কবিতা
নাসরিন সুলতানা
৩. আমি ঘুমুতে পারিনা
সহস্রাব্দের নিষ্ঠুরতা
আমাকে অনুক্ষণ ক্ষত-বিক্ষত করে ;
আমি ঘুমুতে পারি না।
আমার দুটো শ্রান্ত আঁখি
তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে,
মুহূর্তেই বীভৎস স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি ;
আমি ঘুমুতে পারি না।
মানুষ তো আমি !
কে বলবে এই কথা মিথ্যে ?
জেগে জেগে কত যে স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন !
দেখি আর ভেঙে যায়,
ভেঙে যায় আবার শুরু করি।
স্বপ্নের এই ভাঙা-গড়াতেই দিন চলে যায় ;
আমি ঘুমুতে পারি না।
২. মাক্কি আমার মা
মাক্কি,তুমি কেমন আছ জানতে ইচ্ছে করে,
দু'চোখ ভরে তোমায় শুধু দেখতে ইচ্ছে করে।
তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে,
পরান ভরে তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে।
তোমার মুখে সুখের হাসি দেখতে ইচ্ছে করে,
তোমার কোলে সারা জীবন বাঁচতে ইচ্ছে করে।
রাসেল শাহরিয়ার
শিশুপাঠ্য
ব্যাঙাচির জীবনচক্রের মতো শিশুপাঠ্য জলমগ্ন দিনে -
ডোবা-পুকুর-নদী-সমুদ্র অথবা হাঁড়িতে ফোটানো
জলজ জ্বলন্ত আত্মা থেকে বাস্পভুত হয়ে
জগতময় পরিভ্রমণ শেষে -
মেঘেরাও একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র সম্পন্ন করে ।
আমাদের পাখি পোষার মেঘলা যুগে -
'খাঁচায় পুষতে চাই সুন্দরের সকল ধারণা । কিংবা,
পাখির ডানায় উড়ুক মুক্ত প্রাণের স্লোগান ।'
এ বাক্য দুইয়ের ভেতরকার যে দ্বন্দ্ব -
সেখানে দুলতে দুলতে স্কুল পালিয়ে কি যে আনন্দ পেয়েছি ;
আজও নীতি গ্রন্থের কাছে গেলে সেসব ভাবি ।
স্কুল পালিয়ে, ক্রমশ বাস্পভুত হয়ে, ব্যাঙাচির জীবনচক্র দেখতে দেখতে,
পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার চিন্তার শৃঙ্খল খাঁচায়, অথবা
বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে আমরা বৃষ্টির মতো ঝ'রে পড়তাম ;
মুষল ধারে ।
মেঘলা দিনের প্রসঙ্গ
জমিছে মেদুর মেঘমালা । দুই তিন অথবা আরও বেশি দিন ধরে
দক্ষিণের বিনম্র ঝাঁঝালো বাতাস জালের মতো টেনে টেনে আনছে মেঘ ।
সারাদিন প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম, বাতাসও বন্ধ ; তাপে তাপে জলকণা--জলীয়বাষ্প
প্রসারিত - দীর্ঘ - দীর্ঘশ্বাস - সীমাহীন, অসীম ।
স্টেশনের ধুলোবতী পাগলের মাথার মতন এই ধুলোময় গোলকের জালে আছে যে যার তাপে ।
স্টেশন, লোকালয় ; রেলগেট পেরিয়ে তির্যক বালিকাদের চোখ - মেঘলা মহুয়া - আগুন আগুন - কৃষ্ণচূড়ায় ;
মায়েদের মুখে টেনে দেওয়া আতঙ্কের আঁচল ।
সিঁড়িপথে মাকড়সা বুনছে জাল,
বুনে যাচ্ছে ক্রমশ - মেঘে মেঘে - বৃষ্টির সম্ভাবনায় - আটকে পড়া পতঙ্গে - আহার্য ;
আহা, জীবন-যাপন ।
দুই তিন অথবা আরও বেশি দিন ধরে যারা বসে আছে পৃথিবীর তাপে তাপে,
ট্রেনে ঝাকুনির গতিময় দূরে - শেষরাতে বৃষ্টির অপেক্ষায় ; যারা জেনেছে ,
ঝড়-বৃষ্টি কিম্বা সে সব প্লাবনের গল্প -- নূহের নৌকা -- জোড়ায় জোড়ায় প্রাণীসকল -- প্লাবন প্লাবন ;
প্লাবনের শেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জগতময় সিঁড়িপথে মাকড়সার জালে পতঙ্গের আজন্ম আতঙ্কে...
এমন এক মাকড়সার জালের ছবি আঁকতে আঁকতে আমার সমস্ত আষাঢ়ের দুপুর।
সুমিত রঞ্জন দাস
পত্রপাঠ
১ম ভাগ
ইদানিং তোমার কথাগুলো বদলে যাচ্ছে,
সেই পরিচিত গন্ধে আমার আর ঘুম আসে না ।
লুকানো নেশার মত না পাওয়ার কষ্ট
তোমাকে এখন কুরে কুরে খাচ্ছে,
তোমার কবিতায় স্থান পেয়েছে
অবসাদ, মৃত্যু আর প্রিয়ার সহাবস্থান,
কোনদিন প্রেমের কবিতা তো তুমি লেখোই না ।
: ঠিক বলেছিস তুই, দেখছিস না
আমার দরজায় পোঁতা আছে কালের শেষ খুঁটিটা -
দৌড়ে পেরিয়ে গেলেই সব অতীত, ভবিষ্যতের স্বপ্ন শেষ ।
জানিস,
এখন আমার একমাত্র সঙ্গী নৈ:শব্দ,
আমার সাথে কথা বলে,
কষ্ট পেলে আমাকে ভোলায়, বলে
এবার তাহলে "একলা একলা পথ চলা"।
আমি তো কোনদিন বন্ধুত্বের দাবী রাখিনি,
শুধু রাত্রির কাছে চেয়েছিলাম - একটা সুন্দর ঘুম
আর পরিযায়ী পাখিদের কাছে একটা রঙীন স্বপ্ন;
তবু কেন উচ্ছাসের নদী শুধু একটানা বয়ে যায়
দু-পাড়ের ছায়াছবি স্থির-নির্বাক হয়ে যায় ?
আর আমি, এখনও ঘড়ির কাঁটার লেজ ধরে
প্রাণহীন চর হয়ে পড়ে আছি তার অপেক্ষায়।
২য় ভাগ
আজ সকালের ডাকে একলা হেঁটে এলো -
ভালোবাসার সীলমোহরে জড়ানো একটা খাম;
ভিতরে পেলাম ফেলে আসা অভিমানের মোড়কে
শুকিয়ে যাওয়া একটা লাল গোলাপ, হয়তো
কোনদিন তোমার আগের লেখাগুলোর মতই সতেজ ছিল,
রাতের পাহারাদারের মতই চিৎকার করে বলতো
সব ঝুট্ হ্যায়, সব ঝুট্, মুখোশের আড়ালেই যত মিল ...
আর কতদিন তুষার ঢাকা তুঁষের আগুন হয়ে জ্বলবে
তোমার সেই কলঙ্কিনী বিরহিনী ব্যাথা ?
বসেই থাকি, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির বুকে কান পেতে -
একটা হঠাৎ বিস্ফোরণ যদি হয়ে ওঠে কবিতা ।
: আজকাল তুই বড্ডো অবুঝ হয়ে উঠেছিস -
বুঝতে পারছিস না, এ হলো নেশা, শুধু নেশা,
সর্বনাশা মারিজুয়ানার মতো নেশায় বুঁদ,
বাইশটা শ্রাবনেও না মরে বেঁচে থাকা
বিরহী হৃদয়ের ক্লান্তি, যদি একটা শান্তির ঘুম ...
আজো অসমাপ্ত একটা ছবি,
পাতাবিহীন গাছে লাল পলাশ,
নগ্ন প্রেম, দাঁড়িয়ে আছে একঠায়,
ক্যানভাসের পিছনে উঁকিমারা আকাশটা
যেন জীবনের ডাকে উঠে যাওয়া
মানুষটার একটা পোড়ানো হৃদয় ।
আর আমি, সিগারেটের ছাইয়ের মতো বসে আছি
সেই পোড়া অবয়ব নিয়ে, দমকা হাওয়ায় ঝরে পরার অপেক্ষায় ...
৩য় ভাগ
বুঝলাম হারিয়ে যাওয়া কোন কিছুই ফিরে আসে না
শরীরের নিঃশ্বাসের মতো হারিয়ে যায় চিরতরে।
আজ আমার কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা নেই, সবই সয়,
উচ্ছাসে ভরা প্রানোজ্জল তোমার লেখাগুলোর জন্যেও নয় ।
কে জানে বিকেলের কাছে ঝলসে যাওয়া দুপুরের কান্না
তোমার ছোঁয়ায় কাগুজে নৌকায় ভেসে আসবে কিনা আমার কাছে ...
: আজকাল শব্দের আকাশেও সূর্য অস্ত যায় -
মাঝে মাঝে রাত বাড়লে চিন্তাগুলো আটকে থাকে
দুটো দাঁড়ির মাঝে, হয়তো শব্দ খুঁজে বেড়ায় ভাবাবেগে ।
চোখের সামনে দোল খেতে খেতে চলে যায় বর্ণমালা
মগজে কারফিউ, বাউলের একতাড়ায় কেবল দেঁহাতি সুর,
আঙ্গুলের মেরদন্ডে উতরে যায় মহাকালের পথচলা
প্রেমের কবিতা সেখানে কোমরের ডেনিম থেকে অনেক দুর।
বিকেলের সূর্যরেখার বেস্ট স্ট্রোকগুলো যেখানে
বনের ফাঁকে ফাঁকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এসেছে,
কিম্বা মোটা গাছের গুঁড়িতে আলপিন দিয়ে লেখাটা
যেখানে এখনো "তোমারে বেসেছি ভালো“ বলছে,
কিচিমিচি শব্দে যেখানে পাখিরা গাইতে চাইছে
ভালোবাসার গান, মনের আলেয়ার আলোতে
বরং সেখানেই না হয় বেঁধে নিস নিজেকে,
জুতোর ফিতেবাঁধা রোদচশমার স্মৃতিতে ...
আমি না হয় ততদিন ভালোবাসার সেলাইমেশিনে বুনে যাবো
বন্ধুত্বের নকশিকাঁথা, এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফুটিয়ে তুলবো
সৃষ্টি-অবসাদ-মৃত্যু আর নিঃসঙ্গতা,
ঢেকে ফেলবো প্রথম প্রেমের লাশটা
আমার কবিতা তোমাকে দিয়ে ...
৪র্থ ভাগ
আজকাল তোমার চিঠি না পেলে ভালো লাগে না,
বিকেলের পড়ন্ত লালচা রোদে পিঠ দিয়ে ...
না, কারোর জন্য কিছু বসে থাকে না, আমিও থাকি না,
সময়-স্রোত-ইচ্ছা-স্বপ্ন, আমি না চাইলেও যায় চলে ।
এখন আমি আধবোজা চোখে বেশ দেখতে পাই
তুমি আর তোমার বিরহ কে, একদম পাশাপাশি;
সময়ে-অসময়ে বুকফাটা যন্ত্রনা অস্থির করে আমাকে,
বলে - সর্ব্বনাশি, আমি কি তোকে ভালোবাসি ?
: ঝিমিয়ে পড়া সময়টা যে বড্ডো বেমানান আমার কাছে,
কখন যে মনের ফাঁক-ফোকরে তুই ঢুকে যাস্
আর গোলাপ হয়ে লুকিয়ে পড়িস মনের বাগানে,
আমি হিসেব রাখতে পারি না বলপেন আর কাগজে।
শুয়ে শুয়ে তাই ভাবি - সময় মানেই এগিয়ে চলা
পাহাড় যেমন মিশে যায় নীলে দুই বাহু প্রসারিত করে,
দুর্গম খাদ বেয়ে যেমন গড়িয়ে নামে উন্মত্ত ঝর্না
রূপের অঝোর ধারায় আমার সবকিছু তছনচ করে;
জানিস পাগলী,
সেই ঝর্ণার বুকের মাঝে আছে একটা কষ্ট জমা পাথর,
সময়ের সাথে একদিন রাশি রাশি বালিকণা হয়ে
ভেঙে পড়বে তোর চোখের কোনে,
তখন নাহয় ফেলে দিস
ঠিকানা না রেখে ।
৫ম ভাগ
তোমার চিঠিগুলো হয়তো একদিন
সমস্ত সৌরভ বিলিয়ে স্মৃতি হয়ে যাবে ।
কে জানে তোমার কথা ভেবে তার আগেই
আমিই হয়তো শেয হয়ে যাব কোনদিন,
সেদিন ঠাঁই নেব তোমার লেখায়,
সাদা ক্যানভাসটা হয়ে উঠবে রঙিন ...
একটাই অনুরোধ, শেষের সেদিন যেন
কালি-কলমের এই সম্পর্কটা অটুট থাকে,
ইতি টানলেই তো সব স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে যাবে ।
: জানিস, ইদানিং আমি বড্ডো স্বপ্ন দেখি ...
একটাও স্বপ্ন সত্যি হবে না জেনেও
আমি সত্য গোপন করে মগ্ন থাকি জীবনের গল্পে,
তোর লেখনীর মন-ভোলানো রূপে উন্মাদ হয়ে
এই আমি - সারাটা জীবন ঘুঙুর পায়ে যাচ্ছি নেচে;
চারিদিকে বিকটাকার নৈশব্দের নীল আগুন,
রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ সব অদৃশ্য, স্বপ্নের মরুভুমিতে
আত্ম অনুভুতির অর্থহীন মেঘ শুধু উড়ে চলেছে,
আর আমি অন্ধকারে একা, উদ্দেশ্যহীন বিষন্ন ছায়াতে ...
সম্বিত ফিরেই দেখি তোর পাশে আমারই মত একটা কে?
বন্ধু ভেবে তোর প্রগলভতা - আপন মনে ভেসে চলেছিস
নদী-পাহাড়-অরণ্য ভালোবাসার কথায়, হাঁসছিস কাঁদছিস,
ওটাই তো আমি, তোর ছায়া, যাকে তুই ভালোবেসেছিস;
তুই হয়তো
তোর ভালোবাসাকে ভুলে যেতেই পারিস,
কিন্তু তোর ছায়া,
চেষ্টা করে দেখবি দুরে সরিয়ে দিতে পারিস কিনা?
তখন না হয় আমি প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়ে
প্রেমহীন অন্ধকারে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতরে খুঁজবো ডাঙা ...
৬ষ্ঠ ভাগ
মনের অন্ত:পুরে আমার এখন বিষাদের নৃত্যনাট্য
দ্রিমিতাক মাদলের ছন্দে শুধু অতীতের পটভুমি;
একটা কথা রাখবে, যেন ভুল বুঝো না আমাকে,
আর পাঠিও না এরকম হাহাকারে ভরা চিঠি।
আজ সকালেই খুঁজে পেলাম তোমার পুরানো খাতাটা,
প্রথমেই সেই লেখাটা -
তোমার ছোঁয়ায় যদি বদলে যায় এ জীবন,
অনুভবে যদি ফিরে পাই সে অমরত্ব,
তুমি তো অধরা নও, শুধু প্রেমের শিহরণ
বাঘবন্দি নিয়মে বাঁধা মানবীয় এ শরীর
একটিবার ছুঁয়ে যাবে, করে যাবে সমর্পন।
কোথায় হারিয়ে গেছে সেই লেখাগুলো, হয়েছে অন্তর্ধান
তাকে কি ডেকে নিয়ে গেছে আজ অন্য কোনো অভিমান ...
:পাগলী, অরণ্যের মাদকতা - সে ফেলে আসা পথে,
কুড়িয়ে নেওয়া যত ঝরে পড়া শব্দফল
জমিয়ে রেখেছি যত্ন করে কলমের খাঁজে,
যদি কখনো ভাসিয়ে দেয় তোর চোখের জলে ....
আজ শহরের নির্জন রাস্তায় হাঁটছে আমার সব ভুল
মনের অন্তর্বাস ছুঁয়ে আছে জমে থাকা যত জল,
প্রতিটি অঙ্গে আজ শুধু অপেক্ষা -- দূরের বিলাসী
হে মহিয়সী, আমি যে তার সুদুরের পিয়াসী।
জানি সব শেষ হয়ে গেছে অথবা হয়নি শুরু কিছু,
জীবনের নিরর্থকতা প্রেমহীন থেকে অর্থবহ হয় শুধু;
তবু তহবিলে গচ্ছিত রাখি সব স্মৃতি, বিদগ্ধ জোনাক --
কালো রাত শেষ, আবার শুরু হবে নতুন প্রেমের সকাল ।
আরিফ হাসান
জলডাঙা
কী কথা বলার থাকে
সব কাজ বন্ধ করে
তোমাকে হৃদয়ের কোন কাজহীন দিবসের
সব ক্লান্তি
হৃদয়ের সব লেখা জোখা
দেখাতে ইচ্ছা হয় অথচ পারিনা
পৃথিবীর রাজ্যের সব রাজকণ্যা
একদিন ডানা মেলে
ভর করে আমার মেধার ভেতর
তোমার দুঃখগুলো কখনো
বুঝতে ইচ্ছে করেনা
এই রাজসভায় একান্ত বিচারক আমি
অতঃপর তোমার হন্তারক পিতা
তোমার কাহিনী জেনে কী আর অমেয়
জলের তৃষ্ণা থেকে যায়
অস্বচ্ছ জলের কাছে
যেমন যেতে ইচ্ছে করেনা
আমার সকল ইচ্ছাগুলো
ঘুম যায় আমার জানালায়
অদেখা শৈশব
ছিলনা ডাকহরকরা দইওলা
ছিল জলপাই
শ্যাওলা পুকুরঘাট
শানবাঁধানো—
আমার আশ্চর্য ছেলেবেলা
কখনো তোমার কাছ থেকে
ক্রমশঃ দূরে নিয়ে
এ রাজসভার একান্ত বিচারক আমি
আমিই অতঃপর জারীকারক
ঘোষক সবই আমি এ রাজসভায়
শোনাতে আসিনি
শুনতে এছেছিলাম শুধু বিশুদ্ধ
সংরাগ ছলাকলার বোকা কাহিনী
গুলো
শুনলে তুমি খুশি হও বলে
আদতে নিজ থেকে বেশী
আমরা পরস্পর ভালবাসিনি
কখনো
এইসব
সত্যগুলো আমরা জেনেছিলাম
বহু আগে
মাসুদ ভাইর সাথে কাটানো
কাহিনীগুলো
গল্প ফাঁদার আসল
উদ্দেশ্য নিয়ে ছিল
প্রচন্ড হেঁয়ালী; এমনই জীবন
আপন মিথ্যা অহঙ নিয়ে আশাহীন
বেঁচে যেতে শিখে নিতে হয়
নিশি পাওয়া মানুষের
হাওয়ায় যে হারিয়ে গেছে
খ্যাতি যাকে করেছে তিরস্কার
ভুলভুলাইয়ায় পথ ভুলে
বিভ্রমে কেটে গেছে
আমার সকল পরাজিত সময়
যৌবন বেদনার মত ফল
ঝরে গেছে
জৈ্ষ্ঠের ভেজা বাতাসে
কার বাঁশী কানে
কী কুমন্ত্রণা আনে
তোমার মিথ্যা ছলনা তবু মনে করে করে………
২
যদি দেখি
তোমার রাজ্য ছাড়া ঝরে না কেয়া
সময় বেজে যায় যায়
অস্বীকার করেও দেখি মৃত মানুষের মুখ
তোমার বৃষ্টিবেলায় আমাকে
গুমখুন করে গেছে
ঝরে পড়তে হল শেষ বকুলের মত
অবশেষে ঝরে যেতে
আমারও ইচ্ছে গুলোও
মরতে মরতে বাঁচতে শিখল সারারাত
জ্বলে থাকা
জ্বলতে থাকা নক্ষত্রের মতন………
পার্থ প্রতিম রায় এর কবিতা
হয়ত
আমার খাটের চারদিকে অপেক্ষারত সময়কে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি বারবার ,অনুভূতি দ্বারা কিছু বোঝতে চেষ্টা করলেও...
আমি তাকে নিষ্ঠুর ভাবে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলি...
আজ এখন ওই সময় আর আসেনা,হয়ত আর আসবেও না ...
তবে এখন আমি পরিনত হয়েছি মানুষ রূপী প্রেতাত্মা ...
নষ্ট হওয়া কিছু পায়ের ছাপের মতো, আমিও নষ্ট হতে চলেছি...
আমি
আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা ,
আমার নষ্ট জীবন ....
আমার বেহিসাবী ভালবাসা ,
আলোতে হারিয়ে যাওয়া শহর ...
মেঘলা আকাশের, মেঘ হয়ে
ফিরে এসবই তোমার জীবনে
দ্বিধা
এক একটি সময় পার হওয়া,
কিছু স্রোত ধরে রাখা ....
পাথর দিয়ে থেতো করা হলো
কয়েকটি কথা ...!
পাতায় রাখা একফোঁটা বৃষ্টির জল ,
উপমা হয়ে হাঁটছে...
বিশ্বাসের মধ্যে লুকিয়া থাকা ঘাম ,
যার ওজন জানা নেই।
মনের গুল্মলতাগুলো একটু
অবলম্বন চাইছে
মেঘের ওপর আঁকা নক্সাখানি
তোমার পরশে মিলিয়ে গেল ....
ক্ষয়
ডাক, অস্থি মজ্জায় ঘ্রাণ..
শব্দের হাতছানি
মনের সত্তা আবছা নীল...
মন,
মুখের এঁটো কথা
হিংসার আলনাতে
ঝোলানো ....
তৃষ্ণা মেটানো হলো সকালের ....
আত্মভোলা মেঘ বার্তা নিয়ে এলো
সর্বহারা সংশয় ...
মাটিতে কুড়িয়ে পেলাম
ভালোবাসার দানা ..
দিবাকর মজুমদার এর কবিতা
আমার ভয় পাখি
চুপচাপ শুয়ে আছি-
হৃদপিন্ড চকিত ভয়স্পন্দিত, অন্ধকারকে নিতে না করে,
বিগত সময় স্বাধীন স্মৃতি ডাক পেলে ফিরে আসে,
কিছুক্ষণ
পাখির মতো বসে ফিরে যায় অন্য খাবারে-
আমাদের অভিনীত গল্পে কে রাজা?
তার চেয়ে খুঁজি বরং নিজের শ্রাবণ- লোভী সময়ের নোলায়
গৃহিনীর গরম খন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে ফিরে পাই না থাকার উৎসাহ;
ফুটছে জঘন্য সুন্দর-
এতো যে শান্ত সৌম্য কথা, যথাযথ অক্ষয় বচন, নিমগ্ন দেখার প্রলাপ,
পরিমিত প্রিয় নিরবতা, উৎসারিত রূপবান, এতো- অমোঘ সনঞ্চারনে
কলমুখর নিরর্থে পর্যবসিত; নদীর ধারাবাহিক বর্ণনা সাগর দেখিল-
চেচাচ্ছে অসংখ্য শৃঙ্খলা অথচ বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতার সমাপ্তি নেই,
সেহেতু কিবা আসে যায় অধম পাথর হলে বা নাহলে কিছু; তবু,
তবু’কে ভাঁজ করে রাখবো কোথায়?
অন্ধকার শেষত প্রবেশপথ পেয়ে যায়,
বেহুদা স্পন্দন থেকে উড়াল দিয়ে ভয় সম্ভাব্য সকল প্রকল্পে ঠোকর দিয়ে
ফের হৃদপিন্ডে ফিরে আসে- এখানেই স্থায়ী নিবাস তার,
স্মৃতিরা অস্থায়ী যেখানে???
পলাশ
কে বুঝবে অভিমান,তেমন সূক্ষ পুরুষ আছে নাকি পৃথিবীতে; সভ্যতার অনুরুপ কামনাও মার্জিত হয়েছে- বিশৃঙ্খল শাখা বিস্তারের অপরাধ, বনস্পতির সুষমায় পেয়েছে শিল্পিত ক্ষমা; ব্রহ্মতালুর নীচে, মগজের গারদে অপেক্ষাতুর শিকারী কুত্তার মতো এক সমুদ্র ঘেউ ঘেউ বেগ, পেয়ে গেল ঘনশ্যাম পাতার আবেগ- জলপাই রঙের কমরেড, থোকা থোকা, সভ্যতায় বিন্যস্ত শক্তির মাদকতা- রণজিত; আমি জানিনা, কেন তাকে, বর্বর প্রিয়তম সে, ভালোবাসি- তার জামকালো বুকে মাথা ঠুকে ঠুকে, কামনার অন্তিম দরজা, কে খুলেছে! ... কে খুলেছে…
কে রেখেছে পলাশ সবুজ বমিতে-
তার স্থান নেই প্রাণের উলালে, সভ্যতার মার্জনা পাবে না সে, আরশের পুরুষের কাছেও আলাপ রহিত, তার; তাই লাঞ্ছিত অভিমান ফুটেছে , ব্যাকুল নীলের কাছে...
মা; আমরা
অন্ধকারকে শব্দ দিতে চেয়েছি, মায়ের চারপাশে প্রচারিত হয়েছে বেহুদা গুনঞ্জন, পদার্থের পর পদার্থ বিশিষ্ঠ ক্ষমতায় পেয়েছে মমতামাখা নাম, গৃহের সে প্রান্তকে ছায়া পতনে ক্লান্ত বলে মনে হয়, পর্বান্তরেভুলে যাওয়া সমস্ত তুচ্ছতা পাশাপাশি, অর্ধচেতন; আমরা অনাথ- অন্ধকারে অদ্বিতীয় খুঁজি, ভিজতে চাই কর্ষিত জমির মতো বিপথগামী; অর্ধোস্ফূট সত্যের উন্মার্গী ভাষা বিরাট আলোড়ন চায়- মায়ের শরীর থেকে আলো নিয়ে এইসব হয়েছে, উৎসবের বাজী রূপে ফুটে যায় অন্ধকার, উৎসাহিত আলোর বয়ানে- এখন পালাবে ঘুম, সর্বত্র ঢেলে পড়েছি আমি, তবু খোঁজ জারি…অধিক উজ্জ্বল দ্যুতির শ্বাসক্রিয়া নিরাকার অধীরতা থেকে আসে; তাকে রুপ দেই, অচীন পদার্থ সে, তার প্রানে নেতি অনুরাগ, বস্তুবিশ্বে পরিচিত ইতি আমরা- মায়ের কাছে হয়েছি নিষিক্ত, বণ্যার মোতো অবুঝ স্বৈরাচারে আনন্দিত, তবু আরো নিঃশব্দ লিপ্তির জন্য বিষাদ, ক্রোধের সঞ্চার, হাটুভাঙা কান্না- নোবিতার...
একটি স্বপ্নের বর্ণনা, আবেগ ও ইশারা
অপরাধ শরীরে রেখে ঘুমাতে পারিনা; বেহাল জমিন ক্ষুব্ধ নায়িকা স্বপ্নের দেশ কব্জা করেছে – তার তুষ্টি নেই বিচ্যুত শব্দের বলিদানে, বিকশিত আবেগের প্রতি অধীর হিংসায় তাকিয়ে আছে- পাতালঘর থেকে চিলেকোঠার দৈর্ঘ্য মাপছে, তাচ্ছিল্যে; দেহভঙির নগ্নতা, নারাজ একটিও বন্ধ কপাটের খেদ রেখে দিতে, তার অবিরাম জেদের বিচ্ছুরনে ভীত এই উন্মোচিত দালান- যদিও নিখাদ সন্ত্রাস হুহু বেড়েই চলেছে, কম্পনের উৎস হয়েও সেই দেবী সদর দরজার কাঠ খুলে চলে যেতে উদ্যত, অবশিষ্ট করাল ঘৃণায় ছিঁড়ে নাড়ি, বিভক্ত হবে মহাকম্প ভয়ের জননী- শুষে নিয়েছিল হয়তো সম্ভাব্য কুহকগুলো নিবিড় রাত্রির, যেসব কূট ডাক অবহেলা করে আমরা ঘুমাই; আমার তীব্র রাত্রিকে ছঁইয়ে সকালেই, তার অস্পষ্ট স্মৃতি মিশে গেল বিস্ময়ের বিষণ্ণ অসীমে- যাবৎ স্মৃতিরা যেখানে থাকে…
যত্তোসব মারমুখী শৃঙ্খলার তেজ নিয়ে, সে, নতুন মনসা, আমাকে চাঁদবনিকের কোঁকড়া শৈশব দিতে চেয়েছিল, যাতে আমার স্থাণ হয়- প্রতিদ্বন্দী প্রণয়ী কল্পে- লৌকিক কথায়- ভবিষ্য কবিতায়…
জানিনা কেন শীবমন্দিরেও নামকীর্তন, ধ্যানের বদলে হুহু হুল্লুড়ে ঢুলে?- নীল বিষ্ণু আর অতিনীল মনসার নীলিম আঁতাতের প্রয়াস-বিষে? হতে পারে আমার সন্দেহ ক্ষমাহীন ভুল, তবু আমি নিজেই আমার স্বপ্নের রচয়িতা- সেখানে তারা ছিল; স্বপ্নধূলিতে লিপ্ত হয়েও সেখানে আমি ছিলাম না, কোথায় আমি ছিলাম তাহলে- কোন অজাত ঊষার সাথে প্রায় নীরব কথোপকথনে!?!
একটি মাকড়শার গল্প
আ হ মে দ তা ন ভী র
অনেকদিন ধরেই একটি মাকড়শা তোমার ঘরের ঝুলবারান্দায় হাঁটতো-
গভীর রাতে জোছনা-গোসল সেরে যখন স্বামীর সঙ্গে যুগলবন্দি ঘুমিয়ে পড়তে
তখন সে জাল বুনতে শুরু করতো- মাঝে মাঝে ঘাড় উঁচিয়ে দেখতো তোমাকে,
কখনো কাছে যাবার সাহস হয়নি।
জাল বুনতে বুনতে...
বুনতে...
বুনতে...
রাত ভোর হয়ে যেতো!
রাতজাগা কান্ত মাকড়শা তখন
নীল অপরাজিতার ঘ্রাণে ডুবসাঁতার দিতো তন্দ্রার ভেতরে।
রোজ সকালে শলাঝাড়– দিয়ে সে জাল ঝেড়ে ফেলতে তুমি-
মাকড়শা নিজেকে আবিষ্কার করতো
নিচে সরু গলির পাশে- বেয়ে উঠতো আবার
এক দুই তিন করে অনেকদিন... বড্ড উৎপাত...
মহা যন্ত্রণা মনে হলো তোমার কাছে!
এক জোছনাধোয়া মধ্যরাতে ধরা পড়লো সে
আহা অসহায় মাকড়শা!
ধূসর-বরণ মাকড়শা...
বেদনায় নীল হয়ে যেতে যেতে
তুমি বুঝেছিলে ঠিক,
ওটা তোমার মধুর অতীত...
ওটা যে আমার ছায়া...
সুজন সুপান্থের কবিতা
জন্মসূত্র
আমাদের বাহির উঠোনে ছিল কামিনী গাছের সারি
তার সেই সাদা ফুলের সুবাসে ভর করে কেটে যেত
উঠোনের অলস সময়। পাশেই এক কোণায় ছিল
বয়ঃ বৃদ্ধ ধ্যানী বকুলের গাছ,গাছ থেকে দিনমান
খসে পড়তো বকুলের ফুল। মনে হতো কেউবা উঠোনের
গায়ে বিছিয়ে দিয়েছে ঝরা বকুলের চাদর। সেখানে
খেলা করে বেড়াত ফুল কুড়ানির দল, সেখানে পড়ে
ছিল প্রেমিকের আবেগঘন অনুচ্চারিত ভালোবাসা।
অদূরে দিঘির পাড়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল
ফলবতী নারিকেল আর সুপারি গাছের দলবল
আর দিঘির জলে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে
উঠতো গাছেদের দল। দিঘির বুক থেকে ভেসে আসা
বাতাস ভরা জ্যৈষ্ঠেও শীতল করতো প্রেমিকের মন।
এখন আর সেই উঠোনের কাটে না অলস সময়
খসে পড়ে না কোনো বকুল ফুল, দূরে ঝরা বকুলের
স্মৃতিচারণ করে বকুলেরই জারজ সন্তান।
সেই দিঘিটিও আর নেই, নেই তার বুক থেকে ভেসে
আসা শীতল বাতাস তার বুকে এখন বেড়ে উঠেছে
ইটের দেয়াল সঙ্গত, ফলবতী গাছেদের পতন
দেখে মুচকি হাসে সে দেয়ালে গজানো শ্যাওলার ঝোপ।
শ্যাওলার সেই হাসির মানে শুধু আমাদের এই উঠোনই বোঝে
অদূরে একা এক বৃহন্নলা নারিকেল গাছ তার জন্মসূত্র খোঁজে।
চিঠি
[চিঠি দিও আশালতা রায়]
পোস্টবক্স ফাঁকা পড়ে আছে বহুদিন
যত্নহীন; জানি, তবু নিত্যদিন ওই
পোস্টবক্স হাতড়িয়ে যাই চিঠিপত্র।
যে বছর আশালতা সূর্যে চলে গেল
সেই থেকে আর কোনো চিঠিই আসেনি
কথা হয়ে-অপূর্ণতার আঁধার ঘরে।
কত কথা জীবন্ত হয়ে উঠতো সেই
চিঠিদের প্রতিটি শব্দে, এখন সেই
শব্দ রক্ত ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে বুকে।
এই ব্যথার মানে! পোস্টম্যানই জানে।
আশালতা এখন সূর্যে বেধেছে ঘর
তাই হয়তো ভুলেছে আমার সাকিন
কিংবা বোবা আলো ভর করেছে তার
ভেতরের জীবন্ত শব্দগুলোর ওপর।
তবুও তো, প্রতি সোমত্ত রাত্রির কাছে
অকথ্য কান্তি জমা দিয়ে লিখে যাই শব্দ,
সেই সব শব্দ চিঠি হয়ে উড়ে যায়
সূর্যে-আশালতা রায়েরই কাছে।
আশালতা, আদৌ পড়েছ কী সেই চিঠি?
তা নাহলে আমার এই অপূর্ণতার
আঁধার ঘরে বহুদিন কোনো চিঠিই
আসছে না কেন জোনাকির ফুল হয়ে।
গ্যাব্রিয়েল সুমনের কবিতা
শালবনের কবিতা
মৃত্তিকার সাথে মেঘেদের পুনর্বার পত্রমিতালী হয়ে গেলে
পর, শুকনো পাতারা স্বশব্দে ঝরে যাবে। নির্জন বাংলোতে
শোনা যা্বে রাত্রির জনকল্লোল। বাতাসের পাহারায় স্বনিয়ন্ত্রিত
শব্দসন্ত্রাস পাতাঝরা বৃক্ষের সঙ্গী হয়ে রবে। নিঝুম সন্ধ্যারা
পাখিকে দুত করে স্নিগ্ধ ভোরকে পাঠাবে শ্বাশত হাতচিঠি।
শালবনে বসে কোন নামহীন কবি হলুদ পত্রে লিখতে
থাকবে বাতাস পাখির অনাগত রুপকথা।
এইবার বৃষ্টি হলে কী হবে
সব কথা
বলে দেবো
তোকে।
তুই
নিভে যাবি
দুঃস্বপ্ন পূরনের শোকে।
আমার একটা অ্যাশট্রে দরকার
পারস্পারিক অগ্নিদৃষ্টি লুপ্তদৃষ্টি লুদ্ধদৃষ্টি সুপ্তদৃষ্টি
এবং সাময়িকভাবে দৃষ্টির বৃষ্টি; অবিরামভাবে--
অপ্রকাশ্রিত ও প্রকাশ্রিতরূপে অনুপস্তিত বলে,
ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকে পড়ছে কোন অচেনা মশাল;
বৃষ্টির রাতে। গাংচিলের ডানায় সন্তর্পনে লুকানো
ভোরের শিশির অথবা কাশফুলের গোপন পাপড়ি।
মনেহয় দুজনেই জ্বলছি; নিশ্চুপ জ্বালাচ্ছি নীরজাকে,
চারপাশদিয়ে এলোমেলোভাবে ঘুরেঘুরে বেড়াতো
যেসব পাঁচ পয়সার মৌলিক অবোধ দুঃখবোধসমগ্র;
আজ যাকে জলের দরে জলের কাছে বেচে দিচ্ছি।
আড়াই প্যাঁচে (ভূতগ্রস্ত সিরিজ)
জুবিন ঘোষ
সে আমায় পিছন থেকে খুবলে নিয়ে গেছে
সামনে থেকে
আমায় সামনে থেকে জাপটে ধরেছে
পিছন থেকে
কোনরকম খুলে ফেলতেই চামড়া
টিপে টিপে বিষাক্ত ক্ষতমুখ , পুঁজরস
শেষ মুহূর্তে গন্ধ পেয়েছি সোঁদামাটির , পচনশীল প্রকৃতির
পালিয়ে যেতে চেয়েছি গুহায় , গহ্বরে , খোলসদেশে
লিকলিকে তরুণাস্থির ভিতর
কেউ আমায় খামছে ধরেছে সাপের আড়াই প্যাঁচে ...
মৃন্ময় মীযান এর কবিতা
মেটামরফসিস
কে কাকে চায়-
সে আমাকে, নাকি আমি তাকে?
হয়তো চাওয়ারই কোন অস্তিত্ব নেই!
বিষন্ন ফুল ফোটে
ঝুল বারান্দায়,ভাঙা টবে ।
কুড়োনো জলে সে কি বাঁচে?
জলও তাহলে কুড়োনো যায়!
বড্ড বেশি হতাশা আমাদের ।
নাকি হতাশারই বড্ড বেশি আমরা?
দুর্বোধ্য কবিতারও কি বোধ থাকে?
প্রাঞ্জল থেকে রুপান্তরিত তারা?
প্রশ্নের উল্টো পিঠেই তারা বাঁচে!
অথবা আমরাই
নিজেদের কাছে দুর্বোধ্য!
ইচ্ছের তৃষ্ণা
আগাম বৃষ্টির শব্দ শুনেছি আমি
ভেবেছি এবার তাই,
চলে যাব এ মৃত উপত্যকা ছেড়ে।
আমাকে ঘিরে ছিল
শুকিয়ে যাওয়া ঘাস,
দিবাস্বপ্ন আর দুখের কলঙ্ক।
নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারিনি কত রাত..
অমাবস্যা,অথবা জোনাকবিহীন আঁধারেও।
বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেছিলাম
কত গোপন ক্ষত।
অদম্য ক্রোধ আর কত অভিমান
ভুলে ছিলাম এতদিন।
আর নয় শুরার পেয়ালায় জলচুমু।
এবার স্বপ্ন দেখব-
সর্বহারাদের মত ....
অনুপম হীরা মণ্ডল
ময়নার গান
গর্ভিণী মাছের দৃষ্টির মতো স্বপ্ন নিয়ে দেখি
বুদ বুদ ওঠে জলের পরে।
মাটির গভীরে থাকা রুদ্ধ বাতাস
উন্মুক্ত করে নিজেকে
দমকা হাওয়ায় মিলনের অভীপ্সা নিয়ে।
জলের বুদ বুদ মিলে যায় জলে
স্রোতে ভেসে যায় সদ্য জেগে ওঠা ফেনা
মাতৃ জলচর সজাগ হয় সন্তরণে।
মাটিতে নুইয়ে পড়ে ফলে ভরা গাছ
নিমন্ত্রণ পেয়ে প্রতিবেশী পিঁপড়ারা আসে
তোমাকে বরণ করবে বলে।
মায়া ভরা গাছ আর ঘাসেরা
আপ্লুত হয়ে কণ্ঠ ছাড়ে আগমনী গানে।
সুরের মাতনে জেগে উঠি আমি
তোমায় ছোঁয়ার আবেশ লাগে অঙ্গের আভরণে।
ঘরমুখো পাখিরা বলে যায়—
অপেক্ষা করো বন্ধু এখনোত হয়নি সময়
সবে গোধূলি সন্ধ্যা ঘনাক আগে।
খুঁজে পাবে খুঁজে পাবে তাকে
শেষ হবে চাতকের প্রতীক্ষা তোমার ।
নিশুতি হাওয়ার মতো সে অভিসারে আসে
জাগরণের দোলা উঠুক তোমার অতৃপ্ত প্রাণে।
দোহারদের মতো রাতজাগা পাখিরা বলে
অপেক্ষা করো বন্ধু, এই আর কিছু দিন।
তার কাটা দোতায় যে সুর হয়নি তোমার শোনা
বৃষ্টিতে ভাঙা আসরে যে পালার হয়নি কখনো শেষ
সেই প্রতিক্ষীত আসর জমবে আবার বারোয়ারি তলায়
প্রতিপদ, একাদশী শেষে চাঁদনী রাতের হাওয়ায়
তোমার ময়না গাইবে গান তোমারই সম্ভাষণে।
মাটির টান
মায়ের স্তন বঞ্চিত শিশুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে
কৃষকের জমি। নষ্ট বীজের ভ্রুন থেকে জেগে ওঠা দ্রোহী গাছ
ঈশ্বরের কাছে কৈফিয়ত চায়।
প্রশ্ন বানে জর্জরিত করে বৃষ্টির দেবতাকে,
ধরণী বৃষ্টিহীন কেন? প্রার্থনার ফল তাদের চাই, চাই
ক্ষেতের ফসল যেন বৃষ্টির অধিকার পায়।
ঈশ্বর ভীত হয়ে ওঠে, ত্রস্ত বুকে আওড়ায় সৃষ্টিতত্ত্ব
ভ্রুনের বুক থেকে জেগে ওঠা পুষ্টিহীন গাছ
বাধ্য করে সর্বময় ক্ষমতার অধিষ্ঠাতাকে।
রজঃস্বলা নারী ফলবতী করো, মাটি কেন হবে নিষ্ফলা?
পুষ্পবতী করো গাছ, সৃষ্টির যন্ত্রণা উঠুক মাতৃ দেহে।
সন্তানের কামনায় দুগ্ধবতী করো তাকে।
ফসল, গৃহ, চাষীমন রামায়ণের সুরে মৃদঙ্গের সঙ্গত যেন
সুর-স্বপ্নের সঙ্গে অন্বিত। চামড়ার পিঠে আঙুলের টোকা দিয়ে বলে
উদ্ভাসিত হও সকল সম্ভাবনা, সৃষ্টি।
স্বপ্নেরা জেগে ওঠো, জেগে ওঠো বীজের ক্রোড়ে থাকা জন্মের সম্ভাবনা
দুগ্ধবতী গাভী, ডিমওয়ালা মাছ, শঙ্খ লাগা সাপেরা শোভা যাত্রায় আজ
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে তাদের চপল দৃষ্টি।
বৃষ্টি আসে মায়ের আঁচলে ভরা কলমি ডগার মতো,
আসে কথক, গায়েন, বায়েন, পটুয়া, সাথে আনে স্বপ্ন,
স্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ চলে প্রেমিকের চোখে।
বলে প্রেম দেখো জুবার জমিতে, লাঙলের ফলায়,
নষ্ট মেয়ের ফুলে ওঠা পেটে, দাদীর বোনা শিকায়
চোখে চোখ রাখো আর স্বপ্ন রাখো বুকে।
বচন নকরেক এর দু’টি কবিতা
ছোঁয়া
তোমার নিটোল হাত খানা বাড়াও
আমাকে ছোঁও, দ্যাখো
জেগে উঠি যদি
অলিক তন্দ্রা ভেঙে।
তারপর ঠিক বুকের মাঝখানটায়
হাত রাখো
হৃৎস্পন্দন ঠিক হয়ে
গ্যাছে আমার,
আর দ্যাখো
আমি এগিয়ে গিয়েছি কি না
কয়েক ধাপ
তোমার হাতের ছোঁয়ায়...
বুক পকেট
এমন সময় আর নেই
যখন বুক পকেটে থাকতো তোমার প্রেমপত্র
ভাঙা ভাঙা প্রেমকথা
ছোট ছোট দু:খ কথার পর
একদিন সম্পর্ক ভেঙে যাবে
ভেবেছিলে ?
এখন বুক পকেটে থাকে
প্রেমপত্র নয়, ফুলও নয়-
এক প্যাক সিগারেট মাত্র...
মারাসিম
রমিত দে
এক.
অনেকটা দূর থেকে কথা হয়েছিল আমাদের।
অনেকটা দূর- এই ধরো,-যেখান থেকে
একটা ব্যাঙ অর্ধেক জলে পা ধুতে ধুতে
ধুতে ধুতে বৃষ্টি হয়ে গেল।
আমি ঠিকানা দিইনি জলবন্দী গেরস্থের
এখন দশমাস ফুসফুসের ভেতর সব পা হারানো দিন
এখন দশমাস অনেক দূর থেকে কথা হবে আমাদের
দুই.
ধূলোবাড়ি ঘুমিয়ে আছে
আর প্রত্নঘোরের মত আলো
পুঁতে যাচ্ছো বধির বাতিঘরে।
আলো বেজে ওঠে
আলো চলে যায় প্রথম হাওয়ার অভিমানে
কিভাবে ফিরবে প্রসন্ন তারার দিকে!
এ ঘোর যে তোমায় পেয়েছে কাকভোরেই।
তিন.
শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে হাওয়া
হাওয়া ধরে চড়ুইপাখি
কেউ জানতেই পারল না , বুকের ডানদিকে
কারফিউ রেখে গেল কফি রঙের ফিঙে মেঘ।
থেকে যাও বিজন, থেকে যাও।
নেশা ধরে ধরে তোমার বায়বী সুড়ঙ্গে
-এগিয়ে আসছি আমি।
আর কেউ কি কাঁদছে নক্ষত্রের দিকে যাবে বলে?
চার.
দেবতার কানে কানে
জন্মশোধের কথা বলি।
সনাক্ত করতে পারিনা আত্মমৈথুনের হরিনদের
শুধু জানি তারা আমায় উচ্চারন দিয়েছে
ছুঁয়েছে, ছেড়ে চলে গেছে বৃত্তের মতো শরমী চাঁদের দিকে
তবে দেবতা কোথায় ছিল!
বুকের হেনায় দখল নিচ্ছে শহীদ বাতিঘর
- ঈশ্বর
- ঈশ্বর......
পাঁচ.
হঠাৎ একটা ছবি মনে পড়ল
আঁকতে আঁকতে কারা যেন উঠে গেছে কুহু ডাকে।
আর সেই পাখিরা- নগ্ন মেঘেরা- দাঁড়িয়ে আছে একঠায়
বেসামাল বিটপের ঠোঁটে।
মাঝে মাঝে ভুলে যাই পৃথিবীর জ্যামিতি
মাঝে মাঝে ভুলে যাই ফিরে আসা।
লবঙ্গীর বনে নড়ে ওঠে আরও একটা পোড়ানো নিলয়।
হাসান সাব্বির-এর কবিতা
হারানো দিনের গান
দিনলিপি জুড়ে শুধু ঝরা পাতার হাহাকার। বুকে নিয়ে বসে থাকি শূন্যতার পৃথিবী এক। অবচেতনায় কলম হয়ে যায় আঙুল। শূন্যে লিখি জটিল মনস্তত্ত্ব, স্মৃতির কবিতা। কে জানত,স্মৃতির কথা ভেবে ভেবে সারা হব একদিন- শেষ হব অর-ধ্বনিতে! অজস্র স্মৃতির মুহূর্ত ত হয়ে কবি’র অন্তরে, কবিতার পংক্তি হয়ে কাগজের পৃষ্ঠায়!
একদিন স্মৃতি বিস্মৃতি হলে স্বপ্ন ভেঙে যায়, কবিতা হয়ে যায় নির্জন দুপুর, হারানো দিনের গান ।
আত্মপ্রতারণা
ক.
স্বপ্ন সত্যি হবে না জেনেও অনেক সত্যি গোপন করেছি, অনেক নদীর গল্পে মগ্ন পাঠক হয়ে জেগে থেকেছি গভীর রাত। অজস্র মিথ্যের মনভোলানো রূপ বিশ্বাস করেছি বলে উৎসবের আমেজে এই রাত ঘুঙুর পায়ে নেচে যাচ্ছি উন্মাদ-মাতাল। বিশেষ কোন বৃষ্টির দৃশ্য ছাড়াই দিন শেষ- সন্ধ্যেটা তাই নিরামিষ! সমকাল আলোচনায় ছিলাম শুধুই শ্রোতা। কবিতা যদি জানতো অর্থহীন ক্যালিগ্রাফিতে ভরে যাচ্ছে সাদা পৃষ্ঠার ক্যানভাস...। ইস্! এখন যদি লোডশেডিং হতো, অন্ধকারে ভরে যেত ঘর...
ইতি টেনে দিতে পারতাম যদি কালি ও কলমের সম্পর্ক, হয়তো রাত্রির ঘুমে খুঁজে পেতাম স্বর্গের সুখ।
খ.
হয়তো অনেক কিছু লুকাই-গোপন করি অজস্র সত্যি- প্রতারণা করি জেনে-শুনে। তবুও দ্যাখ, ফিরে আসি তোমার কাছেই। অবচেতনায় হয়তো কালো রূপটাকেই ভালবাস- হয়তো জানো, নষ্ট’র আড়ালে আছে ভাল’র একটি মুদ্রা।
বারবার জ্বলে যাও- পুড়ে যাও বুকের মধ্যে। তবুও...
গ.
মরে যেতে যেতে ঠিকই বেঁচে উঠছি আবার- ঘুমোতে ঘুমোতে যেমন জেগে উঠি। স্মৃতি-বিস্মৃতির ভর বহন করতে করতে কখন যে ভীষণ কান্ত হয়ে উঠি...। আগামীর অভিমুখ যাত্রায় অজস্র লোভ ও আকর্ষণ কাছে ডাকে যেন রমণীয় সম্মোহন...। মাতালের মত টলতে টলতে একবার আমি পাহাড়ের উপর ভেঙে পড়ি আর একবার সমুদ্রের কাছে এসে প্রতারণার শিকার হই!
সেই যে একদিন মধ্যরাতের কথাকাটিতে কেটে গেল হৃদয়- মারাত্মক আহত হল প্রাণ, সেই থেকে ভেসে বেড়াচ্ছি শূন্য হয়ে মহাশূন্যে, অনন্তকাল।
ফেরে না কেউ
অলস দুপুর হেঁটে চলে গেছে নিরুদ্দেশ। সন্ধ্যে হলেও ফেরেনি ঘরে। দুপুরের মতো বেড়াল পায়ে বিকেলগুলোও চলে গেছে শহর ছেড়ে। কোনদিন কি দেখা হবে মুখোমুখি আর ? কী ভীষণ নস্টালজিক এই রাত্রির গহন অরণ্য! ফসলের তে থেকে কত যে উঠে আসে সকরুণ দীর্ঘশ্বাস। ঘাসের উপর খোলস বদলানো একটি গোখরো কী বীভৎস সুন্দর! ধোঁয়ার মতো ধূসর শূন্যতায় ভরা নির্জনা এই রাত্রির কালোমাটির ভূ-খণ্ড। অদূর অদৃশ্য থেকে ভেসে আসে মরে ভূত হয়ে যাওয়া শেয়ালের অতৃপ্তি- তুমুল কোরাস। অপঘাতে যারা মারা পড়ে তারা কেন ফিরে আসে রাত নামলে পৃথিবীর অন্ধকার-অভ্যন্তরে ?
স্মৃতি ভুলে যাওয়া অলস দুপুর, নীলাকাশ বিকেল- ফেরে না কেউ আমি শুধু অমাবস্যার রাত জেগে ডায়রির পাতায় লিখে রাখি হলুদ হরফে প্রাপ্তবয়স্ক মস্তিষ্ক বিকৃতি।
বোঝ না মীন-প্রজাতি
প্রচণ্ড ঝড় শেষে পড়ে আছে বিধ্বস্ত রূপ- মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে যেন রতিকান্ত সাপ। কোন কারণ নেই, অকারণেই এই রাত গহন অন্ধকার। কুয়াশার কাফন হয়ে সাদা এক বিষাদ-ঢেউ ঝুলে আছে চোখের আলোতে। দেখি না হাতের কাছে...। বহুদূর অজ্ঞাত ! খোঁজ নেই বহুদিন-কেমন আছ মৎস্যগন্ধা সমুদ্রের তলায় ? চর হয়ে পড়ে আছি অপেক্ষায়। জান না প্রতীক্ষা জান না বালির এই বুক- বুকের উপর সারারাত জ্বলে ফসফরাস।
বোঝ না মীন-প্রজাতি রোদে পুড়ে মরি না- শুধু মারাত্মক আহত হই বুকের গভীরে, স্রোত হারিয়ে লালজলের।
পোড়া রাত
দৃশ্যত: স্বপ্ন ভেঙে যায় ধুলো হয়ে- রাতের গভীরে তীব্র যন্ত্রণা হাড়ের ভেতর। নিষিদ্ধ এক গল্প পাঠ ছায়াছবি হয়ে চলতে থাকে শূন্যতাপথে...। নৈ:শব্দের নীল আগুন ছড়িয়ে পড়ে শরীরের কোষে কোষে- চেতনার আকাশ জুড়ে ধুলোর মেঘ- গহীন অরণ্য-পোড়া ছাই।
হাতের মুঠোয় যখন গোলাকার চাঁদ, তীব্রতর হয়ে ওঠে তলপেটের ব্যথা। আর কোন শব্দ নেই- অর-বর্ণের ছোঁয়া নেই মরা মাছের মতো ভেসে থাকি জলের উপর- শুয়ে থাকি অন্ধকারে অতৃপ্ত আত্মা।
নোনা কবিতা
এক.
সবাইকে কি বলা যায় কোথায় আমার মন উড়ে উড়ে আকাশ, কান্ত পড়ে থাকে
কোন আধারে- রাতে কার বুকে মাথা রেখে...। এইসব সরল আলাপ গান হয়ে গুনগুন করে যখন-তখন ঠোঁট, ঠোঁটে...। গোপন-প্রকাশ্যে কল্পনার পৃথিবীতে কত যে দৃশ্য ও ছবি’র সাদা-কালো, রঙিন রাত্রির প্রেম-উৎসব...
কাউকে বলিনি, মনে মনে কার সাথে দুষ্টুমি আমার- মান-অভিমানের নোনা কবিতা,
কাউকে বলিনি কার সাথে আমার ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক।
দুই.
ভয় আর দ্বিধায় কতবার যে মরেছি ঘাট থেকে ঘাটে...। পথে পথে কী ভীষণ বিব্রতকর এই অস্তিত্ব- কী ভীষণ বিকট অসহায় দর্শন ! রূপ নেই- রস নেই; গন্ধহীন- রঙ নেই। অর্থহীন বোধ! দিনগুলো দূরে রেখে কুয়াশার মেঘ- উড়ে যাচ্ছি হারানো সুর, রাত্রির অন্ধকার প্রদেশে যেখানে মরে পড়ে থাকে অনুভূতির অজস্র দুর্লভ- যেখানে ঝরে ঝরে শুকিয়ে যায় বকুলের ভেষজ গন্ধ- উড়ে যাচ্ছি বিষণ্ণ ছায়া এক, ফিরে যাচ্ছি অদৃশ্য রেখার পথ বেয়ে...
বহুদিন ছায়া হয়ে, ছবি হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি- আয়ুরেখায় য় করেছি অজস্র বিনিদ্র রাত।
যা মনে আসে তাই...
বন্ধু ভাবি যারে সে তো ভাবে শত্রু- এইতো প্রেমের স্বাদ! তারপর আর কিছু নেই- নেই কোন তৎসম অথবা তদ্ভব শব্দের মুহূর্মূহু করতালি। প্রগলভ: স্বভাবে তবুও যা মনে আসে তাই বলি আশা আর লতাকে- নদী-পাহাড়-অরণ্যের কথাও বলি- বলি, মেঘলা আকাশ থেকে বৃষ্টির তুমুল বর্ষণ ! একদিন কথায় কথায় লজ্জার কথাও বলেছিলাম সুমিকে- উত্তরে বলেছিল, ‘আপনিতো ভীষণ ছোটলোক।’
আক্কেল হয়নি। বেয়াক্কেল স্বভাবে আজও তাই নদীর প্রেমে হাবুডুবু খাই।
আমার শুধু আমিই আছি
মাটির স্পর্শ বুঝি- বুঝি না আকাশ ছোঁয়ার অনুভব। দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের মতো কাঁটা নেই প্রাণের ভাষায়, বন্ধু বলে নেই কোন অভিনয়ের মতো সহাস্য কৌতুক! ঐশ্বর্যের মতো প্রিয় কোন শত্রু নেই-আছে শুধু প্রেম-প্রীতি ও মমতার মতো স্বাধীন কিছু শব্দের উপমা। ফুলের ফাগুন নেই- ভুলের মাসুল নেই- আছে অচল মুদ্রা কতক- অনর্থক। সরল পঙক্তির মতো আশ্চর্য অথচ কিছু সুন্দর উচ্চারণ ছাড়া বুঝি না আর কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কীটতত্ত্ব!
এইতো আমি- আমার দাঁড়িয়ে থাক ! দূরে যাবার দরকার নেই- কাছে থাকার অধিকার নেই, আমার শুধু আমিই আছি, সুলভ ভাবসম্প্রসারণ !
অন্ধকারে আমি আজন্ম সাঁতারু
নীরবতা ভেঙে সেলফোনটা জেগে ওঠে হঠাৎ সুরেলা কণ্ঠে- কে যেন ডাকে আমায়। সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না- সেলফোনটা ডেকে ডেকে থেমে যায়। সেলফোন ভুলে...। চোখ বন্ধ করলে যে অন্ধকার সেই অন্ধকারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে খুঁজতে থাকি ডাঙা।
অন্ধকারে আমি আজন্ম সাঁতারু- ডাঙা খুঁজে না পাওয়া।
অদ্ভুত এক নদী-নদীর ঘাট
জোয়ার-ভাটা না বুঝেও ঘাটে বসবাস- ঘাটে বেলা
ওঠে বেলা ডোবে। ঘাট পার হয়েই যেতে হয় ওপারে...
ঘাটে বাস অথচ ঘাট চেনে না হরিদাস !
ভালবাসা
ডানা মেলে উড়ছি
যেন ফড়িং!
নৃত্যের তুমুলে লালপাখায়
বেঁধে রেখে মৃত্যু।
দৃশ্যের এক টুকরো কাঁচ
(অটোমেটিক ডেভ্লপ করতে শুরু করেছে সাবকনসাস-মাইন্ড, অতর্কিত মস্তিষ্কে নৃত্য করতে শুরু করেছে রোবোটিক বাটারফ্লাই!)
চোখের মণি ঘোরাফেরা করে আয়নায়, দ্যাখে প্রাণের প্রতিবিম্ব! টের পাই রাত ঢুকে যাচ্ছে রাতের গভীরে, যেন নিঃশব্দ আততায়ী...। অবচেতনে মুখোশ খুলে বেরিয়ে পড়ে কংকাল সদৃশ হাড়ের কাঠামো- এই পর্যন্ত প্রকাশ্যে হেঁটে বাঁকবদল হয় দৃশ্যের; হাতবদল হয় চিত্রনাট্যের! অবসাদের নীলে ভরে যায় চোখ, বিদ্যুৎ চমকায় না, কেবল তুমুল বৃষ্টিতে ভেজে প্রকৃতির আঁধার।
গল্পপাঠ আধ্যাত্মের নতুন মাত্রা যুক্ত হয় কালের কণ্ঠে! ঘোরের মধ্যে মধ্যরাত সিগারেটের আগুনে পুড়ে অ্যাশ্ হয়- অ্যাশ্ হয়ে অ্যাস্ট্রেতে পড়ে থাকে পোড়া স্বপ্নগন্ধ্যা ফুল!
বৃষ্টি অথবা বিষাদের আকাশ-নীল
বৃদ্ধ বিশদ বুঝি এখনও জেগে আছেন কবিতার খাতায়- লিখে রাখছেন শ্রমক্রুশ, শ্রমপদ্ম, শ্রমপল্লব...। ঋতু তুমি জেনে রেখ পণ্ডশ্রম ছাড়া আমার কখনও হবে না বসন্ত! অনধিকার চর্চা অথবা সমালোচনা ছাড়া কখনও হয়নি কিছুই- আশা অথবা আকাঙ্ক্ষা। এরই মধ্যে যখন দম নিচ্ছি ঝমঝমিয়ে তখনই নামল বৃষ্টির রিমঝিম- ঋতু এখন কি বর্ষা ? বৃষ্টির শব্দে শুনছি নৈশব্দের রাত! কত সনাতন এই শব্দ অথচ কত সুসভ্য এই স্বর- প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কী ভীষণ শীতল স্পর্শ!
নীরবতার ভেতরে প্রকাশিত হবো বৃষ্টি অথবা বিষাদের আকাশ-নীল, অনেক দহন জমে আছে হৃদপত্রে-অজস্র নিষিদ্ধ গোপন হয়ে আছে আত্মপ্রতারণায়।
যন্ত্রণার নীল থেকে
ক.
পাখির ডানায় ভেসে উড়ে উড়ে দেখেছি আকাশ-অসীম!
মধুর এক যন্ত্রণার অনুরণন অনুভবে-
হায়! প্রেম যদি হারিয়ে যেত-
সারাদিন-রাত বৃষ্টি হয়ে ঝরে যেত চোখ থেকে জলের মেঘ...
হয়তো আর কিছু পাবার নেই
যা কিছু পাওনা, পেয়ে গেছি সব
স্বপ্ন থেকে কল্পনা পর্যন্ত!
নিঃস্পৃহ দৃষ্টি, বহুদূর পর্যন্ত এই আমি উদাসীন,
উদ্দেশ্যহীন...
খ.
অসময়, বসে আছি নিস্তব্ধ
যেন প্রাণের চিহ্ন নেই অস্তিত্বে-
যেন বহুদিন ঘুমিয়ে আছি!
শুধু অচেনা কণ্ঠ এক গলে যাচ্ছে বাতাসের সংস্পর্শে এসে-
পৃথিবীর বাতাসে মিশে আছে শত-সহস্র বুকের দীর্ঘশ্বাস।
কবে থেকে যে এমন শূন্যতার বুক
অন্তরে অসহায় বোধ...
আর কত রাত জলের গ্লাসে পান করে যাব
তরল নিভৃতি!?
পতনকাব্যে
শত শত কিলো পেরিয়ে এসে যে বাসটা এখন ঘর্ষণের শব্দ হয়ে চাকায় চলে গেল ছুঁয়ে দিয়ে সেও জানে কোন খাদে গিয়ে সে পড়বে যাত্রীসমেত!? ‘খাদে পড়াও’ তো পতন! উঁচু-নিচু; উত্থান-পতন - এর মধ্য দিয়ে কোথায় যাচ্ছি- কোন সে দূর?
পতনকাব্যে আহত তারুণ্য সারারাত সাঁতরায় শূন্যতার নীল।
নির্জনতা থেকে পাঠ
অনেক সত্য লুকিয়ে থাকে প্রতারণায়। পথ ভুলে যে পথে হাঁটি সে পথও মিথ্যে নয়। যে অধিকারে কবিতা আমাকে টেনে নিয়ে আসে গভীর অন্ধকারে- বসিযে রাখে লোভাতুর আকর্ষণে আর হাসে রহস্যময় আমার কাছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই।
কেউ কি জানি কেন কখনও কখনও আহত হই দ্বন্দ্ব ও দ্বিধার মতো অদৃশ্য কাঁটায় ? নিশাচর পাখির মতো রাত-নদী সাঁতরেও কখনও খুঁজে পাইনি শান্তির সুবর্ণদ্বীপ।
কাব্য মোস্তফা এর কবিতা
জীবনের সমান্তরাল শুয়ে থেকে
শুয়ে আছি পোড়া বৃক্ষ
রাতের অন্ধকারে শুন্য দৃষ্টি
শুয়ে আছি...
