নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে করতে ফোকাসটা আর লেখার দিকে তাদের থাকে না: শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 30, 2012 5:37:30 AM

প্রকাশিত বই: শীতের অব্যর্থ ডুয়ার্স

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: কবিতা লিখি তার সোজাসাপটা একটি কারণ হল, না লিখে পারিনা বলে। এই কারণটা যদি যথেষ্ট মনে না হয় তাহলে আরো একটু খুলে বলতে হয়। কবিতা বা গদ্য বা গান বা ছবি বা ছায়াছবি ইত্যাদি আমার কাছে আমার মত বা ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম, যেখানে অনুভূতি, নান্দনিকতা এবং তথ্যকে ভিত্তি করে আমার কথারা বেরিয়ে আসে। হয়ত মানুষের সাথে, নিজের সাথে বা সামগ্রিকভাবে বলা ভালো জড়-জীবের সাথে কথোপকথনে বা আদানপ্রদানে সন্তুষ্ট হয়ে গেলে আর এই মাধ্যমগুলির প্রয়োজন হত না। কিন্তু মানুষ বৈচিত্র্যপ্রিয়, অতএব প্রকাশের বৈচিত্র্য এবং শিল্পে ভাবনা ও উপলব্ধির উপমাগুলির সামগ্রিক অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনে এইসব মাধ্যমগুলি প্রত্যেক স্রষ্টার হাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: কবিতা লিখে ফেলার জন্য কোনো প্রস্তুতির দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ কবিতার কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা ডেফিনিশন আমরা জানি না। এ একধরণের প্রকাশ, তবে কবিতাকে সঙ্গে করে বেঁচে থাকা বা কবিতা-যাপনের জন্য আমার মনে হয় বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে হয়ে চলা বিভিন্ন কাজ দেখা, শোনা ও পড়া দরকার। না হলে আত্মসমালোচনা, স্ববিরোধ এইগুলি তৈরী হয় না। তার সাথে সাথে এইগুলির মধ্যে দিয়ে গেলে একপ্রকার জারণক্রিয়া ভেতরে চলতে থাকে যা নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবিকে উৎসাহিত করে প্রেরণা দেয়, একপ্রকার তাড়া করে বেড়ায়। যেটা আমার মনে হয় আরো আরো এগিয়ে নিয়ে যায় কবিতাকে। অতএব এগুলিকে প্রস্তুতি না বলে অণুঘটক বা প্রেরণার জায়গা বলা বেশি উচিত বলে আমার মনে হয়।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: সমসাময়িক বাংলা কবিতায় শূন্য দশকের কবিদের হাত ধরে অনেক পজিটিভ চেঞ্জ এসেছে বলে আমি মনে করি। ভাষা ব্যবহার থেকে শুরু করে ফর্ম এবং কন্টেন্ট নিয়ে অনেক ভালোভালো এক্সপেরিমেন্টেশনের কাজ হচ্ছে। সকলের সব কবিতা সবসময় ভালো লাগে না, কিন্তু এমন অনেক লেখকই আছেন যাঁদের অনেক কাজ আমায় ছুঁয়ে গেছে। আর আমি এটাও মনে করি, শূন্য দশক এর সূচনা থেকেই আমরা দেখেছি কবিতা অনেক বেশী সাহসী হয়েছে, সাহসী বলতে আমি বোঝাতে চাইছি নিজের বলার ভাষা তৈরীর জন্য এক্সপেরিমেন্টেশনের সাহস থাকার কথা। প্রথাগত ধারণার কবিতা একটা মান রেখে লিখলে সহজেই মানুষের মনে ঘর করা যায় বা একটা জায়গা বানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু নিজের প্রকাশভঙ্গিমা তৈরী করে তা পাঠকের কাছে গ্রাহ্য ও ভালোলাগার বিষয় হিসেবে তৈরী করা এবং তার মাধ্যমে নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা বেশ কঠিন ও সাহসের কাজ বলে আমি মনে করি।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: খারাপ লাগে কবিতা নয়, কিছু কিছু কবির মনোভাব। বিজ্ঞাপনের বাজারে সবাই ওই আপনার প্রথম প্রশ্নটি নিজেকে করতে ভুলে যায় - কবিতা কেন লিখি? নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে করতে ফোকাসটা আর লেখার দিকে তাদের থাকে না। বিজ্ঞাপনটা জুতসই হল কিনা সেটাই আসল ভাবনার বিষয় হয়ে যায়। পাওয়ার পলিটিক্সটাও বেশ জরুরী এখানে। নামকরা পত্রিকার কবিতা-সম্পাদক, তিনি যদি নিজে প্রথিতযশা কবি বা সমালোচক হন, তবে তাঁর মনোমত কবিতা লিখে ওইসব পত্রিকায় জায়গা করে নেওয়ার একটা তুমুল প্রবণতা দেখি। একটা পত্রিকায় যে কবির একটা লেখা একরকম লাগল, অন্য পত্রিকায় দেখি তার ধারা, রূপ সব বদলে গেছে। এটাকে মেনে নেওয়া খুব কষ্টদায়ক, এটা একপ্রকার নিজের সাথেই নিজের বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয় আমার।