গল্প

স্বপ্নে পাওয়া গল্প

ইলিয়াস কমল

গল্পটা কোথা হতে শুরু করা যায় এই নিয়ে একটা ধন্দ মনে কাজ করে। প্রথমত গল্পটা শুরু করা যেতে পারে অর্ণবের গান দিয়ে। অর্ণবের গান আসলে প্রথম উপাদান নয়। এটা হতে পারে সর্বশেষ পথ। তারপরও আমরা শেষ দিক দিয়েই না হয় শুরু করলাম। তাই আমাদের গল্প শুরু হয়ে গেলো।

গত কয়েকদিন ধরে মনের ভেতর বাহিরে ‘আমায় ধরে রাখো, আমায় বেঁধে রাখো’ গানটি বাজতে ছিলো। ফলশ্রুতিতে এই স্বপ্নের অবতারণা। স্বপ্নটিকে তাই আমরা অবচেতন মনের একটা অবস্থাই ধরে নিতে পারি। ধরে নিতে পারি অবচেতনে এই ভাবনাটাই কাজ করছে তীব্রভাবে। এই ভাবনা আরো গভীর থেকে গভীরতর হয় যখন চারপাশের বন্ধুরা বিয়ে করে একে একে সন্তান-সন্ততির জনক-জননী হতে শুরু করলো, তখন তারও হয়তো বিয়ে করে সংসার কর্ম করার বা জনক হওয়ার আকাঙ্খা তৈরি হতে শুরু করে। যদিও সে জানে বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করা তার পে রীতিমত অসম্ভব। সে অর্থে ‘বিয়ে’ করা যায় কেবল একটা যৌন জীবনের নিশ্চয়তার জন্য। তাই বিয়ের ভাবনা তার মাথায় জেঁকে বসতে পারে। বস্তুত এই ভাবনা তার বাস্তবে রূপ দেয়া এই মুহূর্তে হয়তো স্বপ্নেরও অবান্তরের মতো। অথবা অবান্তরই হয়তো। কিন্তু কল্পনাতো আসলে বাস্তবেরই এক মোহময় পৃথিবী। এই কথা তার অজানা নয়। সে খুব ভালো করেই জানে মানুষ যা স্বপ্নে দেখে তার অনেকটাই তার বাস্তব উপাদান থেকে নিয়ে কল্পনায় শুধু সে একটা রঙ মাখায় মাত্র। আর সেও সেই একই গল্পের অবতারণা করেছে, আর কিছু নয়। তার স্বপ্নটাও তার ভাবনারই একটা প্রতিফলিত রূপ হিসেবে দেখা দেয়। যখন স্বপ্নের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তখন তার মনে হতে থাকে আর কিছুণ দেখতে পারলেই তো হতো। ফলাফলটা হাতে-নাতে জেনে যাওয়া যেতো। কিন্তু ফলাফলটা অধরাই থেকে গেলো তার। এই স্বপ্নের কোনও ফলাফল সে শেষ পর্যন্ত পাবেনা বলেই ধরে নিচ্ছি। তারপরও আমরা ধারণা করতে পারি এই স্বপ্নের বিস্তারিত বৃত্তান্ত নিয়ে কোনও স্বপ্ন বিশারদের কাছে হাজির হলেও এই সমস্যার সমাধান আসতে পারে। কিন্তু স্বপ্ন বিশারদদের সে বিশ্বাস করে না। তার মনে হয় স্বপ্ন বিশারদরা মানুষের স্বপ্ন নিয়ে খেলা করে। যারা স্বপ্ন নিয়ে খেলা করে তারা আর যাই হোক মানুষ হিসেবে সৎ অবশ্যই নয়। এই রকম নানান ধন্দের ভেতর আর তার স্বপ্নের গন্তব্য নিয়ে সে বিচলিত হয়। কিন্তু আস্থা হারায় না, মনে করে এর অবশ্যই একটা সুদূর প্রসারী কারণ রয়েছে। যার দরুণ আজ হোক কাল হোক বিয়ে তো করতেই হবে। সেজন্য প্রস্তুতিও নেয়া প্রয়োজন। ফলে একটি চাকরির জন্য সে হন্যে হয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবতে থাকে, একটা চাকরি এবার যোগার না করলেই নয়। সামনেই তো সুদিন। একটা চাকরি মানে কিছুদিনের অভিজ্ঞতা, কয়দিন পর নতুন চাকরি। আর এভাবে বেশকিছু অভিজ্ঞতার ঝাপি ভারি করে বড় কোনও কিছু করতে না পারলে বিয়ে করা জুটবে না। অন্তত স্বপ্নের বিয়েতো নয়ই। অথচ স্বপ্নের মানুষইতো তার নেই! ভেবেই হাসতে হাসতে খুন। গাছে কাঁঠাল গোফে তেল দেয়ার মতো স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেলো তাহলে। স্বপ্নই তো বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন আছে বলেইতো সেও বেঁচে আছে।

দুইদিন এই স্বপ্ন নিয়ে কোনও ভাবনা সে ভাবেনি। যতটা ভেবেছে সে একটা চাকরি নিয়ে। আসলে তাকে চাকরি দিবে কে? কেন দিবে? এই ভাবনাগুলোই গত দুইদিন বেশি মাথায় এসেছে। এখন কেবল একটা চাকরির চিন্তাই মাথায় ঘুরঘুর করছে তার। তবে এই স্বপ্নকে সে অতিক্রম করতে পারছেনা তারপরও। সারাদিন শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নেংটা কালের বন্ধু রাশেদ ফোন করলো।

এই রাশেদ তার মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেয়। নেয় আর জ্বালা বাড়ায়। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করতে না করতেই রাশেদ বিয়ে করে ফেলেছিলো। অথচ তখন তার কোনও রোজগার নেই। রোজগারের পথও নেই। আসলে দীর্ঘদিনের প্রেম, দুইজন দুই মেরুতে বসবাস করলে যদি এই প্রেম আর কোনও গন্তব্য না পায় তবে তো বিপদ হয়ে যাবে। এম্নিতেই মেয়েটার প্রতি রাশেদ কিছুটা দূর্বলও ছিলো। এই দূর্বলতাই রাশেদের বিয়ের ব্যাপারে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো। যখন মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে যেদিন সবাই যার যার বাড়ি ফেরার জন্য বাক্স পেটরা গোছাচ্ছিলো তখন রাশেদ গো ধরে, তোরা বাড়ি যাবি যা কিন্তু আমি একলা বাড়ি যাবো না।

- একলা বাড়ি যাবি না মানে?

- নীলুরে সাথে নিয়া যামু।

- এইটার কোনও মানে হয়?

- মানে হয় না? প্রয়োজন বোধে বিয়ে করে বউ বানিয়ে তারপর নিয়ে যাবো। তবু একলা যাবো না।

কি আর করা যাবে তখন। বাকী আরও যারা বাড়ি যাওয়ার জন্য বাক্স পেটরা গুছিয়েছিলো তাদের ডেকে এনে, কাজী’র বাড়ি গিয়ে একজনকে উকিল বাবা করে আর দুইজনকে সাক্ষী করে এক কেজি কমদামী মিষ্টি খেয়ে বিয়ের কবুল বললো রাশেদ আর নীলু। ক্যাম্পাস জীবনের ইতি ঘটিয়ে এখন সংসার জীবনের শুরু।

সেই রাশেদের ফোন পেয়ে তার স্বপ্ন বৃত্তান্ত আবার মনে পড়ে গেলো। বন্ধুকে গড়গড় করে বলেদিলো গত দুইদিন আগে দেখা স্বপ্নের সকল কথা। বন্ধুতো শুনে মহাখুশি। বলে- দোস্ত, তোমার এহন তো বিয়া করা ছাড়া উপায় নাই। আমরাতো সবাই এডভান্স ছিলাম বইলা এই স্বাদ আরো আগেই নিয়া নিলাম। কেবল তুমিই এহন বাকী রইলা। এটুকু বলেই ক্ষান্ত দেয়নি তার বন্ধু। বরঙ আর এক হাত এগিয়ে এসে মোম জায়গায় খোঁচা দিয়ে বসে। আর কয়দিন চলবো এইভাবে? কিন্তু কোনও কিছু বলার নাই তার। কারন সে জানে, স্বপ্নের ঘটনা বাস্তবে ঘটেনা। তাকে কোনও মেয়ে বিয়ে করতে রাজিই হবেনা। কারন একাধারে বেশ কিছু। পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরের মতো আমরা দেখি কি কি কারণে তাকে কোনও মেয়ে বিয়ে করবে না। এক. সে এখনও পুরোদস্তর ক্যাম্পাস ছাড়েনি। আজ এই ছোট ভাই এর রূমে তো কাল ঐ ছোট ভাই এর রুমে। দুই. পরিবারেরও তেমন কোনও অর্থনৈতিক অবস্থা নেই যে চাকরি না করলেও চলবে। তিন. তদুপরি এখনো  কোনও প্রকার  সে এখনও কোনও রোজগার করে না। চার. এখনো কোনও কিছুর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে সেই কাজ সফলভাবে সমাপ্ত করার উদাহরণ নেই তার। পাঁচ. এখন পর্যন্ত যে কোনও দায়িত্বই নিয়ে সফল হতে পারেনি সে সংসারের দায়িত্ব যে নিতে পারবেনা তা চারপাশের সকল মানুষেরই জানা।  এমন পুরুষের সাথে সংসার করার অর্থে কোনও মেয়েই রাজি হবেনা। সুতরাং তার সাথে বিয়ের পিড়িতে একসাথে কাউকে বসাতে হলে বড় কিছু করে দেখাতে হবে। তাহলে স্বপ্নের কি হবে?

আপাতত আবার স্বপ্নের কথা বাদ। এবার আবার আমাদের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বড় কিছু করা। কি বড় কিছু, কোন দিকে বড় কিছু বা কিভাবে বড় কিছু এই বিষয়ে চাঁপা পড়ে যায় আমাদের গল্পের নায়কের স্বপ্নের কথা। সেই সাথে স্বপ্নে পাওয়া রাজকন্যার আবছা মুখশ্রীর কথাও। যেই মুখশ্রী তার সামনে আনন্দ আর এক ঝলক স্বস্তির দেখা দিতে পারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বড় কিছু...

কিন্তু বড় কিছুর দেখা আর সে পায় না। এইভাবে দিন যায় সপ্তাহ যায়; সে ভূলে যায় তার বড় কিছু করার কথা। যা দিয়ে হয়তো ফিরে পাবে সেই আধো আলোতে  অতি চেনা অথচ চেনা নয় সেই প্রিয়মুখ। একদিন সে সত্যি সত্যি ভুলে যায় তার স্বপ্নের কথা। ভুলে যায় সে একটি মুখ খোঁজছিলো যা কিনা তার প্রশান্তির ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হবে। ভুলে যায় তার বড় কিছু করার কথা। ভুলে যায় একটি চাকরির খুব দরকার সে কথা। ভুলে যায় একটি নতুন জীবনের স্বপ্নের কথা।

কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে? অথচ তার তো থামা আর চলার কোনও কিছুরই লক্ষণ ছিলো না। সে শুধু চাইতো চলুক না...

কিন্তু একদিন আর চলে না। তার মা আর ছোট বোন এসে তাকে ক্যাম্পাস থেকে রীতিমত অপহরণ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় তার সেই পুরনো প্রেম অপ্রেমের ভূবনে। যেখানে সে কাটিয়েছে জীবনের একটি রঙিন অংশ। তার ঘরে নিয়ে যখন তাকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন হঠাৎ আবিষ্কার করে তার সেই স্কুলের গিটার এখনো দেয়ালের হুকে ঝুলে আছে। এই প্রেমকে যে ব্রতি করতে চেয়েছিলো সে, আজ তা হারিয়েছে জীবনের অতল গহ্বরে। সারা বিকেল ঘরে বসে কাটিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হয়ে ঘুরে আসে তার স্কুল আর কলেজের স্মৃতিতাড়িত শৈশব।

ইদানিং কিসের যেনো শূণ্যতা অনুভব করছিলো সে। বুঝতে পারছিলো না। আর এই মায়া আর মোহের ঘোর তার পরিবার অনুভব করে। সন্ধ্যার পর যখন বাড়ি ফিরে তখন মা-বাবাকে তাকে দেখে চুপ করে যেতে দেখে। পরে খবর পায় তার জন্য বিয়ের পাত্রি দেখা হচ্ছে। বিয়ে বোধহয় এবার হয়েই যাবে। দেখতে দেখতে তার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেলো। কিন্তু বেকে বসলো সে। বললো- এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত নই। আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার বিয়ে তার অমতেই চূড়ান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তার প্রতিবাদ ধোপে টিকলো না। এক প্রকার নজরবন্দী করে রাখা হলো তাকে। এইভাবেই বিয়ের দিনটাও চলে এলো। কিন্তু এখনো মন সায় দিচ্ছে না তার। কিন্তু কোনও উপায়ও বের না হওয়ায় সে বিয়ের পিড়িতে বসলো। বিয়ের দিন রাতে বাসর ঘরে প্রবেশ করতে গিয়েও সে করলো না। হঠাৎ মন বেঁকে বসলো। ভাবলো একটা মেয়ের সর্বনাশ তো এমনিতেই করলাম। আরো কেন? ভেতরে যাওয়ার আকাঙ্খাটা তাই মরে গেলো। বাইরে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণের ভেতরই আবার ঘরে প্রবেশ করলো। টেবিলে চিঠিটা একটা পানির গ্লাস দিয়ে চাপা দিয়ে বের হয়ে গেলো। তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী হা করে শুধু দেখলো, কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।

কিছুক্ষণ পরই খবর বেরোল বাপ্পীকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাপ্পী কোথায় কেউ বলতে পারছে না। ছোটবোন আবিষ্কার করলো টেবিলে রাখা চিঠি টা। যাতে লিখা ছিলো-

আমি বলেছিলাম আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করার মতো মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। তোমরা আমার কথা শুনলে না। বলেছিলাম কিছুদিন অপেক্ষা করতে। তাও পারলে না। তাই আমি চলে যাচ্ছি। হয়তো আবার কোনওদিন ফিরবো। তবে সংসারের দায়-দায়িত্ব নিতে বললে কখনোই নয়। আমি সংসার বুঝি না। তাই আমাকে শুধু শুধু সাংসারিক বানানোর চেষ্টা করলে তোমরা ভুল করবে। যদি তোমাদের মনে হয় আমার এমনিতেই সংসারে ফিরে আসাটা প্রয়োজন। তবে অপেক্ষা কর, আমি অবশ্যই ফিরবো। ভালো থেকো।

    ইতি

    বাপ্পী

আমরা এই পর্যন্ত তার স্বপ্ন আর বাস্তবের গল্পটা জানতাম। পরে এক সময় শুনেছিলাম বাপ্পী সংসারে ফিরে গিয়েছে। একটা ভালো চাকরিও জুটিয়েছে। সংসারই করছে ঠিক সাংসারিক মানুষের মতো।

আর সেই স্বপ্নটার কথা এখন হয়তো ভুলেই গিয়েছে। কারণ স্বপ্নটাই তো শেষঅব্দি বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো তার জীবনে।

থানায় কবুল

জিয়া হাশান

এক.

থানা সদর আর বিশারকান্দি গ্রামের মাঝখানে শোয়ানো পনের কিলোমিটার নাড়ীপথ, অসংখ্য তার প্যাঁচঘোঁচ। তাও স্থল নয় জল । যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। তা ইদানিং পুচ্ছে যন্ত্র জুড়ে নতুন নাম ধারণ করেছে--- ট্রলার। এতে করে জলে তার তাণ্ডব বাড়লেও থানা সদর থেকে যাত্রা করে বিশালকান্দিতে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটাকে পুরো দুটো ঘর হাঁটাতে হয়। সে গ্রামের পায়ের কাছে আজিতুদ্দির নিঃসঙ্গ বাড়ি। তার চারপাশ খালি, কেবল খাল-কোলার রাজত্ব। বাড়িতে দুটো মাথা তোলা সেরেজ  আর ডানা মেলা কয়েক ঝোপ কলাগাছে ঘেরা ছোট্ট দু’খানি ছনে ছাওয়া ঘর। তার মুখের উপর এক টুকরো উঠোন আছে ঠিকই, তবে সকাল ও বিকাল দুবেলাই তা ছায়ার দখলে থাকে। এরকম প্রান্তবর্তী ও পাতে তোলার অযোগ্য বাড়িতে আজ থানার আকমল দারোগা  আসবেন। যার ভয়ে বাঘ ও মহিষ একঘাটে জল খায় বলার যুগ চলে গেছে, বরং বলা ভালো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এক টেবিলে বসে।

দারোগা সাহেবের আগমন,শুধু আগমনই নয়,খাওয়া-দাওয়া তারপর আরাম করা সব মিলিয়ে আজিতুদ্দির কাছে তার দুয়ারে রাজা-বাদশার পা পড়ার মতো। তাই তার আয়োজনে বাড়ির সবার ঘাম ও মাথা উভয়ই ছুটছে।

: বাজান, গোবরগাদাডারে কী হরমু? ওহাইনদা তো গনধো বাইরাইতাছে। পুরো উঠোন সাফ করে, তার সব নোংরা-আবর্জনা, সামান্য খড়কুটোটুকু উৎখাত করে পেছনের ডোবার মুখে তুলে দিয়ে ছেলে রহমত বাবাকে জিজ্ঞেস করে। আজিতুদ্দি কলাগাছগুলোর পরিচর্যায় ব্যস্ত। শুকনো পাতারা গা আঁকড়ে ঝুলে থাকলে গাছগুলোকে কেমন বুড়ো বুড়ো লাগে। নিচের দিকে টেনে ছিলে ফেলে দিলে গাছ নধর নধর হয়ে ওঠে, একেবারে সদ্য বিয়ানো বাছুরের মতো। 

চোখের এক ঘুরানিতে আজিতুদ্দির ঘর দুয়ার মায় কলাবাগানের আঁতিপাতিও পড়ে ফেলা যায়। তখন গাছগুলো নিশ্চয়ই দারোগা সাহেবের চোখ ফাঁকি দিতে পারবেনা। তাই কলাগাছের চেহারায় নতুন রূপ দিয়ে আজিতুদ্দি ছেলের দিকে ফেরেন- কী আর হরবি, খালদার থেইকা মাডি উডাইয়া মুখ বুজাইয়্যা  দে।

গাভীটা যখন ছিল তখন তার ‘আতালের’ বগলেই গড়ে তোলা হয় গোবরগাদা। পূবমুখী মূল ঘরের উত্তর পাশে। ঝড়ে দুখানা ঘরই মুখ থুবড়ালে হাটে মেয়ে ও মা গাভীর বিনিময়ে আজিতুদ্দি আবার তাকে খাড়া করেছে। কিন্তু গোবরগাদাটা রয়েই গেছে। কারণ তার সঞ্চয়ে রাখা গরুর গু বছর শেষে সুদে-আসলে খাঁটি আরকে রূপ নেবে। তার একমুঠো গোঁড়ায় গুজে দিলেই নেতানো ফসলও তরতাজা সবুজ রূপে চোখ মেলে তাকাবে। কিন্তু হাওয়া একটু এলোমেলো হাত-পা ছড়ালেই খোলা গোবরগাদাটা পুরো বাড়ি দখল করে নেয়, যেন তার গন্ধে গোবরময় হয়ে ওঠে বাড়িটা। দারোগা সাব আসার পর হাওয়ার যদি সেরকম মাতলামি চাপে! তাই খালপাড় থেকে নরম মাটি তুলে রহমত গোবরগাদার মুখ বন্ধ করে দেয়।

মাটি তোলা শেষ করে রহমত খালপাড়ের ঘাটে হাত দেয়। খাঁচ কাটা খেজুরগাছ ফেলে তৈরি ঘাটটাকে জোয়ারের পানি অর্ধেকটা গ্রাস করে ফেলে। আবার ভাটার সময় উগড়ে দেয়। ফলে জোয়ারের পলি ঘাটের খাঁচে খাঁচে মুখ বুজে পড়ে থাকে। খালি পায়ে কেউ তাতে পা দিলে সহ্য করে ঠিকই কিন্তু জুতো পায়ে উঠলে পিছলে দেয়। হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হয় তখন। দারোগা সাব তো এ ঘাট থেকেই জুতো পায়ে উঠবেন। তাই রহমত হাত চালিয়ে ঘাটের সব পলি জলের হাতে তুলে দেয়। পানি খেয়ে খেয়ে আবলুস কাঠের মতো কালো হয়ে ওঠা খেজুর গাছটা স্নান পেয়ে পূত-পবিত্র হয়ে ওঠে।

আগেরদিন হাটফেরত আজিতুদ্দির ডালায় ছিল দারুচিনি এলাচ পোলাউয়ের চালের মতো এবাড়িতে প্রথম পা দেওয়া বেশকিছু সামগ্রী। নছিমনবানু  একা একাই তা নিয়ে ‘ওশ্যাঘরে’ হুটোপুটিতে ব্যস্ত। মেয়ে ছালমাকে তাতে হাত ছোঁয়াতে দেননি। সেসব মূল্যবান সামগ্রী নষ্ট করে ফেলবে বলে নয়, বরং মেয়ের সঙ্গেইতো দারোগা সাহেবের কাম। তাকে আজ সাফসুতরা রাখা দরকার। রান্নাঘরের আগুন-কালির জঙ্গলে তার না ঢোকাই ভালো।

ছনেছাওয়া ঘর দুটির একটি অপরটির কোমর সমান। খর্বাকৃতিটার খোপকাটা দরজা দিয়ে একেবারে রুকুতে না গিয়ে ঢোকার উপায় নেই। এ ‘ওশ্যাঘরেই’ রান্না ও বৃষ্টিবাদলের দিন খাওয়া-দাওয়া দুটোই চলে। হুটোপুটিতে সাময়িক ইস্তফা দিয়ে নছিমনবানু বাইরে আসেন। তার মুখ ঘাড়ে ঘাম আর কালির প্রসাধন। ছাবির ত্যানার মতো শাড়ির আঁচলে ঘাম-কালি মুছতে মুছতে উঠানের কোণায় বসা সোয়ামীর কাছে যান--- ‘মুরগীডারে জবাই হরা লাগে’।

লালঝুটির চ্যাপ্টা শিরোপাধারী মোরগটা এ বাড়িতে তার স্বজাতির নেতা। তার কথায় যেন বাকীরা উঠবস করে। নছিমনবানু তাকে এক্সট্রা খাতিরযত্নে বড় করে তুলেছেন। ইচ্ছে ছিল হাটে পাঠিয়ে রহমতের বাপের জন্য একটা নতুন তহবন আনাবেন। কিন্তু দারোগা সাবের জন্য তার ইচ্ছা এবং প্রিয় মোরগ দুটোকেই এক ছুরিতে গলা কেটে জবাই করতে হচ্ছে।

: রহমইত্যারো বোলাও, অয় জবাই হইরা দেবে আনে। মুই একটু বড়ো ভাইডুগো বারি যামু। হ্যাগো এ্যাকটু কইয়্যা আয়োন লাগে।

নছিমনবানু ঝামটা দিয়ে ওঠেন ‘হ্যাগো ক্যান আবার কইতে অইবো? হ্যাগো আত-পায় এ্যাতো ত্যাল মাখলাম হ্যার পরও হ্যারা অ্যাকটু মুক তুইল্যা চাইলো না। এহন হ্যাগো লগে আবার কীসের পীরিত, অ্যাঁ?’

দুই.

বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও আজিতুদ্দি তার একপোয়া হাইল্যা আর তিনপোয়া কামলার ছেঁড়াখোঁড়া নামাবলী গা থেকে নামাতে পারেনি। মৌসুমের একপোয়া কাটে বাড়ির হাতায় নিজের তেটুকুতে কাস্তে-কোদাল ও চারা-বীজ নিয়ে হুটেপুটিতে। বাকী তিনপোয়া যায় মোল্লা অথবা তালুকদার বাড়িতে হুকুমদারিতে। আধপেটা খাওয়া ও বয়সের ভার জোট বেঁধে তার শরীরকে জীর্ণতার হাতে ছেড়ে দিয়েছে যেন, তাই কামলা হিসেবে তার চাহিদায় এখন কেবল ভাটার টান,সহজে কেউ ডাকে না। আবার গ্রামজুড়ে এতো হৈ-হাঙ্গামা কিন্তু তার কোনটার সামনে তো দূরের কথা ডান-বাম কিংবা পিছনে কোথাও কেউ তাকে খুঁজে পায়না। সুতরাং গ্রামের তলানিতে থিতু আজিতুদ্দির সঙ্গে থানার দণ্ডমুণ্ডের কর্তার রিলেশন, বাড়িতে আসা,মুরগী-পোলাউ খাওয়ার মতো ইয়ারদোস্তির পর্যায়ের কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। সেজন্য অবশ্য বেশি গভীরে যেতে হবে না । সামান্য খোঁড়াখুঁড়িতেই সব খোলাসা হয়ে যাবে।

সেদিন সকালে সূর্য তখনো পূব আকাশে উঁকি মারেনি। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে নছিমনবানু ঘর থেকে বেরিয়ে ঘাটমুখী পথে কয়েক পা এগোতেই একটা অচেনা কটু গন্ধ তার নাকে এসে হাজিরা দেয়। তিনি বোধহয় একটু থমকান, এ ফাঁকে নাক দু’একবার নড়েচড়ে সকালের ব্যায়াম সেরে নেয়। নছিমনবানু যতোই আগান গন্ধটা যেন ততো জোরেশোরে তাকে ঝাঁপটে ধরে। তিনি চারদিকে তাকান। সূর্য তার চোখ না মেললেও তার আভাসে নছিমনবানু  চিরচেনা বাড়ির সব কিছুই ঠাহর করতে পারেন। কিন্তু তার চোখ সন্দেহজনক কিছু কব্জা করতে পারে না। তবে তিনি আরো দু’পা এগিয়ে ঘাটে পা দিয়েই মাগো বলে চিলচিৎকারে বাড়ি মাথায় তোলেন। ঘাটে তার সকালের প্রাত্যহিক কাজ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

পূবে সূর্যের হাতদেড়েক আকাশচারীর আগেই ‘আজিতুদ্দির ঘাটে লাশ’ নামের চঞ্চলা খবরটা সারাগ্রাম হেঁটে আসে। সবাই তে-খামার কোলা-কান্দির বদলে তার বাড়ির পথ ধরে। বাড়ির আনাচ-কানাচ তো বটেই স্রোতজীবী খালের ওপারের ক্ষেতেও মানুষের ঢল নামে। যা দেখলে যে কোন ঢাকাইয়্যা নেতানেত্রীর সমাবেশ করজোরে হার মানতো। কিন্তু কেউ-ই চিনতে পারে না জোয়ারে ভেসে এসে ভাটায় নোঙ্গর করা দু‘দিনের মরা মুখ।   

গন্ধ যেমন হেঁটে সাতগ্রাম দূরের কুকুরকে জানান দেয়, তেমনি লাশের খবরও উড়ে গিয়ে থানায় হাজির হয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গোটা তিনেক কনস্টবলের ট্রলার আজিতুদ্দির ঘাটে স্টপেজ দেয়। তারা যথারীতি লাশ তোলে, সঙ্গে আজিতুদ্দিকে এবং শেষে যেন হাতেনাতে খুনি ধরার তৃপ্তিতে ঢেঁকুরও।  নছিমনবানু  কুহুল দিয়ে উঠলে তার মাথায় আজিতুদ্দি হাত বুলায়--- ‘দারোগা সাবরে বুজাইয়্যা কইয়্যা বিহালেই ফিইরা আমু, কান্দিস না।’

থানায় আজিতুদ্দির সঙ্গে আকমল দারোগার মোলাকাত হয়, লাশের অপরিচয়ের পর্দাও খসে পড়ে। এতো পূবধারের রশিদ মুন্সি। সঙ্গে সঙ্গে তার দুই সৎ ভাইয়ের খোঁজে ট্রলার ছোটে। জাহির হয় ----- রশিদ মুন্সি বিয়ের পর আরো দূর গ্রামে শ্বশুরবাড়ির কোমল হাতের বেষ্টনী ভেদ করতে পারেনি। সেখানেই খুঁটি গেঁড়ে উনুন তুলেছে। কালেভদ্রে বাড়িতে পা পড়ে বিধায় তার চেহারা অনায়াসে গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করতে সম হয়,কেউ মনে করতে পারেনি।

কিন্তু দারোগার চেহারা একেবারে ওপিঠে। দ্বিতীয়বার না দেখলেও জনমভর মনে গেঁথে থাকে। রক্ত খেয়ে পেট ফোলানো জোঁকের মতো মোটা গোঁফঅলা কালো চেহারাজুড়ে বসন্তের দাগের নিবিড় রোপা। আজিতুদ্দির সামনে সদরে চালান ও জেলের ঘানি টানার খড়গ ঝুলিয়ে বলেন--- খুতি খোল,পাঁচ হাজার ট্যাহা বাইর কর, নইলে চৈদ্দ বছরের লাল দালান। তোর বাড়ি লাশ পাওন গ্যাচে, এ্যাক বছরও মাফ নাই।

: হুজুর! অতো ট্যাহা মুই কই পামু, মোরে ব্যাচলেও অতো ট্যাহা অইবো না, হুজুর।

: তোরে ব্যাচন লাগবো না। তোর বাড়ি-খ্যাত আছে না? হেইয়্যা ছাইড়া দিলেই অইবো।

: হুজুর,পোলাপান লইয়্যা থাকমু কই, খামু কী, হুজুর! মোরে মাফ কইরা দ্যান। মোর ঘাডে লাশ ভাইস্যা আইছে, মুই লাশের কিছু জানি না।

: বাড়ি-খ্যাত ছাড়বি না, তা অইলে তোর মাইয়্যার .....................................

থানা থেকে বের হওয়ার পথে দারোগার এক উর্দিমোড়া কঞ্চি আজিতুদ্দির কানের কাছে মুখ নিয়ে ঝালাই করে দেয়---- হোনো! দারোগা সাব যে রহম বেবস্তা হরতে কইছে, হে রহম বেবস্তা হরবি। এ্যাকটু এদিক ওদিক হয় না য্যানো। তা অইলে হুদু তোরে না তোর পোলামাইয়্যা হগুলডিরে ধইরা সদরে চালান দিবো, বুঝলি।

তিন.

আজিতুদ্দি উঠানের কোণা ছেড়ে ঘরের আইতনার দাওয়ায় এসে পাছা বিছায়। কোমর থেকে গামছা খুলে কয়েকবার মুখের উপর নাড়ায়। ঘর্মাক্ত উলঙ্গ শরীরকে হাওয়ার সান্ত্বনায় ভোলানোর চেষ্টা। রহমত উঠানের চার কোণায় বাঁশ পুঁতে তার মাথায় শামিয়ানার মতো আধছেঁড়া একটা কাঁথা টাঙ্গায়। উঠানটা যাত্রা মঞ্চের চেহারা পায়। দারোগা সাব এসে তার ছায়ায় বসবেন। আয়োজনে ফিনিশিং টার্চ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় রহমত ‘বাজান, দারোগা সাবের বইতে দেওয়ার কিচ্ছু নাই। মুই কাজীগো বারি থাইকা এ্যাকটা চেয়ার চাইয়্যা লইয়্যা আই।’

ছেলে চলে গেলে আজিতুদ্দি ছালমার মাকে ডেকে আগুন চায়। বিড়ি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘বিছানাপাতির কি হরছো?’ ঘরে খাট বা চৌকির বালাই নেই। মেঝে হোগলা পাতার পাটিতে শয্যা। তাতেই তাদের চার চারটা ছেলেমেয়ে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছে। তার দুটোকে ইতিমধ্যেই শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আরো গোটা তিনেক গর্ভেই আয়ু শেষ করে ফেলেছিল। কিন্তু দারোগা সাব কী শক্ত মাটি সহ্য করতে পারবেন? তার জন্য তাই নরম বিছানার আয়োজন করা করেছেন নাছিমনবানু ‘মোল্লা বারি থাইকা তোষক আনছি, হ্যার উফর আরো দুইডা কাথা লাইছ্যা দিমু। তা অইলে নরম অইবো।’

নছিমনবানু আইতনা থেকে ঘরে পা দেন। ঝড়ের পর ত্রাণ হিসেবে পাওয়া হরেক রঙের ছাপা শাড়িখান একদিনও পড়েননি। তাই তার আনকোড়া নতুন রূপে একটুকু আঁচড় নেই। ভেবে ছিলেন সামনের ঈদে তার ভাঁজ খুলবেন। কিন্তু ছালমা তার শত সেলাইয়ের চোখঅলা শাড়িতে দারোগা সাবের কাছে কীভাবে যাবে? তাই তোরঙ্গে যত্নে রাখা শাড়িখান বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বলেন--- যা নাইয়্যা পইরা আয়। গা রগড়াইয়্যা নাবি। তোর বাজান কাইল হাড  থেইকা বাসনাঅলা সাবান আনছে,শিকায় তোলা আছে।  হেয়া দিয়া গা রগড়াইয়্যা নাইয়্যা আয়, যা।

: মা, দারোগা সাব মোগো বারি ক্যান আইবো?

: আইবো তোরে লগে হুইতে। তোর বাজান থানায় কবুল কইরা আইছে। কবুল না হরলে কী হ্যারে ছারতো? চালান কইরা দিতো  চৈদ্দ বছরের জেল খাডাইতো। হোন, দেহিস দারোগা সাবের য্যানো কোন কষ্টো না অয়, বুঝলি।

মাটির পুতুলের হাড়গোড়

মেহেদী উল্লাহ

কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি হলদি। রসুই ঘরের পুরনো কাঠের আলমারির পেছনপাশ, শোবার ঘরের তিন চারেক অন্ধকার কোণা, চৌকির নিচে কাগজের ঠোঙ্গার এধার ওধার- সন্দেহের সব জায়গা দেখা শেষ। বারান্দার পায়াভাঙা কাঠের জলচৌকির উপরে বার কয়েক চোখ রাখলো সে। সেখানে নেই, তবু নিজের চোখের সচেতনতা পরখ করে দেখলো হলদি। জায়গাটা নিশানা শূন্য দেখেও ফাঁকির সন্দেহকে নজরবন্দি করলো । নিচে দেয়াল ঘেঁষা যে পাশটায় আলো আসতে মানা সেদিকটাও দেখলো কয়েকবার। তবুও পিছু ছাড়ছে না সন্দেহ। এবার নিজেকেই সন্দেহ করলো সে। নিজেই সরিয়ে রাখেনি তো আবার! না, এমনটিও ঘটেনি। তবে কোথায় গেল পুতুল ? মাটির তৈরি পুতুলটাকে তিনদিন ধরে শুকিয়ে কাঠ করেছে। আজ সকালে কাপড় পরানোর কথা। মাথায় ঘোমটাও টানতো হয়তো। আশপাশে কাউকে পেলে হয়তো হলদি এ অন্বেষণের নিরর্থক যন্ত্রণার বাড় আরো বাড়িয়ে বলতো- ‘পুতুলডা কাইল বিকালে জলচৌকির উপর রাখছিলাম। সকালে দেহি হাওয়া। আগো, এডা কী কষ্টিপাতর যে চোরের চোখ সরে নাই।’ পুতুলটা বানাতে হলদির যত যত্ন ছিল, আরো বেশি যত্ন দিতে হলো পুতুলটা খুঁজতে। বৃহস্পতিবার বিকেলে কালাম মুন্সি দিয়ে গেল খবরটা।  তেলি আসবে। মুন্সি নাকি ছমিরহাটে গিয়েছিল কী কাজে। ফেরার পথে খরবটা হলদিকে দিতে বলেছে তেলির শশুড় দিগের কেউ একজন। মুন্সিই জানিয়ে গেল সংবাদটা। হলদি রবিবার দুপুরে রওনা করবে। শ্বশুড়বাড়িতে তেমন নতুন কারবার নাই। সঙ্গে আরো একজন আসতে পারে। হলদি জিজ্ঞেস করেছিল- জামাই সাথে আইবো- এমন কিছু বলছে?

- না, জামাইবাবু নাকি জমিজমার নতুন মাপ জোঁক নিয়ে ব্যস্ত আছে। তা হয়তো পরে আইসা নিয়া যাইতে পারে।

- হাছাই আইবো তেলি। এতদিন পর তাইলে সইমারে মনে পড়লো। কতমাস দেহিনা তেলিরে। কোন বন্ধনে বান্ধা পড়ছে কে জানে!

- না আইলে কী হুদাই খবর পাঠাইছে।

-হ, এর লাইগাইতো কয়দিন ধইরা খালি হলদা পাখি দেহি। ডালিম গাছে, গয়াম গাছে পাতায় পাতায় ফাঁকে দিয়া মুখ দেহায়। দেইখাই কইছি আমাগো তেলি আইবো।

তেলির আসার সংবাদটা হলদির কাছে শুধু কুটুমানন্দ নয়, অনুভূতি জাগায়, শিহরণ জাগায় তার হৃদয়ের অন্য জায়গায়। যেখানটায় পুষে রেখেছে সেই মায়াবী মোহময় সময়, যখন তেলি আর হলদির পুতুলের বিয়ে পর্ব, সংসার ভাঙা পর্ব আর মালাসা খেলার পর্ব চলতো। তেলিকে দিবে বলে বানিয়েছিল মাটির পুতুলটা। কিন্তু সেটাই গায়েব। সকাল থেকেই সারাবাড়ি খুঁজে সারা। কোথাও মিলল না সন্ধান। বাহিরবাড়ি থেকে দৌড়ে ঢোকে লতি। হলদির চার বছরের মেয়ে। আওয়াজ পাওয়া যায়- মা মা আমপাতা দিয়ে একটা সরকি বানাইয়া দে, ঘুরামু’। হলদি যেন লতিকে মনে মনে খুঁজছিল। নিশ্চয়ই এ লতির কাজ। নচ্ছর মেয়েটার হাতে পড়েছে ঐ নিষ্প্রাণ শখের পুতুলটা। মনের চাওয়া আর সময়ের সমস্বরে তেলির উপর চটলো হলদি-‘ হারাদিন খালি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ। ওই হারামজাদি তোরে না কইছি কাউনে কাউয়া পরা দিতে। তুই আইসছ সরকির খবর লইয়া।’ যে উৎসাহে লতি শোবার ঘরের বারান্দায় এসে মায়ের সামনে পড়েছিল, এখন তাতে অনুন্ধারের একটা শংকায় শিশুমনে বিচিত্র ভীতি খেলে গেল। লতি দমে গিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে এবার মা মা করার পরিবর্তে ভ্যা ভ্যা জুড়ে দিল। হলদি তেলির ক্ষেত্রে এমনই। প্রতিনিয়ত গা-ছাড়া। একটু আগে যেমন মা মা কে ভ্যা ভ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছিল, এখন তাতে এতণের পুষে রাখা জেদের বাতিকটা উগড়ে দিল- পুতুলডা কই রাখছস ক। লতি চুপ করে থাকে। মাথা নিচের দিকে করে ভয়ে চোখ ঘোরায় চারপাশে। হলদির সামনে একটা শিশু দাঁড়িয়ে আছে- তার সে খেয়ালে যেন ভাববার অতটুকু সময় নেই। আবার ধমকায়- যেভাবে সে রোদে দেওয়া কাউনের বিছানা থেকে কাক তাড়াতে বলেছিল লতিকে সেভাবে- তাড়াতাড়ি বাইর কর হারামজাদি, এইডা তেলির লাইগা বানাইছি। তোরে আরেকটা বানাইয়া দিমু।’

এরকম অভিনব কায়দায় জেরার পর লতি শুধু বলে- মা মা আমি তো দেহি নাই। কোন পুতুল ঐ যে ওইদিন বানাইছো তেলির লাইগা।

তবুও পুতুল পাওয়া গেলনা। হয়তো লতিই দোষী। তবে পড়শিরা আরো ভালো বলতে পারবে, লতির উপর হলদির নজর নাই। লতি জন্মের পর থেকেই মনে হয় নিজে নিজে চড়ে বেড়িয়ে মানুষ। পাশের বাড়ির চাম্পুলির মা আরো ভালো বলতে পারবে। বুড়িই দেখেছে শুধু জন্মাবধি কয়মাস খেয়েছে লতি হলদি মায়ের বুকের দুধ। আট কী নয় মাস থেকেই লতি ভাতের মাড় খেয়েছে মায়ের দুধের বদলে। সন্তানের প্রতি মায়ের এমন অনুদারতার উৎস কোথায়? পড়শিদের এনিয়ে কানাঘুষা বিরামহীন। চাম্পুলির মা বলেছে- কিজানি, এমন মাও হয়। আপন মায়ে এমন করে কোথায়? এমন মুখ খানা দেখলে পাষানীর বুকেও দুধের ঝরণা বইবো’। চাম্পুলির মায়ের মত গ্রামের মা চাচীরাও দুএকটা কথা সব সময়ই বলে যায়। হলদির তাতে মাত নেই।

আর এসব ঘটে যায়, পুরনো হয়ে যায়- সবই জানে জহুর আলী। নিজেও ঠিকভাবে বুঝে উঠেনি কোনো দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাটে যাওয়া, রাতে বুক পকেটে মসজিদ মার্কা লাল নোট নিয়ে ঘরে ফেরা ছাড়া জীবনে কিছুই জড়ো করেনি জহুর। শান্তির হাটের মাঝবাজারের আর্সেনিকমুক্ত টিউবয়েলটার ডানপাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান কারো চোখ এড়ায়না। কাপের লিকারে ত্রিশবছর রোজ চিনি দুধে যে চামচ পেটাচ্ছে সে জহুর। কে যেন একবার জিজ্ঞেস করেছিল- প্রতিদিন কয়কাপ চা বানাও জহুর মিয়া?

- তার কী আর হিসাব আছে?

- হিসাব থাকলে কইতে পারতাম ত্রিশ বছরে কতে জনে কত কাপে ঠোঁট লাগিয়ে ফুঁ ফুঁ শব্দ তুলেছে।

- ভাইজে কী কন না!

 গত ত্রিশবছরে জহুর আলীর চায়ের দোকান বন্ধ ছিল মাত্র দুই কি তিন দিন। ভাবতেই জহুর নিজেই টাসকি খায়। জীবনের সঙ্গে এইভাবে পারা মুশকিল। কত রকমের জীবনইতো হয়। তার অর্ধেক জীবন চলে গেল চায়ের কাপের সঙ্গে।  এইতো মাত্র পাঁচ বছর আগের ঘটনা। জহুর  জীবনকে কত রকম চিনেছে। রাতে বাড়ি ফেরার আগে চায়ের দোকানে যেমন বড়সড় তালা লাগিয়ে যায় তেমনি পাঁচ বছর আগেই জীবনটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এখনো খোলা হয়নি। অবরুদ্ধ আনন্দ বেদনা অনুভূতি দুখ সুখ নামের চিনি দুধ আর চাপাতা এতদিনে নিশ্চয়ই আগের অবস্থায় নেই। পঁচেছে, গলছে নাকি কেমন আছে জানা যায়না। জহুর এখন চাবিহারা তালাবদ্ধ একটা চায়ের দোকান। তালাটা ভাঙতে পারেনি কেউ, চেষ্টাও কোনদিন করেনি। দিনটা এমনই ছিল সেদিন। শান্তিরহাটে চা খাওয়া মানে এখন যেমন জহুরের দোকান তখনও ছিল তাই। পাঁচবছর আগের এক অপরিচিত সন্ধ্যায় একটা চায়ের আড্ডা হয়েছিল এখানে। সামনের দুপাশের বেঞ্চে দশজন বসার পরও দাড়িয়ে ছিল আরো আট দশ জন। গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ক একটা সভা শেষে ওরা এসেছিল চা খেতে। জহুর ট্রে শূন্য দশটা কাপ সাজিয়ে লিকার ঢেলে যখনই নিত্যকার চামচের প্রি গতি তোলে তখনই কে যেন একজন আরো বেশি গতিতে এসে জানায়- জহুর ভাই, ভাবিতো নাই। দুপুরেই তো মানুষটারে দেখছি শুকনো পাতা কুড়াইয়া বস্তায় ভরতাছে। জহুর খবরটা বিশ্বাস করবে কি করবে না সেসময়ও পায়না। থ - তাকিয়ে থাকে। তারপর দেখলো  আরো কয়েকজন আসছে।  একই গতি এবং একই ভঙ্গিমায়। কিছুক্ষণ পর হাত থেকে কেটলিটা ছুটে যায়। চায়ের কাপের কয়েকটা ভেঙে যাওয়ার সময় কোথায় যেন একটা টনপট টনপট শব্দ হলো। জ্ঞান ফেরার পর সে দেখছিল মা হারানোর বেদনায় সাত বছরের তেলির কি হয়েছিল?  জহুর সব জেনে বুঝেও তেলিকে জিজ্ঞেস করেছিল- তোর মা কই? আর অমনি যেন একটা উপুড় করা চিনিভর্তি প্যাকেটের গিট খুলে দিল জহুর।  ঝরঝর করে চিনি পড়ার মতোই তেলির আটকে থাকা কান্নার রোলের গিট খুলে বাবাকে জড়িয়ে তেলি কাদতে থাকলো। জোহরা মারা যাওয়ার পরদিন চায়ের দোকানে যায়নি জহুর। সেবারই প্রথম। তারপর জহুর বন্ধ রেখেছিল স্ত্রীর চেহলামের দিন। এরপর আরেকটা দিন। অনেকেই হয়তো দিনটা মনে রেখেছে। তবে সেদিন বন্ধ থাকার কথা ছিলনা। হুট করেই বিয়েটা বেঁধে গেল।দূর গ্রাম থেকে নতুন বউকে নিয়ে দিনে দিনে আর আসা হলো না তার। যাদের বুদ্ধিতে জহুর দ্বিতীয় বিয়েটা করলো তারা ভেবেছিল- নিশ্চিত তালাটা খুলতে পারবে হলদি। জহুরা চাবি নিয়ে পালিয়েছে তো কি হয়েছে ? হলদি চাইলেই তালাটা ভাঙতে পারবে। অবশ্য তা আর হলো না। যে পালিয়েছে সে পালিয়েছে। চাবিটা আর উদ্ধার করতে পারেনি হলদি। লোকে বলেছে, সবে তো মাত্র নয়ে পা দিল, পারবে তবে সময় তো রইলো বাকি। হলদি আসাতে জহুরের কী উপকার হয়েছে বলতে পারবোনা।তবে  তেলি পাল্টে গেছে। লতি এখন হলদির কাছে যেমন পড়শিরা বলেছে জহুরাও নাকি ঠিক তেমন ছিল তেলির বেলায়। মা মেয়ের আদর অনাদরে খুব বেশি আয়েস ছিলনা। তাই হয়তো মাকে একটু তাড়াতাড়িই ভুলতে পেরেছে তেলি। তবে হলদি আর তেলিতে মিলেমিশে বাড়িটা নতুন যে রূপ ধরেছিল তাও খারাপ লাগেনি পড়শিদের। জহুর তখন আর আলোচনার বিষয় নয়। সে চায়ের দোকানেই  সকাল- রাত  ব্যস্ত। হলদি আর তেলির বয়সের ব্যবধান তেমন ছিলনা। দুজনে মিলে নতুন একটা সংসার করলো। সে সংসারের নাম পুতুলের সংসার। রোজ পুতুলের বিয়ে হতো। সংসার ভেঙে যেতো। অথবা তেলি জহুর হয়ে দেখাতো হলদিকে। বাবা কিভাবে চায়ের দোকানে চা বানায়, কিভাবে চা বিক্রি করে এসব নিয়ে মিথ্যেমিথ্যি চায়ের আসর সাজাতো তেলি।হলদি কেবল দাঁত বের করে হাসতো আর হাসতো।  কখনো কখনো বলতো, ভাই তাড়াতাড়ি এককাপ গরম চা দেন। জামাইবাবু আইছে। চা খাইতে দিমু। মিথ্যা কাপে ভরে নিয়ে যেতো মিথ্যা চা। পুতুলের জামাইকে সেই চা খেতে দিত। জামাই নাকি লজ্জায় শুধু বলতো- থাক থাক। আবার হলদি যখন বাপের বাড়ি যেতো তখন সঙ্গে করে নিয়ে যেতো তেলিকে। তেলি হলদিকে সইমা বলে ডাকতো। তাদের দুজনের এমন সই ভাব কেউ কেউ সইতে পারতো না। তেলি একবার হলদিকে বলেছিল- সইমা, ও সইমা তর মা আমারে চোখ রাঙাইছে। বলে আমি নাকি  তোর মাথা খাইছি। তর নাকি সংসারে মন নাই। মাথা খাওয়া কি জিনিসরে সইমা, সংসার কী সইমা।’ হলদি শুনে বলেছিল- কি জানি মায় জানে। আমারেও কয়- জামাইরে ঠিকমতো খাওন দিস, পানি দিস, গোসলের কাপড় আগাইয়া দিস,  শোয়াইয়া পাখার বাতাস করিস। খালিতো তর তেলি তেলি কইয়াই জান যায়।

-তুই কি কইলি সইমা ?

- কইছি, তেলি তো আমার সই। আমি ওর সইমা। আর আমার লগে তেলিরে দেখলে ওর বাপ তো কিছু কয়না।

- সইমা, ও সইমা।

- ক

- ল, তুই আর কহনো এইহানে আইস না। তর মা চায়না আমাগো পুতুলের বিয়া হোক, আমরা চায়ের দোকান দোকান খেলি, চড়ুইভাতি খেলি।

এরপর থেকে যতবারই হলদির বাপের বাড়ি থেকে নাইওরের খবর এসেছে হলদি ততবারই নিষেধ করেছে।হলদি মাঝেমাঝে  তেলির সঙ্গেই ঘুমাতো। জহুর হাট থেকে এসে যখন দেখতো দুজনে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তখন সে হলদিকে চাইলেও মন তাতে সাড়া দিতো না। জহুরা মরার পর থেকে চাম্পুলির মা এবাড়িতেই থাকতো। সংসারটা সেই আগলে রেখেছে। মাঝেমাঝে বুড়ি বলতো- বাবা হলদিরে তোমার ঘরে পাডাইয়া দিমু? জহুর কিছুণ চুপ থেকে বলতো- না, থাক। একদিন চাম্পুলির মা তেলিকে জিজ্ঞেস করলো- সইমা তোরে অনেক পছন্দ করে নারে তেলি?

- হ তুমি বুঝি দেহনা।

- সইমারে ছাড়া রাইতে ঘুমাইতে পারছ না?

- না, রাইতে আমরা বেয়াইন বেয়াইন খেলি। আমি জামাইর মা , সইমা বউয়ের মা সাজে।

সেবারই লতির জন্ম। মা হয়েও হলদি তেলির সইমাই  থেকে গেল। লতিকে চাম্পুলির মা বাঁচিয়ে রেখেছে। কেবল লতি ুধার জ্বালায় কেঁদে উঠলেই হলদির প্রয়োজন পড়তো। লতিকে দুধ খাইয়ে আবার ছেড়ে দিত। লতির মুখে যেবার একটু একটু কথা ফুটতে থাকলো এবং বয়স প্রায় তিনে পড়লো সেও তেলির দেখাদেখি হলদিকে মা না ডেকে সইমা ডাকতে থাকলো। সবাই তো শুনে অবাক। চাম্পুলির মা বললো- তরতো মা, তুই সইমা কছ কোন দুঃখে।’

এভাবেই কেটে গেল আরো একটি বছর। এবার তেলিকে সইমার সংসার,পুতুলের সংসার ছাড়তে হল। পাত্রের বিস্তর জায়গা জমি আছে। জহুর বেশি বাচবিছার না করে এই বিবেচনায় একদিন পাত্রপকে ডেকে তেলিকে উঠিয়ে দিল। তবে এটা বেশি দিন আগের কথা নয়। মাত্র ছয়মাস হবে।তবুও এ দিনগুলো হলদির কাছে অনেক বলে মনে হয়। স্বামীর ঘরে যাওয়ার সময় তেলিকে তার পছন্দের সব পুতুল সঙ্গে দিল হলদি।  সেদিন আরেকবার দোকান বন্ধ রেখেছিল জহুর। কেবল চুপ করে দেখে গেছে দুই সইয়ের কান্ড কারখানা। জামাইর হাতে তেলিকে দিয়ে হলদি শুধু এটুকুই বলেছিল- ভাত কাপড়ের জন্য সে তোমারে জ্বালাতন করবেনা। যদি করে তবে সইমা অথবা পুতুল হতে পারে।’ সেদিনের পর আর দুজনে দেখা হয়নি। তেলি আজ আসবে । তেলি কয়দিনের জন্য ফিরবে পুতুলের সংসারে? অন্য আয়োজনের কথা থাক। হলদি তাকে দেওয়ার জন্য একটা মাটির পুতুল বানিয়েছিল। পুরো বাড়ি খুঁজেও তা পাওয়া গেলনা।

কথা

নরেশ মণ্ডল

অনেকক্ষণ হলো সকাল হয়েছে। আলতো রোদ ছুঁয়ে থাকে টেবিলটা। কাগজ হাতে সুদীপ্ত।

  -তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। বলে এগিয়ে আসে রূপা।

  -বল, কি তোমার জরুরি কথা। যার জন্য হঠাৎ এত উদগ্রীব ভাব। সচরাচর এমনটা বড় একটা দেখি না। বল, কি বলবে। হাসি মুখে বলে সুদীপ্ত।

 -রূপা — না, মানে একটা কথা তোমায় বলবো বলে অনকেদনি ধরইে ভাবছলিাম। কন্তিু বলা হয়ে ওঠেনি। বলাটা খুব জরুরি। আরে কি বলবে বল না। এত কন্তিু কন্তিু করার কি আছে। আমতিো বাইররে কউে নই। ধোঁয়া ওঠা সদ্য গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলে সুদীপ্ত।

 সদ্যস্নাত। রূপার আলুলায়তি চুল কোমর ছোঁয়। একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগে সুদীপ্তর। বুক ভরে টেনে নেয় একবার। রূপা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। লাইটপোস্টরে তারে দুটো কাক পরস্পররে ঠোঁট ছোঁয়। একটু দূরে একটা কাক আপন মনে পঠিরে পালকে ঠোঁট ঢুকিয়ে বসে থাকে। যেন কত নিশ্চিন্ত।

 সুদীপ্ত অস্থরি হয়ে বলে — কি হলো চুপ করে আছো। এই তো বললে অনকেদনি ধরে একটা কথা বলবে বলে ভাবছিলে। তোমার মধ্যে অন্যরকম ভাবও তখন লক্ষ্য করছিলাম। একটা উৎকণ্ঠা হাবভাবে! হঠাৎ এত চুপ মেরে গেলে যে। প্লিজ বল না। কি বলবে! সুদীপ্তর মধ্যে এক আকুলতা।

 রূপা চুপ করে থাকে। কোন কথা বলে না। সুদীপ্তর মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে।

 রূপা দূরে, অনকে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় অস্পষ্ট স্বরে বলে — না, থাক।

 রূপা, প্লিজ বল না। কি বলবে বল না বলে চৎিকার করে ওঠে সুদীপ্ত

মণিদীপার কথা

   রাস্তায় নামতেই হইহই করে উঠলো লোকগুলো। ওই দিকে যাবেন না।ঠিক বুঝে ওঠার ‌আগে একটা ধাক্কায় ছিটকে পড়ল রাস্তা থেকে নিচে। ওই দিকটা অনেকটা ঢাল হয়ে নেমেগেছে নিচের দিকে। তাই টাল সামলাতে পারেনি। আর একটু গড়ালেই হল। একদম জলে। নয়ানজুলির। কোনরকমে নিজেকে সামলে সোমনাথ উঠে এলো আবার রাস্তায়। ভিড়টা আরও ঘন হয়েছে। মৌমাছির গুঞ্জন। তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সবে বাস থেকে নেমেছে। তার মধ্যেই হইহই। এমন সময় ভিড়টা ঠেলে বেরিয়ে এলো মণিদীপা।

—আরে সোমনাথদা, তুমি এখানে! কবে এলে, কখন এলে,জানাওনিতো  — অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে করে তবে থামল।

 সোমনাথ একটু দম নিয়ে বলে, আরে দাঁড়াও। তুমিতো একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করলে তা একটু সময়তো দেবে উত্তর দেবার জন্য। বলে হাসতে থাকে সোমনাথ। লজ্জা পেয়ে যায় মণিদীপা।

—না না ঠিক আছে, তুমি ধীরেসুস্থে বল। আসলে...

সোমনাথ মণিদীপার লজ্জা কাটাবার জন্য বলে, লজ্জা পাবার কিছু নেই। অনেকদিন পর দেখা হলে এমন হয়। আমি সবে এলাম। দেখতো  জামাকাপড়ের কি অবস্থা হল।

এতক্ষণে মণিদীপার নজর যায় সোমনাথের পোশাকের উপর। তাইতো সোমনাথদা! আমি খেয়ালই করিনি। ভীষণ বাজে ব্যাপার। কি হয়েছে ? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় সোমনাথের দিকে।

সোমনাথ হাসতে হাসতে বলে তেমন কিছু না। এই একটু গড়িয়ে পড়েছিলাম আর কি।

—মানে! কোথায় পড়ে গিয়েছিলেন। উদ্বিগ্ন হয় মণিদীপা।

সোমনাথ হাত দিয়ে ইশারায় দেখায় রাস্তার ওপাশটা। তা কি করে পড়লেন ওখানে মণিদীপার প্রশ্ন। সোমনাথ বাস থেকে নামার পরের ঘটনাগুলো পর পর বলে মণিদীপাকে। মণিদীপা চুপ করে যায়। বুঝতে পারে । তার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। সোমনাথদা মনে মনে নিশ্চয় কিছু ভাবছে। মুখে না না ভাব দেখাচ্ছে। ‘এতবড় একটা মেয়ে তার কোনোদিকে হুঁশ নেই ! সামনে একটা জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে অথচ তার পোশাকের দিকে কোনও নজর পড়ল না। এ কেমন ধারার মেয়েরে বাবা।’ মনে মনে ভাবে মণিদীপা। লজ্জার ব‌্যাপার।

   চলুন, বলে সোমনাথকে এগোতে ইশারা করে। সোমনাথ মন্ত্রমুগ্ধের মতো মণিদীপার সঙ্গে চলে। রাস্তাটা বড় রাস্তা থেকে অনেকটা নেমে তারপর আবার উঁচু হয়ে গেছে। বড় রাস্তার গায়ে বলে বসতির ঘনত্ব বেশি। অনেক গাড়িও যাতায়াত করে। ইদানীং অনেক দোকান হয়েছে। বেশকিছু খাবার দোকানও হয়েছে। এস টি ডি বুথ,সিম কার্ড, টপআপে ছেয়ে গেছে। দোকানগুলোর কোনটার তলার কিছু অংশ ইট তারপর বাকিটা দরমা। মাথায় টালি। আবার কোনও কোনটা শুধুই দরমা আর মাথায় খড় বা টালি। সম্পূর্ণ পাকাও আছে অনেকগুলো। সেই আগের চেহারাটা এখন আর নেই। পালটেগেছে  অনেক কিছুই। মণিদীপা কি আগের মতো আছে। পাশাপাশি হাঁটছে দু’জনে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সোমনাথ। অনেক প্রশ্ন সোমনাথের মাথায় ঘুরপাক খায়। দূরত্ব কি বেড়ে গেছে অনেক। হঠাৎ একটা গাছের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। খেজুর না !