বৈরী সময়-
ধোঁয়ার মেঘে বিপন্ন প্রকৃতি-
কার্বনের আধিক্য বাতাসে বাতাসে
নরক এক জীবনের সমান্তরাল শুয়ে থেকে
সয়ে যাচ্ছি বোধের অবক্ষয়-
বৃরে শাখা থেকে
ঝরে যাচ্ছি বিবর্ণ পাতা।
অনুভবে নীলে বরফ-অনুভূতি
বিকেল ফুল উঠে আসে নির্ঘুম চোখে
ছুটে আসে দুরন্ত প্রজাপতি-
তবুও বুকে বিষন্ন বেজে যায় স্মৃতির তানপুরা
রোদের উষ্ণতা নেই এখন-
নেই জ্যোৎস্নার মায়াবি হাত বুকের উপর।
অনুভবে নীলে বরফ-অনুভূতি
যেন অনন্তকালের ঘুমে শুয়ে আছি
হিমাঙ্করেখায় !
মহাশুন্য বুকে নিয়ে হাঁটি রাত্রির পথ
আকাশ লুকিয়ে রেখেছি চোখে তাই বুষ্টির জন্য এখন আর প্রার্থনা নেই। দেবীর কাছে নেই আত্মার আকুতি!
আগুন শুধু পোড়াতেই জানে জলের প্রেম তাই পদ্মপাতায় লিখি না শিশিরের কবিতা। মহাশুন্য বুকে নিয়ে হাঁটি রাত্রির পথ- আমার কোন কামনা নেই।
ভূত-সর্বস্ব বচনামৃত
ইদানিং রক্ত-মাংসের ভূতরাও সভা-সেমিনারে বিবেক-আদর্শ ও সততার কথা বলে আড়ালে লালন করে ধ্বংসকামী মনোবৃত্তি সভ্যতা ও সংস্কৃতির। ভূতরাই আজ ভূ-খন্ডের প্রভু! দেশ-জাতির গুষ্ঠী উদ্ধার করে তারাই আবার দেশপ্রেমিক! রক্তচু দেখিয়ে তারাই খুন করে তারুণ্যের স্বপ্ন- প্রগতির প্রতিভা। শেঁওড়া গাছের ভূত আবার নীল রাতের টেবিলে অনামিকার নগ্নবুকে আঁচড় কেটে নখের...
মূলত, ভূতরাই এখন সমাজের মহান সমাজ-সেবক আর
মানুষগুলো অন্ধ ও বধির।
পথে হারিয়ে যাওয়া পথের গল্প
মনে পড়ে ধুপছায়া মুখ চোখের মণিতে! বৃষ্টি হয়ে ঝরে কথার বকুল সময়ের শুন্যে। তারও কি মনে পড়ে দূর-অতীত?
ভুলিনি এখনও অযুত পাখির কলরব-মুখর সন্ধ্যা যুগোল স্মৃতির রাত! প্রণয়ের এই ইতিহাস জানত জোনাক-পোকারা ও শুকপরে চাঁদ। বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে মুছে গেছে লাভ-সম্পর্কিত আরও অনেক দূর্লভ দৃশ্য ও প্রহর। অচল মুদ্রা হয়ে এই আমিও পথে হারিয়ে যাওয়া পথের গল্প এক।
প্রসঙ্গ স্বপ্ন
দুঃস্বপের ভেতর জন্ম তবুও স্বর্গ থেকে উড়ে আসে স্বপ্নরা পাখি হয়ে আর আমাদের চোখে রেখে যায় জলের পদ্য? স্বপ্নও যে আত্মঘাতী হতে পারে- হতে পারে সীমা-লঙ্ঘন কখনও কি কেউ ভেবেছে এমন?
রোজ রোজ স্বপ্নে জন্ম- স্বপ্নে মৃত্যু অগণিত আত্মার!
প্রকৃতির প্রামাণ্যচিত্র থেকে
যেভাবে য়ে যায় মুগ্ধ চাঁদ- স্বাস্থবান জ্যোৎস্নাও
যেভাবে মরে যায় মাতাল নদী- উড়ে য়ায় বৃরে পাতা দমকা হাওয়ায়
যেভাবে জোনাকীরা উড়ে উড়ে ভুলে যায় প্রত্নরাতের উত্তরাধিকার-
সে স্বভাবেই প্রকৃতির প্রামাণ্যচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছি
জীবনের সরল গল্প।
মহিমা
কি অভিজ্ঞতা শিখে নিয়ে মন
রাত্রির ঘুমে শোনে স্বপ্নময় সংগীত ?
সোনালী উঠোন ভরে থাকে প্রগাঢ় অন্ধকারে
আর কবর ভেঙ্গে উঠে আসে পূর্বপুরুষরা আবছায়া হয়ে
চোখের আলোয়; রেখে যায় অজস্র ইংগীত !
জানি না কোন্ পাপে বয়সী হই আমরা,
কোন্ মহিমায় কন্ঠে স্বর হয়ে ওঠে ঈশ্বর ?
ক্ষয়ে ক্ষয়ে রূপালী রাত
কবে যে এলোমেলো পথে নেমেছে পা দু'টো
আর পেছনের পথে থেকে গেছে হৃদয় !
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কবে যে নিখোঁজ হয়েছি...
ভেতরে ভেতরে বদলে যায় লাবণ্য-রাত!
জীবনের যা কিছু ধ্রুব
নত্র-ফুল হয়ে ছিঁড়ে পড়ে পথে পথে রোজ
তবুও শেষ থেকে শুরু করি য়ে য়ে রূপালী রাত
সন্ধানে সোনালী ভোর।
তারুণ্য উড়ে উড়ে মেঘ জমেছে আকাশের গায়
বহুদিন পর আজ বৃষ্টির দিন-
জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা ফোটা বিন্দু।
হলুদ শাড়িতে বেশ লাগে রাত্রিকে
যেভাবে উদ্যাণে ফুলের বর্ণিল সমারোহ-
যেভাবে মিহি ধুলো চোখে পড়ার মধুর যস্ত্রণা
ঠিক সেরকম মিশ্র অনুভূতির খেয়াল বাজে অন্তরে!
তরুণ জলের উপর ভেসে সে যেন শরতের চাঁদ-
এমন জ্যোৎস্না, স্বপ্ন-সোনালী চাঁদরূপ দেখেনি পৃথিবীর কেউ!
অর-বৃত্তে চুমু খাই চাঁদের...
হলুদ শাড়িতে বেশ লাগে রাত্রিকে
পাখির ডানার মত তার চোখের পাতা উঠতো-নামতো-
আজও মুগ্ধ হই হৃদয়ের গভীরে!
যে ভালবাসায় জড়িয়েছি যাকে সে কি রাখে সে খবর?
আঁধারের পাঠ
দেখি, সোনালী ধানের উঠোনে প্রগাঢ় অন্ধকার-
অন্ধকারে ছায়া হয়ে মিশে পূর্ব-পুরুষ-
বংশ-পরম্পরা !
আহ! জীবন! নিদ্রিত এই রাত !
কোন্ পাপে বয়সী হয় মানুষ
মৃত্যুর পর ছায়া হয়ে হাঁটে মধ্যরাতের উঠোনে-
ঢুকে পড়ে নিদ্রার মধ্যে কোন্ অভিজ্ঞতা শেখায় !?
নিদ্রার ভেতরেই নির্ঘুম আমি
রাত্রির গভীর নেমে শুনি পবিত্র সংগীত !
অবেলার কবিতা
১.
কিছু পাখি স্মৃতি মনে রেখে ফিরে আসে বিস্মরণে শুকনো বৃরে ভূগোলে। যতো সব অসমাপ্ত আয়োজন কুয়াশা সময়ের বুকে ডুবে যায় একা। অভিসারী পাখি ডাকে কোথায় ? চৈত্রের খরাবুক বৃষ্টিহীন বহুদিন। দিগন্তের কোন দ্বীপদেশে এই জল-সংসার!
নিনাদে কাঁপে ঘুমের পারদ ছেঁড়া চোখ- স্মৃতির মোম-শরীর গলে যায়। ভস্ম থেকে ফিরে আসে ফেরারী রাত...
২.
ঘুমচোখে যাত্রা’র উৎসব- ইচ্ছেগুলো নিভে যেতে যেতে মিশে যায় পৃথিবীর দূরগামী রেখায় যেখানে মায়াবী সাঁতারে ভাসে নুয়ে পড়া চাঁদ- বাদামী শরীর...
আমি শীতরাত্রির পাতায় শুয়ে থাকি শিশিরে ভিজে, সোনালী রোদের স্বপ্নে বিভোর পোড়া চোখ।
কি যেন নেই
আজ কি করে সব বিকলাঙ্গ হযে গেল-
আমিতো তার মতো অঙ্গহীন হতে পারি নাই
অথচ ঘরময় ঐশ্বর্য, এখনো প্রতিটি আসবাবে তার যত্নের ছোঁয়া
এখনো ঠিক তেমনি আছে সেই তুলসীতলা, উঠোনের এক কোণে পুকুর-ঘাট-
বিকেলটাও অশোভন নয়,
শুধু মনে হয় এই মনে কি যেন ছিল; এখন কি যেন নেই...
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতেই যতো ভয় তবুও সেই ঘরেই ফিরছি-
এই ঘরই আমার স্বর্গ-নড়ক...
ঘণীভূত হলে একাকীত্ব
রাতের আঁচল ছুঁয়ে উড়ছে হিমায়িত অন্ধকার। অসংখ্য জোনাক দিকভ্রম ছুটে বেড়ায় গহীন পথে- আমিও যেন দিকভ্রম জোনাকী এক!
ঘরে ফিরি- আমার ঘর শূন্য আর শূন্য ঘরে একাকীত্ব ঘণীভূত হলে বিনিদ্র চোখে নেমে আসে ছায়ামুখ- অনুভবে বিনম্র অনুরাগ ছুঁয়ে যায় নির্জন বেলায়। যখন কান্তি মুছে স্পর্শের একান্ত ইচ্ছায় ছন্দময় কেঁপে ওঠে হাত- হাত খুঁজে পায় না হাতের অস্তিত্ব ! নিদ্রাহীন চোখ পুড়তে থাকে...
স্মৃতির চাঁদ
মনে পড়ে লাল শাড়ীটা...
তার সুতোর বিন্যাসে মিশে আছে মুগ্ধতার ছোঁয়া
স্বপ্নান্ধ চোখে মুগ্ধতার সাথে কানামাছি খেলি
ঘরময় ওড়ে রক্তাভ শাড়ীর আঁচল
আমার বৃত্তাবদ্ধ সময় জুড়ে হাসে উড়ন্ত বিকেল
স্মৃতির চাঁদ ভাসে একবুক বিশুদ্ধ জোছনায়-
এমনি স্মৃতির বিমুগ্ধ তুষার খুঁড়ে খুঁড়ে আমার বিলাপ, দীর্ঘশ্বাস-
দু'চোখে নদীর ঢেউ!
স্বপ্নঘোর, জলরাত্রির গহীনে ডুবতে থাকি...
বিভাজন
মুখ ও মুখোশের বিভাজন বুঝতে পারি-
বুঝতে পারি মানুষের অবয়ব জুড়ে ঘুমিয়ে থঅকা
ব্যাঘ্রের নিঃশব্দ উপস্থিতি-
লালসার তোড়ে কখন যে খেপে ওঠে- খিপ্ত ঠেউয়ের মতো
আর গো-গ্রাসে গিলে খায়...
বন্য হতে শিখিনি
তাই হিংস্রতা দেখে চমকে উঠি, চেতনায়।
প্রশ্নবোধক চিহ্ন
ছাপচিত্রের বিকেল আর বাস্তবতা এক নয়
স্বপ্নে যে মুখ তরঙ্গিত
বাস্তবতায় বিপরীত রূপ দেখায়
অশ্র“বিন্দুর ওপিঠে যে তাকে প্রেয়সী বলি
ওপিঠের বায়ুমন্ডলে সে এক বিমুগ্ধ মুর্ছনা শোভিত
নক্ষত্রমালা- কোহীনুর...
এপিঠে আলোর বিন্যাসে
সে এক বহুরূপী অগ্নিরেখা
বোধের বিভাজনে এখন এপিঠ ওপিঠ
শুধু এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
পেঁচা পাঁচালী
ক.
রাত বয়সী হলে
ঘুম জাগে পেঁচা-সংসার
বৃরে ভূ-গোলে কথার উনুন জ্বেলে
পার করে নিশিকৃষ্ণতিথি...
দিনের চূর্ণ আলো দূরগামী হয় দৃষ্টির গভীরে
ভাসে ছায়ামুখ কারো
ঘুমপোড়া চোখে থেকে থেকে কেঁদে ওঠে
প্রাণের ফসিল!
খ.
তবুও পেঁচাটার ধুসর চোখে
জোনাক রেখে গেছে ক্ষীণ আলো
আর আলোর দিগন্ত জুড়ে কুয়াশা-মেঘ;
বেদনা-শিশির
পালকে তার শীতরাত্রির হিম
বিনিদ্র চোখে তার স্মৃতির নত্ররা হাসে
স্বপ্নগুলো মৃত প্রজাপতির জলছবি আঁকে
একাকী বিরহী পেঁচা উদাস তারে খোঁজে
জেগে নিশিরাত।
ফেলে আসা পথে
প্রেয়সীর অস্থির চোখের মত
কেঁপে ওঠে রাতের বাতাস
আর মৃদু ঢেউয়ে ভেসে যায় বিষাদ-নগর!
আঁচলে নিদ্রা কুড়ায়ে কেউ চলে যায়
দূর আবিস্কারে, শিশিরে রেখে যায় বিরহ-বিজ্ঞাপন!
জানালার গ্রিলে হাত রেখে ফেলে আসা পথে চোখের দৃষ্টি
চেতনায় ছায়ামুখ তার...
কখনও কি দেখা হবে আবার-
মুখোমুখি?
ছুঁতে পারি না...
পর্বত, আকাশ ছুঁতে পারে না-
মেঘকে ছুঁতে পারে- ভাঙতেও পারে ইচ্ছেমতো
আমি মেঘের প্রচ্ছদ ছিঁড়ে আকাশ ছুঁই
আর নীল জামায় গেথে দি নত্রর বোতাম
পাহার ছুঁতে পারি- বিুব্ধ সাগরও তেমন কিছু নয়
শুধু ছুঁতে পারি না...
ঈশ্বরের দখলে আশ্রম
নিদ্রাভ্রম চাঁদের কাছেই বা কি চাইব-
তার চোখেও দ্রোহের কুয়াশা-রোদকণার যন্ত্রণাবিভ্রম!
জলের আর্তনাদেও স্থবির হই, অতলে তার অগ্নি-কারাগার
প্রত্নসাগরের ভয়াল ছায়া
এখন ইশ্বরের দখলে আশ্রম !
দু'চোখ নির্মোহ পুরোহীত। রোদের কাছে চাওয়ার কিছু নেই
তার বুকে জমে আছে ধুলোর দিন-
গ্রহণের কালো দুপুর।
অন্তরালে
তীব্র সাইরেনে ঘুম ভাঙে...
ভৌতিক সুর সর্বাঙ্গ জুড়ে ঢেউ তুলে টেনে নেয়
কৃষ্ণরাতের গহ্বরে। ক্রমাগত লোনা তরঙ্গে
দূরবর্তী হতে থাকি বিদ্ধস্ত সময়ের সখ্যতায়
সবুজ প্রান্তর আর চোখে ভাসে না- না বালিয়াড়ি মুখ
দৃষ্টির অঙ্গারে পুড়ে যায় ফড়িং- রোদেলা ডানা
অন্তরালে মুঠোভর্তি অন্ধকারে বেড়ে ওঠে পবিত্র নড়ক!
পরস্পর বিচ্ছিন্ন হই সহস্র নটিক্যাল দূরত্ব।
ভূতের প্রকৃত বাসা
গৌতম চৌধুরী
লোকে বলে, ঘুটঘুটে আঁধারে ভূতের প্রকৃত বাসা
ঝোপঝাড় চিলকাঠা বাতিল গুদাম ভাঙা বগি...
বলে, এট্রু-আধটু জোসনা থাকলে ক্ষতি নেই, দুটি চোখই
বন্ধ রাখতে হবে,যত এলেমদার হদ্দমুদ্দ ভাষা
ভুলে যেতে হবে, দেখবে- ভূতের বাবাও দেবে ধরা
শুধু দোস্তি করো আর কথাচ্ছলে চালাও হুকুম
দুনিয়া নখাগ্রে, কিন্তু হোশিয়ার, নামে যদি ঘুম
সঞ্চারীতে, ঘার মটকে খাবে তাকে নিজের অন্তরা
লোকে বলে..., আমি কিন্তু 'পষ্ট দিনালোকে ছুট শুরু
ক'রে দিই, লম্বা লম্বা ঠ্যাংয়ে যেন আলোকেই ধাওয়া
এলোমেলো রাস্তা ধরে, ভূতগ্রস্ত মন উড়ু উড়ু
ছুটতে ছুটতে দিন পার চেনা পথ ঘর বাড়ি দাওয়া
মুছে এল, শ্বাসমূলে ধুলোর আস্তর হচ্ছে পুরু
ভূতের প্রকৃত বাসা তবে হয়ত একটুখানি হাওয়া...
শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এর কবিতা
জিউসের প্রেমপুরাণ
এখানে কেউ কেউ কিংবদন্তী বসে থাকেন। কেউ কেউ মৃত আত্মার খসড়া দলিল। ট্রয়চোখে কেউবা আবার গুনে যান হেলেন উপাখ্যান।
দেবতা জিউস একবার ভেসেছিলেন যমুনার প্রেমবানে। জোছনার আলিঙ্গনে আনন্দে কেঁদেছিলেন সমুদ্রদেবী...। জিউসপ্রেমে মুগ্ধ হয়ে আমিও কিংবদন্তী হওয়ার নেশায় প্রত্নস্বপ্ন ভরে রাখি বুক পকেটে । তারুণ্যের সস্তা ভাষণ ভরে দিই রমণীর ভ্যানিটি ব্যাগে। আর সেই থেকেই নদীগুলো রাখে চিতার আগুন। অনাথ বসে থাকে সমূদ্রশ্রবণ।
প্রদীপ জ্বলবে একা...
এই উর্বশী ক্ষেতে বসে থাকে স্বপ্নের গোলাঘর...। এখানেই শুয়ে থাকে শ্যামা মেয়ের শ্যামলী চোখ। পিপাসার জল কণ্ঠ ছুঁয়ে গেলে শ্যামবালিকার হাসি ঠোঁট মিশে থাকে জল পেয়ালায়। এ যাত্রার কোন শেষ নেই, কান্তি নেই, বিষণ্ণ আঁধারও নেই...।
বিকেল পাড়ের একটি পালক উড়ে আসে, আসুক। ভিজে যাক বর্ষায়। কিছুই বলবো না। কিংবা পড়শিরা ছি ছি করবে, করুক। কিছুই শুনবো না। যদি ক্ষেতের প্রান্ত থেকে উঠে আসে অতৃপ্ত মানব, পরাজয় মানবো না কিছুতেই...। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে এলে নিজেকে বিসর্জন দেবো বিছানার জলে। ভেসে যাবো স্রোতের ভেলায়। একটি মুখ তৈরি হবে। একটি প্রদীপ জ্বলবে একা। একটি শরীর মিশে যাবে শরীরের টানে। আগুনের বিস্ফোরণে আলোকিত হবে হবে পড়শি বাড়ি। পড়শিরা ছি ছি করবে করুক। আজ আমি কোন বাধায় মানবো না। শুয়ে পড়বো শ্যামলী ক্ষেতের ফসলী বিছানায়।
দৃশ্যহীন চোখে
তার নূপুর ঝংকারে চমকে উঠে উঁকি দিই বুকের ভেতর
অকস্মাৎ রক্তের কাঁপুনিতে ঝড় ওঠে তানপুরা সুরে
পরিচিত বারান্দায় দৃশ্যমান রোদ্দুর দেখে বুঝি
নিলাম হয়ে গ্যাছে সব
ঘুমের বাগান, সবুজ ফাগুন
বসন্তি ফুল...
নিলাম হয়ে গ্যাছে সমুদ্রের মুখস্থ কম্পাস।
এখন প্রতীক্ষা, আদিম আকাঙ্খার দৃশ্যহীন শীতল পরশ-
বিপ্রতীপ মায়ার আর কোন শুভ্রতা, অস্তিত্বের তপ্ত নিশ্বাস।
রোদের বর্ষায়
ব্যস্ত শহরে এভাবে হাঁটে না কেউ। কে হাঁটে ভিজে ভিজে রোদের বর্ষায়? হাঁটে না কেউ। কেইবা রাখে হাত রাতের কাঁধে? জ্বেলে যায় আগুন ফাগুন সুতোয়, দুঃখিনী কুপে?
প্রাচীন প্রথার নাগরিক কাক তাকিয়ে থাকে আড়চোখে তার দিকে। জোনাক মেয়ে সাজেনি তার কোনদিন কোনকালে!
রাতগুলো তার কাটবে কি উষ্ণ ঘামে ? দিনগুলো তার আসবে কি ফিরে জোছনা দামে ?
এভাবে স্বপ্ন দেখে না কেউ ব্যস্ত শহরে। কেউ কি স্বপ্ন কেনে, স্বপ্ন বেচে? স্বপ্ন বেচে না কেউ...
বোকা হাসি বুনে বসন্ত সাজাবে কে, কবে, তার আঙিনায় ?
মৃত স্বপ্নের পসরা
স্বপ্নের পসরা নিয়ে বসে যাই হাটুরে মজমায়। কবি কাঁধে ঝুলিয়ে রাখি মাছিদের জীবন ইতিহাস। মুহূর্তেই হয়ে যাই পতঙ্গ বিশারদ ।
নদীবুক ঘিরে রাখা স্বপ্নগুলো প্রতিদিন বিক্রি করি সস্তায় । ভ্রান্ত উড়তে থাকা মাছিদের স্বপ্নগুলো ক্ষত হয়ে পড়তে দেখি বিরহের সার্বভৌম চোখে। অতঃপর, নিজেই হয়ে যাই গল্পরসদ কিংবা সুবিধাবাদি কাকের আদল...
এভাবেই গড়ায় জীবনের দিনলিপি কান্ত সন্ধ্যায়। নিদারুণ অবজ্ঞায় পড়ে থাকে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন-শব।
নিঃশব্দ নিঃসরণ
তোমার আড়ালে লুকানোর দৃশ্যপট মনে করিয়ে দেয় অনুভবহীন সময়! আর মুহূর্তগুলো চোখের বিষন্ন ঘোর !
যতই লুকিয়ে রাখো সহাস্য মুখ তোমার; অন্ধকারে রচিত হয় অভুমিষ্ট শৈশব...আর সেইসব মুহূর্তের বিমূর্ত স্বর প্রশ্নবোধক চিহ্নে সনাক্ত করে কালিক সভ্যতা।
তবুও তোমাকে ছোঁয়ার আশা বুকে পুষে বন্ধ চোখে হাতড়াই সারাঘর। কৃত্রিম অন্ধকারে...।
জংলি নিঃশ্বাস
এখানেই থাকো তবে আজ। সওয়ার হয়ে বসো আদিম অশ্বের পিঠে।
মন্দ কি? আদিম পোশাকে না হয় সাজালে তোমার শহুরে কেবিন ! একদিন জংলি ফুলে নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেলে কি আর ক্ষতি এমন?
কালের দীর্ঘশ্বাস
যতবার নিজেকে সমর্পণ করি দৃশ্য আয়নায়, ভাঙনেরা খেলা করে অদৃশ্যে। অন্তরালে।
আর সেইসব দৃশ্যপট, ঈশ্বরের ভরাডুবি শুষে নেয় বিপরীত ঘাম। নির্ভেজাল বিচরণ রেখে যায় নিদারুণ অভিমান। কালের দীর্ঘশ্বাস।
যতবার মুখ লুকাই কালের নির্ভরতায়, ভবঘুরে মেঘ ভেঙে দেয় বিশ্বাসের অবয়ব। বর্ধিষ্ণু খেয়াল স্পর্শ করে কলঙ্ক-প্রাচীর।
নিষ্প্রাণ মেঘ একলা বিকেল
পরাজিত মেঘে ছিটানো থাকে ভুলের নিঃশ্বাস।দেহের প্রাচীরে ঝুলানো থাকে দুঃস্বপ্নের তাবিজ। দীর্ঘশ্বাস দহনে ভস্ম হয় স্বপ্নের গ্রাম । আর, ভস্ম গ্রামগুলো পুষে রাখে সঙ্গিহীন পাখিচোখ।
আহত বিকেল কাঁধে ভর করে ভুলগুলো গেয়ে যায় দুঃস্বপ্নের রাগ! স্বপ্নরা চেয়ে দ্যাখে কষ্টের কালো রাত। নিষ্প্রাণ ঢেউয়ের নদী! একদিন, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্নরা হেঁটেছিল সমান্তরাল...। ছলনা রঙে আকাশ গেয়েছিল রংহীন শ্রাবণ।
ভুলের কোলবালিশে নিঃশ্বাস আমার এখনও একলা বিকেল; একাকী রাত। কল্পিত মেঘে, এখনো চাষ করি তোমার ধবল দীর্ঘশ্বাস। একলা চোখে...।
বিস্মৃত সুখের বিলাপ
তার বুকে
তারছেঁড়া করুণ আর্তনাদ সুর
নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ নাগপাশ তার চোখে
তার মুখে
বেমালুম ভুলে যাওয়া বর্ণ সোপান
ধর্ষিত গণতন্ত্রের ভয়ার্ত চিৎকার
তার চোখ দেখে না আর
আলোভেজা ভোর
সুবর্ণ পালক
শিশির বকুল
অনির্বাণ সুখ...
জোছনার প্রেমকথন
তোমার আঙিনায় প্রতি বিকেল বেলা প্রজাপতি গায়ে মাখে ফুলের সুবাস । প্রতি জোছনা রাতে বাতাসের যত্নে বেড়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়া একটি গাছ ।
মনে পড়ে এক বোশেখ দুপুর। তুমি জানতে চেয়েছিলে, কতোটা ক্ষরিত তাপে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভরে ওঠে লাল ফুলে। কতোটা আবেগে গোলাপের পাপড়িতে ভর করে অগণন মৌমাছি। উত্তরে, তোমাকে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পাহাড় দেখার গল্প বলি। সারারাত জেগে জোছনা রাত আলিঙ্গনের গল্প বলি।
অনেকগুলো জোছনা রাতের পর আজ আমি তোমার কথা ভেবে ছাদের গোলাপ গাছটির পরিচর্যা করেছি খু-উ-ব। শুধু তোমার কথা ভেবে, আজ আমি কেঁদেছি ভীষণ। খু-উ-ব অন্ধকারে।
দগ্ধ মায়ায়
অন্ধকার না জেনে আলোর সাগরে ডুব দিলে ইচ্ছেরা মরে যায়। পাহাড়ী রাতের চূড়া ছুঁতে বাড়তে থাকে জীরাফ-গ্রীবা। আনমনে পুড়তে থাকে আলোর মায়া দগ্ধচতিায়।
আমাদরে ইচ্ছগেুলো বঁেচে থাকে অনুভবহীন বরিহ ভাবনায়। রোদ্রকণা মিশে থাকে হমিকুয়াশার ভীড়ে... ।
একটা কিছু ঘটবে আজ
একটা কিছু ঘটবে আজ। মোমের আলোয় ভ্রুণ চাঁদ,কুমারী ঘ্রাণ। গোলাপ খাতায় লিপিবদ্ধ হবে ঈগলচোখের শিকারী ঠোঁট...।
মাছরাঙা মন ছুঁয়ে যাবে জলের দাহ। অবগাহনের জলে ভেসে যাবে নিশিঘুম। লজ্জায় লাল হবে সৌরমেরু । ফোঁটা ফোঁটা ঘাম লিখে যাবে দীঘিসাঁতার।
এই মৃদু আলোয় লেখা হবে অমর কবিতা এক। সবুজের কচকচকে রোদ্দুর।
তোমার ঝর্ণাচোখে
তোর রেখে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসেও অনন্ত সুখ
ভুলে থাকা বেনারশী ঠোঁটের কান্নায় মিশে থাকে
মুগ্ধ আবেশ; রঙের প্রজাপতি...
তোর ঝর্ণাচোখে ডুবে যাই তৃষ্ণার্ত ডুবুরী
পুরনো হৃদয় লিখে যায় প্রেমের উপাখ্যান... তারপরÑ
শিহরিত প্লাবন মিশে যায় দিগন্তের শেষ পাঠে।
তুমি এলে
তুমি এলে যাযাবর পাখি হবো
বাঁধমুক্ত ঢেউ...
জ্যামিতিক রেখায় পাপী হবো তোমার গোলাপবিলে ডুবসাঁতারে
তুমি এলে বেপরোয়া ভালোবাসায় থমকে দেব রোদের দুপুর
পাখিঠোঁটে ছুঁয়ে দেব শীতল ছায়ার প্রজাপতি পালক।
তুমি এলে প্রিয় গানের ভেতর খুঁজে নেব ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের বিদগ্ধ আর্তনাদ।
ঈশ্বর আলোয়
ঘুমন্ত দ্বীপের আড়ালে কি লুকিয়ে রাখো?
রোদ? না অন্ধকার?
যদি রোদ রাখো তবে আগুন হয়ে বাঁচি
আর অন্ধকার হলে লুকিয়ে থাকবো পাতার আড়ালে
সুযোগ এলে চড়–ইভাতি রোদ বুনে যাবো ওষ্ঠচুম্বনে...
তারপর ঈশ্বর আলোয় খুঁজে নেব জলের পাহাড়।
বর্ষাহীন মেঘ আকাশ
ভাগ্য ঠোকরায় শাদা শাদা মেঘ। লুকোচুরি খেলা বেয়াড়া রোদ। বিস্তর মাঠ পিষে মরে পায়ের তলায়। তবুও ভাগ্য গোনে কিষাণীর ভাঙামুখ।
পোশাকপাড়ার শ্রমিক হাতে ব্যস্ত টিফিন। সুতোমুখে কুমারীর বদ্ধ বেণী। আনমনে ওঠেনামে নিরাশার ফেরারীবুক। হকারের ব্যস্ত ঝোলায় মরিচিকা খেয়াঘাট। পথের প্রান্তে সূর্যগাঁথা, জলের সরম।
এই রোদভেজা পোশাকপাড়ায় একমুঠো কবিতা বরং পথেই পড়ে থাক। পড়ে থাক বর্ষাহীন মেঘের আকাশ।
ভ্রম
ভুলে যাই কোন পথে যাবো...
সামনে মসজিদ, তুমি থাকো
পেছনে মন্দির, সেখানেও তুমি...
বলতো কোন পথে খুঁজে নিই ঘুমের শ্রাবণ?
ভুল মন্ত্র
তোর ইচ্ছের আগেই কলসে রেখেছি হাত
কোন মন্ত্রবলে তুই দিতে চাস ঘামের বদলে চাঁদ?
কোন মন্ত্রগুনে?
তোর জানালায় বসে থাকে পড়শী বাড়ির সাপÑ
জোছনায় গোনে নিঃশ্বাসের আয়ু
তোর ঢেউমাখা জলে ঝাপ দিয়ে পড়ে আতঙ্কমাছ
তখনই ভুল হয় মন্ত্র সব!
ভুল হয় জেগে থাকা রাতের পান্ডুলিপি...।
পিদিমরাতে
একরাত বুকে নিয়ে এসেছিলো সে। শুধু একরাত। অদৃশ্য মেঘের নীচে রেখেছিলো তার যত রঙ ও রূপ। ভোরের আলোয় স্নান করবে বলে পিদিম আলোয় সে গায়ে মেখেছিলো ফোঁটা ফোঁটা হিম। তারপর, কুয়াশা ও হিমের ভেতর তাকিয়েছিলো স্বপ্নদু’চোখ। শুধু হিমরাত্রি এসেছিলো তার গ্রামে
যত শিহরণ তার দেহে ফুটেছিলো হিমে আজও তা গড়ায়নি রোদ্দুরে। পিদিমের শিখায় পুড়েছিলো সব দীর্ঘশ্বাস, সব দাহ...।
বৃষ্টিতে ভেসেছিলো ওপাশের গ্রাম। পায়ে ভর করে দাড়িয়েছিলো ঝাউবন। কাঁঠালবাগান। কিন্তু, এক ফোঁটা জলও পড়েনি তার পাতার ভাজে সেভাবে...।
একটিও আসেনি ভোর পিদিম শিখায়।
স্যাটেলাইট বাতাস
নাকফুল খসে গেলে বনলতার নিভে যায় জোনাকির নক্ষত্রালোক...
শীতল কাক্সক্ষাগুলো পার করে ফুসফুস চৌকাঠ পুঁজিবাদ নর্তকী সাজে
ওয়েভ-ক্যাম ঢেকুর তোলে কর্পোরেট বিশ্বায়ন পায়ে ঠেলে মাটির চেরাগ
দৈনতা ঘিরে থাকে কৃষাণীর সোনাবুক
নিঃস্বতার প্রাচীর ঘিরে রাখে রোদের আঁচড়, মানবিক মূল্যবোধ
মিডিয়ারমনী ছড়ান আগাম খবর, ম্যাডোনার যৌন গ্লামার...
এই শহরে
এই শহরে বুভুক্ষু পায়ে হাঁটে রকমারী ফানুস
বেওয়ারিশ জুড়ে থাকে অন্ধকার
নগর ফানুসেরা রপ্ত করে মগজের নিঃশব্দ মডেলিং...
পৌষ-তাপ দগ্ধ অন্ধকার ফেরী করে আলোর শহর নগরে নগরে
আর হারানোর শোকবাহী বিপন্ন মুখগুলো খুঁজে নেয় আলোপথ-
রাতের প্রান্তসীমায়...।
অস্বচ্ছ আয়নায়
লজ্জায় লাল হলে পরে নীল বসনা প্রেম আমার
হয়ে ওঠে কাক্সিক্ষত ঐশ্বর্যসুন্দর
বিশ্বাসের নতশিরে যতবার যাই তার ড্রেসিংরুমে
নিঃশ্বাসে মাপি সমুদ্র-গভীর। দেখি-
অস্বচ্ছ আয়না সব; ভাঙনের প্রতিচ্ছবি
ফাগুন জানে
মেঘের সিঁথানে বসে কামনার রোদ বোনে ষোড়শী চাঁদ
ভিজে যায় সবুজ মেয়ে আকাশের ফুলশয্যায়
কী আবেগ গায়ে মাখে পূর্ণিমা চাঁদ
মৌমাছি তোলে গুনগুন সুর মৌরাগে, আহা !
কী রঙে জোছনা হাসে মিলন বানে, রাত্রি জানে; কী রঙে...
কী মায়ার চুম্বনে রাত্রি ভিজে সকাল নামে আকাশ জানে, কতটা মন্থনে-
কত রাত পার করে চাঁদনী মেয়ে হয়ে ওঠে শস্যনারী, ফাগুন জানে...
দৈব কামসূত্র
এসো নরকেই বশিভূত হই;
জলের শরীরে আঁকি কামের আগুন
বোধহীন শ্লোগান তুলুক ফেরিওয়ালা ঘুম
ভিজে যাক কাক্সক্ষা-প্রদীপ, বেহুদা অন্ধকারে!
আমাদের শ্মশানঘাটে অশরীরী পায়ে হাঁটে বিজয়নরক
হেঁটে যায় অসার বৃক্ষের কারসাজি, মৃত কংকাল হাসি
কান্তির চাদর গায়ে তাকিয়ে থাকে ভৌতিক চোখ, কামনার ঈর্ষায়...
এসো নরকেই বশিভূত হই;
সাদ ব্রা’র হুক খুলে জ্বালিয়ে দিই জলের প্রচ্ছদ
নগরসড়কে বেরিয়ে পড়–ক কাপুরুষ সুর- দৈব কামসূত্র!
অনাহুত অন্ধকারে...একা
কী অসীম দূরত্ববুকে বসে থাকো ! বসে থাকো একা !
দাড়াতে পারো না মুঠোভরা প্রেমে-
জলছোঁয়া নিরব সাঁকোয়...
তবে রঙিন পালকে কেন ঢেকে আছো অনুভূতি ঘর?
কি আশায়?
কেন খুঁজে ফের জোছনার সংলাপ নিঃসঙ্গ বুকে,
নিরক্ষর প্রাসাদে জ্বালিয়ে যাও নৈশব্দ্যের শৈশব?
এমন অনাহুত অন্ধকারে কি আশা জাগাও বুকে
এই অবেলায়; কি ভাষা ভাসিয়ে রাখো ক্ষত-বিক্ষত
শীতল চোখে...? নীল আঁচল জুড়ে সাজিয়ে রাখো
অশ্রু-প্লাবন ?
নিষাদ নয়ন এর কবিতা
হৃদয়পুরে নদীর বাড়ি
আর কতদূর হৃদয়পুর
প্রেমের বাড়ি
আমিতো সীমান্তবাসী
পড়শি আমার পাহাড়পুর
তার সাথে আড়ি
সকালে ঝরণায় স্নান
তোমার বাড়ি নদীর কূলে
নদীর জলে তোমার ঘ্রাণ
আর আমার তৃষিত প্রাণ
পান করি তোমার জল।
প্রবৃত্তি
রাস্তার পাশে প্রতিদিন অপেক্ষাচিত্র
আর তাদের বাড়ি ফেরা
মধ্যবয়স্ক মানুষ যার অন্য নাম নারী
পথচারীর কামুক চোখ দ্যাখে
পরিধেয় বসন
আর মন বিবসন করে দ্রৌপদীর শাড়ি
স্বগোক্তির মতো বিপরীত উচ্চারণ কর তুমি
‘সব শালা শুয়োরের বাচ্চা’
দিনলিপি
সকাল যায় দুপুর আসে। দুপুর শেষে গোধূলি
অতঃপর সান্ধ্যমেয়ে; চুলে তার অন্ধকার
অন্ধকারে কাছে আসে
ভালোবাসে
চুম্বনে চুষে নেয় তাপ
শরীরের জ্বর
আর রোমকূপে ঝরায় তনুস্বেদ
রাত শেষে যাও ফিরে দিনলিপি নিয়ে
ধীমান চক্রবর্তী
অশেষ
বহু রঙ ছড়ানো গানে
আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে
শহরের লম্বা সড়ক। জল পড়ার
ঝিরিঝিরি আওয়াজ টোকা দিয়ে সরাচ্ছে মেঘ।-
তার শ্রাবণ নীচের দিকে নেমে এলে,
গাছের পাতারা দ্রুত
আঙ্গুল থেকে খুলে ফেলে নখ।
সমস্ত রাধাচূড়া,ছাতিম,জারুল সরিয়ে সরিয়ে
আমি শুধু আলো খুঁজতে চেয়েছি।
এই দুনিয়াকে উপহার মনে করে
বহু মানুষ তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়,
পৌঁছাতে চায় নিজের গন্তব্যে।
একমাত্র মৃত্যু--
ছায়াপথের উল্টো পিঠ দেখতে পায়
বলে,মাঝে মধ্যে হেসে ওঠে।
ভ্রমণ কোনোদিন শেষ করতে চাই না
তাই খুলে রাখলাম যাবতীয় মুখোশ।
সরলরেখা ধরে ক্রমশ এগিয়ে আসে
বর্ষাতি ও ঝুরো পাতা।
টুসকি দিয়ে ঘুম ভাঙাই
কোমর জড়ানো বিছেহারের।--
তার চোখ থেকে একশো দু'শো
আলোর শহর বেরিয়ে এসে
অল্প গড়িয়ে যায় আমার সবুজে।
সরোজ দরবার
কানেক্টেড
একশো বন্ধু উপর নীচে আমার ছোটো চ্যাটরুমে
একশো বন্ধু কুশল নিচ্ছে নিয়ম করে অভ্যাসে
ঘরের বাইরে আড্ডাগুলো সাহেব বিবি গোলামে
মাতাল হয়ে খেই হারাচ্ছে মিলিয়ে যাচ্ছে কার দোষে
একশো মানুষ মত জানাচ্ছে আমার কথার টুকরোতে
একশো মানুষ ট্যাগ করেছে যে যার নজিরে প্রেম-ঘেন্নায়,
আমিও তার দাম মেটাচ্ছি অনুভূতির খুচরোতে
চোখের জলে কুমির হচ্ছি শেয়ার করা রাত কান্নায়
ভুবনজোড়া জাল পাতা এই ধরাও দিচ্ছি অক্লেশে
তোমায় ছাড়াও চলছি তো বেশ এসব ছাড়া চলছি না...
রাতবিরেতে অবাক আমি ভাবছি এলাম কোন দেশে
বন্ধু আছে জানা তো নেই বন্ধুবাড়ির ঠিকানা!
গেরস্থালি
(বাবা ও মা -কে)
বেশি দিনের টানাটানির পর
মেলে দিন দশের অর্থমুক্তি,
যে কোনো বেতনভুক ক্রীতদাসই
মানেন দিনের এই বৈষম্য
যেমন-আমার বাবা
মা’র কথা অবশ্য আলাদা।
ডিমের সুতোচেরা ভাগ থেকে
ইলিশ টুকরো বা পোলাওর বায়ানাক্কা
প্রতিটি দিনই সমান সমান,
নিক্তির সাম্যে মাপা
আজীবন সাম্যের স্বপ্ন দেখা বাবা
শেষজীবনে এসে যেন মর্মাহত,
বুকশেল্ফের গম্ভীর দার্শনিকরাও
বোধহয় নীরবে মেনে নিচ্ছেন সে কথা
কোনোরকম সাম্যবাদই এঁদের দেখা হল না,
যেমন এঁরা কোনোদিনই দেখলেন না
বাসনপত্তরের তাকে তুলে রাখা
মা’র হিসেবখাতা।
মেয়াদ
সময় চেনে না বলে
সযত্নে কেউ কুড়িয়ে রেখেছ
ভাঙা কাচের রঙ...
ক্লাস তার ভেঙে গেছে বহুকাল,
বান্ধবী অর্গ্যানে নতুন সম্ফিন,
সে বিচ্ছেদ চেনে,বিরহ জানে
পুড়ে যেতে জানে
আতস কাচের তাপে...
তবু দহন মধুর জেনে
আজো যে করে চলেছে বিগত পাঠ্য অভ্যাস
হে সবুজ মফস্বল...নবীনা শিক্ষিকা,
তুমিও কি তাকে জানাবে না আজ
এতদিনে বদলে গেছে সেসব পুরোনো সিলেবাস।
সিদ্ধান্ত
তাকে তুমি কি বলবে বলো,
কোনদিন যে শুনল না
তোমার কোনো কথা,
কোথাও কোন পথ নেই জেনেও,যে
শুধু তোমার ভিতরেই পথ খোঁজে
তাকে কী নাম দেবে তুমি
আত্মহত্যা!
তবে তাই হোক,এই নামেই
তার প্রবেশ হোক অভ্যন্তরে,
প্রতি মুহূর্তে সে তোমায় ধাক্কা দকি,
আর প্রতি রক্তপাতে তুমি মিলিয়ে নাও
তোমার নিদারুণ বেঁচে থাকা।
এভাবেই একটা গোটা জীবন
তুমি অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারো...
তবু,এবারে না হলেও
অন্তত পরজন্মের খাতিরেই
তোমাকে ঠিক করে নিতে হবে
তুমি তাকে
ভালোবাস
নাকি অস্বীকার করো!
অনেক আগে মরেছে বৌঠান
খালেদ হোসাইন
গুহা থেকে বের হয়ে আয়, সোনা
দূরে কোথাও নতুন সুর শোনা
যাচ্ছে তাকে প্রণের ভেতর টান
অনেক আগে মরেছে বৌঠান।
চারিপাশে নানা রকম ভেদ
ঝরে পড়ছে অশ্রু এবং স্বেদ
খুন হচ্ছে আদমজি পাটকল
রক্ত বয়ে যাচ্ছে গলগল।
একলা বেঁচে থেকে কী-বা লাভ
এবার একটু ওদের কথা ভাব
এবার একটু ওদের সাথে মেশ
আলখাল্লা খোল ফেলে দরবেশ।
ফুলের গন্ধে দিন করেছিস পার
চুলের গন্ধে রাত্রিতে তোলপাড়
তাই হয়নি কিছুই জানাশোনা
গুহা থেকে বের হয়ে আয়, সোনা!
রজত সিকস্তি এর কবিতা
০১. গত শতাব্দী আমার কাছে কিছু পাবে না (শোধকরে দিয়েছি)
“তোমার যখনই একজন শত্রুর প্রয়োজন হয় তখন কেন
প্রতিবার আমাকেই শত্রু বানিয়ে নাও?”
ডরিস লেসিং: প্লে উইথ অ্যা টাইগার
কেবল ঢুকতে ইচ্ছে করে- দরবারে, দোযখে ও গোপন ক্যামেরায়
যেমন ছোট ছোট মাছগুলো ঔষধ কিনতে যায়
পুলিশ আঁকছে খুব যত্ন করে প্রহরার নিখুঁত পোট্রেট
আগুনের পাশ দিয়ে যেতে হাত উপরে উঠে যায় মনের নির্দেশে
আমি ও মনে নিই- যদিও তুমি খাওয়ার সময় নিজেকে সাধনা
তিনশ'টা ফুল এ সকল শর্ত থেকে সব সময় ফোটেনা
০২. ফুসলিয়ে যাব কালান্তরে, বাঁকানো বিদ্যালয়ে
আমারতো লেখার কথা ছিল ঘটনা ভরপুর পরিবারটির
বাবা মা ভাই বোন; বোনের আছে বাঘ পোষা সামাজিক
সন্ধ্যা গমন
কেন আমি ইয়াবা লিখি? ছড়াই উত্তেজনা ট্রেনের
সংরক্ষিত খালি আসনের বুকে পিঠে?
দিয়েছে টাকা রানীর পকেট চুরি করে চটক পাপের
এক নিখাদ সমুদ্র রাষ্ট্রদূত তোমাকে- দেয় না?
খাইয়েছি অতিথি ডেকে গচ্ছিত উগ্র আওয়াজ
ফুসলিয়ে নিয়ে যাব কুমিরদের রতিবহুল পানশালায়
দরজা খোলা আছে-আসুন- একাই আসুন
০৩. মানিব্যাগের বন্ধু বান্ধবরা তাকে নিয়ে যে গল্পটি
প্রতিরাতে একবার ঘুমের আগে রোমন্থন করে
টাকার ভেতরে সব সময় একটি হাস ও একটি পুকুর থাকে
হাসটি ডুব দেয়; পুকুর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে
গুড়ো শামুক বা ছোট মাছ মুখে করে হাস ডুব থেকে ফেরে
পুকুর কিচ্ছু বলে না, হাসটাকে খেতে দেয় তার নিরলস খাবার
শেষকালে টাকার ভেতরের পুকুরটির অনেক খরচ
হয়ে যায় আর হাসটির হয় পর্যাপ্ত ইনকাম
০৪. কেটে যাচ্ছে তারের সাবান
ভোর বেলা ঢাকা শহর ইউনিফর্ম পরে আম্মুর হাত ধরে
গাড়ীতে ওঠে... চলে যায় ঘুম ভাঙ্গা স্কুলের সরিতে
আজ তার হোমওয়ার্ক দেখতে এসে ম্যাডাম বললেন-
তোমার মামনি কেমন আছে?
ঢাকা শহরের মামনি এখন অফিসে ব্যস্ত কফিতে-ধোঁয়া
দাঁড় কাক ডাকছে দুপুরের-বাসায় একা একা খেলছে
মনোযোগ; ভাইয়া তার বন্ধুদের সাথে ছাদে গিয়ে
আকাশ থেকে পাড়ছে ইয়াবা।
আজ ঢাকা শহরের বিকেলের মনে জানালার মত
সেটে না কবে বিরস পুরনো দোকান
স্কুলে সে পড়ে এসেছে- হাঁটু জল থাকে
আহমাদ শামীম এর কবিতা
০১. ব্যক্তিগত ডাকটিকেট- আট
এই সব নষ্ট গোপনীয়তা ফ্রেঞ্চফ্রাই ভেবে
খাওয়ার পর আফসোস করি
আমাদের আজ পাহাড়ে যাবার কথা ছিল।
বালতির ভিতর ডুব দিয়ে সন্ধ্যায়
কাউকে চুমো খেতে দেখিনি অথচ এসব গোপনীয়তা
আমাদের স্ত্রীগণ কাঁথা সেলাবার সময়
ব্লাউজের ভিতর থেকে বের করে আনে
আর মাসের খরচ মেলাবার সময় ভুল করে
হিসেব করে ফেলে প্যানথার ও ফেমিকনের দাম
আমরা ছাতার মধ্যে রৌদ্র লুকিয়ে ঘরে ফিরলে
বেডরুমের সরল গোপনীয়তা
গুচ্ছ গুচ্ছ আঙ্গুরের মতো মদ হয়ে যায়।
আমাদের গোপন ঈশ্বর তার শেষ অস্ত্র
ছুড়ে দিয়ে বোকার মতো হাসতে থাকেন
০২. ব্যক্তিগত ডাকটিকেট-নয়
আপাদমস্তক ভুল পোষাকে ভুল উচ্চারণে
যে কাঙ্ক্ষিত সময় হেঁশেল থেকে
চুরি বিদ্যা ধার করে সস্তা চটি বই পড়তে
ভালোবাসতো তার কাছে গত জীবনের
গল্প শুনে আশ্চর্যবোধক চিহ্নের মতো
দাড়িয়ে পড়েছিলাম।
সময়ের মানচিত্র থেকে ভূগোল শব্দটি বাদ দিয়ে
প্রেমিকাদের বগলের ওম থেকে
উদ্ধার করেছি সমূহ জন্মের তৈজস
আর আবেগ প্রবণ সম্ভাবনা গুলো
ছাটাইয়ের জন্য সেলুনে নিয়ে যাই
মামা বাড়ীর আব্দারের মতো।
পৃথিবীর ছবি আঁকতে গিয়ে মুলত
ফুলদানীর ছবি এঁকে ফেলি।
রজনীগন্ধার সাথে মানুষের মৌলিক
কোন পার্থক্য না থাকায় ইদানিং সবাই
ফুলদানীর মতো হাঁটে।
আর সময়ের শরীরে কাঁটা না থাকায়
তার সাথে নির্বিঘ্নে বাজীতে জেতা যায়।
০৩. ব্যক্তিগত ডাকটিকেট - দশ
তোমার ঠোঁট দুটি ঢেলে সাজাবার পর
পাখিরা অস্বীকার করেছিলো বিবাহ পূর্বক
শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা
আর সুর্যকে দাবা খেলার আমন্ত্রণ জানিয়ে
চোখে সানগ্লাস দিয়ে সূর্যগ্রহণের
কারণ সম্পর্কে দিয়েছি নিজের মতো ব্যাখ্যা
যে সব মেঘ রাস্তায় দাড়িয়ে বরফ বিক্রি করে
তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নিয়ে
তোমার চুলের সঠিক বিন্যাসের ব্যাপারে
থেকেছি প্রচার বিমুখ।
সবচেয়ে অভিজাত স্পর্শগুলো হ্যাংগারে
ঝুলিয়ে বুঝলাম তোমার দাঁড়াবার ভঙ্গি
আবিষ্কারের ফলে আমার কোন উপকারই হয়নি।
০৪. প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে যে স্বপ্নটি দেখি
রাস্তায় অপেক্ষমাণ গণিকারা
পেয়ারার স্বরবর্ণ শিখে জিহ্বার স্বাদ ভুলে যায়
ল্যাম্পপোস্টের ধর্মঘট তাদের
শরীর থেকে খসে পড়লে প্রার্থনা শুরু হয়
মসজিদে মন্দিরে
পকেটের টাকা শেষ হবার আগে
সমুদ্রে যাবার নাম করে যারা
প্রিয় গণিকাদের সাথে আদিম হয়ে ওঠে
জোয়ারের অপেক্ষায় তারা লাইফ জ্যাকেট নিয়ে
আবার লোকালয়ে ফিরে যায়।
এভাবে রাতগুলো নিজেদের
মানিয়ে নিয়েছে রঙ্গিন পালকে আর
বিবাগী আপেল নিহত হয় ঘুমের
পাড় ভাঙ্গা শব্দে
পেয়ারার উপাখ্যান পড়তে পড়তে এ শহর
হোমারের মতো অন্ধ হয়ে যায়।
০৫. আত্মহত্যা বিষয়ক রিপোর্ট
আমার ভিতরকার সব সাদা বালির পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তারাদের গায়ে
সেঁটে দিয়ে করবো আলোর উৎসব রঙিন জামার কলারে জমিয়ে
রেখেছি উৎসবের আস্ত বিবরণ, উৎসবের প্রধান অতিথির হাতে
তুলে দেয়া হবে একটি যুবতী তারার মৃত্যুর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।
বক্তৃতা আর সভার শেষে বিভিন্ন খাবারের সাথে পরিবেশন করা হবে
তারাদের আত্মহত্যা বিষয়ক মুখরোচক গল্প। আমার দেয়ালের প্লাস্টার
খসেপড়ে উৎসবে তাদেরও ছুটি প্রয়োজন, আমি বেগুনি তারাদের
কসম খেয়ে বলি-
আত্মহত্যা ! নিজের সাথে প্রহসনের এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
শুভ্রনীল সাগর এর কবিতা
হাতছানি
সর্ষেফুল ছুঁয়ে শুরুটা ‘দ’ অর দোআঁশের মধ্যাহ্ন। জানি ঘাসেরা ঘুম নয় বড়জোর বাঁশমালি বিয়ের ডালি। তবু এই ব্যথা পুতে দিলে হবে গাছ। কথা এটা নয় এলোকেশী সাঁঝ। বলা হচ্ছে ছায়া পর্যন্ত হৃদয় রোয়া ওঠা তালের আটি। শিশির পচনে ক্রমশ সুখের মৌন শ্বাস। সাদাবক তোর গন্ধ কেমন ভাঁপাপিঠা ভোর। চল যাই শালিধান সন্ধানে। সেক্ষেত্রে খানিকটা কুয়াশার ভূমিকা আবশ্যিক আঁধার। পাটখড়ি ব্যবধানে যার ঢেঁকিছাটা বোধের আদল। ভাবনাটা মাঝরাতের। এভাবে ফ্ল্যাশব্যাকে আসা-যাওয়া আমাদের হস্তিনাপুর হলুদ জীবন ....
এ পথও দিন দিন নাতিদীর্ঘ পিডিএফ পীড়ন ....
প্রতিক্ষণ উত্তরে
তোকে বলা যায় এসব কথা? এই ধুলো এই ধোঁয়া নদী হয়ে আমাদের মন। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো দুটো বাজতে এখনো দু মিনিট বাকি। যেতে চাও তো যাওয়া যাক রেল ছুঁয়ে মায়াজল মৈনাক সমাধি। দেখবে ঘুড়ির লেজটা লাল। তোকে চিনিনা বলেই বলছি বিজন বট। এখানে বেঁচে থাকা বড়জোর আলুসেদ্ধ মিহিন মৌনতা। তাও যদি জীবন হত কচ্ছপের পা, নটেগাছ মুড়োলেই পাওয়া যেত ত্রিতাল তিতির। তুই পারতিস এমন কাঠবাঁধাই রূপালী স্লেটের বোঝাপড়া অথবা মন মৃদঙ্গের জামপাতা আড়াল....
পড়ন্ত পাতা হয়তো ভুলে যাবে বেলিফুল চাতাল....
লিটলমেঘ মেলা
অষ্টবসুর আট আহ্নিকে মৈথিলী শব। রোদ রাইসর্ষের মাসতুতো দিদির দ্বিতীয় প ননদের মেয়ের মামী হলেও সম্পর্কে আমার বউদি লাগে। খেজুর রসে ধোয়া চোখ জারুল ছায়া। দূর থেকে যতদূর বোঝা যায় গাছের গুঁড়িরা অবসর ঘাস নয় ফুলকাটা উলেন মন। পাখি-পাতা যাইহোক এইসব বালিহাঁস ওম। খানিকটা হাঁটা হলে এবার থেমে যাই। আমাদের শুরু হোক শুরু থেকে। কলাপাতা ছিঁড়ে গেলে চিঠি হয় জানি। তুমি তো পড়নি মেঘদূত। তাই আপে আদিনাথ চূড়াময় অচেতন অহম। এই মেলা শটিবনে, চোখ রেখো জোনাকির জলজ মিলন....
আমারও ফর্মা দুই ষাট পাওয়ারের হলুদ জীবন....
ডেইলি সোপ
আর তুমিও পাইরেসি আদল। হামেশা পাশ ফিরছ পরাণবাবুর প্রেসে। ওটা বাৎস্যায়ন ভাবুক ব্যাকসিটে সন্ধ্যার রঙ । পরিযায়ী ত পুষে উড়ে আসা পাখির শীত কথা প্রসঙ্গে পেয়ারাফুল। বরং গুনগুন ব্যথাগুলো গান হোক বেলাময়। খানিকটা সময় পেলে হয়তো বোঝা যেত বৈদিক মুখোশ। শ্রুতিলিখনে নোনাজলের নাড়িও সোম থেকে শনি। চিপায় বিজ্ঞাপনের স্নিগ্ধতা। ফাটামন মেনে নীল ময়েশ্চারাইজড্ ধোঁকা । এই ফাঁকে তোমার চোখ কেমন আদিম ছাপাঘর । আমি ভূমিকা বনে যাই ভোরের মলাটে। আমার কাছে আসাই যদি হয় তোমার উড়ে যাওয়ার কারণ তবে থাকুক গরানের সমান্তরাল ব্যবধান। উদ্দেশ্যে উক্ত আশ্বলায়ন ভাষ্য আর আমাদের লুকানো ন্যাফথ্যালিন প্রেম, অ-কাম....
এ ধরনের ব্লাউজে সামনে বোতাম....
সদা ঝরাফুল
উৎসর্গ: কোন এক কাগজকুড়ানি
তোর আদ্যোপান্ত অনুবাদে পেঁপেফুলই অনুমিত আদ্যার। না বাসুক কেউ পোড়াকাঠ ঘুম, লুকিয়ে বর্ষা রাখিস রুটির ভাজে। নালিশে নখ খুটে কেয়াবন কৈলাসের নাড়ি। যদি হয় দুপুর বেটে মেহেদী দিবি তবে একসাথে পিছু নেবো ফড়িং ছায়ার। ভগ্নাংশে ভোর ধুয়ে কফোটাই বা দ্বাদশী বৈঠক। যতদূর বোঝা যায় হাত পাখার উল্টোপিঠে গুটিপোকা দিন। সেটাও তো নয়ানীতি আড়াই চালের। ভরপেট জোছনা ভুলে ভালোবাসা বানভাসি চাঁদ। দিলাম দাঁড়ি টেনে। দেখলি কেমন চোখের কথা চেপে গেছি, তোর খিদেপেট হৃদয়ের ব্যথাও....
রোদ ভুলে তোমরা বরং রাতকেই থামাও....
এখানে আকাশ নীল
কথা প্রসঙ্গে উলগন্ধ কৃষ্ণপুর গন্তব্য। আমাদের সুখও শালা সেদ্ধ বুটের ডাল। এখন শাড়ি শুকেই আদিম অস্থিরতা অনুভব করে নিতে পারি। গরু গৃহপালিত জন্তু, উহার চারটি পা-বিষয়ক রচনায় জানা যায় মানুষ গরুর কোন উপকারেই আসে না। ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে শরীর যদিও ধুপদানি। আমাদের দেখা হোক মেটেআলু মধ্যাহ্নে। এ কথায় ‘অ’ বসিয়ে অবশ্য চোখের ভাষা পড়া যায়। সাঁঝের লন্ঠনে জীবন যেমন পূর্ণদৈর্ঘ্য তৈলাক্ত বাঁশ, স্বভাবে....
নতুন আলু দুকেজি নিলে বিয়াল্লিশ টাকা রাখা যাবে....
চ্যাপ্টার ফোর
কৌতূহল খলনায়কের ভূমিকায় ছিল ঠিকই। আচমকা বন্ধ ডেকে বসে আছে তোমার ঠোঁট। সেক্ষেত্রে ভাবের কথা উঠলে প্রশ্ন দিয়েই উত্তর খোঁজা সহজ। এ শীত পোস্টার হয়ে গেলো রূপমহলের দেয়ালে। নিদেন পে হুডতোলা চুম্বন হতে পারত তৃণমূল বিরোধী। নির্জনতা লতা হোক তুলট বাস্তবে। একদিন কুঁড়ি হলে পারিজাত হরণে হবে ফেরা। রোদ রজ:কালীন, রঙিলার নাভিমূল নাড়িয়ে উরুগন্ধ গন্তব্য। বরং সাবধানতার কথা উঠলে চাঁদও চটিপাতা। পাখি বোঝে সে ভোর? সেই বোধ হয় দুলাইন এক হয়ে মেঘনা ভুলে গেল বৈদ্যবাজারের বুকের মাপ। আর আমিও কেমন অপ্রকাশিত অধম....
বালক বিস্ময়ে পুড়ে ওঠে পাতাকপি সম্ভ্রম....
সাঁকো
বারীন ঘোষাল
এই রেখাটা এক জলের নদী হতে চায়
নদী তার আকূল হারায় প্রতিবার
ছেঁড়া কূল লেগে থাকে সাঁকোতে
আজ সাঁকোর মানুষ চাই
প্রতিবার আমন আঁকা সন্ধ্যা দেয় শহর
পথে নামে পথহারারা
তার সুআভায় দুলদুল করে ঘোড়া
তার হায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি দোয়া নাজ
আঁক জোনাক
প্রতি প্রতিধ্বনি
ফুলবাবু ফুলবিবি কবিতা বিতার খিল্লীয়া
মানুষের এফোঁড় ওফোঁড় তরঙ্গ কেউ গুনছে না
কেবল সে সাঁকো চড়তে চায়
আর নাড়াতে
তার হরাঝান্ডা
চলে যায় যাত্রীহীন জল
আর ছবিহীন অশ্রুসকল
মালিহা জেরিন এর কবিতা
উত্থান ইতিহাস
০১.
অগণ্য অন্ধকারের গলুই ছেড়ে শেষে
বিলোল বিধুর শালিক জনান্তিকে
পৌঁছুতে হবে আজ... পৌঁছুবোই
০২.
বহু-বহুকালের নিদ্রিত হিমের বঙ্কিম চাতুর্যে
অন্ধকার-ব্যাকরণ-বৃত্তান্ত শিখে নেয়া পৃথিবীর
বিকল জীবনের আলিম্পনায় আঁকা ইস্টিশানে
ব্যাকুল-বিদারী অপেক্ষায় আমি
এক নীলুয়া অপরাজিতা ট্রেনের চিহ্ন-টানে
বোধির পরতে জমা
ঝিল্লিমুখর অন্ধকারের
শেষ গন্ধটাকেও অবশেষে
চিনিয়ে দেব, পৌঁছে দেব
চিতার অন্তিম জলসাপুর
সমুখ সূর্যদিনে...
০৩.
প্রস্তুতি গড়েই নিয়েছি
তন্ত্রের উনুন-অঙ্গারে পুড়ছে এখন আমার
ফেলে আসা কাপালিক-আশ্রয়ের
সবটুকুন অতীতের বর্তমান
সঙ্গমসঙ্গীত
অলীক সহস্র সুখ জেনে নেয় যে পূর্ণতার অন্তিমে আঁকা থাকা দীপাধার, সে গন্তব্যের কাছাকাছি প্রার্থনার নিবাত ধ্যানের মতন জেগে থাকে, জাগিয়ে রাখি তুমি আর আমি- আমাদের নোক্তা নোক্তা অপার বিমুগ্ধ ক্লান্তির নিঃসরণ। নিঃশব্দে নিঃশ্বাসে নিঃক্ষত্রিয় তকমা তোলে আমাদের প্রেমে কামে ঘামে নামে নামিয়ে আনি ঠিক প্রমোদে প্রলয়-পুরাণ।
এরপর, পিঙ্গল মাটির ভাঁজে আমাদের সৃষ্টির সাঙ্কর্য সাষ্টাঙ্গে তুলে দিলে গন্তব্যের কাছাকাছি এসে এক সুনন্দ শঙ্খধ্বনি শোনা যায়...
এস এম ফারুক এর কবিতা
মাতৃভূমি
আলোটা জ্বালিয়ে রাখ...
ওরা ফিরে আসবে আবার।
জানালাটা খুলে দেখি--
সত্যের সন্ধানে দাড়িয়ে অসহায় নির্ভীক সৈনিক।
ওরা আসবে...
