গোলাম মোর্শেদ চন্দনের স্মৃতিকথা ভালো থেকো বাবা ভালো থেকো

Post date: Dec 20, 2014 5:44:12 PM

বাবাকে মনে পড়ছে খুব । বিশেষ করে যে দিন মারা যান তিনি । আমি তখন অফিসের কাজে ১ মাস যাবৎ চট্রগ্রাম । বাবা বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে বার বার ফোন দিচ্ছেন । ঢাকায় আসার সুযোগ হচ্ছিল না । কিন্তু বাবা খুব অস্থির হয়ে উঠছিলেন । তাঁর শুধু একটাই কথা তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে । বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে ঢাকায় এসেছি শুধু তোমাদের দেখতে । তোমাদের বলতে আমিও আমার ছোট বোন তুলি । এর আগে কখনোই তাঁকে এমন অস্থির হতে দেখিনি । চট্রগ্রাম থেকে সকালে বাসায় ফিরে দুজন এক সাথে জুমার নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খাই । একান্তে দুজন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলি । বাবা আমার কাছে একটা আবদার করেন । আবদারটা হলো মায়ের সাথে আমি যেন তাঁকে মিলিয়ে দেই । আমার মায়ের সাথে বাবার কোনো সম্পর্ক ছিল না কারণ বাবার দ্বিতীয় বিয়ে । বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৯৮২ সালে আমি তখন ৩য় শ্রেণির ছাত্র তুলির বয়স মাত্র ৬ মাস । সেই থেকে মা আমাদের নিয়ে মামাদের বাড়ি চলে আসে । মায়ের বয়স তখন বড় জোর ২৭-২৮ বছর । মাকে বিয়ে দেয়ার জন্য মামা তাঁর সব ধরনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন । সেই থেকে মা আমার একা ।

বাবা বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন মায়ের সাথে দেখা করতে । মা আমার বাবাকে ক্ষমা করতে পারেননি মৃত্যুর আগঅব্দি । অথচ মা আজ বাবার জন্য মানসিক ভারসাম্যহীন ।

১৯৮৪ সালে বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর মাত্র একবার দেখা হয় ১৯৯০ সালে । সে বছর আমি s.s.c পরিক্ষার্থী । তারপর ২০০২ সাল । বাবা কিভাবে আমার অবস্থান জানেন আমি জানি না । ১৯৯০ সালে বাবাকে যখন দেখি তখন বাবা ছিল আমাদের অত্র অঞ্চলের সব চেয়ে সুদর্শন যুবক । ২০০২ সালে আমি তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত (চাকরীর সুবাদে ) । বাবা ICD (কমলাপুর) তে এসে আমাকে খুঁজতে থাকে দু'একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে আমাকে পেছন থেকে চন্দন বলে ডাক দেয় । আমার উত্তরটা ছিল এমন 'ভাই আপনি দাঁড়ান আমি আসছি ' । আসলে বাবাকে সেদিন আমি চিনতে পারিনি । তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল বাবা তখন দাড়ী রেখে অনেক বেশী বয়স্ক হয়ে উঠেছেন আমার অলখ্যে । সেদিন তাকে বাসায় নিয়ে আসতে ভীষন যুদ্ধ করতে হয়েছিল নিজের সাথে । মা এটাকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখেননি । তাঁর কাপড়চোপর এতোবেশী নোংরা ছিল যে বলে বোঝানো যাবে না । এভাবে তাঁকে দেখতে হবে কখনোই চিন্তা করিনি । এরপর থেকে ২/১ মাস অন্তর বাবা আসতেন গ্রাম থেকে । বাসায় অবস্থান করতেন ৮/১০ দিন । মা কখনোই সামনে যেতেন না । মায়ের ১টি অনুরোধ ছিল আমি যেন তাঁকে টাকা পয়সা না দেই । কেননা টাকা দিলে তিনি আমার সৎ মা এবং সৎ ভাইবোনদের পেছনে ব্যয় করবেন । যা মা মেনে নিতে পারবেন না । আমি মায়ের সে অনুরোধ রাখতে পারিনি । প্রায়ই গোপনে মা ও ছোটবোনকে না জানিয়ে টাকা দিতাম । বাবা আবদারটা আমি রাখতে পারিনি । কারন মা চাননি তার সাথে পূণরায় এক হতে ।

বাবা ডায়বেটিসের রোগি ছিলেন । কিন্তু ফাক পেলেই মিষ্টি খেতেন । দুপুরে একসাথে জুমার নামাজ পড়ে খেতে বসি । খাওয়া শেষ হতেই বললেন আজ বাড়ি যাবেন । আমার কাছে খুব বেশী টাকা ছিল না । তাছাড়া অনেকদিন চট্রগ্রাম থাকায় বেতন তোলা হয়নি । ঐসময়টায় আমি নিজের কাছে টাকাপয়সা বেশী একটা রাখতাম না । সব টাকা দিয়ে দিতাম মাকে । বাবাকে খরচ বাবদ ৫০০ টাকা দেয়া হলো । বোনের যুক্তি হলো বাড়ি যেতে তার সর্বসাকুল্যে খরচ ২০০ টাকা । তারপরও লুকিয়ে আমি আরো ৫০০ টাকা দেই । বাবা ২.৩০ মিনিটের বাসে করে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দিশ্যে রওনা হন । কিন্তু বাবা ছিলেন মারাত্মক অসুস্থ বাসার কাউকে জানাননি সেটা । ডায়বেটিসের রোগি অথচ আগের রাতে অতিরিক্ত রিচফুড খাওয়ার জন্য পাতলা পয়খানা হয় । বাসে বসেই ৪/৫ বার পায়খানা হয় । বাসের লোকগুলো সবাই তাঁকে রেখে যাওয়ার মত দেন । বাসে ২/৪ জন পরিচিত ছিল বাবার তারা বাবার নাম বলায় সবাই মেনে নেয় । পাটগাতি বাসস্টপে বাস গিয়ে পৌছায় ১০টা নাগাদ । বাস থেকে নেমে সোজা হসপিটালে ভর্তি হয় । দুঃখ জনক হলেও সেদিন রাতে আমি মোবাইল বদ্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলাম । সকালে ফোন খোলার সাথে সাথে বাবার মৃত্যু খবর জানতে পাই ।

মা ও ছোট বোন তুলি বিলাপ করে কাঁদতে থাকে আমি তখন বোঝানোর চেষ্টা করি। অফিসে বসকে ফোন দিয়ে জানাই । বস তাঁর গাড়িটি পাঠিয়ে দেন । আমরা টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই । পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা । বাড়িতে যাওয়া মাত্র আবার কান্না ও বিলাপে মাতোয়ারা ।

তখনও আমি অশ্রুহীন পাথর । বাবার ৩য় জানাজাও শেষ । দাফনের সব রকমের প্রস্তুতি শুধু । শেষ বারের মতো বাবাকে দেখানোর জন্য মুখটা খোলা হল এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না । এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো কবরের কাছে । বড় সন্তান হিসেবে আমি যখন কবরে নামি বাবাকে শোয়ানোর জন্য আমার সারা শরীর একটা শীতল আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল । মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তির স্থান হলো চিরনিদ্রা ।

সেই থেকে সৎমা ও ভাইবোনদের পুরো দায়িত্ব আমার উপর । এখন আর মা কোনো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে না ওদের এবং তুলিও ।