  হ্যাঁ, ছোট্ট উত্তর দেয় মণিদীপা। তুমি দাঁড়াও আমি কুড়িয়ে নিচ্ছি। বলে মণিদীপা ঝুঁকে পড়ে মটির উপর। অনেক বড় হয়ে গেছে মণিদীপা। ছোটকালের শিউলি তোলার কথা মনে পড়ে। তখন বয়স আর কত হবে ! বড়জোর আট কী দশ হবে। এরকম গাছতলা থেকে কতবার যে খেজুর কুড়িয়ে খেয়েছে। মাঠ ঘাট বাদাবন। অনেক দিন অনেক সময় অনেক কথা। কত স্মৃতি মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। কয়েকটা বছর বাদ গেছে মাত্র।

   সোমনাথদা না ! বলে সুধন্য এগিয়ে আসে। সোমনাথ প্রথমে চিনতেই পারেনি। মণিদীপা মনেকরিয়ে দেয়। আরে ও তো সুধন্য। মিত্তির কাকার ছোটো ছেলে। এ বছর বারো ক্লাস পাস করে কলেজে পড়ছে। খেলাধুলায় খুব ভালো। কিন্তু মন নেই। মন রয়েছে আঁকায়।

   মন্দ কি ! অনেক লাইনতো আছে। মনোযোগী হতে হবে কাজটায়। দেখার চোখ চাই। নিয়মিত চর্চা করেযেতে হবে। কথাগুলো বলে সোমনাথ। আসলে অনেকদিন দেখিনিতো তাই ঠিক মনে করতে পারছিলাম না।

—তা কিছুদিন থাকবেনতো সোমনাথদা। সোমনাথ সম্মতিসূচক ঘাড়নেড়ে হ্যাঁ বলে। পোশাকের দিকে একবার ভালোকরে চোখ বুলিয়ে সুধন্য বলে— এটা কি করে হল! সে অনেক কথা পরে শুনবি বলে কাটিয়ে দেয় মণিদীপা। সুধন্য আর কথা না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো বলে— আমি এখন যাই পরে দেখা হবে। সোমনাথ ঘাড় নাড়ে। ভাবটা এমন অনেক হয়েছে । এবার এসো। অনেকটা সময় যেন ওর নষ্ট হয়ে গেল। আসলে মণিদীপার সঙ্গে এই সময়টায় ‌আর কেউ ভাগীদার হোক এটা সোমনাথের মনপছন্দ নয়। কিন্তু তাই বলে হুট করেতো কাউকে চলে যেতে বলা যায় না। যখন অনেকদিন পর তার সঙ্গে দেখা। সে যতই না চাক। ‌আর সবকিছুতো তার চাওয়া পাওয়ার উপর নির্ভর করছে না।

     মণিদীপা সোমনাথের মনোভাব আঁচ করার চেষ্টা করে। এদিকে সোমনাথ ভাবতেও পারেনি যে এভাবে মণিদীপার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে। বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে ঠিকই কিন্তু মনের ভেতরের সেই জায়গাটা আজও থেকে গেছে।

  বড় রাস্তা থেকে এলি —প্রশ্নটা মণিদীপার দিকে ছুঁড়েদেয় মিত্তির কাকা। মানে সুধন্যর বাবা।

—হ্যাঁ, উত্তর দেয় মণিদীপা। কিছু বুঝতে পারলি লাশটা কার।

—না, তবে সবাই আলোচনা করছিল আমাদের এ দিকের কেউ না। তা তোর সঙ্গের ছেলেটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। চোখেও এখন কম দেখি। সোমনাথ কী।

—হ্যাঁ, উত্তরটা সোমনাথই দেয়। কেমন আছেন ?

—ভালো। তবে বয়সতো হচ্ছে।

তাতো বটেই সোমনাথ বলে। একটু আগে সুধন্যর সঙ্গে দেখা হয়েছিল । বলল মণিদীপা। তাই! মিত্তির কাকু বললেন। তা কিছু কথা হল সুধন্যর সঙ্গে। ছেলেটা তো পড়াশোনায় মন বসাতেই চায় না। ছবি আঁকায় মন গেছে। কি করি বলত বাবা সোমনাথ ?

—চাইছে যখন চেষ্টা করে দেখুক। আপনি না বললে যদি শোনে তো আলাদা কথা। নাহলে আপনি আর কি করবেন বলুন। তবে লেগে পড়ে  থাকলে একটা না একটা রাস্তা নিশ্চয় বের হবে। আপনি ভাববেন না। মিত্তির কাকু হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে বড় রাস্তার দিকে হাঁটা লাগালেন। কৌতূহলও বয়সের বাধা মানতে চায় না।

গাছের ছায়া ধরে এগোয় ওরা দু’জন। বেলা কম। মেঘের আনাগোনা চলে। রোদের পরশ গা সওয়া। রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে গাছ। উপরের নীলের সঙ্গে সবুজ মন ভরায়। ভালোলাগে সোমনাথের। কংক্রিটের জঙ্গল নেই। সীমাহীন আকাশ। চেনা-অচেনা নানা পাখির নানা ডাক। ছোটবেলা মাঝে মাঝে তাকে জড়িয়ে ধরে।  

   পাশের ধানিজমি ছুঁয়ে ফুরফুরে বাতাস মণিদীপার চুল অবিন্যস্ত করে দেয়। একটা ছাগলছানা মাঠ থেকে ব্যা ব‌্যা করতে করতে রাস্তায় উঠে আসে। মণিদীপা এক ছুটে ছাগলছানাটাকে কোলে তুলেনেয়। সোমনাথ মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মণিদীপার দিকে। মণিদীপা ছানাটাকে জড়িয়ে ধরে। 

 

নিশি লীলা

বচন নকরেক

খুব ভোরে গরাঙ্গের ফার্মেসিতে মাখন মাথায় আঘাতের চিকিৎসা নিতে আসে। আশপাশের চা স্টলে বসে থাকা দু’একজন জড়ো হয়। নানা জন নানা মন্তব্য করে । একজন বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে-নটি মাগি, এক স্বামী খাইসে, আইস্কা আবার আরেক স্বামীরে থুইয়া লুচ্চা দ্বিগীনের লগে পলাইয়া গেসে গা। তাও মাথায় আঘাত কইরা । গরাঙ্গ ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হলে মাখনকে ওষুধ দেয়। কারোর সাথে কোন কথা না বলে চুপচাপ বাড়ীর দিকে চলে যায় মাখন। মাখনের পাশের বাড়ির চেঙ্গু বিড়ি কিনতে আসে দোকানে। তাকে ঘিরে ধরে সবাই জানতে চায় -ঘটনা কি? চেঙ্গু বলে-মাগিডার দ্বিগীনের লগে পরথম স্বামী নকুল থাকতেই ভাব আসিল, আরও কার কার লগে আসিল, জানি না , মাখনের লগেও আসিল। শেষেতো নকুল মরার পর মাখনের লগে হাঙ্গা বিয়া করে। একটা বাচ্চা অয়। এহন থুইয়া-দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকা লোকগুলো বলে উঠে-ছি:ছি:ছি:ছি:।  

-মান্দিরা শিক্ষিত অইয়া অহন বড় বড় চাকুরি করে। আমরাও খ্রিস্টান অইলে পড়াশুনায় আগাইতাম। আরও ভাত দেও।

-নাইকা, খালি তুই খাবি? পুলাইপান খাই নাই। আমিও খাই নাই।

-আমার পেট ভরে নাই যে।

-হ, কাম না করলে ভাত আ’ব কোন থিকা। মান্দি বাড়ি কাম কইরা সারা বছর তোমারে খাওয়াইতাসি। বড়শি নিয়া ঘর থিকা রোজ বাইর অও ফিরো রাত কইরা, মান্দি বাড়ী মদ খাইয়া মাতাল অইয়া। মাখন বর্মণ না শোনার ভান করে হাত ধোঁয়  আর গান গায়-ছি:ছি;ছি;ছি: লইজ্জায় মরি একই তোমার ব্যবহার। তুলসী গলা ছড়িয়ে বলে-গানতো অয়না ছাগল ভ্যাবানি। অইযে  কয় না, মাইনসের স্বামী গান গায় মধুরবাণী, আমার স্বামী গান গায় ছাগল ভ্যাবানি ।

-ধ্যাৎতেরী, ভাতও পেট ভইরা দিলি না, গান গাইলেও কুটা মার। যা, খালে যামুগা। মনে অয় আইস্কা মাছ পামো, ভালা স্বপ্ন দ্যাখসি।

-পাইলেও কি অ’ব , বেইচ্যা চা-বিড়ি খাইয়াই শেষ করবা। বাড়িতে অইনাতো খাওয়াবা না কোনদিন ।

-ধ্যাৎতেরী, তুই কামে যাগা, প্যাচাল পারিস না। আইস্কা ঠিকই মাছ পামু। বাড়ীতে নিয়াও আমু স্বপ্নে মেলা মাছ ধরসি।

গজারীগড়া গ্রামের মান্দাই পাড়ার মান্দাইরা কেউ নাস্তা পানি না খেয়েই, কেউ খেয়ে নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে লাল কাকড়ের সরু রাস্তা ধরে। কারো হাতে কাচিঁ-কাস্তে,কারো হাতে ছেনি। গ্রামের নাম গজারীগড়া হলেও এখানে আর একটিও গজারী গাছ নেই। একটু বুঝনেঅলা মান্দাইরা নিজেদের ‘মান্দাই’শব্দে আপত্তি করে বলে-মান্দিরা আমাগো মান্দাই কয়গো। কেউ কোচ, কেউ ক্ষত্রিয় বলে নিজেদের দাবী করে। দু:খজনকভাবে গজারীগড়া ও তার আশপাশের মান্দাইরা নিজেদের ভাষা আর বলতে পারে না, ভূলে গেছে। তারা এখন বাংলায় কথা বলে। এখানে তারা ঘণবসতির মত করে থাকে। ক’য়েক বছর পরে হয়তো মান্দাই পাড়া বস্তির মত হয়ে যাবে। কারণ তারা পরিবার পরিকল্পনা করে, অল্প বয়সে বিয়ে করে। অবশ্য ওদের কেউ কেউ ভাগ্য বদলের আশায় খ্রিস্টান হচ্ছে। চেবেং বর্মনের নেতৃত্বে কয়েকজন এস.ডি.এ চার্চে দীক্ষা নিয়েছে আর তাপস বর্মনের নেতৃত্বে কিছু মান্দাই ব্যপ্টিস্ট হয়েছে। এখানে অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষা দীক্ষায় মান্দাইরা পিছিয়ে আছে আরেক  আদি জাতি স্বত্তার উত্তরাধিকার মান্দিদের তুলনায়। মান্দাই প্রাচীনরা বলেন-আগেতো এই এলাকায় মান্দাইগো অবস্থা মান্দিগো চাইতেও ভালা আসিল। পরথম পরথম আমরাই এলাকায় আইলাম, জঙ্গল সাফ করলাম, পরে না মান্দিরা আইল । কিন্তুক অইযে, সনাতন মান্দাইগোতো আবার বার মাসে তের পার্বণ। আর মান্দাইরা একটু বিলাসী, অহংকারীও আসিল। পড়াশুনাও করে নাই। ইশ্কুলে ভর্তি অইলে যদি খ্রিস্টান বানায় এই ধরে ।

বালিসের নীচে তুলসী ভূল করে ৫০ টাকা রেখে গেছে বিড়ি খুঁজতে খুঁজতে মাখন তা দেখে ফেলে। ২০-৫০ টাকা হাতে থাকলে মাখনের হাতচুলকানি শুরু হয়ে যায়। রিং মাস্টারের কলা বাগানের জুয়ার আড্ডায় মন চলে যায়। কান ধরে কতো প্রতিজ্ঞা করেছে সে আর তাস খেলব না বলে। আজও মন মানছে না । এদিকে বুদুর চা দোকানের সামনে দিয়ে যেতেই বুদু গাল দেয়-কি’রে খাঁটা, দুই মাস অয় বাকী দেস না।

-ধ্যাৎতেরী, এহন একহানু যাইতাসি, পরে দিমুনি।

-একহান কই যাও জানি। তুলসীর কাসে কইয়া দিমু। খাঁটা মাখন না শুনার ভান করে গুটুর গুটুর করে হেঁটে কলা বাগানে ঢুকে পড়ে। কলা বাগানের সার-বিষের তীব্র গন্ধ তেমাথা বাজার পর্যন্ত চলে আসে। তেমাথা বাজারে কাঠচোর, সুদখোর, ভ্যানঅলা আর টেম্পো ড্রাইবাররা আড্ডা মারে। ক্উে কেউ সারাদিন আড্ডা মারে আর বিড়ি খায়। যেন-–নাই কাজ তাই খই ভাজ। কলাচাষ এলাকায় শুরু হওয়ায় দোষণ শুরু হয়েছে সবখানে। দোষণ লেগেছে বাতাসে, মনে, সবখানে। কলা বেঁচে আর কলা বাগানে কাজ করে কাঁচা পয়সা আসছে হাতে। আর এই কাচাঁ পয়সার ঝন্ঝনানি আওয়াজ বাজে নিশি রাতে, এই পাড়ায়। দূর থেকে টেম্পোটে করে চুলাই মদের চালান আসে অন্ধকার হলে। প্রথমে শুকরের মাংস দিয়ে ঢুকঢুক করে গিলে খায় মদ্ । পরে নেশা হলে বলে-কই, আইস্কা কারে লাইনে রাখসস্ ।  পয়সা বেশি কইরা দিমু যদি অমুকের বউরে.................

-মোর জ্বালা, তোমার কপাল দেহি ভালা। এই বলে শম্ভু বিড়ির ফুটকিতে শেষ টান মেরে ছুড়ে দেয়।

-ধ্যাত্তেরি, আইস ভালা স্বপ্ন দেখসি। স্বপ্নে মেলা মাছ ধরসি। আইস্কা আমি পামুই। ইতিমধ্যেই লাভের টাকা দিয়ে উক্কিকে বাজারে পাঠিয়ে পাইলট সিগারেট আনিয়ে নিয়েছে মাখন। তাসের আড্ডার আশেপাশে নারু, উক্কির মতো যোগানদারেরা বসে থাকে অর্ডারের অপেক্ষায়। তাদের সাথে থাকলে চা, বিড়িতো আছেই মাঝে মাঝে মদও খেতে পারে। বোমা শম্ভু আবার বলে-মোর জ্বালা, মেলা টেহা লাভ করলি, তেনাচুর(চানাচুর) চা খাওয়াবি না?

-তুই খালি খাই খাই করস।

-হি-হি ক’রে হাসে আর তাস বাটে বোমা শম্ভু।

এদিকে লম্বা মাখনের বাড়িতে চরগ পুঁজার মিটিং-এ বসেছে সনাতন মান্দাইরা । প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি মেলা বসে এখানে। স্থানীয়রা একে চরগ পুঁজা বা চরগ মেলা বলে। ওদের মধ্য থেকে একজন বলল-চেবেং আর তাপসরেও মিটিং এ ডাকসি । ওরা অহন খ্রিস্টান অইলেও মান্দাই পুলা না । আ’ব কইসে।

-হিন্দু খ্রিস্টান বইলা না। পাড়ায় অনুষ্ঠান, তাই সবারই থাহন দরর্কা । কইসস্ ভালা করসস্ । মাতব্বর গোছের একজন বলল।

-কতো কইসি, মাইয়্যা ডাঙ্গর অইতাসে চোখে চোখে রাখ, শাসন কর। করে নাই। পাড়ার আর বাইরের পুলাইপানরা খালি ঘোর ঘোর করে। কতো কইসি, কাঁচা বাঁশেই ঘুণে ধরে-শাসন কর। শাসন করে নাই।

-একলা একলা কী প্যাচাল পার, কারে গাইল দেও বুড়ি? টোট রতন জিগায়।

-কারে কমুগো, রাক্ষসীদা আইসকা আবার আইতাস ।

-ও, রুমার কথা কও।  

-আবার সব পুলার মাথা খারাপ করবো। স্বামী মরসে বিষ খাইয়া । এহন ঢাহা থাহে না কই কি করে কেউ জানেন । মাঝে মাঝে  আহে। উই আইলেই পাড়া গরম অয়। বুড়ির কাছ থেকে রুমার আসবার কথা শুনে রতন খুশি হয়। রাতে দালালী করে টাকা কামানোর চিন্তা মাথায় আসে। বুড়ি আবার প্যাচাল পারে রুমার স্বামীডা ভালা আসিল গো। কিন্তুক অই যে, দাঁড়ি ব্যাপারি মইজ্যার লগে বউডার আকাম-কুকাম যখন দেখল, পরে বিষ খাইয়া মইরা গেল গা। এসময় কোত্থেকে এক কুকুর এসে ঘরের বেড়ায় এক পা তুলে মুতে দেয়। রতন কুকুর তাড়াতে তাড়াতে মাথা বাজারের দিকে চলে যায়।

খাঁটা মাখনের তাস খেলায় লভ হয়েছে। ভাতের তোকানে ঢোকে ডিম দিয়ে ভাত খায়। -ভালা অইসে, আরো দেও । দোকানী পাতে আরো ডিম ভাত দেয়। ভাত পেট ভরে খেয়ে বুদুর দোকানে যায়,বাকি শোধ করে। বুদুকে গাল দেয়-অল্প কয়েক টেহা, এই টেহাই অতগুনা মাইনসের সামনে চাইলি। নে, ধর টেহা। পান খায়, পাইলট সিগারেট কিনে। সকালের কথা মনে পড়ে মাখনের । তুলসীকে বলেছিল সে-আইসকা মাছ পামু , ভালা স্বপ্ন দেখসি। মাখন মাছের দোকানে যায়, মাছ কিনে, শব্জি-ডিম কিনে।

অন্ধকার শুরু হয়েছে । তুলসী ঘরে পৌঁছে কুপি বাতি জ্বালায়। কুপি বাতিতে কেরোসিন কম। বিছানার নিচে টাকা খুঁজে পায় না। তুলসীর সন্দেহ হয়। সে সময় মাখন শিস্ পারতে পারতে মাছ, ডিম-শব্জি নিয়ে হাজির হয়।

-খুশী অইনাই আমি । কেরা তোমারে তাস খেলাবার কইসে? এই কইরা জমি হারাইসস্ , মাইনসের বাড়ি কাম কইরা টেহা জমাইয়া ভ্যান রিক্সা কিইনা দিসিলাম তাও বেইচ্যা ফেলাইসস্ ,আবারও তাসের আড্ডায়ই বইলি? মাতবরগর সামনে কান ধইরা কইসিলি আর তাস খেলাবিনা, মনে নাই? এই বলে তুলসী কেদেঁ উঠে। মাখনের সাথে তার ভবিষ্যৎ ঘর সংসার নিয়ে ভাবে। দ্বিগীনের কথা ভাব । দ্বিগীন তাকে এখনো ভালবাসে। মাখনের উপর তার বিশ্বাস উঠে যায়। খুব দ্রুত এসব তুলসীর মাথায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়। মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে । মনের কথা গোপনে রাখতে নিজেকে সামলে নেয়।

-ধ্যাত্তেরি, আইসকাতো হারি নাই । দেহ, মেলা টেহা। এই বলে মাখন টাকা বের করে বিছানায় রাখে । তুলসী ওদিকে তাকায় না ।

-কেরোসিন নাই, এহনি নিয়া  আহগা । মাখন টাকা পকেটে নিয়ে তেমাথা বাজারের দিকে পা বাড়ায়। তুলসী বলে-বাজারে একটুও দেরি করবার পারবানা কিন্তু। এদিকে বাজারের প্রতিটা চা স্টলে রুমাকে নিয়ে ফিস্ ফিসিয়ে আলাপ শুরু হয়েছে। মাখন শুনে ফেলে। পকেটে হাত দেয়। পকেট উঁচা লাগে। বাসনা জাগে । তাড়াতাড়ি কেরোসিন নিয়ে বাড়ি ফিরে। তুলসী বলে-তোমারে তোমার মাছ রাইন্দা দিতাসি, ভালা কইরা খাইয়্যা ঘুমায় পড়বা।

-ধ্যাৎতেরী, খাওয়ার পর পান না খাইলে অ’ব ।

-চলব না, তোমারে আমি চিনি। রুমা আইলে তোমাগোতো মাথা ঠিক থাহে না।

ভাঙা ঘটিবাতির তালে পুরানো বাংলা সিনেমার গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। খাওয়া দাওয়া হয়তো শুরু হয়ে গেছে।

-দাদা, দাদা । বাইরে রতনের গলার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। তুলসী ঘরের ভিতর থেকে উত্তর দেয়-কোন কুত্তার বাচ্চারে ।

-ইস্ , দাদার কাছে আইসকা  মেলা টেহা আসিল কি না । বলতে বলতে রতন ফিরে যায়। মাখন এ সময় হে-হে-হ করে হাসে। তুলসী বলে-বোকায় বিলে হাসে অন্যের হাসি দেইখ্যা, তুই হাসস কিসের নিগা।

-তোমার নিগা । তোমার মত বউ যার ঘরে সে কোন দু:খে পর নারীর কাসে যা’ব। তোমার যা গাল। কথায় কয় না-”ডাইলের মজা ঝালো, নারীর মজা গালো।”

তলসী কুটি বস্তা থেকে অসম্পূর্ণ কাঁথা বেড় করে কাঁথা সেলাইয়ে মন দেয়। কাঁথা সেলাই করতে করতে বলে-তোমারে আমি চিনি। মেলা টেহা নষ্ট করসস পর নারী আর জুয়ার পেছনে। অগ্যতা মাখন পাইলট সিগারেট জ্বালায়, আয়েশে ধোঁয়া ছাড়ে, আর ফাঁকে ফাঁকে গান গায়-ছি;ছি;ছি;ছি লইজ্জায় মরি একই তোমার ব্যাবহার। এদিকে নকুলের শিষ্য দ্বিগীন দ্রিম-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়, দ্রিম কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড় তালে ঢাকে বুল তোলে। সুতা টানে, ঢাকের সুর ঠিক করে । নকুলের পর ঢাকের দায়িত্বটা এসে পড়েছে দ্বিগীনের উপর। দুই বছর আগে নকুল মারা গেছে যক্ষায় । আর স্বামী মারা যাবার পর তুলসী হাঙ্গা বিয়া করে খাঁটা মাখনকে । দ্বিগীনের তুলসীর প্রতি টান ছিল প্রচন্ড। কিন্তু চালু মাখন কেমন করে যেন পটিয়ে হাঙ্গা বিয়ে করে ফেলে তুলসীকে । এরপর পাড়ায় রটনা ছড়িয়ে পড়েছিল এভাবে-মাখন অষুধ কইরা তুলসীরে বিয়া করসে। নইলে তুলসী কী মাখনরে.........।

দ্বিগীনও নকুলের মত পা নাচিয়ে নাচিয়ে ঢাক বাজায় । নকুলের ঢাকের সুরে পাগল হয়ে তুলসী নকুলকে বিয়ে করেছিল। তুলসী কী তারই শিষ্য দ্বিগীনের দ্রিম কুড়-কুড়-কুড়-কুড়-কুড় বুল শুনছে। এক সময় পকেটের মটর বিড়ি পড়ে যায় উঠোনে। চওড়া হাসি হেসে হেমন্ত পাগলা তা তুলে দিতে আসে। দ্বিগীন ঢাক বাজানো রেখে বলে-নাগবোনারে, আমিই তুইলা নিতাসি। একটু জল খাইয়া বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া সাইরা নিমু আগে। আইসকা এম্নি বাজাইয়া দেখতাসিতো।

-হ, একটু পরে একহানু যামুনি। হেমন্ত বলে। রাহ তোমার রুমা। খালি রুমা রুমা কইরা তোরা মরস।

-এ্যাঁ, তুইওতো তুলসীরে না দ্যাখলে থাকা হাস না ।

-ধ্যাৎ-ধ্যাৎ, তুলসীর লগে রুমার তুলনা । সব দিক দিয়া তুলসীই সুন্দরী । এসময় হেমন্ত ঢাকের কাটি নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করে। দ্বিগীন বলে-গান গাইলেই গান অয় না। হেমন্ত জবাব দেয়-আমার বাজানিও একদিন বাজনা অ‘ব। দ্যাইখো, হেইদিন তুলসী খাড়াইয়া খাড়াইয়া আমার বাজানিও দ্যাখবো । দ্বিগীন হেমন্তের কথায় মুচকি হেসে বিড়িতে তীব্র টান টেনে এক্কেবারে অর্ধেক করে ফেলে। বিড়ির ফুটকি হেমন্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে-খাবা ?

-না, দিলে আমানদিই দে ।

-খালি ছি;ছি;ছি:ছি; লইজ্জায় মরি- ভূবনে এই গানডিই পারো । তার উপর তোমার যে গলা,আর গাইয়ো নাতো। মাইনসে জরা অ’ব। কিয়ের নিগা কান্না কাটি করতাসস তাই মনে কইরা। এই বলে শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে তুলসী। মাখন তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ হয়ে। এ সময় তুলসীর বুকের কাপর পড়ে যায়।

-কি এমন কইরা চাইয়্যা দেহ ড্যাব ড্যাব কইরা। বলতে বলতে সুইসুতা নিরাপদ যায়গায় সরায় তুলসী। আবার বলে মাচা থিকা নাইম্যা আইতে পারো না । মাখন কুপি বাতি নিভিয়ে দিয়ে বাঁশ পাটির বিছানায় শোয় তলসীকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

রাত ভেঙে দুমরে মুচরে মান্দাই পাড়া যখন কেঁপে উঠে দ্বিগীনের দ্রিম কুড়-কুড়-.........তালে ঢাকের কাব্যিক সুরের ব্যাঞ্জনায় তখন তুলসী মাখন তাদের আদি প্রবৃত্তি নিবারনে নিমগ্ন, আরেক নিশি রাইতের পদ্য রচনায়। এ সময় তুলসীর মনশ্চক্ষে ভাসছে ধবধবে সাদা ধূতী পড়া নকুলের প্রতিচ্ছবি । ফর্সা ধূতি পড়ে পা কুঁদে কুঁদে নেচে নকুল চরগ পূঁজার হাজিরার রাতে ঢাক বাজাত। শঙ্খর করুণ ধ্বনি, আর নকুলের ঢাকের সুর শুনলে তুলসী ঘরে থাকতে পারতো না। আজও থাকতে ইচ্ছে করছে না । তার ইচ্ছে করছে এ মুহুর্তে মাখনকে উপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দ্বিগীনের কাছে ছুটে যেতে। সত্যি সত্যি জোড়ে ঢাক্কা মারে তুলসী। ছিটকে পড়া মাখনের মাথা পেরেক বিঁধানো বাঁশের বেড়ার খামে লাগে। অজ্ঞান হয়ে যায় মাখন । এদিকে দরজা খোলে অন্ধকার ভেঙে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে তুলসী যেদিক থেকে ঢাকের শব্দ আসছে সেদিকে-------যেন কৃষ্ণর  বাঁশির ডাকে রাধা ছুটে যায়-অন্ধকারের সব ঝঞ্জাল সামনে থেকে সরিয়ে সরিয়ে.............।   

আমি নই ক্ষত্রিয়

কুলদা রায়

স্বপ্নের মধ্যে শুধু বৃষ্টি আসে। আর আসে সেই পুকুরটা। কেন বাবা হেমামালিনী আর জুহু বীচ আসতে পারে না?

 

কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাতা থেকে এখনো টুপাটাপ জল ঝরছে। কিন্তু গরম। জলে নামতে পারলে বেশ হয়।

একটি লোক হাতছানি দিলেন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো উজ্জ্বল। বললেন, এত ছোট ছেলে তুমি। পূর্ব বাংলা থেকে এসেছ? বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছে না?

--লেবুবাই কৈলেন। তাই যুদ্ধ করতে আইসি।

--কার পক্ষে যুদ্ধ করবে?

--বাঙালীদের পক্ষে।

--কোন্ বাঙালী? ধনী বাঙালী? না, সর্বহারা বাঙালী?

 

কঠিন প্রশ্ন করেছেন এই দাদা লোকটি। তিনি বুঝিয়ে বললেন, তোমরা যে যুদ্ধ করছ, এটা কোনো জনযুদ্ধ নয়। একটি বিদেশী শোষক শ্রেণীর বদলে আরেকটি দেশী শোষক ধনীক শ্রেণীকে ক্ষমতায় আনার জন্য তোমাদের এই যুদ্ধ ? সর্বহারা শ্রেণীর কি হবে এই যুদ্ধে?

--তাইলে কী করতে হবে?

--শ্রেণী সংগ্রাম। একমাত্র শ্রেণী সংগ্রামই হল এ সময়ের কর্তব্য। আওয়ামী লীগ হল ধনীক শ্রেণীর প্রতিনিধি। শোষক শ্রেণীর দল।

--আমি তো আওয়ামী লীগের লগে নাই। কম্যুনিস্টগো লগে আছি!

--কোন কম্যুনিস্ট? মনি সিংহের? মনি সিংহ তো রাজার ছেলে! সে কি করে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট হবে? হু, এরা হল সংশোধনবাদি। এরা বিপ্লবের জন্য খুব ক্ষতিকর। সর্বহারাদের মধ্যে থেকে শ্রেণী সংগ্রামের বিপ্লবী নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

বিপ্লব তাইলে শিশু! তার দীর্ঘজীবি হওয়া দরকার।

 

পুকুরের জল দুলে দুলে উঠল। পশ্চিম বঙ্গের পুকুরে জল কম। বাংলাদেশের জল শীতল- ছায়াময়।

 

 

বাড়ি ফিরেই দেখা গেল- -লোকজন নেই। সব ফাঁকা। দরোজায় তালা। অনেক ডাকাডাকির পরে আম্মার গলা পাওয়া গেল। পেছনের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তোর আব্বা- ভাইদের বাঁচা, মান্নান।

--কেন, তারা কী করছে?

--রাজাকারি করছে। এখুন পালাইছে।

 

অনেক জিনিস পত্রে ঠাসা ঘর। এগুলো আগে ছিল না। ঘরের খুঁটিতে সিদুঁরের দাগ। দরোজায় হালকা করে স্বস্তিকা চিহ্ণ আঁকা। ঘরের মাঝখানে একটি সেগুনকাঠের পালঙ্ক। মাথার কাছে লেখা-- সুখে থাক। হাজী আবদুল গফুর ভূঁইয়া। এটা বিখ্যাত ভূঁইয়াদের বড় ছেলে ঘুমাত। সুখে থাক লেখার কাছে রক্তের দাগ। তাকে কি মেরে ফেলা হয়েছে? আম্মা রান্না ঘরে চলে গেলেন। মান্নান বাইরে নতুন তোলা ঘরের বারান্দায় গুম হয়ে বসে রইলেন।

 

পরদিন একটি ঘটনা ঘটল। ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থীরা কলেজ মাঠে তাবুর মধ্যে থাকত। মান্নান বামহাতে একটা মাছকাটা বটি ডানহাতে তার আব্বাকে টেনে নিয়ে এলেন কলেজ মাঠটিতে। লোক জমে গেল। তিনি বটি উঁচু করে অলৌকিক এক বক্তৃতা দিলেন। বললেন, তার আব্বা বিশিষ্ট রাজাকার। লুটপাট করেছেন। কিছু মানুষকে হত্যার সঙ্গেও জড়িত। আরও কি সব। তার আব্বা এখন ধনীক শ্রেণীর মধ্যে পড়েছে। ধনীক শ্রেণী হল শোষক শ্রেণী। এই শোষক শ্রেণীকে তিনি সকলের সামনে কতল করবেন। শ্রেণী সংগ্রামের সূত্রপাত করবেন। শ্রেণী শত্রুকে রেহাই দেয়া যায় না।

 

তিনি বটি উচু করে ধরলেন। তার আব্বা হুজুর জোরে জোরে সুরা ইয়াসিন পড়ছেন। আম্মা মান্নানের শার্ট চেপে ধরেছেন। তারস্বরে চিৎকার করছেন-- কী করিস মান্নান। কী করিস মান্নান। তার তিন ভাইও চিৎকারে গলা মেলাচ্ছে। এরা তিনভাই কুখ্যাত রাজাকার হিসাবে একাত্তরে এলাকা দাপিয়ে বেড়িয়েছে।

 

ভয়ংকর হয়ে উঠছে ঘটনাটি। শ্বাস রোধ হয়ে গেল অনেকের। অনেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল। কজন দুর্বল মনের মহিলা ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। তাদের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। আর শিশুরা মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকাল। বটিটা অনেক উপরে উঠল। মান্নানের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। বটিটা ধা করে নিচে নেমে আসবে। তার গলা বরাবর নেমে আসছে। এক, দুই, তিন ..

 

একজন মুরুব্বি চিৎকার করে উঠল। বাবা, পিতৃহত্যা নাজায়েজ।

 

সেদিন কোন রক্ত ফিনকি দিয়ে উঠল না। কারো মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিয়ে ছিটকে পড়ল না। কারো স্ত্রী বিধবা হলেন না। কারো পুত্র পিতৃহীন হল না। ধর্ম রক্ষিত হল। কলেজ মাঠে যে সমস্ত শরণার্থীর শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল- তাদের নতুন করে শ্বাস বইতে শুরু করল। এরা অনেকেই পিতৃহীন, মাতৃহীন, ভ্রাতৃহীন, সদ্য বিধবা, সর্বস্বহীন এবং কোনো কোনো নারী ধর্ষিতা।

 

মান্নান হিরো হয়ে গেলেন। পুচকি মান্নান হয়ে গেলেন বিপ্লবী মান্নান ভাই। তার আব্বা হুজুরও ডাকতে লাগলেন- মান্নান ভাই। ভাইগুলো হাতের রক্তটক্ত মুছে একটা সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিল বাড়ির গেটের সামনে খেজুর গাছে। লেখা- বিশিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল মান্নান ভাই-এর বাড়ি। মান্নান ভাইয়ের জন্য নতুন তোলা ঘরটি বরাদ্দ হল। ঘরটি নিচু পাড়া থেকে লুট করে আনা। পুরনো শালকাঠের একটি আলমারী। পালংকে ঘুমানোর সময় চোখে পড়ে লেখাটি-- ‘সুখে থাক।‘ হাজী আবদুল গফুর ভূঁইয়া অংশটি চুন দিয়ে বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। ভুঁইয়া সাহেব সপুত্র নিহত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। এই পরিবারটি শ্যাখের দল করত। মান্নান ভাই এই ঘরটিতে থাকেন। আর ঘুমান। মুরগী-মুসাল্লাম খান। আলমারীতে লাল লাল সব বই সাজান। মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার ওঠেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। সে চিৎকার রাত্রি ভেদ করে দিনে গভীরেও পৌছেঁ যায়।

 

মান্নান ভাইয়ের আব্বা হুজুর এবং ভাইগণ ব্যবসাপাতি শুরু করলেন জোরে শোরে। কলেজ মাঠের শরণার্থীরা অনেকে বাড়ি ফিরে গেল। কোন উপায় না দেখে কেউ কেউ ওপারে চলে গেল। তাদের মন ভেঙে গেছে। তাদের ঘরদোর পুড়ে গেছে। সব কিছু লুটপাট হয়ে গেছে। কেউ পোড়া ভিটেতেই তাবু খাটিয়ে বসবাস শুরু করতে লাগল। কলেজ মাঠে লাল বাহিনী, নীল বাহিনী খায় দায়-- ঘোরে ফেরে-- আর মাঝে মাঝে মার্চপার্ট করে। হাক দিয়ে ওঠে-- জয় বাংলা। রাতে মাহফিল। লাল দোপাট্টা মল মল।

 

লেবু ভাই বললেন, মান্নান চলো-- লোকজনের কাছে যাই। ঘরবাড়ি তুলতে সাহায্য করি।

 

মান্নান ভাই দিল খোলা মেজাজে বলে দিলেন, এইটা আমার কাজ না। আমার কাজ বিপ্লব।

-- আমরা তো বিপ্লবের জন্য কাজ করছি!

- -আপনে বিপ্লবী হতে পারেন না। আপনের বাপ জোদ্দার। তিনি শ্রেণী শত্রু।

 

লেবু ভাই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন। মান্নান ভাই পড়তে লাগলেন লাল লাল অই বইগুলো। আর খেতে লাগলেন মুরগী মুসাল্লাম। তার স্বাস্থ্য টগবগ করতে লাগল। বিপ্লবের দীর্ঘজীবি হওয়ার জন্য সুস্বাস্থ্যের বিকল্প নেই। দুটো ফ্যান ওনার জন্য ঘর থেকে বের করা হল। এই ফ্যান দুটি গীর্জাঘরে হাওয়া দিত। গীর্জায় হাওয়ার দরকার নেই। এ বড় কঠিন তত্ব। তত্ব না বুঝলে বিপ্লব করা যাবে না।

 

কিছুদিন পরে লেবুভাই নিহত হলেন। দিনের বেলায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মান্নান ভাই আমাদের বাসায় এলেন। একটা গানের খোঁজে। যিনি গানটি করতেন সেই ঠাকুরদা নেই। আমার বোনের খাতা থেকে গানের পাতাটি ছিঁড়ে নিলেন। আর নিয়ে গেলেন দিদির হারমোনিয়ামটি। অসাধারণ অধ্যবসায় তার। স্কুলে যেতে আসতে শুনতাম, মান্নান ভাই হারমোনিয়াম টিপে টিপে গাইছেন কানা কেষ্ঠর গান--

 

মুক্তির মন্দির সোপান তলে

কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷

কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দীশালার ওই শিকল ভাঙা

তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে

যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে৷ 

 

একদিন তার আলমারীটা ঝাড় দিতে ডাকলেন। বললাম, পূজায় যাব।

বললেন, ছি কমরেড, ধর্ম হল আফিং। তার চেয়ে বিপ্লব জরুরী। দেরী করলে বিপ্লবের ট্রেন ছেড়ে দেবে। তখন?

 

ঝেড়ে পুছে আলমারীতে বইগুলো সাজিয়ে রাখতে হল। মাও সেতুং, মার্কস, এংগেলস, লেনিন, স্টালিন-এর রচনাবলী মাওলানা আব্দুর রহিমের ইসলাম ও সমাজতন্ত্র, লু সুনের গল্প এবং সিরাজ সিকদারের কিছু লেখা। তার পশে বেহেশতের কুঞ্জি, সচিত্র কোকশাস্ত, কী করিলে কী হয় এবং সচিত্র রোমাঞ্চ। প্রচ্ছদে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ের ছবি। নায়িকা টায়িকা হবে। উর্ধাঙ্গ ফাঁকা। হেসে বললেন, বিপ্লব হলে এরকম নায়িকাদের পাওয়া যাবে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

 

পড়তে পড়তে সুন্দর লিখতেও শুরু করলেন মান্নান ভাই। কী সব কঠিন কঠিন প্রবন্ধ। বোঝার ক্ষমতা নেই। শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ এলেন ফরিদপুর। জসিমুদ্দিন হলে মান্নান ভাই তার সম্মানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শীর্ষক একটা প্রবন্ধও পড়ে এলেন। সেটা পরে ছাপাও হল পুস্তিকা আকারে। ডিসি সাহেব সব স্কুলের টিচারদের কাছে প্রবন্ধটি পাঠিয়ে দিলেন। তাদের বেতন খেকে পুস্তিকাটির দাম কেটে নেওয়া হল।

 

এ সময় তার অত্যন্ত প্রিয় গান হয়ে উঠল এসডি বর্মনের-

শোনোগো দক্ষিণ হাওয়া

প্রেম করেছি আমি

 

সমস্যা হয়ে গেল আমাদের এই শহরের সব লোকই মান্নান ভাইকে মান্নান ভাই বলেই ডাকে। সমীহ করে চলে। মেয়েরা তাকে দেখলেই কাতর হয়ে পড়ত। তারা ঘেমে উঠত। তাদের শ্বাস ঘণ হয়ে যেত। তাদের চোখের সামনে বটি হাতে মান্নানের চেহারাটি ফুটে ওঠত। কোনো গোলাপ নয়। মান্নান ভাই দমলেন না। পাড়ি দিলেন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন। কিভাবে ভর্তি হলেন- সে এক রহস্য। একদিন বললেন, নতুন গান শিখছি-- নব প্রাণ আন্দোলনের গান। গেয়েও শোনালেন দুএক কলি।

 

‘বৃষ্টি বাদল দুই ভাই বোন শহর দেখতে আসে

বড়লোকদের গাড়িগুলো সব কাছিমের মতো ভাসে

ভাই বলে বোন বোন বলে ভাই আজ স্কুল থাক

বড়লোকদের গাড়িগুলো সব বন্যায় ভেসে যাক...’

 

কানের মধ্যে ঢুকল না। মাথার উপর দিয়ে সুর আর বানী চলে গেল। গানটা গুতা খেল টিএসসির ছাদে। অইখানে দুটো পাখি বসে কিচির মিচির করছিল। দুটো পাখিই ধপ করে পড়ে মারা গেল। তিনি একটি কবিতাও শোনালেন। নিজেই লিখেছেন। তিনি ঠিক করেছেন কবিতাই লিখবেন। বিপ্লবীরা সবাই কবিতা লিখতেন। এ সময় একটি মেয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে এসে পড়ল। একদম শ্রী দেবী। বলল, হাই। তার চোখে তেপান্তরের ঝিলিক। কে উপেক্ষা করে তাকে। তার দিকে দৌড়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। তিনি বিপ্লবের পিছনে পিছনে দৌড়ে গেলেন।

 

আমাদের বয়স থেমে নেই। আরও জোরে দৌড়ুতে শুরু করেছে। শিশুটি থেকে বড়োটি হয়ে গেছি। বড়োটি থেকে বুড়োটি হয়ে যাচ্ছি। বিপ্লব কিন্তু সেই কচি খোকাটি। বিপ্লবের বয়স বাড়ে না।

 

একটি চাকরীর ইন্টারভিউ ছিল ঢাকায়। ভোর ভোর বাসে উঠেছি। গোয়ালন্দে দেরী হয়ে গেল। নির্ধারিত সময়ে ফেরী আর ছাড়ে না। লোকজন উসখুস করছে। ফেরীর লোকজন বললেন, স্যার নামাজ পড়ছেন। শেষ হলেই ছাড়া হবে।

 

ফিরে এলেন স্যার। চমৎকার স্যুটেড বুটেড। স্যারের কপালে দাগ পড়েছে। মাথার টুপিটা ঠিক করলেন। জিন্নাহ টুপি। পকেটে উকি দিচ্ছে মওদুদীর বই। সরকারী গাড়ি। আমার দিকে একবার তাকালেন। একটা কার্ড দিলেন। সচিবালয়ে পোস্টিং। পাশে ভাবি। বোরকা পরা। মুখ ঢাকা।

 

হাত মেলালেন না। হালকা করে উঁচু করলেন। বাতাসে আতরের সুবাস। মুখে তোরাবোরা পাহাড়ের হাসি। একটু জেগেই উবে গেল। মনে হল মৃদু স্বরে বললেন, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।

তিনি কী সত্যি সত্যি বলেছিলেন-- বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক। না কি ভুল শুনেছি? ধাঁধা লেগে গেল।

 

কোনো বটি নয়-- তার হাতে তখন একটি বই। খুব আদব লেহাজের সঙ্গে পড়ছেন একটি লোকের আত্মজীবনী-- একাত্তরে আমরা ভুল করিনি। ছবিতে লেখক খুব সহি সালামতে রাও ফরমান আলী আর টিক্কা খানের সঙ্গে বসে আছেন।

 

বিপ্লবীরা কখনো ভুল করেন না।

বৃত্তার্পিত গান

তানিম কবির

ঘরময় হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বাতি জ্বালালাম। ঘড়িতে তিনটা বেজে একুশ। ‘ক্যান, তোমার চোখ নাই? ভালা কথা তুমি দেহ নাই, প্যাকেটটা ফালানের আগে একটু নাইড়া চাইরাও দেহন যাইতো না, কোনও শব্দ করেনি?’ আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। ‘ক্যামনে কি করবা তুমি জানো,আমার সিগ্রেট চাই- সোজা কথা।’‘কইলামতো খেয়াল করি নাই, বাদ দেয়ন যায় না? ঘুমাও না, কি অইবো অহন না খাইলে?’ ‘ফালতু কথা কবি না, আমার সিগ্রেট দে’। ‘তুই তোকারি করতাছো ক্যান?’ ‘চপ- লাট সাহেবের বেটি আইছে, তারে হুজুর হুজুর করতে হইবো।’ ‘কইলামতো আর এমন হইবো না, আজকে ঘুমাও।’ ‘না। তুই অক্ষন আমার সিগ্রেট দিবি, এতো কিছু বুঝি না- মাগীর ঘরের মাগীর শইলে বাতাস লাগে না, না? গায়ের চামড়া তুইল্যা ফেলমু অক্ষন সিগ্রেট না পাইলে।’ ‘আইচ্ছা আমি কইত্তে পামু অহন সিগারেট?’ প্রথমে চর এবং পরে মিহিস্বরের কান্নার শব্দ ভেসে এলো কানে। আমি খুব বেশি অবাক হলাম না। বাবা মাকে মারছেন আর মা কান্না করছেন- আমাদের ঘরের দেয়াল বাসিন্দা সবগুলো টিকটিকির কাছেও এটা কমন একটা ঘটনা। তবুও আমি এগিয়ে গেলাম। দরজার এপাশ থেকে বললাম ‘বাবা, থামেনতো এলা, টাকা দেন- আমি আইন্যা দিতাছি।’ বাবা বের হয়ে এলেন। অভিযোগের ভঙ্গিতে বললেন ‘দেখছোস কাণ্ডটা? তিনডা সিগ্রেট লইয়া আইছিলাম। ভাত খাওনের পর একটা আর ঘুমানের আগে একটা ধরাইলাম। পাকনা ঘুমডা ভাঙলো খারাপ খাব দেইখ্যা। উইঠ্যা পানি খাইলাম এক গেলাস। সিগ্রেট ধরামু কইয়া খাটেরতন নামলাম, কিয়ের সিগ্রেট? সব খা খা করতাছে ...’ ‘থাক থাক, আমনেরে অহন ব্যাবাক কিচ্ছা কইতেন কইছি না, টাকা দেন লইয়া আসি।’ ‘এতো রাইতে দোকান খোলা পাবি?’ ‘পামু, আমনে দেননা ...’ বাবা ভেতরে গেল টাকা আনতে, মার কান্নাও থেমে গেছে স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী। বাবা আমাকে এমন সমীহ করার মানুষ না। আমাকেও মাগীর পুত বলে গালি দিয়ে ওঠাটাই ছিলো তার জন্য স্বাভাবিক, কয়েকদিন আগে মিহির রোডের খানকি পাড়া থেকে আমি বাবাকে বেরুতে দেখি, বাবাও দেখেন আমায়। তারপর থেকেই হঠাৎ করে এই অপ্রত্যাশিত ব্যবহার পেয়ে আসছি। আমার ভালোই লাগে। আমি আসলে বাবার ভয়টা উপভোগ করি। অবশ্য বুঝতে পারি না বাবার ভয়টা কি নিয়ে। মাকে যদি বলে দিই? কিন্তু সেটার কোনও প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাই না। বাবাতো মাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। ব্যাপারটা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। ‘নে, দুইডা আনলেই হইবো, আর তুই চা বিস্কিট কিছু খাইস।’ আমি বেরিয়ে গেলাম।

আমার নাম কদর। শবে কদরের রাতে জন্ম হয়েছিলো বলে দাদা এই নামকরণ করেছিলেন। আগে পিছে আর কিছু নাই। শুধুই কদর। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। পড়াশোনার খরচ চলে টিউশনি করে। কলেজ আর টিউশনির সময় বাদ দিলে যা থাকে তার সবটুকুই ঢালি পার্টি অফিসে। আমি কলেজ শাখার গুরুত্বপূর্ণ একটা পদও দখল করে আছি। আমার পার্টি- স্বপ্ন দেখে এবং বিশ্বাস করে কম্যুনিজমে। আমিও দেখি- স্বপ্ন দেখি, বিশ্বাস করতে কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করি। পার্টি অবশ্য এসব স্বপ্ন ও বিশ্বাস নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করে না। আমরা কর্মীরা সম্ভবত স্বপ্ন আর বিশ্বাসের মাঝখানের ফারাকটুকু বুঝতে চাই না। আমরা একদল অবিশ্বাসী স্বপ্নবাজ। বিশ্বাসের মোড়ক লাগানো স্বপ্নগুলোকে পোস্টারে এঁকে দিই অথবা দেয়াল লিখন অথবা মিছিলে অথবা মিটিংয়ে অথবা আহ্বানে। আমি হাঁটছি। যাচ্ছি স্টেশন রোডের দিকে। ওদিকে কিছু দোকান-পাট খোলা থাকে রাতভর। আর দোকানে বসে থাকা ক্লান্ত দোকানিরা আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝখানে বুনতে থাকে স্বপ্ন। আমার জানতে ইচ্ছে করে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের স্ব-স্ব স্বপ্নের উপর কতোটুকু বিশ্বাস স্থাপন করেছে আজ অবধি। নীরব রাস্তা। আমি আমার হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার এগিয়ে যাওয়া শব্দে রূপান্তরিত হচ্ছে- আমি উৎসাহ পাই। হণ্টনের উপর আমার আস্থা আসে, আমার মনে হতে থাকে মানুষ এগিয়ে যেতে পারে আর এগিয়ে গেলে যে শব্দ সৃষ্টি হয়- সেই শব্দও অলীক নয়। আমার ভালো লাগে। এবার আমার রাস্তা দ্বি-খণ্ডিত হয়ে যায়। রেললাইন ঘেঁষা রাস্তাটিই আমার। আমি সেদিকেই পা বাড়াই। ঐতো দেখা যাচ্ছে স্টেশনের সিগনাল বাতি। একটানা তিনটা সিগনাল পয়েন্ট। দুটোতে জ্বলছে লাল, একটিতে সবুজ। পেছন ফিরে তাকাই। অনেক দূরে ট্রেনের লাইট দেখা যাচ্ছে। আমি আবার হাঁটতে থাকি। শব্দ করে হাঁটতে থাকি- স্বপ্ন আর বিশ্বাসের মাঝখান দিয়ে যেমন শব্দ করে হাঁটতে থাকে সন্দেহ, তেমনি। বাবার কথা মনে আসে। এতক্ষণে নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়েছে, আর কোনও খারাপ খোয়াব না দেখলে এই ট্রেন চলবে বিরতিহীন- সকাল নয়টা অব্দি। আমার আসলে বের হতে ইচ্ছে করছিলো, নয়তো আগ বাড়িয়ে বাবার উপকার করার মতো সুবোধ ছেলে আমি কখনোই না। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেট বের করি। গোল্ড লিফ। কাঠির বারুদে আগুন জ্বলে ওঠার শব্দ কিছুটা অপ্রস্তুত করে দেয়। ট্রেনটাও হুইসেল বুনলো টানা তিনটা। আমি আবারো হাঁটতে থাকি। নিহারের সেলুনটা বন্ধ। এখানেই ছোটনের সাথে শেষ দেখা। ও চুল কাটছিলো আর আমি বসে ছিলাম পাশের চেয়ারে। ‘একদম ভাববি না আমি চলে গেছি। ওখানে গিয়ে ডলার কামাবো দেদারসে, মাসে যা কামাবো তার অর্ধেক পাঠাবো পার্টির জন্য- দেখিস’- বলছিলো ছোটন। কলেজ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ আরেক সদস্য। আমার হাসি পায়। ছোটন গেছে আজ এক বছরের বেশি হতে চললো। পার্টির কারো কাছে একটা চিঠি দিয়েছে বলেও শোনা যায়নি। আমি একবার গিয়েছিলাম ওর বাসায়। ঠিকানা চেয়েছিলাম। ওরা আমাকে আগে থেকেই চিনতো। হয়তো সে কারণেই

ঢুকতেও দেয়নি গেটের ভেতর। ঠিকানা চাইতেই বললো- ‘ক্যান আইছো আবার, পোলাডার মাথা খারাপ করতে? যোগাযোগ করবা? চিঠি লিখবা? কোনও কাম নাই- যাও, যাও।’ সেখান থেকে ফিরতে গিয়েই প্রথমবার মনে হয়েছিলো কথাটা- আমরা কি সত্যিই বিশ্বাস করি আমাদের স্বপ্নগুলোকে?

এখন আমি আবার নতুন করে ভাবতে থাকি। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমার হেঁটে যাওয়ার শব্দ, তারমানে এগিয়ে যাওয়া ...। আচ্ছা কেন ভাবছি, শব্দই সত্য? জানি না। কিন্তু আমার ভাবতে ভালো লাগে। বিশ্বাস আর স্বপ্নের দূরত্ব বিলীন হতে থাকে। এগিয়ে যাওয়ার শব্দের ভেতর আমি আমার সমস্ত অবিশ্বাসগুলোকে মাটি-চাপা দিতে থাকি। আমি হাঁটতে থাকি ...। হাঁটতে হাঁটতে হয়তো একটু ঘুমিয়েও নিই। লম্বা হুইসেল বাজিয়ে বাজিয়ে ট্রেনটা এবার খুব কাছাকাছি। আমি জেগে উঠি। ধুলো উড়িয়ে ট্রেনটা তুমুল গতিতে চলে যেতে থাকে আমার পাশ ঘেঁষে। আমি সম্বিতজ্ঞান ফিরে পাই, লক্ষ্য করি এবার আর শুনতে পাচ্ছি না আমার এগিয়ে যাওয়ার শব্দগুচ্ছকে। আমি শংকিতবোধ করি। মুঠোবন্দি হাত তুলে চিৎকার করে উঠি- ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো ...’ আমি টের পাই আমার ঠোঁট নড়ছে- কিন্তু ট্রেনের হুইসেল আর গতির শব্দের নিচে কাটা পড়েছে আমার কণ্ঠ-বিশ্বাসহীন স্বপ্ন। আমি কেঁদে উঠি, অথচ ... অথচ আমার কান্নার শব্দও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল আর গতির শব্দের কাছে।

রক্তজবার ঘ্রাণ                                           

জায়েদ ফরিদ

    ঘুম থেকে ঊঠে কাউকে কিছু না বলেই হেঁটে যাই এক মাইল দূরের রেল স্টেশনে। একরাশ ধোঁয়ামেঘ ছড়িয়ে পুরনো একটি কয়লার ইঞ্জিন এসে থামে, প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে বেশ খানিকটা দূরে। লাইনের দুপাশে দাঁড়ানো ছাইমাখা কয়েকটি পরিবারের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে- এখনি গনগনে কয়লা ঝরাবে ইঞ্জিন।

    রেলসড়কের ঢালে মজা পুকুর। সেখান থেকে এক বালতি জল তুলে এনে লাইনে দাঁড়ালো হরিদাসী। আমাকে দেখেই মিশিমাখা আয়না-দাঁত বের করে হেসে উঠলো-‘কি গা হৃদ ভাই সাতসকালে ইশটিশান পাড়ায় কী মনে করে?’

-‘তোমাকে দেখতে এলাম হরিদাসী, মুখার্জ্জী বাড়ির কাজ ছেড়ে দেয়ার পর শুনেছি স্টেশনে কয়লা কুড়িয়ে ভালোই চলছে তোমার।’

-‘হ্যাঁ তার আশির্বাদে ভালোই আছি, বলতি পারো।’

    ঘটাংঘট আওয়াজ তুলে ট্রেনটা চলে গেলো। কয়লার স্তূপে ঝাঁপিয়ে পড়লো কয়েকটি পরিবার। একটি মাঝারি স্তূপের অঙ্গারে জল ঢেলে দিলো হরিদাসী। পটাপট ঝাঁকায় তুলতে থাকলো পোড়া কয়লার টুকরো। আমিও যোগ দিলাম সাথে। ঝাঁকা নিয়ে এবার সে রওনা হলো স্টেশনের পেছন দিকে চায়ের দোকানে। ছাই-কালো হাতগুলো ধুয়ে নিলো মজা পুকুর থেকে।                                                                   

                                                                                  

    জীবিকার জন্য শেষ কাজটি বেশ সহজ মনে হলো আমার। বাবার প্রস্তাবিত চারটি কাজের এটিই সর্বশেষ। এখানেও ফেল হলে নির্ঘাত ফিরে যেতে হবে পড়াশোনার জেলখানায়।

    খুব খিদে পেয়েছে। সেই সকাল থেকে এখন পর্যন্ত পেটে দানাপানি পড়েনি। বাড়িতে সবাই হয়তো নাশতার টেবিলে বসে পরোটা-ভাজি অথবা ভুনা খিচুরি খাচ্ছে। পেটের ভেতরটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে আমার। খাওয়া দাওয়ার ঝামেলা না থাকলে জীবনটা অনেক উপভোগ্য হতো মানুষের।

    যেতে যেতে জিজ্ঞেস করি তাকে,-‘আজ সকালে কী দিয়ে নাশতা করেছো হরিদাসী?’

