নিজেকে আবিষ্কারই কবিতা: একরাম আলির সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Apr 24, 2014 12:50:54 AM

প্রকাশিত বই: আঁধার তরঙ্গ (১৯৯১), অতিজীবিত (১৯৮৩), বাণরাজপুর (২০০০), বাউটির কবিতা।

সদ্য প্রকাশিত একরাম আলির কবিতার বই ‘বাউটির কবিতা’ থেকে উৎসর্গপত্রসহ কিছু কবিতা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল এবং এরপরেই অনলাইন সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হল।

।। স্মৃতিপত্র ।।

নিশীথ ভড়, তুষার চৌধুরী, অনন্য রায়

ভুলে যেতে পারে, তাই কোথাও কিছুতে লিখে রাখে

নতুন বৃষ্টির ফোঁটা, পিপাসার্ত প্রাণ, তার ঋণ

যদি ভুলে যায়, ত্রস্ত চিরকুটে লেখে প্রতিদিন

সমস্ত লেখার গায়ে তাই কি বিস্মৃতি লেপটে থাকে!

১।

এমন অস্থায়ী নীল আলো

জ্বলে, নেভে, ফের জ্বলে, ফের কে নেভালো

কুয়াশা, স্টিমার, আবছা ঘুম-ঘুম জেলে-নৌকা ভাসে

বাসি গয়না, বাসি চোখ, তারাটি ফ্যাকাসে

এমন আকাশ যার শূন্যে দুটো পাখির চিৎকার

এমন জঙ্গল যার অন্ধকার অবিশ্বাসে নড়ে

এমন শয়ন যাতে নিদ্রা নেই, সারা রাত তার

জমানো পাথরখণ্ড ছুড়েছে ঘুমের দিকে তাক করে-করে

স্নান ঘর, বাসি আয়না, ছোপ-ছোপ প্রতিহিংসা, স্মৃতি

জলের অতল খোঁজে, পেতে চায় পাতাল-প্রতীতি।

২।

আকাশ আনতনীল, পথ উঁচুনিচু

ঘাসে ঘাসে মাকড়সার জাল ছিঁড়ে-ছিঁড়ে

এই পথ দিয়ে শেষ বারের মতন তার যাওয়া

বিষ ঢালা আছে ওই ঘাসের শিশিরে

যুদ্ধ আর্তি কান্না আর তর্ক অবিরাম

বন্ধ ঘরে পুড়ে ফুড়ে ক্ষয় হয়ে গেছে চতুর্যাম

এখন কপাট খোলা- কিছু নেই বাকি

শেষ হয়ে গেছে সব কথা, আলোচনা

এখন একাকী বাউটি - এমন একাকী

হিংস্র হয়ে ওঠে তার অন্তর্গত সোনা

৩।

নতুন জঙ্গর খোঁজো, পার হও পেতে রাখা ফাঁস

অসুস্থ হাওয়ার ঘুর্ণি, পেরোও তাদের দীর্ঘশ্বাস

টিলার ওপারে, দূরে, বহুদূরে, জঙ্গলের রেখা

তার আগেও ঝোপঝাড়, স্মৃতি তাতে নষ্ট কিছু লেখা

কাঠকয়লা, নদীতীর নিভু ধোঁয়া, সন্ধ্যাতারা জ্বলে

বাঘিনীর ক্ষিপ্ত মন ছুটে যায় মাংসাশী অঞ্চলে

৪।

ফুসকুড়ি উঠেছে, তার কষ্ট আঞ্চলিক ভাবে শরীরে ছড়ায়

অঞ্চল সমগ্র নয়, ক্ষুদ্র অংশ প্রায়

অথচ নক্ষত্রদেহে সামগ্রিক তাপে

বিক্রিয়াসঞ্জাত নীল ফুসকুড়িয়া জন্মায় স্বভাবে

এ দেহ তারার অংশ - কৃত্তিকা! কৃত্তিকা!

