সাহিত্যে সিন্ডিকেশন এর বিন্যাসে এবং মূল ও বিভিন্ন উপধারা নির্মাণে কতটা ভূমিকা রেখেছে? অনলাইন আলোচনা। আয়োজনে ক্ষেপচুরিয়াস-অলস দুপুর অনলাইন আলোচনা প্রকল্প।

Post date: Jan 26, 2013 12:02:08 PM

আলোচক: জিল্লুর রহমান, অত্রি ভট্টাচার্য্য, শুভ মৈত্র, নবেন্দু বিকাশ রায়, পীযূশ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত সরকার, ইয়াসিন ফিদা হুসেন, দুপুর মিত্র, ও আবু জাইদ।

জিল্লুর রহমান: কতটুকু ভূমিকা রেখেছে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে, ভূমিকা রেখেছে এ-বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। তবে, দেখার বিষয়, ঐ সিন্ডিকেশন সাহিত্যের স্বার্থে, নাকি ব্যক্তিস্বার্থে? ব্যক্তিস্বার্থের সিণ্ডিকেশন কিছুই করতে পারিনি। রাজনীতি কেবল পৃথক করেছে; সাহিত্যের জন্য তিল পরিমাণও ভালো কিছু বয়ে আনেনি। সাহিত্যের ছোট-ছোট আন্দোলন কিন্তু সিন্ডিকেশনের ফল।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: আজ-ও বিষয়টির মাথামুণ্ডু কিস্যু বুঝতে পারলেম না ! আলোচনা করব কিভাবে? আচ্ছা, সাহিত্যের আলোচনা প্রকল্পে এইধরনের গসিপ বা নোংরামী ও রাজনীতিসংক্রান্ত বিষয় কি না রাখলেই নয়? ক'টা রেফারেন্স আসবে এই আলোচনায়? কি এমন সমৃদ্ধ হব এখান থেকে? আমি এই ডিসকাশন বোর্ড থেকে আমার নাম প্রত্যাহার করে নিলাম !

শুভ মৈত্র: আন্দোলন মানে কিন্তু সিন্ডিকেশন নয়। সুররিয়্যালিস্ট মুভমেন্ট বলা হয় কিন্তু তাতে ব্যক্তিরা আলাদাই তো ছিলেন। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয় নি। অত্রি, নোংরামি যদি থাকেও, যদিও আমার ধারণা যতটা ভাবা হয় ততটা নয়, সেটা সাহিত্যের ভাবনাতেও ফলিত হওয়া দরকার।

জিল্লুর রহমান: আন্দোলন সিন্ডিকেশন নাহলেও ইহা সিন্ডিকেশন তৈরি করে। শুভ মৈত্র, আপনার সাথে একমত। অত্রি তবে, সাহিত্যের স্বার্থে এ-বিষয়ে কথা-বার্তা বলাটাও জরুরি, নয় কি?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: না,একেবারেই নয়। সাহিত্যের স্বার্থে বরং এসব বিষয় নিয়ে যত কম চর্চা হয় তত-ই ভালো।

জিল্লুর রহমান: ওই ভালো দিকগুলো কীরকম হতে পারে, যেমন...?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: বুঝলাম না প্রশ্নটা !

জিল্লুর রহমান: আপনার মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতায় বলেছিলাম, সিন্ডিকেশন বিষয়ে আলাপে না-বসাটা কী কী ভালো দিক বয়ে আনতে পারে, কিংবা এ-বিষয়ে আলাপ কী কী খারাপ দিক আসতে পারে যা সাহিত্যের জন্য সুখকর নয়?

