দশকের ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আপত্তিকর: কবি নীলাঞ্জন সাহার সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 25, 2012 7:38:49 AM

কবি: লেখালেখির শুরু নব্বইয়ে। কবিতা পাক্ষিকসহ বেশ কিছু লিটলম্যাগে তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

নীলাঞ্জন সাহা: প্রথমত না লিখে পারি না বলেই কবিতা লিখি, দ্বিতীয়ত স্পর্শ করার জন্য, ক্রমাগত মার খেতে খেতে একটু রুখে দাঁড়ানোর জন্যেই লিখি। এ ছাড়া অন্তত আমার আর কোনও মহত্তর উদ্দেশ্য নেই।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?.

নী: কবিতা লেখার জন্য আমি কোনদিন সেভাবে নেয়নি, মনের কোনও এক গভীরে হয়ত সেই অলৌকিক প্রস্তুতি চলে আমার যা সেই গভীর তলদেশ থেকে উপরিতলে উঠে আসে এবং লিখতে বাধ্য হয়। তবে আমি চেষ্টা করি জোর করে কবিতা না লেখার। কবিতা লেখার ব্যাপারে হৃদয়কে যতটা প্রশ্রয় দেই, মস্তিষ্ককে ততটা দেই না। কারণ আমি বিশ্বাস করি, চালাকির দ্বারা, বুদ্ধিমত্তার দ্বারা অন্য অনেক কাজ হতে পারে, কবিতা হয় না। মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে হলে হৃদয় শাসিত কবিতা লিখতে হবে, তাই জীবনে একটু বোকা থাকাই ভাল।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

নী: সবার কবিতা তো পড়ি না। তবে কারো কারো বেশ কিছু কবিতা আমাকে ছোঁয়ে গেছে। নাম করতে গেলে কিছু নাম বাদ পড়ে যেতে বাধ্য এবং সেটা একপ্রকার তাদের প্রতি অবিচার হয়ে যাবে নাকি? তাই নামের ব্যাপারটা তোলা থাক। কেন ভাল লাগে তার উত্তর মনে হয় ভাবনার মধ্যে আছে যেটা আগের প্রশ্নে বললাম।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

নী: কাদের কবিতা খারাপ লাগে? এখানে আমি নাম করব না ইচ্ছে করেই। কারণ যেগুলি খারাপ বা সার্থক কবিতা নয় সেগুলি এমনিতেই সময়ে ঝরে যাবে। তবে ওই যে বললাম, মস্তিষ্কের ব্যায়াম কবিতায় নয়, আমার খারাপ লাগা কবি বা কবিতাগুলি কেবলি মস্তিষ্কের চর্চা করে। যেন কবিতা লেখাটা একটা চাকুরী, তাদের লিখতেই হবে। আজব ব্যাপার। আমার এদের জন্য কষ্ট হয়, হাসিও পায় খুব। এড়িয়ে চরি। চেষ্টা করি ভালোর সঙ্গে থাকার। সব সময় পারি না যদিও।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

নী: এই দশকের ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আপত্তিকর, যেন প্রতি ১০ বছর আন্তর কবিতার দারা পাল্টাবেই। এটা অংক নাকি? যতদিন কবিতা লিখছি, ততদিন তো আমরা সবাই সমকালের কবি, যারা চিরকালীনটাকে ছুঁতে চাচ্ছি। তবে চিনতে বা একটা পরিচয়ের জন্যে দশকভাগ কিছুটা মেনে নেই, কি আর করি? এবং সেই অর্থে আমি কবিতার কোনও ব্যাপক উন্নতি দেখছি দেখছি না। কবির সংখ্যা বাড়ছে, ম্যাগাজিন বাড়ছে, ওয়েব জিন, ব্লগ এসে গেছে, তবু নাড়া দিবার মত কবি কোথায়? কোনও কোনও বিগ হাউস কাউকে কোথাও তুলে ধরার চেষ্টা করছে বটে কিন্তু কতদিন উড়বে এভাবে যদি নিজের এলেম না থাকে। দেখলাম তো অনেকেই মুখ থুবড়ে পরে নিজেরাই কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এও এক বিষম ট্র্যাজেডি। আজও মন খারাপে আমাদের সঙ্গী সেই পুরনো কবিরাই। তাই না?

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

নী: দুই বাংলার মধ্যে আমি কোনও ভাগ দেখতে চাই না হৃদয়ের চোখ দিয়ে। তবু প্রশ্নের খাতিরে বলছি, পশ্চিমবঙ্গে কবিতা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট মনে হয় বেশি হয়ে এসেছে বা হচ্ছে যেটা সবসময় খুব স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে নি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের কবিতা অনেক বেশি হৃদয় শাসিত, অনেক সরল যা মনকে স্পর্শ করে, ইদানিং পশ্চিমবঙ্গে সেই কঠিনকে সহজ করে তুলে ধরার কঠিন কাজটা করার লোক বড় কম বাংলা কবিতায়। তবু দু' একজনের উচ্চারণে মাঝে মাঝে আলো দেখি, তখন ভরসা জাগে। আসলে কাউকে কবি হবার দরকার নেই, কবি চাই না, কবিতা হয়ে ওঠুক, কবিতা চাই।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

নী: দিচ্ছে তো অবশ্যই। কিছু মানুষ তো পড়ছেন দেখতে পাই। ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে যে কেউ পড়তে পারেন, খারাপ কি? তবে বেনো জল তো থাকবেই কিছু। কোথায় বা নেই সেটা?

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

নী: লিটলম্যাগের জায়গা ব্লগ এখনও নিতে পারেনি, আসলে ছাপার অক্ষরে নিজের, নিজেদের নাম দেখার ব্যাপারটা রয়ে গেছে আমাদের মানসিকতায়। তাছাড়া একটা ম্যাগাজিন হাতের কাছে রাখা যায়, নাড়াচাড়া করা যায়, এই আর কি। তবে আগামী দিন মনে হয় ওয়েবম্যাগ, ব্লগ এসবই থাকবে। ভালই তো, ক্ষতি নেই কিছুতে।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?!

নী: আমাদের এখানে দৈনিক গুলিতে শনি বা রবিবারে বেশ ভাল ছোট গল্প বের হয়, এর কিন্তু পাঠক আছে বেশ। ইদানিং নতুন কয়েকটি কবিতাও সসম্মানে ছাপছে, এটা দেখে ভাল লাগছে। আসলে এত ভোগ, পাশেই উন্নতির চিন্তা, সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর প্রকল্প, বিশ্বায়ন, অমুক-তমুকের বড়, সাহিত্যকে কিন্তু অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এটা খুব ভাল ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করি কবিতা না থাকলে, সাহিত্য না থাকলে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। গৃহ-যুদ্ধ বেঁধে যাবে, আজও যেটুকু শুভ উচ্চারিত হচ্ছে পৃথিবীতে, যেটুকু প্রতিবাদ, তা সেই শিল্প-সাহিত্য আছে বলেই। না হলে তো আমরা যন্ত্র হয়ে যাব।