তরুণ গল্পকার মেহেদী উল্লাহর সাথে অনলাইন আলাপ ও তার গল্প পোস্টমাস্টার

Post date: May 15, 2012 6:17:26 AM

মেহেদী উল্লাহ্, তরুণ গল্পকার। বিভিন্ন লিটলম্যাগ ও দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তার গল্প প্রকাশিত হয়েছে।

দুপুর মিত্র: কবিতায় না এসে আপনি কেন গল্পে এলেন?

মেহেদী উল্লাহ্: ছোটবেলায় প্রচুর ভুতের গল্প পড়েছি। পড়তে পড়তে লিখতে ইচ্ছা করত ভীষণ! ভুতের গল্পে রাক্ষস-খোক্ষস চরিত্র ভালো লাগত খুব। তারপর একসময় ভুতের গল্প লিখলাম, তখন সিক্স-সেভেন। ভুতের গল্পের নেশাটাই পরবর্তীকালে সাধারণ গল্পে টেনে এনেছে আমাকে। গল্পে যা বলতে পারি, মূলত তাই বলতে চাই।

দু: আচ্ছা কখনও কবিতা লিখেন নি বা লিখার চেষ্টা করেন নি।

মে: লিখেছি একসময়, এখনো লিখি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম প্রথম তো কবিতার পেছনেই সময় দিয়েছি। আসলে ব্যাপারটা ভাষার। আপনি, একটা বিষয় পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর তো তার প্রকাশ, তখন প্রকাশ করতে গিয়ে দেখলেন গদ‌্যে বললেই বেশি জনযুক্ত(বোধগম্য) হবে আর আপনিও প্রকাশ করতে পারছেন সাবলীলভাবে, যা কার্যকর। তখন গদ্য পদ‌্যের ফয়সালা হয়ে যায়।

দু: সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের ভাষা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

মে: কথাসাহিত‌্যের না বলে আমি বরং বলব, কথা সাহিত‌্যিকের ভাষা। সবসময়ই সাহিত‌্যিক ভেদে ভাষা বিভিন্ন রকম থেকেছে। এই সেদিনও কমলকুমার (বিশ শতকের মাঝামাঝি) এমন ভাষা প্রয়োগ করেছেন, তার সমসাময়িকরা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেখবেন, একই সময়ে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষার স্কেল(মানদণ্ড) তিন রকম। ভাষা মাত্রই লেখকের আধার, কিন্তু লেখক মাত্রই ভাষার আধার নন। প্রত্যেক লেখককেই নিজস্ব ভাষাজগত ও ভাষারীতি দাঁড় করাতেই হয়। লেখক নিজেই তার ভাষার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চেষ্টা করেন, সঙ্গে আছে বিষয়বস্তু,চিন্তা প্রভৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে যে ভাষা বিতর্ক চলছে, আমি মনে করিনা, কথাসাহিত্যিকদের তাতে ক্ষতি বা লাভ আছে। সেটা অনেক বেশি ব্যাকরণিক ও সমাজভাষা বিজ্ঞানের ডিসকোর্স। লেখক তার ভাষাকে এমন একটা পর্যায় থেকে দেখেন, যা পাঠককে কোন একটা নিয়ামকের অংশ করে তুলে। আমি আমার গল্পে চরিত্রের সংলাপে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা তখনই আনছি, যখন ঘটনা বা প্রতিবেশটা নোয়াখালীর, নতুবা কেন আনব। প্রতিটি ভাষার শব্দই নির্দিষ্ট সাইন বহন করে চলে। সাইনটার লিখিত রূপের একদিক সেদিক হলেই যে অর্থ ধরা যাবে না তা নয়। আর্য, প্রাকৃত, বাংলায় একই একটা শব্দের তিনটা রূপ। অনেক শব্দ আছে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ধরতে পারবে না, কিন্তু অশিক্ষিত গ্রামের লোকজন ঠিকই বুঝতে পারছে। মোটকথা সামাজিক ভাষা বা উপভাষার সঙ্গে লেখকের ভাষার ভেদ এবং অভেদ দুটোই আমি দেখতে পাই এবং মানি। ইলিয়াস এবং হাসানের ভাষা যেমন এক নয়, কিন্তু তা বাংলা, তেমনি মাহবুব মোর্শেদ এবং শামীম রেজার ভাষাও এক নয়, কিন্তু তা বাংলা। আর যারা বলবেন, বাংলার সঙ্গে অন্য ভাষার মিশ্রণ আছে, তাও মানবো, এবং বলব, যদি না মেশাতে চান, তবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশীসহ অন্য ক্ষমতাশালী দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন। কারণ, ভাষা ভাষাকে চেনে, মানুষকে নয়। কথাসাহিত্যিকতো অনেক দূরের।

দু: তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন মাহবুব মোর্শেদ ও শামীম রেজা সাহিত্যে আলাদা ভাষা তারা তৈরি করতে পেরেছে। সেটা কেমন । একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?

মে: আমি ভাষা তৈরি করতে পেরেছে কি, পারে নি তার চেয়ে জোর দিচ্ছি, মাহবুবের 'দেহ' এবং শামীমের 'ঋতু সংহারে জীবনানন্দ'র ভাষা ভিন্ন- সেদিকে।

দু: একটু বুঝিয়ে বলবেন?

মে: যেমন, শামীম রেজা তার গল্পে বরিশালের আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগ করছেন, আবার বরিশালের প্রতিবেশে লিখিত গল্পও তাতে আছে। মাহবুব মোর্শেদ তা প্রাসঙ্গিক ভাবেই করেন নি, তার ভাষা তারই মতো, তিনি তৈরি করার মধ্যে আছেন। ফলে, দুটো ভাষার শরীর এক তো হবে না।

দু: এসব তো শরীরের ভাষা , আমি একদম সাহিত্যের ভাষা যে ভাষার মাধ্যমে একজন লেখক চিহ্নিত হয়ে উঠেন, তার কথা বলছি। এক্ষেত্রে আমাদের এখানে ভাষার একটা ব্যবহার আছে আলাদা হবার জন্যে , শৈলীর জায়গা থেকে ভাষাকে ব্যবহার করা, মূল উদ্দেশ্যই থাকে আলাদা হবার। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?

