মাসুদ খানের স্মৃতিকথা: কবিতা ও কুড়িগ্রাম _অপরূপ শোভামেরাজের মতো, স্নিগ্ধ গন্ধকাহিনির মতো

Post date: Sep 29, 2014 3:29:54 AM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

মাঝে-মধ্যে শীত এসে গ্রাস করে ফেলে সবকিছু। ভর করে এক ধরনের স্থিতিজাড্য। সৃজন-উন্মুখ বৃত্তিগুলি চলে যায় শীতনিদ্রায়। কেমন যেন ভোঁতা হয়ে আসে ইন্দ্রিয়ানুভূতি। এরকম চলে কিছুদিন। তারপর একসময় শেষ হয় জাড্যকাল। আস্তে-আস্তে ফিরে আসে জঙ্গমতা। ফুটে উঠতে থাকে সৃজনচাঞ্চল্য, একটু-একটু করে। শীতের প্রহারে নাঙা হয়ে-যাওয়া অনুভূতির গাছপালাগুলি তখন দ্রুত মেলে ধরতে থাকে তাদের পাতা ও পতঙ্গ, লতা ও পল্লব। অনুকূল আবহাওয়া থেকে যে যেভাবে যতটা পারে গ্রেফতার করে নেয় উত্তাপ ও আলোক। হাতিয়ে নিতে থাকে নিকট ও দূর থেকে ধেয়ে-আসা শক্তি ও সংকেত, প্রেরণা ও উদ্দীপনা। তখন সে-কী স্নায়ু-টান-টান উত্তেজনা! আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধির তীব্র চাপ ও তাড়না_ কায়ায়, ছায়ায়, মনে। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত্রি জুড়ে। কমবেশি সব কবিকেই, সব সৃজনশীল মানুষকেই বোধ করি যেতে হয় এমনসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে। কখনো যুগপৎ, কখনো-বা পর্যায়ক্রমিক ভাটা ও জোয়ার, যন্ত্রণা ও উন্মাদনা, নির্বেদ ও সংবেদ...সৃজনস্রোতের খেয়াল ও গতিপথ সম্ভবত এরকমই। সম্ভবত ওই খেয়াল ও গতিমেজাজের সঙ্গেই বাঁধা কবি তথা সৃজনশীল মানুষের নিয়তি।

গত শতকের আশির দশকের শেষপর্ব থেকে নব্বই-এর প্রথমভাগ। বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে তখন চলছে এক উত্তেজনার কাল। তরুণ প্রজন্মের ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই উত্তেজনা। পো, পাউন্ড, এলিয়ট, এলুয়ার, অ্যাপোলোনিয়র থেকে শুরু করে জয়েস, স্যাঁ জঁ পার্স, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, নেরুদা, লোরকা, হিমেনেথ, জয়েস, বোর্হেস, মার্কেজ, র্পারা, কার্দেনাল, পোপা, হোলুব, মিউশ, মাচাদো, গিয়্যেন, হিউজ, হিনি, গিন্সবার্গ...পঠনপাঠন চলছে এঁদের বিচিত্র লেখালিখির। পঠনপাঠন চলছে আপ্রাচীনআধুনিক নানা বাংলা কবিতার। ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সিম্বলিজম, ফভিজম, পয়েন্টিলিজম, ডাডাইজম, স্যুররিয়ালিজম, ফটোগ্রাফিক সিম্বলিজম, ব্ল্যাক আর্ট, ব্ল্যাক ম্যাজিক, অপটিক্যাল আর্ট, কাইনেটিক আর্ট, প্রত্নপ্রতিমা, পুরাণ, সর্বপ্রাণবাদ, দুয়েন্দে-তত্ত্ব, স্ট্রিম অব কনসাসনেস, ম্যাজিক রিয়ালিজম... ইত্যাকার বিচিত্র তত্ত্ব, প্রপঞ্চ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ছাপ পড়ছে সে-সময়কার অনেক তরুণ কবিসাহিত্যিকদের লেখালিখিতে। তালগোলও পাকিয়ে যাচ্ছে। জীবনানন্দ, বিনয়, উৎপল, শক্তি, শঙ্খ...এঁরা তো আছেনই, ওপার বাংলা থেকে জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, গৌতম চৌধুরী, ভাস্কর চক্রবর্তী... এঁদেরও ঢেউ এসে লাগছে এপার বাংলায়। জয়ের ‘আলেয়া হ্রদ’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে তাঁর ‘ভুতুম ভগবান’ নামের একটি দীর্ঘ কবিতা রকমারি ইলাসট্রেশনসহ ছাপা হলো ‘দেশ’ পত্রিকায় (পরে ওই নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল)। এক অদ্ভুত ঘোর আর উন্মাদনার বাঁধভাঙা প্রবাহ যেন কবিতাটি। কী ছন্দে, কী অলঙ্কারে, কী কল্পনায়...একেবারে বল্গাছেঁড়া বেগ ও আবেগ। ম্যাড হয়ে লেখা কবিতা। আর ‘উন্মাদের পাঠক্রম’-এ তো ব্ল্যাকের সঙ্গে রীতিমতো ম্যাড-মেশানো এক উন্মত্ত অটোমেটিক রাইটিংয়ের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিলেন জয়। ব্ল্যাক_ম্যাজিক তরিকার ওইসব কবিতাতরঙ্গের অভিঘাত এসে পড়তে থাকে এপারের বেলাভূমিতে। জয়ের ওইসব কবিতার দিকে কেউ_কেউ অবশ্য তাকাচ্ছেন তির্যক চোখে, বলছেন_ “কী সব কবিতা! অপোগণ্ড, গলগণ্ড, অণ্ডকোষে মলভাণ্ড...।” হজম হবে না ব’লে হাড্ডিগুড্ডি চিবানো থেকে বিরত থাকতে বলছেন কেউ-কেউ। জয়ের বইগুলি তো বটেই, রণজিৎ-এর ‘জিপসিদের তাঁবু’, ‘সময়, সবুজ ডাইনি’, মৃদুলের ‘জলপাই কাঠের এস্রাজ’, ‘এভাবে কাঁদে না’ তখন ঘুরছে অনেকেরই হাতে-হাতে। পাঠ হচ্ছে, পাঠান্তর হচ্ছে, চলছে আলোচনা-প্রত্যালোচনা।

