প্রাতিষ্ঠানিক পত্র-পত্রিকা খুললেই প্রকাশিত মলমূত্র চোখে পড়ে: সাম্য রাইয়ানের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Oct 29, 2012 7:22:13 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কবিতা লিখেন কেন?

সাম্য রাইয়ান: আনন্দের জন্য। স্রেফ আনন্দের জন্য। আর কিছু না— কিচ্ছু না। একটা চিন্তা লেখার পর (তা সে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিংবা এন্টি কবিতা, এন্টি গল্প, এন্টি উপন্যাস এন্টি প্রবন্ধ, নভেলা বা যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন) আমার মধ্যে যে আনন্দের সৃষ্টি হয়, অহংভাব তৈরি হয়— তার তুলনা কী—! পরবর্তীতে যদিওবা এই লেখার অধিকাংশই জায়গা করে নেয় কাগজের ঝুড়িতে। তাৎক্ষণিক। তবুও, লেখার সময় যে অফুরন্ত আনন্দ পেয়েছি এর অধিক কিছু পাবার নেই, আশা করিনা। এইসব আনন্দযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যসৃষ্টি করি।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

সাম্য রাইয়ান: প্রস্তুতি—! কবি হওয়ার প্রস্তুতি নাকি—! বাহ্ বেশ মজা তো—! কবি হওয়ার জন্য ‘প্র-স্তু-তি’...

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

সাম্য রাইয়ান: শুরুতেই সমসাময়িক শব্দটার বিষয়ে আমার চিন্তা পরিষ্কার করতে চাই। শিল্পজগতে আমার ‘সমসাময়িক’ বিচার করব আমি সৃষ্টিযোগ্যতা দিয়ে। আমি যখন আবুল হাসানের কবিতা পড়ি, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়ি, জীবনানন্দের কবিতা পড়ি তখন এঁদেরকে আমার পুরনো বলে মনে হয় না, সমসাময়িক।

আবার অনেক তরুণ বয়সীর কবিতা পড়ে মনে হয়, এ ব্যক্তি অনেক পুরনো; আমার আগের কালের। এর জৈবিক বয়স যতোই কম হোক—শিল্পজগতে এ আমার সমসাময়িক হতেই পারে না।

ভালোলাগা কবির তালিকাটায় রয়েছেন আবুল হাসান, আরণ্যক টিটো, সুহৃত শহীদুল্লাহ্, নাভিল মানদার, আহমেদ নকীব, রাশেদুন্নবী সবুজ, শুভ্র সরখেল, মলয় রায়চৌধুরী, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র, লিন্ডা মারিয়া বারোজ, শামীম কবির, চঞ্চল নাঈম, ডায়ানা ডি প্রিমা, সঞ্চয় প্রথম, হুমায়ুন আজাদ, অনুপ চণ্ডাল, শাহেদ শাফায়েত, ফ্রাঙ্ক ও’হারা, বিষ্ণু বিশ্বাস, রাইনার মারিয়া রিলকে, পাভেল মাহ্মুদ, আহমেদ মওদুদ, মনজুরুল আহ্সান, শামীম সৈকত, শাহ্ ফরিদ, বোদলেয়ারসহ আরো আরো বেশ কয়েকজন, যাদের নাম এই মূহুর্তে মনে নাই..

নদীতীরে দাঁড়ালে হুবুহু বাতাস যে কারণে ভালো লাগে, এ-ই কবিদের প্রকাশিত অধিকাংশ কবিতা ঠিক সেই কারণেই ভালো লাগে।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

সাম্য রাইয়ান: বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিক পত্র-পত্রিকা খুললেই তো বস্তাপঁচা শব্দের, প্রকাশিত মলমূত্র চোখে পড়ে। এদের নাম— কিংবা লেখা— কোনটাই মনে নেই— থাকে না, হারিয়ে যায়।

পুঁজের মতো, চতুর্দিকে এতো এতো আবর্জনা— ঘেন্না ধরে যায়।

খারাপ লাগার কারণ, বলি গু-য়ের গন্ধ যে কারণে খারাপ লাগে, এদের লেখাও সেই একই কারণেই খারাপ লাগে।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সাম্য রাইয়ান: একটু অবাকই হলাম প্রশ্নটা শুনে। নয়’র দশককে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এটা ভুল, মিথ্যা। আর শূন্যকে দেখেছি শেষের দিকে, স্বল্পমাত্রায়। এই প্রশ্নটা, আমার সম্পর্কে না জেনেই করা হয়েছে বোধ করি; মিথ্যায় অপমানিত বোধ করি; প্রশ্নে উত্তর দেয়া নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। —দোল খায়।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

সাম্য রাইয়ান: শিল্পক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল টাইম এন্ড স্পেস।

একজন শিল্পী কোন সময়ে শিল্পচর্চা করছেন, সেই সময় কী রকম; যুদ্ধের আগে—পরে, নাকি যুদ্ধকালীন এইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধকে এখানে প্রতীকীভাবে বললাম।