মে: আমি একটা গল্পের শরীরের ভাষাকেই সাহিত‌্যের ভাষা বোঝাচ্ছি। হ্যাঁ, সাহিত‌‌্যিকের নিজস্ব ভাষা রীতি তো থাকবেই, যাতে তিনি চিহ্নিত পারেন। আমি মনে করি, আলাদা ভাষা রীতি তৈরি করেই সাহিত্যিককে মাঠে নামা উচিত, এর আগে নয়। সাহিত‌্যিকের ভাষাই তার জার্সি নম্বর।

দু: পশ্চিমবাংলার কথা সাহিত্য আর বাংলা কথা সাহিত্যের মধ্যে কে বেশি এগিয়ে? কিভাবে? কেন?

মে: ভাষা তো আসলে এক্সপ্রেশনেরই প্রকাশ। একেক লেখক একেক ভাবে তার এক্সপ্রেশনকে প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ, প্রভাতকুমার, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নরেন্দ্রনাথ মিত্র সবার ভাষাই আলাদা। বিষয়বস্তুই ভাষাকে অনেকক্ষেত্রে আলাদা করে দিতে পারে। শব্দতো আসলে সাইন, অনুভূতির সাইন মাত্র। একেক লেখকের অনুভূতি একেক রকম, সেভাবে তিনি শব্দ চয়ন করেন। আপনি এখন যদি, তৎসম শব্দ বহুল লেখা লিখতে চান, আমি তো বাধা দিতে পারব না, বাধা দিতে পারে যে একমাত্র, সে পাঠক। পাঠকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লিখুন। বাক্যের গঠন, যতি-ছেদ চিহ্নের ব্যবহার-এগুলো ভাষাকে খুব কমই পৃথক করে।

আপনার প্রশ্নটি হওয়া উচিত, 'পশ্চিম বাংলা' ও 'বাংলাদেশের' কথাসাহিত্য-এভাবে। তাই নয় কি! দুটোর ভাষাই তো বাংলা। যাই হোক, যদি তাই হয়- এভাবে তুলনা করতে আমি আগ্রহী নয়, উভয় দলই বাংলায় লিখছে। তবুও বলব, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা তার স্বাদ উপলব্ধি করেই লিখতে পারছেন, আর পশ্চিমবাংলার বড় সংকট তারা

স্বাধীন নয়। স্রেফ স্বাধীনতার প্রশ্নটি ছাড়া অন্য কোনো তুলনায় তারা বাংলাদেশের সঙ্গে আগ্রহী হবার কথা নয়।

দু: হুম আমি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের কথাই লিখতে চেয়েছিলাম। দেশের শব্দটি বাদ পড়ে গেছে। যাই হোক, একেবারে সমসাময়িক তরুণদের মধ্যে কাদের লেখা গল্প বা উপন্যাস আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মে: সমসাময়িক তরুণদের লেখা খুব একটা পড়া হয় নি। তবুও অনেকের গল্প পড়েছি, পড়ছি, তাও নাম ধরে বলার মতো নয়। সমসাময়িক তরুণরা তো এমনিতেই সব কবিতার পাগল। গল্প-উপন্যাস কেউ লিখছে বলে তো খবর মিলছে না। আর লিখলে তো পরে ভালো খারাপের বিচার। ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে গল্প-উপন্যাসে মন্দা যাচ্ছে বলে শোনা যায়। তবে নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারি, তরুণরা গদ্যের আঙ্গিক নিয়ে খুব সংকটের মধ্যে আছে। বিশেষ করে গল্পের নতুন ভাষা রীতি ও আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা হচ্ছে। ছোটকাগজগুলো ছাপছেও। আসলে সময়টাই অনেক জটিল। তরুণরা(তরুণীসহ) ইন্টারনেট, মোবাইল, টিভি সিরিয়াল নিয়েই বেশি ব্যস্ত। সময়টা কেমন জটিল, নিজের জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে। মধ্যবিত্তের জীবনটাই তিন বেলায় তিন রকম রং ধারণ করে। ছোটবেলায় একবার দেখছি, দাম্পত্যের ঝামেলা স্বরূপ আমার আব্বা আমার আম্মাকে তিন তালাক দিয়েছেন। তখন তালাকের অর্থ বুঝতাম না। তবে বুঝেছি, দুজনের মধ্যে খারাপ কিছু হয়েছে। মন খারাপ করে স্কুলে চলে গেলাম। ক্লাসেও মন খারাপ। শিক্ষক-বন্ধু সবাই জানতে চাইলেই বলতে পারিনি ঘটনাটা কি? শেষে একই মন খারাপ অবস্থা নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি, সেই বাবা-মা ই চৌকিতে বসে গল্পে মশগুল হয়ে শিমের বিচি ভাজা খাচ্ছে। আমিও ছোকরা তাদের মন ভালো দেখে সঙ্গে সঙ্গে মন ভালো করে পাশে বসে পড়লাম। বাবা আগ বাড়িয়ে নিজ থেকেই বললেন, 'সকালের ঘটনায় কিছু মনে করিস না, আমি আসলে মন থেকে তোর মাকে তালাক দেই নি।'

এই হল মধ্যবিত্তের মনের অবস্থা। সকালে এক, দুপুরে আরেক। এই চরিত্র ধরে আবার গল্পে তাদের আনা মুশকিল। আর ভাষার চিন্তা তো আছেই।

দু: গল্পে আপনি সাধারণত কি করার চেষ্টা করেন? মানে কোন ধরণের কাজ?

মে: জানি না, কতটুকু কি লিখতে পারছি! সে বিচার সময় এবং মানুষের হাতে। তবে আমি শুরুতে দুটি গল্প (ক বর্গের ধ্বনি এবং ম তে মডেল-মরদেহ) নিয়ে নিরীক্ষা করলেও এখন আবার গতানুগতিক আঙ্গিকের ভেতর গল্পকে রেখেই নিরীক্ষা করার চেষ্টা করছি। যেমন, লিখলাম আপনার ওখানে, পোস্টমাস্টার। নিরীক্ষা আসলে গল্পকারের প্রয়োজনেই। নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দুটো কাজ হয়। এক. পাঠকের হাতে নিজেকে অন্যরকম ভাবে সমর্পণ করা। দুই. পাঠককে 'নতুন বোতলে গদ্য রস পরিবেশন করা(যদি পাঠক গ্রহণ করে)। আমি চেষ্টায় আছি, আমার মতো করে কিছু দাঁড় করাতে- ভাষায়, আঙ্গিকে- দুই নিরীক্ষার মধ্যই দিয়েই। দেখি যদি কিছু দাঁড়ায় আর কি! যাতে পাঠক বসবেন। সত্যি বলতে কি-পাঠকই তো নেই, আছে পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠাল চাপার গন্ধে, আর এখন সিরিয়ালের আনন্দে। সময় কেমে গেছে সবার। কার জন্য লিখব! দেখি অপেক্ষা করে কাকে কাকে পাওয়া যায়। ঢাকার মধ্যবিত্তের একটাই সংকট, টাকায় কিনা করে, শুধু বই পড়তে দেখি না।

দু: বাংলাদেশের গল্পে সম্প্রতি আর কোন কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনার চোখে পড়েছে? সেগুলো কেমন?

