কবিতা লিখতে ভালো লাগে, তাই লিখি: ইরফানুর রহমান রাফিনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jul 11, 2012 8:26:37 AM

প্রকাশিতব্য বই: অনন্তকালের দৃশ্য

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

ইরফানুর রহমান রাফিন: আমার কবিতা লিখতে ভালো লাগে, তাই লিখি। আর কোনো কারণ নাই।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ই: যাঁরা কবিতা নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা এই প্রশ্নের একটা যথাযথ উত্তর পারবেন। আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলে সে-টা হাস্যকর হবে। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

ই: টোকন ঠাকুরের কবিতা খুব ভালো লাগে। সোহেল হাসান গালিবের কবিতাও বেশ ভালো লাগে। তাঁদের কবিতা আমার অনুভূতিকে কোনো-না-কোনো ভাবে স্পর্শ করে, তাই ভালো লাগে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ই: ব্রাত্য রাইসুর কবিতা ভালো লাগে না। হয়তো উনি খুব ভালো কবি, কিন্তু উনার কবিতা বোঝার সামর্থ্য আমার নাই। যেহেতু উনার কবিতা বুঝি না এবং উনার কবিতা আমাকে একটুও স্পর্শ করে না, তাই উনার কবিতা আমার ভাল লাগে না।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ই: এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চাচ্ছি না।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ই: আমার মনে হয় পশ্চিমবঙ্গে কবিতার কোনোরকম ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে না। বাংলাদেশের কবিরা কবিতা নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের কবিতা একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন তাঁদের বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে ভারতীয় পরিচয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, চাকরি বাকরি ব্যবসা বানিজ্য ইত্যাদিতে সুবিধা পাওয়ার জন্য, প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য। আর সাহিত্য যেহেতু জীবনের ভালোমন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তাই পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিকদের ভেতরেও এই প্রবণতা কাজ করবে। হয়তো ইতিমধ্যেই কাজ করা শুরু করেছে। সেখানকার কিছু ব্যতিক্রমী কবি সাহিত্যিক হয়তো স্রোতের বিপরীতে চলার চেষ্টা করছেন বা ভবিষ্যতেও করবেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা দিনদিন কমবে বৈ বাড়বে না। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলা কবিতার ভবিষ্যত বাংলাদেশে। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যেরও। এটাই বাস্তবতা। শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নাই।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ই: ব্লগের একটা ভালো দিক হচ্ছে এটা সাহিত্যকে তথাকথিত "সাহিত্যিক শুদ্ধতা"-র হাত থেকে রক্ষা করছে। যাঁদের সাহিত্যের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছোটকাল থেকে গড়ে ওঠে নাই, তাঁদের অনেকেই ব্লগে কবিতা পড়ে কবিতা ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এমনকি নিজেও লেখার চেষ্টা করছে। মাধ্যম ভালো কবি তৈরি করতে পারে না, যিনি ভালো কবি তিনি তালপাতার পুঁথিতে কবিতা লিখলেও সে-টা ভালো কবিতা হবে আবার ব্লগে কবিতা লিখলেও সে-টা ভালো কবিতাই হবে। ব্লগ কবি বা সাহিত্যিকদের সাথে পাঠকদের যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। ব্লগের সাফল্য এই জায়গায়, যোগাযোগ বাড়ানোর জায়গায়।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ই: হ্যাঁ, মনে হয়। এ-টা ঠিক আর লিটল ম্যাগের ভেতরে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার একটা দ্রোহী মনোভাব কাজ করে, আর লিটল ম্যাগ কর্মীদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু এই দ্রোহের অন্তিম গন্তব্য কি?

আপনি একটা বিষয় খেয়াল করবেন, সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়-রা কৃত্তিবাস করেছিলেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসেবে, একটা সময় কিন্তু তাঁদের প্রায় সবাই দেশ পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। দেশ কি "অ-প্রতিষ্ঠান"? কেন এমন হল? সততার অভাবে? আমার মনে হয় না। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা লিটল ম্যাগ-কে কিন্তু কোনো শক্তিমান মানবিক আদর্শের অবস্থানে নিয়ে যায় না, বরং লিটল ম্যাগ কর্মীদের দিন দিন সমাজবিচ্ছিন্ন করে তোলে। তাঁরা এক ধরণের হিংস্র প্রতিহিংসা নিয়ে জগত জীবনের সবকিছুর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকেন, মনে করতে থাকেন তাঁরা আছেন এক ধরণের "সেইফ হ্যাভেন"-এ। এতে নিজের অবস্থানটা নিরাপদ থাকে। কিন্তু পরিত্রাণের পথ দ্যাখানোর আগ্রহ আর থাকে না, ভাবেন হয়তো তাঁদের কাজ শুধু নিরন্তর সমালোচনা করে যাওয়া। কিন্তু সমালোচনা করার পর উজ্জ্বল বিকল্প নির্মাণের কাজে হাত না দেওয়ার ফলে একসময় তারা হতাশ হয়ে যে প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করতেন তারই পেটের ভেতরে ঢুকে যান এবং ওটাকে "অল্পবয়সের অপরিণত কাজ" হিসেবে দেখতে ও দ্যাখাতে থাকেন। এভাবে আসলে নিজের অনিচ্ছায় তারা প্রতিষ্ঠানেরই উপকার করছেন। এরকমই হয়েছে, হচ্ছে, হবে; এরকমই হওয়ার কথা। এ-বিষয়ে ফারুক ওয়াসিফ তাঁর "প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাঃ একলব্যের বুড়ো আঙুল বনাম প্রতিষ্ঠানের উদ্যত তর্জনী" প্রবন্ধে যা যা বলেছেন সেসবের সাথে আমি একশভাগ একমত। প্রবন্ধটি তাঁর "ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে" গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

ব্লগ লিটল ম্যাগের চেয়ে শক্তিশালী, কারণ ব্লগের মাধ্যমে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছা যায় এবং অনেক বেশি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে কবি সাহিত্যিকদের পরিচয় ঘটে। ফলে, মানবতাবিরোধী সকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানুষের সমাজ গড়বার যে লড়াই, তাতে লিটল ম্যাগের চেয়ে ব্লগ অধিকতর সহযোগী ভূমিকা পালন করতে পারে।

ঠিক এই কারণেই ব্লগ-কে লিটল ম্যাগের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ই: আমার মনে হয় অনেক ভালো লেখা ছাপা হচ্ছে এখনকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সাময়িকীসমূহে।

দু: নিজেকে আন্যের লেখা থেকে কিভাবে পৃথক করেন?

ই: হা হা হা, আমার বয়স এতই কম যে নিজের লেখা-কে অন্যের লেখা থেকে পৃথক করতে পারবো। আমার মনে হয়, নিরন্তর লিখে যাওয়ার মধ্য দিয়েই আমার একটা নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি হতে পারে, এখনো আরো বহুদূর যেতে হবে...