সুবীর সরকারের স্মৃতিকথা: ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’

Post date: Oct 8, 2014 3:50:38 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

১।

কবেকার কোন রাত্রিদিন থেকে নতুনতর হয়ে গড়িয়ে নামতে থাকা রাত্রিদিবসসকল যেন মজা ও ম্যাজিক ছড়াতে থাকলেও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নচিহ্নের সমস্বরে দূর থেকে ভেসে আসা মহরমের বাজনায় তাজিয়ার বর্ণবহুলতায় উন্মুখ হয়ে উঠতে উঠতে বাল্যস্মৃতি জেগে উঠতে থাকলেও তাকে প্রশ্নাতীতভাবেই বলরামপুরের মাঠখেতপ্রান্তর উজিয়ে হাটগঞ্জ উজিয়ে ডম্ফ বাজনার স্বরশ্রুতির নিবিড়ত্বে আটকে পড়তে হয়। বলরামপুরের বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও তাকে কিন্তু সম্পৃক্ত থাকতে হয় আত্মপরিচয়ের গূঢ়সত্যেই যে সে জাফর জোতদারের জোতজমির অংশ হয়ে উঠেছে শেষাবধি।আর পূর্বের কালজানি নদী, নদীপারের কুলঝোপ,নদী পেরিয়ে তুফানগঞ্জ বন্দর,দোতরাবাঁশির ভিতর জেগে থাকা বেঁচে থাকা,বেঁচেবর্তে থাকতে থাকতে কখন কিভাবে বলরামপুরই বুঝি আত্মপরিচয় খসিয়ে ফেলতে থাকে।তখন আব্বাস তার চোখের সারল্যে বয়ন করতে থাকে দিনযাপনের টুকরোটাকরা। যেন কাড়ানাকাড়া বাজে।সানাইবাদ্যে ভরে ওঠে ঘর গেরস্থালী।এত এত যাপনের ভিতর চুপ করে বসেও থাকা যায় না।কেননা যাপন দিয়েই তো মেপে নেয়া হয় জীবনযাপন। বলরামপুরের ওপর নেমে আসতে থাকে আদ্যন্ত বলরামপুর। গঞ্জ বল গাও বল হাটগঞ্জ বল সবেরই দিকে ছুটে আসতে আসতে আব্বাসকে প্রাণপণ জীবনের কুহকেই গিয়ে পড়তে হয়। আর চলেই যেতে হয় গ্রাম্য গীদালের বাঁশি দোতরার টানে আদ্যন্ত এক বলরামপুরের দিকেই যেখানে মাঠফসলের পরিপক্কতায় বিমূঢ় হয়ে থাকতে হয় আদিমধ্যঅন্তহীন এক যাপনপর্বের বহুরৈখিকতায়।

‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে’

২।

কালজানি নদীর বিস্তৃতির সামনে এসে দাঁড়ালেও বিস্তারহারানো নদীর প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করবার উপায়ন্তর না দেখে তুমুল ফিরে আসা কালজানির শিথানে। প্রান্ত থেকে প্রান্তকথা থেকে জীবনমরণময়তায় শষ্যভূমির ভিতর খেলে বেড়ানো হাওয়াবাতাসে মিশে যেতে থাকে পাগারু বুড়ার দোতরার গান। পাগারু বুড়ার গানে গানে স্মৃতিকাতরতা এসে পড়লেও আদ্যন্ত এক বলরামপুর দানাফসলের দেশ হয়ে আকাশের নীলে নীলে ভূটান পাহাড়ের দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদল ফিরে আসতেই চায় কালজানির পাড়ে পাড়ে গো-মহিষের গালার ঘান্টির মত। কালজানি উজিয়ে কখন চলে যাওয়া জাফর জোতদারের ইজারা নেওয়া হাটের অন্দরে অন্দরে। রাতের স্মৃতিতে রাত্রিকালের স্মৃতিতামাসায় গরুর গাড়ির নিচে দুলতে থাকা লণ্ঠণ আলোয় ঝমঝম করে ওঠে গানগুলি-

‘ও রে আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু

পাছা নাওয়ে বইসো’

গান তো রক্তের ভিতর মিশে যাওয়া পরিণতির মত। সে তো নিমেষেই কন্ঠে তুলে আনতে পারে চাষিকিষাণমৈষালমাহুতের কন্ঠের সুর। সে তো গানের ভিতর গান হয়ে নাচের ভিতর নাচ হয়ে নাচগানের পর নাচগান অতিক্রম করতে করতে জনপদজনজঙ্গল খেতিবাড়ি বন্দরে বন্দরে টাড়িতে টাড়িতে আবহমানের জীবনের গল্প বহন করতে থাকে। কালজানির ঢেও কালজানির বয়ে চলা কালজানিতে বাইচ খেলা ধনীবাড়িতে সত্যপীরের গানের আসরে নিমজ্জিত হতে হতেই তার বেড়ে ওঠা বেঁচেবর্তে থাকা। দিগন্তপ্রসারী মাঠে মাঠে হারিয়ে যেতে যেতে আধিয়ারি প্রজাদের গানগুলি দিনকালগুলির ওপর ঝুঁকে পড়ে। হাল বাইতে বাইতে পাট নিড়াতে নিড়াতে জীবনের দর্শনকে খুঁজে পাবার মরিয়া প্রয়াসটাই জোরালো হতে থাকে। জীবন গনগণে আঁচে দাউ দাউ হয়ে ওঠে। আব্বাজান জাফর জোতদারের পশ্রয়ে পশ্রয়ে আস্ত এক জীবন নিয়ে সে জীবনের প্রকৃত জীবনযাপন হয়ে উঠবার দিকেই নিবেদিত করে তুলতে প্রস্তুতিপর্বই শুরু করে দেয়। পাথারবাড়ির দিকে কচুবনের দিকে বলরামপুরের কুঞ্জ পালের দোকানের দিকে সে আস্ত এক স্বপ্নবৃত্তান্তই রচনা করে ফেলে-

‘আজি নদী না যাইও বৈদ

নদীর ঘোলা রে ঘোলা পানি’

কোচবিহারের রাজার শিকারযাত্রার মিছিলের বাদ্যে বাদ্যে সে তুলে আনতে থাকে কেবল গান আর গান;আর আব্বাস আমার ভিতর আমি হয়ে চলে আসে,আমার পরিক্রমণের ভিতরেই সে তুমুল মিশে যেতেই থাকে,আমার বয়ানে বয়ানে আত্মগত হয়ে উঠতেই থাকে-

‘মুখকোনা তোর ডিব ডিব রে

ভাওজি গুয়া কোনটে খালু’

৩।

নদীর ভিতর নদী শুয়ে থাকে।নদীর মধ্য থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।হাই তোলে।পায়ে পায়ে গড়িয়ে যায় রাস্তা।গলিপ্তহ।তস্য গলি বস্তির বাচ্চারা গান গায়।গানের গায়ে জড়িয়ে যায় খিস্তিখেউড়।আবার এক একদিন সীমাহিন এক প্রান্তর হয়ে ওঠে পৃথিবী।বাতিদান বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে।রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিরদের ডানার নীচে কাঁচপোকা,ফড়িং।জীবন কাটাগাছের দিকে পাশ ফেরে।দেশাচারের নকশির ভিতর হরেকরকম মানুষজন।বিলাপরত স্কুল্বালিকা।গান বাজনার তাড়সে সংকরমনতায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাঠ প্রান্তর থেকে উড়ে আসে প্রজন্মপীড়িত কথকেরা।তারপর লোককথার ঢঙে গল্প এগোতে থাকে।অন্ধকারের নদীর পাশে তখন ভূতুড়ে ভাটিখানা।আর চোখে জল আসতেই মাতালেরা সব প্রেমিক হয়ে যায়।প্রান্তবাসীর হাতে হাতে বাঁশি ঘোরে।বাঁশি বেজেও ওঠে আচমকা।তখন হেরম্ব বর্মন উঠে দাঁড়ায়।মহামানব হতে পাবার সুযোগ হেলায় সরিয়ে দিয়ে সে ধুলো-মাটি আর মানুষের আখ্যানমালা সাবলীল বলে যেতে থাকে।অবিরাম তাঁতকল ঘোরে।আর নদীর মধ্যে থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।

৪।

ভালো ভালো গান শুনে বড় হয়ে ওঠা।নানা রঙের মানুষ দেখে দেখে বেড়ে ওঠা। অপমানের পর অপমান,গলাধাক্কা ডিঙিয়ে খোলা আকাশের তলে।আর নতুন শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উলুধ্বনি ভেসে আসে,রাজবংশী মেয়েদের দলবদ্ধ নাচ।বিবাহ উৎসবের দিকে যাত্রা শুরু করল একটি নিঃসঙ্গ পালক।

এতসব টুকরো,ছেঁড়া খোঁড়া সময় যাপন অভিঞ্জতা সবসময় ঘিরে থাকে এই বহুমাত্রিক জীবনই তো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। ইতিমধ্যেই দেখে ফেলা সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মানুষটিকে।আর গাছের পাতায় আঠা মাখিয়ে সারাদিন ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করত বাবুলাল বাঁশফোঁড়।অন্ধকারে শতশত জোনাকি পোকা।লোকজ এই ভুবন যার ভিতর থেকে কোনওদিনই বেরিয়ে আসা হবে না।অথচ ব্যাধ যুবকেরা সব একদিন ভুলেযাবে প্রলাপকথন। আর মাটির ঊঠোন থেকে অনিবার্‍য কিছু গান গোটা জীবন সঙ্গে থেকে যাবে। জীবনের বৃত্তে ঘনঘন আছড়ে পড়বে উড়ন্ত ঘোড়া,টিপছাপ ও হস্তচিহ্ন।

নদীত ফোটে নদীয়া হোলা/হায় এল্যা /ফুটিয়া রইল মোর ডালতে...

রাস্তায় রাস্তায় উপচে পড়ছে রোদ।মন কেমন করা রোদ। পথচলতি লোকজন সারা শরীরে মেখে নিচ্ছে ছোট শহরের দাউ দাউ রোদ।আর শহরের সমস্ত পুরানো,শতবর্ষ আক্রান্ত ইতিহাসের ছোঁয়া লাগা সেই সব ভূতুড়ে বাড়িগুলির দিকে কী যেন এক চোরাটানের কুহক। আবার বাল্যকালের বন্ধুরা যায় সব আগের মতো। সাইকেলকে ঘনঘন দাঁড়িয়ে পড়তে হয়।জীবন উবু হয়ে বসে পড়ে গেরস্থ বাড়ির সম্পন্ন উঠোনে।উঠোন জুড়ে সদ্য কাটা ধানের আঁটি।ঢেঁকিশালে পোষা বিড়াল।গলায় ঘণ্টা বাঁধা। রাজবংশী সম্পন্ন কৃষকদের ডারি ঘর বা বৈঠকখানা ঘরে বসে দোতারার আওয়াজ শুনি।গেরস্থালীর কাজের ফাঁকে মেয়েরা চটকা গাইছে—

‘আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই

দুয়ারত আসিয়া করে ম্যাও’

অজস্র আবিস্কারে ভরে উঠতে থাকে জীবন,ঘটনাবহুল বর্ণময়,গনগনে মশালের আলোয় বৃত্তে চুপচাপবসেথাকা জীবন। গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ সারতে থাকা। উত্তরবাংলার লোকায়ত ভুবনের মায়া তার জাদুতে সেই থেকে বন্দি।এবংআচ্ছন্ন।

৫।

ভালুক মিঞা শিস দিয়ে ভাওয়াইয়ার সুর তুলছে।সাইকেলের বেল দিয়ে,বাতিল থালাবাসন দিয়ে বাদ্যযন্ত্রতৈরিকরছে।

ভালুক মিঞা একজন জন্মান্ধ লোককবি।বিচিত্র সব লোক গানের সুর বাজিয়ে,আর নানারকম পশুপাখির ডাক নকল করে গোটা জীবন জীবিকার তাগিদে বন্দরে,মফঃস্বলে অবিরাম ঘুরে বেড়ায় ভালুক।মানুষ তাকে ঘিরে ভিড় করে। ভালোবেসে ছড়ানো পয়সা সাজিয়ে দেয়।ভালুক ব্রাত্যজনদের গান গায়। আর প্রান্তবাসীরা সেই সব শোনে।আর ঝুঁকে পড়ে।