মে: যেমন শাহাদুজ্জামানের ‌'কয়েকটি বিহ্বল গল্প' বইটির শেষ গল্পটাই তো নিরীক্ষার উদাহরণ। গল্পটার নাম মনে পড়ছে না। দেখবেন, শুধু সংলাপ। ন্যারেটর অনুপস্থিত। শুধু চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এই ধরণের গল্পকে এই ভাবে বিশ্লেষণ করি- বর্তমানে দেখছি তৃতীয় পক্ষের কার্যকারিতা বা ভেল‌্যু কমে গেছে। আরব বিশ্বে বা পৃথিবীর কোন যুদ্ধ-ফুদ্ধের সুরাহা করতে পারেনি নিষ্পত্তিকারী হিসেবে জাতিসংঘ। কার্যত, মধ্যম পক্ষের গুরুত্ব উহ্য। এক্ষেত্র ন‌্যারেটর মধ্যপক্ষ। সেও বাদ গেল, তাই রইল শুধু চরিত্র, তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় একটা গল্প বা বলতে পারেন প্লট। আর অদিতি ফাল্গুনীর গল্পকে অনেককেই বলতে শুনেছি, ওটা নাকি, 'জাতিসংঘের রিপোর্ট'! আমি মনে করি, এই রিপোর্টই- নতুন, বাংলা গল্পে নিরীক্ষা। বাংলা গল্পে, খারাপ কি, নিরীক্ষাধর্মী গল্পের জন্য জাতিসংঘের রিপোর্ট কেউ লিখলে, আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, আমি যখন শাহাদুজ্জামানের ওই নিরীক্ষাকে বাড়িয়ে আরো নিরীক্ষা প্রয়োগ করলাম, তখন অনেকেই বলেছে, শুধু সংলাপ, তা বাবা নাটক লিখলেই তো পার! এতে আমার কিছু এসে যায় না, কারণ, জাহাঙ্গীরনগরের এক রিকশা চালক গল্পটি শুনে বলেছেন, 'ভালাইত কাইজ্জা'! আমি মূল্যায়ন পেয়েছি। আমি জানি জগতের কাইজ্জা(ঝগড়া) নিরসনে মধ্যপক্ষ(ন্যারেটর) নেই বলেই তা চলেছে-চলবে।

আর, আপনার কিচ্ছাগুলোও(দশভুজা বইয়ের) একধরণের নিরীক্ষা, আমি বলবো, তা অবশ্যই আঙ্গিকগত। এছাড়া কাজল শাহনেওয়াজ 'গতকাল লালে' যে গল্পগুলো লিখেছেন, তার অধিকাংশই নিরীক্ষাধর্মী গল্প।

দু: ঠিক একই প্রশ্ন যদি উপন্যাসের ক্ষেত্রে করা হয় তাহলে কি বলবেন?

মে: উপন্যাসে তেমন নিরীক্ষা নেই, কারণ ওটা যাদের দখলে তারা নিরীক্ষার চেয়ে গতানুগতিক ভাবে নিজের পোষ মানানো রীতিটা হাত ছাড়া করতে নারাজ। আর পাঠক পড়ছে তো! হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন। আরো কে কে যেন আছেন! যাই হোক, উপন্যাস নিয়ে আপাতত আমার মাথাব্যাথা নেই। আর গল্পটাও চলে যেত, যদি না হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শাহাদুজ্জামান, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, সেলিম মোর্শেদরা ফাইট না দিতেন। গল্পে আমাদের অধিকার শেষ করে উপন্যাসে যেতে চাই। শুনেছি, উপন্যাস তো এখন একরাতে বসে লেখা হয়, কিন্তু মনে রাখবেন, ছোটগল্প একরাতে বসে লিখলে সমস্যা নেই, তা জায়েজ। এরকম সংজ্ঞা তো আছে, যা একবসায় পড়া যায় তাই ছোটগল্প, তা একরাতে কেউ লিখলে আশ্চর্য হব না।

কিন্তু, উপন্যাস! কিভাবে একরাতে সম্ভব। আগেতো আলাদিনের প্রদীপের কথা শুনেছি। এখন দেখছি, আলাদিনের কালি পেয়ে বসে আছেন কেউ কেউ।

দু: অনেক সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।

মে: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মেহেদী উল্লাহর গল্প পোস্টমাস্টার

ডাকঘরে শসার গুদাম, পোস্ট মাস্টার বসেন দোকানে!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া

বাইরে থেকে ডিজিটাল সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘আটমূল পোস্ট অফিস’। ছোট্ট একটি ঘরের সামনে চিঠি ফেলার জন্য লাল রঙের বাক্সও আছে। কিন্তু সেখানে অফিসের কোনো কার্যক্রম নেই। ডাকঘরটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি অফিসের মধ্যে রাখেন শসা, সঙ্গে অন্য মালামালও। সেগুলো বিক্রি করা হয় হাটবারে।

বর্তমানে ডাকঘরের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদান করার আধুনিক সার্ভিস (ই-পোস্ট) চালু করা হয়েছে। এ কারণে আগের চেয়ে বিভিন্ন শাখা ডাকঘরগুলোর গুরুত্বও বেড়েছে অনেক। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের ডাকঘরগুলোর দৈন্যদশার কারণে হয়রানি হতে হচ্ছে সেবা গ্রহণকারীদের। আটমূল গ্রামের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবুল কালাম আজাদ জানান, ছুটির কারণে স্থানীয় ডাকঘরে তিনি ১৩ হাজার টাকা পাঠাতে ই- পোস্ট সুবিধা নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন ডাকঘরের সাইনবোর্ড লাগানো অফিসে চলছে শসা বেচাকেনা। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, পোস্ট মাস্টার অফিস ঘরটি ভাড়া দিয়ে অন্যখানে বসেন। কিন্তু সারা দিন অপো করার পরও তিনি পোস্ট মাস্টারের সাক্ষাৎ পাননি।

