শুধুমাত্র ভালোলাগার জায়গা থেকে সিরিয়াসলি সাহিত্য চর্চা করা যায় না: মোজাফফর হোসেন-এর সাথে অনলাইন আলাপ ও তার গল্প

Post date: Jun 28, 2012 6:35:09 AM

সম্পাদক, ‘শাশ্বতিকী’

প্রকাশিত বই : ‘দ্বিধা’ (গল্প সংকলন, অন্বেষা ২০১১)

প্রকাশিতব্য : ‘চলো একটু হাঁটি’ (গল্প সংকলন), ‘শাশ্বতিকীর অনুবাদ সংকলন’ (সম্পাদনা গ্রন্থ), ‘একজন মা-র প্রতিকৃতি’ (স্মৃতি কথা)

দুপুর মিত্র: বর্তমান সময়ে লেখকরা খুব বেশি দিন ভাল লেখা উপহার দিচ্ছেন না কেন?

মোজাফ্ফর : কথাটা সর্বাংশে না হলেও বেশ খানিকটা সত্য। আমি আসলে একটা মোটা দাগে ভাল কিছু হচ্ছে না সেটা বলবো না, বলবো অপেক্ষাকৃত কম হচ্ছে। এর কারণ অনেক ও বহুবিদ। তবে মূল কারণ হলো একাগ্রতার অভাব। আবার, বলতে দ্বিধা নেই, কারও কারও ক্ষেত্রে মেধারও ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে আমরা একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছি। রাজনীতিতে যে চলমান অরাজকতা ও অর্থনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা সেটা থেকে তো আর চাইলেই দূরে থাকা যায় না। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে লেখালেখি কাজের ফাঁকে ফাঁকে করার কোনো বিষয় না। এটা কোনো পার্টটাইম জবের মতো না। ফুলটাইম এটার পেছনে লেগে না থাকলে সেই ভাবে ভালো কিছু বের করে আনা মুশকিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমাদের দেশে লেখালেখির ক্ষেত্রে সে পরিবেশ এখনো গড়ে ওঠেনি। অন্যত্র রোজকারের একটা পথ বাতলে তবেই না এ পথে পা বাড়ানোর কথা ভাবা যায়! কাজেই, একজন লেখককে আমরা অসময়েই ফুরিয়ে যেতে দেখছি। তিনি হয়ত লিখছেন কিন্তু মানের ক্রমোন্নতি ঘটছে না। একশ তম গল্পের সাথে প্রথম লেখা গল্পের কোনো পার্থক্যই থাকছে না। তবে হ্যঁা, একটা লেখক যদি মনে করেন যে তাঁর দ্বারা আর ভালো লেখা বের করে আনা সম্ভব নয়, তবে তাঁর সেখানেই থেমে যাওয়া উচিৎ। এই থেমে যাওয়াটাকে আমি সাধুবাদ জানাই। হাসান আজিজুল হক পঞ্চাশটির মতো ছোটগল্প লিখে সময়ের শ্রেষ্ঠ গল্পকারে উপনীত হয়েছেন। ইলিয়াসও বেশি লেখেননি। তাঁরা আরও লিখলে হয়ত অপেক্ষাকৃত দুর্বল গল্পের সংখ্যা বেড়ে যেত, আবার উল্টোটাও হতে পারতো। তাঁরা প্রথম সম্ভাবনার কথা ভেবে থেমে যেতে পারেন। তবে এটাও সত্য, অতীতেও যারা বেশিদিন ধরে লিখেছেন তাঁরা সব লেখায় যে ভাল লিখেছেন তাও সত্য নয়। ও’ হেনরি ৮০০-এর মতো ছোটগল্প লিখেছেন। কৃষণ চন্দর লিখেছেন আরও বেশি। সব গল্প কি আমাদের সমান ভাল লাগে?

দু: লেখালেখিকে কেন টাকা কামানোর হাতিয়ার করা যাবে না?

মোজাফ্ফর : লেখালেখি অবশ্যই রোজকারের একটি মাধ্যম হওয়া উচিৎ। একজন লেখক লিখে যদি পেট না চালাতে পারেন তাহলে তিনি লিখবেন কেন! টাকা না থাকলে কি খেলাধুলার এত প্রসার ঘটত? তবে লেখালেখিটা টাকা কামানোর মস্ত হাতিয়ার হলে আবার সমস্যা আছে। আমাদের দেশে যে হারে বেকার বাড়ছে তাতে করে লিখতে পারুক আর না পারুক সকলে লেখক হতে চাইবে। লেখালেখির সাথে বিলাসিতার চরম একটা এলার্জি আছে। আপনি একজন সিরিয়াস লেখককে কয়েকটা পণ্যের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর করে দেন, দেখবেন তাঁর লেখালেখির সর্বনাশ ঘটে গেছে। কাজেই এখানে কম্প্রোমাইজ যতটা কম করা যায় ততই ভাল। আসলে শিল্পের সাথে কোন সমঝোতা হয় না। শিল্প সাহিত্যে যারা আসবে, এই সত্যটা জেনেই আসতে হবে। এই নিষ্ঠুর সত্যকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করতে হবে। সাহিত্য শিকড় ধরে জীবনের একদম তলানিটুকু চেটেপুটে বের করে আনে। সাহিত্যিকরা যদি পুঁজিপতি হোন এবং পুঁজির বশ্যতা স্বীকার করে নেন, তাহলে আর এমন নির্বিঘ্নে নির্দয়ভাবে জীবনের কথা বলতে পারবেন না। তখন তাঁরা একটা পাওয়ার স্ট্রাকচারের টুলস হিসেবে কাজ করবেন। কাজেই টাকা কামানোর বিষয়টা যদি একটা রিজেনবল পর্যায়ে থাকে তাহলে আমার মনে হয় ভাল হয়।

