কবিতা না লিখে আর তো কিছু করার নেই: ঊষসী ভট্টাচার্যের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 24, 2013 1:47:11 PM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

ঊষসী ভট্টাচার্য: কোন আান্দোলন বা উগ্রপন্থা নিয়ে আমি জন্মাইনি। আমার জন্মের কোন ঐতিহাসিক তাৎপর্য নেই। কোন ব্যতিক্রমী সময় বা ইতিহাস দাবি করেনি আমার জন্ম বা বেড়ে ওঠবার সময়ে । তবু কলমের কালি আর ডায়েরীর পাতা খরচের কাজ আমি বেশ তাগিদেই ছোট থেকে করে চলেছি। আমার লেখাকে কবিতা,গদ্য এসব নামে ডাকা টা ঘোর অবিচার হবে বোধহয়। এই লেখাকে সহজ কথায় ছন্নছাড়ার ইতিবৃত্ত বা পাগলের পাগলামি বলা যায়। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া কিছু কথা নেমে আসে কলমের সরণী বেয়ে। ইচ্ছে ,অনিচ্ছের সংগ্রাম বা চাওয়া, পাওয়ার বিভেদ সমস্ত কিছুর খসরাই আমার লেখার পাতায়। আমার লেখা পাগলামি গুলি বেশির ভাগই ‘কবিতা’ নামক প্রচ্ছদ, বলেন অনেকে। যদিও কবিতা বহু তপস্যা, বহু সাধনার ধন। সেই একাগ্র তপস্বিনী হবার যোগ্যতা আমার আছে কিনা জানিনা। আর কবিতা আমি লিখিনা, কবিতা আমার বুকে এসে বাসা বাঁধে, তখনই বাধ্য প্রেয়সীর মত আমার কলম চালনা। কবি জন্ম মাতৃ গর্ভে হয় কিনা আমার জানা নেই। আমি কেবল জানি টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে ফুটবলের মত এ প্রান্ত ,ও প্রান্ত ছুটে চলা জীবনে আর কিছু করার ছিলনা। সমাজ, পারিপার্শ্বিক চিত্র, মানব- দানব সংযোগ সব দেখে শুনে কালের হাতে মৃত এক পলাতক মানুষ ছুটে আসেন । দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ডায়েরীর পাতা ওলটানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা । আসলে একবিংশ শতকের এক নারী হয়ে ‘ফেমিনিসিম’ আওড়ানো বা সভা সমিতির নারীত্ব আমার ঠিক পোষায় না। ছোট বেলা থেকেই বাবা বলতেন ‘তুই বেটি ভারী বেয়াড়া’ । আদরের সেই কথাই আজ আমার চারিত্রিক তকমা। আমার লেখা বা কবিতা বা ভাবনার বৃষ্টিপাত ব্যাক্তিগত দৃষ্টি ভঙ্গি বা সামাজিক এলোপাথাড়ি ছুটে চলা সময়ে চূড়ান্ত হেনস্থা হয়ে বাঁচার বা বলার একমাত্র রাস্তা। ভাবনার সাগরে ডোবা কোন বড় সাহিত্যিক বা শিল্পী আমি না। যা চোখে দেখি, যা বুঝি বা যা বুঝতে চেষ্টা করি তাই আমি লিখি। সহজ-সরল-সাধারণ এক জবানবন্দী বা প্রতিবাদ হয়ে ওঠে সেই লেখা। তবু লিখি, লেখা ছাড়া বলা বা ভাবা সম্ভব না। প্রিয় কিছু কবির কবিতা বা হঠাৎ মনে দাগ কেটে যাওয়া কোন লেখা পড়েও লিখতে বসি। ভাবনার বারান্দায় রোদ্দুর কখন কিভাবে আসে বলা বেশ কঠিন।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ঊষসী ভট্টাচার্য: প্রিয় কবিদের কবিতা আমার বাঁচবার ও টিকে থাকবার একমাত্র সঙ্গী। সমসাময়িক লেখা সেভাবে বলতে পারব না। কারণ- বয়স তো লেখার ক্ষেত্রে বিচার্য নয়। বিচার্য সময়ের প্রাসঙ্গিকতা । সেই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও আমার সমসাময়িক । তিনি যেন আমরা ভাবনা গুলিকে কান ধরে কলমে নামিয়ে এনেছিলেন একদম প্রথমেই। তাঁকে বাদ দিলেও বহু কবি ও সাহিত্যিক আমার প্রিয়, যারা আমার ভাবার ও পথ চলবার পথপ্রদর্শক (যাদের নাম নিতে গেলে এই লেখা মোটামুটি একটা উপন্যাস হয়ে যাবে) ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ঊষসী