর্ব) তাঁর সম্পাদকীয় শ্রেষ্ঠতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত টেনেছি। এটা আমার বিবেচনা এবং এর সাথে অন্যদের দ্বিমত থাকতেই পারে। মানুষের সাথে মানুষের তুলনা যে শুধুমাত্র তাঁদের সমকক্ষতার ভিত্তিতেই হতে হবে এমন কোন কথা নেই, তাঁদের উদ্দেশ্য ও কর্ম-প্রক্রিয়ার বিবেচনা থেকেও হতে পারে। বুদ্ধদেব বসু,সিকান্দার আবু জাফর অথবা আহসান হাবীব যেমন তাঁদের কালপর্বে নতুন ধারার কবিতা ও কবিদের পাটাতন নির্মান করতে চেয়েছিলেন, খোন্দকার আশরাফ হোসেনও তাঁর কালে তেমন চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তি ও প্রতিভা ভেদে কারো অর্জন বেশি, কারো অর্জন কম। কিন্তু তুলনা করলে তা কেন হাস্যকর হবে, আমি বুঝি না!

দু: আপনার রবি চক্রবর্তীর সাথে অনেক ভাল যোগাযোগ। কলিম খান ও তাঁর কাজ কর্ম নিয়ে বেশ যোগাযোগ রয়েছে আপনার। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি নিয়ে কিছু বলবেন? ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির কি কবিতায় প্রয়োগ সম্ভব?

তু: কলিম খানের লেখা পাঠের সূত্র ধরেই প্রথমে তাঁর সাথে ও পরে রবি চক্রবর্তীর সাথে আমার যোগাযোগ হয়। তাঁরা মহাপ্রাণ ও তাঁদের সাধনালব্ধ ধন বাঙালির চিরকালের অর্জন।

ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের বুঝে নেয়া ভালো যে এখন সারা পৃথিবীতে যে বিভিন্ন ভাষায় মানুষেরা যোগাযোগ করে তা কোন নিয়মে চলে। আমরা এখন যে ভাষা ব্যবহার করি তার শব্দগুলি হচ্ছে বিশ্ব জগতের সমস্ত বিষয় ও বস্তুর প্রতীক বা চিহ্ন মাত্র। বিশ্বের সমস্ত বস্তু বা বিষয়কে এক একটি পৃথক শব্দপ্রতীক দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে এবং শব্দগুলোর মানে একবার কারো কাছ থেকে বুঝে নিতে হয় অথবা অভিধানের মাধ্যমে জেনে নিতে হয়। শব্দের বাইরে থেকে শব্দের মানে জানবার এই পদ্ধতি হচ্ছে ‘প্রতীক-কেন্দ্রিক’ (= ‘logo-centric) বা ‘প্রতীক-ভিত্তিক’এবং এই ভাষাকে তাই বলা যায় প্রতীকী ভাষা। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত অর্থ প্রকাশ করতে হয় প্রতিশব্দের সাহায্যে। কিন্তু শব্দের বাইরে থেকে শব্দের মানে জানবার একটা পদ্ধতি সংস্কৃত ও প্রাচীন বাংলা ভাষায় চালু ছিল। এই পদ্ধতিতে শব্দের ভিতর থেকে শব্দের মানে বের করার রেওয়াজ ছিল। যে-কোন শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করতে পারলে, শব্দের ভেতরের অর্থটিকে দেখতে পাওয়া যায় এবং সেই অর্থটিকে একটি বাক্যের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। প্রাচীন ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে শব্দের আদিতে দুটি জাতি – নাম আর ধাতু। তবে নিরক্তকার শাকটায়ন ও যাস্ক বলেছেন, আসলে, সব শব্দের মূল উপাদান হল ধাতু। নামও ধাতু। নামের মধ্যেও একটা ক্রিয়াত্মক অর্থ রয়েছে। শব্দের এই প্রকৃতি তার আত্মা আর প্রত্যয় হল তার শরীর। তার মানে আমাদের ভাষার সকল শব্দের ভিতর একটা ক্রিয়াত্মক ব্যাপার রয়েছে, সেই-ই শব্দের প্রাণ বা আত্মা। এখন আসুন একটা শব্দের মানে দেখা যাক, সেটা প্রতীকী ভাষায় এবং ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় কী ধরণের অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, একটি শব্দ ‘অজ’-আধুনিক বাংলা (প্রতীকী) ভাষায় এর অর্থ ছাগল। প্রাচীন বাংলায় (ক্রিয়াভিত্তিক) এই শব্দের ২৫ টি মানে দেয়া আছে। কারণ ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির নিয়মানুসারে প্রতিটি বর্ণের অর্থ হয় এবং সেই বর্ণের অর্থ অনুযায়ী শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়, যেমন: ‘অজ = ন জ’। ‘জ’ মানে ‘জননের আধার’; তাই ‘ন জ’ মানে ‘জনন নেই যাহাতে’। এখন যে সব সত্তা জননরহিত, তাদের প্রত্যকেই অজ। এই অজ পরিবারের মধ্যে বিষ্ণু, ব্রহ্মা, অগ্নি, শিব থেকে ছাগল পর্যন্ত সব কিছু এটে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রতীকী শব্দার্থবিধি যেখানে একরৈখিক, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি সেখানে বহুরৈখিক। [১] মানব সভ্যতার বিবর্তনের এক পর্যায়ে পণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা চালু হলে লেনদেনের সুবিধার্থে নির্দিষ্ট পণ্যের নির্দিষ্ট নামের প্রয়োজন হয়, এবং ভাষার ক্রিয়াভিত্তিক রূপ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে প্রতীকী শব্দার্থবিধিতে নিঃশেষিত হয়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ সর্ব প্রথম এবং কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী সম্প্রতি দু’খণ্ডে প্রকাশিত তাঁদের ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ অভিধানে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেছেন।