৬।

খোকা বর্মন সানাই বাজায়। খোকা বর্মন হাতঘড়ি-প্যান্ট-সার্ট লুঙ্গি এসব কিছুই পড়ে না। পাজামা ও ফতুয়া পরে। খোকা বর্মন নদী ভালোবাসে। আর নদীর পর নদী পেরিয়ে সে নদীপথেই ফিরে আসে। ঘর বানায়। সংসার বানায়। বানায় নাকি নির্মাণ করে। আবার নির্মাণ করে বলেই খোকার একটা বসতবাড়ি হয়। খোকা বর্মন সানাই বাজায় এটা কোনো ঘটনাই নয়। কেননা পৃথিবীতে হাজার হাজার সানাই বাজানেওয়ালা মানুষ আছে। তবু খোকা বর্মন সানাই বাজায়। এটা একটা ঘটনাই। ঘটনার সাথে তুরন্ত জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-দশটি গ্রাম। মানুষজন। খোকা বর্মনের সানাই ছাড়া সেইসব গ্রামে কোনো বিয়ে হবে না, অন্নপ্রাশন হবে না, লোকদেবতার পজো হবে না। মাটির গভীর থেকে সানাই-এর সুর উঠে আসে। আর উঠে এসেই সেই সুর কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে না। খোকার এমনই যাদু যে সুর প্রথমে স্বল্পগতির দৌড় লাগায়। এরপর ক্রমাগত গতিশীল হয়। গতিশীল দৌড় একটা বহুরৈখিকতা অর্জন করে। অর্থাৎ সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে পড়ে মাঠ প্রান্তর নদী বসতবাড়ি বৃক্ষরাজি বালক বালিকা মেঠোপথ যাবতীয় গ্রাম্য অনুষঙ্গের ওপর দিয়ে। ‘ওপর দিয়ে’র মানে বদলে ভিতর দিয়ে বা মধ্য দিয়েও হয়। খোকার সানাই বাদন আবার নাচগান ভুলতে বসা গ্রামের মেয়েবউদের টেনে নিয়ে আসে চিরাচরিত বিবাহনাচের কাছে। অর্থাৎ আনন্দের কাছে। খোকার সানাই টুকরো চাঁদের নিচে ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকলেও সানাইকে মোতেও দোলনা অথবা মই মনে হয় না। মনে হয় না কেননা খোকার সানাই অপদেবতার পুজোতে বাজে, বাজতেই থাকে অথচ আমাদের গা ছমছম বা ভয় ভয় কিছুই করে না। খোকা কি জানে বা টের পায় বা বোঝে পৃথিবীতে মেয়েদের জীবন আদতে কষ্ট আর কান্নার জীবন। সেই সানাই শুনে অনেক মেয়েই আবার কান্নাতেই মুখ ঢাকে। কেননা সেই কান্না প্রকৃতই কান্না নয়। তা আসলে বিড়বিড় করে কথা বলে, মেয়েদের নিজস্ব ভাষায়।

খুব ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। উল্টোপাল্টা করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে বাঁশি বাজিয়ে পুনরায় নদীকে পুরনো খাতে ফিরিয়ে আনতে। মাঠে মাঠে আমি তো শূণ্যতাকেই খুঁজি। আর বাজপোড়া গাছ, কালো কয়লার মতো, শূণ্যতাকেই রেখে যায়। আগুনে পোড়া লাশ, যুদ্ধ ও দাঙ্গার গল্পে কেঁপে কেঁপে ওঠা রেলব্রিজ; অথবা রেলসেতু ঘামে ভেজা দুপুরের রেলিং ছুঁইয়ে উড়ন্ত পাখির ঠোঁট হয়ে যায়। ঠোঁট নড়ে। আর রামকথার আড়ালে জীবনগাথা গেয়ে চলেন কোনো কোনো লোকশিল্পী। শূণ্যতা তুমি তবে পিরামিড হও। ফুলবাগানের কোণে কোণে আমি রেখে আসি ছেঁড়া বোতাম। বোতামের গা জুড়ে রক্তের দাগ। জীবন মানে আপোষ। আত্মহত্যা। অথবা হননদৃশ্যের শুরুতেই অদৃশ্য থেকেই উলুধ্বনি। উলুধ্বনি থেমে গেলে জনপদ জুড়ে আশ্চর্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। গণধোলাইয়ের আগে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ধূপ ও ধুনো। এই জনপদ গূঢ কোনো বধ্যভূমি। চৌদিকে মাংস পোড়ার গন্ধ। আমি কি যাদু জানি। আমি কি আগের মতন হাতের উপর রাখতে পারবো হাত। বিচ্ছেদপর্বে খুব অন্ধকার। বিষাদের গন্ধ লেবুপাতার মতো। আর শান্ত মেয়েটির মুখের কাছে সামান্য মৃদু মেঘ। জোড়া শিমূলের গাছ। বোবার শত্রূ নেই – এই প্রবাদ ফিকে হয়ে আসছে। তাই পিচকারি থেকে শূণ্যতা ছড়াই। আমার স্বপ্নে প্রিয়জন বা অগ্রজ কবিদের কেউ কেউ তো আসতেই পারেন। আসেনও। তাই বলে কি আমি সমস্ত গোপনীয়তা চুরমার করে পুনশ্চ ফিরিয়ে আনবো সান্ধ্যভাষা, শীত ও শিরির। আর আমার দুপুরের ঘুমে বারবার কড়া নাড়ে মহাশূণ্যতা। শূণ্যতা ধুয়ে দিচ্ছে জলের দাগ। আর তা অনুসরণ করতে থাকুক মেঘের শব্দ।আর আব্বাসের গান।

৭।

কাষ্ঠ নির্মিত ঘরবাড়ির প্রতি আবাল্য আকর্ষণ আমার । আমার বাল্যকালের অনেকটা কেটেছে কাঠের বাড়িতে । কাঠের সব বাড়ি ঘরের মাঝ খানে । এবং আজ কানে বাজে পিতামহর কাঠের খড়মের শব্দ । আবার ঝরনার পাশে ঝোরার কাছে কাঠের বাড়ি । কাঠের বাড়ি মানেই জঙ্গল আর জঙ্গল । জঙ্গল থেকে হাওয়া আসে । হাওয়া এসে ঢোকে কাঠের বাড়ির মধ্যে ।কাঠের বাড়ির সামনে দিয়ে উত্তরের হাতির পালদলবেধে যায় । আবার কাঠের বাড়ির কাঠের বারান্দা থেকে কেউ কেউ হাতিমিছিলের ছবি তুলে । তবে বনবাংলো এবং কাঠের বাড়ি কখনো এক নই । জদিও উভয়ই কাঠ দিয়ে নির্মিত । বনবংলোতে প্রবেশের জন্য ভ্রমনোপযোগী বিকেল দরকার । আর বর্ষাকালের ভেতরে আকুল হয়ে থাকে আমাদের কাঠের ঘরবারি ।তরাই ডুয়ার্স এ এখনও কতো কাঠের বাড়ি । ছরানো ছিটানো । কাঠের বাড়ী আমাদের স্বপ্ন ঝাপি । স্মৃতিকাতর করে । আর স্মৃতিকাতরতা খুলে দেয় দেখা জল চোখ ।আমার কবিতায় খুব চলে আসে কাঠের বাড়ি । বাড়ির সামনে চিলতে মাঠ । নাবাল জমির ঢাল । কাটাগাছে।বনতুলসী । কবিরা আসেন এখানে নদী পেরিয়ে । ছবি আঁকবার লকজনও । আর সকলে সিঁড়ি ভেঙেই কাঠের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে । আর তারা তো ঢুকেই আর চুপ চাপ বসে থাকেনা । মানে বসে থাকাই যায় না । কাঠের ঘরবাড়ী আবার নিসগপ্রীতিজাগায় ।তখন একা একাই গান ধরা । একা একাই হাততালি। কাঠের বাড়ির তৈলচিত্রে পাখিদেরও দেখা যায় । খুব মনখারাপের দিনে আমি কাঠের বাড়ির স্বপ্নে দুবে থাকি ।স্বপ্নে কাঠের বাড়ীকে পাশ কাতিয়ে চলে আসে কাঠের খড়ম , কাঠের আরামচেয়ার , ভ্রমনলাঠি ও কাঠের সিঁড়ি । অথবা সিঁড়িটাতে বাদ দিয়ে বা ঠেলে সরিয়ে দেয়াওয়া যায় কেননা সিঁড়ি তো কাঠেরবারিরইগুরুত্বপূর্ণঅংশ। ।

৮।

দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টি হচ্ছিল । বৃষ্টি হচ্ছিল এটা সত্যি ।সত্যি দিদির মৃত্যুও। বৃষ্টি হচ্ছিল তবে সেটা জোরাল বা ধারালো বৃষ্টি নই । বৃষ্টি থামছিল আবার শুরু হচ্ছিল । অথবা বৃষ্টি টেনে নিয়ে যাছিল বৃষ্টিকে । আচ্ছা " টেনে নিয়ে " কাটছাঁট করে লিখি বরং " নিয়ে যাচ্ছিল " । বৃষ্টি তবে কথায় যাই । যায় বললেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ।ফাঁকা ফাঁকা মানে মহাশূন্যতার একতা বোধ ।অনুভূতি । কবিতা লিখবার সময় কালে এমনকি পড়বার সময়ে বা রিক্সায় চেপে একা একা ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তেও ফাঁকা ফাঁকা অবশ্যই ভাবায় ।ভাবায় এবং দীর্ঘ ভাবনার পরেও আমার শূন্যতাটা সরে না । সরে না তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমি পাথর গড়িয়ে দিই। গড়িয়ে দিই একারণে অনুতাপ হয়ই না কোন । শহরের শীত সহজেই যুক্ত করে নেয় সার্কাসের তাঁবু । জোকারের হৈ-হল্লা রাজহাঁসের ডাক ঘোড়াদের মৃদু মেদুর সমবেত হাসি -----এইসব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সার্কাসের প্রসঙ্গে ।প্রসঙ্গ এমন জিনিস বারবার বদলে যাওয়া যার স্বভাবধর্ম । বদলে যাওয়াটা যথাযথ শোনাবে যদি বলি অবস্থানবিন্দুর ঘরফেরা ,চলাচল ।চলাচল এবং ঘরাফেরা চমৎকার ছবি টাঙিয়ে দেয় ।একজন পর্যটক ।একাধিক ধর্মযাজক ও অজস্র হাটফেরত জনতা সমুদয় অনুযঙ্গ এসে বসে পড়ে টাঙিয়ে দেওয়া সেই ছবিতে আর একনদী থেকে বেরিয়ে আসা আরো এক নদী থাকলে তৎসহ বেরিয়ে আসা নদীর ঢালু জুড়ে যদি কিছু উড়ন্ত পাখির ঝাঁক টেনে আনা যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে উপহারযোগ্য ছবি হয়ে উঠবে সেটা আর কথাপ্রসঙ্গে চলাচল ও ঘোরাফেরা মুদ্রাদোষের মত ঘুরে ফিরে আসবে।যেমন কত কত শব্দ রোজদিন ঘুরেফিরে আসে । আর তাদের অধিকাংশই ঘরে ফিরে চলে যায়।চলে যাওয়াটা সামান্য মর্মাহত করে ।আবার উৎফুল্লও ।চলে যায় বলেই তো আবার খুজতে সুরু করি ।জাগরণে থাকি । থাকি তাই বৃষ্টি হচ্ছিল এই শব্দটি আমাকে সবসময় দিদির মৃত্যুর কথা ,মৃত মুখের কথা মনে করিয়ে দেয় ।

৯।

ধনীরাম হেঁটে আসছে এক অন্তহীনতা নিয়ে হাওড়হাওয়ার দিকে।নিশারাত্তিরের ছমছমে অনুভূতি জড়িয়ে মায়াময় হয়ে উঠতে চাওয়া পৃথিবীর অতিঘোর বিস্তারের বহতায় আকাশজোড়া মেঘের চলনবিচলন ও একাকীত্বের অসহাতায় তার কেমনতর হয়ে ওঠা জীবনের রহস্যকে মাঠের মধ্যে বাজিকরদের তাঁবুতে যৌথ কোলাহল সংগীতধ্বনীতে বিমনা হতে হতেও কিভাবে যেন টাল খাওয়া স্বপ্নগুলি বারবার জেগে উঠতে থাকে স্মৃতিকন্দরে।দূরের গাঁ-গঞ্জে তখন হিমস্তব্ধতা।কুকুরের ডাক। মিটমিট লম্ফআলো।বাঁশবাগানের ভিতর সাপখোপ ফিসফিস সংকেতভাষ্য। ধনীরাম দ্বিধাগ্রস্থতা থেকে সামান্য সরে এসে দ্রুতগামী হয়।মাথার তন্ত্রীতে জেগে থাকে ব্যাপারীপাইকার পেঁয়াজ হলুদ পুঁইপাতা টাড়িবাড়ির ধুলোমাখা মানুষজন।সব মিলিয়ে গমগম করে ওঠে যেন আস্ত একটা নাথুয়ার হাট।জঙ্গলঘেরা।চা-বাগান ঘেরা।ভূটান পাহাড়ের কোলঘেঁষা।হাট থেকে দু’কদম দূরে আঞ্চলিক নদী,বামনীঝোরা আর পিয়ারুদ্দিনের মহিষবাথান।পিয়ারু তার ইতিহাস ও আখ্যান মেখে জেগে উঠতে চায় স্পষ্টতর দিবালোকের মতো।বাথানের ভিতর মহিষের গালার ঘান্টি এবং আকালু বর্মণের গান যুগপৎ ভেসে ওঠে-‘ওরে বাথান বাথান/করেন মইশাল ও/ও মইশাল/বাথান কইচ্চেন বাড়ি/যুবা নারী ঘরত থুইয়া/কায় করে চাকিরি/মইশাল ও.’..।