আশ্চর্য হয়ে কোমর থেকে ঝাঁকা নামালো সে,-‘আমার আবার নাশতা, করিচি আপিং দিয়ে।’

-‘আপিং কি হরিদাসী?’

    কোমর থেকে সে বের করলো একটি ছোট কৌটো। কালো জেব্রা দাগের চেরিব্লসমের কৌটো। সেখান থেকে দু’আঙুলের মাথায় সামান্য একটু পদার্থ নিয়ে যত্ন করে ঘষে ঘষে সে তৈরি করলো একটি ছোট সরিষা-দানা। হাতের তালুতে রেখে বললো-‘এই আমার নিত্যিকার নাশতা, এর এক দানা খেলি দুপুর তক আর খিদে লাগতি পারে না’।

    সরিষার দানার মত আফিম দিয়ে নাশতা করার ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। কয়লা কুড়িয়ে জীবিকা অর্জন করার প্রস্তাবটা তেমন খারাপ ছিলো না। হাত কালো হলেও তা অনায়াসে ধুয়ে ফেলা যায়-জেলে বউয়ের হাতের রঙ তো নয়! আফিম দানার পুতুল নাশতাটা আমাকে আরো ক্ষুধার্ত করে তোলে।

.

    ব্যর্থতার চুনকালি মেখে আমি ভারী পায়ে অগত্যা পুরনো জেল-ঘরের দিকেই হাঁটতে থাকি। কয়েদি হলেও সেখানে খাওয়া-দাওয়ার কোন অসুবিধা নেই। কেবল স্মৃতিশক্তি ধারালো করার জন্যে আয়ূর্বেদের ব্রাহ্মীশাক রসায়নটা নাক টিপে গিলতে হয়। কিন্তু রুই মাছের মুড়ো, ঠ্যাংসহ গলদা চিংড়ি, এসব তো অনায়াসলভ্য।

   পাকা এক মাইল পথ হেঁটে যেতে হবে- ততক্ষণ কি বেঁচে থাকবো? পকেট হাতড়ে রাস্তার ধার থেকে ফুলুরি কিনে হতাশভাবে হাঁটতে থাকি বাসার দিকে।

    বাসার সামনে বিরাট দুটো দেবদারু গাছ। এত মোটা যে তিনজন লাগে বেড় দিতে। সেই গাছের খদ্দর গায়ে ঘুঁটে দিচ্ছে আমার প্রিয় দুটো ঘুঁটেকুড়োনি মেয়ে। প্রথমে একটি গোল তারপর তার চারদিকে আরো ছয়টি গোল- এভাবেই নক্সা বানিয়ে যায় ওরা। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম- এই নক্সাটা  তারা কোথা থেকে শিখেছে? ওরা বলেছিল, এই নক্সা শিখতে হয় না, ঘুঁটে দিলেই হয়।

একদিন কিউটিকুরা পাউডারের কৌটার মুখে এরকম নক্সা দেখে ভেবেছিলাম- পাউডার কোম্পানির নক্সাকারী আগে নিশ্চয়ই ঘুঁটেকুড়োনি ছিলো। এ ব্যাপারে অনুমানটা মেলেনি তবে এখন বুঝতে পারি গ্রাফিক আর্টস্-এর প্রতি আমার আগ্রহটা সেখান থেকেই।

    ঘুঁটেকুড়োনিরা ঘুঁটে দেয়া রেখে আমাকে সমানে প্রশ্ন করে চলেছে- কেন এতদিন তাদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ এবং খেলাধুলা বন্ধ রয়েছে। তাদের ঔৎসুক্য নিরসনে আমি এ গল্পের বাকি অংশটুকু বলেছিলাম।

                                                                         

    সাতদিন আগে নাশতার টেবিলে বাবা আমাকে একটি খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন- ‘এর ভেতরে একটি ট্রেনের টিকেট আর কিছু টাকা আছে, এগুলো তোমার। আমরা চিন্তা করে দেখেছি- লেখাপড়া সবাই করতে পারে না, এর জন্যে মনকে তৈরি করতে হয়। অনেক বলা কওয়া আর মারধোর করা সত্বেও যখন তোমার মতিগতি স্থির হয়নি তখন আর কি করা। অভিভাবক হিসেবে তোমার ওপরে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে তাই তোমাকে আমরা স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের জন্যে চারটে পথ বাৎলে দিতে চাই। তুমি গভীরভাবে এই পথগুলো সম্পর্কে ভেবে দ্যাখো, হয়তো এর কোন একটিতে তোমার মন স্থির হতে পারে। প্রথমত তুমি গ্রামে গিয়ে তোমার চাচার সঙ্গে হালচাষ করতে পারো। কাজটা তেমন কঠিন নয়। তোমার বয়সের অনেক ছেলেই এ কাজ করছে। কাজটা মনঃপূত না হলে তোমার চাচার বাড়ির পেছনে জেলে পাড়ায় খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে পারো। মৎস্যজীবী হওয়া মন্দ নয়। তুমি সাঁতার জানো, এ বয়সেই দলেবলে খাল-বিল, আত্রাই নদী পার হতে শিখেছো, অতএব আমাদের তেমন দুশ্চিন্তাও থাকবে না। গ্রামের দুটো কাজেই বিফল হলে তুমি শহরের আরো দুটো কাজ করার সুযোগ পেতে পারো। বাসার সামনে বড় মাঠটার কোণে আমগাছের নিচে একটি ছোট মুদির দোকান আছে। এ রকম একটি দোকান তোমাকেও যোগাড় করে দেয়া যাবে, সংসারের একটু খরচ হলেও। বেচাকেনা অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, হয়তো তোমার ভালো লাগতে পারে।  আর যদি তাতেও তুমি অপারগ হও তবে শেষমেষ রেলস্টেশনে কয়লা কুড়োতে পারো। শুনেছি, প্রতিবেশী মুখার্জ্জী বাড়ির পাচিকা হরিদাসী রাঁধুনীর কাজ ছেড়ে কয়লা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ কর‌ছে। আমরা তাকে জানি এবং তুমিও। নিমপাতা আর চিনি ছিট দেয়া শুক্তো রান্না করে সে কয়েকবার আমাদের খাইয়েছেও। দুপুর বারোটায় ট্রেন, এখনো তিনঘন্টা বাকি। রেডি হয়ে নাও, স্টেশনে যাবার জন্যে রিকশা নিতে পারো, তবে হেঁটে গেলে কিছু পয়সা বেঁচে যাবে তোমারই।’

    নাশতার টেবিলে গম্ভীরভাবে সবাই আমাকে দেখছে, কেউ কোনো কথা বলছে না। একটা বেতের বাক্সে সামান্য জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে কাউকে না বলে যখন রাস্তায় বেরিয়েছি তখন ছোটবোন মিনু এসে বললো, ‘ভাইয়া তোমার ঠাণ্ডা লাগবে, চাদরটা নিয়ে যাও, আর একটা কথা– ভোরবেলা জবা ফুল নিতে এসে জ্যোতি যদি তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, তবে কী বলবো?

-‘বলবি, জ্যোতি একটা পাগলী, জবা ফুলে গন্ধ আছে একথা কেবল ওই মানে আর কেউ না।’        

    ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে সেই রাতে আমার মনে হলো কেবল মিনু আর জ্যোতির কথা। কাল সকালেই হিমেল কুয়াশা মেখে সাদা ফ্রক পড়ে জ্যোতি আসবে ফুল নিতে, আমাকে খুঁজবে মগডাল থেকে ফুল পেড়ে দিতে। মিনুর হাত থেকে প্রথম ফুলটি নিয়ে এভাবে সে গন্ধ শুঁকবে যেন বসরাই গোলাপের তীব্র গন্ধে ডুবে যাচ্ছে সে। বিস্তৃত পাঁচ পাপড়ির ফুলটা যখন সে ধরে রাখবে বুকের সামনে, মনে হবে একটি অনন্য সূর্যোদয়। সে সূর্যোদয় আমি দেখতে পাবো না।

                                                                               

    ট্রেন থেকে নেমেই ছুট। গ্রামের বাড়ি পৌঁছুতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেলো। যাত্রার ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম এলো না- কাল সকালেই প্রথম প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

    কুয়াশাঢালা মাঠে সারি সারি লাঙল চলছে। পরিচিত এক চাষীর হাত থেকে প্রায় জোর করেই লাঙলটা নিজের হাতে তুলে নিই আমি। হাতলটা সামান্য উঁচু হলেও ভারসাম্য রক্ষা করাটা তেমন কঠিন নয়। ইস্পাত ফলার ধারে অদ্ভুতভাবে চিরে যাচ্ছে নরম মাটির বুক। উল্টে যাওয়া মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ছে পোকামাকড়, এমনকি দু-একটি ছোট কচ্ছপও। লাঙলের আলে পেছনে পেছনে হাঁটছে শাদা বক। ঠুকরে ঠুকরে আঁধার গিলছে।

    অন্যমনস্কভাবে পেছনে বকের সারি দেখতে গিয়ে ঘটে গেলো বিভ্রাট। হাম্বা শব্দে চিৎকার করে উঠলো একটি বলদ। লাঙলের ফলা লেগে রক্তাক্ত হয়ে গেছে বলদের পেছনের পা। চাষী তেড়ে এলো, আমি এক ছুটে গ্রাম পার।

    এরপর আর কখনো লাঙল ধরা হয়নি। লাঙলের ক্ষেতে তবুও হেঁটেছি আমি- কেবলই বক দেখার জন্যে।   একদিন বিকেলে রওনা হই পার্শ্ববতী জেলেদের গ্রামে। মৎস্যজীবী হওয়া, অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্যেই ওখানে যাওয়া। গ্রামের মুখে হালকা জঙ্গল পার হতেই দেখি- টকটকে হলুদ এক জেলেবউ। আমগাছের নিচু ডাল থেকে ঝুলছে একটি মাছ ধরা জাল। জালের প্রান্তভাগ সে অনবরত ডুবিয়ে চলেছে একটি মাটির চাড়িতে। চাড়ির ভেতর চকোলেট রঙের পানি। জেলেবউ কাজে ব্যস্ত, আমাকে সে খেয়াল করে না। অনেকক্ষণ তার জাল রং করার কায়দাটা লক্ষ্য করি আমি। জাল ছড়ানোর সময় কখনো কখনো জেলেবউ জালের ওপাশে চলে যায়। মনে হয়, কোন মৎস্যকন্যা জালে আটকে পড়েছে। কিন্তু হাতের তালু দুটো তার কুচকুচে কালো। জেলেবউকে খুব কুৎসিৎ মনে হয় আমার। এমনকি চাচীর রান্নাঘরে কালো রঙের ঢেঁকি পাড় দেয়া মেয়েটির চেয়েও। জেলে বউ হয়তো ইচ্ছে করেই হাত কালো করে, কে জানে কি দিয়ে!

    জেলেবউয়ের জাল ছড়ানো শেষ। একবার পড়ন্ত বেলার দিকে আর একবার বাড়ির দিকে তাকায় সে। আমি দৌড়ে যাই তার কাছে। ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞেস করি –‘ আচ্ছা তোমার গা টা হলুদ, কিন্তু হাতদুটো কালো কেন?’জেলেবউ লজ্জা পায়, তবু বলে- ‘গাবের কষ বাপু, ইহজন্মে এ রং যাবার লয়।’

    আবার প্রশ্ন করি তাকে- ‘জেলেরা কি তবে গাবের কষ দিয়ে গোছল করে? সবাই এতো কালো কেন ?’

জেলেবউ হেসে গড়িয়ে পড়ে, উচ্চস্বরে জেলেকে ডাকে- ‘দেখে যাও, শুনে যাও পাগল ছেলেটার কতা।’

ততক্ষণে আমি হাওয়া।

শহরে ফিরে আসি পরদিনই।                                      

   বাসার সবাই আমাকে লক্ষ্য করে কিন্তু কিছুই তেমন বলে না। আমার ব্যর্থতার গল্প কাউকে বলি না, এমন কি মিনুকেও।

একসময় মিনু বলে-‘তুমি  যাবার পর জ্যোতি একদিনও আসেনি।’

-‘না আসুক।’

   আমার মাথায় তখন শহরের শেষ প্রস্তাব দুটো জেঁকে আছে- আজ মুদির দোকানে অবশ্যই যেতে হবে।

দোকানের কাছে পশু চিকিৎসালয়। আমি সারা সকাল হাসপাতালের খোলা বারান্দায় বসে মুদির কাজকর্ম মনোযোগ দিয়ে দেখি। বেচাকেনা মন্দ নয়, কাজটাও কঠিন নয়। কিন্তু মুদির চেহারা-স্বাস্থ্য নিয়ে আমি বিপাকে পড়ি।

   দোকানে ক্রেতা না দেখে মুদির কাছে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করি- ‘আচ্ছা তোমার পা-গুলো মুলি বাঁশের মতো এত সরু সরু কেন ?’

মুদি বলে- ‘খোকাবাবু, তোমরা হেসে খেলে বেড়াও, ছুটোছুটি করো তাই তোমাদের পায়ের গোছা মোটা। আমার কি আর উপায় আছে? বেচাকেনা না হলি পেট চলবে কি করে। সারাদিন একঠায় বসে থাকি, তাই পা-দুটো শুকোয় গেছে।’

-‘আর একটা কথার উত্তর দেবে ?’-‘কী কথা ?’

-‘তোমার মুখটা অর্ধেক শাদা আর অর্ধেক কালো কেন ?’

    মুদি লজ্জা পায়, তবু বলে- ‘সকালে দোকানের ঝাঁপ খোলার পরে বাঁদিক থেকে রোদের আলো পড়ে দুপুর তক, তাই এ পাশটা কালো হয়ে গেছে, কোনো উপায় নেই- ঝাঁপ না খুললি ব্যবসা হবে কি করে?’

গরীব মুদির জন্য আমার খুব দুঃখ হয়।

আমি তাকে পরামর্শ দিই- ‘তুমি সামনের এই হাসপ[তালে শরীরটা দেখাও না কেন?’

মুদি সরু গলায় খনখন করে হেসে ওঠে- ‘চলো দুজনেই না হয় একত্রে গা-মাথা দেখিয়ে আসবো একদিন।’

    মুদির বিচিত্র শাদা-কালো কিম্ভূত মুখ আর সরু সরু হাত-পা আমাকে ভূতের মত তাড়া করে ফেরে। মনস্থির করি- কাল সকালে একবার শেষ প্রস্তাবটি পরখ করার জন্যে রেলস্টেশনে যেতে হবে।

    স্টেশনের গল্প শেষ হলে ঘুঁটেকুড়োনিরা জানালো- ‘লেখাপড়া করাই সবচে সহজ কাজ, সুযোগ থাকলি আমরাও লেখাপড়া করতাম।’

    চোরের মতো গৃহে প্রবেশ করলাম আমি। কাউকে কিছু না বলে পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসে পড়ি। ব্যর্থতার গ্লানিতে ঘুম আসে না। একা আমার ছোট ঘরে জানালায় মুখ রেখে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকি সারারাত।

    কুয়াশার কারণে সেদিন সূর্য উঠতে অনেক দেরি। ঘোলা অন্ধকারে একটি শাদা মূর্তি এগিয়ে আসে বাগানের জবা গাছের কোণা থেকে- ঐ তো জ্যোতি এসেছে ফুল কুড়োতে। তার শাদা বুকের জমিনে তখন রক্তজবা সূর্য উঠছে। আমাকে দেখে মিষ্টি হাসলো সে। গভীর করে গন্ধ নিলো জবা ফুলটার, তারপর বললো- ‘খুব ভালো করে শুঁকে দ্যাখো হৃদ্ ভাই- জবা ফুলের কত ঘ্রাণ।’

    আমি জবা ফুলটা জানালার শিক গলে হাতে নিই। দুচোখ বন্ধ করে নিবিড়ভাবে ঘ্রাণ নিই জবাটার। নাসারন্ধ্রপথে আমার সমস্ত শরীর-বেলুন ভরে ওঠে অদ্ভুত ঘ্রাণে। জবার গন্ধ আবিষ্কারের আতিশয্যে আমি চোখ খুলে চিৎকার দিতে চাই, কিন্তু জ্যোতিকে দেখতে পাই না কোথাও।

    সকালে নাশতার টেবিলে মিনুকে বলি- ‘আজ খুব ভোরে জ্যোতি এসেছিল ফুল কুড়োতে।’ মিনুর চোখ ছলছল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে হেঁটে গেলো সে- ‘মিথ্যে বলো না ভাইয়া, তুমি যাবার পরদিন থেকে কেউ আর জ্যোতিকে খুঁজে পায়নি।’

ময়ূরপঙ্খী রাতে কলঙ্কছায়া

সনোজ কুণ্ডু

ফুলজান এই গ্রামের বউ। বিয়ে হয়েছে দু’বছর। স্বামী আমিনুল চেয়ারম্যানের জমি বর্গা চষে। পাটের মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় কামলা খাটতে যায়। স্বামীর এই সামান্য রোজগারের ওপর ভরসা রাখতে চায় না ফুলজান। নিজেও এ-বাড়ি সে-বাড়ি গিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভেনে সংসার চালানোর অংশীদার হয়। গৃহস্থকে এক মন চাল বানিয়ে দিতে পারলেই তিন সের নিজের ঘরে আসে।

গায়ে খেটে সংসার চালানোর সেই মধুর সুখ কপালে সইলো না ফুলজানের- কয়েকদিনের ভেতর কালা মেম্বর নিজ বাড়িতে বসায় ধান ভাঙার কল। ভোরের আলো ফুটতেই ধপ্ ধপ্, ধপ্ ধপ্ শব্দে ধান ভাঙতে লাইন পড়ে যায় কতো চেনা-অচেনা মানুষের। কিছুদিন যেতে না যেতে কালা মেম্বরের লিকলিকে শরীরটায় নতুন রঙের জিল দেয়। মুখের পান শেষ না হতেই আরেক খিলি গুজে লাল টকটকে ঠোঁট বানায়। জিহ্বা দিয়ে সে পান অদ্ভূত ভঙ্গিমায় নেড়ে দমে দমে উচ্চারণ করে-

মন প্রতি পনের টাকা।

সাদা পয়সা ঝন-ঝনিয়ে ওঠে মাজায় গিট দেয়া খুতির ভেতর। ইচ্ছে করেই মুঠি মুঠি পয়সা হাতে নিয়ে কচলায়, নিজের মনকে নাচায় আর শব্দ করে মানুষকে শোনায়। অল্পদিনের ব্যবধানে কালা মেম্বরের টালির ঘর থেকে মাথার ওপর ওঠে দোতলা টিনের ঘর। আগের দুই বউয়ের সন্তান না হবার অজুহাতে ঘরে আনে তিন নম্বর বউ মরিয়মকে।

পরের সুখ দেখে ঘরে বসে কপাল চাপড়াতে রাজী নয় ফুলজান। ইউনিয়ন পরিষদের নারী শ্রমিকের খাতায় নাম লেখায় সে। প্রকল্পের কাজ শুরু হলেই রাস্তা-কালভাটে মাটি ভরাটের কাজে লেগে যায়। হাঁটুর ওপর কাপড় বেঁধে সাওতালী বেশে নেমে পড়ে মাটির উদোম বুক খান খান করতে। কোদালের প্রতিটি কোপে কোপে তার গচ্ছিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তবুও ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতে পেরে শুকনো ঠোঁটে ফুটে ওঠে বেঁচে থাকার হাসি। কাজ করতে করতে কপালের লাল টিপ কখন ঘামে ধুয়ে যায় সে দিকে খেয়াল থাকে না।

এইতো জীবন! নানা রঙের কাপড়ে যে হাতে একদিন ফুল তুলতো, বানাতো  নকশা করা পাটালী গুড়- সে হাতেই এখন উঠেছে কোদাল, পাথরভাঙা হাতুড়ি। কখনো ছাদ পিটানোর মোটা কাঠ।

এতোকিছুর পরেও বউকে নিয়ে আমিনুলের গর্বের শেষ নেই। ফুলজানের পরিচয়ে নিজেকে চেনাতে মন আঁকু-পাকু করে। সোনা বউয়ের মুখে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে নিজের ক্ষুধা মেটাতে পারে সে। সন্ধ্যা নামতেই ফুলজান নিজের ঘরে ফিরে আসে। কান্ত বউয়ের মুখে হাসি দেখতে আমিনুল নিজের হাতে চানাচুর- মদন কটকটি-বাদাম ভাজা আরও কতো কি খাবার মুখে ভরে গল্প বলে।

একদিন কাল কেউটের বিষাক্ত ছোবলে আমিনুলের ভালোবাসার ঘরে আগুন লাগে। সেদিন শীতের রাতে উত্তর বাতাস তাদের পড়ো পড়ো একচালা টিনের ঘরটি নাড়িয়ে দেয়। অজস্র পাতার বুক চুয়ে টপ টপ শিশির ঝরার শব্দে শব্দে রাত বাড়ে- আরও নিস্তব্ধ রাত। কখনও মাথার উপর চাঁদ দেখা টিনের ত্রিভুজ ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে দু’-চার ফোঁটা শিশির কণা তাদের দেহ-মন ভিজিয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে আচানক কেঁপে ওঠে দু’জন। ফুলজান আরও শক্ত করে আমিনুলকে নিজের লকলকে কোমল শরীরে চেপে ধরে। দুটি দেহ-মন রূপান্তর হয় এক দেহে। এক নিঃশ্বাসে। বউয়ের এতো ভালোবাসা পেয়ে আমিনুলের মন সন্ধ্যাকাশের শুকতারা হয়ে যায়-

‘তুমি আমারে এতো ভালোবাসো ক্যারে বউ? তুমারে না দেবার পারি একখান মোটা কাপড়, না দেবার পারি পেট ভইরা দুই ওক্ত ভাত!’

‘তুমি আমারে পেট ভইরা এক ওক্ত ভাত দিও। কও দিবা? আমার আর কিচ্ছু লাগবি না!’

ফুলজানকে এক ওক্ত ভাত দেবার নিশ্চয়তাও দিতে পারলো না আমিনুল। তার আগেই থানার পুলিশ এসে দরজার কড়া নাড়ে-

আমিনুলকে মিথ্যে চুরির অপরাধে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় চেয়ারম্যান  রমজান। ফুলজান কতোবার মাথা ঠুকেছিলো তার পায়ে। রমজান লোলুপ দৃষ্টিতে তার কোমল শরীরে হাত বুলিয়ে কথা দেয়, রাত পোহালেই আমিনুলকে সে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনবে। ফুলজান স্বস্তি বুকে ফিরে আসে নিজের ঘরে।

পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত অপো করার পরেও আমিনুল বাড়ি আসে না। ফুলজানের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে গভীর উৎকণ্ঠায়- স্বামী ছাড়া সাতকুলে যার কেউ নেই, তার কি ঘুম আসে? টিম টিম হারিকেনের আলোর সাথে রাত জেগে থাকে অনেক আশায়। এই বুঝি স্বামী এলো; আঙিনায় পা রেখে সোহাগ গলায় ডাকলো-

    ও বৌ, ঘুমাইছো নাকি? দরজাডা খুলো।

    হঠাৎ ফুলজানের মধুর স্মৃতি ভাঙে দরজার ঠক্ ঠক্ আওয়াজে- বাইরে ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকার। সাথে-সাথেই ভেসে আসে চেয়ারম্যানের গম্ভীর কণ্ঠ। দরজার কাছে যেতেই কী এক অশনী সংকেত তার মনে বাজে।

রমজান তা টের পেয়ে বুদ্ধির অস্ত্রে একটু শান দেয়-

‘আরে বুঝিস না ক্যা? থানায় গেছিলাম। আমিনুলের সাথে কথা হইছে। জোরে কওয়া যাবি না। আগে দরজাডা খুলেক।’

ফুলজান কাঁপা হাতে দরজা খুলতেই মর মর করে ঘরে ঢুকে রমজান। দরজার খিল মেরে চৌকিতে বসে। ঘুণে ধরা চৌকির মট্ মট্ শব্দে ফুলজানের আত্মা কেঁপে ওঠে। সে নিরুপায়। এই হিংস্র দৈত্যের থাবা থেকে নিজেকে রা করার কৌশল খুঁজতে থাকে। ভয়ে তার বুক এ মুহূর্তে মরুভূমি। একফোঁটা জল নেই; গলা শুকিয়ে কাঠ যেন! হাত জোড় করে কৃপা-প্রার্থীর মতো বলে-

‘আপনের আলার কছম- হাঁইট্যা যান। মাইনসে জানলি আমার বদনাম হবি।’

রমজান ফিক্ করে হাসে।

‘আরে হাঁইট্যা তো যাবই। পূর্ণ ভাদ্দরের গাঙের মতন তোর ওই থৈ থৈ

যৈবনে একখান ডুব না দিয়া গেলি পাপ হবিরে ফুলজান। কাইল বিয়ানেই তোর সোয়ামীরে থানায় যাইয়া ছাড়াইয়া আনবানে।’

ঘরে তার দু’ স্ত্রী। নছিমন ও ফরিদা। ছোট বউ ফরিদাকে নিয়েই রমজান সাধ আহ্লাদ মেটায়। তবুও তার তৃষ্ণা মেটে না। পরের বউয়ের দিকে নজর দেয়া এক ধরনের নেশা।

ফরিদা একদিন শ্রাবণ রাতে সাহস করে বলেই ফেলেছিলোÑ

আমি কি কোম সোন্দর? অন্য মাইয়া-মাইনসির দিক চোখ দ্যান ক্যা?

রমজানের পান খাওয়া ঠোঁটে রসিক হাসি-

অন্য মাইয়া-মানুষ দেখলি পরানের ভেতর পিরীত উছ্লাইয়া ওঠে। তোরে তো শিথানেই পাই। ফসকাইয়া যাবার ভয় নাই। আহারে! ফসকাইয়া যাবার মধ্যি কী যে সুখÑ  তুই হইলি ডোবা জলের তেউলা টাকি। বুঝবি ক্যামায়-হেই!

সোয়ামির লোমশ বুক খামচে ধরে ফরিদা-

আপনি বুঝি সমুদ্রের হাঙ্গর।

হাঙ্গরইতো! এতোদিনে বুঝবার পারিস নাই আমার পেটে কতো খিধা। তুই আর কতো খাওয়াবি?

ফরিদার সারা অঙ্গ ওলট-পালট করেও রমজানের কোথায় যেন খাঁ খাঁ শূন্যতা।

তোর উদোম সর্বনাশা বুকির মধ্যি কিচ্ছু নাইরে বউ! ওই বুকখান ব্যাঙের ছাতার ঢিবি। খালি শরীলির খায়েশ মিটাইলি হবি? একখান ছাওয়াল দেবার ক্ষমতা হইলো না।

এ অপবাদ ফরিদার ধৈর্য্যরে বাঁধকে ভেঙে চুরচুর করে দেয়। স্বামীর সবকিছু নীরবে সহ্য করলেও কী এক অসীম দৃঢ়তায় মাথার শিঁড়দাড়াকে প্রতিবাদী রূপে উপস্থাপন করে। অতি দানবীয় কথা ফরিদার ঠোঁট পিছলে বেরিয়ে যায়-

‘বাজা আপনে-!’

‘কী কইলি- আমি বাজা? আমারে তুই ডাক্তার দেহাবার কইস? আমি তোরে তালাক দিলাম। এক তালাক...দুই তালাক...’

‘আলার কছম আপনের। এতোবড় গুণার কাম কইরেন না। আলায় সহ্য করবি না।’

রমজানের মাথায় যেন কাল বৈশাখী ঝড়। যে মাতাল তাণ্ডবে এ মুহূর্তে সব ছাড়খাড় করে দেবে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে হঠাৎ করেই সে ঝড় আপাতত শান্ত। দু’চোখ বেয়ে তার অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ে। ফরিদাকে বুকে টেনে নেয়। বড় বউ নছিমনকে কাছে ডাকে।

‘জীবনের চরম সত্যি কথাটা তুমরা আইজ শুনো। ফরিদা ঠিকই কইছে। দোষ আমার। কোনোদিন আমার সন্তান হবি না। নিজের দোষ ঢাকবার জন্যি তুমাগো উপর ম্যালা অত্যাচার করছি। আমারে তুমরা মাপ কইরা দিও। আমি জানি একদিন তুমরাও আমারে ফ্যালাইয়া হাঁইটা যাবা।’

ফরিদা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে। পেছন থেকে নছিমন এসে ভালবাসার বাঁধনটা শক্ত রশি দিয়ে বাঁধতে চায়-

‘বুইনরে, সোয়ামীর সোহাগ আমার কপালে জুটে নাই। দেহের জ্বালা মিটাইয়া হাঁইটা গ্যাছে। আমি সোহাগ চাইনা। সন্তানও চাই না। মানুষটারে এইভাবে বিপদে ফ্যালাইয়া আমরা কুহানে যাবো- ক’? তোর মতো বুইন আমি কুহানে পাবো?’

অতি আনন্দে রমজানের কণ্ঠ বোবা হয়ে আসে। এতোকিছুর পাবার সুখ যে কতো মধুর! এই প্রথম বুঝলো সে। দুই বউকে বুকে জড়িয়ে অনেক ভালবাসায় হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। সোয়ামীকে তারা এভাবে খুব কমই কাঁদতে দেখেছে। এ কান্নার অশ্রু মুছিয়ে দেবার মধ্যে যে কতো সুখ, কতো আনন্দ আগে কখনই তাদের জানা ছিলো না।

 

কিন্তু তাদের স্বামী যে মানুষ রূপী একটা ছদ্মবেশী শয়তান, তা কি জানতো? এমন অনেক কছমকে সে হরহামেশা পদদলিত করেছে। কখনো পীর আওলিয়ার নামে, কখনো কোরআন ছুঁয়ে, আবার কখনো দু’বউয়ের মাথায় ডান-বাম হাত রেখে কছম করেছে। অন্ধকার রাত্রি নামার সাথে সাথেই তার শরীর যেন আদিম রক্ত উছলে উঠে। ছোট বউয়ের কোমড়ের মাংস খাবলা দিয়ে তালুবন্দী করে বলে-

‘মাইয়া মাইনসির শরীলির মধ্যি যৈবনডা বাইন্দা না রাখলি অকালে ভাটা পড়বি যে!’  

ফুলজানের পেটে তখন দু’মাসের সন্তান। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চেহারার ভেতর অন্যরকম মায়া। রমজান টিপ-টিপে হারিকেন বাড়িয়ে ফুলজানের থলথলে পেট দেখে। বা চোখটা তার ট্যারা ও ছোট ধরনের। নাক থ্যাবরানো। সারা মুখে বসন্তের চিহ্ন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঠোঁটের নীচের অংশে কাটা দাগ।

ফুলজান দরজা খুলে বের হতেই খপ্ করে তার নরম হাত ধরে রমজান। চুড়িগুলো মটমট শব্দে ভেঙে মাটিতে ছিটিয়ে যায়। ইজ্জতের ভয়ে সে চিৎকার করতে পারে না। চাপা কান্নার শব্দে বলে-

‘আপনি ছাইড়া দ্যান। ওই রকম কাজ কইরেন না!’

সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও হাত ছুটাতে ব্যর্থ হয় সে। রমজানের সুরমা আঁকা চোখে হিংস্রতার ছাপ। সদ্য কলপ লাগানো এক থোপ দাড়ি। চিলের মতো ছোঁ মেরে শাড়ীর আঁচল তার দখলে নিয়ে আসে। ফুলজানের লাউয়ের ডগার মতো লকলকে আহ্লাদের শরীরটাকে নিজের বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করে। হিংস্র থাবায় হাতের মুঠিতে নিয়ে আসে লাল বাউজের ছেঁড়া অংশ। থলথলে স্তন দুটি খামচে ধরে নেকড়ে বাঘের মতো। উন্মাদ হয়ে যৌনাঙ্গ খাব্লা দেয়। ফুলজান ঠোঁট কাঁমড়িয়ে চাপা চিৎকারে শেষ আর্তি জানায়-

 ‘দোহাই আপনের- এতোবড় সর্বনাশ কইরেন না। আলায় সহ্য করবি না। আপনি আমাগো চেয়ারমেন। গিরামের মাথা। আমার বাজানের মতোন। ছাড়েন আমারে।’

রমজানের দাঁতের তীব্র দংশনে ফুলজানের ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরে। গলায় যন্ত্রণার ধ্বনি-

‘উঃ আঃ ছাইড়্যা দ্যান।’

শক্তিতে ব্যর্থ হয়ে একসময় রমজানকে অবলিলায় দেহটা ছেড়ে দেয় ফুলজান। জাত সাপের মতো মুখে হুস হুস শব্দ করে ফুলজান বিবির শরীরের শেষ স্তরের মাংসের স্বাদ পেয়ে যৌবন জ্বালা মেটায় নিশ্চিন্তপুরের চেয়ারম্যান রমজান- ওরফে পাচু গাজী।

সাধনের যত স্বপ্ন, ইচ্ছে ইত্যাদি...

অর্ণব সেনগুপ্ত

সাধনের স্বপ্ন বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ছিন্ন নয়। সে-স্বপ্ন ভেসে যায়, ডুবে যায় চন্দ্রবাণ নদীর বুকে। কখনো কখনো বা মুখ তুলে ওঠে, যখন চন্দ্রবাণ নিজে উদ্যোগী হয়ে তার দু হাত দিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিজের বুকের ওপর রোপণ করে। চন্দ্রবাণের যে তীরের ভূমি বন্ধ্যা, বন্ধুর, যে-তীরের আধাঁরে সূর্যের উজ্জ্বল রুদ্র আলো কিংবা কোজাগরি পূর্ণিমার চাঁদের শীতল, শান্ত আলো চির ধরাতে পারেনা, যে-তীরে কারাতের শব্দের থেকে সুচোলো কোনো নৈ:শব্দ বর্তমান, সেই তীরে বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখণ্ডের খাঁজে যাপন করে সাধন। সেই যাপন ছন্দে মেলায় বন্ধ্যাত্ব, বন্ধুরতা, আলোকহীনতা, নৈ:শব্দ। পরপারে - যে পার শ্যামল বনানীতে আবৃত, হলুদ সবুজ রক্তিম গাছগাছালি, পাখপাখালির আলোয় আলোকিত থাকে রাজকন্যা। এ রাজকন্যার সারা গা ভর্তি অলংকার নেই, নেই বিশাল রাজবাড়ি, বিশাল সাম্রাজ্য, রাজপুত্র, ঘোড়া, পাইক, হাতি,বরকন্দাজ, পালকি, সৈন্য। এ রাজকন্যার সারা শরীর থেকে নারীত্বরূপী সংস্কার ঝরে পড়েনা। তবুও এ রাজকন্যা - সাধন ও চন্দ্রবাণের কাছে রাজকন্যা।আসলে ওরা মনে করে রাজকন্যা সমস্ত অস্থি, মজ্জা, পেশী, ধমনী, শিরা, হৃদ্‌পিন্ড, অন্তরে নিহিত আছে পৃথিবীর সমস্ত শক্তি, সে-শক্তি অবশ্যই জ্বালানীজাত শক্তির মতো নয়, সে-শক্তির মধ্যে নিহিত আছে বোধ, বন্ধুতা, বিশ্বাস, ভালোলাগা, ভালোবাসা, ইচ্ছেশক্তিগুলো - তাই এ শক্তি এত মৌলিক, সরল, নিষ্কলুষ। আসলে এ শক্তির কাছেই তো পরাজিত হয়েছিল সাধন, এ শক্তির সামনেই তো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েছিল সাধনের সমস্ত জটিলতা, সংস্কার। সাধন চিরকাল চন্দ্রবাণের এ তীরে বসে ভেবে যায়, স্বপ্ন দেখে যায়, ওই তীরে রাজকন্যার কাছাকাছি যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনদিনই যেয়ে উঠতে পারেনা। সাধন হয়তো ভয় পায় রাজকন্যাকে - রাজকন্যার বিরাট শক্তিকে। কিন্তু রাজকন্যা তো কোনদিনও শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করে না। তবে হয়তো সাধন ভয় পায় রাজকন্যার কাছে গেলে রাজকন্যাকে হারিয়ে ফেলার। তাই সে কখনো চন্দ্রবাণের তীর বরাবর ছুটে যায়, স্বপ্নকে বুকে আগলে ধরে রেখে, আবার কখনো বা কুটীরের জানলা দিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওই পারে রাজকন্যার কুটিরের দিকে। তারপর কখনো জ্ঞানত বা অজ্ঞানত সে-স্বপ্ন ভাসিয়ে দেয় চন্দ্রবাণের বুকে। আসলে সাধন হয়তো ভাবে এই অনন্ত ভেসে যাওয়ার মধ্যে নিহিত আছে স্পর্শিত হওয়ার সম্ভাবনা। দু পারের এই দুই কুটিরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যায় চন্দ্রবাণ – তার কোন অংশ শান্ত, কোনোটা বা খরস্রোতা, কোন অংশের জল রঙিন, আবার কোন অংশের স্বচ্ছ, কখনো বিস্তৃত, কখনো বা সরু।

চন্দ্রবাণের উত্‍স আর অন্তিমস্থলের সন্ধান জানেনা সাধন। সে শুধু দ্যাখে চন্দ্রবাণের ধারা রজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে আরও দূরে, বহুদূরে চলেছে বয়ে। চন্দ্রবাণের বুকে সাধনের যে-স্বপ্নগুলো ভেসে বেড়ায়, তার কিছু স্বপ্ন আবার রাজকন্যা নিজেকে চন্দ্রবাণের বুকে উন্মুক্ত করার সময় উদ্যোগী হয়ে সোহাগস্পর্শে স্পর্শিত করে নিয়ে যায় নিজের কটিরে। সাধনের কিছু ভেসে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, চন্দ্রবাণের বুকে মুখ তুলে থাকা স্বপ্ন এ নদীতে বাস করা মাছের পেটস্থ হয়। তারপর চন্দ্রবাণের বুকে যখন বড়ো ট্রলার আসে, সে- ট্রলারের উপর থাকে এক অশ্বরোহী। কালো অশ্বের ওপর তার উন্মু্ক্ত তরবারি এ অঞ্চলের সমস্ত পশু পাখি মাছ গাছপালা ঘাস ফুল ফল, সবার রক্তকে হিম করে দেয়।সে জাল ফেলে চন্দ্রবাণের বুকে, ধরে নিয়ে যায় মাছেদের সাধন চন্দ্রবাণ ও রাজকন্যার স্বপ্নদের। সাধন, চন্দ্রবাণ, রাজকন্যার স্বপ্ন পণ্যায়িত হয়। সাধনের স্বপ্ন মাছের টুকরোর কমড়ের মাধ্যমে মানুষের পেটস্থ হয়। চন্দ্রবাণের চোখ থেকে জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দেয় বুককে। রাজকন্যা ও সাধনের কুটিরও সিক্ত হয়ে ওঠে। সিক্ত হয় আকাশ। সিক্ত হয় মাটি। সিক্ত হয় গাছপালা। পশুপাখি। তারা পরপস্পরকে আলিঙ্গন করে। একে অপরকে সিক্ত করে। তাদের শরীরে জল ছিটোয় চন্দ্রবাণ। তাদের হিম রক্ত ক্রমে তরল হয়। রাজকন্যা চন্দ্রবাণের বুকের জল মুছিয়ে দেয়। চন্দ্রবাণ স্পর্শ করে প্রথমে রাজকন্যার চোখ, তারপর গাল, তারপর বুক। তারা পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। সিক্ত করে। অম্নি মাটি কেঁপে ওঠে, আকাশে বজ্র বিদ্যুত্‍ হয়। চরাচর জুড়ে তখন শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। আদিম কোন ছন্দে সমস্ত গাছের শরীর দুলে ওঠে। দুলে ওঠে শরীর পশুপাখিদেরও। তারা ভুলে যায় সংস্কার, নিষেধের অতন্দ্র পাহারা। রাজকন্যার ঠোঁট চন্দ্রবাণের বুকে ছায়া আকেঁ। আর চন্দ্রবাণের ঠোট মায়া আকেঁ রাজকন্যার বুকে। সে ছায়ায়-মায়ায় কখনো চন্দ্রবাণের বুকে কখনো রাজকন্যার স্তনে লুকোচুরি খেলে। চন্দ্রবাণের লিঙ্গ সিক্ত হয়, রাজকন্যার যোনি সিক্ত হয়। তারা পরস্পরে প্রবেশ করে। সাধনের স্বপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।

চন্দ্রবাণের যে তীরে সাধন যাপন করে সেই যাপনের মাধ্যম থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ক্রোশ খানেক দূরে যেখানে বন ক্রমশ সবুজ হলুদ রঙ ধুয়ে ফেলে নিকষ বাদমি রঙে সেজে ওঠে, যেখানে বন এতই গভীর যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র তাক করেও চন্দ্রবাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়না - খুব ক্ষীণ ভাবে শোনা যায় তার অবিরাম বয়ে চলার শব্দ, সেই খানের শিয়রে গাছে গুঁড়ির তলায় পলকহীন নেত্রে শুধুমাত্র চন্দ্রবাণের বয়ে চলার ক্ষীণ শব্দটাকে আশ্রয় করে বসে থাকে দুয়োরানি - হয়তো বা চন্দ্রবাণের ধারা কোনো একদিনও বা এমুখী হবে এই আশায়। আসলে আগে তো চন্দ্রবাণের ধারা এমুখীই ছিল। তারপর যবে থেকে রাজকন্যা পূর্বদিকের তীরে এসে বসবাস শুরু করল, সেই যবে সাধন এসে তার স্বপ্নের কথা চুপিচুপি চন্দ্রবাণের কানে বলেছিলো - সেই তবে থেকে চন্দ্রবাণের ধারা যে পূর্ব দিকে ঘুরে গ্যালো, তারপর দিন গ্যালো, রাত গ্যালো, সপ্তাহ গ্যালো মাস গ্যালো, এমনকি বছরও কেটে গ্যালো, কিন্তু সে-ধারা তো কোনদিন এমুখী হয়ইনি, বরং যত সময় এগলো, তার ধারা তত নিকটস্থ হয়ে রাজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে কোথায় মিলিয়ে গ্যালো। আর ততদিন এই অংশে বালির ওপর ক্রমশ বড় বড় গাছ গজালো - ক্রমে তা ঘন বনের আকার নিলো। এখন এস্থান শুধুমাত্র চন্দ্রবাণের বয়ে চলার শ্রোতা। তবু দুয়োরানি অপেক্ষা করে। চন্দ্রবাণ যবে এ স্হান ছেড়ে পূবদিকে রওনা হয়েছিল, সেই তবে দুয়োরানি পাতার এক ডিঙা চন্দ্রবাণের বুকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। চন্দ্রবাণের স্রোত এ তাবত্‍ কাল তকে ডুবিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সবই ব্যর্থ। চন্দ্রবাণের ধারা যত রাজকন্যার কুটিরকে আলিঙ্গন করে, সেই পাতার ডিঙা তত গাছের গুঁড়িতে সে থাকা দুয়োরানির চোখের জলে পূর্ণ হয়, কিন্তু ডোবে না - ভেসেই থাকে।

জোয়ারের সময় যখন চন্দ্রবাণের বুকে জল বাড়ে তখন তার ধারা রাজকন্যার কুটিরকে প্লাবিত করে। তার ধারা খেলা করে রাজকন্যার বুকে। আর সেই জোয়ারের ধারায় রাজকন্যার শরীর থেকে আলগা হয়ে যাওয়া কাপড় চন্দ্রবাণের ধারায় ভেসে যায়।তাদর শ্বাসে ঠোকাঠুকি লাগে। একটা শ্বাস অপর শ্বাসকে এই জোয়ারের মুহূর্তটাকে চিরন্তন করে তুলতে বলে। পরপারে প্রস্তরখণ্ডের খাঁজ থেকে এ সব কিছুই দ্যাখে সাধন। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শক্ত পাথরকে মুহূর্তের জন্য হলেও নরম করে। তারপর সেই চোখের জল ভেসে যায়, ডুবে যায় চন্দ্রবাণের বুকে। দুয়োরানি যে-গাছের গুঁড়ির তলায় বসে থাকে তার পূর্বদিকে ক্রোশ খানেক দূরে বয়ে চলে চান্দ্রেয়ী নদী। নিকষ বাদামী বনের ভিতরে সে কখনো কখনো তার বুক তুলে ধরে বলি চিরে, বয়ে নিয়ে চলে নীলে সবুজ জল, কখনো বালির উপর দিয়ে, কখনো বা নিচ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে, নিস্তব্ধে। এ অঞ্চলের প্রতিটা গছ মাছ পাখি জানে, হয়তো বা পূর্বজদের থেকে শুনেছে, বা ভাবে চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ী একই সত্তার ভিন্ন দুই বিপরীতমুখী রূপ। যদিও তারা কেউ কোন দিনই চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ীর উত্‍সস্থল ও অন্তিমস্থলের খোঁজ পায়নি, তবু তারা বিশ্বাস করে এই দুই নদী উত্‍সস্থল ও অন্তিমস্থলে এক, যেখানে তাদের এ স্থানের বিপরীতমুখিত্ব মিলেমিশে একাকার। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূখন্ডে যাপন করে সাধন দুয়োরানি, গাছগাছালি পাখপাখালির দল, আরও কত কী। চান্দ্রেয়ী নদীর তীর বরাবর ক্রোশ খানেক অঞ্চল জুড়ে বন এতই ঘন যে সেখানে এ পাশের কোন পাখি কোনদিনও প্রবেশ করতে পারে না, পথ হারিয়ে ফ্যালে। বদলে যায়। গাছেরাও। চান্দ্রেয়ীর তীর বরাবর ক্রোশ খানেক বিস্তৃত অংশে। এখানে গাছেরাও কোমলতা, সরলতা, প্রাণময়তা হারিয়ে অনেক বেশি কঠিন, ঋজু, কন্টকময়। সাধন বারবারই চেষ্টা করে এই নিকষ বন পার হয়ে চান্দ্রেয়ীর তীরে উপস্থিত হতে। কিন্তু প্রতিবারই পথ হারিয়ে ফ্যালে। তবু সে বারবার এই চেষ্টা চালিয়ে যায়। কারণ সে শুনেছে পূর্ণিমা অমাবস্যা তিথিতে চান্দ্রেয়ীরর বুকে নিজেকে অর্পণ করে রাজকন্যা। তখন চান্দ্রেয়ীর স্তন রাজকন্যার স্তনে স্পর্শ হয়, চান্দ্রেয়ী ও রাজকন্যার যোনি পরস্পরে ঘর্ষিত হয়। সে-স্পর্শে, ঘর্ষণে কখনো পূর্ণিমা তিথির নীলচে সাদা আলো, কখনো বা অমাবস্যা তিথির কালচে বাদামি আলো ঝাপ্‌টা মারে। প্রতিটা স্পর্শে, ঘর্ষণের ছন্দে এ অঞ্চলের গাছেদের চেহারা আরও বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। তাদের গায়ের কন্টক আরও প্রসারিত হয়। একে অপরে স্পর্শিত, ঘর্ষিত হয়। আর বিফল হয় সাধনের প্রতিবারের চেষ্টা। কিন্তু এই দুই তিথিতে সে বৃহত্‍ তিন প্রস্তর খন্ডের খাঁজে এক মুহূর্তও শান্ত ভাবে বসে থাকতে পারে না। সে থেকে থেকেই ছুটে যেতে চায় চান্দ্রেয়ী নদীর দিকে। গাছেদের কন্টকে রক্তাক্ত হয়, ব্যর্থ হয়। চান্দ্রেয়ী নদীর তীরে না পৌঁছালেও তার চোখের সামনে চান্দ্রেয়ী-রাজকন্যা সঙ্গমদৃশ্য ঝাপটা মারে। সাধনের স্বপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে, চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।

সকালবেলা চন্দ্রবাণ ও চান্দ্রেয়ীর মধ্যবর্তী জ্যা সূর্যের আলোয় হরিদ্রাভ রক্তিম বর্ন ধারণ করে। সূর্যের তির্যক রশ্মিস্রোত স্পর্শ করে গাছগাছালি পাখপাখালিদের। স্পর্শ করে সাধনকে ঘিরে থাকা বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখন্ডকে। তারা রশ্মিস্রোত গায়ে মাখে। এ ওর গায়ে মাখিয়ে দেয়। ভেসে যায় রশ্মিস্রোতে। বেলা বাড়ে। ঢলে পড়ে সূর্য। রশ্মিস্রোত চুঁয়ে চুঁয়ে নেমে আসে বালিনির্মত খন্ডিত ভূ-এ। সূর্য অদৃশ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত তাদের গায়ে লেগে থাকা রশ্মি ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে বালির বুকে। তারপর সেই রশ্মিস্রোতের ধারা দু ভাগ হয়ে বয়ে চলে চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর দিকে। প্রস্তরখন্ডের খাঁজ থেকে আঙুল দেখা যায় সাধনের। রাতে দেখা, বুকে জমে থাকা স্বপ্ন ভাসিয়ে দ্যায় সে চন্দ্রবাণের দিকে বয়ে চলা রশ্মিস্রোতে। স্বপ্ন জমা হয় চন্দ্রবাণের বুকে। অদৃশ্য সূর্যের স্থান নেয় নীলচে সাদা বৃত্ত। তার নীলচে সাদা আলোর স্রোতে স্নান করে খণ্ড ভূ। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় নীলচে আলো। নীল পোষাকের সাদা ডানার পরীরা বালির ওপর নেমে আসে। জাদুকাঠি বুলিয়ে দ্যায় সকলের চোখে। বৃহত্‍ তিন প্রস্তরখণ্ডের মাঝে সাধন ঘুমিয়ে পড়ে। অদৃশ্য ঝুলনবিন্দু থেকে নেমে আসে দোলনা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সাধন দোলনায় উঠে পড়ে। দুলতে দুলতে কখনও চন্দ্রেয়ীর বুকে পৌঁছে যায়, আবার কখনও বা রাজকন্যার কুটির স্পর্শ করে। চান্দ্রেয়ীর বুকে পৌঁছে দোলনা থেকে নেমে পড়ে সাধন। ডুবে যায় চান্দ্রেয়ীর বুকে। ডুবতেই থাকে। চন্দ্রবাণ পার হয়ে দোলনা রাজকন্যার কুটির স্পর্শ করলে সাধন হাত বাড়িয়ে দ্যায় রাজকন্যার কুটিরের দিকে। বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে দোলনায় উঠে আসে রাজকন্যা। দুলতে থাকে দোলনা। সাধন রাজকন্যার শরীর পরস্পরে পেঁচিয়ে যেতে থাকে। নীল পোশাকের পরীরা তাদের সাদা ডানা প্রসারিত করে ঘিরে ধরে দোলনাকে। দোলনার ছন্দে দুলতে দুলতে তারাও ভাসতে থাকে। দুলতে থাকে দোলনা - চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর মধ্যবর্তী বায়ুস্তরে, স্পর্শ করে দুই প্রান্তবিন্দু - চান্দ্রেয়ীর বুক, রাজকন্যার কুটির। ট্রলারের বিকট শব্দ শুষে নেয় রাতের শেষ বিন্দুকে। অদৃশ্য হয় দোলনা। জেগে ওঠে সাধন। জেগে ওঠে গাছগাছালি, পাখপাখালির দল। সারা রাতের স্বপ্নিল মায়া তাদের মুখ থেকে মুছে যেতে থাকে। হলদেটে রঙ গ্রাস করে তাদের মুখ। অশ্বারোহী জাল ফেলে চন্দ্রবাণের বুকে। ধরে নিয়ে যায় মাছেদের। সাধন, চন্দ্রবাণ ও রাজকন্যার স্বপ্নদের।..........। সাধনের স্বপ্ন......... পেটস্থ হয়। ......... সিক্ত হয় গাছপালা, পশুপাখি। .........। চন্দ্রবাণ স্পর্শ করে.........। .........। তারা পরস্পরে.........। সাধনের স্বপ্ন ডুবে যায়, ভেসে যায়, মুখ তোলে চন্দ্রবাণের বুকে, জমা হয় রাজকন্যার কুটিরে।

দুয়োরানি অপেক্ষা করে চন্দ্রবাণের জন্য। তার চোখের জল জমা হতে থাকে চন্দ্রবাণের বুকে ভেসে চলা পাতার ডিঙায়। সেই জল তারপর চুঁয়ে পড়ে চন্দ্রবাণের বুকে, আর মুহূর্তের জন্য হলেও চন্দ্রবাণের মিষ্টি জলকে নোনতা করে। অশ্বারোহীর জালে পাতার ডিঙা বন্দি হয়। অশ্বারোহী হাতছানি দেয় দুয়োরানি, সাধনকে, ট্রলারে উঠে পড়ার। দুয়োরানি প্রাণপণে সে-হাতছানি প্রত্যাখ্যান করতে চায়, কিন্তু তার শরীরে গতি সঞ্চারিত হয়। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূ-এ ঋজু দাঁড়িয়ে সে-হাতছানি প্রত্যাখ্যান করে সাধন।

এ ভাবে কত দিন কেটে যায় তার খবর কেউ রাখেনা। সাধন চন্দ্রবাণ পেরিয়ে রাজকন্যার কুটিরে পৌঁছার চেষ্টা, চান্দ্রেয়ীর তীরে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায় – পথ খুঁজতে থাকে। সাধন জানেনা ওপারে রাজকন্যার কুটিরের পরে , চান্দ্রেয়ীর ওপারে কী আছে - এ অঞ্চলের কেউই জানেনা। তারা শুধু সাক্ষী হয়ে থাকে কিছু প্রেমের, প্রতীক্ষার, অপেক্ষার, সংগমের, ট্রলারের বিকট শব্দের, আর সাধনের চোখের জলের।

চন্দ্রবাণের বুকে যে ট্রলার আসে, যার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কালো অশ্বের উপর বসে থাকে এক অশ্বারোহী, তার গতিপথও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। এখন সে শুধু চন্দ্রবাণের বুকে ভেসে চলা মাছেদের, সাধন, চন্দ্রবাণ, রাজকন্যার স্বপ্নদের জালবন্দী করেই ক্ষান্ত হয়না - তীরে নেমে আসে, কেটে ফেলে গাছ, হত্যা করে পাখিদের, বন্দি করে দুয়োরানীকে, সাধনকে। দুয়োরানীর অপেক্ষা তার শক্তির সামনে পরাস্ত হয়। সে দুয়োরানীকে শুয়ে দেয় ট্রলারের বুকে। নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে দ্যায়। রক্তাক্ত হয় দুয়োরানীর সারা দেহ। সে-রক্তে খেলা করে চলে অশ্বারোহী। দুয়োরানীর নির্বাক চিত্‍কার, কালো অশ্বের একটানা হ্রেষাধ্বনি সমস্ত আলো, চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর বহমানতার শব্দ শুষে নেয়। দুয়োরানীর চোখের জল রাতকে ভিজিয়ে দ্যায়। অশ্বারোহীর তীব্র হাসির শব্দ নীল রঙ গ্রাস করে খয়েরি রঙ ঢেলে দ্যায় অন্ধকারের বুকে। সাধন এখন চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ীর তীর বরাবর খালি ছুটে যায়। দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূ-খণ্ড অশ্বারোহী অধিকার করে। বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয় দুই নদীতে। দুই নদীর মধ্যবর্তী স্থানে নদীর ওপারে রাজকন্যার কুটিরের দিকে সেতু নির্মাণ শুরু হয়।

ঘটনা রটনা আর দুর্ঘটনার প্রবহমান স্রোতে সে-ছেলের দেহখণ্ড বা বা জীবিত লাশ অথবা যথার্থই লাশ ভেসে চলে নদী থেকে নদীতে, নদী পার হয়ে সাগরে, অথবা প্রস্তরীভূত হয় পাহাড়ের শিলায় কিংবা আটকে থাকে পাহাড় ও নদীর অন্তর্বর্তী খাঁজে। বয়ে চলে চন্দ্রবাণ থেকে চান্দ্রেয়ীতে। চন্দ্রবাণ চান্দ্রেয়ী পার হয়ে ছুঁতে চায় রাজকন্যাকে।

সাধন তার সাধ পূরণের লক্ষে করে চলে সাধনা।

ঋণ:

অদ্বৈত মল্লবর্মন রচিত তিতাস একটি নদীর নাম।

বিস্মৃতপ্রায় একটি নাট্য প্রযোজনা, সম্ভবত যার নাম ও গল্পের শীর্ষক এক।

পার্থপ্রতিম মৈত্র।

বন্ধুরা, রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মেরা।

মাগো তোমায় নিয়ে কোন পঙক্তি লেখা হয় নি

এমন নির্মল সুঘ্রাণ ভাষা আমার কাছে আসে নি

শফিকুর রহমান শান্তনু

মা

ট্রেন থেকে নেমে আয়েশা বেগম ঘোলাটে চোখে তাকান।

ওমা ! স্টেশনটা দেখি তেমনি আছে। শুধু চেহারায় কেমন রুতার ছাপ। কেউ যত্ন নেয় না নাকি ? তিনি গভীর মমতায় রঙ মলিন হয়ে আসা একটি পিলারে হাত রাখেন। খালেক তাড়া দেয়,  মা চলেন।

তিনি মাথা নাড়েন। বাবা , তুই হঠাৎ আমারে নিয়া আইলি যে !

আপনে তো প্রায়ই বলেন সে কোন আমলে বাজানের হাত ধরে আসছিলেন। কত কি দেখছেন ! খালেক ইতস্তত মুখে বলে, তাই ভাবলাম নিয়া যাই। আমারও হঠাৎ ঢাকায় কাজ পড়ল!