পদ্মা মেঘনা যমুনার অববাহিকায়
রৌদ্রোজ্জ্বল কৃষ্ণচূড়ায়;স্বপ্নময় চোখের চেতনায়
জলকেলি; আম্রকানন -তরুলতায়
বিদুষীর প্রতিটি শিরা-উপশিরায়-রক্তকণিকায়
ওরা আসবে;
আবহমান বাংলায়;
রক্ত দিয়ে রক্তের ঋণ শোধ করতে ।
ওরা আসবে--
দুর্বার গর্জনে,দোর্দণ্ড প্রতাপে,খঞ্জর হস্তে
জঞ্জাল সরাতে।
শ্বশানে যৌবনের মশাল জ্বালাতে।
স্কুলের ব্ল্যাক বোর্ডের খছখছ শব্দে বারুদ জ্বালাতে
বৈশাখী মিছিলে রং-বেরঙ্গের প্ল্যাকার্ড আর
আপন শক্তিতে আত্মার বন্ধনগড়তে
প্রচণ্ড ঝড়ের শেষে;আম কুড়ানিরগল্প শোনাতে ।
ওরা আসবে--
দামামা; বাজিয়ে; আউল বাউল আর
নেউলের ঠোটে সুখ-সারি গান শোনাতে
ছায়াবীথি তলে মেঘল দীঘির পূর্ব পাড়ে
জ্যোৱস্না-স্নানে; সাথী হতে
কৃষাণীর এলো কেশে অনিন্দ্য সুখের দোলা
দোলাতে।
পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভায় একটি
ফুটন্ত গোলাপ আঁকতে
মাতৃক্রোড়ে একটি শিশুর “ভাস্কর্য”
নির্মাণ করতে এবং এ-দেশটাকে ভালবাসতে।
শব্দ
পর্ব-১
জলের ভেতর এতো শব্দ ?
হাসি-কান্না; ত; “আহা: বাবা”- নষ্ট গদ্য।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো পদ্য
রক্তের দাগ; চোয়ানো বিষাদ; কষ্ট
“জীবন্ত কন্যা-সন্তানের মাটি চাপা”
ছুটন্ত তীর বটবৃক্ষে বিদ্ধ।
জলের ভেতর এতো শব্দ-এতো কাব্য ?
চিহ্নহীন ধূসর দিগন্ত - ছন্নছাড়া
দুর্ধর্ষের ঘাড়ে মৃত্যুর থাপ্পড় –, কাঁপুনি
অশ্লীলতার ভাজে দীর্ঘকায় কামড়-অত্যাচার
সু-গন্ধির বাসর ঘরে সেই সব স্পর্শ
রোদ-বৃষ্টি-ঝড়; ভাঙ্গনের করুন সুর।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো যুদ্ধ ?
নুড়ি পাথর মাটি; পাহাড় পর্বত খুড়ে দেখ।
অনাদি কালের বে স্পর্শ করে দেখ।
রুক্ষ রুঢ়; রোদ- বৃষ্টি- ঝড়ের কত ত?
হাজার বছর পর আবার পিছু ফিরে দেখ
জলের ভেতর কত শব্দ? কত দুঃখ?
ক্ষুধা তৃষ্ণা-যন্ত্রণা; কাব্যের গর্ভে--
ঝলসানো রুটি।
পর্ব -২
পৃথিবীর উৎস মুখে’ যে শব্দ, বর্ণমালা; য়
আদি-উপাখ্যান ; চুইয়ে পড়া বিষ; ”প্রতিধ্বনিত”
পথে-প্রান্তরে; লোনা জলে ; শালবনে; উল্লাসে
অগ্নিপালকে; সে সব শব্দ “বনবাসী”
উত্তর প্রদেশের ফুলনের বে হাড়-পাজরে ।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো বর্ণমালা।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো কান্না
পৃথিবীর উৎসমুখ হতে হেটে চলেছি... ...
গ্রীস সভ্যতা; ভারত বর্ষ; পারস্য উপসাগর;
রোম সাম্রাজ্য; বেদনার নীলাসক্ত পার্ল হার্বার
চীনের প্রাচীর; বিধ্বস্ত-বিদগ্ধ হিরোশিমা; ভিয়েতনাম
টুইন-টাওয়ার; ট্রয়নগরী, জুলুল্যান্ড; পিউনিখ;
ইয়োডক, কোডক প্রিজন সেল; গুয়েন্তানামো;
কত-শত যুগ,– শীত-বসন্ত- হেমন্ত... ...
ফিদা, কোরা উপত্যকা,
ঝলসানো পোড়ানো ১৯৩৯ হতে ১৯৪৫
মানবতার হীন-ঘৃর্ণ্য বিপর্যয় ১৯৭১,
শ্বেত-শুভ্র রমনার বটমূল; নগ্ন তেপান্তর
তপ্ত তৃষ্ণার্ত মরু; বিদগ্ধ অযোধ্যা বিপন্ন
জেরুজালেম; আদিবাসী; নৃ-জাতি গোষ্ঠী,
উজাড় শালবন, পতিত ভাঙ্গা রাজ প্রাসাদ
বোধের দেওয়াল, সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড;
বিষণ্ণ প্রান্তর নদীচরাচর, উপত্যকা,
তন্ন তন্ন করে হেটে চলেছি----
সাম্রাজ্যের প্রাণান্ত প্রতিটি দেওয়াল,
খুটে- ভেঙ্গে দেখ কত শব্দ?
কত কান্না জলের ভেতর ।
পর্ব -৩
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো স্পর্শ
ত্রিশূলে প্রেতাত্মার পদধ্বনি; ভ্রূণ হত্যা
প্রহসন খুন আর হানাহানি; গায়ত্রী মন্ত্রে
সূর্যে; রাহুর কক্ষপথে - কাব্যের টানাটানি
যুগের দেহে নিমগ্ন সমগ্র বিপর্যয়।
স্পর্শখানি আছড়ে পড়ে প্রাচীন গ্রন্থে ।
অতৃপ্ত আত্মার মিছিল-কোলাহল প্রতি জনপদে
আরব্য রজনীর হাজার রাতের গল্প এক চিলতে
বোধের দেওয়ালে ।
বাদল-দিনে তুমুল বৃষ্টি-ঝড়, পুণ্য স্নান, অর্ঘ্য
তীর্থ যাত্রা; আত্মার স্পর্শ; দহনে, দংশনে
আত্মদীর্ণ লখিন্দর।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো স্পর্শ
বেহালার সুর --- কতদূর------।।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো বিষ-
অশ্লীলতার শিস, অমরত্ব প্রতিশোধ প্রতিহিংসা
সৃষ্টিমুখে অগ্ন্যুৎপাত জ্বলন্ত শিখায়
গলে গলে লণ্ডভণ্ড প্রান্তরে।
ঝকঝকে কাচের দেওয়াল; গাঢ় যৌবন
বাতাসী বন; উল্ল্যাসী সজ্জা, প্রেয়সী চোখ
তপস্বী চুম্বন, ঘনান্ধকার, বসন্ত-রজনী উৎপীড়িত;
বিষে, আর ... পোকার দখলে ।
জলের ভেতর এতো শব্দ, এতো বিষ।
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো বর্ণমালা
চিরকাল নদী চরাচরে শুনি ভাঙ্গনের গান
আহত আত্মার নূপুর সানাই আর্তি-”বর্ণীল”
বসন্তের রাগ-রাগিণী এক তারা কেঁদে উঠে বিষণ্ণ প্রান্তরে
তুমুল বৃষ্টির অর্ঘ্য ধুয়ে-মুছে নেয় নোনাবালি, রক্ত, দাগ
যুগের ক্ষত
পর্ব -৪
জলের ভেতর এতো শব্দ। এতো দাগ
আকাশের বুকে পোড়া-মাটির দাগ
অপূর্ণতায় বেড়ে উঠা পোড়ামাটি
দীনতায় হীনতায়; ভাগ্যের নির্মম নিষ্ঠুরতায়
ছেয়ে যায় দিন- লক্ষহীন অলক্ষ্যে
সারস পাখি উড়ে যায় নীরব নিঃশ্চুপ।
জলের ভেতর এতো শব্দ-এতো গান- এতো প্রাণ
শিশিরের আনমনা সুর বেজে উঠে তেপান্তরে পুণ্য জলে ।
কর্মে-ধর্মে পৃথিবীর সকল শালবনে
দ্বীপান্তর, শিকড়-বাকড় সুসম সমতলে
স্বপ্নময় চোখের দ্যুতিতে তৃষ্ণার্ত ভালবাসার অবগাহনে
সুখ-সারি মাঝি, জোয়ার ভাটায় বৈঠা বায়
মোঘল- রোম- গ্রীস সভ্যতায়, বাকিমহাম,
ক্রেমলিন, জলজ নায়াগ্রা, বেথেল হেম
পৃথিবীর উৎস মুখ হতে তন্ন তন্ন করা
প্রতিটি জনপদ, রোদ- বৃষ্টি -ঝড়, তরুলতা;
বেবিলন, চিত্রানদীর এতো প্রেম এতো ছন্দপতন
এতো গভীরতা, প্রলুব্ধ প্ররোচিত করে নগ্ন- প্রেতাত্মা।
জলের ভেতর এতো শব্দ ? এতো গন্ধ ?
চন্দন নগরে তীক্ষ্ণ তীর ধনুক- গোলাবারুদ
দগ্ধ উদ্যান; অপ্সরা যুবতী থোকা থোকা রক্ত
ক্রন্দন; নিংড়ানো ভালবাসা।
ঝাপসা আলো- শ্মশানের চন্দন গন্ধ
তন্দ্রায়; মাটি চাপা; কাটাকাটি,
বজ্রের সঙ্গে মেঘের সঙ্গম
বাতাসে যুদ্ধের ফিস-ফিসানি, দামামা,
লক্ষ্মী পেঁচার কপোল বিদীর্ণ-লুণ্ঠিত,
স্রোতস্বিনীর আঁচলে রক্তের দাগ-কান্না;
সলজ্জ-রৌদ্রকণা; দুপুর।
পর্ব- ৫
জলের ভেতর এতো শব্দ ? এতো উৎস রহস্য
ইহকাল, শুকনো এক অভাবগ্রস্ত বাসীপান্তা- গ্রন্থ
দম্ভকারী- ধনাঢ্য করুণ অবশেষে ডেবে গেল মাটির অতলে
অপরাহ্ণে যে বালকটি হত্যা করা হল?
জুলকারনাইন লৌহ-শিশা দ্বারা যে প্রাচীর নির্মাণ করলো?
একটানা তিনশত বছর যে যুগল ঘুমিয়ে ছিল
আদি স্রষ্টা হিংসা- হানাহানি সব সঞ্চালন করলো
গ্রন্থি সমূহে ।
গুণীজনেরা এক দৃষ্ট তাকিয়ে অনন্তে ছুটে চলা
”চির যুবা”- অশ্বটির প্রাণে।
ম্যাক্সিম গোর্কীর প্রাচুর্যের স্বর্ণ শিখরে
আরোহণ করে আত্মহত্যা ?
মহীয়ান ভাস্কর্য; রাজমুকুট, গম্বুজ নক্ষত্র
কাব্যের গর্ভে আটেনা যেন, এতো কান্না
রহস্য-কাব্য-কবিতা।
প্রাণ ভরা আর্তি; ছন্দ-গন্ধ, ব্যর্থ মনোরথে
মুনি-ঋষি ভ্রু-কুঁচকায় ক্ষত-বিক্ষত অন্ধকারে।
সন্ন্যাসীর উদাসী ব্যাকুলতা; মর্মমূলে
ভয়ংকর আর্তনাদ বাজিয়ে... ...
তৃষ্ণার্ত উনোনে বাজায় করুন সুর।
জলের ভেতর এতো শব্দ, এতো পাপ-পুণ্য?
ক্যাথলিক চার্চ; গীর্জা মন্দির, পূজা মণ্ডপ
উপাসনালয়; ছন্দময় গন্ধময় আগুন হতে
প্রজ্বলিত আলো বিচ্ছিন্ন নয়।
দম্ব-ভম্ব, জয় ক্ষয়, জুলুম নির্যাতন
ধ্বংস যজ্ঞের দেহে অশনি সংকেত ।
সৌরাংশু সিংহ এর কবিতা
তারাপদ রায়কে...
বাড়ি
আমার বাড়িতে
লোকজন এলে ভালো লাগে না আর
ক্লান্ত হয়ে পড়ি... বিরক্ত লাগে খুব
ইচ্ছা করে না, কিছুতেই ইচ্ছা করেনা...
কেবল সবাই উল্লাস করতে করতে
ঘুমিয়ে পড়লে
আমি নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াই বাড়িময়
চাপা দীর্ঘশ্বাস... অযথা বাড়তি মৌনতা
তারপর আমিও ঘুমিয়ে পড়ি
এক-বুক ইচ্ছাকে জাগিয়ে রেখে।।
সূর্য
শচীন সেন সরণী দিয়ে হেঁটে আসার সময়
তুমি ডান হাত তুলে দেখিয়েছিলে শেষ আকাশের সূর্যকে
কাঁপা কাঁপা হাতে মেখে নিয়েছিলাম তার স্বপ্নকে
আজ হঠাৎ আবার দেখলাম উলটো ফুটপাথ থেকে
কিন্তু, দুহাত দিয়ে জাপটে ধরেও উষ্ণতা অনুভব করি নি কোনো
পরে মনে পড়ল আজকাল
চুলে কলপ লাগাচ্ছি দু হাত ভরে...
খুব করে।
ভূমিকম্প
একদিন একটা রেলগাড়ির কামরার নাম দিয়েছিলাম
‘প্রেয়সী’
কিন্তু সে ফিরে আসে নি কখনো...
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, সময় নিয়ে, বারন্দা থেকে খুঁজেছি অনেক-
তবু কখনো মনে হয় নি যে সে আসছে।
পরশু ভূমিকম্পের পাতায় প্রকাশ হয়েছিল
ভগ্নস্তুপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে
একটা রেলগাড়ির কামরা
প্রাণপণে নিজের নাম খুঁজে চলেছে।।
তোমারও ভাল হোক
দেবযানী ভট্রাচার্য
তুমি চলে গেছ বলে, গাছের পাতারা
হাহাকার করে কেঁদে ওঠেনি একবারও
তুমি চলে গেছ বলে, আকাশে তারাদের কাছে
জানতে চাইনি, কী করেছিলে তোমরা
তুমি চরে গেছ বলে, ক্রোধের আগুনে
জ্বলে ওঠেনি আমার তৃতীয় চোখ
সবকিছুর জন্য মনের ভেতরে চাই তোমার উপস্থিতি
মনের পরতে পরতে শুধুই পাথর, তুমি নেই
পাথরে খাঁজে জমে আছে প্রেম, তুমি নেই
সকলের পাশাপাশি তোমারও ভালো হোক।
মমিন মানবের একগুচ্ছ কবিতা
এ্যকুরিয়াম সাঁতার
নি:শ্বাসটুকু আটকে আসে দীর্ঘশ্বাসে,
খোলা আকাশটা ঠেকে যায়
বনসাই অরণ্যের চুড়োয়
দূরদিগন্ত লেপ্টে থাকে
গেরস্ত দেয়ালের দেয়ালিকায়।
আজকাল শখের এ্যকুরিয়াম সাঁতরাই
পাড় হতে চাই ময়লা খাদ,
বহুদিন আমরা লিলিপুট সভ্যতা
সারাদিন হেঁটে বেড়াই
নিজেদের ছায়াটায়।
ভ্রান্তিপাঠ
ভুল ঘণ্টা শুনে ফেলে গেলে স্কুলকাল
পাঠ্যপাঠ পোড়ায় কাঁটাতার নিয়মে;
আজও পাপ-ই পড়ি নিরঙ্কুশ পুণ্যে!
ফারাক বুঝি না ময়লা আর মননে।
ক্লাস ছেড়ে স্কুল সুইপারের কাছেই
বুঝি উত্তম- এভাবে ফেলবো নর্দমা
দুর্গন্ধে ছিটাবো আরো ব্লিচিং পাউডার।
জন্মজঠর
নিজ গর্ভেই জন্মধারণ প্রত্যেকের
প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগায় শরীরের
পায়ের পাতা গজায় হাটতে হাটতে
নিজ হাতেই মাপন কত হাত হবে
হাত, পাঁজরে হৃদপিণ্ডের মাপ আর
মগজ, রক্ত স্রোত কেমন? স্বপ্ন রঙ?
ভুল দূরত্বে বারবার জন্মেই বুঝি
আজও পেরুতে পারিনি এ জন্মজঠর।
স্টেশন
ট্রেন চলে গেলে
শূণ্যতা পড়ে থাকে পিছনে পিছনে
শহরটা মরে যায় একদিন
ধূলি জমে থাকে এখানে ওখানে
কোনো ট্রেন ভিড় করে না আর
ধূলি জমা স্টেশনে
ফিরে এসো চাকা
বিনয় মজুমদারকে
ফিরবো না বলে প্রতিদিনই
মুছে আসি তোমার শরীরের ঘ্রাণ
তবুও প্রতিমূহুর্তেই ফিরে যাই
তোমার কাদামাটির পৃথিবীতে
মুঠোতে আগলে রাখি যত পাহাড়পর্বত
প্লাবিত করি উপত্যকা তোমার
আর চাতক পাখির মত তুমিও
বৃষ্টি ঝরাও আমার আসমান থেকে।
বিভাজন
নিজেকে ভাঙছি; প্রতিনিয়ত।
ইটের খোয়ায় ভেঙে ভেঙে নির্মাণ নয়
স্বার্থের শিকারে দ্বিধান্বিত তারামাছ।
হাত পা, সব ক’টা চোখ
চোখের কোঠরে এতোশত স্বপ্ন
ছেড়ে দিয়ে এখন লেজ-খসা টিকটিকি।
সময়ের মুখোমুখি ছাড়ছি নিজেকেও-
অস্তিত্বের ভেতর আজ ভিন্ন স্বর
ভিন্ন সমুদ্রের বসবাস;
থেকে থেকে নি:শেষ করে।
পাথরপদ্য
অযত্নে পড়ে থাকে পাথর পাহাড়,
কথা বলবে না- ভেবে ভেবে
ঘুম চোখের ঈশ্বর দিন;
মানুষ দিনে পাথরে আজ
দ’হাত রাখি স্বপ্ন আবাদে-
উল্লাসে হাসে তাই পাথর পৃথিবী।
পাপ!
জানি সত্যই পাপ! আর এ পাপ পবিত্র: আশ্চর্য এক ঈশ্বর!
ব্রুনো যেদিন নগ্ন করলো সত্যের সৌন্দর্য সেদিন, আকাশ মাটির সবকিছু আবার নতুন করে সাজানো হলো। পৃথিবী তার প্রাচীন স্থবিরতা ছেড়ে ছুটে চললো, নতুন আলোতে আলোকিত হলো পৃথিবীর পুরনো সব খাদখন্দর, পৌরাণিক গুহা। তখন সে আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো ঈশ্বরের পায়ুপথ।
এ পাপে ব্রুনোকে পোড়ানো হলো পাদ্রিদের পবিত্র আগুনে!
লালন
মমিনুল হক, পুরু নাম মোহাম্মদ মমিনুল হক-
আসমান ছোঁয়া এক ডালে একটা পোক্ত রশি বেঁধে ঝুলতে থাকে। মনে করে এই রশি বেয়ে বেয়ে একদিন সে পৌঁছে যাবে হুরপরিদের আস্তানায়। তখন পেছন থেকে আতর মাখা কেউ কেউ ধাক্কা দিলে মহানন্দে উপর নিচ দোল খায় আর ভাবে, এভাবে হয়তো একদিন আরশে মানে আরশিনগরে পৌঁছে যেতে পারবে।
ওদের সবার চাপাচাপিতে হঠাত রশিটা ছিঁড়ে গেলে লালন ওটা ধরে ফেলেন। লালন মানে ফকির লালন সাঁই। তখন রশিটা একতারা হয়ে বেজে ওঠে আর আসমানে যারা ছিলো ওরা সবাই মাটিতে নেমে আসে।
সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে লালন গাইতে থাকলো:
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, নইলে খেপারে তুই মূল হারাবি... ...
মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার... ...
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে, যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান জাতি-গোত্র নাহি রবে... ...
এক সময় মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলেন: মানব তুই আরশিনগরে যাবি না!
তখন থেকে সে, মমিন মানব।
তোমার অতল গভীরে
ডুবে যাবার আগে
ভেবেছিলাম আমার পূর্বপুরুষদের কথা মনে পড়বে
কাছি পাকাতে পাকাতে যারা
স্বপ্নগুলো পাকিয়ে তুলতেন।
আমার বাবার কথা মনে থাকবে
যিনি অন্ধকারের ভিতরেও অনেক অনেক আলো খুঁজেন,
বড় বোনের কথা-
কামারের দোকানে পুড়ে পুড়ে শান তোলা অস্ত্রও
অনাস্ত্র হয়ে যায়... ...
মা- সরলভাবে ভালোবাসা, তৃষ্ণা রেখেই তৃপ্ত এক নারী!
আমার বন্ধুদের কথাও মনে পড়েনি
আগামী দু:খগুলোতে যারা সাথে থাকবে বলে
অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে ছিলো
চোখের চৌকাঠে।
ডুবে যাবার আগে আমার মনে ছিলো না
আমার অতীত
আমার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অথবা
অতীত-ভবিষ্যতের মাঝামাঝি কল্পিত বর্তমান।
ডুবে যাবার আগে বুঝতেই পারিনি
আমি ডুবে যাচ্ছি
চোখের গহ্বরে, তোমার স্বপ্নের ভিতর;
ডুবে গিয়ে আমি আবারও ডুব দিলাম অতল গভীরে।
রাহু-কেতু
ব্রক্ষ্মান্ড সাজানোর সময় রাহু আর কেতু দক্ষিণা পায়নি বলে একজন সূর্যকে অন্যজন চন্দ্রকে গ্রাস করে সময় সময়। এই সূর্য কিংবা চন্দ্র পুরু গিলে ফেললে এই পৃথিবী আর থাকবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে।
কলম্বাসও একবার রাহু হয়েছিলো। ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডের আদিবাসীদের বললো: তোমরা আমার কাছে নত না-হলে আমি দিন-দুপুরে সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলবো। তারপর সূর্য হঠাত গ্রাস হয়ে গেলে তারা তখন কলম্বাসকে দেবতা মেনে ছিলো। এরপর সে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী হত্যা করে দেবতার আসল রূপ দেখিয়ে দিলো।
রাহু-কেতুতে বিশ্বাস নেই আমার। কিন্তু অবিশ্বাস তো বিশ্বাস করি! অবিশ্বাসই কী বাহু-কেতু! গ্রাস করে চন্দ্র সূর্য পৃথিবীসহ এই মহাবিশ্বজগত।
স্যাটেলাইট
সূর্যরা কখনও ডুবে না!
পৃথিবীর দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে, কোটি কোটি বছরের জ্বালানী নিয়ে ঝলঝল জ্বলে চলে।
এখানে আলো আসে না, সূর্যের; আসে না তাপও। অন্য কোনো নক্ষত্রের খুব ক্ষীণ আলোও প্রাণ চঞ্চল করতে পারে না, এখানে… …যারা দৌড়াতে পারে না তারাই তো পরে থাকে পৃথিবীর গাঢ়তম অন্ধকার পীঠে!
আমরা তাই দৌড়াতে থাকি পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে। জানি, যে দিন দৌড়াতে দৌড়াতে পৃথিবীর চেয়ে গতিমান হবো, আমাদের গায়েও চাঁদের মতন আলো পরবে; সারাদিন, সারারাত। তখন আমরা প্রত্যেকেই, চাঁদের চেয়ে দৃপ্তমান একেকজন।
মহাকাশ জুড়ে তখন, অসংখ্য চাঁদের মিলন মেলা।
আজগুবি
আকাশের উপর অদ্ভুত কল্পনায় আঁকা সেই মাচায় বসে তুই হাসছিস! তোর দাঁতে এখনো দেখি মাংসের আঁশ আটকে আছে- মানুষের শরীরের কাঁচা মাংসের আঁশ! মানুষের মগজ-মাংস-হাড় তোর এতো প্রিয় কেনো! হাড়গুলো চুষে চুষে খেয়ে তুই ঝুলিয়ে রেখেছিস তোর ঘরের দরজায়; শুধু ঝড়ো বাতাসে নয়, হালকা বাতাসেও টুং টাং বেজে ওঠে; আর আমাদের মনে পড়ে যায়- তোর ক্ষমতা কী প্রকাণ্ড! কী প্রতাপ তোর সবখানে! মুতে-কুতে তোর চারপাশ কেমন জঙ্গল করে রেখেছিস, তবুও কেমন আতর আতর গন্ধ আসছে; কিন্তু তারপরও গা গিন গিন করছে। দূর থেকে দেখলে তো তোকে সুন্দরই দেখায়! আর সামনে থেকে দেখলে, দেখা যায় তোর চেয়ে বিশ্রী কোনোকিছু আর নেই।
ঘুমের মধ্যে এসব যা-তা ভাবছিলাম। ঘুম ভাঙার পর কোনো মাচার চিহৃও খুঁজে পেলাম না।
যত সব আজগুবি গল্প!
গ্রামীণ ব্যাংক
মাঠের সব আখ মাড়াই করে রসগুলো এক সাথে রাখা হয়, পরে এখানেই আবার গুড় ভাঙা হয়- ঠিক এমন না।
ছোট ছোট মাড়াই মেশিন ঠিক যেমন এখানে ওখানে, রাস্তা-গলি-মাঠের ধারে ধারে থাকে-
আখের খণ্ডগুলো খাঁজ কাটা রোলারের ভেতর চমৎকারভাবে ঢুকে যায়। চিরে চিরে ভিতর থেকে তাজা রসটুকু বেরিয়ে এসে আরও চমৎকারভাবে একটা টিনের ভিতর পড়ে। রোলারগুলোতে একটু ফাঁকাই রাখা হয়। একবার আখটাকে চাপ দিয়ে কিছু রস বের করার পর পানিতে আবার ভিজিয়ে রাখা হয় পরের বারের জন্যে। আখের খন্দগুলো চিরে ফানাফানা হয়ে গেলেও এগুলো দুমড়ানো হয় না। এভাবে আখের একফোঁটা রস থাকা পর্যন্ত একবারের পর আরেকবার আবার আরেকবার রোলারের ভিতর দিয়ে আখের খন্ডগুলো অনেক যত্ন করে চাপিয়ে আনা-নেয়া করা হয়। আর অনেক অনেক যত্ন করে রসের টিনটা সরিয়ে রাখা হয় পরিষ্কার জায়গায়।
প্রতিদিন কতো পরিচ্ছন্ন কাজ চলে এখানে…
শ
শরীরের ভাঁজে ভাদ্রের বুনো টান। পরতে পরতে রোদরঙ লুকোচুরি- লালগোলাপীনীল অথবা ধবধবে সাদা বুনন।
চাঁদের ওম ছাড়ে পাহাড়ের চূড়া আর সুপ্তগিরির মাতাল লাভা গোপন তাপ চোখে মুখে রঙধনু ছড়ায়। দ্রষ্টা ধ্যানে শরীর ধুয়ে ওঠে ঘন নি:শ্বাসে, হৃদয়ের গলিত কুয়াশা ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্লান্ত হয় শস্যের ক্ষেত। মাথা নুয়ে দুধেল ডগা মাটিতে দৃষ্টি রাখে বীজ ধানের প্রার্থনায়।
তখন কবিদের ঈশ্বর শরীর ছেনে লুফিয়ে নেয় অশরীরী শব্দ, ভাদ্রের টানটান অনুভূতি ভরে তোলে শস্যের গোলা আর ক্লান্ত ঘ্রাণে মৌ মৌ করে কবিতার শরীর।
ভিয়েতনাম পর্ব
সিঙ্গাপুরে যেখানে এম্বেসি অব গড আছে
জানি না, গডের কাছে আবেদন করা যায় কিনা!
ভিয়েতনামে দেখলাম এম্বেসি অব শাতান
এর চারপাশের দেয়ালগুলো থুব উঁচু আর
বর্শার মতন গ্রিলগুলো উপরের দিকে তাক-করা
গেটের কাছে খাকি রঙের কয়েকটা প্রহরী
হয়তো ওরা শয়তানের প্রতিনিধি, হয়তো অনুচর।
বিল্ডিংটার উপরে যে পতাকাটা ওড়ছিলো
ইউএসএর পতাকার সাথে তা হুবহু মিল দেখে
তখনই আমার হুগো শ্যাভেজকে মনে পড়লো।
২
সাইগন রিভার বেয়ে দক্ষিণ চীন সাগর
সমুদ্র ঘেঁষা পাহাড়ী শহর বুন তাও
ফরাসিরা ঘাঁটি বেঁধেছিলো কোনোকোনোদিন
পাহাড়ের চুঁড়ায়
জিসাসের উচু একটা স্টাচুতে
অনেকের সাথে সূর্য ওঠা দেখতে ওঠলাম...
সকালের সমদ্রস্নাত সূর্যটা না-দেখিয়ে
একটা লাল পতাকা দিকে তাকিয়ে
ভিয়েতনামিজ এক কলেজ স্টুডেন্ট বললো:
আংকেল হু আমাদের শিখিয়েছেন
কীভাবে মাথা উচু করে দাঁড়াতে হয়।
৩
আশি মিলিয়ন লিটার এজেন্ড অরেন্জ
পাঁচ মিলিয়ন যার ইফেক্টেড পিপল
পরিমানে অনেক কম
চল্লিশ ভাগ বিধ্বস্ত বনভূমি আয়তনে অল্প
অথবা চার মিলিয়ন মৃত ভিয়েতনামিজও
সংখ্যায় কিছু না।
অথচ, একজন সিআইএ এজেন্ট...
আহা রে!
এ
কা
ই
অসংখ্য...
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও যা
গুনে শেষ করতে পারে না...
ঘাস
সাদা স্বপ্নের প্রতি অনাগ্রাহ বলে
সাদা পৃষ্ঠা পেলেই
দাগাদাগি খেলি অনেক আগে থেকে;
ঘাঁই খেয়ে খেয়ে লালচে কালো শরীর
পুড়ে পুড়ে আরও গাঢ়ো হলো।
কোনো একদিন সবুজও ছিলাম হয়তো:
’ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।’
মানুষ নাম নিয়ে আমি শুধু ঘাস হয়েই রইলাম!
জীবনানন্দ, আমি তো সবুজ রইলাম না-
সবুজ ঘাসের মতোন...
২
রৌদ্র উজ্জ্বল স্বপ্নের ভিতর শরীরের ম্যালানিনগুলোর
গোপনে ক্লোরোফিলে রূপান্তর...
তারপর থেকে এডিবি’র অনুদান ছাড়াই
তড়তাজা হয়ে ওঠলাম
নিরক্ষ রেখায় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে।
আমি খুবই কালো- কালোর চেয়েও
যাদের সব থাকে তারাই সাদা হয়।
-এই সূত্রটা স্কুলজীবনেই জেনেছি। বিঞ্জান জাদুঘরের পদার্থবিদ্যার কক্ষে যেদিন সবগুলো রঙ মিলে আমাকে বিস্মিত করে আশ্চর্য রকম সাদা হয়ে গেলো, সেদিনই বুঝলাম জীবনের রঙসূত্র: পূর্ণ শুন্যতাবোধের কালোরূপ।
আমাদের স্বপ্নপুরণ নেই, সাধনার সমাধান নেই, সম্পর্কের সমীকরণ নেই, শুধু নেই নেই জীবনের দু:সহ কালোরঙধনু কালো করে রেখেছে আদিকাল থেকে।
আমি কালো, আফ্রিকার লোক কালো, আদি মিসিসিপির আদিবাসীরাও কালো…
অরুন্ধতী রায়
লিসেনিং টু গ্রাশহোপারস:
প্রজাপতি কিংবা ফড়িংয়ের চেয়ে মৌমাছি অনেক অনেক উপকারী! যদিও মৌমাছির হুল থাকে! হলুদসাদালালনীল রঙ তুলে ফড়িংগুলো বাগানটা শুধু ভারীই করে তোলে! মধুটুকু খেয়ে যায়! কেনো কাজে আসে না- শুধু পরাগায়ন ছাড়া! অথচ মৌমাছি সবই করে; মধুটুকু জমিয়ে রাখে- আমাদের ফাঁদপাতা বাক্সে, আমাদের জন্যে! তাই তো কেউ ফড়িংয়ের চাষ করে না, করে মৌমাছির চাষ! একচুয়েলি মৌমাছির চাষও না, এটা মৌ চাষ!
দ্যা গড অব স্মল থিংস:
পিঁপড়েগুলো যেখানে বাসা বেঁধে ছিলো কিছু কুকুর তা মাড়িয়ে গেলো। তাতে অনেক গুলো পিঁপড়ে মারা গেলো- তা কুকুরগুলোর চোখে একটুও পরল না। দু’চারটে পিঁপড়ে কুকুরের গায়ে চড়ে চলে গেলো কুকুরের আস্তানায়। তারপর তাদের পিঁপড়ে বন্ধুদের নিয়ে আসলো সেই আস্তানায়। পিঁপড়েগুলো এখন জানে কী করে ঢুকে যেতে হয় কুকুরগুলোর কানের সুড়ঙ্গ দিয়ে, পায়খানার রাস্তার অলিগলি দিয়ে। কুকুরগুলো তাই নিয়মিত সমাবেশে বসে পৃথিবীটা কীভাবে পিঁপড়ে মুক্ত করা যায়।
ওয়্যার ফর পীস
আজ বুঝলাম ওয়্যার অ্যান্ড পীস কোনো ভিন্ন শব্দ নয়। একই…
ওম শান্তি! শান্তি- বলে মহান মহাত্মা গান্ধীর পুরু ব্যাপারটাই রপ্ত করে ফেলেছি। তবু আমার দাসগিরি গন্ধো গেলো না।
হাতের ব্যবহার জানতাম তবে হাতিয়ার জানতাম না। মন বুঝতাম ঠিকই কিন্তু মাইন বুঝতাম না। তাই বলেই কী পিপাসা পেলে পান করতাম নিজের পরিত্যক্ত পেশাব!
এসব ব্যাপারে অনেক উৎসাহ আসে আশপাশ থেকে। বলে, এ-ই হলো শান্তি প্রিয় মানুষ! এদিকে তোমাদের দিকে সবাই ছি: ছি: ছড়ায়। কারন তোমরা হাতকে হাতিয়ার বানিয়েছো এবং মনকে মাইন।
সূর্য ধরার দৌড়
এ রকম সূর্য উঠা কখনো ভাবিনি। ভাবনাটা অভাবনীয় করে দিয়ে সত্যিই সূর্য উঠলো মাঝ রাতে। এ সময় ঘুমোতে যাবার কথা নয় কারো। তবু কেউ কেউ যায়। আবার কেউ ঘুম ঝেরে লাফিয়ে উঠে সূর্যের পিছু দৌড়াতে থাকে সূর্যকে ধরবে বলে। যেমনটা তুমি।
আমার তখন একের পর এক দু:স্বপ্ন দেখা ঘুম ভাঙা নিথর দেহ। বহুদিন তাই ঘুমোতে যাই না দু:স্বপ্নের ভয়ে।
তোমার সূর্য ধরার দৌড়ে একদিন তুমি নিজেই সূর্য হয়ে দেখা দিলে। তাই যে পথে এখন আমি হাঁটি অথবা দৌড়াই তার শেষমাথায় প্রতিদিন সূর্য উঠে। সারাদিন আলো দেয়, তাপ দেয়। কোনো দিনই ভুল হয় না তার।
আমি জানি সে-টা তুমিই!
বিড়াল আর দুধের গল্প
দেশ আর রাষ্ট্রের তফাৎ এক সময় বুঝতাম না। যতীন সরকার একদিন দেশকে বুঝিয়ে দিলেন, সেদিনই চিনে নিলাম রাষ্ট্রের চেহারা। কুৎসিত চেহারাটা দেখে আমার মুখে থু থু জমতে থাকে, হাত মুঠো হতে থাকে, ঠিৎকারে চোয়াল শক্ত হতে থাকে। তাই রাষ্ট্রও আমকে ঘৃণা করতে থাকে। অবশ্য তা আগেও করতো। কিন্তু বুঝতে পারতাম না।
এখন বুঝতে পারি রাষ্ট্র আর দেশ কীভাবে মিলে যায়! এ-ঠিক বিড়াল আর দুধের গল্প।
কচুরিপানার ভেলা
নোয়াম চমস্কি’কে
অনেকই বলে, জলে তলিয়ে যাবার সময় কচুরিপানা ধরতে পেলেও বাঁচার আশা ফিরে পাওয়া যায়; এমনকি নাগাল না-পাওয়া কচুরিপানা দেখেও চোখে আশার আলো আসে, ভেসে থাকার প্রেরণা আসে।
অনেক কিছু না-পাওয়ার অনেক কষ্ট তলিয়ে দিতে চাইলে, অন্তত কিছু পাওয়ার কিছু কিছু আনন্দ; বাঁচিয়ে রাখে- সে তো কম না!
জলে তলিয়ে যাবার আগে তন্নতন্ন খুঁজে ফিরি কচুরিপানা। একটার পর একটা মিলিয়ে বানাতে চাই ভেলা। একী আমাকে ভাসিয়ে রাখতে পারবে না অথৈ জলের সাগরে, বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না এ পৃথিবীতে!
আই এম টকিং অ্যাবাউট ফুয়েল অয়েল
আই এম টকিং অ্যাবাউট ফুয়েল অয়েল
বিহাইন্ড দ্যা সান:
মারাই কলের চাকা ঘুরে ঘুরে আখের মিষ্টি ঘ্রাণটা হঠাৎ হেভি ফুয়েল অয়েলের সাথে মিলে গেলে বুকের আর্তনাদ পাঠ করে বিব্রত মৃত্যু।
ব্রাজিলের মাঠে মাঠে আখ চাষার চোখ এভাবেই কী বিস্ময়ে ছেয়ে যাবে আখের রসগুলো ইউএস টেকনোলজিতে ট্যাংকারে ঢুকে যেতে দেখে!
:আজব মাহাজন! সবখানে কেমন তেল তেল গন্ধ পায়।
দ্যা গোল্ড রাশ:
কালের কেরামতিতে ডাইনোসরগুলো এখনো গলে যাচ্ছে খনিতে খনিতে। তার উৎসবে ঘরে ঘরে গ্লোবাল আমেজ। মানুষও তো গলে গলে চলে যায় মাটি খুঁড়ে আরও দূরের খনির নিচে। সেই মানুষ জীবন্ত একএকটি তেল, উৎস ইউএসএনএস অবজারভেসন আইল্যান্ড ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে আর হোয়াইট হাউজের চোখের সামনে হেঁটে বেড়াবে তা তো হয় না!
তাই তুই খুব ঘন করে গণকবর খুঁড়িস বাগদাদে, কাবুলে। কালেরে দেখাস তোর কেরামতি।
জারজ
কে জন্ম দেয় আমাকে! মূহুর্তে মূহুর্তে-
ঠাওর হয় না
কার ভিতরে গতকাল আমার জন্ম
আর আজ কার ভিতর
জানি না
কীভাবে যেনো জন্মে যাই বেজন্মার হদ্দ-
কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।
শ্রীনগর, পশ্চিম তীরের ঢিল হাতে
রাগী চোখের কোনো বালক-
হঠাৎ তার বুকে জলপাইরঙ মৃত্যু
না জন্ম
ঠিক ঠিক-থাকে না;
মৃত্যু তো অনেক দুরে!
আমার কোনো জন্ম জ্ঞান নাই।
কালপাত্র কিছুই জানা নাই।
অহরহ ঘটতে থাকে জন্ম আমার
এখানে, ওখানে
আমার ভিতরে।
গতি
আলোর গতি কতো- সেটা সবারই জানা হয়ে গেছে সে অনেক আগেই। তবে স্বপ্নের গতি!
আমাদের স্বপ্নের সাথে ছুটে চলে লুসিয়া মোরেট। ম্যাক্সিকো শহরের প্রিয় পরিবার আর অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ফেলে চষে বেড়ায় দূরদেশ জঙল দূর্গম গেরিলা জীবন।
মোরেট, স্বপ্নের গতি জানতে স্বপ্নের পায়ে পায়ে তোমার গতিও দিয়েছো মিলিয়ে, বাড়িয়ে দিয়ে সে গতি তোমার বারুদক্ষত দেহ বিছিয়ে রাখো স্বপ্নসাধকদের সাথে ইকুয়েডর সীমান্তে, সমচেতনার বন্ধুদের হাতে প্রতিবাদ ব্যানারে ছেয়ে দেয়া ম্যাক্সিকোর দেয়ালে দেয়ালে।
আর আমার অপুষ্ট প্রেমের পাঁজরগুলো ঢেকে রাখি সেই শ্লোগানেই।
সত্য নেংটোই দাঁড়িয়ে রইলো
সত্যকে নেংটো দেখে সবাই হা-পিত্তেস শুরু করলো। তারপরও সত্য এভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
মাছগুলো
পৃথিবী যখন শুধু এককোষির জলাশয় ছিলো মানুষ পশু তো দূরের কথা উদ্ভিদ আর প্রাণিতেও কোনো তফাত ছিলো না। এক সময় মাছ হয়ে সাঁতার কাটতাম আদি সমুদ্রে। তারপর বানর, শিম্পাঞ্জী অথবা মানুষ। আর কী বিবর্তন হবে না! মানুষ তখন কী হবে? কল্পনার দানব?
এখনকার মাছগুলোও একদিন মানুষ হবে। আমাদের মতোন ঘর সংসার করবে। সংস্কার করবে অনেক কিছু।
গাছের গল্প
পার্কের বেঞ্চিতে বসতে সামনে অনেক পাতা পরে। আর আমি পাতা পড়ি। পাতার ধ্বমনি শিরা উপশিরা পড়ি। কিন্তু হৃদপিন্ড পড়তে পারি না। সব সময়ই ভাবি গাছের শিকরেই খুঁজে পাবো হৃদপিন্ড।পরক্ষণেই মনে পরে গাছের ডালও তো মাটিতে গুজে পূর্ণাঙ্গ এক গাছ।
গাছের গল্প বলতেই অনেকে আরশে আজিমের কাছের একটা গাছের কথা বলে। দুনিয়াতে যত মানুষ ততটা পাতা সে গাছে। নতুন পাতা গজালে একজন শিশু জন্মায় আর কোনো পাতা ঝরে গেলে একজন মানুষ মরে যায়। সে সময় আমার কেনো যোনো পাথর কুচির কথা মনে পরে খুব। তার পাতাগুলো মাটিতে ঝরে পরে আর নতুন গাছেরা গড়ে পাথর কুচির শিকল। ঠিক যেনো মানব বন্ধন।
গোয়াল
এই নদী আমার এই আকাশও আমার
এই পাখিভোর মেঘঘুড়ি বৃষ্টিদিন সবই আমার;
শুধু এই রাষ্ট্র আমার নয়।
অন্য যে কোন রাষ্ট্রও কি আমার?
মানুষ মানুষের হয়
নদী হয় নদীর
আবার নদীরাও হয় মানুষস্বপ্নের অবলম্বন।
কোন রাষ্ট্র কি হতে পেরেছে সে স্বপ্নচারী জীবনের?
রাষ্ট্র শুধু গোয়ালে গোয়ালে বেঁধে রাখে
সবার ওলান শূন্য করে দিয়ে
খনিদুধটুকু বাজারজাত করে প্রভুরাষ্ট্রে।
সুমন গুণ
স্বেচ্ছাচার
সরল ফলের মত বোঁটাশুদ্ধ, অনুযোগহীন
দক্ষিণের ঘরে তুমি সাজাচ্ছ দেরাজ, ছবি আর
সফল বিছানা।
জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দেখছ দূরের
বাড়িতে নিঝুম রোদ, এক গাছ থেকে
অন্য গাছে শব্দ করে উড়ে চলে গেল
দুতিনটি চড়ুই, টের পাচ্ছ চারপাশে
হাওয়ায় পুরনো কোনো গানের বেদনা মিশে আছে
একটু পরে, অনুতাপহীন
ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবে পাশের বাড়িতে
বিভ্রান্ত শরীর থেকে, ঝুঁকে
খুলে ফেলবে নির্ধারিত শস্য ও বল্কল।
কাজল চক্রবর্তী
সম্ভবের সম্ভাবনা
পাতাটা নেমে এল মাটিতে, এইটুকু জেনে
এখন সে গাছের নয় মাটির
কোন মাটির ! যে মাটি ধারণ করে বীজ
বীজ থেকে কাণ্ড ও পাতা
পাতা ছাড়া গাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব।
তবুও পৃথিবীতে বীজ ফলে, গাছ দেখি
পাতাদের ঝড়ে পড়া দেখি
অসম্ভবের অ মুছে দিয়ে সম্ভবের সম্ভাবনা ও দেখি
হাসান সাব্বির এর কবিতা
প্রামাণ্যচিত্র
নৈশব্দেই আত্মহত্যা করে জোনাকিরা সৈকতে উঠে আসে তিমির ঝাঁক। ভাবনার বুদবুদ ওড়ে ; উড়ে যায় দীর্ঘশ্বাসের গোপন চিঠি বেনামী ঠিকানায় । নির্মাণের খাতায় পড়ে থাকে ভুলে ভরা দৃশ্য ও দীর্ঘশ্বাসের অজস্র মুহূর্ত স্বর্নোজ্জ্বল জন্ম-মৃত্যুর আল্পনা আঁকা! বাউল মন আজ ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখে মনে পড়ে নেয় দুরন্ত কৈশোর- ধুলোমাখা পথের দৃশ্য ও ছবির প্রামাণ্য- মনে পড়ে অমলের কথা, বই পড়ে যার সাথে বন্ধুত্ব এবং বছর পর বিচ্ছেদ। পাললিক প্রাণের দিক দর্শনে এখনও আনাড়ি খুব- সময়ের ফ্রেমবন্দী চোখে তবুও স্বপ্নের কোলাহল। কৌতূহলের তুমুল তৃষ্ণায় সেই কবে নেই হয়ে গেছে প্রেমজ মধুরতা- নিভে গেছে আলোর প্রভা।
মুগ্ধতার সকাল য়ে য়ে স্মৃতির বিবর্ণ পাতারা ঝরে যায়- মৈথুনে নীল হয় কুমারী হৃদয়!
পোস্টকার্ড থেকে পাঠ
পর সমাচার এই যে, ভূতটাকে যখন হাতে-নাতে ধরিয়া ফেলিয়াছি তখনই হাত ফস্কে...। ভূতটা যে কি তি করিতেছে মানুষের মগজে...। অত্যুক্তি হইবে না যদি বলি, ভূতটার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। এত দ্রুত রূপ বদলায় অতঃপর রাজার রূপ ধরে যখন শীর্ষ আসনে বসে তখন বিশেষ শ্রেণীর প্রজারা ধুলো নেবার জন্য...। বলিতে সংকোচ করিতেছে- এইসব দেখিয়া-শুনিয়া কিছুই করিতে পারিতেছি না। এই রাজ্যের মানুষগুলো এত মননশীল ও মেধাবী যে...
পরিসর সংক্ষিপ্ত তবুও একটা কথা না বলিয়া পারিতেছি না তুই কি এখনও ধ্যানমগ্ন দেবী’র চরণে ?
ধ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রা
দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়ে বেলা নেমে আসে ভাটিতে...
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন- স্বপ্নের মধ্যে কল্পনার মুখ! নব্বইয়ে পাগল হয়েছি- শূন্যে হয়েছি কবি! আর প্রজন্মে এসে পদ্যে লিখি পদ্য-পাতার জল। তিন প্রহরের ইতিহাস যার নখ-দর্পণে নেই তার চোখেও এই অবেলায় নেচে ওঠে ধ্রুপদী নৃত্যের মুদ্রা- কিভাবে যেন সেও জেনে যায় বাসনার বাৎস্যায়ন হাতের আঙুলে। স্বপ্নে যা দেখি তার সবই আভিধানিক নয়- না কোন বোতলবন্দী ভূতের কাহিনী-কেচ্ছা!
একটি জীবন তবুও
শনি ও রাহুর শত্রুতায় চুরি হয়ে গেছে অজস্র স্বর্ণের অধ্যায়- স্মরণীয় মুহূর্তের অনেক দুর্লভ। জীবনতো অসংখ্য ছোট গল্পের সমষ্টি- সব গল্প বেঁচে নেই- বেঁচে থাকে না। অদৃশ্য অনেক গল্প- দৃশ্যত: কোন কোন গল্পের পৃষ্ঠা ছেঁড়া, অস্পষ্ট অর শব্দ ।
একটি জীবন তবুও ঘোরেফেরে বুকে নিয়ে ক্ষতচিহ্ন পথে পথে- পাড়ায় পাড়ায়।
চলতে চলতে পথ
শূন্যতা বিষয়ক একটি গল্পের মধ্যে কত যে প্রশ্ন...। উত্তরপর্বে এসে বোকার মতো মাথার উপর খোলা আকাশ নিয়ে হাঁটি বহুদূর- তবুও কি খুঁজে পাই তৃষা মেটাবার মত...। বুকের মধ্যে অচিন পাখি এক করুণ স্বর, কাঁদে নিভৃতে। পূর্ণতার কাছে পরিত্যক্ত এই অস্তিত্বের খড়িমাটি!
পথের মোড়ে মোড়ে ঝুলে থাকে অনেক প্রশ্ন- অনেক উত্তর নতমুখ হেঁটে যায়- রঙিন হাসে। এইসব দেখে দেখে শূন্যতা বিষয়ক গল্পটা ক্রমশ বড় হয়- অনেক প্রশ্নের উত্তর তবুও অজ্ঞাত। শুধু চলতে চলতে হঠাৎ সরু পথ- ঘোলাটে দৃষ্টি।
একটি শব্দ জীবন্ত হয়ে হঠাৎ
এইমাত্র যে শব্দের জন্ম সেই শব্দও একদিন তরুণ হয়ে ওঠে- তরুণ পর্বে প্রতিটি শব্দেরই থাকে বন্ধুদের আড্ডা ! একদিন আড্ডা ভেঙে গেলে সন্ধ্যে দখল নেয় আকাশের। রাত নেমে আসে অর-বর্ণের পৃথিবীতে। অর-বর্ণের পৃথিবী !
একদিন তৃতীয় প্রহরে এসে রাত্রির একটি শব্দ জীবন্ত হয়ে হঠাৎ মিটমিট জ্বলতে থাকে নক্ষত্র-চোখে ! রাত গভীর হলেই কিছু কিছু শব্দ হেঁটে বেড়ায় নির্জন অলি-গলি- নির্ঘুম পথ।
চাকা বিষয়ক
কোনভাবে যদি লাইনচ্যুত হয়...। একটি মাত্রার চাকা- তার উপর কোটি কোটি নক্ষত্রের দিন-রাত্রি, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ !
একটিমাত্র চাকার উপর চলছে সভ্যতা।
প্রেমস্বপ্নের রাতগুলো
ছুঁয়ে দিয়ে রেখে যাও প্রেম। অনুভবের অতলে কী যে এক মধুরতা- না বিরহ না মিলন! অতঃপর যখন আয়নায় দেখি অন্তঃসারশূন্য অবয়ব তখন খুঁজে নিতে হয় অদৃশ্যের আড়াল। অদ্ভুত এক সংকোচ এর ঘুণপোকা অস্তিত্বের অন্তঃপুরে কাটতে থাকে...। নীরবতার প্রশান্ত সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে হাতের মুঠোয় বুঝে নিতে ইচ্ছে করে অবজ্ঞা-অবহেলার মতো তুচ্ছ বস্তু- প্রসারিত অনুগ্রহের মতো করুণা-ভিক্ষা!
প্রেমস্বপ্নের রাতগুলো এভাবেই ভোর হয় একদিন- তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে লোকালয়ের ভিড়ে হারিয়ে যায় হঠাৎ।
প্রেমগন্ধী ফুল
কে তুমি নেচে যাও চোখের পলকে! দুষ্টু-মিষ্টি অরে হাস দিকচিহ্নহীন। হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় না আঙুলে অথচ অনুভবে মধুর স্পর্শ।
ভুল করে তোমাকেই ভাবি প্রেমগন্ধী ফুল- কবিতার খাতায় সোনালী প্রেম। হৃদয়-সমুদ্রে গোপন শিহরণ
মৃত্যু এক মহান মিথ্যে
‘মৃত্যুর চেয়ে বড় মিথ্যে আর নেই- প্রতিটি মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় নীল নক্ষত্রের রাত।’- কবিতার মুখ থেকে শোনা এই কাব্যকলা থেকে পাঠ করি মহাজাগতিক বিস্ফোরণ- সৃষ্টি রহস্য! এমন সত্যি আর কেউ বলেনি- বলেনি কোন অমর দেবতা। অচেনা রহস্য ভেদ করে যেতে পারার আনন্দে...। অভিশপ্ত প্রাণ হাঁটছি পৃথিবীর পথ- আলোকবর্ষ-আয়ুষ্কাল। আপাত: মৃত্যু এক মহান মিথ্যে- বিনিসুতোয় বোনা দারুণ এক শিল্পের রূপকথা তবুও স্রষ্টার আতিথ্য লোভে আরাধনা করি মহান এক মিথ্যের মিথ- জল্পনা কল্পনা।
উৎসব উপলক্ষে অচিন বৃক্ষ থেকে ঝরে পড়ে একটি করে পাতার প্রকৃতি, মাতাল মৃত্যুর পরাবাস্তব!
অজ্ঞাতসূত্রে
পূর্ণদৈর্ঘ্য স্বপ্ন এক উঠে আসে স্বপ্নের ভেতর- স্বপ্ন ভেঙে আর এক তারপর আর এক...। চিরন্তন এই গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে একদিন প্রগতিশীল হয় সংস্কৃতি, সভ্যতা । কালের পাতায় বিবর্তিত হয় পৃথিবীর ভূ-গোল।
রিখটার স্কেলে একদিন দশ মাত্রার ভূমিকম্প হলে...
মাতাল রাত্রির কবিতা
নীল এক পৃথিবীর দোয়েলের রাত- ঘুমের মধ্যে জেগে আছে সরীসৃপ চোখের তীব্র দৃষ্টি। ক্রমশ: বুকের উপর ধ্বংস হতে শুরু করেছে আন্দিজ ও হিমালয়! অতঃপর প্রবল এক সুনামির ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নূহে’র প্লাবনে। কর্পূর হয়ে ভেঙে যাচ্ছে সময়!
অজানা গন্তব্যে ডুবে যাচ্ছি মাতাল রাত্রির জাহাজ। তবুও কিছু পতঙ্গ-প্রাণ ধুলো হয়ে উড়ে বেড়ায় তৃতীয় বিশ্বের মুখের উপর।
নীল ঢেউ
থেমে থাকেনি কেউ, দাঁড়িয়ে থাকেনি অপক্ষার একটি মুহূর্ত-
চোখে রেখে দূরের আকাশ ভাবেনি কেউ বহুদূরের পৃথিবীতে জেগে আছে নক্ষত্র এক।
শুধু নীল ঢেউ এক একদিন ছুঁয়ে দিয়ে...
অতি-প্রাকৃত
একদিন এই শরীর উই এর ঢিবি- মগজে মগজে শুধু উই আর উই- জাদুবাস্তবতার মাতাল উৎসব! একদিন এই চোখেও নেশার লাল- রক্তনদীর লবণ স্রোত...
আষাঢ়ে গল্প ভেবে আমরা যারা এক ফুঁ-তে উড়িয়ে দেই এইসব অতি-প্রাকৃত অধিভৌতিক প্রকৃতি-পাঠ তারাও একদিন নীল হয়ে রাত্রির মোড়ে মোড়ে জমিয়ে আড্ডা চুমুক দেই মদের পেয়ালায়- একদিন তাঁরারাও শুনি দূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা মনোমুগ্ধকর সাইরেন- প্রলুব্ধ হই মৃত্যুর উপকূলে...
থামতে হবে কোথায় ?
১.
ভাল আছি- ভাল না থাকলে কি আর আড্ডায় আড্ডায় রাজা-উজির মেরে বেড়াই কিংবা তাড়িয়ে বেড়াই বনের মোষ? এই কথা শুনেই তুমি তো হোঃ হোঃ হেসেই খালাস! কাল যেমন হঠাৎ দেখা বন্ধুটিও তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে...। আশ্রমে যাবার কথা শুনলে কি হাসতে হয় ? কেউ কি জানে কার বুকে কার আশ্রম!
জানি না ঠিক ঠিক কোথায় থামতে হবে- কোথায় দাঁড়ালে মাথার উপর ছায়া দেবে ছায়ামেঘ অথবা বৃশাখা ?
২.
হয়তো এসবই কথার কথা- নেই কোন তাৎপর্যবিশেষ। প্রাণের স্পন্দন মানেই শুধু গতি আর গতি- গতিসর্বস্ব! মাঝে মাঝে ভীষণ ভাল লাগে কল্পনার উৎসব- গল্পের ভেতর অন্য এক গল্পপাঠ। ভুলেই যাই, মনের ভুলে অদ্ভুত এক গল্পের মধ্যে আমাদের স্বপ্নবিলাস- অম্ল-মধুর অমলের জীবন-যাপন! গল্পের রচয়িতা যখন সামনে এসে দাঁড়ায় চিনতে পারি না- চিনতে পারতাম যদি...
কখনও কখনও ভীষণ কান্ত প্রাণ অথচ বুঝতে পারি না থামব কোথায় ?
অনুরাগ
অভিযোগের আঙুল তুলে বার বার আমাকে শাসাও, অন্ধকার করে মুখ আমাকে বলও, ‘কি এত ব্যস্ততা দিতে পার না একটা মিস-ও... ।’ সত্যিইতো সারাদিনের মধ্যে একটিবার...। কেন যে এমন আমি- কেন যে এমন- পথে পথে হ-য-ব-র-ল ?
জান না- এই ঘনঘোর বরিষায় কোথায় সুখ আমার কোথায় আনন্দ। তুমিতো কেবল পাগলের মত ঘোরাফেরা দ্যাখ শহরের অলিতে-গলিতে- কখনও দ্যাখ না তোমাকে নিয়ে কত যে সুখ আমার- চোখের পাতায় কত যে সবুজ স্বপ্নের আল্পনা আঁকা। শুন্যপ্রাণ তোমার দিকেই হাঁটছি- ভালবাসছি কবিতার সান্নিধ্য।
নীল-ঠোটের পাখিটা
উড়তে উড়তে কত যে পালক খুল গেল- কত স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্নের অতলে তলিয়ে গেল- সে মনে রাখেনি তার একটি অর অথবা বর্ণও! সে শুধু জানে একদিন তাকে ছুঁয়ে দেখতে দূরের আকাশ। তাই সে রোদে পোড়ে- বৃষ্টিতে ভেজে...
একদিন সে সত্যি সত্যিই আকাশ ছুঁয়েছিল- নীলিমার চোখে চোখ রেখে, ঠোটে...। সেদিন তার মৃত্যু হয়েছিল!
আবার যদি দেখা হয় কখনও
হঠাৎ দেখায় সুরুজ রায়হান বলেছিল, ‘দোস্ত কেমন আছিস?’ সহজ প্রশ্ন অথচ উত্তর কী কঠিন!
সুরুজ রায়হান খুব সহজ সহজ প্রশ্ন করতো অথচ উত্তরগুলো আমার জন্য সহজ ছিল না মোটেই। একবার সুরুজ রায়হান বলেছিল, ‘দোস্ত তোর নীল পাঞ্জাবীটা আমাকে দিবি- ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। জানিস দোস্ত বড়লোকের বেটারা সব প্রতিদিন নতুন নতুন ড্রেস...।’ ‘না’ বলেছিলাম স্বার্থপরের মতো। রায়হান এতো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ফান করতো আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না- কোনটা ফান আর কোনটা রিয়েল। সুরুজ রায়হান মেসে থাকে। মিরপুরে।
সুরুজ রায়হান ওর মায়ের কথা বলতে; বলতো ওর বাবার কথা। ওর মা’ই ছিল সব। বাবাকে ও ঘৃণা করতো- বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে...। ওর জীবনের আনন্দ-বেদনা; সখ-দুঃখ; প্রেম-বিরহের কত যে টুকরো টুকরো গল্প...। ওকে মন খারাপ করতে দেখিনি কখনও- ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগেই থাকত। সূর্য তোকে হারিয়েছি আবার। আবার যদি দেখা হয় কখনও তোকে একটা নীল পাঞ্জাবী কিনে দেব- অনেক দামী। দোস্ত দেখা হবে তো?
বর্ণান্ধ, উপেক্ষা করি রঙ ও রেখার চিত্রলেখা
খেয়ালের বশে অনেক উড়েছি, উড়িয়েছি কবুতর- আকাশ ছিল ভীষণ চেনা!
অনেক মন্ত্র ছিল জানা- জাদুকরের জাদুঘর ছিল আমারই দখলে। জাদু দেখিয়ে দুই হাতের কারসাজিতে কত যে কুড়িয়েছি হাততালির প্রকাশ্য উপহার। এখন গ্রহণকালে চাঁদ-সূর্যের সাথে আড়ি, তুমুল বাদানুবাদে অবশেষে মেনেছি হার। কর্তব্যবিমূঢ় কখনও কখনও তাই নিসর্গে ডুবে থেকে ভুলে থাকি অতীতের জলছবি- জীবনের ক্যানভাসে পাখি ও প্রজাপতির প্রেম-প্রণয়। বর্ণান্ধ, উপেক্ষা করি রঙ ও রেখার চিত্রলেখা। বিমূর্ত পড়ে থাকি ভুল বানানে অন্তরালে লোকচক্ষুর- কল্পনায় আমার রাজ্য বিস্তৃত বহুদূর।
ঘুম-ঘরে
বুঝতেই পারিনি কখন কেটে গেছে রঙের ঘুড়িটা- অচেতন ছিলাম এমন গভীর ঘুমে। ঘুমের মধ্যেই হারিয়ে ফেলি বাস্তবের স্বপ্ন, কল্পনার ছায়াপথে অজস্র নক্ষত্রের পতন।
এতো ঘুম কেন মনের মধ্যে- চোখের দেখায় ? সকাল-দুপুর, গভীর রাত চেতনায় থাকিনি কখনও। পড়ে পড়ে শুধু ঘুম শয্যার শূন্যে ভেসে। যদি জেগে থাকতাম পেতে হতো না শোক!
নেপথ্য উচ্চারণ
আন্তরিক শব্দগুলোর শত্রুতায় বিপন্ন বোধের ব্যকরণ ও ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের আলাপ-সংলাপের পরাবাস্তব।
একশো বছর পর এক মুহূর্তের সুখ! এর জন্যেই মেঘে মেঘে অনেক বেলা; তিলে তিলে অনেক য় ও তির প্রলেপ মেখে মুখে চেয়ে থাকা অপলক দূর-দিগন্তে। অন্তে ধ্বংস হয় ভূ-গোল- সময়ের কালক্রম তবুও নিত্য-নতুন সংলাপে লিখে রাখি সমকালীন দৃশ্যপট। অজান্তেই পান করি ঘৃণা ও শ্লেষ এবং শুয়ে থেকে লাশের মতো জীবনের সমান্তরাল- পাঠ করি কালের কন্ঠে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস আর অদৃশ্য জাদুর কবলে পড়ে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে বরণ করি বৃক্ষের হলুদ পাতায়!
