নব্বই আর শূন্যে আদৌ কোনো ফারাক আছে বলে মনে হয় না আমার: মাহবুব লীলেনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Dec 22, 2013 5:56:43 PM

প্রকাশিত বই: সাকিন সুন্দরবন, বেবাট, নিম নাখারা, উকুন বাছা দিন,বাজারিবাটু , খেরোখাতা, কবন্ধ জিরাফ, মাংস পুতুল, তৃণতুচ্ছ উনকল্প, ট্যারাটক, নম্র বচন।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মাহবুব লীলেন: একটা নিজস্ব নরক তৈরির জন্য; যে নরক যাচাই বাছাই ছাড়াই ভুলে-শুদ্ধে ক্ষমতায়-অক্ষমতায় আমাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ কার মতো উদার। কবিতায় যত আবোলতাবোল করা যায় সাহিত্যের অন্য কোনো মাধ্যমে তা করা সম্ভব না; অন্য সব মাধ্যম বড়ো বেশি শুচিবাইগ্রস্ত; ঠিক ধার্মিকদের স্বর্গের মতো। হয়তো এজন্যই লিখি... তার পাশাপাশি আরেকটা বড়ো বিষয় হলো কবিতায় নিজেকে যেমন লুকানো যায় তেমনি অন্যের কবিতা থেকে খুঁটে খুঁটে তাকে আবিষ্কারও করা যায়। আমার হিসাবে এই দুইটাই কবিতার সবচে বড়ো আকর্ষণ; তা হোক লেখার ক্ষেত্রে আর হোক পড়ার ক্ষেত্রে...

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার?

মাহবুব লীলেন: কবিতা লেখার জন্য প্রস্তুতির চেয়ে কবিতার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাবুডুবু খাওয়াটাই বেশি দরকারি। আগে প্রস্তুতি নিলে হয় সে কবিতার পণ্ডিত হয় না, হলে হয় আঁতেল। কবিতার সাথে থাকতে থাকতেই কবির দরকারি প্রস্তুতিটা আপনা আপনিই হয়ে যায়...

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মাহবুব লীলেন: কারো নাম বলে ক্যাচাল বাঁধাতে চাই না। সমসাময়িক অনেকের লেখাই আমার ভালো লাগে। সবচে বেশি ভালো লাগে যাদের লেখা দেখে আমার হিংসা হয়; মনে হয়- আহহারে শালাতো আমার কথাটাই বলে ফেলল...। এই ভালো লাগার দুইটা ধরন আছে। প্রথমতো এক্কেবারে চোখের সামনে দেখা কোনো জিনিস যা আমি আবিষ্কার করতে পারিনি কিন্তু সে বা তারা আবিষ্কার করে ফেলেছে সেইটা দেখে তাব্দা খাওয়া; আর দ্বিতীয়ত আগের কবিতাগুলোতে যা নাই তা কারো কবিতায় খুঁজে পাওয়া... এবং তা ঘটে। প্রায়ই ঘটে...

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

মাহবুব লীলেন: এখানেও নাম বলব না। কারণ একটা মানুষ অন্য কিছু বাদ দিয়ে কবিতা নাড়াচাড়া করে দিন পার করে; এইটাও একটা বিশাল বিষয়। তবে বহু কবিতা খারাপ লাগে। কবিতায় পণ্ডিতি- বিদেশি বস্তুর জাবর কাটা- খামাখা ভাষা নিয়ে অর্থহীন ক্যারিকেচার কিংবা ব্যক্তিগত ছ্যাকাবর্ণন এইগুলা এক্কেবারে অসহ্য...

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মাহবুব লীলেন: নব্বই আর শূন্যে আদৌ কোনো ফারাক আছে বলে মনে হয় না আমার। নব্বইয়ের লোকজন একটু বয়সে বড়ো; চুলদাড়িতে কলপ দিয়ে হাঁটাচলা করে; প্রেম-টেমের বাজার মন্দা; বাচ্চার ইস্কুল আর বাজারের ব্যাগ টানতে হাড্ডিগুড্ডি ত্যাড়া। অথবা চাকরিতে দুই তিনটা প্রমোশন পেয়ে কিংবা ব্যবসা গুছিয়ে ঘাড়ে গর্দানে প্যাটে কিছু চর্বি জমিয়েছে কিংবা হার্টে ডায়াবেটিসে কিংবা হতাশায় মাইর খেয়ে এখন আর আগের মতো লাফানোর এনার্জি পায় না কিংবা অন্যসব কারণে তাদের জীবনের রংটং এখন একটু ফিকে। এইসব ছাড়া নব্বইর সাথে আমি তো শূন্যের লেখার কোনো ফারাক দেখি না। নব্বইর লোকজনের প্রথম দিকের কবিতার বই আর শূন্য দশকের কারো প্রথম কবিতার বই মেলালে বিষয়টা একই মনে হয়। মনে হয় একই সময়ের লোকজন একই সাথে লিখেছে। পদ্ধতিগত দিক থেকে নব্বইর লোকজনকে পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের তেলটেল মেরে কবিতা ছাপাতে হতো বলে নিজস্ব বাছাই প্রক্রিয়াটা একটু বেশি ছিল; যা শূন্যের নেই। তাদের কবিতা প্রকাশের জায়গা অনেক বেশি.... নব্বইর অনেকেই দীর্ঘ দিনের চর্চায় এখন দুর্ধর্ষ কবিতা লিখছেন; যেখানে শূন্যের অনেকেই এখনো মেতে আছেন কাচা লেখার মাহাত্ম বর্ণনায়। নব্বইর লোকজন একটু মফস্বলি আর শূন্যের লোকজন একটু নাগরিক। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু মফস্বল আর নাগরিকতা আলাদাভাবে কিছু নাই; সবই মূলত আধানাগরিকের মফস্বল জীবন। কবিদের অবস্থাও তাই। নব্বইর লোকজন মফস্বলি থেকে নাগরিকতা আয়ত্ব করেছে আর শূন্যের লোকজন নাগরিকতা থেকে আয়ত্ব করছে মফস্বলি বিষয় আশয়। এইসব ছাড়া কবিতায় কোনোই পার্থক্য চোখে পড়ে না আমার... এক। এক্কেবারে এক...

