বাংলাদেশের কবিতা যতটা বাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের কবিতা ততটা বাঙালি নয়: কবি শ্রীশুভ্রের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 26, 2012 4:22:50 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

শ্রীশুভ্র: কেন কবিতা লিখি ভাবতে বসলে মনে হয় কেন বেঁচে থাকি? নিশ্বাস নিই? উপায় নেই বলেই তো। কারণটা এক কথায় তাই। ঐ লেখার মধ্যে দিয়েই চারপাশের বহতা সময়ের সাথে যোগাযোগের একটা সেতু তৈরি হয়ে যায়। আর সেই সেতুতেই ছুঁয়ে থাকি বিশ্বজীবনকে। বিশ্বজীবন আর আমার ব্যক্তিজীবনের মধ্যে একটা নৈর্ব্যাক্তিক মিলন হয় বলেই আমার অনুভব। সেই অনুভবের প্রবাহই আমার কবিতা। অন্যকিছু না। আর সেই ভালো লাগাটাই আমাকে লেখায়। তাই লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

শ্রী: আমার প্রথম উত্তরের মধ্যেই এর উত্তর আছে।

কবিতা অনেকটাই মানুষের রূপ সৌন্দর্যের মতোই স্বাভাবিক বিকাশ। সেটাকে যত্নকরে লালন করা যেতে পারে।এইটুকুই। পরীক্ষার প্রস্তুতির মতো এর কোনো সাধারণ টিপস্ হয় না।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন? সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

শ্রী: এইটি আমার কাছে জানতে না চাইলেই ভালো। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর দেবার অধিকারী নই আমি। আমার কাব্য পরিক্রমা শামসুর রহমানের পর আর এগোয় নি বিশেষ। ফলে সত্যি বলতে কি সমসমায়িক বাংলা কাব্যধারার সাথে আমার পরিচয় এতোই সামান্য যে তার উপর ভিত্তি করে কিছু বলা ঠিক নয়।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

শ্রী: হ্যাঁ, গত দুই দশকে পৃথিবীর বুকে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম গোটা বিশ্ব একটি মাত্র দেশের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা লিপ্সার অধীনস্ত হয়েছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন নামক ছেলে ভুলানো ছড়ায় মজছে বিশ্ব বিবেক। সেইখানে নোঙর ফেলেছে এ সময়ের কবিতা। জানিনা হয়তো আমার ভুল হতে পারে, তবে মনে হয় ঠিক এই সর্বনাশই ঘটেছে বাংলা কাব্যেও।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

শ্রী: হ্যাঁ পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার মধ্যে একটা মস্ত বড় ফারাক হল, বাংলাদেশের কবিতার মধ্য বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই প্রথিত আছে। পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় যে সঙ্কটের ছায়াপাত ঘটেনি কখনো। এবং বাংলাদেশের কবিতা যতটা বাঙালি, পশ্চিমবঙ্গের কবিতা ততটা বাঙালি নয়। এছাড়া আঞ্চলিকতার বিভাজন, ভাষার উপর আরবি- ফার্সি ভাষার প্রভাব এবং ধর্মীয় ভাবাবেগে বাংলাদেশের কবিতা বিশিষ্টতার দাবী করতেই পারে। আরও একটি পার্থক্য অনুভব করি ব্যাক্তিগত ভাবে; সেটা হল বাংলাদেশের কবিতা ততটা আকাদেমিক নয় পশ্চিমবঙ্গের মতো।

পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় মেধার বিচ্ছুরণ যতটা, বাংলাদেশের কবিতায় হৃদয়াবেগের স্বতঃস্ফূর্তটা ঠিক ততটাই বেশি।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

শ্রী: দেখুন ব্লগ একেবারে হাল আমলের মাধ্যম। প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকরা ব্লগে এলেও তাঁরা তাঁদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন বা করছেন মাত্র।

কিন্তু বিপুল পরিমাণ মানুষের কাছে ব্লগ একটা কার্যকরী এবং অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এবং তাদের মধ্যে এই বিষয়ে আগ্রহের প্রাবল্যও বেশি। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হলেও আমার বিশ্বাস এই বিপুল পরিমাণ লেখালিখির মধ্যে থেকেই নতুন যুগের যুগন্ধর বেড়িয়ে আসবেন তাঁর মৌলিক বাণী নিয়ে। এবং ব্লগ হয় উঠবে বাংলা সাহিত্যের যথার্থ আঁতুর ঘর। তবে সে এখনো কয়েক দশক সময়ের কাজ।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

শ্রী: লিটিল ম্যাগ এখনো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার ঐতিহ্যের কারণেই। সেখানেই আছে গবেষনার পরিসর।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

শ্রী: যেহেতু বর্তমান কাব্যধারার সাথে আমার পরিচয় নিবিড়তর নয় তাই এই বিষয়ে আমার অভিমত অর্বাচীনের মতোই শোনাতে

পারে। তবে ব্যাক্তিগত পর্যবেক্ষন থেকে মনে হয় আমাদের দেশে কোনোকালেই দৈনিক পত্রিকায় সিরিয়াস সাহিত্য চর্চা হয় নি। আর সেটাই স্বাভাবিক। দৈনিকের প্রয়োজন অন্যতর। তবু সিনেমা হলে সাপ্তাহিক মর্নিং শো র মতোই দৈনিকেও সাহিত্য নিয়ে কাজকর্ম কিছু হয়ে থাকে।

কিন্তু সেই বিশ্বায়নের হাত ধরেই বাংলার সাহিত্য পত্রিকা ক্রমশ তার পাঠক হারাচ্ছে। ফলত দৈনিকে অণুসাহিত্য চর্চার একটা প্রচলন যে ক্রমশ বৃদ্ধির পথে, সে বিষয়ে সহজেই অনুমান করা যায়।

পরিশেষে একটা কথাই বলবো, মাধ্যম যাই হোক সাহিত্য মূলত জীবন চর্চার গভীরেই প্রোথিত!