স্বপ্ন ভেঙে গেলে
হঠাৎ অনুপ্রবেশ স্বপ্নে- রঙিন দৃশ্যের ভেতর বন্দী মন।
স্বপ্ন ভেঙে গেলে চোখে বিচ্ছেদ-বিরহের ছবি আঁকে রঙতুলি- আঁকা চোখ থেকে টিপ টিপ ঝরে পড়ে হৃদয়ের রক্ত! উদ্ভ্রান্ত হাঁটে মন পরাবাস্তব পথে নিঃশ্বাসে নিঃশেষ করে পেয়ালা ভরতি লাল মদ। পুরো এক বোতল শেষ করেও যন্ত্রণা কমে না- শুধু দৈর্ঘ্যে বাড়ে রাত নিযুত মাইল।
অলক বিশ্বাস
দেবতা
বছর হলে শুরু রাঙা সূর্য নতুন বাঁকে
আলোর রবি তোমার গানে সব পাখিরা ডাকে
পঁচিশ কেবল নয়তো তারিখ বাংলার আলো-তারা
পঁচিশ আমার গঙ্গা প্রাণের পঁচিশ নাড়ে কড়া
প্রিয় বর্ণে যখন দেখি স্বপ্ন-স্বরলিপি
গোরা, বলাই যুদ্ধে আজও যুদ্ধ আরও বাকি
ছড়িয়ে দিয়ে রোদ্দুর-প্রেম বলছে আকাশ হেঁকে
দেবতা ওগো, জন্ম তোমার আমারই বৈশাখে
ইলিয়াস কমল এর কবিতা
ব্যাকুল বিশ্রাম
একটা ধূয়া আমার দিকে ছুটে আসে বার বার
তাই কেবল শৌখিন মৎস্য শিকারির জালে
ধরা পড়ে না ব্যাকুলতা…
এই গ্রীষ্মের যাত্রা কালে ছিলো সেই আনন্দময়ীর গান
একবার তাই মুগ্ধতা নিয়ে বসে থাকে বেলফুল নদী
বাঁশবন উজাড় করে সেই শিকারি পাখি ধোয়ার মতো
এক ভিনদেশী পায়রার সাথে করে মিতালী;
রাতের আঁধার নেমে এলে ঘুম ভেঙে চেয়ে দেখে
এখনো ফুরায় নি রাত্রি; সেই মোহ মুগ্ধতা নিয়ে একখানি বার
কেবল রাতের গল্প বলে চিত্রকল্পের পাহাড়ে বসে।
একবার ঘুম জেগে গেলে মৃত্যুই বন্ধু তখন সম্রাট আমার
আমি জানি এই বেদনার হাওয়া মিশানো শরবতের আলগা সুর
জানি ছেলে ভুলানো ছড়ার পাহাড়, তুমি তো জানো কেবল
সমুদ্র ভেজায় নীল জলের কিনারা- এই সত্য তোমার ভুল জেনেছে কাকতাড়ুয়া
আমি তাই ব্যাকুল বিশ্রাম!
ঘোর লাগা রাত্রে তাই আমার বন্ধু ডাকে মৃত্যু হয়ে, তোমার কাছে ছিলো সেই
উত্তরীয়; যা কিনা মহাচলের কথ্য ভাষায় তুমি বলতে ভুলে গেছো পরিচয়।
প্রিয় মৃত্যুময় ঘুম বন্ধুআমার, আমরা কেন গলা জড়ায়ে শুয়ে থাকি বলো?
পত্রপাঠ-২
আমিতো কেউ নই, কোনও মোহিত লোবানের মত নই
রূপান্তরিত! পাখি ও রংধনুর মতো বাদামী ডানার প্রিয়তমা
তোমার ত্বকে ময়নামতির ঘ্রাণ বুনে দিয়েছে কৃষক-
আমি এক ফেরিওয়ালা তার কর্পূর ফেরি করি পথে পথে
যার রঙে রাঙা রাজপথ কেবল তুলোর মতো উড়ে
পাগল প্রেমিকার মতো এক বালিকা অক্লেশে চুম্বন খায় পথের প্রান্তে
ভুলে যাই নির্মেদ ভালোবাসার গল্প- কেবল লিখেরাখি নিম্নাঞ্চলের ইতিহাস
আমার কোনও পাথর শো-কেসে জমা করলে এত এত অন্ধজাদুকর
কথা কয় আগুনের ভাষায়- চোখে জ্বলে নির্মোহতার দীপ্তি
জানি তো কেবল আক্ষরিক স্বপ্নের রূপ! তবুও অক্ষরের প্রতিরূপ তৈরা করা
প্রাগৈতিহাসিক গল্পগুলো একে একে জমা হয় দেয়ালের প্রতিপক্ষে
কেউ তো তবু প্রতীক্ষায় আছে, না জেনে কাঙ্ক্ষার গন্তব্য- তবুও
জানিনা তার পরিচয়, জানি শুধু লোভনীয় রঙের ফেস্টুন ঝুলাবো আকাশে
কেউ জানুক আর নাই জানুক; আমিতো জানি তার সকল গোপন আন্ধার।
লেবু বাগান
অনেক দূরের পথ ফেলে এসেছি শৈশবের দুয়ারে।
আমি কি কেবল ঘোড়া?
যেই দিকে ছুটায় সেই দিকেই ছুটি?
অথচ আমার জানা ছিলো কোন দূর
মরূদ্যানের পাশেই রয়েছে এক বিস্তীর্ণ লেবুর বাগান...
মিঠাপানির স্বাদ লেগে রয়েছে তার থোকা থোকা ঠোঁটে!
এইভাবে পার করে এলেও সু-সময় প্রাণের ঢেউ
কোন বাগান দেখি নি; একদা যেখানে দেখেছি কেবল ছায়া
অথবা জলের বিস্তার-
আজ সেখানে কেবলই শূন্যতা, নিয়তির কাছে হেরে যাওয়া যুবকের মতো
আমিও কোন এক লেবু বাগান সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বুনে চলেছি
এক একটা বীজ;
আমার বৃক্ষ হোক শান্তির মহিমান্বিত ছায়া
আমার লেবু বাগানে ফুটে উঠলেই শাদা ফুল
ধীরে ধীরে হয়ে যাবে আস্ত এক শরবতের পেয়ালা।
রেজা নুর -এর কবিতা
শিপ্রা, তোমাকে
কৈশোরের স্বপ্নময় আকাশে
তখনও হাসেনি চাঁদ,
মনন ছোঁয় ছায়ারা
ভোরের সবুজে সূর্যের লুকোচুরি—
দিগন্তের নীলাদ্রির মতো
স্বপ্নরা শুয়ে আছে,
শীতের ঝরাপাতা পায়নি শিশু-রোদ।
সকাল এলো রঙ ও আলোয়
রাত্রি, পূর্ণ চন্দ্রিমায়,
তুমিও, শিপ্রার স্রোতধারায়…
চিবুক
এভাবেই দিন কেটে যায়।
সেদিনও কথা হয়েছে কতটা সময়…
মন যায়নি চেনা কোলাহলে,
ছুঁয়ে দেখিনি, তুমিও না।
দ্বিধা নেই—
মনে হতো, একটু ছুঁয়ে দিই।
তারপর কতোটা বছর…
সেদিন
নাটাইয়ের সুতোর মতো নিশ্বাস নিয়ে
তুমি এলে— চোখে দীঘল সেই ভঙ্গিমা।
অজানা গল্পের সন্ধ্যার পর
স’রে গেলো সবাই
পায়ের নীচে চুম্বক নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে,
ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ওই ডালিম-চিবুক।
আলো
শীতল নিশ্বাসে ছেয়ে আছে চারদিক,
গুচ্ছ আকাশ মায়াবী আলোয় আঁকা।
পথে ঝরাপাতা,
কুয়াশায় হিম বিষণ্ণতা।
দিগন্তে ঝুঁকে আছে সময়।
আমি— তৃষ্ণার আগুনে জ্বলা মোম,
আলোময় গহীন হৃদয়।
মানচিত্র
সূর্য হেঁটে গেলে গোধূলির দিকে
আমিও পিছু নিই তার...
নীরব আতশবাজির মতো সন্ধ্যার তারা
সফেদ রুমালের মতো চাঁদ ঢাকা মেঘ
প্রকৃতির মৌন কাফেলা...
তখন আমি মগ্ন আলাদীন, যাদুর কার্পেট
বিছিয়ে দিই হাওয়ায়
আলো ও আকাশ দেখি
মেঘের মানচিত্রে আমার বাংলা।
... সন্ধ্যায় সর্ষে-শাক তুলে বাড়ি ফিরছে সমিরণ
বিদ্যুতের মরিচিকার পর মোমের আলোয়
চিমনি মুছছে মমতা...
অজস্র আলোর মাঝেও
ভরে আছে চোখে
সন্ধ্যার চিরচেনা, গ্রামীণতা।
বার বার বাংলাদেশ
ঘাড়ের ওপর গামছা ঝুলিয়ে
খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানো যায়,
এমন দেশ আর আছে ব'লে
আমার জানা নেই।
যে দেশের বাতাস কথা বলে,
নির্জন মাঠে জড়িয়ে ধরে বন্ধুর মতো।
পাখিরাও খুনসুটি ক'রে
টুকরো মাটি ছুঁড়ে দেয় জলে,
মাটির চকলেটে খুশি হয় নদী,
ঢেউ গড়িয়ে দেয় ঢেউয়ের ওপর।
সন্ধ্যার সবুজ গাঢ় হয়ে এলে
মনে হয় ঝুলে আছে অন্ধকারের ফল...
যে পাখি নিয়ে আসে ভোর
যে বাতাস প্রেয়সীর মতো খুলে দেয় দোর
যে নদী জলজ হাসি ছড়ায় ডাঙায়,
এখনও দেখতে উদাস এক
নির্বিঘ্ন সকাল।
মেঘ নদী আমি
নরেশ মণ্ডল
অনেকদিন আকাশ দেখিনি আমি
তোমরা কি দেখেছ
তারা ভরা আকাশ ?
আজ তারাদের সাথে দেখা হলো
বহুদিন বাদে। শব্দহীন ছাদে আমি একা
ভীষণ ভাবেই একা। জ্যোৎস্নায় ভাসে মেঘ
কেমন অগোছালো
মনে হলো তারাদের, তাই বলল—
কি হয়েছে তোমার, এমন তো দেখিনি আগে
কোনো অ-সুখ কি ছুঁয়েছে তোমায়
নিশ্চুপ আমাকে দেখে মেঘেরা বলল—
তোমাকে সেদিন নদীর তীরে দেখলাম মনে হলো।
নদী ভাসিয়েছে পদচিহ্ন
নদীই গড়ে দেয় ভালোবাসা, নগর
সুখ-অসুখের মাঝে থাকে সাক্ষী বালুচর!
যিশু মহম্মদ
পৃথিবী প্রসবের গান
০৫.
আয়নায় মুখ দেখো সময় অস্তোন্মুখ ভঙ্গিমায় তোমার মূক স্পষ্টে ঢুকে গেলাম, তবু পদচ্ছাপ
রেখে যেতে চাই পৃথিবী প্রসবের গান,এটুকুই আগুনের অধীন ঋণ আমার।পাখিরা জানে প্রোজ্জ্বল
শপথের সময় মানুষের অনুভূতি সুস্বাদু ফলরে প্রতি। কুঞ্চিত ডানা গুলো তাই অজ্ঞাত প্রায়শ্চিত্তে
উড়ে যেতে যেতে সূর্যকে বেষ্টন করে, আর সন্ধ্যার প্রসূতিবর্ণে অপরাধী আঙুলের অনুসন্ধানে খুঁজে পাই
মসৃণ আয়নার শরম।
বিস্মরণে পিপাসায় চলে গেছে প্রফুল্ল পাথরের তন্ময়, তবু অনুজ্জ্বল সব পোশাকরে কাছে রেখেছি
সম্মান। জলরে অতিক্রমণে আছে যে স্মৃতিশক্তি এবং স্মৃতি বেদনা তাকে ঘিরেই আমার সাঁতারের
আকাঙ্ক্ষা, আর চিরকাল আমার অধঃপতন পানশালার আক্ষেপের দিকে অনুগত। কণ্ঠে শীতের
প্রসন্নতা নিয়ে অভিভূত সত্যের অন্যদিকে সকলেই চলে গেছে তবু আমি অস্বচ্ছে গাঢ় হতে প্রতিশ্রুত নই।
উৎসবে উপেক্ষিত তবু সুগভীর দরজায় সহিষ্ণু দাগ রেখে যাই, জলের উপর উচ্চারিত হতে থাকে
অনুতপ্ত গান। তাই মনে হয় মৃতরে ছদ্মরূপে সূর্যের অপরাধ অস্তমিত হয় আর আমাদের অহেতুক
আটপৌরে কান্না এসে যায়, এসব চোখের ছল কুশলের আড়াল ছুঁয়ে দরজায় ব্যবহৃত ছিদ্রই ধরে
রাখে। অনুমতি পাইনি তবু মাছের স্বচ্ছন্দে বিন্যস্ত, তবু সঙ্কেতের আচ্ছাদনে দাস।
১৪.
জ্যামে আটকা পড়লে আমিও ঘুমাই, ঘুমের ভেতর পুকুর-
অসহায় সাঁতারে কার মুখ মর্মে ভেসে উঠে,
কে ডাকে? যে ডাকে ডাকুক।
বিচূর্ণ ঘেন্নার ভেতর আমি এখন
এ শহরের মৌলিক পাখির নাম কাক- এ নিয়ে ভাববো।
এ শহরের মৌলিক প্রেমিকার নাম বেশ্যা-
যে শহরের আয়ু চিরে অন্ধকার বিইয়াইছে।
ক্ষতের সংকল্পে ঋতুরক্ত মাখা জরায়ু কি ফণার মতো?
জ্যামে আটকা পড়লে আমিও জেগে থাকি, উঁকি দেই জন্মের ভেতর-
ঘ্রাণে-গন্ধে শ্বাস চিহ্ন বাড়ে,
কে বাঁচে? যে বাঁচে বাঁচুক।
ঝুঁকে পড়ে ধ্যায়ানের ভেতর আমি বরং দৃশ্য ধরে ফেলে, ভাবি-
এ শহরে তাসের সমর্পণে থাকা জুয়াড়িই একমাত্র কবি-
এ শহরের নুনমাখা রোদে কালো পকেটমার ছেলেটিই নায়ক-
ক্ষমাহীন পৃথিবীকে জেনে নির্জন শব্দের কাছে কি সাপ শুয়ে থাকে?
কামরুল হাসান এর কবিতা
দেবী
লাবণ্যের প্রান্ত ঘিরে নির্লোভ রাত্রি জেগে আছে
ওকে দিও খানিকটা বিদ্যুৎ তোমার
অসুন্দর সুন্দরের বুকে এসে এমন সুন্দর!
দু একটা প্যারিস তোমার পদচ্ছাপ নিয়ে শিল্পের
নিলাম ডেকেছে
তোমারই কারণে পুড়েছে ট্রয়, সমরকন্দ বিক্রি হয়ে গেছে।
মোহন বিন্যাস জুড়ে অপ্সরী আলোর উত্থান
তোমার নির্মাণ ব্যপে তাঁর তীব্র অতুল প্রতিভা!
আঁখি কার? ঘুম নাকি নির্ঘুমের?
এক জীবনের চেয়ে ভারী
এত যে ভেঙ্গেছি, নুয়েছি আর মিশেছি ধুলোয়
তুমি খুব উঁচু হয়ে ছিলে?
তোমার প্রাসাদ কেশর ফোলানো দীপ্র সিংহের মতো
বরফের তাপ তুলেছিল?
দক্ষিণ মেরুর হাওয়ায় ঝুর ঝুর কবে ভেঙ্গে গেছে!
এখানে কেউ খুব দীর্ঘসময় থাকে না,
স্বল্পস্থিতির ভেতর কেন এত দুঃখ দাও?
এত দীর্ঘ মনঃস্তাপ, এত দীর্ঘভার -
যা এক জীবনে সহেনা!
একজন কবির দৃষ্টি ছাড়া
তোমার কাব্যগ্রন্থ যদি থাকতো সাথে আবুল হাসান
এ লোকালয়ে চিনে নেয়া ঢের বেশী সহজ হতো।
অচেনা নারীদের নাম ধরে ডাকা যেত ফুলের নিয়মে
পোয়াতী পেটের মত উঠেছে ঐ যে দূরের সাঁকো
তার জন্ম-বৃত্তান্ত ছিল তোমার বর্ণনায়।
আমি সবই দেখতে পাচ্ছি, তবু কি দেখতে পাচ্ছি সব?
একজন কবির দৃষ্টি ছাড়া কি পাখি, কি লোকালয় গদ্যময় সবই।
তোমার দ্যুতির টর্চ জ্বেলে আমি এই মনোরম বাগানে এসেছি
মানুষের শিল্পমেলায় নিয়েছি ভবঘুরের ঠাঁই
লোকায়ত, চিরন্তন, অচিন্তসম্ভব এই রূপভার আমাকে তুলে দিয়ে
স্বরূপের যাদুকরী হাঁট থেকে তুমি কেন চলে গেলে আবুল হাসান?
মৈত্রীজিনা
হোক মৈত্রী তবে। সমুদ্রস্নানে দেহে বাড়ে শুধু
লবণের ভাগ, ঠোঁটে পাই সেই নুন;
কাঁপে, কিছু ঢেউ ছেড়ে যায় চোখের সৈকত।
সূর্যোদয় দেখা হয়, সূর্যাস্ত এ সমুদ্রে নয়
পড়ে আছে মধ্যদিন, গনগনে আগুনের বেলা
এখন বালিকা তরু, দিনে দিনে বৃ হবে জানি
বাড়ে জোয়ারের জল, পাই তা’রি প্রস্তুতিধ্বনি।
কি করে বাতাস বোঝো, আরো তীব্র ঝড়ে
উড়ে যাবে তুমি, তব পঙ্খীরাজ দেবে ঝাঁপ
বাহুতে ব্যগ্রতায়, ডানার কাঁপনে মেঘ সরে
জিন ছিঁড়ে আমি পড়ি বালিতে লুটিয়ে।
আমি ও যীশু ভাই ভাই
গণি আদম
আমি ও যীশু দুই ভাই
কুমারী মায়ের সন্তান আমরা দুইজনাই
যীশু তো একবার মোটে, আমি নিত্যিদিন ক্রুশকাঠে
নিজেরে ঝুলাই
মেরি বা মরিয়ম বা হলোই বা এইদেশি মৌরি
উনার গর্ভের কথা ফেরেশতারা আগাম কৈসলাইন
হয় গায়েবী মাজেজা না হয় যা কিছু মানুষের লাহান
তাই খালাজীর প্রসবকালে বিস্তর দৌড়াদৌড়ি
শেষে-- গোয়ালঘরে যীশুদা ভূমিষ্ঠ হৈসলাইন
য়ীশুদা-র জীবনের সবতা ঠিক করা যে তিনি মহান হৈবাইন
মুর্দারে জিন্দা কৈরা, কুষ্ঠরোগী ছুঁইয়া দিয়া ঐশ্বরিক প্রেমে
এক রুটিতে চাইর হাজার মেমান বিদায়-- জীবনভর কেরামতি শেষে
বেবাক পাপের বোঝা তাইনে নিজের কান্ধে লৈবাইন
এতো অপমানজ্বালা, ক্রুশে মৃত্যু-- মানুষকে উদ্ধারের নামে
আমার মায়ের নাম চন্দ্রাবতী হয়
পিতা নাই, আমার তো জন্মসূত্রে বীর্য অর্থহীন
মা মেরি শেষতক যদিও আব্যাত নয়
মা আমার শিবের পূজায় পুরুষের স্পর্শবিহীন
আমার মা আমাকে অক্ষরের মালা গাঁথা শিখাইসেন
বৈলা গেসেন রাম একটা সাধারণ পুরুষ যার মনে প্রেম কম
আর নিজের দুক্ষ দিয়া মা সীতারে বানাইসেন
তারার কিচ্ছা কৈতে কৈতে বুঝাইছেন বাংলা ভাষাটার সৌন্দর্য কী রকম
এই যে আমার কিছু কথা কিছু লেখা, এইটা মা দিয়া গেসুইন
মায়ের আগেও অনেকের হাতে ছিলো এই তেলেসমাতি চিরাগ,
এইটার পশরে অনেকে রাস্তা-ঘাট চিনসুইন
এইটাই মায়ের ওয়ারিশ, আমার জীবন, প্রেম-অনুরাগ
আমি আর যীশুতে মিল কী আসলে হয়? কুমারী মায়েরা
আমাদের জন্ম দিসুইন তাই প্রভুর মর্যাদায় তিনিরে ভাই বানাইসি
আর কতো শতো বর্ষ আগে এই সব অ-আ-এরা
জোড়া দিয়া আমি ও চন্দ্রাবতী মা-পুত হৈসি!
এইদিকে, জোসেফ আর জয়চন্দ্রের ফারাকখানি এ-ই
জন্ম না দিয়াও জোসেফ যীশুদা’র বাবা হয়
আর বেচারা জয়চন্দ্র আমার মায়েরে এতো চাইয়াও
কারুর বাপ নয়
মাতিয়ার রাফায়েল এর কবিতা
হা-লাল, পেল্লাই যুগের শুরু
জেনগল্প হৈতে প্রবাহিত...
ফুরান যুগের কথা। কথা আর কথায় চলিত না ঘানিকলে। জিহ্বার ধারে, ঘন ঘন মুদ্রণ প্রমাদে হারাইয়া যাইত সব। চোলাই নাগরিকদের মধ্যে তখন হৈতেই ভারি ভারি জ্ঞানের জোয়ার বইতে লাগিল । তাহে গ আবার কোন্ প্রযুক্তিনিযুক্তির সমাসোক্তি কাল!
ফলে, খাস খাসলতেই প্রাচীন ধর্মগুলিও একটু একটু খসিয়া পড়িতেছিল। নয়া ধর্মের ওপর। সাতিশয় বিংশ শতাব্দীর কথা। প্রৌঢ় ও তরুণেরা তাহাদের গৃহে নয়ালোক ধর্মের জ্ঞানকাণ্ড মার্কস-এর সশ্মশ্রু ছবি টাঙাইয়া রাখিতে লাগিল। পাশে ঠাঁই লৈত এ নাম ভাঙাইয়া আরও এঙ্গেলস, লেনিন কি সগুম্ফ স্তালিন। ফলে, অভ্যাগতদের জ্ঞানান দেওয়া যাইত, ইঁহাদেরও ভারি ভারি জ্ঞানের শান শওকত বহিরাগত যায়।
কে হায় ঘরের ঠাকুর ফেলিয়া ধরে আর বিদিশি কুকুর! তখনই ‘জনমত’ ওঠে, স্বদেশি জগতে নয়া কোনও জ্ঞান না হৈলেও চলিবে। পৃথিবীর ইতরবিশেষ কিছু হয় তো হৈলে হৌক। নিদেন তালুক হারানো ভালুকদের সামনে আমরাও না হয় হইলাম কালো চামড়ার নিচে মামলুক। দে’খো না, মা’ গো, বিৎরে বিৎরে পোকায় কাটে কাটুক!
নতুবা বিরাগে আগে আগে ভাগেন! ফলেস্তু, অতিথিগণও সেই উত্তাপে একটু কাচুমাচু ভাব সশ্রদ্ধ হৈয়া বসিত। পাছে ইঁহাদের কথায় কি না পানরস ভুলচুক হৈয়া হৈয়া যায়! সে তখন ফেলিবে কোথায়, এখন কি আর যত্রতত্র সোনার পিকদানী পাওয়া যায়! অতিথি সৎকারও হয় না আর তখন। সুবাদে, তাহাদেরও নাই সায় ক্রসে কি প্যারালালে ‘হত্যার গণতান্ত্রিক অধিকারে’। তাহে ইঁহারা আবার সকল পুঁজিপ্রযুক্তিকলাবিৎদের অভিভাবক! তখন ভয়ানক সুষুপ্তির কাল।
সেই বারবাড়ন্ত জ্ঞানরাজগুলি অধুনান্তিকে বৌ-বাচ্চাকাণ্ডে যোগদান করিল। ঘর-কন্নায় ভূতভবিষ্যৎ করিতে লাগিল। রাজার দরেই বাজার সদাই করিতে লাগিল। বোলবুলিতেও তাহাদের বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আনিতে লাগিল। আনত হৈয়া বাচ্চাদের সামনে ফুস্করি করিতে লাগিল। লৈতে আবার চোট চোট ‘রাষ্ট্র’ শিক্ষার ধারাপাত; র-তে রণপা, রণচণ্ডী, রণকাণ্ড...
হা-লাল! তালিয়া বাচ্চালোক- এ ত প্রাচীন প্রবাহ প্রচলিত, খেলনা, খেলনা।
সেই সদাসদ গুরুগম্ভীর মুখগুলা আনিতেছে প্রীতিসুখিভাব, রীতিভাব, গোত্রভাব, আর্থনীতিভাব, স্বার্থনীতিভাবের। কন্যা-পুত্র মিলে, গোত্রের ভিতর স্বগোত্র। ইয়ার্কি করিতে করিতে জমিয়া উঠিল হায়ারার্কি, মনাসঙ্গ, সবার সাধ্যে। পেল্লাই যুগেরও শুরু এই অব্দেই। প্রলয়ে তাড়িতের স্বপ্নে-ভাঙা জলপাই ডালে-ডালে পাতার প্রতিধ্বনিগণ ভূমিষ্ঠ হৈল জনগণে। প্রসববেদনার ইতি, ইহারই পর। নয়া পরিবেশবাদের কথা লৈতে লৈতে খুলিয়া ফেলিল পৈতে, নয়া ব্রাহ্মণেতর সভাসদগুলি। গঙ্গাস্নান পূর্বে, নয়া মাল মূলের। শীরায় হাজিয়া মসৃণ তনু সুশীল-সুশীল চিল হৈয়া যাইবার কালে। আকাশ বাঁকানো শঙ্খের খিলানে, নীল দরিয়াতীরে, বকে বকে ওড়া চুম্বকচোখে, অথই অথই দিল দরিয়ার।
চিকা
চিকা । সে এক অদ্ভুত নিশাচর।
আমি চিকা মারি এই রাইতকে রাইত? কালের শপথ- কস্মিনকালেও না।
স্বপথে শপথ, ল’য়ে এই অভিন্ন শূন্য বলয়ের।
রাইত পুরা ঘুর যায়
লৌরে লৌরে, দেয় ছোটা, ভূতুরে-ওড়া তাল তাল মদিরা বধির।
আল্গা আল্গা পা’য়।
আরও কোন্ এক অদ্ভুত খেয়ালে, চোখ ফোটে একদিন দে’আলে দে’আলে।
কোনও বিভ্রান্তির কান্তি নাই। কসম, সবুজ মলয়ের।
যাকেই পাই তাকেই বিলা করে দেই।
তবে মানুষ হত্যা করতে না পারার দু:খটা আমিও লিখা রাখি হালে
কোথাও না কোথাও। ফলে ওটাকে দিয়াই একটা করণাকরণে পৌঁছাই-
অক্রুর সংবাদে, মেলা বিবাদ উত্তর।
লোকালয়ে, স্বেদমুক্তা ফোঁটে অঝোর, হাঁটতে হাঁটতে বিরল জনপদে;
মানুষের গন্ধ কি প্রায়ান্ধ মানুষ কখনও পায়, মোরচায় মোরচায়।
ফিরা আসি অরণ্যানিতে, কেননা বিলয়ে, চিক চিক করা স্মৃতির সুর্মায়
মাদীচতুষ্পদীদের ওপর যৌনিক ব্যাঙ সার্জারির তালিমটা
অপপ্রয়োগ করিয়াই কিয়ৎ পরাশীল্পজ মুদ্রা তলে তরল করবো,
গিলবো, গিলাবো এই প্রত্যয়ে। আরও শপথ এই প্রত্যয়ের।
কোনও অলীক বাস্তবতায় মতিসম্মতি নাই। পারি না তো।
সম্ভাব্যেও । নাই তো মগজে পুরা অ্যামাইগডালা। ভাগি না কোথাও।
ফলে মাগি না কোনও অমরতা, চির চঞ্চল চিরায়ু। থাকি না মুর্দায়।
মাগি, লা পরোয়া হরদম নীল রং রক্ত আদিমতা, অপূর্ব ক্ষিধায়।
তটে তটে লোটে বিছানো লেজ রাঘব বোয়ালের, চিকচিক চাঁদের ফাঁকিতে।
টুপটাপ লাফাইয়া পড়া চিকা, স্থির, ফিরে না আর গদীতে নদীর, অমরতার।
অতএব, দ্বিধা নাই। বলছি সন্নত মস্তকেই। প্রউদ্ধত ফুটস্বরে।
এই অবুদ্ধিয়া আত্মনং ক্ষমঃ নির্দ্বান্দ্বিক মিত বিনন্দিত জনমন।
জনধন; ঊষর ভূমণ্ডল উড্ডীনদাপানো দানো, প্রাচীন ডাইনোসর, উন্মনাচারী!
প্রহরী
ফেনায় দুলছিল স্বপ্নতরঙ্গ, যখন অনঙ্গের বোন খালি শনৈশ্চরে উইঠা বৈঠায় যায়। গলুইয়ের তীরে এসে ঘুরে যায় ফুরফুরা হাওয়ায়, টলটলা জলায়িত, নির্ভার, নিকেল নিকেল নারিকেলডানাগুলি আর। সুদূর আচ্ছন্নতায় ডোবা রৌপপাত। মনোবিকলিত মার্কারিস্নাত চাঁদের ছায়ায় অথবা সূর্যের। শান দেয়া ধারালো চোখ; কে দেয় কান আর সে কথায়। নি:শব্দ নৈশপ্রহরী শিকার সন্ধানী চোখে ছুটেই যাবে তবু। এ তো নয় আইনের বাইন। ছাই দিয়াও তাই ধরল না কেউ। প্রসঙ্গের পর প্রসঙ্গ থাকে শুধু অনঙ্গের বাইরে। আর সভাসদ বিশদ দেখে শেষকালে বুঝে, হা এ তো নাস্তিঃ সুনসান ক্রমজাগর রোষ কষায়িত খরখরে দৃষ্টির উপসহচরী... মানুষিক জালের বিশল্যকরণী হাতের নিরুত্তাপ শশব্যস্ত বিকাশঃ ফিকা হইয়া আসে বনবনানী চিরা আপন বোধির তলে তমিস্র-তমিস্রানী; একদিন দুধের সঙ্কটে আমিও বুঝে যাই বিড়ালছানার দরে কেন এতো কদর; কাঁপে শুধু ভাদ্রের তাপে। কেননা, হুলো বিড়াল; নহে প্রকৃতি অধ্যাস্য কখনো যার । খালি দেখি তাড়াতাড়ি অনাবাশ্যকীয় প্লুত প্লুত মুত ঝাড়াঝাড়ি...
এরকম মেলা অনিত্য প্রত্যয়; না, - শেষাব্দি কিছুই থাকে না তো এ উপাচারে! খালি ভাসাভাসি যায় ডিম ফোটা শব্দে, তরল রাত্রির আলোঃ গোপন অস্তিত্বে ঢুকিয়ে দেওয়া দেড়গজী হাত; বিদ্যুতায়িত স্বপ্নভঙ্গের জলছাপ- নামতাপড়া খাড়া ব্যারোমিটার- পালে যদিও লাগে নাই হাওয়া এ দিন কোনও। এহেতু, কেননা, নাবিকের জ্ঞাতবন্দি ছিল না তো কাকে বলে তস্করতা এসবেরে। ফলে দিখা যাক নাবিক, অদরকারে কি দরকার শুধু মস্তিষ্ক পেটা, ওঠে যেখানে শুধু ক্ষয়রোগির মতো শ্লেষ্মাদি- সমুদ্রের। বাদী রাখার দিনকাল আছে কি আর তখতে একালের কোনও গোলামের! আছে শুধু শান্তসুবোধ উন্নাসিকতা; লাল দেইখা ওঠবস কিস্তি, অস্থির খিঁচুনি সে আশিকের। বড়ো সহায়ক ছিলো তবু সেদিন সেখানে খুব, দম টেনে টেনে দম ভরে দিয়ে দিয়ে শান্তিরসাস্পদ সব হারানোর দেশে ভেসে ভেসে হওয়া হাওয়া...
ফিরা আসে একদিন নাবিক, দেখে আর অবরুদ্ধ যবনিকা মেলাদিন পরঃ দিকে দিকে শুধু দূর, দূর নোঙর, নোঙর ফেলা ভোর। টিম টিম ঝোলান লণ্ঠন; ‘মা, আমাদের রাইতকে রাইত পার হওয়া হাওয়া লণ্ঠনটি গেল কোনাই? খুঁইজা দ্যাখো তো সেই ইন্দুরটিই নিয়া গেল কিনা...’ পুনর্বার, গুলাইয়া যায় আবছা আবছা অন্ধকারে অন্ধকার; ক্ষয়ে যাওয়া পাথর; তামসিক জীবনে পুনর্বার। চাপা পড়া নাভিস্বাসে। ক্রম প্রসারিত হাত, গোপন অনুভব... পুনর্বার, ব্যস্ততা ঝাড়া দিয়া ওঠে দূরে অনতি, বাঁকানো লাল ঝুঁটিঅলা মোরগ এক, মধ্যবয়েসী; দুঃসহ যাপন যার আপন রাত্রিকালীন বিবরণে... এবং অন্যত্র, আরেক খাড়া লালঝুঁটি বন মোরগ, জানায়ে দেয় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তার সাবালকত্ব অর্জনের মুহুর্মুহু বহু এষণাযুক্ত সাড়ম্বর ঘোষণাঃ
কুককুরুকো কু কুককুরুকো কু, কুক...দূরতর, বাতাস বহিয়া নিয়া আসে কানে...
জ্যামিতিক মানব
এ যে কেমন সংশয় ধরা দিল আবার আহা পাই না যে হদিস কোনও সত্যি কি ভালোবাসা ভালো বাসবো কি ভালো নাকি দীক্ষা নেবো জিউসের রমণ আহাহা মনে পড়ে যায় জানি না তো কেন হায় প্রেমের প্রসঙ্গ কানে আসলেই সে-ই যুদ্ধাপরাধী নাৎসীর লৌহকপাটের পরাসার্গিক দামিনীগুচ্ছ, ফলে আর তাই হ্যাঁ, আর তাই হাত ভেঙে, ভেঙে পা’ যামিনী-দামিনী তিন পাণি কাবরিক গুহায় পড়ে গড়াই টিউবওয়েলের প্রতিকুলে গতিবিরোধগুলে হরদম জবরদস্তিমূলক দ্বন্দ্বে করাই বমন একমশক অনলবিহারী তলপ্রবাহিনী সুপেয় সফেদ জল
হায় বলা ভালো নয় তবু বলি বলা ভালো নয় বলছি তবু এই ধন্দ্বে গোপন থাকে যেন এই কথা কারু গোপন থাক থাকা ভালো গোপন সাবধান ঈশ্বরো না জানে যাতে অ্যামন ক্যামন অহ্ জড়ায় জটায় পুনরায় পায়ে পায়ে শিশ্ন অবদি এ কেমন ভেক আরেক অদ্ভুত সমস্যায়... আহা মশকের-ই জরায়ুতে দেখি আহা মদমত্ত নিরালায় অবেলায় উল্লম্ফিত বীতঅধীত মাছ, মাছ!
হ্যাঁ, নীলাভ, খুনাভ কোয়েসারমাছ...
পরে থাকে, পরে থাকা ভালো নয় পরে থাকে জং ধরে জং ধরা ভালো নয় তবু কভু ভালো নয় রাখা এই বিশ্বাস; কাঁচা মাল পাকা হোক মন্দা বাজারে কোনও ধান্ধা; শোনো না লাজবিনম্রবন্ধুরা, রেখো না আশ্বাস কোনও কানে আঙুল ঢোকাতে শেখো এবং নেমে পড়ো পরাঅভিজ্ঞতায় এই পাঠান্তে;-
আমরা জ্যামিতির ভিতরে চলে যাই, ঘূর্ণা দিতে দিতে গাছে ওঠা এবং জ্যামিতির অতলে অতলান্তে চলে আইসি পুনরায়; পুনরায় চলে যাই তরতর ত্বরে জ্যামিতির ভেতরে এবং, এ্যাবং তল তল
‘A’ বিন্দুর সরল রেখা বেয়ে বেয়ে চলে আইসি কেননা, হ্যাঁ কেননা ক্ষুধামন্দা রোগে কাটে আমাদের দিবস যাম ফলে ফলত তাই না হলো বনিবনা, হ্যাঁ তাই চলেই আসা ভালো, ফিরে যেতে যেতে গতরে বিচরে ঘূর্ণা, জ্যামিতির ভেতরে
দেখা যাবে ফলত তখন পুনরায় হ’য়ে উঠি চলতি থামতি আমরা এবং হ’য়ে উঠি জ্যামিতির ভেতরে বিচরি কুটিলা জটিলা ফলাফল পেয়ে করি ধুনাধুনা বনিবনা সব আমাদের ছুঁড়িয়া আনা-আঁধুলী জ্যামিতির উপবনে, হাসি তুলে অদ্ভুত অচেনা প্রস্তাবিত কেন্দ্রাতিগ জ্যামিতিক মানুষ!
ফকির ইলিয়াস এর কবিতা
প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ ও দুর্ভিক্ষবিষয়ক সেমিনার
নীতি নির্ধারণী বৈঠকের বনভোজনে আমরা আমন্ত্রিত হয়েছি
এই দ্বিতীয়বার। ‘গ্রীনহর্স’ ব্র্যান্ডের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ
সম্বন্ধ বেড়ে উঠেছে এভাবেই। যেভাবে পাঁজরবিহীন কোনো
সূর্যাহত কৃষক সন্তান বেড়ে উঠে সমান্তরাল। কাল-আকালের
বৃষ্টিছন্দ মাড়িয়ে। তারপর মাটির প্রচ্ছদে আঁকে নিজের ছবি।
কবি হলে লিখতে পারতো বিরহের কবিতা।
মঙ্গার মাদুর জড়ানো জীবনের জলকলা। বন্দনার দগ্ধ বিধুরতা।
ছাদহীন, চাঁদহীন শৈশবের পথধরে গড়ে উঠা প্রথার বিরুদ্ধে প্রথা।
সরল সলতেকথা
আনন্দের উত্থান দেখি ঢেউয়ের মননে। চিনে রাখি এইসব
লঘু রোদের ঋতি। ইতি টেনে এসেছি সকল মৌন বৈভবের।
কালের কলতানে হারিয়ে গেছে যে গান, তারও স্বরলিপি খুঁজে
বাজাই এস্রাজ। সাজ , সম্ভাষণ সব ভুলে সমবেত হই সকালের
অমোঘ শয্যায়। প্রায় প্রতিভোরে যে পাখি পালক ফেলে যায় ,
আমি করি তারও সন্ধান। প্রাণের আগুনে জ্বালাই সলতের সুতো।
দ্রুত চলে যাই মেঘনার বিমুগ্ধ মোহনায়।দেখি আহত পাখিটি উড়ে যায় ..
ধানী জমির ধ্যানে মগ্ন যে জীবনের গান
তোমার প্রিয় তালিকায় আমার নাম নেই , তা আমি দেখেছি। কিংবা তোমার
লিংক সাম্রাজ্যে নেই আমার নীড়ছবি। তাও অজানা নয় আমার।মেরু বিষয়ক
গোলটেবিল বৈঠক সেরে ষ্টকহোম থেকে ফেরার পথে ওর সাথে নিবিড় দেখা
হয়েছিল আমার। দেখতে ঠিক তোমার মতোই। বলেছিলো, বোষ্টনে যাচ্ছি।
ঘুরতে। বলেছিলাম, ফেরার পথে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাশনাল
হেরিটেজ দেখে যাবার আমন্ত্রণ রইলো।
এর ঠিক তিনদিন পর বেজে ওঠে ফোন। সেই পরিচিত কন্ঠ। সময় হবে ?
প্রশ্ন শোনে সেরে নিই প্রস্তুতি পর্ব। তারপর দেখা হয়ে যায়। আবারও শোনাই
পাল তোলা নৌকোর গল্প।
ধানী জমির ধ্যানে মগ্ন জীবনের গান। ও আমার গল্প শোনে তন্ময় হয়ে।
মানুষকে এভাবেই তন্ময় হয়ে যেতে হয়। আর পুঁজিতে জমা রাখতে হয়
বেগার বেদনা। তালিকায় না থাকলেও যে সাথীকে মোছা যায় না কখনও,
শব্দে ও শ্রমণে করে যেতে হয় সব লেনাদেনা।
তবে কী গৃহীত হবো না
দুপুরের দরোজা খুলতেই দেখি, আমার বুকের
ভেতরে ঢুকে পড়ছে একটুকরো মেঘ। জমাট সূর্য
তার অসমাপ্ত সত্ত্ব নিয়ে লিখাচ্ছে নাম ঘাসের পাঁজরে,
আর বুড়ো নদী তার প্রাগৈতিহাসিক তারুণ্য ধারণ
করে জানাচ্ছে প্রণাম জলকে , জলাশয়কে।
পকেটে কলমের কংকাল দেখে আমিও স্মরণ করতে
চাইছি আমার পুরো নাম। ঠিকানার প্রাচীন ইতিহাস।
এর আগে ছিলাম কোথায়, ইত্যাদি সময়ের রূপরেখা।
আর ভাবছি যে ইট একদিন নিজে পোড়ে , স্তরে স্তরে
সাজিয়েছিল দালান – সেই ইমারতের আলোয় যে
মানব- মানবী দাঁড়িয়ে আজ করছে প্রেমালাপ, তাদের
পূর্বসূরিরা কী তাকিয়েছিল পশ্চিম আকাশে – ভেসে যাওয়া
মেঘ দেখার সবুজ অপেক্ষায় !
অথবা এটাও ভাবছি বলা যায়, যে হেমন্ত মাঠের আঙিনায়
একটি দোয়েল ছায়া খুঁজে করছে বিলাপ
তার মতোই , আমিও কী এই মাঠালয়ে আরেকজন বন্দী
হিসেবে কখনওই গৃহীত হবো না !
অনাবাদী গ্রহের সবুজে
ক
যে আমি আত্মগোপন করে ছিলাম, আজ ভোরে তারই অস্তিত্ব
খুঁজেছি প্রথম। তারপর এই হাডসন নদীর পাড় মোড়া সাদা
কংক্রিটগুলোকে স্পর্শ করে দেখেছি , প্রাত:ভ্রমনকারীরা কিভাবে
ছুটে চলে ঢেউয়ের সমান্তরাল। ছোঁয়া পেলে অনাবাদী গ্রহও বিতরণ
করে জীবনের ঘ্রাণ । উষ্ণতার আঙিনায় দাঁড়িয়ে যে ঋষি করে
আলোর আরাধনা , কিংবা বনান্তরে একাকী হেঁটে যেতে যেতে
যে বাউল বাজায় সুরেলা বাঁশী, তারাও জানে এই জগত-সংসারে...
সকল বিরহকামীরাই সগর্বে ফিরতে পারে গ্রহের সাকারে ।
খ
অনেকটা বাবুই পাখির মতোই জেগে উঠেছিলাম, এই শতাব্দীর
প্রথম প্রহরে । পুষ্প আর বৃষ্টি হাতে , মাঠ -ঘাট -তৃণ ও তারার
মায়ায় , আরেকটি জন্ম বরণে।
জন্মের জ্যোতিই প্রেম, উৎসবের আনন্দই গতি ।
যারা জ্যোতি এবং গতিকে দর্পণে খুঁজে , হয়তোবা তারাই
এক সময় পেয়ে যায় মনের মানচিত্র।
কোনো ভূমি-বৈভবই আমার আরাধ্য ছিল না।
ছিল না বিত্তের ঋজু বন্দনা।শিল্পচিত্র অংকনে আমি কেবল খুঁজেছি
নবীন তান্ডবের মুখ , আরেকটি ঝড়ের পরে ।
গ
তোমার কন্ঠে যদি পরিয়ে দিই শিশিরের মালা , একগুচ্ছ জবার
ঝলকে যদি আবার উজ্জল হয়ে উঠে এই শীতলক্ষা নদী
তবে জেনে রাখো, আবার জয়ের বারতা নিয়ে এই পাড়ের পড়ন্ত
বিকেল আমাদের হয়ে ফিরবে ঘরে।
কণার সমষ্টি নিয়ে পরিযায়ী মেঘ ,
যে সাহস পেয়ে নিকুন্জে ফিরে।
পথের পসরা নিয়ে
ঘাড় ঘুরিয়ে আমি অনেক কিছুই দেখতে চাই না।
আমাকে পিছু ফেলে চলে গেছে যে চিরকালীন ফালগুন,
তাকে আবার দেখে আমি হতে চাই না বিধ্বস্থ ফুলের
কাঁটা। অথবা নবীন ভুলের পাশে সারারাত নিমগ্ন দাঁড়িয়ে
বাঁশি বাজায় যে রাখাল, আমি হতে চাই না তার মতোও
সাহসী নিশাচর। শুধুই চেয়েছি, এই অরণ্য অন্য কারো জন্য
সংরক্ষিত থাক। এই বনজ নীলিমা, অন্য কারো ছায়া হয়ে
হেঁটে যাক পাশাপাশি। আমি না হয় একান্তই সৌন্দর্যবাদক
হয়ে বাজাই মাঠ। মাঠের ঢেউদিগন্ত। আর বার বার তোমার
পাঁজরে তুলি স্মৃতির সিম্ফনি।
যে মেঘ জমে থাকে ঘুমের কপালে, আমি
তার নিদ্রাসঙ্গী হয়েও দেখতে চাইনা মিছে সুখস্বপ্ন।
কী হবে সাজিয়ে পসরা ! পথে এবং প্রত্যন্তে ভাষ্যবর্ষার
ছাপ রেখে কী হবে আবার। যে মেঘ উড়ে যায়, তার ছায়া
আর কী করে কখনও রূপের বিস্তার !
জলের ইকার
(কবি তমিজ উদদীন লোদী - সুজনেষু )
তামা ও তমার তারতম্য বুঝি। নিসর্গের তন্দ্রা দেখে নির্ণয় করি
তনুদের ঘুম। তন্তুর তাপ এসে ছুঁয়ে যায় যে প্রেমের শরীর,আমি
তার বাহু হয়ে নাড়ি হাত। আহা ! গ্রহণের সূর্য ; তুমিও হারিয়ে
গেলে রেশ থাকে আঁধার বিভার।পালকের পুষ্পগুলো উড়ে যায়
মহাকাশ ঘিরে। কখনও আয়নার আদলে , পাথরের পিতৃদেশে
দেখি নিজের মুখ। কিংবা বিবর্তনে, বৃষ্টির জ্যোতিষ্কে খুঁজি ধীর
কোনো জলের ইকার। আকার আর আবর্তের দিন।যেভাবে রূপ
রাগে গ্রন্থির বিধানে,নুয়ে থাকে মরমের কাল আর গ্রহাণু প্রবীণ ।
এক অথবা চতুর্থের রেখায়ন
পার্থক্য অনেক আছে । একই প্রজাতির ফুল কিংবা
একই গোত্রের প্রজাপতির ডানা দেখে বলা যায় না এরা
এসেছে একই বনদেশ থেকে। একই সমুদ্র থেকে
উৎসারিত নদীর কিরণ ভিন্নপ্রদেশে, দিয়ে যায় ভিন্ন
পলি, আর উৎপাদনের অভিন্ন রসায়ন।
আমি রেখার পার্থক্য খুঁজে বার বার দেখতে চেয়েছি
তোমার চিবুকের ভাঁজ। রঙমাখা পরাগের দীর্ঘমন্থন,
আমাকে দিয়েছে ধীর বৃহস্পতির ছায়া। আরেকটি ভূগোল
পেরিয়ে আমি কেবলই নির্মাণের নবম প্রহরে,তাকিয়েছি
সারি সারি নক্ষত্রের দিকে।
দেখার পার্থক্য থেকে এভাবে নিজেই সাজিয়েছি ,
এক অথবা চতুর্থের রেখায়ন। মুক্ত নদীসূত্র দেখে
একটি গল্প লিখবো বলে পেতে চেয়েছি ঘাসফুলের
ঘনিষ্ট সান্নিধ্য ।
কম্পিত ভূমির মন
কেঁপে ওঠো জলাভূমি ,আরো কাঁপো এবং কাঁপাও এই বাষ্পপ্রদেশ
জলানলের সপ্তম বিভায় আবার সংরক্ষণ করো প্রান্তের অধীর অস্তিত্ব
এসব সম্ভার একদিন দিয়ে যাবে প্রমান, খুব গোপন ছোঁয়ায় একক
কেঁপেছিল চরের কাশফুল ,অভিসারী আলো গেয়েছিল অনন্ত বন্দনা।
পৃথিবীর পায়ে পায়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল শেষকথা, ভালোবাসো-কাঁপো
আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি কিভাবে জলের যকৃত, মৃদু কম্পন
পেলে মিশে যায় পর্বতের সাথে।ভূমির সংবেদ এসে কিভাবে ধারন
করে নদীর উৎস। কোথা থেকে শুরু এবং কোথায় শেষ হয়ে যায়
প্রকৃতির মনকম্পন। তারপর যাপন চিত্রে অংকিত কালের নৌকো
ভেসে যায় ঝরনা শিখায় ।কখনো করভূমে ফিরে ,কখনো ফিরেনা।
কাগজের সপ্তম পৃষ্টায়
আমি ক্রমশঃই সরিয়ে নেবো আমার স্থাপনা, ভোর, নিক্কণের সুরেলা দুপুর
সরিয়ে নেবো নদী, সমাধি - পাথরের অপ্রতুল দক্ষিণায়ন। কিছুটা দূরের
স্মৃতিতে ভাসিয়ে দেবো নৌকোর ছবি। কাগজের সপ্তম পৃষ্টায় আঁকা প্রিয়
নিয়তির মেঘ। এবং বলবো , তোমরাও উড়ে যাও পাখিরা - এখানে এখন
মানুষ ও পাখির সহাবস্থান নেই। দূরূহ , দ্রোহী সমুদ্রের নিষ্পলক বেঁচে থাকা।
চোখের জ্যোতি কমে এলে দুপুরেও নেমে আসে মনের অন্ধকার। কিংবা
ধ্রুববাতি হারিয়ে ফেলা জাহাজ , যেভাবে গন্তব্যের খোঁজে আরেকবার
পাঠায় সর্বশেষ সংকেত, ঠিক সেভাবেই আমিও নির্মেদ মাটির কাছে
রেখে যাবো আমার বিবেচনা। উড়ো , উড়ে যাও পাখিরা - তোমরাও দেখো
পালকশূন্য পৃথিবীর গায়ে লেগে আছে কেমন এক মোহ,
যা কেবল মানুষকেই বার বার আত্মপ্রতারক করে ক্রান্তিগ্রহের দিকে পাঠায় ।
একগুচ্ছ কবিতা
এহসানুল ইয়াসিন
স্বপ্রাণ ভিক্ষুক
রাজপথে মানুষের দীর্ঘ লাইন থাকে না
থাকে কেবল দীর্ঘশ্বাস আর শূন্যতা।
প্রতিটি নগরের পিতাই এ রহস্যটা জানেন
তবুও তারা সুবোধ বালক সেজে
ডানা মেলে উড়ার ভান করেন। আর
আমরা কতিপয় স্বপ্রাণ ভিক্ষুক
দুয়ারে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকি
বস্তুত আমরাও নিরস্ত্র পাহারাদার।
সত্য-অর্ধসত্য
০১
অলৌকিক সম্ভাবনার বাতি জ্বলছে পৃথিবীতে
পাতা ঝড়লেও শব্দ হবে না।
সুতরাং তুমি দাঁড়াতে পারো
নিজের পায়ের ওপর আস্থা না রাখলেও আজকাল চলে।
আর যারা সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্বে বিভোর
তারা চিরকাল ভিক্ষা মাগে।
০২
সত্যের বিপরীত মিথ্যা নয় অর্ধসত্য
এ জন্যই বোধ হয় সুবিধাজীবীরা
অভিধানে অর্ধসত্য সংযোজন করেছেন।
তারা অবশ্যই নৈরাশ্যবাদী নয়।
তারা সকলেই দীর্ঘজীবী।
অর্জিত বলে কিছু নেই
অর্জিত বলে কিছু নেই
সবকিছু ঘটনার প্রবাহমাত্র
এই ধরো বিছানা, ব্যর্থ সঙ্গম কিংবা অন্যকিছু
সবই ঘটবে বলে সংঘটিত হচ্ছে
আমি তুমি কেবল ঘটনার লেশমাত্র।
সুতরাং সবকিছু প্রকৃত অর্থে অন্ধকার। আর
কে না জানে?
অন্ধকারে সবচেয়ে নিরাপদ হচ্ছে মানুষ
দাঁড়কাক ও আমাদের গল্প
দাঁড়কাকের ডাক শুনলেই
দাদু অস্থির হয়ে উঠতেন। আর
মাকে বলতেন
ভাত ছিটিয়ে দিতে।
তার বিশ্বাস মানুষের অমঙ্গলের খবর
পশুপাখিই প্রথম পায়।
দাদু আমরা এখন ধূলোর শহরে আছি
লোকাল ট্রেনের যাত্রীর মতো প্রতিদিন
ঝুলে পড়ছি। কোনো মাঙ্গলিক বার্তা নেই। কিংবা
অস্থিরলগ্নে আগাম কোনো সতর্ক সংকেত।
যদিও তোমার অস্থির হওয়ার গল্প শুনলে
নগরের উঠতি ডাকাতরা মুচকি হাসি দেয়
তুমি কি খুব কাতর হয়ে আছো আমাদের জন্য?
তবে তোমার জন্য সান্তনা
ডাকাত পড়ার এই সময়ে ধুলো খাওয়া
ছাড়া আর কোনো উপায় না থাকলেও
শত্রুর সঙ্গে সহাবাসে আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি
কেননা এখন মঙ্গল আর অমঙ্গল এক বিছানায় থাকে
সুতরাং তুমি এবার ঘুমাতে যাও।
সাপ ও ফুল বিষয়ক দর্শন
সাদা ফুল রাতে ফুটে। এবং গন্ধও ছড়ায় অত্যধিক!
দাদু বলতেন
এই গন্ধে নাকি সাপ আসে ফুলতলায় সঙ্গমের জন্য
তবে কি বিষ আর সুবাস দুজনে বান্ধবী!
কানা পয়সার হাট
চিতার উপর মিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে মঠ
আমি নিজেরে বিক্রি করি
কানা পয়সার হাটে
পাশের গলিতে কারা যেন পানির দামে
ভাড়া দিচ্ছে শরীরের ওম
এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিনা বহুকাল
যার কাছে নিজেকে সপে শুদ্ধ হবো।
পবিত্রতা
গাঢ় অন্ধকার সঙ্গমের মতোই পবিত্র
এসো সঙ্গম করি
এসো পবিত্র হই
এসো আগুন গিলে পুরোনো বটগাছ হই
যদিও পাতালে নেমে এসেছে ফেরাউনের ছায়া
তারপরও বলি
ঘাস ও গোবরই হচ্ছে
সময়ের নায়কদের খাবার
এসো সঙ্গম করি
এসো পবিত্র হই
এসো ঘাস ও গোবর খাই।
শৈলেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী মানিক এর দুইটি কবিতা
বাবা
বাবা তুমি একটি বার শোন!
জন্মের পর তুমি যে আদোর করে
চুমু দিতে কপোলে
আজো সেই পরশ পাই !
যখন আমি একলা থাকি !
তুমি চলে গেছো আমা থেকে
অনেক দুরে !
বাবা তুমি কি শুনতে পাও !
আমার কান্না !
যদি শুনতে পাও
তবে আসো না কেন ?
প্রতি দিন বাহির হই
নানা কাজে !
কখনতো তাও দেখা পাইনা !
আমায় ছাড়া থাকতে পার ?
কেমন করে !
আমি ভালো নাই
তোমার কথা মনে পরে
খুব বাবা খুবই !
তুমি সব কিছু ভুলে
একটি বার শুধু একটি বার
তোমার খোকাকে খোকা বলে
চুমু দিয়ে ডাকো !
ধুনকার
রাত এগারটার ঘন্টা শোনা গেলো
শীতের রাত সবাই এই শীতকে চাইছে না
শুধু ধুনকার চাইছে !
কী বিচিত্র মানুষ এই পৃথিবীতে !
কী বিচিত্র অনুভুতি !
আজ সারা দিন সারা রাত
কী কন্ কনে ঠান্ডা !
বাজারে দেখলাম-
দুই কুকুরের মাঝে শুয়ে আছে
এক মানব শিশু !
শিশুটির মুখটি ছিল
ঠিক যিশু খৃষ্টের মত !
ওদের কারোরই শীতের বস্ত্র নাই !
শিশুটির মা আছে
লোকে বলে পাগল মাথা ভর্তি উকুন ,
গাযে গন্ধ ,দাঁতে নুংরা ...
শিশুটির বাবাও আছে
কে সেই বাবা কেউ জানে না !
জানে শুধু শিশুটির বাবা !
ঐ বাবাটির বাড়ি কোথায় ?
ঐ বাবাটি কী করে ?
ঐ বাবাটির পরিচয় কি ?
কেউ বলতে পারে না !
ও সে জেরুজালেমের পুরোহিত !
রহমান হেনরী
কোনও কোনও দোলপূর্ণিমায়
হিন্দি ফিল্মের রোমান্টিক সুরেলা গানের মতো ফুরফুরে জ্যোৎস্না, বয়ে যাচ্ছে চৈত্রের বুকের ওপর দিয়ে; বাতাস ধুম মেরে বসে আছে দূরমাঠে, বটগাছের শেকড়ে-ঝুড়িতে; গালিবের বিষন্ন গজলগুলি এ ওর গায়ে ঠোকাঠুকি করতে করতে পায়চারি করছে নিঃস্ব বারান্দায়; বখাটে জ্যোৎস্নার দেমাগপ্লাবিত এই রাতে জিরো পাওয়ারের বাল্বগুলিরও ছুটি! রাত্রিকালের ধূলি উড়ছে মেঘের ওপর দিয়ে; আর আনতমেঘ ঝুঁকে পড়েছে কোথাও মাঠের কিনারে, জল ছুঁই ছুঁই, বিলের দিকে...
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, নিদ্রাহীনা তোমার চুল অবাধ্য হতে হতেই আবার পোষ মেনে যাচ্ছে। তোমার নিঃস্বপ্ন ঘুমের মধ্যে শান্ত জড়সড় অজগর অলস শুয়ে আছে; তার আকস্মিক জাগরণের নিঃশ্বাস, আজ আমাকে উড়িয়ে নিক দিগন্তের দিকে, যেখানে যুগলপাখি, শাদাকালো ছবির মতো ক্লান্তিহীন... উড়ছে, উড়ছে, উড়ছে...
খাণ্ডবদাহনের দিন
(পাখি আমার একলা পাখি)
দাহ-মুহূর্তেও অম্লান থেকে যাক গান
পক্ষিণীর ঠোঁটে; থেকে যাক টান টান
ডানার অহমিকা, বিমল... চিরায়ত।
খাণ্ডবদাহনের এ দিন, চিরকাল
ফিরে আসে, বাঙলায়, পুরাণের মতো;
পোড়ে সুন্দর, পক্ষিণী; প্রেয়সী আমার।
বৃক্ষপত্রে ওড়ে ওই কাহার নিশান?
কোন হৃদয়ের ম্লান বাকল ও ছাল
দহনে দহনে হলো লোহিত অঙ্গার!
অনন্ত অম্বরে প্রতিবিম্বিত, সে কার
প্রণয়ের প্রনত কঙ্কাল, হতাহত?
থাক, থেকে যাক, সে সব প্রশ্নপ্রধান
সুর; শুধু পক্ষিণী তার চঞ্চুতে, লাল
যন্ত্রণারঙ মেখে, দেখুক বিরহকাল!
আশুলিয়া রোডে
আশুলিয়া কখনও যাবো না; যেতে পারবো না, একা। সেখানে যে পথ ছিলো, আমাদের প্রশান্তির দিকে বাঁক নেওয়া; দেখলাম : সটান উল্টে গেছে, বাঁক নিয়ে চলে গেছে অপরিচিত সেই দিগন্তের দিকে, যেখানে নরক তার অগ্নিদুয়ার খুলে ডাকে। দুই পাশে নীল ও লালাভ গাছপালা, ছায়ার বদলে দিচ্ছে আগুনের লালা; পাখির প্রশ্বাস থেকে বায়বীয় এসিডের ঝাঁঝ অনিরাপদ ক'রে তুলছে স্নিগ্ধ হাওয়াকে। সেই রাতে, কী কী তুমি আমাকে দিয়েছো; আমি কী কী না দিয়েও সম্প্রদান কারকে নিহিত, উহ্য থাক সেইসব কথা। আমার স্তব্ধতা জুড়ে যে সকল বাণী ছিলো তোমার শ্রুতিকে নিবেদিত; আশুলিয়া রোড সব জানে। তোমার তো দোষ নয়! কোনও দায়ভার আমি তোমাকে দেবো না; সব দোষ বিস্মৃতির; বিস্মৃতিই চিরন্তন, মানুষজীবনে!
আশুলিয়া রোডে আর কখনও যাবো না; সেখানে যে পোল্ট্রি-খামার হবে, তুমি যেও, একা... দেখে এসো, কেলভিনেটর থেকে অকস্মাৎ মুরগী-শিশুরা নয়__ ঝাঁক বেঁধে হয়তো বেরিয়ে আসবে, বিরহের অজস্র শিশুরা! এই নগরীর উচ্ছ্বল যন্ত্র-যুবতীরা, মিলন-পিয়াসী; বিয়োগাত্মক কোনও চলচ্চিত্রই কোনক্রমে পছন্দ করেনি তারা। তবু সেই সাতাশের রাতে, তারা সব একযোগে বিরহ প্রসব করে এসেছিলো, আশুলিয়া রোডে!
দুইজন একা মানুষের গল্প
[ প্রণয়ের রূপকথায়, পুবদেশে, এক যে ছিলো পাগলা রাজা আর ব্রজসুন্দরী তার রানী। একদিন রানী ব্রজসুন্দরী পশ্চিমে চলে গেল, একা; আর সেই পাগলা রাজা, পুবেই থেকে গেল...]
পশ্চিমে, খোলা হাওয়ায়, দাঁড়িয়েছো তুমি, অবিরাম তুষার-বৃষ্টিতে, একা...
পুব দিকে, ভয়ে কুঁকড়ে যেতে যেতে, একা আমি , গুটিয়ে যাচ্ছি আত্মার ভেতরে; আর কুচি কুচি বরফের নিষ্ঠুর আক্রমন, তোমার চুলে-চিবুকে-গ্রীবায়... আজ যদি ব্লিজার্ডের দমকা হাওয়ার রোষ, তোমাকে উড়িয়ে নেয় মধ্য আটলান্টিকে ! হাঙ্গরের চেয়ে ক্রুদ্ধ ঢেউ যদি তোমাকে ভাসিয়ে নেয় লহমায় নিরুদ্দেশ দ্বীপে !
ঝড় থামে, জানি; সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়া তছনছ তীব্র প্রলয়, তাকেও তো থেমে যেতে হয় ! ঝড় থেমে যাবে... তুঙ্গমুহূর্ত থেকে একদিন সবাইকে ফিরে যেতে হয়; তখন সমুদ্র শান্ত, সুনসান স্তব্ধতা, তখন হৃদয়ে দুঃসময়; অপার বিশ্বাস বেঁধে তবুও তো কোনও দ্বারে ফিরে যেতে হয় !
ব্লিজার্ডের থাবা যদি সত্যি একদিন তোমাকে উড়িয়ে নেয়, নিরুদ্দেশ দ্বীপে !
আমি কার শূন্য-কুটিরে যাবো, কার দ্বারে অর্থহীন-প্রতিধ্বনিহীন, কড়া নেড়ে নেড়ে, আবারও রক্তাক্ত হবো ? তুমি বলে দাও !
