আবু নাসিবের আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে স্মৃতিকথা উনি একজন মানুষ

Post date: Jan 17, 2015 2:05:52 PM

দুপুর মিত্র ঘাড় চেপে ধরেছে। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে একটা স্মৃতিচারণ করতে।আমি পিছলাতে চাইলাম।বন্ধু প্রবালকে ধরিয়ে দিতে চাইলাম।কিন্তু মিত্র কামড়ে ধরেছে কচ্ছপের মতো।তার প্লিজ বলার ধরণের কাছে হার মানলাম।কিন্তু কথা হল আমি পালাচ্ছি কেন?সায়ীদ স্যার সম্পর্কে কী আমার কিছু বলার নেই।নাকি তাঁকে ঠিক মতো চিনি নি।

তিনি কি আমার অনেক দূরের মানুষ। নাকি এত কাছের যার সম্বন্ধে বলাই যায় না। নাকি স্রেফ আমার আলস্য। আচ্ছা আমার ভেতর কি ভয় কাজ করছে। সাধারণত স্মৃতিচারণ করা হয় কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর আমার এই লেখার পর যদি... আল্লাহ না করুন।আমি জানি না এই সবের কোন কারণটা আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল। নাকি সব কটাই। যাই হউক দুপুর মিত্রের পীড়াপিড়ির কাছে হার মেনে আল্লা-রসুলের নাম স্মরন করে, গাজি-কালুর দোহাই পেরে স্মৃতিতে চারণ করা করা যাক। শুরুতে, শুরু থেকেই শুরু করা যাক।সাতবারের চেষ্টায় রবার্ট ব্রুশ হৃত রাজ্য পূনরুদ্ধার করেন। এই ঐতিহাসিক কাহিনী জানতে পাই সয়ীদ স্যারের কাছে তখন আমার বয়স কত মনে নেই। বি.টি.ভি তে একটা অনুষ্ঠান দেখাত যেখানে ছোটদের গল্প বলে শোনানো এবং সেই গল্পগুলোর নাট্যরূপ দেখানো হত। সেই গল্পগুলোর কথক ছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। অত্যন্ত চমৎকার উপস্থাপনায় তিনি পরিচালনা করতেন অনুষ্ঠানটি।আমার শিশু মনে দাগ রেখে গিয়েছিল।

একবার ঈদে আনন্দমেলা আয়োজন করা হল জুয়েল আইচের জাদুর উপর। সেই অনুষ্ঠানটি হয়েছিল সোনায় সোহাগা। যেমন জুয়েল আইচের জাদু তেমন স্যারের উপস্থাপনা। ৯৪ কি ৯৫ এ আবার স্যার ফিরে এলেন আরেকটি অনুষ্ঠান নিয়ে অনুষ্ঠানটির নাম চারুপাঠ। চমৎকার হত অনুষ্ঠানটি। কিন্তু কিছুদিন পরেই কী কারণে জানি বন্ধ হয়ে গেল। বই পড়বার অভ্যাস আমার ছোট বেলা থেকেই। আমি তখন রিডিং পড়া শিখেছি, স্কুলে ভর্তি হই নি। আব্বা তখন একটি বই এনে দিল চয়নিকা। ছড়া আর গল্পে ঠাসা ছিল বইটি। আমার পড়া শুরু চয়নিকা থেকে। জীবনে যা পেয়েছি তা পড়েছি, পড়ায় কোনও বাছবিচার করি নি। পড়া ছিল আমার কাছে নেশার মতো(অবশ্যই তা পাঠ্যবইয়ের বাইরে)।

কিশোর বয়সে তিন গোয়েন্দা খুব পড়তাম। তারপর হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু। পড়তাম আর ভাবতাম আমার একটা বাড়ি হবে যেখানে একটা রুমই হবে বইয়ের তাকে ভরা। ৯৯ কি ২০০০ সনে হবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আমাদের এলাকায় আসে। আমার সামনে খুলে যায় বইয়ের বিশাল রাজ্য।

মোবাইল লাইব্রেরির মাধ্যমে কেন্দ্রে আসা-যাওয়া শুরু হয়। স্যারকে তখন দেখতাম দূর থেকে মাঝে-মাঝে কোনো সেমিনারে। তখনো স্যার আমাদের মোটামুটি দূরের মানুষ। আমরা তখন লেখালেখি করি টুকটাক। মোবাইল লাইব্রেরির একটা অনুষ্ঠান হয় মোবাইল লাইব্রেরির ইনচার্য এবং এবং বিভিন্ন এলাকার সদস্যদের নিয়ে ছিল অনুষ্ঠানটি। অবশ্যই স্যার ছিলেন প্রধান বক্তা বলা বাহুল্য বরাবরের মতোচমৎকার বক্তব্য রাখলেন তিনি।