দু: অসীম কুমার দাসকে বেশ কাছে থেকেই দেখেছেন আপনি। তার এই প্রচারবিমুখতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মোজাফ্ফর : অসীম কুমার দাস আশির দশকের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন। বাংলাদেশের পরাবাস্তব কবিতার কথা বলতে গেলে তাঁর নাম আসতে পারে। সম্প্রতি ‘শুদ্ধস্বর’ থেকে তাঁর কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র। যাই হোক, নববই এর পরে আমরা আর তাঁকে সেইভাবে পাইনি। তিনি পরবর্তীতে ধ্যানে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। লেখালেখিতে আর ফিরলেন না। এটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা যে অনেকগুলো ভাল কবিতা থেকে বঞ্চিত হলাম সে কারণে একটা মৃদু আক্ষেপ না করে পারা যায় না। তাঁর প্রচারবিমুখতা না বরং আমি বলব তাঁর ঐ না লেখাটাই তাঁকে একেবারে অন্তরালে ঠেলে দিয়েছে। হয়ত তিনিও এটাই চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো মেধাবী মানুষগুলো শিল্প সাহিত্যে থাকুক সেটাই আমরা চাই। এটা অন্যায় চাওয়া নয় নিশ্চয়।

দু: আপনি নিজেকে কেন লেখক বলে পরিচিত করাতে চান?

মোজাফ্ফর : প্রশ্নটা এভাবেও হতে পারতো- আমি কেন লেখক হতে চাই? সাদা বাংলায় বলতে গেলে - আমি গাইতে পারি না, অাঁকতে পারি না তাই লেখার চেষ্টা করি। শিল্পের এই একটি শাখায় নিজেকে কিছুটা হলেও উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। আর একটু ভেতর থেকে বলতে গেলে বলতে হয়- জীবনকে আমি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চাই, জানতে চাই, জানাতে চাই, আর এর জন্যে সাহিত্যের কোনো বিকল্প আমার জানা নেই। থাকলে হয়ত লিখতাম না। শুরুতে হয়ত লিখতাম মনের আনন্দে, ভালোলাগার জায়গা থেকে, তখন নিজেকে লেখক বলে পরিচিত করাতে চাইনি। তবে এখন নিজেকে লেখক বলে পরিচিত করাতে চাই কেননা একটা গন্তব্য ঠিক না করে নিলে শুধুমাত্র ভালোলাগার জায়গা থেকে সিরিয়াসলি সাহিত্য চর্চা করা যায় না, করলেও সেটা বেশিদিন টেকসই হয় না। তবে এও ঠিক, আমি লেখক হতে চাইলে তো আর লেখক বনে গেলাম না। আমি লেখক হলাম কিনা সেটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র পাঠকরাই রাখে।

দু: কবিতার চেয়ে কথাসাহিত্যকে আপনি কেন বেছে নিলেন?

মোজাফ্ফর : লেখালেখির শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও নিজের জায়গা হিসেবে কথাসাহিত্যকেই বেছে নিয়েছি। বেছে নিতে হয়েছে। এর কারণ মূলত দুটো। এক. আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতা আমার হয় না। সারাজীবন কবিতা লিখলে হয়ত কয়েকটি মধ্য মানের কবিতা হাত ফসকে কিংবা কাব্য দেবীর কৃপায় বের হয়ে যেতে পারে। দুই. আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা গল্পের মধ্যেই। এখানে একটু বিস্তারিত বলা দরকার। আমরা ছিলাম বার ভাই বোন। আমি এগারতম। বার ভাই বোন মানে বারটা ঢাউস উপন্যাস আর শত শত গল্প, অনুগল্প। আর বাবা মা হচ্ছে রীতিমত মহাকাব্য! সবকিছু নির্ধারিত- মোটা দাগে, খুব সাধারণ কনজারভেটিভ মুসলিম পরিবার। দিনের শেষ ভাগে সবার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা একটাই : জান্নাত। মানে জীবনটা যে ভাবেই কাটুক মৃত্যুর পরের হিসেব নিকেশ ঠিক থাকলেই হলো। এখন শুধু লিখলেই চলে। কিন্তু লেখালেখি করাটা কখনই আমার জন্যে সহজ ছিল না। পরিবারের কেউ এটা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। ধর্মগ্রন্থে লেখালেখি করবার নির্দেশ দেওয়া হয়নি, হলে হয়ত প্রশংসা তো করতই সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও লিখত। আমার সাধ্য ছিল না তাদের সাথে পেরে ওঠার। পরিবারে শুধুমাত্র বাবাই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন। মা যখন জীবিত ছিলেন তখন আমার মাথায় লেখালেখির ভুত ঐভাবে চেপে বসেনি। শুধু মনে পড়ে, মাঝে মধ্যে পরিবার দুটো গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়তো। একগ্রুপে বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সব বড়রা, আর এক গ্রুপে মা একা। আমি, মানে আমরা ছোটরা, একবার এদিক যায় একবার ওদিক যায়। মা সারারাত কাঁদে, কেঁদে কেঁদে কুরআন শরীফ পড়ে। আমি কুরআন তেলোয়াত এর শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম, যেন মা কোনও মন্ত্র আওড়িয়ে মহাপ্রলয় ডেকে আনবে আজি। কিন্তু পারেননি। মা-র সেই শক্তি ছিল না। মাকে শেষ পর্যন্ত এডজাস্ট করতে হয়েছে- বাবার সাথে, সন্তানদের সাথে, ক্ষমতার সাথে, সর্বপরি পুরুষতন্ত্রের সাথে। আমি তখন সবটা বুঝতাম না। ইনফ্যাক্ট, অনেক কিছুই বুঝতাম না তখন। এক্ষেত্রে, নোবেল ভাষণে নাইপল তাঁর নিজের সম্পর্কে যেমনটি বলেছিলেন- my background is at once exceedingly simple and exceedingly confused- আমিও সেটাই বলবো। কিংবা তলস্তয় ইভান ঈলিচের জীবন সম্পর্কে যেমনটি বলেছিলেন- most simple therefore most terrible- কথাটি আমার ক্ষেত্রেও সত্য বলে খাটে। মা প্রায়ই বলতেন- তোরা কেউ আমাকে চিনলি না, আমি যদি লেখক হতাম, আমার সব লিখে শোনাতাম দুনিয়াবাসীকে। আমার গল্প শুনে পাষাণেরও মন কেঁদে উঠত। তখন ভাবতাম- লিখলেই পারে। এখন জানি মা কেনও লেখেননি। মা-র সব ছিল, স্বামী, ঘরভর্তী সন্তান, ভাই-বোন, নিজ হাতে গড়া দু-দুটো দোতলা বাড়ি। সৃষ্টিকর্তা। সবই। কিন্তু কিছুই ছিল না তাঁর। মৃত্যুর সময় তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে এই ভয়াবহ সত্যটার উপস্থিতি আমি টের পেয়েছিলাম। আমি অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন, মা মারা গেছে এই জন্যে না, ওই সত্যটার জন্যে : এতকিছু থেকেও মানুষ এতটা একা হতে পারে!

মানে আমি বলতে চাচ্ছি, আমার একটা বক্তব্য আছে যেটা কবিতায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে একজন পাঠক হিসেবে আমি বার বার কবিতার কাছে ফিরে যায়, যাবোও। এটা একটা গোপন সম্পর্ক। ওখান থেকেই আমি আমার লেখালেখির শক্তিটা সঞ্চয় করি। মানে কবিতার সাথে পরকীয়াটা আমার জমেছে ভাল।

এখানে টীকা আকারে একটা কথা না বললেই না। ২০১০ সালের শেষের দিকে আমার ও রাতুল পাল-এর গল্পের বই ‘দ্বিধা’র ভূমিকা লেখা কালীন সময়ে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আবদুশ শাকুর আমি কবিতা লিখি জানতে পেরে বলেছিলেন- দ্রুত নিজের লাইনটা চিহ্নিত করে তারপর এগুতে। নইলে তাঁর মতো আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগতে হবে। যতদূর মনে পড়ে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথাও তিনি বলেছিলেন। তাঁর কথা মতো আমি তখন সিরিয়াসলি কবিতা ছেড়ে দিয়ে কথাসাহিত্যে আসলাম। তবে পাশাপাশি আমার ভালোলাগা গল্প ও প্রবন্ধগুলো অনুবাদ করছি আর টুকটাক সমালোচনা সাহিত্য লিখছি।

দু: শাশ্বতিকী সম্পাদনা করছেন। সম্পাদনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের সমসাময়িক গল্পচর্চা নিয়ে আপনার বেশ ভাল একটা ধারনা হয়েছে। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

মোজাফ্ফর : বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ের গল্প চর্চা নিয়ে আমি খুব বেশি উৎফুল্ল নই। এখন তরুণরা গদ্যের চেয়ে কবিতার দিকে ঝুঁকছে বেশি। এর মূল কারণ হলো, একটা গল্প কিংবা উপন্যাস লিখতে যে সময় ও সাধনা প্রয়োজন সেটা দেওয়ার সময় ও মানসিকতা তাঁদের নেই। আমি এক কবিকে চিনি যিনি শুরুতে খুব ভাল গল্প লিখতেন। পরে ব্যাংকে চাকুরী হওয়াতে গল্প ছেড়ে কবিতা লেখা শুরু করলেন। এখন তিনি পুরোদমে কবি। তরুণদের গল্প থেকে সরে আসার আর একটা কারণ হলো পরিমিত জীবনবোধ। এখন একজন তরুণ জীবন বলতে ফেসবুক আর আকাশ সংস্কৃতি বোঝে। গল্প লিখতে হলে যে জীবন ঘনিষ্ঠতা প্রয়োজন সেটা না থাকার কারণে গল্প চর্চার জায়গাটাকে একটা হাহাকার বিরাজ করছে। গল্প যে কম লেখা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। যারা লিখেছেন বেশির ভাগের গল্পে একটা গল্প হয়ত থাকছে কিন্তু জীবন থাকছে না। আবার যে জীবন থাকছে সেটা মানিক কিংবা তারাশঙ্করের কাছ থেকে ধার করা। ষাটে তরুণ হাসান আজিজুল হক তাঁর ‘শকুন’ গল্পে যে সমাজ ও জীবন জিজ্ঞাসার কথা বলেছেন তা এখনকার একজন তরুণ গল্পকার ঐভাবে বলতে পারবে না। কারণ তখনকার বাস্তবতা আর এখনকার বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বর্তমান। আর একটা ব্যাপার হলো- বেশির ভাগ তরুণ লিখছে বেশি, পড়ছে কম। ঘটনা উল্টোটা হওয়াই স্বাস্থ্যকর ও সমীচীন। ভাল গল্প লিখতে চাইলে বিশ্বসাহিত্যের উৎকৃষ্ট গল্পগুলোর সাথে পরিচয় থাকাটা খুব জরুরী।

আর একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি- আমাদের এখানে যে জীবন আমরা যাপন করছি, সেই জীবন নিয়েই লেখা হয় বেশি। ধরুন, কয়দিন কয়টা মেয়ে ধর্ষিত হলো, তখন সবাই ধর্ষণ নিয়ে লিখবে। কয়দিন এখানে সেখানে কয়জন গুম হলো, আর অমনি গুম নিয়ে লেখার হিড়িক পড়ে গেল। আমি সমসাময়িক সময় নিয়ে লেখার বিরুদ্ধে নই। কথাসাহিত্যে টাইম এন্ড স্পেস একটা বড় ফ্যাক্টর, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের সে জীবন নিয়েও লিখতে হবে যে জীবন আমরা যাপন করি না। আমাদের অনেক সময় অনেক ধরনের মুড থাকে, সেগুলোকে সাহিত্যে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কিংবা যাপিত জীবনকেও আরো ভিন্ন ভাবে লেখা যায়। যেমনটি করেছেন অরওয়েল তাঁর এনিমাল ফার্মে, কাফকা মেটামরফোসিসে। এজন্যে তরুণ গল্পকাররা দেবেশ রায়ের ‘পায়ে পায়ে’, ইলিয়াসে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, জেরোম ওয়াইডম্যানের ‘মাই ফাদার সিটস ইন দ্য ডার্ক’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘রূপসাগরে ডোবে না, ইভ’, দস্তয়ভস্কির ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’, নাইপলের ‘বি ওয়ার্ডওয়ার্থ’, অস্কার ওয়াইল্ড-এর ‘দি হ্যাপি প্রিন্স’, গগলের ‘দ্য নোজ’, হেমিংওয়ের ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’, ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড-এর ‘এ গার্ডেন পার্টি’, মার্কেজের ‘আইজ অব এ ব্লু ডগ’, শহীদুল জহিরের ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ এই ধরনের গল্পগুলো পড়ে দেখতে পারেন। মোদ্দাকথা, সার্বিক ভাবে আমাদের গল্পকারদের আরও বেশি চিন্তাশীল হওয়ার দরকার। আফটার অল, তাঁরাই তাঁদের গল্পের উত্তম সমালোচক।

দু: কথাসাহিত্যের কোন ধারাকে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং কেন?

মোজাফ্ফর : আমার কাছে প্রতিটা ধারা আলাদা আর সমান গুরুত্বের। সাধারণ ভাবে হয়ত উপন্যাস আমাদের মাঝে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। কারণ, একটা উপন্যাসে অনেক কিছু বলা যায়। চরিত্রগুলোকে ইচ্ছে মতো নেড়ে চেড়ে, উল্টে পাল্টে আঁকা যায়। দীর্ঘদিন ধরে পাঠক একটা উপন্যাসকে আত্মস্থ করে বলে মনের ভেতর এর রসটা গেঁথে যায়, রেশটাও রয়ে যায় বহুদিন। আর তাছাড়া আমি মনে করি, উপন্যাসের মধ্য দিয়েই একটা লেখকের প্রকৃত লেখনি শক্তির প্রকাশ ঘটে। টমাস মানকে চিনতে হলে ‘ম্যাজিক মাউনটেয়ন’ পড়তে হবে। তাঁর গল্প পড়ে হবে না। একই কথা দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, হারমান মেলভিলে, জয়েস এঁদের বেলায়ও বলা যায়। ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘ইডিয়ট’, ‘দ্য ব্রাদারস কারামাজোভ’, ‘ওয়ার এন্ড পিস’, ‘আনা কারেনিনা’, ‘মবি ডিক’, ‘এ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ এ ইয়াং ম্যান’ এই উপন্যাসগুলো কয়েকশ ছোটগল্পের সমান। তার মানে আমি বলছি না যে ছোটগল্প লেখা হেনতেন ব্যাপার। এডগার এলান পো, নিকোলাই গগল, ও’ হেনরি, চেখব, সাকি, জ্যাক লন্ডন, কৃষণ চন্দর, জন আপডাইক, হাসান আজিজুল হক সকলে ছোটগল্প লিখেই তো জনপ্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। হেমিংওয়ের দু’ পৃষ্ঠার ছোটগল্প ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লেস’, বনফুলের এক পৃষ্ঠার ‘নিমগাছ’ আমার কাছে দুশো পৃষ্ঠার উপন্যাসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ লিখলেন। তারপরও আমি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে ‘শকুন’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘মা মেয়ের সংসার’ এই গল্পগুলোকেই আগে টানবো। মানিকের ছোটগল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’ তাঁর উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কিংবা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতোই শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যে উপন্যাস ‘গোরা’ ছাড়া বাকি সব উপন্যাস তাঁর ছোটগল্পগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বনফুল উপন্যাস লিখেছেন তারপরও তাঁর ছোটগল্প সর্বাধিক পঠিত। কাজেই আমি বলতে চাচ্ছি, ভাল লেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ কোন ফর্মে লেখা হল সেটা আমার কাছে বিবেচ্য নয়।

দু: লেখার বিষয়ের ক্ষেত্রে আপনি কোন জায়গাকে বেশি গুরুত্ব দেন এবং কেন?

মোজাফ্ফর : আমার সমস্ত গল্পের যে বাস্তবতা তার খানিকটা আমার দেখা খানিকটা আমার কল্পনা, খানিকটা আমার যাপিত খানিকটা আমার অযাপিত। কিছু গল্পের মধ্য দিয়ে আমি আমার মতো করে একটা বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করি আর কিছু গল্প লিখি মনের আনন্দে, গল্পটা সেখানে মুখ্য নয়। মানে মুড নির্ভর গল্প আর কি! চেষ্টা করছি ফর্ম ও ফ্যাক্ট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। তবে সব মিলিয়ে আমি গুরুত্ব দিয়ে থাকি গল্প নয় কিভাবে গল্পটা বলব তার ওপর। গল্প নির্মাণের যে শিল্প সেটাই আমার কাছে অধিক গুরুত্বের। দেখবেন, একই বিষয় নিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে অনেকেই লিখেছেন। যার বলার ভঙ্গিটা ভাল তাঁরটা টিকে গেছে। আমাদের এখানে দেশভাগের কথায় ধরুন না কেন। দুই বাংলায় অনেকেই দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন। সবারটা কিন্তু সমান ভাবে আমাদের টানেনি।

আর বিষয়বস্ত্তর কথা যদি বলতে হয়- আমি আমার ছোট গল্পের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের বাইরের ও ভেতরের আলাদা যে জগত সেটাকে মিশিয়ে তারপর আবার আলাদা করে দেখতে চাই কি দাঁড়ায়! এজন্যে রাজনীতি, সমাজনীতি, মনস্তত্ত্ব, ধর্ম সবকিছুকেই আমি আমার গল্পের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করি।

দু: লেখা নিয়ে আপনি কেমন আশা করেন? তার কতটুকু আপনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন এবং কেন?

মোজাফ্ফর : আশা খুব বড় কিছু নয়। কারণ আমি আমার ক্ষমতা ও সামর্থ্য সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবগত। পূর্বেই বলেছি, আমার কিছু একটা বলার আছে। ওই বলাটা যেদিন ফুরিয়ে যাবে সেদিন হয়ত আর লিখবো না। তবে সবটাই নির্ভর করছে পাঠকদের ওপর। পাঠকদের ওপর কারও জোর খাটে না। তাদের সাথে বোঝাপড়া হওয়াটা দরকার। তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে তাদের সাথে আমার কোন আপোষ নেই। আমি তাত বুনতে পারি। কেউ চাইলে তো আর আমি ক্ষেতে নেমে যাবো না। মানে আমার যা বলার তা আমি বলবো। ২০০৮ সালে ‘উড়ে যায় সাদা শকুন’ লেখার জন্যে একজন শিবির কর্মী সাবধান করে দিয়েছিল। সম্প্রতি ‘একটি গল্প বা গল্প না বা নিছক কল্পনা’ প্রকাশের পর মেইলে একজন হুমকি দিয়েছে। আমি সাবধান হয়নি বরং আরো সচেতন হয়েছি এই ভেবে যে আমার লেখা তাহলে একেবারে শূন্য দিয়ে যাচ্ছে না, কিছু না কিছুতে বাড়ি খাচ্ছে!

আর কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। সবে আমার দ্বিতীয় গল্পের বই প্রকাশের অপেক্ষায়। সম্ভবত বিশটি গল্প থাকছে বইটিতে। গল্পগুলি দুই বাংলায় বিভিন্ন কাগজে একাধিক বার করে প্রকাশিত। কতদূর পেঁŠছালাম সেটা ভেবে দেখবার সময় এখানো আসেনি, পথ চলা সবেই তো শুরু।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্য আর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ফারাক কোথায়?

মোজাফ্ফর : পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক কথাসাহিত্য নিয়ে পর্যাপ্ত পড়া হয়নি। সবে ‘দেশ’ ও ‘আনন্দ বাজার’-এর গল্প সংকলন পড়া শুরু করেছি। কিছুদিন আগে শচীন দাশ পড়লাম। দেবেশ রায় হাতে। মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর, পরশুরাম, বুদ্ধদেব বসু, জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কমলকুমার মজুমদার পড়েছি। আমাদের সাথে কলকাতার অনেক কিছুতে ফারাক। ভাষাটা এক হলেও আমরা তো আর এক জীবন যাপন করি না! আর কথাসাহিত্য যেহেতু সমাজের চলমান হালচালকে উঠিয়ে আনে সেহেতু আমাদের কথাসাহিত্যের সাথে ওপার বাংলার কথাসাহিত্যের একটা ফারাক আছেই। এই ফারাক ঘুঁচবার নয়। আর তার দরকারও নেই। ওপার বাংলার কথাসাহিত্যের ভাষা, প্রকাশভঙ্গী, দৃষ্টিভঙ্গী, মানুষের জীবন যাত্রার মান, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন, মূল্যবোধ, জীবনবোধ সবকিছুই আমাদের থেকে আলাদা। আমাদের সাহিত্য যতটা নাগরিক হতে পেরেছে ওপার বাংলার ততটা পারেনি। ভাষার ক্ষেত্রেও ওরা একটু পুরনো। মানে আমাদের মতো এতটা খেয়ালি নয়, একটু হিসেবি আর কি! তবে একদিক দিয়ে ওরা আমাদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে- সেটা হল সিরিয়াসনেস। ওরা অনেক বেশি সিরিয়াস। ওখানে সাধারণ পর্যায়ে আমাদের এখানকার চেয়ে সাহিত্যের কদরটাও বেশি। এর কারণ হল ধর্মীয় মূল্যবোধ। হিন্দু ধর্মের সাথে লেখালেখির কোনো বিরোধ নেই কিন্তু ইসলাম ধর্ম বানিয়ে বানিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে গাল গল্প লেখাকে প্রশ্রয় দেয় না! অন্যভাবে বলতে গেলে- ইসলামের সাথে লিবারাল সাহিত্যের সম্পর্ক বাস্তানুপাতিক। কাজেই টোটাল দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই একটা ফারাক আছে। তবে হ্যঁা, ভালো গল্প, উপন্যাস, কবিতা দু’জায়গাতেই লেখা হচ্ছে। কিন্তু ওদের সাহিত্য অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত যে কারণে তুলনামূলক ভাবে ওখানে বাজে বই কম হয়। এটা আমার ধারণা। দূর থেকে দেখা তো, ভুলও হতে পারে।

ধন্যবাদ। আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি।

একটি রাতের গল্প

রাত ১টা। চারিদিকের কোলাহল রাতের অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে। মাঝে মাঝে গাড়ির হর্ন আর নিজের হার্টবিট ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না সফেলা। টানা ছয় ঘণ্টা গাড়িতে থাকার দরুন গাড়ির শব্দটি খুবই সাধারণ ঠেকছে অথচ এই শব্দকে একদিন মোটেও সহ্য করতে পারত না সফেলা। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে পাশের বাড়ির সবদার শেখের মেয়ের বিয়ের কথা। সেবার দু’দুটো বাস এসে সফেলার উদোম উঠোনে এসে থামলো, শব্দে তো প্রায় জানটার যায় যায় অবস্থা! সফেলা সেদিন সবদার শেখকে প্রাণ ভরে গালি দিয়েছিল। গালিটাই যে তার একমাত্র সম্বল! সবদার সাহেবদের কাছে যেমন সফেলা অতি তুচ্ছ, সফেলার গালির কাছে তাদের দশাও তেমনি--সফেলাকে যারা চেনে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন দ্বিমত ঘটবে না। তাই তো সফেলা সুযোগ পেলেই তার এই অস্ত্রটা কৃতিত্ত্বের সাথে কাজে লাগায়।

বাসটি তেল পাম্পে এসে ভিড়লো। সফেলার ডান পাশের লোকটি প্রস্রাব করার জন্য তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লো, বাম দিকের লোকটি নড়েচড়ে বসলো--এতক্ষণ সে সফেলার ঝুলে যাওয়া বাম স্তনটি মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছিল। এদের দু’জনার সহায়তায় আজ সফেলা অন্ধকারকে গ্রাস করে চলেছে দেহ-খাদক একদল পিশাচের ক্যাম্পে। ওরা ইচ্ছেমত ভোগ করবে তাকে---উল্টে-পাল্টে, খাবলে-খুবলে খাবে তার পাখির ঠ্যাংয়ের মতো রসকষহীন শুকনো শরীর। প্রয়োজনে থাকতেও হতে পারে কয়েক রাত--বিনিময়ে টাকা; কিন্তু কত দেবে ওরা? দেহের ওপর অনেক ধকল যাবে ভাবতেই মুখখানা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় সফেলার। সে ধকল না হয় সইলাম কিন্তু কত দেবে ওরা--মনে মনে ভাবে সফেলা। তাকে যা দেয়া হবে তার দুই ভাগ আবার যাবে এই দালালদের পকেটে। প্রতিটা কারবারে মধ্যস্তকারীরা সবথেকে বেশি সুফল ভোগ করে, এই বেশ্যা বাজারেও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। দালালদের সহায়তা ছাড়া যে সফেলার পক্ষে আর কোন পার্টি ধরা সম্ভব না। বেশ্যা বাজারে তার দাম পড়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন আগে থেকেই দর হাঁকিয়ে পা বাড়ানো যেতো। কিন্তু এখন আর আগের সেই টসটসে মিনসে ভোলানো গতর নেই। ফুলে রস না থাকলে মাছি বসবে কেন! তাই দামাদামি করতে গেলে হটিয়ে দেয় সকলে। সফেলা নীরবে মেনে নেয় সব। দশ বছর পূর্বেকার কথা মনে পড়তেই তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে ওঠে। এক সাহেব গোছের মানুষ- সফেলার বয়স তখন বাইশ কি তেইশ- তার ভরাট যৌবন দেখে সাহেব তো একেবারে পাগলপ্রায়! সাহেব হলে কী হবে--লোকটি পাজি-নচ্ছড়, বৌ-বাচ্চা রেখে চলে আসে সফেলার কাছে, সফেলাও খাসা মাল, চেয়ে বসে এক হাজার টাকা! ভদ্রলোক এক কথাতেই রাজি। সফেলা টানা নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজের অজান্তেই। এ সমাজটাই হচ্ছে নচ্ছার। এ সমাজস্থ প্রতিটি লোক বেশ্যা অথচ ভারটা বইতে হয় সফেলার মতো গুটিকতক অসহায় নারীকে। রাত হলে সমাজের কতো হর্তা-কর্তা লালা ফেলতে ফেলতে মাগি বাড়ির সন্ধান করে সফেলার তা ভাল করেই জানা। ওরাই বড় বেশ্যা অথচ সকাল হবার সাথে সাথে যেনো এক একজন ধোয়া তুলসী পাতা।

গাড়ির শব্দ ভোতা হয়ে আসছে ক্রমশঃ। ভিতরের বাতিগুলো এখন বন্ধ। সকলে বোধহয় তন্দ্রচ্ছন্ন। বামের সিটে বসে থাকা দালালটির হাত আর নড়ছে না। রাস্তায় হালকা আলো-ছায়া সফেলাকে ভেংচি কেটে দ্রুত সরে পড়ছে। রাতের নীরব আত্মা তাকে শাঁসিয়ে যাচ্ছে ঘন ঘন। দিনের আলো সফেলার গায়ে কাটাতারের মতন বিঁধে--অপমানে, লজ্জায় কুঁকড়ে যায় তার সর্বাঙ্গ, অথচ রাতের পৃথিবীতে সে পানির মধ্যে মাছের মতোন খুবই স্বাভাবিক। দিনের আলোয় যারা ভালো মানুষের মুখোশ পরে সভ্যতার নকশা তৈরি করে, রাতে তাদের নগ্ন চেহারা দেখে সফেলার খুব করুণা হয়। সফেলা তো এই সমাজেরই একজন, সমাজের প্রতিটা মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সেও বেঁচে থাকতে চায়ছে। মোদ্দা কথা টিকে থাকাটাই এখানে সব। কোন জগতটা তবে বেশি সত্যি--রাতের নাকি দিনের? যদি রাতের হয় তবে সফেলাতো অন্যায় কিছু করছে না। বেঁচে থাকার জন্যই আর পাঁচটা ব্যবসায়ের মতন দেহ ব্যবসা করছে, ভদ্র ঘরের নারীদের মতো দৈহিক তাড়না কিংবা ভোগ বিলাসিতার জন্য কিছু করছে না, সে যা করে স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যই করে; এক্ষেত্রে দেহ তার ব্যবসায়ের মূলধন; কিন্তু সমাজের সভ্য মানুষগুলো তো তার কাছে আসে দেহের গন্ধে, মাংসাশী প্রাণির মতন খাবলে-খুবলে খায়, সুখের নেশায় মাতাল হয়ে আচড় কেটে দেয় তার ভেতরে ও বাহিরে। বেশ্যা শব্দটা যদি এতটাই ঘৃণার হবে তবে আসল বেশ্যা তো ওরা যারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখোশ পাল্টায়, রাজত্ব করে ভন্ড সভ্যতার!

এতসব বোঝেনা সফেলা। এত বোঝবার জ্ঞান তার নেই। সমাজের শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তার কাছে জ্ঞান দিতে যায় না, যায় তাদের পাশবিক চেতনাকে উগরে দিতে। এদেরকে অজ্ঞ করে না রাখলে যে বড় ক্ষতিটা তাদেরই হবে! অন্ধকারে থাকে বলেই সফেলা জানে মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে।

গাড়িটা মেইন রোডের এক কোণায় থামলো--দশ মিনিটের বিরতি। দুয়েকটি দোকান এখনো খোলা। বাম পাশের লোকটি বিড়ি কিনতে নেমে যায়, সফেলা বুকের কাপড়টা ঠিক করে আলোর দিকে মুখ বের করে দেয়, চোখ পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক করতে থাকা সিনেমার পোস্টারের দিকে। অর্ধ-উলঙ্গ নায়িকাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সফেলা। সমাজের এই উঁচু শ্রেণির বেশ্যাদের দেখে হিংসে হয় তার। সমাজে এদের বেশ কদর আছে, টাকাও পায় ঢের বেশি। আচ্ছা, এরা কি সুখ পায়, নাকি আমার মতো ব্যথায় কুঁকড়ে যায় পুরা শরীর?--ছবির ওপরে দন্ডায়মান লাম্প-পোস্টটিকে প্রশ্ন করে সফেলা। প্রচন্ড সুখে যখন খদ্দেরদের মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন আহত সফেলা খুব কষ্ট করে জানটাকে ধরে রাখে। পঁচিশ বছরের বেশ্যা জীবনে মাসিকের সময় যে শান্তিটুকু পেয়েছে সে, এছাড়া আর অবসর মেলেনি জীবনে। প্রথম যে বার মাসিক হয়, কী গালিটাই না দিয়েছিল মাসিককে! কী ভয়ানক রক্ত দলা বেঁধে শরীর থেকে নেমে আসে, ব্যথায় কুঁকড়ে যায় তলপেট, নারী জীবনে এর থেকে অভিশপ্ত আর কিইবা হতে পারে! তখন কি জানতো সফেলা- এই বিভৎস ঘটনাটাই তার জীবনে সব থেকে কাঙ্খিত হয়ে দাঁড়াবে!