গানের সুর আবহ শিল্পোর্ত্তীর্ণ হয়ে ওঠে কারণ ঘান্টির বাইজন যেন বাদ্যবাইজের ঢেউ ছড়িয়ে দেয়।রাত ঘন হয়।ধনীরাম ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছে বাড়ির সদরে উঠে আসে।

১০।

জন্মজন্ম ধরে জন্মান্তর পেরিয়ে এভাবেই তো ধনীরামদের বাঁচা;বেঁচেবর্তে থাকা।ধনীরাম,ধনীরামের মতোন করে এই আকাশবাতাসপরিধীর ভিতর অতিজীবিত করে ফেলতে থাকে যাপনটুকুন।শরীরের ভাঁজে ভাঁজে কম্পনরেখাসূত্র ধরে কিংবদন্তী থেকে খুঁজে আনতে থাকে লোককথার দর্শনদর্পণ কাজলটানা এক সময়পরব। যেখানে স্বাদু জলের আঞ্চলিক মাছেরা ঘাই মারে।জালুয়ার জাল ফেটে বেরিয়ে যেতে চায় মহাশোল।পূজাবাড়ির উৎসবমুখরতায় স্তব্ধতা এনে দেয় জঙ্গলের প্রসারতা থেকে ছলকে আসা ২১ হাতির দঙ্গল।

বিলপুখুরির শিথানে দেহতত্বের আখড়া বসায় অধিকারি।জোড়শিমুলের ডালে ডালে স্পন্দন তোলে গানের সেই বিষাদসুরটুকু_’একবার হরি বলো মন রসনা/মানব দেহাটার/ গৈরব কৈর না’...

জীবনের সহজ প্রশ্নসমুহ কি ধনীরামকে বিচলিত করে?না কি জায়মানতা থাকে না কোথাও তবু জায়মান মাঠপ্রান্তরের ভিতর হালবলদগরু নিয়ে নেমে গিয়ে হলকর্ষণে মেতে ওঠা।৪০/৫০ শরত হেমন্তের আগেকার দিনগুলির মায়ামেদুরতায় আচ্ছন্ন হতে হতে ধনীরামের স্মৃতিঝিল্লিতে ভেসে ওঠে পিরডাঙ্গার সাজুবিল-এ ‘বাহপরব’,মাছ ধরার উৎসব।জোতদারের খোলানে ধান লুঠের মেলামিছিল।নুরুদ্দিন জোতদারের খুটার বন্দুকের সে কি বিক্রম!বিগত সব দিনগুলি আগিলা মানষিলা সব কেমন হাওয়া!উধাও।ধনীরাম বিষাদ্গ্রস্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে না চাইলেও জীবন তাকে বাধ্যতই এই চিরসত্য দার্শনিকতায় একপ্রকার পৌঁছেই যেন দেয়।

১১।

এইভাবে একপর্বে গানমাষ্টার কিংবদন্তির মত হয়ে ওঠে।হারাতে হয় নিজনাম।তার গান, গায়নভঙ্গি কণ্ঠের জাদু তাকে লোকপ্রিয় করে তলে।উত্তীর্ণ হয় গানমাস্তারে।গৌরিপুরের রাজার বেটি নিহারবালার ডাকে সে ঘুরে বেড়ায় গৌরিপুর আভয়াপুরি গদাধরের ভূগোলে ভূগোলে ।কত গান কত বাদক গিদাল লোক মানুষের উত্তাপ তাকে অঙ্গে মাখতে হয়।সে সব বড়ো যুদ্ধের সময়কালের।ঐ যেবার বোমা পড়ল।হিটলারের নাম প্রথম যেবার শুনল গানমাষ্টার।আর গরুর গাড়ির নিচে শীত রাতের লণ্ঠন দোলে ভয় ও ত্রাসে। ‘মানসীর বাড়িত মানসী নাই সুকান দিঘিত পানিনাই’ ।

১২।

এইভাবে একটানা আমাকে শুনে ফেলতে হয় আখোড়টি।গানমাস্টারের গল্পটি।১৯৪৫ এর পৃথিবী ২০১৩ তে এসে থমকে দাড়ায়।তখন টাড়িবাড়ি বাতাস আকাশ রাজাজোতদার শিকারটিকার দোতরাসারিন্দার দীর্ঘ পরিভ্রমণ সাঙ্গ হতে না চাইলেও ইতিহাসপুরানকে নুতনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস সচেতনভাবেই জারি থাকে।দূরের মাঠ নদি থেকে হাওয়া আসে। হাওয়ায় জাগে শত শেয়ালের ডাক।মাঘনিশিথের ককিল।জিনপরিময় সময়ক্রম।সব কিছু না সরিয়েও বুঝে নিতে পারি কোথাও বিনির্মিত হচ্ছে নিম্নবর্গীওদের ইতিহাস,য়ার ভিতর বাদ্য বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছেন আমোদিত এক গানমাস্টার।

১৩।

গান গান করিয়া সর্বনাশ/ তবু না মেটে গানের হাউস খুব বেশি শীত।খীব জাড় বাহে।হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে যায় আলতাফ করাতী।কুয়াশা দলা দলা।অগুণতি পাখিরা কূয়াশাবাড়ীর দিকে।শূন্য সব মাঠে মাঠে শিশিরশব্দ।কোথাও কী যাওয়ার থাকে মানুষের?পাখির ডানার নীচে হেঁটে যেতে যেতে স্মৃতিতাড়িত এক যাপনই সামনে এসে পড়ে বুঝি।শীতের রহস্যময় রাতগুলি যেন না ফুরতে চাওয়া কীসসাগাথা ।অনেকানেক প্রান্তরের জেগে থাকা গানবাড়িগুলি তাকে প্ররোচিত করলেই আমোদিত হবার বহুবর্ণ উপাদান সমেত সম্পন্নতায় আশ্চর্য মিশে যায় কুয়াসাঘেরা চাঁদের আলোর খদলে। এত এতোর ফাঁকে কখন দোতরাবাহিত ঢোল বাসি,সারিন্দাবাহিত জীবনযাপন নিয়েই কখন ধনীবাড়ীর খোলানে এসে দাঁড়ায় গানমাষ্টার ছায়াময় মায়াময় সব দোহার বাদকবৃন্দ সমেতঃ ‘মাছমারেমাছুয়াদোলাবারিতহালুয়া।‘

১৪।

চার পাঁচ কুড়ির মাঝামাঝি বয়সের গানমাস্টার ভুলে গেছে তার নিজনাম।৮/৯ বয়স থেকেই বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত অধিকারির সঙ্গে সঙ্গেই গানের দলে কেবল ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যৌবন এসে গিয়েছিল, তারপর বাপ ধনকান্তর দলের মূল গিদাল হল সে।বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত খুব ভালবাসতেন এই নাতিতিকে।চন্দ্রকান্তই তার দীক্ষাগুরু শিক্ষাগুরু।চন্দ্রকান্ত তাকে জীবন শিখিয়েছেন।চিনিয়েছেন।গানের তত্ত্বতালাশ মণোশীখন শিখিয়েছেণ;বুঝতে শিখীয়েছেন-লোকগান হল শাঢোণা,জীবনবন্দনা।সেই থেকে দিনকাল পেরিয়ে দেশাচার লোকাচার গঞ্জ মানুষ নদিদিঘি মেলামহোতসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে চন্দ্রকান্তর বড়োবেটার বড়োবেটা রতিকান্ত নাম হারিয়ে মাইল মাইল জঙ্গলজনপদ হাওড় হাওয়ার এক পৃথিবীর গান মাস্টার। যার গানে যার বাদ্য বাজনায় অতিপ্রাকিত পাখিরা ,মানুষেরা চিরকালীন হয়ে যেতে থাকে। রসিয়া বসাইছে ফান্দ বানিয়া বসাইছে ফান্দ ৩৮। সে কবেকার কথা।ব্রিটিশ আমল।চারদিকে কত কত জোতদার।পুবে জয়নাব মুন্সি খামারু জোতদার সরকারবাবু ফনিমোহোন তো উত্তরে ঢোল দেওয়ানি খগেন বসুনিয়া হাতি জোতদার। নিজ চোখে কতবার দেখা হাতির পিঠিত চড়ি জোতদারের গমনাগমন।ভবতারণ ধনির বাড়িতে রাসযাত্রা হত।পালোয়ানি কুস্তির লড়াই কুশান যাত্রা দোতারা পালার আসর,সে এক ধুন্ধুমার বেপার।একবার রানিরহাটের এক গানবাড়িতে সে দেখেছিল কোচবিহারের এক রানিকে।পাতলাখাওয়ার জঙ্গল থেকে চিতা বাঘ বেরিয়ে আসতো মাঝে মাঝে।ও ছিল কোচবিহার রাজার রীজাভ ফরেশট।গান মাস্টার একবার রাজাদিঘির খেলার মাঠে পালা গাইতে গিয়েছিল।রাতভর পালা শেষ করে ফিরে আসার পথে দেখেছিল হাতির জুলুস আসছে।বাজনা বাজছে।পথের দু পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মানুষেরা।জানা গেল মহারাজা আসছেন শিকারকাম্পে।একঝলক দেখেওছিল বুঝি রাজাবাহাদুরকে!

১৫।

দিনদুনিয়ায় দেশকালের ওপর কখন যেন আন্ধার নেমে আসে। লম্ফ জ্বলে ওঠে কচুঝোপে জোনাকআলোর জোনাই। ধল্লা নদীর চরে কাশিয়াবাড়িত শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। পাকশালে আন্ধনঘরত রেহেনা খালার তৎপরতা শুরু হয়। দাওয়ায় বসে তামাক টানে ইদ্রিশ মোল্লা। তামাকের রসে পুরুষ্টু হতে থাকে শরীরমন। অর্ধচেতনায় তখন জোতজমি কাকিন্যার বড়বিল নীলসাগর রসুনভাজার গন্ধ।নিকাহের খোয়াব ভাসতে থাকে। একসময় খোয়াব ভাঙেও রেহেনা খালার গুনগুন বিয়ের গীতের টানা সুরের লহরীতে। জোতজমির মতো জোতজমি পড়ে থাকে আর চারপাশেকেবলআহাজারি।রুহেরজন্যমাগফেরাত।

১৬।

‘হাড়িত নাই ভাত

মাথাত দিনু হাত’

বনাঞ্চল চরাঞ্চল-এর ভিতর হাওড় বিল কুড়া দহের ভিতর উদ্দেশ্যহীন অনিবার্যতায় নৌকো ও মাঝির সম্পর্কের মতোন দোতরা ও গীদালের সখ্যতার মতোন জীবন সংকোচনপ্রসারনের ধন্ধধোঁয়ায় ফাঁকা ফসলহীন শীতমাঠে নেমে এসেও নির্জনতা খুঁজতে গিয়ে চিরকালীন বিষাদ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে শোক ও শ্লোকবাহিত। ধান কাটার মরসুমে কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলার অপরূপ দৃশ্যসুখ স্মৃতিতে বহন করতে থাকা রূপকান্ত অধিকারী তখন ঘুমের ভিতর পাশ ফেরে আর বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে বাওকুমটা বাতাসের যত গান। গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যাবার মতন।

‘টরেয়ারেটরেয়া

হাতিবান্ধারটরেয়া’