দুটি কবিতা
রাজীব সিংহ
মেঘের জন্য, সেতুর জন্য
মন মাননো একটা অসুখ মধ্যিখানে নদী
নদীর পাশে চোরাবালি মুগ্ধ হয়ে যদি
তক্ষুণি কেউ করলো তাড়া রাত্রি বিষম ঘোর
ঘোর সে পাগল থমকে একা কলেজস্কোয়ার মোড়
মোড় পেরোতেই একশো আগুন এবং কসমেটিক্স
কসম কাটো রাধার নামে বন্ধ পোলিটিক্স
পোলওটিকা দেড় মাসে দাও স্বাস্থ্যটাকে চেনো
চিনবে আমায় শালবনেতে খাচ্ছি যেথায় ধেনো
ধেনোর পাশে শালপাতাতে সাজিয়ে ছোলার চাট
চাটরে স্বাদে শূণ্যে ভাসি পেরিয়ে সবুজ মাঠ
মাঠ মানে তো রোদ্দুরে তার ভাসছে বসতবাড়ি
বাড়রি সাথে আলভোলা তার ঠোঁটরে জন্মআড়ি
আর যাবোনা অন্য কোথাও মন মাননো আজ
আজ তুমি মঘে ভাঙতে থাকো তোমার রাধার সাজ
প্রেম পদাবলী
ও পলাশ ও কৃষ্ণচূড়া গুঞ্জমালা গলে
আবিরে প্রেমে রাঙাও ও মন এক পল দুই পলে
তোমার দলে গাইছে যারা বাসন্তিকার রঙে
নাচের মেয়ে হারিয়ে গেলো গানের মেয়ের ঢঙে
একটিবার ছোঁবো ও হাত একটিবার মুখ
ইচ্ছেটুকু লুকিয়ে রাখি শঙ্কিত দুইবুক
আমার দলে সব বেমানান সবাই জড়োসড়ো
ঢেউয়ে আলোয় উঠবো মেতে এই চোখে বাণ ছোঁড়ো
রৌদ্র ধূলা কুঙ্কুমে আজ চৌদিক মাখামাখি
বদ্ধ মনের গোপন কোঠায় কাঁদছে গানের পাখি
ঝাউয়ের নিচে বৃত্ত রচি ঝাউয়ের তলে গান
কৃষ্ণচূড়া, পলাশ কোথা! সঙ্গী অভিমান...
সনোজ কুণ্ডুর কবিতা
সারেং এর চোখে ধ্রুপদী জল
এভাবে নত্র পতনযাত্রাকালে জ্যোৎস্নাধোয়া জল গলাতে থাকে দারুচিনি। শঙ্খের নিনাদ কান্নায় ডাহুকের ডানা ছুঁয়ে রাত্রি নামে। এখানে দ্রাক্ষাসুরার জলে যুবতীরা আদিম হতে চায়। ভিনদেশী জলজ খুঁজে পায় অসংখ্য শরীরের মোম পরান। নিঃশ্বাসের একনদীতে জ্যোৎস্নাবতী রাত ডুবসাঁতার খেলে। মনপোড়া জলের নৈবেদ্য সাজিয়ে সারেং গেয়ে ওঠে বৈরাগী গীত। বাদুড়ঝোলা ইতিহাস থেকে মানচিত্র হারাতে থাকে। শিরোনামহীন অজস্র কবিতার পংক্তি বৃন্ত থেকে খসে পড়ে- হারাতে থাকে বউ মানুষের পরবাসী তৃষ্ণা।
চৌচালায় বিরহ নামে
আমি কার বিরহে ভাসি অষ্টাদশী চন্দ্রজলে। মাঘিজ্যোস্নায় কেঁদে ফিরি লালরঙ শূন্যতায়। ঢেউয়ের লহরতোলা জোনাকরাতে জোড়া ঘুঙুরের ত্রিতাল ছন্দে হয়েছি উতল। কদম ফুলের আবেশ জড়ানো মোহে সেই কবে ছেড়েছি ঘর। পথের তাড়া খেয়ে খেয়ে এসেছি প্রান্তবেলায়- যেখানে সঞ্চয় শুধু ভাঙনের টুকরো টুকরো অবসাদ। তবুও জানা হয় নি দুধরঙ চিত্রদেহের অপার্থিব মায়াছল।
মৃত্তিকার অদৃশ্য ডাক
আমিতো জ্বলেই আছি। রণদীপে বেঁধেছি প্রাণ। য়ে যেতে আটপোড়ে বিধি সূচি করেছি সাতগাঙ ধোয়া মোহন জলে। লালিত দুঃখরাগ কবেই ঝরে গেছে সপ্তসুর থেকে। বাঁশপাতা মনের বিমূর্ত স্মৃতি রেখাচিত্রের পতন দেখে। কাজলাীর মায়াছলে অংকিত হবে আরো একটি সমাধির কালো ছক। নীল গহনের ওপার আকাশ নিয়ে যেতে যায় মৃত্যুবতী অচীন মৃত্তিকায়। জানা নেই তার- আমি যে মরেছি আছি। মৃত্যুর আগে হয়ে আছি মাটি। জীবনের আগে জল।
সেই রাত্রি চাই
আমি সেই রাত্রি চাই- যে রাত্রি সব কলমের কালি চুষে তার রহস্য ছড়াবে পাথর অন্ধকারে। রাতজাগা বাদুড়ের চোখে অন্তহীন তৃষ্ণা মেটাবে। চৌরাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোকে এক নিঃশ্বাসে গিলে খেতে সম। হিজল গাছে আশ্রিতা জোড়া-কুটুম শতাব্দীর বিচ্ছেদ ভুলে চঞ্চুতে ভরে দেবে আজন্মের জলবিষ। আমি সেই রাত্রি চাই- যে রাতে পরবাসী নদীবউ আরো একবার ভেসে যেতে চায় জল-আগুনের মিলন স্রোতে।
দোলনা ঘুম
বেদনার কী যে ব্যথা- চরজাগা নদীবউ নিশি জেগে জানে। কুটুম রাত জল-আগুনের মিলন দৃশ্যের সময় গুনে। সময় চলে যায় ভাটিয়াল দ্বীপে, যেখানে মুখ গুজে পড়ে থাকে মৃত ঝিনুকের কষ্ট। জ্বলন্ত চুলা জলশূন্য জ্বলে জ্বলে নিভন্ত হয়। স্বপ্নের শ্বেতকরবী ঝরে ঝরে মহাশূন্যের পথ ধরে। ডানাভাঙা ফড়িংমন আশ্রয় খোঁজে গলতে থাকা নগ্ন পাথরে। মোমস্বপ্নের আলোরঙ জ্বেলে ভাসতে চাই নিশিজোয়ারে। কোন এক শতাব্দীর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি আমার যে চোরাবালিতে সাঁতার শেখা হয়নি! জীবন নিজেই ফিরে যেতে চায় দোলনাঘুমে।
রঙশূন্য
হারানোর কিছু নেই। আমিতো গৃহদাহে বেঁধেছি মন। আমার আছে বিশ্বস্ত দীর্ঘশ্বাস। রাত জেগে দেখি ঋতুমতী আসমান কতোটা উজার। কতো অন্ধকারে ডুবে আছে ডাহুকের গোলপাতা ঘর। জলশূন্য ভুবনেশ্বর কার বিরহে এখনো উদাস। ঘরভাঙা সারেং নির্বাসিত জীবন খুঁজে পেতে কী যে ব্যাকুল! কাজল চোখের কী নিবিড় প্রার্থনাগুলো দু’পায়ে মারিয়ে দিলো কতো। সেসব ভুল যদি ভুলের খাতায় লেখা না হয় তবে জীবনের নাম প্রায়চিত্ত হবে না কেনো!
কষ্টপোড়া নীল ছাই
আগুনকে পোড়ার অনুমতি দাও। অলৌকিক সেই বিধবা পাখির কষ্টপোড়া ছাই ভেসে যেতে দাও গাঙরের মান জোয়ারে। দেবলোকের কলঙ্ক ছুঁয়ে যাক উজান নগরের বৈষ্ণবী চাঁদের শরীর। সহস্র বছর প্রাচীন অন্ধকারে ডুবে থাকা দেবী নারীটি কামনার বহ্নিতে জ্বলে উঠুক। শস্যহীন অনাবাদী উর্বর সমতল জমিন বন্ধ্যা জীবন থেকে মুক্তি পাক। বুকের ফসিল কাব্য জেগে উঠুক শতাব্দীর নিদ্রা থেকে।
দুঃসময়ের সংলাপ
পথ তুমি দাঁড়াও! এবার পথিক চেন। একদিন যার হাতেই তোমার জন্ম সত্যি ছিল। আজ আমার পিছু ফেরার সময়। রাখালিয়া উজান স্রোতে অনিবার্য স্বপ্নময় গোপন সাঁতারে আমি কতটুকুই সম। বালুচরী রাতের বিমূর্ত ছায়া দেখে পাখিপাড়ায় জেগে ওঠে অভিসারী মন। রক্তের অঞ্জলি দিয়েও জীবন থেকে সূচি হলো না পৌরাণিক পাপ। ক্যাকটাসের শেকড় না ছোঁয়ার কষ্টে আর কতো ভাঙবে নৈঃশব্দ্যের জলঘুম। অজুত দুঃখের নামতা গুনে গুনে অন্ধঘড়ি কি থেমে যাবে বিষমবাহুর ত্রিভুজ ছকে।
মৃত্যু উৎসব
পাখিসভায় এ কোন শোকের মিছিল। মেঘের পালকছোঁয়া রূপালী জ্যোৎস্নার গায়ে মৃত্যুঘ্রাণ। যুবতী দিঘির জলে চাঁদের নৃত্যকলা। বনবিহারী কীট-পতঙ্গ দেখে উৎসবরত মৃত্যু। এ রাজ্যে আজো শেষ বিকেলের সূর্য হাসে। মেঘের প্রাচীর ডিঙিয়ে বৈষ্ণব চাঁদ প্রণামের অপোয় প্রহর জাগে। জ্যোৎস্নাবতী রাত নিয়ে আসে জ্যেঠিঙ্গাদের মৃত্যুখেলা। পূরবী রাগে আসামের নিসর্গে কলঙ্ক নামে। তবুও অসনী বার্তা নিয়ে আলো জ্বলে এই পাখিপাড়ায়।
সুখ আপনি কার
যৈবতী গাঙের জল ছুঁইয়া দেখি পরানের হলুদবরণ নাচ। মনঘুড়িটা পবনের সওয়ার হয়ে নীল আসমান ছুঁইয়া আসে। থোকা থোকা শরীর মেতে ওঠে ভাটিবেলার উৎসবে শান বাঁধানো ঘাটে। চোখের জলে বাইন্ধা পিরীত ঘু ঘু সোহাগে মন ভাসাই। শঙ্খচিলের আঁচলে বাঁধা মনবদলের রঙ ফিরে পেতে চাই। ভেসে যেতে চাই মোহনাগামী নদীর মতো হীরক জ্যোতি ছড়ানো কোন শিশির সিক্ত ঘাসফুল বনে। যেখানে খুঁজে পাব একচিলতে মেহনতী সুখ।
ছুটির ঘণ্টা বাজে
মন তুই স্কুলে চল
একটি ছুটির ঘণ্টার অপোয় থাকি
কানামাছি জীবন থেকে
এভাবে পালিয়ে আর কতদিন
এক শ্রীপঞ্চমী রাতের আঙ্গিনায়
যে স্বপ্নের সমাধি হলো
স্নেহের শিশিরটুকু চুষে
ঘাষকিশোরী পুষ্ট হলো
তা কি ফিরে পাবার
যাত্রাপালা শেষেও
বিবেক কাঁদে থৈ থৈ নোনাজলে
কানে তার বৈতালিক ঘুঙুরের আওয়াজ
যেন একটি ছুটির ঘণ্টা।
মাটিগন্ধী তৃষ্ণা
বাঁকফেরা নদীটিকে ছেড়ে দেবো
মোহনার জন্মান্ধ টান
তাকে যে প্রত্নতাত্তিক সুখ দেবে
জলেশ্বরীর বুকে বাস করেও
আমি কি পাব জলফুল মন
চৈতন্যের লালদিঘি জলে
বৃথাই সাঁতার কেটেছি আমি
মাটিগন্ধী তৃষ্ণাবুকে
রৌদ্রজ্বলে দহন ভানে....
দুঃখ পুরাণের অথৈ গহীনে
মৃতপাখির বিবর্ণ পালক দিয়ে
খচিত হবে নকশী কাঁথার ফোঁড়।
ত্রিদিব মিত্র'র কবিতা
হত্যাকাণ্ড
আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফঁদাই পড়তে হচ্ছে
মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে
চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের
ধ্বস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়
আমার মিথ্যে জিভ থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফঁড়ে
ঝলসা দিচ্ছে মানু-বাচ্চাদের
তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান
আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ
প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কঁদে উঠেছিলাম আমি
চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার
চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে
আমি দানব না যিশুকৃষ্ট বুঝতে না পেরে
রেস্তঁরায় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা
আজ আর কোনো রাস্তা খঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার
সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে
সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়
সব জীবনের মথ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা
আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু
অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়া
কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান
কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে
ভয়ে কঁচকে গিয়েছিল তার চোখ
অন্ধ চোখে কঁদে উঠেছিল মাথা নিচূ করে
এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে
নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর
আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে-আমার ভালবাসা
ভয় আর ভালবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে
বঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর
ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়
সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়
বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ
সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যের বেতারে
টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু
এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়
রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি
আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য 'টোপ'
নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে
খেলতে চাইলাম চাতুরী
তোমার প্রতারণা থেকে ভালবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম
আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা
আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা
আমার দিব্যজ্যোতি আমার আম্ধকার
আমার চারধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার
চলছে মানুষের
আমি বুঝতে পারছি মানুষ মানুষকে ভালবাসতে পারছে না
....মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালবাসেনি
উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্ধ লাশ
আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে
আমার ধর্ম কি মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে
আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে
স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু
পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা
অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটৈ ক্ষুরধার ভালবাসা
আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি
প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমত
অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান
কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু
আমার ভালবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি
অসুস্হ ভালবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য
মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও
আমার সকল উত্তাপ জযো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক
ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা
আগুনের হল্কা চুঁড়ে দিলে আমার গায়ে
শিশুর মত হেসে উঠলাম আমি
পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর
আকাশ ঘঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ
স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে
ওঃ
আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল
আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না
নিজেকেও তেমন করে ভালবাসা হল না আমার
এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি
এক সঙ্গেই হাসছি আর হাসছি না
ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি - অক্লান্ত আওয়াজ - আঁকাবাঁকা টানেল -
লুপ - পরিসংখ্যান - ক্ষুধা - মহব্বৎ - ঘৃণা -
কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের
আত্মাকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও
বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে
আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে
মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ ওব্দি
ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমিওঠা চোখে
মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার
কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালবাসা আমার অসহায়তা
মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে
অক্ষম আর আঊর্ব স্বাধীনতা
মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে
অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা
ওঃ আমি কোনো দিনই ভালবাসতে চাইনি
আঃ..................................আঃ
কলজে গঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়
বুকের ভেতর ইনজিনের চাপা ক্রোধ
রক্তের উত্তেজনে থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা
অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রণাম রেখেছিল সুবো
তিন মাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ
মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি
ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে
আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়
ভাঁটার সঙ্গে সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতদিন চিনতে পারেনি
আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খঁজে পাচ্ছি না নিজের
"মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই" বলতে ককিয়ে উঠেছিল
৩৫২ কোটি মানুষ তায় ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা
ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন
কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে
আমার ।
তাদের অজান্তেই...
(১৯৬৩ সালে শিবপুরের পুরানো বাড়িতে থাকাকালীন রচিত, এবং মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত 'জেব্রা' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত । )
হামিদা রহমান এর কবিতা
স্নায়বিক
অনুভব আর চাপা নি:শ্বাস দেখে নেয় রাত্রিপরিখা, ম্লান ক্লান্তির ঘোরে ধীরে ধীরে মোলায়েম দু'টি চোখের
কষ্ট বাড়ে… তোমার পছন্দের সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে সত্তা... প্রতিবাদ করতে পারিনা
সাহসিক পরিচর্চায় হাতের নাগালে ধরা দেয় ধূমকেতু, অনায়াসে পা বাড়াই, স্বপ্নের ঘোরে হাঁটি, ওপারে নামে
বর্ষা… স্নায়বিক পরিচর্যা শুরু হলে আমার কিছু বলার থাকে না
মনের চোখ থেকে একটি মিনিটের জন্য আড়াল করতে পারি না; ফের চোখে চোখ রাখি; চোখের ভাষা বুঝে নিই আপন মহিমায়। চোখ যে কখন হলো রুদ্ধভাষা!
রূপভেদে ভিন্নতার ছাপ রেখে যাও গোপনে বিরূপ ভৎর্সনায়। নিজের আড়ালে দেখি, তার স্বরুপ। চোখে
ছেঁড়া পাপড়িতে মিলিয়ে নেয়া দুঃখ। আমি আর কিছু ভাবতে পারি না।
দেহভাঁজ
তারে খুব কাছাকাছি রাখি। নিজের সাথে বনিবনা না হলে, চোখের আড়াল করি। ...আর শূণ্যতা! সে-ও
এক হাহাকার! আকুতি নিয়ে ফিরি বারা বার। কিসের দর্শনে এমন করে উঠে চারপাশ!
আকুতি নিয়ে করি নাড়াচড়া- দেহস্বপ্নভাঁজ
২.
খুব ফুরফুরে সময়টা পার হলে; আদিম নিয়ম ভেঙে দাঁড়াই। নিজেদের অন্যকিছু ভাবতে পারি না। শুধু
পাশবিক পূজো ছাড়া...
কী হবে আর স্বপ্নের সাথে বসবাস করে। এসো, নেমে পড়ি জলে… জল সেঁচি
৩.
এতো নির্ভর কখনো ছিলাম না। গত ক'দিন ধরে ভাবছি থিয়েটারে যাবো, সাথে কিছু কেনাকাটা। এতোটা
পাশাপাশি থেকেও মনে হয় অনেক দূরে... সবকিছু কেমন যেন, শ্বাসরূদ্ধ অবস্থা!
এরপরও আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখি। বুননের মাঝে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করি…
৪.
ক্লান্ত দেহে আবারও রিসিভার তুলি, ও-পাশ থেকে হারিয়ে যাওয়া ক্ষীণ কন্ঠে তোমার জলছবি দেখি…
প্রহর জমা হতে হতে বাড়ছে আগ্রহ, এ-বেলা ও-বেলা কেমনে যে ফুরায়! ঘোর কেটে না।তুমি কথা
না-বললে বুক চৌচির, যদি এসে বলো… কানভরে শুনি
নিয়তি আমার, বদলা নিতে নিতে বারবার হেরে যাওয়া
৫.
নিজেকে আড়াল রাখা; সে-ও কি এক ধরণের লুকোচুরি! ইচ্ছেমতো করছি আনাগোনা… বাঁধতে পারি না
লাজে। অভিলাস সেতো লুকিয়ে রেখেছি নয়নজলে। ভাবি এই বুঝি রিসিভারটা আবার টেনে ধরলো! গর্জে
উঠলো আমুক নিয়মে। মানে না কোন বাধাঁ... সবকিছুর ভিতর লুকিয়ে থাকে জানাশোনা
শরতে সাদা মেঘের কাছে আজও জানা হলো না; ডুবে যেতে যেতে কেনো আবারও ভাসি অপয়াজলে...
দ্বিতীয় সত্তা
তুমি অপরাগ হলে, আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রই
আগ্রহ দিন দিন কমে-বাড়ে। চিন্তায়-চেতনায়
যেমন করে ভাবতাম আগে; হে সূর্যগালিচা...
দুঃসাহসিক কি এমন, ভাবনায় পুরোটা দখল
হলে। যেভাবে পারি নিজেকে বলি দিতে
হায় ঈশ্বর! স্বর্গ-নরক সে-তো দুনিয়ার তরে
দায়বদ্ধতার উপহাসে ক্ষীণ হয়ে আসে কোলাহল
অ
পা
র
গ
সমঝোতা আর আশাবাদের সঙ্গে বসবাস দ্বিতীয় সত্তা
বলি, শুধু আভিধানিক হয়ে সূর্য গালিচায়
দাঁড়ায় নিজের অবস্থানে-
অবচেতন দেহ, বৃথা বলির নিশানা উড়ে
তিনক্রোশ দূরের জনশূন্যতায়
জীবন চুক্তি
প্রায়ই চূর্ণ হয়ে ধরা দেয় বিকালের আস্তানায়
মাঝে মাঝে ভাবি এ সবই বিভ্রান্তি... প্রাকৃতিক প্রবাহ
বর্তমান ব্যতীত আর সব এক
আমাদের চেনা পথ
তরঙ্গের মত জীবন, জীবন-চুক্তি...
শেষাংশ কখনও এক হয় না। চিরন্তন
স্পর্শ জীবন, আশীর্বাদ জীবন, অভিশাপও জীবন
বিভ্রান্তি থেকে আরো একটু দূরে সরে দাঁড়াতেই
একটি রাস্তা এসে মিলিত হয়। ত্রিমুখি...
বুননের ভিতর বাস করে জীবন-চুক্তি
ঘুম বিষয়ক উপাখ্যান
যতই হতে থাকে রাতের গভীর
ঘুমঘোরে জেগে ওঠে পাহারদার
ঘুমের সদৃশ্য, ঘুমন্ত মস্তিষ্ক
ঘুমন্ত রাত, ঘুমন্ত পাহারাদার
বাড়তে থাকে শব্দআলোড়ন
আঘাতে আঘাতে খুলতে থাকে স্নায়ুজট
জেগে থাকা চাঁদ
২.
ঘুম তাড়াতে যত উপাখ্যান
চোখের মণিতে জলের আবাসন
শব্দআলোড়ন, শব্দের মাত্রাকে উপেক্ষা করে
ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে নিদ্রাদেবী
ঘুম-মৃত্যুর মাঝামাঝি জেগে থাকে আত্মা
ঘুমজাগানিয়া দীর্ঘশ্বাস হেঁটে বেড়ায় দৃশ্যের ভিতর
ঘুমজাগানিয়া বন্ধ চোখে একের পর এক হাঁটতে থাকি অতিচেনা আইল ধরে। আমন ধান আর বাতাসের
তালে তালে ঘাসফড়িং ধরার প্রতিযোগিতায় আমি সব সময় পিছিয়ে পড়লে তুমি ভীষণ অভিমান করে
বরপইরে গিয়ে ও-পাশ ফিরে আনমনে পইরের পাড়ে বেড়ে উঠা দূর্বাঘাস ছিঁড়তে
আমি তখনও অধীর আগ্রহে ঘাসফড়িং এর লেজের দিকে চেয়ে ভাবি-
আর পারা গেল না; হেরে গেলাম আজও...
দুই
বরপইরের কোণাকোণি দৈর্ঘ্য কত হতে পারে? কখনো জানা হয়নি। কখনো আধেক, কখনো একচতুর্থাংশ
সাঁতার কেটে স্নানের স্বাদ মিটিয়ে উঠে পড়তাম। আহা! আমাদের বরপইর...। এক সময় সাহসের পাখায়
ভরে কোণাইচ্ছা সাঁতার কাটার ভূত তাড়াতে গিয়ে মাঝপথে বার-বার ডুবে যেতে-যেতে ডানদিকে অনেক
কষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে, শরীর আর চলে না; শেষ-মেষ কিনারা পেয়েছিলাম
এখন শুধু ঘুমজাগানিয়া দীর্ঘশ্বাস- এপাশ ওপাশ...
তিন
"এটা কি মরিচ? এক ডুবে ধরিচ"- মরিচ মরিচ খেলার নেশায় চৈত্যের ভর দুপুরে স্কুলের জানালায়
কতবার হারিয়ে গেছি।... বই-পত্তর ছুঁড়ে দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দে এখনও হারিয়ে যাই সেই
বরপইরে। মরিচ মরিচ খেলতে গিয়ে একসময় পাঁচেকজনের নিচে পড়ে গেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে পানি খেতে
খেতে ভেসে উঠেছিলাম!
আজও ঘুমজাগানিয়া মরিচ খেলায় বার বার শ্বাস বন্ধ হয়ে জেগে উঠি আর হাসি
চার
আজ ইতিহাসের ভয়াবহ দিন। দাদীমা তসবীহ হাতে মলিন চেহারায় ভগবানের নাম জপছেন। বরপইরের
ইতিহাসে কেউ ডুবে মরেছে কিংবা কোন অঘটন ঘটেছে, এমন নজির নাই বললেই চলে। দাদীমার মুখে
শোনা-কতবার ডুবে মরতে মরতে ভেসে উঠেছি। দাদীমা তাঁর দাদীমার কাছ থেকে শোনা গল্প প্রায়
বলতেন; যেদিন পুকুর কাটা শেষ হয়ে ছিল; এলাকার প্রভাবশালী স্বপ্নে দেখলেন "গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী
নববধুকে পইরে ডালী দিলেই কারো কোন ক্ষতি করবে না।" তিনি তাই করলেন। সারা গ্রামের লোকজন
কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ আছড়িয়ে কাপড়-কাচসে, কেউ সাবান ডলে গোসল করছে
আজ ইতিহাসের ভয়াবহ দিন
আজ বরপইরে জাল ফেলা হবে
সম্পর্ক
দাহ! বহন করো দূরে, আরো দূরে
ও-পাড়ের প্রতিধ্বনিতে ফিরে স্বস্তি
নিত্য বসবাস সংশয় গোপনে
পাপ...
মেঘের ঠোঁটে জমে অনিয়ম নিয়মে
২।
প্রকৃত আত্মহত্যা, হত্যার চেয়ে ভয়াবহ ভেবে নিজেই আত্মহত্যার মাপ গুনি। যোগাযোগে বারবার
দোষারোপ। বাঁধার পেছনে অদৃশ্য বাঁধা। হিসেবের শূন্য পাতায় জমা হয় এক মুঠো রোদ!
বিস্ময়ে নয়, সম্পর্কের গভীরে জন্ম নেয়া আরও একটি সম্পর্ক। আগুনের ছোঁয়ায় যেখানে শুরু... চৈত্রের
দাবাদাহে মোম। করোটি বরাবর আত্মহত্যা দাহে প্রদাহে
বৃষ্টিস্নাত
তুমি কি জানতে মেঘের উচ্চতা কত? কার বা সাধ্য আছে বাধ্য হবার! বিনয় করে যার অমরত্বে
ছুটেছি... হিসেবের মাথামুণ্ডু খেয়েছে জলবরফ, শীতলের আর্দ্রতা মাড়িয়ে পাহাড়ের চূড়ায় ভর করে আমি
পাড়ি দেই শীতের দেশে। অন্যরকম বৈরি আবহাওয়া। মেঘ আমাকে ত্যাগ করো না। ধুলোয় মিশে যাবে
আমার আত্মা। ছায়া রেখে যেয়ো এতেই পেয়ে যাবো জীবনের জয়গান। আমি বৃষ্টির গায়ে আর জল
মাখতে চাই না!
নিজেকে দেখে নিই হিমে... শুদ্ধ হবো মেঘ, স্নাত হবো বৃষ্টির জলে
মোহ
অন্ধকারের ঠোঁটে লেগে থাকে পাপ
মেঘের হিসেব নিতে নিতে মাথা নত
বৃষ্টি; নির্ভুলভাবে পাঠ চলে প্রকৃতির
আকিঞ্চন ঘুমে কাঙ্ক্ষা জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে
মোহাচ্ছন্নদৃষ্টি...
পাশে দাঁড়াব, শুধু আতঙ্ক...
কেঁপে কেঁপে ওঠে দীর্ঘশ্বাস
জলছাপ
তাকে যখন দৃষ্টির আড়ালে রাখি, জলছাপে নয়নের কোণ ভিজে। ছেঁড়া-ছেঁড়া কথামালায় আমরা পূর্নজন্মের
হাজারো প্রশ্নোত্তরে নিজেদের পছন্দের তালিকা তৈরি করে ঈষদুষ্ণ ঘামে স্ফটিকের মত শীতল জলে দু'পা
ডুবিয়ে নদী ভ্রমণে হাওয়াবিন্দুর মত নেচে উঠি...
জলের তীব্রতা একই সমান্তরাল... একই আশা থেকে কিছুতেই পৃথক ভাবতে পারি না। এখনও স্বপ্ন আছে
বলে জলছাপ, হাওয়াবিন্দু দিবা-নিশি স্বপ্নজলে ভাসে
জলস্বপ্ন, একাকার হয়ে আমাদের দিকে হাতছানি দেয়, আমরা জিজ্ঞাসা বাদ দিয়ে দুইয়ে-দুইয়ে আঙুলে চার
গুনি। যোগ আর গুণের একই সমরোহ। জলাবাসন, গ্রহণের আসক্তিতে খুঁটি গাড়ি
প্রতীক মাহমুদের কবিতা
ব র ফ মা নু ষ
এই কুয়াশা সকালে অন্তর্ভেদী শীতলতা নিয়ে আমি এক বরফ মানুষ। প্রচন্ড ঠান্ডাস্ত্র তাক করে এগোচ্ছি শহরের বুকে। মনে হচ্ছে শহরটা আজ মৃত শরীসৃপের শান্ত বুক, যেখানে কোমল রোদ টোকা দিচ্ছে নিরব কথনে। একটি রাতের সমস্ত শাহুরিক পাপ বস্তায় ভরে টোকাইয়ের দল ছুটছে গোরস্থানের দিকে; জৈবিক ঋণ শুধতে পারেনি বলে চৌরাস্তার মোড়ে নগর কোটালের মমি ঘিরে দারুণ উল্লাসে মাতোয়ারা গণিকার দল। অথচ গতরাতেও যাদের দেহজ উত্তাপ ছাপিয়ে ক্ষুধার উত্তাপে চোরাগলির অন্ধকার কাঁপছিল, আজ তাদের কান্তি জমে যাচ্ছে কুয়াশার স্তনে। সকালের আলোয় ছায়া খাটো হতেই ভ্রুণের যন্ত্রণা নিয়ে রিক্রা গ্যারেজের চৌচালায় কুয়াশা ঝরছে শিশিরের অস্তিত্বে। আর আমার কবিতার কিছু ভগ্নাংশ মুখে চটকিলা হাসিতে যখন রাতপ্রতিমা, তখন শীত কফিনে মোড়া সমস্ত পাপ নির্বাসনে দিয়ে ফিরছি নগরীর সনাতন চৌকাঠে-অতন্দ্র প্রহরায়-এক বরফ মানুষ।।
অ ন্য জ ন্মে ভা লো বা সা
নতুন বীজে জন্ম নেবে সরস ভালোবাসা
জন্মান্ধ তুমি যতোই ভালোবাসা খোঁজো এই আকালে!
দেখবে যুগল বুকে অস্থিরতা নিয়ে সবাই চলছে একই পথে,
পারলে পকেট ভর্তি আগুন নিয়ে সাথে চলো;
অন্ততঃ পুণঃজন্মের আগে কিছুটা দিন উত্তাপ ছড়াতে পারবে জলের ক্যানভাসে।।
সূ র্য পা হা রা
গ্রহণকাল থেকে ছিটকে পড়া সূর্য হাতে নিয়ে
পথে বেরুতেই খবর পেলাম
আগামীর প্রতিটি জন্মই হবে বুলেট বিদ্ধ,
স্বৈরিণী সময়ের গোঁজ ঢুকানো থাকবে খুলির ঠিক পেছনেই।
প্রসবমাত্র সুতীব্র চিৎকারে নেবে
আলোকিত বয়সী প্রাণ, গর্বিত ঐতিহ্য ঘ্রাণ
এবং স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা দিন,
এমনকি গর্ভের উত্তাপ থেকে বের হতেই
শরীর জমে যাবে অজানা হিমে,
মায়ের স্তনে থাকবে সূর্যের ঋণ।
তাই কথা দেওয়া মিছিল ফেলে
প্রতিটি সাম্ভব্য আঁতুড় ঘরের সামনে
বসিয়ে দিলাম সূর্য পাহারা।।
অ যা চি ত সং লা প (১-১২)
১.
তুমিতো আজ আপন ঘরে আছো অন্যস্বরে
চেনা স্বরের কেউকি তোমার ভেতরটাকে নাড়ে?
নিজের ভেতর নিজেই কেন খুঁজে ফেরো ঘর,
ঘরহীন ঘরে কেউ খেলছে অন্যস্বর।
২.
অসংখ্য মৃত্যুর ভেতর আমার ছায়া যেন
অসংখ্য জীবনের ভেতর তুমি,
কতোবারের মৃত্যুতে বৃষ্টি শেষের রংধনু
আবাদের ঘ্রাণে ফিরে আসে ভূমি?
৩.
যেখানেই হাত রাখি
তৃষ্ণার্ত নগরীর বন্ধ্যা জীবন,
বস্তি অথবা ফুটপাত
চিলেকোঠা অথবা সুরম্য ঘর
সবখানেই অনিবার্য সঙ্গম।
৪.
তোমার ঘুমচোখে আমি বিরক্তির কাম
আমার আত্মার ভেতর তুমি আহত স্পর্শ,
স্বপ্ন খুঁড়তেই দ্যাখো অচেনা এক মোহ
আমি জেগে চোখে নিয়ে রাত্রির ঘাম।
৫.
আমরা হেঁটে চলছি যুগের ভেতরে নিশ্চুপ
আমাদের পেছনে শত বর্ষায়ু আগুন্তক,
হঠাৎ তাদের চোখে দেখি জন্মের আদিমতা
চিৎকারে আজ কাঁপছে স্বদেশ, আমরাই শুধু শ্রোতা।
৬.
আমিতো আর প্লাবন চিনি না
যতোই বৃষ্টি হোক,
জীবন চলেছে মৃত্যুও দিকে
হারিয়ে ফেলেছি শোক।
৭.
এবার পরাজিত মানুষের আত্মকথনের সময় এসে গেছে
এবার জয় হবে আমার,
এবার সাদাকালো ফ্রেম থেকে বের হয়ে আসবে জ্যন্ত অভিজ্ঞতা
এবার দৃশ্যপটে রঙের বাহার।
৮.
আমিতো আর অনুমিত সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করতে পারিনা,
যতোই বলো সবকিছু আছে ঠিকঠাক- পরিপাটি সাজানো গোছানো।
তারপরও আমার বিশ্বস্থ মূহুর্তগুলো কৃত্রিম সৌন্দর্যকে ভয় পায়
বিরাণ হলেও ভেতরে শেষ মাড়াইয়ের চিহ্ন কিছুটাতো আছে
যা দিয়ে আগামী মৌসুমে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ঘরে তুলতে পারি।
৯.
আমি আলোতে থাকি আঁধার হয়ে নিশ্চুপ,
তোমার ঘরে সান্ধ্য-ধূপে সারিয়ে দেই মনের অসুখ।
তুমি কি আজ শুদ্ধচোখে রাঙিয়ে দেবে দিন?
বুকের কাছে জমা আছে দুঃখ-রাতের ঋণ।
১০.
এই ভাঁজেতে তুমুল উত্তেজনা
ঐ ভাঁজে শব’র বাড়ি,
এক পাশে সময়ের উত্তাপ
অন্য পাশে থামা ঘড়ি।
১১.
ভুল মন্ত্রণার ভদ্রবেশ ছেড়ে
এবার তোরা মানুষ হ!
কমিউনিজমের ভেতর থেকে
পুঁজিবাদের অস্ত্র চালা!
১২.
হে বঙ্গমাতা,
তোমার স্তন থেকে আরও কিছু বিশুদ্ধ রক্ত ঝরাও!
আর না হলে,
রাজাকারদের কোলে তুলে দুধের ঋণে দেশ বাঁচাও!
এবারের নৈবেদ্যঃ হৃদয়ের কথা
আশিক রেজা
আশিক রেজা,
আমার চোখ, আমার দৃষ্টিও,
হৃদয়, রক্ত, অশ্রুপ্লাবন.....
কি বুঝলা ?
হৃদপিন্ডের শল্য চিকিৎসা সম্ভব- বন্ধু আমার, হৃদয়ের নয়।
লিখতে পারো লক্ষ, কোটি শব্দ....
ভাষার ক্ষমতা নাই অনুভূতির অনুবাদ করে।
হৃদয়, রক্ত, অশ্রু.....
বেদনা, সোহাগ, আনন্দ থেকে
অভিধান খুঁজে বার করা সুন্দরতম শব্দ;
অভিমানে, ভালোবাসায় কাঁপতে থাকা নাসারন্ধ্র থেকে
শিষ কেটে বের হওয়া ভাষা বাদ দিলে অবশিষ্ট যা থাকে.......
জানো কি? হৃদয় তা ।
তুমি তা নিতে পারো না।
তালাশ তালুকদার
ন্যাড়া কাঠের টেবিল
কত ফুলই তো জন্ম নেয়, ছাদে বৃষ্টি পড়ে
শীতের সকালে জ্বলন্ত উনোন ঘিরে লোকেদের বসে থাকা-
সবাই কি জানে এই ন্যাড়া কাঠের টেবিল, যাকে ঘিরে
ঐ দ্রাবিঢ় বন স্বপ্ন বুনেছিল? এখন দেখুন তার পায়ে ঘূণ,
ধ্বংসবীজ পোঁতা, একটু ভরেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে।
অথচ তোমার জন্য চিলেমচি ভরা জল ছিল!
প্লেটে মেঘের পায়েস ছিল
-নিমেষের টানে দ্রাক্ষারসে মজে যেতে পারতে! কি পারতে না?
এখন ড্যামেজ হয়ে যাচ্ছ তুমি, যাচ্ছ হয়ে দূর্ঘটনা-
ভয়াবহ রেলবাঁক হয়ে ঢুকে যাচ্ছ তুমি খাঁচার কোনায়!
তুমি জানো না এখন বুকের ভেতরের লেটার বকস্
খালি পকেটে থাকে, জীবনীশক্তি ফিরে পেতে
জতুগৃহে আগুন লাগায়-যৎসামান্যে মন ভরে না
জ্বালানীর সবটুকু তার চাই, চাই।
এমন সময়ে বুঝ হে, তোমাকে জলের ফাটলে দেখা পেলে
মন ঘূর্ণমান জলে পাঁক খায়, কেমনতর কাশবনের শোকে
উতালা, -কাঁথায় সূঁচের মতন এফোঁড় ওফোঁড় তোলে-
কী উপায়ে তাকে রোধ করি বলো?
আমার বিকেলখানি কাটে এখন অসুস্থ চাচার হা-মুখ করে
লোকমুখ চাওয়া অসুখের মতো। যে সব সময়
ভবিষ্যৎ হারানোর উদ্বিগ্নতায় তটস্থ থাকে।
এ হৃদয় য়বিন্দুতে হাঁটছে ক্রমে-
রুবীনা, মনে রেখো নিভৃত অরজন্মাদের-
যাদের কলম হারানো অর খুঁজে ফিসফিস করে বলে দিয়েছিলো,
দোষারোপ লিখে রাখা ঠিক যেন গোলাপের চারা
আমার অজান্তে পরিবারের কেউ না কেউ তাতে জল ঢালবে রোজ!
চুইংগামের মতো সুকৌশলে নিন্দাতীর ছড়িয়ে দিয়ে বলবে
‘জীবন’ -সব ঝুট হ্যায়’ সব ঝুট হ্যায়!
-আমি জানি ব্যথার কথা নির্জনতা বুঝবে শুধু!
হঠাৎ আমার দিকে যদি ল্য করো-দেখবে মুখায়বে ব্রণদাগ, তচিহৃ-
ভনভন করে মাছি উড়ে থুতনির কালো আঁচিল চাইছে উড়ে দিতে!
-সংবাদ পেয়ে গণ মাধ্যমকর্মী শন্শন্ করে এগিয়ে আসবে
এবং হু হু করে পত্রিকার পাতায় ছাপিয়ে দিয়ে বলবে: কিসের টানে
মানুষ গলায় শখের বশে শাঁখের বালি রাখে? আমি তবু ঝুর ঝুর করে
মাটির মতো একেবারেই ভেঙ্গে পড়বো না!
তার সংস্রবে না যেয়ে বরং
কালো দুটি হাত উঁচু করে বলব: দেখুন, দেখুন ঐ
আগুনসাগড়ে সাঁতরাতে আমি আর ড্রেস পড়ছিনা!
এখন ভ্রুণের মতো মাটি ফুঁড়ে উর্দ্ধকাশে উড়বো
সীমাহীন ভয়, দ্বিধা সবকিছু পিছু ফেলে
মায়ের মতোন সাংসারিক হয়ে উঠবো আমি।
অথচ তানপুরার টান আমাকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রাখে
প্রতিদিন প্রতিসন্ধ্যায় এ অভ্যাসটুকু আমাকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে খায়
আর আমি লাফ দিয়ে সদ্য ঢাকা স্মৃতি উপর লাফিয়ে পড়ি
সে আমাকে চেনে, আমিও তার গলায় ঝুলিয়ে পড়ি
কী আপন সখ্যতায় তার সাথে আলাপন জমে উঠে
-ক্রমশ তার ভেতর টেনে নেয় প্রকৃতি।
আমি দীর্ঘদিন হলো মৃগনাভি হারিয়েছি। ঐ নিয়তিবোধে
কাঁচবৃষ্টি, লাউসাপ বারবার ফণা তোলে। বিশ্বাস কর -এই শরীর
দোমড়ানো রুটির মতোন বেঁকে গেছে!
মন ততোধিক ভুল স্মৃতি ঘিরে বেড়ে উঠে
জীবনব্যাপি ততোধিক পাগল প্ল্যান আমাকে জব্দ করে
আরো করেছে নাজুক। -খেলার সাথি ও খেলার সাথি
তোমাদের মতো আমারও আবির্ভূত জীবন ছিল। -হ্যাঁ হ্যাঁ
একই ছিল জীবন, দুটি সুতোয় বাঁধা-
ছিল পরস্পরের বিবেচনাবোধ-
টানা দুটি চোখও স্ফীতমান ছিলো
কিন্তু হায়,
আমার বিপন্নতায় এতটুকুও সহানুভূতি দেখালো না ক্রেতা।
বরং আমাকে দেখে শত শত প্রেম বৈষম্যের হাসি ফুটালো মুখে-
আমাকে ঘিরে শত শত কৌতুক রটে দিলো
হৃদয় ভরে গেল বিষন্ন সন্ধ্যায়-
এই জ্বালানী নিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছি
ইলাহি প্রচার করছি প্রতি মনে মনে।
আমি জানি, একটি জীবন নষ্ট করে সব জীবনেরে দাও আলো
ভুলে ভরা থাকগে জীবন তবু সব জীবনের হোক ভালো।
আমি নিরুপায় বলে গ্রন্থ রচনার দিকে মনোনিবেশ করি
কী সরল রহস্যময় আত্মা আমার- আকাশের ম্যাপ হাতে
মই বেয়ে উঠছি আকাশে। কিছুটা পরীক্ষামূলক-
যদি শ্যাওলায় পিছলে পড়ে দেহ!
তবু ডুবে যেতে যেতে বাস্তবিক নত্রের আলো
যদি দেখে যাই বলবো, সেদিনও আলোছায়াটানাময় দিন ছিল
কই, রোদ এসে এই পালকে জুড়ে বসেনিতো!
আমার দেবতা আমাকে দেখে হাসে আর কিছু ইস্তেহার ছুঁড়ে দেয়
তদারকি করতে দু একজন পাঠায়। তাদের বলি,
আহার যোগানো ছাড়া এই ডাকটিকিটে কি লিখে পাঠিয়েছে-
রুবীনা দেখে যাও দেখে যাও, তোমার পাঠানো প্রতিনিধির খবর
আমাকে ইতস্তুত রাখে, সারাণ ভয়ঙ্কর গল্প শুনিয়ে যায়।
রুবীনা, আমিও চিঠি লেখার কৌশল জেনে গেছি
যখন জেনে গেছি সেকি উচ্ছ্বাস, উদ্বেল
সেই কথা বলে দিতে আমার সারাণ ইচ্ছা করে।
আর আমারও হাসি পায়;
এই রাজনীতিজ্ঞের অতিবৃষ্টি
আমাকে প্রকৃতির দিকে আরো দৃষ্টি নিবন্ধ করে রাখে।
কৌতুহলে গোয়েন্দাদের চোখ মাড়িয়ে আরুঢ় হই
বাদাম খোসার উপর।
এক নিষিদ্ধ তামাসায় সওয়ার হয়েছি আজ
আমাদের ইহলৌকিকতা ছেড়ে
কোথাও না কোথাও যেতে চাইছো তুমি
প্রশ্ন করবো না, শুধু এই যুদ্ধত্রে ছেড়ে উঠে আসতে চেয়েছি
অন্তত একবার সহিঞ্চুতা নামে চিঠি বিলি হোক।
এইভাবে দুপুরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে
তোমার নুপূরখানির দিকে মনোস্থাপন করি
কিন্তু আকাশে চিড় ধরে, মেঘেরা গন্ডোগোল বুঝিয়ে দেয়
কারো কাছে ছেলেমানুষি হই, কারো কাছে এইসব
বিচার বিশ্লেষণ তোমার নয় বলে দুঃখগ্লানি তুচ্ছ করে
জীবনখানি ভীষণ ঠেকিয়ে দেয়। -মা চাই হে,
অতি উচ্চতাময় প্রেরণাকাঙ্খি পুরানো চাঁদ
তুমি সারারাত ঢেউয়ের মতন দুলেছ আর
চারুকলা পরীক্ষার্থীর খাতা ঘেঁটে ঘেঁটে যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছ
বারবার বিদ্যুৎচ্চমকে লাল বুলবুলির কথা পাল্লা দিয়ে
মৌসুমী ফলের মতো বারেবারে ফিরে এসেছ
সে সব এখন ভূবনছাড়ার দেশে ভেসে চলেছে।
এখন আমি অল্পই কথা বলি
যতদূর এই কৃতজ্ঞতাবোধ জমে না ওঠে
খলনায়ক আততায়ীর ছুরিতে জখম না হয় ততদূর
এই কুশলতাগুলো অতিকষ্টে চেপে রাখি -বাতাসে শুকাই!
অল্পই যাই মানুষের মাঝে
প্রথম দেখা যদি হয় রোদে আঁউরে যাওয়া পাতা!
গ্রীষ্ম-তাপ যদি গায়ে লাগে! উকুন ঝেড়ে ফেলতে যেয়ে
যদি অতি হীরের চিরুণী দিয়ে চুল উঠে আসে!
ঐ বিদ্যা শিখে সাপের পথচলার শব্দ কেউ টের পায় কি তখন?
আমি অনেক বেঁটে- বামন, রিক্সার চেন ছুঁতে অনেক বেগ পেতে হয়!
হাই-জাম্প দিতে যেয়ে গুগ্লি বলের মতো
দৈবক্রমে লাফিয়ে উঠতে পারি না!
অল্পই ভাবি, বাদামের খোসা ফেলে দিই।
মাটি থেকে কেল্লা সবুজ ঘাস উপ্ড়ে নিয়ে শস্যকে স্বস্তি দেই।
আর ছাগলের মতো গলায় দড়ি বেঁধে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে
জাবর কাটতে কাটতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
আসছে রেস ময়দানে সবাইকে তাক্ লাগিয়ে দিয়ে বলব
আমিই একমাত্র মৌয়াল যে বায়ুর আগে দৌড়ে
মধু সংগ্রহে আসতে পারি!
অল্পই লিখি, যতণ এই বিবেচনা পদ্ধতি
বিস্ময়করবোধে থেমে না যায় ততণ হাত-মুখ ধৌত করে
সামান্য-বা পরিস্কার করাতে চেষ্টা করি।
রুটি-পানীয় দ্রব্যাদি খাওয়াতে উঠে পড়ে লেগে যাই।
ফোমাশ্রিত বিছানায় নিদ্রাযাপনের কথা বলি, সেও রাজী হয়,
রাত বেড়ে গেলে গৃহবধূর মতো কথা শোনে!
অল্পই দেখি, দৈবক্রমে কোন গৃহিণী যেন
বটি হাতে সব্জির টাটকা শরীর দেখিয়ে দিয়ে বলতে না পারে
‘ঐ যে ঘাতক’ পরকীয়ায় নিজের জীবন বিসর্জনে উদ্যত হয়েছে।
কারণে অকারণে বুক ফেঁড়ে সারকার করে দিচ্ছে!
-আমি গোলাপ বৃহৎ ছাদের উপস্থিতিতে
গৃহের এককোণে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য প্রকাশে থাকি।
অল্পই দেখেছি, দু’মুঠো ভাত খেতে দিয়ে
যে আলগোছে দু’য়েকটি মশাকে হাতের তালুতে ধরিয়ে ফেলে।
আস্ত পায়ে পেরেক ঢুকিয়ে অমলেন্দুকে কি দেখেছ
একঝুড়ি বইয়ের স্তুপ মাথায় করে ফিরতে?
আমি বুঝি, জল ফুরোলেই কেবল গ্লাসের তৃষ্ণা পায়!
কেন যে পেটরোগা ছিলে, খেতে পারোনি!
-বাংলা ফিল্মের জামানায়িকার মতো
বাঁশবাগানের ভেতর অল্প একটু হেঁসেই বিদায় নিয়েছিলে!
সমস্ত ধ্বংসের শেষে কি থাকে আর সংহারের?
শুধু এক চূর্ণ সম্ভাষণ নিয়ে ঋতুর মতো বারবার ফিরে আসতে চাই
কিন্তু উজ্জ্বীবনপ্রান্ত আশ্চর্য শূন্যতা ঘিরে থাকে আমাকে।
মনে হয় পাঘাতগ্রস্ত আমি, সহজে মানুষের নাগাল পাই না।
যে জাত পাতে বড় হলে সে সবুজ পাতায় এখন
পিপীলিকার হাঁটাচলা। কবে কে হেসে সে পাতে বেড়েছিল ভাত?
আমার স্মৃতিরোদ সমস্ত নোনাজলে ভেসে যায়
আমার ভেতরে নিভৃত যত গান ক্যাসেটের দোকানে বেজে ওঠে
-ইশারাময়, শুধু নিঃশব্দে আঘাত পায় এ নিঃশব্দে কাতর হৃদয়।
আত্মশাসনমুক্ত এ হৃদয় শুধু রুবীনার বেণী দুলানো ফলো করেছে
নির্জন বালুতট, নিভৃত বটছায়ায় চোখ রেখে
সারাদিন হৃদয় করেছ পণ্য-
তাই পিপাসিত এখন তুমি, পিপাসায় হৃদয়কাতর-
একথা ভাবতেই এখন আমার রক্ত
মেঝেতে কেরোসিন তেলের মতো গড়িয়ে যায়
বিচ্ছিন্ন খড়ের মতো আগুন ধরাতে কাজে লেগে যাই।
আমি আরেক দিবসে জন্ম নিতে চাই, আরেক নগরে
যেখানে ক্যালকুলেটরে পরিদৃশ্যমান সময় সমান বন্টন হবে
কান্ত উড়ে আসা চাঁদ কিংবা পলাতকে থাকা জ্যোস্না
উভয়েই পাবে দূরুহ বার্তা।
এবার সাজাও ডানা। -পেয়েছ কি নির্দেশ?
হে আমার সরল রহস্যময় আত্মা
আমার অস্তিত্বকে কি ফিরে পেতে চাও?
পূর্ণবার শুনতে চাও কি তার আত্ম কেকারব!
অনেকদিন হলো গাবের পাতা নড়ছে না
মনে হচ্ছে দুঃখ ভারি হচ্ছে প্রত্যেকের।
-তোমাদের বোঝার দায় কে নেবে বলো??
এইখানে শুধু শিকারির আনাগোনা।
এইখানে শুধু ফুলের টব ঘিরে রোদেরা শোভাসিত হয়
পাশে অন্ধকার জামবন ঘিরে ঈগলের উড়াউড়ি
উভয়ের পায়ের ছাপ বুঝে দেয় চিত্রাত্মক মূহুর্তময়তা।
যা চেয়েছি আমি তা আজও চৈতন্যে থেকে গেল
জানি, মেঘলোকে সুখী লোকের বাস
ওখানে প্লাবন এসেছে, ‘ এবার চলো নামি...’
আমাদের চপ্পল্লাঘাতে বহুদিন হলো
বেদনায় কাতরাচ্ছে সিঁড়ি
আমরা মানুষ তবু মাড়িয়ে চলছি পথ।
এই দেশে সবাইকে মানায় না এই কথা
শক্ত কুঁড়ি বুঝেছিল কেবল বোঝেনি তার হাড়
আমি বসিয়ে রাখি জীবন বিষের সাধক হয়ে
সামনে পড়ে থাক সৎ সিংহাসন; ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে
টুকরো তলানিতে এসে ঠেকুক। জীবন বুঝুক
কেমন স্বেচ্ছাচারি সে- কারণে অকারণে মড়ক ধরায় শুধু।
ঐ আগুনে পোড়ার লোভ আমার এখনও গেলনা
হৃদয়পুর আমার কেটে গেল হেসেখেলে
চিকচিক বালির স্বপ্ন দেখতে দেখতে
সামনে এসে গেল সূর্যপাড়া;
এবার পুড়ুক মর্মরের ব্যথা-
গ্রীষ্ম তাপ এসে কিছুটা গায়ে লাগুক
-শুনলাম, সেই তাপে হুড়কো জ্বালিয়ে উঠেছে
আর স্বপ্নের স্টিমারগুলো ত্যক্ত মাছের কান্কোয় ভরে উঠেছে।
তারচে’ তুমি উদ্ধার করো পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ
উদ্ধার করো স্ত্রীলোকেদের জরায়ু! যেখানে সব
মানুষ একই অধিকারে পালিত হয়।
অথচ পৃথিবী তোমাকে বুঝিনা;
তাই হতচকিতের মতো হয়ে থাকি
বাতাস থামলে দূরে মশার উপদ্রুব টের পাই
’পরে ঢাক শুনে উঠে পড়ি!
কিন্তু ততোণে দূরত্ব হয়েছে ঢের
মধ্যবর্তী বিষন্নতা মনুমেন্ট হয়ে দেয়াল উঠেছে যেন-
আমি সংগ্রহ করছি মুচিপাড়ার নূন্যতম ঘোর অন্ধকার
যে আস্তানা দিয়ে রোজ লালুচাচা মদ্যপ সেজে পাড়ায় ঢুকতো
আর টই টই করে ডালহৌসির প্রলাপ নির্বিঘেœ বলে যেতো
শোভাসিত আলমারি তুইও কি চাস অমন শৌখিনতায় ডুবে যেতে?
অথবা তোর ভেতরে আরো কোমল স্রষ্টতা, শিশুর রক্তাভ খাদ
-কেন্দ্র, সেই কেন্দ্র ঘিরে অযুত বর্ষের সুপ্ত স্তব্দতা
তাকে নিরাপদ রাখার চেয়ে ঘনবিনুনি শূন্যতাই কি শ্রেয়?
মদ্যপের সোঁদাগন্ধে মঁজে থেকে কি লাভ?
ঝাউ পাতার ঝড় দেখেই যদি বলো
এ পৃথিবী পাতায় পাতায় ভরে গেছে
তবে থুতনিতে তিল রেখে কি লাভ?
কি লাভ তবে
জিহ্বা দিয়ে আলগোছে দুয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা ধরে রেখে?
এই অনাবশ্যক ভুল বিরহে ফোটেনা ফুল
এসরাজের সুর যখন নামলো দেশে তখন বৃষ্টি হল অনেক
গাছপালা বৃষ্টিতে কেবলই বৃষ্টিতে ভিজে র’ল।
দূর হতে শুনি সাগরেদদের সূরাপানের শব্দ
মন শুধু বলে, ছাড়ি ছাড়ি এই স্বাদের নৌকো!
-এখন অসীমের আলোয় নিজেকে প্লাবিত করি
বেঁচে আছি কিনা দাঁড়ি কামাতে গেলে টের পাই
ততণে বিদেশী কবিতার অনুবাদের মতো তিগ্রস্ত হয়েছি আমি!
কর্পুরের মতো আজ আস্থাহীন তুমি
উষ্ণ করতল না বুঝে বাহিরের টানে পা ফেলো!
পালক ঝরবে কিনা তার আগেই ঝরাও তোমার পতন-
তুমি দেহদ্রোহী কোনো?
অহেতুকই ফলের বুকে দিয়েছ কামড়
সু-সমাচার না জেনে লবণঝড়ে সূর্য দিয়েছ নিভে।
ছিলে একদিন শুধুই ছিলে জানাশোনার আগে
যখন এলো লিরিক তখন সকল ভালবাসাবাসি শেষ হল
-আলপিনে গেঁথে র’ল আতঙ্কজনক দ্বীপ!
হঠাৎ তোমার সঙ্গে লড়াই করতে করতে দীর্ঘমেয়াদি
অসুখ হলো আমার। যখন হলো তখন সব পড়ে র’ল
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল একমনে-
এবে একে ছলনাই বলো, অনধিক কিছু বলো না, না!
তোমার থেকে ফিরে এলে নিজেকে মেলাতে পারিনা আর
চূর্ণ হয়ে প্রকাশ্যে পেশির অনশন ভেঙ্গে একদিন
বিষাক্ত ছোবলে শ্যামাপোকাকে বিষন্ন করে দিই।
-আখ মাড়াইয়ের পাশেই কর্মরত ভূত দেখে বুঝি
এ জীবন বিষাক্ত বৈ ছাড়া কিছু নয়!
এখন আমার সংসারের উপর অনেক মেঘ, ঝড়
তারা কালো বজ্রধূলি হয়ে আতিথ্য গ্রহণ করে!
আমি স্বেচ্ছায় দ্রারিদ্রতার বরফে গলতে যাই
অনতিদূরের চাঁদ সেও সমর্থনের মতো সাড়া দেয়
-বেলা পড়ে আসে।
আমি মানুষের মতো অতটা সামাজিক নই। মই হাতে
রুবীনা এগিয়ে এলে তাকে গাছে তুলে দিই
-সে কঠিন হতে হতে করে প্রতারণা।
আমি তবু এই পৃথিবীতে টিকে যাওয়ার গল্প বলে যাবো
আমি তবু ভদ্রতার আরো দু’একটি দিক জানাবো।
তুমি আশ্চর্যজনকভাবে সামরিক অস্ত্রের মতোন
টেবিলে শুয়ে রয়েছ কি? আর মনে করছ জলের ফ্রেমে আটকানো
এ্যাকুরিয়ামটাই প্রকান্ড এক ঢাকা!
হয়তো পার্কের সিমেন্টের নীল ছাতাকেই
মনে করছ পাঁপড়- যাকে কুরমুড় করে খাইতে চাইছ তুমি।
আজ ভাবি, এসবই কূট -মানুষের মাঝে বিছিয়ে রয়েছে।
আমি জানি, তোমার মূত্রথলিতে
যত রক্তখাল ও কাঠের গুঁড়ো শোভা পায়
টিয়ার পালক দিয়ে হৃৎপিন্ডের শহর আচ্ছাদিত হয়-
নিজেকে নির্মিত করতে চাও যেভাবে সেভাবে নিজের ধূপকাঠি
ভস্ম করতে পারনা। -নির্বাসন দন্ডে কার যেন ভাস্কর্য গড়াতে যায়!
তুমি কি জানো, তোমার টেলিফোন ব্যস্ত থাকলে বুকের
ভেতর সাতশো মাইলের ঝড়
ঐ চত্বর দিয়ে বয়ে যায়, মনে হয় ন্যাড়া গাছ আমি-
সাতশো বছরে কোনও জল এ শেকড়ে পড়েনি!
-এখন উপেতিদের মনে পড়ছে খুব
মনে পড়ছে ঐ হীনমন্য গরীবের চোখ
যার সামনে শুধুই পরিশ্রুত রোদ ঝরে
অতকিছু জানাশোনা হয় তবু ঠাট্রাচ্ছলেও বলতে পারেনা
এসব ঘোলা জল,-পরিশ্রুত না হওয়ার আগেই
ট্যাবে ভরে উঠেছে। -আমার জামায় প্রলেতারিয়েতের গন্ধ;
-দোকানী মোটা দানার চিনি বিক্রয়েও ফুঁসে উঠতে পারিনা।
শুকনো পাতা ঝরে গেছে কবে
এবার ভিটে কামড়ে পড়ে থাক্
-হ্যাঁ, হ্যাঁ সম্বোধন মাথা ঠুকে ঠুকে।
কবে তোমার পাকস্থলীতে প্রজাপতির নাচন শুরু হবে?
কবে ইচ্ছেমতো নিজেকে বুঝিয়ে দিয়ে
একটুতেই হিংসুটে হয়ে ঊঠবে তুমি
পুচকে ধনুক টানা অভিনিবেশে মাছরাঙাকে ল্য করে
কবে ঘটাবে শান্ত রক্তপাত?
ঐ আদর্শবাদীদেরই-বা খৎনা করাবে কবে?
আজ ভাবি, পদ্ম টানে জল। -আমায় টানে কে?
-আমি ধীবর বলেই নির্বিচারে পোড়ে দেহ।
-টুকরো নিপে এর মতো দূরে ঢিঁল হয়ে
আছ্রিয়ে পড়ি ঘাসফুলের পায়ের কাছে।
তবু কোনো বিদেশী ফলের কাছে গন্ধ চাইবো না আজ
রাগী, ঠগবাজ আর মদ্যপের কাছে ফিরতে চাইবো শুধু
কী করে তোমার আমার বাক্যুদ্ধ হয়- হয় খুনসুটি;
হৃৎকমলের আতিথ্যে বধির কানের ভেঙ্গে ফেলে খিল
গন্ডুষের মতো জল স্থির হয়। বাকী কিছু ফল খুঁটে খুঁটে
পিপীলিকা টেনে নিয়ে যায় খানাখন্দে ফেলে দিতে-
সেই পারুলের রুপ আমার মৌসুমি ফুলে উঠছে ছট্ফটিয়ে!
-দূরে ভোজনক্যান্টিন দেখলেই জিভ লক্লকিয়ে ওঠে কি তোমার
ডেক্চির ভেতর তেল আর মাংসের খন্ডযুদ্ধ দেখো-
যেনো বিঁধে থাকে চোখ; রান্না শেষে পরস্পরকে লেহন করে
এসো তবে এই মন ঐ অনন্তে বাঁধি, কিছু বুঝমান হই-
দেখে যাই কেন মানুষ উড্ডিন নয় সাংখ্য প্রকৃতির কাছাকাছি।
তুমি চাইলেই আমি ঐ ইলেক্ট্রিকের তারে লটকে যাওয়া
জেদি পলিব্যাগ হয়ে যাই।
কখনোবা কলার খোসা পা পিছলে অন্য পাড়ায় চলে যাই
ঝুন্ঝুনিমতো শিশুদের হাতে শোভা পাই খেলনা সামগ্রী হয়ে
যতবার এক হাতে সামলে রাখতে যাই নিজেকে; পাপোষদানী
ততবার জলে ভেজে -আমারও লৌকিকতা শুরু হয়।
আমরা তো হবো পিনে আটকানো কাগজপত্র কিংবা
কাগজের নৌকা। আমরা হবো র্যাংকীন স্ট্রিটের ভাড়াটে বাড়ির গহনা
রেগুলার যেখানে পাপোষে পা মুছে একই স্বপ্নে সশব্দে ভেতরে ঢুৃকবো।
তুমি ব্যান্ডেজের তুলোর মতোন আমার হাতে লেপ্টে থাকবে আর
সমস্ত সমর্পনে বলবে, এ্যাঁই দেখো ছিড়েছি গুল্মজাল
এবার কাঠের কেবিনে পেরেক ঠুকলে তুমি ঠুকো।
আজকাল তুমি আমাকে যখন খুশি তখনই চাও
আমি কি তোমার উদোম বাঘিনী?
-তুমি জিজ্ঞেস করো ঐ ঝিরিঝিরি পাতাদের
তারা কেন ম¯িত্তস্কের জন্য এত বেশি আরামদায়ক!
অথবা বিরহ ভাগাভাগি করে জ্বলতে শেখা, জ্বলুক
চোখটা- যে চোখে পথ আঁকা। চরম না পাওয়া জুড়ে জুড়ে
যক্ষ্মাসুখ নামে অতর্কিতে- স্তম্বিৎ হোক স্তব্দতা!
তবু তুমি ভূলে যেয়োনাকো আমাদের বারান্দার কাছে
রোজ রাতে খড়কু্েটার কাছে চুপি চুপি চাঁদ এসে শুয়ে পড়ে
ভুলে যেয়োনাকো কঠিন অসুখেও জল পেটের ভাষা বোঝে।
আমি হতে চাই দ্রাক্ষাদি ফলের অন্তর্বর্তী শর্করা
অতিবৈতনিক স্কুলছাত্র, জনময় ভিটার আলপথ বেয়ে
জঙ্গলের ধার দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো
যে রেগুলার সশব্দে গন্তব্যে পৌঁছে
লেখাপড়া বুঝে নিতে চায়
-পেন্সিল, রুলে অতিকায় হিমহাওয়ার ছবি আঁকে!