গত রবিবার সরেজমিন আটমূল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ১১টায়ও ডাকঘর বন্ধ। পোস্ট মাস্টার নুর মোহাম্মদ বিশ্রাম নিচ্ছেন অল্প দূরেই তাঁর বাড়িতে। তাঁকে ডেকে এনে জানা যায়, যেহেতু তাঁর এতো বড় জায়গা লাগে না তাই তিনি, বাজারের নজরুল নামের এক ব্যবসায়ীর কাছে ঘরটি ভাড়া দিয়েছেন। অফিসের কাগজপত্র নিয়ে তিনি কাজ করেন পাশের একটি দোকানঘরে। এতে তাঁর কোনো সমস্যা হয় না। স্থানীয় লোকজনও বিষয়টি জানে, সে কারণে প্রয়োজনে তারা তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে। অফিস কখন খোলেন, কখন বন্ধ করেন? জানতে চাইলে নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘কোনো টাইমটেবল নাই। কাজ থাকলে খুলি। না থাকলে খুলি না।’ তিনি জানান, তাঁর কোনো পিয়ন বা সহকারী নেই। ব্রজেন্দ্রনাথ মালি নামের একজন রানার আছে। সে মাঝেমধ্যে আসে।

স্থানীয় বাসিন্দা আমির আলী জানান, তাঁরা জানেন পোস্টমাস্টার কখন কোথায় থাকেন। তাঁর বাড়িও চেনেন সবাই। এ কারণে প্রয়োজন পড়লে বাড়ি থেকে তাঁকে ডেকে আনেন তাঁরা। এটা এখন একটা স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে। তবে বগুড়ার ডেপুটি পোস্টমাস্টার মহিদুল ইসলাম জানান, বিষয়টি একেবারেই অনৈতিক। অফিস ঘর ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করা গুরুতর অপরাধ। অন্য দোকানঘরে অফিস খুলে বসলে জরুরি কাগজপত্র ও টাকা-পয়সার নিরাপত্তা দেবে কে? তিনি জানান, এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হবে।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদনটিতে বগুড়ার ডেপুটি পোস্টমাস্টার হিসেবে যার নাম উল্লেখিত, আমি সেই, মহিদুল ইসলাম। সাংবাদিক সাহেবকে মন্তব্য দিয়েছিলাম, এ ব্যাপারে খোঁজ নিবো, অথচ খবরটি বের হওয়ার দিনটায়, সরাসরি ডাক বিভাগের মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে প্রথমে আমারই খোঁজ নেওয়া শুরু হয়ে যায়। এইবার আমার খবর আছে, এমনটি না ভাবলেও, উর্ধ্বতন কতৃপ সরাসরি এক বেতার বার্তায় অর্থাৎ মোবাইল ফোনালাপে আমাকে ঝাড়ির ওপর রেখে বলেন,‘ মহাশয়, দিলেন তো ডুবিয়ে। আপনার জেলার খবরটা ডাক বিভাগের যে খবর করে ছেড়েছে, গত পাঁচ বছরে ৮৬৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েও ডাকের নামডাকে অত ভাটা পড়েনি। বলি কি, শুধু কি নাক ডেকে ঘুমোন, না গাঁওগেরামের খোঁজ কিছু রাখেন, ওদিকে যে পোস্ট অফিসে গুদাম, শসার গুদাম…। ‘ই- ফোস্ট’ বানিয়েছি কি আপনার ওই ‘শসাঙ্ক’ মহাশয়কে পালিতের জন্য। ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠান। আর এত বেশি বলেন কেন? কথা কমিয়ে বলবেন সামনে, আপনাকে নিয়ে লেখা হয় নি তাই বেঁচে গেলেন, ফাঁদে পড়েছে যে, কারণ তাকে নিয়ে যে লেখা হয়েছে। সব মানুষেরই কিছু না কিছু দোষ বলেন আর ন্যাগেডিব সাইড থাকে, সাংবাদিকের কলম যে দিন আপনার মুখে ওঠবে সেদিন পাবেন টের।’

আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে জাস্ট শুনে গেলাম, মহাশয় ফোন রেখে দিলেন তারপর। এই যে, দেখুন না, যে জ্ঞানকাণ্ড তিনি শুনিয়ে দিলেন, যদি না তা চিঠি হয়ে আসতো তবে পেতাম, কি হতো? আসছে, আসছে, আসছে, অবশেষে এলে পরে বুকের উপর ধরে, শুয়ে শুয়ে আয়েশ করে পড়তাম। কণ্ঠের যে নগদ জোর আছে, তা কি আর ওই বাসি লেখা-জোখায় ফলে। আর এখন, মোবাইলের জোরে মারলেন নগদ নগদ। তাহলে হবে না কেন ডাকের এই হাল। মোবাইল ফোনে যত দ্রুত ডাকাডাকি, হলুদ খামের কপালে দুঃখ আছে, সেকি আজ বোঝা গেল। তাই হয়েছে, ডাক আউট টেলি ইন।

সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমি প্রতিবেদনখানায় কিছু আণ্ডারলাইন করেছিলাম। এর ফোকাস বা মূল উদ্দেশ্য আসলে কি পোস্ট অফিসটা না শসার গুদাম? পোস্টমাস্টারের অনৈতিক ও অপরাধঘটিত এই উদ্যোগের বিচার-বিশ্লেষণ-সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

আসলে দেখুন, এমন সিচুয়েশন এর আগে কখনো কি এসেছিল? বিশেষত, পোস্ট অফিস আর পোস্ট মাস্টার কে কেন্দ্র করে? এই যেমন বিশ শতকের পোস্টমাস্টার বাবুরা। আহা, কত মহৎ, কত বৃহৎ. কত উদার। দেখলেন না, পোস্ট অফিসের কর্ম-ধর্ম বাদ দিয়ে রতনকে কিনা অ-আ শেখালো। আর শেষে যে সঙ্গে নেয় নি, তার কারণ কি জানেন, আরে সে তো, বেয়াড়া-অভিসন্ধিবাদী সমাজপতিদের জন্যই। পাছে আবার রটিয়ে দেয়, তা বাবু কোন মাগীখানা থেকে ধরে আনলেন গো… মনে নেই, জগদীশ বাবুর লঘুগুরুর মতো আর কি। আর ওই যে প্রভাতকুমার, তিনি তো একেবারে রসে ভরা, টসটসে এক বাবুকে পোস্টমাস্টারি করতে দিলেন। দেখলেন না, কেমন লুকিয়ে চুরিয়ে চিঠি খুলে খুলে পড়ে। শেষে পরকীয়ার প্যাঁচে ধোলাই। দোষ পড়ল ডাকাতের ঘাড়ে। রাষ্ট্র দেয় পুরস্কার। আর এখন কিনা পোস্ট অফিসে গুদাম, ভাবা যায়। এতো জনাব, পোস্ট কলি কাল, এক্কেবারে।