১৭।

মাইল মাইল দিগন্তের ভিতর,দিগন্ত পেরিয়ে আরো আরো দিগন্তের ভিতর,নদীঘেরা মানুষঘেরা অরন্যঘেরা গানঘেরা বাজনাঘেরা জীবনের অনন্ততা ছুঁয়ে কোথাও কি যাবার থাকে মানুষের! প্রশ্ন নয়,প্রত্যাশাহীন সংশয় হয়ে কবে কার কতকালের জীবন যেন মায়াকুহকময়তায় জীবনেরই বন্দনাগান।চড়িয়ে যাওয়ায় ছড়িয়ে যাবার আবহমানের আবহমানতায় চিরসত্য হয়ে জীবন যেন নুড়িভাষানদীরঅঞ্চলকথারঅত্যাশ্চর্যচোরাটান।

১৮।

দিগন্তের মধ্যেখানেই তো নেমে আসে মানুষ।কত কত মানুষ।ভালোমন্দ হাসিকান্না অসুখবিসুখ নাচগান শীতবর্ষা হাটগঞ্জ পাইকারব্যাপারি বাথানটাথান টাড়িবাড়ি নিয়ে উজ্জলতর সব মানুষের যাপন দিয়েই তো একটানা বুঁনে চলা নকসিকাঁথা।পালাগানের মাষ্টার টরেয়া বর্মন পেরিয়ে যেতে থাকে সুপারিবন শুকনো বাঁশের সাঁকো।হাতিবান্ধার ধানহাটিতে নাচতে থাকে বুধেশ্বরী বুড়ি।ঢোল বাজিয়ে উড়ানি কইতরের গান বাঁধে হরিকান্ত।সবকিছু নিয়েই তো জীবনের জীবন হয়ে উঠবার প্রয়াস।

১৯।

‘ধলা মুরগি টা

বাচ্চা ফুটাইচে’

নদির কাছাড়ে কাছাড়ে ঘুরে বেরান মুন্সি করিম।প্রবীন চোখের ওপর তার আসমানের ছায়া।ডান হাতে কনুই-এর নিচে দীর্ঘ ক্ষতের কাটাকুটি।তুষভাণ্ডার জমিদারবাড়ির চড়ক মেলা থেকে কত কত কালখণ্ড পুরনো এক শীতকালীন সন্ধ্যেয় বড়খাতার তিস্তা সন্নিহিত জঙ্গলপথে এক চিতাবাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।গাছের শুকনো ডাল দিয়েই করিম মুন্সির মরণপন লড়াই।সেই থেকে মুন্সি করিম দশ চল্লিশ গঞ্জগাঁয়ে মিথের মতোন।সেই থেকে তিনি ঘুরে বেড়ান জীবনময় অন্তহীন।

২০।

ফাঁকা প্রান্তর থেকে মিছিল উঠে আসছে।মিছিলের শ্রেণিচরিত্র এক ধরনের পূর্ণতা পেয়ে গেলেও আসলে মিছিলটা ব্যাপ্ত হতে হতে বৃহত ব্যাপ্তি পেয়ে যায়।তখন বিস্তারের ভিতর সন্তর্পণে সাপ ও সর্পগাথা ঢুকে পাড়ে।ডানকানসাহেব তার ঘোড়াটিকে ছেড়ে দেবার পর ঘোড়াটি পুলকিত হয়...... ঘুড়ি হয়ে যেন উড়তে থাকে।ফাঁকা প্রান্তরে তখন আর মিছিলের চিহ্নটুকুও দেখা যায় না।মিছিল বড় কোনও হাটের চৌহদ্দি পেরিয়ে একটা কিংবদন্তি খুজতে থাকে।পিছনে পড়ে থাকে শস্য সবুজ জনভূমি ... ইতিহাসপিছল বন্দুক।বন্দুক এমনই যা পরম্পরাগত হাতবদলে ইতিমধ্যে খ্যাতমানতা পেয়ে গেছে।লোককথা অতিকথা এমনকি ঘুমপাড়ানি গানের গায়েও বারংবার আছড়ে পড়ে বন্দুকটি তার যাবতীয় ইতিহাস ভূগোল জনগল্প নিয়ে।অথচ ডানকানসাহেবের হারিয়ে যাওয়াটুকু অখন্ড সিল্যুয়েট হয়ে থাকে।আবার বৃষ্টির ভিতর দিয়েই একা একা সাহেব চলে যেতে থাকেন সাহেবপাতার হাটে।হাট কখনও জীবন থেকে ফুরোয় না।কেবল হাটের গল্প হাটমিছিল হাটপুরাণের অতিকথা ঘুরে ফিরে বর্ণময়তার গড়ানে নুড়িপাথরসহ প্রবাহিত হতে থাকে।

২১।

যদি পরিপ্রেক্ষিতটা কালখন্ড দিয়ে সাজানো থাকে ...যদি ধুলোবালির সংকীর্ণতা দিয়ে দুচারটি হাটবাস যায় আর মেঘের আবডাল থেকে পুরানো গল্পগুলি মাটিপৃথিবীতে খুব মায়াময়তাসহ ফিরতে থাকে ... ফিরতে থাকাটা সাময়িক এমন ভাবনা স্থির হবার কোনও ফুরসতই পায় না যদিও জলবাহিত এক ভূগোল উপচে ফকির বাবার কন্ঠে গান বাজে......

‘শামুক খাজারে আমার বাড়ি আয়/কুচি

কুচি শামুক দিমু/হলদি দিমু গায়’.........

গান গড়াতে থাকে গান মেদুর হয়ে ওঠে আর মেদুরতার পিচ্ছিল সীমান্তে প্রাচীনজঙ্গল থেকে হাওয়া আসে,হাওয়াকলের নীচে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে ডানকানের বাদামি অশ্ব আর তার ধবল পেশির শূন্যতাটুকু বাদলা মেঘ হয়ে ভেসে যেতে থাকে আন্দুবস্তির নারী ও নদীর দিকেই।পর্ব থেকে পর্বে যেতে গিয়ে বিস্তর হেঁটে বহুলতার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়েও প্ররোচনাহীন অসহায়তার প্রাবল্য সত্ত্বেও ডানকান সাহেব – সাহেবের বন্দুক ঘোড়া এবং বিস্তারময়তার মধ্যে বারংবার এলোমেলো গল্প টুকরোগুলি ফিরে ফিরে আসে আর আবহমানতা থাকে বলেই ডানকানসাহেব আর সামান্যতম চরিত্রে না থেকে নতুন গল্পের খোঁজে হাহাকারের কোরাসের ভিতর ডুবে যেতে থাকে।কুয়াশা কাটলে নতুনতর কোনও কুয়াশায় ঘোড়াসহ ডানকান হারিয়ে যেতে থাকেন......স্বপ্নোচ্চারণের মতো তখন মনে হয় সবকিছু।

২২।

চলা তো শেষ হয় না কখনও ডানকানসাহেবের ।অন্তত আজ অব্দি হয়নি।সামান্য বিরতির পর নিশ্চিত তিনি ছুটবেন।আপাতত বন্দুক নামিয়ে রাখুন তিনি বড়াইকবাড়ির উঠোনে।আর ঘোড়াটি ছেড়ে দিন অতিকথনের এক দুনিয়ায়।নদী ও হাটের ...হাট ও জঙ্গলের ...নাচ ও গানের পরিসীমায় আর পরিসীমাহীনতায় সাহেবের ভুমাত্রিক ঘোড়াটি আরও বহুমাত্রিকতায় ঢুকে যাক।ধীরে ধীরে সময় গড়াক ......রাত্রি হোক......বড়াইবাড়ির চারপাশে হাওয়া ও আগুনের ঢেউ উঠুক।উপসংহারের বদলে আমরা পুনর্বার ঢেউহীনতার কথা লিখি।আশ্চর্য গান ও গল্পের কথা লিখি।গল্প দীর্ঘকাল শুয়ে থাকবার পর হয়তো আড়মোড়া ভাঙবে......গুটিকতক হাই তুলবে ... তারপর যথারীতি ঢুকে পড়বে ঢেউহীনতার বিস্তারে।

২৩।

চাঁদের পূর্ণ আলোয় দেখা গেল ঘোড়া ছুটছে।ঘোড়ার পিঠে ডানকান সাহেব।দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ বলশালী পুরুষ।সাহেবের হাতে বন্দুক।ঝাঁ-চকচকে এবং দো-নলা।সাহেব যাচ্ছেন হাটের দিকে।হাট থেকে আবার যাবেন নতুনতর হাটে।এভাবে হাটপর্বের গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকবেন চক্রাকারে।আর আমরা গল্পের উৎসমুখ খুঁজতে খুঁজতে শেষাবধি গল্পের খুব ভিতরে ঢুকে পড়ব।অবশ্যি বন্দুকটা থাকবে।বন্দুক থাকলে খুব অদ্যিকালের সব গ্রামগঞ্জ হাটবাজার মানুষও থাকবে।থাকা না থাকার অস্পষ্টতায় জন্ম নেবে ক্রমান্বয়ে অগণন মিথ.... নদী ও দেশাচার চাঁদের পূর্ণ আলোটুকু কেবল বাঁচিয়ে রাখবে আর ছড়িয়ে দেবে ডানকান সাহেব ও তাঁর ভুমাত্রিক ঘোড়াটি।

২৪।

ডানকানের ঘোড়া অথবা বন্দুক ও ঘোড়াসহ সাহেব ডানকান যখন হাটে ঢুকে পড়বে তখন চাঁদ সরে গেছে।নদী থেকে সর্বত্র ছিটকে যাচ্ছে বাতাস।হাটের ভিতর থেকে জটলার গহন থেকে মিছিলের মতো মানুষ আসতে লাগল আর এসবের ধারাবাহিকতায় ধরাছোয়ার বাইরে চলে যেতে গিয়েও হাটের গানের টানে আবার ফিরেও আসতে হয়।সাহেব যেদিকেই যান তীব্র এক আর্তি তাকে ঘিরেই থাকে আর স্বপ্নের পর স্বপ্ন ভেঙে যেতেও থাকলে শেষাবধি স্বপ্নের কাছে ফিরে আসতে হয়।জঙ্গল সংকীর্ণ ও গভীর হতে থাকে,হাতির পাল দানাশস্যের বিস্তীর্ণতায় নেমে আসতে থাকে খুটামারার অজ্ঞাত এক বাথান থেকে সমবেত হাতি-ধরা গানও ছড়িয়ে পড়তে থাকে... আল্লাহ আল্লাহ বলরে ভাই হায় আল্লা রসুল/কোন মহালের মাহুত রে তুই হায় আল্লা রসুল...। গানের রকমফের থাকে ওঠানামা থাকে আর সব ছাপিয়ে জীবন্ত এক সুরও।নদীও এক সময়ে সাবলীল গান লগ্ন হয়ে ওঠে,আশ্চর্য আহ্লাদে লালন করে গান ও গানের প্রেক্ষিতে স্থাপিত সবুজ এক জনপদ।গীদাল বয়াতি পিঁরফকির কাঁঠালখুটার ময়ুরমুখা দোতারা তালবাদ্য।সব ছাপিয়ে অনিবার্য হয়ে ওঠে সাহেব ও তার ঘোড়া।ঘোড়ার ছুটে চলা ধীরলয় ছন্দপতন পুনর্বার ছন্দের জাদু পাওয়া সমুদয় মিলেমিশে অত্যাশ্চর্য গাথাকাব্য ও মিথ হয়ে ওঠে।মিথপাশের ধুলোর মতো উড়তে থাকে আর গেঁথে যেতে থাকে গ্রাম দেশের উঁলুজোকার ও বিবাহবাজনার সঙ্গে।

২৫।

চা বাগানের হাটের ভিতর ঘন জটলার মধ্যে থেকে কিংবা মোরগলড়াই হাড়িয়ার হাট থেকে সরে এসেও দ্বিধাগ্রস্ত ডানকান সাহেব একসময় দাঁড়িয়ে যান।আদতে সাহেব দাঁড়ান না,দাঁড়িয়ে পড়ে তার ঘোড়াটি।দাঁড়িয়ে থাকার আদিঅন্তহীনতায় অবকাশ যাপনের আবডালে সাহেব চোরাচোখে তার বন্দুকটিকে দেখে নেন।গায়ে হাত বোলান ঘোড়াটিরও।হাট হাটের মতো নিস্পৃহ উদাসীন,বেরিয়ে আসা বাতাসের মতো।অন্তহীন এক কালখন্ড আর আটকে থাকা লেপটে থাকা বাঁশফোঁড় টুডু কুজুরদের গ্রাম সহজ জীবন ধামসার তাল খুটামারার সাঁকো ডোবোর হাট শ্মশান ও সাসানডিরি কীর্তনবাড়ি জিতুমনি বডুয়ার মুখানাচ আড়বাঁশি।অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে কি ? সীমায়ন থাকে না, বোধকরি শতাব্দীপ্রাচীন একটা বাড়ি এ কথা জানে আর সমূহ জ্ঞানভান্ডার এঁকে রাখে বাড়ির দেয়াল ও মাটি লেপা উঠোনে আর সামান্য নস্টালজিয়াও থাকে হয়তো বা।আর এসবের অন্তহীনতায় লীল হয়ে গিয়েও পুনশ্চ ফিরে আসে ডানকানসাহেব ঘোড়া ও বন্দুকসহ বড়াইবাড়ির প্রশান্ত বৃক্ষঘেরা উঠোনের মধ্যিখানে।