অত্রি ভট্টাচার্য্য: এভাবে বলি - যে কারণে আমি ডেইলি সোপ দেখিনা বা পরনিন্দা-পরচর্চা করিনা - সেই কারণেই এসব বিষয় নিয়েও চর্চা করব না।

নবেন্দু বিকাশ রায়: minimum কতজন মানুষ লাগে একটা syndicate form করতে গেলে? আমার ধারনা ৩; এই ৩ সংখ্যাটাও মজার। ২ জন মানুষ একসাথে থাকলে একটা অদ্ভুত জিনিস তৈরি হয়ঃ ক্ষমতা। ৩ জন মানুষ ক্ষমতার structure তৈরি করে এবং একটি অলৌকিক জিনিস তৈরি হয়ঃ রাজনীতি। ফলত একটা syndicate বাধ্যতামূলকভাবেই কিছু না কিছু রাজনৈতিক বয়ান রেখে যায়। এখানে আগেই বলে রাখি, এই রাজনীতি কিন্তু broader senseএ। যেমন কৃত্তিবাস গোষ্ঠী এবং হাংরিদের মধ্যের বিরোধিতা। মনে রাখতে হবে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই ধরণের বিরোধিতাগুলো কিন্তু শুধু 'আমি সিপিএম, তুমি তৃণমূল' গোছের নয়। এটা অনেক ক্ষেত্রে নান্দনিক ও আদর্শগত বিরোধিতা। তাই প্রণিধানযোগ্য।

পীযূশ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়: আর কোনো সাবজেক্ট নেই,ধুর!!

প্রশান্ত সরকার: একটা আদর্শগত বিরোধিতা থাকাটা খারাপ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যের পক্ষে লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। তো সেখানে ব্যক্তি স্বার্থটা বেশি প্রাধান্য পেলে তার বহুমুখিনতাও বৃদ্ধি পায়। সে ক্ষেত্রে সাহিত্যের অপর কিছু সময়ে তা বোঝাস্বরূপ বৈকি।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: সাহিত্যের নির্মাণে সিন্ডিকেশনের ভূমিকা আছে এ নিয়ে প্রশ্ন নেই, করছিও না। প্রশ্নটা এখানে যে তা প্রভাবটা কতটুকু ধনাত্মক বা ঋণাত্মক। সাহিত্যের নির্মাণে যারই ভূমিকা আছে তাই আলোচনায় আসা উচিৎ। আলোচনাটা এভাবে এগিয়ে নেয়া যায়। সমসাময়িক এক কবি বিষয়টি এভাবে দেখেছেনঃ "তিরিশের কবিদের যে সচেতন প্রয়াসের ভিতর দিয়া আধুনিকতার শেষ পর্যায় সূচিত হয় বাংলা সাহিত্যে, যাতে বাংলার লোকমানস, ভাবদর্শনের সঙ্গে একটা ছেদ ঘটে বাংলা কবিতায়, তা তো একটা সিন্ডিকেশনেরই ফল। এরা নজরুলকে গ্রহণ করে নাই, গুরুত্ব দেয় নাই জসীম উদদীনকেও। অথচ এদের লেখায় পূর্বকথিত 'ছেদ' অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু তিরিশের সিন্ডিকেশনের ফলে মধ্যবিত্ত, নাগরিক পাঠক যেভাবে কনভিন্সড হইলেন, প্রস্তুত হইলেন, তাতে নজরুল-জসীম খানিকটা অপর হয়ে রইলেন, কবিদের কাছে তো বটেই। এই সিন্ডিকেশনের সহায়তা জীবনানন্দ পাইছিলেন।"

দুপুর মিত্র: সিন্ডিকেট সাহিত্য বলে সম্ভবত বাঙ্গালিরাই নতুন কিছু সাহিত্য জগতে নিয়ে আসল। একেবারে শব্টটির উদ্ভবও সম্ভবত এখানে। এটাকে বিশ্ব সাহিত্যে বড় ধরণের কন্ট্রিবিউশন হিসেবে ধরা যায়।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: সাহিত্যে সিন্ডিকেট বিষয়টা কিন্তু প্রাচীন। বিষয়টা এসেছে দু'ভাবে। একটা হচ্ছে সমায়তনের বলয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেশন, যেটাকে হয়তো কোন কবি/লেখক এককভাবে প্রভাবিত করতে পারেনা। যেমন রোমান্টিসিজম আর রিয়েলিজম এর পরস্পরবিরোধী সিন্ডিকেট। দলগত ভাবে হয়তো এখানে কন্ট্রিবিউট করা যায়, অনেকে আবার উদ্দেশ্যপূর্বক না হয়েও কন্ট্রিবিউট করেন। আরেকটা হচ্ছে, সচেতনে ক্রিয়াশীল সিন্ডিকেট। এখান থেকে নির্মান এবং স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক মুখ্য এবং গৌণ ধারা।

