কাজী রাহাতের স্মৃতিকথা: আমার প্রাইমারি স্কুলের খণ্ডচিত্র

Post date: Dec 26, 2014 4:26:56 PM

প্রাইমারি স্কুলটি ২ কিলো দূরে বলে ছোট ওয়ান ও বড় ওয়ান পড়া হয়নি আমার। একটু বড় হয়ে একবারে ক্লাশ টু তে, ১৯৭৬ সালে। মাটির সড়ক বয়ে বয়ে হেঁটে যাওয়া। শুকনা দিনে হাঁটু বালি আর বর্ষা মৌসুমে কাদা ঠেলে স্কুলে যাওয়া। লিকলিকে গড়নের শরীর নিয়ে ২ কিলো পথ বহুদূর মনে হত। তাও সময়মত পৌঁছে যেতাম স্কুলের মাঠটি বড় ভাললাগত বলে।সে সময় মর্কিনিদের বিস্কিট, গুঁরো দুধ ও ছাতু দেয়া হত মাঝে মধ্যে। সেদিন আনন্দের সীমা থাকত না। স্কুলের ছাত্র সংখ্যাও বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যেত সেই সেইদিনগুলোতে। অন্যান্য দিন টিফিনের জন্য পেতাম ১০ পাই। দু’টি বরফ (আইসক্রিম) হত তাতে। কোন দিন বাড়ির পাশের দোকান হতে ৫ পয়সার ছোলা ভাজা কিনে খেতে খেতেস্কুলের রাস্তা শেষ হত। ছুটির সময় বরফ কিনে ফিরতি পথ।মাঠের পাশের বিশাল দু’টি লিচু গাছের নিচে সকলকে জড়ো করে নামতা পড়াতেন স্যার। আমার ডাক পড়ত দুই এক কে দুই.... সুর করে পড়ার জন্য। তখন ২০ এর ঘর অবধি নামতা শুধু আমারই মুখস্ত ছিল। আমার বলার সুর ধরে সকলে যখন নামতা পড়ত তখন খুব আনন্দ পেতাম। নিজেকে মাস্টার মাস্টার মনে হত। তখন পাড়ার এক বাড়িতে মেহের দাদার কাছে বাধ্যতামূলক কায়দা পড়তে যেতে হত। সবার চাইতে আগে পড়াটা ধরতে পারতাম বলে দাদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। রোজার কোন এক দিন বাবা ডেকে বললেন অযু করে আসো। তারপর বাবা কায়দা নিয়ে পড়াতে বসলেন। আজব এক কায়দায় তিনি কায়দা পড়াতে লাগলেন। আমি সে আসরেই কায়দার শেষ পৃষ্ঠাও শেষ করলাম। তারপর ঐ আসরেই সিপারা এবং শেষে কোরআন এগিয়ে দিয়ে বললেন পড়। আমি পড়তে পারলাম। তিনি খুশি হয়ে বললেন যাও ছুটি। তার পর হতে আমার আর মক্তবে যেতে হল না। কিন্তু মক্তবের সন্ধ্যাগুলোকে খুব মিস করতে থাকলাম।স্কুলে হাতের কাজ দিতে হত বার্ষিক পরীক্ষায়। আমি মাটি দিয়ে সুন্দর নৌকা বানিয়ে নিয়ে যেতাম। কিন্তু নম্বর বেশি উঠত না। যারা ঝাড়ু, বদনা, মাদুর ইত্যাদি কিনে কিনে দিত তাদের নম্বর বেশি উঠত। আমার সহপাঠি দূরন্ত হামিদুল আমার থেকে বয়সে ৩/৪ বছরের বড় ছিল। হাতের কাজের দিনে সে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট কিনে নিল আমাদে সাথে করে নিয়ে। আমরা তো অবাক, কি করবি এটা দিয়ে? হামিদুল বলল, আমার হাতের কাজ। হাতের কাজ হিসেবে স্যার সেদিন সত্যি সত্যি সেটি গ্রহণ করেছিলেন। আমরা দূর থেকে হামিদুলের শাস্তির পরিমাণ নিয়ে যল্পনা কল্পনাকরছিলাম কিন্তু কোন শাস্তি নয়, হামিদুলকেও নম্বর দেয়া হল। ক্লাশ ফোরে আমাদের ক্লাশ টিচার ছিলেন আবুল স্যার। খুব কড়া মাষ্টার বলে খ্যাতি ছিল এবং অংকের জাহাজ বলা হত তাঁকে। আমাকে তিনি খুব ভালবাসতেন। তিনি যে কড়া তা আমি বুঝতে পারতাম না। তাঁর ক্লাশ সকলেই দুরু দুরু