হ্যাঁ, কবিতায় ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির প্রয়োগ সম্ভব এবং তা এক সম্পূর্ণ নতুন ও ঐশ্বর্যময় কাব্যজগতের সূচনা করবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আগে তো ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির ব্যাপার-স্যাপার ভালো করে বুঝতে হবে। কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর প্রচুর বইপত্র ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, সে’গুলো ভালো করে পড়া দরকার; পাঠচক্র করে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা হওয়া দরকার। তাঁরা দু’জনে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ব্যবহার করে রামায়ন, মহাভারত, পুরাণসহ বহু প্রাচীন গ্রন্থের যে-সব পাঠোদ্ধার করেছেন সে সম্পর্কে ভালো করে জানা দরকার, তবেই না আমরা কেবল ভাবতে পারি কবিতায় এর প্রয়োগ নিয়ে।

দু: আপনি সাজ্জাদ শরিফ এবং রণজিৎ দাশের সম্পাদিত শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন বিষয়ে লিখেছিলেন,সাজ্জাদ শরিফের এই সংকলন শুধুমাত্র দলবাজি এবং গোষ্ঠীবাজির নমুনা,নাকি তার থেকেও কোনো গভীর উদ্দেশ্য ও রাজনীতি রয়েছে,তা ভেবে দেখার জন্য বঙ্গের কবিকুলকে আহবান জানাই। এটা কেমন,বুঝিয়ে বলবেন কি?

তু: এ বিষয়ে আমার যা কথা তা আমি যথেষ্ট পরিস্কার করে ওই লেখাতে বলেছি। লেখাটির শিরোনাম: ‘ধরা যাক দু’একটা ইঁদুর আবার’ আমার ফেসবুক নোটে আছে। নতুন করে এ নিয়ে কথা বলার আর কি আছে? তবু একটি বিষয় উল্লেখ করছি যা দিয়ে সেই ‘গভীর উদ্দেশ্য ও রাজনীতি’-র স্বরূপ বোঝা যাবে। সম্প্রতি হুমায়ুন আহমেদের বিতর্কিত উপন্যাস ‘দেয়াল’ নিয়ে ‘প্রথম আলো’-তে লেখা সাজ্জাদ শরীফের প্রবন্ধ, ‘হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল: সাহিত্যের সীমানা ও আদালতের দায়’ এবং এর জবাবে অনিন্দ্য রহমান সচলায়তন-এ যে লেখাটি লিখেছেন ‘অর্ধেক পাথর তুমি আজ বালক কবির করতলে’ পড়লেই বিষয়টি খোলাসা হয়ে যাবে: http://www.sachalayatan.com/aninda21/45003 অনিন্দ্য রহমানের লেখাটির কোনো জবাব সাজ্জাদ শরীফ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

দু: কবিতার রাজনীতিকরণ বা অতি রাজনীতিকরণকে কি আপনি ক্ষতিকারক মনে করেন? করলে কেন,না করলে কেন?

