ছড়া উত্তরাধুনিক পথযাত্রায়ও নেমেছে: জগলুল হায়দারের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 28, 2012 8:51:32 AM

প্রকাশিত বই: উড়তে উড়তে ঘুড়ি, অনার করলে অনার পাবি, জোয়ান অব আর্ক

দুপুর মিত্র: সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ছড়া আসলে হারিয়ে যাবে। আপনার কি এরকম মনে হয়?

জগলুল হায়দার: এমন তো মনে হয় -ই না বরং আমার ধারণা ছড়া দিন দিন আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। আরও বড় জায়গা করে নেবে আমাদের সাহিত্যে।

দু: ছড়াকে শিশুসাহিত্য হিসেবেই কি আপনি মেনে নিতে চান? চাইলে কেন? না চাইলে কেন নয়?

জ: এটা দুই দশক আগে হলে মেনে নেওয়া যেতো। আজকের প্রেক্ষিত ভিন্ন। পুরা দৃশ্যপট পালটে গাছে। এখন শিশুতোষ ছড়া যতোটা লেখা হচ্ছে তারচে' ঢের বেশি হচ্ছে adult তথা বয়স্কজনচিত ছড়া । সব সময়েই দুটা ধারা পাশাপাশি প্রবহমান ছিল। সন্দেহ নেই এর মধ্যে শিশুতোষ ধারাটাই প্রবল। তবে সাম্প্রতিক কালে ছড়ায় এই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে খুব জোরেসোরে। আমি কেনও,যারা এ সম্পরকে সামান্য ওয়াকেবহাল তারা কেও আর আজ এতা মানবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

দু: ছড়ার আবেদন ক্ষনস্থায়ী। আপনি কি একমত? হলে কেন না হলে কেন নয়?

জ: এর দুটা উত্তর-ই হতে পারে। প্রথমত বলবো হা। কিন্তু উত্তরটা এত সরল হলে আবার বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে। লোকে বুঝবে ছড়ার বোধয় চিরস্থায়ী আবেদন নেই। আসলে ছড়ার একটা মৌল উদ্দেশই হল 'তাৎক্ষনিক' আনন্দ দান। তো এই তাৎক্ষনিক আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী হতেই পারে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কারণ প্রথম উদ্দেশও তো তাই ছিল। সুতরাং উদ্দেশ্য সাধনে ছড়ার সিদ্ধই অর্জিত হয়েছে এতে। কথা হল এরপরও সেই আনন্দের রেশটা থাকে কিনা? আমরা দেখেছি অনেক ছড়াতেই তা থাকে। অনেক ছড়াতেই তা আছে। অজস্র উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।দরকার নেই,কেননা আমি আপনি আমরা সবাই এরকম ছড়ার সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। সুতরাং আমরা বরং বলতে পারি ক্ষণস্থায়ী আবেদনের মধ্যে দিয়েও ছড়া কালাতীত হয়ে উঠতে পারে। ওঠেও।

দু: রাজনৈতিক ছড়াচর্চা অনেকটাই কমে গেছে বা বলতে গেলে নেই। এর কারণ কি? অনেকেই এই ছড়াকে সাময়িক বা ক্ষণস্থায়ী বলে থাকেন। আপনারও কি তাই মনে হয়? হলে কেন না হলে কেন নয়?

জ: রাজনৈতিক ছড়ার চর্চা কমে গেছে, কথাটা তথ্যভিত্তিক ঠেকছে না আমার কাছে। হ্যাঁ ,এক্টা ব্যাপার ঘটেছে, সেটি এই ধরণের অনুসিদ্ধান্তের 'বিভ্রম' তৈরি করে কখনো কখনো । এর পেছনে রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেরও একটা ভুমিকা আছে। ব্রিটিশ গেলো । উপনিবেশিক শাসন গেলো। এক সাগর রক্তে স্বাধীনতা এলো। তারপর ৭৫ এর ট্র্যাজেডি। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন । ৯০ এর গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন । এসব পার হয়ে আমরা কিছুটা হলেও এক্টা স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি ।ফলে শুধু ছড়ায় কেনও,আমদের শিল্পের সব শাখায় এর আক্তা প্রভাব পড়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমান ছড়াকাররা এই অবস্থায় নিজেদের ছরাকেও খানিক্তা রেমদেলিং করে নিয়ছে। ফলে রাজনৈতিক ছড়া এখন লেখা হচ্ছে একটু ভিন্ন কায়দায়। আগের মতো অত সরাসরি কিম্বা ঝাঁঝালো ভাষায় না লিখে এই ছড়ায় প্রতিভাবান ছড়াকার যোগ করছেন ভিন্ন টিউন। এই ছড়াগুলো মূলত 'সমকালিন' ছড়া হিসাবে পরিচিত হচ্ছে । এসব ছড়ায় হইছই বরং কম,তবে তীব্র হুল ফোটানোর ক্ষমতাটা রয়েছে যথামাত্রায়। এক অর্থে রাজনৈতিক ছড়া সাময়িক, তবে কথা হল সমকালের হয়েই তো শিল্পকে চিরকালের হতে হয়।যার হাতে সেই শক্তি আছে তার ছড়া নিশ্চয়ই ভিন্ন কথা বলবে। এ ব্যাপারে এখনই কোনও সিদ্ধান্তে আসা থিক হবে না।এর জন্য ইতিহাসের দিকেই চেয়ে থাক্তা হবে। তবে পেছনে তাকালে এমন উদাহরণ আছে যা আমাদের ভবিষ্যতের প্রশ্নেও আশাবাদী করে তোলে ।

