কবিতা কোনও পারফর্মিং আর্ট নয় যে তার একটা প্র্যাক্টিস বলে বস্তু থাকবে: ভাস্করজ্যোতি দাসের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 28, 2012 7:58:21 AM

ভাস্কর জ্যোতি দাস, সম্পাদকঃ দুয়েন্দে ও iদুয়েন্দে (www.iduende.weebly.com)

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লেখেন?

ভাস্করজ্যোতি দাস: মানুষ খেলে তাকে পায়খানাও করতে হবে, প্রতিমুহূর্তে জীবন থেকে কত কিছু আমি খাচ্ছি তার ইয়ত্তা নেই, আমার কবিতা, শুধু কবিতা কেন, আমি তো ছবি আঁকি অভিনয় করি, অনেক কিছুই করি, আমার সমস্ত শিল্প ক্রিয়াই আমার জীবনকে হজম বা বদহজম যাই করি না কেন তার পায়খানা... সেই পায়খানা একদিন মাটিকে উর্বর করবে গাছের পাতাকে সবুজ করবে এইটুকু আশা... হয়তো পৃথিবীর অক্সিজেনের ভাঁড়ারে টান পড়া কিছুটা হ’লেও কমবে, কিছুটা হ’লেও অন্য কোনও মানুষ যদি নাও হয় আমি অন্তত আর একটু বেশি প্রাণ ভ’রে শ্বাস নিতে পারবো।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ভাস্করজ্যোতি দাস: কবিতা কোনও পারফর্মিং আর্ট নয় যে তার একটা প্র্যাক্টিস বলে বস্তু থাকবে, থিয়েটারের যেমন মহড়া হয়, ছবি আঁকার হাত আরও সূক্ষ্ম করতে কেউ পোট্রেট আঁকা প্র্যাক্টিস করতে পারে, এখানে সুযোগ নেই... শুধু চারদিকটাকে দেখে যেতে হয়, ব্লটিং পেপারের মতো শুষে যেতে হয়, প্রচুর কবিতা পড়তে হয়, আর বড়ো জোর বহুদিন লেখা না এলে অনুবাদ করলে লাভ হয়, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হ’লে মানুষ যেমন পেঁপে সেদ্ধ খায়...

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ভাস্করজ্যোতি দাস: সমসাময়িক বলতে কি বোঝানো হচ্ছে? যারা সমসময়ে শুরু করেছে না কি যারা সমসময়ে লিখছেন? সমসময়ে যারা শুরু করেছে বা তার পরে তাদের মধ্যে পার্থজিৎ চন্দ, সম্বিত বসু, ঋতম সেন, শ্রীজিৎ, অস্তনির্জন দত্ত, অরিন্দম রায়, দীপাংশু আচার্য, প্রশান্ত হালদার, সরোজ দরবার, শুভ্রনীল সাগর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়... আরও অনেকে, এইমুহূর্তে নাম হয়তো মনে পড়ছে না...

অগ্রজ যাঁরা এখনও জীবিত তাঁদের মধ্যে সুজিত সরকার, শঙ্খ ঘোষ, অনির্বান দাস, রনজিৎ দাশ, উৎপল কুমার বসু, বিশ্বনাথ পুরকাইত, নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, অংশুমান কর আরও অনেকে...

প্রত্যেকের লেখাই হয়তো আলাদা কারণে ভালো লাগে তাই ‘কেন’ বলা মুশকিল তবে মোটের ওপর বলা যায় এদের লেখা পড়লে আমার দৃষ্টি খুলে যায়, প্রত্যেকে সময় কিছু নতুন অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গীর আশা করতে পারি যাতে আমার বোধ ও অনুভূতি পুষ্ট হয়। (নামগুলো কিন্তু ভালোলাগার ক্রমানুযায়ী সাজানো নয়)

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ভাস্করজ্যোতি দাস: ব্যাক্তিগতভাবে কারও সব কবিতা ভালো বা খারাপ লাগা সম্ভব নয়, ক্রিয়েটিভ একটা জগতে যারা কিছু করতে এসেছে বা টিকে আছে তারা একটা সীমানা পেরিয়েই এসেছে যা এই ভাবে ভালো বা খারাপ লাগার উর্ধে, ওপরে ভালো লাগা মানে যাদের লেখা বেশি ভালো লাগে, আর যারা ওই তালকায় নেই তাদের খুব কম লেখা ভালো লাগে এই যা... তবে বাংলা বা বিশ্ব কবিতায় যে কারখানা আছে তার প্রোডাক্টগুলো আমার অপছন্দ, কারণ তা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, আগে থেকে থিয়োরি তৈরি ক’রে ক্রিয়েটিভ কিছু হয় না, ওটা মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ওটার প্র্যাক্টিস হয়। দলবেঁধে থিয়োরি তৈরি ক’রে কবিতা কেন কোনও শিল্পই হয় না, শিল্প জিনিসটা মানুষের একার অন্তরের কাজ, একসঙ্গে পায়খানা করতে বসলে পায়খানা চমকে যায়, নজর অন্যদিকে ঘুরে যাবে, তখন কোঁত না পেড়ে উপায় থাকবে না... কেউ মাথার দিব্য দেয়নি লেখার, নিজের জীবনের প্রথম লেখা মানুষের হয়তো সবচে দুর্বল লেখা কিন্তু ওর চেয়ে বিশুদ্ধ লেখা জীবনে আর হবে না... যে প্রথম লেখাটা নিয়ে মানুষ এই জগতে প্রবেশ করে সেখানে কিন্তু দল নেই থিয়োরী নেই, শুধু বিস্ময় আছে বাল্মীকির মতোঃ এ কী উচ্চারণ করলাম!