দুপুর মিত্র: আপনি নন্দনতাত্ত্বিক আন্দোলন আর সিন্ডিকেটকে মিলিয়ে ফেলেছেন। সেসবের মেনিফেস্টো আছে। কেন তারা এসব আন্দোন করছে তার ঘোষণা আছে। সেসবকে কেউ কখনও সিন্ডিকেট বলে নি। সিন্ডিকেট বলে যাদের কোনও মেনিফেস্টো থাকে না, কেন সাহিত্য করছে তা তারা জানে না, কিন্তু সিন্ডিকেট করে শুধু নিজেদের স্বার্থে। এটা কেবর চোরদেরই হতে পারে।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: দুপুরদা - অন দ্য কনট্রারী - সিণ্ডিকেট-ই কেন সাহিত্য করছে তা সুস্পষ্টভাবে জেনেশুনে সাহিত্যে আসে। নন্দনতাত্ত্বিক আন্দোলনের অভিমুখ কখনোই সূচনাকালেই স্থির হয় না, র‍্যাদার পুরনো থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য-ই তারা পথ খোঁজে। অর্থাৎ, পথ থাকে না বলেই পথ খুঁজতে আসে ! যে কোন সাহিত্য আন্দোলনের জননী তো দিশাহীনতা, অন্ধকার ! তাই না?

দুপুর মিত্র: বিরোধিতা তখনই করা যায় নতুন পথ তখনই খোঁজ করা যায়, যখন পুরনোকে চেনা থাকে। পুরুনোকে জেনে যাই বলেই আমরা বলে ওঠি না এইপতে আর নয়, এই দেখো নতুন পথ। এভাবে আমরা এগুতে চাই। আসো এভাবে এগুই।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: ত্রিশের কবিদের নিয়ে যে মন্তব্য তাহলে কি তা আমরা মেনে নিচ্ছি?

দুপুর মিত্র: বুদ্ধদেব কি সিন্ডিকেট করেছিলেন নাকি?

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: নাকি তাকে সিন্ডিকেটই বলছিনা?

নবেন্দু বিকাশ রায়: লালন-ও তো একটা সিন্ডিকেট-ই ফর্ম করেছিলেন, না কি?

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: বুদ্ধদেব নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তবে লালনকে হয়তো বাদ রাখা যায়, কারণ তার একক সৃষ্টি সিন্ডিকেট গঠনের প্রক্রিয়াকে ছাপিয়ে গেছে।