ও আল্লা! তাইলে দাদুভাইরে আনতাম। তার তো অনেক শখ।

সময় তো ফুরায় যাচ্ছে না মা। তারে পরে আবার আনবো।

আয়েশা আর কিছু বলেন না। কথায় যুক্তি আছে! তার ছেলেটা বিরাট যুক্তিবাদি। যুক্তি ছাড়া এক পা এদিক ওদিক করে না। আফসোস, কিছু করতে পারলো না। এই দেশে যুক্তিতে কিছু চলে না। অন্য কোথাও হলে সে নিশ্চয়ই বিশাল কিছু একটা করে ফেলতে পারত! সে চেষ্টাও হয়েছিল। গ্রামে যে অল্প ক’টুকু জমি আছে সেসব বেচে টাকা দিয়েছিল এক দালালের হাতে। দালাল দুবাই পাঠিযেছে ঠিকই। কিন্তু যে কাজের কথা বলেছিল তার নামগন্ধও পাওয়া যায় নি। দেড় মাস পরে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। শ্বশুর বাড়ি থেকেও প্রায় হাজার পঞ্চাশ টাকা নিয়েছিল। তাও শেষ!

খালেক মাকে আহসান মনজিল দেখায়। তারপর চিড়িয়াখানা। তাতেই দুপুর। ছোট দেখে এক রেস্তরাঁ’য় ঢুকে খেয়ে নেয় তারা। আয়েশা ঘন ঘন অস্থিরতা দেখান।  আহা দাদু ভাইটা বান্দরের নাচ দেখলে বড় মজা পেত।  এতগুলো টাকা নেমে গেল!  চিতল মাছের পেটি নেওয়ার দরকার কি? শুধু ভাজি নিলেই তো হয়! ছেলে হয়েছে ঠিক বাপের মতো। টাকা হাতে থাকলেই খচখচ করে উড়াতে ইচ্ছা করে। আগে পরে ভাবে না। খুবই বদভ্যাস।

খালেক বিরক্ত হয়। আপনের অভ্যাস তো খুব একটা সুবিধার না। এইখানে এত মানুষ! কাউরে দেখছেন এত ফটর ফটর করে !

আয়েশা ধমক খেয়ে চুপসে যান না। তাঁর ভালোই লাগে। কি যুক্তিযুক্ত কথা!

খাওয়া শেষ হলে খালেক বেয়ারাকে দিয়ে পান কিনে আনায়। মা , পান খেয়ে বেঞ্চে হেলান দিয়ে আরাম করেন। ঠিক আছে ? আমি একটা কাজে যাচ্ছি। জলদি ফিরব। আপনে এইখানেই থাইকেন। আমি হোটেল মালিককে বলে যাচ্ছি। এই টাকা ক’টা রাখেন। বিকালে যদি দিা লাগে চা সিঙারা কিনা খাইয়েন। আর শোনেন, যেখানে সেখানে পানের পিক ফেলবেন না। পিক ফেলতে হলে আস্তে করে কোন চিপায় টুক করে ফেলে আসবেন। মনে থাকবে ?

আয়েশা মাথা নাড়েন। মনে থাকবে না আবার! কি সুন্দর গুছিয়ে বলেছে! হাতে একশ টাকার একটা নোটও ধরিয়ে দিয়েছে! কি সুন্দর বিচার! ছেলের দরাজ দিলের কথা ভেবে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আরেকটু ছোট মন হলে কি এমন তি হত! তাঁর ধারণা, এই দরাজ দিলের জন্যেই ছেলেটার কিছু হলো না। তবে বৌটা হিসেবি হয়ে রা। তাই  দু’বেলা খাবার জুটছে। নইলে কি যে হত! দুশ্চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে তাঁর অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। নাতিটা বড় হচ্ছে। ওকে স্কুলে দিতে হবে! তার ওপর তিনি বাড়তি বোঝা। থাকা খাওয়া ছাড়াও এবযেসে নানা অসুখ লেগেই আছে। অন্যান্য খরচ! রাতে তাঁর ঘুম হয় না। প্রায় জেগেই কাটে সারারাত। রাত গভীর হলে ছেলে, ছেলে বৌয়ের ফিসফিস শুনতে পান। সত্যি, টাকা রোজগার করতে গিয়ে হাপিত্যেশ উঠছে ছেলেটার। অথচ দিন দিন গরিব থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া চোখের সামনেই দেখছেন।

রেস্তরাঁ খেকে বেরিয়ে কিছুন গন্তব্যহীন হাঁটে খালেক। কড়া রোদ্দুরে ভিজে টুপটুপে হয়ে যায়। একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান দেখে থমকে দাঁড়ায। ভাই, একটা ফোন করা যাবে ?

কত নাম্বার ?

খালেক পকেট থেকে ছোট ডায়েরিটা বের করে নাম্বার বলে। রুনু ভাবীর মোবাইল। তাকে বললে নীলাকে ডেকে দেয়।

হ্যালো ভাবী ...

হ্যাঁ, এই যে আপনার গিন্নি পাশেই আছে। কথা বলেন।

পরমুহূর্তেই নীলার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ পায়। হ্যালো, পৌঁচেছ ? সব ঠিকঠাক হয়েছে তো ?

হুঁ।

খুব খারাপ লাগছে ?

খালেক কিছু বলে না।

নীলা ক্ষীণ কন্ঠে প্রবোধ দেয়, করতে তো হতোই। তাই না ? ..অভাবের সংসার !

খালেক হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ মোড়ে চলে আসে। চারদিকে ভীর, ব্যস্ততা। সে তো এই অচেনা ভীরেই হারিয়ে যেতে চেয়েছে। শূন্য চোখে সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। বাসের প্যাপোঁ, চিৎকার চেচামেচি কিছুই কানে ঢোকে না। এমন একটা কাজ সে করতে পারল! আর ক’দিনই বা বাঁচতো মানুষটা ! ছ’মাস! এক বছর! বড়জোর দু’আড়াই! এ’কটা দিন কষ্ট করে রাখা যেতো না ?

না , যেতো না। এই মানুষটার পেছনে মাসে কত টাকা খরচ হয় সে খেযাল আছে ? কম করে হলেও পাঁচশ। এটা আসবে কোথা থেকে ? যা অবস্থা মাসে তিন হাজার আয় করতেই হিমসিম। ঘর ভাড়া বাকি আজ চার মাস। ওইটুকু একটা ঘরে চারটা মানুষ দিনের পর দিন কিভাবে থাকে ? তা না হয় থাকা যায়! কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে হারে বাড়ছে! তারপর অষুধ! কিভাবে সম্ভব ? জীবনের প্রতি বিতৃষায় খালেকের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে কোথাও চলে যেতে ! পারে না পুত্রের ফুটফুটে মখখানি দেখে। খালেক ধরেই নিয়েছে কিছু মানুষ থাকে ভাগ্যের খেলায় কেবলই হেরে যায়। সে তাদের একজন।

রাস্তার পাশে এক মধ্যবয়স্ক জ্যোতিষি চট বিছিয়ে বসেছে। সামনে এক পাশে হস্তরেখার বই। অন্য পাশে একটা গোল ডিব্বায় কয়েকটা বিচিত্র রঙের আংটি।  জ্যোতিষি তন্দ্রায় ঢুলছে। খালেকের উপস্থিতি টের পেয়ে নড়েচড়ে ওঠে। সরু চোখে তাকায়। হাত দেখাবেন ? ভালো সময়ে এসেছেন। হাত দেখার আদর্শ সময় হচ্ছে এইটা। সূর্য থাকবে ঠিক মাথার উপরে যখন দুনিয়ার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসও খালি চোখে দেখা যায়।

না, আমি ঠিক ...

জ্যোতিষি মৃদু হাসে। কায়েন্ট হারাতে চায় না। শোনেন ভাই, হাত দেখার আদর্শ সময় হলেও এটা হচ্ছে অফপিক। অফপিকে ফি অর্ধেক। মাত্র দশটাকা।

খালেক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। আমি হাত দেখাতে চাই না।

অ।

ভাই, একটা কথা বলি।

জ্যোতিষি বিরক্ত চোখে তাকায়। সাংবাদিক ?

না, না।

তাহলে কিসের কথা ?

এমনিই। আপনার নাম কি, ভাই?

বোরহান উদ্দিন চিশতি।

আপনে তো এই ব্যবসা অনেকদিন যাবত করতেছেন ,না ?

চিশতি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

খালেক ঢোক গিলে বলে, এতে আপনার চলে ? মানে কিরকম আয় ...

ঠিক নাই। এক একদিন একরকম। চলে আর কি!

আপনে কি একাই ?

একা হবো ক্যান? আপনার কি ধারনা, একা হলে আমি ফুটপাতে ছালা বিছায়া রৌদ্রের মধ্যে জ্যোতিষচর্চা করতাম? কখনোই না। সোজা কামরূপ কাম্যাা। বিয়া কইরাই ধরাটা খাইছি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছাওয়াল পাওয়ালে ঘর ভরে গেছে। আসার কথা ছিল একটা। আসছে দুইটা। যমজ।

আর ?

আরো ? আপনের মাথা খারাপ?

না, না, আমি বাচ্চার কথা বলি নাই। মানে আর কেউ নাই পরিবারে ?

আছে। মায় আছে। বইন ছিল একটা। ওইটারে বিয়া দিয়া পার করছি।

আর মা ?

মা কি ? মারে তো আর বিয়া দেওন যাইবো না। যাইবে ?

না মানে কষ্ট হয় না ?

কষ্ট তো হয়ই। তাই বলে তো ফেলে দিতে পারি না। পারি ?

খালেক কিছু বলতে পারে না। 

স্টেশন মাষ্টার জিজ্ঞেস করে , টিকেট কয়টা ?

একটা। কখন ট্রেন ?

রাত সাড়ে দশটা।

খালেক হাত বাড়িয়ে টিকেটটা নেয়। তার হাত মৃদু কেঁপে ওঠে কি ?

খালেক ধীর পায়ে হেঁটে একটা খালি বেঞ্চিতে বসে। হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে। ঘুমিয়ে এসময়টুকু কাটিয়ে দেয়া যায়। একটু পর পর টক ঢেকুর উঠছে। পেটে গ্যাস হয়েছে বোধহয়। সে এদিক ওদিক তাকায়। পান খেতে পারলে হত! পানের রস খুব উপকারি। পেটে ঢুকার সাথে সাথে এ্যাকশন। ছোটকালে যখন এমন অস্বস্তি লাগতো মা তার মুখ থেকে এক টুকরো পান ছিঁড়ে তার মুখে দিয়ে দিত। সে পান চিবিয়ে মুখ লাল করে ফেলতো। মজা লাগে ?

সে গাঢ় উৎসাহে মাথা নাড়াতো।

জর্দা কিন্তু বেশি খাবি না। বুঝছস ? ...

রাত ন’টার পরে হোটেল মালিক আয়েশা বেগমের কাছে এগিয়ে গেল। আপনার ছেলে আসছে ?

আয়েশা মৃদু মাথা নাড়েন।

আমাকে তো বলে গেছে বিকেলের মধ্যে ফিরব।

মনে হয় কাজে আটকাইছে।

তা একটা খবর দিবে তো ?

ক্যামনে দিব ? অর কাছে তো মোবাইল নাই।

কি কাজে কোথায় গেছে জানেন কিছু ?

না।

এইখানে আপনারা উঠছেন কোথায় ?

উঠি নাই কোথাও। কাজ শেষ হলে ফেরার কথা।

তাহলে কি এখানেই বসে থাকবেন ?

বসতে বলে গেল তো!

মালিক আর কথা খুঁজে পায় না। তবে তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। নিশ্চয়ই কোথাও একটা ঘাপলা আছে। কিছুন পরেই সেই ঘাপলা প্রকাশ পেতে শুরু করে লোকমুখে।

- ভাগছে। ভাগছে। আর আসবে না।

- এই সেদিনই তো পেপারে পড়লাম। ঠিক এইরকমই ঘটনা। মারে নিয়ে আসছে। তারপর ভুজুমভাজুম বুঝিয়ে পগারপার।

- কি দিনকাল যে পড়ছে রে ভাই!

কয়েকজন অতি উৎসাহী যুবক এগিয়ে আসে আয়েশা বেগমের কাছে। খালাম্মা, আপনার বাড়ি কই ? চিনে যেতে পারবেন ?

-ঠিকআছে, নাম ঠিকানা বলেন। আমরা আপনাকে দিয়ে আসব। আর আপনার ছেলের দুই গালে দুইটা চটকানা দিব। কোন আক্কেলে সে এই কাজ করল?

আরেকজন মনোবিশ্লেষক চেহারার যুবক বলে ওঠে, এই বুদ্ধি ছেলের মাথায় আসবে না। এইটা হচ্ছে ছেলে বৌয়ের বুদ্ধি। ছেলের বৌয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন, খালাম্মা ? কারবালা রিলেশন ?

আয়েশা বেগম কিছু বলতে পারেন না। নিস্পলক তাকিয়ে থাকেন। এসব এরা কি বলছে ? আচমকা তিনি উঠে দাঁড়ান। খবর্দার , আমার ছেলের নামে এইসব কইবা না। তারা অত্যন্ত ভালো। তিনি ন্যুব্জ দেহে হোটেল মালিকের কাছে এগিয়ে যান। একশ টাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, বিকালে যে নাস্তা করছি তার দাম রাখো। আর একটা কথা, আমার ছেলে নিশ্চয়ই কোন কাজে আটকা পড়ছে। সে ওই রকম না যে মাকে ফেলে পালায় যাবে। সে আসলে বলবা, চিন্তার কিছু নাই। আমি ভালো আছি।

আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?

আয়েশা বেগম মৃদু হেসে পথে নামেন। গন্তব্য সবার একটা। তবু মানুষ কত না জায়গায় যায়! এমন দার্শনিক উত্তর ছাড়া আর কি বলার ছিল তার !

খালেক ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে, মা ! মা!

মা তার কাঁধ ধরে ঝাকাচ্ছে। এই খালেইক্যা ওঠ! ওঠ রে বাপ! বেলা হইছে! খালেক চোখ মেলে তাকায়। আদতে তাকে একজন ডাকছে। না, মা না। এক যাত্রী। ভাই, ট্রেন ছাড়ছে। যাবেন না ? কি ঘুম আপনার ! সঙ্গে জিনিসপত্র কিছু আছে না একাই ?

খালেক আড়মোড়া ভেঙে বলে, একা।

ভাগ্যিস! জিনিসপত্র থাকলে এতনে সাফা কিরকিরা হয়ে ... তা এইভাবে ঘুমাচ্ছিলেন কেন ? অজ্ঞান পার্টির হাতে পড়ছিলেন নাকি ?

খালেক জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। কই চললেন ? ট্রেন ছাড়ছে তো !

খালেক এবার দৌড়ায়। যাত্রী ভদ্রলোক একমুহূর্ত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। কত অদ্ভুত অনাকাংখিত ঘটনাই তো প্রতিদিন ঘটে। এতসব দেখলে চলে ?

ক্লাস এইট। তার হলো কালজ্বর। রাত দিন কাটছে ঘোরে। যখনই ঘোর ভাঙে দেখে, শিয়রে মা বসে, তাকে চোখ মেলতে দেখে চকচকে চোখে তাকান, ক্ষিদা লাগছে বাপ ? মাগুর মাছের ঝোল রানছি। দেই একটু? ডাক্তার বললো, আমার আর কাজ নাই। এখন সব আল্লার হাতে।

মা বিচলিত মুখে বলে, শহরে নিয়া যাবো ?

যাইতে পারেন। তবে বিশেষ লাভ নাই। 

সে কাস এইট পড়–য়া দাম্রা ছেলেকে কোলে আগলে মা রাতেই রওনা হলো শহরের উদ্দেশ্য। সাথে দুঃসম্পর্কের এক বড় ভাই। আধো জাগরনে তার কেবলই মনে পড়ে মা বলছে, বাপধন খুব কষ্ট হইতেছে গো ? আর একটু সবুর কর। আর একটু। ও খোদা , খোদা গো , আমার পুলাটারে তুমি বাঁচাও গো খোদা।

মায়ের বুকের সে ওমে এখনো কি শিহরিত হয় সে ? সে ছুটতে থাকে। কেবলই ছুটে যায়।

আপনি বললেন বিকেলে ফিরবেন। এখন বাজে রাত সাড়ে এগারটা।

খালেক কথা বলতে গিয়ে হাঁপায়। ভাই ,একটু ঝামেলায় পড়ছিলাম।

তা জানাবেন তো ! আমার ফোন নাম্বার নিলেন না !

ভাই, ভুল হইছে ভাই। চারদিকে তাকায় সে। আ.. আমার মায় কই ?

সে তো চলে গেছে।

চলে গেছে ? কো.. কোথায় ?

কিছু বলে নাই তো।

রাগে দুঃখে খালেকের মাথায় যেন রক্ত ওঠে। জামার কলার চেপে ধরে হোটেল মালিকের। আপনারে আমি কি বলছি ? বলছি না, আমার মা। একটু খেয়াল রাইখেন। 

আশপাশে বেয়ারারা ছিল। তারা ছুটে এল। তাদের দেখে কিংবা নিস্ফল আক্রোশেই কলার ছেড়ে দেয় খালেক। ভাই, ভাই কোনদিকে গেছে ? মায় তো শহরে কিছু চেনে না।

দূরে কোথাও বোধহয় যায় নাই। ঘন্টা খানেক আগে বেরিয়েছে তো। দ্যাখেন , আশপাশেই পাবেন হয়তো।

খালেক ঘুরে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে যায়। হোটেল মালিক ও কয়েক পথচারি দেখতে পায় রাতের অন্ধকারে এক বয়স্ক অসহায় শিশু তার হারানো মাকে চিৎকার করে ডাকছে আর অবিরল দৌড়াচ্ছে।

বি:দ্র: প্রিয় পাঠক, দৈনিক প্রথম আলোয় (২৬.১২. ০৭) প্রকাশিত হয়েছিল খবরটা। এক বর্বর ছেলে অম অসুস্থ বৃদ্ধ মাকে ফেলে গেছে নেহাত বোঝা মনে করে। মিরপুরের দুয়ারীপাড়া বাজারের বটতলায় আশ্রয় নিয়েছেন ওই মা। ক্ষীণ শরীরটায় জোর না থাকলেও জোর কমেনি মনের। কিছুতেই নাম বললেন না মা - না নিজের, না ছেলের; না যেখানে থাকতেন সেখানকার কোনো ঠিকানা। খবরটি পড়ে যে কষ্ট পুনজিভূত ছিল তা বহন করেছি এতদিন। আর পারলাম না। বাস্তবতা গল্পের চেয়ে ভয়ংকর। গল্পে পুত্র ফিরে আসে। বাস্তবে ফেরে না। লেখক হিসেবে নিশ্চয়ই আমি নিম্নমানের। তাই অতোটা নির্মম হতে পারিনি।

 

আত্মহত্যার পরে

পূর্বকথা

তানিয়া যেদিন আত্মহত্যা করে আকাশে মেঘ ছিল না।

আচমকা ঝুম বৃষ্টি।

কাক ভেজা হয়ে কলেজ থেকে ফেরে সে। মা বকেন, কত বলি ছাতাটা সাথে রাখ । কে শোনে ! ঠান্ডা লাগার আগে তাড়াতাড়ি মাথাটা ধুয়ে ফেল। গরম পানি দিচ্ছি।

কিছু না বলে তানিয়া সোজা ঘরের দরজা দেয়। মা ক’বার তাড়া দেন। তারপর সন্দেহ। ঘন্টা দেড়েক পরে যখন দরজা ভাঙা হলো ততনে সব শেষ।

কয়েকটা জাতীয় দৈনিকে খবরটা বেরিয়েছিল। টিভি কভারেজও পায়। তবে কোন সুইসাইড নোট না থাকায় আত্মহত্যার কারণ নিয়ে মুখরোচক আলোচনা চলে ক’দিন। প্রেমের জের থেকে অবৈধ গর্ভধারণ এমন নানা কাল্পনিক কারণ মুখে মুখে আবিস্কৃত হতে থাকে। এই সৃজনশীল চিন্তার ভিত আরো শক্ত হয় যখন ওর পরিবার লাশ ময়না তদন্ত না করার জন্যে অনুরোধ জানায়। সেদিন বিকেলেই তানিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। কবরস্থ করে ঢাকা ফেরে দুদিন পরে। তার অল্পদিন পরে এই পরিবারটি পাড়া বদলায়। এছাড়া উপায়ও ছিল না। আশপাশে এত কথা রটেছে যে, তানিয়ার ছোট দুবোন, এক ভাই, বাবা মা’র বাইরে যাওয়াই বন্ধ হবার জোগাড়।

এটা ২০০৭ সালের এপ্রিলের ঘটনা।

১.

মজনু ভাই রেগে গেলে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে।

ইংরেজিতে যারা ন্যুনতম ধারণা রাখেন তাদের কাছে এটা সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। আমরা যারা তার এই স্বভাবের সাথে পরিচিত এবং অভ্যস্ত ব্যপারটাকে স্বাভাবিক ধরেই নিয়েছি।

নো বডি ট্যাক্সি এনি হয়্যার ! শেম! শেম! অবশ্য এদেশে এর থেকেও খারাপ হতে পারতো।

রাত ক’টা বাজে তুমি জান ?

তো ? আমেরিকার রাস্তায় নাইট ডাসন’ট ম্যাটার। অল নাইট ট্যাক্সি ইজ এভেলেবেল।

হেলাল হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে মৃদু হেসে বলে, লাস্ট তুমি ম্যারিকা থেকে কবে এলে যেন মজনু দা ?

নো ফাউল টক ! নো ফাউল টক ! আই ডোন্ট এলাউ দিস। আমেরিকা না গেলেও একটা ইয়ং আমেরিকানের চাইতে আমেরিকা বিষয়ে আমি কম জানি না। জসিম, ডু ইউ এগ্রি মি ?

আমি বার্গেনিং এ যাই না। সোজাসাপ্টা উত্তর, অবশ্যই।

হেলাল কম যায় না। আমি অবাক হয়ে ল্য করেছি, ও তালে এবং মাতাল উভয় অবস্থাতেই যথেষ্ট হুল ফুটিয়ে কথা বলতে জানে। জসিমের কথা তো ভ্যলুলেস। আপনি যদি ওরে এক দলা শুকনা বিষ্ঠা দেখায় বলেন, এতে ভিটামিন এ আছে। ডু ইউ এগ্রি মি ? ও সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলবে, অবশ্যই। আপনি বললে ও হয়তো চেখে দেখতেও রাজি হবে। কি রে জসিম, ঠিক বলি নাই ?

আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। অনেক ন ধরে নিজেকে ভারি ভারি লাগছে। একটু হালকা করতে পারলে হত। আশপাশে দোকান পাট সব বন্ধ। নির্জন রাস্তা। কোথাও দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিলেই হয়। কিন্তু স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। মাথাটা টলছে ক্রমাগত। আজ বোধহয় পেটে একটু বেশিই পড়েছে।

ইউ আন্ডারএস্টিমেট মি ? মজনু ভাইয়ের রাগের সাথে সাথে ভয়েজ স্কেল বাড়ছে। কথাগুলো মাথায় বাড়ি খাচ্ছে।

আমি আর পারি না। হাঁটতে হাঁটতেই ছেড়ে দিই। হেলালই প্রথম খেয়াল করে। গলা ছেড়ে হাসে। জসিম ভাই নাক মুখ কুঁচকে তাকায়। কি যন্ত্রনা ! এটা খেলা পেয়েছিস ? প্লে গ্রাউন্ড ! পেশাব ধরেছে, বলতি। হাঁটতে হাঁটতে পেশাব করা তো কোন আইনের মধ্যে পড়ে না। ডিসগাসটিং। অবশ্য এর থেকেও খারাপ হতে পারতো !  

হেলাল হাসতে হাসতেই বলে, এর থেকে কি খারাপ হবে , মজনু ভাই ?

ধর, ও আমাদের গায়ে কাজটা সেরে ফেলত যদি !

আমি এবার ফুটপাতেই বসে পড়ি। আহ!

এই সময় হেলাল কিভাবে যেন একটা সিএনজি ধরে ফেলল। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বিপদে পড়েছে। ভয়ও পাচ্ছে আবার যেতেও চাইছে না।

আমাকে ধরে বেঁধে সিএনজিতে তোলা হলো। হেলাল নাক চাপে। শালা ছোটলোক ! গোসল করিস না ক’দিন ?

সিএনজি স্টার্ট দিলে বাতাস ফনা তোলে।

আমাদের বাসাটা গলির ভেতরে। সিএনজি গলির মুখেই থামে। যেতে পারবি ?

হুঁ।

দেখিস, উস্টা খেয়ে ড্রেনে পড়ে থাকিস না !

আমি মাথা নেড়ে রওনা দি। ওরা চলে যায়। বাসার সাথে আমার সস্পর্কটা কোন পথে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আমিও মাঝেমধ্যে ভাবি। এই যেমন এখন। অনেকের মতো হয়তো আমার বাবা মা'ও আগডুম বাগডুম নানা আশা করেছিল। তার কিছু কি এখনো অবশিষ্ট আছে ? মনে হয় না। এখন তারা বোঝে, মানুষ হচ্ছে আসা যাওয়ার প্রাণী। শুধু আসার জন্য কেউ আসে না। আবার শুধু যাওয়ার জন্য কেউ যায় না। বাজে বকছি নাকি ? হয়তো বা। এসব কিসের লন ? পাগল হয়ে যাচ্ছি ? ভালোই হলো। বাবা এবার বলতে পারবে, আমার ছেলে ! আগে ছিল বখাটে। বর্তমানে মাথায় সামান্য সিগনাল দিচ্ছে।

দূরে আবছা একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পাচ্ছি। কয়েক কদম এগিয়ে চোখ কচলাই। ছায়ামূর্তিটা একটা মেয়ে। পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। চুল খোলা। পরনে সালোয়ার কামিজ। খালি পা। তরুনি মনে হচ্ছে। তবে চেহারা না দেখে এব্যপারে আমি নিশ্চিত হতে পারি না। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি। পেছন থেকে মনে হয় এক রকম। ঘুরে দাঁড়ালে অন্যরকম। যে হেলাল এব্যাপারে এক্সপার্ট, ও পর্যন্ত দু’বার ধরা খেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন সেটা না। প্রশ্ন হচ্ছে, এত রাতে একটা মেয়ে ( আপাতত মেয়েই বলি ! যতন চেহারা দেখতে না পাচ্ছি।) এভাবে একা অন্ধকার গলির ভেতর কি করছে ? অন্য কোথাও হলে কথা ছিল। কিন্তু এপাড়ায় তো ওরকম মেয়েদের ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি কোন দিন। নাকি চোখের ভুল ? নাহ, মালটা আজ বেশিই পড়েছে ! কে !

নারীমূর্তি নড়ে চড়ে না। স্থির।

কথা বলে না কেন ? কে ? কে ওখানে ?

টলতে টলতে  এগোই। এসময় আচমকা নারীমূর্তিটা ঘুরে দাঁড়ায়। পাড়ায় আমার নামে যথেষ্ট র্দুনাম থাকলেও কেউ কখনো ভিতু বলতে পারবে না। সেই আমি সারা শরীরে শিউরে উঠি। অন্ধকার রাস্তা পার হওয়ার সময় আচমকা চলমান ট্রাকের হেড লাইট দেখে লোকে যেমন আঁতকে ওঠে, তেমন। মেয়েটার চোখদুটো যেন জ্বলছে। ক্রর ভঙ্গি। চুলগুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। কেমন শীত শীত লাগে।

মেয়েটা কি এক পা বাড়াল ? সেই ভঙ্গি ! সেই... সেই মুখ...জরাগ্রস্থের মতো আমি ঠক ঠক কাঁপতে থাকি। ও খোদা ! ও খোদা !

তারপর আর কিছু মনে নাই।

২.

ঝাড়া তিন দিন হাসপাতালে থেকে আমাকে বাসায় আনা হলো। বাবা আমার সাথে কথা বলে না আজ প্রায় পাঁচ বছর। মা’ও  ইদানিং তার পথ অনুসরন করছে। বাসার সাথে আমার একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম রাখি, আমার ছোটবোন। সকালে উদ্বিগ্ন মুখে ও হাজির। আমি হাই তুলতে তুলতে বলি, চা টা কিছু হবে নাকি ?    

না।

আচ্ছা, আমাকে হাসপাতালে নিল কে ?

তোর ধারণা পাড়ায় তোর অনেক শুভাকাঙ্খী আছে ?

পরিস্কার করে বল। এ জাতীয় কুয়াশাচ্ছন্ন কথা বলা শিখেছিস কবে ?

পরিস্কারই বলছি। তোর চারপাশে কুয়াশা।

যা তো, যা।

অবশ্যই যাবো। তোর ঘর কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান না যে মুগ্ধ হয়ে বসে থাকব। বাবা জানতে চেয়েছে, এসব আর কতদিন চলবে ?

কোন সব ?

এই যে, মদ খেয়ে বাড়ির সামনে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা।

হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম নাকি ?

রাখি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।

আজই শেষ। আর ওসব খাবো না। কসম।

আচ্ছা ! আর তোর ভালোমানুষ বন্ধুরা যখন গ্লাস ভরে দেবে, তখন ?

তখন বলবো, দোস্তরে , দয়া করে একটু ঘুরে দাঁড়াবি ? তারপর যেই ঘুরে দাঁড়াবে অমনি ধাই করে একটা মারবো ব্যাক পোর্শনে। ঠিক আছে ?

রাখি মৃদু হাসে। আচ্ছা দাদা, তুই ওভাবে পড়ে গিয়েছিলি কেন ? আমরা বড্ড ভয় পেয়েছিলাম।

আনমনে বলি, ভয় !

ভয় ! কিসের ভয় ?

ঘোর ভাঙে আমার। কেমন একটা হিম স্্েরাত বয়ে যায় মেরুদণ্ড বেয়ে। মুহুর্ত্তে মনে পড়ে যায় সবকিছু। ঘুরে চারপাশে তাকাই।

কি হলো ? ভূতের ভয় পেয়েছিলি ?

ভূত !

হ্যাঁ, ভূতই তো ! এটা তো সত্যি হতে পারে না। আমি জানি, আমরা জানি, সবাই জানে, তানিয়া মারা গেছে। ও আত্মহত্যা করেছে। সেসব বহুদিন আগের কথা। বছর খানেক তো হয়েছেই। কে মনে রাখে ওসব। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৯.৫% মানুষ মারা যায়। এত মৃত্যুর খবর রাখা যায় নাকি?

ঠিক এ সময় আমি স্পষ্ট টের পাই, কানের কাছে খুব তাচ্ছিল্য করে কে যেন মৃদু হাসে।

পেয়েছিস ? কিছু শুনতে পেয়েছিস ?

কি ?

আমি তার গায়ের গন্ধটাও পাই। দুধ পোড়া গন্ধ। - গন্ধ ? বড় করে শ্বাস নে তো। পাচ্ছিস ?

রাখি আশ্চর্য, কি !

আমি ব্যাকুল চোখে চারদিকে তাকাই। আমি নিশ্চিত , এ ঘরে কেউ আছে। তার অস্তিত্ব টের পাই। কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব ?

রাখি বিরক্ত হয়ে চলে যায়।

তানিয়া ! তানিয়া আমি জানি তুমি এ ঘরে আছো । তু.. তুমি কি চাও ? বল, কি চাও আমার কাছে ? তা.. তানিয়া, বিশ্বাস করো, আ.. আমি চাই নি এমন হোক। তবু...

আমার শীত শীত লাগতে থাকে। গা কাঁপিয়ে প্রচন্ড জ্বর হলে যেমন হয়।

খবর পেয়ে হেলাল আসে। মোড়ের রেস্টুরেন্টটা আমাদের নিয়মিত আড্ডাস্থল। ও কোথা থেকে যেন একটা হোন্ডা যোগাড় করেছে। ভট ভট শব্দ করে। বিশ্রী।

এই এন্টিক কোথা থেকে ?

মামা, পুরনো হলেও জিনিস ভালো। তা তুই নাকি সেন্সলেস হয়া পুরা পাংখা...

সেজন্যই ডাকছি তোকে।

না, না, তোরে তো আর ঐ মাল দেয়া যাইবো না। তোর দরকার নেপিয়ার।

সেটা আবার কি ?

এক প্রকার ঘাস। ও হাত নেড়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, গরুর জন্য খুব পুষ্টিকর।

এবার আমাকে বলতে দিবি ?

বলতে চাইলে বলবি। ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। সমান অধিকার।

একটু থেমে সময় নিই। দোস্ত, সেদিন রাতে আমি কাকে দেখছি জানিস ?

হেলাল মৃদু কৌত’হলি চোখে তাকায়।

তানিয়া ! তানিয়াকে দেখছি।

তানিয়া ! কো.. কোন তানিয়া ?

তানিয়াকে মনে নাই ?

হেলাল কয়েক সেকেন্ড স্মৃতি হাতড়ায়। তানিয়া! আমরা যারে.. তবে মালটা কিন্তু জব্বর ছিল যা বলিস।

আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে যায়। ঠাস করে চোখের পলকে একটা চড় বসিয়ে দেই ওর গালে । শুধু হেলাল না, আমি নিজেও কাজটি করে হতভম্ব। এটা কি করেছি আমি ? রেস্টুরেন্টের লোকজন ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যস্ত হয়ে যায়।

হেলাল চড় খাওয়া গালে হাত রেখেই বলে, তুই আমারে ...  

সরি।

না, না, এটা তো সরির কোন বিষয় না। তুই আমারে মারলি কোন আইনে ?

বললাম তো সরি। তাছাড়া এসব শব্দ পাবলিক প্লেসে ইউজ করা আমার পছন্দ না।

হেলাল দাঁতে দাঁত চেপে বলে, তোর কোনটা পছন্দ ?

খামোকা কথা বাড়াচ্ছিস । আমি গাল পেতে দিচ্ছি। মারতে চাইলে মার। কিন্তু আমার কথাটা একবার বোঝার চেষ্টা কর। প্লিজ!

কি বুঝব ? তুই তানিয়াকে দেখেছিস। এখানে বোঝার... হেলাল এ পর্যন্ত বলে চুপ করে গেল। আমি জানতাম দেরিতে হলেও গাধাটা বুঝবে। একটু থেমে বিড়বিড় করে বলে, তানিয়াকে দেখেছিস মানে ?

মানে দেখেছি।

ও আসবে কোত্থেকে ?

সেটা আমি কিভাবে বলব ? কিন্তু এটা নিশ্চিত ও আছে। আমাদের আশপাশেই আছে।

কি ! কি চায় ?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ি। জানি না। হয়তো প্রতিশোধ।

কিসের প্রতিশোধ ?

তুই জানিস না ?

না। আমার মনে হয় তোর কিছু একটা ভুল হচ্ছে। সেদিন অতোটা খাওয়া ঠিক হয় নি। তুই তো এমনিতে সফট মাইন্ডের । আগে কবিতা টবিতাও আধ লাইন লিখেছিস। তুই হয়তো ওর মৃত্যুটা একসেপ্ট করতে পারিস নি। মনে মনে ভেবেছিস। ফলে, ঐ কি যেন বলে না, সাইকোলজিতে, হেলুসিনেশন...

আমি আজ ভোরে ওর অস্তিত্ব টের পেয়েছি। সেদিন না হয় নেশা করেছি। আজ ?

হেলাল অধৈর্য হয়ে বলে, এক কাজ কর। বাসায় গিয়ে ম্যারাথন একটা ঘুম দে। দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি যাচ্ছি। একটু কাজ আছে।

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ি। তবু বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় , হয়তো ও ঠিকই বলছে। একটা ঘুম দিলে এ ঘোর কেটে যাবে। সব হেলুসিনেশন। স্রেফ উত্তপ্ত মস্তিস্কের ভাবনা। ঠিক এ সময় কি যেন হয়ে যায়। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, আমার সামনে তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। স্থির। মৃদু হাসিমুখ। সেটা তুচ্ছার্থে নাকি ...। এমন কি বাতাসে ওর চুল উড়ছে।

হেলাল ! হেলাল !

হেলাল থমকে তাকায়।

আমি চোখ ইশারায় পাশে তাকাতে বলি। ও সংশয় চোখে ধীরে ধীরে কাঁধ ঘুরিয়ে দেখে। কি ?!

দেখতে পাচ্ছিস না ?

কি? কাকে ?

তানিয়া এখনো স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।

আমার অবাক লাগে। তাহলে কি ওকে একমাত্র আমিই দেখি ? আর কেউ না ? এটা কেমন করে হয় ?

হেলাল হেসে ফেলে। যা তো, ওঠ, তুই বাসায় যা।

যাচ্ছি। তুই যা।

হেলাল উঠে দাঁড়ায়।

হেলাল।

হেলাল ফিরে তাকায়।

সাবধানে।

হেলাল মৃদু হেসে চলে যায়।

আমি ফের তানিয়ার দিকে তাকাই। ও ধীর পায়ে আমার সামনের চেয়ারে বসে। একটু আগে যেখানে হেলাল বসেছিল। আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। কেবল ঢোক গিলি।

জসিম ভাই, ভয় পেয়েছো নাকি ?

না !

আচমকা শব্দ করে হেসে ওঠে তানিয়া। বিকট, অপার্থিব সে শব্দ। আমি কান চেপে ধরি।

তোমার মাথামোটা বন্ধুটা আমাকে বিশ্বাস করে নাই। তার মজা সে টের পাবে।

আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে বাইরে তাকাই। এইতো হেলাল হোন্ডা স্টার্ট দিচ্ছে। ওই তো ভট..ভট...

কি ! কি করবে তুমি ?

তানিয়া ফের হেসে ওঠে।

আমি সহ্য করতে পারি না। বাইরে তাকাই। যে ঘটনা এপাড়ায় আগে কোনদিন ঘটে নাই, কোনদিন ঘটবে কি না সে ব্যপারে সন্দিহান, তাই ঘটল। খুব অদ্ভুত ভাবে ছায়াছবির মতো আমি দৃশ্যটা দেখি। হেলালের হোন্ডা ও অপর দিক হতে দ্রুতগতি এগিয়ে আসা একটা মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ।

চোখের পলকে সব হয়ে গেল। হা হা করে লোকজন ছুটে গেল। মাইক্রোবাস ড্রাইভার উদভ্রান্তের মতো পালাল। চিৎকার, ইট নিপে। মনে মনে ভীষন প্রার্থনা করছিলাম , যা ঘটছে সব মিথ্যা। এখনই ডিরেক্টর বলবে, কাট। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। হেলাল গায়ের ধুলো , কৃত্রিম রক্ত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে। ডিরেক্টর ছুটে এসে পিঠ চাপড়ে দেবে, যা দেখালে বস্। হলিউড ফেল !

কিন্তু হেলাল ওঠে না। স্পট ডেড মানুষের উঠে দাঁড়াবার কোন আইন নেই।

৩.

ডাক্তার সাহেব আপনি দয়া করে পুরো ঘটনাটা শোনেন। একটু সময় লাগবে। কিন্তু সমস্যাটা বোঝার জন্য সব জানা দরকার। ইনফ্যাক্ট আমি বলতে চাই।

সাইকিয়াট্রিস্ট মঈন উদ্দিন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড , আমি কি পান খেতে খেতে আপনার গল্পটা শুনতে পারি ? আমার পানের ভীষন বদভ্যাস।

প্লিজ ! আর একটা কথা, এটা কিন্তু গল্প না। আমার নিজের ঘটনা।

সাইকিয়াট্রিস্ট  পান মুখে দিতে দিতে মাথা ঝাঁকায়। ও সরি, সরি , ইউ আর এবসুলেটলি রাইট।

আমি মাথা নুয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবি। কোথা থেকে শুরু করবো ? .... কাস এইটে উঠে আমি প্রথম সিগারেট ধরি। স্বাভাবিক যা হয়, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খাওয়া। তখনকার দিনে এটা যেমন বড় হয়ে গেছি বোঝানো তেমনি মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষনের ব্যপারটাও বোধহয় কাজ করেছিল। বেশ কিছু বন্ধু জুটে গেল। আমাদের কাজই ছিল স্কুল পালিয়ে মেয়েদের স্কুলের সামনে বসে শিষ দেয়া, অকথ্য মন্তব্য। ধীরে ধীরে এটা যেন একধরনের খেলায় পরিণত হলো। মেয়েরা যত বিরক্ত হয় আমরা তত মজা পাই। পাশাপাশি পাড়ায় এক আধটু গুন্ডামি। ফলাফল লেখাপড়ায় ক্রমশ অবনতি। কাস ফাইভে আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। সম্ভবত সেটাই আমার জীবনের একমাত্র সাফল্য। কাস এইটে বৃত্তি পাওয়া দূরের কথা। দেয়ারই সুযোগ হলো না। কাস টেনে থাকতে আমার খোঁজে বাসায় পুলিশ এলো। আমি সিঁড়িতে নামছি। সাব ইন্সপেক্টর আর এক কনস্টেবল উঠছে। আমি বলি , স্লামাইকুম।

সাব ইন্সপেক্টর আমাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে। এটা আমজাদ সাহেবের বাড়ি ?

জি !

তার ছেলে জসিম ?

জি !

তুমি কে ?

আমি মৃদু হেসে বলি, আমার নাম দুলাল। আমজাদ সাহেব আমার মামা হন। কি হয়েছে বলেন তো ?

জসিম কি বাসায় আছে ?

জি না। ভাইজানতো বাসায় নাই। তবে মামা আছে। ভেতরে আসেন। আমি খবর দি।

তুমি কি এখানেই থাকো নাকি ?

জি না, বেড়াতে এসেছি।

মামাতো ভাইয়ের খোঁজ খবর রাখো কিছু ?

সে তো একটু ডানপিটে স্বভাবের।

এক বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে ফেলা আর ডানপিটে স্বভাব তো এক জিনিস না।

আমি চূড়ান্ত অবাক হয়ে বলি, মাথা ফাটিয়েছে নাকি ?

ফাটিয়েছে মানে ? চুরমার করে দিয়েছে। আটটা স্ট্রিচ পড়েছে।

বলেন কি !

আমি পুলিশ দুজনকে যত্ন করে বসার ঘরে বসাই। বাবা নামায পড়ছিল। মার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলি, পুলিশ এসেছে। ম্যানেজ করো। মা তো আকাশ থেকে পড়েছে। পুলিশ এসেছে মানে ? মার সবকিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি। তিলকে তাল বানানো স্বভাব। আমি তাই কথা না বাড়িয়ে বাবাকে খবর দিতে বলে বাসার পেছনের পাইপ বেয়ে পালাই।

ফুটবল টুর্নামেন্ট কেন্দ্র করে পাশের পাড়ার এক ছেলেকে পিটিয়েছি। তারই রেশ ধরে পুলিশ এসেছে। ব্যপারটা এতদূর গড়াবে , ভাবিনি। শালার বাপটা একটা খচর। মানুষের যে কেন বাপ থাকে ! রক্ত দেখে সাথে সাথে থানায় জিডি করেছে। সে রাতে বাবাও ভীষন একচোট মারল। আমারও রোখ চেপে গেল। আসলে বুঝতে পারছিলাম যে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই নষ্ট হয়ে যাওয়া, বখাটে হয়ে যাওয়ার মধ্যে একধরনের আনন্দ আছে। নিষিদ্ধ আনন্দ।

এক চান্সে এস এস সি হলো না। দ্বিতীয়বার টেনেটুনে। কলেজেও তাই। তারপর আমার মনে হলো একজীবনে যথেষ্ট পড়ালেখা হয়েছে। আর না ! ব্যবসা পাতির চেষ্টা করলাম। কিছু টেন্ডারের কাজ করেছি। আর সাধ্যের মধ্যে যেসব বদভ্যাস করা যায় সবই রপ্ত হয়ে গেল। বাবা মা একপর্যায়ে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। বলা যায়, তারাও বাঁচলেন। আমিও।

এভাবেই চলছিল সব। ভালোমন্দ জানি না। তবে বিতৃষ্ণা আসেনি এটুকু বলতে পারি। হঠাৎ একটা ঘটনা আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিল।

ডাক্তার সপনে পানদানিতে পিক ফেলে।

আপনি কি বোর হচ্ছেন ?

ডাক্তার মুখ প্রসারিত করে হাসে। যদি হই তাহলে আপনি ঘটনাটা বলবেন না ?

আমি এক মুহুর্ত্ত থেমে বলি, বলব।

বছর দুয়েক আগে আমাদের পাড়ায় এক ফ্যামিলি আসে। তাদের এক মেয়ে, কলেজ পড়ুয়া, আমার বন্ধুর পছন্দ। সে একাধিকবার প্রপোজ করে। মেয়েটি এড়িয়ে যায়। বিষয়টা নিয়ে বন্ধুমহলে অনেক রকম হাসি ঠাটা হয়েছে। একপর্যায়ে যখন বুঝতে পারা গেল, আমাদের বন্ধুকে ঐ মেয়ের পছন্দ না। যদিও পছন্দ হওয়ার মতো তেমন কোয়ালিটি ওর নেই। বানরের আধুনিক এডিশন যে মানুষ তা ওকে দেখলে বিশ্বাস হয়, এছাড়া এসএসসি ফেল বেকার, বখাটে এটসেটরা। তখন হলো কি, ওর কলেজ যাওয়া আসার পথে শুরু হলো টিজ করা। কিশোর বয়সের সে অভ্যাস ততোদিনে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাই মাত্রাটা কতোটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গিয়েছিল তা খেয়াল করিনি কোনদিন। একদিন, বৃষ্টির দিন। আমরা যথারীতি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি। এসময় হেলালই প্রথম ওকে দেখে মানে আমার যে বন্ধূ প্রপোজ করেছিল। রিক্সা টিক্সা পায়নি বলে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল তানিয়া। মানে...

ডাক্তার মাথা নাড়ে। বুঝতে পেরেছি। তারপর ?

হেলাল হুট করে বলল, চল মজা করি। আমার তেমন ইচ্ছে ছিল না। তবু এসব েেত্র যা হয়, দুজন হ্যাঁ বললে অপরজন অটোমেটিক হ্যাঁ । যেতে হলো। দাঁড়ালাম ওর সামনে পথ আটকে।

তানিয়া বোধহয় একটু ভয়ই পেয়েছিল। গুটি শুটি হয়ে দাঁড়ায়।

কিছু বলবেন ?

হেলাল দাঁত কেলিয়ে হাসে। বাসায় যাচ্ছ ?

তানিয়া শক্ত মুখে জবাব দেয়, হ্যাঁ।

চলো না, বৃষ্টিতে ভিজি। প্রেম করবা না বলে বৃষ্টিতে ভেজা যাবে না এমন আইন হয়েছে নাকি ? তাছাড়া বৃষ্টির পানিতে ভিটামিন বি আছে। ঠিক না জসিম ?

তানিয়া একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল কি ?

আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছি।

আমাকে যেতে দিন।

যাবা তো । অবশ্যই যাবা। আচ্ছা যাও, পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট দুজনে হাত ধরে চোখ বুজে চলো হারিয়ে যাই।

জসিম ভাই সংগত দেয়, লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প !

হেলাল ঝট করে তানিয়ার হাত ধরে ফেলে।

হাত ছাড়েন। হাত ছাড়েন বলছি।

তোমারে একটা শের শোনাই। জবরদস্ত শের। কিস কিস কি মাহফিলমে কিস কিস নে কিস কিস কো কিস কিয়া ? এক তুম থি জো হার কিস কো মিস কিয়া। অর এক ম্যায় থা জো হার মিস কো কিস কিয়া।

হেলালের শের-ই-প্রতিভায় আমরা মুগ্ধ হয়ে হর্ষধ্বনি তুলি।

তানিয়া আচমকা ধাই করে চড় মেরে বসে ওকে।

রেগে গেলে হেলালের ব্যলেন্স থাকে না। আমরা জানি। তানিয়ার জানার প্রশ্নই ওঠে না। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তানিয়া কোনমতে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালায়। তারপর ...

আমি চারদিকে তাকাই। তানিয়া কি শুনছে ? নিশ্চয়ই শুনছে। তানিয়া আমি মা চাই। তুমি যা বলবে আমি তাতেই রাজি। এক দলা থুতু ফেলে যদি নাকে খত দিতে বলো তাই করবো। তবু .. তবু তুমি যাও। যাও তানিয়া। যাও। প্লি..জ।

ডাক্তারের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে। তারপর ?

আমি থেমে থেমে বলি, তারপর ... সেদিন.. ও আত্মহত্যা.. করে। কতটা নিচে নেমে গিয়েছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। এই ঘটনার পরেও এতটুকু অনুশোচনা হলো না। উল্টো ঐ পরিবারটি হয়ে উঠল আমাদের খেলার পাত্র। পাড়ায় রকমারি কথা ছড়াচ্ছি। রিএকশন দেখছি। হা হা করে হাসছি। আমাদের যন্ত্রনায় পরিবারটি যখন চলে গেল ভাবলাম উচিৎ শিক্ষা হয়েছে।

এখন কি আপনার অনুশোচনা হচ্ছে ?

এটাকে অনুশোচনা বলা যায় কি না জানি না। আমি ..আমি.. বন্দি হয়ে গেছি ডাক্তার সাহেব। না..না.. এটা অনুশোচনা না। ভয়। একটা আতঙ্ক। সারান একটা আতঙ্কের মধ্যে আমি বাস করি। ঘুমাতে পারি না । চোখ মেলে কোথাও ভালোভাবে তাকাতে পারি না। মনে হয়.. মনে হয় এই বুঝি তানিয়া আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার শরীর হিম হয়ে আসে। আপনি... আপনি আমাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব।

আপনি তাকে দেখতে পান ?

মৃদু মাথা নাড়ি। পাই।

কথা বলে ?

বলে। আগে মানে আত্মহত্যার আগে ওর সাথে কখনো সেভাবে কথা হয়নি। এখন তুমি সম্বোধনে বলে।

এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছেন ?

এদিক ওদিক মাথা নাড়ি। কিন্তু ...

কিন্তু ?

গন্ধ পাচ্ছি। দুধ পোড়া গন্ধ। ও আছে। আশপাশেই কোথাও।

দুধ এ ঘরেই আছে। আমি রোজ সন্ধ্যায় একগ্লাস দুধ খাই। ডাক্তার ডেস্কের ভেতর থেকে এক গ্লাস দুধ বের করে দেখাল। জ্বাল দেয়ার সময় আজ বোধহয় একটু পুড়িয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা, পুরো ব্যাপারটি আপনার অবচেতন মনের কল্পনা। একধরনের অপরাধবোধ থেকে এর জন্ম। ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছে। এই যে আপনি দুধ পোড়া গন্ধের কথা বললেন তারও ব্যাখ্যা আছে। আত্মহত্যার পরে আপনি সেখানে গিয়েছিলেন ?

হ্যাঁ।

মনে করে দেখেনতো এ গন্ধটা তখনো পেয়েছিলেন কি না ! হয়তো সে বাড়িতেই চুলায় দুধ ছিল। এ ঘটনায় হত বিহবল হয়ে বাড়ির লোক চুলা বন্ধ করতে ভুলে যায়। ফলে পোড়া গন্ধটা আপনার মস্তিস্কে গেঁথে যায়। আপনি বলেছেন,তার সাথে সেভাবে কথা হয়নি। অথচ এখন তুমি করে বলে। এর কারণ আপনার অবচেতন মন তাই চেয়েছে। তবে জসিম সাহেব আপনি জানেন, কত বড় অন্যায় আপনারা করেছেন। আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আপাতত কিছু ঔষধ দিচ্ছি। নিয়মিত খান।

সাইকিয়াট্রিস্ট ঘস ঘস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দেয়। আমি আড়চোখে এদিক ওদিক তাকাই। সাইকিয়াট্রিস্টের চেয়ারের পেছন থেকে আচমকা তানিয়া বেরিয়ে আসে। যেন এতন ওখানে গুটি শুটি মেরে বসে ছিল। মৃদু হাসে। কি ভয়ংকর শীতল !

ডা..ডাক্তার সাহেব !

সাইকিয়াট্রিস্ট  আমার দিকে তাকায়। আমার দৃষ্টি অনুসরন করে তাকায়। জানি, সে কিছুই দেখবে না। জানি, এ প্রেসক্রিপশনে আমার কিছুই হবে না। তানিয়া .. তানিয়া .. আমাকে মুক্তি দেবে না !

৪.

আমি ইদানিং বাইরে তেমন যাই না। বেরোলেই একটা না একটা অঘটন ঘটছে। তানিয়ার কান্ড। আমাকে হেনস্থা করাই একমাত্র ল্য। এতদিনে বুঝতে পারছি, আমাকে নিয়ে এটা ওর একটা খেলা। মৃত্যু মৃত্যু খেলা । মাঝে মধ্যে এবিষয়ে ওর সাথে অল্প কথাও হয়েছে। ও কথা ততো বলে না। বেশির ভাগ সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। শীতল দৃষ্টি। ক্রুর মৃদু হাসি।

তানিয়া তুমি তো এক কাজ করলেই পারো। হেলালের মতো আমাকেও একবারে শেষ করে দাও। ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি ?

ও নিরুত্তর। তবে আমার কথায় মজা পাচ্ছে বুঝতে পারছি। জালের মধ্যে আটকে পড়া মাছের লাফ ঝাঁপ দেখে আমরা যেমন মজা পাই।

তুমি চাও আমি পুলিশের কাছে যাই ?  আমার শাস্তি হোক।

মুক্তি চাইছ, না ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মুক্তি চাইছি, তানিয়া।

তারপর ?

তারপর ! তারপর কি ?

তারপর আবার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করবে। বর্ষার দিনে হুটহাট একলা পেয়ে আরেকটু সাহসী হয়ে উঠবে ...

না, না, আমি ভালো হয়ে যাবো। কথা দিচ্ছি।

এতটুকুতেই কান্ত হয়ে পড়েছ ?

আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বলি, আমি আর পারছি না তানিয়া।

তুমি আমার ঝুলন্ত দেহটা দেখেছিলে, জসিম ভাই ? যে ফ্যানে আমি ওড়না ঝুলিয়েছিলাম তার একটা পাখা পুরো বেঁকে গিয়েছিল। তুমি বুঝতে পারো, কতটা যন্ত্রনা তখন আমার হচ্ছিল ? তুমি তার কিছুই বুঝবে না।

বুঝি ! বুঝি তানিয়া ! বড় কষ্ট ! বিশ্বাস করো, সেদিন আমি কিছু খেতে পারি নাই। কেবল বমি পাচ্ছিল। তোমার চোখদুটো কেমন ঠিকরে বেরিয়ে এসেছিল। জিহবা ...

তানিয়া শক্ত মুখে বলে, যে কষ্টের ভেতর দিয়ে আমি গেছি তোমাকেও তার স্বাদ পেতে হবে। পেতেই হবে।

ও হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়।

আমি অন্ধকারে চুল খামচে পড়ে থাকি। যন্ত্রনায় ছিড়ে যেতে চায় সব। ঔষধ গুলো খেলে ঘুম ঘুম আসে। কিন্তু ঘুম হয় না। কেবল ছটফট কাটা মুরগির মতো।

মজনু ভাই ফাইনালি আমেরিকার ভিসা পেয়েছে। ঝলমল মুখে মিষ্টি নিয়ে একদিন বাসায় হাযির। বাবা মাকে অনেকন ধরে বোঝাল, ফ্রাস্টেশন। গভীর ফ্রাস্টেশনই আমার বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। আমেরিকা গিয়ে একটু সেটল হয়েই আমাকে নিয়ে যাবে।  

বাবা মা হয়তো বন্ধু প্রীতিতে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। দ্যাখো বাবা , সারাদিন ঐ ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। কাউকে ঢুকতে দেয় না। কেউ একটু শব্দ করলেও চিৎকার হুলস্থূল করে বসে।

চিন্তা করবেন না খালাম্মা। এর থেকেও খারাপ হতে পারতো।

আমাকে দেখে মজনু ভাই সত্যি সত্যি অবাক হয়। এ কি অবস্থা হয়েছে তোর ?

আমি মৃদু হাসি। মাথার যন্ত্রনাটা আজ একটু কম।

শোন, ফার্স্ট চান্সেই বিয়েটা সেরে ফেলব। একটা আমেরিকান বাগাতে পারলেই আর চিন্তা নাই।

তুমি ভালোই আছো।

ভালো আছি মানে ? আমার তো চিন্তার শেষ নাই। সামনের ২৫ তারিখে ফাইট। অথচ এখনো কত কাজ বাকি। কিছুই বুঝতে পারছি না কি করবো ! পুরা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা ! এই টাইমে কোথায় তোরা ফ্রেন্ডরা একটু হেল্প করবি, তা না ! একটা তো মাইনাস কেস। মজনু ভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তবে এর থেকেও খারাপ হতে পারতো !

কি বলছো মজনু ভাই ? হেলাল মোটর এক্সিডেন্টে মারা গেছে আর তুমি বলছো এ থেকেও খারাপ হতে পারতো !

ও যেদিন ঐ ভটভটি হোন্ডাটা ম্যানেজ করল আমার কাছে এসেছিল। বলল, চল এক জায়গায় যাবো। কি কাজে যেন আমি গেলাম না। দ্যাখ, যদি রাজি হতাম, তাহলে কি হতো ! আচ্ছা , তোর ঘটনা কি , বলতো ?

ঘটনা কিছু না।

কাকে নাকি দেখিস ? সত্যি নাকি ? পার্টিকুলার সে কি চায় ? কোন বিদ্যা শেখাচ্ছে ?

আমি মৃদু হাসির ভঙ্গি করি।

শোন, এরপরে যদি সে আসে স্ট্রেট টাকা ডিমান্ড করবি। ফ্রি ফ্রি কোন বিদ্যা অর্জনের দরকার নাই।মনে থাকবে?

মজনু ভাই তোমার তানিয়ার কথা  মনে আছে ?

মজনু ভাই চোখ নাড়ায়, ঐ সুইসাইড কেস ?

হ্যাঁ।

এ্যাই, তানিয়াকে দেখিস তুই ? তুই শালা মনে মনে ওকে ...

না, মজনু ভাই, ওসব না। তানিয়া আসলে মরে নাই।

মরে নাই মানে ?

মজনু ভাই দ্বিধাগ্রস্থ চোখে ঘুরে ঘুরে এদিক ওদিক তাকায়।

হেলালের মৃত্যুটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু না। তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি ।

তুই এসব কি বলছিস ?