প্রতিবেদনের আণ্ডার লাইনগুলো খেয়াল করে দেখুন না…

১. ডাকঘরটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে এক ব্যবসায়ীর কাছে। তিনি অফিসের মধ্যে রাখেন শসা, সঙ্গে অন্য মালামালও। সেগুলো বিক্রি করা হয় হাটবারে।

২. অফিসের কাগজপত্র নিয়ে তিনি কাজ করেন পাশের একটি দোকানঘরে। এতে তাঁর কোনো সমস্যা হয় না।

৩. তাঁর কোনো পিয়ন বা সহকারী নেই। ব্রজেন্দ্রনাথ মালি নামের একজন রানার আছে।

৪. বর্তমানে ডাকঘরের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদান করার আধুনিক সার্ভিস (ই-পোস্ট) চালু করা হয়েছে।

৫. বিষয়টি একেবারেই অনৈতিক।

ডাক বিভাগ আমাকে সময় বেঁধে দিয়েছিল মাত্র দশ দিন। এই সীমার মধ্যেই আমাকে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। আমার প্রতিবেদনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে, আটমূল পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার জনাব নুর মোহাম্মদের চাকরির হাল-তবিয়ত। আমি শুরুতেই দুই দিন খেয়ে বসলাম পারিবারিক কাজের চাপে। তৃতীয় দিনে চলে গেলাম আটমূলে তদন্ত শুরু করবার জন্য। বগুড়া জেলা শহরে দীর্ঘদিন ধরে বাস করে আসলেও আমার এক দূর সম্পর্কের বোন থাকতো আটমূলে, প্যাঁচ বেশি জটিল হলে সেই বোনের বাড়ি গিয়ে ঠেকবো, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শহর ছেড়েছি। আটমূল বাজারেই পোস্ট অফিসটার অবস্থান। ওখানে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিল অবস্থান। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে ডানে নাক ঘুরিয়ে একটা সরুগলির শেষপ্রান্তে। আমি পোস্ট অফিসটার গলির মুখে পস্রাবের গন্ধ পেলাম, ভূতের গলির আসল রূপ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এই গলিটা তাই। দিনের বেলায়ও কেমন গুমোট পরিবেশ, আশপাশে কোনো জনমানুষ নাই, কেমন পরিবেশ ওটা। আমি দেখলাম একটা জং ধরা কালো চায়নিজ চালা ঝুলছে পোস্ট অফিসের দরজায়। আর এর আশেপাশের একচালা ঘরগুলোরও এক অবস্থা, সবই গুদাম মনে হলো। দু একজন কে অবশ্য এখন দেখছি, ঘরের ভেতর মাল ঢেলে দরজায় দাঁড়িয়ে খালি চটের বস্তাটা ঝেড়ে নিচ্ছে, ফলে বালির ভাগ আমিও পেলাম। তালা দেখে ভাবলাম, এই তো একটা দৃশ্য সত্যি পাওয়া গেল, হারামজাদা পোস্টমাস্টার। তালা ঝুলছে, তার মানে মাল সংরণ ও নিরাপত্তার বিধান। ইতরটা কোনদিকে গেল? এতন চট ঝাড়ছিলেন যিনি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,‘ আচ্ছা ভাই। এরকম একটা গুদাম ঘরের মাসিক ভাড়া কত?’

- কিরকম ঘর নিবান? জায়গা বুঝে দাম, ছয়শ টাকা থেকে শুরু।

-আচ্ছা, এই যে পোস্ট অফিসটার সমান জায়গাওলাটার ভাড়া কত হবে বলেন তো?

-কত আর, সাত-আটশ টাকা।

- ও, আচ্ছা, দেখতেছি।

তারমানে ঘরটা ভাড়া দিয়ে পোস্টমাস্টার মাসিক সাত-আট টাকা কামিয়ে নিচ্ছে। ভালোই তো বুদ্ধি। বলেছিলাম না, এ যুগের পোস্টমাস্টার তো!

লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আচ্ছা ভাই, পোস্টমাস্টার কোথায় বলতে পারেন?’

লোকটা চট ভাঁজ করতে করতেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানালো,‘ মাস্টার সাব, পাইবেন, সামনের গলিটা ধইরা গলে, একটা কাপড়ের দোকানে গল্প করতেছে, মনে হইতে পারে।’

দেখা হয়ে গেল পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদের সঙ্গে। পরিচয় আর আসার উদ্দেশ্য বলে দিতেই, বসার জায়গা করে দিয়ে, বললো, ‘আসিয়াছেন বাবু, শহর থেকে। বড় কান্ত হইয়া আছেন। চলেন, পাশে হাঁটিয়া গেলেই আমার বাড়ি। হাতমুখ ধুঁয়ে আরাম করে বসে তাহার পরে যাহা জানিতে চাহিবেন বলিবো।’

বুদ্ধি খারাপ দেয় নি, কিন্তু আমি মূল উদ্যেশ্যে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বললাম,

- পোস্ট অফিস থাকতে, বাড়ি কেন?

- শুনিয়াছেন না বাবু, পেপারে কি খবর বেরিয়েছে। বসলে বসতে পারেন, এখন আর ভিতরে শসা নাই, গতকাল বাহির করিয়া লইয়াছি। তবে একটু অপরিষ্কার, এখনো ঝাড় দেইনি, সেই ভাবেই পাড়িয়া আছে। আর বাবু দুপুর হইয়াছে, খাবেন গিয়ে চলেন। আপনি তো এলেনই সেই শহর পাড়ি দিয়া।

ভাবলাম, বদমায়েশ, নতুন কোনো চাল দিচ্ছে না তো। কিন্তু এর কথা বার্তা যেমন মধ্যযুগীয়, এর মধ্যে আর কি ই বা ফিকশনাল এটিচিউড থাকবে। তার চেয়ে বরং যাই না, খেয়ে দেয়ে তার পরেই পোস্ট অফিসের তালা খুলে ঘরটা দেখে, জিজ্ঞাসাবাদ করবো।