নানাবিধ ঐনসর্গিক ধাতুক্ষয়ে জ্বলে অগ্নিশিখা

তারা দ্যাখো, দেখে দেখে খোঁজো তুমি কোনটি নতুন

ক্ষতকষ্ট চেপে আরও বাঁচার নবীনতর ঘুণ

৫।

অতর্কিতে দেখা নীল ঘষা কাচে, বিনিদ্র জড়তা

গন্ধক, আগুন, রক্ত, ভেজা-ভেজা ডানার পালক

মনে পড়ে সেইসব গগনবিহারী মাংস-কথা

সমস্ত খাদ্যই মূলে প্রকৃতির বিবর্তিত শোক

প্রকৃতি রচিত হয়, ধ্বংস হয় জলে ও প্রলয়ে

নষ্ট হয় অপচয় হয় কত ফল পাতা বীজ

কত পরিচিত মেঘ শুকিয়ে গিয়েছে ক্ষয়ে ক্ষয়ে

টানা বারান্দায় একা স্মৃতিছাপ পুরনো কামিজ

দুজনের ডানা আজ দু-দিকে উড়েছে তর্ক-দোষে

তবু আয়, কথা বলি আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে

অনলাইন সাক্ষাৎকার

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে? যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

একরাম আলি: কবিতা লেখে নিঃসঙ্গ মানুষ, একা। কবিতাও একা থাকতে পছন্দ করে। তবু কখনও কখনও কবিতাকে আমরা সামাজিক করে তুলি নিজেদের প্রয়োজনে। এবং সমাজে সে একটি ভূমিকাও রাখে। তবে ভূমিকা-ই। তার বেশি তাকে নিয়ে টানাটানি করতে গেলে কবিতার-ই সর্বনাশ হয়। ধরা যাক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। কবিতার বড় ভূমিকা সেই যুদ্ধে ছিল। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং আরও অনেকের কবিতা। কিতু তার পরে বাংলাদেশের উপর-কাঠামোয় যে একটি অদৃশ্য ছাঁদ তৈরি হল, সেটি কবিতার খড়, ঘাস, লতাপাতা আর অতীব উচ্চাকাঙ্ক্ষা দিয়ে নির্মিত। অতীতে কোনও ভাষার ক্ষেত্রেই তার ফল যেমন ভাল হয়নি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনই। হাজার কবির ভিড়ে মাত্র এক-আধজন আল মাহমুদ। বাকিরা এডিটর, ডিরেক্টর বা উচ্চপদস্থ, এমনকি প্রেসিডেন্টও! অন্ধকার ঘরে একলা একটা মানুষের স্বপ্ন, কল্পনা, রক্ত-ঘামের জারিত হওয়ার সুযোগ কমে যাওয়াটা কোনও ভাষার কবির পক্ষেইশুভ নয়। তাই বলি, কবিতা বস্তুত অসামাজিক। তাকে তেমনই থাকতে দিন আর কবিকে দরিদ্র।

স্বাধীনতা আন্দোলনের দীর্ঘ সময় জুড়ে ভারতেও এমনটা ঘটেছিল। কিন্তু সে সব কবিতার সিঁড়ি বেয়ে কবিরা দেশের মাথায় ওঠার চেষ্টা করেননি।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

একরাম আলি: কোনও কবির দ্বারাই নয়, আবহমান বাংলাভাষার দ্বারা।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

একরাম আলি: নিজের অচেনা স্তরে পৌঁছানো।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

একরাম আলি: নিজেকে আবিষ্কারই কবিতা, যা পরোক্ষে জগতকে আবিষ্কার।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

একরাম আলি: সমসাময়িক কবিতার প্রবনতা শুধুমাত্র সমসাময়িক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে আগ্রহী নই।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

একরাম আলি: সাহিত্য আন্দোলন কবিতার বহিরঙ্গের পরিবর্তন করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। সুররিয়ালিজম আন্দোলনের আগেও ও জিনিস ছিল। শুধু নামটি খোদিত হয় আন্দোলনের আড়ম্বরের মাধ্যমে।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