বুকে করত কারণ তিনি ছড়ি ছাড়া কখনোই থাকতেন না। ক্লাশে পড়া না পারলে যে পেরেছে তাকে দিয়ে কান মলিয়ে নেয়ার অভ্যাস ছিল আবুল স্যারের। কান মলার পর চলত বেতের ব্যবহার। একদিন ক্লাশে অনেকেই পড়া পারল না। ফার্স্ট বয় এবং ক্যাপনেট হিসেবে আমার অনেক দায়িত্ব ছিল। সেদিন দায়িত্ব পড়ল যারা পারেনি তাদের কান মলিয়ে দিয়ে গালে একটি করে চড় কষানোর। এ কাজটি আমার ভাল লাগত না। কিন্তু স্যারের হুকুম তালিম করতেই হবে। হামিদুলের কান ধরতে হলে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে আমাকে লম্বা হতে হত। ওর কাছে যেতেই ও ফিস ফিস করে আমাকে বলল, জোড়ে দিলে রাস্তায় তোকে মজা দেখাব। আমার ভয় লেগে গেল। তা ছাড়া ২ কিলো পথ চলতে সে নানাভাবে আমাকে সাহায্য করত। আমার বই ভারি লাগত বলে কিছুটা বই বরাবর ওর হাতে নিত। আমি কান মলার নাম করে কানে হাতটি ঘুরিয়ে নিলাম আর আলতো করে গালে চর কষালাম। তার পরের জনদেরও সেদিন তাই করলাম। এবার সকলকে স্যার বসতে বললেন। সকলে বসলে স্যার ডাকলেন রাহাত, এদিকে এসো। স্যারের কাছে যেতেই স্যার কষে থাপ্পর লাগালেন আমার গালে। আমার ঘাড় ঘুরে গেল থাপ্পরের আঘাতে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভারি চর ছিল সেটি। ফ্যাল ফ্যাল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যার বললেন, এইভাবে চর কষাতে হয় বুঝলে? বুঝলাম হামিদুলের সাথের সমোঝতা স্যার খেয়াল করেছিলেন। ২ কিলো পথ পেরুতে আমাকে অনেক রকম ভয়কে ডিঙাতে হতো। পথের কুকুর ও বেঁধে রাখা গরু থেকে ভয় পেতাম। পাটের সময় পাটের পাতা খাওয়ার জন্য শঁয়ো পোকারা রাস্তা সয়লাব করে ঘুরে বেড়াতো। সেসব পাশ কাটাতে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। বড় ভয় ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা মীর সাহেবের পুকুর পার হওয়া। সকলে বলত পুকুরটি দোষানা। তার চাইতে বড় ভয় ছিল জলিল পাগলের। পুকুরের পাশের কালভার্টে বসে থাকতো আর আপন মনে বিরবির করত। দূর থেকে দেখতে পেলে আমরা সকলে জড়ো হয়ে এক সাথে পাগলকে পার হতাম। এক দিন আমি একা পড়ে গেছি। সকলে চলে গেছে অথবা পিছ পড়েছে। দূর থেকে দেখতে পেলাম কালভার্টের উপর জলিল পাগলা বসে আছে। আমার বুক ধকধক্ করতে লাগলো। আস্তে আস্তে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছি। আর একটু হলে পাগলের এড়িয়া পার হয়ে যাব। এমন সময় পাগল উঠে দাঁড়লো। ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকলো। আমি ঘেমে একাকার। পাগল আমার বুক পকেট থেকে কালি ওয়ালো ঝরনা কলম তুলে নিল। আমি ভাবলাম কলম গেছে যাক, এখন পালাই। পাগল কলম খুলে হাতের তালতে কিছু কালি ঢেলে নিল। হাতে দেখলাম ঘা। ঘায়ে কালি মাখতে মাখতে বলল, এবার ঘা ভাল হয়ে যাবে। কলম লাগিয়ে আমার পকেটে দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করল যাও। তারপর থেকে আমার জলিল পাগলের ভয় ভেঙে গেল।