নব্বই দশকের কয়েকজনের কয়েকটি কবিতা ভালো : চন্দন চৌধুরীর সাথে অনলাইন আলাপ
Post date: Dec 27, 2012 9:14:58 AM
কাব্যগ্রন্থ :
যাবে হে মাঝি, দিকশূন্যপুর, লাল কাঁকড়ার নদী, কাকের ভাস্কর্য
উপন্যাস :
নীলতোয়া জোনাকি
ছোট গল্প :
আয়নাপাথর
শিশুতোষ ছোট গল্প : গোল্ডফিশ ও একটি প্রজাপতি, দুষ্টুরা দশ মিনিট আগে, হ্যালো ফড়িংমিয়া, শহর জুড়ে বাঘ-ভালুকের মিছিল, ভূতের বাচ্চাটা ক্লাসে এলে কাঁদে
ছড়া :
লাল ফড়িঙের বৌ
অনুবাদ :
নতুন ডানার উড়াল [বিশ্বের তরুণ কবিদের কবিতা], আরব বিশ্বের কবিতা, কাহলিল জিবরানের দ্য অনডারার
দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?
চন্দন চৌধুরী: আমার ভেতরে আরেকটা আমি আছে। সে আমিটাই মনে হয় আমার চেয়ে অধিক বাস্তবিক। তার যে কথা, উচ্চারণ, তীব্র অনুরাগ-তাই হয়তো সঠিক। দৃশ্যমান আমিটা যথেষ্ট কর্পোরেট। ভেতরের আমিটার যে কথা, দেখার যে সাহস, দৃষ্টিভঙ্গির যে চিরহরিৎস্বভাব... এসব কারণেই সে হয়তো কবিতা লেখে।
আমার মনে হয় একজন মানুষ একসঙ্গে অনেকগুলো সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকে। একটু ভালো করে জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, একেক ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের আচরণগত পার্থক্য অনেক। পাশাপাশি আলাদা চিন্তাও তাদের আলাদা করে দেয়। কখনো একটি বিশেষ সূত্রে থাকে মানুষ। অভ্যন্তরগত জটিলতা, যাপনের নানাবিধ সমস্যা থেকে মানুষ মুক্তি চায়। একসময় সে ধরা দেয় নিজের মূল সত্ত্বার কাছে। অনুভব করে নিজকে। আমার মনে হয় সেই সত্ত্বাটাই কবি। সেই সত্ত্বাটার কারণেই মানুষ কবিতা লিখে।
দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?
চন্দন চৌধুরী: কবিতা লেখাটা চর্চার বিষয়। চর্চাটাই দেখার চোখ তৈরি করে। কবিতাকে মনে করি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। একটি বিষয়কে নতুন করে দেখা। প্রশ্ন করতে পারেন, নতুন ভাবে দেখাটা কেমন? তাহলে আপনাকেও উল্টো প্রশ্ন করা যায়, তাহলে কেন আপনি আমার কবিতা পড়বেন? পৃথিবীতে অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। পুরোনো কথাগুলোকে কচলে তো আর কবিতা হয় না। দেখতে হবে নতুন দৃষ্টিতে। আর এজন্য চাই পঠনপাঠন। আমি আজ যে ভাবনাটা ভাবছি, হয়তো অনেক আগেই কোনো কবি সেটা ভেবেছেন। এবং তা নিয়ে লিখেও ফেলেছেন। যদি এমনই হয়, আমার লেখা কবিতা পড়া কী দরকার! নতুন করে বলতে, নতুন কিছু বলতে পারার কসরতের জন্যই পঠনপাঠন দরকার। তবে প্রস্তুতির শেষ নাই। পড়া আর প্রকৃতি অবলোকনই মূখ্য কাজ।
দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?
চন্দন চৌধুরী: একক কোনো কবির সব কবিতা ভালো লাগে এমন নয়। অনেকের কবিতার কিছু বিষয় ভালো লাগে। আমি কবিতায় টোটালিটি চাই। ঘোর চাই। ভালো লাগার ক্ষেত্রে আমি হয়তো একটু বেশিই হিসাবি। আমার ভালোলাগার বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ আপনাকে দিতে পারি। যেমন বিজয় আহমদের একক কোনো কবিতা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু তার পংক্তির যে মাতালতা, তা ভালো লাগে। সজল সমুদ্র ও মাহমুদ শাওনের কবিতার মধ্যে যে টোটালিটি, তা ভালো লাগে। আপনার এবং চন্দন সাহা রায়ের যে সহজবোধ্যতা, তাও ভালো লাগে। পাশাপাশি দেখেন, আমাদের পরে আসা তানিম কবির, আহমেদ শামীম, সালেহীন শিপ্রার কবিতায় ঘোর আছে। আরো অনেকের অনেক বিষয় আমার ভালো লাগে। এগুলো আমি শুধু উদাহরণের জন্যই বললাম। কিন্তু একজন কবি আমার প্রিয়, এমন বলতে পারি না।
দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?