মজনু ভাই আমরা বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি। বিরাট অন্যায়।

আমি যাই রে । অনেক কাজ পড়ে আছে। পরে একসময় তোর সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেব।

২৩ তারিখ রাতে মজনু ভাইয়ের পা ভাঙল। রিক্সা করে ফিরছিল। আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় পানি জমা। আচমকা খাদে পড়ে রিক্সা উল্টায়। রিক্সাওয়ালা, মজনু ভাই দুজনেই পঙ্গুতে এডমিট। একদিন দেখতে গেলাম। পা উপরে ঝুলিয়ে রেখেছে।

ফেসে গেলাম রে ! এখানকার ডাক্তাররা মানুষ না। সব এনিমেল। বলতেছে, তিন মাস বেড রেস্ট। আরে গাধা, তিন মাস চিৎ হয়ে, কাত হয়ে, উপুর হয়ে শুয়ে আমি করবো টা কি ? আমেরিকা হলে...

কি অবস্থা এখন ?

ফ্রাকচার মারাত্মক। কতগুলো নাকি টিস্যু ছিড়ছে। অবশ্য এর থেকেও খারাপ হতে পারতো !

এর থেকে খারাপ কি আশংকা করেছিলে ?

ধর, যেভাবে রিক্সার নিচে চ্যাপ্টা হয়ে পড়েছিলাম আমার ধারণা ছিল পা-টাই কেটে নেবে।

যাই তাহলে। মাঝে মাঝে আসব।

এ্যাই শোন !

কিছু বলবা ?

মজনু ভাই এক মুহুর্ত চুপ থেকে বলে, তানিয়া কি এখনো তোর কাছে আসে ?

আসে।

ওর প্ল্যানটা কি আসলে ?

আমি মৃদু হাসি। অসহায়ের হাসি। আমি জানি না, মজনু ভাই।

আমি একটা খুন করেছি।

তাই নাকি ? ইন্সপেক্টর খুব আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সাব ইন্সপেক্টরকে ডাকে। দ্যাখো মিজান, চাকরি জীবনে এটা খুব রেয়ার। খুনের আসামি নিজে থানায় এসেছে ধরা দিতে।

সাব ইন্সপেক্টর দ্বিধান্বিত কন্ঠে জানতে চায়, কেসটা বলেন তো ?

তানিয়া হত্যা মামলা।

এই নামে তো কোন কেস নাই।

ও আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু দায়ী আমি।

বিষ সাপ্লাই দিছিলেন না দড়ি ?

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। এরা বেশ মজা পাচ্ছে বুঝতে পারছি। এরা কেন আমাকে বিশ্বাস করছে না ? কেন সাজা দিচ্ছে না ?

ভাই, আপনার এ্যাড্রেস বলেন।

কেন ?

যোগাযোগ করে দেখবো, ছাড়া পাইছেন কবে ? যে ডাক্তার আপনাকে ছাড়ছে তার বিরুদ্ধে একটা কেস করা যায়, কি বলো মিজান ?

পুলিশ দুজন নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকে।

৫.

স্যার, একমাত্র আপনারা পারেন আমাকে মা করতে। আমি মা চাইতে আসছি। আপনারা মা করলেই ও আমাকে ছেড়ে দেবে। স্যার আপনি একবার বলেন, আমাকে মা করছেন। আমি সারাজীবন আপনাদের গোলাম হয়ে থাকব। বাজার করে আনব। ঘর দোর বাথরুম পরিস্কার করবো। জুতা মুছে দেব। সব। যা বলবেন সব করব। শুধু স্যার , একবার বলেন।

তুমি এ বাসার ঠিকানা পেয়েছ কোথায় ?

অনেক... অনেক কষ্টে পেয়েছি স্যার। এর কাছে যাই, তার কাছে যাই কেউ বলতে পারে না। পরে এক মুদি দোকানদার বলতে পারলো । আপনারা তার কাছ থেকে সদাই করতেন নাকি ! তার দোষ নাই স্যার। সে প্রথমে দিতে চায় নাই।

ওকে মেরেছ ?

না ... না স্যার। আমি এখন কাউকে মারি না। একটা ...একটা সামান্য পিঁপড়া পর্যন্ত না। বিশ্বাস করেন। একটা ধমক দেয়ার মতা আমার নাই। মাকড়সা.. মাকড়সার মতো দেয়াল আকড়ে আমি হাঁটি। আমাকে দেখে সে করুনা করে দিয়েছে ঠিকানা।

শামীম সাহেব , তানিয়ার বাবা , ভালো করে আমাকে দেখেন। কতটা অসহায় হয়তো পরিমাপ করছেন।

তুমি যাও এখান থেকে। কোনদিন আসবে না।

স্যার, স্যার এটা আপনি কি বলছেন ? আমি বড় আশা নিয়ে এসেছি। আমি ভুল করেছি। আপনি আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি তাই মাথা পেতে নেব। যা করতে বলবেন তাই করবো।

পারবে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে ? শামীম সাহেব উদাস চোখে জানলার বাইরে তাকান। জানি, পারবে না। আমার মেয়েটা বড্ড অভিমানি ছিল। একবার ঝড়ে বাসার সামনে বকুল গাছটা ভেঙে গেল। পরের দিন সকালে ওর সে কি কান্না ! রাতে ঝড় উঠেছে দেখে কেন মাটি খুঁড়ে বকুল গাছটা ঘরে আনা হলো না এই নিয়ে কান্না !

তানিয়ার চোখে পানি ছলছল করে। এই প্রথম বার আমি ওকে দেখে চমকে উঠি না। আতঙ্কগ্রস্থ হই না। অবুঝ শিশুর মতো বাবাকে দেখছে। যেন এুনি ঝাপিয়ে পড়বে কোলে।

স্যার !

শামীম সাহেবের ঘোর ভাঙে।

যা হোক, এসব তোমাকে বলছি কেন ? তোমার মত একটা বখাটে কি বুঝবে ? তুমি যাও। তোমার প্রতি আমার কোন রাগ নাই। এটাকে নিয়তি মেনে নিয়েছি আমি। তুমি যেমন অপরাধি তেমনি আমিও। বাবা হয়ে ওকে আমি কি দিতে পেরেছি ? একটা নিরাপদ পরিবেশ যেখানে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় ? না ! বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস ? না ! কেবল এসকেপিস্টের মতো দুর্নামের ভয়ে সরে দাঁড়িয়েছি। তোমার চেয়ে আমি তো কম অন্যায় করি নি !

স্যার , ও কাঁদছে !

শামীম সাহেব ঘুরে তাকান। কে !

তানিয়া !

শামীম সাহেব এদিক ওদিক তাকান। কোথায় ?

জানি দেখবেন না তবু হাত তুলে দেখাই। তিনি অন্ধের মতো শূন্যে হাতড়ান। মা! মাগো! কোথায় তুমি !

তানিয়া বাবাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। বারবার ব্যর্থ হয়ে তাকায় আমার দিকে। সে চোখে কেবল ঘৃনা।

আমার মেয়েকে তুমি দেখতে পাচ্ছো ! অথচ কি অপদার্থ পিতা সে সৌভাগ্য আমার কোনদিন হবে না । কোনদিন আর মামনিকে দেখবো না। ওহ !

শামীম সাহেব কেঁপে কেঁপে কাঁদেন। ড্রয়িংরুমের পর্দার ফাকে কয়েকটা ছোট ছোট মুখ দেখতে পাচ্ছি। তারা আশ্চর্য হয়ে বাবাকে দেখছে। একটা অচেনা, বখাটে লোকের সামনে কেন তাদের বাবাটা ছেলেমানুষের মতো কাঁদছে  ! লোকটা চায় কি ?

মজনু ভাইয়ের অবস্থা বোধহয় আগের চেয়ে খারাপ। চোখ বসে গেছে। এলোমেলো চুল। সাত দিনের বাসি দাঁড়ি গোফ। আমাকে দেখে মৃদু হাসে। পা-টা কেটে ফেলতে হবে রে ! ভিতরে ইনফেকশন হয়ে গেছে।

কি বলছো ?

পরশু অপারেশন। এখনো ফুল টাকা যোগাড় হয় নাই। আমি বলে দিয়েছি, আমার আমেরিকা যাওয়ার পয়সায় কেউ হাত দেবে না। ওটা আলাদা।

অপারেশন আগে হোক। পরে আমেরিকা।

মজনু ভাই চুপ করে থাকে।

দুঃখ করো না। এর থেকেও খারাপ হতে পারতো ।

মজনু ভাই বিরক্ত মুখে বলে, গাধার মতো কথা বলিস না।

না, ধরো, আরেকটা পা-তো থাকছে, তাই না ?

পথে নেমে আড়চোখে তাকাই। ও মাথা নুয়ে হাঁটছে। বড় মায়া মায়া মুখ।

তানিয়া।

ও ফিরে তাকায়। চোখের নিচে অশ্র“ শুকিয়ে আছে এখনো।

আমি যে ভুল করেছি তার মা নাই।

ও কিছু বলে না।

একটা কথা বলবো। জবাব দেবে ?

ও ধীর পায়ে হাঁটে।

আচ্ছা , শুধু আমি কেন তোমাকে দেখতে পাই ?

তুমি তো আমার প্রেমে পড়েছিলে।

তুমি জানতে !

মেয়েরা অনেক কিছু ধরে ফেলে। সে বুঝবে না। তোমার বন্ধু আগে প্রপোজ করেছে বলে চেপে গেলে ?

হেলাল ভীষণ একগুয়ে। ও সব বুঝেও তোমাকে বিরক্ত করতো।

আমি খুব ভিতু টাইপের মেয়ে ছিলাম। সেদিন কিভাবে সাহস করে ওকে চড় মেরেছিলাম , জানো ?

আমি কৌতুহলি চোখে তাকাই।

আমার ধারণা ছিল, ওর স্পর্ধার এই বাড়াবাড়ি দেখে তুমি অন্তত কিছু একটা করবে। অথচ তুমি নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আমার অপমান দেখলে ! আমার এত রাগ লাগল ! চোখ ফেটে কান্না আসছিল !

বড্ড কাপুরুষ ছিলাম।

হ্যাঁ , কাপুরুষ।

আর ভয় পাবো না এখন থেকে। তোমাকেও না। জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, তানিয়া ? জীবন যেখান থেকে ইচ্ছা , শুরু করা যায়। তুমি থাকবে তো সঙ্গে ?

ও জবাব দেয় না। হয়তো দেবে না। বাতাসের বিপরীতে কেউ না কেউ ঘুরে দাঁড়ায়। কেউ না এলে কিছু যায় আসে না।

কাঠিবাবু

সায়ন্তনী পুততুন্ড

লোকটার নাম বটকৃষ্ণ। অপভ্রংশে বটকেষ্ট।

বয়স ত্রিশ থেকে তেতাল্লিশ পর্যন্ত যে কোন সংখ্যা হতে পারে। দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট দু ইঞ্চি। ওজন চল্লিশ কে জি! উস্কোখুস্কো চুল, আমের আঁটির মতো মুখে তেল মজুত রাখার উপযুক্ত দুটি গাল, কাদা ঘোলা চোখ এবং খিটখিটে মেজাজের মালিক!

নিন্দুকেরা বলে বটকেষ্টর মুখ দেখলে নাকি একটানা সাতদিন ডিসেকশন টেবিলে কাটানোর এফেক্ট হয়। সত্যি সত্যিই তাই হয় কি না জানা নেই, তবে নিন্দুকদের কথা গায়ে না মাখাই ভালো। বটকেষ্ট মাখেও না।

বারাসতের একটু অভ্যন্তরে একখানা কচুরীপানাযুক্ত ও মশাচ্ছন্ন পুকুরের পাশে ছোট্ট শ্যাওলাধরা ইঁট পাঁজর সর্বস্ব বাড়িতে দুটি টিয়া, একটি ঘুঘু, একরাশ ছুঁচো ও ইঁদুর—আর একটি রুগ্ন বৌ নিয়ে তার উলোঝুলো সংসার। রোজ সকালে ‘অ্যাঁ...অ্যাঁ’ করে একরাশ বমির সাথে নৈঃশব্দকে উত্তেজিত করতে করতে দিনের শুরু। আর রাতে ঝাল ঝাল শুয়োর বা মুরগীর পরিত্যক্ত অবশিষ্টাংশের সাথে সস্তার বাংলা মদে দিনের শেষ।

এই জাতীয় শুরু ও সারার মাঝখানের সময়টা কাটে মেইন রোডের উপর তার নিজস্ব ছোট্ট ঘুপচি পানের দোকানে বসে।

বটকেষ্ট প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের নাম কস্মিনকালেও শোনেনি। পানের দোকানে বসে সে সারাদিনে যতটুকু নিজস্ব দার্শনিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট। তার মৌলিকতা সম্পর্কে কোন আগ্রহ নেই। থাকলে জানতে পারতো যে, মাস্কারাময়ীর আস্কারায় জেগে ওঠা মনের গভীর আকুতি শুধু তার একার নয়—ব্যর্থতার এই জ্বালায় কমবেশি সকলেই জ্বলেছেন। পানের দোকানি, নিরীহ কেরানি থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট –এমনকি দান্তে, শেলি, বায়রণ পর্যন্ত কেউ বাদ যান নি।

অতঃপর সারাদিন দোকানে কাটিয়ে এসে রাত্রে একথালা পান্তাভাত আর ঝাল ঝাল মাংস সপাসপ মেরে দেওয়া। সাথে দেশি মদের অনুষঙ্গ! এবং স্বাভাবিক নিয়মেই চিররুগ্ন স্ত্রীয়ের সাথে অস্বাভাবিক নড়বড়ে সঙ্গম। বাকি রাতটা কাটে গেঁয়ো পাঁচীর বিছানায় শুয়ে পরীর স্বপ্ন দেখে!

জীবন বলতে এইটুকুই! প্রাত্যহিক একঘেয়ে কাজগুলো নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা। আলুথালু ফাটাফুটি দিনগুলোকে সেলাই করে যাওয়া। অবশেষে কান্ত হয়ে পড়া,--আর আবার পরের দিন সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি!

স্বাভাবিকভাবেই মনে খুব সঙ্গত একটা প্রশ্ন জাগে। লোকটা বাঁচে কি নিয়ে? এ হেন নিস্তরঙ্গ একটানা বিনোদনহীন জীবন—আর যাই হোক, মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে না। যারা এই ধরণের জীবন যাপন করেন তারা তাস পাশা খেলে, জুয়া সাট্টার আড্ডায় গিয়ে অথবা রেড লাইট এরিয়ার উর্বশীদের কাছ থেকে প্রেম কিনে কোনমতে দিন গুজরান করেন। ঐটুকুই তাদের রসদ!

অথচ বটকেষ্ট এর কোনটাই করে না! তাস জুয়ার নেশা তার নেই! মদ খেলেও, মেয়েমানুষের দোষ আছে একথা বটকেষ্ট সম্পর্কে কেউ বলবে না! আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পাড়ায় তার ছায়াও পড়েনি—যদিও ও পাড়ায় যাতায়াত থাকার বেশ যুৎসই কারণ ছিল!

এই কার্য-কারণের মাঝখানের ফাঁকটাই লোকটার সম্পর্কে কৌতুহল জাগিয়ে তোলে। জুয়া খেলা বা লাম্পট্য—কোনটাই খুব গুণের কথা নয়। কিন্তু তার মতো মানুষের ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক চরিত্রগত ত্রুটি। ঐ ত্রুটিটুকু না থাকার জন্যই হয়তো লোকটাকে বড় বেশি অস্বাভাবিক লাগে। মনে হয় কোনরকম বিনোদন ছাড়া মানুষটা বেঁচে আছে কি করে.........?

সেদিন সকালে খোশমেজাজে দোকান খুলে বসেছিল বটকেষ্ট।

এখন অফিসটাইম। বাবুরা ভাত খেয়ে পান চিবুতে চিবুতে আপিস যাবেন। তাই সকালের দিকটায় বিক্রিবাটা বেশি হয়। ব্যস্ততাও তদনুরূপ। কারও মিঠাপাতিতে চুন, সুপুরি, খয়ের। কারুর মৌরী, মশলা, চমন বাহার, কেউ বা আবার সাদাপানে জর্দা! তার সাথে চ্যান্সেলর, নেভিকাটের ফরমায়েশ তো আছেই। বটকেষ্টকেই সব মনে রাখতে হয়। ধরাবাঁধা খদ্দেরকে বাঁধাধরা অর্ডার সাপ্লাই দিতে দিতে আবার টুকটাক রসালাপও চলে—

--‘কেমন আছেন দাদা?আজ যে এত সকাল সকাল?’

দাদার উত্তর দেবার অবসর নেই। কোনমতে খুচরো আড়াই টাকা বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন—‘স্পেশ্যাল ডিউটি’।

--‘ইস্পেশাল ডিউটির জন্য ইস্পেশাল পান বুঝি? হেঁ হেঁ হেঁ...’।

দাদাটি তার ছোট্ট রসিকতায় হাসার সময় পেলেন না দেখে সে নিজেই একচোট দেঁতো হাসি হেসে নিল। পরমুহূর্তে খরিদ্দারটি পিছন ফিরে চলে যাওয়া মাত্রই হাসি থামিয়ে ভেঙচি কেটে বলল—‘ ইস্পেশাল ডিউটি! সা—ল্লা—হহ’।

তার প্রায় মৃতবৎ নিষ্প্রভ চোখ চিতার আগুন নিয়ে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলে ওঠে! সবাইকে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিতে চায়!!!

 

আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে আসে। খদ্দেরদের ভিড়ও ক্রমশ পাতলা হচ্ছে। কাছাকাছি বাড়ির গুটিকতক বৌদি তার নিয়মিত ক্রেতা। ভাতঘুম দেওয়ার আগে একটা মিষ্টি পান তাদের বরাদ্দ। কিছুণের জন্য একটা মেয়েলি সুখী সুখী গন্ধ ভেসে বেড়ায় ছোট্ট দোকানে। তারপরেই ফেটে যায় আবেশের বুদবুদ গুলো! মেইন রোডের শ্লথ ট্র্যাফিকের পাশে ক্ষুদ্রতম ছায়া নিয়ে এসে দাঁড়ায় খাঁ খাঁ নির্জন দুপুর!

বটকেষ্ট তার স্বল্প পরিসর দোকানে হাত পা গুটিয়ে প্রায় গোল হয়ে বসে ঝিমোচ্ছিল। সবে তন্দ্রার ঝিমঝিমে মৌতাত অল্প অল্প ছড়িয়ে পড়ছে, এমন সময় ‘ক্যাঁ---চ’ করে একটা গাড়ি ব্রেক কষে এসে দাঁড়াল তার সামনে।

তন্দ্রাটা কেটে যেতেই ধড়মড় করে উঠে বসে বটকেষ্ট। ততণে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে জুতো মসমসিয়ে নেমে এসেছেন এক সুসজ্জিত ভদ্রলোক।

--‘ইন্ডিয়া কিং আছে?’

সে বোকার মত মাথা নাড়ে। এই নামটা তার কাছে পরিচিত নয়। ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন মনে হয়।মুখে সামান্য কুঞ্চন ছাপ ফেলেই মিলিয়ে গেছে।

--‘শুনছো?’ গাড়ির জানলায় এবার একটা মুখ ভেসে উঠেছে। মুখ না বলে বেলুন বললেই বোধহয় ভালো হয়। পিটপিটে চোখ, ডাবল ডেকারে চাপা দেওয়া নাক, গ্রীবার লেশ মাত্র নেই। সারা গায়ে একরাশ সোনালী আলো ঝমর ঝমর করে বলল—‘ওকে জিজ্ঞাসা করো না! লোক্যাল লোক। বলতে পারবে’।

ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির দিকে তাকালেন। তারপর এদিকে ফিরে গলা সাফ করে নিয়ে বললেন—‘রজনীবাবু,...মানে রজনী সান্যালের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো?’

বটকেষ্ট প্রথমে প্রশ্নটা খেয়াল করেনি। সে অবাক হয়ে মহিলাকেই দেখছিল। এই ভর দুপুরে জগদ্দল চেহারার মহিলা এমন ভয়ানক সেজেছেন কেন? এ পাড়ায় কোথাও কোন বিয়ে আছে বলেও তো মনে পড়ছে না!

--‘ এক্সকিউজ মি...রজনী সান্যালের বাড়ি...’

রজনী সান্যাল এ পাড়ার নামজাদা রইস!

--‘সান্যালবাবুর বাড়ি?’ সে এঁড়ে গলায় বলল—‘এই ত সোজা গিয়ে ডানদিকের গলির দুটো বাড়ির পরের তিনতলা বাড়িটা!’

--‘থ্যাঙ্কস’।

ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে বটকেষ্ট পেছন থেকে ডাকে—‘ও সার, শুনুন...’

তিনি অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়ান—‘ইয়েস!’

--‘ না ...মানে আপনি সান্যালবাবুর কে হন?’

নিতান্তই নিরীহ কৌতুহল। উত্তরে গাড়ির ভিতর থেকে ভেসে এলো অ্যালসেশিয়ান গর্জন। যেন বলতে চায় –‘ কে হে তুমি! আমার মনিব কার কে হন তাতে তোমার কি?’

সে ঢোঁক গেলে। আড়চোখে গাড়ির জানলায় তাকায়। কুকুরটা বাঁধা আছে তো?

--‘ না...আসলে আপনাকে অনেকটা ওঁর মতোই দেখতে কি না...তাই জানতে চাচ্ছিলাম...’।

কথাটা বলেই বুঝতে পারল কি ভুল করেছে!

সান্যালমশাই অত্যন্ত কুৎসিত দর্শন! তাঁর মতো দেখতে মানে...

ভদ্রলোক কিন্তু বেশ ভালো মানুষ। রাগলেন না। অর্থাৎ পয়সাওয়ালা মাত্রেই খেঁকুটে নয়। বরং হেসে বললেন—‘আমি ওঁর কেউ নই। তবে হতে যাচ্ছি। ওঁর ছেলের সাথে আমার মেয়ের...’

বটকেষ্টর মাথা একধাক্কাতেই পরিষ্কার। সে অদ্ভুত মুখভঙ্গী করে পান সাজতে সাজতে বলে—‘ অ!!!ও-না-র ছে-লে! তা ভা—লো!’

ভদ্রলোক তার মুখভঙ্গী দেখে চলে যেতে গিয়েও পারলেন না। পানের দোকানি মিটমিট করে তার দিকেই তাকাচ্ছে। মুখ দেখলেই মনে হয়, ওর ভিতরে কোন রহস্য আছে। অথবা গোপনীয় কোন কথা!

এমন কিছু, যা সে বলি বলি করেও বলছে না।

--‘তুমি ওঁর ছেলেকে চেনো?’

বটকেষ্ট সুপুরির কুঁচির মতোই মিহি দৃষ্টিতে তাকিয়েছে—‘চিনবো না স্যা-র!!! কে না চে—নে!’

এমন কথা থেকে বুদ্ধিমান লোক মাত্রেই বুঝতে পারে যে চেনার খবরটা খুব স্বস্তিজনক নয়। ভদ্রলোক তখনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বাকিটা পূরণ করে দেয়।

--‘ও ছেলেটার আগের বৌটা তো কম হাঙ্গামা করেনি! পাড়াময় ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল’।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মোম কথাগুলো এসে ধড়াম করে ঘাড়ে পড়লো! তিনি চমকে উঠলেন—এমন একটা প্রসঙ্গ এসে পড়বে তা কল্পনাও করেন নি। বিস্মিত, ব্যথিত স্বরে বললেন—‘ না...না... ভুল হচ্ছে কোথাও...! ওঁর ছেলে তো অবিবাহিত!!!’

--‘ওরা তাই বলে। মেয়েটাকে বৌ বলে স্বীকার করতে চায় নি’।বটকেষ্ট এদিক ওদিক সন্তর্পণে তাকায়। গলার স্বর যথাসম্ভব নীচু করে বলে—‘আপনি ভালো মানুষ মনে হয় সার। কাউকে বলবেন না যেন...’।

মানুষটি কোনমতে মাথা নেড়ে জানালেন—বলবেন না।

--‘ মেয়েটা ভরা পোয়াতি ছিল! ঐ গুণধর ছেলের কীর্তি।—পেম! পেম!বুঝলেন কি না? কালীঘাটে গিয়ে নাকি সিঁদুর ও পরিয়েছিল! কিন্তু তারপর আর স্বীকারই করলো না। মেয়েটা খেপে গিয়ে মহা হাঙ্গামা করেছিল। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে একদিন সান্যালবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির! অনেক গলাবাজি করে হুমকি দিয়ে এলো—বৌ বলে ঘরে না তুললে পুলিশে নালিশ করবে’।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে—‘মেয়েটার তেজ ছিল সার’।

ভদ্রলোকের মুখ আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে উঠছিল। রুদ্ধশ্বাসে কাহিনী শুনছেন...

--‘তারপর?’

--‘তারপর আর কি?’ বটকেষ্ট’র চোখ গোল গোল হয়ে গেছে—‘দুদিন পরে মেয়েটার লাশ মিলল ইস্টিশনে। ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে! এখন নিজেই মরেছে না কেউ মেরেছে তা ভগবান জানে। তবে সেই ঘটনার পর পাড়াশুদ্ধু লোক ছেলেটাকে চেনে! সবাই জানেও’।

শ্রোতাটি তবু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলেন—‘সবাই জানে! কিন্তু একথা তো কেউ আমাদের বলেনি! আমরাও তো খোঁজখবর নিয়েছি......!’

--‘কে বলবে সার?’ সে বঙ্কিম হাসল—‘আপনি বাঁচলে পরের নাম। পেয়ারের জানটা কেউ সেধে হারাতে চায়?’

সান্যালবাবুর ভাবী সম্বন্ধীর মনের অবস্থা বলার অপো রাখে না। কথাবার্তা শেষ করে যখন গাড়িতে উঠে বসলেন, তখন তার মুখ গম্ভীর।চোয়াল শক্ত!

স্ত্রী তার কাঁধে হাত রেখেছেন—‘একটা পানওয়ালার কথায় এতো গুরুত্ব দিচ্ছো কেন? ওরা সবসময়ই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে’।

তিনি সরাসরি জবাব দিলেন না। শুধু আলগোছে বললেন—‘হুঃ’

বলাই বাহুল্য যে ছোট্ট শব্দটায় তেমন জোর পাওয়া গেলো না...!

খবরটা যেন রাতারাতি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল।

দুনিয়ার এটাই নিয়ম। এখানে গরীব লোককে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হতে হয়।তাই তার হেনস্থা খুব জোর খবর নয়। কিন্তু ধনী ব্যক্তি যদি দৈবাৎ বিপাকে পড়েন তাহলে সেটাই জনসাধারণের গরমাগরম আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বিনা ইন্ধনেই চিড়বিড় করে জ্বলছেন রজনীবাবু! ছেলের বিয়েটা বেশ বড়ঘরেই ঠিক করে ফেলেছিলেন। কেতাদুরস্ত আদব কায়দা ও মোলায়েম অভিজাত ব্যবহারে মেয়েপ বেশ ভিজেছিল। শুধু পাকাকথা বাকি। বিয়েটা এখানে দিতে পারলে ঘরের লক্ষ্মীর সাথে বেশ মোটাসোটা লক্ষ্মীপ্রাপ্তিও হত। কিন্তু আকস্মিক ভাবেই গোটা ব্যাপারটা ভেস্তে গেল! কি করে এমন অবশ্যম্ভাবী সম্বন্ধটা ভেঙে গেল, তা এখনও তাঁর বোধশক্তির বাইরে!

তার উপর আবার দুশ্চরিত্র, লম্পট বদনাম! ভাবলেই শিরায় শিরায় লাভার স্রোত বয়ে যাচ্ছে! বহু চেষ্টাতেও তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না! কি প্রচন্ড অপমান! কি প্রচন্ড......!!!!

একেই হাই ব্লাডপ্রেসারের রোগী, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত আবার এই কান্ড! সকাল থেকে একের পর এক গ্লাস শেষ হচ্ছে! ঠোঁটের ফাঁকে ঝুলে থাকা সাবেকি পাইপটার প্রাণ থাকলে এতণে ‘ত্রাহি মধুসূদন’ বলে ডাক ছাড়ত। মেয়ের বাপকে হাতের কাছে পেলে বোধহয় এভাবেই মুখে ফেলে চিবোতে শুরু করতেন। কিন্তু উপস্থিত যখন তার সম্ভাবনা নেই তখন পাইপের উপর দিয়েই গায়ের ঝাল মেটাচ্ছেন!

পরপর তিনদিন গৃহবন্দী থাকার পর আর পারলেন না!উত্তপ্ত মস্তিষ্ক একটু শীতলতা চাইতে চাইতে কান্ত হয়ে পড়েছে। তাই বেরিয়ে পড়তেই হল।

নিজের ছোট্ট পানের দোকানে বসে বটকেষ্ট তখন অন্যান্য দিনের মতোই দুলে দুলে পান সাজতে ব্যস্ত! মন খুশি খুশি। মাঝেমধ্যে রেডিওটার সাথে তাল মিলিয়ে হুঁ হুঁ করে গানও গাইছে। হেঁড়ে গলায় বিশেষ সুর নেই। তবু বেসুরো গলার গান তার নিজেরই কানে মধুবর্ষণ করছে।

হঠাৎ হেঁচকি উঠে গানে তালা পড়ে গেল। রজনীবাবু দ্রুত গতিতে এদিকেই আসছেন যে! কি সর্বনাশ! জানতে পেরেছে নাকি! তার টাকরা থেকে ব্রহ্মতালু অবধি শুকিয়ে গেলো। রজনীবাবুর সুখ্যাতি এদিকে বিশেষ নেই। বরং দুর্নামই আছে। মতাশালী লোক ইচ্ছে করলে সবই পারেন। এরপর হয়তো কোনদিন বটকেষ্টর লাশটাই......!!!!

চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল! মুখ থেকে ভক ভক করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে! মাথার চুল উস্কো খুস্কো! একি মূর্তি! সে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে! এখন তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল! কেন যে শখ করে কেউটের লেজে টান মারতে গিয়েছিল! এখন বুঝি ছোবল খেতে হয়। হয়তো এক্ষুণি লোকটা এসে তার গলা টিপে ধরে বলবে......

--‘তামাক দে’।

রজনীবাবু একটা নোট বাড়িয়ে দিয়েছেন—‘কড়া তামাক দিবি। ভেজাল হলে সব ফেরৎ দিয়ে যাবো!’

ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়লো। কথার ধরণ শুনলে গা জ্বলে যায়। তবু হেঁ হেঁ করতে করতে তামাকের প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছে সে।

--‘কেমন আছেন সার? সব ভালো তো?’

আলগোছে একটা ‘হুঁ’ বলে রজনী চুপ করে গেলেন। তাঁর নীরবতা যে কোন অংশেই ‘মহান নীরবতা’ নয় তা বুঝতে বাকি থাকে না।

--‘শুনলাম আপনার ছেলের বিয়ে নাকি ঠিক?’

ভদ্রলোক লাল চোখ আরও লাল করে তাকিয়েছেন!

--‘খুব ভালো খবর সার...খুব ভালো খবর... পানের অডারটা কিন্তু আমার দোকান থেকেই নিতে হবে। আপনারা সজ্জন ব্যক্তি। কত বিদেশী! আপনাদের পায়ের ধুলো পড়লে... বুঝলেন কি না...হেঁ হেঁ হেঁ...’

বটকেষ্ট একতরফাই বকে গেল।রজনী কি বুঝলেন কে জানে! গম্ভীর মুখে তামাকের প্যাকেট নিয়ে চলে গেলেন।

সে একদৃষ্টে লোকটার গমনপথের দিকে তাকিয়েছিল। অতবড় রাগী, দাপী মানুষটাকে কেমন যেন অসহায় লাগছে। এলোমেলো পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন।সেই স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসী পদপে আর নেই। প্রকান্ড কয়েকমহলা অট্টালিকা যখন ভেঙে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যায় তখন বোধহয় তাকে এমনই দেখতে লাগে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা দ্বিধা বিবেকে কামড় বসালো। কাজটা কি ঠিক হল? সে মিথ্যে কথা বলেনি ঠিকই—কিন্তু সত্যিটাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে বলেছে।এতটাই বেশি জমকালো করে তুলেছে যে ঘটনাটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে!

আসল ঘটনাটা আদৌ এতটা অসহ্য ছিল না। রজনীবাবুর ছেলের প্রাক্তন প্রেমিকা ঝামেলা করেছিল ঠিকই। পাড়াশুদ্ধ তা নিয়ে ঢি ঢি ও পড়ে গিয়েছিল—কিন্তু সে গর্ভবতী ছিল না। এমনকি মারাও যায় নি। বরং নবদ্বীপের কোন এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে।

এর সবটাই বটকেষ্ট জানতো। অথচ......!

নিষ্প্রভ চোখদুটো আবার অগ্নিকুন্ডের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে। বেশ হয়েছে! বেশ করেছে বলেছে! আবার বলবে! কি ভেবেছে লোকগুলো? দুনিয়ার সমস্ত সুখ করায়ত্ত করে বসে থাকবে? দুঃখ, গ্লানি, কদর্যতা কোনদিন তাদের স্পর্শও করবে না!

মামাবাড়ির আবদার!

সে সমস্ত চিন্তা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে পান সাজায় মন দিল। ভাবনাগুলোকে দূর করতে পারলেই বাঁচে। এই চিন্তা-ভাবনা নামক বস্তুগুলোই আসলে যত নষ্টের গোড়া। যত কম ভাবা যায় ততো বেশি আনন্দে থাকা যায়। ভাবতে বসলেই যত বিপদ!

--‘বটকেষ্ট, একটা মিষ্টি পান দে, এলাচ ছাড়া’।

বটকেষ্ট মুখ গুঁজে পান সাজছিল। পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে তাকিয়েছে। তার মুখে আলতো একটা হাসি ঝিলিক মেরে যায়—

--‘ আ-রে! সেকেটারিবাবু যে! আসুন আসুন...কতদিন আসেন না’।

হারাধন মন্ডল স্থানীয় হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সেক্রেটারি। বিয়ে থা করেন নি। সম্পূর্ণ স্বাধীন চেতা মানুষ। স্কুলের কাজেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। স্কুল অন্তপ্রাণ মানুষটি আবার ভয়াবহ আদর্শবাদীও বটে। ঠিক করেছেন তাঁর স্কুলের কোন শিককে প্রাইভেটে পড়াতে দেবেন না। শিকরা তাঁকে প্রায় যমতুল্য জ্ঞান করেন। মাঝেমধ্যে তাঁর জন্য যমের করুণাও প্রার্থনা করে থাকেন। কিন্তু এতো লোকের সমবেত প্রার্থনায়ও মৃত্যুদেবতা কর্ণপাত করেন নি!

পান সাজতে সাজতেই বটকেষ্ট ‘ক্যাসিক’এর প্যাকেট এগিয়ে দিয়েছে। হারাধনবাবুর ওটাই ব্র্যান্ড।

 তিনি প্যাকেট থেকে আলগোছে একটা সিগ্রেট তুলে নেন।

--‘ভাবছি সিগ্রেট খাওয়াটা ছেড়ে দেবো’।

গত তিন বছর ধরেই হারাধন সিগ্রেট ছাড়ার কথা ভেবে যাচ্ছেন। স্রেফ ভেবেই যাচ্ছেন। ছাড়া আর হচ্ছে না।বটকেষ্ট মিটিমিটি হাসে। পানের গায়ে তরল খয়ের বোলাতে বোলাতে রেডিওর কান মোচড়াচ্ছে! আদ্যিকালের পুরনো রেডিওটা মাঝেমধ্যেই গাঁক গাঁক করে বাজতে শুরু করে দেয়। এখনই ফের তারস্বরে বাজতে শুরু করে রসালাপে ব্যাঘাত ঘটাতে যাচ্ছিল।

কিন্তু তার আগেই বটকেষ্ট রেডিও বন্ধ করে দিয়েছে।

--‘তা ছেড়ে দিন না। ওটা কি একটা খাওয়ার জিনিস হল?’

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল—‘ছাড়ব তো ভাবি। কিন্তু পারছি না’।

উত্তরে একটা রহস্যময় হাসি হাসল সে। এক একটা নেশার প্রকোপ এতটাই বেশি যে ছেড়ে দেওয়া মুস্কিল। ছাড়তে চাইলেও ছাড়ে কই!

--‘পানও ছাড়বেন না কি?’

--‘নাঃ, পান চলতে পারে’। তিনিও হাসছেন—‘ পানে কোনও দোষ নেই। ওটা হার্মলেস’।

--‘তাহলে বটকেষ্টর ইস্পেশাল পান খেয়ে দেখুন। মুখে দিলেই গলে যাবে’।

--‘ঠিক আছে। খেয়ে দেখছি’। হারাধনবাবু ঘড়ি দেখছেন—‘তবে একটু তাড়াতাড়ি কর্। একটু তাড়া আছে’।

--‘এক্ষুনি হয়ে যাবে’। সে প্রিহাতে সুপুরি সাজাচ্ছে—‘ তা তাড়া কিসের? যাবেন কোথায়?’

--‘একটু জিতেনের বাড়ি যাবো। স্কুলের ব্যাপারে একটু কথা আছে’।

পিটপিটে তেরছা চোখে বটকেষ্ট তাকাল। জিতেন হালদার মেকানিকসের শিক। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক লেভেলে ফিজিক্সও ভালো পড়ান।

--‘অ” সে পানটা মুড়তে মুড়তে এগিয়ে দিয়েছে—‘কিন্তু এখন কি তাকে পাবেন?’

হারাধন আস্ত পানটা মুখে পুরে দিয়েছেন। পানের রসে মুখভর্তি। পিচ করে পিক ফেলে বললেন—‘কেন? বাড়ি নেই নাকি?’

--‘ না...না...যাবেন কোথায়? তবে একটু আগেই...’ সে খুচ খুচ করে মাথা চুলকুচ্ছে!

--‘একটু আগেই? একটু আগে কি?’

--‘একটু আগেই আপনাদের ইস্কুলের কয়েকজন ছাত্তর কে ওদিকপানেই যেতে দেখলাম কি না! তাই বলছিলাম...উনি বোধহয় ছাত্তর পড়াচ্ছেন...’।

--‘কি?’ সেক্রেটারি বাবু প্রায় তড়িতাহত ব্যাঙের মত লাফিয়ে ওঠেন। পরণেই টাইফুন গতিতে জিতেনের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেছেন। প্রায় দৌড়তে দৌড়তেই চিৎকার করে বললেন—‘তোর পান সিগ্রেটের দাম পরে দিয়ে যাচ্ছি বটকেষ্ট... আমি এখন একটু ব্যস্ত......’

বটকেষ্ট ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসল—‘ নিয়ে যান বাবু, দাম দিতে হবে না। আপনারটা ফি-রি!’

 তখন বেশ রাত হয়ে এসেছে। আশেপাশের বাড়িগুলোর জানলার চোখ ফুটেছে টুপটুপ করে। তেল চকচকে পিচের রাস্তা চাঁদের আলোয় কেউটের পেটের মতো মসৃণ। আকাশ যেন ময়ূরকণ্ঠী জেলি। মেইনরোডের উপর হুশহাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির সঞ্চরণ। ল্যাম্পপোস্টগুলোর কোনটার চোখে আলো জ্বলছে, কোনটা আবার নিরেট অন্ধ। তাদেরই সমবেত আলোয় স্পষ্ট মেইনরোড। আর একটু দুরেই নিষ্প্রভ জ্যোৎস্নায় নারকেল গাছের ছায়া ছায়া শরীর দিগন্তে প্রান্তসীমা টেনে দিয়েছে।

পানের দোকানে এখনও জমাট ভিড়। সামনের স্টিরিওর শোরুমে হিমেশ রেশমিয়ার অনুনাসিক কণ্ঠস্বর। অফিস ফেরত বাবুরা বাজারে শোরগোল জমিয়ে তুলেছেন। আজ শনিবার। কাল সকাল থেকেই ভালোমন্দ চলবে। মাছের বাজারে প্যাঁচপ্যাঁচে মাছ ধোয়া আঁশটে কাদায় দাঁড়িয়ে দরাদরি চলছে রুইমাছের মাথা, ইলিশের পেটি, কুচো চিংড়ি অথবা ভেটকির টুকরোর। পাঁঠার মাংসের দোকানের সামনে লম্বা কিউ। শাকসব্জীর দোকানে পান্নার মত ঝকঝকে সবুজ পুঁইডাটা, তাজা হেলেঞ্চা, পটল , ঢেঁড়স। দেখলেই জিভে জল আসে।

রাত আরেকটু গভীর হয়ে আসতেই বটকেষ্ট দোকানের ঝাঁপ ফেলে ঘরমুখো হল। ডানহাতের ঢিলে স্ট্র্যাপওয়ালা আদ্যিকালের রংচটা ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। রাস্তাঘাট শুনশান। রাত্রি অদ্ভুত মোহিনী সর্পিনীর মতো আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে গোটা অঞ্চলকে।

সব্জিবিক্রেতা মকবুল কিন্তু তখনও বসে আছে তার সর্বশেষ ক্রেতাটির জন্য। বটকেষ্টকে সে নাম দিয়েছে—কাঠিবাবু। কোন একসময় নেশাতুর দুর্বলতায় এর কাছে তার গোপন কথা ফাঁস করে ফেলেছিল। তারপর থেকেই এই নতুন নামকরণ। তবে মকবুল মানুষ ভালো। প্রাচীন পরিত্যক্ত কুয়োর মত রহস্যটুকু নিজের পেটেই জমিয়ে রেখেছে—পাঁচকান করেনি।

পোকায় কাটা বেগুন, বাসী আলু আর মাংসের টুকরোয় থলি ভরে যখন সে বাড়ির দিকে রোনা হল তখন মাথার উপর অজস্র তারা টুনি বাল্বের মতো জ্বলছে, নিভছে। বেশ বড়সড় জলসাঘরের বাতির মতোই নীলাভ, কুহকময়।

বটকেষ্ট হাঁটতে হাঁটতেই নিজের কথা ভাবছিল। পৃথিবীর সব অংশে না জানি এখন কত সুখ! প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু আনন্দ আছে। কারুর দাম্পত্য সুখ, কারুর সুখটা অর্থকরী—কারুর বা সন্তানলাভের আনন্দ। দুঃখ থাকলেও কোথাও না কোথাও সুখের তিরতিরে ঝোরা ক্রমশই বয়ে চলেছে।

শুধু একা সে-ই সবকিছু থেকে বঞ্চিত! কেন? মকবুলের দেওয়া নামটা বারবার মনে পড়ছিল তার।–কাঠিবাবু! পরের পিছনে কাঠি দেওয়া যার স্বভাব তার এমন নাম হওয়াই স্বাভাবিক।

সে আপনমনেই ফিক করে হেসে ফেলল। মকবুল জানে না, যাকে ওরা ‘আল্লাহ’ বলে আর বটকেষ্টরা’ভগবান’, তার চেয়ে বড় ‘কাঠিবাবু’ দুনিয়ায় আর নেই। সে যখন কাঠি দেয় তখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

আকাশটা তখনও ঝকঝক করে হাসছিল। বটকেষ্ট আকাশের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কারুর দিকে মনে মনে একরাশ গালাগালি ছুঁড়ে দেয়। চোখে আগুনের হল্কা নিয়ে উগরে দেয় অশ্রাব্য খিস্তিখেউড়...

শালা...হারামজাদা...শুয়োরের বাচ্চা!...পিছনে কাঠি দেওয়ার জন্য তুই একটা হতভাগা পানওয়ালাকেই পেয়েছিলি?......

বাড়ি ফেরার পর মেজাজ আরও খিঁচড়ে গেল।

সব পুরুষই চায় সারাদিনের খাটুনির পর স্ত্রী’র সঙ্গলাভ করতে। কান্ত তৃষ্ণার্ত মানুষের সামনে জলের গ্লাস এনে দেওয়ার একটা চুড়ি পরা হাত। সযত্নে খাবার বেড়ে দেওয়া। পান্তাভাতই হোক কি বিরিয়ানি—একটি মানুষের সস্নেহ পরিপাটি পরিবেশনে তাই হয়ে ওঠে অমৃত। তারপর রাতে একটি সুস্থ, সুন্দর, সপ্রেম মিলন।

অথচ বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় রীতিমতো দাপাদাপি করছিল বৌটা! এমন পেট ব্যথা তার প্রায়ই হয়। তখন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে থাকে। আজ বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। মধ্যরাত অবধি একফোঁটাও ঘুমোতে পারেনি। মনে হচ্ছিল আজই বুঝি সব যন্ত্রণার শেষ হয়। কিন্তু মাঝরাতের দিকে ব্যথাটা নরম হয়ে আসতেই বাঁচোয়া।

মেয়েছেলের একেবারে কই মাছের প্রাণ!

বাড়ির বাইরে দাওয়ায় বসে বৌয়ের ঝটপটানির শব্দ শুনছিল বটকেষ্ট। তার সাথে সাথেই চলছিল নিজের স্বর্গগত বাপের দ্বিতীয়বার শ্রাদ্ধ! সারা দুনিয়ায় আর মেয়ে খুঁজে পায় নি! একটা রোগের ডিপো কে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলো! নে শালা! পচা লাশ ঘাড়ে চাপিয়ে বৈতরণী পার হ! বাপ নয়...বাপ নয়...শত্তুর! নিজে তিনটে বিয়ে করেছিল। র-সে-র না-গ-র! আর ছেলের বেলায় একটা জন্মরোগীকে গছিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে!

মরা বাপটাকে হাতের কাছে পেলে এইমুহূর্তে খুনোখুনি হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে উপায় নেই। অগত্যা স্বর্গীয় পিতার উদ্দেশ্যে ‘ছিক’ করে একদলা থুতু ফেলে সে উঠে দাঁড়াল। রাতের খাওয়া হয়নি। খাবারে বা মদে আর রুচি ছিল না।শিকারী বেড়ালের মত ক্ষুধার্ত জ্বলজ্বলে চোখ! ঠান্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তপ্ত শরীরকে জুড়িয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টায়।

বটকেষ্টর বাড়ির কাছেই তখন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ! মেয়ে গলার চাপা হাসি, পুরুষের উত্তেজিত শ্বাস! তার মুখগহ্বর ঘন লালায় ভরে গেল। শরীরটা কেমন যেন আঁকুপাকু করছে!

ডোবার ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির ছেলেটার নতুন বিয়ে হয়েছে। ছেলেটাকে দেখতে আস্ত ষাঁড়ের মতো! অথচ বৌটা বেশ। নরমসরম পাঁউরুটির মতো ফুলো ফুলো গাল।পরিষ্কার রং, গড়নটাও চমৎকার! অমন পুতুলের মতো মেয়েটাকে একটা ষাঁড়ের সাথে বিয়ে দিল কেন মেয়ের বাপ কে জানে! দুনিয়ার সব বাপগুলোই বোধহয় চোখে ঠুলি পরে বসে আছে। নয়তো কোন প্রাণে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা দেয়?

বটকেষ্ট গুটি গুটি পায়ে সেদিকেই এগিয়ে যায়।

শোবার ঘরের জানলা বন্ধ করেনি কেউ। এই ভ্যাপসা গরমে জানলা বন্ধ করেও ঘুমোনো সম্ভবও নয়। সদ্য বিবাহিত দম্পতির ঘরের জানলাও খোলাই ছিল।

ভিতরে জমাট অন্ধকার। তা সত্বেও দুটো ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুটো শরীর মেতে উঠেছে আনন্দ খেলায়! উপরের দেহটা পুরুষের। তার দেহ আড়াল করে আছে নারীকে। মিলনের চরম সুখে দুজনেই আকুল হয়ে উঠেছে! চরম উত্তেজনায় উদ্বেলিত।

হঠাৎই মেয়েটির স্তিমিত দৃষ্টির সামনে যেন একটা পর্দা খসে পড়ল! ওকি! খোলা জানলায় এতরাতে ওটা কার মুখ! দুই জ্বলজ্বলে অতৃপ্ত চোখ মেলে নির্লজ্জের মতো চেয়ে আছে......কে?

পুরুষকে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে আর্তচিৎকার করে ওঠে মেয়ে—‘ঐ...ঐ...কে?’

মুখটা সাঁৎ করে বিদ্যুৎগতিতে জানলা থেকে সরে গেল। পুরুষটি ততণে লাফ মেরে দরজা খুলে ফেলেছে......

--‘এই শালা...বা......’

একটা ছায়া প্রিগতিতে ছুটে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাইরে শুধু জমাট কালোর প্রলেপ ছাড়া আর কিছু নেই!

জানলা দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় ফিরে এলো পুরুষ। মেয়েটি নিথর হয়ে শুয়েছিল। স্বামী তাকে স্পর্শ করতেই নিস্তেজ স্বরে বলে—‘ আজ থাক’।

দুটি শরীর পাশাপাশি শুয়ে রইলো—নিস্পন্দ, প্রতিক্রিয়াহীন!

পালাতে পালাতে বস্তি পেরিয়ে বটকেষ্ট ফের রাস্তায় চলে এসেছে। সার সার ল্যাম্পপোস্ট রাস্তার দুপাশে ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে। গায়ে পালস পোলিও টিকার জমকালো বিজ্ঞাপন। রাস্তার পাশে জলের কল থেকে জলবিন্দু পড়ছে টুপটাপ। আর কোন শব্দ নেই।

সামনেই মাথা উঁচু দাম্ভিক ফ্যাটের বাঁদিকের জানলায় নীল সমুদ্র। নীল জোয়ারে হয়তো ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ! দুটো সোনালীমাছ হাবুডুবু খেয়ে খেলা করছে এখন।

বটকেষ্ট একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ঠেস দিয়ে পাগলের মতো খুব একচোট হেসে নিল। ছেলেমেয়েদুটোর সুখের রাতটায় আচ্ছা কাঠি হয়েছে! রোজই সুখ ভোগ করবে! আহাদ! একটা রাত অন্তত নষ্ট হোক।

ফ্যাটের নীচে দাঁড়িয়ে দামী চতুষ্পদ। বেশ দামি গাড়ী। কাঁচে আলো পড়ে ঝলসে উঠছে। ভেলভেটের মতো গায়ে মাছি বসলেও বোধহয় পিছলে পড়বে! তেল চকচকে শরীরে ঝকঝক করছে অর্থ, সুখ, সমৃদ্ধি, প্রতিপত্তি।

এটা এই ফ্যাটের প্রোমোটার তপন পালের গাড়ি। নীল কাঁচওয়ালা ফ্যাটটাও তারই। শালা, একনম্বরের খচ্চর! অমন মাগীবাজ লোক দুটো নেই। একটা বৌ আর দুটো মেয়ে থাকে ব্যারাকপুরে। তারপরেও হারামীর হাতবাক্সটা আরেকটা মেয়ের সাথে হাওড়ার ফ্যাটে থাকে। আবার মালতীবৌদির সাথে এই ফ্যাটে প্রায়ই রাতে রাসলীলা করে। আরও কটা বেশ্যা পুষে রেখেছে কে জানে! ব্যাটা টাকার কুমীর—একশোটা মহিলা থাকাও আশ্চর্য নয়।

নীল কাঁচের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে। মালতী বৌদি ভিতরে আছে নিশ্চয়ই। স্বামীটা ঘরে মরছে। নিজস্ব একটা পয়সাও নেই চিকিৎসার জন্য। তপন পালের পয়সায় বেঁচে আছে গোটা পরিবার। ক্যান্সারের রোগী বরটা বেশিদিন বাঁচবে না সে ঐ হারামী প্রোমোটারটাও জানে। লোকটা মরলে তো ওরই পোয়াবারো!

মালতী বৌদিরও কি পোয়াবারো? মহিলাকে বোঝা মুস্কিল। স্বামী বাঁচবেনা তা কি সে নিজে বোঝে না? তবু কিসের আশায় বহুনারীভোগী লম্পটটার হাতে নিজের চামড়া বেচছে?

ধুস্ ...!

বটকেষ্ট ভেবে দেখল সে আবার ভুলভাল ভাবতে শুরু করেছে! আজকাল কি একটু বেশিই ভাবছে? নিজের ভিতরই কি করে যেন দুটো ভাগ টের পায় সে! একটা তার মতোই কুচকুচে কালো। আরেকটা সাদা। সাদাটা যে কোথা থেকে এসে টপকে পড়ে তা ভগাই জানে! সে ব্যাটা শুধু প্রশ্ন করে যায়—এটা ঠিক হল?... ঠিক হল? এটা কি ঠিক হল?......

আচমকা পিঠের উপর একটা নরম স্পর্শ!

বটকেষ্ট চমকে পিছনে ফিরল। পিছনে তাকাতেই বিস্ময়টা আরও প্রগাঢ় হয় তার! এত রাতে নিঝুম রাস্তায়, তার পিছনে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে! জ্বলজ্বলে দুই চোখে নির্ভেজাল হিংস্রতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ঐ নীল জানলার দিকেই!

মালতী বৌদির ছেলে---বিট্টু!!!

সে অবাক হয়! বাচ্চা ছেলেটা এতরাতে এখানে কি করছে? কতই বা বয়েস ওর? মেরেকেটে চোদ্দ কি পনেরো হবে। এখন ওর ঘুমোনোর কথা, স্বপ্ন দেখার সময়। সেসব ছেড়ে এতরাতে এই জনহীন রাস্তায় কি জন্য এসেছে সে?

বটকেষ্ট গলা খাঁকারি দেয়—‘তুই বিট্টু না?’

ছেলেটার জ্বলজ্বলে চোখ ফ্যাটের জানলা থেকে বটকেষ্টর মুখের দিকে ফিরল। সে একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়—‘হুঁ’

--‘এখানে কি করছিস্’?

তার দৃষ্টি অনাবিল জিঘাংসা নিয়ে ফের ঘুরে গেছে ফ্যাটের জানলার দিকে। বটকেষ্টর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন সে বোধ করল না।

--‘কি হল?’ বটকেষ্ট ঝাঁঝিয়ে ওঠে—‘এতরাতে এখানে কি করছিস্? চোখে ঘুম নেই?’

বিট্টু যেন চমকে উঠে তার দিকে তাকায়। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে সে! এবারও প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। তবে কয়েকমুহূর্ত গভীর ভাবে কি যেন চিন্তা করে আস্তে আস্তে পা বাড়াল উল্টোদিকে।

বটকেষ্ট দেখল বিট্টু ধীরে ধীরে নিজের বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে।

 

এরপর আরও দিন তিনেক বিট্টুকে দেখেছে বটকেষ্ট । রাতদুপুরে—ঐ ফ্যাটের সামনে। সে যেন কিছু করতে চায়। একটা অদম্য ইচ্ছা তার ভিতরে দাপিয়ে মরছে। অথচ আরও একটা মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে।

বটকেষ্ট অনুভব করে অনিচ্ছাসত্বেও আজকাল কিছু কিছু বিষয় তাকে বড়ই ভাবায়। অনেকবার ঠিক করেছে যে কিছুতেই ভাববে না। তবু একেবারে ঝেড়ে ফেলা মুস্কিল। বিশেষ করে বিট্টুর কথা। ছেলেটা ঠিক কি করতে চায়? কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সে প্রায়ই ঐ ফ্যাটের সামনে এসে দাঁড়ায়? কি আছে ওর মনে?

মালতী বৌদিকেও প্রায়ই দেখতে পায় সে।ঘরে একটা আধমরা মানুষ—তাও মহিলার কি সাজের ঘটা!স্বামী মরতে চলেছে—কিন্তু বৌয়ের গাঢ় লিপস্টিক তাতেও ফিকে হয় না! দামী দামী শাড়ি গয়না পরে তপন পালের এ সি গাড়ি চড়ে হুশ করে চলে যায়। দেখলেই গায়ে জ্বালা ধরে তার। মেয়েছেলের কি নষ্টামি! হোক মৃত্যুপথযাত্রী—তবু স্বামী তো আছে! তাকে ঘরে ফেলে মাগী ফূর্তি করতে চলল! পেটে অল্পস্বল্প শিক্ষেদীক্ষেও  আছে। একেবারে ক’ অর গো মাংস নয়। গতরে শক্তি আছে। তাই খাটিয়ে খা না বাপু!পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করতেই হবে?

তার হাত নিশপিশ করে।খুব ইচ্ছে হয় দুটোর ফূর্তিতে কোনভাবে কাঠি দিতে। কোন কষ্ট নেই, খাটনি নেই—শুয়ে শুয়েই কি সুন্দর আরাম আর বিলাসের জিনিসগুলো হাসিল করে নিচ্ছে মহিলা! এত সহজে হাসিল করে নেবে সব সুখ! কি অন্যায় আবদার!

ধুত্তোর! মাথা ঝাঁকিয়ে যেন চিন্তাগুলোকেও ঝেড়ে ফেলতে চায় বটকেষ্ট।পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। মরুক গে যাক। এসব লটঘট নিয়ে চিন্তা করে খামোখা সময় নষ্ট। যা পারে করুক। তার কি?

সে সমস্ত ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রেখে পান সাজায় মন দেয়। আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় গরম কম। ভোরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। গা জুড়িয়ে দেয়। মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে।

পান সাজার মধ্যেই কানে আসে, কোথায় যেন রেল রোকো হয়েছে। অফিসযাত্রী, স্কুলের ছেলেমেয়েদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। অনেকে স্টেশনে গিয়ে ফের বাড়ি ফেরৎ চলে এসেছে। কেউ কেউ আবার বাসের দমবন্ধ ভিড়ে মারামারি করে অফিস স্কুলমুখো হয়েছে। 

খদ্দেরকে পছন্দমতো পান দিতে দিতে সবই চুপচাপ শুনছিল বটকেষ্ট। এসব খবরে কোন নতুনত্ব নেই।

এক দাদা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থা নিয়ে লম্বা লম্বা লেকচার ঝাড়ছিলেন। তার সাথে হঠাৎ আরেক দাদার তর্ক বেঁধে গেল।

--‘আরে বনধ কি লোকে এমনি এমনি করে? এসব বনধ, রেলরোকো না করলে সরকারের যে টনক নড়ে না!’ প্রথম দাদা প্রায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন—‘এত দিনের শাসনে কি দিতে পেরেছে সরকার? তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। বাজার অগ্নিমূল্য মিডল কাস খাবে কি? চালের দাম দেখেছেন?’