নবেন্দু বিকাশ রায়: " বাংলার লোকমানস, ভাবদর্শনের সঙ্গে একটা ছেদ ঘটে বাংলা কবিতায়, তা তো একটা সিন্ডিকেশনেরই ফল। " এটা কি ৩০ এর সিন্ডিকেশনের ফল, সত্যিই? বাংলার যে মানস ও দর্শনের কথা বলা হচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই ২০১২ তে এসে রামপ্রসাদী শুনে আমোদ পাবে না। বা অন্য দিক থেকেও বলা যায়, নজরুল বা জসীম উদ্দীনের যে বাংলা সেটাই যে সর্বৈব তা ভাবারও কোনও কারন নেই। ছেদটা আসলে ছেদ নাও হতে পারে। আর নজরুলের কথা উঠলো বলে একটু বলি। আমার তো মনে হয় নজরুলের সাকুল্যে চার পাঁচটার বেশী কবিতা নেই। বাকিগুলো ওই চারপাঁচটাকেই ফাঁপানো। তো আমি এখন নজরুলের কবিতা পড়ে আনন্দ পাই না। সে তো বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পড়তেও ভালো লাগে না। তাহলে কি বলবো, বুদ্ধদেবের সিন্ডিকেশন সফল? তাহলে তো ওনার কবিতা পড়তে ভালো লাগার কথা। লালন কিন্তু সিন্ডিকেশনের জন্য যা যা করার দরকার সবই করেছিলেন। একটা ক্ল্যান বানিয়েছিলেন, প্রত্যেক বছর ভান্ডারা দিতেন, অনেক জায়গা থেকে লোকজন আসতো। গান- আলাপ- আলোচনা চলতো। লালনের মৃত্যুর পর সম্পত্তি (যার পরিমাণ খুব একটা কম ছিলো না) বিলি- ব্যবস্থা করে যান। লালনের PR তো বেশ প্রশংসনীয় ছিলো বলেই জানি।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: যে সূত্রে লালনকে বাইরে রাখতে বলছি তা হলো, সিন্ডিকেটকে যদি আমরা কিছু সংখ্যক কবির বা লেখকের সচেতন বা স্বত:স্ফূর্ত প্রচেষ্টা বলি তাহলে লালন তা করেননি। উনি নিজের একক মতাদর্শই প্রচার করে গেছেন।

আবু জাইদ: এটা ঠিক না, কারন লালনের মত যাই থাকনা কেন এখনো লক্ষ মানুষ তার মতের হয়ে একটা নির্দিষ্ট ধারার চর্চা করে, এর ব্যাপকতাও বিশাল, একে যদি আমরা সিন্ডিকেট না বলি তাহলে ত বলতে হয় সিন্ডিকেট শব্দের অর্থই পাল্টাতে হবে।

নবেন্দু বিকাশ রায়: আলোচনাটা কিন্তু ঘুরে যাচ্ছে। যাই হোক, লালন নিয়ে কথা বলতে আমি সবসময় উৎসাহী। লালন এবং তাঁর আদর্শকে একক ভাবলে বোধহয় একটু ভুল হবে। আসলে শিল্পীকে একা ও একক হিসেবে পশ্চিমই প্রথম গ্লোরিফাই করেছে। বাংলায় কিন্তু সেটা ছিলো না। শিল্প এখানে অনেকটা সমবায় ছিলো। একই ধরণের দোঁহা, বৌদ্ধগান, পাঁচালি,পটচিত্র ও ছড়া একশ দু'শ বছর ধরে চর্চা চালিয়ে গ্যাছেন আমাদের লোকায়ত কবি-শিল্পীরা। এখনো বাঙালি সংকলন করতেই সবচে' বেশী ভালবাসে যার প্রতিফলন ঘটে চলেছে লিটিল ম্যগগুলোতে। আমি তো মনে করি লিটিল ম্যাগ বিষয়টা গোটা মানব প্রজাতিকে বাঙালির উপহার। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে কলেজে এত পত্রিকা বিশ্বের আর কোথাও নেই বোধহয়। এগুলো এক ধরণের সিন্ডিকেট বলা যায়। লালনের আগে এবং পরেও বাংলার নিজস্ব সহজিয়া অধ্যাত্মিক চেতনা ছিলো। লালন একক মতাদর্শ প্রচার করেননি। তিনি অনেকগুলো মতাদর্শকে এক সঙ্গে গেঁথেছিলেন। লালন তাঁর গানের মধ্য দিয়েই তাঁর পূর্বসূরিদের স্বীকৃতি জানিয়েছেন যেটা সেই সময়ের একটা বিশেষত্ব ছিলো। লালন যাদের আদর্শ সংগঠিত করে নিজে সাঁই হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্যে শ্রী চৈতন্য,হজরত মহম্মদ ও সিরাজ সাঁই বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বসন্তকুমার পালের লেখা থেকে জানা যায় লালনের আখড়ায় গান ও কবিতার চর্চা ভালোমতই হতো। লালনের আখড়া থেকে অধুনাবিস্মৃত অনেক বাউল/লেখক তখন বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। প্রতিটি সিন্ডিকেটের প্রিমিয়ারের মতই লালনও তাঁদের উৎসাহ দিতেন। কাঙাল হরিনাথ এর মত মেধাবী মানুষ এই সিন্ডিকেটের থেকে গানের ভাব ও ভাষা নিয়েছিলেন, ফিকিরচাঁদী গানের একটা ট্র্যাডিশন শুরু হয়ে গ্যালো যার থেকে পরবর্তীকালে প্রভাবিত হবেন মীর মোশাররফ হোসেন ও রজনীকান্ত সেন। এমনকী আরও পরে গণসংগীতের ভূমিকায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস লালনকে রেফার করবেন। বাঙালির এই অমূল্য সিন্ডিকেটটি লালনের একার ছিলো না কখনোই। লালনের স্বীয় আদর্শও বোধহয় এই একক মতাদর্শের বিপরীতে থাকবে।