তু: কবিতার রাজনীতিকরণ কেন, উদ্দেশ্য প্রণোদিত কোনো নীতিকরণেই আমার বিশ্বাস নেই। কবিতায় রাজনীতি ব্যবহারে অতি উৎসাহী অথবা অতি বিরোধী, কোনো ব্যাপারকেই আমি ভালো চোখে দেখি না। আমি মনে করি কবিতায় যে কোনো কিছুই আসতে পারে, ঠিক যেভাবে রাজনীতিও আসতে পারে; কিন্তু যাই আসুক না কেন, তা কবিতা হয়ে উঠতে হবে, শিল্পের দাবী মিটিয়ে আসতে হবে। আমরা কি পৃথিবীতে মহান কবিদের রাজনৈতিক কবিতা পড়ে আন্দোলিত হইনি, তাঁদের কবিতা কি বিশেষ বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে মানুষকে জাগিয়ে তোলে নি? এখন এমন কি হ’ল যে কবিতায় রাজনীতি আসলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় কবিতায় সেটা উপেক্ষা করার চেষ্টা মরু বালুতে উটপাখির মুখ গুঁজে আড়াল নেবার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র। এসব নিয়ে ফেসবুকে প্রকাশিত আমার ঐ নোটে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। লিঙ্ক দিলাম: http://www.facebook.com/note.php?saved&&note_id=173109440124

দু: নব্বইয়ের কবিতায় কি ধরণের রাজনীতি হয়েছে?

তু: বুঝলাম না প্রশ্নটা! আপনি কী নব্বইয়ের কাব্যরাজনীতির কথা বলছেন না কি কবিতায় রাজনীতির ব্যবহার নিয়ে বলছেন? যদি কাব্যরাজনীতির ব্যাপার হয়, তাহলে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। আর যদি কবিতায় রাজনীতির ব্যবহার নিয়ে কথা হয়, তাহলে বলব নব্বইয়ের অধিকাংশ কবি রাজনীতিকে কবিতার জন্য অবাঞ্ছিত মনে করার কারণে এর সৃজনশীল ব্যবহার কিভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবেন নি। হাতে গোনা দু’একজন কবি তাদের কবিতায় রাজনীতির শিল্পিত প্রয়োগ করেছেন।

দু: সুমন রহমান বা সুব্রত-মাসুদ-মজনু-সাজ্জাদ শরিফ একই সূত্রে গাঁথা। আপনার কি এরকম মনে হয়? হলে কিভাবে?

তু: এভাবে ব্যক্তি বিশেষ নিয়ে মন্তব্য করার ব্যাপারে আমি আগ্রহী নই। আমি বিষয়ভিত্তিক কথা বলতে পছন্দ করি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

তু: সমসাময়িক সময়ে অনেকেই ভালো লিখছেন। কবিদের নাম ধ’রে ধ’রে বলার থেকে বরং কাব্য প্রবনতা নিয়ে কথা বলা অনেক ভালো এবং কোন প্রবনতার কবিতার প্রতি আমার পক্ষপাত রয়েছে বা আমার ভালো লাগে, সেটা বরং আমি বলতে পারি।

