ভাল ও নতুন কবিতাই লক্ষ্য হওয়া উচিত: হিজল জোবায়েরের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 5, 2012 6:13:42 AM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

হিজল জোবায়ের: 'গোটা শরীর যখন মন হয়ে কথা বলে সেটাই যৌনতা...নিঃশ্বাস,প্রস্রাব,পায়খানা- এগুলো ইনভলান্টারিলি হয়ে থাকে; প্রাকৃতিকভাবে। কিন্তু সেক্স শুধু প্রাকৃতিকভাবে হয় না। এই একটা যা আপনাকেই করতে হয়। 'আমিত্ব'-র এত প্রয়োজন এত উপস্থিতি আর কোনও মনুষ্য কর্মে নেই। যেন একটা দীর্ঘশ্বাস, যা নিজেকেই টানতে হয়।' সন্দীপন থেকে টানলাম। আমার কাছে কবিতা এই যৌনতা। 'আমিত্ব'-র এত প্রবল উপস্থিতি, সীমাহীন পরিতৃপ্তি কবিতার বেশি আর কোথাও পাইনি। কবিতা লেখার কারণ বোধ করি এটাই, যা কিনা ধারণ করে আমার শ্বাস ও দীর্ঘশ্বাস। কবিতা সেই যে ভাষায় প্রকাশিত হয়েও ভাষারই সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে এবং ততোধিক ভাব ও অর্থ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চায় ঈপ্সিত পরমের দিকে, নৈঃশব্দ মথিত সুরের বিস্ফার ও নিরবতা, আঁধার শীতলতা ও অনুধাবনের দিকে। আর কে না জানে - Silence is acuurate.

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

হি: আমার জানা নেই, কেননা আমি নিজেই যে নিশ্চিত নই। আর নিশ্চিত হতে পারা মানে নির্ধারিত করা। কিন্তু ভাল মন্দ বা যে কোন কিছুরই সুস্পষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ধারণের মত ব্যাপারে মানুষ এখনও ততটা উন্নত স্তরে পৌঁছাতে পারে নি বোধহয়। তারপরও totally equipped হবার ক্ষেত্রে ধ্যান, চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ও পাঠ গুরুত্বপূর্ণ। বাকিটা যে যার মেধা ও রুচি অনুযায়ী সম্পন্ন করতে থাকবে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

হি: যাদের কবিতা পড়ে স্বাদ পাই, রস আরাম ও তৃপ্তি পাই তাদের কবিতা পড়তে ভাল লাগে। শিল্পীর কাজ জীবনকে দেয়া নয়, নেয়া। এই নেয়ার প্রক্রিয়াটা কার কতটা অভিনব ও উৎকর্ষ-মধুর তাই বিবেচ্য। পরমের উদ্ভাস, ব্রেথ অব স্পিরিচ্যুয়ালিটি, মিউজিক্যালিটি, ইমেজারি, শেপ, প্যাটার্ন, লাইট এন্ড শেড, কালার, থ্রোয়িং, ফর্ম, কন্টেন্ট আরও যা যা সব কিছুর সংমিশ্রণে এমন এক সংহতি ও টোটালিটি যা অনিবার্যভাবে দাঁড় করায় উপেক্ষারহিত এক নতুনতর অনুধাবনের সামনে। সে এক অভাবিত রিয়ালিটি। বর্ণ-সম্বলিত ভাষার উপরিতল ছেড়ে তার অভিমুখ স্মৃতি-সঞ্জাত ভাষা, অনুভূতিতে পাওয়া তার দিকে। এই স্মৃতি flash forward ও হতে পারে, হতে পারে 'কল্পিত স্মৃতি'।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