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: এ'বিষয়ে আগেই খানিকটা বলা হয়ে গেছে। কয়েকটি কথা আরো বলা যেতে পারে সেই সূত্র ধরেই, এই সময়ের কবিদের কবিতার বিষয়ে উন্মাদনা বা উৎসাহ খুব চোখে পড়ার মতো। ছোটপত্রিকার জগৎ এবং আকার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হুজুগে হোক বা ভালোবাসায় তারা বেশ সচেষ্ট ও নিষ্ঠাবান হয়ে লড়ে যাচ্ছে। এটা খুব পজিটিভ একটা ব্যাপার। আমি অর্থনীতির ছাত্রী ছিলাম, তাই আরেকটা ব্যাপারও আমার মাথায় ঘুরপাক খায়, সেটা হল এইসবকিছুর অর্থনৈতিক দিকটা। অনেক প্রতিভাবান কবি তার সমস্ত সময় উৎসর্গ করতে পারেন না কবিতা লেখার প্রতি, কারণ কবিতা বা গদ্য লেখা তাকে জীবনধারণের রসদ জোগাতে পারে না। এক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির এই ক্ষেত্রে সফলভাবে ঢুকতে না পারাটা দায়ী, তবে এটাও ঠিক বাজারিকরণ অনেকক্ষেত্রেই শিল্পের বা শিল্পীর মানসিকতার ও সততারও ক্ষতি করে, কিভাবে করে, কেন করে এবং এটা না হওয়ার ব্যবস্থা কিভাবে করা যায় এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনার জায়গা রয়েছে। কবিতার মান নির্ধারণ কিভাবে হবে বা কারা করবেন সেটাও খুব ধোঁয়াশাময় ব্যপার কারণ আগেই যেটা বললাম যে এগুলির কোনো ধরাবাঁধা সংজ্ঞা আমাদের কাছে নেই, ব্যক্তিগত বোধ ও ভালোলাগার উপরে নির্ভর করে গোটাটাই, যেখানে আবার Bias বলে একটি বস্তুও ব্যাপকভাবে কাজ করে।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: মূল ফারাকটা ভাষা এবং এলিমেন্টের। বাংলাদেশের প্রকৃতি সেখানকার কবিদের লেখায় খুব বেশী করে উঠে আসতে দেখেছি, যেটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মফঃস্বলের কবিদের লেখায় খানিকটা আসে, কিন্তু তাও এখন খুবই কমে গেছে। শহুরে শব্দগুলি বা যাপন বেশী করে উঠে আসে। ভাষার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য তফাৎ রয়েছে। তৎসম শব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের সাহিত্যে খুব বেশী, যেটা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেকটাই রিপ্লেসড হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের কবিদের লেখায় অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহারও বেশ প্রচলিত হয়ে গেছে। বিদেশী সাহিত্য বেশী করে পড়া এবং বিদেশী ছবি দেখা ইত্যাদি এর পেছনে অনেকটাই কাজ করেছে। তাছাড়া ভারতীয় সিনেমা, থিয়েটার এবং লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্ট এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: ব্লগ তো একধরণের আদানপ্রদানের জায়গা, শেয়ার করার উপায়। আদানপ্রদান ও সমালোচনা সবসময়েই শিল্পকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে বলে আমি মনে করি।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: দুটোর জায়গা ও টার্গেট অডিয়েন্স তো আলাদা, এভাবে তুলনা চলে না। প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার দুটো স্পেস হল ছোটপত্রিকা ও ব্লগ। দুটোরই পাঠকদের এক একটি সেট আছে, কখনো সেটা ইন্টারসেক্ট করে, কখনো করে না। দুটোরই নিজের নিজের জায়গায় গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম, কোনোটাই কোনোটার জায়গা নিতে পারে না তবে ব্লগ আসায় বাংলা কবিতার রীচ বা প্রসার ও প্রচার আরো খানিকটা এগিয়েছে এটা খুব সত্যি।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী: দৈনিকগুলি যেহেতু অনেক বেশী মানুষের কাছে পৌঁছয় তাই সাধারণ মানুষের মনে এ'বিষয়ে উৎসাহও জাগে, এখানে সাহিত্য প্রকাশ পেলে তাও অনেক বেশী মানুষের কাছে পৌঁছয়। লেখক হিসেবে বেশী মানুষের কাছে নিজের কথা পৌঁছনো যায়, প্রতিবাদ বা উচ্চারণগুলি জোরদার হয়। এটা একধরণের উৎসাহও জোগায়। তাছাড়া বেশ কিছু দৈনিক তার জন্য পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন তা কোনো না কোনো ভাবে লেখককে সাহায্যও করে। অনেকের কাছে সেটাও বেশ জরুরী।