তো, সেই সময়কার বৈচিত্র্যপূর্ণ কবিতাকৃতি, নিরীক্ষা, উন্মাদনা, অতিরেক... সবকিছুকে বিশেষভাবে ধারণ ও লালন করেছে ছোটকাগজ ও সাহিত্যপত্রিকাগুলি_গাণ্ডীব, সংবেদ, নৈবেদ্য, পেঁচা, প্রসূন, প্রান্ত, দ, একবিংশ, নদী, নিসর্গ, দ্রষ্টব্য, প্রতিশিল্প, বিপ্রতীক, লিরিক, আড্ডারু, চালচিত্র, কিছুধ্বনি, ফৃ স্ট্রীট স্কুল...(দুঃখিত, অনেক পত্রিকার নাম হয়তো বাদ পড়ল)।

বলা বাহুল্য, ওইসকল জ্বর ও উত্তাপে আমিও তপ্ত ও উত্তেজিত তখন। ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দচয়ন, কয়েনেজ, ভাব, ভাষা এসব নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা ও ভাঙচুরে আমিও তখন অকাতর, বেহিসাব। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা, ইতিহাস আর পুরাণের নানা রঙের ঢেউ, জমকালো মেঘ-রৌদ্র তখন খেলা করছে আমার কবিতায়। শব্দের ওজোগুণের, শব্দের ঝংকারের প্রেমে আমি মশগুল তখন। তাপ ও ঘোরের ভেতরে থেকে ততদিনে ‘ত্রিজ’, ‘ধূলিবিদ্যা’, ‘স্রোত’, ‘কোলাজ’, ‘সার্কারামা’, ‘সিলিকন চিপ্স...’ ‘সিমেন্ট/আরসিসি’, ‘পরমাণু’ ‘এপ্রিল’ এগুলি সব লেখা হয়ে গেছে। সে-ও কয়েক বছর ধরে। তারপর উত্তেজনা একটু থিতিয়ে এলে, কিংবা উত্তেজনাপর্ব বহাল-থাকা অবস্থাতেই, শহর যখন পুড়ছে তুমুল আগুনে তখন যেমন হঠাৎ ইচ্ছা করে, শহর থেকে দূরে গিয়ে হাঁটি ঝিরঝির বৃষ্টির ভেতর, হাওয়া খাই মনোরম আবহাওয়ায়, অনেকটা সেরকম ইচ্ছা করছিল আমার। কোনো কান্তি বা একঘেয়েমি থেকে নয়, এমনিতেই। তখন আমি বগুড়ায় থাকি। ছোট ও নিরিবিলি একটি শহর। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮। বেশ কয়েক বছর ছিলাম বগুড়ায়। মাঝখানে দুই বছর রংপুরে; সে-ও এক অদ্ভুত সুন্দর রঙ্গপুর। এই দশ বছরে কত সখ্য, কত মাখামাখি, কবিতা-কবিতা ক’রে কত পাগলামি, কত বয়ে যাওয়া, প্রাণপাত্র উপচে কত ছলকে-ছলকে-পড়া...। প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে সারাদিন নিংড়ে নিচ্ছি প্রভূত প্রাণশক্তি আর তা উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছি আমাদের সান্ধ্য আড্ডাগুলিতে। আমাদের দিনযাপন তখন কবিতাযাপনের নামান্তর। কবিতাকে সাক্ষী রেখেই আমাদের সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। কবিতার আবহেই আমাদের নিরন্তর ডুবে থাকা, কবিতার কোহলেই নিবৃত্তি আমাদের তাবৎ নেশা ও পিপাসা, কবিতা থেকেই অক্সিজেন গ্রহণ, আবার কবিতাতেই ত্যাগ আমাদের সকল আপে, অভিমান, গ্লানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। নিরীক্ষার ঘোর ও রেশ পুরাপুরি কাটেনি তখনো। ‘একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে’ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কবিতাও