আর একটা বিষয় হল স্পেস। শিল্পি যে জায়গায় শিল্পচর্চা করছেন সেই জায়গাটা ক্যামন, তার আবহ কী রকম, বহুজাতিক আলোয় আলোকিত নাকি প্রাকৃতিক অন্ধকার, এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আজ আমি যে চিন্তাটা লিখছি এই কুড়িগ্রামে বসে, পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রান্তের একজন মানুষের চিন্তার সাথে এর সময়গত একটা মিল থাকতে পারে, যেহেতু আমরা একই সময়ের। কিন্তু স্পেস আলাদা হওয়ার কারণে তার প্রেক্ষাপট আলাদা—আমার আলাদা, তার সমস্যাসমাধান আলাদা আমার আলাদা, তাই এক্ষেত্রে স্থানগত একটা অমিল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এই বিষয়টাকে শুধু ‘পশ্চিমবঙ্গ-বাঙলাদেশ’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এভাবে ভাবলে বোধ করি লাভ হবে না।

পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাঙলার মিল-অমিল, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তের কবিতায় অমুক শব্দটির ব্যবহার— তমুক শব্দটি কতোবার— এইসব হাবিজাবি— বালছাল নিয়ে বলবে, তিনটা বই পড়ে একটা বই (গবেষণা নামের গরুরচনা) লিখবে প্রতিষ্ঠানের রামছাগলরা; আমি না।

আমি শিল্পী; চিন্তা করি পৃথিবী-বিশ্বব্রহ্মা-কেন্দ্রিক; এমনকি চেষ্টা করি তারও অধিক— যতোটা প্রশস্ত করা যায়।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কী বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

সাম্য রাইয়ান: ব্লগ একটা প্রকাশমাধ্যম। একটা প্রকাশমাধ্যম সাহিত্যকে কী দেবে?

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার কাছে মনে হয় কি? হলে কেন, না হলে কেন নয়?

সাম্য রাইয়ান: প্রশ্নটা নিয়েই একটা সমস্যা আছে। লিটলম্যাগ তো একটা মুভমেন্ট.. একটা মাধ্যম.. একটা নীরবতা.. একটা ভাঙচুর.. একটা শিল্প.. একটা হাবিজাবি.. একটা প্রতিশিল্প..; আরো অনেক কিছুই; সেটা ছাপাও হতে পারে, অনলাইনও হতে পারে। এখানে প্রশ্নটা হয়তো হার্ডকপি ও সফটকপি বিষয়ক। সেক্ষেত্রে আপনার শব্দগুলোকে অটুট রেখেই আমার মতো ব্যাখ্যা হচ্ছে, ‘ব্লগ ও লিটল ম্যাগাজিন’ দুটোই প্রকাশমাধ্যম। ব্লগ একধরনের, লিটলম্যাগ আরেকধরনের। দুটোর বৈশিষ্ট্য দুই রকম, ত্রুটিও দুইরকম। কোনটির চাইতে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ তা কীভাবে বিচার সম্ভব, জানি না।

বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে ব্যখ্যা করা যেতে পারে। দালালমেরুদন্ডহীন বুর্জোয়া-শয়তানরা ক্ষমতায় থাকার কারণে যেহেতু লিখিতভাবে এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ হলেও দখলসূত্রে ওরা, ফলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো হয়নি। ইন্টারনেট-কম্পিউটার তাই এখনো ফ্যাশানের মতো। কতোজন পাঠকের ব্লগ পাঠের সক্ষমতা আছে? আমার নিজেরই তো নেই। আর দ্রষ্টব্য, বিন্দু, শিরদাঁড়া, গান্ডীব, জঙশন, প্রতিশিল্প, দুয়েন্দে প্রভৃতি লিটলম্যাগ যখন ছাপা হয়ে আসছে তখন খুব সহজেই তা পাঠের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

আবার আরকেটা বিষয় হলো, আমি কুড়িগ্রামে থাকি, ধরা যাক দ্রষ্টব্যের সুবিমল মিশ্র সংখ্যাটা আমি পড়তে চাচ্ছি—যা বইয়ের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি সম্পাদকের কাছেও কোন কপি নাই; এমন অবস্থায়, যদি দ্রষ্টব্যের ব্লগ সংস্করণ থাকতো তবে কিছুটা হলেও চোখ বুলানো যেত (যেহেতু সাইবার ক্যাফেতে বসলে টাকা দিতে হয় ঘড়ির কাটার হিসাবে), কিন্তু তা না থাকার কারণে হয়ত’ ঐ সংখ্যাটাই আমার পড়া হল না!

তাই আমার মতে লিটলম্যাগাজিনের দুই সংস্করণই থাকা প্রয়োজন। এখনতো বিনে পয়সায়ই ব্লগ খোলা যায়, যা স্বতন্ত্র ওয়েবসাইটের মতোই কাজ করে প্রায়; আমরা বিন্দুর (www.onlinebindu.blogspot.com) ক্ষেত্রে যা শুরু করেছি। মোট কথা, হার্ডকপি ও সফটকপি একটি অপরটির সাথে সমন্বয় করে চলতে পারে। সেক্ষেত্রে দুইটিই পূর্ণতা পাবে।