দ্বিতীয় দাদা অপোকৃত শান্ত—‘ওটা সেন্ট্রালের ব্যাপার। স্টেট গভর্নমেন্ট কি করবে? তাছাড়া এতদিনে কি রাজ্যটা উচ্ছন্নে গেছে?’

--‘ নয়তো কোথায় গেছে?’ প্রথম দাদা মুখে ফেনা ভেঙে বললেন-‘অন্যান্য মেট্রো সিটিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেছেন......’?

বটকেষ্ট মিটমিট করে হাসছিল। লোকগুলোর খেয়ে আর কাজ নেই। ফালতু মগজমারি নিয়ে গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ লাগিয়েছে।দুনিয়ার খবর রাখে, শুধু নিজের ঘরের খবর ছাড়া!

সে তর্কের মধ্যে বাগড়া দেয়। প্রথম দাদার দিকে তাকিয়ে হাসছে—

--‘দাদা কি দল পাল্টেছেন না কি?’

প্রথম দাদা থতমত খেয়ে তাকিয়েছেন—‘মানে?’

--‘আপনি সরকারি চাকরি করেন না?’

--‘করি। তাতে কি?’ তিনি আবার চেঁচাতে শুরু করেছেন—‘সরকারি চাকরি করলেই পা চাটতে হবে না কি?’

--‘অ!’ তার চোখে পেটেন্ট মিহি দৃষ্টিটা ফের উঠে এসেছে। এই দাদাটি তার চেনা। পাড়ারই লোক। এর মেয়ে কাস ফোরে পড়ে। রোজ সকালে যখন বটকেষ্ট দোকান খোলে তখন মেয়েকে স্কুলে দিতে যান ভদ্রলোক। ওনার বৌ ভারি আলাপী মানুষ। দুপুর বেলা প্রায়ই মিষ্টি পান নিতে আসেন। গল্প গাছা করেন।

--‘বৌদি বলছিলেন মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়ামে দেওয়ার খুব ইচ্ছে আপনার’।সে ধীরে সুস্থে বলে—‘ নামী ইস্কুলে ভর্তির জন্য পাট্টির লোক রাজীব সমাদ্দারকে ধরেছিলেন না? রাজীববাবুও কাজটা করে দেবেন বলে দিয়েছিলেন......’ 

তড়পানি যে কোথায় গেল! দাদার মুখ চুপসে ফাটা ঠোঙা। আশেপাশের লোকেরা তার দিকেই দেখছে। সকলের চোখেই প্রচ্ছন্ন বিস্ময়ের সাথে মিশ্রিত বিদ্রূপ। কেউ কেউ বঙ্কিম অম্লরসাক্ত হাসিও হাসছে।

খুব সুনিপুণ ভাবে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকল বটকেষ্ট—‘ আপনি দল বদলেছেন সে কথা রাজীব বাবু জানেন?’

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাদা তাকে জরিপ করছেন। এভাবে লোকটা সবার সামনে বাঁশ দিয়ে দেবে তা ভাবেন নি। আশেপাশের লোকগুলো মিটিমিটি হাসছে।

দাঁতে দাঁত পিষলেন তিনি। গিন্নীর পেট পাতলা হলে কর্তাদের এমন সর্বনাশই হয়!

অসম্ভব রাগ আর অপমান কোনোমতে গিলে ফেলে জ্বালাময়ী কণ্ঠে বললেন—

--‘একটা চ্যান্সেলরের প্যাকেট দিতে আর কত সময় লাগাবি তুই?’

বটকেষ্ট হেসে ফেলল। বোঝা গেছে লোকটার দৌড়!

--‘ঔরত জাতই হয় সব্বোনাশের গোড়া’

মকবুল সবজি মেপে মেপে চটের থলিটায় ভরে দিচ্ছিল। রোজই সে পরিমাণে একটু বেশিই দেয়।বলাই বাহুল্য, এই হতভাগা কাঠিবাবুর উপর তার মায়া পড়ে গেছে। বেশির ভাগ ক্রেতাই সব্জীবিক্রেতাকে মানুষ বলে গণ্য করে না। কথা বলার ভঙ্গিতেই থাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য।

একমাত্র এই লোকটার সাথেই আলাপ জমাতে পারে মকবুল। পেশ করতে পারে তার দার্শনিক তত্ত্বগুলো।

আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

--‘উয়াদের রংঢং দেইখ্যা ভোললেই জাহান্নামের রাস্তা খুলে! বোঝলা নি কাঠিবাবু?’

বটকেষ্ট হাসে—‘রঙ ঢং দেখার সুযোগ হল কই রে?’

--‘ক্যান?’মকবুলের মুখে চিন্তার ছাপ—‘ বিবিজানের বিমারি কুমে নাই?’

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ বিমারি আর কমার নয়। রোগী নিয়ে ঘর করতে করতে তাকেও যেন রোগে ধরেছে। মাঝেমধ্যেই টের পায় ভিতরটা বড্ড জ্বালাপোড়া করে। একেবারে দাবানলের মত বুকের ভিতরে আগুন পাঁজর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দেয়। শুধু ভস্ম...! শুধু শ্মশানের ছাই মেখে বসে আছে সে! এ এক অদ্ভুত রোগ! এ রোগেরও নিরাময় নেই।

--‘ আল্লাহ রে তো আর বিশ্বাস করো না’। মকবুল ব্যাগটা এগিয়ে দিয়েছে—‘ভাবিজানরে লইয়া কুনো পীরের দরগায় যাও। দানোর নজর লাগে মনে লয়। নিজের জন্য না যাও বিবিডার কথা ভাইব্যা দেইখ্যো’।

ব্যাগটা হাতে নিয়ে বটকেষ্ট অর্থপূর্ণ হাসল। আর কথা না বাড়িয়ে এবার ফেরার পথ ধরেছে। মকবুল ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাই জগৎজুড়ে ঈশ্বরের কৃপা আর দানবের কুদৃষ্টিই তার চোখে পড়ে। তার বিশ্বস্ত ‘আল্লাহ’ ও যে কুদৃষ্টি দিতে পারেন তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজকাল আর বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করে না। ঘরের টান নেই। সংসারের প্রতি তীব্র অনীহা। জৈবিক চাহিদাগুলো দমবন্ধ হয়ে শরীরের ভিতরে আঁকুপাঁকু করতে থাকে। নবদম্পতি সেদিনের ঘটনার পর জানলা বন্ধ করে শুতে শুরু করেছে। আর যারা প্রতিবেশী আছে তাদের বেশির ভাগই বুড়ো বুড়ি। দেখার কিছু নেই। এমতাবস্থায় নিজের রিপুকে শান্ত করার উপায়ও অপ্রতুল।

বাজার থেকে অনতিদূরে রাস্তার পাশের সাদা বাড়িটা মুখুজ্যেদের বাড়ি। এ বাড়ির বৌ রেখা সম্ভবত বাঁজা। এখনও পর্যন্ত বাচ্চা-কাচ্চা হওয়ার লণ নেই। কিন্তু দম্পতির মধ্যে প্রেমের অভাব তো নেই-ই উপরন্তু লোক দেখানো সোহাগের চোটে চোখে অন্ধকার! ভাব এমন করে যেন উত্তম সুচিত্রা চলেছে!রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যেই প্রায় জড়াজড়ি করে হাঁটে। লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছে!

বটকেষ্টর খুব ইচ্ছে ছিল উত্তম-সুচিত্রার মধ্যে বিকাশ রায় হয়ে ঢুকে পড়ে। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

আজ মনটা বিপ্তি ছিল। নিজের দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতায় মনে মনে জ্বলছিল সে। কোথাও জ্বালাটা উগরে না দেওয়া অবধি শান্তি নেই। চিড়বিড়ে যন্ত্রণাটা জ্বালিয়ে খাচ্ছিল তাকে।

এমন সময়ই সামনে পড়ে গেলেন রেখা বৌদি।

সম্ভবত স্বামী এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। হয়তো ওভারটাইম অথবা যানজটে আটকে গেছেন। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তার অপোই করছিলেন রেখা। স্বামীর বাড়ি ফেরার সময় হলেই প্রতিদিন নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেন। একঢাল খোলা রেশমী চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে। উড়ছিল পরিপাটি করে পরা শাড়ির আঁচলও।

বটকেষ্ট পাশ দিয়ে যেতে যেতেই থমকে দাঁড়াল। একটা অদ্ভুত সুন্দর উষ্ণ গন্ধ ভেসে আসছে রেখা বৌদির শরীর থেকে! গন্ধটা নাকে আসতেই ভিতরের রিপুগুলো অসহ্য রাগে ফের রাক্ষুসে দাপাদাপি করতে শুরু করল।

বটকেষ্টর মুখ কিন্তু ভাবলেশহীন। অন্দরের উথাল পাথাল উত্তেজনা ছাপ ফেলেনি বাইরে। সে হেসে বলে –‘বৌদি, এতোরাতে বাইরে যে! দাদা ফেরেননি বুঝি?’

রেখা বৌদি প্রায় ফিল্মের নায়িকার ভঙ্গীতেই অপো করছিলেন। বটকেষ্টকে হয়তো ল্য করেননি। এবার খেয়াল হল।

--‘নাঃ’। তিনি হাসছেন—‘ওর ওভারটাইম চলছে। ফিরতে দেরি হবে’।

--‘রোজই ওভারটেম?’

--‘হ্যাঁ, এই সময়টা ওদের কাজের চাপটা বেশি থাকে’।

--‘রোজই? বলেন কি?’ বটকেষ্ট অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে—‘তা’লে গত তিনদিন ধরে আপনারা দুজনে মিলে বাইকে বেড়াচ্ছেন কি করে?’ পরণেই ফিক করে হেসে ফেলেছে—‘দাদা আপিসের কাজেও ফাঁকি দেন তা’লে!’

--‘কে বলল তিনদিন ধরে বাইকে চড়ে বেড়াচ্ছি?’ রেখার মুখে পাতলা হাসি—‘একসময় অবশ্য খুব বেড়াতাম। কিন্তু এখন ওর সময় হয় না’।

--‘ কি যে বলেন বৌদি!’ তার চোখে কৌতুক—‘আমাদের কাছে লুকিয়ে লাভ কি? এই তো গত কাল, পরশু, তার আগের দিনও আপনাদের দুজনকে একসাথে বাইকে করে ফিরতে দেখলুম!আপনি কমলা রঙের জামা আর কালো প্যান্ট পরেছিলেন। মনে নেই?’

রেখা বৌদির মুখের হাসিটা কেউ যেন ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিল। চোখে অনাবিল বিস্ময়—‘টপ! জিনস! কিন্তু আমি তো টপ জিন্স পরি না!’

--‘ সেকি! আপনি পরেন না!’ সে যেন থতমত খেয়ে বলে—‘তবে দাদার পিছনে কে বসেছিল!’

বৌদির মুখ আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে উঠছিল। আগের ‘নায়িকা নায়িকা’ ভাব আর নেই। বটকেষ্টর মনে মনে ব্যাপক হাসি পাচ্ছে। আজ বেচারি উত্তম কুমারের কপালে দুঃখ আছে। বাড়ি ফিরে সুচিত্রা সেনের বদলে ‘গীতা দে’র রণং দেহি মূর্তির মোকাবিলা করতে হবে। বেচারা!

--‘তুমি বোধহয় ভুল দেখেছ’।

--‘হুঃ’ সে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে—‘ বোধহয় তাই। যদিও খুব একটা ভুল আমার হয় না। তবে...আপনি বলছেন যখন...তখন বোধহয়...ভু-ল-ই দেখেছি!’

স্তম্ভিত বৌদিকে পিছনে ফেলে আর কোনও বাক্যব্যয় না করে এগিয়ে গেল বটকেষ্ট। তার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিল। মহিলা যেমনই হোক, যতই সুন্দরী আধুনিক হোক, বরকে সন্দেহ করতে ছাড়বে না। ওটা মেয়েদের বহু অভ্যাসের একটা!

যাক্, আজ আরও দুটো নারী-পুরুষের রাত মাটি করে দেওয়া গেছে। সে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসে। কখনও কখনও নিজের হাসিটা তার চতুর খ্যাঁকশেয়ালের মতো মনে হয়। হায়নার হাসির কথা অনেকেই শুনেছে। কিন্তু শেয়াল হাসে কিনা ঠিক জানা নেই।

তবে আন্দাজ করা যায় যে শেয়াল হাসলে বটকেষ্টর মতো করেই হাসতো। এমনই চতুরতা আর হিংস্রতার সম্পৃক্ত মিশ্রণ!

আজ কিছুতেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হল না। ইচ্ছেটাই বিকল হয়ে গেছে। বাড়ি যত কাছে আসছিল তত যেন একটা দমবন্ধ অনুভূতি চেপে ধরছিল তাকে। যেন ভেতরে ব্যর্থতা নামের একটা রাস বসে আছে তারই অপোয়। ঘরে ঢুকলেই চেপে ধরবে!

নিজের বাড়ির সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বটকেষ্ট। ভিতরে যথারীতি নিস্তব্ধতা ও অন্ধকার। বাড়ি নয়—শ্মশান! এখানে কোন জীবিত মানুষ ঘর করে না। মৃত স্বপ্ন আর ইচ্ছেরা সংসার পেতে বসেছে। ইঁট-কাঠ-পাথরগুলোও শোকস্তব্ধ।

এখন নিজের বাড়িতে ঢুকতেও ভয় করে। আজ পর্যন্ত এই বাড়িটা ‘ঘর’ হয়ে উঠলো না। দেওয়ালগুলো কোনওদিন হাসি শুনলো না। বহুদিনের নীরবতা জমে জমে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।

সে বাইরে দাঁড়িয়েই ভিতরের ঘরে বৌয়ের ব্যথাকান্ত নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ঐ শব্দটুকুই একমাত্র প্রমাণ যে এ বাড়িতে একজন জীবন্ত মানুষ আছে। অন্ধকার চৌহদ্দির মধ্যে আর কোন প্রাণের সাড়া নেই। নেই আলো, নেই শান্তি!

অথচ আকাশটা আজও কি সুন্দর! সামান্য ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ এখনও ইতস্তত ভাসছে। রূপোর টাকার মত চাঁদটা জ্বলজ্বল করছিল একপাশে। কখনও কখনও মেঘের পাতলা আস্তরণ অল্প অল্প ছুঁয়ে যাচ্ছে—কিন্তু ম্লান করে দিতে পারে নি। নীলাভ আভার শান্ত জ্যোৎস্না গাছের মাথা থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল। আলোর ধারায় ভেসে যাচ্ছে সব!কত আলো! কত আলো!

এমন আলোর একাংশও কি তার ঘরে জ্বলতে পারতো না? সবাই এর ভাগ পেতে পারে—একা বটকেষ্টই বাদ!

বাড়ি ফিরেও সে ভেতরে ঢুকলো না। রুচি ছিল না। বেশ কিছুণ দাওয়ায় বসেই কাটিয়ে দিল। তারপর কি ভেবে যেন ফের উঠে দাঁড়িয়েছে। গন্তব্যস্থান ঘর নয়। কোথায় যাবে নিজেও জানে না। শুধু এইটুকু জানে এই অভিশপ্ত বাড়ি থেকে যতদূরে পালানো যায় তত ভালো!

বটকেষ্ট দ্রুত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডের দিকে চলল। সে পালাচ্ছে।নিজের বাড়ির বিষণ্ণতার দিকে মুখ ফিরিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষটা।

ঝোপঝাড়ের গা থেকে একটা বুনো গন্ধ ভেসে আসছে। রোজ এই গন্ধটা পাওয়া যায় না। সকালের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল বলেই এখনও স্যাঁৎস্যাঁতে ভেজা আগাছার গন্ধ প্রকট।

ঝোপের ফাঁকে ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গের মত জোনাকি জ্বলছিল। তার পদতারণায় সন্ত্রস্ত হয়ে উড়ে গেল। চতুর্দিক অন্ধকার। শুধু সামান্য দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো মিটমিট করে জ্বলছে। সামনের দশাসই ফ্ল্যাটের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তারই ক্ষীণ রশ্মি উল্টোদিকের মেটে রাস্তায় এসে পড়েছে। খানিকটা আলোকিত করার চেষ্টা করছে যেন। কিন্তু বিপরীতদিকের শূন্যতা সেই সামান্য আভাকেও শুষে নিয়েছে। সেখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকতেই পারে না।

রাস্তার উপরের ফ্যাটে তপন পালের ঘরের জানলায় নীলাভ আলোটা আজও দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ কপোত কপোতী ভিতরেই আছে। ফ্যাটটাকেই বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছে দুজনে।দামী কাঁচের জানলায় নির্লজ্জ নীল রশ্মি। স্পষ্ট নয়, যেন নীল কুয়াশায় আবেশাচ্ছন্ন।

বটকেষ্ট সেদিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। জানলাটা বড্ড উঁচুতে। নয়তো উঁকি মেরে একটু লীলাখেলা দেখা যেত। মন আনচান করছে। ভিতরে নিশ্চয়ই গরমাগরম ব্লু ফিল্মএর লাইভ টেলিকাস্ট চলছে! দেখার লোভ সম্পূর্ণ আছে। উপায় নেই।

সে ল্য করেনি কখন যেন অগোচরে আরেকটা ছায়ামূর্তি সরীসৃপের মত সাবধানী ভঙ্গীতে উঠে এসেছে রাস্তার উপরে। অগ্নিদৃষ্টিতে ঐ জানলাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। বটকেষ্টর পিছনে, কয়েক হাত দূরত্বে একটা ছোট্ট ছায়া!

তার দু চোখ রাতচরা নেকড়ের মত ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছিল!

কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা! পরণেই ছোবল মারার মত বিদ্যুতগতিতে উঠে এসেছে ছায়াটার হাত! একটা আধলা ইঁট অভ্রান্ত লয়ে আছড়ে পড়ল নীলাভ জানলাটার উপরে। মুহূর্তের ভগ্নাংশে আরও একটা!

প্রচন্ডশব্দে ঝন ঝন করে ভেঙে পড়ল জানলার কাঁচ! রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল একটা বিকট চিৎকার! ইঁটটা কারুর গায়ে পড়েছে! 

--‘ এই কে?...কে রে?’

বটকেষ্ট দ্রুত গতিতে পিছনে ফিরল। ছায়াটা প্রাণপণে পালাবার চেষ্টা করছিল। সে প্রায় বাঘের মতো লাফ মেরে তাকে চেপে ধরেছে। তার ভীম বেষ্টনের মধ্যে ছায়াটা ছটফট করছে। কিন্তু পালাতে পারেনি।

--‘ কে রে শালা? রাতদুপুরে লোকের জানলায় ইঁট......!’

বলতে বলতেই সে থেমে গেল! ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অপরাধীর মুখ দেখতে পেয়েছে। একটা বছর চোদ্দ-পনেরোর অপরিনত মুখ।

কিন্তু সে কি মুখ! হিংস্রতায় মুখের প্রত্যেকটা পেশি শক্ত! চোয়ালের হাড় কঠিন সঙ্কল্পে দৃঢ়বদ্ধ!

--‘বিট্টু! তুই......!’

অপরিসীম বিস্ময়ে সে হতবাক। কি বলবে ভেবে পেল না। ছেলেটা এখন আর ছটফট করছে না। ভীষণ রাগে ফুঁসছে! সে অপলকে বটকেষ্টর দিকেই তাকিয়ে ছিল।

--‘ কৌন বে মা......? কৌন হ্যায়?’

ফ্যাটের হিন্দুস্থানি নাইটগার্ডের আওয়াজ শুনতে পেল বটকেষ্ট। একঝলক তার চেহারাটাও দেখা যায়! মুষকো লোকটা হাতে লোহার রড উঁচিয়ে এদিকেই ছুটে আসছে!

সে একধাক্কায় সরিয়ে দিয়েছে বাচ্চাটাকে। ক্রূর, নিষ্ঠুর গলায় বলল—

--‘পালা...’।

বিট্টু হতবাক – এত সহজে ছাড়া পাবে ভাবেনি! বাইরে প্রকাশ না করলেও সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল লোকটা তাকে ধরিয়ে দেবে। কিন্তু......

--‘ কি হল?’ বটকেষ্ট চাপা অথচ কর্কশ ভাবে বলে—‘দারোয়ানের লাঠি পিঠে পড়লে তবে যাবি? যাঃ ভাগ......ভাগ বলছি!’

পরিস্থিতি সঙ্গীণ বুঝতে পেরে বিট্টু পড়ি কি মরি করে দৌড়েছে। প্রিগতিতে সাঁৎ করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

ততণে নাইটওয়াচ ম্যানের চিৎকারের সঙ্গে মিশেছে তপন পালের ক্রুদ্ধ গর্জন। একটা ইঁট তার কপালে পড়েছে। তবে একদম সোজাসুজি লাগেনি। অতবড় ইঁটের টুকরো মাথায় পড়লে মাথাটা আর আস্ত থাকতো না। অল্পের উপর দিয়ে গেলেও চোট লেগেছে। কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। জামাকাপড় অবিন্যস্ত! মদের নেশায় চোখ লাল। বীভৎস মূর্তি নিয়ে লোকটা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে—

--‘হারামি...খানকির বাচ্চা! বদরী ধর শুয়োরটাকে! কাঁচে ইঁট মারা! তপন পালের মাথা ফাটানো! দেখে নেবো বা...টা কে!’

নাইটওয়াচম্যান ততণে রাস্তায় চলে এসেছে। বটকেষ্ট বিট্টুকে ছেড়ে দিলেও নিজে পালানোর চেষ্টা করেনি। নাইটগার্ড বদরীপ্রসাদ হাতের কাছে তাকে পেয়েই কলার চেপে ধরল।

--‘শা—লে! সাবজি কা কাঁচ তোড় দিয়া! সর্ ফোঁড় দিয়া!...চল্......’

সে বিন্দুমাত্রও প্রতিবাদ করলো না।নিজেকে দরোয়ানের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও নেই। বদরী তাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল তপন পালের ফ্যাটে।

তপন পালের কপাল থেকে রক্ত পড়ছিল। সে একটা তোয়ালে চেপে রেখেছে তস্থানে। জামাটার বুক খোলা। গোরিলার মতো রোমশ বুক। পাঁচ মাসের পোয়াতির মতো ভুঁড়ি। লুঙ্গিটা নাভির নীচে এমন ভাবে পড়েছে যে ভয় হয়—এই বুঝি খসে পড়ল!

লোকটাকে দেখেই বটকেষ্টর গা ঘিনঘিন করে ওঠে...।

তপন পাল একদৃষ্টে তাকেই দেখছিল। বটকেষ্টকে সে চেনে। বেশ কয়েকবার ওর দোকান থেকেই পান সিগ্রেট কিনেছে। সে অত্যন্ত ধূর্ত লোক। লোক চরিয়ে প্রোমোটারি করে খায়। একঝলক দেখেই আন্দাজ করলো—বোধহয় এ লোকটা এ কাজ করেনি। তার মতো লোকের বাড়ির জানলা ভেঙে দেওয়ার মতো সাহস হয়তো ওর নেই। তাছাড়া একটা পানওয়ালা তার কপাল ফাটাতে যাবে কেন?

তবু সে তীব্র কণ্ঠে বলে—‘তুই এখানে কি করছিস বে?’

বটকেষ্ট নিরুত্তর। সে মনে মনে ভাবছিল অন্য কথা। সব কথা ফাঁস করে দিলে কেমন হয়? এমন সাধের লটঘটটায় কাঠি হয়ে যাবে। প্রেমিকার ছেলে ইঁট মেরে নাগরের মাথা ফাটিয়েছে একথা জানতে পারলে পিরিত আর থাকবে কি?এমন সুন্দর রোজগারের রাস্তাটিও বন্ধ হয়ে যায়। মালতীবৌদির যাবতীয় সুখ, আরাম, বিলাসের মুখে ছাই পড়ে।

--‘তুই এ কাজ করিসনি’।তপন পাল হিসহিসিয়ে বলে—‘আমি মানুষ চিনি। তোর এত সাহস নেই। কিন্তু নিশ্চয়ই দেখেছিস কে করেছে। বদরী তোকে ফ্যাটের সামনে থেকে ধরেছে। তুই কিছু জানিস না তা হতেই পারে না’।

বটকেষ্টর গলার হাড় সামান্য নড়ল। যেন কিছু বলবে।

মালতী বৌদি পাশের ঘর থেকে সশঙ্ক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। স্পষ্ট না জানলেও আন্দাজ করতে পারেন এ কাজটা কে করেছে। অনেকদিন ধরেই এ আশঙ্কা ছিল। চাপা উত্তাপের আঁচও পেয়েছিলেন। কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলের আক্রোশ এতদূর গড়াবে তা ভাবতে পারেন নি।

তিনি অসম্ভব আতঙ্কে বটকেষ্টর দিকেই তাকিয়েছিলেন। বটকেষ্টও সেদিকেই তাকাল।

হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেল!

--‘ বল্ কে ইঁট মেরেছে’। তপন পাল যেন সাপের গলায় কথা বলছে—‘নয়তো তোকে পুলিশে দেবো। পুলিশের মার খেলে বুঝবি তপন পাল কি চিজ। সিধা সিধা বল্, নয়তো......’।

বটকেষ্ট মালতী বৌদির ফ্যাকাশে মুখের দিকে একবার দেখে নিল। মহিলা আতঙ্কে সাদা! তার প্রাণভোমরা এখন এই কাঠিবাবুর হাতে। একটা নাম বললেই মাগীর ফূর্তিতে কাঠি!

তার চোখ মহিলার মুখ থেকে সরে গেল। ফ্যাটের ভাঙা জানলা দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। স্বচ্ছ, সমুদ্রনীল আকাশটা আলোয় ভেসে যাচ্ছে! সে নিষ্পলকে সেদিকেই দেখছিল। উপরওয়ালা মিটমিট করে হাসছে। একটা চোদ্দ পনের বছরের ছেলেকেও ছাড়েনি হারামজাদা!

--‘ বলবি না পুলিশ ডাকবো?’

আবার হুমকি!

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বড় কাঠিবাবু যার পিছনে অন্তহীন কাঠি দিয়ে রেখেছে। এই নগণ্য কাঠিবাবু আর নতুন করে তাকে কি কাঠি দেবে?

--‘ডাকবো পুলিশ?’

--‘যাকে খুশি ডাক্’।

হঠাৎ সমান আক্রোশে বলে ওঠে বটকেষ্ট। তার মুখ ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে! উদ্ধত অনমনীয় ভঙ্গীতে বলল—

‘আমিই ইঁট মেরেছি। ব্বেশ করেছি! কি করবি...কর শা—লা!’

বিট্টুর চোখের চাপা রাগ বটকেষ্টর চোখে লেলিহান আগুন নিয়ে জ্বলে উঠেছে! ধ্বক ধ্বক করে দাবানল সব গ্রাস করে নিতে চায়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাঁক করে দিতে চায় সব কিছু......!

শুধু ভস্ম......শুধু ভস্ম......আর কিছু না......!!!!

এক অস্তিত্ববাদীর নোট

দেবদুলাল মুন্না

কিছুই করা হয়নি । বেড়াতাম । এখন বাসায়ই থাকি। লিখতাম । ভাষা খুঁজে পাই না । চাকরি করতাম । হারিয়েছি ।  রাজনীতি নিয়ে ভাবতাম । ভাবিনা । স্বপ্ন দেখতাম ।  ঘুম হয়না আজকাল ।

একা একা থাকি । ভাগ্যিস আব্বাজান চারতলা বাসা রেখে মারা গেছেন । বাসাভাড়া দিয়েই চলে জীবনযাপন ।

সারাদিন বাসায় কাটে । সন্ধ্যের পর কোনো কোনো দিন বেরুই  । উদ্দেশ্যহীন । হাটি । মানুষের ভীড়ে ।

একদিন দেখা হয় তুলির সাথে । মৌচাকের মার্কেটের সামনে ।

জানায়, তার লিভারে ক্যান্সার । ১১ দফা ইন্ডিয়ায় গিয়ে কেমোথেরাপি দিয়েছে । মাথার চুল ছোট। রং পুড়েছে । বাসার ঠিকানা দিয়ে বলে একদিন বেড়াতে যেতে ।

যাই না । এর দু মাস পর আবার দেখা তুলির সাথে । হাইকোর্টের মাজারের সামনে,মানুষের ভীড়ে । আমিই তাকে আগে দেখেছিলাম। দেখে ফুটপাত পাল্টে অন্যদিকে পা বাড়াচ্ছিলাম । ডাকলো ।

বললো, মরে যাবো, বাসায় যেও ।

মানুষের মৃত্যু নিয়ে একধরণের রোমান্টিকতা আছে । আমার পছন্দ না । তবু একদিন গেলাম তুলির বাসায় ।

মানুষের জীবন আসলে কিছুই না—-এ টাইপের কথাই বেশী শোনালো তুলি  ।

তার তিনমাস পর তুলি মারা গেলো । আমার মনের রোগ দেখা দিল এরপরই ।

কমোডে বসে ভয়ে ভয়ে দেখি পায়ুপথে আমার রক্ত বেরুচ্ছে কিনা দেখি প্রতিদিন ।

একবার নয়,কয়েকবার । কমোডে বসার পরিস্থিতি না হলেও বসে থাকি । আবার বাথরুমে যেতেও ভয় পাই ।

মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিকতা একদম আমার পছন্দ না । কিন্তু আমি রোমান্টিক হয়ে উঠতে থাকি । মৃত্যু বিষয়ক যেখানে  যা পাই পড়ি,গান শুনি।

অসীম আকাশ এভাবে আস্তে আস্তে  আমার সসীম মাথার ভেতর ঢুকতে থাকে । আমি চুলোয় পানি ফোটাতে দিয়েছি,গরম পানি দিয়ে গোসল করবো বলে,দেখা গেলো, পানি ফুটতে ফুটতে হাওয়া । সেই পানি মেঘ হলো । বৃষ্টি এলো,ছাদে লুঙ্গি পড়ে খালি গা’য়ে ভিজি । ভাবি,আহা আমার চুলোয় ফোটানো পানি ।

এক বিকালে ঘুম ভাঙলে কফির মগ নিয়ে বারান্দায় বসেছি । হঠাৎ মনে হলো,কনকনে হাওয়া টের পাচ্ছি,কিন্তু দেখতে পাইনা কেন ? রাতে একা বাসায় ভয় পেতে শুরু করলাম ।

কমলাপুর স্টেশনে তিনরাত পার করলাম । তারপর গ্রামের বাড়ি থেকে এক বুড়োলোককে আনালাম-আমার সাথে থাকার জন্যে ।

আমারও মনে ঘুরপাক খেতে থাকে সবসময়,তুলির মতো আমিও একদিন মরে যাবো । আমি আমার পরিচিত মৃতদের মনে রাখিনি,জীবিতরাও আমায় মনে রাখবে  কেনো ?

আমার মনে পড়তে থাকে বিদিশার মুখ । আমার মেয়ে । লন্ডনে থাকে । পড়তে গিয়ে স্থায়ী হয়েছে সেখানে । আমার মনে পড়তে থাকে রোমেনার মুখ । আমার বউ ছিলো  । সংসার টিকেনি ।

আমার শৈশবের বন্ধুদের কারো কারো মুখ মনে পড়ে । কিন্ত কাউকে মনে পড়–ক আমি চাই না । শেষমেশ এলিফেন্ট রোডে মনোরোগ চিকিৎসকের সাথে দেখা করলাম । মনে পড়ে, রাতে সব রোগী দেখার পর আমায় তার সামনে ডাকা হয়েছিল । রাত ৯ টা ২২ মিনিটে । মনে আছে সব । অনেক কিছু জানতে চাইলেন । বললাম । তিনি একা না থাকার এবং  যে কোনো কাজে ব্যস্ত থাকার পরামর্শ ও কিছু অষুধ দিলেন ।

আমি ফুটপাতে,রেলস্টেশনে,পার্কে,নাগরিক জ্যামে মানুষের পাশাপাশি হাটি । তারা কী  নিয়ে মশগুল-বোঝার চেষ্টা করি,তাদের সংগতা এভাবে নিতে যাই । দেখি সবই পুরনো আলাপ । বাজার-সংসার-ক্যারিয়ার-সব একাকার । রাত হলে গোলাপী রংয়ের ল্যাক্সোটানিল । আধো ঘুম আধো জেগে থাকা । এভাবেই যাচ্ছিল দিবারাত্রি ।

 একদিন আমাকে একজন ফেসবুকের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দিল । আইডি করলাম । প্রোফাইল লিখলাম । কিছু পুরনো ছবি আপলোড করলাম । কিছু বন্ধু জুটল । ফেসবুকের খুটিনাটি ব্যাপারগুলো রপ্ত করতে বেশ কিছু দিন লেগে গেলো । এবার একটা স্ট্যাটাস লিখতে হয়,শেয়ার করতে হয় । কী লিখব কিছুই খোঁজে পাই না । বন্ধুদের স্ট্যাটাস পড়ি । কতোকিছু নিয়ে যে তারা মেতে থাকে । আহা, আমি যদি তাদের মতো মেতে থাকতে পারতাম ।

একদিন রাতে  বসে আছি ফেসবুকের সামনে । কারো অ্যালবাম দেখছিলাম হয়তোবা । হঠাৎ মনিটরের নিচের দিকে ডানকোণে একটা লাল সিগন্যাল জ্বলে উঠতে দেখি,সাথে সাথে একটা ছোটো বক্স ভেসে উঠে । অরিন রহমান নামের একজন বলে----হাই

জবাব দেই----হুম

হুম কি?

ঘুম

ঘুম পেয়েছে তোমার ?

না

আমার এখানে এখন ভরদুপুর । তোমার তো বেশ রাত । জেগে আছো যে-

??????

??????

কি ব্যস্ত ?

না

কী করো তুমি ?

আমার হঠাৎ কি মনে হলো,ভাবলাম একটু ভয় দেখাই,উদ্ভট কথা বলি ।

টেক্সট পাঠাই —তুমি কী জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো ?

কার ?

মৃত মানুষের সাথে  ।

হিহিহিহি, তারপর বেচেঁ উঠলে কীভাবে ?

যার সাথে কথা বলছ,তিনি নেই॥

তুমি কে ?

হ্যাকার,যার আইডিতে কথা বলছ তিনি মারা গেছেন॥

হিহিহিহিহিহি

তারপর অফলাইনে চলে গেলাম । অরিন রহমানের ইনফো,প্রোফাইল,এ্যালবাম কিছইু দেখলাম না । আগ্রহ কাজ করলো না । শেষরাত । ঘুমানো দরকার । ঘুমঘুমঘুম । তুলিকে মনে পড়লো । শেষের দিকের অসুস্থ তুলি নয় । সুস্থ তুলির সুন্দর শরীর । পর্নো সাইটে সার্চ দিলাম । তুলিকে খুঁজলাম ওইসব মুখগুলোয় । ডুবসাতাঁরের নেশায় পেয়ে বসলো । তুলি মারা গেছে । তাতে কী,আমি তুলিকে নিয়েই ডুবসাতারে মেতে উঠলাম ।

পরদিন তুলিকে নিয়ে রাতের ওই ব্যাপারটা মনে পড়তে একটু অস্বস্তি । ধেৎ,নৈতিকতা। দুপুরের পর দুই ভাড়াটিয়া ভাড়া দিয়ে গেলো । মাসের প্রথম উইক ।

মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যাবার কথা । ইচ্ছে করছে না যেতে । তবু গেলাম । সন্ধ্যেয় । ভীড় বেশী নেই । ডাক্তার জানতে চাইলেন,আমার মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে কি-না । বললাম,খুব জাগে আজকাল ।

কিন্তু ওটি কখনোই করব না ।

ডাক্তার বললেন,ধর্মীয় মুল্যবোধ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে ।

না হেসে পারলাম না তার কথায় । হাসার কারণ জানতে চাইলে বললাম,নাস্তিক কয়জন আর সুইসাইড করে, রিলিজিয়াসরাই বেশী করে ।

 তিনিও এবার হাসলেন । আমি বললাম,আমি সুইসাইড করবো না,কারণ আমার কাছে আমার লাইফ মিনিংলেস । সুইসাইড করলে মিনিংফুল হয়ে যাবে ।

তিনি এ কথায় কি বুঝলেন তিনিই জানেন,আমাকে দুটো অষুধ বদলে দিয়ে বিদায় দিলেন ।

বিদ্রোহ

রেজা ঘটক

মধুমতি নদী থেকে উঠে আসা বড়খালের জোয়ার ভাটার পানিতে সাঁতার কাটার সময় ওরা এক আলাদা জগত তৈরি করে। ওরা সবাই প্রায় কিশোর বয়সের। তবে ভালো সাঁতার জানা ছোটদের কেউ কেউও ওই খেলায় খেলার সুযোগ পায়। দেখলে মনে হবে ওরা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দদায়ক ওই খেলা খেলছে আর সে খেলায় ওরাই সবচেয়ে সেরা। এই খেলায় অন্যসব খেলার মতো কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে সীমিত নয়। সংখ্যাটি এখানে উন্মুক্ত। যে কেউ যখন খুশি তখন এই খেলায় অংশ নিতে পারে অন্যদেরকে শুধু আনুষ্ঠানিক একটা জানান দিয়ে। সাঁতার কাটার সময় হলেই এই খেলায় ওরা মেতে ওঠে। কবে কখন কোথায় এই খেলা প্রথম চালু হয়েছিল তার কোন ইতিহাস যদিও বা কেউ বলতে পারে না। তবে পৃথিবীর যাদেরই জলের পাশাপাশি বসবাস তারা প্রায় সবাই বলতে গেলে অমন সব জলখেলা খেলে অভ্যস্থ। কারণ এই খেলায় কোন সরঞ্জাম লাগে না। শুধু সাঁতার জানলেই চলে। দলনেতা নির্বাচনটাও হয় ঝটপট। দলের কোন একজন খালপাড় থেকে একটু মাঝখানে গিয়েই নিজেকে নেতা হিসেবে ঘোষণা দেয়। নেতার প্রস্তুতি শেষে রেডি ওয়ান টু থ্রি বলার পর অন্যরা তার উদ্দেশ্যে ছুট লাগায়। এই খেলায় জলের উপরে মাথা থাকা অবস্থায় যে প্রথম নেতার মাথা ছুঁয়ে দিতে পারবে সে-ই হবে পরবর্তী টার্গেট ম্যান বা পরবর্তী নেতা । জলের নিচে মাথা ছুঁয়ে দিলে বা জোড় করে নেতাকে আটকে রাখলে তাকে ওই খেলা থেকে পরবর্তী নেতা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বহিস্কার করা হয়। নতুন নেতা নির্বাচিত হলে বহিস্কার হওয়া খেলোয়ার আবারো এই খেলায় অংশ নিতে পারে।

সাধারণত দুপুর বারোটায় এই খেলা সবচেয়ে বেশি জমে। কারণ তখন খেলোয়ারের সংখ্যা থাকে অনেক অনেক বেশি। বেশি খেলোয়ারকে কে কতো বেশি সময় ধরে খাটাতে পারল, তা দিয়েই এই খেলায় নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব যাচাই করা হয়। এমনিতে কেউ একজন স্বেচ্ছায় প্রথমে নিজেকে নেতা ঘোষণা দেয়। অন্য কারো আপত্তি না থাকলে তাকে দিয়েই খেলা শুরু হয়। আর যদি প্রথম নেতা হবার জন্য একাধিক আগ্রহী প্রার্থী থাকে তখন ওরা টস করে নেতা নির্বাচন করে। নেতা নির্বাচন শেষেই শুরু হয় খেলা। যদি কেউ কোনোদিন প্রথম বারের মতো নেতা নির্বাচিত হতে না চায়, তাহলে অন্যরা সবাই মনে মনে ধরে নেয় হয়তো আগের রাতে সে মাওলানা সাহেবের সাথে ঘুমিয়েছিল। আর যে-ই মাওলানা সাহেবের সাথে রাতে একবার ঘুমায় পরের দিন সে নেতা হওয়া তো দূরের কথা রহস্যময় এক কারণে ওই দিন সে আর জলেই নামে না। মাওলান সাহেবের সাথে ঘুমানোর পরের দিন সে নিজেকে এই আনন্দদায়ক খেলা থেকে নিবৃত রাখে। আর তখন তীরে বসে সে কেবল অন্যদের উৎসাহ যোগায়। তাছাড়া এই খেলায় জোড়জবরদস্তি করে কাউকে নেতা বানানোর নিয়ম নেই।

ধীরে ধীরে হোস্টেলের প্রায় সবাই মাওলানা সাহেবের মধ্যরাতের আলো আঁধারি শরীরি পাঠে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দিনের বেলায় ওসব নিয়ে রা করার মতো দুঃসাহস দেখায় না কেউ। ভিতরে ভিতরে সবাই মাওলানাকে সায়েস্তা করার ইচ্ছা পোষণ করলেও ছাত্রদের প্রায় প্রত্যেকেই মনে করে বিষয়টা সম্ভবত অন্য কারো বেলায় হয়তো ঘটে না। পাছে অন্যদের কাছে নিজের ইজ্জত বিষয়ক গোপন খবর রাষ্ট্র হয়ে গেলে ইমেজ সংকটের বারোটা বাজে আর তখন মাদ্রাসা ত্যাগ না করে কি উপায় আছে? ফলে ভিন্ন ভিন্ন রাতে ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রের সাথে মাওলানা সাহেবের মধ্যরাতের ওইসব ব্যাপার স্যাপার ধামাচাপাই থাকে। সেই সুযোগে গহরডাঙ্গা এবতেদিয়া মাদ্রাসার রেসিডেন্সিরাল পরিচালক মাওলানা কুতুব উদ্দীন দুপুরে খানাপিনা সেরে নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। ভুক্তভোগীরা সেই সুযোগ হাতছাড়া করে কিভাবে? এমনিতে ফজরের আজানের পর থেকেই কঠোর সব নিয়ম কানুনের মধ্যে কখন যে দুপুর গরিয়ে যায়। এরপর ঘন্টা খানেকের একটা বিরতি। ওই সময়টা খেলাধূলা আর সাঁতারে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরে। তারপর যোহরের আযান, নামাজ, দুপুরের খাবার। একেবারেই টাইট সিডিউল।

ফলে লান্সের পর একটু না ঘুমালে সন্ধ্যায় পড়ার আসরে যাদের চোখ ঢুলু ঢুলু, তাদের মধ্যে কোনো একজনের ওই রাতে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে ঘুমানোর নিয়ম। দুপুরে খাবারের পর আছরের আযান পর্যন্ত যারা না ঘুমিয়ে দুষ্টামি বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে, তারা কেউ আজ পর্যন্ত মাওলানা সাহেবের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। আশ্চর্য জাদুর কৌশলে মাওলানা কুতুব উদ্দিন সেই সব ছাত্রদের চট করেই বাছাই করতে পারেন। লম্বা চিকন কাঁচা বেতের দু-চার ঘা পরলেই না ঘুমানোর কারণটাও বেরিয়ে যায় দ্রুত। তারপর রাতের খাবার পর্যন্ত তাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার নিয়ম। পড়া না পারলে আবার বাড়তি শাস্তি তো রয়েছেই। কোনো কোনো দিন এমন হয় যে, শাস্তির মাত্রা তীব্র হলে ওইসব  ছাত্ররা ঠিকমতো রাতের খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত ঠিক মতো করতে পারে না। আর তখন স্নেহের পরশে মাওলানা  সাহেব সেই ছাত্রটিকে ওইরাতে নিজের সঙ্গে ঘুমানোর প্রস্তাব করেন। ওই প্রস্তাবে আজ প্রর্যন্ত যারাই দ্বিমত পোষণ করেছে তারা বরং আরো ভয়ংকর শাস্তিও পেয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত ওই সব ছাত্রের মাওলানা সাহেবের সহশয্যা এড়ানো খুবই কঠিন ব্যাপার।

তাই মাওলানা সাহেবের ওপর হোস্টেলের প্রায় সকল ছাত্রেরই একটা কমোন ক্ষোভ রয়েছে। যে করেই হোক মাওলানা সাহেবকে একটা কঠিন শিক্ষা দেওয়া চাই। ক্ষোভ ধীরে ধীরে বিক্ষোভে রূপ না নিয়ে কৌশলের দিকে গড়াল। ওরা আবিষ্কার করল যে মাওলানা সাহেব দিনের বেলায় অনেকটা মরার মতো পরে পরে ঘুমান। পাশাপাশি ভয়ংকর রকম নাক ডাকেন। কৌশল আর কুশলীদের যৌথ প্রযোজনায় ঠা ঠা রোদের কাঁঠালপাকা গরমের মধ্যেও ওরা আমগাছের ডালে এক এক করে সবাই জড়ো হয়। যেন আজ এই মাদ্রাসায় মাওলানা কুতুবউদ্দীন সাহেব ছাড়া কোনো ছাত্রেরই কোনো ভাবেই দুপুরের ঘুম আসে না। ঘটনা সরাসরি দেখতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। পূর্ব পরিকল্পনা মতো রমজান আর সুলতান বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ঘুমন্ত মাওলানা কুতুবউদ্দিন সাহেবের পায়ের কাছে গিয়ে বসে। অন্যরা কেউ বা বাইরের জানালায় দাঁড়িয়ে। কেউ বা আম গাছে। কেউ বা মাঠ এবং রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে। যাতে মাওলানা সাহেবের কাছে কেউ আসলে ওরা নিরাপদে কেটে পরতে পারে।

এক নাম্বার নাইলনের বারো নম্বর সুতা। সুতা দিয়ে ফাঁস বানানোর কাজে রমজানরা প্রায় সবাই ওস্তাদ। দ হাতে মাওলানা সাহেবকে ওরা ফাঁসের টোপে বেঁধে চুপচাপ বাইরে এসে আমগাছের তলায় অপো করতে থাকে।

অপো খুবই অসহ্য ব্যাপার। কারো কারো মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি চাপল, আযান হতে পারে এক নম্বর ওষুধ। এই একটা বিষয়ে ওরা মাওলানা সাহেবকে খাঁটি মাবুদের বান্দা মানে ওরা। যতো বেহুসের মতোই মাওলানা ঘুমাক না কেন, আযানের সুর শোনা মাত্র তাঁর ঘুম ভাঙবেই। বেলালের আযান শুনেই মাওলানা কুতুব উদ্দিন সাহেব পাশ ফিরে শরীরের আলস্য ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। অমনি মাওলানা সাহেবের লিঙ্গে সুতার টান পরে। ঘুমের ঘোরে ব্যাপার বুঝতে না পেরে মাওলানা সাহেব উঠে বসার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না । লিঙ্গ তার কঠিন ভাবে বাঁধা পরেছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই নিশ্চিত ওটা দ্বিখন্ডিত হবে।

 

বাইরে আমগাছে আর মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে তখন আনন্দের উৎসব বয়ে যায়। আজ যেন রমজানদের উৎসব করার দিন। আজ অন্তত মাওলানার ওপর একটা যুতসই বদলা নেওয়া গেছে। উৎসব আর হৈ হুল্লোর দেখে প্রতিবেশীদের ভীড় বাড়ার আগেই ওরা যে যার মতো মাদ্রাসা ছেড়ে পালায়। 

                                           

আশ্চর্য সুখের কবি

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

মাছ অলা কবিতা পড়ে না

মধুবিক্রেতাও কবিতা পড়ে না

মুমূর্ষু কিশোর, ভাই তুমিও কবিতা পড়ো না

জ্যোতিবাবু কবিতা পড়ে না।

কবিতার প্রকাশক কবিতা পড়ে না।

কবিতার সম্পাদক কবিতা পড়ে না।

কলেজে পড়ায়, সেও কবিতা পড়ে না।

তবে কি রাক্ষস পড়ে সমস্ত কবিতা?

তবে কি খোক্ষস কেনে কবিতার বই?

(রাক্ষস খোক্ষস : সুবোধ সরকার)

এরকম ঘটনা ইতোপূর্বে কদাচিৎ ঘটিয়াছে। বড়জোর দুইবারের কথা মনে করিতে পারা যায়। একবার নব্বইয়ের শেষের দিকে আরেকবার বোধ হইতেছে সাতানব্বইতে। আজিকে এই দুই হাজার আষ্টের আষাঢ় মাসে তৃতীয়বার কবিতা পড়িতে পড়িতে শিরদাঁড়া খাড়া করিয়া সকল দণ্ডায়মান লোমসমেত নিজেও দণ্ডায়মান হইতে বাধ্য হইল সাজ্জাদ। সম্মুখে উপস্থিত কলিংবেলখানা চাপিয়া অন্যসকল সময়ের মতো ফরমায়েশীদের ডাকিল। জীবনের মতো দীর্ঘ কিছু মুহূর্ত কাটিয়া যাইবার পরও কেহ ঘরে না আসায় গলা ছাড়িতেই হইল, ‘মুনীর-।’

কর্তার চিৎকারে হন্তদন্ত হইয়া কামড়ায় ঢুকিল মুনীর। একেলা নহে। সঙ্গে বদরও। ঠাওর করা যায় উভয়েই খোসগালগপ্পে মশগুল হইয়াছিলো। বদন সামান্য ভ্রুকুঞ্চনযোগে তুলিয়া ধরিয়া সাজ্জাদ উচ্চারিলো, ‘গাড়ি! আমি বের হবো।’ চর্তুচক্র যন্ত্রযানের পশ্চাৎ আসনে আসন গ্রহণ করিয়া চালক হাশেমের বরাবরে নীলচে রঙের কাগজখানা বাড়াইয়া দিয়া সাজ্জাদ জিজ্ঞাসিলো, ‘এইটা মিরপুরের কোন দিকে, কইতে পারো? বাংলা কলেজ তো চেনা পাড়া, কিন্তু ১০ নম্বরের একুশের সি?’ হাশেম দর্শন করিল অর তো নয় যেন কাগজের  পৃষ্ঠে উপস্থিত ফুল্লকারুকাজ। ঠিকানাখানি ঠাহর করিয়া, উত্তমরূপে দেখিয়া অধমরূপে অর্থাৎ অত্যন্ত নিচু ও ক্ষিণ কণ্ঠে উত্তর করিল ‘স্যার, রফিক আজাদের বাড়ি গিয়েছেন তো আপনি, ওর কাছাকাছিই হবে বোধহয়....।’

‘ঠিক আছে। যাও।’

বাহনযান বড় রাস্তায় পড়িলে কবিতাখানি আর একবার পাঠ করিল সাজ্জাদ। অমনি হিমালয় বাহিত এক ঝলক মৃদুমন্দ সমীরণ যেনো আসিয়া লাগিল সাজ্জাদের চোখেমুখে, অক্ষর তো নয় যেন এক ঝাঁক অচেনা অচিন মদবিলানো পাখির কিচিরমিচির নেশাপায়ি দ্রব্য হয়ে চণ্ডালের মতোন তাহার মগজ ছুঁইলো। তাহারা একবার উড়িয়া যায় তো ঠিক পরণেই আবার ফিরিয়া আসে।

সপ্তাহে কম করিয়া হইলেও একশোখানা কবিতা পড়িতে হয় সাজ্জাদকে। তাও বন্ধু এবং অধ:স্তন সহকারি সম্পাদক কবির নয়ন তাহার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করিয়া আরো শতখানেক বাছাই করিয়া দিবার পর। এই একশোর মধ্যে অধিকাংশই প্রথম পঙক্তি পড়িবার পরই চলিয়া যায় রদ্দা কাগজের ঝুড়িতে। দুটি কি বড়জোর তিনটি রাখিয়া দেয় তাহার সম্পাদকীয়র চূড়ান্ত নথিতে। পরে আরবার ছাপাই কর্মের নিমিত্তে চালান করিবার সময় যখন চোখ বোলানোর প্রয়োজন পড়ে তখন মনে হয় উহাদের কোনওটাই বুঝি কবিতা হইয়া ওঠিলনা! নব্বইতে চমকিয়া উঠিয়াছিল একখানা গল্প পড়িয়া। তখনও কোম্পানি বাহন প্রদান করে নাই। ভাড়া করা ট্যাক্সি লইয়াই ছুটিয়াছিল নারায়নগঞ্জের বি কে সাহা লেনে। অদ্ভুত জীবিকা ছিল ছেলেটির। ঘুরিয়া ঘুরিয়া আখের রস এর কারবার করে। আখের রস চাই আখের রস চাই, আখেরবোঝা আর হস্তচালিত পেষণযন্ত্রখানা লইয়া ঘুড়িয়া বেড়ায়। হঠাৎ কি খেয়াল হইলে একখানা সাড়ে নয় পাতার গল্প ডাকে ফেলিয়া দিয়াছিল সন্ধি ও সাহিত্য সম্পাদক বরাবরে। তারপর তাহাকে লইয়া সমগ্র শহর, উপরন্তু সমগ্র দেশ তোলপাড়। সেই মিনারউস সালেহীন এখন বাংলা সাহিত্য জগতের প্রথম দশ গদ্য লেখক এর একজন হইয়া উঠিয়াছে। গত বছর উত্তরাতে নয় তলা বাড়ি করিয়াছে। জব্বর বাড়িখানার গৃহপ্রবেশের দিন হাজির হইতে হইয়াছিল সাজ্জাদকে। কিন্তু আজ তাহার কপাল মন্দ। এই তৌহিদুল ইসলামকে তাহার আস্তানায় পাওয়া বিরল হইতে বিরলতর হইয়া উঠিতেছে। বাড়িখানা খুঁজিয়া পাইতে অসুবিধা বিশেষ হয় নাই যদিও, কিন্তু তাহাকে পাওয়াই ভার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। জানা গিয়াছে মহাশয়ের দেশের বাড়ি পাবনাতে। বাবা সেখানকার প্রথম শ্রেনীর অবসরপ্রাপ্ত বাউণ্ডুলে সর্দার আর মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াইয়া কোনোক্রমে অন্ন যোগান। তৌহিদুলকে তাই পাবনাতেই থাকিতে হয় বছরের  বেশিরভাগ সময়। মিরপুরের এই বাংলা কলেজ পাড়ার ১০ নম্বর রোডের একুশের সি বাসায় সে বেড়াইতে আসিয়াছে তাঁর নানার বাড়ি। তাহার তিন মাতৃভ্রাতা অর্থাৎ মামার দুইজন অর্থোপার্জন নিমিত্তে বৈদেশে বসবাস করিয়া থাকেন এবং আরজন সন্ন্যাসী হইয়াছেন অর্থোপার্জন না করণ নিমিত্তে।  তিনি এলাকাতেই থাকেন এবং ঘুড়িয়া বেড়ান। এই সংসার এইখানে বিগত মাস ছয়েকের মতো আগলাইয়া রাখিয়াছে তৌহিদুল ইসলামের মাতা রেহানা খানম।  তাঁহার নানা একজনা আধবুড়ো চাকরের উপর ভরসা করিয়া তিনপুরুষের বাড়ি আগলাইয়া বসিয়া আছেন এই একুশের সিতে।

‘রাইতে তো বাড়িতেই শোয়। এইটাই জানি। আর সারাদিন কৈ টো টো করে কওয়া মহামুশকিল। কিছু কইলেই এমুন রসের উত্তর দেয় আমি লা-জওয়াব হইয়া হা কইরা থাকি’। সদালাপী বৃদ্ধ কথা বলিতে থাকেন আর হাসিতে থাকেন ফিক ফিক করিয়া। বয়স আশির ঢের বেশি হইবে, মাথাভর্তি কাশফুলের মতো চুল, ধবধবে ফর্সা রঙ আর রিমলেস চশমাখানায় তাহাকে মনে হয় আয়ারল্যাণ্ড কিংবা জার্মানির বয়স্ক রাজপুত্র কিংবা অবসর নেওয়া বৃদ্ধ রাজা। মানিতেই হইবে বুড়ো সৌখিন বটে। তবে ইদানিং যে অর্থাভাব চাড়ি দিয়া উঠিতেছে তাহা মুখের কোণের সামান্য মলিণতায় বোঝা খুব কঠিন হয় না। আপনারা কি সুভাষ দত্ত, ঔ যে বাংলা সিনেমার ত্রিকালদর্শী অভিনেতা, তাহাকে দেখিয়াছেন? বৃদ্ধকে দেখিয়া আমার তাঁহার কথা মনে হইতেছে। তাঁহার সাথে খুব কম অমিলই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের রহিয়াছে।

-‘ও কতদিন কবিতাটবিতা লিখছে বলতে পারেন?’

-‘কবিতা! ’ বৃদ্ধ যেনো ঠুয়া খাইলেন। হাত হইতে বেনসন এণ্ড হেজেস পড়িয়া গেল ধবধবে সাদা ধূতির মতো পড়া লুঙ্গির উপর। মুহূর্তে তাহাকে ঝাড়িয়া বলিয়া উঠিলেন -

-‘ও কবিতা লেখে নাকি! তুমি তো মিয়া আমারে সাংঘাতিক খবর দিলা। আমি তো জানি ও ডানপিটে আর মারকুটে ক্রিকেট ব্যাটসম্যান, রাত্তির বেলা আসমানের দিকে লাম্বা একখান চোঙ লইয়া চাইয়্যা থাহে আর ময়ূরের পাখনা জমায়। আর বাড়ি ফিরেই হুম হাম কইরা খাইয়্যা চিলাকোডায় উইঠ্যা যায়।’

পরিচয় দিতেই তিনি বলিলেন- ‘ তোমার নামও তো আমি হুনছি। অনেকদিন ধইরা ‌ সম্পাদকগিরি করতাছ। বহুৎ ল্যাখক বাইর করছ আর উডাইছ তুমি, কিন্তু অহন এইগুলা কি করতাছ? নাম সাহিত্য পত্রিকা, ভিতরে মোবাইলের অ্যাডবেটাইজ, আর তারমইদ্যে দুনিয়ার জিনিস, সেলাইকলের থেইক্কা সুইসুতা কিছু বাদ নাই’।

-আর বলেন কেন।’ সাজ্জাদ নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়া অভিযোগসমূহ হইতে মুক্তি চায়। ‘এখন পাঠক ওই সবই চায়। দুই মলাটের মধ্যে নিখিল বিশ্ব।’

বৃদ্ধের হাত হইতে মুক্তি পাইতে প্রস্থান বিনা গতি নাই, এই মত বান্ধিল সাজ্জাদ। উঁঠিয়া দাঁড়াইয়াছে এমন সময় বৃদ্ধ শুধাইল ‘রফিকরে চেন? মোহাম্মদ রফিক। ইউনিভার্সিটিতে সাঁতারে মেডেল পাইছিল, সাংঘাতিক পাঞ্জা লড়ত...?’।

সাজ্জাদ বলে, ‘জী! চিনেন আপনি উনারে?’