দু: অন্নদাশংকর রায় এর মতে, ছড়া লেখার উপকরণ আসে সমসাময়িক ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে। আপনিও কি এরকম মনে করেন? বা এর ফলে ছড়া তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে- এরকম মনে হয় কি?

জ: শতভাগ না হলেও অনেক ক্ষেত্রই কথাটা ঠিক। না,এতে ছড়া বৈচিত্র্য হারায় বলে আমি মনে করি না। করি না এই কারনে যে সমসাময়িক দুনিয়াটাইতো প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর সংগে ছড়াকার যদি নিজেকে আপডেট করতে পারে তাহলে ছড়া বৈচিত্র্য হারাবে না। যুগটাইতো বৈচিত্র্যপূর্ণ,সুতরাং যুগকে যিনি যথার্থ ভাবে ধারন করবেন তার ছড়াও বৈচিত্র্যপূর্ণই হবে।

 

দু: ছড়া তার প্রয়োজনের খাতিরেই হাল্কা হয়। কিন্তু ছড়াকাররা একে এতটাই হাল্কা করে ফেলেন যে ছড়া কোনও গুরুত্বই বহন করে না। আপনি কি একমত? হলে কেন ? না হলে কেন নয়?

জ: এটা এক ধরনের বিভ্রম জাগানিয়া ব্যাপার। ছোট বেলায় ট্রেনে যেতে হকারদের হাঁক দিতে শুনতাম-'অই মিষ্টি আমড়া...আমি আব্বার কাছে আমড়া কিনে চাইলে মেজো আপা ঝাড়ি দিয়ে বলতেন এই আমড়া খাবো না। হকার মিষ্টি বলে আমড়া গছাতে চাইছে,আর মেজো আপা সেকারনেই ওটা খেতে চাইতেন না। তার কথা আমড়া খাবো টকের টেস্ট পেতে ।তাই ওই আমড়া আমরা খেতাম না।তেম্নি সাধারণ ভাবে ছড়া হাল্কা হলে আমি দোষের কিছু দেখি না। কারণ আবহমাঙ্কাল থেকেই ছড়ার হাল্কা মেজাজের সংগে আমরা পরিচিত। এটা ছড়ায় নতুন কন অনুসংগ নয়। তবে চিরকাল বা সব সময় সব ক্ষেত্রেই তাকে হাল্কা থাকতে হবে এমনও নয়।আজকাল বরং ছড়ায় অনেক ভারি বিষয় আসছে। এটা বরং ইতিবাচক ঘটনা। চিরকাল এক জায়গায় আটকে থাকা তো প্রগতি বিরুদ্ধ।আমদের কবিতা এগুচ্ছে নানা বাঁক আর মোড় পেড়িয়ে। আমরা চাই ছাড়াও তেমনি এগুবে নতুন পথের সন্ধানে । যেমন ইতিমধ্যে ছড়া উত্তরাধুনিক পথযাত্রায়ও নেমেছে। গত বই মেলায় প্রথম উত্তরাধুনিক ছড়ার বই ''পাওয়ার প্লে'' বেরিয়েছ। দীর্ঘদিন ধরে লেখা আমার প্রায় ৬৪ টি উত্তরাধুনিক ছড়া রয়েছে বইটিতে, যার অনেকগুলোই বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছিল আগেই। আর শেষমেশ বলবো হাল্কা করতে গিয়ে ছড়ার নান্দনিক মূল্য যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সে বিষয়ে আমরা যারা ছড়া লিখি, ছড়াকে ভালোবাসি তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ধন্যবাদ।