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ভাস্করজ্যোতি দাস: দশক হিসবে কবিতার আসলে কোনও চরিত্র থাকেনা, ওটা সমসাময়িক লেখকদের লেখনির যে দিকটা বেশি প্রতিফলিত হয় তার একটা এভারেজ হিসাব মাত্র... তবে নব্বই এর স্মার্ট কবিতা ও শূন্যের অর্থশূন্য শব্দের জালগিরি আমার অপছন্দ, পোশাকটা মানুষটাকে প্রকাশের জন্য, সে নিজেই যদি মানুষটাকে চাপা দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠে তবে তার চেয়ে নগ্ন থাকা ভালো, অনেকেই তখন প্রশংসা করে, এসে বলে জামাটা শাড়িটা দারুন হয়েছে, এটাকে নিজের প্রশংসা ভাবা মুর্খামি, তক্ষুনি পোশাকটা বদলানো দরকার... নগ্ন থাকলে মানুষ তবু বলে লোকটা অসভ্য... লোকটাকে বলে, গায়ের চামড়াটা অসভ্য বলে না কিন্তু... বাংলা কবিতা এতো সমৃদ্ধ কিছুদিন কবিতা না লেখা হ’লে কিছু ক্ষতি হবেনা... এমন কিছু কবিতা লিখুন যেটা ভালো বা খারাপ লাগে... কিছু লাগার উর্দ্ধে লেখা, লেখার-ই অপমান... জীবন্ত মানুষকে পোশাক পড়িয়ে পড়িয়ে দেখা যায়... মরা মানুষের পোশাক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট হয় না... ওটা অশোভন, রাজনীতি...

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ভাস্করজ্যোতি দাস: বর্তমানে ফারাকটা মিশে যাচ্ছে, তবে খুব কাছ থেকে আমি প’ড়ে ও বাংলাদেশের শূন্যদশক নিয়ে সংকলন ক’রে যেটা দেখেছি, বাংলাদেশের কবিতায় মুক্তি যুদ্ধের প্রভাব ভীষণ, এবং ভীষন ভীষণ সৎ লেখা, আর আবেগ তো অসাধারণ...

পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় সামাজিকতা ও বিপ্লবী কথাবার্তাকে ঘৃণা করা হয়, সুকান্ত তাই এখানে কবি নয়, নজরুল কবি নয়, তার চেয়ে ব্রা প্যান্টি লুঙ্গি নিয়ে যারা অবদমিত কাম প্রকাশ করে এখানে তারা নাকি কবি হিসাবে অনেক বড়ো...

আমি কিন্তু মূল গড্ডালিকা প্রবাহটা নিয়ে বললাম, ব্যাতিক্রম আছে, এবং তারাই বাংলা কবিতার মুখ...

তবে এককথায় পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কবিদের বেশিরভাগটাই কবিতার ইঞ্জিনীয়র, বাংলাদেশের বেশিরভাগ আজও চাষী...

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ভাস্করজ্যোতি দাস: ব্লগ একটা মাধ্যম, একটা মাধ্যমের যা দেওয়ার থাকে কম বেশি তাই দিচ্ছে...

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ভাস্করজ্যোতি দাস: এখনও অব্দি লিটলম্যাগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ১০ বছর পর সেটা আর থাকবে না এটা নিশ্চিত। আমি লিটল ম্যাগ ও ওয়েব ম্যাগ দু’টোর-ই সম্পাদনা করি...

ওয়েব এর সুবিধা হ’ল তা মুহুর্তে পৃথিবীর সমস্ত পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, খরচ কম বা ফ্রি, যে কোনও সময় ছাপার ভুল শুধরে নেওয়া যায়... এবং লেখক ও পাঠকের মধ্যে কমিউনিকেশন যা কিনা মুখোমুখি নয় অথচ সরাসরি... এ তে সত্যি কথা বলতে সুবিধা হয়, খারাপ লাগলে সরাসরি ব’লে দেওয়া যায় অনায়াসে...

বর্তমানে ইন্টারনেট এখনও অতোটা সর্বত্র পৌঁছায়নি, কবিরাও বেশিরভাগই কম্পিউটার-এ ততোটা সাবলীল বা স্বচ্ছন্দ নন... সময় লাগবে...

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ভাস্করজ্যোতি দাস: হাতে গোনা একটা কি দু’টো লেখা ভালো পাই আমরা... সাহিত্যের মূলগত কোনও লাভ হয় না... তবে একটা জিনিস হয় যা খুব গুরুত্বপূর্ণ... অন্তত পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে, বাংলাদেশের ব্যাপারটা জানিনা...

এর ফলে রোজকার জীবনে খবরের কাগজ পড়ার মতো স্বাক্ষর ব্যাঙালির, কবিতা বা সাহিত্য দেখা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়, এবং অভ্যাস তাকে স্বাভাবিক ক’রে তোলে, ঘরের ছেলেটা কবিতা লিখলে তার খাতা পুড়িয়ে না দিয়ে হয়তো কাগজে পাঠায়, ছাপলে গর্বিত হয়ে মাসি-মেসোকে দেখায়... ছেলেটা প্রেরণা পায়, যদি সে বড়ো কবি নাও হয়, সে একটা পাঠক হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের পাঠক বাড়ায়... আর কে না জানে এখন পাঠকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি!