সমসাময়িক অনেকেই কবিতার চেয়ে প্রচার-কৌশল আর ধূর্তামির দিকে সময় বেশি ব্যয় করছেন: সৈকত হাবিবের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 21, 2012 10:51:18 AM

প্রকাশিত বই: বনলতা সেন : ষাট বছরের পাঠ, শহর যৌবন ও রাত্রি

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

সৈকত হাবিব: যে আমি নিত্য খাই-দাই-কাজকর্ম করি, হেঁটে বেড়াই, ফিকির করি, মনে হয় সে আমি কবিতা লেখে না, বরং আমার মস্তিষ্ক ও জিনের ভেতর এমন এক উপাদান আছে, যা আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়। কারণ, কবিতা লেখার জন্য আমি খুব কমই সচেতন প্রয়াস করি, বরং বলা যেতে পারি আমি কবিতার জন্য অপেক্ষা করি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

সৈ: প্রস্তুতি তো অনেক রকমের, সেটি আবার জনে জনে খুবই আলাদা, আপনার-আমার কিংবা অন্যের, প্রত্যেকের প্রস্তুতির ধরনটা একেবারেই পৃথক রকমের। কাজেই প্রস্তুতির বিষয়টাও কবির অনেকটাই ব্যক্তিগত। কিন্তু প্রশ্নটা হলো কবিত্বের। যদি কারো ভেতর কবিত্ব থাকে, এবং তা ‘যথাযথ’ভাবে প্রকাশিত হতে চায়, তাহলে সম্ভবত তা-ই কবিকে প্রস্তুত করে নেয়। তবে পাঠ, ধ্যান, আত্ম-অনুসন্ধান, প্রজ্ঞা, কবিতার ব্যাকরণ ইত্যাদি কিছু শর্ত তো আছেই, যা একজন কবিকে প্রস্তুত করে তোলে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

সৈ: সমসাময়িক অনেকের কবিতাই ভালো লাগে, যখন দেখি, সত্যিকারের কবিত্ব তার ভেতর আছে এবং তার প্রকাশও বেশ চমৎকার।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

সৈ: এই প্রশ্নের জবাবটা আসলে এর আগের প্রশ্নের বিপরীত। আমাদের সমসাময়িক অনেককেই দেখি, কবিতাকে অনেকটা বিপণন-উপকরণ করে তুলেছেন, এবং নানা দামে সেটা বাজারে বিকানোর জন্য কবিতা লেখার গুরুত্বর চেয়েও বেশি শ্রম দিচ্ছেন। অর্থাৎ যতটা না তার কবিত্ব, তার চেয়ে বেশি প্রচার-কৌশল আর ধূর্তামির দিকে সময় বেশি ব্যয় করছেন।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সৈ: নব্বই তো অনেকটা থিতু হয়ে এসেছে। ওই দশকের কবিদের অনেকেরই বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। অনেকেরই কয়েকটা করে বইও বেরিয়েছে। তাদের সক্ষমতা-অক্ষমতা, কাজ-অকাজ বেশ মোটা দাগেই চোখে পড়ছে।

অন্যদিকে শূন্য দশকের কবিরা এখনো মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের উত্তেজনাও অনেক বেশি। আরও অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। মূল্যায়নের সময় এখনও ঢের দূরে।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

সৈ: যদিও একই ভাষাভাষী, তবু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরত্ব/পার্থক্য রয়েছে। স্থূলভাবে না হোক, সূক্ষ্মভাবে ফারাক তো আছেই। আর নানাভাবেই ধরনটা আলাদা। যেমন ধরুন, পশ্চিমবঙ্গের কবিরা যে কোনো বিষয় যেমন ঘরকন্যা, নিত্যজীবনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও অবলীলায় কবিতা লিখে ফেলতে পারেন, সে তুলনায় বাংলাদেশের কবিরা কবিতাকে এখনো এতটা আটপৌরে করে তোলেননি, বরং কবিতার কৌমার্য বা বিশেষত্ব রায় যেন অনেকটা শুচিতা অবলম্বন করে চলেছেন (বিষয়টার ভালো-মন্দ, সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন কিন্তু করছি না। কেবল ফারাকটা বোঝানোর জন্যই বলছি।)।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

সৈ: ব্লগ তো অনেক কিছুই দিচ্ছে। সবচে বড় যা দিচ্ছে, সাহিত্যকে পত্রপত্রিকার গোষ্ঠীতন্ত্র, স্বেচ্ছাচার আর ব্রাহ্মণ্যত্ব থেকে মুক্তি। একটা সময় ছিল যখন স্বাধীন বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের একমাত্র আশ্রয় ছিল ছোটকাগজ বা সাহিত্যপত্র। কিন্তু সেটাও এখন দিনে দিনে খুব দুর্মূল্য হয়ে পড়েছে। কাগজের দাম, ছাপা খরচ, বিজ্ঞাপনস্বল্পতা, ভালো লেখা জোগাড়, সময় বের করা। আবার এখানেও গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবল। কারণ, ছোটকাগজের উদ্দেশ্যই তাই, নিজস্ব/সমমনা লেখকদের প্রমোট করা। কিন্তু ব্লগ যেন এক্ষেত্রে খোলা ময়দান। সবার জন্যই উন্মুক্ত। সেখানে ভালো-মন্দ, আপন-পর সবাই একত্রে সহাবস্থান করতে পারে। ব্লগ অবশ্যই সাহিত্যের জন্য আশীর্বাদ, যদি সেখানে নতুন/ভিন্নধর্মী/সিরিয়াস/মুক্ত লেখার প্রাধান্য থাকে।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

সৈ: এর কিছুটা জবাব আগের প্রশ্নেই দেওয়া আছে। তবু বলি, ছোটকাগজের জন্ম হয়েছিল একটি বিশেষ সময়ের প্রয়োজনে। আবার ব্লগের জন্মও সময়েরই দাবিতে। ছোটকাগজের চাইতে ব্লগ আমার কাছে তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ : ১. ব্লগ পরিবেশসহায়ক, এতে কাগজের মতো পরিবেশ ধ্বংস করতে হয় না; ২. ব্লগে লেখকের-সম্পাদকের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হয়, ছোটকাগজ প্রকাশের জন্য বেশ বড় এক আর্থিক চাপ থাকে; ৩. ছোটকাগজের প্রচার ও বিপণনের পরিসর বেশ ছোট কিন্তু ব্লগের লেখা কারো ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া যায়।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেণ কি?

সৈ: দৈনিকের সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্যটা মূলত ব্যবসায়িক, আর কিছু ছিঁটেফোটা সামাজিক দায়। নাম, সম্পর্ক, উদ্দেশ্য, বাজার, মর্যাদা, মতা এসব হলো দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর প্রাণভোমরা। সেখানে সাহিত্যের চেয়ে মতাচর্চা বড়, লেখার চেয়ে লেখার রাজনীতিটা শক্তিশালী। তাই বলে কি ভালো লেখা প্রকাশ হয় না? নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু দৈনিকের উদ্দেশ্যটা সবসময়ই সাহিত্যের ভেতর দিয়েই সাহিত্যের বাইরের কিছু, অতএব সন্দেহজনক। কিন্তু সাহিত্যের প্রচারের জন্য এটি একটি বিস্তৃত পরিসর, এর বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি শুধু উদ্দেশ্যটাই সৎ হতো।