-‘চিনি মানে! কলেজে পড়ছি দুইবচ্ছর একলগে। তারপরেত্তে যোগাযোগ কম। নাইলে একটা সময় আছিল যেসুমে প্রত্যেকদিন দেহা হইত। তুমি নিজের নাম করলা-ত তহনি তাঁর কথা মনে হইল...

- মামা তো .... নেই। গাজীপুরেই ছিলেন। গত বছর স্ট্রোক...

-আহা...’ বৃদ্ধ অন্যমণষ্ক হইয়া পড়িলেন।

  

 -‘তোমারে তুমি কওয়া তাইলে অনুচিত হয় নাই! তুমিতো আমার চাইতে অন্তত ২০ বচ্ছরের ছোড অইবা! কি ? ঠিক না?’

- হ্যাঁ, ঠিক ঠিক! তা প্রায়.. আমারও তিপ্পান্ন।’

সম্পর্ক বাহির হইয়া পড়াতে বৃদ্ধ প্রায় নিজের লোকের মতো ‘ও-রে তোমার দরকার! তা ওর ঠিকানা এই বাড়ির চিলাকোডা। কহন আহে, কহন যায় কিচ্ছু ঠিক নাই, রাইতে একবার খাইতে বইস্যা এই বুড়ার লগে কতা হয় রঙ্গরসের।’

ফিরিতে ফিরিতে বৃদ্ধ আর তৌহিদুলের কথাই ভাবিতেছিল সাজ্জাদ। আরো কয়দিন চলিয়া যায়। কিন্তু তৌহিদুলের দেখা মেলে না । সন্ধি ও সাহিত্য  সম্পাদক বাড়ি বয়ে দেখা করিতে আসিয়াছেন জানিয়াও তাহার কোন হেলদোল নাই। কবিতাখানি ছাপা হইয়াছে এই সপ্তাহেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চতুর্দিক হইতে ফোন এবং চিঠি। চেনা জানা অনেকেই জানতে চাহিয়াছে ‘এই পোলাডা কেডা সাজ্জাদভাই? এই তৌহিদুল ইসলাম?’

দিনকয়েক পরে আবার লোক প্রেরণ করিলেন সাজ্জাদ। তাহার বিশ্বস্ত কবির নয়নকে। দুজনে একসঙ্গে স্কুলে পড়িতেন। কিন্তু কবির এত ডানপিটেমি করিত যে স্কুলের পরে আর লেখাপড়া হইলো না। এইখানে সেইখানে ডিগদারী করিয়া বেড়াইত। শেষে সাজ্জাদ তাহাকে সন্ধি ও সাহিত্য পত্রিকায় চাকরি দেয়। গত বছর তাহার মেজোজামাই কাসেমও এইখানে বহাল হইয়াছে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরিতে।  নয়নের মাথায় কদমছাঁট চুল, একটা চোখ ঘোলাটে। তাহার বারোমেসে পোষাক সাদারঙ না থাকা সাদা রঙের পাজামা ও হাফশার্ট। অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান। অফিসের খাতায় নয়ন সহকারী সম্পাদক হইলেও সাজ্জাদের প্রেমিকাদীগের কাছে উপহার পৌঁছাইয়া দেয়া হইতে শুরু করিয়া বাড়ির জন্য বাজার করা সকল কর্মই বিশ্বস্ততার সাথে নয়নকেই করিতে হয়। একভাবে নয়ন সাজ্জাদের বন্ধুও। সেই নয়নও বিফল হইয়া ফিরিয়া আসিল। অনেকটা প্রথম বলেই হিট উইকেটে ব্যাটসম্যানের আউট হইবার মত ঘটনা। একদিন গিয়া জানিতে পারিল তৌহিদুল ধামরাই গিয়াছে রাসমেলা দেখতে, পরের দিন গিয়া শুনিতে পাইল সে রাসমেলার দলের সহিত পাড়ি দিয়াছে ময়মনসিং। তৃতীয়দিনের দিন বৃদ্ধের বাড়ির চাকর জানলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া জানাইল, -‘আছেন, কিন্তু দেখা হবার জো নাই।’

‘ওর নিশ্চই প্রেমিকা আছে!’- অফিসকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে মন্তব্য করিল নয়ন। ‘হ্যাঁ, পেয়েছি, সেই ইয়েকেই ধরতে হবে, তবে যদি ওর দেখা পাওয়া যায়’।

নয়নের অনুমান হয়তো ঠিক। এতো প্রাণ যাহার কবিতায়, অনিবার্যভাবে তাহার প্রেরণা নারী হইবারই কথা। এক চুমুক মেশানো জল গলায় ঢালিয়া সাজ্জাদ শুধায় ‘কিন্তু, কে সে?’।

দুই দোস্ত সপ্তাহে সপ্তাহে ডলফিন-এ আসে নিরিবিলিতে একটু মদ্যপান করিতে। খাদ্যপানীয়ের যা আকর্ষণ এই সুরম্য বারটির, তাহা হইল এর মাঝখানেই রহিয়াছে এক টলটলে জল সুইমিং পুলের তীরে সাঁতরানো নারীদের ঘর।

-‘ সেইটাই জানা বাকি রইয়্যা গ্যাছে আমার।’-নয়ন মাথা নাড়িয়া নাড়িয়া বলিয়া চলে। ‘বলতাছো- বয়স পঁচিশ পার অয় নাই, চেহারা রাজপুত্রের মতোন, লেখা ও কি তার! গলানো সোনা, তার পিছে মাইয়্যা মানুষ থাকবো না একি কইরা অয়?’।

বাইশ বছর সন্ধি ও সাহিত্য র ধূলো ঘাটিতেছে নয়ন। অমনোনীত গল্প কবিতার তাড়া আর নির্বাচিত কবিতা গল্পের ফাইল নাড়াচাড়া করিতে করিতে সে অভিজ্ঞতায় ধরিয়াছে ঘুণ আর মুখের ভাষায় আসিয়াছে ধার। ‘আমি দুইদিনের মধ্যেই পাত্তা লাগাইয়া ফেলমু’ মুঠোয় পোরা সিগারেটে টান দিয়া বলিল নয়ন। ‘তুমি শুধু হাশেমরে কইয়্যা দিও যেইহানে যাইতে চাই আমারে যেন নিয়্যা যায় ও’।

সাজ্জাদ বিস্তর দেখিয়াছে। নিজের জীবনে এবং বাইরের পৃথিবীর হাজারো ভাঙাগড়ার সাক্ষী  সে। অবস্থাটা যে দ্রুত পাল্টাইয়া যাইতেছে তাহা  যে সে বোঝে না তাহা নয়। আগে উঠতি লেখকরা তাহাকে যেমন সমীহ করিত তেমনই তাহাদের সাধনায় কোন ফাঁকিরও অস্তিত্ব পাওয়া যাইত না। গত চল্লিশ বছরে বহু পত্রিকার জন্ম এবং মৃত্যু ঘটিয়াছে। কিন্তু সন্ধি ও সাহিত্য ’র অটল মহিমা কেহই অনুমান করিতে পারে নাই। কেবল ধারাবাহিকতায় নহে উৎকর্ষতায়ও সে এখন পর্যন্ত অপ্রতিম। সাজ্জাদের চাওয়া যতদিন সে নিজে এই পত্রিকার হাল ধরিয়া আছে ততদিন কেহ যেন এর ধারে কাছে না আসিতে পারে। এর জন্যই দরকার হইয়াছে তৌহিদুল ইসলামকে ধরিবার। ধরিবার এবং বাঁধিয়া ফেলিবার। কেননা এর লেখার মধ্যে যে অমল প্রতিভার দেখা সাজ্জাদ পাইয়াছে তা শুধু দুর্লভ নয় , তৌহিদুল অন্য কোন পত্রিকা গোষ্ঠীর আনুগত্য নিয়া ফেলিলে তা হবে সন্ধি ও সাহিত্য- র জন্য এক চরম দুঃসংবাদ।

‘আমার অনুমান ভুল আছিল; প্রেমিকা না, নষ্ট মাইয়্যামাইনষের কাছে যায় ও’ ।

‘তাই!’ সিধা হইয়া বসিল সাজ্জাদ। এমন একটা সন্দেহ যে তার একেবারে হয় নাই তাহা নয়। তৌহিদুলেরই একটা কবিতার শুরু এই ভাবে ‘ও নষ্ট বেভুল স্পর্যিতা, তুমি আমার মা-...’

 ‘জানতে পেরেছিস কি কোন বিশেষ পাড়ায় যাতায়াত ওর?’

‘না। তয় লোক লাগাইয়্যা দিয়া আইছি।’ চেয়ারে বসিবার আগে র‌্যাপিং পেপারে মোড়ানো একতোড়া গোলাপ টেবিলের উপর রাখিল নয়ন-‘ ছোকরা গভীর জলের কাদাখোচা মাছ, তবে আমিও বাঘা তেতুল’। এ বিষয়টিতে নয়নের সহিত একমত না হইয়া উপায় পাইল না সাজ্জাদ। প্রেমিকা নাই, অথচ খারাপ মেয়েছেলের কাছে যায়, কবিতায় নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ঘটায় কিন্তু সম্পাদককে থোড়াই কেয়ার করিয়া চলে, এ সহজ পাত্র নয় বাবা! বোধহয় চল্লিশের দশকের দিকে রেওয়াজ ছিল কবি হইতে গেলেই নিষিদ্ধ পল্লীতে নাড়া বাঁধিতে হইবে, আসক্ত হইতে হইবে মদ্যপানে। পঞ্চাশের দশক পাড় হইতেই কবিদের রক্ত নরম হইতে থাকে, তখন প্রেম করার পাত্রী হিসেবে বিবাহিতা রমণী বা নির্দোষ কিশোরী নিরাপদ বিবেচিত হইতে থাকে। ওই সময় হইতেই আসলে কবিতার দীপ্তি লয় পাইতে থাকে, হারাইয়া যায় ছক ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দুঃসাহসী হওয়ার শক্তি এবং উভয়ত সাহস।

‘এইটা?’

নয়ন নিজেরকর্ম্মে যাইবে বলিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাজ্জাদ টেবিলের গোলাপতোড়ার দিকে দেখাইলে নয়ন বলিল, ‘নিউমার্কেটের কছ দিয়া আইতেছিলাম, বিপ্রার লাইগা লইলাম, ভাল্লাগলো দেইখা’। এই সপ্তাহেই ‘উন্মেষ’ এ তৌহিদুলের কবিতার কথা মনে পড়িল-

‘গোলাপ; ফোটার আগে না পরে তুমি কুঁড়ি?

 গোলাপ; আমি তোমার পায়ে বিভ্রান্ত মাথা খুঁড়ি’।

 গোলাবনেশা কাটাইয়া লইয়া সাজ্জাদ নয়ন পানে প্রশ্ন  রাখিল ‘বিপ্রার বিয়ের কিছু আগ্গাইলো?’

-‘কই! যেরা পছন্দ কইরা গেছিলো, হেই পোলার পিয়াজ খাওয়ার দোষ আছে বইলা ওর মা জানতে পারছে। সামনের মাসে আরেকজনের দেকতে আওয়ার কতা, দেহা যাক...’

‘বিপ্রা’ নামখানা সাজ্জাদের দেয়া। বিপ্রার জন্মের আগে সাজ্জাদের সহধর্মিনী প্রভারও গর্ভসঞ্চার হইয়াছিল। দুই ছেলে রহিয়াছে, সাজ্জাদ চাহিয়াছিল এইবার মেয়ে হউক। কিন্তু সেইবারও হইল ছেলে। যে নাম নিজের মেয়ের জন্য ভাবিয়া রাখা সেই নাম দিয়া হইলো বন্ধুর মেয়ের নামকরণ। তাহাকে সাজ্জাদ ভালও বাসে নিজেরই মেয়ের মতন, মেশে যেন নিজের বয়সী কেউ, যেমন চাহিয়াছিল তেমনই তাহার স্বভাব -একেবারে ঝর্ণার মতো। রূপও যেন টেবিলের কাঁচের ওপর রাখিয়া দেওয়া সদ্যফোটা শিশিরভেজা গোলাপ কিংবা এইমাত্র পাড়িয়া আনা টকটকে লাল আপেলের মতো।

-‘তুই আমার একটা কাজ কইরা  দিবি বিপ্রা?’

বিপ্রা মিটি মিটি হাসিল। সাজ্জাদের পরণে আজ তসরের পাঞ্জাবি, পাজামা, পায়ে চকচকে জুতো, চুলে তার কলপ লাগাইতে হয় নাই এখনো, এমনিতেই কুচকুচে কালো। ‘তুমি কিন্তু দিন দিন আরো সুন্দর আর জুয়ান হইয়্যা যাউতাছ জ্যাঠা’, বিপ্রা চোখ বড় বড় করিয়া সাজ্জাদের আপাদমস্তক দেখিয়া বলিল, ‘মনে হইতাছে য্যান হিন্দি সিরিয়ালের পর্দা থাইক্যা ঠাস কইরা  পইড়্যা গ্যাছোগা!’

-‘মাদাম, আমার যশ করলেন! ধন্যাবাদ। এর জন্য আপনার পাওনা রইল।’ ভুরু কপালে তুলিয়া এক মুহূর্ত ভাবিয়া সাজ্জাদ বলিল-‘ সুবীর নন্দীর অ্যালবাম বেরিয়েছে। ঠিক!’

-‘থ্যাঙ্কস! নন্দী আমার দারুন লাগে জেঠু। এখন কি করতে হবে বলো’

নয়ন এ দুইজনের মধ্যে কখনোই থাকে না। সে বেচারা অন্য তিন কন্যাকে লইয়াই ব্যাতিব্যাস্ত। বড় ছেলের বউ বিইয়েছে তাহাকে দেখিতে যাইতে হইবে, মেজর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিতে হইবে, তো একে ধরো ওকে ধরো, ছোটর বড় পা ভাঙিয়া  হাসপাতালে, তাহার চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাঠানো দরকার। হাজারো হুজ্জত। ওই কুচোটার ভার যদিবা সাজ্জাদ নেয় তাহাতে ক্ষতি কি? পল্টনের এ বাড়িও সাজ্জাদের, ভাড়া যাহা নেয়, তাহার চাইতে বেশি খরচ করিয়া বেড়ায় নয়নের মেয়েদের উপহার দিতেই ।

-‘এই ছেলেটারে ধইরা  আইন্যা দিবি?’

 কোথা হইতে তৌহিদুলের একটা হলুদাভ হয়ে যাওয়া ছবি পাইয়াছে নয়ন, কে বা জানে!

বিপ্রা ছবি হইতে মুখ উঠাইয়া ঘাড় ঘুড়াইয়া বলে ‘বাব্বা ! এ যে একেবারে কলির কেষ্ট।’

-‘কিছুটা আমাদের সময়ের ‘নীল আকাশের নীচে আমি’-মার্কা রাজ্জাক আর কিছুটা তোদের ‘তেরে জমিন পার’-মার্কা আমির খান, কি বলিস?’  

বিপ্রা যে মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখিল এতে সাজ্জাদ খুশি হইলো। বিপ্রা মডেলিং করিয়া থাকে, ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়িয়া থাকে, তাহার একুশ বছরের জীবনে সে দেখিয়াছে শিখিয়াছে জানিয়াছে তা নেহাৎ কম হইবে না। সাজ্জাদের মন বলিয়া ওঠে, বিপ্রা নিশ্চই তৌহিদুলকে তুলিয়া দিতে পারিবে সন্ধি ও সাহিত্য সম্পাদক সাজ্জাদ চৌধূরীর হাতে। কোনওদিন এমনতরো হয়নি। গত চল্লিশ বৎসরে যত কবি, লেখক, ঔপন্যাসিক উঠিয়া আসিয়াছেন সবাইকে জল খাইতে হইয়াছে তাহার হাতে। না, বশ্যতা স্বীকার বা কুর্ণিশ করিয়া শিরোপা তুলিয়া দেওয়া নয়, সে ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া দিয়াছে আর ইসলাম, মিত্র, হোসেন, গঙ্গোপাধ্যায়, বসু, আহমেদরা তাতে সোনার ফসল ফলাইয়াছে। কাহারও দরকার হইয়াছে টাকার, কাহারও থাকার জায়গার। কেহ বা কাঙাল ছিল দুইখানা মিষ্টি কথার। সাজ্জাদ সাধ্যমত জুটাইয়াছে তাহাদের প্রয়োজনের রসদ, বদলে পাইয়াছে কিংবা দখল করিয়াছে তাহাদের শ্রেষ্ঠ রচনা। যাহার ফলে লেখক পাইয়াছে প্রতিষ্ঠা, মান বেড়েছে সন্ধি ও সাহিত্য- র। কবি পেয়েছে বাংলা একাডেমী, স্বাধীনতা, ঔপন্যাসিকের গ্রন্থের সুবর্ণজয়ন্তী সংস্করণ প্রকাশিত হইয়াছে আর গর্বে  চেস্ট টার্ন  ইনটু ব্রেস্ট হইয়াছে সাজ্জাদের। জনগণের অভিনন্দন গ্রহণ করতে জনপ্রিয়তম গল্পকার হাঁটিয়া আসিয়াছে মঞ্চের মাঝখানে আর উইংসের আড়ালে দাঁড়ানো সাজ্জাদের চোখ দুটি সজল হইয়া আসিয়াছে।

করতালিমুখর প্রক্ষাগৃহের আড়ালে সে হয়তো দেখিতে পাইতেছে ফরিদপুরের সেই নিভৃত শহরতলীর সেই রাস্তা ও গলি, যেইখানে সে সারাদিন সাইকেলে দুধ বা খেঁজুরের রস ফেরি করিয়া সংসার চালাইত। সেইখান থেকে মামার কৃপায় রাজধানীর  বুকে এসে জীবনবদল। হাজার লড়াই। বার বার জীত।

 সেই সাজ্জাদ আজিকে হারিয়া যাইতে বসিয়াছে। মুকুটের পালক গিয়াছে খসিয়া। ধূলোয় মলিন হইয়াছে রাজপোষাক। পাঁচখানা চিঠি, তিনবার তার বাড়ির পাপোঁষে পা ঘষিয়া আসা সব বিকলবিফল। ওই আকাশের অতলতার ফাঁকে এক অতি ক্ষুদ্রকায় তারা যেন যেন মিটিমিটি হাসিয়া বলিতে চাহিতেছে, নাগাল পাবে না তুমি সাজ্জাদ চৌধুরী, দুয়ো! দুয়ো! ভূয়ো! ভূয়ো!

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় দেখা হইতেই হাঁসফাঁস করিতে করিতে বিপ্রা বলিল ‘উঃ  কি সাংঘাতিক এক অভিজ্ঞতা যে হইল না জেঠু, মদ চলে না বলেইত মনে হইল, মেয়েমানুষেরও যে খুব দরকার তাও মনে হইলনা। এক ঘন্টার উপর ছিলাম। আমার আঙুলগুলো শুধু একবার ছুঁইলো। কী কী কইলো হোনো, আমি টেপ কইর‌্যা আনছি’-

... লেখা আমার বেঁচে থাকার হাজারো আকর্ষণের একটি। আজকে লিখতেছি, কালকে যুদি ছাইড়্যাও দেই

তবু আমার বাঁইচ্যা থাকার আনন্দ একটুও কমবো না। জীবন আমার এক পরম অভিজ্ঞতা, এক অন্তহীন অজানার গুহা, আমি ভালোবাসি মানুষের মধ্যে মিশ্যা যাইতে, একলা থাকতে, সমুদ্রে পাহাড়ে বেড়াতে যাইতে, আবার চুপ কইরা  বইস্যা থাকতে। আমি সব চাই, আবার কিছু না হইলেও আমার চইল্যা যায়। আমার চাইরপাশে চলমান যে জীবন, আমার কাছে আসলে তা একটা উপন্যাস। এ শুধু বেঁচে থাকা না, দিনের পর দিন একটা আবহমান বইয়ের পাতা উল্টাইয়্যা যাওয়া...

সাজ্জাদ অবাক হইয়া দেখিতে থাকে বিপ্রাকে। আজ ‘ওমেন’স ওয়ার্ল্ড’ হইতে চুল বাঁধিয়া আরো কত কি নখরা করিয়া যেন গিয়াছিল মেয়ে। এই রাজহংসীর মতো রূপবতীর কাছ হইতে তৌহিদুল শুধু চাহিয়া নিয়াছে একখানা চুলের কাঁটা। সে ময়ূরের পালক জমাইয়া থাকে। তাহারই ফাঁকে সে রাখিয়া দেবে এই অমূল্য সংগ্রহ।

সেই ‘ডলফিন’ বার, সেই টলটলে নীলাভ জল। ফের টেপ চালু করিতেই শোনা যায়- ‘...... তোমার পায়ের পাতায় একটি চুম্বনের আমার বড় সাধ অয় নন্দিনী। আইজকা না, যেদিন একটা ভালো কবিতা লেখতে পারবো , সেদিন তোমার পা দুইটা আমার বুকে লইতে দিবা-

.....................................

জলের আয়নাতে মুখ দেখা মেয়ে/ তোমাকে আমি বিস্মরণের চাঁদ দেখাবো/ তোমার নিটোল ঠোঁটের উপরে/

সাজিয়ে দাঁতের দাগ/ মুখের চোখের বিষন্নতা / ঢেকে দেব আমি । / কী ভালো তোমায় বাসি বুঝবে তবেই।/ তুচ্ছ এই অল্পে কেন ফুরিয়ে যাই আমি/ কেনবা অফুরন্ত হই না আকাশের মতো/ কেন আমি চাইলে তোমার মাথায় / পুষ্পবৃষ্টি ঝরে না অবিরত?/ প্রতিদিন পুষ্পবৃষ্টি হোক তোমার উপর / এই চাই বর/ সময় হয়েছে, শহরের দেওয়ালে ছবি এঁকে দিয়ে/ নাম দাও সুন্দর।

হাঃ, হাঃ হাঃ হ, সুন্দর যা কিছু বস্তু তা যেন সব চোখের সামনেই দেখতে পাই আমি। সে হইতে পারে নারী, মেঘ কিংবা এক উড়ন্ত পাখি, প্রথম সকালে সূর্যের রশ্নি, গাছেরছায়া বা কবিতার শেষ লাইন- সবই তো সুন্দর। এই যে তোমার আঙুলগুলো হাতে র্ধছি মনে হইতাছে এর মতো সুন্দর আর কিছু নাই। আর ওই শোনো, বাইরের কোকিলটা কামার্ত আহবানে কি সুন্দর ডাইকা উটল ‘কুউউউউউউউউউউউউ ’ কইরা ।.......

সাজ্জাদ স্থির হইয়া বসিয়া শোনে। শূণ্য গেলাস ভরিয়া দিয়া যায় বেয়ারা বা আর কেউ। সাজ্জাদের বুঝিয়া লইতে কষ্ট হইলো না, এই ছেলেটি জাতখ্যাপা। তবে তো উহাকে তাহার চাই-ই চাই। এখনই তাহাকে সন্ধি ও সাহিত্য র গোষ্ঠীভূক্ত করিতে না পারিলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা বসিয়া না থাকিয়া কব্জা করিয়া ফেলিবে অচিরেই। সম্মুখে তাহার গোটা জীবনই পড়িয়া। তাহার অন্য পত্রিকায় লেখার গুঢ়ার্থই হইল সন্ধি ও সাহিত্য র বারোটা বাজিয়া যাওয়া।

অর্থ। অর্থই একমাত্র ওষুধ উক্ত রোগের। সাজ্জাদের অভিজ্ঞতাও তাহাই বলে। সকলের না হইলেও সাজ্জাদ লক্ষ করিয়াছে কবি লেখকদের টাকার নেশা ধরাইতে পারিলে তাহাদের পাগলামিছাগলামি অনেকটাই ঘুঁচিয়া যায়। তখন তাহাদের আরো টাকা আরো আরও টাকা বায়ু তাহাদের চাপিয়া ধরিয়া তাহাদের পাগলামীসমূহকে গিলিয়া ফেলে। কী করিয়া তাহার বইখানার বিক্রি আরো বাড়িবে, উপন্যাস সিনেমার বা গল্প টিভি সিরিয়ালের অর্ডার পাইবে সেইসব চিন্তা তখন প্রবল হইয়া উঠিয়া হিমালয়ে চড়িতে থাকে। গল্পের প্লট ভাবিবার চাইতে লেখক তখন সেন্টমার্টিন কিংবা গাজীপুরে জমি কিনিয়া রাখিবার কথা ভাবেন বেশি করিয়া। কিংবা বউয়ের নামে আরও একখানা ফ্যাট কিংবা সস্তায় যদি ছোট বাড়ি পাওয়া যায় সাভার বা নারায়নগঞ্জে ঢাকার আশেপাশে  কোথাও- মাঝে মাঝে আউটিংএ যাইতে পারিলে মন্দ কি! 

এই চল্লিশ বছরে অনেক দেখিয়াছে সাজ্জাদ। এই সন্ধি ও সাহিত্য’র একতলায় যারা বসিয়া নাই সেই আহমেদ, গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, হোসেন রা- হাল আমলের বাংলা সাহিত্যের সেনাপতিবৃন্দ- প্রত্যেকেরই  এহেন ইতিবৃত্ত। প্রথমে পা দুখানি থাকে ধূলোয় ধূসর। নাটকের পরবর্তী অঙ্কেই মাথায় মুকূট নিজেই উঠিয়া পড়ে ঝলমলিয়ে। একটা সময়ে লিখিয়া লিখিয়া য় করিয়া ফেলা কলম, তাহারপর লেখার পূর্বেই শিরোনামের দেিণ হেলাভরিয়া শুধু নিজের স্ব-প্রদত্ত নামখানা লিখিয়া দেওয়া।

এদিকে বিপ্রা প্রায় মাতালের মতোন টেপ শুনিতেছে তো শুনিতেছেই। শুনিতেছে যেন মেঘ পাহাড়ের রাজপুত্রের স্বর। সে নাকি এমন আচানক যুবক কখনো দেখে নাই। তপ্ত কাঞ্চনের মতো তাহার রঙ। দেহের সমস্ত অঙ্গে যেন বৃষ্টিভেজা কৃষ্ণচূড়া ফুটিয়া আছে।  মাথায় অযত বর্ধিত চুল। মুখে শিশুর মতোন সারল্যমাখা একখানা অসংজ্ঞায়িত হাসি। তৌহিদুল ইসলাম কম লিখিয়া, দেখে বেশি। বলে যত কম, শোনে তাহার বহু গুণ। শুনিতে শুনিতে সাজ্জাদের মনে হয় সে যেন রক্তকরবীর রাজা। নন্দিনীর প্রাণ-ভোমরাখানি মুঠোয় না পুরিতে পারা পর্যন্ত তাহার যেন স্বস্তি নাই।

পরিকল্পনাটি আঁটিতে সময় লাগিয়াছিল দুইদিন। আজ তাহা বাস্তবে রূপ দিবার দিন। স্থান, কাল সকলি নির্দিষ্ট হইয়াছিল।  ঠিক পাঁচটা বাজিতেই ‘ওমেন্স ওয়ার্ল্ড’ এর সামনে থেকে বিপ্রা কে তুলিয়া লয় সাজ্জাদ। তার এক মাইল পর নিউমার্কেটের তিন নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপোর প্রহর গুণিতেছিল নয়ন। গাড়ি আসিয়া থামিল। সাজ্জাদ জিজ্ঞাসিল ‘সব ঠিক তো?’

-‘হ্যা’, নয়ন জবাব দিয়ে সামনের আসনে উঠিয়া পড়িল। কোলের উপর কালো চামড়ার থলেখানা চকচক করিয়া ওঠিল। পশ্চাৎআসন হইতে হাত বাড়াইল সাজ্জাদ। নয়ন থলেখানার মুখ খুলিয়া বাহির করিল একতাড়া নোট আর একখানা বিলাতি মিনার্ভার বোতল। দেখিয়া মনে হয় বাণ্ডিলখানা লাখখানেকের হইতে পারে।

-‘মিষ্টি?’

-‘এই যে।’

প্রথম দুইখানা ঢোলা পাঞ্জাবীর দুইপকেটে চলিয়া গেলে সাজ্জাদ কড়া পাঁকের মিষ্টির বাক্সটি কোলের উপর রাখিয়া চোখ বুজিয়া গাড়ির পিছনে হেলান দিল।  এ পথ ও পথ ঘুরিয়া গাড়ি যখন দশ নম্বরের একুশের সির সম্মুখে থামিয়া হর্ণ দেয় তখন পৃথিবীতে অন্ধকার নামিয়া আসিয়াছে।

 বেল টিপিতেই চাকর দরজা খুলিয়া দেয়। বড় বড় পা ফেলিয়া সবাই ভিতরে চলিয়া গেল। বৃদ্ধ কোলের উপর একখানা দৈনিকের পাতা খুলিয়া শব্দভেদ করিতেছিলেন। মুখ তুলিয়া হাসিলেন যেন কেল্লা ফতেহ করিয়া দিয়াছেন।

-‘আপনার জন্যে!’

মিষ্টির বাক্স রাখিলে বৃদ্ধের কোটরাগত চোখ চকচক করিয়া বাহির হইয়া আসে। অতঃপর ডান হস্তের তর্জনী তুলে বলিলেন- ‘তোমার  কপাল ভালো, আইজকা আছে ঘরে।’

সিঁড়ি ভাঙিতে কষ্ট হয় সাজ্জাদের। ডাক্তারের নিষেধও রহিয়াছে। তবু এ কষ্ট তাহাকে করিতেই হইবে। এরপর একুশের সিই আসিবে তাহার কাছে। তখন আর কষ্ট করিতে হইবে না। তখন সাজ্জাদ দেখিবে এই সিঁড়িভাঙা কষ্টের কি মহিমা!

চিলেকোঠার ঔ ঘর যেনো প্রস্তরযুগের গুহা। সামান্য আলো, অন্ধকারকে আরো তীব্র করিয়া তুলিয়াছে। দেওয়াল জুড়িয়া হাবিজাবি ছবি, মেঝেতে ছড়ানো বইপত্র, ছেঁড়া কাগজ, ভাস্কর্যের নিদর্শন। পোড়ামাটির পুতুল।

তারমধ্যে চৌকির উপর আকাশের দিকে মুখ করিয়া বজ্রাসনে বসিয়া তৌহিদুল ইসলাম, এক ধ্যানস্থ বুদ্ধ যেন।   

-‘এ যে ঘরেই আছো দেখছি, শুভ-অপরাহ্ন।’

-এ সময়টায়তো আমি ঘরেই থাকি’ তৌহিদুল হাসিলে যেন দিগন্তের দিগবলয়ে প্রথম সূর্যকিরণ আসিয়া পড়িল ,‘এই যে আকাশের আলো অল্প অল্প মুছে যাওয়া আর এক এক করে তারাদের ফুটে ওঠা- এ আমি রোজ বসে বসে দেখি এইখানে।’

সাজ্জাদ ভাবিয়াছিল ধাপে ধাপে আগাইবে। যতণ পারিবে ততণ মুখখানা হাড়িমুখ করিয়া রাখিবে। ঐখানাতে উঠতি লেখকেরা ভারী জব্দ হয়। কিন্তু তৌহিদুল ইসলামের নিকট তাহা সে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।

‘-অনেক আশা নিয়ে আমি এসেছি। বোধহয় জানো, গত একমাস ধরে তোমাকে গরুখোঁজা.....’

 তৌহিদুল এর চোখদুখানা সরল কিন্তু দৃষ্টি অতীব তীক্ষ্ণ। সে এককথায় মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করিয়া দিল। ‘কিন্তু কেন আপনি মিথ্যে হাঁটাহাঁটি করছেন বলুনতো?’

সাজ্জাদের মাথায় খুন উঠিয়া পড়ে। ছোকরা ভাবিয়াছে কি? সন্ধি ও সাহিত্য- র সম্পাদক স্বয়ং তাহার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে কি তাহা জানে না? সাহিত্যের সংসারে চন্দ্রসূর্য ওঠে যাহার কথায়-ঈশারায় তাহাকে এতোখানি হেনস্থা!

- ‘আমি অনেক ঘাটের জল খাওয়া মানুষ তৌহিদ, বুঝলে’, ধাপে ধাপে গলা চড়াইতে থাকেন সাজ্জাদ। , ‘আমাকে তুমি বোকা বানাবে, অত বুদ্ধি তোমার নাই।’ সামনে আসিয়া ঘাড় সোজা করিয়া গলার সুর পাল্টাইলেন সাজ্জাদ, ‘আমার কথা শোনো, তোমার ভাল হবে। এত বড় প্রতিষ্ঠান দেশে আর একটি নেই। তুমি যা চাও সব পাবে শুধু এই কথাটি লিখে দাও, এখন থেকে যা লিখবে তার সব কেবল আমার পত্রিকার জন্য-’

-‘লিখে দিতে পারি। কিন্তু সে কথা তো রাখা যাবে না,’কথা নয় যেন বন্দুকের গুলি বের হইয়া আসিল,‘ কেন না লেখা আমি ছেড়ে দিচ্ছি বরাবরের মতো-’

-‘তুমি লেখা ছেড়ে দিচ্ছ?’ সাজ্জাদ এমন আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন যে তিনচারখানা দমকল ছুটিয়া আসিলেও কেউ অবাক হইতো না।

- হ্যাঁ। এই যে’ সামনে চৌকির উপর পাঁচছয় পাতার একখানা পাণ্ডুলিপির উপর আগেই নজর পড়িয়াছিল, তৌহিদুল সেটার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল,‘ এই আমার ইহজীবনের শেষ লেখা। একটু আগে শেষ করা। আর তারপর থেকে লজ্জায় দুঃখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে।’ সাজ্জাদ যেন চাঁটগার কোন পাহাড়খাদে পড়িয়া যাইবার ভয়ে কিনারে দাঁড়াইয়া টাল সামলায়। ীণ স্বরে শুধাইল,‘ কেন? কেন?’

- কেন নয়?লিখে যত আনন্দ না লেখার সুখ যে তার চেয়ে অনেক বেশি। লেখা তো একটা আটপৌরে মেহনত, পাথরের বুকে অনবরত ছেনি দিয়ে ঘা মেরে যাওয়া। তবু তো যা দেখি, অনুভব করি, মস্তিষ্কে যে কম্পন রণিত হয় তাকে ফোটাতে পারি কই? মিথ্যে কান্ত বোধকরা, যে সময়টায় প্রাণহীন অরের ইমারত সাজাতে খরচ করে ফেলি, সে সময়টার মধ্যে সমুদ্রে কত ঢেউ নিঃশেষে মিলিয়ে যায়, কত তারা ঝিকমিক করে ওঠে, ডুবে যায় চাঁদ, হরিণেরা এক বন ছেড়ে চলে যায় অন্য বনে। কেন লিখব? ঈশ্বরের পৃথিবীর এত অজস্রতা। উপভোগ না করে কাগজ কলম নিয়ে মেরুদণ্ড বাঁকা করার কোনও মানে হয়? এই যে আমার শেষ লেখা।’ আঙুল দিয়া পুনরায় সেই সদ্যজাত পাণ্ডুলিপিখানা দেখাইল,‘ওকে নিজের হাতে হত্যা না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।’

সাজ্জাদ ঢোক গিলিল। ওরা দুজন রাস্তায় অপেক্ষা  করিতেছে। অপেক্ষা করিতেছে সন্ধি ও সাহিত্য  পত্রিকার অফিসেও অন্তত দুইজন কেষ্টুবিষ্টু। তাহাদেরও পিছনে দাঁড়াইয়া অসংখ্য পাঠক, দীর্ঘকাল সন্ধি ও সাহিত্য যাহাদের স্নেহে সমর্থনে পুষ্ট হইয়াছে, যাহারা চিরকাল আশা করিয়া থাকিয়াছে সন্ধি ও সাহিত্য  পরিবেশন করিবে সারস্বত সাধনার শ্রেষ্ঠতম ফসল। না, সাজ্জাদ হার মানিবে না। শেষ চেষ্টা তাহাকে করিতেই হইবে। ‘আমি বুঝেছি তোমার কি চাই, সাজ্জাদ গলা খাকারী দিয়া বোঝাইবার চরিত করিল,‘সব লেখকেরই দরকার হয় এ সবের।’ একে একে পকেট হইতে আনয়ন করা সামগ্রীগুলান বাহির করিয়া চৌকির উপর রাখিল,‘এগুলো আমার উপহার বলেই জেনো।’

 তৌহিদুল তাকাইয়া দেখিল অর্থ পানীয় ইত্যাদি। প্রথম আগুন দেখিয়া শিশু যে অপরিচিতি লইয়া তাকায় তৌহিদুলের চোখে সেই একইরকম বিস্ময়। বিড়বিড় করিয়া সে বলিল,‘ ভুল করেছেন, আপনি ভুল করেছেন। আমার কোনও অভাববোধ নেই,এটা আর এক সমস্যা আমাকে নিয়ে। আমি মার কাছ থেকে যে পয়সা পাই তাই আমি ফুরাতে পারিনা। রইল পানীয়। তা আমি তো আকণ্ঠ ডুবে সুন্দরকে দেখার নেশায় যে, যে রয়েছে  উড়ন্ত পাখির ঝাঁকে, প্রগলভা নারী নটভঙ্গিতে, ভিখিরি শিশুর দল যখন রাস্তার কলে স্নান করে, দেখেছেন? দেখেছেন তাদের উল্লাস?’

সাজ্জাদের কান মাথা ঝিম ঝিম করিয়া উঠিল। ঘরঘরে গলায় সে জানিতে চাহিল, ‘তবে তোমার লেখার প্রেরণা পাও তুমি কোথা হতে?’

‘ওই যে’ আনন্দে অধীর বালক যেমন বেলুনওয়ালার খুঁটিতে বাঁধা সবচেয়ে বড়, লাল বেলুনটা দেখায় তেমনই সহর্ষ প্রসন্নতায় তৌহিদুল দেখাইল আকাশ,‘সারাদিনে কত রূপ এর দেখে দেখে যেন শেষ করা যায় না। এখনই আলোয় ভাসা তো একটু পরেই মেঘ- মেঘে ধূসর। এবেলা কেবল নীলতো ও বেলা প্রজাপতি সাতরঙা, এই স্থির জলের হৃদ তো কিছু পরে অস্থির জলপ্রপাত। এই চিত্রপত্র ঈশ্বরের, সারাদিন তিনি এর উপর অজস্র মায়ারঙখেলা খেলে চলেছেন। ওই আমার অফুরন্ত প্রেরণার উৎস।’

টলিতে টলিতে নিচে নামিয়া আসিল সাজ্জাদ। সাজ্জাদ চৌধূরী। সম্পাদক সন্ধি ও সাহিত্য। বৈঠকখানা পাড় হইবার সময় পেছন হইতে বৃদ্ধের ডাক,‘কি কথা হইলো?’ কানে পৌঁছিলনা সাজ্জাদের। বাহিরে রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের তলায় গাড়ির সামনে বিপ্রা আর নয়ন, বাপে-বেটিতে দাঁড়াইয়াছিলো। সাজ্জাদ কাছে আসিতেই নয়ন শশব্যস্তে আগাইয়া আসিল,‘কৈ? সে কৈ?’ প্রত্যুত্তরে একটুখানি ঘুড়িয়া সাজ্জাদ আঙুল তুলিল উর্ধ্বপানে। চিলেকোঠার উপরে পাথরে কোঁদা কালো এক স্লেটমূর্তি আবিষ্কার করিল নয়ন। সেইখানে তৌহিদুল পাণ্ডুলিপি কুচি কুচি করিয়া ছিঁড়িয়া হাওয়ায় উড়াইয়া দিয়া দুইহাত শূণ্যে মেলিয়া দিয়া যেনো আকাশকে ডাকিতেছে, ‘নেমে এসো।’ খানিকক্ষণ বম মারিয়া দেখিল নয়ন। তার কিয়ৎণ পর সশব্দে নাক ঝাড়িয়া বলিয়া উঠিল, ‘শালা পাগল।’

-‘উহু!’, সাজ্জাদ যেনো অস্ফুটস্বরে শাসন করিয়া দিল নয়নের বেয়াদবি। একাগ্রদৃষ্টি মেলিয়া সেও তাকাইয়া রহিল উপরদিকে। উত্তরহস্তে বোতল, দণি হস্তে নোটের বাণ্ডিল, সাজ্জাদ বাড়াইয়া দিল তাহা দুইজনের দিকে। খপ্ করিয়া দুইখানাই বাগাইয়া লইল নয়ন। সাজ্জাদ যেনো এক মুক্তপুরুষ এখন, দুইহাত উপরে তুলিয়া ধরিয়া যেনো বলিতে চাহিল, ‘নেমে এসো’।

আকাশে মেঘ নাই। তবু শূণ্যে কোথায় যেন ঘনঘোর মাদল বাজিতেছে। ঝরঝর করিয়া নামিয়া আসিল বৃষ্টিধারার মতো ছেঁড়া পাণ্ডুলিপির কাগজ। রাস্তার লোকজন অবাক হইয়া দেখিল সেই দৃশ্য। বিপ্রার মুখের উপর আসিয়া পড়িল  সেই অজস্র কাগজের টুকরোর একখানি। বিপ্রা সঙ্গে সঙ্গে সেটি দুই হাতে ধরিয়া আলো-আঁধারির মধ্যে পড়িয়া ফেলিল। মুক্তোর মতো কয়েকটি অরে সেখানে লেখা রহিয়াছে, ‘আহ্! কী আনন্দ!’

আজ দুইজন পুরুষ ফিরিয়া যাইবে ঘরে তাহাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়বোঝা বহন করিয়া লইয়া। কিন্তু বিপ্রা জানে তাহার অভিসার অন্তত আজিকে বিফলে যায়নি। সকলকে লুকিয়ে একটি প্রগাঢ় চুম্বন সে আঁকিয়া দিল সেই পাণ্ডুলিপি খণ্ডের লেখাটুকুর উপর।

(*গুরুচণ্ডালীদোষ লেখক নিজেই বরিয়া লইয়াছেন।)

প্লাস মাইনাস গুনন ভাগ = জিরো

মহিউদ্দীন আহমেদ

কোটিপতি অধ্যাপকের লাখপতি ছাত্র।

না পাঠক! এটি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার কোনো গল্প নয়। তবে, হতে পারে পেট ফুলে মেদভুড়ি হওয়ার গল্প;হতে পারে জনসচেতনতামূলক গল্প কিংবা এ আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, হতে পারে নিরঙ্কুশ একটা প্রেমের গল্প।

ড. শামসুল পরামাণিক (ডাবল পিএইচডি, যথাক্রমে মেলবোর্ন ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে!)। তিনি একটি স্বায়ত্বশাসিত কাম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপুটে অধ্যাপক। একই সঙ্গে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

একজন মেধাবী এ্যাডভাইজার হিসেবে তাঁর পরিচিতি এখন পৃথিবীব্যাপী। সেবা সংস্থার হয়ে নানারকম কাজ করলেও এবার আশ্চর্যরকম একটা রিসার্চের কাজ পেয়েছেন। প্রথম দফায় কাজটা করবেন কী করবেন না-এই দোটানায় ভুগলেও অগণিত টাকার অফার তিনি পায়ে ঠেলতে পারেননি। কাজটা দিয়েছে বিশ্বের সব চেয়ে বড় সিগারেট কোম্পানি। অনেকটা কাটা দিয়ে কাটা তোলার মতো কাজ। এই নিয়ে তিনি ভীষণ উত্তেজিত। সুতরাং প্ল্যানটাকে ঝালাই করার জন্য একটা লং ড্রাইভে না-গেলেই নয়। লং ড্রাইভে গেলে তাঁর মাথাটা খোলে ভালো। এবার ভাবছেন একমাত্র কন্যা শিলাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ও থাকলে ভালো জমে। যমুনা ব্রিজ, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির বাণিজ্যিক ভার্সনের ইতিহাস ইদানীং তাঁর প্ল্যানে বড় ভূমিকা রাখে। ফলে লং ড্রাইভের সঙ্গে এগুলোর সুব্যবস্থাও করতে হবে।

আর থাকবে তাজ। ইমতিয়াজ আহমেদ তাজ। তাঁর ছাত্র। শিল্প-সংস্কৃতির সকল শাখায় যার উলেখ করবার মতো পদচারণা। যে-কারণে বয়সের বিশাল ব্যবধান সত্ত্বেও ড. পরামাণিক তাকে বন্ধু করে নিয়েছেন। ডিপার্টমেন্ট, চায়ের দোকান কিংবা বৈকালিক ভ্রমণে সবসময় তার সঙ্গী হাঁটুর বয়সী এই তরুণ। তাদের সম্পর্ক এখন এমন এক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে, ড. পরামাণিক তাই করেন, যাতে তাজের সমর্থন আছে। শুধু এখানেই শেষ নয়। তাঁর বিশাল লাইব্রেরিটা পর্যন্ত তাজের দখলে। বাকি শুধু একজন। তাকে দখল করতে পারলে তাজের পুরোপুরি পোয়াবারো পূর্ণ হবে। সে-ই একজন আর কেউ নয়-অধ্যাপক কন্যা শিলা। স্বভাবে চটুল, দুরন্তপনায় এক নম্বর, আর সবচেয়ে যা উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছে সে একজন উঁচু মাপের সংগীত শিল্পী। তার সঙ্গে ইদানীং তাজের প্রায়শই সংপ্তি বাক্য বিনিময় হচ্ছে।

যাইহোক পাঠক! মূল গল্প আসলে এটা নয়।

অধ্যাপক পরামাণিক অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন,বড় লোক হয়েছেন। খোদ ক্যাম্পাসে তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। কিন্তু তিনি অনড়। কারো কথা কখনো তিনি কর্ণপাত করেন না। মন থেকে যা বিশ্বাস করেন, তাই করেন। ফলে তিনি সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙে এখন একটা স্থায়ী সিঁড়িতে পা রাখতে সমর্থ হয়েছেন। বিদেশি সেবা সংস্থাগুলো গরিব দেশটাতে টাকা ছাড়ার আগে অবশ্যই একবার তাঁর সঙ্গে সলাপরামর্শ করে নেয়। এই সেবা সংস্থাগুলোই তাঁর শক্তি; এরাই তাঁর সম্পদ!

তিনি বড় হয়েছেন অজপাড়া গাঁয়ে। সরকারি অফিসের কেরানি বাবার টানাপোড়েনের সংসারে। অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে। সে-কারণে হাড় ঝিরঝিরে শরীর নিয়ে তাঁকে বড় হতে হয়েছে। মধ্য বয়স পর্যন্ত তাঁর শরীর টিঙটিঙেই ছিলো। কিন্ত বছর দশেক হলো তার শরীরে মাংস লাগতে শুরু করেছে। এখন তিনি অনেক বড় ভুড়ির মালিক। কোনোভাবেই কোমরে এখন আর প্যান্ট আটকে রাখা যায় না। তাই কোটিপতি অন্য এক বন্ধুর পরামর্শে প্যান্টের সঙ্গে বেল্ট জুড়ে দিয়েছেন। সেই বেল্টের ফিতা কাঁধের সঙ্গে সর্বদা লেপ্টে থাকে। আরো বলতে কী, এই বেল্ট তাঁকে অনেকখানি স্মার্টও করে তুলেছে!

ডিপার্টমেন্টে ডুমুরের ফুলের মতো তার উপস্থিতি সত্ত্বেও এ-নিয়ে ছাত্র-ছাত্রী কিংবা সহকর্মী কেউই তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট নয়। কারণ বছরের পুরোটা সময় তাদেরকে তিনি ব্যস্ত রাখেন নানারকম জরিপের কাজে। আর এসব জরিপে তারা খুচরা পয়সা যা পায়, তা তাদের জন্য মোটামুটি মোটা অঙ্কের টাকা।

তাজও ছিল এসব সাধারণ ছাত্রের দলে। কিন্তু তার কর্মদতা এবং গরিব মানুষ সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূল্যায়ন তাকে আজ নিয়ে গেছে উচ্চ পর্যায়ে। ফলে সে অধ্যাপক পরামাণিকের ডান হাত, বাম হাত। ফলে এরই মধ্যে তাজ একখানি ফাটের মালিক বনে গেছে। চু লজ্জার ভয়ে গাড়িটা তার কেনা হচ্ছে না। এখন তার পুরো ঝোঁকটা শুধুই শিলার দিকে। বড়শি ফেলে চণ্ডিদাস হয়ে বসে আছে। শিলা তার আধার গেলামাত্র সে একটা গাড়ি কিনে ফেলবে।

যখন তাজ পড়ার নাম করে অধ্যাপকের লাইব্রেরিতে সময় কাটায় তখন মাঝে মধ্যে শিলা পুব বারান্দায় এসে খোলা চুলে দাঁড়ায়। তখন রাজ্যের মাধবীলতার গন্ধ এসে তার নাকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। একেবারে দিশেহারা অবস্থা! হাতের কাছেই স্বর্গের চাবি। কিন্তু তালা খোলার অনুমতি নেই। মনে মনে ভাবে, আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই তালাও তার, চাবিও!

খুবই দুঃখিত পাঠক!

গল্পটা বারবার শুধু শিলার দিকেই চলে যেতে চাইছে। শত লাগাম টেনেও থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। কী আর করা! পড়ন্ত বিকেলে অমন এলো চুলের মাতাল গন্ধে কে স্থির থাকতে পারে বলুন? দেবতা হলে কথা ছিল। কিন্তু ইমতিয়াজ আহমেদ তাজ কিংবা স্বয়ং গল্পকারও যে মানুষ!

এমন মোহময় ললনাকে রেখে অন্য গল্পে যাওয়া সত্যিই কঠিন কাজ। শিলা যখন গান ধরে, ‘আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি সেথায় চরণ পড়ে তোমার সেথায় চরণ পড়ে।’Ñতখন কী অন্য জগতের চিন্তা করা সম্ভব? তাজও তাই পণ করেছে শিলার হৃদয়ের সেই পথে হাঁটবে। কিংবা যখন লং ড্রাইভে বাবার পাশে বসে শিলা উদাস মনে গান শুনতে শুনতে প্রকৃতি দেখে, তখন কার এতোবড় বুকের পাটা যে, করোটির ভেতর তোলপাড় শুরু হবে না? 

এবার আসল কথাটা বলি। রিসার্চর কাজটি হচ্ছে ধুমপান বিষয়ক। ধূমপান কীভাবে নির্মূল করা যায় তা নিয়েই গবেষণা করতে হবে। পৃথিবীর সব চেয়ে বড় সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এর উদ্যোক্তা।

কী পাঠক! বিষয়টা হাস্যকর মনে হচ্ছে? হাস্যকর হলেও সত্য। বছর দুয়েক আগে এই প্রজেক্টটা পেয়েছিল সরকার। মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে সরকারি আমলারা গবেষণার দায়িত্ব দিয়েছিল তারকা খচিত কিছু ইন্টেলেকচুয়ালের হাতে। সেই তালিকায় ছিলেন একজন স্বঘোষিত পরিবেশবিদ, একজন তোতলা মনোবিজ্ঞানী, একজন ঘুষখোর ইঞ্জিনিয়ার, (এই তালিকায় সাহিত্যিকদের থাকবার কথা ছিলো, কিন্তু সঙ্গত কারণেই তাদেরকে রাখা হয়নি) একজন তোষামদকারী সচিব এবং একজন এনজিও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন (ইনি খুবই সুন্দরী মহিলা! মন্ত্রীদেরর সঙ্গে তার প্রেম ঘটিত কয়েকটি স্ক্যান্ডাল আছে)। তিন মাস পরে তারা যে রিপোর্ট পেশ করেছে তা আর কোম্পানি পর্যন্ত পৌছতে পারেনি। কারণ তারা রিপোর্ট দিয়েছিলো ধূমপানে মারাত্মক কোনো নেশা হয় না বিধায় ইহা নির্মূল করার কোনো প্রয়োজন নাই। ইহা মনকে চাঙ্গা করে এবং মেজাজকে খিটখিটে হওয়া থেকে সাহায্য করে। সর্র্বোপরি একজন মানুষকে কাজে মনোনিবেশ করতে ধূমপানের কোনো বিকল্প নাই। এইসব কারণে আমরা সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ধূমপান বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নাই। কেননা ইহা বন্ধ করতে গেলে এর মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উলিখিত সচিবকে তিন মাসের জন্য চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করলেও আমাদের প্রিয় কোম্পানি দারুণ খুশি হয়েছিল!

তবে আশা করা যাচ্ছে, এবার ভালো একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে। তাজ ফিল্ডওয়ার্কের মাধ্যমে এ ব্যাপারে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছে। ড. পরামাণিকও অনেকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন। দুএকদিনের মধ্যেই সব উপাত্ত নিয়ে ছাত্র-শিক বসবেন।

এরই মধ্যে শিলার জড়তা অনেকখানি কেটে গেছে। সে এখন তাজের সঙ্গে ফ্রাঙ্কলি কথা বলে। এমনকি এই ধূমপান বিরোধী কার্যক্রমেও তার অনেক অবদান আছে।

তাজ এই প্রজেক্টের জন্য সারা দেশব্যাপী ফিল্ডওয়ার্ক করেছে। ফিল্ডওয়ার্ক করে ধূমপান বিষয়ে বেশ কিছু গল্পও সংগ্রহ করেছে। সেইসব গল্প থেকে একটা গল্প শুনিয়েছে শিলাকে। 

গ্রামের এক বৃদ্ধের গল্প। সেই বৃদ্ধের ছেলেটি ঢাকায় চাকরি করত। অল্প বেতনের চাকরি। তার ছিল কষ্ঠ-কাঠিন্য রোগ। অনেক ডাক্তার দেখিয়েও রোগটা কোনোভাবে সারছে না। বৃদ্ধ বাবা শোনাশুন ছেলের এই রোগের কথা শুনে ত্বরিৎ ঢাকা চলে এলো। ব্যাগ থেকে বের করে দিলো একটা বিড়ি। তারপর কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল, ‘শরম করিস ন্যা। এই জিনিস খাইলেই তোর ব্যারাম ভালো হইয়্যা যাইবো।’

শিলা উৎসাহী হয়ে বলে, ‘তো তার প্রবলেম সলভ হয়েছিল?’ 

তাজ বলে, ‘হ্যাঁ।’

শুনে শিলা হেসে মরে। বলে, ‘ইন্টারেস্টিং তো!’

যাইহোক। এক চাঁদনী রাতে তারা বসলো সব নথিপত্র নিয়ে। কীভাবে ধূমপান বন্ধ করা যায়? একটা উপায় বের করতেই হবে। না-পারলে হাত ছাড়া হয়ে যাবে অনেকগুলো টাকা। চিন্তা করতে করতে রাত বাড়ে কিন্তু সঠিক কোনো উপায় তারা আর পায় না। বার কয়েক চা পরিবেশন করে শিলা। এতে তাজের বেশ ভালোলাগে। কেননা শিলা এলেই তাজ চাঙ্গা হতে পারে। সে চলে গেলে তাজকে ঘুমে পায়, চোখের পাতা ভারি হয়ে যায়।  

অবশেষে খুব শক্তিশালী একটা উপায় পাওয়া গেল যখন অধ্যাপক পরামাণিক পকেট থেকে বেনসন এ্যান্ড হ্যাজেজের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট নিজে ধরালেন এবং তাঁর ছাত্রকেও একটা দিলেন (তাজ এই প্রথম তার শিকের কাছ থেকে সিগারেট পেল!)!

সুপ্রিয় পাঠক! তাদের উদ্ভাবিত উপায়টা গল্পকার এখনো জানতে পারেনি। কেননা গবেষণালব্ধ ফলাফল তারা জমা দিয়েছে কোম্পানির হাতে। আর কোম্পানি সেটা পেয়ে একেবারে গুম করে ফেলেছে। তবে আশার কথা, ঐ কোম্পানি আগামী বছর আরো নির্ভরশীল কিছু মানুষের কাছে একই গবেষণার ভার অর্পণ করবে।

আগ্রহী হলে আপনিও ট্রাই করে দেখতে পারেন! 

mohiuddin_neil@yahoo.com

দূরের মানুষ : দূরের মানুষ

এস, এম, তাহমিদুর রহমান

ঠিক বারটা দশ মিনিটে হাসানের মাথায় বজ্রপাত হল। বজ্রপাতে তার শরীরের মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ার কথা কিন্তু তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সে ঢাকা থেকে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বাসে করে রওনা হয়েছিল এগারটা বিশ মিনিটে। কুমিল্লা এখনো এগার কিমি মত বাকি। এরই মধ্যে বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এটাই বাসের শেষ টিপ। তারপর অহনাকে সাথে নিয়ে আজ ঘুরতে গিয়ে টিউশানির সব টাকা শেষ করে ফেলেছে সে। পকেটে মাত্র এগার টাকা। অটোরিক্সায় করে যাওয়ারও রাস্তা বন্ধ। ভেবেছিল বাসে করে কুমিল্লা পৌঁছুতে পারলেই মেসে যাওয়া নিয়ে কোন চিন্তা নেই। তাই হাসানের মাথায় বজ্রপাত ছাড়া আর কি পড়তে পারে?