আমাদের বন্ধু তুষার মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিল। আমাদের তরুনদের লেখালেখির জন্য কোনো পত্রিকা নেই। স্যার আমাদের তরুনদের লেখালেখির জন্য আপনি যদি পত্রিকা বের করেন। স্যার তুষারের জ্বালাময়ী বক্তৃতার উপর পানি ঢেলে দিলেন। স্যার জবাবে বললেন, "যৌবন তোমার আর বেদনা আমার"। পত্রিকা নিজে বের কর। আমি বের করব আর তুমি লিখবে। পরে আমি, তুষার আর রাজ মাসুদ ফরাদ (এখন কুঁড়েঘর নামে একটি পত্রিকা বের করে) পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিই।" ভাস্বতী" নামে একটি পত্রিকা বের করি। জানি না পত্রিকাটি কতটা মানসম্পন্ন হয়েছিল বলতে পারব না। তবে ঐ পত্রিকায় তিনজন তরুণের প্রাণ, প্রেম, আর আবেগ মিশে গিয়েছিল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের প্রাণে আলো জ্বালতে পারে না।

আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ক্ষয় করে দেয়। আমরা যে কিছু করতে পারি সেই বিশ্বাস আমাদের থাকে না। এই প্রথম একজন প্রবীণ যাদুকর তিন তরুণের প্রাণে আত্মবিশ্বাসের আগুন জ্বেলে দিলেন।২০০৩ সনে কেন্দ্রের ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমরা ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করেছিলাম সারা দিন চলছে অনুষ্ঠান। একের পর এক শিল্পী, আবৃত্তিকার, লেখক, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসছেন। চলছে গান, আবৃত্তি,বক্তৃতা।এক ছেলে স্যারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্যারকে সায়ীদ ভাই বলে সম্বোধন করে, পরে ওর চোখ কপালে ওঠে যখন দেখে জাফর ইকবাল ও তাঁর বক্তৃতায় স্যারকে স্যার বলে সম্বোধন করছেন। ঐ ছেলে অবাক হয়ে বলে, উনি জাফর ইকবালেরও স্যার!

স্যরকে খুব নৈকট্যে পাই যখন পাঠচক্রে ঢুকি। এলাকার রাস্তায় রাজ মাসুদ ফরহাদের সাথে দেখা, রিক্সা থামিয়ে জানালো সে কেন্দ্র থেকে এসেছে, কেন্দ্রে পাঠচক্র শুরু হয়েছে। আমি ঢুকব কি না জানতে চাইল। আমি বুঝতে পারছিলাম না পাঠচক্র ব্যপারটা কী তাই কোনো তাগিদ বোধ করছিলাম না। পরে রাজমাসুদ ফরহাদই কী কৌশলে যেন আমাকে দিয়ে ফর্ম কেনাল এবং তা পূরণ করাল,অফিসে জমা দেয়াল।

ইন্টারভিউয়ে আমার ডাক আসার পর আমি ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন কী কী বই পড়েছ, অনেকগুলো বইয়ের নাম বলার পর যখন শেষের কবিতায় এলাম স্যার এই বইটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। শেষের কবিতা নিয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলাম। স্যার জানতে চাইলেন শেষের কবিতার মূল বিষয়টা বলতে পারবে। অত:পর স্যার আমাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কি তোমার এলাকায় কোনো বই নিয়েছ। আমি বুঝতে পারলাম না, ই টা কী ? তিনি বারবার ই,ই করছিলেন। কোনো একটি শব্দ তিনি মনে করার চেষ্টা করছিলেন।পাশের সোফায় বসে ছিলেন আরেকজন, নাম সম্ভবত প্রবীরকান্তি। তিনি জানতে চাইলেন আমি আমার এলাকায় কোনো "উদ্যেগ"(?) নিয়েছি কি না। তাঁর মুখে উদ্যেগ শব্দটি শুনে তাঁর পোষাকের দিকে তাকালাম,স্যুট-কোট পড়া রীতিমতো ভদ্রলোক। আমি তাঁর জুতার দিকে তাকালাম জুতাও পলিশ করা। তবে শব্দটা কি ভুল উচ্চারণ করলেন, দেখেতো মনে হচ্ছে না শব্দের সঠিক উচ্চারণ তিনি জানেন না।আমি তাঁকে পূনরায় প্রশ্নটি করতে বললাম আবারও শব্দটি তিনি ভুল উচ্চারণ করলেন।আমার তখন দ্বিধা হল আমিই কি ভুল করছি।