২৬।

তবু তো পেরিয়ে আসতে হয় অসংখ্য ঝাড়-জঙ্গল-বাবলাবন-কলার বাগান।গহিন ছমছমে বৃহৎ কোনও অরণ্যভুমিতে প্রবেশ করবার আগে যেমন আট-দশটা সংক্ষিপ্ত সাঁকোহীন নদী।জীবন ছন্দময় প্রবাহিত হয়।বাইসন হানা দেয়।হাতি মানুষ মারে।অথচ জীবন থেমে থাকে না।শোকপালনের অবকাশই দেয় না।মাঠ প্রান্তরের ভিতর বছরের পর বছর সাহেবদের কবর শুয়ে থাকে।আরও জীর্ণ ও পুরাতন হয় ক্রমে ক্রমে।মকবুল বয়াতির দোতারার ডাং কোন কোন শীত রাতে ওম ও উষ্ণতা ছড়ায়।উষ্ণতর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় শামিল হয় পাখি ডাক,মনশিক্ষার গীত-‘কচুপাতের পানি যেমন রে/ও জীবন/টলমল টলমল করে ...’ বিধ্বস্ত পুরুষ উঠে দাঁড়ায়।তার সর্ব অঙ্গে দৃঢ়তা জমে।আর অন্ধকারেই রাস্তা খুঁজে পায় সে।তখন আঙিনায় নাচগানের আসর।ঢোল-সানাই।আর নজরুল ইসলামের মরমিয়া গান-‘আইসো মোর কালাচান,যাও খায়া যাও বাটার পান’... জোতদারের ধানের গোলায় আগুন।অথচ উদ্বেগহীন জোতদারের মুখে তখন তেভাগার গল্প।লাল পতাকা,কৃষকজনতা ও বারুদ বন্দুকের গাথাগল্প।গল্পপথে রক্তের দানা ফন্দিফিকির ও সমূহ চক্রান্তকথা।আগুন প্রায় নিভে আসে অথচ গল্প শেষ হতে চায় না।আদতে এক গল্প কিছুদুর গিয়েই নানা প্রশাখায় বিভক্ত।তাই এমন ধারাবাহিকতার মজাদার ফানুষ।এইসব গল্প খুঁটে খাই আমি।আমোদিত হই।আর বাড়ি ফিরবার পথে সন্ধে ও রাত্রির মধ্যপর্বে প্রায়শই বাঁশবাগান পড়ে।বাঁশবনের ভিতর অগণন জোনাকি।মন্দ আলোর নদী।সামন্তরক্তের মতো।লোককথার ঝোলা কাঁধে অপরূপ সব কথোয়াল হেঁটে যান।তাঁরা হেঁটে যেতেই থাকেন।আর ভালোবাসার পাশে সন্ত্রাস-রক্ত-লালসার আগুন।জন্ম ও মরণ লেখে বাজপাখি।

২৭।

. আমি সারাজীবন বহু দোলনা দেখেছি, দেখবোও। আমার মেমরী ব্যাঙ্কে কতিপয় পাগল থাকবেন যারা মধ্যসেতুতে সাঁকো ঝাকায়। আর তারা একাজ করে বলেই আমরা হয়তো লিখতে পারি সাঁকো ও শালবন। আবার থালা বাসনের কথাও তো ভাবি। মাটির কলস আমাকে টান টান উত্তেজনায় রাখে। লোকদেবতার থানে বেড়াতে যাই। অথচ, বরাবরই আমাকে টেনেছে অপদেবতারা। যেমন আমাদের মাশানঠাকুর। অন্ধকার রাতের এই আদিম পুজো আমার জীবন টলিয়ে দিয়েছে। তাই নাচগানের আসর থেকে ঘুরে এসে আমি বালিতে মুখ ঘষি । অজগরের মতো ঘুমিয়ে পড়ি। অথচ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে যায় যখন বোবায় ধরে । কিছু করার থাকে না । শূণ্য রুমাল নাড়াই । বিষন্ন হবার আগে আমাদের গলা লম্বা হয়ে যায় । কিন্তু দ্রতগামী অশ্বের লেজ ধরে ঝুলে থাকবার দিনগুলি যে পেরিয়ে এসেছি । তাই সন্ধ্যেবেলায় টেলিফোন বেশ বিগলিত থাকে । বড় বেশী মধ্যবিত্ত হয়ে যাই । মধ্যবিত্তরা বোধ করি নিরাপত্তার অগ্নিকুন্ডলীর বাইরে বেরিয়ে জীবনের গল্পে ভাসাতে পারবেন না । তাই কবিতার লিখার জীবন সুগন্ধের পিঁড়ি পেতে বসে । শ্বেত চন্দনমাখা রুমাল হয়ে পতপত ওড়ে।

অনিবার্যভাবেই আমরা মাঝে মাঝে তাই পাহাড়ে বেড়াতে যাই । পাহারের আশে পাশে প্রাচীন গুহা ,বিজ্ঞাপনের টুপি ওড়ে । ছায়া খুবই অর্থবহ; তবু্ও সংকেত টেনে আনে অধুনালুপ্ত ব্রতকথা। উপাখ্যান । এই জনপদে ঘুরে ফিরে ভোরবেলা আসে । রাস্তাগুলি নদী হয়ে যায় সব । প্রিয় শব্দেরা দলা পাকানো কুয়াশার অনুবাদে মুখর । শান্ত শব্দেরা ঢেউয়ের ডাকে পুনশ্চ চঞ্চল । উদ্বেল। বেশ তবে শিখিয়ে দাও কিভাবে উদ্বেল হতে হয় । কিভাবে রাত পাখিটির সাথে একা একা শূণ্যতাযাপন !

২৮।

ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কিংবা স্বপ্নতাড়িত কোন এক ঘুমকুহকে ঢুকে যেতে যেতে মাতব্বর তার সমগ্রতায় এক ধরনের শিহরণ টের পায়;তার মনে হয় কোথাও জায়মানতা থাকে না;কেবল নদীর ভিতর জেগে ওঠে অগণন নদী যাদের আঞ্চলিক প্রবাহের ফাটল ছুঁয়ে বিষন্ন সব বুদবুদ জেগে ওঠে।মাতব্বর আবার দেখতে পান ফালাকাটা শহরের কবেকার সেই শহর কাঁপানো বাঘটিকে।বাঘ কেবল আর বাঘ থাকে না,তার গায়ের ডোরাকাটা হলুদের উজ্জলতায় বারবার মানুষের তাড়া খাওয়া,জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাঘের ভীত সন্ত্রস্ত দিশেহারা ছুটে বেড়ানোটুকু বুঝি মাতব্বরের ঘুমকে হিমশৈলের মতো জাগিয়ে রাখে।অনন্ত ঘুমের কুয়াশাময় আর্তিতে কোচবিহার রাজার শিকারী ভাই ফালাকাটা শহরের বিপুল জমায়েত ডোরাকাটা বাঘের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা জার্মান সাহেব;সব যেন তুমুলভাবে দুলে উঠতে থাকে।

মাতব্বর তার ঘুমকে সঞ্চরণশীল মেঘের মতো,বৃষ্টিপতনের মতো স্থিরতা এনে দিতে না পারলেও তার প্রয়াসটুকু জারি থাকে।জোতদারবাড়ির ভগ্ন আগাছা গজানো বর্তমানে এসে নস্টালজিয়ার রেশ ও রেণু সর্বাঙ্গে মাখতে মাখতে মাতব্বরকে ঘুমের পাঁকে পাঁকে তুমুল ডুবেই যেতে হয় পরিত্রাণহীন ভবিতব্যতায়,সুদূরপ্রসারী কোন গানের মতোন।

২৯।

এইভাবে একপর্বে গানমাষ্টার কিংবদন্তির মত হয়ে ওঠে।হারাতে হয় নিজনাম।তার গান, গায়নভঙ্গি কণ্ঠের জাদু তাকে লোকপ্রিয় করে তলে।উত্তীর্ণ হয় গানমাস্তারে।গৌরিপুরের রাজার বেটি নিহারবালার ডাকে সে ঘুরে বেড়ায় গৌরিপুর আভয়াপুরি গদাধরের ভূগোলে ভূগোলে ।কত গান কত বাদক গিদাল লোক মানুষের উত্তাপ তাকে অঙ্গে মাখতে হয়।সে সব বড়ো যুদ্ধের সময়কালের।ঐ যেবার বোমা পড়ল।হিটলারের নাম প্রথম যেবার শুনল গানমাষ্টার।আর গরুর গাড়ির নিচে শীত রাতের লণ্ঠন দোলে ভয় ও ত্রাসে। মানসীর বাড়িত মানসী নাই সুকান দিঘিত পানিনাই ।

৩০।

এইভাবে একটানা আমাকে শুনে ফেলতে হয় আখরটি।গানমাস্টারের গল্পটি।১৯১৫ এর পৃথিবী ২০১৪ তে এসে থমকে দাঁড়ায়।তখন টাড়িবাড়ি বাতাস আকাশ রাজাজোতদার শিকারটিকার দোতরাসারিন্দার দীর্ঘ পরিভ্রমণ সাঙ্গ হতে না চাইলেও ইতিহাসপুরানকে নুতনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস সচেতনভাবেই জারি থাকে।দূরের মাঠ নদি থেকে হাওয়া আসে। হাওয়ায় জাগে শত শেয়ালের ডাক।মাঘনিশিথের ককিল।জিনপরিময় সময়ক্রম।সব কিছু না সরিয়েও বুঝে নিতে পারি কোথাও বিনির্মিত হচ্ছে নিম্নবর্গীওদের ইতিহাস,য়ার ভিতর বাদ্য বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছেন আমোদিত এক গানমাস্টার।

‘আরো দিয়া যায় পীরীতির বায়না’...

৩১।

হাটের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ফাগুন চোতের রোদ হাওয়া অতিক্রম করতে করতে রতিকান্তকে কখন কিভাবে যেন মহামহিম এক হাটখন্ডই হয়ে উঠতে হয়! হাট থেকে হাটের দিকে যেতে যেতে সে তার ঢোল,ঢোলের কাঠি সমেত কত কত খেতপাথারবাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। অনুপ্রবেশের হালহকিকত থেকে নতুন ধানের চিড়া খইএর সুঘ্রাণ তাকে আমোদিত করলে রতিকান্ত ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে কিন্তু মগজের কোষে কোষে গান ঘুম আর স্বপ্ন নিয়ে সে অনুপ্রবেশের চিরকালীনতাকে হাটগঞ্জের বাতাসেই যেন উড়িয়ে দিতে চায়।

৩২।

জীবনের উজানে কি যাওয়া হয় মানুষের!জন্ম জন্ম ধরে জন্মান্তরের পাকে পাকে ভাটির দিকে এগিয়ে যাওয়াই যেন গাঁথা হয়ে যায়।রতিকান্ত বয়াতি ঢোল বাজাতে বাজাতে মাথাভরতি বাবড়ি চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কখন বুঝি চলেই যায় হাওড় বাওড় বাওকুমটা বাতাসের নৈরাজ্যের ভিতর। তার কাঠিঢোল নিয়ে সে জীবনভর যেতেই থাকে সোনাপুর মথুরা নিমতি তপসিখাতা বঞ্চুকুমারী দেওডাঙ্গা শালকুমারের হাটে হাটে। ধুলোর ঘূর্ণী তাকে ঢেকে ফেললেও সে কবেকার যেন বংশপরম্পরাসূত্রেই ভীষণভাবে ঢোল দোতরা আর নাচগান নিয়ে হাটের ভিতর চলে আসে;চলেই আসতে হয় তাকে। বুঝি রতিকান্ত বয়াতি ছাড়া,বয়াতির ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি বিনা হাট শেষাবধি কিছুতেই হাট হয়ে উঠতেই পারে না! রতিকান্তের গান,নাচের বিবিধ মুদ্রা,কাঠি ঢোল দীনদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে নদীজঙ্গলজনপদের ফাঁকে ফাঁকে অনবরত হাটখন্ডগুলি পাশ ফিরতেই থাকে।