লিখছি, আবার পাশাপাশি এরকমও ভাবছি_ নিরীক্ষার জটিল স্রোতে সাঁতার না কেটে সহজ-সাধারণ বিষয় নিয়ে অনুভূতি ও কল্পনার বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা রচনা করা যায় কিনা, করলে কীভাবে করা যায়। সময়টা সম্ভবত ’৯১ কিংবা ’৯২। ঘুরে বেড়াচ্ছি উত্তর বাংলার বিভিন্ন এলাকায়_পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন পল্লিতে পল্লিতে। এসব অঞ্চলের মৃত্তিকা কোথাও ঝুরঝুরে বেলে, কোথাও বেলে-দোআঁশ, আবার কোথাও-বা শক্ত, আঠালো লালমাটি। মাঠের পর মাঠ_কখনো সবুজ, দিগন্তপ্রসারিত অবারিত সবুজ গালিচা; আবার কখনো ধূসর, ঊষর_পুরনো, ময়লা, দাগদাগালিতে-ভরা, দাগটানা মানচিত্রের মতো। মাঝে-মধ্যে লোকালয়, জ্যোৎস্নায় ভিজতে থাকা কুঁড়েঘর, ভেঙে-যাওয়া হাট, মেঠোপথ, পথের পাশে চায়ের দোকান। শেষ-শীতের শুষ্ক আবহ, রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি। এসবের মাঝেই হঠাৎ সুনীল শুশ্রূষার মতো দেখা মেলে কোনো পুষ্করিণীর কিংবা কোনো এক দীর্ঘিকার। কাকচুকালো জল; লোকে শখ করে নাম দেয়_সাগর। রামসাগর, নীলসাগর, জয়সাগর, হুরাসাগর। অথবা ময়দান-আকারের এক দিঘি। ময়দানদিঘি। স্পষ্ট বরাভয়ের মতো বিরল দু-একটি নদী। শান্ত, স্বচ্ছ, শীর্ণকায়া, বালিবক্ষা, বঙ্কিমগতি। আঁকাবাঁকা গতিপথ। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ নদীর নাম মহানন্দা, বেরং, ডাহুক, ঘাঘট, বুড়ি যমুনা, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, কালিন্দী, আত্রাই...। সেই আদিগন্ত-সমতল ভূ-আয়তনের এক কোণে পড়ে আছে একটি শহর। কুড়িগ্রাম। অখ্যাত, নিরীহ, ছোট্ট ও ছিমছাম। ধরলা নদীর বাঁকে। সে-নদীর প্রবাহ ইস্পাত-পাতের মতো চকচকে ও ক্ষুরধার। এই সেই নদী যেখানে ফাঁদে পড়ে বগা কাঁদে আর বগী ঘুরে-ঘুরে উড়তে থাকে তার চারপাশ ঘিরে। খুবই সাদামাটা, আটপৌরে এক বঙ্গশহর। কিন্তু অদ্ভুত এক মায়া ও কুহক সারাক্ষণ লেগে থাকে শহরটির গায়ে। সেখানকার ধরলা নদী সাড়া দেয় গ্রহ_উপগ্রহের আকুল আহ্বানে। উতলা হয়ে ওঠে। মাঝে_মধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার উস্কানিতে বড়-বড় ঢেউ তুলে বয়ে যায়। আবার শান্ত হয়ে আসে যখন, তখন, মাছরাঙা আর পানকৌড়ি, দুই বৈমাত্রেয় ভাই, বাসা বাঁধে নদীর বুকে। স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে। কুড়িগ্রামের বয়নকুশলী বাবুই পাখিরাও কী এক নাক্ষত্রিক কারণে থেকে-থেকে ভুলে যায় বয়নসূত্র হঠাৎ। আর শাস্ত্রবাক্যে-বাঁধা যত গৃহনারী_বিবিধ বেড়া ও প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে ভিড় করে দাঁড়ায় নদীকূলে। তখন কী যে সপ্রতিভ হয়ে ওঠে তারা! প্রকাণ্ড ক্রিস্টালের মতো সপ্রতিভ।