সব কার্য সমাধা করে আমি ফিরে এলাম শহরে। আমার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি শেষ। আটমূলে ছিলাম মোট তিন দিন। থাকার কারণ, একটা মায়া, পোস্টঅফিসের মত সাধুভাষায় বললে, এখনো, কোথাও মায়া রহিয়া গেল। তবে সে মায়ার ছিটে ফোঁটাও ডাক বিভাগের কাজে আসবে না। আমি বরং তদন্ত প্রতিবেদনের দিকটা খোলাসা করি।

পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশেরও ষোল-সতের মাস আগে পোস্ট অফিসে শসার গুদাম ছিল না। তবে আমি যে দৃশ্য প্রত্য করেছি, সেই দৃশ্য দুই হাজার চার সালের পর থেকেই আরম্ভ। পোস্টঅফিসের গলিটায় দিন দিন প্রাপক-প্রেরকের অভাব বোধ হলো, লাল বাক্সের পেট আর চিঠিতে ভরে না, ওটা সম্ভবত বাতাস খেয়ে খেয়ে ঝিমায়। গলিটা একা, একটু হারাগে মূল বাজারের। ফলে এদিকটায় গুদাম হওয়া শুরু হলো। বাজার ফেরত হাটুরে হাটু ঘেঁড়ে পস্রাব করে পোস্ট অফিসের পেছনে, যেখানে অচেনা ঘাস-লতা-পাতা হলুদ হয়েছে হলুদ খামের শূন্যতার শোকে, হলেও হতে পারে। এই ভূতের গলি, মূত্রাখোলা, প্রাপক-প্রেরকের অভাব-চেপে ধরে পোস্টঅফিসটার থুতনি। দূরে দাঁড়িয়ে, গলির মাথা থেকে পোস্টঅফিসের সামনের লাল পোস্টবাক্সটাকে একটা লাল ক্যাপ, লাল শার্ট আর লাল হাফপ্যান্ট পরা শিশু বাচ্চা বলে ভুল হয় কারো কারো। এমন শূন্যতা কেন? হলুদ খাম আর আসে না, আর যায়ও না। লেখার কারো টাইম নাই, শুধু বলার সময় ওটা। ‘প্রাপক’ কিংবা ‘প্রেরক’ এর জায়গা দখল করলো ‘হ্যালো’। এই হলো মোবাইল ফোনের সূচনার ইতিহাস আটমূল এলাকায়। পোস্ট বাক্সটা আচমকা কিছু বুঝতে না পেরে অবুঝ শিশুর মতো শুধু অনড় দাঁড়িয়ে।

১৯৭৭ সালে একশ কুড়ি টাকা মাসিক মাইনেতে পোস্টমাস্টারি শুরু করেছিল নুর মোহাম্মদ। পোস্টমাস্টারির জোরেই প্রথম ছয় মাসের মধ্যে বউ, তারপরের বারো-চৌদ্দ বছরের মধ্যে মেয়ের জন্য উপযুক্ত জামাই জুটেছিল। এত দাম, এত সুনাম, তিনি পোস্টমাস্টার, নুর মোহাম্মদ। ১৯৭১ এর বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদের কত দাম! তার চেয়ে অধিক দাম চারদিকে তার, বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদের নাম ওইগ্রামে শুনেছে কয়জনে, অথচ পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদ এলাকার ছেলে, সবাই চেনে-জানে। আটমূলের সমাজে-নমাজে ডাক পড়ে তার। বিচার-সালিশে তার সিদ্ধান্তের সেকি ডিমাণ্ড!

পাত্র কি করে? পোস্টমাস্টার। মেয়ের বাবা কি করে? পোস্টমাস্টার। বাহ! এবড় সৎপাত্র। সৎ-সচ্ছ্বল ঘরের কন্যা। পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদ বছর না ঘুরতেই ঘরের ভিটি পাকা করে, কল তলা পাকা করে, রসুইঘরে নতুন মাটির প্রলেপ দেয়, নতুন চুলার প্রয়োজন না থাকলেও তাতে পাতিলের হারে চোখ বাড়ায়, চুলার চোখের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে তার নিত্যনৈমিত্তিক সুখের পাল্লা। মানুষের জন্য মানুষ, আত্মীয়ের জন্য আত্মীয়, খোঁজের জন্য খোঁজ, খবরের জন্য খবর, চিঠির জন্য চিঠি, উপচে পড়া আরো কথা বিঃদ্রঃ। এসবের বৌদলতে নুর মোহাম্মদের জীবনে সুখ-সানকত পোস্ট বাক্সের ডাকের হলুদ খামের চিঠির মতো অনবরত ছিদ্র অন্বেষণ করে কি না করে প্রাপক-প্রেরকের আঙ্গুলের টোকায় চলে যায় গর্ভাংশে। জীবনের গর্ভাংশ ভাগ, যৌবন সমৃদ্ধ হয় একই কায়দায়। ভরে যায় গল্পে-গল্পে পোস্ট অফিসের আশপাশ।

প্রতি হাটবারে চিঠির ভস্তা খোলা হতো খোলামেলা মাঠে। প্রাপক ফিরে যেতো বুক পকেটে হলুদ খামের চিঠি ভরে।

কত ঘটনা-কথা-উপকথা-আখ্যান-দুঃখ-বেদনা-মান-অভিমান এই পোস্ট অফিস ঘিরে, পোস্টমাস্টারকে ঘিরে। আটমূল ছাড়িয়ে অন্যান্য গ্রাম থেকে লোকে আসতো পোস্টমাস্টারের কাছে, এসে অনুনয়-বিনয়ের শেষ নেই-‘ বাবু, চিঠিখানা একটু পড়ে দিবেন। লেখাপড়া জানা ছেলে-পুলে নাই তো, বাইরের মানুষের কাছে নেব, ঘরের কোন কথা শেষে কোথায় নিয়ে লাগায়, তার চেয়ে একান্ত চিঠিখানা আপনি একান্তভাবে পড়ে দিন না।’

সে সব আরেক যুগের ইতিহাস মনে হয়। তৈরি হয় নতুন উপখ্যান। হলুদ খাম বাউরী বাতাসে একদিন হঠাৎ উড়ে যায় বেনামী ঠিকানায় আটমূল থেকে, বাংলাদেশ থেকে, সে দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে স্বয়ং পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদ। হলুদ খামের যুগ বিদায় হয়, আসে সুরের যুগ, উপচানো কার্ডে ভরা টাকার যুগ, টাকার নোটের গন্ধ নাই, অথচ নখ দিয়ে ঘসলে টাকা বেরোয়, বাতাসে ভাসে টাকা, যে বাতাসের পথ ধরে উড়ে চলে যায় হলুদ খামের চিঠি। সেই আকাশের মাথায় গিয়ে ঠেকে টাওয়ার। ইয়া বড় বড় লাল রঙা টাওয়ার। ছোট্ট ওই লাল রঙের ডাকবক্স এর কাছে কি!