৩৩।

ভাঙা হাটের হাটফিরতি মানুষের চোখেমুখে চলন বিচলনের ভিতর আকুলতা বিকুলতা থাকে বুঝি! তেমনভাবে রতিকান্তের কথা কেউ না জানলেও রতিকান্তের বয়াতি হয়ে ওঠার গল্পগাথাটুকরোগুলি হাটের পরতে পরতে আঠার মত আটকে থাকে। রতিকান্তর গুরু ঝাম্পুরা, কিংবা তারও গুরু নালচান সব যেন আইলে আইলে হাটতে থাকে। হোঁচট খায় আইল কাশিয়ার থোপে থোপে। সবজিহাটার পথে কুঁপির আলোয় চতুর শেয়ালের চোখের ভিতর আগিলা দিনের গান বাজে। বাজতেই থাকে। যেভাবে ঢোলের লোকজতা নিয়ে সর্বশরীরে বিষাদ মেখে নেয় রতিকান্ত বয়াতি। বাতাসের খুব নিকটে কান পাতলেই পাখিদের ডাক,পাতা খসে পড়া; আর সব ছাপিয়ে হু হু হাহাকার হয়ে বেজে ওঠা গান,

‘ও মুই কং তোমার আগে

ও মোর কইতে শরম নাগে

সগায় যাছে মেলা দেখিবার

মোক না নিগান কেনে’

৩৪।

গান বলি নাচ বলি কালখণ্ড বলি সবেরই ভিতর যাপিত জীবনের প্রবহমানতা গল্পের পর গল্প জুড়ে যেন ঘাসের স্তূপ বেরিয়ে আসা বাঘেরা বুঝি জল খেতে চলে আসে দিনকাল ভুলতে বসা হাটবাজারের ভিতর! এতসব ঘটে,ঘটেই চলে; রতিকান্ত বয়াতির বিশ্বাসযোগ্য কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। গান শুরু হয় নাচ শুরু হয়। বাদল মেঘের নিচে রতিকান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। রতিকান্তর কোন বৃত্তান্ত রচিত হয় না। বরং রতিকান্তই নতুন নতুন সব বৃত্তান্তের জন্ম দিতে থাকে জলহাওয়াজনপদের ভিতর।

৩৫।

সাঁতার কাটা বা না কাটাটা বড় কথা নয়। সন্তরনশীল এক যাপন নিয়েই তো মানুষের জন্মের পর জন্ম কেটে যায়। ভাবনাস্রোতের বাঁধনহীনতায় টুংটাং দোতারার সুর জটপাকানো স্বপ্নের ভিতর অনেকানেক পাখির ডানাঝাপটের আশ্চর্য দৃশ্যপট হয়ে চোখে ভাসে। তখন আলোহীন সাঁতারহীন এক জীবনযাপনের নেশার টানে ইয়াসীন মাতব্বর উঠে দাঁড়ায়। হাই তোলে। শরীরের পেশীসমূহে একসময়ে স্থিতাবস্থা এলে মাতব্বর দীর্ঘ এক হাটার জন্য পরিক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কোথা থেকে যেন দোতারার আওয়াজ উঠে আসে। কে বাজাচ্ছে কে জানে! মাতব্বর হাঁটা শুরু করে জোতদারটাড়ির জঙ্গলের দিকে। জঙ্গল অতিক্রম করে তাকে দ্রুত পৌঁছতে হবে একুশ ঘোড়ার ধনকান্ত জোতদারের বাড়ির খোলানে।

৩৬।

সে কবেকার কথা মাতব্বর জানে না। তবে মাতব্বরের প্রবীণ চোখের তারায় তারায় এখনো কী জীবন্ত সব দৃশ্যপট। তখন চারধারে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। চা বাগান। রাজবংশী আদিবাসীদের বসত। গুটিকয় মুসলিম টাড়ি। বাগানবাবু। ফরেস্ট বাবু। ধনকান্তের বাপ তখন জোতদার। আধিদৈবিক জীবনের বর্ণময় যৌথতা। তার খুব মনে পড়ে জার্মান সাহেবের কথা। মাতব্বর তখন ছোট। বাবা দাদার সঙ্গে হাটগঞ্জে ঘুরে বেড়াত। কত কত মানুষ। হাটের পথে ধূলোর ঘূর্ণী। সন্ধ্যে পেরিয়ে অনেক রাতে কতবার বাড়ি ফেরা। গরুর গাড়ির ক্যাঁচর কোঁচর শব্দ। গাড়ির ধুরায় কালিপড়া লণ্ঠণের দুলুনি। ছইএর ভিতর থেকে লণ্ঠণআলোর কম্পনরেখায় ভৌতিকতা দেখা যেত। যেন নদীর জলে ধরাছোঁয়ার খেলা। একবার শালকুমারের জঙ্গল থেকে বাঘ বেরিয়ে এসেছিল। গোটা দিন সেই বাঘ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ফালাকাটা শহর। শেষে কোচবিহারের রাজার এক শিকারি জ্ঞাতিভাই এসে সেই পাগেলা বাঘকে মেরে ফেলেছিল। মাতব্বরের এক নানুভাই ইয়াসিনউদ্দিনকে এক চাঁদনিতে শিঙের গুঁতোয় শুইয়ে ফেলেছিল বাইসন। এত এত স্মৃতির জটে আটকে যেতে যেতে চার কুড়ির মাতব্বর যেন ফের ধাক্কা খায়।

৩৭।

পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে কোন এক কুহকের দেশে বারংবার ফিরে আসতে থাকে জার্মান সাহেবের ঘোড়া ,বন্দুক ও বাজখাই টুপি। কত কত বাজারহাট নদীর ঘাট ঘাটোয়াল রাখালবন্ধু মইষাল একোয়া হাতির মাহুত বুধুরাম –হাসতে হাসতে নেমে আসছে মথুরা হাটের খুব ভিতরে! প্রবেশ প্রস্থানের নিয়তিতাড়িত সম্ভাবনায় পাতলাখাওয়া শুটিংকাম্পের হরিনেরা একযোগে নাচের একটা ঘোর তৈরী করতে একধরনের নতুনতর নাচই যেন বা বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। মাতব্বরের হাঁটাটা জারি থাকলেও এক পর্বে দোতরা আর বাজে না।

৩৮।

কালজানি নদীর কাছাড়ে আটকে পড়লে কে তাকে উদ্ধার করবে। নদীপাড়ের জঙ্গলে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। ডাকে। অথচ ঘাটোয়াল আসে না। বাউদিয়া, ঘাটোয়াল ঘাটবাজার ছেড়ে কোন পালার আসরে গেছে বাঁশিয়ালের সাকরেদ সেজে...। ঘাটের শূন্যতায় চরাচরবাহী ব্যাপ্ততায় লীন হবার সমাধান সূত্র নিয়ে মাতব্বর নেমে পড়ে প্রাক শীতের আশ্বিনা নদীর জলে। পাহাড়ী নদীর শীতল বরফগলা জল তার পায়ের পাতা গোড়ালি উরু ও কোমর স্পর্শ করলেও শরীরময় একাগ্রতায় সে হাটফেরত মানুষের ঘরে ফিরবার শৈশবস্মৃতির ভিতর কেমনধারা ডুবেই যায় যেন। আর বাঘের নদী পেরিয়ে এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল পারাপারের সফলতার মত নদীটা ঠিক সে পেরিয়েই আসে। তারপর শরীরময় হাসির তাড়সে কাঁপতে কাঁপতে নাভির তলদেশ থেকে গান তুলে আনতে থাকে-

‘হালুয়া রে হালুয়া

পাতলাখোয়ার হালুয়া

হালুয়া রে হালুয়া

বলরামপুরের হালুয়া’

গানের মত্ততায়, গানের উজান ঠেলে সাজানোছড়ানো আকাশময় মেঘরোদের পৃথিবীর মায়াবন্দর দিয়ে সে যথারীতি পৌঁছেই যায় একুশ ঘোড়ার জোতদারের বাড়ির অন্দরে। অবশ্য এখন আর জোতদার নেই। রাজা নেই। জার্মান সাহেব মরে ভূত। কিন্তু জোতদারতাড়ি আছে। রাজারহাট রাজারদীঘি সাহেবপোঁতা এসকল রয়ে গেছে স্মৃতির শস্যবরণ নকসাদার শাড়ির পাড়ের চিক্কণতার মতো।

৩৯।

মাতব্বর জোতদারবাড়ির জোড়শিমুলের গাছের গোড়ে বসে পড়ে। ক্লান্তি না থাকলেও সে ঘুমিয়ে পড়ে। নিন্দের আলিসায় টোপ পাড়ে। ঘুম ও জাগরণ নিয়ে তার দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেমনধারা কেটে গেল।পর্ব পর্বান্তরে স্মৃতিচিহ্নিত যাপনবিন্দু দিয়েই সে উজানভাটির স্বপ্নকাতর জীবন কাটিয়ে দিল। বাইচের নাও বেয়ে বেয়ে তবে কি চলে যাওয়া যায় আর কান্দাকান্দির মেলায়! বাওকুমটা বাতাসের ঘূর্নীতে আঁতকে উঠে ভয়ার্ত শেয়ালের কান্নায় সচকিত হলেও নতুন নতুন সুরস্বপ্নের ধারাবাহিকে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে চোরাবালিছোঁয়া হাওয়া। ফালাকাটা শহরের বাঘ। স্মৃতির দীর্ঘ অভিশাপের ভার বহনের ক্লান্তি শোকের দিনগুলিতে ফিরে যাবার উদগ্র বাসনার মতো কখনো হামলে পড়লেও জীবন চোরকাঁটাবাবলাবন, ঝাড়ের বাঁশের আবহমানতায় বহুধাব্যাপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। ইয়াসিন মাতব্বরের চার কুড়ি বৎসর অতিক্রান্ত শরীর সচেতনভাবেই আরো আরো ঘুমের ভিতর ডুবে যেতে থাকে। ভূগোলইতিহাসের বহুস্বরের মধ্যে তার ঘুমজড়ানো অস্তিত্ব একসময় মুছে যায়। ঘুম না ভাঙাটাই তখন চিরসত্য। মরণঘোরের মতো স্পষ্টতর ক্রমে।

৪০।

বৃত্তান্তের আরো আরো ক্রমবর্ধমানতায় মাতব্বর স্বয়ং নবীকৃত চিরনতুন বৃত্তান্তের রূপকথা হয়ে বৃত্তান্তকে মান্যতা দিতে গিয়েও বৃত্তান্তের চিরবিষন্নতায় লীন হয়ে যেতে যেতে তীব্র এক ঘুমের বৃত্তের অত্যাশ্চর্যে চিরায়ত কোন বৃত্তান্তই বুঝি তীব্র বাজনার মতো ঢের বাজাতে থাকে আর বৃত্তান্তের দিকে তুমুল বৃত্তান্ত হয়ে হেঁটে যেতে থাকে শুভ্র হাঁসের দল।

৪১।

এই ভরা রোদের পৃথিবীতে আজকাল নিজেকে বেশ ভরভরন্তই মনে হয় সখিচরনের। হেমন্তের মাঝামাঝি। চারপাশে রোদের বিস্তার। নরম হলুদ মায়াময় রোদের ভিতর হাঁটতে হাঁটতে কখন কিভাবে যেন জন্মান্তরের ডাক শুনতে পায় সখিচরণ। তার হাতের মোহন বাঁশিটিকে বহুমাত্রিকতায় পেয়ে গেলে ভরন্ত ধানমাঠের ভিতর ঢুকে পড়া। জীবনের পর জীবন সে কেবল রোদ চেয়েছে।

রোদভরা সংসার চেয়েছে। জীবন ফুরোয় না। শস্যের ভাঁড়ারে বুঁদ হয়ে বসে

পড়ে জীবনের ভিতরকার কুহকখন্ডগুলি তাকে ভাবিত করে তোলে।

৪২।

সেই মথুরার হাট। ভরা হাটের মধ্যে ঢুকে পড়া। মোরগহাটির পাশের মাঠে

মোরগলড়াই। ধামসা মাদল। চাটের গন্ধ। হাড়িয়ায় আকুল সব হাটুয়া। সখিচরণ

ঠিকঠাক দৃশ্যের ছায়ায় মিশে গিয়ে নিজেই এক দৃশ্যপট রচনা করে ফেলে।তার চার কুড়ির সুঠাম পেশল শরীরে আহ্লাদ জড়ো হলে সে হাটবাজারের দিকে উদাসীন