আমি মাথা নিচু করে উদ্যেগ,উদ্যেগ করতে থাকলাম। দেখলাম স্যার কী যেন লিখতে যাচ্ছে তাঁর হাতে ধরা কাগজে। সহসা আমার মনে হল এটা একটা ফাঁদ হতে পারে আমার জন্য। আমি সঠিক উচ্চারণটা পারি কিনা সেটাই তাঁরা জানতে চাইছেন। তখন আমি হুট করে মাথা তুলে বললাম হ্যাঁ আমি আমার এলাকায় উদ্যোগ নিয়েছি। শব্দটি উচ্চারণ করলাম (উদযোগ)। স্যার জিজ্ঞেস করলেন শব্দটা কী বললে। আমি আবার বললাম উদযোগ।পরে মোবাইল লাব্রেরির সমন্বয়কারী কামাল ভাইয়ের কাছে জানতে পারি ইনটারভিউয়ে যেই ব্যক্তি "উদ্যোগকে" "উদ্যেগ" বলে সেই বাদ পড়ে যায় ।

স্যারকে পাঠচক্রেও দেখতাম কথা বলার সময় তিনি বয়সের ব্যবধান রাখতেন না। যেই ভাবে তিনি জাফর ইকবালের সঙ্গে কথা বলছেন সেইভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমাদের মনে হত না এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছি যার সঙ্গে আমাদের বয়সের ব্যবধান প্রচুর। তখন খুব মৌলবাদীদের তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। এমন এক সময়ের কথা, কিছুদিন আগেই হুমায়ূন আজাদ আক্রান্ত হন।এক রাতে দেখি স্যার কেন্দ্র থেকে বের হয়ে একা হেঁটেই বাসার দিকে যাচ্ছেন।

আমরা কিছু আতঙ্কগ্রস্ত হলাম এবং স্যারের সঙ্গ নিলাম রিক্সা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য। রিক্সা ঠিক করে ভালোভাবে চেক করলাম যদি বোমটোম থাকে। আমাদের আচরণে স্যার খুব বিরক্ত হলেন। পরের ক্লাসে স্যার আমাদের ধরলেন খুব বকলেন। স্যারের সব বিষয়েই ছিল আমাদের আগ্রহ। তাঁর সব আচরণই আমরা লক্ষ্য করতাম আর সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। তাঁর ছিল পেঁপে খাওয়ার অভ্যাস। কেন্দ্রের পাশে পেঁপে গাছ ছিল প্রতি সন্ধ্যায় ঐ গাছের নির্ভেজাল পেঁপে স্যারের রুমের দিকে যেত। কেন্দ্রে কাউকে পেঁপে খেতে দেখলে মস্করা করে বলতাম পেঁপে খেলেই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ হওয়া যায় না।আমার ধারণা ছিল স্যারের খ্যাতি বুঝি ঢাকা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । এই বাংলাদেশে কয়জনই বা বই পড়েছে। যেখানে বাংলামটরের সীমা পার হলেই কাউকে পাওয়া যাবে না শহীদুল জহিরের নাম শুনেছে, রবীন্দ্রনাথের ছুটি আর হৈমন্তী ছাড়া আর কিছু পড়েছে, জীবনানন্দের বনলতা সেন ছাড়া আর কোনো কাব্যগ্রন্থের নাম বলতে পারবে। সেখানে ঢাকার বাইরের কথাতো বলা বাহুল্য।

আমার এই ভুল ভাঙল ২০০৭ সনে গ্রামে গিয়ে। আমার বালকবেলার বন্ধু, যার সঙ্গে কিছুদিন গ্রামের স্কুলে পড়েছি। ও কোনো ভাবে জানতে পেরেছে আমার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া-আসা আছে। ওর কণ্ঠে দেখলাম শ্রোদ্ধা আর সমীহের ভাব।ও স্যারের কথা পারল, ওর নাকি একবার স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন সম্ভবত আরিচায় স্যারকে দেখে ও। তিনি গাড়ি থেকে নেমে যানজটপরিস্থিতি দেখছিলেন। স্যারকে দেখার ঘটনা বেশ আবেগের সঙ্গে বর্ণনা করছিল ও।"উনাকে দেখেই আমার কোন কথা মনে হইল জানো উনি একজন মানুষ" । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ওর মনোভাব। ও বারবার বলছিল "চিন্তা করে দেখ আমার মনে হইয়েছে উনি একজন মানুষ"।স্মরণে পড়ছে না আমার তখন ঐ উক্তিটি মনে পড়ছিল কি না, "পশু-পক্ষি সহজেই পশুপক্ষি তরুলতা সহজেই তরুলতা কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় মানুষ"।প্রথমে কিছুই বলতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল।আমাদের রোদ্রময় দিনগুলো কেটেছে সময়ের এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে যাঁর আছে একটা স্বাপ্নিক মন আর ভালোবাসার হৃদয়।

১১, ০১,১৫ খ্রিঃ