যেদিন থেকে হলুদ খাম হারিয়ে যায়, প্রাপক-প্রেরক আর পোস্টঅফিসের গলি ধরে হাঁটে না, পোস্টমাস্টার ভেবেছিল কি মানুষ মানুষকে ভুলতে বসেছে। ছেলে মায়ের, বাবার, ভাই বোনের, ছাত্র শিকের, প্রেমিক তার প্রেমিকার খোঁজ নেওয়াই কি ছেড়ে দিল নাকি। তবে তার বুঝতে না পারার কথা নয়। পোস্টমাস্টার তো আর লাল ডাক বাক্সটার মতো কচি খোকা বাবু নয়! সে ঠিকই ধরতে পেরেছিল। পোস্টমাস্টার নুর মোহাম্মদের কদর কমে গেছে, সেই যদি ধরতে না পারলো তো কোনো ফোন কোম্পানীর কাস্টমার কেয়ার থেকে জানানো হবে‘ বাবু, এই মুহুর্তে হলুদ খামে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ হলুদ খাম নাই, তার স্বপ্নও নাই, হলুদ খামের সোনালী স্বপ্ন স্থগিত।

স্বপ্ন তো বড় বস্তু, ওই যে ব্রজেন্দ্রনাথ মালি নামের রানার টা আছে না, সেই ছোকরাটা তো তখন সবে এইট পাশ। তাকে রানার, যাকে বলে ডাক হরকরা হিসেবে এই পোস্ট অফিসে ঢুকিয়েছে তো নুর মোহাম্মদ পোস্টমাস্টার। ছোকরাটা টো টো করে ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক, তো ঘুরে যখন বেড়াবি, বেড়া, কাঁধে চিঠির ঝোলা নিয়ে প্রাপকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়া। ব্রজেন্দ্রনাথের অবসরের সময় কোথায়, তবুও অবসরে নুর মোহাম্মদের শরীর বানিয়ে দিত, চুলে বিলি কেটে দিত।

আদর-সোহাগ চিঠির ভাষার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে। তবু যেন বিশেষ দ্রষ্টব্য হয়ে কিছু দায়িত্ব রয়ে যেত ব্রজেন্দ্রর পোস্টমাস্টারের প্রতি।

একদিন পোস্টমাস্টার ব্রজেন্দ্রকে বললো, ‘ কি রে খালি চিঠি বিলি করিয়া বেড়াইলেই হইবে, বিয়ে-শাদি করিতে হইবে না।’

উত্তরে ব্রজেন্দ্র বলে,‘ আমি বিয়ে করলে তোমার প্রতি খেয়াল রাখবে কে বাবু। তখন তো বাকী সময় চলে যাবে বৌ-বাচ্চার পেছনে।’

পোস্টমাস্টার হেসে কয়,‘ সারাজীবন কি এই ভাবে চলিবে?’

পোস্টমাস্টারের এইসব ইতিহাস এখন বাসি, বর্তমানের সঙ্গে সে উপকথার বনিবনা নাই। সময় তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, সে কি করবে?

কথা হচ্ছিল ষোল-সতের মাস আগের । সেই একদিনের সকালে রানার ব্রজেন্দ্র হনহন করে হেঁটে যাচ্ছিল পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে। বাবু ডাকলেন,‘ব্রজেন্দ্র, ব্রজেন্দ্র।’ খানিক সময়ের মধ্যেই সোহাগ করে ডাকলেন, ব্রজেন্দ্র, ও ব্রজেন্দ্র। শোন রে।

কে শোনে কার কথা। ব্রজেন্দ্র চায়নার মোবাইল সেটে ইমরান হাশমির হিন্দি গান শুনতে শুনতে বাবুর কথায় কামাই দিয়ে চলে যায়। বাবুর ব্যাথা অবশ্য সেদিনই প্রথম নয়।

অবশ্য সেদিনই পোস্টমাস্টার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল তার আর কারো কাছে দাম-দরদ নাই। তিনি একা হয়ে পড়েছেন। যুগের হিসাবের খাতায় তার কৃতিত্বের ফল শূন্য খাটে। এতকালের পরিশ্রম কয়েক বছরেই একটা ছোট্ট পিঁড়ির মতো বস্তুর কাছে ধুলিস্বাৎ হয়ে গেল। ভাবা যায়।

ব্রজেন্দ্র হলুদ খাম হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই হারামি শুরু করে। পোস্টঅফিস এমনকি পোস্টমাস্টারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। শুধু ব্রজেন্দ্র বললে ভুল ঠেকে, গোটা আটমূল, এমনকি তার বিবি সাহেবা আর মেয়েরা পর্যন্ত, তাদের জামাইয়ের কথা তো বাদ, তারা আর বাপের বাড়ি আসবার সময় পায় না। অথচ আগে ছয়মাস অন্তে নায়র খেটে যেতো। সেই দিন আর নেই, হলুদ খামের সঙ্গে তা উড়ে গেছে আগে।

পোস্টঅফিসের গলিটা দিনে দিনে ভূতের গলিতে পরিণত হলো। কেউ এই পথে হিসু করার প্রয়োজন ছাড়া আসে না। সারাদিন কার্য ছাড়া একা একা নুর মোহাম্মদের ভালো লাগে না। অথচ আগে জন-মানবের অনুরোধ, হাসি, ঠাট্টা আরো কত কীসে কেটে যেতো দিন। নুর মোহাম্মদ পোস্ট অফিস খোলা রেখেই নিজের কাছেই চা খাওয়ার নাম করে চলে যায় পাশের গলির গনি মিয়ার কাপড়ের দোকানে। গল্প আর শেষ হয় না তার। পুরনো জীবনের গল্প। পোস্টমাস্টার গদিতে বসে শুরু করে,‘ বুঝলে গনি, একদিন হইলো কি, এক নতুন বউ তাহার ভাইকে চিঠি লিখিবে, অথচ বলিবে কাহাকে, লাজ-শরম ভাঙ্গিয়া তো আর কাহাকে কইতে পারে না, এরকম করিয়া একটা চিঠি লিখি দাও ভাইয়ের কাছে, যাহাতে এই মাসেই আমারে নাইয়র নিতে আসিয়া যায়। বাধ্য হয়ে এলো আমার কাছে। হা. হা. হা. দ্যাখো তখন, আমার তো মেলা কাজ পড়িয়া আছে। তবুও আমি বলিলাম…’

