অজয় দাশগুপ্তের স্মৃতিকথা: দেয়ালের মত অনুভূতি মাখা মোম

Post date: Oct 18, 2014 4:30:38 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

হুলিয়া পড়ার পর থেকে নিজেকে আত্মগোপনকারী বিপ্লবী ভাবতে ইচ্ছে হতো। না প্রেমিক না বিপ্লবী পড়ার পর মনে হল আমারো কিছু রক্ত চাই। কিন্তু তখনো তাঁর প্রতি প্রেম জন্মায়নি। তিনি নিজেও নিজের প্রেমে পড়েননি তখনো। বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর কবির খাতা খুললো প্রিয় বন্ধু আবুল হাসানের অকাল মৃত্যুর পর। 'এত যে আমি ওখানে যাই ওখানে পাই কাছে/ ওখানে তার পায়ের কিছু চিহ্ন পড়ে আছে"। আস্তে আস্তে সে পদচিহ্নের রেখা ধরে তাঁর সাথে পরিচয়ের একটা জানালা খুলে ফেললাম। প্রথম যখন দেখা হল তখন তিনি বেসামাল এক কবি। বোহেমিয়ান। কৃত্তিবাসে পড়া হামদি বে'র মত। আমাদের চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়েছিল "তার আগে চাই সমাজতন্ত্র"। টালমাটাল আশির দশক। কবি এলেন প্রকাশনা উৎসবে। অনুষ্ঠান চলছে জমজমাট মিলনায়তনে উপচে পড়া মানুষ কবির প্রত্যাশায়। কিন্তু তাঁকে খুঁজেপাওয়া কি এতই সহজ? ভগ্নমনোরথ উদ্যেক্তাদের আশা যখন নিভু নিভু রিকশা চড়ে কোথা থেকে এসে নামলেন। বোঝা যাচ্ছিল খুব একটা স্বাভাবিক নন। কিন্তু মঞ্চে দাঁড়াতেই সব ঠিকঠাক। আবৃত্তি আর কথার তোড়ে ভাসিয়ে নিলেন, ভাসিয়ে দিলেন অন্যদের। তখনো আড্ডা দেবার মত সখ্যতা বা ভালোবাসা হয়নি আমাদের। কিন্তু নিরবে একটা বন্ধন যেন গড়ে উঠছিল কোথাও।

কালক্রমে প্রবাসী হবার পর সম্পর্কটা যেন আরো নৈকট্য লাভ করলো। ঢাকার বইমেলায় যাওয়াটা নেশার মতন। সেবার আমি আর সোহরাব হাসান ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম একসাথে।সোহরাব ভাই তখনো প্রথম আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের মত আলো আঁধারির মানুষ। বললেন গুণদাকে খবর দেই। মোবাইলে পাওয়া গেল কবিকে। সেদিন তাঁর আসার কথা না।তিনি এলে নির্দিষ্ট ষ্টলে বসেন। ভক্ত পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, বই কেনে অটোগ্রাফ নেয়। চাইলেই তো আর ঘুরে বেড়াতে পারেন না। তারপরও শুনেই বললেন অমুক ষ্টলে থাকো, আমি আসছি। তাঁর আগমনে আমাদের চাইতে খুশি সেই পাবলিশার। লম্বা লাইন দিয়ে পাঠকরা বই কিনছেন। আর আমরা আমাদের কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম ক্লাশ সেভেনের ছাত্র যেমন তেমনি দাড়িওয়ালা টুপি পরিহিত ষাট বছরের বাঙ্গালি ও তাঁকে পা ছুঁয়ে সালাম করছে। তিনিও সমানে আর্শীবাদ করে যাচ্ছেন।

এর দু'বছর পর এক সন্ধ্যায় সিডনির এক নাম্বার থেকে তাঁর উত্তেজিত কন্ঠস্বর। "আইসা পড়লাম অজয়"। এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের আমন্ত্রণে। কোনরকমে অনুষ্ঠান সারা। তারপর আবার লাপাত্তা। নামকরা এক রেঁস্তরায় নৈশ ভোজের আয়োজনে তাঁর দেখা নাই। হাসান ইমাম লায়লা হাসান সাথে তালেবর যত ব্যক্তির ভিড়ে কারো কারো কপালে ঘাম। কোথায় গেলেন কবি? যথারীতি বিলম্বে এসে সবার মনযোগ আর ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হতে সময়ে নেন নি। তাঁকে সবিনয়ে কিছু বলার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। বললেন "আপনারা কি আমাকে পাঁচ ডলার করে দিতে রাজী আছেন"? সবারতো চোখ ছানাবড়া! বলে কি এই কবি? তিনি ভাবলেশহীন । তাঁর এককথা কাল রাত থেকে ক্যাসিনোয় প্রচুর ডলার হেরেছি। মাথার ঠিক নাই। সবাই পাঁচ ডলার করে দিলে তবেই তিনি কথা বলবেন। খুব মজা লাগছিল। অন্তরে বাইরে হিপোক্রেট বাঙ্গালির মুখে এমন করে কালি মাখাতে পারে ক'জন? সেবার তাঁর সান্নিধ্য আর অন্তরঙ্গতায় আমাদের ভেতরের দেয়াল খসে পড়ে।

যার প্রমাণ মিললো কয়েক বছর পর। এবার আসার আগে থেকেই জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ই চলে এলেন । কোন কথাবার্তা ফর্মালিটিজ না সোজা বেডরুমে দুপুরের ঘুম। ঘুম থেকে জেগে হালকা খাবারের পর জীবনের অনেক স্মৃতি রোমন্হন করেছিলেন কবি। বসার জন্য চেয়ার পর্যন্ত বেছে নেননি। সোরআয় আধোশোয়া স্বকন্ঠের কবিতাটি প্রশান্তের নীল জলের মত তার দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছিল সবার মনে। জীবনের ওঠাপড়ায় পোড় খাওয়া নির্মলেন্দু গুণকে কাছে না পেলে বা সান্নিধ্য না পেলে বোঝা যেতো না তাঁরভেতরে বিরাট এক শিশুর বসবাস। আড্ডাবাজ কবির কৌতুহল আর রসবোধ ও দারুণ। খেতে বসে বলেছিলেন ডাল ভাত সবজী আর যেকোন এক প্রকারের মাছের বাইরে আর যে কোন খাবার মানেই অতিথিকে আসলে খেতে না দেয়া।

জীবনে অনেক বড় কবি সাহিত্যিক আর নামজাদা মানুষের সাথে আড্ডা দিয়েছি। সান্নিধ্য পেয়েছি এমন রাজনীতি সচেতন অথচ আপদমস্তক কবি দেখিনি। প্রেম তারুন্য আরশিল্পবোধে টইটুম্বুর এই কবি যখন হৃদয় সংক্রান্ত জটিলতায় খবর হয়ে ওঠেন মুষড়ে পড়ি। বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে এখন তেম করে কবিতা লেখা হয়না। আমাদের শিল্প সংস্কৃতিতে কর্পোরেটের আগমন অনেক সারল্য আর বেদনাকে শুষে ম্লান করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা অকপট নির্মোহ কবি জন্মায় না আর।

সে অর্থে তিনি ও তাঁর সাহচর্য আমার জীবনের দুর্লভ অনুষঙ্গ। যতদিন যায় দেয়ালের মত অনুভূতিমাখা মোমে তিনি আরো নিবিড় ও আপন হয়ে ওঠেন। দীর্ঘায়ু হোক আমাদের এই প্রান্তিক মানুষের কবি।।