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: নবেন্দু বিকাশ রায়, ছেদটা আসলে ছেদ নাও হতে পারে। - সহমত। ... "আমার তো মনে হয় নজরুলের সাকুল্যে চার পাঁচটার বেশী কবিতা নেই। বাকিগুলো ওই চারপাঁচটাকেই ফাঁপানো।" - এটাকে আপাততঃ হাইপোথিসিস হিসেবে ধরে নেই। আপনার উল্লিখিত "চার পাঁচটা" কবিতা যদি নির্দিষ্ট করেন, তাহলে আমরা খুঁজে দেখতে পারি এর চেয়ে বেশি কিছু আছে কিনা। তবে, আমার ব্যক্তিগত মত, নজরুলের কবিতার ব্যাপ্তিকে এত ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। প্রক্রিয়াগত দিক থেকে হয়তো বুদ্ধদেবের সিন্ডিকেশন প্রচেষ্টা সফল। কিন্তু সুখপাঠ্যতার দিক থেকে তা কতটুকু সফল তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। নন্দনতাত্ত্বিক আন্দোলন আর সিন্ডিকেটকে তখনই মিলিয়ে ফেলা মনে হবে যখন "সিন্ডিকেট" শব্দটিকে নেগেটিভ অর্থে নেয়া হবে। আমরা যদি সিন্ডিকেট বলতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের কিছু কবি/লেখকের উদ্দেশ্যপূর্ণ বা স্বতঃস্ফূর্ত সাহিত্য প্রচেষ্টা বুঝি তবে তাতে নন্দনতত্ত্বের সাথে মিলিয়ে ফেলার সুযোগ থাকেনা। নেগেটিভ অর্থে বললেই বলা যায় এর কোন মেনিফেস্টো নেই, কিন্তু মেনিফেস্টো তো থাকেই, তা যে অর্থেই হোক।

নবেন্দু বিকাশ রায়: বুদ্ধদেব সুখপাঠ্য কে বললো? আমি তো বলিনি। বুদ্ধদেবের সিন্ডিকেশন নিয়েও একটা কথা বলিনি। বরং বলেছি যে আমার বুদ্ধদেব বসু পড়তে ভালো লাগে না। কিন্তু ৩০ এর সিন্ডিকেশনের কারণে নজরুল বা জসীম উদ্দীন হারিয়ে গেলেন এটা মানতে পারছি না। আর নজরুল এর কথা? থাক্‌। সেটা অন্য একটা বিতর্ক। (আমার তো এও মনে হয় যে নজরুলের কবিতায় মাত্র একটা দু'টো লাইন ভালো থাকে আর বাকি কবিতাটা ওই একটা দু'টো লাইনের ভাবসম্প্রসারণ বা ফেনানো। কিন্তু নজরুলের গদ্য আমার দুর্ধর্ষ লাগে। গতিময়। বক্তব্য আছে। যাই হোক, এটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।)