ভট্টাচার্য: সাম্প্রতিক কিছু পত্র- পত্রিকা বা সাহিত্য বিষয়ক লিটিল ম্যাগাজিন গুলিতে বহু লেখা পড়ছি ও পড়ি । সাম্প্রতিক লেখায় প্রেম,সমাজ নীতি, ধর্মনীতি উঠে আসছে , ভালো লাগছে। তথাকথিত বিপ্লব, রাজনীতির প্রভাব, প্রতিবাদের স্বরূপ সাহিত্য – আমায় খুব আকর্ষণ করে। মূলত কবিতায় একটা নতুন ধারা বা গদ্যের খেত্রে মুক্ত গদ্য, সব কিছুই সাহিত্যের প্রগতির ই লক্ষণ। নব্বই, শূন্য বা প্রথম দশকের কবি সাহিত্যক রা এখন মূলত নতুন প্রজন্মের । যদিও আমি দশক বিশেষ বুঝিনা , দেশ ,কাল ,সময় পেড়িয়ে গেলে তবেই সাহিত্যের স্রষ্টা হওয়া যায় বলে আমি মনে করি। কিন্তু আজকাল কিছু নতুন লেখকদের লেখায় একটা নতুন ভাষার চল হয়েছে, যা মুখের ভাষা। অর্থাৎ জগাখিচুড়ি ভাষা। কিছু লেখক মনে করেন, যুবক যুবতী দের মুখের কথায় সাহিত্য অনেক বেশি সাম্প্রতিক। এটা নতুন কিছু নয় ঠিকই, কিন্তু ভাষার নিজস্বতা বোধহয় সামগ্রিক। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতে হলে, সেটা তো বাংলাই হতে হবে, তাই না? ।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ঊষসী ভট্টাচার্য: কবিতার কোন ফারাক আমার কাছে নেই, কবিতা টা কবিতা হলেই আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়। বাংলাদেশের বেশ কিছু পত্রিকা ,বই সংগ্রহ করে পড়ি। ভালো লাগে, এদেশের আর ওদেশের কবিতার পার্থক্য জানিনা,বুঝিওনা। কবিতাতো কবিতাই, ভাষা টাও বাংলা ... তাই ফারাক আছে বলেই বোধ হয়না।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ঊষসী ভট্টাচার্য: ব্লগ সাহিত্য ও ওয়েব ম্যাগাজিন এর মাধ্যমেও বেশ বাংলা দেশের কবিদের লেখা পড়ি, ভালো লাগে কখনো বা লাগেনা। সেটি নির্ভর করে আমার পছন্দ ও কবিতার ওপর কবির ওপর না। এখন আমরা অনেকেই ব্লগ সাহিত্যের সাথে জড়িত, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর একটা ইতিবাচক দিক অবশ্যই আছে। কিন্তু ফেসবুক,ব্লগ বা ইন্টারনেট এর সাহিত্য যদি হাততালি কুড়নোর জায়গায় পরিণত হয়, তবেই সমূহ বিপদ। লেখক কেই বুঝে নিতে হবে তার ক্ষমতা কতটা ও কোন টি স্তাবকতা ও কোনটি সঠিক পরামর্শ। ব্লগ থেকে নতুন ভালো লেখক উঠে আসছেন, নতুন দের লেখার একটা প্ল্যাটফর্ম ও এটি। কিন্তু বাংলা সাহিত্য এর থেকে কিছু পাবে, নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা বলবে সময়, তাই সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।লিটিল মগ্যাজিন বহু বছর ধরে সাহিত্য ও সাহিত্যিক দের প্রস্তুতি ও পথ চলবার অন্যতম প্রিয় রাস্তা , আমার ও তাই। লিটিল ম্যাগাজিন আর ব্লগ এর তুলনা মূলক আলোচনা ঠিক নয়। প্রিন্ট এর ক্ষেত্রে লিটিল ম্যাগাজিন আর ওয়েব এর ক্ষেত্রে ব্লগ, বিভাজন টা এমন রাখাটাই সঠিক হবে বোধহয় । তবে লিটিল ম্যাগাজিন এ যে মাপ কাঠি ও নির্বাচন পদ্ধতি আছে তা ব্লগ এর ক্ষেত্রে মানা হলে, ব্লগ আরও উন্নত হবে বলে আমার ধারণা।

আমার মধ্যে এক পলাতক সেকেলে জেদি মানুষের বাস। আমার লেখা তাই আমার শাড়ির মত। যে আমার আব্রু , আমার সম্মান ও। তাই যখন কুমীর ছিঁড়ে খায় রোদ চামড়া। রক্তে বাসা বাঁধে বিষাক্ত সবপোকা, ঘড় জোড়া তুমুল আন্দোলনে- বিক্ষিপ্ত হয় মনের ব্যালকনি। তখনই মুহূর্তের কবি জন্ম। যে জন্মায় কোন পরজন্মের মৃত্যুতে।