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

মাহবুব লীলেন: পশ্চিম বঙ্গের কবিতা পড়তে ভাল্লাগে না আমার। আমার মনে হয় তারা অন্য কোনো এক ভাষায় কিছু একটা লেখে। ...পশ্চিম বাংলায় কবিতার বাংলাটা আর আগাচ্ছে না...

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

মাহবুব লীলেন: কোনো মাধ্যমই সাহিত্যকে কিছু দেয় না। সাহিত্যকে যা দেবার তা সাহিত্যই দেয়; তা হোক ব্লগে কিংবা হোক তালপাতায়। তবে ব্লগ এখন সবচে বড়ো প্রকাশ মাধ্যম; যা আগের যে কোনো মাধ্যম থেকে লেখক আর পাঠকদের বেশি স্বাধীনতা দেয়। লেখা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি কিংবা সম্পাদক-প্রকাশকদের না তেলিয়ে লেখকরা সরাসরি নিজের লেখা পাঠকের সামনে দিয়ে দিতে পারেন। যা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাছাড়া ব্লগ একই সাথে সর্বক্ষণ সহজলভ্য লাইব্রেরি কিংবা আর্কাইভও। যে কারো যে কোনো সময়ের লেখা টোকা মেরেই যেমন যখন ইচ্ছা পড়ে ফেলা যায় তেমনি অন্যের সাথে শেয়ারও করা যায়। এ দিক থেকে ব্লগই এখন সাহিত্যের সবচে বড়ো এবং কার্যকর মাধ্যম; তা যেমন লেখকের জন্য তেমনি পাঠকের জন্য...

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

মাহবুব লীলেন: খালি লিটলম্যাগ কেন; অন্য যেকোনো প্রকাশনা মাধ্যম থেকেই ব্লগ বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আর লিটলম্যাগ এখন এক মৃত বিষয়। দৈনিক পত্রিকায় যেসব বিষয় ছাপানো কঠিন সেসব বিষয় প্রকাশের তাড়া থেকেই তো লিটলম্যাগের জন্ম? কিন্তু এখন ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্লগ থাকায় সেসবে আরো বেশি সুবিধা। যদিও এখনো অনেক লিটলম্যাগ প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। সবকিছুই যেন কিছু লেখার সংকলন মাত্র। তাছাড়া প্রকাশনা যন্ত্রণার বিপরীতে লিটলম্যাগের প্রকাশ সংখ্যাও নিতান্ত নগণ্য; যেখানে ব্লগ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং অনায়াস। ব্লগ ছাড়াও সংকলনের ক্ষেত্রে ই-বুকও এখন এক বিশাল কার্যকর মাধ্যম...

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মাহবুব লীলেন: দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য। পাঠক আছে বলেই বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো প্রতি সপ্তায় দুই চার ফর্মা সাহিত্য ছাপায়। এটা পশ্চিম বাংলায় নাই। এটা নিঃসন্দেহে বিশাল একটা বিষয়। যদিও অন্যান্য মাধ্যম; বিশেষত ইন্টারনেট মাধ্যমের জন্য এখন অনেকেই উৎসাহী হন না দৈনিকে লেখা দিতে; কিন্তু তারপরও এর প্রভাব বিশাল। অন্তত যাদের কাছে ইন্টারনেট নেই কিংবা যারা ধীরে ধীরে পড়তে চান তারা কিন্তু পড়েন। তবে দৈনিকের সাহিত্যের জন্য বার্ষিক বই বিক্রিতে একটা নেগেটিভ প্রভাব পড়ে। পশ্চিম বাংলায় দৈনিকে সাহিত্য না থাকার কারণে সাহিত্য পত্রিকা আর বইয়ের বিক্রির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি; কিন্তু বাংলাদেশে কম। কারণ দৈনিকের সাহিত্য। বছর শেষে যেসব বই বের হয় তার অনেকগুলোই পাঠকরা আগে দৈনিকে পড়ে ফেলেন; ফলে বইটা আর কিনতে হয় না। এটা পাঠকদের দিক থেকে যেমন বিশাল একটা সুযোগ তেমনি লেখকের জন্যও চ্যালেঞ্জ। কারণ পাঠককে বই কিনতে বাধ্য করতে হলে লেখকদেরকে আরো বেশি চিন্তা করে লিখতে হয়। যেনতেন গল্প কবিতা না....