ইয়াসিন ফিদা হুসেন: "৩০ এর সিন্ডিকেশনের কারণে নজরুল বা জসীম উদ্দীন হারিয়ে গেলেন এটা মানতে পারছি না।" একথাটাও কিন্তু আমি বা উক্ত কবি কেউই বলেননি। আমাদের বক্তব্য ছিলোঃ সোহেল হাসান গালিবঃ... 'তারা পশ্চিমরে আবাহন করছেন তাদের উপনিবেশিত চিত্তের কারণে। জনসংস্কৃতির যে সম্পৃক্ততা বা যে জনসংযোগের ওপর দাঁড়ায়া জসীম বা নজরুল কাব্যে লোকমান্যতা অর্জন করছিলেন, তাদের নন্দনতত্ত্ব সেইটারে খারিজ করছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন নাই বা চান নাই, তাদের সাহিত্য তাদের আরও সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে নিয়ে ফেলছে। স্বদেশের বড় একটা অংশের সঙ্গে ছেদ ঘটাচ্ছে। এই ছেদ অতিক্রমের জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। প্রথম দিকে নজরুলকে এদের অনেকেই অনুসরণ করেছেন বটে। কিন্তু তাদের জীবনবোধ বা রুচি সেই পরিমাণে জনসম্পৃক্ত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দও এই আফসোস করেছেন : ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন হওয়া দরকার। সুধীন দত্ত বলেছেন : সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালি।এই কারণে নজরুলকে অপোজ করার দরকার ছিল তাদের। এবং সেটা নিজেদের সাহিত্যের পথ প্রশস্ত করতেই।'

প্রথমে উপনিবেশিত চিত্ত প্রসঙ্গে বলি, ত্রিশের দিকে যারাই একটু পশ্চিম সাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছেন, তাদেরকে কেন উপনিবেশিত চিত্ত বলা হয় আমি বুঝি না। তারা উপনিবেশিত চিত্ত হতেও পারেন, আবার নাও পারেন। এটা কি শুধু ঔপনিবেশিকতার যুগে তারা সাহিত্যচর্চ্চা করেছেন বলেই। আজ আমি যদি পশ্চিমা সাহিত্যে প্রভাবিত হই, আমার কবিতাকে তো উপনিবেশচিত্ত বলা হয়না, বরং কোথাও কোথাও আধুনিক বলা হয়। ... বিশ থেকে ত্রিশে সাহিত্যে ট্রানজিসানের ব্যাখ্যা আমরা নজরুল আর জীবনানন্দকে সামনা-সামনি দাঁড় করিয়ে করতে পারি, আবার অন্য কোনভাবেও হয়তো করতে পারি। নজরুলের সব্যসাচী সাহিত্য-প্রতিভার সামনে জীবনানন্দকে দাঁড়া করিয়ে ট্রানজিসানের ব্যাখ্যার প্রচেষ্টাটাও তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হইতে পারে।

আব্দুল্লা জামিল: সিন্ডিকেশন সাহিত্যে অবদান রাখছে কিনা বা কোনো ধারা সৃষ্টি করছে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত মতামত, গোষ্ঠীর স্বার্থেই বরং সিন্ডিকেশনের সৃষ্টি হয়। এতে অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

অত্রি ভট্টাচার্য্য: হ্যাঁ, সেই অর্থে আমাদের নবজাগরণটাকেই তো উপনিবেশিত চিত্ত বলে দেগে দেবার কথা, তাই না? তাছাড়া বঙ্কিম নিজেও তো ইংরাজী উপন্যাস দ্বারা প্রভাবিত !

নবেন্দু বিকাশ রায়: এইবার পরিস্কার হলো, প্রেক্ষিতটাই ধরতে ভুল করছিলাম।