একটা ব্যাপার খুব স্পষ্ট যে সত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় একটা পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের ধারায় যারা লিখছেন, তাদের মধ্যে মোটা দাগে দু’টো ভাগ করতে পারি। এই মোটা দাগের ভিতর আরো সরু উপভাগ করা যায়, সেটা থাক, আলোচনা জটিল হয়ে যাবে! আধুনিকতাবাদী (হাই মডার্নিজম) সাহিত্যের যে ধারাটি তিরিশের দশকে শুরু হয়েছিল তা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পঞ্চাশের দশক থেকে নানা মাত্রায় বিকশিত হয়ে, মোটামুটিভাবে, সত্তরে এসে সম্ভাবনা নিঃশেষিত হয়ে যায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নতুন কাব্যভাষা নির্মানের যে চেষ্টা দেখতে পাই, নব্বইয়ে তা অনেক বেশি তৎপর ও বিচিত্রগামী হয়ে ওঠে। প্রাসঙ্গিক কারণে এই সময় উত্তর-ঔপনিবেশিক (পোস্ট কলোনিয়াল) ও উত্তরাধুনিক / আধুনিকোত্তর/ অধুনান্তিক (পোস্টমডার্ণ)চিন্তাভাবনা বা ডিসকোর্স তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই পোস্টমডার্ণ চিন্তাভাবনাকে তরুণদের একটি অংশ গ্রহন করেছে তার আত্মা বা মর্মের দিক থেকে, আরেকটি অংশ গ্রহন করেছে তার পোষাক বা ফর্মের দিক থেকে। যারা আত্মার দিক থেকে গ্রহন করেছে তারা আধুনিক কবিতার খণ্ডত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সরে গিয়ে অখণ্ড সমগ্রতার দিকে দৃষ্টি ফেলেছেন এবং বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, দ্রোহ ও সংগ্রামকে যার যার মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী আত্মস্থ করে নতুন জ্ঞান ও চিন্তার সাথে একালীকরণ (আপডেট) করে কবিতা লিখছেন। তাদের অনেকের কবিতা একমুখী ঝোঁক বা একরৈখিকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহুস্তর ও বহুরৈখিকতায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে যা অন্তর্গতভাবে পোস্টমডার্ণ চিন্তা-পরিধির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ এবং তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখা করা যায়। এই কবিরা কবিতার চারিত্র্য অনুযায়ী ছন্দে, বিবিধ ছন্দ নিরীক্ষায় এবং ছন্দের বাইরে এসে কবিতা লিখছেন। আর পোস্টমডার্ণ চিন্তাভাবনাকে যারা পোষাকী দিক থেকে গ্রহন করেছেন এবং তোতাপাখির মত মুখস্ত করেছেন যে কবিতার কোনো অর্থ হয় না, ব্যাখা হয় না; কবিতা হবে কেন্দ্রহীন, পরম্পরাহীন; অস্পষ্টতার ধুম্রজালে বাঁধা; এক শব্দের সাথে অন্য শব্দের সম্পর্ক হবে না, এক পঙক্তির সাথে অন্য পঙক্তি ভুগবে ক্রমাগত দাম্পত্য বিরহে --এক শাব্দিক নৈরাজ্যের জন্ম দেবেন তারা যার ভিতর থেকে হয়ত কিছু শব্দ ও পঙক্তি ঝলক দিয়ে উঠবে কিন্তু সার্বিকভাবে তেমন কিছু দাঁড়াবে না। পাঠক পড়ে মুখ কালো করে বলবেন: বুঝতে পারি নি, কিন্তু খুব উচ্চমার্গের হয়েছে! এরা কবিতায় রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অবশ্য পরিতাজ্য মনে করেন যেন তা জীবনের অংশ নয়; ছন্দে কবিতা লেখাকে মনে করে পিছনের দিকে যাওয়া বা আনস্মার্ট, কারণ তাদের অধিকাংশ ছন্দ জানে না এবং জীবনে একটিও ছন্দে কবিতা লেখে নি। মূলতঃ যে কোনো কবিতাই যে এক বা একাধিক অনুভব, উপলব্ধি, বোধ বা চিন্তা-তরঙ্গকে অনুসরণ করে মূর্ত হতে চায় এবং শব্দ কাঠামোর মাধ্যমে পাঠকের সাথে যোগাযোগ করে, কিন্তু সে’টি ঠিকঠাক মত করতে না পারার অক্ষমতা থেকে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্টতা ও অর্থহীনতা তৈরী করে যারা তাকে তথাকথিত পোস্টমডার্ণ মুক্ত স্বাধীন টেক্সট বলে দাবী করেন তা খুবই হাস্যকর এবং কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। তারা লিখবেন, কিন্ত সৃষ্টিশীলতার কোনো দায় গ্রহন করবেন না এটা হয় না, মুক্ত হতে গিয়ে তাদের বদ্ধ পাগল হওয়ার দশা ... তাদের রক্ষাকবচ হ’ল সর্ব রোগহরণকারী, মহাধন্বন্তরী পোস্টমডার্ণ জামা! এদেরই আরেকটি গ্রুপ আছে, যারা আবার তরল ছন্দে কবিতা লেখে ... এক গ্লাস পানিতে এক মুঠো জয় গোস্বামী, এক চিমটি বিনয়, উৎপল অথবা রনজিৎ ... বাজিমাৎ!