একরাম আলি: আমি কবিতা লিখতে পারি না। নানা ভাবে চেষ্টা করি মাত্র।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

একরাম আলি: আমার সমসাময়িক কবি র‌্যাবোঁ, অক্তাভিও পাস, আনা আখমাতভা... এঁরা সব। এর বাইরে কোনও সমসাময়িকতায় আমার আস্থা নেই।

দুপুর মিত্র: কবিতা লিখতে আপনার কতটুকু সময় লাগে?

একরাম আলি: আগেই বলেছি, লিখতে আমি পারি না। তাই, কোনও একটি ৬ লাইনের কবিতা লিখতেও কখনও ৩/৪ দিন লেগে যায়। আবার কোনও লেখা ১ ঘণ্টাতেই শেষ হয়।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

একরাম আলি: সব ধরনের। বেঁচে থাকবার জন্যে যত রকমের প্রস্তুতি দরকার, কবিতা লেখার জন্যে তার সবগুলো তো চাইই, তার অতিরিক্ত চাই বহু কিছু। এই অতিরিক্ত আয়োজনে কি লাগবে, সে সব কবিই ঠিক করবেন। কি ধরনের পড়াশোনা তাঁর দরকার ইত্যাদি। প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, মহাকাব্য, সাধ্য মতো বিশ্ব কবিতা পাঠের ধারাবাহিকতা ... সবই আয়ত্ব করার পর এক জন মানুষ কবিতার কিনারায় গিয়ে দাঁড়াতে পারেন হয়তো বা।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

একরাম আলি: সমসাময়িকতার প্রতি আমার আস্থা নেই, আগেই বলেছি। তবু বলি, বেশ কয়েক জনের লেখা ভাল লাগে। কেন না, তাঁরা সচেতন ভাবে সমসাময়িকতা থেকে দূরে রাখতে পারেন তাঁদের কবিতাকে। অন্তত চেষ্টা করেন। মানুষের চেষ্টাকে সম্মান করতেই হয়।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

একরাম আলি: কাছ থেকে দেখেছি, এমন দাবি করতে পারি না। যেটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, বলতে পারি যে, নব্বই আর শূন্য দশকের কবিতার দুটো ভিন্ন পথ। শূন্য দশক আমার বেশি প্রিয়। অনেক উন্মুক্ত। অনেক গভীর। রাকা দাশগুপ্ত, শ্যামসুন্দর মুখোপাধ্যায়, স্বাগতা দাশগুপ্ত... এঁদের লেখা পড়ি। টাটকা।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

একরাম আলি: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পঙক্তি মনে পড়ছে- 'প্রভেদ জটিল, অবগুণ্ঠিত সড়কে চাঁদের আলো।' একটি 'অবগুণ্ঠিত সড়ক', অন্যটি 'চাঁদের আলো'। কে কি, জানতে চাইবেন না যেন।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

একরাম আলি: ব্লগ দরকারি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু লেখা নির্বাচনের দিকটা বড্ড অবহেলিত থেকে যায়। সত্যি বলতে কি, কষ্টই হয়।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

একরাম আলি: লিটলম্যাগাজিন হচ্ছে লিটলম্যাগাজিন। তার একটা গন্ধ আছে। সে অনেক কালের এবং একই সঙ্গে একেবারে তরতাজাও। তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। হাতে নেওয়া যায়। পড়তে পড়তে বুকের ওপর রেখে ঘুমুনো যায়। ব্লগ স্পর্শ করা যায় না।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

একরাম আলি: দৈনিক সাহিত্য বলে কিছু হয় না। তাই দৈনিকের সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে কিছু বলার নেই। যারা কষ্ট করে পড়লেন, তাঁদের ধন্যবাদ। আর, বিরক্ত হলেন যারা, তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।