বাংলা সাহিত্যে এখন জাতীয় দৈনিকের স্থান নিয়ে নিচ্ছে বাংলা ওয়েবম্যাগাজিন: ফকির ইলিয়াসের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 21, 2014 11:50:50 AM

ফকির ইলিয়াস। কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক। সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, লালন ও চর্চায় তিনি নিরলসকাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা এগারোটি। তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হচ্ছে ঢাকা,কলকাতা,লন্ডন, নিউইয়র্ক, কানাডা, সুইডেন, ইতালি, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান সহ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক ,সাপ্তাহিক, ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রে। ওয়েবম্যাগ, ব্লগ, ই-নিউজ গ্রুপেও তিনি লিখছেন নিয়মিত। নিউইয়র্ক অভিবাসী এই কবি, সাহিত্য কর্মের জন্য - 'ফোবানা সাহিত্য পুরষ্কার' , 'ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরষ্কার' পেয়েছেন। তিনি দ্যা একাডেমী অব আমেরিকান পোয়েটস , দ্যা এ্যমেনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল , কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিষ্টস, আমেরিকান ইমেজ প্রেস, - এর সদস্য।

 

দুপুর মিত্র:  আপনি কেন কবিতা লিখেন?

 ফকির ইলিয়াস: কবিতা লিখি আমাকে প্রকাশের জন্য। কবিতা লিখি আমার সময়কে ধারণ করে রাখার জন্য। কবিতা লিখি নান্দনিক শব্দগুলোকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। কবিতা লিখি আমার ভালোবাসার রেখাক্রম এই মাটিতে রেখে যাবার জন্য।

 

দুপুর মিত্র:  কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ফকির ইলিয়াস: কবিতা লেখার পূর্বশর্ত হচ্ছে, খোলা আকাশের দিকে দুচোখ ভরে তাকানোর কৌশল রপ্ত করা। প্রস্তুতির অনেকগুলো ধাপ থাকে। পঠন-পাঠন এর অন্যতমএকটি। যে ভালো পড়তে পারে না- সে ভালো লিখতে পারে না। লেখালেখিতে 'শর্টকাট' বলে কিছু নেই। এটি একটি দীর্ঘ পথপরিক্রমা। আমি বলি, ২০ ঘন্টা পড়ুন। নিরীক্ষণকরুন। ভাবুন। তারপর একঘন্টা লিখুন। তাছাড়া, সমকালকে  ধারণ করার শক্তি অর্জন করে যেতে হয় কবিকে।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ফকির ইলিয়াস: এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। যারা তাদের কবিতায় নিজের মতো করে বলেন,তাদের সকলের কবিতা আমার ভালো লাগে। কবিতায় নিজের হস্তছাপ থাকা চাই। পূর্বজ কবিরা যা বলেছেন, সেদিকে না গিয়ে যারা নিজ ভাবনা পরিমণ্ডল তৈরি করেন আমি তাদের কবিতা মনযোগ দিয়ে পড়ি।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ফকির ইলিয়াস:  যারা কবিতায় কি বলতে চাচ্ছেন- নিজেরাই জানেন না, তাদের কবিতা আমি পড়ি না। যদি কোনো কবিতা আমার মননে ঝলক জাগাতে না পারে, তাহলেআমি তা পড়বো কেন। সময় নষ্ট করবো কেন ? কবিতা তো কিছু শব্দের সমাহার নয়। চিত্রকল্পের বিন্যাস যদি কালিক চেতনা ও এর ব্যাপৃতিকে আঁকতে না পারে- সেকবিতা মানুষের মনে দ্যুতিপাত করতে পারে না।

 

দুপুর মিত্র:  নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ফকির ইলিয়াস:  আমি আশির দশকের কবি। দেখেছি নব্বই,শূন্য, এর পরবর্তী সময়ের কবিতাও। হ্যাঁ, এই সময়ের কিছু কবি নিজের জগত তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছেন-তাবলা যায়। দশ বছরের কবিতা লেখা দিয়ে কাউকে সঠিক মূল্যায়ণ করা যায় না। কবিতা একটি সূদূর প্রসারী যাত্রাপথ। তাই বলি- অনেকেই ভালো লিখছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের অবস্থান কোথায় হবে, কীভাবে হবে তা বলার সময় এখনও আসে নি।

 

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ফকির ইলিয়াস: বাংলা ভাষার কবিতা যেসব ভূখণ্ড থেকে লিখিত হচ্ছে, প্রায় সব কবিতাইএকই মনন পুষে। আর তা হচ্ছে বাঙালী জাতিসত্তার অনুরণন। স্থান-কাল কিছুটা ভিন্ন হলেও অনুপ্রাস, চিত্রকল্প, বুনন,বিন্যাস,বক্তব্যের মাঝে খুব বেশি ফারাক নেই। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ কবিরা বেশি পড়াশোনা করেন। যা বাংলাদেশের তরুণ কবিরা করেনবলে আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের অনেক তরুণ কবি সরাসরি স্প্যানিশ,জার্মান,ইতালিয়ান,রুশ, এমন কি হিব্রু ভাষা শিখছেন বলে আমি জানি। অনেকের সাথে কথাবিনিময়ও হয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ কবিদের মাঝে সে ইচ্ছে কমই দেখি। যারা ভালো নিতে জানেন- তারাই ভালো দিতে পারেন। আহরণের বিষয়টি কবিতার জন্য একটিমুখ্য বিষয় তো বটেই।

 