রাত দু’টা। সফেলার মনে হচ্ছে গাড়িটা অন্ধকারকে আঁকড়ে তর তর করে বয়ে চলেছে অজানা এক শঙকার দিকে। বাড়িতে তার আট ও দশ বছরের মেয়ে দুটো একা। ছেলেটা ছ’ মাস ধরে জেলে। ছাড়াতে অনেক টাকা লাগবে। পুলিশের মন ভরানোর মতো বয়স ও টাকা কোনটাই তার নেই। ছেলেটা গেছে, এখনও সময় আছে মেয়ে দুটোকে রক্ষা করার। সফেলা অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজকের রাতটিই হবে তার বেশ্যা জীবনের শেষ রাত; ওরা যে ক’টা টাকা দেবে তা নিয়েই মেয়ে দুটোকে সংগে করে এ সমাজের কোন এক গর্তে ঘাপটি মেরে পড়ে রইবে। টাকার কথা মনে হতেই হার্টবিটটা বেড়ে যায় সফেলার। বুক থেকে দালালের হাতটি হটিয়ে নিজের হাতটি শক্ত করে চেপে ধরে সেখানে যেনো জানটা বেরিয়ে না যায়। আচ্ছা, কতো দেবে ওরা, নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে!--এই সংশয়টি তার সকল সংশয়কে পিছনে ফেলে পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। একটা সময় ছিল যখন ওরা রূপের ঝলক দেখে দু’হাত ভরে দিত। তাইতো বেশ্যা বাজারে সকলে হিংসে করতো তাকে। এমনকি সতী-সাধ্বী নারীরাও আড়ালে-আবডালে সফেলার মতো হতে চায়তো। অথচ আজ ঝুলন্ত আর ঢিলে-ঢোলা গতর দেখে সকলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এ ব্যবসায়ে কচি দেহ বিকোয় বেশি। তাইতো সুযোগ পেলেই প্রতারণা করে সবাই, সফেলাকে সয়তে হয় নীরবে--এ প্রতারণার যে কোন বিচার নেই, আদালত নেই, আর থাকলেই বা কী এমন লাভ হতো! এদের ‘করুণাতেই’ যে সফেলারা বেঁচে থাকে! আর জীবন? টানা নিঃশ্বাস ছাড়ে সফেলা।

গাড়ি এসে থামলো গন্তব্যে। দালাল দু’জনের পিছন পিছন সফেলাও নেমে পড়ল হিড় হিড় করে। আচ্ছা কত দেবে ওরা--ফিসফিস করে বলল নিজেকে। আঁচলের গিট্টু থেকে একটা বড়ি বের করে গুঁজে দিল মুখে, দেহ অবশ করার এই ঔষধটা ওর সাথেই থাকে। বেশ কয়েক কদম হাঁটার পর পৌঁছাল পিশাচদের ক্যাম্পে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশ্রি রকমের গরম পড়ছে আজ। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়েই মেঘের মধ্যে লুকিয়ে পড়ছে চাঁদ। সখী, তোর যৌবনের ধার একটু ধার দিবি আমাকে? সফেলা কতবার বলেছে এ কথা! আজ তার মেজাজটা বেশ বিগড়ে আছে। মাগি, ছিনালিপনা করিস আমার সাথে? হাতের কাছে পেলে তোর মাথার চুলগুলো ধরে স্যাটাই ধান ভাংতাম! সফেলা মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করে বলে। দালালের একজন এগিয়ে যায় দরজার দিকে। অন্যজন সফেলার হাত দুয়েক দুরে দাঁড়িয়ে ছছছড় করে পেশাব করতে থাকে। কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে একটা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, ‘কে? কে এই অসময় দরজা হেটকায়?’ সফেলার বাম পাশের লোকটি একটু বিনয়ের সুরে বলল, ‘আমরা সাব, মাল লইয়া আইছি’। ভেতর থেকে আর কোন সাড়া শব্দ আসে না। সফেলা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে বলল, ‘কত দেবে ওরা?’ ডান দিকের লোকটা আন্ডারওয়্যার এর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে খিঁচুনি দিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ কর শালী, এত্ত ঠাপ খেয়েও কামড় মেটেনি!’ ততক্ষণে ভেতর থেকে একটা তৃপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘আজ আর লাগব না; আমরা কম বয়সী এক মাগী পাইছি। অন্যদিন নিয়া আইসো’। সফেলাকে হটিয়ে দালাল দু’জন পিছন দিকে পা বাড়ায়। সফেলা মাথা ধরে বসে পড়ে--আরও একটি নষ্ট রাত, আরও একটি স্বপ্নের প্রতিক্ষায়। কিন্তু কত দেবে ওরা?