    বাস থেকে নামতেই বৃষ্টির পানির ফোঁটা তার সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। একে তো শীতের রাত তারপর আবার বৃষ্টি। ঠান্ডায় অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছে।

    আশে পাশে একটা পেট্রোল পাম্প স্টেশন ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লোকজন দৌঁড় দিয়ে সেখানেই ভীড় জমাচ্ছে। লোকজন বলতে জনা দশেক। শেষ টিপ বলে লোকজনও তেমন নেই। মাথায় বৃষ্টির পানি মুছতে মুছতে বেশিরভাগই বাসওয়ালাকে গালাগাল দিচ্ছে। মনেহয় বৃষ্টিটাই ড্রাইভার আর হেল্পারকে মারের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

    হাসান চুপচাপ ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক বাস নষ্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত দিনটা খুব ভাল ছিল। আজ সে আর অহনা সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে। হাসানের শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট হওয়া বাকি। আর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অহনা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হাসানের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে।

    সকালে বেশ রোদ ছিল। রোদ চশমা পড়ে অহনা যখন হাসানের সামনে এসে দাড়াল তখন নটা বেজে কুড়ি মিনিট। ঢাকা শহরে এটাই সকাল। হাসান ইতিমধ্যেই অস্থির হয়ে পড়েছিল। মনে মনে স্থির করছিল, অহনাকে আজ বুঝাবে অপেক্ষা করতে কেমন লাগে? তার কিছু পরে ও যখন অহনাকে আসতে দেখল তখন এসব বেমালুম ভুলে গেল। যাদের ভালবাসার মানুষ আছে তারা খুব সহজেই অনুভব করতে পারবেন হাসানের অনুভূতি।

    - সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল। তুমি এত সকালে বাসে উঠবে আমি ভাবিনি। রাগ করো না লক্ষীটি। অ্যাই এ্যাম ভেরি ভেরি সরি।

    অহনা এসেই হাসানকে বলে। হাসান উত্তর না দিয়ে গোমড়া মুখে তাকিয়ে থাকে। এবার অহনাও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

    - সরি, বললাম তো।

    হাসান এবার উত্তরে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে দেয়। অহনাও হাসে। আজ ওরা একসাথে রিক্সায় ঘুরবে।

    - কোথায় যাবে হাসান? কিছু ঠিক করেছ?

    - আমি তো ভাবলাম তুমি ঠিক করবে। হাজার হলেও তোমার ঢাকা।

    - আমার ঢাকা?

    - নাতো কি? তুমি ঢাকার বাসিন্দা। আমি দূরের মানুষ। সেই কুমিল্লার।

    - ছাই কুমিল্লার। কুমিল্লা আর ঢাকা তো একই।

    - জ্বী না ম্যাডাম। যাহা চমচম তাহা রসগোল্লা নয়।

    - তার মানে ঢাকা রসগোল্লা?

    - এই দেখ তুমি রেগে যাচ্ছ। এই জন্যে বললাম তোমার ঢাকা।

    - মোটেও আমি রাগি নাই।

    - হে হে……

    - ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে হাসবে না।

    - হা হা ……আমি হে হে হা হা করে হেসেছি। মানুষ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে, হাসে না।

    - ঐ হলো।

    ঠিক এসময় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে রিক্সা যাচ্ছিল। অহনা রিক্সাওয়ালাকে থামতে বলে। হাসান অবাক হয়ে বলে,

    - এখানে কি?

    - নাস্তা করবে চল।

    - আমি নাস্তা করিনি তোমাকে কে বলল?

    - কে আবার বলবে? আমি তোমাকে চিনি না? পাঁচ বছর ধরে আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছ।

    হাসান এবার দাঁত বের করে হাসে। বলে,

    - এটা বিয়ের পরের ডায়লোগ হয়ে গেল না।

    - আমার দূর্ভাগ্য বিয়ের আগেই বিয়ের পরের অবস্থা। চল তাড়াতাড়ি।

    - যা হুকুম ম্যাডাম।

    বৃষ্টির মাদল আরো বেড়েছে। হাসান অনেকটাই ভিজে গিয়েছে। তবু বৃষ্টির দিকে তেমন মনোযোগ নেই। অহনা যে কিভাবে ওকে এত সহজে বুঝতে পারে, ভাবে হাসান। ও কি অহনাকে বুঝতে পারে? মনে হয় পারে না। ও সারাজীবন যে মেয়েগুলোর সাথে মিশেছে অহনা তাদের মত নয়। একটু অন্যরকম। সে সকালে নাস্তা না করে দেখা করতে গেলে অহনা ঠিকই বুঝে ফেলে। সকালের নাস্তার কথা মনে হতে হাসান বুঝতে পারে, তার খিদে লেগেছে। রাত্রে মেসে খাবে বলে রাতের খাবার খাওয়া হয়নি।

    লোকজনের মধ্যে একজন পুলিশ দেখে আজকের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ও আর অহনা নাস্তা করেই পল্টনের দিকে ঘুরতে বের হয়েছিল। ওরা জানত না যে ওখানে আজ এক রাজনৈতিক দলের জনসভা। ওদেরকে দেখে হঠাৎই কোথা থেকে যেন র‌্যাব এসে হাজির। সোজা দুজনকে র‍্যাবের ভ্যানে গিয়ে তুলল। তারপর আধঘন্টা ধরে চলল জিজ্ঞাসাবাদ। হাসান খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অহনা একদম ভয় পাইনি। একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। তারপর আধঘন্টা পর শাহবাগের মোড়ে ছেড়ে দিয়েছে।

    শীতের কাঁপুনিতে হাসান বাস্তবে ফিরে আসে। রাত সাড়ে বারটা বাজে। একে একে সবাই চলে গিয়েছে। কিন্তু হাসান কি করবে বুঝতে পারে না। পেট্রোল পাম্প স্টেশনের ক্যাশে বসে থাকা লোকটির যেন একটু দয়া হল। তিনি হাসানকে বললেন,

    - ভাই আজকের রাতটা আমার এখানেই কাটিয়ে দিন। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

    হাসানের মন তাতে সাঁই দিল না। সে বলল,

    - না ভাই। আমি ঠিক চলে যাব।

    এটা বলেই বৃষ্টির মধ্যেই হাসান পায়ে হেঁটে রওনা দিয়ে দিল। মনে মনে বলল, ভালবাসার জয় হোক।

বলধা গার্ডেন কিংবা এক বলদের গল্প

এহসানুল ইয়াছিন

আমাকে পরিচিতজনরা গোয়ার হিসেবেই জানে। একটি ঘটনার বিবরণ দিলেই বুঝতে পারবেন আমি কেমন প্রকৃতির মানুষ। ঢাকা শহরে আছি প্রায় ৮ বছর। কোনো দিন যাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা শিশুপার্কে যাইনি। গ্রামের বাড়ি থেকে একমাত্র আদরের ভাগ্নি মাইসা বাসায় বেড়াতে এলে সে আমাকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে যাবার বায়না ধরে। সাধারণত তার কোন আবদার ফিরিয়ে দেই না। কিন্তু আদর্শগত কারণে কিছু আবদার আজকাল রা করতে পারি না । তখন নানা অজুহাতে নিজেকে ব্যস্ত দেখাই। যেমন একদিন সে বায়না ধরেছে যাদুঘরে যাবে। আমি যাইনি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পাঠিয়েছি। আপনারা হয়তো ভাবছেন কেন যাইনি। এবার আসল কারণটা বলি- প্রত্যেক বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যেখানে আমার সঙ্গে অমিল সেখানে আমি পারতপে পা মাড়াই না। যেমন যাদুঘর, চিড়িয়াখানা কিংবা শিশুপার্ক নিয়ে আমার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এ নিয়ে পরিচিত মহলের লোকজন হাসাহাসি করলেও  তোয়াক্কা করি না। কারণ যাদুঘরে যেতে টিকেট লাগবে কেন? এর ভিতরে যে সব জিনিস প্রদর্শন করা হচ্ছে তা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এগুলো পূর্ব পুরুষের সম্পদ। আমরা যে জাতি হিসেবে অচ্ছুত নই। কিংবা আমাদের যে গৌরবের ইতিহাস আছে এটা আমাদের সন্তান বা আগামী প্রজন্মকে টাকা খরচ করে দেখাতে হবে কেন? বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি কী টাকা দিয়ে ভোগ করি? এখানে যেতে টাকা লাগবে কেন? এগুলো কিসের আলামত? আমাদের সন্তানদেরকে ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার? নাকি মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে সবখানে বাণিজ্য চালু করার নতুন কৌশল। বন্ধুরা এ নিয়ে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে। তাদের বক্তব্য সরকারের এতবড় অর্থনীতি নেই যে, সব জায়গায় ভূর্তুকি দেবে। টিকেটের টাকায় যদি ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? আমি তর্কজুড়ে দেই, টাকাটা আপাতত বেশি মনে হচ্ছে না, কিন্তু টিকেট নেয়ার রীতি যখন চালু হয়েছে তা একদিন যে বাড়তে বাড়তে অনেক বেশি হবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? আর এখন যে টাকায় টিকেট বিক্রি হচ্ছে তা কেনার সামর্থ্য কী সবার আছে? রাস্তায় যে মেয়েটা ফুল কুড়িয়ে মালা তৈরি করে ভদ্দননোকের কাছে বিক্রি করে সে কী একটা টিকেট কেনার সামর্থ রাখে? নিশ্চিত রাখে না। কিন্তু এগুলোর ওপর কী তার কোনো অধিকার নেই? আছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যে অন্ধ হয়ে গেছি।  বন্ধুরা এ ধারণাকে গোয়ার্তুমি মনে করে। গোয়ারকে যে বুঝানো যায় না এটা ধরে নিয়ে তারা কোনো কথা বলে না।

এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বর্ষা। সে আমার এই আদর্শে বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে এবং  কখনো এ বিষয়ে তর্ক জুড়ে বসে না। শিশুপার্ক নিয়ে আমার মতবাদটা নিজস্ব পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্য হলেও তারা নিরূপায় হয়ে তাদের বাচ্চাদের পার্কে ঘুরতে নিয়ে যায়। আমার সোজা কথা, আমরা এ শহরটাকে শিশুদের অনুপযোগী করে তুলেছি। অথচ জন্মের পর একটা শিশু প্রকৃতির আলো-ছায়ার মধ্যে বড় হওয়ার অধিকার রাখে। আমরা সে অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেছি। এখন যে দু‘একটা কৃত্রিম পার্ক তাদের জন্য তৈরি করেছি সেটা অপ্রতুল হলেও ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের সেখানে ফ্রি ঢুকতে দিতে হবে। আমার এসব ভাবনা নিয়ে বন্ধুরা নানা সময় হাসি ঠাট্টা করলেও শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। প্রকাশ্যে গোপনে বলাবলি করে আমি নাকি ছোটখাটো একজন  চিন্তাবিদ। আর মাঝে মধ্যে দু‘চার লাইন লেখা কোনো খবরের কাগজ কিংবা স্মরণিকায় প্রকাশ পেলে তো কথাই নেই। 

আজকাল এসব বিষয় মাথায় কেবল গরুর জাবর কাটার মতো ঘুরপাক খায়। অফিসের কেরানিগিরী করতে গিয়েও মাঝে মধ্যে মাথা বিগড়ে যায়। সব সময় যে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি এমন নয়। তবে বেশির ভাগ সময় ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করি। যদিও কষ্ট হয় তারপরও করি, বর্ষার জন্য। কেন চেষ্টা করি সে বিষয়টি না বললে আপনারা আমাকে ভুল বুঝবেন। ভাববেন আমি বুঝি বর্ষাকে যমের মতো ভয় পাই। বিষয়টি এমন নয়। তারপরও ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলি। আমি সবেমাত্র বর্ষাকে বিয়ে করেছি। সম্ভবত বিয়ের ২/১ বছর পার হয়েছে। মতিঝিলে একটা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদনার কাজ করি। সারাদিন গতর খেটে দম ফেলার জো নেই। প্রশ্নোত্তর তৈরি করা থেকে শুরু করে সব কাজই করতে হয়। কিন্তু বইয়ে আমার নাম যায় না। নাম যায় বেসরকারি কোনো এক কলেজ শিকের। ঐ অথর্ব লোকটা একটা লাইনও লেখে না। এ নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ আছে। আমি চাই আমার নামটা সম্পাদক হিসেবে না যাক অন্তত সম্পাদনা সহকারি হিসেবে থাকুক। কারণ এতে করে চাকরি বদলের একটা সুবিধা হবে। কিন্তু মালিক প এ কাজ করতে রাজি নয়। একদিন এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া বেধে গেল। এক পর্যায়ে বলে উঠলো- আরে ভাই, আপনি বলদের মতো কথা বলছেন কেন? আপনি কোথাকার কে? আপনাকে কি কেউ চেনে? আপনার নাম ছাপিয়ে আমি কী ব্যবসা লাটে উঠাবো? আমার মাথা বিগড়ে গেল। শালা বলে কী। সারাদিন কুলোর বলদের মতো কাজ করি। তাও আবার মাস শেষে ঠিক সময়ে বেতন পাই না। সে কিনা বলে এ কথা। আমার নাম দিলে নাকি ব্যবসা লাটে উঠবে। এখন কার কাজ দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। সেদিন রাগে দুঃখে অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে আসি। আর কোনো দিন ঐ অফিসের পথ মাড়াইনি। আমার দুঃখের কথা শুনে বর্ষা অনেক কষ্ট পেয়েছিল। বললো দরকার নেই এ চাকরির। তুমি চলে এসে ভালো করেছ।

বর্ষার কথা শুনে একটু ভরসা পেলাম। কিন্তু মাস শেষে টের পেলাম চাকরি কি জিনিস! সংসারে টানাটানি। সকালে, বিকালে, সময়ে অসময়ে বাড়িওয়ালা এসে ভাড়ার জন্য তাগাদা দেয়। মাথা নিচু করে বাড়িওয়ালার কথা শুনি। কিছুই করার নেই। প্রতিদিন আধপেটে বাসা থেকে বের হয়। আর কাজ খুঁজি। কিন্তু কাজ কোথায়? সবখানে হাহাকার। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পত্রিকা স্টলে পত্রিকা কেনার ভান করে পাতা উল্টায়। উদ্দেশ্য কোথাও চাকরির বিজ্ঞাপন দেখা যায় কি না। কোনো সম্ভাবনা দেখি না। চোখে পড়ে বিশ্ব মন্দার খবর। তবে কোথায় যাবো? কি করবো? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। এরমধ্যে দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। মতায় আসলো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। চারদিকে ধরপাকড়। প্রতিদিনই চমকপ্রদ খবর আসছে। মানুষ বলাবলি করছে ব্যক্তিগত আক্রোশও নাকি অনেকে এই সুযোগে মেটাচ্ছে। অবশ্যই প্রকাশ্যে নয়। সবই চলছে কানাঘুষার মধ্য দিয়ে। পত্রিকা আর টেলিভিশনে দেশ প্রেমের গান আর দুর্নীতির বিরোদ্ধে জনমত গঠন করার জন্য  সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিরা হেলিকপ্টারে করে সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছে। চারদিকে এই নিয়ে হাসাহাসি, তবে গোপনে। আমি আরো অস্থির হয়ে উঠি। একে তো চাকরি নেই অন্যদিকে দেশের এই অবস্থা। আপনাদেরকে সে দিনগুলোর প্রকৃত অবস্থা বুঝানোর জন্য একটি ঘটনার কথা বলি। তাহলে বুঝতে পারবেন দেশ কোথায় যাচ্ছিল? আমার এক বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। বেশ কয়েক মাস দুজনের মুখোমুখি দেখা কিংবা কথা বলাবলি নেই। শেষে আমাদের কয়েকজনের মধ্যস্থতায় সম্পর্কটা একটু শিথিল হয়। তবে প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে নয়। বলা চলে এক ধরনের বন্ধুত্ব। আচ্ছা বলুন তো সম্পর্ক কী কখনো বলে কয়ে এক জায়গায় স্থির থাকে? তার ওপর আবার দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক। ফলে  মোবাইলে কথা চালাচালি হলেও ফাকে ফাকে প্রেম বা বিয়ে সংক্রান্ত কথা প্রায়ই উঠতো। কিন্তু বিপত্তি যত ওখানেই। এ বিষয়ে কথা উঠলেই প্রেমিকা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো। একদিন সে ফোনে প্রেমিকাকে জিজ্ঞেস করছে কী করছো?

সে বললো কী করছি এ কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?

তোমার সঙ্গে জরুরি অবস্থা চলছে যে

মানে?

মানে সোজা। তোমাকে যদি প্রেম বা বিয়ের কথা বলি তাহলে ফোনটা রেখে দেবে। এ জন্য কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

তাদের ফোনালাপ শুনার পর আমি হাসতে হাসতে একাকার। জরুরি অবস্থা চললে এ দেশের  কী অবস্থা হয় তা আমার মতো আপনারা অনেকেও হয়তো দেখছেন। মিডিয়া পাড়ায় কোনো খবর নেই। পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্য আম কাঠালের গুণাগুন আর নায়ক নায়িকাদের বুক পাছার মাপের খবর ছাপছে প্রতিনিয়ত। আর সুশীলের উল্লাস দেখলে তো লজ্জায় মাথা হেড হয়ে যাওয়ার অবস্থা। জেলা উপজেলায় সাদা মনের মানুষের খোঁজে সবাই ব্যস্ত। রাজনীতিবিদরা যেন অচ্ছুত!

একদিন পত্রিকায় দেখি সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ গণতন্ত্রের নতুন শিক্ষা দিচ্ছেন জনগণকে। আমি তো হতবাক! এটা কোন ধরনের কথা। সরকারি চাকরি করে রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে মত দেয়া!  অন্যদিকে জনগণকে আশস্ত করছেন এই বলে, সেনাবাহিনীর মতা দখলের কোনো ইচ্ছা নেই। মাথা বিগড়ে গেল। কিন্তু কি আর করার। আমার মতো বেকার লোকের মেজাজে ওদের কি আসে যায়? বাসায় ফিরে বর্ষার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বললে দেখি, আজকাল ও আমার কথার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। বলে- আদার বেপারির জাহাজের খবর না নিলে হয় না। আমি খুব আহত বোধ করি। ভেতরে কান্নার স্রোতধারা বইতে থাকে। বেকার বলে দেশ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে পারবো না। দু‘চোখ জলে ভিজে আসে। আমার এ অবস্থা দেখে সেও কাদতে শুরু করে। এমন অসহায় মূহুর্তে আমি হঠ্যাৎ করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি।

ভেঙ্গে পড়লে চলবে? একটা না একটা ব্যবস্থা তো হবে। সময়টা খারাপ। দেখছো না, ভয়ে কেউ কিছু করতে চাচ্ছে না।

সেদিন সে বললো- তোমাকে একটা কথা বলবো, রাখবে?

বললাম বলো- চেষ্টা করবো।

না, আগে কথা দাও রাখবে।

রাখবো।

এরপর থেকে যেখানে চাকরি করবে অন্তত মাথাটা ঠাণ্ডা রেখো। দেখছো না চাকরি নেই বলে চারদিকের মানুষের কথা শুনতে হচ্ছে। এত অপমান সহ্য করার চেয়ে একটা জায়গায় অপমানিত হওয়া ভাল না।

আমি আর কোনো কথা বলি না। নিজের সঙ্গে মনে মনে যুদ্ধ করি। আদর্শ ব্যক্তিত্ববোধ এসবের কি কোনো মূল্য নেই। আমরা কি এভাবে জিম্মি হয়ে পড়বো কর্পোরেটদের কাছে? মনের ভেতর যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত দানা বাধে। চোখের সামনে ভাসে বর্ষার চেহেরাটা। ভাবি যদি আমার আদর্শ এক জায়গায় জলাঞ্জলি দিয়ে চারদিক সামাল দেয়া যায় না হয় দিলাম। তারপর থেকে আমি প্রতিনিয়ত নিজেকে বিক্রি করার জায়গা খুঁজি। এবং একদিন তা পেয়েও গেলাম।

এ জায়গাটা যে অপরিচিত এমন নয়। দু‘চার লাইন লেখালেখির সুবাদে সংবাদপত্রের কিছু মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তাদেরই একজনকে ধরে একটি পত্রিকার অফিসে কাজ জুটিয়ে নিলাম। অফিসে প্রতিদিন আসি যাই। কোনো কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমার এ ধরনের নির্বিকার ভাব দেখে অন্য কলিগরা সুযোগ নিতে থাকলো। কোনো কাজের দরকার হলেই আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। চাকরি হারানোর ভয়ে ওদের সব আবদার গিলে খাই। এভাবে চলছে প্রায় দুই বছর হলো। কিন্তু আজ সকালে অফিসে ঢুকেই চাকরিটা হারালাম। বিশ্বাস করুন আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো মানুষ। আমার ভুল হতেই পারে। তাই বলে ভুলের মাশুল হিসেবে চাকরি হারাব ভাবতে পারিনি। বিষয়টি একদিক থেকে দেখলে অনেক বড় এটা আমি স্বীকার করি । তারপরও আপনাদের বলি। আমি পত্রিকায় প্রুফ রিডিং এর কাজ করি। প্রথম এবং শেষ পাতার ম্যাটার পড়ে দিই। গতকাল একটা নিউজ ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবম শতকের দুটি মূর্তি পাওয়া গেছে। সুলতানপুর গ্রামে এক মেম্বারের বাড়ির পাশে পুকুরের পাড় অতি বৃষ্টির কারণে ভেঙ্গে গেলে মূর্তি দুটি বেরিয়ে আসে। ফাইনাল ট্রেসিং আউট করার আগে সাদা কাগজে আমি নিউজটি পড়ে দিই।  কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া শব্দটি ভুলে ব্রাণবাড়িয়া রয়ে যায়। আমার চোখে পড়েনি। এটি ছিল প্রথম পৃষ্ঠার বক্স আইটেম। পরদিন অফিসে এসে দেখি তুলকালাম কাণ্ড। নিউজ এডিটর আমাকে ডেকে পাঠায়। আমি তার কাছে করজোড় মা চাই। কিন্তু তার এক কথা, কাল থেকে আমাকে যেন অফিসে না দেখে। আমার পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যেতে থাকলো। কি করবো বুঝে ওঠতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিক্রি করেও চাকরিটা বাঁচাতে পারলাম না। অফিস থেকে বের হয়ে এলোপাতাড়ি হাঁটতে শুরু করি। গন্তব্যহীন হাঁটা। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট শেষ। ঘোরের মধ্যে সকালে কেনা পুরো প্যাকেটটাই শেষ করে ফেলেছি। ফুটপাতের একটি টং দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়ে খেয়াল হলো ভুল রাস্তা ধরে হেঁটে আসতে আসতে বলধা গার্ডেনের কাছে চলে এসেছি। এখন আমার আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। অতিরিক্ত সিগারেট টানার কারণে মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। সামনের দিকে একটু হেঁটেই দেখি গার্ডেনের গেট। পকেট থেকে খুচরা টাকা বের করে কাউন্টারে টিকেটের জন্য হাত বাড়াই। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। দ্রুত গার্ডেনের ভেতর প্রবেশ করি। এই প্রথম কোনো স্থানে টিকেট কিনে প্রবেশ করলাম। নিজের ভেতর নানা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে। কিভাবে বাঁচতে চেয়েছি কি ঘটছে। জীবন কী এমন আচরণই করে প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে? আপসকামিতা কিংবা আদর্শবাদীতা সব কিছু কি কর্পোরেটদের করতলে? মেলাতে পারি না। কেবল ঘোরপাক খায়।

গার্ডেনের ভেতরে প্রবেশ করে হাঁটতে হাঁটতে শান বাধানো ঘাটে এসে বসলাম। প্রচুর লোকজন। বেশির ভাগই উঠতি বয়সী। গা ঘেষে ঘেষে বসে আছে বাগানের ঝোপের ভেতর। কেউ কাউকে দেখে লজ্জাবোধ করছে না। একটা ছেলেকে দেখলাম তার বান্ধবীর বুকের উপর হাত মারছে। এখানে যে মানুষজন আছে সে সম্ভবত ভুলে গেছে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীও আছে। ওরা নিশ্চয় এসেছে প্র্যকটিক্যাল কাসের উপকরণ যোগাড় করতে। আমি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে এ সব দৃশ্য দেখছি। নিজের উপর ভীষণ অভিমান হচ্ছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ঘাট থেকে নিচের দিকে গেলাম হাত মুখ ধুতে। পাশেই কয়েকটি ছেলে ঘাটের শেষ সিড়িতে বসে পানি ছিটাছিটি করছে। আমি পানিতে হাত রেখে একটু সস্থি অনুভব করলাম। হঠ্যাৎ কানের মধ্যে একটি বিশ্রী শব্দ এসে বিধলো। মালটা খুব কড়া। দেখ দুধগুলো। আশেপাশে তাকালাম। কোনো মেয়ে ছেলে চোখে পড়লো না। এমন সময় পুকুরের অপর পাড়ে চোখে পড়লো, কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে বয়স্কগোছের একজন ভদ্রমহিলা। হতে পারে ওদের মা কিংবা শিক। ভাবলাম ঐ মহিলার কানে শব্দটি গেলে কি প্রতিক্রিয়া হতো। ইচ্ছে করছিলো উঠে দাঁড়িয়ে কানের উপর কষে দুটো চড় লাগায়। সাহস করতে পারলাম না। মুখ ধুয়ে এসে ঘাটে বসলাম। বর্ষার কথা খুব মনে পড়ছে। বাসায় গিয়ে ওকে কি বলবো। মনে পড়লো অনাগত  সন্তানের কথা। ভাবছি ওকে পৃথিবীতে এনে কি ভুল করছি। নাকি চলমান দিনগুলো প্রত্যেক মানুষেরই এমন কঠিন যায়? পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলাম। গেটের ঢুকার সময় চোখে পড়েছিল ধূমপানমুক্ত এলাকা। কিন্তু ভেতরে দেখছি  অনেকেই সিগারেট ফুকছে। আইন মেনে কি লাভ!

মানুষের কোলাহল বাড়ছে। আমার পাশ ঘেষে আরো কয়েকটি ছেলে মেয়ে এসে বসলো। বাদাম খাচ্ছে আর খোসাগুলো পানিতে ছুড়ে মারছে। দেখলাম মাছগুলো খোসাকে খাবার মনে করে  খেতে চেষ্টা করছে। ছেলেগুলো এ দৃশ্য দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস আমার একদম পছন্দ না। জীবন কি এ রকম মিথ্যা আশ্বাসের ওপর চলছে? আমাদের চোখের সামনে স্বপ্ন নামক যে মুলাটি ঝুলানো এটি চির সত্য? না কেবলি মোহ। এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। বর্ষার ফোন।

হ্যালো কি করছো।

বললাম কিছু না।

তোমাদের পত্রিকায় তো দেখলাম একটা মেজর ভুল।

কী ভুল?

ব্রাহ্মণবাড়িয়া যে ব্রাণবাড়িয়া হয়ে আছে।

আমি কোনো কথা বললাম না।  ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখে হাঁটা শুরু করলাম। পেছন থেকে একটি পরিচিত কণ্ঠের শব্দ শুনতে পেলাম।

হাসান এই হাসান।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখি নীলা।

আরে বাবা কতণ ধরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছস না।

বললাম না।

তুই এখানে কি করে এলি? ভুল পথে, না ইচ্ছে করে।

না ইচ্ছে করেই এসেছি।

যাক শেষ পর্যন্ত নিজের চিন্তাধারা পাল্টালি।

কেবল মাথা নাড়ালাম। হ্যা বা না কিছুই বলিনি। ও বললো

চল বাইরে কোথাও দাঁড়িয়ে চা খাই।

বললাম তাড়া আছে অন্য একদিন।

দ্রুত বের হয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। চোখের সামনে বারবার ভেসে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর বর্ষার মুখ। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বর্ষাকে ফোন দিই। ওপার থেকে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা কেটে যায়। আবার চেষ্টা করি। এবার আর ফোন যায় না। অপর প্রান্ত থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসছে আপনার আ্যকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ...   দয়া করে...

পতঙ্গ বিষয়ে ১০০ নম্বরের রচনা    

জাহেদ সরওয়ার

অফিসের মাসিক মিটিংয়ে এই একবার ঝলসে উঠেছিল কেরাণী আবদুল হাকিম। একেবারে অর্তকিতে, অন্যের কথা বলার মাঝখানে দাড়িঁয়ে যেন এই তার জীবনে শেষ প্রতিবাদ। মৃত্যুর আগে যেন এই তার জীবনে শেষ চাওয়া।

আমি কিছু বলতে চাই বলে শুরু করেছিলো সে ‘আজ সকালে চাল কিনেছি ৪৫ টাকা দিয়ে। আপনারা জানেন কিনা জানিনা। জানিনা আপনারা কেউ বাজারে জান কিনা। সয়াবিন তেলের দাম ১০০ টাকার উপরে। এদেশে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। এদিকে দিনের পর দিন অফিসে কাজ বেড়ে যাচ্ছে। মাত্র চারহাজার টাকা বেতনে আর কারো চলে কিনা জানিনা আমার চলেনা। তাই বেতনের ব্যাপারটা আমি চেয়ারম্যানকে ভেবে দেখতে বলি” এটুকুই তার কথা। কখনোই জীবনে কোনো মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলে নাই হাকিম। তার কথার শেষে গমগম করতে থাকে মিটিংরুম। প্রথমত হাকিম অতি নিরীহ প্রকৃতির কেরাণী, ২য়ত সবার মনের আসল কথাটা সেই বলেছে। তাই ব্যাপারটা একেবারে আনকোরা বিশদৃশ হয়ে দাঁড়াল। চেয়ারম্যানের থুতনি দিয়ে ঘাম ঝরল। চেয়ারম্যানরা হচ্ছে সম্রাট নীরুর মত কাজের পর কাজ চান। বেতন বাড়াতে বললে অপমানিত বোধ করেন। কারণ এদেশে শিতি বেকারের সংখ্যা কোটির উপরে। তিনবেলা খাবার বিনিময়েও অনেকে কাজ করতে রাজি। এ অবস্থায় হাকিমের এ দাবি রীতিমতো অগ্নিকান্ডের মত ব্যাপার। ব্যাপারটা শুধু হাকিমের ব্যক্তিগত হলে চেয়ারম্যানের কথা ছিলনা। এটাযে পুরা অফিসের সবারই  অঘোষিত দাবি। চেয়ারম্যানের কি একটা পুরস্কার নেবার জন্য বিলেত যাবার কথা। তিনি নাকি কারো সাথে কথাবার্তা কইছেন না।

এর ঠিক দুইদিন পর আব্দুল হাকিমকে চাকরি ছেড়ে দেবার নোটিশ দেয়া হয়। বলা হয় যেন সে নিজ থেকেই পদত্যাগ পত্র দিয়ে যায়। হাকিম হঠাৎ করে ইন্তেকাল করে যেন আবার বেচে উঠে। অন্ধকার কবরের ভিতর শুয়ে থাকা একটা শেয়ালের মত মনে হতে থাকে তার নিজেকে। দিলে তার মুর্হুমুহু মোচড় দিতে থাকে। অফিসে তার অন্য সহকর্মীরা যারা তাকে প্ররোচিত করেছিল, বলেছিল তোমার কিচ্ছু হলে লগে আছি। ওরা আর তার লগে কথা কয়না। সে অফিসের এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে ইঁদুরের বাচ্চার মত। একবার ব্যবস্থাপকের ঘরে উকি মারে। ব্যবস্থাপকের রক্তচু তার বুকে ছেল মারে। সব সম্ভাবনা শেষে যখন সে দেখতে পায় মুহুর্তের মধ্যে এ অফিস তার অচেনা কোনো স্থানে পরিণত হলো। যেন সে সম্পুর্ণ অচেনা কোনো জায়গায় এসেছে। তখন তার বউ আর সদ্যপ্রসূত বাচ্চাটার কথা মনে পড়ল সাই করে। ইতিমধ্যে বউয়ের কাছে তুলেছিল সে কথাটা। আতকে উঠলেও হাসনাহেনা ব্যাপারটা যে এত গুরুতর আকার নেবে ভাবতেও পারে নাই। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয় হাকিম এ অফিস তার কাছে লাশঘরের মত। একটা ভয়াবহ মানসীক অবস্থার মধ্যে সে পদত্যাগ পত্র দস্তখত করে পিওনকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের ঘরে। নিজেকে একেবারে মুক্ত মানুষ মনে হয় তার। যেন এতদিন ধরে তার হাতে পায়ে দাসত্বের শৃংখল বাধা ছিল। কিন্তু একটু পরেই বাসার পাশে মুদিদোকানদার আর শিশুটার দৈনিক অষুদ পথ্য আর দুধটুদের কথা মনে পড়তেই তার মনে হল আসলে সে পা দিয়ে হাটেনা হাটু দিয়ে হাটে। বাসায় ফেরার পর হাসনাহেনা কথাটা শোনার পর পাগলের মত আচরণ করে।

‘দেশের এমন একটা সময়ে তুমি চাকরি ছাইরা দিলা’ আর মা-বাপ তুলে অফিস চেয়ারম্যান টেন সবাইকে গালাগালি করে। তারপর এক্কেবারে চুপ মেরে যায়। বাচ্চাটা ট্যা ট্যা করতে থাকে বিরামহীন।

পরদিন অফিসে গিয়ে চলতি মাসের ১৫ দিনের মানে আধামাসের বেতন তুলে আনে।

ঐ কয়টা টাকা দিয়া কয়দিন যাইব’ হাসনাহেনা বলে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়া তার একটা আঁচাড় মারতে ইচ্ছা করে। পুরা জীবনটা অন্য কোনো দেশে গুরু করার অবাস্তব স্বপ্ন জাগে তার।

কাল থেইকা আমি নতুন চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু কইরা দিমু- হাকিম আশ্বস্ত করে।

সংসারের প্রতি মোটেই উদাসিন নয় হাকিম। পরদিন থেকে সত্যায়িত কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে পসন্দের কয়েকটা অফিসে, কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের কাছে হানা দেয় হাকিম।

খুব দ্রুত জমানো টাকা শেষ হয়ে আসে। শেষে হাকিমের হাতে বাসাভাড়াটাও থাকেনা। না খেয়ে আধাপেট খেয়ে হাসনাহেনা আরো ১৩ দিন সহ্য করে শেষে শিশুর কান্না সইতে না পেরে বলে- আমি গেলাম।

কই যাও- হাকিম জিগায়। দোযখে- হাসনাহেনা বেরিয়ে যায়।

হাকিম কিছুই বলেনা। সে জানে হাসনাহেনা তার মার কাছে চলে গেছে। ওরাও তেমন সুবিধেয় নাই সে জানে। যেমন তেমন অবস্থা। হাসনা হেনা চলে গেছে দুই দিন। গত এক দিন ধরে সে প্রায় কিছুই খায়নি। পাশের মুদিদোকান থেকে আলু কিনতে গিয়েছিল বাকিতে। কিন্তু চাকরি চলে যাবার খবর বুলেটের চাইতেও গতিশীল। দোকানদার পষ্ট করে বলে দেয় সে দানছত্র খুলে বসে নাই।

আমাকেও এই দোকান কইরাই বউ-পোলার মুখে খাওন দিতে হয়”। ঘরে ফিরে দেখে কাজের মেয়েটা কি যেন হাতড়াচ্ছে। তাকে দেখে বলে কিছুইতো নাই কি রান্ধুম?

হাকিম দেখে প্লাস্টিকের জারের মধ্যে সামান্য চাল অবশিষ্ট আছে। সেটা সে বার করে নেয়। দুইটা কাচা পেয়াজের খোসা ছড়ায়। চালটা মুঠোয় নিয়ে মুখে পুরে। এক কামড়ে পেয়াজের অর্ধেকটা মুখের মধ্যে ফেলে চিবোতে থাকে। তার অবস্থা দেখে বুয়া মুখে আচল চাপা দেয়। ইয়াছিন ছুরা পড়ে বুকে ফু দেয়। ভয়ে সাবধানে দরজা খুলে চিরদিনের মত পালিয়ে বাঁচে। মানুষের ুধা ভয়ংকর সে জানে।

পরদিন সকালে ক্ষুধা ঘুম থেকে টেনে তোলে হাকিমকে। সে দেখে ঘরে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। মুদিদোকানদারের কাছে গিয়ে কিছু লাভ হবেনা সে জানে। পাশের দেয়ালে তার চোখ চলে যায়। একটা ক্ষুদ্র পোকাকে তাড়া  করছে একটা টিকটিকি। শাদার ওপর আবছা লাল কেকের মত মনে হল তার টিকটিকিটার পিঠ। পাশে রাখা একটা ম্যগাজিন তুলে সে ছুড়ে মারে টিকটিকিটার দিকে। লেজটা আগে খসে পড়ে বিছানার ওপর লিরলির করতে থাকে। আদমরা প্রাণীটা কাত হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। একটু ঘেন্না করে উঠল তার। দুহাতে জিনিসটা ধরল। কেমন যেন কেপে উঠল একটু। উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর মুখের ভেতর ফেলে দিয়ে চোখনাক বন্ধ করে দিল এক কামড়। ঘ্যাঁচ করে একটা শব্দ হয়। একটা তরল পদার্থ মুখগহ্বরটা আটালো করে তোলল। ঢোক গিলে জিনিসটাকে সে ভিতরে পাঠিয়ে দিল। ুধাপেঠে খুব একটা খারাপ লাগল না তার। এরপর পর্যায়ক্রমে তেলাপোকা গিরগিটি চামচিকা ইঁদুর ইত্যাদি খুঁজে খুঁজে সে উদরপুর্তি করতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার বাসস্থান পোকামাকড়হীন এলাকায় পরিণত হয়। সপ্তাহ খানেকের মত হবে সে দাঁড়ি কাটে নাই। যে দিন কোনো পোকামাকড় সে পেলনা আর। সে দিন তার সম্মুখে একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। স্বপ্নে স্বর্ণের ডেকসি পাওয়া লোকদের মত টেবিলে কিল মেরে উঠে দাঁড়ায় সে। ইয়াহু! ইয়াহু! পেয়ে গেছি। সে ভাবতে লাগলো আমি তো পোকামাকড় খেয়ে থাকতে পারি। তাহলে আমার আর এ অসভ্য জগতে কাজ কি। জঙ্গলে চলে যাব। এখনি। সেখানে অনেক পোকামাকড়। অনেক। সে হবে শুধো আমার একার রাজ্য। সেদিনই কেরাণী আব্দুল হাকিম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে একটা বোস্কা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এরপর তাকে আর কেউ লোকালয়ে দেখেনি।

সুদর্শনচক্র

রায়হান রাইন

এক লোক বহুবছর পর বাড়ি ফিরছে। জেল কর্তৃপক্ষ জামাকাপড়গুলো ঠিকঠাক মতো ফেরত দিলেও হাতঘড়িটা ফেরত দেয় নাই। তার নিজের গায়ের চামড়াকেও তার নিজের মনে হচ্ছে না, এমনকি নিজেকেও না।

ব্যথাহীন

রাতুল পাল

বিস্তীর্ণ ধূ-ধূ প্রান্তর যেখানে দূরের ঐ সুউচ্চ পর্বতমালার পাদদেশে গিয়ে মিশেছে, সেখান থেকে এক কিশোরের ক্রন্দন-ধ্বনি ভেসে আসে। ধূসরতা-রুক্ষতা-শূণ্যতার নির্মম জয়জয়কার এ-প্রান্তরে, সুদূর অতীতের কোন এক অজানা কাল হতে যা নিরবচ্ছিন্ন রয়েছে আজ অবধি। অবিরাম অশ্রু ঝরিয়ে হেঁটে চলে কৃশকায় কিশোরটি, নির্জনতার নিরন্তর চোখ রাঙানিও তার অশ্রুসিক্ত দু’চোখে সামান্য ভীতি সঞ্চারে সফল হয় নি। কয়েঁক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু প্রায়ই কিশোরের কপোল গড়িয়ে ঝরে পড়ে ভূমির উপর, তৃষ্ণার্ত বালুকণার দল মুহূর্তেই শুষে নেয় তা। আজন্ম তৃষ্ণার্ত এ-বিরান ভূমি-বৃষ্টি ঝরে না এখানে, আকাশে জমে না মেঘ। দীর্ঘকাল এ-প্রান্তরে পড়েনি কোন মানুষের পদচিহ্ন, সমতল বালুর স্তরের উপর কিশোরের পায়ের ছাঁপ তাই জমাট বাঁধা শুষ্ক পললের উপর নিশ্চিহ্ন প্রাগৈতিহাসিক প্রানীর শরীরের ছাপের মত বিস্ময়কর মনে হয়।

পর্বতমালা ছাড়িয়ে কিছু দূর পার হয়ে এলে হঠাৎ-ই একটি ক্ষীন মানব-কন্ঠের শব্দ শুনতে পায় কিশোরটি-কেঁপে ওঠে সে, দীর্ঘক্ষণ পর তার ব্যথিত হৃদয় চকিত হয়।

হে কিশোর! দয়া করে একটি বার দাঁড়াও।

বিস্মিত কিশোর কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়, চারপাশ ঘুরে খুঁজতে থাকে কন্ঠস্বরের উৎস। বিস্ময়ের মাত্রা ত্বরিত হয় আরও, সে লক্ষ্য করে অদূরে একাকী দন্ডায়মান একটি শীর্ণ বৃক্ষ-পত্রহীন, বাকলহীন; শুধুই কান্ড আর শাখা-প্রশাখাময়। কন্ঠস্বর ধ্বনিত হবার সাথে সাথে বৃক্ষটির দেহে মৃদু কম্পন হতে দেখে কিশোর, বুঝতে পারে শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকেই। ক্ষণিক পরেই উপলব্ধি হয় কিশোরের-বৃক্ষটি বাকশক্তিপ্রাপ্ত!

হে কিশোর, তুমি যেয়ো না। একটি বার দাঁড়াও, দয়া করে একটি বার দাঁড়াও।

আমি তোমায় দেখে শঙ্কিত। বৃক্ষ হয়েও তুমি কথা বলে চলেছো কি করে? পূর্বে এমন বৃক্ষ আমি কোথাও দেখিনি।

আমি তোমায় বলব, সব বলব হে কিশোর। শুধু কথা দাও, তুমি এখানে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করবে, ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনবে। আমায় ভয় পেয় না, করুণা কর। দয়া করে করুণা কর।

বলো হে বৃক্ষ-মানব, তোমার কথা বলো। তবে তোমার কথা যদি শুধু দুঃখেরই হয়, তবে আমি শুনতে চাই না। আমার নিজের হৃদয়ই যে দুঃখ ভারাক্রান্ত, তাই তো পাহাড়ের ওপারের লোকালয় ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে এসেছি।

আমি যদি তোমার দুঃখ চিরতরে বিলীন করে দি-ই? দেবে আমায় সে সুযোগ? একটি বার আমায় সুযোগ দাও।

তা কি করে সম্ভব! কেউই অপরের দুঃখ ঘোচাতে পারে না বৃক্ষ-মানব। আমার পিতা বলেন-বিশ্বে আমরা সবাই একা, একাই লড়ে যেতে হবে চিরদিন।

হে কিশোর, আমি মিথ্যা বলছি না। আমার কথা শেষ পর্যন্ত শুনেলই সব বুঝবে তুমি। শোন তবে...

আজ আমার যে বৃক্ষের শরীর, তা একদিন ছিল না। তোমার মতই ছিলাম আমি-সম্পূর্ণ মানব শরীরের এক সম্পূর্ণ মানব। তবে আমি ছিলাম এমন এক দেশের অধিবাসী, যার নিয়ন্ত্রক এক রূঢ়-নিষ্ঠুর দেবতা-সামান্য অপরাধের শাস্তি সেখানে নির্মম! এই যে আমি আজ বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এই শুষ্ক প্রান্তরে, তা এমনই এক অপরাধের জন্য। আমার রাজ্যে পানীয় জলের তীব্র সংকট। গভীর রাতে আমি যখন একদিন ঘুমন্ত ছিলাম, এক তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধ আমার গৃহে এসেছিল একটু জলের আশায়। বৃদ্ধের ডাক শুনে আমি বিরক্ত বোধ করি, এবং তাকে বলি গৃহত্যাগ করতে। সেই আমার অপরাধ! সেই ক্ষণিকের অপরাধের জন্য আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি এই নির্জন প্রান্তরে। আমার মৃত্যুও সম্ভবপর নয় এখানে, এই বৃক্ষ-দেহের মূলের সামান্য অংশ মাটি ফুড়ে ছুঁয়ে আছে পাতালের জলপৃষ্ঠে;- তাই আমি বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকি কিন্তু ধুঁকি, ধুঁকি প্রতি মুহূর্তে, প্রতি ক্ষণে।

-তোমার যন্ত্রনা যে আমার থেকেও বেশি, হে বৃক্ষ-মানব। এর থেকে কি কোন মুক্তি নেই তোমার?

-আছে হে কিশোর, আছে। সে-কথাই তোমায় বলব আমি। দয়া করে চলে যেয়ো না। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবার একটি মাত্র উপায় আছে। আমি যদি কারো দুঃখ লাঘব করতে পারি, নিঃশেষ করে দিতে পারি চিরতরে, তাহলেই এই বৃক্ষ-দেহ থেকে মুক্তি পাবো আমি। যে-কোন দুঃখী মানুষের দু’টি ইচ্ছাপূরণ করতে হবে আমায়, মাত্র দুটি। ইচ্ছা দু’টি প্রযোজ্য হবে শুধুমাত্র দু’জন মানুষের উপর, এবং অমরত্ব ছাড়া অন্য যে কোন কিছু হতে পারে কাম্যবস্তু। বছরের পর বছর ধরে আমি অপেক্ষা করে আছি, অপেক্ষা করে আছি একজন দুঃখী মানুষের; কিন্তু ভুলেও কারো আগমন ঘটে না এখানে, এ-রিক্ত প্রান্তর শুধু আমার মত অভিশপ্তের আবাসভূমি। আজ আমি তোমায় কাঁদতে দেখেছি, নিশ্চই তোমার কোন দুঃখ আছে। বলো কি তোমার দুঃখ? আমি মুহুর্তেই ঘুচিয়ে দেব সব, নিজেও পরিত্রাণ পাবো এই অভিশাপ থেকে।

-আমার সারা শরীরে প্রহারের চিহ্ন কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না? আমার পিতা, আমার জন্মদাতা পিতা কি নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করেছে আমায়! সবাই নিষ্ঠুর হে বৃক্ষ-মানব, সবাই নিষ্ঠুর। দুর্বল-ক্ষীণকায় আমি, খেলার সাথীরাও কারণে-অকারণে আমাকে আঘাত করে-ওদের কাছেও যে আমি নিতান্ত তাচ্ছিল্যের পাত্র। হে বৃক্ষ-মানব, আমায় তুমি ব্যথাহীন করে দাও। যে যতই আঘাত করুক, আমাকে যেন আর ব্যথা পেতে না হয়, যেন কাঁদতে না হয়।

-হে কিশোর, তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে। আমি কথা দিলাম তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে-তুমি সম্পূর্ণ ব্যথাহীন হয়ে যাবে, হাজার আঘাতও তোমার কাছে তুচ্ছ মনে হবে। এবার তোমার দিত্বীয় ইচ্ছাটি বলো।

-এই মুহূর্তে যে আমার আর কিছু মনে পড়ছে না। হয়তো একাধিক প্রত্যাশার কথা হয়ত বলা সম্ভব, কিন্তু তা তোমার অভিশপ্ত ক্ষমতার তুলনায় নগণ্য হবে। আমার যে ভাববার জন্য একটু সময় প্রয়োজন, বৃক্ষ-মানব। এই দুঃসহ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকাই আমার পক্ষে যে আর সম্ভব হচ্ছে না, আমি সিদ্ধান্ত নেব কি করে? আমি ব্যথাহীন হয়ে এখন দেশে ফিরে যাই, সেখানে গিয়ে অবশ্যই কিছুর প্রয়োজন বোধ করবো, আর সঙ্গে সঙ্গে তখন ছুঁটে এসে দিত্বীয় ইচ্ছার কথা বলবো। আমি অবশ্যই ফিরে আসবো হে বৃক্ষ-মানব, তুমি দুঃখ করো না।

-তুমি আমায় এ কেমন দুর্বিষহ অপেক্ষায় রেখে চলে যাচ্ছো, হে কিশোর? আমায় মুক্তির মধ্যপথে দাঁড় করিয়ে রেখে তুমি এভাবে চলে যাবে? হয়ত এমনই হয়, হয়ত এ আমার শাস্তিরই অংশ। সত্যিই তো, তুমিই বা কেন এই দুর্লভ ইচ্ছাপূরণের সুযোগ হারাবে? তুমি যাও হে কিশোর, তুমি যাও; তবে নিজে ব্যথাহীন হয়ে ভেবো না পৃথিবীময় সকলে ব্যথাহীন হয়ে গেছে, আমি ব্যথাহীন হয়ে গেছি। দয়া করে আমার কথা ভুলো না, যত শীঘ্র সম্ভব আবার ফিরে এসো তোমার দিত্বীয় ইচ্ছা নিয়ে। মনে রেখো, তোমার ইচ্ছাপূরণেই আমার মুক্তি।

-আমি ভুলবো না হে বৃক্ষ-মানব, আমি ভুলবো না। যে তুমি আজ ব্যথাহীন করে দিলে আমায়, যে তুমি আমায় মুক্তি দিলে শরীরের যন্ত্রণা থেকে, যে তুমি অভিশপ্ত হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছো এই ধূ-ধূ প্রান্তরে, যে তুমি অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমার একটি ইচ্ছা প্রকাশের-তার কথা আমি কিভাবে ভুলি? বিদায় হে বৃক্ষ-মানব, আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।

-বিদায় হে কিশোর, বিদায় হে আমার দীর্ঘ আকাঙ্খিত বন্ধু, বিদায়। তোমার প্রতীক্ষায় রইলাম, বিদায়।

কিছু দিন পর...

কিশোরকে আবার দেখা যায় প্রান্তরে। এবার সে কাঁদছে না, দৌঁড়াচ্ছে, দ্রুত বেগে দৌঁড়াচ্ছে, বহুদূর হতে চিৎকার করে বলছে, ‘‘হে বৃক্ষ-মানব, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি আমার দিত্বীয় ইচ্ছার সন্ধান। আজ তুমি মুক্তি পাবে, তোমার দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হবে আজ। কিশোরের চিৎকার শুনে যেন মোচড় দিয়ে ওঠে বৃক্ষটি; যতদূর পর্যন্ত তার শিকড় বিস্তৃত, ততদূর অব্দি ভূমি ক্ষণিকের জন্য মৃদু কেঁপে ওঠে।

-হে কিশোর, তুমি এসেছো? তুমি সত্যিই আবার এসেছো? এ নিসঙ্গ প্রান্তরে থেকে আমি বিশ্বাস করতে ভুলে গেছি। তবে আজ মনে পড়ে সত্যিই একদিন আমি বিশ্বাসী ছিলাম, বিশ্বাস করতাম মানুষকে; যদিও বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছি বহুবার। কিন্তু হে কিশোর, তুমি আমায় প্রতিদান দিয়েছ, আমার অনন্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছো। তুমি জানো না, কি অধীর অপেক্ষায় আমি প্রতিক্ষা করেছি তোমার জন্য। আমি বুঝেছি, আশাহীন প্রতিক্ষার চেয়ে আশাময় প্রতিক্ষা সহস্রগুণ বেশি দুঃসহ। হে কিশোর, আমার ধৈয্যেঁর আর পরীক্ষা নিও না; বলো তোমার দিত্বীয় ইচ্ছা কি?

-হে বৃক্ষ-মানব, আমার প্রথম ইচ্ছা তুমি পূরণ করেছো। আজ আমি সম্পূর্ণ ব্যথাহীন, প্রবল প্রহারও আমার শরীরে বিন্দু মাত্র ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে না। সবাই আমায় দেখে বিস্মিত হয়, সমীহ করে; তাচ্ছ্বিল্য করে না আগের মতো, ভাবে আমি ঈশ্বরিক ক্ষমতা পেয়েছি। কিন্তু তবুও যে আমি সুখি হতে পারিনি, হে বৃক্ষ-মানব। আমার শরীরের ব্যথা হয়ত লাঘব হয়েছে; কিন্তু যখনই রাজ্যের অজস্র বসনহীন ভিক্ষুক আমার চোখের সামনে পড়ে, যখন দেখি অনাহারক্লীষ্ট শিশুরা পথের পাশে অসহায় দাঁড়িয়ে আছে, জুলুমে জর্জরিত চাষাকে যখন দেখি রাজার অত্যাচারে ঘর ছাড়তে-তখন আমার হৃদয় আবার কেঁদে ওঠে। আমার এই ছোট্ট বুকটা ভেঙে তখন আবার দুঃখের প্লাবন বয়ে যায়, সহ্যশক্তি দিয়ে আমি আর তা আটকে রাখতে পারি না। হে বৃক্ষ-মানব! তুমি আমায় হৃদয়ের এ-ব্যথা থেকে মুক্তি দাও, চিরতরে মুক্তি দাও।

-হায় কিশোর! হায়! এ তুমি কেমন ইচ্ছার কথা শোনালে আমায়? এ-ইচ্ছা পূরণ হলে যে তুমি আর মানুষ রবে না! ওই যে তুমি কেঁদে ওঠো বারেবার, ওই যে তোমার বুকে কষ্টের প্লাবন বয়ে যায়, তার জন্যই যে তুমি মানুষ, তোমার শ্রেষ্ঠত্ব যে অমলিন সে-জন্যই।

-কিন্তু আমি যে এ-ব্যথা চাই না, নাই বা থাকলাম মানুষ তাতে। তুমি আমার ইচ্ছাপূরণ কর, কষ্ট থেকে পরিত্রান দাও আমায়, নিজে মুক্ত হও অভিশাপ থেকে।

-না হে কিশোর! না! আমি যে আজও ভুলিনি একদিন আমি মানুষ ছিলাম, আমি যে কোনদিন ভুলব না আমি মানুষ ছিলাম। নিজের মুক্তির জন্য আমি যে তোমার মানব-আত্মাকে বন্দি করতে পারব না, কিশোর। তোমার ইচ্ছা পূরণ হলে তুমিই হবে বিশ্বের প্রথম মানব-শরীর, যার অন্ত্যস্থল শূণ্য, যে পাথর। হে কিশোর, আমি যে তা পারব না! তুমি চলে যাও, চিরতরে চলে যাও। আবার আমি অপেক্ষা করব, আবার শুরু হবে আমার প্রতিক্ষার প্রহর, আবার হয়তো কারও আগমন হবে এ-প্রান্তরে, হয়তো হবে না; তবুও তোমার এ-অনুরোধ আমি রাখবো না। তোমার কন্ঠস্বরের দৃঢ়তা শুনে মনে হয় তুমি এই ইচ্ছাপূরণে বদ্ধপরিকর; কিন্তু হে কিশোর আমি নিরুপায়, অসহায়, অসমর্থ্য। তুমি চলে যাও, আর কোন দিন ফিরে এসো না; যন্ত্রনায় আর কাতর করে তুলো না আমায়।

-আমায় ক্ষমা কর হে বৃক্ষ-মানব, আমায় ক্ষমা করো। সমগ্র শরীরে ব্যথাহীন হয়ে আমি অন্তরের মর্মস্থলেও ব্যথাহীন হতে চেয়েছিলাম, হৃদয় উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যে আজ আমার নতুন বোধদয় ঘটালে, হে বৃক্ষ-মানব। মুক্তির দ্বারে দাঁড়িয়েও তুমি যে চেতনায় প্রবুদ্ধ হয়ে আজ অকাতরে রুদ্ধ করলে নিজের ভবিষ্যত, তার মহত্ত্বের আলোকচ্ছ্বটায় আমি আলোকিত হলাম! না, বৃক্ষ-মানব! না! আমি মানুষই থাকতে চাই, হৃদয় আমার শতছিন্ন হোক ব্যথার প্রাবল্যে, তবুও আমি মানুষ থাকতে চাই। তবে প্রশ্ন জাগে, কতদিন আর সহ্য করে যাবো এভাবে?

-হে কিশোর! তুমি আবার আশার সঞ্চার করলে আমার এ ভগণ হৃদয়ে। তোমার হয়ত উপলব্ধি হয়েছে - ব্যথাহীনতা ব্যথার কাছে নির্লজ্জ পরাজয়ের নামান্তর, ব্যথাকে নির্মূলের প্রচেষ্টাই প্রকৃত বিজয়।

-তুমিই সঠিক হে বৃক্ষ-মানব, তুমিই সঠিক। আমার পূর্বের আকাঙ্খা ছিল কাপূরুষ হবার হীন প্রত্যাশা। আমি আমার ইচ্ছা বদলে ফেলেছি।

-বলো তোমার নতুন প্রত্যাশার কথা। তবে আবার এমন কিছু বলো না যা পূরণের চেয়ে বৃক্ষ হয়ে থাকা শ্রেয়তর হয়।

-হে বৃক্ষ-মানব, তুমি আমারই মতন ব্যথাহীন হয়ে যাবে তোমার মানব শরীর ধারণের পর-এই আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা। আমরা দুই ব্যথাহীন ব্যথা দূর করব মানুষের, সমগ্র জীবন কাটাবো ব্যথার নির্মূলে, শরীরে ব্যথা নিয়ে যা সম্ভব হবে না কোন দিন। থাকবে তুমি আমার সাথে?

-থাকবো হে কিশোর, থাকবো, আজীবন থাকবো।

   একটু পর বৃক্ষটি রূপান্তরিত হয় এক বৃদ্ধপ্রায় মানুষে-চোখে তার জল ঝরে পড়ে; জল ঝরে পড়ে কিশোরটির চোখ থেকেও। একে অপরকে আলিঙ্গন করে তারা অঝোরে কেঁদে চলে অনেক্ষণ। ক্ষণিক বাদেই হাঁটতে থাকে তারা, হেঁটে পার হয়ে যায় সেই বিভীষিকাময় প্রান্তর, চোখে তাদের স্বপ্ন-বিরাজমান সকল ব্যথা দূর করবে তারা।