দুপুর মিত্র: ব্লগ, সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ফকির ইলিয়াস: ব্লগ সাহিত্যকে তাৎক্ষণিক বাহবা দিচ্ছে । যা সাহিত্যের জন্য খুব দরকারী নয়। এখন ফেসবুকও একটা গণমাধ্যম। দেখা যাচ্ছে, ফেসবুকে কেউ কেউ নাপড়েই 'লাইক' দেয় । শত শত লাইক পড়ে। তাতে কি একজন কবি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবেন ? না- পারবেন না। ব্লগকে আমি ডায়েরি মনে করি। ব্লগে মতবিনিময়, পাঠকের উত্তরে 'ধন্যবাদ' দেবার যে কথিত রীতি- এটাকে আমার কাছে সময়ের অপচয় বলেই মনে করি। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার বড় বড় ব্লগার/ব্লগ লেখকদের - পাঠকেরসব কথার উত্তর দেবার সময় নেই। বড় লেখকরা লিখেই যান। পাঠকরা পড়ে ঋদ্ধ হন। এটাই নিয়ম। তা ব্লগে হোক আর কাগজে হোক।

 

দুপুর মিত্র:  লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ফকির ইলিয়াস: আমার কাছে এখন পর্যন্ত লিটলম্যাগকেই প্রধান সাহিত্য মাধ্যম মনে হয়। কারণ লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় সুবিন্যস্ত, পরিকল্পিত ও মেধাবৃত্তির মাধ্যমে। ব্লগে যে কেউ যা ইচ্ছে লিখতে পারে। কারণ ব্লগের সম্পাদকীয় নীতিমালা ঢিলেঢালা। লিটলম্যাগে সেটা নেই। তাছাড়া ব্লগস্পট, ওয়ার্ডপ্রেস, উইবলী- এদের কল্যাণে এখন গড়েউঠেছে অসংখ্য ওয়েবম্যাগাজিন, ব্লগজিন। এসব ওয়েবম্যাগ গুলো সম্পাদকীয় নীতিমালা পালন করে। তাই ঢালাও ভাবে কোনো লেখা সেখানে প্রকাশ করা যায় না।এটাএকটা ভালো দিক। মনে রাখা দরকার, ব্লগ কিংবা ফেসবুকে কয়েকশ' লেখা প্রকাশ করা মানেই 'খুব খ্যাতিমান' হয়ে যাওয়া নয়। ওয়েব মাধ্যম কিছু আগাছা তৈরি করছে- সে টা শংকার বিষয়।

 

দুপুর মিত্র:  দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ফকির ইলিয়াস: দেখুন,একসময় বড় বড় দৈনিক,সাহিত্যপত্র,লিটলম্যাগের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, বুদ্ধদেব বসু, শিবনারায়ণ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ‌্যায়, আব্দুল্লাহ আবুসায়ীদ প্রমুখ। এখন জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদক কারা ? এটি একটি বড় প্রশ্ন। জাতীয় দৈনিকগুলো কর্পোরেট ব্যবসারমুখপত্র। সেখানে সাহিত্য সম্পাদক অনেক গৌণ পদ। এ বিষয়টি দুই বাংলা তো বটেই- বহির্বিশ্বেও প্রকট আকার ধারণ করেছে।এখনকার জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যসম্পাদকদের একটা বলয় তৈরি হয়। দু'চার জন মুখ পরিচিত লেখক ছাড়া তাদের নিজস্ব বন্ধু-বাদ্ধবরাই সাহিত্য সাময়িকী'র পাতা আলোকিত করেন ! লেখার গুণগত মানসেখানে গুরুত্ব পায় না।পাচ্ছে না। অনেক সাহিত্য সম্পাদকের, সাহিত্য পাতার ইমেল আছে। তারা সেই ইমেল নিয়মিত দেখেন কী না আমার সন্দেহ আছে। ওগুলো লোকদেখানো। তারা ইমেল করে একজন কবিকে তো জানাতেও পারেন-'আপনার লেখা মনোনীত হয়নি'। আর মনোনীত হলে তো অবশ্যই জানানো দরকার। আমরা যারা আশিরদশকের কবি- আমাদের অনেকেই সেসময়ে সাহিত্য সম্পাদকের চিঠি পেতাম ডাকযোগে। কবিতা মনোনীত হলে জানানো হতো। বলে রাখি- কলকাতার 'দেশ' পত্রিকা কর্তৃপক্ষএখনও সেটা করেন। লেখককে চিঠি অথবা ইমেল করে বলেন- ' আপনার অমুক লেখাটি মনোনীত হয়েছে। আপনার সম্মানি কোথায় কিভাবে পাঠাতে হবে, সেটা আমাদেরদয়া করে জানান।' বাংলাদেশে লেখা ছাপার পরও জাতীয় দৈনিকের অফিসে দৌড়েও সম্মানি পান না লেখক। এটা খুবই দুঃখজনক। অথচ সেই কর্পোরেট হাউসগুলো কোটোকোটি টাকার ব্যবসা করে। তারা লেখক সম্মানি দেয় না কেন ? অথবা দিতে এতো কার্পণ্য করে কেন ? আশার কথা, কবি লেখকরা এখন আর জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা নির্ভর নয়। বিশ্বের সিংহভাগ দেশেই কিন্তু জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতা নেই। আছে লিটারারী

ম্যাগাজিন। আমেরিকার 'পোয়েট্রি' ম্যাগাজিনকে আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারি। বাংলা সাহিত্যে এখন জাতীয় দৈনিকের স্থান নিয়ে নিচ্ছে বাংলা ওয়েবম্যাগাজিন। একটিওয়েবম্যাগাজিন একজন করির ১৫/২০ টি কবিতা একসাথে প্রকাশ করছে। কারণ তাদের স্পেস আনলিমিটেড। আকাশ বিস্তৃত এই স্পেস, সাহিত্য ও সাহিত্যিকের জন্যআশীর্বাদ অবশ্যই।