কিন্তু ফিকে হয়ে গেছ তুমি
ফিকে হয়ে গেছ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বেদনায়
তুমি কি গাইতে পারবে বাংলার উত্তরাধুনিক গান?
-উড়ে আসে সন্ত্রাসভীতি
বনের ভিতর নিঃসঙ্গ পাখি একেলা উড়ে যায়!
সাক্ষাৎকার
ঐ টাট্রুঘোড়ারা এমনই সৃষ্টিছাড়া
শ্লেটে রসাত্মক বাক্য লেখে-অবসরে
হাবিলদারের মত অনাত্মীয় গন্ধ
পেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে বেড়ায়!
তবুও কেমন সুখী ওরা -বেডরুমে
কাঁচা কাপড় সরিয়ে ষ্পষ্ট জবাফুল;
পাকা পেঁপের মতন দু’পায়ের ফাঁকে
ভর করে থাকে। -যেন অনায়াস ঝর্না;
নিম্নমুখী হলেই ও নেচে ওঠে- জল
বাঁকা হয়ে ঝুঁকে পড়ে জলের ভিতর
-যাই, চুষ্মান দেখি ঐ আত্মার মাঝে
কার ভুরু কাঁপে, কাকেই বা উহ্যে রাখে
-ফ্রেন্ড, খবরাখবর, পূর্বাপর ন্যায়
চোখরাঙানী কি এই বয়সেও চলে!
যে আতাফলের জন্য এত লোভ তোমার
যে আতাফলের জন্য এত লোভ তোমার; কৃত্তিকা
দোসর হয়ে চর্বিতে হাত রাখো, পশমের আলো
গন্ডোলা উজ্জ্বল করে দূর বুকে নারীঝড় বয়
ধৃত শরীর জালে আটকে গেলে কেউই চেনেনা
-মাংসখন্ড কার? শুধু লঘু আয়নায় ঝগড়াটে
মুখ ফাটা গেলাসের মতো চিত্র এঁকে যায়। -স্বপ্ন
যাকে তোমরা ঐ নত্র ছোঁয়ার জেটিকল বলো
সেকি এই বাকরুদ্ধ আগুনের জিভে শোভা পায়?
অনর্থক শেরপুর থেকে চিঠি এলেও বলবে কি
চুপ কর চুপ কর হে এখন আমার ব্রান্ড
দেখার সময়। -এসো, টাট্রুঘোড়াদের ভুলে যাই।
-সাপের শিশ্ন কি যৌনক্রোধে অনাথ হয় কখনো?
এই সহজাত তৃঞ্চা ময়ূর পেখম পেয়েছিল
সেই থেকে সঙ্গ, -খাও খাও বলে অনেক বলেছে!
ফল
তুমি নিমপাতার লুকানো ভাঁজে ডোবো
খুচরো জ্যোৎসনা দিয়ে মহল বানাও!
আমি হারানো অর খুঁজে দোল দিতে
গেলে ব্রত ভেঙ্গে যায়- মন হয় সাঁকো!
ঐ জাংলার মাচানের মতো হেলে পড়ি
তোমার সামনে, তবু তুমি রাজি হয়ো।
-তুমি পানের পিকের মতো ঐ উচ্ছ্বিষ্ট
ভেবে দেয়ালে ছুঁড়ো না থুতু! -চলো যাই
নিষিদ্ধ ফলের অবকাশে। -লঘু শব্দে
ত্বক, মুখ -মধু মিছ্রিতে ডুবে থাক!
টা টা দিয়ে চলে যেওনা তুমি। -কিছুক্ষণ
বসো, তোমার মাংসের ভাপ চক্রাকারে
ঘুরে খাদ্যবস্তুর কুসুমঘ্রাণ বুঝে
পাক। -ঐ জেলঘরের কাঠামো বাড়ুক।
তথ্য
তুমি হঠাৎ করেই ওই বাঁদরের মতো দোকানীর কাছে কূট-সয়াবিন তেলে ভাঁজা মচমচে রকমারী চানাচূড় চেয়ে বসেছিল-তোমার বিবেচনার অভাবেই এ গ্রন্থখানা তোমার বইয়ের তাক্-এ দপ্তরির চাকরি নিয়েছে, এই কি সেই মগ যে ডাঙ্গা ক্ষেতে পোকা মাকড়দের সাবধান করে বলেছিলঃ সট্কে পড়ো, সট্কে পড়ো ঐ লোক মেশিন হাতে তোমাদের দমন করতে এসেছে, -ফার্ণিচারের গোপন কাজ শিখে নিতে রাজুমিস্ত্রিও প্রথমে খুবই ছোট, মূর্খ ও বামনদের সঙ্গে হেঁটেছিল- এখন তার সৃষ্ট’তে পানের বাটাখানিও হাসে- ঐ ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে তোমাকে দেখা যায় যতখানি তুমি দেখাও সম্পূর্ণ উজার না হয়ে- এখানে এমনি এমনি বসে থেকে কি লাভ তার চেয়ে চলো লাইব্রেরীতে বসে (শূন্যদশকের) হাস্যকর কিছু লেখা পড়ে আসি, গে- জলচৌকি কি বোঝে তার উপর বসে বসে পৃথিবীর কত ভাঁড় হাসি-ঠাট্রা, খোশগল্পে -নিরর জ্ঞান করে, ড্রইং টিচারকে ডেকে এনে কি লাভ তার চে’ ও যা অঙ্কন করেছে তা বাস্তবে গোটানো ছাতার চেয়েও ভাল, দৃশ্য -টিভির সংবাদে বোঝা গেল দূর আকাশের চেঁচামেচি, হট্রগোল উপস্থাপিকা বললঃ এইমাত্র বিরোধীদল স্ট্রাইক করে সড়ক পথে অবস্থান নিয়েছে, হুজুর দেশে দেশে এত যে হাঙ্গামা, আন্দোলন (সর্বহারা-জঙ্গিমতো) হয় তার জন্য একটা হিল্লে করে দিন তো, ধন্যবাদ কেন শুধু উঁচু ফ্ল্যাটের সজ্জন; শুদ্রদেরই কন্ঠে মানায়, কেন রাঁধুনি নির্ভর থাকে পুরুষ- মদে প্রীত না হলে কবিতা লেখার দূরত্ব বাড়ে- ভাবছি, বাইজিদের সঙ্গে আজ নাচা উচিৎ হবে কি? -বছর দশেক আগে ওদের সঙ্গে নাচ করে করেই তো অতো তারার নিচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরতাম বাড়ি- গেল রাতে শালা হারামি‘র দেখা না পেয়ে ঐ পাল্কি থেকেই নবাস্কৃত ধাত্রী দেখলঃ মাতৃসদন -তারে টাঙানো ভেজা কাপড়; রোদের সাথে সখ্যতা গড়াতে আষ্টেপৃষ্টে বিঁধে আছে, তারও আশা বহুদিনের ‘এই লেখাগুলোর আমুদে চেহারা’ এ জাতীয় তারিফ শুনতে-অভিভূত হতে কার না ভাল লাগে!
বলাৎকার
তোমার নাম রেবা ছিল! ছিল না? এক বিশেষ কারণে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিলে। পায়ের নিচে ছিল গালিচা, - উর্দ্ধগমন করতে তর্ক-বিতর্কের কাঁটা চামচের উর্দ্ধে থেকে চালিয়ে দিয়েছিলে নিজেকে! তৎপর যেমত বিষ -রক্ত কলুষিত করতে উঠে পড়ে লাগে! কালের মুচকি হাসি ও কটাপাত স্থানু অচলতার মধ্যে প্রোথিত করে কমলালেবুর মতো রসালো হলে, ফুটন্ত কড়াইয়ে আকাশটা ওমলেটের মতো উল্টালে আর রাজহংসী নিজের ডিমটাকে সাদা ডানার নিচে তাঁ দিতে দিতে দেখল, পুলিশের কালো জিপ অলিগলির মধ্যে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে, আর তোমার চোখের জলে চলাচল করলো জাহাজ, শহরতলি গয়নাভরা বৌ-য়ের মতো সে’জে গেল।
মাহ্ফুজ রিপন-এর কবিতা
অস্তিত্বের খোঁজে
প্রাগৈতিহাসিক অস্তিত্বের খোঁজে ছুটে যাই গন্ধমের বনে। সাড়ে পাঁচশত কোটি আদম-হাওয়া গড়ে চলেছে এই চম্পক নগর। সাধের গতরে এখন উত্তর হাওয়ার আগুন। খর্ব হয়ে গেছে আজ বিবেক, বুদ্ধি, মানবতা। উচ্ছেদের কষ্টে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা আমি। অস্তিত্বের বাস্তভিটা আজ নষ্টদের দখলে। খণ্ডিত শস্যভূমির মত- অনুর্বর মাটি, নষ্ট পাথার, নষ্ট বীজ অস্তিত্বের বরেন্দ্রভূমি॥
আঁধার জলে ডুবে
ভীষণ উষ্ণ বুকে এ পথ চলা। কালি ও কলমের মিলন হলো না কষ্মিন কালেও। তবু সৃষ্টি হলো গীতাঞ্জলি, সনেট, মহাকাব্য। ওপারে যাবার সুর বার-বার বেজে ওঠে। অবশিষ্ট পঁচানব্বই স্মৃতির ডানা মেলে! খেয়াপারের তরী হারিয়ে ফেরে ঘাট। অনিশ্চিত গন্তব্য কোথায় ভবের হাট। সব আলো নিভে যায়। শব্দ নিঃশব্দের রং ছড়ায়। পৃথিবী তখন গভীর তন্দ্রায়। আঁধার জলে ডুবে জেগে থাকি আমি তুমি আর সে॥
রবিরাগ
এক বুক উজান ঠেলে ছুঁতে চাই আলোকচ্ছটা! অথৈ পরান আমার খুঁজে ফেরে লাল-নীল-বেগুনী। সোনাভানের পুঁথির আসরে পিদিম হাতে বঙ্গজননী। জোনাক ঝারবাতিগুলো সন্ধ্যে জ্বালিয়ে যায় গ্রাম, গঞ্জ, অবরুদ্ধ লোকালয়। গৃহিণী এক বুক তপ্ত বুকে পোড়াতে চায় শাড়ির আঁচল। মহাকালের বৈতরণী রবিরাগ পোঁছে যায় সাগর সঙ্গম॥
বেহুলার ভাসান
দূরের বাতি ঘর, কামরাঙা মেঘবতী আকাশ। ভাগীরথী ভাসিয়ে ফেরে বেহুলার ভাসান। সমীরণ যাকে ছুঁয়ে যায় সে প্রকৃতির সন্তান। দৃশ্যলোকে একাল-সেকাল-পুরাকাল! সিগ্ধতায় স্নান সেরে ঘরে ফেরে আদম। গান্ধারী বিলাস হয়ে প্রতীক্ষায় আদি পবন॥
কেন্দ্র
মানুষ-ঈশ্বর, শরীর-আত্মা, অন্ধকার-আলো মিলে মিশে একাকার। তবু যেন অমিলের বারতা। একালব্যের মতো সাধনায় রত হই। মানুষ- ঈশ্বর, শরীর-আত্মা, কেন্দ্র নির্ণয়ে মন সাধাই। অসীম কোথায়? দৃশ্যে-কল্পনায় না দৃশ্যলোকে। ষষ্ঠ ইন্দ্রের জলসা ঘরে কেন্দ্র নির্ণয়ের পসরা সাজে।
আন্ধার মানিক
অন্ধকারে আন্ধার মানিক জ্বলে। শৈল কোঁপার কুঁড়ে ঘরে সান্ধ্য পিদিম নেভে। কৃষ্ণতলায় সংগপ্রেমী ভৈরবী রাগ তোলে, আজ চন্দ্র তিথির প্রথম যামিনী যে- রত্রি যে আজ নব বধূ সাজে- লাজুক লতা লাজে। পদ্মবিলের কাজল ধোয়া জলে- ডুব দিয়ে সে সাবিত্রী সাজ সাজে। নিশার ঘরে কুমার নদী পদ্ম জলে ভাঙ্গে। সাঁইজি আমার আন্ধার ধামে দৃশ্যলোকে আসে। পরান আমার বাউল বেশে তারই সুরে ভাসে ॥
শেষ কৃত্য
পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে যাই অজানা গন্তব্যে। খুঁজে যাই অমরত্বের বীজমন্ত্র। রংধনুর সাত রঙে গতর রাঙিয়ে হতে চাই প্রকৃতির সন্তান। আমি ছাড়তে চাইনা হে ধাম! মাটির গন্ধ মুছতে পারে না বিদেশী পারফিউম। মৃত্যু চিন্তায় আমি বার বার মরি আবার জন্মাই। কখনো বৃক্ষ হই, কখনো বৃতল॥
বহিমিয়ন
বাউলের একতারায় মন ভাসাই। দুধের নদী সাঁতার কাটি; আমি চপল প্রাণ মৌমাছি, দৃশ্যকাব্যে পাহাড়-ঝর্ণা-রাজপথ-ক্ষীরের নদী। ভুলে যাই জন্ম-মৃত্যু-পরকাল! অসাড় দেহ লয় বোঝে না। ঢিমা-মধ্যমা-দ্রুতর ব্যবধান খোঁজেনা। বৈতালিকে ঘুরে বেড়াই সকাল-দুপুর-রাত্রি নাই। সারা ধামে পায়ের ছাপ। খুঁজে ফেরে ইন্দ্রজিত মন আসমান-জমিন মিলন বিন্দু.......!
ঘরে ফেরা
শেকড়ের টানে ফিরে যাই মূলে নষ্ট্রালজিক হই আলো-আঁধারে। মেঠপথ, শ্যামল ছায়া, সবুজ ধানতে স্মৃতিরা লুটিপুটি খায় ফিরে আসে স্বদেশ। পরবাসি জীবন মানে না বাঁধন বিহঙ্গ হয়ে ডানা মেলে অবুঝমন। কত শত দিন কেটে গেছে- কুমারের জল-কাদা গায়ে মেখে, ভেলায় চড়ে। বিয়োগ ব্যথায় হারিয়ে যাই সোনালি দিনে। রাখাল পোড়া, নৌকাবাইচ,ঐল্ডুব, গোল্লাছুট- খেলেছি, দিন-মাস-বছর। কখনো বা পুঁথিপাঠ, গাজির গান, মুরশিদি- লোক গান মাড়িয়েছি যাত্রা আসর। স্মৃতির চাদর গায়ে মন আজ হারিয়েছে চেনা পথে। শরীর শুধু পড়ে থাকে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ে॥
প্রকৃতির টানে!
সবুজ নিথর এ প্রকৃতি যেন আরোগ্যনিকেতন! দৃষ্টি মেলি ধরণিতে-জীবন নৌকায় মাঝি হয়ে। কৃষ্ণ চুড়ায় আগুন লাগা গাছের নিচে। চারপাশে সারি-সারি মেহগনি, সবুজ দুর্বা ঘাস। কদমের ছায়ায় কান্ত কৃষক। পুকুরের শান্ত কাজল নীরে খেলা করে মাছ-মাছরাঙা-রাজহাস-ফড়িং কচি কিশোর, কিশোরিরা রান্না-বাটি খেলায় মশগুল। কখন আসবে কিষাণ গৃহিণী বসে আসে উদাস দাওয়ায়! যেন অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র প্রকৃতি আর মানবের। এ মন শুধু ভাবে ছাড়াতে হবে-হে ধাম! আবার আসব কি ফিরে গন্ধমের মোহে বাংলার মেঠপথ! শ্যামল ছায়া, হিজল তমালে॥
অস্তালয়
হতাশা-দুঃখ-ক্ষোভে দহন মিলে- ইলুয়েশন ব্যর্থতা- কষ্ট- কান্না, অতপর হাসি-এলিয়েনেশন। সপ্তস্বরে বাঁধা এ ব্যর্থ জীবন। স্কেল নির্ণয়েও মেলে না জীবনের মডিলেশন। সত্তা চায় সম্ভোগ, প্রকৃতি দেয় বিপ্রলব্দ নব রসের প্রভাবে অস্থায়ী ভাক্ষ মানব জীবন। আঙ্গিক বাচিক সাত্তিক ভবরঙ্গের নাট্যালয় আহার্যের পূর্ণতা সৃষ্টি-স্রোষ্টার শিল্পালয়। দর্শন ধারণ লালন শিল্পের মৌল উপায়, প্রয়োগের মধ্য দিয়ে মূল শিয়ানার পরিচয়। ছন্দ-তাল লয় সুরের মিলনে জীবনের সূর্যদ্বয়, বৈতালিকে ঘুরে ফিরে পুনরায় সেই অস্তালয়।
চারবাক
পথের মাঝে পথ হারিয়ে পা বাড়াই আগামীর পথে। চারবাক পাড় হয়ে অপ্সরার দেখায় পুরুষ আমি কবিত হয়ে উঠি। আদিরস পান করে সুখের নিদ্রা হই। বিয়ান বেলা ঘুম ভেঙে ঈশ্বর হয়ে জাগি। দড়ি ধরে টান মেরে ভাঙতে চাই সাম্প্রদায়িকতা আঞ্চলিকতা। চিত্ত পটে মানব প্রেমের ক্যানভাস এঁকে যাই। গন্তব্যহীন মুসাফির আমি শব্দের খোঁজে নিঃশব্দ হয়ে শূন্যে ভেসে বেড়াই
সেইফি ভুঁইয়া
অক্লান্ত
মেঘের ডানায় ভর করে মেঘ-বালিকা এলে
নরম দুটি ডানায় করে নিলে বুকে তুলে!
এমনি করে কাছে থেকো দিও আমায় ডাক
চোখের মাঝে ডুব সাতারে কাটাবো দিবা-রাত।
তোমার হাসি শুনি আমি,মুগ্ধ চোখে দেখি
তোমার চোখে স্বপ্ন দেখি,সেথায় বাঁচতে শিখি!
ভুলেও যদি কষ্ট পাও,আঘাত দিয়ে ফেলি
একলা ফেলে অভিমানে যেওনা আবার চলি।
কষ্ট ভুলে হৃদয় খুলে আবার দিও ডাক
মান অভিমান সকল কিছু যাক ধূলোয় মিশে যাক!
চৌম্বকীয়
তোমার ভালবাসার উত্তাপ
আমার বুকে সুখের ক্ষত
আমার হৃদয়ের অনন্ত গহীনে সেই উত্তাপ ছড়াচ্ছে ক্রমাগত।
তুমি এখন আর অচেনা স্বপ্ন নও
এখন তোমার বসবাস আমার গভীরে।
হে সতর্ক সুখ পাখি!
আমার ভাবনার রাজ্য!!
নরম আর ভংগুর হৃদয়ে
জ্বেলেছ আলো দিয়েছ সকল প্রেরনা
আমার মৃত্যু চিন্তা,যাতনা সব বদলে দিচ্ছ।
আমি এখন অশান্ত গহীন সমুদ্রের তীর খুঁজে পেয়েছি।
সব কিছু ভাগা ভাগি করে নেবো বলে
আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমার দুয়ারে।
তোমার চৌম্বকীয় আকর্ষন আমায় গ্রাস করুক
আজ এটাই চাই
আজ শুধু তোমায় চাই
তোমাকে-ই-চাই।
আকাঙ্খার এক রাতে
রঞ্জনা বিশ্বাস
অনেক আকাঙ্খার কোনও এক রাতে
চাঁদের কঙ্কাল ভেসে উঠে
পুনরায় ডুবে গেলে
মেঘেদের ভীড়ে দেখেছিলাম তাকে
ভীরু এক চড়ুইয়ের মতো
ঝড়ের আঘাতে
ডানাদুটি মেলে পড়ে আছে মাটির ওপর।
বুঝি তুমি তুলে নিলেই
দু'হাতে অফুরান আকাশ
সূর্যের সোনারঙ আমাদের গায়।
সময় শেষ হলে
জীবন এবং সময়ের স্বাদ পায় কেউ?
মানুষ বলেই সে
পাখি হয়
পাপী হয়
ভালবাসা ঢেলে দিলেই হয়ে যায়
মহান আকাশ।
তাহমিদুর রহমান এর কবিতা
নির্বর্তন
বললেই হল
কানটাই মল
নাঁকি “উঁ” কথা বল
চোখে “নঁ” জমকালো
সেই দেখে “কু” থেমে গেল
ধী তবু খেলা ছেড়ে দিল;
তবে তা হোক, আজকে দূরদর্শন
বেদিতব্য তবে কেন কালপেণ?
বখাটে
কলিকাল, এসেছে দোরগোড়ায়
হাতের কাছেই ওরা, আমাদের পাড়ায়
চোখ নয় যেন এক্সরে মেশিন
ভাষা তাদের অশ্লীল বীণ।
“ন”
ভাবছ, তোমার জিব কেটে নিব-
না, তোমার উপর পাটির ছয়টা দাঁত তুলে নিব-
যেন “ন” উচ্চারন করতে না পার-।
উপন্যাসের মধ্যবর্তী সময়ে
এই এবার কলম থুয়ে বিরতি নিলাম
তোরা আমাকে একটা কফিন এনে দে
ওটাই আমার নাগরদোলা;
নয়ত সদ্য হওয়া নারীর শরীর এনে দে
যে আমার যৌনস্থলে দিবে মালা
বীর্য উৎগীরণ, আমার জীবনীশক্তির চালা,
শুরু হবে এবার কামনৃত্যের খেলা।।
বেজন্মা
প্রথম দেখেই ওদের শরীরে “থুতু” ছিটিয়েছিলাম
ঠিক পরেরবার “থুতু” চাটিয়েছিলাম
তবু আজও তাদের লজ্জা হল না
আজকাল জনসম্মুখে ন্যাংটো হয়ে পড়ে
“পিশাব” করে ট্রাফিক পুলিশ ছাউনিতে;
টুপিটা লালসবুজ বলে “চিল্লিয়ে” বেড়ায়
সাথে তারা কিছু “লেজুড়ে” ঠিকই পেয়ে যায়।
নিলাম দিবস
দাঁড়িপাল্লাটা নিয়ে আয়
বিক্রি করব মহাদেশ
সাথে দোঁপায়া গুলোকেও
আজ নিলাম দিবস।
পড়শি
দূর থেকে ফুলগুলো বেহেশত মনে হয়
তেতো স্বাদ কাছে গেলেই
তবু সে গেছে সেখানে
অনেক আগেই রাজি করিয়েছে বেহুলাকে
আজ ওদের বিয়ে।
ক্ষ্যাপা
কা কা করে ডাকছে কাকগুলো,
জীবনরূপ কি চোখে পড়ে?
মানুষটাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে কে যেন,
মুখের কোনা দিয়ে লালা ঝরছে আর
নগ্ন হয়ে ঝুলে আছে নির্জীব অণ্ডকোষ।
সার্বজনীনতা
শুনো, আমায় ভেবো না ভুল,
এইযে, এইতো আমি আছি,
হ্যাঁ, অন্যখানেও তাই,
সার্বজনীনতা মেনে চলে
আমি যে আজ সার্বজনীন।
দূরদৃষ্ট
দুচোখে আগুন জ্বলছে যখন
তখন নিজ ইচ্ছায় অন্ধ হয়ে গেলাম
আমার দিন গুলো কাটে এখন অন্ধকারে,
ভাবছি কানগুলোকেও অবশ করে দিতে হবে;
আজকাল দেবতা যে মনের মধ্যে নেই,
শয়তান, করুনার আশ্রয়ে বর্তমান সময়।
জনাপবাদ
সময় চলে যায় তবু বয়স বাড়ে না
মাঝে কিছু সম্পর্কের বেড়াজালের তিক্ততা
দাঁড় করিয়ে দেয় দুই নৌকোর মাঝে
বিশাল সে নদী, বিষাদ সে নদী।
কবির মৃত্যুতে
সেই কবি, চেতনা মুক্তিযুদ্ধ,
বজ্রমুষ্ঠি, প্রতিটি লাইন ধ্বনি
৭১ যুদ্ধে যাবে বলে হাজারটা আহাজারি;
তারপর মহাখালী কেন্দ্র করে ব্যস্ত রাস্তায় ছুটে চলা,
কাগজের ঠোঙ্গায় করে অনুভূতি ফেলে দেওয়া;
সেই কবির মৃত্যুতে,
ধিক কবি, ধিক সেই কবি।
উচ্ছিষ্ট
আমাদের পঞ্চনদে আসর বসেছে
মেলার পূর্ব প্রস্তুতিতে পূর্ব মদ্দচ্ছোপ
ঘুরে ঘুরে লুটিয়ে উলঙ্গ যাত্রীকূল;
তার মাঝে-
একটি নারীর জন্যেই আমি এসেছিলাম
যার বুকে এখন আপরিচিত দাঁতের দাগ
আমাকে তবে উচ্ছিষ্টই খেতে হবে
কুমারী নারীর স্বাদ অন্য কোন একদিন
আমাকে আজ উচ্ছিষ্টই খেতে হবে।
ক্রন্দসী
আমাদের খাবারে কোন শব্দ নেই
আমাদের নির্ভুল সাক্ষ্যে পিতৃপালক নেই
আমাদের মন্দিরের মত গর্ভবতী নেই
আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে কোন দেবতা নেই
আমাদের স্থায়ী বাঁধাধরা শয্যাসঙ্গী নেই
আমাদের মদের পাত্রে কামুক ঝর্না আছে
সেখানে ঋতুস্রাবের পরেই সুপ্রসবীর প্রস্রবণ দেখা যায়।
আমি এসেছি শুধু ঘাড়টি দিব বলে
জানি ওরা যাবে, চলে যাবে,
আমাকে যে একাই থাকতে হবে-
পালকির নিচে ঘাড়টি দিব বলে;
আমি যে অমর-
আমি এসেছি শুধু ঘাড়টি দিব বলে।।
নদী
দুইকূল মিলে তার সৃষ্টি
যতদূর চোখ যায় দৃষ্টি
চারদিকে জল আর জল
পবন গায়েন করতল
যুগে যুগে পুষ্পিত প্রবাহ জলরাশি
সমুদ্র বিপুলা সেতো তোমারই মাসি।
ভিক্ষুক
স্পর্শ পেতেই ছিটপিটিয়ে ওঠে শরীরটা
ঘিনঘিনে কোন পদার্থ লেগে গেছে যেন;
বারবার ঝেড়ে ফেলেও স্বস্তি হয় না
শালা ছোটলোকের জাত, শেষ পর্যন্ত ছুয়েই দিলি।
পাশে দাঁড়িয়েই আমি লোকটির কথা শুনি
আর দেখি সেই ভিক্ষুকটি তবুও ভিক্ষা চেয়েই চলেছে।
ধ্বস্ত
যখন তুমি প্রতিদিন রাতের পসরা সাজাতে শিখলে,
আমি তখন দক্ষিণি জৈবিক অনুভূতি সাজালাম;
তারপর একঘেয়েমিতে, তোমাকে এঁটো মনে হল একদিন
এবং আমি আবার নতুন জৈবিকের সন্ধানে,
নিজেই রাতের পসরা সাজিয়ে বসলাম;
আমার লালসার নারীরা আজ আমাকেই ভোগ করে।
দুকূল
ক্রমান্বয়ে দূরত্ব বেড়ে চলে দুকূলর মাঝে
কিংবা এক কূলের উপর আরেক কূলের হিংস্র থাবা এসে পড়ে
ভাগ হয়ে পড়ে জাতিসত্ত্বা, ভাষা আর সংস্কৃতির
আর তখনই -
যুদ্ধকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে হয় মানব জীবন ভুলণ্ঠিত।
দুখু সুমন এর দ্বিপদী
১।
অবক্ষয়ের অন্ধকূপে হারাই দিশা নিজের কোপে !
মন-মহাজন বন্দি থাক এই খোলসের মন্দ-খোপে !!
২।
মেঘাবৃত-মেঘাত্যয় কত ঋতু গত হয়
নিষ্প্রদীপ অন্ধরাতি সবলে জাগিয়া রয় !
৩।
কাছে এলেই হারিয়ে ফেলি !
দূরে গেলেই মরমে জ্বলি......
৪।
তোমার ডাকে যাবো চলে, সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ফেলে
ভাঙা তরীর শেষ ঠিকানা, হবে তোমার আঁচলখানা !
৫।
আঁধার-আলোর ঘূর্ণিঝড়ে
কেবলি হারাই তোমারে।
৬।
বিরহ-অনল তলে কত রবি-শশী জ্বলে
বেহুলা ভাসিয়া রয় গাঙ্গুরের নীল জলে !
৭।
রক্তশূন্য ফ্যাকাসে চোখ
রক্ত নেশায় খুঁজে ঐ মুখ !
৮।
হাড়ের কঙ্কাল ভাসে জীবনের দূরবাসে
তবুও শরীর জুড়ে স্বপ্নের ভেলা হাসে...
৯।
গোধূলির আলো হাসি আঁধারের গান
শূণ্ণে ভাসিয়া ফিরে মধুমাখা তান...
সুস্মিতা চক্রবর্তী
শীতার্ত সফলতা
মাঘের শেষের হিম ঝরানো ঘুমের প্রবাল ঠেলে
কোন দুরাশার মত্ত হুতাশ আচমকা দ্বার খুলে
পুড়িয়ে দেয়ার উগ্র দেয়াল কেউটে ফণার বিষে
ফেনায় ফেনায় জমাট রক্ত উগড়ে দিল হেসে
দেখাল তার চকচকে লোভ আগুন রঙে মুড়ে
সবুজ পাতা হলদে হল অসহ্য রোদ্দুরে!
শীতের বিদায় পাতা ঝরার বিচ্ছেদ ক্রন্দনে
ন্যাড়া গাছের বেদন জ্বলে নির্জনতার ধ্যানে?
খসে প’ড়া বোঁটার কষে আনকা একলা ফল
কার ইশারায় দেখলো গাছের চোখের নীচে জল!
পদ্মা মরে বাঁধের ফাঁদে এ কোন সফল কালে?
কত নদী উজাড় হলো জেলে বন্দি জালে!
চন্দন রিমু এর কবিতা
শুভতে বিদীর্ণ
গাভীর ওলান ফাঁটা দুধ, শাদা চাঁদ, ছুরিকার মতন লাফিয়ে
ঝাঁকেঝাঁকে পড়ে মাছ,মৌ-মৌ গন্ধ ,ফুলে গুঞ্জরিত ভ্রমর মৌমাছি
স্তন-মাপের সুমিষ্ট তাজা-পাকা ফলে অভিশপ্ত কীট হয়ে আছি
ভালো ছিলো মাটি-জল বায়ুতে যা কিছু সুনসান নীরবতা নিয়ে।
বসে আছি ফাঁটা-কাপ সভ্য ট্রেতে, শুভপথে ভাঙ্গা ঝাড়ু নগ্ন নাচি
অশুভ একলা পাখি কখনো খালি কলস মানুষের দিব্যচোখে
পতিত পঙ্কিল অশীল ঢুকেছি রব ওঠে দেবালয়ে, সর্বমুখে;
ভালো ছিলো মাটি-জল বায়ুতে যা-কিছু ,ভালো ছিলো খেলা কানামাছি।
গোত্র-সভ্যতার ধার ধারি না -বুঝি না ঈশ্বর,অন্যায়,আদালত;
অসহায় ব্যর্থ চলেছি পথিক একা বিষের বাটিকে ভালোবেসে,
যেখানে রেখেছি পা ধরেছে ক্ষয়রোগ,নগ্ন দাঁতাল উঠেছে হেসে
তবু বর্বর বাতিল আমাকে চুম্বনে টানে নারী আর লাল মদ।
শুভতে বিদীর্ণ মনপ্রাণ ভরে আজ অভিলাষ জমেছে আমার
খসে পড়ুক মুখোশ ঐশীগ্রন্থের,মানুষ ও তাদের দেবতার।
অমৃতের মিছে শব্দ ছাড়া কোনো ভ্রান্তি নেই
এখনো আমরা যারা চোখে দেখি নি সামান্য প্রশান্তির স্থির বিন্দু
পান করেছি অভিশপ্তের মতো তপ্ত সীসা আর বিষময় বিন্দু
অমৃতের মিছে শব্দ শুনে ভ্রান্ত হই!
দাবানলের চেয়েও ক্ষুব্দ; ক্রুর সময় ও মৃত্যুর চেয়েও হিম
পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা এখনো যারা থমকে দাঁড়াই বৃত্তাকার
এক স্বচ্ছ আয়নার সামনে! দু’চোখে দেখি মর্মান্তিক , হাস্যকর
নিজেদের প্রতিবিম্ব! তখন কে করে কারে উপহাস?
মৌসুমি ঢংয়ের বাস্তবতা আর অবাস্তবতায় ; নৈতিকতা আর অনৈতিকতায়
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোথায় চলেছি হে ইচ্ছে স্বাধীন একান্ত গোয়ার্তুমীর _
দাম্ভিক পদভারে সব কিছু চুর্ণ করে?
সব মানব-মন্দির বিধি ও বিধান একে একে দেখি হারিয়েছে খেই
আজো বেতালের তালে শুনি অমৃতের মিছে শব্দ ছাড়া কোনো ভ্রান্তি নেই।
পতনপ্রিয়
কীভাবে হলাম এতোটা পতনপ্রিয়?
উপহাস্যে ছুড়ে দেই ব্যাঙ্গাত্বক তুড়ি
অমৃত ঝর্ণাধারায় সিনান করি ও
গোলাপ হৃদয়ে আমূল ঢুকাই ছুরি।
কী-পাপ করেছি যে এতোটা হাসি-খুশি
উর্ধ্বে মদিরা মাতাল নিম্নে অগ্নি পুষি!
ভিসুভিয়াসের সাধ্য কি
গোখরো তরুণী মাতাল উন্মাদিনী প্রিয়া
নাচের মুদ্রায় হানে বিষের ছোঁবল
উত্থিত বক্ষে তার অনলের ক্রিয়া
প্রেয়সী তবুও সে ডাইনি অবিকল।
তার শুদ্ধ বিষে আর অমৃতে-অঙ্গারে
কবি ও বাঁশিতে মজে মোহনপ্রিয় নিরো
ভিসুভিয়াসের সাধ্য-কি তাহারে পোড়ে?
উদ্ধার উন্মুখ সকল মাতালে ভীরু।
হঠাৎ স্তব্দ! হবে হিম শূন্য-অন্তসার
বাজাও ইচ্ছেমতো প্রাণ তোমার সেতার।
চরু হক-এর কবিতা
ঝরনা
আমাকে তুমি একটু কাছে চাইছো
আমি বুঝতে পারছি, আর তাই আমি
অরণ্য, ফুল, পাখি, জ্যোৎস্না এসব
বিছিয়ে দিয়েছি তোমার বিছানায়
এদেরকে জড়িয়ে ধরো, চুমু খাও
দেখবে, আমাকেই পাবে।
এখন তুমি আমাকেই দেখতে চাইছো
আমি বুঝতে পারছি, আর তাই
খুব ধীরে খুলে দিলাম আমার দণি জানালা
ঐ যে দূরে তারা দেখছো
ওর ভেতর দিয়ে আমি এখন দেখছি তোমাকে।
প্লিজ, অশ্রুতে ভিজিয়ে দিও না তোমার পঙ্ক্তিগুলো
কেননা এখন অনেক রাত
আর আমার বুকের ভেতরটা একেবারে শূন্য
ঠিক এ মুহূর্তে তুমি আমার হৃৎপিণ্ড থেকে
দুঃখগুলো কুড়িয়ে নিতে চাইছো
আমি বুঝতে পারছি, ভীষণ বুঝতে পারছি
আর তাই আমি
ধীরে খুলে দিলাম আমার হৃৎপিণ্ড এখন.........
ডাকো
সুনসান বিকেল জুড়ে
রোদদের বালুচরী কাজ
অভ্যাসবশত অশ্রু মনিমুক্তোর মতো
ঝরে পড়ে রুপোর কৌটায়
নিজেকে খুঁজতে গিয়ে অগত্যা হারাই চেনা পথ।
তুমি শুধু বাঁশিওয়ালা
কেন যে এমন করে ডাকো!
আরতি
সব খেলা শেষ হয়ে গেছে
এখন শুধু নিজের ভেতর
বেদনার চাষবাস করি
নিজের খেলানো আলো ছায়া নিয়ে এসে
আমাকে আরেক খেলা সাধে!
এ কেমন ব্যথাতুর আনাগোনা
কুয়াশা গলানো রাতে
কুয়াশা ছড়ানো রাতে
কুয়াশার আদিগন্ত মেখলা নিবিড় কালোরাত
জন্ম দেয় বোধের জরায়ু।
এখনো আরেক জন্ম আগোচরে কাঁপে থর থর
ছিন্ন পাখার রক্ত ফেলে রেখে যায়।
রিলিফ
জানি না কখন আলো নিভে যাবে,
নিভে যাবে জীবনের দীপ
তার আগে পূর্ণ করে নিতে হবে সুধাপাত্রখানি
আমারা সকলে তাই সারিবদ্ধ কান্ত
দাঁড়িয়ে আছি উন্মনা হৃদয়ে
রিলিফ নেয়ার জন্য সুখের সংসার
আমরা সকলে আজ শরণার্থী
খালি পাত্র খা খা রৌদ্রে ভাসে।
এন জুলফিকার এর কবিতা
অচেনা
প্রতিটি বাসাবাড়ির পাশে
এক চিলতে ভাড়াটে রোদ্দুর খেলা করে।
মাঠের সবুজ কোণে পেঁজা তুলোয় ভাসে
আমাদের সুরভীত স্বপ্ন-সকাল।
সিঁদুরে মেঘের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া দুঃখের নদী
খড়কুটোর সঙ্গে কাটাকুটি খেলে
জেনে নেয় নিষেধের গণ্ডী-কবাট।
আমিও কি ছুঁয়ে দেব?
জেনে নেব কার ঘুমে ভেসে ওঠে
শিকলের গান?
ওপারেই যাব বলে
এই আমি
থমকে দাঁড়িয়ে আছি পথে।
ডার্করুম
এখনও তুমুল বৃষ্টির পর ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে।
ফাঁকা মাঠের মাঝে সমবেত হ্রেষা ধ্বনি
দু’কুল ছাপিয়ে ঘরে ঢুকে এলে
উড়ন্ত ফাইওভারের বুকে কিন্নরকণ্ঠীর তীè স্বর
বৃষ্টির বাতাস হয়
ঢেকে দেয় ব্যাধের ধনুক।
বিপন্ন বীজের পাশে ন্যাংটো অতীত
স্মৃতি হাতড়ায়, আর ডার্করুমের মতো
কিছু মায়াবী অন্ধকার সহসাই ফনা তোলে;
সম্মোহনের যাবতীয় ছলা নিয়ে কিশোরীর বাঁকা ভ্রু
কেবলই সাপের মতো ক্রমশ জড়ায়।
তখন ব্রক্ষ্মাণ্ড জুড়ে তীব্র আলোর মাতামাতি।
উড়াল
চাকায় আগুন নিয়ে বন্ বন্ ঘুরে যাচ্ছে দিন।
ঘুরে যাচ্ছে ফনা ও বমন; শুদ্ধ রক্ত খুঁজে
গভীর গোপন খাঁজ, তার যত পেলব পলি
হন্যে কুকুর ছিঁড়ে দিচ্ছে রাত্রির মাতাল প্রহর।
মাথা ভর্তি চাঁদ আর জোনাকি নিয়ে
কারা যেন অকারণ গলি মাড়িয়ে হলুদ চারার মতো
দৃশ্য থেকে নেমে গেল দ্রুত। ধূসর ছায়ার পাশে
বন্ধ্যা স্বপ্নকুসুম নিয়ে আমাদের নিবেদিত প্রাণ
কারুময় বীজ হাতে মৌন কৃষক।
বৃষ্টি ছোঁবে বলে এখনও যাদের মুখে খেলে যায় রোদ,
পিপাসায় গলা কাঠ ; শূন্য দৃশ্য থেকে উদ্গত ধোঁয়া
ঢেকে দেয় সেই সব মগ্ন বাউল। খুলির ভেতর জুড়ে
দাউ দাউ আগুনের শিখা। দ্রুত পাক খায়।
তবুও উড়বে বলে আমার দু’বাহুর পাশে
সহসা গজিয়ে ওঠে উন্মুখ পাখা।
বারোয়ারি
শান্ত ঠোঁটের পাশে সায়াহ্নের দীর্ঘতর ছায়া
আজ বড় অন্যদিন; পরকীয়া, বাঁকা ঠোঁট, মায়া
যে ভাবে লুকিয়ে রাখে ঘরদোর, ফিরিও’লা রাত
সে সকলই সাঁকোহীন ‘বটতলা’ বই, গিরিখাত।
শহর এগিয়ে আসে, মনোরোগ, হাড়কাটা গলি
পলকে দারুণ ওম্, মনোরম ডগমগ কলি।
সে সব কী হবে জেনে? বিষদাঁত, উপাদেয় রাই
গোকুলে ঘাটের সিঁড়ি নীল সাদা ফেনা আর ঘাই
দু’ কুলে উপছে পড়ে ভিজে যায় পালকের মুখ
সে সকলই বারোয়ারি, ভুল লোক, অচেনা অসুখ !
কর্ষণ
একটি বীজের খোঁজে কাটে দিন মাস
অনন্ত রাত্রির মাঝে ব্যাকুল ুধায়
গোপন গুহায় জ্বালি দন্ড-মশাল
প্রতিটি হনন-রাতে ঘামে-নুনে মিশে
হাতড়াই গুহামুখ প্রবল আশায়
তবু কে বাড়ায় ছাই বাড়া ভাতে নুন
মাসের শেষেই দেখি শূন্য কলস
প্রবল খরার শেষে চাতক আশায়
একটি বীজের খোঁজে হন্যে কুকুর।
খনন
এ সকলই গূঢ় পাপ, বৃষ্টি-ঝড়
গরলে আকন্ঠ ডোবা
দর্পণ-বিম্বিত মুখরাশি ।
ইশারায় ফুটে ওঠা মুদ্রাকে জড়ো করে
ভুল রাই খুলে দিল
জানালা-কবাট।
উদোম বাতাসে ওড়া
পালক আর চূর্ণ চুড়ির বুকে
বাঁধ-ভাঙা জল আর পলির সকাল
আচমকা টান দেয়,
ছিঁড়ে দেয় রাত্রির সকল বাঁধন।
উদ্দাম ঝরণায় ক্রমশই ডুবে যাই,
গুহামুখে হাতড়াই আলোর ভুবন।
নির্জনে, ফ্রেমের ছবিকে - এক
দমকা হাওয়ার সাথে ভেসে এলো ভুঁইচাঁপা, শিউলি-প্রহর। চূর্ণ নত্র থেকে সহসাই উড়ে এলো তোমার আঁচল। মাঝখানে পোড়োবাড়ি। রাশি রাশি ধুলো আর নীরব প্রহর জুড়ে নেই কোনো পদছাপ। এখানে জমিয়ে রাখা নুনের পাহাড় কারা যেন বহুদিন লুঠ করে গেছে। রং-চটা জানালার পাল্লার ফাঁক দিয়ে সহসাই ঢুকে পড়ে জোনাকির আলো। দপ্দপে। যেন কান্নাও থমকে আছে দূরে। আর দখিনা বাতাস বেয়ে প্রাগৈতিহাসিক কোনও ঋণ সকল ঘুলঘুলি ছুঁয়ে পাক খায়। চিনে নেয় বেহিসাবি প্রণয়-সকাল...
বিদ্যুৎ-চমকের মতো এইসব ছবি আমার অ্যালবামে ভরে ওঠে। যতেœ টিকিয়ে রাখা নৌকাটি দোল খায়। কোনও মাঝিমাল্লা নেই। আলতা পায়ের ছাপ বহুদিন পড়েনি পাটায়। রাত বাড়ে। উন্মুখ কারও মুখ ঝর্ণাজলে ভেসে ওঠে দূরে। আর আমাদের জোড়াছবি টলমল করে। ধাক্কায় ভেঙে যায় জলের অতল। আমি সহসাই ঋজু হই। গহিন আকাশ থেকে কে যেন ছড়িয়ে দেয় আলো। নিষ্কম্প। এ কি আমারই প্রভা? দন্ড-প্রহর জুড়ে আকাশের দিকে মুখ। প্রশ্নেই ভরে ওঠে ভিতর-বাহির।
ক্রমশ গুহার মাঝে ঢুকে পড়ি, একা। চৌদিকে অৗেহিণী। আকাশ ও পাতাল ছাড়া পালাবার পথ নেই। কতদিন শূন্য ঝুলি। মুখোসের সজ্জাও লোকালয়ে এসেছি ফেলে। অতএব আলোর কথা ভাবি। তীব্র আলোর ছটা। চৌদিক ভেসে যাক আলোয়-আলোয়।
এসব তুমিও জানো। বাতাসে প্রাসাদ গড়ি আমি। প্রাকৃত শিকড়গুলো আচমকা খুলে ফেলে দোল খাই, নেচে উঠি তার-সপ্তকে। এই সব নির্মোহ, স্পন্দনভোর সবুজ কলোনি বেয়ে ঘুরপাক খেলে সহসাই ভেসে আসে নূপুরের ধ্বনি। অন্ধকারের সকল জন্মরহস্য প্রবল ধাক্কায় খুলে যায়। স্নানের ঘাটে ঘাটে উন্মুখ গোপিনীর উলুধ্বনি ছুঁয়ে জেগে ওঠে জলসিঁড়ি। সিঁড়িতে পায়ের পাতা, গ্রাস করে জল। থ্যাঁতলানো চাঁদ আর কবিতার খাতা নিয়ে তুমি ঠায় বসে থাকো। দু’হাতে আঁকড়ে রাখো দেহজ প্রবাল।
নির্জনে, ফ্রেমের ছবিকে - দুই
বরং তীব্র বাসনার কথা বলো। বলো, কীভাবে গর্ভিনী মেঘ থেকে ফেটে পড়ে জল। আর সে অমোঘ বৃষ্টিতে আদম পুড়ে যায় একা। আঙুলের ফাঁক দিয়ে যে তীব্র ছলাৎছল নদী সূতিকাগৃহের পথ খোঁজে, তার দেহখাঁজে কেউ বুঝি লিখে রাখে জন্মান্তরবাদ ! তীব্র ফলার মুখে লাল-নীল স্বপ্নের কুচি।
এখানে জমানো হাড়ে বিদ্যুৎ বাসা বাঁধে রোজ। আকাশ ঝুপ করে নেমে এসে দেখে যায় পোড়ো ভিটেবাড়ি। মৃত্যুচিহ্ন ধারণের মতো কোনো রহস্যময়তা আমার জানা নেই আজও। পোকাদের কাসরুম থেকে নির্দিষ্ট সহবত শেখা ছেলে আমি নই। পুলসেরাতের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি তাই। চুলের সাঁকোর ওপারে যে অসম্ভব বৈভব খেলা করে, নীরস কঙ্কাল থেকে স্বয়মাগতা বিলোল কটাে জাগায় পুরুষ-হৃদয়, তা থেকে ঈষৎ দূরে আমার পথের রেখা শেষ। এ-কাহিনী নতি-স্বীকারের, নুন হয়ে গলে যাওয়া দৃশ্যের ছবি।
তুচ্ছ করো, শূন্য শূন্য করে আমাকে ওড়াও হৃদি-দূরে। এভাবে এড়িয়ে যাওয়া আপেলের প্রথম কামড় তোমার ক্যানভাসে বুঝি আঁকা ছিল না। এই যে মাপতে মাপতে আমি ক্রমে পথ হয়ে গেছি এ অমোঘ সত্যটুকু আপাতত দৃশ্যের খাঁজে। লাট খায়। সাপ-লুডো পৃথিবীতে তুমিও তো অন্ধ-ধারক। কাচপোকা টিপ পরে শুয়ে আছ রক্তের মাঝে।
নির্জনে, ফ্রেমের ছবিকে - তিন
অধিক রাত্রে জ্বলে ওঠো তুমি। ঘাইহরিণীরা ঝর্ণায় জল খেতে এসে সাবধানে দেখে নিক চুম্বনরেখা। শক্ত বাড়িটার ওপারে একাকী পোড়ো বাড়ির নির্জনতম প্রকোষ্ঠে পুরোনো পায়ের ছাপ কেউ সন্তর্পনে মুছে দিলে ঝর্ণার জলে ভেসে ওঠে ঈশ্বরীয় মুখ। আর ক্রমশ নিষিদ্ধ ভূখন্ডগুলো অধিকার করতে করতে জেনে নিই ঘুলঘুলির বুড়ো শালিকের কাছে রেখে যাচ্ছি কতটা বিনম্র ঋণ।
প্রতিবেশী কান্নায় কীভাবে ডুবে যাচ্ছে আমার অতল ! আচমকা মেটাফর গিলে নিচ্ছে উচ্চারিত ব্যবহারলিপি। চিৎকারের মধ্য থেকে স্পষ্টভাবে জেগে উঠছিল হ্যামলিনের বাঁশি, আর প্রায়ই পাড়ার সোমত্থ মেয়েগুলো এক একজন বাঁশিওয়ালার সাথে উবে যাচ্ছিল অদ্ভুত সম্মোহনে। তখন রকগুলিতে অঘোষিত কার্ফু। এই মালিকানাবদল পর্বে অতিদীর্ঘ এক নত্রমালা আমাকে শিখিয়ে দেয় কনফিডেন্সের থার্ড লেসন।
নির্জনে, ফ্রেমের ছবিকে - চার
এই ফাঁকে বলে নিই গাণিতিক শুদ্ধতার কোনো কিছুই ঘটেনি এ জীবনে। ছায়ারা দীর্ঘ হলে অপূর্ণ জন্মের যত দীপ্ত অহংকার প্রসূতিসদন থেকে ধেয়ে আসে ক্রমে। আমিও দুই চুম্বকমেরুর মাঝে নিশ্চিন্তে আসন পাতি। গাছের শরীর বেয়ে রোদ নেমে এলে জলসিঁড়ি নদীঘাটে কোলাহল থেমে যায়। সহসা ঘোমটা খুলে নদী নামের সেই পদ্মগন্ধী মেয়ে সন্তর্পণে দেখায় সেই গোপনীয় তিল। কুর্চি-পাড়ার শিউলিতলায় হলুদ বসন্ত পাখি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে যেতে খরচোখে দেখে নেয় সুতো কেটে যাওয়া সেই চাঁদিয়াল ঘুড়ি, যার বুকের প্রায় কাছে লাট খাচ্ছে না-পৌঁছানো এক নীল চিঠি।
এত যে আলোর কথা বলো, আমাদের প্রাকৃত শিকড়ে আজ তার লেশমাত্র নেই। নৌকার ছই-এর মাঝে টিমটিমে লম্ফ থেকে পৃথিবীর তাবৎ কালো কেবলই মিশে যাচ্ছে রাতের মাতলায়। দু’ধারে পাশাপাশি গাছ। গল্পরা সার বেঁধে ছুঁয়ে দেয় কিশোরীর হাত। প্রথম কবিতা লেখার মতো সেই ছোঁয়া কোনো এক ঋজু কিশোরের বুকে সংক্রামিত হলে মেঘবালিকারা তুলে নেয় রাধাহরণ বাঁশি। তখন একক নৌকা ভেসে যায়। নার্সিসাস পড়ে থাকে পাথরের খাঁজে।
ছাদ
কীভাবে খেলা যে খেলি, ছানি-চোখ, কোমরেও জং
তবুও দিব্য আছি টং হয়ে বিকেলের ছাদে -
ওপাশে চিলতে ঘরে লাল-নীল ওড়নার ওড়া
ডানার ঝাপটা মেরে বলে কেউ - ঢং, বুড়ো ভাম।
বলে সে বলুক লোকে, রক্তেরা কিলবিল করে
তছনছ, আঁকিবুকি ভুলঘুমে বিছানা-চাদর -
এখনো গ্রীষ্ম-শীতে কুসুমের ডাল ছিঁড়ে একা
কেবলই হলুদ বন, কাঁপা রাত, জোছনার সারি।
খুলেছি খাতা তো তাই, শ্যাওলাও ঘষে-মেজে সাফ
বুকে রোজ ঝুমঝুমি, খরচোখ, বাঁধভাঙা নদী
বাতাসে নিশির ডাক, ছুটে প্রায় উঠে যাই ছাদে
অবুঝ ওষ্ঠ থেকে ঝরে রোদ, বিষধর ফেনা।
দৃশ্যপট
পাঠ্যসূচির ভাঁজে পালি-রোদ চর্যার গীতি।
তীব্র পিপাসা এঁকে
তপ্ত বালির পাশে একা, গরলের ঝাঁপি খুলি
দৃশ্যের মাঝে আঁকি শীতল-গোপন।
কেটে যাওয়া নীল ঘুড়ি আচমকা ডাক দিলে
ছন্দরা উঠে আসে খাতার পাতায়-
সেখানে ইশারা-নারী, অবনত, ঘোমটার ফাঁকে
ক্রমশ রাত্রি হয়,
দূর বনে ডেকে ওঠে মত্ত হরিণ।
উষ্ণতা শূন্যের কাছে, ক্রমাগত দৃশ্যবদল
খাঁচায় আমিও ঢুকি,
অবিরাম বন্যায় ভেসে যায় ঘর।
গাজী লতিফ এর কবিতা
খ- খ- অখ- নীলিমা
১.
পাতাবাহার সময়ের কার্নিসে কেউ কেউ দোল খায়
অনেকের ঝুলে থাকে দঃখের নেকাবে ঢাকা
অভিজ্ঞান-অমলিন বুটিদার স্মৃতির চাদর!
আজো দখিনা বাতাস এলে স্মৃতিলতা অলৌকিক হেঁটে হেঁটে-
ছুঁয়ে যায় স্বপনের সানুদেশ, স্বপনের ভেতরে স্বপন
ডানায় সীমার কষ্ট মেখে নিয়ে
বিষাদের বৈরি সুখপাখি, উড়ে উড়ে পুড়ে পুড়ে
একাকার করে ফ্যালে শৃংখলিত আকাশের অথই নীলিমা
কেউবা নীলিমা দ্যাখে মুগ্ধ চোখে দৃষ্টির চিহ্নিত সীমায়
বলে, নীলিমা নামের মেয়ে! চমৎকার! আহা!
কই বাবা আকাশের গতরে তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই!
নীলিমার স্মৃতিরাশি মননের ক্ষুধিত পাষাণে
সুসুপ্তির গহন গহীন গানে যে হৃদয় শুধুই পোড়ায়
কজনই বা দ্যাখে- হৃদয়ের জ্বলন্ত অংগার; পোড়া ছাই!
২.
স্মৃতি!
দিঘির কাজল জল! রাঁজহাস! জলকেলি! পারিজাত-পরী!
যেন এক ঝাঁক নগ্নবাহু শুভ্র-যৌবনার-
দাপাদাপি-মাতামাতি পাখা-ঝাপটানি অবিরাম!
অন্যপাশে পুরাকীর্তি! জরাজীর্ণ হাজার কুঠুরি ইমারত!
সবগুলো কক্ষে তার এস্রাজের করুণ সিস্ফনী
কখনও বা বেহালার অশ্রুভেঁজা বেদনা-বেহাগ-
অকারণ জোডাতালি সারারাত! খ- খ- অখ- নীলিমা।
আমি- দূরগামী
সেফালী রাতের চৌকাঠে মাথা রেখে
তুমিও ঘুমাও- ঘুমায় নষ্ট চাঁদ
নিস্তব্ধতা বাড়ায় নিশিতে ডেকে
আমি জেগে চাখি নষ্ট রাখির স্বাদ।
ভেসে ভেসে চলে মন-পবণের নাও
আরশিনগরে পরশিরে করে খোঁজ
সুবিদখালীর মিষ্টি-স্বরের বাও
জিজ্ঞেস করে খোঁজো কি এখানে রোজ?
শম্ভূসাহার হৃদয়ের উচ্ছ্বাস-
আকর্ণ শুনি কুশল শুধানো-‘দাদা,
ক্যামন আছেন, এখন কোথায় বাস’?
কীভাবে যে ঘোঁচে দূর-দূরত্ব বাঁধা!
ভাবি আর তার পাশটাতে ঘেঁষে বসি
সেলিনা সরায় খুলবে মশারী!- রশি!
এখানে দাঁড়িয়ে আছি
যখন ব্যর্থ-প্রেমের কষ্ট-পুঁজির বীজে
অযুত প্রাণের হ্রদ ভরে যায় নিযুত সরসিজে
এবং মদির ঘ্রাণে ঘ্রাণে তার
ভরে ওঠে হৃদয়খামার আর
মানুষেরা মুহূর্তেই ব্যাপ্ত মনসীজে
তখনই সময় কাব্যগ্রন্থ পড়ার।
যখন প্রেমাগুনে দু’চোখ পুড়ে সারা
দগ্ধ-ভস্ম-অন্ধ-ছন্নছাড়া-
মনের আলোয় ভাসতে ভাসতে কবি
হৃদয়ে আঁকে প্রিয়তমের ছবি
তার বিরহে ক্ষ্যাপা- বাঁধনহারা
তখনই সময় নতুন কিছু গড়ার।
পরের সোপানে আকাশ সাগরে এসে
চেরাপুঞ্জিতে অঝোর ধারায় মেশে
অমৃত ফলে ব্যর্থপ্রেমের প্রতিফলনের বিষে
বিস্মরণে হারায় না তাই আস্বাদনের দিশে
সে বিষের স্বাদ মধু হয়, বধু বেশে।
এখানে দাঁড়ালে ইচ্ছে হয় না নড়ার।
চুলা-আগুন-ছাই
১.
তারপরও ভেংগে যায় সুন্দরের গান
বোধিদ্রুমও ফণা তোলে আজকাল মাঝরাতে কুটিল আঁধারে
নেপথ্যের ফুঁয়ে জ্বেলে লেলিহান লোলুপ আগুন- কী বিস্ময়!
মঞ্চের গান তবু বার বার একই হয়
‘ওম শান্তি, ওম শান্তি, শা-ন্তি; শা--ন্তি!
কক্ষ কারোরই নয়
প্রতিটি শাখায় পত্রে ছালে ও শেকড়ে
জেগে ওঠে দাউ দাউ আগুনের ফণার বিস্তার!
প্রশান্ত কানন তবু খান খান ভেঙে পড়ে বুদ্ধের ধ্যান!
অকারণ মৃত্যুপুরী শ্মশানের সমারোহ অযথাই জেগে ওঠে শুধু!
প্রাণনাথ বাউলের বোধের এন্টেনা ছাঁকে মাহাত্ম্য ফুঁয়ের
মুখ ও মুখোশ বেছে তুলে রাখে চিত্ত-ঘরামী।
আরপাশে রাশি রাশি সাধুতা-শুভ্রতা পোড়ে!
পুড়ে যায় সুন্দরের ধ্যান... ... ।
থরে থরে বেড়ে ওঠে বেহিসেবি মগ্নতার অবিনাশী ছাই
ভাবের পাগল বলে কথা-
ঘুড়ি ও লাটাই ফেলে ছাই-ই ওড়াই!
২.
ছাই উড়ে যায় দিগ্-দিগন্তে হই চই মাতামাতি
সবগুলো ঝাঁক একঝাকে মিলে পাখিরা ছাইয়ের সাথী
ছাই ছুঁয়ে গেলে মেঘের অধর টুপটাপ ঝরে বৃষ্টি
উষর মরুতে এককণা ছাই মরুদ্যানের কৃষ্টি।
ছাই উড়ে গেলে পড়ে থাকা পথ, বাতাসও সবুজ হয়
ছাই ছুঁয়ে দিলে আলোহীন তারা হঠাৎ সূর্যময়
ছাই পড়লেই বন্ধ্যা নদীতে জোয়ারের ধুম জাগে
ছাই ও জীবন পাশাপাশি ওড়ে জীবনের অনুরাগে।
দহন : ১
পাবে না জেনেও কভু সে দু’টি নয়ন
খামোকাই বেহিসেবি একটা জীবন
জনমের হাহাকার নিয়ে গ্যালে পুড়ে
সঞ্চযের থলিতে মাত্র অচল সিকিটা ছাড়া
না- কোনো জমেনি মোহর
‘কল্লোল-ক্রন্দন’ তবু গান হলো সুরে!
এবং ‘ও’ আছে এই সুখ
থাক না বন্ধুরা; যারা রয়েছে বিমুখ
আমিতো চেয়েছি যেতে তবু কেন তাতে
লাভার জ্বলন্ত গিরি বুকের খনিজে
নিজেই বুঝি না ঘটে অঘটন কি যে!
একটা সিকির দস্তা, বস্তা বস্তা-
হীরে হয়ে ঠিক্রায় আমার নিখিলে
তরল অনলে ডোবে হৃদয়ের খাঁজ
তবে কি পুড়েই হবো নীলিমার
আরো এক মুনসুর হেল্লাজ!
কেউ কেউ নিভৃতে একাকি জাগে
পিরামিড প্রশ্নস্তুপে দীর্ঘদিন ডুবে থাকা নশ্বর দেহ
জীবন্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন- কান্ত, কীষ্ট; হা-পথে পথিক
কার প্রতিবিম্ব তুমি, ও নশ্বর কায়া?
কারো কারো এমত জিজ্ঞাসা থাকে সবার থাকে না।
মাঝরাতে ফিরে এসে ঘরহীন ঘরে
দশদিশি বেপথু পথের কষ্ট! হা-পথ! হা-ঘর!
অকারণ মনস্তাপে জ্যোৎস্নাশিশিরে সিক্ত চিরল পাতা-
কষ্টের স্বাক্ষীগোপাল হয়ে জেগে জেগে টুপটাপ ঝরো,
নিশির নেশায় মত্ত, নিশি পাওয়া তুমি কোন্ নিশি কবিয়াল?
কেউ কেউ এভাবেই শরীরী শারিন্দাখানা
বাজিয়ে বাজাতে শেখে একদিন নিজেই নিজেকে।
অন্যপাশে হাট বসে জমে ওঠে মানুষের ভীড়
লক্লকে লোভের লোলুপ জিভ্
আলো থেকে অন্ধকারে নিয়তই হ্যাচোর-প্যাচোর টেনে
পার্থক্য ঘুচিয়ে দ্যায় মানুষে-কুকুরে
তা বলে বসে না পেয়ে সবাইকে বিভ্রমের ঘোরে!
চৈতন্যের খেয়াঘাটে কেউ কেউ বসলেই
একটি মুহূর্ত হয়ে হাজার রজনী কেটে যায়!
বেপথু পথেরা সব আলোর মিছিল হয়ে ছুটে আসে সুন্দর বিভ্রমে!
তখন থাকে না প্রশ্ন উষ্মা কিংবা কোনো অভিযোগ
সহস্র রাত মানে একটি মুহূর্ত মাত্র-পাল্টে যায় দৃশ্যপট এই প্রতিবেশ
শরীরী শারিন্দা জুড়ে অশ্রুত সুর ওঠে
দ্যাখে, এই আমি আমি নই, তুমি তুমি নও!
আসলে সে অন্য কেউ! অন্য কোনো মজুমদার কমল কুমার!
নিজেকে বাজাবে বলে কেউ কেউ নিভৃতে একাকি জাগে
অনন্তর জেগে থাকে বিভ্রম-সুন্দরে মগ্ন কোটি কোটি আলোক বছর!
জনৈকের জিজ্ঞাসা
পোড়া প্রান্তরে হরিয়াল খোঁজে নিস্তার
চাতক-স্বপনে গাভীন-মেঘের বিস্তার
বর্গী উধাও অধুনা জুটেছে মস্তান
চাঁদা না পেলেই খুন! ধর্ষণ! পস্তান
যারা তিলে তিলে বানিয়েছে খুনি মস্তান!
নেতা ও নেত্রী মঞ্চ পেলেই কান্না
প্রতিশ্রুতি মানে ভাঙা কাচ,-নয় পান্না
জনতা জেনেছে, ভানুমতি খেল আর না।
নেতা ফেরেস্তা, নেত্রী বেহেস্তি হুর!
আদম-কদম,আদু-গেদু-খেদু দূর
দূরত্ব বাড়ে ক্ষমতাবানে ও হীনে
যত দিন যায় জনতা জড়ায় অপরের খাওয়া ঋণে!
রক্ষার নামে হরিলুট আর কতো?
নিরীহ মানুষ আর কতো হবো হত? ?