এই সেই কুহকশহর কুড়িগ্রাম। শহরবাঁধের ধারে কংক্রিটের বড় একটা ব্লকের ওপর একদিন এক তারাভরা বসন্তসন্ধ্যায় শুয়ে আছি চুপচাপ। চারদিকে ধারাবাহিক অন্ধকার, হাওয়া ও নীরবতা। ওপরে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে তখন অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে জোনাকির মতো জ্বলছে নিভছে ছড়ানো নক্ষত্ররাজি। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লীলালাস্য অবলোকন করছি নক্ষত্রজোনাকির। একসময় হঠাৎ ওজনহীনতার বোধ জাগে। যেন কুড়িগ্রাম তার আলাভোলা আধপাগলা ধরলাকে সাথে নিয়ে ধরণীর সকল অভিকর্ষ ছিন্ন করে আস্তে_আস্তে উঠে যাচ্ছে ওপরে। উঠছে, উঠছে, মেঘ_মেঘান্তর ফুঁড়ে, বায়ুমণ্ডল ভেদ করে... কুড়িগ্রাম যেন এক অতিকায় পিরিচবাহন... দ্রুত ভেসে যাচ্ছে হালকা হাওয়ার ভেতর দিয়ে, কখনো হাওয়াহীনতা, কখনো-বা এক পূর্বাপর ভয়েড ও ভ্যাকুয়াম_রাজের মধ্য দিয়ে। কাত হয়ে তাকিয়ে দেখি নিচে এক ভয়াল-কালো গহ্বর। ভেসে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই... একসময় লাল-লাল বাষ্পের ঝাপটা এসে লাগল এক দমক...কেমন যেন একপ্রকার ঘ্রাণ! কী-কী যেন দেখতে পাচ্ছি চকিত ঝলকে, কীসের যেন স্পর্শ, কীসের যেন আস্বাদ_উদ্ভাস! একযোগে ঘনিয়ে আসছে সবগুলি ইন্দ্রিয়, কিংবা স্থানবদল করে চলেছে তারা মুহুর্মুহু... এইমাত্র কোনো এক নক্ষত্র-জংশনকে সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমাদের এই পিরিচবাহন। কি জানি! এভাবে অনেকক্ষণ... কুড়িগ্রাম ভাসতে ভাসতে এত ওপরে উঠে যাচ্ছে যে, দূরের ধরিত্রী থেকে হয়তো এই কুহক_শহরকে মনে হচ্ছে আকাশের মুখে এক নিটোল তিলচিহ্ন। এক অপরিহার্য সৌন্দর্যবিন্দু। হয়তো-বা।

যেন বয়ে যাচ্ছে এক অপরূপ স্বপ্নভ্রমণের রাত্রি, সে-এক অপূর্ব শোভামেরাজ... মোহ জেগে উঠছে, ভেঙে যাচ্ছে, ফের জেগে উঠছে, নিশিডাকে, রাত্রিচারিতায়। যেন এক দুর্দান্ত এপিফ্যানি_মুহূর্তঝিলিকের মতো চকিত, গন্ধকাহিনির মতো স্নিগ্ধ।

বাস্তব-অধিবাস্তব-মেশামেশি এমনই এক কল্পজ্বরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘কুড়িগ্রাম’ কবিতাটি। এখনো, বহুকাল পর যখন ফিরে তাকাই কবিতাটির দিকে, তখন ওরকমই কিছু উদ্ভাস, উন্মোচন, ওরকমই কিছু অনুভূতি এসে ভিড় করে। অজান্তেই।