ওদিকে পোস্টঅফিসের আশেপাশে যেহেতু গুদামের চল শুরু হয়ে গিয়েছে, তাই নজরুল নামের একশসার ব্যাপারী প্রথম প্রথম পোস্টঅফিসটার দরজার একপাশে তার শসার বস্তা রাখতে শুরু করলো। কয়েকদিন নিয়ম করে শুধু শুধুই কথা বলবার লোক হিসেবে, নজরুল কে পোস্টমাস্টার ডেকে বলতেন, ‘রাখনা, অসুবিধা কি হইয়াছে। তবে আরো একটু খানি চাপাইয়া রাখো, শুন, বস, তোর লগে কথা আছে, জরুরী কথা।’ এভাবে নজরুলের সঙ্গে চললো কয়েক দিন। নজরুল ধান্দাটা ধরতে পেরে রোজ ভোরে বড়বাজার থেকে আনা শসার বস্তা পোস্টঅফিসের দোরের গোড়ায় রেখে উধাও হতো। তারপর একদিন নুর মোহাম্মদ তাকে ডেকে পাচ্ছেন না বলে, পরবর্তীতে আবার যখন দেখা হলো, তখন বললেন,‘ শোন নজু। আমি ভাবিয়াছি কি, তুই তো চাইলেই পোস্টঅফিসের ঘরখানার এককোনাতেই শসার বস্তা রাখিতে পারিস। তোর কি কোনো অসুবিধা আছে।’

নজরুল মনে মনে অধিক খুশি হয়ে বললো,‘ বাবু, আপনার দয়া’

এবার ছাড়লেন না পোস্টমাস্টার। তিনি নজরুলকে একখানা শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন,‘ তবে, শোন, ঘরের চাবি কিন্তু আমার কাছে থাকিবে। তোর যখন প্রয়োজন পড়িবে তুই আমাকে বাড়ি থেকে ডাকিয়া আনবি।’

নজরুল বুঝতে পারলো না ঘটনা কি। তবে সে রাজি না হয়ে অন্য উপায় পেল না। পোস্টমাস্টারের এমন আচরণকে আমি বলতে পারি, দীর্ঘদিন মানুষের সঙ্গে মিশবার যে অভ্যাস সে চিঠির কারবারে পেয়েছে, তা মুছবে না কখনো। তাই আগে যেমন লোকে তাকে বাড়ি থেকে চিঠির প্রয়োজনে ডেকে আনতো, সেই পুরনো অভ্যাসটার মোহে তিনি নজরুলকে এমন শর্ত দিয়েছিলেন।

একদিন দুইদিন কোণা-কানচি চলে, তারপর আর চলে না, নজরুল ঠিকই পোস্টঅফিসের পুরোটা দখল করে। তবুও চাবির একটা প্রয়োজন আছে পোস্টমাস্টারের পৃথিবীতে, যার জন্য নজরুল তার বাড়িতে পুরনো রীতি মতো তাকে ডেকে আনে। পোস্টমাস্টারের মনে পড়ে, সেই সব ব্যস্ত দিনের কথা। তিনি নজরুলের এমন ঘটনায় পুরনো দিনের খাতার সঙ্গে মিল খুঁজে পান। প্রতি হাটবারে নজরুল পোস্টঅফিস থেকে শসা বের করে নিয়ে যায় বিক্রির জন্য কাচাবাজারে, অনুরূপ পোস্টমাস্টারের এই নজরুলীয় প্রয়োজনের খাতিরে মনে পড়ে, মাত্র দশ বছর আগেও প্রতি হাটবারে তিনি আসার আগেই প্রাপক দাঁড়িয়ে থাকতো পোস্টঅফিসের সামনে, এসে চিঠির বস্তা খুলে প্রাপকের নাম ধরে ডাকতেন, আর একটা একটা হলুদখাম নিয়ে চলে যেতো মানুষ, তাতে কত আনন্দ-বেদনার বুনিয়াদ।

ই-পোস্ট নতুন জিনিস। এই পোস্টঅফিসে ই-পোস্ট করার মতন কটা মানুষ আসে, আটমূল তো গ্রাম, অভাবের গ্রাম, এখানে টাকাওলা শহরবাসী কই। তাই ই-পোস্ট অন্তত এই পোস্টঅফিসের জন্য কোনো নতুন কাজের বিষয় নয়, নয় কোনো নতুন ব্যস্ততা পোস্টমাস্টারের জন্য। এরচেয়ে নজরুলের শসার গুদাম ভালো, অন্তত নজরুল প্রতিদিন এসে এই সুবাদে গল্প করে যায় তার সাথে। তাকে মানিয়ে দিয়ে যায় পুরনো দিনের সঙ্গে। হলুদ খামের সোনালী স্বপ্নে বিভোর হন তিনি নজরুলের জন্য, অন্তত অন্যকোনো ভাবে। যা নজরুল তাকে দিয়েছে। অথচ নজরুল মাগনা রাখে শসা। মাসিক কোনো ভাড়া তার দিতে হয় না। ফলে আমার জানতে সুবিধা হয়, পোস্ট অফিসে শসার গুদাম ঠিক, কিন্তু তাতে পোস্টমাস্টারের কোনো টাকাই সুবিধা নাই। যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে একটা পোস্ট অফিস গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে তার জন্য দায়ী কে বা কি-তা আর বলতে হয় না। তবে সময় অনেক মুক্তকে বদ্ধে আর মুক্তিকে বন্দিতে পরিণত করতে পারে-এটুকুই এপ্রসঙ্গে কথা।

পোস্টমাস্টারের এই কর্মকাণ্ডকে আমি আর অনৈতিক বলতে পারি না। তদন্ত প্রতিবেদন দেখে ডাকবিভাগ আমাকে হয়তো গাঁজাখোর, আর প্রতিবেদনকে গাঁজাখোরি আখ্যা দিতে পারে, তাতে আমার ভয় নাই। বরং কখনোই এই আমি ডেপুটি পোস্টমাস্টার মহিদুল ইসলাম, আটমূল পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টারকে অনৈতিক বলতে পারি না। আপনারা কি বলবেন, একটু ভেবে দেখুন।