শিশিরআখ্যান
সোমত্ত জ্যোৎস্নার গলে পড়া রাতে
পঙ্ক্তিরা বেড়াতে এলে
অঘোর ঘুমের রাজ্যে জেগে থাকি,একা
পানপাত্রে মজে গেলে ফেণার বুদ্বুদ
আকাশ ছেয়ে যায় ঝড়-সম্ভাব্য জোৎস্নার রোদে
প্রপাতের ঢল থেকে নেমে আসে
বৃষ্টিপাত দৃষ্টিপাত তুমুল ধারায়
জ্যোৎস্নার-বৃষ্টিতে স্নান সেরে
পঙ্ক্তিরা উঠে আসে ক্রমান্বয়ে হাতের তালুতে
উরু ভুরু উপত্যকা ব্লাউজের বুটি ছুঁয়ে
ধারাল চিবুক নাক কণ্ঠার বাঁক ছুঁয়ে
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে ত্রিমাত্রিক প্রগলভ নেশা...
আকণ্ঠ জ্যোৎস্না পানে চুর হলে
পঙ্ক্তির ভাঁজ খুলি-হাত্রাই
কপোলের কণ্ঠার নিতম্বের উষ্ণতিল তিলের বিভাস
জ্যোৎস্নাশিশির-জলে রাতের গতর ভাসে
ঝাউবনে দোলা দেয় মাতাল বাতাস ...
পাঠ
চাঁদ উঠলেই- তোমার চোখে বৃষ্টিকাতর পদ্যলেখা
লজ্জাহারা ঘরবিলাসী হিমতাপাকুল সাঁতার শেখা
বৃন্দাবনে কৃষ্ণলীলার রুদ্ধমাতাল বহ্নিরেখা।
ফুল ফুটলেই ফুলকুমারীর সতীচ্ছদের অশ্রুফোঁটা
ক্ষেত্রবতী ভ্রষ্টাকলির পাপড়িপতন হলুদকোটা
নির্জলাঢেউ, নগ্নজলে শ্বেতকরোটির আঁতকেওঠা।
পাশে থাকলে- সিন্ধু ঈগল চন্দ্রক্রীড়ার নীলকপোতী
ঘরবিবাগী ঊল্কাত্রাসী অশ্রুআঁধার অরুন্ধুতি
মগ্নপাঠে শূন্যমাঠে পথপ্রবাসী ছন্দযতি।
কাছে ডাকলে- রুদ্ধবাতাস একনিমিশেই ব্রীড়াঙ্গুলি
আগলে রাখে বুকের ভারে তৃষ্ণাসুতোর জলকাঁচুলি
মন্ত্ররতির যমজআগুন রাতেরফাগুন ব্রজবুলি...
প্রপাত
উড়ছিল শিশিরের চুল
পুড়ছিল দুধমাখা চাঁদ
ঘামছিল রোদসাদা ফুল
নামছিল নীল অবসাদ
কাঁপছিল বিহ্বল হাত
মাপছিল পাহাড়ের খাদ
খুলছিল নতমুখী রাত
দুলছিল শ্বেত জলছাদ
উড়ছিল পুড়ছিল ঘামছিল নামছিল
চুল চাঁদ ফুল অবসাদ
কাঁপছিল মাপছিল খুলছিল দুলছিল
হাত খাদ রাত জলছাদ
কবিতাসম্মত
ঘোরের ঘুমের সাথে পঙ্ক্তিরা আসে
কেউ সাথে সহজিয়া কেউ নাচে হাসে
কিছু ধরি কিছু ছুঁই কিছু পড়ে থাকে
জলাঙ্গি-জলজপঙ্ক্তি মরমিয়া ডাকে!
অরা-অধরার খেলা আপাত এমত
আধো ঘুমে জাগরণে কবিতাসম্মত!
জেগে ছোটা অলিগলি পঙ্ক্তির খোঁজ
পঙ্ক্তি যখন আসে আমিই নিখোঁজ!
যাপন : ৩
অদূরে জানালা যুবতীপল্লী- আলো
প্রলুব্ধ করে প্রিজমের আদিকাচ
রাতের নগরে বর্ণিল রঙ নাচে
পতংগ যাচে- প্রিয় আগুনের আঁচ
আমি ডানামেলে দুঃখিত দেবদারু
বিনীত বাকলে পুষে উড়ালের বোধ
সাজিয়েছি শুধু পাতার-পালকফাঁকি!
শাখা-শেকড়ের স্বপ্নিল সবিরোধ
তবু চাঁদে পায়- বিরহ যাপনে জাগি
জাগে প্রচ্ছায়া, আদি রমণের পাপ
ফুলের ভুলের ভ্রুণ থেকে উঠে আসা-
মনুষ্যকীট!-বিশ্বপিতার শাপ।
দ্বিধায় ধাঁধায় গন্দমঘোরে থাকি
ধুলো-ক্যানভাসে শূন্য সাঁকোটি আঁকি...
তাই, ছুঁয়ে যাই
শিশির ফোটাবে হাস্নুহেনার ফুল
কোকড়ানো চুল ঠোটের বকুল স-ব
গন্ধমদিরা পূর্ণিমা উৎসব
ভিজবে পরাগ রাতের মায়াবী ঘামে
সুরভি রাতের ঝর্ণা যতটা নামে
ছোঁয়ার নেশায় শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দ্যাখা
আমি ছুঁয়ে যাবো চাঁদের সিথান, একা
স্বর্ণালী রাত, রাতের কোড়ক; ফুলের মর্মমূল
ছুঁয়েছি বলেই বার বার ফিরে আসি
ছুঁয়েছি বলেই জীবনেরে ভালবাসি
ছুঁয়েছি বলেই আলোকিত এই হাত
আমি ছুঁয়ে যাবো শুভ্রশিশির-গোলাপগন্ধি রাত।
যুদ্ধ
গ্রীষ্মদাহনে পোড়া শ্রাবণময়ী
আমাদের দিনগুলো রৌদ্রব্যাকুল
তুমি আকাশের আঙিনায় আগুনের ফুল
ফুটতেই ছুঁতে গিয়ে করে বসি ভুল
যেন যুদ্ধ ঘোষণা করি রক্তক্ষয়ী...
আমাদের ভালবাসা মরণজয়ী
চক্ষুসাগরগুলো অশ্রু-আকুল
তাই ব্যথাতুর কথামালা সুখাশ্রয়ী
আমাদের কষ্টেরা জ্যোৎস্নার ফুল
আমাদের দিনগুলো জ্যোৎস্নাময়ী
আমাদের রাতগুলো শ্রাবণব্যাকুল
তুমি- আমি- ঈশ্বর মুগ্ধত্রয়ী
যেন একনদী তিনস্রোত অসীম অকুল
দূরে একা ঈশ্বরী লাস্যময়ী ...
শেকড়
(সাধক বিনয়বাঁশি জলদাসের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য)
কতটা পিপাসা কান্নার আশে পাশে
জলের জলজ জিহ্বা কতটা গ্রাসী
সে-ই শুধু জানে রক্তের ধারাপাত-
ক্ষরণের জ্বালা যাঁর পাঁজরের শিকে
বরফের চাঁই পার হয়ে হিমযুগ
শেকড়কথন শিখেছে যে যাত্রিক
সে-ই শুধু জানে শারীরিক জলভাষা
সিঁদুরের কাছে আগুন কতটা ফিকে
জল-প্রতিভাসে অভিভূত আশরীর
বিনয়বাঁশি তুমি জলদাস সুরদাস
কালের শেকড়; চেতনার অধিবাস
শেকড় পোড়ে না- ছড়ায় চতুর্দিকে
অনেক পিপাসা কান্নার চারপাশে
জাগে জলদাস সুরের চেতনাকাশে
শিমুলস্য কবোষ্ণ-কদম
বয়েসি শিমুলগুলো অসম্ভব ভারী হলে
বাধ্য হয়ে ফট্টাস! বাতাসই ফাটায়!
তুলাশ্রয়ী ধুলার দৌরাত্ম বাড়ে ঘাটে-আঘাটায়
উড়ে উড়ে পুড়ে যায় ভেতরের অসহায় মোম
খমোকাই পেকে ওঠে নাগরিক নাসিকার লোম
ফাটার যা ফেটে ফেটে হেঁটে হেঁটে উড়ে পুড়ে দূরে চলে গেলে
টিকে থাকে লাজনত কুশলী-শিমুল
ঠোঁটে তিল, গালে টোল-টোলের কৌশল
ধরে রাখে বালিশের ওম
ধুলোদিন কেটে গেলে গীতল শ্রাবণে ফোটে কবিতার কবোষ্ণ-কদম
বীক্ষণ
ছাদ আমাকে ইশারায় ডাকে
নভঃজাগতিক ছাদ! গোল্লা গোল্লা কস্মিক দ্যুতি
ছাদে চড়তে সিঁড়ি কিংবা লিফ্ট চাই
সিঁড়ি টপকানোর কৌশলগত বিদ্যা মানিব্যাগের আয়ত্বে
মানিব্যাগে বন্দি-মানিব্যাগ ফাঁকা-!
ছাদ! নভঃজাগতিক ছাদ!
ছেদোভাষা অর্থাৎ কস্মিক বিচ্ছুরণ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ি
ঘুমে স্বপ্ন নামে- স্বপ্নে চাঁদে যাই- চাঁদে ঘরবাড়ি তুলি- চন্দ্রবাসী!
চাঁদ থেকে ছাদ দেখি!
প্রত্ন-সম্পর্কের জট
সম্পর্কের সুতোগুলো কী যতনে জড়িয়ে রেখেছে আমাদের
আমরা বিশালতর বট যেন মৃত্তিকাসন্ধানী সব ঝুরি
নামিয়ে দিয়েছি মাঠে
হাটে বাটে যত্রতত্র-বোধির তল্লাটে
ঠাটে তেমনটা যায় না বোঝা, তারপরও পুড়ি
প্রতিদিন চোখের সামনেই আমাদের অগণন শস্য যায় চুরি
দেখি বাধ্য বশংবদ; অভ্যস্ত কানে শুনি শিশুদের চিৎকার,ফের
বিষণ্ন মাঠের শেষে থেমে থেমে বেজে ওঠে যেন দুপুরের
খরতাপে প্রাত্যহিক আশা-ভালবাসা নয়, পুড়ে যাচ্ছে মরীচিকাগুলো!
আমাদের প্রান্তিক পায়ে ওড়ে তারই বিপন্নতার ধুলো
সভ্যতার মচ্ছবে কাটা গেছে আমাদের সবগুলো বট
শেকড়ের মাটি খুঁড়ে খুলে আনি তার প্রত্ন-সম্পর্কের জট।
বিজয় আহমেদ এর কবিতা
দাইমা
মেয়েটির মুখের দিকে তাকাই; আর মুহূর্তেই
মুখটি হয়ে যায়
দুধ সাদা এক ফুল ।
অথচ সে পড়শীর মেয়ে...
আমি এই রহস্যজালে ঘুরপাক যাই। ফলে, মেয়েটির পায়ে পড়ে যাই খুব সহজেই, যেনো তার পা যুগল থেকেই পুরোটা পৃথিবী উঠেছে জেগে? আর বলি, ‘তুই কি কারো কন্যা? নাকি ফুলগাছ হতে এসেছিস বেড়াতে গরীব-পড়শীর বাড়ি?’
তখন মেয়েটি হাসে। অথচ আমি দেখি, শত শত কোটি কোটি ফুল হারাচ্ছে লাল থেকে নীলে, নীল থেকে ফিরোজায়, আর ফিরোজা হতে হঠাৎ হাসিতে; আবার সেই মোহন হাসিটাও হারাচ্ছে যেন ফুলে-ফুলে, ঘ্রাণে ও কাতর সুধায়! এমন দেখি বলে বিভ্রমে মুষড়ে পড়ি। আর কেমন যেনো এক প্রকার ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠি, বিলীন হতে থাকি। মনে হতে থাকে এ জগৎ ভ্রম, ভ্রম তার গুয্ঞন, ভ্রম তার ধান ও সুরেলা শিস...
তখনি সব কিছু থমকে দিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে,
‘হায় পুরুষ, এত ভয় কেনো তোর?’ অথচ আমি শুনি এক রিনিঝিনি কণ্ঠ
সুতীব্র পাহাড়ি স্রোত হতে উঠে এসে যেন ডাকছে আমাকে!
আর বলছে, ‘পুত্র আমার বুক বেঁধে দাঁড়া, কতটা বেড়েছিস একটু দেখি?’
সোনার ট্রফি
আহা দাইমা, দেখো এই যে ফুল,
ঘ্রাণ আছে। ঝিরঝিরে পাতা আছে,
বাকলে আছে বংশের ম্যাপ, রক্ত-ঋণ ও খুন
বলি, এইবার তুমি চোখ বুজো। ভাবো,
ফুলটি হাসছে, আর হাসির গভীরে
কুস্তির কসরত; দেখো তীব্র পেশীর তেজে
কুস্তি লড়ছে মধুপোকা?
তার মানে মধু নয়। ইশারাকাতর পাপড়িও নয়,
নয় সজল সবুজ, ধূলি ও ঘামের মিউজিক,
দিনশেষে চায় সবাই, রক্ত-রঙে উচ্ছ্বল ট্রফি,
আহা সোনার ট্রফি!
সাহসের কবিতা
সাহসের কথা বলতেই, মাঠ থেকে উড়ে এসে
একটা খয়েড়ি শালিখ
ভেংচি কেটে গ্যালো
বলি, হেই ব্যাটা সাহস কাকে বলে জানিস?
সাহস হলো মায়া-খনির পাশেই, নিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে
তোর ঝুঁটিতে, প্রবল মায়ায় এঁকে দেয়া অন্ধ এবং বেপোরোয়া চুমু
পারলে শেরিফকেও ডাকিস, তাকেও দেখাবো
ধূলি-গ্রন্থেও
এমন সাহসের কথা লেখা ছিলো
ধাঁধার তারকা
পাহাড় চূড়ায় মায়া, মায়াময় নীল।
আর চূড়ান্ত মুহূর্তের ও হর্ষধ্বণি
তুমিই হাসি, তুমিই আলেয়ার ফুল।
যদিও জানি সিনেমা শেষের হাততালিতেই
জমে ওঠে ভিলেনের বিষাদ ও খিলখিল হাসির জগৎ।
আরো জানি ধানের পুস্তকেই জীবন পায়
ডাকাতের শীস। তার মানে
প্রকাশ্যে যত ঘ্রাণ, তারো আছে কুহক
তারো আছে মোহ, মোহের পুলিশ?
ফলে ভাবি, দৌড় শেষে ভ্রমর, পায় যে ট্রফি
তা কেবলই ঝিলিক আর মায়া;
তৃপ্তির জীবন সেখানে মুহূর্তের সোনারঙ ফেণা,
আর সাফল্যফুল, সে তো দূর
সীমান্তে হারানো ধাঁধার তারকা কেবল?
অজয় রায় এর কবিতা
আলোর পাখি
সে বড় প্রিয় কোমল কথা−
পৃথিবীর প্রথম প্রত্যুষ মেখে উড়ে এসেছিল
স্নিগ্ধ আলোর পাখি।
সদ্য-স্নান-সারা পৃথিবীর ঘাসের পরে,
তার নীল-সবুজ পাখনার ছটা।
কপোত রোদ্দুরে নেয়ে−
সিসিলি দ্বীপ হ’য়ে গিয়েছে উড়ে ব্যাবিলনের দিকে,
কখনো তার নরম পালক ট্রয় ছুঁয়ে নেমেছিল
গ্রীসের পথে−সিরিয়া হ’য়ে সুদূর চীনে।
আকাশ ধোয়া পরম-প্রজ্ঞা-দ্যুতি ছিল তার অরুণাভ ঠোঁটে,
তার গা ছুঁয়েই প্রবল গ্রীষ্ম হয়ে যেত নরম-শ্রাবণ ;
আর অসীম মমতায় বড় হত আরবের নদী।
শিশিরের নরম এক রং ছিল তার গোলাপী পায়,
গায়ে ছিল মধু-রেণু চাঁদের চাদর।
যাঁরা দেশে দেশে জ্বেলেছে জ্ঞানের স্বর্ণ-প্রদীপ
জেনেছি তাঁদের কাছে−
মানুষ ছিল তার কাছে দেবোত্তম-স্বপ্ন-ঋষি।
সপ্তর্ষির শ্বেত আলোর মত রূপালি আদরে
আজো সে ছুঁয়ে আছে গৃহী মানুষের মন,
আর দিকে দিকে খুলে গেছে আলোর শহর ;
আলোকিত গ্রাম−সেই সে প্রথম আলোর পাখি।
চুল-বালিকা
পুষ্পিত মাটির বুকে চন্দন চুয়ানো দু’টি পা,
শিশিরের টুপটুপ সোনা-জলে সোনাগুলে রেখে গেছে।
অভিমানী মেঘের মত ঠোঁটে রুয়ে পৃথিবীর-পদ্ম-পরাগ,
এই পথে চলে গেছে সুদূর অলকায়।
যে ছিল পৃথিবীর একাই একটি শ্রাবণ।
নব আষাঢ়ের মেঘ-জলে ভিজে
আবার সে আসবে কি ফিরে ?
গোধূলির সবটুকু সোনালী শরম চুরি ক’রে
চুপি চুপি চলে গেছে অষ্টাদশী চুল-বালিকা।
ইলোরায় আমি তার সুডোল বাহুডোর দেখেছি
গোপন-প্রেমিকের সাথে।
দেখেছি নীল ভোরে কৃষ্ণ খোঁপা খুলে
নীল জল ঢেলে গেছে মিশরের নদে।
গ্রীসের পাহাড়ী ফুলে রাঙা ভ্রমরের সাথে
শুনেছি তার নরম আলাপ। অন্তর পোড়ানো
পৃথিবী-প্রেমিকা চলে গেছে দূর দূর সুদূরের নীল-পরী-পথে।
সোনা-জলে সোনা গুলে চলে গেছে যে সোনা মেয়ে−
কোনদিন আর কোনো নীল ঘোড়-সওয়ার তাকে
ফিরিয়ে আনবে কি লাজুক মানুষের ভিড়ে !
টুপটুপ শিশিরের সোনা রং জলে !
অরুণ-অক্ষরে
তোমার পাখির ঠোঁটে তুলে রাখা,
ফুলের নিটোল অক্ষর-
আমাকে একবার ছুঁতে দাও।
আমি নদীর নিবাস খুলে তোমায় গংগা এনে দেব।
তোমার জন্যে প্রজাপতির দেশে হবো উদিত রবি।
পাখির ফুলশয্যা নরমে জড়াব বুকে।
তাই অপোর সিঁড়িতে বসে কত রাত
জেগে আছি একা থরে থরে।
অশ্রু ছুঁয়ে উড়ে গেছে হলুদ জোনাকীর দল,
কেটে গেছে বুকের করাত-মমতার ফসলী মাটি।
মনের ভাঁজে পুড়ে গেছে কত নগর-কত শহর-গ্রাম,
তবুও অরুণ পিপাসায় সংসার সাজাব বলে,
শিমুল খুঁটে তুলেছি গাঢ় লাল−
নদী খুঁটে তুলেছি জলের জননী-জীবন।
দুরন্ত শ্রাবণে মেঘকে পিছনে ফেলে
সংসারে কার আঁচলটুকু সবার অলক্ষ্যে করেছি চুরি !
পৃথিবীর সব মায়াবী শিশির; সব সবুজ স্বপ্ন এক পাত্রে রাখব ব’লে−
বল, স্নেহের অরুণ-অরে কাকে আমি মেনেছি মানসী !
ডাস্টবিনে−প্রিয় নীল খাম
আমিও তো সুতোয় বেঁধেছিলাম স্বর্ণালি আদর
মেঘের মেরুতে গেঁথে আকাশে উড়াব ব’লে।
দুঃখের হীরক খচিত এক দীঘি জলে−ভিজে গেল তা।
জানালার তরল কাঁচ খুলে দেখি−
প্রিয় পাখি উড়ে চলে যায়,
পার হয় অবন্তীর আষাঢ় আকাশ।
দুঃখের বিপন্ন বাগান থেকে
সবগুলো ব্যথাতুর বর্ণমালা আঙুল গড়িয়ে
তুলেছি হাতের ডগায়−
পাশ ফিরে শুইয়েছি নিজের কাঁথায়।
নীড়ের কাকলি চোখে তুলে সানুনয় প্রার্থনায় কেঁদে গেছে−
আমার একজোড়া কুহেলী আঁখি।
নরম পায়ের নীচে ভিজে গেছে গ্রীষ্মের মাটি পলে-অনুপলে।
তবুও আমি এখনও একপলক উঠে দাঁড়িয়ে
মানুষের মত দু’পায়ে তো হাঁটি−বেদনা বোঝাই
তোমারই এক কালের একখানি প্রিয় নীল খাম।
মনিদীপা, ছিঁড়ে খুঁড়ে এখনও আমি এক নিশি
বেঁচে আছি তোমারই চেনা ডাস্টবিনে-
যেখানে দিনেতেও পানকৌড়ির কালো ঝাঁকের মত
নেমে আসে মনোযোগী অন্ধকার।
দুঃখবরণ
দুঃখ অমৃতেরই আধুনিক নাম।
দু’চোখে রাত মেখে আমিও সারাদিন আঁধারের সংসারে
একা একা ঘুরি−হই চিরায়ত অতিথি।
স্নিগ্ধ করুণ রাত−আমার কষ্ট করুণ কোমল ঝর্ণা।
বোঝে না সে কখনই বোঝে না−তার মিষ্টি অবহেলাও
গুছিয়ে ডেকে আনে আমার ঝকঝকে সোনালী বিনাশ।
ভেঙে যায় জল-স্বচ্ছ কাঁচের সংসার। মুহুর্তেই শুকিয়ে যায়
সুখের শুভ্র-নদী।
ভেতরের মাংসে কেঁদে ওঠে দীর্ঘ একটি নিশি, একটি শ্যামাংগী পাতা।
জল ছুঁয়ে জমে ওঠে রূপালী কষ্ট। রোদেলা দুপুরে উড়ে আসে
মাছরাঙার উড়ন্ত ডানার মত দুঃখের যমজ বাটি।
আমি নীরবে ঠোঁটে তুলি তা−সেখানেই ডুবাই গোলাপী অধর।
দুঃখ−হে আমার সুপেয় স্বর্গ পানীয় ;
হে আমার মনের রোদ ধ’রে নেমে আসা বিনীত শ্রাবণ ;
হে আমার কৌমার্য খুঁটে তুলে আনা ঠোঁটের করুণ কাঁপন ;
চোখের সব শেষ মিনতিতে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা জল---
দুঃখ−তরুণ অমৃত আমার ! আমার মায়াবী অতিথি−
ভাঙা সংসারে−
তোমাকে স্মৃতিময় রাঙা-অর জড়ানো
সোনালী অভিনন্দন।
কথা দাও
কথা দাও−একটিবার ফুলের পাপড়ি হাতে ফিরি−
মাটি ছেনে তুলে আনি অনন্ত মোহর,
পৃথিবীর সব বিপ্লব থামিয়ে দিয়ে
সূর্যকে বলি−
আঁধার সরিয়ে শান্তির ধুপছায়া দাও।
কথা দাও তো−নদী ডেকে আনি।
শুভ্র রাজহাঁসের শান্ত গ্রীবা এ পাপী হাতে ছুঁই।
পথিকের পায়ের তলায় আমি হই পুষ্পিত মাটি।
মাঘের মাঠে আমি কচি ফসলের মত হাসি।
গ্রীষ্মের উঠোনে আমি হই শ্রাবণের জল-থই ভোর।
গোয়ালের কাবিলাকে একবার ঘরে এনে তুলি।
কথা দাও তো−কথা দিচ্ছি, নীল বিষের ধারে
আমি আর যাব না।
তোমারই কালো চুলে আমি হব লাল-নীল-হিরা,
পাতার মত মেলে দিয়ে শাখে−
ধরণীতে ফুল হ’য়ে ফুটি।
আর হৃদয়ের তে খুঁড়ে,
করি শুধু মমতার চাষ।
সত্যিই কথা যদি দাও তো−
লালমিয়া মাঝিকে সারস পাখি
সবুজ বনে ছেড়ে আসতে বলি,
বিনিময়ে বনটাই নিয়ে আসুক ঘরে
পৃথিবী আবার মরু থেকে হোক বনভূমি।
কথা দাও কথা দাও−
একবার ফুল হয়ে ফিরি।
মালবিকা
মালবিকা তোমাকেই বড় বেশি মনে পড়ে।
নরম শিউলির মত সরল রঙে লেপে আছ তুমি
শৈশবের দীপ্ত প্রহর।
খোঁপা খুলে জেগে থাকা রাতের মত
কোমল স্মৃতিগুলো আজো তোমার শ্যাম-চুলে
উড়ে গিয়ে বসে।
আমার অনিদ্রা আঙুলগুলো
ছুঁয়ে যায় তোমার উঠতি অরুণাভ শরীর,
কোমল কমনীয় গ্রীবা−সুবর্ণ মালার মত।
গোলাপী বৃষ্টির মাধুরীর মত তুমি আমার অপূর্ব রাতের
স্বাতী-নত্র। কুমারী আকাশ ছুঁয়ে নেমে আসা তুলতুলে জ্যোস্না-নদী ;
একটি শ্বেত পায়রার অমৃত উড়ান।
মালবিকা তোমার কোমল কান্নাগুলি,
সবুজ পান্নার মত আমাকে অবুঝ ব্যাকরণে
মাঝ রাতে ছড়িয়ে ছড়িয়ে জড়িয়ে ধরে।
উচ্চারিত সাদা সত্যের মত আমার মর্মমূলে
অরুণ-কষ্ট এনে দেয়। আমাকে অভিশপ্ত সাতটি
ফুলের মত নিদারুণ আহত করে।
তোমার জলকন্যার মত স্মৃতিগুলো আমায়
বেদনার রাঙা-সাগর চিনতে শেখায়।
বুকের মনোময় জলে,
সাদা সারসের ঋষি-নিমগ্ন বেদনার−
শেষ ধ্যান ঢেলে দেয়।
তোমাকে ভাবতে গিয়ে হয়ত আমি একদিন
মৃত্যু মেখে নিথর মৃত্যুর দেশে---
মালবিকা তবুও তোমাকেই মনে পড়ে। তোমাকেই---
তাঁর সন্ধ্যা হয়
মাটিতে মাঘের আঁখি−
কয়েক ফোঁটা পৌষী কাজল ছিল
রূপালী নদীর পাড়ে।
সোনালী পরাগ ছিল বিকালের গোলাপী চোখে−
এসব কুড়াতে গিয়েই তাঁর সন্ধ্যা হয়।
স্নিগ্ধ রাত গুলোর হাসিতে জোস্নার নবীন গল্প ছিল
ফুলের কমনীয়তায় অলির অনুরণন−
আর মাঠের পারে কুহেলী পাখির বসত ছিল,
এসব কুড়াতে গিয়েই তাঁর সন্ধ্যা হয়।
নদীর পললে মাছের শৈশব ঝরে গিয়েছিল
সরল চোখে তাকিয়ে ছিল ভোরের আশ্বিন,
সবুজ পাতার হাসি ছিল গোলাপের বনে−
এসব কুড়াতে গিয়েই তাঁর সন্ধ্যা হয়।
কবির চোখে রাত জেগেছিল রজনী নামে,
শিশির গুলি শিশু থেকে ধীরে কিশোরী হল−
অনাথের কান্নাগুলো নীল জলে ছুঁয়ে গেল মাটি মার পা,
আর হাত গড়িয়ে মাটিতেই পড়ে গেল সোনার মনুষ্যত্বটুকু−
এসব কুড়াতে গিয়েই তাঁর সন্ধ্যা হয়।
একটি একাকী সন্ধ্যা
সুবর্ণ সন্ধ্যা, বালিকা বিকাল হাতে ধ’রে
চলে গেছে−নীল নদী পথে,
মাটির রথে নেই আর স্নিগ্ধ রাখাল।
এক নদী পললে ভেসে গেছে দু’টি কালো চোখ
জোনাকীর অভিমান ছিল যে চোখে−
আজ তাকে নিষিদ্ধ রাত্রি জানি।
অথচ শ্রাবণের মেঘ-জলে
একদিন সে নিটোল আউশ বুনেছিল এখানে
এই সুহৃদয় মাঠে।
এই আঙুলে করেছিল রাত্রি যাপন।
নগর ঠেলে দূরে খানিকটা দূরে
মাঠের মত খানিকটা মাঠ দেখি
নদীর মত কিছুটা সুনয়না নীল−
শুধু সুবর্ণ সন্ধ্যা, বালিকা বিকাল দেখি না।
দূর আকাশে কখনো দেখি নত্র পাড়ি দিয়ে
ব্যথিত পালকের একটি একাকী ডানায়
উড়ে চলে একটি একাকী সন্ধ্যা।
মোহনায় ফেলে যাওয়া অশ্রুগুলি
কবিতা-কুমকুমে রাঙানো ছিল যার সরল আঁখি;
দু’টি সোনালী বাহু−চলে গেছে সে।
দত্তক দিয়ে গেছে রাঙা বিরহ−দুঃখ তাই আজীবন পাঁজরে পুষি।
আর নিয়ে গেছে কোলে করে আমারই পরাণ ;
স্বর্ণালী সাঁঝের আঁচল−গোধূলির প্রেয়সী পাখি।
জন্ম-জন্মান্তর মেখে নেমে আসা ব্যথাতুর নীল−
চোখের কাজলেই কি সহজে মুছে ফেলা যায় !
নৃত্যের মত একান্ত নরমে তাই ভেঙে গেছে আমার সংসার ;
পদ্ম-পাতার মত চোখ মুছে নেমে গেছে নির্মম-সংসারি-জল।
রঙীন পালকে লেগে থাকা এক ফোঁটা চন্দনা ভোর ;
ফুলের চেয়েও অধিক সুগন্ধী সাদা কিশোরী ; আজ তাই
‘ছড়ানো চুলের মত’−নষ্ট অন্ধকারে জমানো কষ্ট মনে হয়।
তাই মোহনায় ফেলে যাই অশ্রুগুলি−
কালের পথিক কখনই তা পড়বে না জানি,
দুঃখ কি সত্যিই পরশ পাথরেরই নাম !
নাকি জীবন-জড়ানো ব্যথিত পলিমাখা একখানি ভুঁই !
নাকি চোখ থেকে নেমে আসা ফোঁটা ফোঁটা
দুখিনী স্বর্ণ-রেণু−
মায়াবী আঙুলে কেটে কত কাল আর তা তুলব
অকৃপণ দগ্ধ দু’হাতে !
দুঃখ-ক্রয়
সযত্নে আলগা করো দুঃখের দারুণ খোঁপা।
দুঃসহ দুঃখগুলো আবারও আমাকেই ঢেলে দিয়ে যাও।
গোলাপী আঙুলের ভাঁজ ভেঙে
কষ্টের শিমুল সুতোয় বাঁধ আমাকে !
তীব্র দহনে লেপে দাও আমার আসক্ত অভিলাষ।
দ্যাখো চেয়ে কাজল মেঘের পাশে হাঁটে মেঘের মেয়ে−
সেই একলা মেঘ মেয়ে কৃষ্ণ কাজল ক’রে
মাখাও এই ব্যথিত চোখে।
নরম নির্জন ঘরে আমি আরো বেশি একলা হলাম−
এবার মনকে শক্ত ক’রে তুলে এনে হাতের মুঠোয়,
হাতের বিষটুকু দাও−আমাকেই দাও।
চাই না বৃষ্টির মত যোগ্য মাধুরী−
বাতাবী লেবু ভরে জমে ওঠা অসহ্য সুখ,
অথবা অরুণ আলোয় হেসে ওঠা বাতায়নী ভোর−
না, চাই-না ।
চাই তারা সরল সুখী বোঁটা ধ’রে শাখাতেই থাক।
বরং আঁচল খুঁটে তুলে আনা তোমার দগ্ধ-দারুণ-দহন,
সোনার বাটি ভরে আমাকেই দাও,
রজনীগন্ধার কষ্টে বোনা তরুণ পাপড়ি আমি−
নিয়মিতই রূপালী দুঃখ কিনি জীবনের পাত্র ভ’রে।
আরো কিছু নতুন তারা
আকাশে ছড়িয়েছিল আরো কিছু নতুন তারা−
ছিল অরুণ বর্ণ পুব-মমতা।
ছিল তোমাকে খুঁজে পাওয়া পৃথিবীর প্রথম বাদল।
রাতের অরে ভেজা সোনালি সকাল ;
ময়ূরের পাখার মত নেমে আসা পাখি-পাঠশালা।
হয়ত ছিল আকাশের এক কোনে চামচ গুলে নেমে আসা
কিছুটা বেকার-সন্ধ্যা।
আকাশের বুকে কতবারই তো খুঁজেছি পাখি-পালক-গাঁথা
শালিকের সুশীল-সমাজ।
সময়ের অভিধান ঝেড়ে খুঁজেছি আরো কিছু তরল চুলের দোলা;
আরো কিছু আমনের বর্ধিত সুখের বাড়ি।
বার বার দোলা দিয়ে যায় তবু আকাশের পুব-মমতা ;
সমস্ত লালিত-সকাল। লোলিত-বরণ নারীর মত
দুয়ারে এসে দাঁড়ায়−মাঝে মাঝে শিরোনামহীন অসহ্য ভালবাসা ;
নরম শিশির দু’টি হাত−
রাতের নবীন ভোরে আরো কিছু নতুন তারা
খুলে দেয় হৃদয়ের মিষ্টি প্রহরা; মনের ফলন্ত গিঁট।
আর নতুন নীলের বুকে কাকলির কালিতুলে এঁকে যায়
আরেকটি নতুন−প্রিয়-দ্রাঘিমা।
চৈত্রে কে ফেলে গেছে মন
এখানে চৈত্রে কে ফেলে গেছে মন
আর একটি মাটির নয়ন।
আঁচলের মুগ্ধ শরম, এক কণা নীল-মাধুরী।
ধবল মাটির ফাঁকে ফেলে গেছে
দখিনা বাতাস ভেজা পাখির নোলক, সরল সোহাগ।
নরম বউয়ের মত নদীর বুকে
রেখে গেছে থই থই বুক উচু কুসুমিত জল।
রেখে গেছে একটি কুমারী কপোত
পুষ্পিত ফুলের ঠোঁটে।
বেণী বেঁধে রেখে গেছে আকাশের মেঘ, সুবর্ণ-সময়।
ঝর্ণার সাবালিকা জলে গুলে রেখে গেছে
ভিজে নারী মন, আর তার ঠোঁটের আধেক নরম।
ওইখানে মাঠের মাঝে রেখে গেছে
মাটির বালিশ, একটি মাটির কাঁথা
আর ঘাসের ভাঁজে বোনা একটি নবীন চাদর।
মাটির নতুন তীর্থে , চৈত্র সরোবরে
ফেলে গেছে ফুল, পাখি, পাখি-উৎসব।
এখানে চৈত্রে কে ফেলে গেছে মন
সে শুধু নেই−
চেয়ে আছে তবু তার মাটির নয়ন।
বিপ্লব রায় এর দু'টি কবিতা
আরোগ্য
জানি কিছুতেই আর নেই মনোরম সুসময়
কাগুজে নৌকার মতো সরল শৈশব ভেঙে
স্বপ্নগুলো আর তো খোঁজে না বুকের সহজ নোঙর।
যত জলছাপ চারুপাঠ ছিল ডিঙির শরীরে-
বাহুখুলে তারাও খুঁজে নিল দেখ
কৃষ্ণকলি জলের আড়াল।
খড়ের খসড়গুলো নিয়ে গেছে মাঘের বাতাস
প্রগলভ হয়ে ঝরে যাওয়া বটপাতা পুঁথি
কোথায় যেন হারিয়েছি- ধোপদুরস্ত শ্রাবণের সংসারে।
নখাগ্রে গাঢ় হয়ে বসে থাকে শব্দের পিপাসা
তবু গর্ভিনী রাতগুলো ফর্সা হয়ে কোলে নেয় কবিতার শব।
মনে পড়ে চাপান-উতোর শেষে
চুমুর তিলক এঁকে কেউ দিয়েছিলো বিজয় সম্মান।
সেইসব যতিচিহ্নহীন ভাললাগা কোথায় হারালো?
রক্তের ভিতর কই পার্বনের ধুম-লাগা লাল?
পদ্মপতার মতো করতলে সাপের নিঃশ্বাস-
কোথায় ছড়াবে তবে কবিতার বিনম্র পরাগ?
চাঁদের চামচ নেড়ে যে সেবিকা জোছনা ছড়ায়
জলপটি মেঘ দিয়ে শুষে নেয় ক্ষরার বিভ্রম
তাকেই তো বেসেছিলাম যতটা ভালবাসা যায়।
তবু কেন আয়ুর ফসল খেয়ে
তার্কিক ইঁদুরেরা ভ্রান্তির ভূগোল শেখায়?
সবুজ পুষ্টির মতো
বাঁধাকপির ভাঁজের মতো সাজানো কাপড়েই মানায়
বাদামের পলকা পাতায় গড়া গোলাপি ব্লাউজের নিচে
দুটি ফুটন্ত ফুলকপি,
সমস্ত শরীরে বেগুনের পিছলে পড়া পেলবতা।
বুঝেছি রক্তিম টমেটোর মতো মৌসুম এসেছে ফিরে
তার পাতলা যমজ ঠোঁটে।
সবজীওয়ালা নই,
যে তার তরকারি হৃদয় বেঁচে দেব মিথ্যে প্রেমের হাটে।
সে আমার বুকের মাচায় ঝোলা কচি লাউ-সুখ
একফালি তরমুজের মতো রসালো সোহাগ রাতে
বেগুনের কাঁটায় তীক্ষ্ণ কামনায় ভরপুর।
কুমড়ো ফুলের মতো স্নিগ্ধ গৃহিণীপনায়
প্রতিদিন ফুটে ওঠে শিশির স্নানের দেশে-
কাঁচা লঙ্কার ঢঙে বাঁকানো কটিতে তোলে
রসের ভাড়ের মতো ভরন্ত সংসার।
সে আমার সবুজ পুষ্টির মতো নিভৃত দয়িতা এক
শরীরের শীতের ভিতর ফসল ফলাতে জানে।
দিবাকর সরকার এর কবিতা
১। বেহুলা
বেহুলা চলে এসো, সন্ধ্যা নেমে গেছে, শীতের রাতে কেউ বাইরে থাকে না
তোমার আগমনী, শহর পেরিয়েছে, গ্রামও পেরিয়েছে, তিতিবিরক্ত
কিছুটা খবরের কাগজে ছবিতে, কিছুটা চ্যানেলের আওতাভুক্ত
বেহুলা চলে এসো, সন্ধ্যা নেমে গেছে, শীতের রাতে কেউ এভাবে ডাকে না
২। সন্ধ্যার আপন খেয়াল
সন্ধ্যার আপন খেয়াল। চাঁদ ছাঁকে অন্ধকার কাপে।
যে কেউই পড়তে পারে তার মন, তার মায়া
তাপে পরিতাপে।
সন্ধ্যার আপন খেয়াল। কাক যায় অন্ধকারে মিশে।
যে কেউই গড়তে পারে তার ঘর, তার বাড়ি,
শেষে, অবশেষে।
সন্ধ্যার আপন খেয়াল। আঁচলটা সরে প্রতিশোধে।
যে কেউই গিলতে পারে তার চোখে তার চোখ
রোধে, অনুরোধে।
৩। যুগল
গর্ভে ছড়াবোই রেণুর গুঁড়ো বীজ, রেণুরা ফুল হয়ে আবার ছড়াবে
তোমার গরবেতে, অন্য গর্ভেতে, নাভি ও মূলাধারে কেউ তো দাঁড়াবে
কেউ তো বলে দেবে তোমার নাব্যতা, আমার দাঁড় বাওয়া, মিশছে না
মিলন রয়ে গেছে শরীরে শরীরে, দেহ ও দেহভারে কেউ তো ডুবছে না
তপন বাগচী-র গুচ্ছকবিতা : যাত্রাকাহিনি
যাত্রাকাহিনি : এক
একজন যাত্রা করে দিনে-রাতে সকল প্রহর
একজন নেচে যায় ঝাপতালে লোভের মুদ্রায়
একজন সঙ সেজে কেড়ে নেয় নটীর খেতাব
একজন পারদর্শী পৌরাণিক চৌষট্টি কলায়।
পেটের দরদ-তাই পতিতারা সেবাপরায়ণ
দরদাম ঠিক হলে কারো সাথে ঝামেলা করে না।
পতিতারা পর নয়, বায়ুজলমাটির সন্তান
বংশ তার বহমান ধমনীর রক্তে যায় চেনা।
আঁচলের নিচে ঢেকে যৌবনের গোপন প্রতিভা
পতিতারা নাচে-গায় শহরের ছয়তলা রঙিন দালানে
এই তো দুমাস আগে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি
রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে-এই আলোময় খোলা ময়দানে।
পতিতারা ভালো আহা, তারা নয় মন্দ অভাগিনী!
কেবল পেটের দায়ে তারা করে রূপ বিকিকিনি!!
যাত্রাকাহিনি : দুই
চারটি বছর ধরে চিনি এক পুরুষ-পতিতা
বয়স ষাটের কাছে, টাক নেই, মাথাভরা চুল
শুনেছি সে ‘যেই পাতে খায়, সেই পাতে হাগে’ আর
সকল পাছায় নাকি সোজা করে ঢুকায় আঙুল।
দু’চরণ পদ্য লিখে পেতে চায় কবির শিরোপা
সিনেমা পাড়ায় তার ইদানীং বেশ যাতায়াত
চারজন সেবাদাসী সঙ্গে নিয়ে পতিত-পুরুষ
শিকারের খোঁজে-খোঁজে ইতিউতি ঘোরে দিনরাত।
পতিতারা ভালো-তারা নিষ্ঠা রাখে নিজের পেশায়
পুরুষ-পতিতা দেখি কালি মাখে মানবজমিনে
আমার মুখের থুথু তার মুখে সবটুকু ছুড়ি
তারপর শুরু করি নবযাত্রা কার্তিকের দিনে।
পুরুষ-পতিতা বড় হিংসাতুর মিচকে সেয়ানা
ভালবেসে কাছে ডেকে তি তার করে তেরো আনা।
যাত্রাকাহিনি : তিন
এইখানে বাসনার নিয়ত সমাধি
শেষরাতে জেগেছিল ডাকিনীর চর
তুমুল জমেছে দেখো শকুনির পালা
ঘুণ ধরা সমাজের কে দেবে কবর?
ঘর ভাঙা ঘরে দেখি নিহত গোলাপ
অচল পয়সা ছেড়ে নটী বিনোদিনী
সাতপাকে বাঁধা পড়ে গাঁয়ের বধূটি
কেউ এসে বলে নাই চিনি তারে চিনি।
এই দেশ এই মাটি বুড়িগঙ্গা-তীরে
কে ঠাকুর ডাকাতের নামে তুমি ভাই
আঁধারের মুসাফির দিনের ফেরার
মহুয়ার দেশে সাজো একতারা-সাঁই।
যাত্রা শুরু, পদধ্বনি বাজে চারদিকে
অলিখিত ইতিহাস যাই শুধু শিখে।
যাত্রাকাহিনি : চার
কানসাটে কনসার্ট বেজে ওঠে কার্তিকের শীতভেজা রাতে
কেটেছে মঙ্গার রেশ, ঘ্রাণ ভাসে অগ্রহায়ণের
এবার জমেছে দেখ মনাঞ্জলি অপেরার নতুন সংসার
আমাদের ভাঙা বুকে স্বপ্ন আনে দস্যু কালা শের।
জালিম সিংহের মাঠে প্রেয়সী আনার কলি একা নেচে যায়
জীবননদীর তীরে কেঁদে মরে ঘুমন্ত সমাজ
উত্তরবঙ্গের যুবা কে তুমি সাহসী প্রাণ ফকির বিদ্রোহী
তোমার দেখানো পথে নবযাত্রা শুরু হয় আজ।
খড়ের গাদার পাশে মাঠের চাঁদোয়া-তলে সুরের মদিরা
শুরু হয় রাত্রি জেগে কান্তিমোচনের আয়োজন
আবার নতুন ভোরে কেউ কেউ খোঁজ করে সোনার হরিণ
থামে না আলোর রেশ পোড়া মন হয় উচাটন।
হেমন্তের এই শুর বসন্তেও প্রবাহ অধীর
অবোধের মনজুড়ে জেগে থাকে লালন ফকির।
যাত্রাকাহিনি : পাঁচ
এই মঞ্চে আমি রাজা আমার কথাই আজ বেদবাক্য জেনো
আমি তো এখন নই ভাগ্যাহত যুবকের প্রকৃত প্রতীক
রঙ মেখে সঙ সেজে আমার মতোই জানি অনেকেই নাচে
কেউ কেউ আবড়ালে, কেউ কেউ লজ্জা ঝেড়ে প্রকাশ্য পথিক।
যাত্রা সকলেই করে, কেউ ওঠে খোলামঞ্চে হ্যাজাকের নিচে
কেউ খোঁজে কিছুটা আড়াল আর আলোময় আঁধারের জাল
কারো হাতে পানপাত্র সুধারসে মজে থাকে রাতের প্রহর
মুখস্ত সংলাপে কেউ রাত ভেঙে গড়ে নেয় কুয়াশা-সকাল।
নটীর অভাব নেই এ শহরে, বিনোদিনী তবুও অচেনা
শাড়ি খুলে বাহুলগ্ন নেচে গেয়ে সতী থাকে- আমি তারে চিনি
যেদিকে বাতাস পায় সে দিকে খাটায় জানি শাড়ির বাদাম;
দোষের সকল ভাগ একা নিয়ে বাসে আছে ভগ্নি বিনোদিনী।
যাত্রাকাহিনি : ছয়
আমি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ি তখন ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে’ মুখস্থ করেছি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের তিনটি দীর্ঘশ্বাসের কথা জেনেছি বাংলার শিক অনিলকৃষ্ণ দত্তের কাছে। এক. মাইকেল রোজগার করতে চেয়েছিলেন কোটি-কোটি টাকা, তা হাজারে-হাজারেও হয়নি। দুই. হতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ কবি, হলেন স্বল্পপ্রশংসিত বাংলা কবি মাত্র। তৃতীয় দীর্ঘশ্বাসের কথা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। এই দীর্ঘশ্বাসে বা খ। ক্ষেদোক্তির মধ্যে অনেকটা বিনয় আছে। মাইকেল রোজগার করেছিলেন কিংবা করতে পারতেন, তবে তা ধরে রাখার চেষ্টা করেননি। আর স্বল্পপ্রশংসিত বাংলা কবি মাত্র নন, বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠকবি হিসেবেই ইংরেজদের কাছে তাঁর নাম পৌঁছে গেছে।
এই মাইকেলকে একদিন দেখার সৌভাগ্য হলো কদমবাড়ী গনেশ পাগলের মেলার মাঠের যাত্রামঞ্চে। সেই চুল, সেই দাড়ি, সেই ধোপদুরস্ত পোশাক, সেই উচ্চারণ। জীবনী পড়ে যে চেহারাচিত্র মনের মধ্যে এঁকেছি, তা থেকে ব্যত্যয় হয়নি। মাইকেল হেঁটে আসছেন, কথা বলছেন, জলচৌকির ওপর বসে তিন টিকিধারী পণ্ডিতকে ডিকটেশন দিয়ে একসঙ্গে তিনটি কাব্য লিখছেন। পণ্ডিতদের ভুল সংশোধন করে দিচ্ছেন। মহাকবি মাইকেলকে দেখে জনম সার্থক হয়ে গেল! অভাব-জর্জরিত মাইকেল যখন দেবকীর কাঁধে হাত রেখে যখন বললেন ‘দেবকী তোমায় আমি দেব কী?’ অলঙ্কারশাস্ত্রের পাঠ না থাকলেও ‘দেবকী’ আর ‘দেব কী’ শব্দের উচ্চারণ-সাজুয্য এবং অর্থ-ভিন্নতা আমার কানে তখনই সুধা বর্ষণ করে। আমি মাইকেলের কবিত্বের আকর্ষণ টের পাই আমার ভেতরে। শব্দের খেলায় মেতে উঠতে মাইকেল আমাকে ডাকে। মেলার মাঠের যাত্রামঞ্চ আমাকে ডাকে। ঘোরের মধ্যে ডুবতে-ডুবতে বাড়ি ফিরি।
পরদিন বিকেলে স্কুলের পাশের রাস্তায় শিশুকন্যার হাত ধরে দাঁড়িয়ে একজনকে কথা বলতে শুনি। ঠিক মাইকেলের কণ্ঠ। পাশের এক বন্ধু আঙুল তুলে বলে, ‘আরে ওই তো কালকের মাইকেল! অমলেন্দু বিশ্বাস।’
অমলেন্দু আমার কাছে আজকেরও মাইকেল। যাত্রামঞ্চে মাইকেলকে দেখেছি। রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখেছি অমলেন্দুকে। অমলেন্দুই আমার জীবনের মাইকেল।
যাত্রাকাহিনি : সাত
কার্তিকী মেঘ ভিজিয়ে দিয়েছে রিহার্সেলের বাড়ি
আমরা দুজন প্রতিদিন বসি মুখোমুখি আড়াআড়ি
তুমি সুলতান মঞ্চেই নও হৃদয়ের সিংহাসনে
এই ঘোষণা আগেই দিয়েছি চোখের চতুর ভাষণে।
তবু কেন সংলাপে জোর নেই, কেন মিছে সন্দেহ
কেউ কি কখনো দিয়েছে কাউকে একসাথে মনদেহ?
আমি প্রস্তুত, মন তো দিয়েছি, দেহ আর কত দূর
রিক্তানদীর বাঁধ ভেঙে করো হনন মহিষাসুর।
আমি প্রস্তুত পরাজিত হতে যুদ্ধের ময়দানে
বিজিতের কী যে সুখ-প্রশান্তি, বিজয়ীরা তা কি জানে!
যাত্রাকাহিনি : আট
যাত্রা শুরু।
কনসার্ট বেজে ওঠে খোলামঞ্চে
গ্রিনরুমে হ্যাজাকের উজ্জ্বল আলোয়
মেকআপ নেয় কুশলীরা
যাত্রা শুরু।
রাজারানি নেই আজ
কেউ হয় গরিব কেরানি আর
কেউ হয় মেধাবী সুজন
ধনীর দুলালী এসে অর্থমূল্যে কিনে নেয়
কেরানির ভরসার স্থল।
যাত্রা শুরু।
ভোগ শেষে পড়ে থাকে
সুজনের গরিব শরীর।
বাবা তার বসে আছে ঘরের দাওয়ায়
মা গেছেন রোগেভুগে পরপারে একা।
যাত্রা শুরু।
দুলালীর রূপ ফিকে হলে
ফিরে আসে সুজনের কাছে
অনেক চোখের জলে
অনেক কালের দামে
দুলালীর ঠাঁই হয় সুজনের ঘরে
মহাসুখে কেঁদে ওঠে কেরানির বুক।
যাত্রা শুরু।
যাত্রা শুরু।...
যাত্রাকাহিনি : নয়
‘আকাশে চাঁদ জাগে আরো জাগে হেনা’...
এমন গানের তালে নাচের মুদ্রায় তুমি জেগে উঠেছিলে
আর কেউ কেউ জেগেছিল সারারাত
রাতজাগা রাতে কারো কারো কানে বাজে
‘আমার এ দুনয়নে ঘুম তো আসে না’...
নাচের মুদ্রায় তুমি মঞ্চ নয় মন মাতিয়েছো।
নাচের স্কুলে তুমি যাওনি কখনো
তোমার দেহের ভাঁজে খেলে যায় নাচের ঠমক
ফাইভফিফটিফাইভ রত্নাও হার মেনে যায়।
তুমি কোনো যাত্রাদলে যাওনি কখনো
তোমার চোখের বাঁকা চাউনির ঠার
কিওপেট্রাবেশী শবরী গুপ্তাকে মনে এনে দেয়।
তুমি সংসারেই আছো
রঞ্জন দেবনাথ বুঝি তোমার কথা ভেবেই
‘নন্দরানীর সংসার’ লিখেছেন।
নন্দরানীর সংসারে সুখ এসেছিল
সুখী হও নন্দরানী।
তোমার কাহিনি নিয়ে লেখা হোক
‘সংসারে সঙ সার’ পালা!
যাত্রাকাহিনি : দশ
আজকের নবযাত্রাদিনে আমি তোমাকেই মেনেছি নায়ক
ঘনঘোর রাত্রিপথে আমাকে কে সঙ্গ দেবে জানি না হদিশ
সহে না সহে না আর একাকীত্ব, বড় দায় যন্ত্রণাদায়ক
কাছে এসে হাত ধরো, আনন্দে উঠুক মেতে ভরা মজলিশ।
বুকের ক্রন্দন ঢেকে দুই চোখে মেখে নিই জলরঙধারা
হাসির গমক বুঝি ঘাই মারে কারো কারো বন্ধ দরোজায়
রাতের প্রহর কাঁপে, পেঁচকের ডাকে নাচে সবুজ পাতারা
হ্যাজাকের নিবু আলো কোন দূরে ডেকে নিয়ে যায়!
যে ছিল পরাণসখি, তারে আমি দিগি¦দিক পাই নাই খুঁজে
আমার কীসের দোষ, খিলিপান সাধে যদি অচেনা নাগর
আমি তার হাত ধরে একা একা যেতে যাই খড়ের গম্বুজে
আমি তো ডোবায় তুষ্ট, এনে দিতে বলি নাই অসীম সাগর।
মঞ্চের মায়ায় নাচি, কোনোদিন হই নাই সলাজ নায়িকা
নিজের কপালে মাখি একা একা অমোচনী বৈজয়ন্তী টীকা।
যাত্রাকাহিনি-এগার
কী রসে মজিলা সই, কারে কই প্রাণের বেদনা
বুঝি নাই কোন দিকে টোল খায় রাতের মাচান
কুর্দনে কি ফেটে পড়ে ঝুমঝুম রাতের চাঁদোয়া
নটরাজ দেখেছে কি ঘুমচোখে প্রগাঢ় মদিরা!
রসের কলস ভরে প্রতিদিন ছড়াই দুহাতে
কেউ এসে কাছে বসে তোলে নাই তৃপ্তির ঢেঁকুর
কেবলি অপূর্ণ সুর নেচে যায় নাড়ার পালায়
নিত্যানন্দ চুপচাপ জীবিকার মোহন পরশে।
সজ্ঞান ঘোষণা করি-কারো মনে দিই নাই দাগা
আমার পাপের বোঝা তবু নাকি বেড়েই চলেছে
কখনো হইনি কারো বিন্দুসম ক্ষতির কারণ
পুণ্যের আশায় আমি বাঁধি নাই জনারণ্যে ডেরা।
মঞ্চের মায়ায় আমি রঙ মেখে শুধু নৃত্য করি।
মোহমুগ্ধ কেউ কেউ ভাবে বুঝি শিল্পের অপ্সরী!
যাত্রাকাহিনি-বার
শীতরাত এই মঞ্চ আমাকে উতলা করে দারুণ প্রকোপে
কখনো নবাববেশে কখনো-বা সাধুসন্ত ফকির লালন
কখনো-বা বীরদর্পে তলোয়ার নিয়ে করি মিছে আস্ফালন
মঞ্চের প্রতিভা আর নিজগুণে কতটুকু টিকে থাকে ধোপে?
প্রতিরাতে মঞ্চে উঠি তবু দেখি কাটে নাই মঞ্চমায়াঘোর
আমাকে শিখতে হয় কণ্ঠবৃত্ত লয়মাত্রা উদারা মুদারা
প্রতিদিন একমঞ্চে একমন্ত্র শিখে-শিখে একা হই সারা
কখন যে রাত হয়, কখন যে হয়ে যায় অশ্রুমুখী ভোর!
কে না জানে সবচেয়ে বড় মঞ্চ আমাদের সংসারের ঘাড়
সকলেই সেই মঞ্চে চুপিসারে সাধ্যমতো করে রঙ্গলীলা
কেউবা পাহাড়ে ওঠে কেউ কেউ পাড়ি দেয় মৃত্তিকার টিলা
দর্শকবিহীন সেই অপরূপ শিল্পক্রীড়া জীবনের সার!
যাত্রাকাহিনি-তের
চোখের নিচে কালো দাগ
এ-আমার অনিদ্রাকুসুম!
ঘুম থেকে জাগলেই নগ্ননৃত্য দেখি
দৈনিকে রাখি না চোখ
নিগ্রহের দাগে ভরা প্রতিটি অক্ষর!
জানি, এখন প্রকল্প ছাড়া কিছুই হয় না।
নাচের অনুষ্ঠান করতেও
প্রকল্পপত্র জমা দিতে হয়।
যাত্রাশিল্প বাঁচাতেও লাগে
সুশীল সেমিনার, মানবিক প্রাক্কলন!
লঘুগুরু নির্যাতনের সংবাদ ছাপাতে
কিংবা না-ছাপাতেও লাগে প্রকল্পের ধারণা
পরিবেশ ধ্বংস করার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে
পরিবেশ রক্ষায় তৈরি হচ্ছে নতুন প্রকল্প।
আকাশের নির্মলতা ঢেকে দেয়
বৃক্ষধ্বংসের মেঘ
নিঃশ্বাসে ভরে নিচ্ছি বিষের মায়া।
জানি, এখন প্রকল্প ছাড়া কিছুই হয় না।
যাত্রাকাহিনি-চৌদ্দ
শীতরাত এই মঞ্চ আমাকে উতলা করে দারুণ প্রকোপে
কখনো নবাববেশে কখনো-বা সাধুসন্ত ফকির লালন
কখনো-বা বীরদর্পে তলোয়ার নিয়ে করি মিছে আস্ফালন
মঞ্চের প্রতিভা আর নিজগুণে কতটুকু টিকে থাকে ধোপে?
প্রতিরাতে মঞ্চে উঠি তবু দেখি কাটে নাই মঞ্চমায়াঘোর
আমাকে শিখতে হয় কণ্ঠবৃত্ত লয়মাত্রা উদারা মুদারা
প্রতিদিন একমঞ্চে একমন্ত্র শিখে-শিখে একা হই সারা
কখন যে রাত হয়, কখন যে হয়ে যায় অশ্রুমুখী ভোর!
কে না জানে সবচেয়ে বড় মঞ্চ আমাদের সংসারের ঘাড়
সকলেই সেই মঞ্চে চুপিসারে সাধ্যমতো করে রঙ্গলীলা
কেউবা পাহাড়ে ওঠে কেউ কেউ পাড়ি দেয় মৃত্তিকার টিলা
দর্শকবিহীন সেই অপরূপ শিল্পক্রীড়া জীবনের সার!
যাত্রাকাহিনি-পনের
সেচযন্ত্রে ধরণীরে করা যায় নিতান্ত সবুজ
কিন্তু তুমি ধানেক্ষেত কবিতার কুসুম ফলাও
তুমি তো বিধবা নও, নও তুমি কুমারী অবুঝ
কেন তবে কান্না মেখে রৌদ্রময় একা হেঁটে যাও!
তোমার সামনে আছে মালবিকা, সুপ্রিয় কুসুম
তুমি তো বেহুলা নও, কেন যাবে ইন্দ্রের সভায়
কার জন্যে নৃত্যগীত সাজিয়েছ, হারিয়েছ ঘুম
নিটোল প্রান্তর জুড়ে বৃষ্টি হোক, প্রশান্তির দায়।
আমি এক ছন্নছাড়া ছন্দপ্রেমী শান্ত প্রতিবেশী
আক্রান্ত সুরের ছটায় শুধু তুমি ঘাই মারো বুকে
আমি তো চিনি না এতে কার লাভ কার তি বেশি
জানি শুধু পৃথিবীতে কেউ কেউ আছে খুব সুখে।
আহারে রে সুখের দিন, খুলি তোর মগ্নতার ভাঁজ
সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বলো কোনো কালে মানে কারুকাজ?
যাত্রাকাহিনি-ষোল
তালিকা বানাই চলো, দু-কলাম জুড়ে লিখি নাম
সুন্দরের ধ্যানমগ্ন সেই সব দুধসাদা বক-
মৎস্যের লোভে যারা অবিনীত এক পায়ে খাঁড়া
যাদের নামের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ে গুণিতক।
এরাই তো দ-মু-, এরাই তো সাক্ষাৎ বিধাতা
বুড়ে যায়, জুড়ে বসে-কাকলিতে মাতায় জমিন
কেউ কেউ স্থিরলক্ষ্য নিয়মের মৌল ব্যতিক্রম
তারাই মেটায় কিছু চুনোপুটি-বহুরঙা মীন।
কিছু বক উড়ে যায় শিকারীর মৃদু ফুঁৎকার
আসুন তালিকা থেকে বাদ রাখি কিছু সাদা নাম
এখনো যাদের পিঠে খাঁড়া আছে মেরুদ-খানি
তালিকা ছাড়াও যারা নিরিবিলি বাঁচে অবিরাম।
নাম লিখি, ছিঁড়ে ফেলি, পূর্ণ করি কাগুজে তালিকা
কিছু নাম ঝরে যায়-হয়ে ওঠে শুভ্র শেফালিকা।
যাত্রাকাহিনি-সতের
বেড়ালের পায়ে পায়ে রাত্রি এসেছিল
শীতঘুমে একটি জীবন যদি করা যেত পারে!
পেচকের কান্না শুনে দুটি কান কত ভারী হবে?
বেড়ালের পায়ে রাত্রি গাঢ় হয়
দূর থেকে ভেসে আসে তকের গান
হুহু করে ছুটে যায় ভেতর-বাউল
বেড়ালের পায়ে পায়ে রত্রি চলে যায়
দুচোখে ঘুমের দাগ লেগে থাকে তবু
শুশুকের নাচ দেখে কাটাই সময়।
যাত্রাকাহিনি-আঠার
বোশেখি মেলার ভিড়ে
হারিয়ে ফেলেছি আহা কাগুজে মুখোশ
আমার ছেলের প্রিয় এইটুকু খেলার সামগ্রী
আমি তারে খুঁজে ফিরি দূর্বাঘাসে অবেলায় আজ।
হয়তো কিনতে পারি আরেক নতুন ...
কতই-বা দাম তার!
কিন্তু আমি পেতে চাই হারানো পুরাণ
সন্তানের ছোঁয়া আছে মুখোশের মুখে
এভাবেই ব্যবহার্য সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যায়।
মুখোশের জন্য আজ কত কেঁদে মরি
কত যে মুখের ছবি হারিয়ে গেছে
আমি তার হিসেব রাখিনি!
যাত্রাকাহিনি-উনিশ
না গেলে হবে না
এমন ধারণা প্রচারের পরে
না গিয়ে পারি না।
এ-ও সত্য যাওয়া-না-যাওয়ায়
কিছুই আসে-যায় না।
মধুমতীর জলের প্রবাহ তাতে
একফোঁটা হেরফের হয় না।
গেলে ভালো লাগে, তাই যাই
না গেলে কে নেবে কাঁধে তুলে
স্মরণের দায়
কারো জন্য কিছুই বসে থাকে না
সময় যায়, স্রোত যায়,
ইচ্ছা যায়, স্বপ্ন যায়
আমি তাই না গেলেও চলে!
যাত্রাকাহিনি-কুড়ি
পাহাড় শব্দের মানে কেবলই উত্থান
কেবলই আকাশ ছুঁতে প্রসারিত হাতের নাচন
সরিষার তে থেকে যতদূর দৃষ্টি দিতে চাই
কেবলি হলুদরঙ
আমাকে বসিয়ে দেয় ধ্যানের পিঁড়িতে।
আধবোঁজা চোখে দেখি
পাহড়ের খাঁদ বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে
অশরীরী ঝড়ের মাতম!
কেথায় যে নেমে যায়
আমি তার ঠিকানা জানি না...
আমার কেবলি ক্ষয়
ফোটা ফোটা অম সঞ্চয় নিয়ে বসে থাকি
পাহাড়ের কোল বেয়ে কোনদিন আসে যদি
একটি শালিক!
যাত্রাকাহিনি-একুশ
বারান্দায় শুয়ে থাকা কিছু ধুলোবালি
একফাঁকে ঢুকে যায় ঘরে
সাজানো বইয়ের তাকে খুঁজে নেয় নিশ্চিত আশ্রয়
আমার বৌয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে কতদিন থাকা!