তাকিয়েই থাকে। চোখের ঘোলাটে পাতায় কীর্তনবাড়ি জেগে উঠলে সে বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও কেমনতর এক দ্বিধাও কাজ করতে থাকে। কালজানির স্রোতে ভেসে যাওয়া শোলার ঠাকুরের মতো। সখিচরণ অতীতচারিতাকে মান্যতা দিয়েই বর্তমানে ফেরে। মথুরা হাটে সন্ধ্যে নামে। সখিচরণ হেঁটে চলে সাহেবপোঁতার জঙ্গলের দিকে। ধনীবাড়ির হরিবাসরে আজ অনিবার্য বাজাতেই হবে তাকে বাঁশিটি। ম্যাজিক লন্ঠন দুলিয়ে হাঁটুরেরা সঙ্গও

দেয় বুঝি তাকে। হাট থেকে হাটে গানকীর্তন আখরেআখরে বিমূর্ত হয়ে থাকে

এই পরিক্রমণ।

৪৩।

কীর্তনের তালে তালে দুলতে দুলতে কীর্তনতত্বের আখরগুলির ভিতর ডুবে যেতে যেতে সখিচরণ তীব্র উঠে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়া শরীর নিয়ে কেমন এক অভিজ্ঞতাময়তায় দীর্ঘ জীবনের দিকেই যেন তার নেমে যাওয়া। সখিচরণ কি নিঃসঙ্গ! না কি নিঃসঙ্গতা নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া আস্ত একটা জীবন তাকে কি সত্যিই কোন জীবনযাপন সাজিয়ে দিতে পেরেছিল! সখিচরণের তামাটে গাত্রবর্ণ,

তাকে লালন করেছে হাওড় বাওড় নদীনালার দেশ। বাঘশিকারের দিনগুলি যখন ফ্রেমবন্দী হয়ে শহরের অডিটোরিয়াম মাতায় তখন সখিচরণের তামাটে হয়ে ওঠবার রহস্যটি কিভাবে উন্মোচিত হয়, সে সংশয় জাগরুক হলেও বাতাসে ভেসে

আসে আবহমানের সব আবহমান দেশকালজনলগ্নতা। সখিচরণ কি আদতে অন্তহীন বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভূবনমায়ার বৃওে বসতভিটার ভিতর বৃওান্তের সব দৃশ্যপট

নির্মাণ করতে করতে অতিলৌকিক জীবনযাপনের ভরভরন্তের ভিতর চুপিসারে ঢুকে

পড়তে থাকবে।

৪৪।

হিম ও হেমন্তের এই সময় বড় মনোরম এক ইশারায় ডেকে নিলে সখিচরণ ঔদাসীন্য দিয়ে অন্যমনস্কতা দিয়ে দূরেকাছের সব খেতপ্রান্তরআশমান বুঝি দেখতে

থাকে; যেন অনন্তকালের চিরকালীনতায় সে জীবনের অপার রহস্যকে খুঁজতে খুঁজতে

সাহেবপোঁতা থেকে বেরিয়ে আরো আরো কতো মথুরাহাট,সাহেবপোঁতা বা তপসীখাতার দিকে চলে যাবে! জীবনের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়ে কখনো ভাবতে

দেখা যায় কি তাকে! সে কেবল মেঘ সাজানো আকাশের তলদেশে নদীর পারের

কুলজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ধরাছোঁয়ার খেলাটাই খেলে গেছে আজীবন। তার বিষাদ তাকে অন্তহীন জনমানুষ কীর্তনবাড়ি ভাটিখানা মরিচখেত সরিসাভরা মাঠের দিকদিগরেই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সখিচরণ তার শিল্পীস্বত্বায় টের পায় কেবল

প্রাণবিন্দুটুকুন। প্লুত এক সুখানন্দে আবিষ্ট হতে হতে তার নিঃসঙ্গতায় মধ্যরাতের

শেয়ালডাকের মতো কেবল চিরনতুন বাঁশিটিই বেজে ওঠে। তাকে সঙ্গ দেয়। তখন ভরা শীতের স্মৃতির সঙ্গে সে গুলিয়ে ফেলে ভরা বর্ষার স্মৃতিকেই। তার কি স্থবিরতা আসে? না কি, জীবনের বিষণ্ণতা গান হয়ে উঠতে উঠতে একসময় শ্যাওলাসবুজ কোন কাঠামবাড়ির জঙ্গল হয়ে ওঠে আর মাটিলগ্ন হতে হতে সে বুঝে নিতে থাকে কত কত গাঁথা শোলোক দরবেশী গানের সান্ধ্যভাষা।

৪৫।

বহুবর্ণতার ভিতর বহুবর্ণ এক যাপন নিয়ে সখিচরণ যাপনকেই বহুবর্ণ এক জীবনযাপনে উন্নীত করতে থাকে। ঋতুচক্রকাল আবর্তনের ধারাবাহিকতার ভিতর চিরদিনের সব মানুষের রোদের বিস্তারিতের দিকে চলে যাওয়ায় কেমন এক আহ্লাদ থাকে; শীতের হিম, কার্তিকের জ্যোৎস্নায়, কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া নদীবক্ষ সবকিছুর ওপর কেমন এক মায়াময়তার রঙীণ বিছিয়ে পড়া যেন। সখিচরণ ভরভরন্ত যাপন

দিয়েই তার অস্ত্বিত্বকে মহামান্য করে তোলে। সখিচরণ আসলে প্রতীক। যে প্রতীকতার আড়ালে আস্ত এক জীবনই বুঝি সংশয়তাড়িত হয়ে চেপে বসে। হাসি,বাঁশি,পেশীময় শরীরের তীব্র আর্তি নিয়েই ভরভরন্ত জীবন হয়ে সখিচরণ

কেবল হেঁটেই যেতে থাকে।

৪৬।

জটাজালে।নতুন ভাবে ফিরে আসা স্বপ্নগুলি দিনরাত্রির স্রোতে ভেসে যেতে থাকে ভেসে যাবার দ্বন্দদ্বিধা নিঃশব্দে সরিয়ে রেখেই ।জীবনেরপ্রবলতাটুকুন পিষে ফেলতে চাইলেও সবজিবাগান উঠোনের ধানের স্তরে স্তরে তন্ত্রমন্ত্রের খাতা মেয়েলি গীত ভেসে আসতে থাকে অনর্গললুপ্তপ্রায় লোকশব্দের অন্তজ্যতার মতোন।গানের ধারাবাহিক আবর্তে যাদুটোনা থাকলেও পুরনো পৃথিবীর থেকে তো আর টেনে আনা যায় নামাছধরার লোকক্রীড়া,বঁড়শি ছিপ বর্শার ধারালো চিক্কণে নূপুরশব্দে সচকিত কোনো জোতদারবাড়ির অলিন্দ সাজঘরে বড়ো দালানোরনাট্যযাত্রা মহড়া খিলখিল হাসির চটুলতা;তবু ঢেঁকির ওঠানামার শব্দের ছন্দে ছন্দে বিমিশ্রিত যাপন টুকরোগুলি আদিতমারির বাঘের পোষননখ যা ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্বমুহুর্তে দৃশ্যমান হয়েছিল কবেকার অতীতচারী মধ্যরাত্রির কন্দরে।জীবন বইতে থাকে নদীর কিনারে কিনারেকুলজঙ্গলের সীমাপরিসীমার বাইরে ঢেঁকিশাকের দঙ্গলে পুঁইমাচায় মরিচখেতে উড়ে বেড়ানো ঘুরে বেড়ানো জোনাকির ভিতরে হাঁটতে হাঁটতেজীবনই কেমনধারা এক অসহায়সর্বস্ব বিষাদই বুঝি এনে দেয় গাননাচের চৌহদ্দিতে।

৪৭।

পুরনো পৃথিবীর লোকোত্তরে অবিরাম পাক খেতে খেতে পুরনো পৃথিবীর আলো-অন্ধকারকে মাখতে মাখতে চাচামিঞা তার বৃত্তকে সম্প্রসারিতকরে তুলতে থাকে প্রসারনের গতিপ্রকৃতির খন্ড-বিখন্ড জুড়ে জুড়ে অনবদ্য এক জীবনযাপনের তালপাকানো আদিমতায় নিঃশঙ্ক ফিরে আসতেথাকে।সময়ের সময়গ্রন্থির বাদামখোসার ভেঙে পড়বার মতো।হাহাকারের কোনো পর্বে যেন চিরকালীন এক হাহাকার এসে ঢোকে।চাচামিঞাকফিখেত আলুখেত তাংকুবাড়ি পাটাবাড়ি পেরোতে পেরোতে এগিয়ে যেতে থাকেন আবহমানের এক টাড়িবাড়ির দেশে।কত কত গঞ্জবাজারেরউষ্ণতর স্পর্শে তার রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠা শরীরে সে টেনে আনতে থাকে মোরগলড়াই হাডুডুখেলা গানবাড়ির কন্দরের আশ্চর্য বাইজন।কতকিসিমের লোকমানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়।অনন্তকালের সব গানগুলি দিয়েই তো বেঁচেবর্তে থাকতে হয়।বেঁচে থাকার চিরকালীন গল্পেহামা দিয়ে ঢুকে পড়ে ক্ষীণ চাঁদ মোল্লাবাড়ি নিধুয়া পাথার।আর ভাঙাভাঙির টাড়ি দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে পুরাণপুরুষের ঢঙে গাছ পালারআড়ালে চলে যেতে গিয়েও নতুন এক সকালেররোদে শরীর মেলে দিয়ে জীবনের প্রাবল্যকে প্রাচীনত্বে রূপান্তরণের ব্যর্থতায় কেমনতর যেনহতাশায় ডুবে যাওয়া।এই নিমজ্জন থেকেও তো সরে আসা যায় না।ফাঁদে পড়া পাখির মতো এক জীবন অসহায়ত্বটুকুন পাথারবাড়িতে নাচতেথাকা নাচগানের ছন্দবদ্ধ পদাচারণায় জোতজমি হারানো কোনো জোতদারটাড়ির ছাড়াভিটায় কিংবা ভিতর এগিয়ে বসে থাকা পাখিদের।হাঁসেদের জল গড়ানো পালকের হিজিবিজিতে আত্মগত হয়ে ওঠে।এভাবে সংকট ক্রমে ঘন হয়।ঘনায়মান হাড়িয়ামেঘ,যেন বৃষ্টি নামাবে এমতোসম্ভাবনায় দীপ্ত হয়ে উঠতে গিয়েও চলনবিচলনভাঙা যাপনের প্রাবল্যে চিরনতুন যাপনটাই কেন্দ্রাতিগ হয়ে ওঠে।তখন গুয়াবাড়ি থেকেপূজাবাড়ি থেকে রেলপুল থেকে সোনারবরণ রোদমেখলায় আবৃত হতে গিয়ে জীবন তার গুরুতর সকল জিজ্ঞাসার সমাহারে জটপাকানোযাপনবৃত্তান্তের মহার্ঘ অংশ হয়ে উঠতে থাকলেও আদিমতার তাড়সে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে আমাদের অতিলৌকিক পৃথিবী তার রোদ মেঘকুয়াশাভেজা দিবারাত্রির মধ্যরেখা ধরে কেমনিতর ছুটে চলে অগুন্তি ঘোড়াদল।চাচামিঞার ক্লান্ত চোখের আলোয় পেশিময় আর্তি ও ক্রোধ খেলাকরে।জীবনকে নতুন এক জীবনের পর্বান্তরের ঢালে খোলে প্রবিষ্ট হতে দিয়েও কেমন এক পরাজয়ের বিষাদময়তায় জীবনযাপন অর্থহীনবোধের নান্দনিক দার্শনিকতার দিকে অর্থময়তায় পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকে।হতে থাকবার ধ্রুবসত্যতায়।তখন মরিচের বিস্তারময়বিস্তৃতিটুকুন অবলুপ্ত হাঁসের ঠোঁটে কিলবিল পিঁপড়েদের পদযাত্রার মতো গুহাগাত্রে আঁকা ঝরনার ছবি দেখে বরফগলা জলের স্রোতেবিপরীতমুখী নৌকোর অন্তহীনতায় স্বতঃপ্রাণিত জীবনছবিতে আঞ্চলিকতাবাহিত এক অঞ্চলগাথার সূত্র ধরে হাড়হিম শীত ঢুকে পড়বারঅবসরটুকু কীভাবে যেন গাড়িয়ালবন্ধুর গানের দমকে থমকে জীবনগানের দিকে গড়িয়ে যায়।অনন্তকালের গানবাজনা নিয়ে অনন্তেরকালখন্ডে এভাবে আবারো কখন যেন প্রবিষ্ট হয়ে পড়ে অতিলৌকিক এক পুরাণপৃথিবীর বারোমাস্যা।

৪৮।

‘গান কইরচে হায় প্রাণ ঢালেয়া

গোয়ালপরিয়া গীতি’