হি: আগে যা বললাম, যাদের কবিতায় ওসব বিষয়াদির ঘাটতি থাকে তাদের কবিতা ভাল লাগে না। অন্তত কিছুটা উপস্থিতি তো থাকা চাই। যাদের লেখায় যুগপৎ নির্মাণ ও রস জারণ তথা নন্দনের ঘাটতি থাকে, তাদের কবিতা আমাকে টানে না। আমি বিশ্বাস করি শিল্পীর সেই কাজটির চেষ্টা করা উচিত, যা সে না করলে আর কেউ করতে পারবে না। এভাবে তার শিল্পকর্মের একটি অনিবার্যতা হাজির করা। যে কাজ হয়ে গেছে তার পুনরাবৃত্তি ও ব্যর্থ অনুকরণ করে লাভ নেই। এখানেই নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়া, নিজের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়ে একটা জবাবদিহিতার ক্ষেত্র তৈরি করা, একটি কাঠগড়া নির্মাণ ও আত্ম-রমণ পরিত্যাগ করে নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারা। নিজের কাছে সৎ থেকে, নিজেকে মিথ্যে প্রবোধ না দিয়ে বিবেচনা করলেই, প্রত্যেকে তার নিজের কাজটি আসলেই নতুন ও ভাল কিছু হচ্ছে কিনা তা বুঝতে পারবে। প্রত্যেকের উচিত একান্ত তার এবং তারই সত্যকে আবিষ্কার করা, না হলে অসততা বা অসচেতন থাকলে এক জীবন শেষে দেখা যাবে, সে এতদিন যে সত্যে কথা বলেছে তা প্রকারান্তরে মিথ্যা, কেননা তা ছিল অন্যের সত্য। তার এতদিন যে সত্য ও অনিবার্যতা সেখানে ছিল না। আমাদের চারপাশে যথেষ্ট ভাল কবিতা আছে, হয়তো আছে নতুন কবিতাও। কিন্তু যুগপৎ ভাল ও নতুন কবিতাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

হি: নব্বইয়ে বহুভাবে বহুরকমের প্রচেষ্টা সক্রিয় ছিল। নানান নিরীক্ষাকে বিবেচনায় আনা হয়েছিল। সেই অনুপাতে ফলাফল ততটা আসেনি বোধহয়। আপর দিকে শূন্য ততটা বৈচিত্র্য অভিমুখী না হয়ে তাদের মত করে বিশেষ কাব্য-বিশ্বাসে স্থির থেকে বরং চেয়েছে বিস্তারের দিকে যেতে। শেষ পর্যন্ত সব প্রজন্মে দুই-একজনাই উজ্জ্বল থাকে।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

হি: দুটোই বাংলা কবিতা। দুটোই আমাদের কবিতা। আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে বিভিন্ন- সময়ে প্রবণতার ভিন্নতা দেখা দেয়। এ রকম টুকটাক কিছু পার্থক্য আছে। রিমার্কেবল কিছু দেখি না।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

হি: ব্লগ বা অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমার কাছে একধরণের দ্বন্দ্ব সংকর। যুগপৎ সুফল ও কুফল দায়ী। এসবের সৎ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু তা না হওয়ায় যেহেতু সহজেই যে কেউ এগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারছে ফলে এক ধরনের সাহিত্যিক হাঙ্গামা ও সাংস্কৃতিক দাবদাহের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়। যদিও মত প্রকাশের স্বাধীনতার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, এরও ভাল মন্দ আছে।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

হি: ঐ অর্থে তো লিটলম্যাগ নাই। কিছু সাহিত্য পত্রিকা আছে যেগুলা বেসিকেলি কোলাজ এর কাজ করে। ৩ টা প্রবন্ধ, ২ টা ছোটগল্প, কিছু কবিতা , দুই একটা অনুবাদ এই সব মিলিয়ে একটা কমন কাজ করে। যা হোক তারপরও ব্লগ এখনও পত্রিকাগুলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি আমার মতে। পত্রিকাগুলো পাঠক নিজে আগ্রহী হয়ে সংগ্রহ করে পড়ে। ফলে তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সততা থাকে, কিন্তু ব্লগ বা ফেসবুকের মাধ্যমে অনুমতি ছাড়া নিজে সেধে ট্যাগাট্যাগি করে সবাই অন্যের বেডরুম পর্যন্ত ঢুকে যায় এবং যেন কিছুটা জোর করেই বলে 'এইটা পড়েন'। সেক্ষেত্রে পাঠকের আন্তরিক সততা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। খেয়াল করলে দেখা যায় এসব ট্যাগাট্যাগির বেশির ভাগই ফ্লাইং কমেন্ট। যেটা পর মুহূর্তে ঐ কমেন্টকারীরও মনে থাকে না।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

হি: দৈনিকে লিখলে সাধারণের মাঝে লেখকের পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এই গ্রহণযোগ্যতা তৈরির ব্যাপারে দৈনিকের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। তারা আসরেই যোগ্য ও মেধাবীদের গ্রহণযোগ্য করতে আন্তরিক কিনা তার একধরনের নৈতিক জবাবদিহিতা থাকা উচিত। তা না হলে সাধারণ পাঠকের ভুল লেখকটিকে বড় ও গ্রহণযোগ্য ভেবে বসতে পারে। সেটা প্রকারান্তরে আমাদের নিম্ন স্তরের মেধারই প্রদর্শন।