আমার কাছে প্রথম অংশের কবিদের কবিতা ভালো লাগে। আমার এই বিশ্লেষণ মনে রেখে যদি সমকালীন কবিদের কবিতা পাঠ করা যায়, তাহলে বোঝা যাবে কে কোন গোত্রে পড়ে এবং আমার কাদের কবিতা ভালো লাগে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

তু: এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে আগের প্রশ্নোত্তরে।

দু: ৮০-৯০-০০ এই ত্রিদশকের নানাকিছু আপনার চোখের সামনেই ঘটল। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

তু: কবিতা নিয়ে একটা তোলপাড় বাংলাদেশে সব সময়েই আছে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার প্রভাব সাহিত্যের জগতে এসে পড়বে সেটা স্বাভাবিক, বিশেষত কবিদের সম্পর্কের ভিতর তা প্রভাব ফেলছে। ব্যক্তিদ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তো রয়েছেই। এছাড়াও কিছু প্রধান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মত পার্থক্যের কারণে এবং প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচারণার কারণে সমস্ত পরিবেশ খুব ঘোলাটে হয়ে আছে। তরুণ কবিদের দায়িত্ব খুব গভীরভাবে বিষয়গুলো বোঝা এবং ও সাময়িক খ্যাতির জন্য সত্যকে পাশ কাটিয়ে না যাওয়া বা বিভ্রান্তির শিকার না হওয়া।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার বিকাশ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

তু: বাংলার পঞ্চভূবন: বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও বহির্বঙ্গ (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাভাষী মানুষেরা)। আপনার প্রশ্ন অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার বিকাশ নিয়ে।

অঞ্চল নিরপেক্ষভাবে বাংলাভাষী, বাঙালি জাতি গোষ্ঠির রয়েছে এক অভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। তা সত্ত্বেও, অঞ্চলভেদে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে সংস্কৃতি ও তার অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে কবিতার বিকাশ কিছু মাত্রায় ভিন্ন ছিল ও হবে, সন্দেহ নাই। যেমন দেখেন, পশ্চিমবঙ্গে বৈষ্ণবকাব্য বেশি সমৃদ্ধ, কারণ শান্ত নিসর্গ ও দিগন্তে মিশে যাওয়া প্রান্তরের মধ্যে ব্যক্তির সীমা অতিক্রম করে অসীমের মধ্যে বিলীন হবার আকুতি প্রবল। অন্যদিকে নদীপ্রধান পূর্ববঙ্গ, মানে আজকের বাংলাদেশ --নদীর আবর্তে, ভাঙাগড়ার খেলায় সব সময় অস্থির। এই সদা জাগ্রত প্রকৃতির ভিতর শাক্তকাব্যের জন্ম ও বিকাশ, মানে মনসামঙ্গল-এর উদ্ভব। এ তো গেল প্রকৃতির দিক থেকে দেখা। যদি সামাজিক বাস্তবতার দিক থেকে দেখেন, তাহলে প্রাচীন ভারতীয় সাম্যবাদী সমাজ যখন ব্রাহ্মন্যবাদীদের দ্বারা কুক্ষিগত হয়ে যায় এবং জন্মসূত্রে জাত-পাত নির্ধারিত হতে থাকে, তখন বুদ্ধের আবির্ভাবে বর্ণবাদী প্রথাকে অস্বীকার করে যারা অধিক সংখ্যায় বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিল তারা ছিল বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় অধিবাসী, মানে আজকের বাংলাদেশের বাঙালি। আবার হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানে, বৌদ্ধদের যখন নিকেশ করল ব্রাহ্মন্যবাদীরা, সেই শূন্যতার স্থানে যখন ইসলাম আসে, তখনও এই অঞ্চলের বাঙালিরাই আবার বেশি করে মুসলমান হয়। এই যে প্রতিবাদের উত্তরাধিকার, এর সাথে জলবায়ুর সম্পর্ক আছে। তার মানে এই নয় যে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা প্রতিবাদী নয়! কিন্তু বিভিন্ন কারণে তার মধ্যে পার্থক্য আছে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর এই পার্থক্য বেড়েই চলেছে। দু’টো অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা এই পার্থক্য সৃষ্টি করে চলেছে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল তাকে এ অঞ্চলের বাঙালি প্রত্যাখান করে ভাষা আন্দোলন ক’রে ও তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র পত্তনের মাধ্যমে। কিন্তু তার যথার্থ গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে এখানকার বাঙালি এখনও সমর্থ হয় নি। ধর্মীয় পরিচয় কি জাতিসত্তা নির্ধারণ করবে না কি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভিত্তিতে সংশয়হীনভাবে জাতিসত্তা নির্ধারিত হবে এমন একটি প্রাথমিক প্রশ্নে জাতি আশ্চর্যজনকভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষনীয়, কিন্তু সংশয় মাঝে মাঝেই এসে হানা দেয়; ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যে রাষ্ট্রের উদ্ভব, সেখানে মৌলবাদ যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে। মৌলবাদ শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে আছে এবং তাদের সহযোগী হয়েছে সেই বিভ্রান্ত বাম যারা মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলেছিল। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও হাজার বছর ধরে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নিয়ে যে ডিসকোর্স রয়েছে যার ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের কবিতা ও সাহিত্য এতকাল ধরে বিকশিত হয়েছে, তার বিপরীতে বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদীরা একটা পাল্টা ডিসকোর্স তৈরী করে চলেছে এবং তরুণ কবি, লেখকদের একটা অংশকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা কোন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন ডিসকোর্স তার প্রভাব বিস্তার করবে তার উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের কবিতার ভবিষ্যত।

পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিতরে কোনো বিরোধ নেই, জাতিসত্তা ও আত্ম পরিচয়ের প্রশ্নে কোন সংশয় নেই এবং দীর্ঘকাল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং দু’দশকের অধিক বামফ্রন্ট সরকারের শাসনে তারা ভালো-মন্দ সব প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পরিবর্তনের আশায় নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। দীর্ঘকালীন শিল্প সংস্কৃতি ও নাগরিক বোধের চর্চা তাদের পরিণত মানসিকতা সৃষ্টির পাশাপাশি এক ধরণের অবসাদ তৈরী করেছে এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে তারা মনমরা, তাদের ভিতর স্বপ্ন ও প্রাণ-প্রাচুর্যের অভাব। [২] একদা অবিভক্ত ভারতের রাজধানী কলকাতায় বাঙালি মনীষা শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতিতে বাংলায় ও সর্ব ভারতীয় পর্যায়ে যে নেতৃত্ব দিয়েছে ও বিকশিত হয়েছে, আজ বিভাগোত্তর ভারতের একটি প্রদেশের অধিবাসী হিসেবে সেই বিকাশ ও নেতৃত্বের আলো অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের বাঙালি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্ব ও বিবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটে সদা টলটলায়মান, কিন্তু একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিবাসী হিসেবে অফুরন্ত স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে সম্ম্মুখে ধাবমান। পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় প্রধানত পোষাকী পোস্টমডার্ণ ধারায় এ সময়ের কবিদের আত্মপ্রকাশের তাগিদ তাই সঙ্গত কারণে অনুভব করা যায় যা সম্ভবত তাদের কবিতাকে অনির্দিষ্ট নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাস করে যারা পশ্চিমবঙ্গের পোষাকী পোস্টমডার্ণ ধারার অনুসরণে কবিতা লেখার কোশেশ করছেন, তাদের জন্য করুণা ভিক্ষা করা ছাড়া কিইবা করার আছে।

পোস্টমডার্ণ/ পোস্টকলোনিয়াল ডিসকোর্সের আলো যারা ভেতর থেকে গ্রহন করে দেশ ও ঐতিহ্যলগ্ন থেকে অখণ্ডতার সাধনায় নিবিষ্ট আছেন, তারাই বাংলাদেশ কী পশ্চিমবঙ্গে, কবিতার ভবিষ্যত নির্মান করবেন।

তথ্য:

১। কলিম খান, ‘শব্দার্থের বঙ্গীয় উত্তরাধিকার’, পরমা ভাষার বোধন ও উদ্বোধন, অফবিট পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০২

২। কলিম খান, ‘বাঙালি মনমরা কেন’, জ্যোতি থেকে মমতায়, হাওয়া ঊনপঞ্চাশ প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০২