চন্দন চৌধুরী: আমি মনে করি, একটা কবিতা আমাকে কিছু না কিছু একটা জানাতে চায়। একটা কবিতা যখন সেই মেসেজ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন আর ভালো লাগে না। আমাদের কেউ একজন লিখেছেন, কবিতার কোনো সারমর্ম থাকে না। তাহলে কী থাকে! চারদিক থেকে কিছু পংক্তি যোগ করে দিলেন আর বললেন, এটা পড়ো, কবিতা এমনই...। হাস্যকর। অনুভবের ভেতরে যদি কোনো টুংকারই না তুলতে পারে, তাহলে কেন কবিতা!
আমাদের সময়ে উৎকৃষ্ট কবিতা রচিত হয়নি। হয়তো হবে।
দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
চন্দন চৌধুরী: নব্বইয়ের কবিদের মধ্যে ভাঙনের চেষ্টা ছিল। ফলে ভাঙতে গিয়ে যেমন কিছু ভালো হয়েছে, মন্দটা হয়েছে তার চেয়েও বেশি। তাদের কাছ থেকেই শূন্যের কবিরা পেয়েছে কবিতার অবোধ্যদর্শন। ফলে কবিতার নামে অনেকেই পাথর বানাচ্ছে। নব্বই দশকের কয়েকজনের কয়েকটি ভালো কবিতা আছে। কিন্তু মহান কবি নেই। নব্বইয়ের কবিদের অনেক শিষ্যও আছেন শূন্যে এবং পরবর্তী দশকে। তারা প্রিয়’র তালিকা করে ভালোই চিৎকার চেঁচামেচি করে বেড়াচ্ছেন। মিডিয়াও সায় দিচ্ছে। তবে এর ফলাফল দেখা যাবে আরো তিন চার দশক পর।
দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?
চন্দন চৌধুরী: প্রাকৃতিক গাছ-গাছরা থেকে ওষুধ হয়, আবার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোও ওষুধ তৈরি করছে। প্রাকৃত ও কেমিক্যাল। দুই বাংলার পার্থক্য বোধ হয় এখানেই। আমাদের মাটিবর্তী ঘ্রাণ এবং ওদের টেকনিক্যালি এগিয়ে যাওয়া। এতে করে আমাদের কবিতায় কিন্তু বৈচিত্র্য অধিক। অনেক বাঁক আছে কবিতায়। তাদের কবিতায় এত বাঁক পাবেন না। ভুলেও পঁচা পাটের গন্ধ পাবেন না। গ্রামে গেলে যে সব বিচিত্র গন্ধ পাওয়া যায়-এপাড়ের বাংলা কবিতা তারই আধার। মোটকথা, গ্রাম, নদীভাঙনের মতো বৈচিত্র্যময় আমাদের কবিতা। তবে আমি কিন্তু ওদের কবিতাকে মোটেও খাটো করছি না। একটা বিষয় হলো, কবিতা মূলত নির্ভর করে যাপনপর্যায়ের ওপর। ওরা যেভাবে যাপন করছে, কবিতাও সেইদিকে যাচ্ছে। পরিপার্শ্বিক সবকিছুই কবিতাকে আক্রান্ত করে। টেকনিকে ওরা আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। আমরা যেখানে ছন্দ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি (অনেকে আবার ছন্দটা পারেনও না, তবে ছন্দহীনতার কথা বলেন, তাদের কথা আলাদা), সেখানে তারা রীতিমতো ভালোরকম ছন্দপ্রিয়।
দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?
চন্দন চৌধুরী: ব্লগ এখনো সাহিত্যকে কিছু দেবার জন্য প্রস্তুত হয়নি। তবে দেবে। কারণ এখন এর শৈশবপর্যায় চলছে। এই সময়েই যদি আপনি ব্লক থেকে বিশেষ কিছু আশা করেন তবে ভুল হবে। একদিন এমন সময় আসবে, ব্লগ অনেক কাজে আসবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে। অনেক সমৃদ্ধ হবে ব্লগ।
দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?
চন্দন চৌধুরী: আগেই বলেছি ব্লগ এখনো যোগ্য হয়ে উঠেনি। তবে এটি লিটলম্যাগের পরিপূরক হয়ে যেতে পারে। তা বিচিত্র নয়। কারণ এখনই দেখতে পাচ্ছি কিছু কিছু সাইট তৈরি হয়েছে। কিছুটা লিটলম্যাগ ধাচের। ব্লগ একটা দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে, সেখানে মতামতের সুযোগটা বেশি।
দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
চন্দন চৌধুরী: নব্বইয়ের দশকে দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে একটা জোয়ার ছিল। এখনও যে নেই এমন নয়। কিছুটা শ্লথই বলতে হবে। দৈনিকের সাহিত্য লেখককে প্রচারমুখি করতে পারে, কিন্তু লেখককে তৈরি করতে পারে না। ওই কাজটা আসলে লিটলম্যাগেরই। আমার নিজের কথা বলতে পারি। লেখা শুরু করেছিলাম দৈনিকে। এখনো যে লিখছি না, তা নয়। কিন্তু বেশি লিখছি লিটলম্যাগেই। লিখে যে স্বাছন্দ্যবোধ, তা লিটলম্যাগ ছাড়া দৈনিকের সাহিত্য পাতা দিতে পারে না। প্রায় সব লেখককেই দেখেছি লিটলম্যাগে লিখে এরপর দৈনিকে আসে। আমার ক্ষেত্রে হলো ঠিক উল্টোটা। আমি এখনও বলি, লিটলম্যাগই সাহিত্যজগতের বস্।