গৌরীপুরের গল্পে অবধারিত গদাধর নদী।অনিবার্য মাটিয়াবাগ।রাজকুমারী।খেলপাথার থেকে রাজকুমারী হেঁটে আসছেন হন্তদন্ত মাহুতবন্ধুরটানে।ঢোল বাজাচ্ছেন বসন্ত মালি।সারিন্দায় সীতানন্দ বুড়া।১০০ বলির দুর্গাপূজা এখন আর হয় না বুঝি।তবু গৌরীপুর থাকে গৌরীপুরেই।রাজবাড়ির দিকে যুগপৎ উড়ে যাওয়া কুয়াশা ও গানগুলি।আচ্ছা,রাজবাড়ি কি সমুদ্র পাখি!জলস্তম্ভ!স্তরীভূত মেঘ সরিয়ে একসময় নতুন চালেরপিঠে পায়েস খেতে আসে বাইদর হাতিরা।গদাধারের বুকে অগনন পানসি।গারো পাহাড় থেকে তরমুজ আনারস আসে।গাঙে গাঙে বিছিয়ে পড়েতারা কতকালের স্বপ্নবৃত্তান্তে হামলে পড়ে চিরজীবিত হাসপাতাল ও মেঘদল।উচ্চারণটাই যথেষ্ট তবু ফাঁকে ফাঁকে উচ্চারণহীন শূন্যতা গ্রাস করেআর অধুনান্তিক দোলকেদারার বাইরে অন্য স্বাদের স্বরিকতায় জেগে থাকা কৃষি বউ-এর গল্প শুনতে শুনতে ভোররাতের মোরগডাকধূলিমলিন বিকেলবারান্দায় আবশ্যিক যুক্ত হতে থাকা দৃশ্যখন্ডের কালচক্রে সাঁকো-পেরোনো মানুষের বিপন্নতাজাত বিষন্নতায় হাটবাজারজাতঅতিক্রমণের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েও জটজটিল এক কুহকে রচিত হতে পারে জেনেও ঝুঁকিবহুল বাহুল্যতায় বহুচর্চিত প্রসঙ্গের নিবিড় মমত্বেশেষবারের মতোন ঘুরে দাড়াতে চাওয়ার আর্তিটুকু নিয়ে উপস্থাপিত হয় কারন এর থেকে তো আর পরিত্রাণ,মুক্তি নেই।গৌরীপুরের হাতিরাঅনিবার্য হেঁটে হেঁটে জঙ্গল থেকে আরো আরো জঙ্গলের দিকে।হাতিদের অগ্রসরতার দিকে বশীকরণ,হাতির গান।তবু আদিম হয়ে উঠতে চাওয়াপরিসরে একটুকরো মেঘের জাগলারিতে মত্ত ডাহুক পাখিপশুসিরিজের একান্ত নিজস্বতাকে মান্যতা না দিয়েও মান্যতর সত্যতায়জলজঙ্গলজলার পাঁকে গা ডুবিয়ে বসে থাকা মহিষের কালো কালো অস্তিত্বের ব্যক্তিগতে এসে আদ্যন্ত ব্যক্তিগত প্রক্রিয়ায় পাকেচক্রেবোধশক্তিহীন অচলায়তন গুড়িয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে তীব্র ক্রোধ সহ উঠে আসা হাওয়ার বিস্তার থেকে সরিয়ে আনানদীমাঠপৃথিবীর ভিন্ন গল্পে সাজানো যাপনের আয়নায় কেমন যেন দেখে ফেলে নিজের মুখ নিজেই দ্বন্দ্বদ্বিধার পারাপারে।তখন শীতসন্ধ্যায়ঘুমিয়ে পড়া গৌরীপুর তার দর্শনটুকরোর আনাচেকানাচে ছড়িয়ে দিতে থাকে অনবদ্য এক দার্শনিকতা।তখন লোকগান লোকশব্দ লোক্ক্রীড়ালোকায়তকে মান্যতা দিয়ে অট্টহাসির বিব্রতকর পরিবেশস্থিতিতে লুকিয়ে থাকা অর্থবহ বা অর্থহীন এক জারকরসে লিপ্ত হওয়া মন্দমধুরগ্রহণতায় হাজার প্রজাতির পাখির উড়ালটুকুই সত্যাসত্য হয়ে থাকে যদিও এইসব ব্যক্তিবিশেষ এড়ানো ব্যক্তিজনদের সাথে মিশে গিয়েচাচামিঞা শেষাবধি চিরন্তন এক প্রতীক হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরতে থাকে হাতিমাহুত ফান্দির চিরলৌকিক কার্যপরম্পরার কুয়াশারভিতর।

৪৯।

উজান ঠেলে ঠেলে গল্প গড়িয়ে যায় নতুনতর গল্পের দিকে।আচ্ছা গল্পের কি সততই কোনো উজানভাটি থাকে।সব গল্প সব কথা একদা এসেবিমিশ্রিত গল্পগোলকে মিশে যায় আর এই অত্যুগ্র বাসনায় গল্প তার ভ্রম্যমাণতাকে মান্যতা দেয় আর অতিপুরাতন মিথজালকেররহস্যমোড়কের ছাইচাপার ভিতর এগিয়ে গিয়েও বহমানতায় নিবিড়তর অতিসংকেত মিথবাহিতা সত্ত্বেও নবজন্মের দিকে সরে আসতে চাওয়াদেশকালকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিক্ষত করে দিয়ে একপ্রকার যুক্তিফাটলে ধাক্কা খেয়ে অতিপ্রাচীন স্তরের মতো বারংবার ধ্বনিত হতে হতে ধ্বনিবাহিতহাহাকারের দিনকাল ছুঁয়ে অত্যাশ্চর্য এক হাহাকারই যেন হামলে পড়তে থাকে জোতদারটাড়ির প্রশ্নোত্তরহীন ধারাবাহিকতার যাবতীয়উচ্চারণের আদিঅন্ত গাম্ভীর্যে।তখন সন্ধের মাঠে মাঠে ধ্যানস্থ ধানখেতের অসীম শূন্যতায় কবেকার মানুষেরা হেঁটে যায়।রাজবাড়ির গল্পেআমোদিত সব ঢালু ছনের ঘরবাড়ি হাঁসপায়রার খোপরা শেষ রাতের ডেকে ওঠা মোরগ গ্রাম্যতার জাবনায় জমজমাট গোল আগুন যেনছড়াতে থাকে আবহমানের উত্তাপ গাথা।হাতির দল এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যাবার পথে আড়ে আড়ে দেখতে থাকে জোতদারটাড়িরসুউচ্চ টংঘর চা-বাগান গির্জালাইন বাঁশবাড়ি বস্তির কলাবাগানের সজীবতায় হাতির পাল প্রলুব্ধ হলেও নিজেদেরকে সংযত করতে করতে তারাচলে যায় খয়েরবাড়ি নীলপাড়ার দিকে।তখন জন্মান্তরের পাকে পাকে গভীর শূণ্যতায় দলা দলা কুয়াশারা উঠে আসে,পাক খায়।আর অনাদিঅতীত থেকে ইতিহাস ভূগোল ছোঁয়া মরমিয়া বাতাসের স্রোতে ভেসে যেতে থাকে ভেসে যেতে চায় ফাগুলালের ঢোলক সীতানন্দের সারিন্দাঅনিলের বাঁশি বেগম সুরাইয়ার ভাওয়াইয়া।ভেসে যাওয়া ডুবে যাওয়া ডুবসাঁতার থেকে চিৎসাঁতারে চলে আসবার খেলাটাকে পরিবর্ধিতগানের স্তবকে স্তবকে আটকে দিয়েও কি আর জন্মান্তরপ্রেরিত দানাফসলের দেশে আবহমানের বিপুল বিস্তৃতির পরতে পরতে ধুলো ওড়ার মাঠেমাঠে অনাবিল হাসিরমতো জন্মান্তর থেকে আরো আরো জন্মান্তর কুড়িয়ে এনে নাচগান কুড়িয়ে এনে কিভাবে শুকনো খড়কুটোর তৎপর জ্বলেওঠা।আগুনের আঁচে সকল হিমকন্থ দিনকালগুলির ভিতর গতজন্মের সব শীতশিশির জমতে থাকলে জোতজমির গল্পের তাড়সে ভরাফসলেরদিনগুলির ফেনিলতায় জীবন অনন্তের এক জীবনযাপনেই বুঝি রূপান্তরিত হয়।চাচামিঞা তখন পৌঁছে গেছেন অনন্তের কোনো ভরা হাটে মরচেধরা বন্দুক তীর-ধনুক ও পাখিপালকের খোঁজে।

‘দ্যাওয়ায় কইরছে ম্যাঘ মেঘালি’

৫০।

জীবনের ভিতর ডুবে যেতে যেতে জীবনের চলমানতায় কত কিছু যুক্ত হয়, যুক্ত হতে থাকে অনিবার্য গানের ঢেউএর মত। সুরেন বসুনিয়া নায়েব আলি টেপু কেশব বর্মন যাত্রাদল পাটের দাঁড়িগোঁফ বাঁশের তলোয়ার কেরাসিন টিনের বাজনা কালিমোহন বাবু আইনুদ্দিন কাচারি বাড়ি ডারিয়া ঘর শীতসন্ধের শেয়াল ডাক তুফানগঞ্জ থেকে কত কত বন্দরের দিকে চলে যাওয়া জীবনভর। পূবালি বাতাস টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম; আহা রে জীবন যেখানেই নিয়ে যাক বলরামপুরের বৃষ্টি কালজানির পালতোলা নাও দেহতত্ব ঢোলবাঁশিদোতরার ভাওয়াইয়া গান সঙ্গেই থেকে যায়।

‘বাহইতে নদী মারে

জোর শিঙ্গা দিয়া রে’

বারকোদালির দোলমেলা তুফানগঞ্জের মদমকামের মেলা দেওচড়াইএর কুষান পালার ছুকরি নাচ হলদিবাড়ির প্রিয়তম দোস্ত মোসারফ হোসেন মাছ মারবার বাহ পরব রাজার হাতি স্বদেশী গানের ঢেউ কালজানির খেয়া মাঝি রামরতন ঠাকুর সব মিশে যায় পর্বে পর্বান্তরে। কখন ঝাঁকড়া চুলের কাজি দা,কাজি নজরুল জীবনের পরতে চিরকালীনতা নিয়ে ঢুকে পড়েন তাকে নতুন মানুষে রুপান্তরিত করে দেবার জন্যই বুঝি বা। তার তন্দ্রার ঘোরে নেমে আসতে আসতে চিরসত্য হয়ে উঠতে থাকে ডোমারের চিকনমাটি গ্রাম। বেগম লুৎফুন্নেসা। হাসির শব্দে বেজে ওঠে পরিপার্শ্ব। পটভূমির ভিতর এসে পড়েন চুণীলাল বাবু শৈলেন রায় দূর্গাদাস বাবু কাননবালা ইন্দুবালা কোচবিহারের মিলাদ এ কাজি নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির দিনগুলি অকালমৃত আব্দুল লতিফ নাকু ঠাকুর বিমল দাশগুপ্ত তকবীর সাহেব ইসলামী গান পূর্ব পাকিস্থানের পল্লিসংগীত। চলমানতা আয়ত্ব করতে করতে চলমান দিকদিগরের ভিতর লীন হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। ভূতগ্রস্থ হয়ে হেঁটে যেতে যেতে তাকে অনুসরণ করে কানাই শীলের দোতরা গোলাম মোস্তাফা জসিমুদ্দিন ফয়েজউদ্দিন মজিরউদ্দিন পীয়ারু কাওয়াল ঠুংরি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর আদ্যন্ত এক বলরামপুর;আর গেয়ে ওঠা বারবার-

‘ও ভাই মোর কুচবিহারী রে’

৫১।

আব্বাসউদ্দিন কেবল আব্বাসউদ্দিন থাকেন না,থাকতে পারেন না। বলরামপুর থেকে তাকে সারা পৃথিবীর দীনদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে হয়। আর্ন্তজাতিক হয়ে উঠতে হয়। তার গানের শেষে অবধারিত বৃষ্টি নামে। বর্ষার সজলতায় ভেসে আসতে আসতে আব্বাস আমার ভিতর ঢুকে পড়েন। তার ভিতর নিমজ্জিত হয়েই তো আমার লোকজনপ্রবাহের তুমুল অংশ হয়ে ওঠা। আব্বাস চিরকালীন হয়ে ওঠেন। সবার আব্বাসউদ্দিন হয়ে ওঠেন। অন্তহীন গানের মতন-

‘হাঁকাও গাড়ি তুই

চিলমারীর বন্দরে’