একদিন সব ধুলো ঝরে যায় ঝাঁটার আদরে।
এইসব ধুলোবালি, এই সব মার্জনার কথা
আমি আজ লিখে রাখি বলপেনে কাগজের পিঠে।
বই থেকে জন্ম নেয় ধুলোর পাহাড়
একদিন পাহাড়ের কোলে শুয়ে
চোখ মেলে দেখে নেব আকাশের বিশাল বিস্তার!
যাত্রাকাহিনি-বাইশ
আজ যদি না-ও ওঠে রোদ
ছাদের কিনারে এলিয়ে দেব সমস্ত বিকেল
টবে রাখা ফুলের কলিরা যদি হেসে ওঠে মেঘ দেখে
তুলসির পতাগুলো যদি নেচে ওঠে
আমার তাতেই যত সুখ।
কেতকীর গালে কোনো সনাক্তযোগ্য দাগ নেই
তবু তারে সবটুকু চিনি
তার এলোকেশ ছড়িয়ে দেয়া বিকেল
অনেকদিন উপভোগ করা হয় না।
রাধাচূড়ায় রঙেও দেখি ফাঁকি!
এইসব দেখতে দেখতে বিকেলের কাছে
আমাদের সকল সমর্পণ!
পরিতোষ হালদারের কবিতা
পৃথক খনিজ
কার কাছে নতজানু হই, রেখে যাই বিপন্ন রাতের আমুল প্রার্থনা। হেলেঞ্চা লতার বনে শিশিরের মুক্তি ও মৃত্যুর ঘ্রাণ। তীব্র উষ্ণতায় গলে শতাব্দীর আম্রপালি তৃষা। এই নাও ইহজন্মের প্রথম পরম, যারে বেঁধেছিলাম শূন্যতার গোপন সূতায়। প্রতিদিন উড়ে যায় গন্ধর্ব পরাগ- ঘুম বদলের প্রাচীন কাহানী। হাজার বছর শুয়ে থাকে মৃত্তিকা ও কালো অন্ধকার- একই আগুনে পোড়া পৃথক খনিজ। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাসের অরে নৈঃশব্দ লিখে রাখি, লিখে রাখি বিবর্ণ রাতের নিশা। গোলপাতা বনে মায়া হরিণের একটানা চিরল উৎসব। অববাহিকায় নেমে আসেন ঊর্বশী। পায়ে রাঢ় বাংলার নদীর মুদ্রা। স্রোতগন্ধে ভেসে যায় জন্মান্তরের মাতাল ছায়া। ও গাঙবালা- কোন পাহাড়ের বউ তুমি, না কী প্রেমভর্তি বিপুল পলল।
নৈঃশব্দ্যের বাড়ি
এরপর তৃষ্ণা এলে আমি পান করে নেবো ক্যানভর্তি ঘুম। গোয়েন্দার কাছে ফাঁস করে দেবো আপেলতত্ত্ব আর পতনের লাল ডায়েরী। নারীকে প্রীতিভোজে ডেকে পুরষ নয় দেখাবো জল ও দীর্ঘশ্বাসের পাথর। এইভাবে সব উড়াল অংক সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নেমে যাবে। আর একটা শাদা বাড়িতে কী সুন্দর বাস করতে থাকবো আমি একা, অন্ধকার। তুমি কাঞ্চি পাথরে শরীর আঁকতে আঁকতে হয়ে যাবে যুগল দহন-চপল প্রতিক্ষা। সময়ের সোমরাতে এসো, মুগ্ধ নিষেক ছুঁয়ে ডাক দিয়ো-আমি দিয়ে দেবো আমার নৈঃশব্দ্য।
দীর্ঘশ্বাস ও কালোপাথরের ফুল
ছেড়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে নদী। নদীর জলে কালোপাথরের ফুল। কুয়াশায় হাত ছোঁয়ালে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে এক কোটি ঢেউয়ের বাজনা। এমন কোন রাত্রী ছিলোনা যাকে বলোনি জননী। এখন দিনের বিপরীতে তুমিই সফল সময় আলগা আকাশ ডাক দেয়, যেন ত্রিরত্ন রমনী। তুমি চন্দ্রগুপ্তের ঘোড়ায় চড়ে ফিরে যেও প্রাগইতিহাস থেকেও দূরে। আমরা থেকে যাবো আরও কিছুদিন আর দীর্ঘশ্বাসের মতো পোড়াতে থাকবো শাদা শাদা নৈমিত্তিক মোমবাতি।
দ্বাদশ তৃষ্ণা
ডুবসাঁতার থেকে জেগে উঠে দেখো চতুর হাওয়া বইছে বুকে। কাঁচভাঙ্গা শব্দের টুকরো টুকরো জীবন, চায়ের টেবিলে দ্বাদশ তৃষ্ণা। পূর্নদীর্ঘ পথের ওপাশে শুইয়ে আছে কমলাক্ষী ঘুম। কচ্ছ বণিকের মতো জল, টান ভর্তি জোয়ার। চৌষট্টি নন্দন ছুঁয়ে থাকি, হাতের মুদ্রায় কৌণিক জ্যামিতি। একজোড়া উড়াল ডানায় কতোটা সুদূর থাকে, ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যায় প্রজাপতি ও তুষার। নীল অন্ধকার গায়ে কে তুমি পাথর, দীর্ঘশ্বাসের নামতা পড় রোদের চাতালে। সূর্যের পুঁজি থেকে প্রথম চন্দ্রগ্রাস তোমাকে দেবো, তুমি দশ আঙ্গুলে বাজিয়ে যেও শুন্যের সানাই। পকেটে সূর্যাস্ত নিয়ে দৌড়ে এসো, রেলগাড়ীর মতো তোমার শরীর, কেমন কু-ঝিকঝিক গন্ধ।
প্রথম জল
কথা ছিলো মৃত ছায়ার কাছে শুয়ে রবো; এই গাঙপাখি সন্ধ্যায়- তুমি আমি খুব নীরবতা। কতোটা আধার পেলে একরাত একা হয়ে যায়। নিজস্ব শাড়ির আড়ালে বিপন্ন বেহাগ, কেঁপে ওঠে চাঁদের গহন। দূর কোন অতিতের কোন পাখি পাতাখসা উষ্ণ নিয়ে উড়ে যাবে আরো দূর ইপ্সিত অন্ধকারে। নরম নৈঃশব্দ্যের মতো আমিও হেটে যাবো প্রগাঢ় তৃষ্ণার দিকে। কে আমার প্রথম জল, প্রথম অগ্নিমালা। কার কাছে আবার হারাবো, ভেসে যাবো সহজ তরলে।
উছল
রাত নামে, ছুঁয়ে যায় কামরাঙা নদীর আঁচল। কিছুদিন বৃতলে ছায়া হয়ে কাটিয়েছি মহুয়ার কুসুম নেশায়। পরাঙ্গী ধানের গন্ধে কতবার হারিয়েছি কৈশোরের নবান্ন সকাল। হেমন্ত উড়াল দিতো ধনেশের ডানায় ডানায়। আমারও পিদিম ছিলো, জ্বালিয়ে রাখতে গিয়ে নিভে যেতো প্রতি পূর্ণিমায়। পাখিদের বিমগ্ন শরীরে মিহিদানা চাঁদের পরাগ। কতটা বাঁধবে তারে, টপ্পার আসর থেকে যে সময় পালিয়েছে একা। যে সময় ফাঁকি দিয়ে নিয়ে গেছে কুমারী প্রাচীন- ছাতিমের প্রহর মৌনতা। তুমি যাই বলো অহল্যা জীবন ছেড়ে কোথাও যাবনা, আমিও পাথরে পাথর হয়ে শুয়ে রবো দ্রাবিড় ধূলিতে। তুমি প্রাণ খুলে ডেকে যেও, ডেকে যেও বুকের সারস। জলাঙ্গী কী দেবে জল, রাতপোড়া রোদের উছল।
অন্য দীর্ঘশ্বাস
এগার আখর ডাকে, খরাবৃক্ষ নৃজন্ম শোনায়। নিশিথ প্রহর জুড়ে দৃশ্যলাজ- অধরা স্বজন। কার বুক ছুঁয়ে আসে পোড়াকষ্ট অভিমানী হিম। নদীরাত বড় হয় ডেকে আনে চতুর জীবন। পাখির পালক খসে পড়ে ঘাসের সকাল। হরিণেরা ছেড়ে যায় নীল উপবন, তার চোখে কোমল গান্ধার। স্বপ্নচাকা গড়াতে গড়াতে নদী হয়। নদীর পাগলা জলে চাঁদের ঝিলিকবাজি-দীর্ঘতর রাতের বুনন। অপার মুলুক ছুঁয়ে আমলকি সবুজের দেশ, কেঁপে ওঠে বউঘুম, ঘুমের মৃত্তিকা। সোনার কাঠি বদলে যায়- রূপার কাঠি বদলে যায়...। মাঠময় অমরতা ঝিরঝির নওল বিকাশ। একজন পান্থ হাসে বুকে তার অন্য দীর্ঘশ্বাস।
ছায়ামন্ত্র
যেখানে যাও না কেন যেতে হবে জলের ওধারে। রাতভাঙা জন্ম নিয়ে পাখি ওড়ে, পাখিদের পুরুষভ্রমণ। উড়ে যায় ফুল- বুকের তুষার; পাথরের মাঝে কাঁদে ধ্যানমগ্ন মেঘ। সমুদ্র দেখেনি তবু চোখে কার আসমুদ্র তৃষা। ও চাঁদ... ডুব দেও জলের গভীরে, জলকে কুমারী বলে ডাক। জেনে রেখ জল কভু জানে না ছলনা। ছায়ামন্ত্র শেষে কোন মৃত্যু জাগে জল ও কবির।
চলো
বাকি পথ হেঁটে যাই চলো। যেতে যেতে যদি পাই পথের উদাস। মানকুমারীর চোখে বিচুর্ণ রতি, নিষাদ দৃষ্টিতে যোজন আকাশ। সুনীল পাতার নীচে দূর খোঁজে পাখিদের ঝাঁক, বাতাশে বাতাশে মেঘ বদলের চিঠি। প্রান্তরে আলোর ছায়া, আলো কি রাতের অসুখ! সব দিকে যতোটা সবুজ ভাবি তার তেকে শাদা বেশী। যুথবদ্ধ জীবন কেবল অন্তলীন। অরণ্যের ওপাশে ঈষৎ জলমগ্ন শিশির ও চাঁদ। চলো লভেদী রাত্রি হাঁটি, পাথরজঙ্ঘা পাড় হয়ে যাই। পেছনে বিস্ময় ছিল; আমি তার অংশ অংশ কুড়িয়ে এনেছি, এই নাও শাদা গন্ধ ঘুমের পালিশ। সামনে কী আছে দেখতে দেখতে যাই, চলো দেখতে দেখতে যাই....।
অরবিন্দ চক্রবর্তীর কবিতা
ঝড়ে ঝরে কুমার গাঙে
ঝরা সমগ্র জড়িয়ে শরীরেও মেখেছি মেঘলা
যেন উলঙ্গ না বলে কেউ
অথচ পাতা যে জেনে ফেলেছে চতুর্থ গোপন
এবার চিরেকোঠায় তাকে থাকে যত্নসমেত
তুলে রেখেচি ভাঁজ....
এরচে ও বাওকুরারি খোয়াব, তোমাকে দেইনি পাত্তা
এখনও নয়, ঝড়ে জলেও ঘূর্ণি ঝরিয়া
আমিও ছুটেছি পুর্ব পড়শি কুমার গাঙে।
টিনএজ ট্রেনে শিকার বিষয়ক
চোকের পর্দা এচাঁলে মনে হয় মুদি তার তুলে নিচ্ছে শাটার
চোখের পর্দা নেভালে- মনে হয় অপরাধি বালক তার
কিশোর অপরাধে দুষ্ট হাওয়ায়
ওঠবস করছে আততায়ী বালিকার বিনোদিত উঠোনে।
ঘীনমন্য এই দৃশ্যশব দেখে
আমি কুমার পুত্র হেঁটেই যাচ্ছি
জেব্রাক্রসিং ডোরাকাটা আরণ্যক পথে।
য়েন শিকারি টিনএজট্রেনে কাটানা পড়ি আর।
দৃশ্য খুঁজে মগ্ন হদিস
যে দৃশ্য সামনে দাঁড়ানোর কথা ছিলো- চলেও গেছে
যোজন দুরে
একন এর ছায়া খুজি
হেঁটে যাওয়া চিহ্ণ উপকূল
ঐক্যের হাত বাড়ালেই এগিয়ে দেবে মৈত্রীবন্ধ
অথচ একটা কালো বেড়ার লাফিয়ে ওঠে
ভৈঁররাগে- আমার পাজরে
এর হুলস্থুল কা- বৈভবে
আমি যেন দাঁড়াতে অক্ষম।
দ্দধু মগজের কোষে কিলবিল মাতলামি তোলে
আরেক উন্মাদ
ফলে রাতকানা চোখে দিনজ্যোস্নায় আদিম গোধূলি খুঁজি।
খুজে খুঁজে নিজেই হারাই নিজউদ্দেশ মগ্ন হদিশ।
ছবি ও গোপনতাকামী
ছবির পাঁজরে ছবি এঁটে দেহভাণ্ড গোপনতাকামি
ঊপসনাগুলোর কোষে মিলনস্ফুরণ ঘটে কিনা
পেবিকরজুরেও দিই
দেখি ক্ষতের গভীরেও ক্ষয় রোগ
কীর্ষ আবেগে ছুটিয়ে তুরছে
আড়িয়াল খাঁ নদী..
তার পরান ও আমার হৃদয়ে
ফুটিয়ে চলছে নিরুদ্দেশ চির
যেন আগ্নেয় ফাটল
ক্রমশ সনদ সহি লিখবে
বেদনা বিচ্ছেদ।
ঐক্যের মরমী ক্ররতা মুখে
ফুটে উঠছে লকলকে জিভ
এর ভবিষ্য ছোবলে ছুঁইয়ে দেবে
চির সনাতন প্রত্নদাগ।
যাকে ঘিরেও একদিন তোমাকে উদ্বোধক করে পরবাসীজন
জমকালো প্রদর্শনী দেবে।
বুর্জোয়া স্বপ্নকে মদ্যপ পানে শ্রীল সত্যকে অপমান
মিথ্যেরও সৌন্দর্য বহু; ওরা কুচি ভাজে শাড়ি পড়ে
সমভ্রান্ত বুকের তালে
কোমর বেঁধে দোদুল নেচে যায়।
এসব নিতম্ব মুদ্রা দেখে
ভৈঁরবী নেচে গেয়ে যায় উরোজ সংগীত।
ফলে, পর্দার ওপারেও যারা লুব্ধক পরশ্রীদল
পরলোক মেকী ভেবে
বাকির খাতায় শূন্য টেনে
যা নেবে হাতে তাই যাবে সাথে-এই সাময়িক
প্রত্যয় ইজারা টেনে, প্রভূত যাচনা বসিনা মেঙে
প্রত্নপতনে ধাবমান।
নইলে বারবণিতা মিথ্যেকে জাপটে ধরে
বুর্জোয়া স্বপ্নকে মদ্যপ পানে কেনইবা করবে
শ্রীল সত্যকে পার্থিব অপমান।
নির্মলেন্দু পোদ্দার
বেদনার রঙ
নিঃসঙ্গ রাত্রীর গাঢ় কষ্ট বুকে চেপে
সম্ভাব্য সকালের প্রত্যাশায় প্রতিদিন
আবির ছড়ানো বিকেল, গোধুলীর রঙ
কষ্টের বীজ বোনা দখিনা সমীরণ...
পশ্চিমের সূর্য অনিদ্রা শয়নে, সন্ধ্যা নামে
সদল বলে পাখিরা ফিরে আসে নীড়ে
ঘর কন্যা পাতা হয় সুখ স্বপ্ন আয়োজনে
অচেনা সে জন ফেরে একা নীল নির্জনে...
ফেরারী অতীত জল রঙে আঁকে নীল ছবি
কখনো সময় বদলে যায় নিয়ন আলোয়
কষ্টের ছবিগুলো দৃশ্য থেকে দৃশ্যমান
স্বপ্নের অনুরণে পথিকের হাতে বেদনার রঙ...
নাঈম মাহমুদ
গন্তব্য ১
পিঁপড়াটা বুঝতে পারে নাই
শিকারীকেও মাঝে মাঝে পরিস্থিতির
শিকার হয়ে শিকার হতে হয় ।
ক্ষুধাকেও অস্বীকার করা যায় না
আবার মৃত্যুও জন্মগত অধিকার
কোথায় যাবে সে !
ইন্দ্রজিৎ সরকার
কোন এক বিষন্ন সন্ধ্যায়
বিষন্ন সন্ধ্যার গ্রাসে ডুবে যাচ্ছে প্রিয় নগর-
সারি সারি বহুতল আর জীর্ণ উদ্ভিদকূল
ঢাকা পড়ছে ময়লা অন্ধকারে।
কেউ ঘরে ফেরে, কেউ ঘর ছাড়ে
ফুটপাতের ঝুপড়ি থেকে বেরোয়
সস্তা লিপিস্টিক-পাউডারের কড়া প্রলেপ
দেওয়া শ্যামলা তরুণী।
নিয়ন্ত্রিত আলো-আঁধারে নিকোটিনের কুয়াশা,
গ্লাসে-গ্লাসে ঠোকাঠুকি-চিয়ার্স;
উত্তরের টেবিলে কারও বরফকুচির আবদার।
নভো থিয়েটার থেকে অভিজাত আবাসিক
বিলাসী বাহনে যেতে হঠাৎ চমকে ওঠে আধুনিকা-
ইউ টার্নে দাঁড়িয়ে যেন খুব চেনা এক
প্রাচীন বিষন্ন সন্ধ্যা, আত্মঘাতী স্মৃতি!
লম্বা চুল খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নীল পাঞ্জাবী;
শেষদিন শেষবার এমনই দেখেছে তাকে,
আকণ্ঠ অভিমানে প্রতিবাদহীন।
এ কী আঁধারের মায়া...নাকি অবিশ্বস্ত অবচেতন-
সড়কবাতির মৃদু আলোয় ঠিক তার হয় না ঠাহর।
মধ্যরাতে একজোড়া দস্যুহাত
মধ্যরাতে একজোড়া দস্যুহাত
তোমাকে বিপর্যস্ত করে তোলে;
নিদ্রাতুর তোমার তনু আড়মোড়া ভাঙ্গে
মৃদু অন্ধকারে-অতল জলধির পাড়ে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমি
নগ্ন চিত্রকলার মডেল বনে যাও,
দস্যুহাত বেপরোয়া লুণ্ঠন চালায়
রত্নগর্ভা খনি-উপত্যাকায়;
যেন এক ঝড় বয়ে যায়...
ঝড়ের ফুরায় তেজ, আর
অসময়ে তুমি জেগে ওঠো
প্রবল তৃষ্ণার সামনে
পড়ে থাকে বিস্তৃত বালুভূমি-
থরথর কম্পনে কোন প্রিয়মুখ
কারও ভালোলাগা চুল ভেবে তুমি
মুঠোতে জড়াও বিছানার চাদর, বন্ধ দু’চোখ।
তোমার পাশে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমায়
থেমে যাওয়া ঝড়ের অবয়ব।
ফয়সল অভি এর কবিতা
দোহন
হালকা ক্ষরণ রঙে লাল গাভী
গত দু’বছর ধরে বিঘায় বিঘায় তীর্থ যাত্রা করছে
ফলও হলো বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে :
ধার কৃত লালের ঢেউ নিয়ে জলবতী টলটলে চোখ
এই বাছুর তারই সন্তান ।
আগমনে সবাই খুশী হয়
বিঘাপতিও আনন্দিত চকচকে সময়
বইতে বইতে কাঁটা আর ঘন্টার মিলন
ঘাটে বাধা গাভীর কোলে বাছুর আয়না
না ছোয়া : না ধরা : না কোন তৃপ্ত দুগ্ধ পান!!
এভাবেই পৃথিবীর তাবৎ অনুভুতির দোহন
আমাকে ঘিরে আমাদের জন্য : যেন জীবন পালিত মানুষ ।
একটি বোমা হামলার কারণ
আমরা বেঁচে আছি ।
পরিবার সহস্র সংগ্রামে আমাদের বড় করেছে
জাগতিক মমতার পাত্রে ধারণ করে ক্রমশঃ পরিণত বৃক্ষে
পারিবারিক মাটিতে শেকড় ছড়িয়ে নিজস্ব জগৎ : সবুজ আর সবুজ
বৃক্ষ ও বৃক্ষক্ষেত্র জুড়ে নিদারুণ আস্থার স্বস্তি দণ্ডায়মান করেছে ।
কিন্তু যে ক্ষেত্র শুধু নিজস্ব তারপরে হাঁটলেই আরো ক্রমশঃ হঠাৎ মরু
ঝরে পড়া শুষ্ক বৃক্ষের যে শরীরে সূর্য প্রতিফলিত হয় : তার ফলন সোজা চোখ বারবার
নিজস্ব থেকে বের হলেই স্বস্তির ব্যবচ্ছেদ : যা আগে কখনও বোঝা যায়নি ।
দুটো ক্ষেত্রের মাঝখানে কোন অনিকেত প্রান্তর নেই
যে প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছুটা চিন্তার বীজ বোনা যাবে
আর ফসল হলে কেটে নেওয়া যাবে
তাই সিদ্ধান্ত আকাশ বারবার নীচে সর্বোচ্চ সামরিক : দাঁড়িয়েই নিতে হবে ।
আমার ও আমাদের নিজস্ব ক্ষেত্রেগুলো যতই হোক সমান্তরাল
আসছে সময়ে নিদারুণ খরা গ্রাস করবে না আগামীর বৃত্তকে : তার কি গ্যারান্টি?
আজ যারা পূর্ববতী সময়ের অধিকর্তাকে নগ্ন করেছে : তারাই পরবর্তীতে নগ্ন হবে
সেটা তো নিশ্চিত ।
তাই দায় ভার বহন বন্ধ হোক ।
এক একটা আত্মঘাতী বোমা হামলায় দায়গুলো বিনষ্ট হোক ।
যা কিছু আছে আমাদের: নিজস্ব বলে আঁকড়ে ধরে আছি
বস্তুত সেগুলো খোলস :নিয়তই যা আমরা হারাচ্ছি
আমার উঠোনের নিজস্ব আকাশ : জমিনের নিজস্ব ফসল আর বাতাসে নিঃশ্বাসের অধিকার
সব...সব...একদম সব শুধু খোলসটা রেখে বাকি সব কর্পোরেট সত্তার মত গায়েবী হয়ে যাচ্ছে
নিজস্ব জগৎ বলে যে সবুজ ও সাচ্ছন্দ্যে আমরা বেড়ে উঠছি তা রেপ্লিকা ।
দৃশ্যত আমরা সবাই সর্বহারা ।
আমি নিরপেক্ষ নই
আমার বাবা
সহ্যের পথ ধরে পাথর
পাড়ি দিয়েছে চুপের সকল পরীক্ষা
জানেনি পুত্রের লাশের ভার কতো ।
কিন্তু
দেবতা ঘরে যে বিপ্লবী ধূমকেতু
চার পায়ে বাড়ি ফিরে
উঠনে জন্মায় আরেক উন্মত্ত পদ্মা;
আমি দেখেছি
আমাদের শুনিয়েছে স্বয়ং ঈশ্বর ধারাভাষ্য ।
সবুজের পাতায় সবুজ স্বাভাবিক না হতেই
হঠাৎ ধ্বংস হলো গাছের কাঙ্ক্ষিত কুঠুরি!
ঝরতে ঝরতে মাটিও তল হারিয়েছে
মাটির লজ্জায় :জলও ঋণ নিলো
এতো প্রবাহে ঈশ্বরও ধুয়ে দৃশ্যমান হতো ।
শুধু
প্রহরের যে গুণে পরিত্যক্ত অধিকার
জাগেনি :পুনরুত্থান আর হয়নি
রক্তে রক্তের স্নানই হলো
পবিত্র হয়নি গ্লানির বয়ে বেড়ানো আস্ফালন;
আলো নির্বাসিত :ঠিকানা রুদ্ধ এখন জঙ্গল ।
তবুও
সমুদ্র কাঁধে নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে
জাহাজের যে খবর আমি পাইনি
ব্যাপারীর ঘাট তবে বেদখল হোক
নিজ দরজায় বাঁধা সেই পাথর ভেঙ্গে ।
আমার বাবাও
ভার বহনে হাঁটতে হাঁটতে লাশ হয়ে যাক
শিশুপাঠে শেখায়নি কেন : যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ আমজনতা নয় ।।
পরিবেশ পরিচিত সমাজ
একটা সময় ছিল, যখন পাড়ায় পাড়ায় কানাঘুষা হতো । বউ ঝিয়েরা পাড়া বেড়াত, সন্ধ্যায় মহল্লা গল্লিতে সালিশ বসতো । কেউ ন্যাড়া হতো কারো হতো ভর্তসনা । তবুও পাড়ায় পাড়ায় সম্পর্ক ছিল, এক সুতোয় বাঁধা বাংলাদেশ । মরণে চার কাঁধ সে হিন্দু হোক কিংবা মুসলিম অথবা তাবৎ ধর্মের শবদেহ । সবাই নিশ্চিতে হেঁটে যেতো ঠিকানায় । ওটা অতীত বলা যায়; যেখানে সম্পর্কগুলো সকল স্তরে দাঁড়িয়ে জানান দিতো মানুষ ও মানুষে এক দেশ এক ঘর, মাঝখানের বেড়ার ফাঁক দিয়ে জোৎস্না আর সূর্যের ভাসা ও ডোবা ।
পৃথিবীর বয়স বেড়েছে তার চেয়েও বুড়িয়ে গেছে স্বদেশ । প্রাণের সেই স্রোত আর নেই । তারণ্যের সকল উন্মাদনা ঝিমিয়ে গেলে যেমন ভর করে সীমিত জগৎ তারই আয়না এখন সমাজ । প্রত্যেকের পৃথক পৃথিবী । জীবন, মৃত্যু ও আকাশ সব কিছু আলাদা এক একটা অনিকেত প্রান্তর । পাড়ায় পাড়ায় আরো পাড়া প্রত্যেকটা পাড়া যেন লুকিয়ে থাকা দ্বীপ; স্থল ও জলের বাইরে শুধুই আকাশমুখী সম্পর্ক; একদম সরাসরি আকাশমুখী । সেই গলি, মহল্লা ও জায়গা পাথর্ক্য শুধু উচু তারও উচু পাথরবাস, বেড়া বিতাড়িত হয়ে কংক্রিট সকল শব্দের আকড়ে ধরা থাবা । এসময়ে রুমে রুমে সংসার সাউণ্ডপ্রুফ জীবন, কেউ কেউ কারো হয় তবে সবাই এখন নিজের । ভাত খায়, আয়ু কিনে বেঁচে থাকে পরিবারের জন্য । বাবা হয়, মা হয় তারপরও আশ্রমের জন্ম হয় সর্বত্র । এটা সভ্যতার নিদর্শন । এখন সম্পর্ক শুধুই লৌকিক-মুঠোফোন, প্রজনন কিংবা অবসর বিনোদন । মানুষ এখন কাগজের সংজ্ঞায় প্রাণের রং বদলায় ।
তাই চুপ থাকার অর্থ নাগরিক । স্লোগান অর্থ উদ্দেশ্য । বেঁচে থাকাকে এখন শুধু অতিবাহিত সময় বলা যায় ।
জয়দেব কর এর কয়েকটি কবিতা
বেদনার ঝুড়ি
জিহ্বায় লালার বিষ ছিলো অপূর্ব মদের খনি।
চুম্বনে চুম্বনে তাই সব হারিয়েছি গরিবের ;
নীলকণ্ঠ আজ , ফের যাযাবর, যাযাবর ফের!
অনেক সহায় নিয়ে মাংসপিণ্ডে তুমি মহাধনী।
শ্মশানের মতো কতো দুই বুকে আগুনের উৎসবে
পুড়ে পুড়ে ছাই সব, ফিরে এসেছি দু’চোখ নিয়ে!
দেখো দুই চোখে তাই জল নেই, জল নেই প্রিয়ে,
আমার সুদীর্ঘ দণ্ড মাথায় উঠলো বুঝি তবে!
মনে আছে কি পাঁজরে কতো গড়েছো হাতের চুড়ি?
দিগন্তের টানে আমি হারিয়েছি বারবার তবু!
চড়া দামে কিনে দেখি প্রেম মানে বেদনার ঝুড়ি!
এই বেদনাই তুমি! চিরবেদনার মহাপ্রভু!
বারবার বহুবার তোমার আগুনে যেনো ফিরি,
ভালোবেসে জল দিয়ো, বুকে-পোষা প্রেম, অগ্নিগিরি!
যখন সন্ধ্যা নামে
যখন তোমার সন্ধ্যা নামে
তখন আমি জেগে উঠি
যখন তোমার সন্ধ্যা নামে
মানবশিশুপদ্ম ফুটি,
প্রেমের জলে একলা ভাসি।
যখন তোমার সন্ধ্যা নামে
এক জীবনের হাসাহাসি
শুষ্ক ঠোঁটের কোণায় থামে।
যখন দুয়ের সন্ধ্যা নামে
নেশার ঘোরে বেহুঁশ থাকি
যখন দুয়ের সন্ধ্যা নামে
মানবভাষার ডাকাডাকি
অন্ধকারে নীরব থামে।
আমরা যখন সূর্য দেখি ম্লান হয়েছে
ছেয়ে গেছে বিষম কালো অন্ধকারে,
দাহ্য যুগল আমরা তখন আগুন জ্বালাই
বৃষ্টিপোষা গোলাপ ঠোঁটে বারেবারে।
একমাথা চুল
এখানে থমকে দাঁড়িয়েছি বিষণ্ণ বিকেলে যার মুগ্ধচোখে,
হাওয়ায় ওড়া আগাম পাপের সুখচিহ্নে, একমাথা চুলে,
জানি না সে জানে কি না লাল গোলাপের চেয়ে তীব্র নখে
গরিমার বর্ণিল বেলুন ফেঁটে গেছে হৃদয়ের উৎসব ভুলে।
ক্ষিপ্র ডিঙির পালের মতো দূরগামী অশান্ত যুগল বুকে
তার হয়তো-বা বিভিষিকা-সন্দেহের বরফ জমতে পারে
চাঁদের ইশারা এলো তবু ফেরারির সংকীর্ণ দুয়ারে!
স্বপ্নের আল্পনা এঁকে গেলো একা নৈঃশব্দের চারুবাক মুখে!
পৃথিবীর সমূহ আঁধার এই অমল স্বপ্নের কাছে ঋণী
পূর্ণিমাআগুনঠোঁটে তারে শুধু এই আমি খুব বেশী চিনি।
চোখে ছুঁড়ছে মুক্তোর তীর অমন সুন্দর বধিরের হাসি
এই অশান্ত হাসি তো আমি সেই কবে থেকে ভালোবাসি।
তীক্ষ্ণ ছুরির মতন আজ ধেয়ে যায় স্বপ্ন, রূপোলি ইলিশ;
স্থির আমি নিভে গেছি খুব, শুধু শুনি অজানা পাখির শিস্।
অস্ত্রাগার হয়ে যাক জাদুঘর
ষড়যন্ত্রের গন্ধে বিবর্ণ আকাশের নীল
কী-করে ভালো থাকি বন্ধু?
এভাবে কি ভালো থাকা যায়?
নাভি আর শাড়ির দূরত্বে যদি
চঞ্চল হয়ে ওঠে অস্ত্রাগার!
ভাড়ারের শস্যদানা হয়ে ওঠে বিষধর গোখরো!
মদের পেয়ালা হয়ে ওঠে কাফেরের মাথার খুলি!
স্থবির সময় শিরোস্ত্রাণের মতো
ঘিরে রাখে স্বপ্নের শরীর!
স্বপ্নেও ঢুকে পড়তে চায় দুরন্ত হানাদার!
এভাবে কি ভালো থাকা যায়?
আসো এবার অন্তত একবার আমরা
আমাদের নিজস্ব অগ্নিগিরি বের করি
উত্তপ্ত করি ভালোবাসার হিম
আমরা সৌন্দর্যের জন্য হয়ে উঠি চরম প্রতিক্রিয়াশীল
আমরা হয়ে উঠি আফ্রিকার সিংহের চেয়েও অধিক অদম্য
আমাদের নিশানা হয়ে উঠুক ঈগলের চেয়েও নিখুঁত ও অব্যর্থ।
আমাদের রক্তের প্রতিরোধ
আমাদের কন্ঠের প্রতিরোধ
আমাদের দৃষ্টির প্রতিরোধ
আমাদের ঘৃণার প্রতিরোধ
ভোতা করে দিক ঘাতকের হাতিয়ার
বধির করে দিক ঘাতকের কান
অন্ধ করে দিক ঘাতকের চোখ
সমস্ত ইন্দ্রিয় করে দিক অনুভূতিশূন্য
আর আমাদের হৃদয়ের প্রতিরোধে
অস্ত্রাগার হয়ে যাক জাদুঘর
সমবেত নিশ্বাসে নির্বাপিত হোক সকল ভ্রান্তির দাবানল
নক্ষত্রের সবখানে জ্যোৎস্না ছড়াক
মাটির পৃথিবীর স্নিগ্ধ হাসি।
রূপান্তর
দীর্ঘ ঘুম ভেঙেছে কবেই পৃথিবীর নিমন্ত্রণে
তাই না-থামা কালের পথে আছি তার প্রতীক্ষায়
ঘন-শাদা-কাশফুলফোঁটা বৃদ্ধ আকাশের সনে
বিবর্ণ হৃদয়ে মেখে রঙ, স্নিগ্ধ নীলের ছোঁয়ায়।
এখানে স্মৃতির গতকাল, অন্ধ অমানিশারাত
স্বপ্নের পেলব রূপান্তরে প্রেয়সীর কালো চুলে,
রক্তের পাষাণ হোলিখেলা থামছে পলাশ ফুলে;
জবর নিঃসঙ্গ সরোবর ইঙ্গিতে তুলছে হাত।
প্রাণের বিষাক্ত পৃথিবীটা এ-অসম্ভব সৌন্দর্য
খুলে দিলো প্রচণ্ড ঠাট্টায়? না কি করুণার বশে?
না কি সে প্রাণের প্রতিপক্ষ ? সমস্ত সংশয় খসে
পড়ে নতুন পাতার মতো কবিতাই অনিবার্য?
চলছি শান্তির অন্বেষণে কতো যুগ যুগান্তর
মৃত্যুর তুমুল আয়োজনে দেখি অপূর্ব সুন্দর।
শীতের সংসারে
ক্ষুধা আর নিদ্রার অমোঘ আলিঙ্গনে
বহুরাত্রে বাড়িফেরা কর্মহীন যুবকের মতো
আমি ফিরে যাই বারবার স্বপ্নের সেই পুর্ণিমাআলোয়!
দিগন্ত বিস্তৃত চাঁদের রাজত্ব গ্রাস করে
উঠে আসা লক্ষ কোটি পুর্ণিমার দ্যুতি নিয়ে তুমি এলে
শূন্যে মহাশূন্যে আমার!
সকল সীমান্তের কাঁটাতার ভস্মীভূত
এই অলৌকিক অপরূপ সুন্দরের দাবানলে
কামনায় জল বিন্দু বিন্দু মহাসিন্ধু হয়ে নিমগ্ন পৃথিবী
শুধু জননির যুগল স্তনের মতো ভেসে উঠেছে দুটি চর
একটিতে আমি আর একটিতে স্বপ্ন আমার তুমি মানুষীর রূপে।
আমি শব্দহীন!
বাক্যহীন!
অসহায়!
আমাকে ভীষণ একাকীত্ব দিতে তোমার ঝলমল উপস্থিতি!
তাই প্রম-কাম-ভালোবসা-পুরুষ-নারী পৃথিবীর তাবৎ শব্দের
অর্থ ভুলে গিয়ে শুধুই দৃষ্টিসর্বস্ব হয়ে গেলাম নিমিষেই
যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক দলছুট শিকারীর
মায়াহরিণের পাশে বুনোফুলের বাহার দেখে
হাত থেকে খসে গেলো পাথরের বর্শা!
কতো জন্ম-জন্মান্তর পারি দিয়ে আমি দেখতে পেলাম
মানুষের গর্ভ থেকে ফুটে উঠেছো আশ্চর্য মানবীপুষ্প
গভীরতর অন্ধকার রাত্রির অরণ্যের চেয়ে গভীর, আরো গভীর,
গভীর তোমার চোখে অরণ্যপৃথিবী দুটি।
পৃথিবীর বিশালত্ব বিসর্জন দিয়ে আজ আমি ধাবমান
ওই চোখের ভেতরে অজস্র চোখের স্নিগ্ধ আশ্রয়ে
আগুনমুখী পতঙ্গের মতো
মৃত্যুর চেয়েও সরস আলিঙ্গনে!
আহা!
পরম উপাস্য দেবী
সমস্ত মত্ততা কাজলের মতো মুছে
আমার তৃষ্ণার জল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেলে
মিশে গেলে দূর আকাশে, বর্ণে বর্ণে, বর্ণহীনে।
সুপাঠ্য উদ্যান,তুমি স্থির না কি চঞ্চল আছো একা?
আমি পাঠক প্রবর, বিষণ্ণ উদ্বাস্তুর মতো ঘুরি
কুয়াশার ধুম্রজালে বিমূর্ত শরীর আঁকি চঞ্চল ভ্রান্তির রেখায়
যেন শত শতাব্দী ধরে আকাশ দেখছি চাতক-প্রতীক্ষায় নক্ষত্রচোখে।
আমার রক্তে ভাসা অজস্র ঈশ্বর সঁপে দিয়েছি
তোমার আকাশভরা রঙধনু-আগুনে।
আমার সুপেয় মদ্য, তুমি ছাড়া মগ্নতা চলে যায় বাষ্পের সাগরে,
ভালো থেকো তুমি, আমি ভালো নেই অদ্ভুত শীতের সংসারে।
কয়েকটি কবিতা
শৌনক দত্ত তনু
ভালবাসি এই অপরাধে
তোমাকে ভালবাসি এই অপরাধে
ছোট হতে হতে
মিশে গেছি মাটির ভেতর
যদি কখনো বাতাসে ওড়ায়
ধুলো করে
সেই ভয়ে জলের জঠরে
প্রতিস্থাপিত করে কাদা হয়ে থাকি ।
আমি তো মীন রাশি নই
তবুও আজ মাছের স্বভাব
জল ছাড়া বাঁচি কই !
জলের পরতে পরতে জলীয় ফাঁদ
প্রেমহীন জেলেদের ঘরে শুঁটকি
হবার সাধ ছিলনা কখনোই
তবুও চিত রোদে সটান শুকাই
নিরবধি নরম কাদা
জলের কসম জলে আর ভিজবো না আমি…
উচ্ছন্নে যাচ্ছে যাক সব পথ
লেপনের আশায় তুলে নাও যদি
প্রলেপে প্রলেপে তোমার মাটিতে
ঘরে মিলে মিশে যাব দিনে দিনে
তোমার হাতের ভাপে যত্নে
তোমারই ঘরে-
এ জীবনে জানবে ও না তুমি……….
কবিতাঃ বিষন্ন এক বিকেলের কথকথন...
অতঃপর চোখের পাশে বিষন্ন এক সন্ধ্যাতারা জেগে উঠেছে ।
আমি দেখি ছায়াসরণির এক পাশে
বালিহাঁস উড়ে গেলে পদচিহ্ন পড়ে থাকে আমার বালিতে ।
কালের কলস ভেঙে গড়ায় দিন গড়িয়ে যায় রাত ।
কোনও সকালে সূর্য ওঠে জলমেশানো দুধের মতো ফিকে
সাদাবাড়ীর ছয়তলাতে লেবু রঙের রোদ ছিটকে পড়ে
বুঝতে পারি অনেক দূরে কোচবিহারে বিনা আড়ম্বরে
লাল সুরকি রাস্তা ।একা দৌড়ে যায় নীচু টিলার দিকে
না,একা নয় ।সঙ্গে যায় স্কুল পোশাকে আমার শৈশব
জংলা ফুল,এক্কা দোক্কা,গোল্লাছুট কানামাছি ভৌ ভৌ,নুড়ি পাথর
পূর্বাপর ভুলে গেছি সব ফেলে যাওয়া রাধার ঘুঙুর
তোর্ষার সহজ দহন পরিণতি !
ঘিরে আসে জলের বিমর্ষ শব্দ রৌদ্র পোড়া যৌবন
ধুধু মাঠের একলা গাছে পাশে ভালবাসা আসে ও চলে যায় ।
ভালবাসা ভেঙে যায় যারা ফিরে গেছে নতুন ঠিকানায়
তাদের জন্য কান্না খামে নীল চিঠি
তোমরা সুখী তো সবাই ? সাগরদীঘির জলের মতো শান্ত ।
পরিযায়ী পাখির মতো আমার অতীত খোলস ।
ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকা মুখ অথচ ছুটছি এক দুরন্ত আমি
তুমি এবং আমরা । ভূলন্ঠিত পাতার মতো হৃদয়ের দোলে….
কবিতাঃ নীল খামের চিঠি...
সূর্য অনেক আগেই ফিরে গেছে
ধ্যানে। ফিরে গেছে পাখিরাও,
কুয়াশা ভেজা সন্ধ্যা যাচ্ছে
টুপটাপ রাতের কাছে টিনের চালে
কেমন আছো তুমি ?
ঘাসের ডগায় শিশিরের উচ্ছলতায়
আমিও বেশ আছি !
তোমার জন্য বড় দুঃখ হয়
তোমার ছিলো স্বপ্ন দেখার অসুখ
এখনো তেমনি আছে ? আর-
এখানে একে একে সবাই জোছনা ধরতে সরে গেছে দূর থেকে দূরে ।
ধু ধু করা এক মাঠের একলা গাছের মতো
আমি কেবল জোছনার মতো শীত রোদ মাপছি ভুল কম্পাসে ।
শুনলাম !তুমি নাকি দেশে ফিরছো?
নব তুমি ।নাকি স্মৃতির মোড়কে নতুন বেঁচে ওঠা ?
বরাবরের মতো চমকে উঠি !
মেঘের সাথে কথা বলি কিন্তু
পরক্ষণেই মনে হয় বিস্মরণে
দুঃখ নেই আছে দগ্ধতা ।
আচ্ছা,বিয়ে করোনি কেন ?
ঘৃণায়,নাকি চিরচেনা সেই মন
ভুলেছে ভালবাসার মানে ?
দুই যুগ পেরোনো সময়,
কুয়াশার মতো ঝরে গেছে ,নির্বাক
জানি তুমি চোখ বুঁজে ভাবছো ।
ভাবছো ফেলে যাওয়া মরচে সময়
কি,তাই না ?
আমিও ভাবি রাতের নিস্তব্ধতায়
মাথা রেখে সোনালী সেই দিন
ভাবি পাতাবাহারের কথা
যে সাক্ষী ছিলো প্রথম ছুঁয়ে যাওয়া
দুটো হাতের অস্থিরতার ।
আয়নার কথা ভাবি
যার বুকে ছায়া ফেলেছিলো
প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট রাখা ঘোর ।
সেও সাক্ষীই থেকে গেলো !
এ চিঠি তোমায় বিব্রত করছে না তো ?
বাইরে টুপটুপ ঝরছে শেষ রাতের শিশির ।বাতাসে ভেসে আসা শীত
কাঁপিয়ে দিচ্ছে
কমে যাচ্ছে সারাটা দিনের তাপ ।পৃথিবীজুড়ে শ্মশান শীতলতা ।
জানি.আজ ভেঙে যাচ্ছে বুকের প্রাচীর অচেনা গুঙানিতে ।
ভাবছো কেন এ চিঠি ?
না। কোন প্রত্যাশার গোলাপ আজ ফুটবে না কোথাও ।
একটা সত্যি কথা বলবে ,
যদিও জানতে চাওয়াটাই বালখিল্য
তবু কেন মনে হচ্ছে
চব্বিশ বছর পর ফিরে
আবার তুমি আমার জন্যে -
নিঃস্ব হয়ে যাবে !
কবিতাঃ পুনশ্চ প্রত্যয় আমার...
কুয়াশায় ঘিরে আসে শীতার্ত বিকেল
বাড়ি ফেরা পাখির পালকে শীত।
এইমাত্র উড়ে গেল তিনটি প্রজাপতি
এবং আমি তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন জামা
আর তার উষ্ণতা ।
বলো !ভাল আছো তো ?
রেখা ও আয়তনের উদাসীন ছবি
থেকে অকস্মাত্ ঘুরে দাঁড়াই আমি,
খুঁজে ফিরি কাঠকয়লায় লেখা আমার ডাকনাম ।
আমার মন কাঁপে,হাত ঠান্ডা হয়ে আসে শীতে ।
আমার পাগল পাগল লাগে এই সন্ধান ।
জানো !
আমার খুব ট্যালেন্টেড হবার সাধ জাগে ।
নস্যাত্ করে দিতে ইচ্ছে হয় তাবৎ
প্রতিভাধরের মুখ.তাদের আঁখর,নাম ।
জানি,অসম্ভব এই জলালপনা শখ।
মন,তুমি তিরিশ পেরুলে,তাই পরাজয়ের ভয় ?
পাতার ভেতর শীতের বাতাস আন্দোলন করে যায়
প্রসারিত সবুজের ভিতর নাম খোঁজে চোখ ।
বুঝি,তুমি দ্বিধায় আছো। আর তাই
সমূল ঘাস ফুলের থেকে পরগাছার ফুল আজ বেশি দামী-
পুনশ্চঃ
কুয়াশার কান্নায় সব শব্দ ডুবে গেলে
ডুবে যায় রাত.ভোরের ঝাপসা আলোয়
আজকে আমি নত হবো
জিতবো,খুঁজে পাবো নাম
কান্না পেলে লুকাবো না কোথাও
তিরিশ জনম আগের কান্না ফ্রিজে রেখে
ফড়িং এর মতন পবিত্র প্রেম হাওয়ায় উড়িয়ে
আজ আমিও বহুগামী হবো !
সমুদ্রকান্তা
সমুদ্রকান্তা,আজ তুমি বাসে
কাঁটাবনের পথে
আমার অন্ধ চোখের সামনে
অসহ্য পুলকে ।
তোমার নাকের নীচে ফুটে উঠা
তিনটি সুস্পষ্ট মুক্তাবিন্দুকে
আমি আলাদা করে তুলে রেখেছিলাম
জলে ভাসমান নীলপদ্মের পাতায় ।
সেই পাতায় ঠোঁটে ছোঁয়াতেই জলের বিছানায়
তুমি কেঁপে উঠলে অসহ্য কম্পনে
আর আমি-
সেই জলমগ্ন সমাধিক্ষেত্রে ভূলন্ঠিত জনসমুদ্রে
ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুধু জেনে গেলাম
মৃত্যু এতটাই সাংঘাতিক ও সোজা ।
অভিমান
শরীফা বুলবুল
আমাকে ছেড়ো না পাখি
বুকের ভেতর জমানো অভিমানটুকু ছাড়া
আমার আর কিছু নেই।
উথালি পাথালি ঝড়ে
সুদূরে বিলীন হয়েছে আমার সবুজ ভূমি।
ছেড়ো না পাখি তুমি...
আমার অশান্ত ডানায় আলতো রাখো হাত
তোমার চোখের পাতা পুড়িয়ে দেয়া গানে
আমার রক্তে আবারও লেগেছে দোলা!
বিরহজ্বালা ভুলে তাই উঠে দাঁড়িয়েছি
শহীদ মিনারের মতো মাথা উঁচু করে!
পতাকার মতো উড্ডিন হয়ে বাতাসে উড়ছি।
ভীতু
রবিউল মানিক
নান্দনিক গোলাপ না-কি রুটি-সব্জী
কোনটি বেশি প্রিয়---
আজো বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক য্যামোনটি
ঠাহর করতে পারি নাঃ
তুমি না-কি কবিতা
কে কতখানি হৃদয়ের জায়গা দখল করে আছে
কৃষ্ণগহ্বরে একে একে বিলীন হয় ছায়াপথ,নীহারিকা,ধূমকেতু
সৌরজগত,আস্ত গ্যালাক্সি
উত্তরাধুনিকতা গ্রাস করে নেয় চর্যাপদের ঐতিহ্য
পদাবলী-মঙ্গল-মহাকাব্যের সুষমায়িত ইতিহাস
আজন্ম সমুদ্রে বাস তবু
সমুদ্রে ভয়---
ঝড়ের আগে ঠিক নিশ্চিত করে নেই নিরাপত্তা
আজীবন সঞ্চয়িত ভালোবাসা পেয়েও
চোখের সমুদ্র হ'তে নিদ্রা বিসর্জন দিয়ে
নিরন্তর জেগে থাকি হারাবার ভয়ে
এ্যামোনই ভীতু আমি
শ্যামল ভট্টাচার্য্য এর কয়েকটি কবিতা
আমি
(তৃতীয় আহুতি)
অদ্বয় আনন্দের প্রতিপাদক যে সুমঙ্গল বানী
স্বীয় হৃৎকমল হতে নির্গত হয়েছে
ও প্রাচীন আচার্যগনের সকাশে উপস্থিত হয়ে সহস্রধা বিভক্ত হয়েছে
সেই বানী জয় যুক্ত হোক
এই বানীই সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ, সর্বরস
এই বানীই আভাসের দ্বারা বিদ্যা ও ঈশ্বর সৃজন করে
এবং স্বয়ং মায়া ও অবিদ্যা হয়ে থাকে
কোন শিশু যেমন জলের উপর দৃষ্ট নিজ প্রতিবিম্বের
ঋজুতা ও বক্রতারূপ পরিবর্তনাদিকে আপনার মনে করে ক্রীড়া করে
এই সুমঙ্গল বানীও সকল মনের উপর
যে সকল ক্রিয়া হয়
সেগুলি নিজের মনে করে ক্রিয়া করে
আর এই আশ্চর্য ক্রীড়াহেতুই অনুভূত হয়
আমাদের রক্তের সকল চলাচল পরিযায়ী পাখির মতো
ধাবিত হৃদয় হতে হৃদয়ান্তরে
যে চলাচল হংসের ন্যায় হর্ষ গদগদস্বরে গেয়ে যায় এই উদগীত--
আমাদের পালকে সকল মেঘ বিচরন করিতেছে
সমস্ত অঙ্গের সন্ধিদেশে নদীসকল প্রবাহিত হইতেছে
তবু এ জগতে গৃহে অন্ন থাকে বলিয়াই
আমরা গৃহস্থ হই
আবার গৃহস্থের নিকট হইতে অন্ন লাভ করা যায় বলিয়াই
আমরা ভিক্ষু হই--
আসলে এহেন বানীই সেই হৃদয় যা আমাদের ঈশ্বর বলে স্পন্দিত করে
ও উপলদ্ধ করে--
কাব্য যত নিঁখুত হয়ে উঠে ততটাই ভ্রান্ত হয়ে ওঠে আমাদের কবিসত্ত্বা
আর যেহেতু অশ্রুর স্পর্শটি ছাড়া কোন কিছু স্পষ্ট হয়না কখনো
আমাদের পান্ডুলিপিগুলি অশ্রুপ্রবাহের ভিতর গভীর সব বিসর্জনে যায়
ও খুলে যায় আশ্চর্য সব সর্জন যাহার ভিতরে
আমাদের প্রকৃত ভঙ্গিমাগুলি
লতাগুল্ম ও বৃক্ষস্থিত নদীমুদ্রার মতোই আকাশগামী হয়ে থাকে
আসলে,গন্তব্যই প্রমান
যা কিছু নদীর বক্রগতি তা মহাসমুদ্রের কাছে নিতান্তই সরল হয়ে থাকে
অশ্রুর এই সরলতার ভিতরে হে পাঠক, অনুভব করো
আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভ্রুযুগের মাঝখানে
বৃক্ষবৎ দন্ডায়মাণ
অতএব বৃক্ষমূলে স্থিত হও -- উপদেশ হৃদয়ে রক্ষা করার নাম ধ্যান
বৃক্ষই সংসার
যা আলোর অস্তিত্ত্বটুকু ছাড়া কিছু নয়
এই সংসারহেতু উপলদ্ধি করো
দীপ-বর্ত্তিকা নিম্নে টেনে তৈলে নিমজ্জিত করলে দীপ নিভে যায়
তবু প্রতিটি দীপ প্রজ্জ্বলন বহুজনের মঙ্গলার্থেই ঘটে থাকে
প্রতিটি প্রসববেদনা সকলের মঙ্গলার্থেই হয়ে থাকে
ইহাই আনন্দ
যাহার ভিতরে সকল সংজ্ঞার উপশম সুখময় হয়
আর উনুনের উপরিস্থিত গাঢ় পরমান্নের ন্যায়
অভ্যন্তর আলোড়নকারী তোমার সকল রাগসমূহ স্থির হয়ে আসে
অনুভব করো -- ইহাই নির্বান যার ভিতরে প্রবিষ্ট থাকে
পদ্ম ও রেনুময় ঔষধি, মহাসমুদ্র ও অন্নতৃপ্তি,
মনোময় মনি ও আকাশ, রক্তচন্দন ও নির্জন উপাসনা
আমাদের সকল ইতিহাস এই নির্বান বোধের সাথে জড়িয়ে থাকা গল্পমাত্র
আর ইহার ভিতরে সর্পবিষজাত যন্ত্রনার সতত আবৃত্তিই
আমাদের মহাভারত
আসলে, আমি যুদ্ধ করবোনা -- এই ক্ষুদ্র সংকল্পকে
আমি তোমারই নির্দেশ মেনে চলবো -- এই বিরাট সংকল্পে পরিবর্তিত করার
যেটুকু ছন্দব্যপ্তি
তাহাই সংগীত
সকল যুদ্ধই তাহাদের
তাহাদের জন্যে
এবং তাহাদের দ্বারাই অনুষ্ঠিত হয়
যাহারা জানেনা যে তাহারা যুদ্ধরত
যাহারা ইহা প্রকৃতই জানে সকল যুদ্ধ তাহাদের নিকট প্রশান্ত হয়
কামনাতুর নারীর সকল শীৎকারই
আমাদের সকল রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়
মাতৃময়ী নারীর সকল অপেক্ষাই
এ সকল যুদ্ধকে খন্ডিত ও সমাপ্ত করে থাকে
নারীর ক্রোড়স্থিত সমূহ নবজাতকের হাতের স্পর্শই
আমাদের পার করে আনে সকল মৃত্যু
নারীই প্রকৃতি যে এইভাবে খন্ডন-মন্ডন-সাক্ষ্য-অপেক্ষা নির্মান করে
আবার প্রকৃত পুরুষার্থে
খন্ডন-মন্ডন-সাক্ষ্য-অপেক্ষা বলে কিছু হয় না-- ইহাই প্রশান্তি
এই প্রশান্তিহেতুই
চাষী মাটিকে সংযত করে
আর মাটি সংযত করে কর্ষকের সকল প্রানশক্তি
ইহাই পুনরাবৃত্তি
জগতে সকলই সকলকে সংযমের দিকে নিয়ে যায় এইভাবে
আর স্বাদুতর হতে থাকে প্রতিটি রন্ধনকৌশল
এই পুনরাবৃত্তিহেতুই
বীজ থেকে অঙ্কুর,অঙ্কুর থেকে কাণ্ড,কাণ্ড থেকে নাল,
নাল থেকে গর্ভ,গর্ভ থেকে শূক,শূক থেকে ফুল আর ফুল থেকে ফল
তবু
বীজ কখনো এই চেতনা লাভ করেনা
আমি অঙ্কুর উৎপাদন করি
অথবা অঙ্কুর এই চেতনা লাভ করেনা
আমি বীজের দ্বারা উৎপন্ন
ইহাই প্রকৃতি যা সৎ হয়ে থাকে
মেঘ সৎ বলেই সে প্রতিক্ষনে ভিন্ন ভিন্ন
নদী সৎ বলেই তাতে ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তন দেখা যায়
যে অর্থক্রিয়া করে সে-ই সৎ
অর্থাৎ প্রত্যেকেই আমরা আমাদের অর্থক্রিয়াকারী রূপের দ্বারাই সৎ
মিথ্যা সর্পহেতু সন্ত্রস্ত হলে মিথ্যা দংশনের ভয়ে মৃত্যুও ঘটে থাকে
মিথ্যা সর্পও অর্থক্রিয়াকারী অর্থাৎ সৎ হয়ে থাকে
সকলেরই স্বভাব সত্য হওয়া, মিথ্যারও
সকলই কর্তব্যময়--ভ্রান্তিরও নিজস্ব কর্তব্য আছে
আর এই কর্তব্যহেতুই সমস্ত সংসারী জীব সুখের অভিপ্রায় করে
ও প্রবাহিত হয়ে থাকে ভেদবাসনা
যেভাবে মালার সব ফুলে অনুগত একটি সুতোই মালার প্রমান
প্রবাহ থাকলেও তদতিরিক্ত কিছু একটা থাকেই যা প্রবাহের প্রমান
সঙ্গমই এই প্রমান যা ত্যাগ ও ভোগের মিলনমাত্র
এই সঙ্গমহেতুই উপলব্ধ হয়
বালুকারাশির মধ্যে যেমন আকাশ আছে
প্রতিটি বালুকার মধ্যেও আকাশ আছে
বৃক্ষরাশির মধ্যে যে এক একটি বৃক্ষ স্বতন্ত্ররূপে দৃষ্ট হয়
তার কারন আকাশই
প্রতিটি বস্তু এইরূপ সঙ্গমের অধিকারী বলেই
বস্তুসমুহ যুগপৎ অনন্ত ও ভঙ্গুর হয়ে থাকে
যেহেতু কোন একাকী প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাত অর্থকে সিদ্ধ করতে পারেনা
সে-ই হেতু রচিত হয় এমতো সমবেত মন্ত্র
হে অমৃতের পুত্র
এমন অবস্থা সততই বিদ্যমান
যেখানে চন্দ্র ও সূর্য উদ্ভাসিত হয়না
যেখানে মাটি-জল-অগ্নি-বায়ু-আকাশ ও বিজ্ঞান নাই
যেখানে গমনাগমন স্থিতি উৎপত্তি হয়না
অর্থাৎ একাকীত্ব সম্ভব হয়না কখনো
ইহাই দুঃখের অন্ত, অর্থেরও
অর্থাৎ সেখানে আনন্দ আছে আনন্দের ভোক্তা নেই
নির্বান আছে কিন্তু নির্বানপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি নেই
পথ আছে কিন্তু পথিক নেই
আসলে যা কিছু আমি নই তা আমি ভাবাই অবিদ্যা
আর যা কিছু আমি নই তার সাথে পৃথকীকরনই--মুক্তি
পূর্ণজ্ঞান সেইহেতু সকল জ্ঞানের সমাহার হয়না কখনো
যখন আত্ম-উল্লেখ থাকেনা,আত্মার বোধও হারায়
তখনই প্রকৃত ধ্যান উদ্ভাসে জাগে
যাহার ভিতরে সকল স্বপ্ন দ্বৈততা হারায়
মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি আর কিছু নয় -- আত্ম ভাবনার প্রবাহটি স্তব্ধ করা ছাড়া
অর্থাৎ শরীর সংযমের নামই ধ্যান
মনসংযোগ -- শারীরিক মুদ্রারই অনুবাদমাত্র
শরীরই বুদ্ধি
শরীরকে প্রত্যাখ্যান করলে প্রত্যাখ্যাত হয় যুক্তির সকল বোধ
যা সকল গুনের আধার হয়না তা শরীর হয়না কখনো
স্বর্গ, মর্ত্য ও সকল আয়তন শরীরেরই পরিমাপ মাত্র
ধেনুর সমগ্র অস্তিত্বই দুগ্ধ নিঃসরনের হেতু হলেও
তাহা যেমন ধেনুর স্তনবৃন্ত হতেই বিনির্গত হয়
সমগ্র জগৎ প্রেম নিঃসরনের হেতু হলেও
তাহা কেবল শরীর হতেই প্রকট হয়
অর্থাৎ শরীরই প্রেমাঙ্কুর
আত্মরতিই পরিণত হয় প্রেমে আর প্রেম স্নেহে
স্নেহ মানে আর মান প্রনয়ে
প্রনয় পরিনত হয় রাগে আর রাগ আনুরাগে
এই অনুরাগই হয়ে উঠে মহাভাব আর গীত হয়--
পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত আমি মৃত্তিকা
হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত আমি জল
নাভি থেকে ঘাড় পর্যন্ত আমি আগুন
ঘাড় থেকে কেশরাশির সীমা পর্যন্ত আমি বায়ু
কেশরাশির সীমা থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত আমি মহাকাশ
এই শরীরহেতুই আমার গোপন নাম আহার
অর্থাৎ আমার বক্ষস্থলই যজ্ঞাধার
বক্ষস্থলের লোমসকলই কুশ
হৃদয়ই গার্হপত্য অগ্নি
মন অন্বাহার্যপচন অগ্নি ও আমার মুখই আহবনীয় অগ্নি
আমার প্রাণবায়ুই এ সকল আগুনের উৎসারক
অর্থাৎ শ্বাস ও প্রশ্বাসই কম্পন
যা কিছু কম্পিত হয় সকলই প্রান
সকল গতি ও স্থিতির প্রানই খাদক
এই প্রানের কারনেই কোথাও কোন সঞ্চয় নেই
শুধু পুনরাবৃত্তি আছে
অর্থাৎ মুক্তি প্রানের ভিতরেই থাকে
শারীরিক সুস্থিরতাগুলি উন্মুক্ত করে এই মুক্তিকে
জ্ঞানও একটি শারীরিক ক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়
শরীরই পরমতত্ত্ব
আর সেইহেতু আমাদের মস্তিস্কের স্বরূপটি
সহস্র পাপড়ির মতো আশ্চর্য হয়ে থাকে
প্রতিটি ধ্যানের মুদ্রা -- পদ্মবৎই হয়ে থাকে
যার প্রতি রেনু
শিবের কপালে স্থিত চন্দ্রের ন্যায় জ্যোতিস্মান ও মধু নিঃসারী
শরীরের সকল বীজকে এই মহামধু অনুসারী করাই সাধনা
আসলে বন্ধনই পাশ
বন্ধনের ভিতরে ছোট হয়ে থাকাই পশু
এই কুন্ডলীকৃত বন্ধনকে বিস্তৃত করাই তন্ত্র
আমাদের সকল শিকড় যখন পূর্ণ জ্যোৎস্নার অনুসারী হয়
তখন আনন্দ -- উহাই মদ্য
ইন্দ্রিয়ের সংযমই -- মৎস
যখন ভক্ষ্য ও ভক্ষক একাকারে হারায় উহাই মাংস ও তাহার আস্বাদন
আহারের আগে পরমান্নের যে অপেক্ষারত ভঙ্গীটি -- উহাই মুদ্রা
যখন অপেক্ষার কাছে খুলে যায় শতসহস্র মুক্তির পথ -- উহাই মৈথুন
আমাদের সকল ক্ষুধাই সর্পবৎ
উহাকে আহার দিও
নামিয়ে রেখ উহার বিষ
ইহাই আচার যা একটি সাক্ষাৎকারের অনুভবই হয়ে থাকে
আর যেহেতু কোন অনুভবই কল্পনা করা যায় না
এই অনুভবটি শূন্যতাই হয়ে থাকে
আমাদের বোধ
এই অনুভবকুন্ডলীর সংকোচন ও প্রসারনের দ্বৈততামাত্র
আমাদের বোধ
এই ক্ষুধা ও তৃপ্তির দ্বৈততা ছাড়া কিছু নয়
অ-উ-ম এই প্রনবধ্বনি সত্ত্ব-রজ-তম এই ত্রিগুন সমাবেশমাত্র
এই প্রনবতনুময় উপলদ্ধিই আমাদের আত্মোপলদ্ধি ও মুক্তি হয়ে থাকে
আর সেইহেতু আমাদের প্রতিটি মন্ত্রেই শরীর উল্লেখ প্রাচুর্যময় হয়
ও উহারা পিঁপড়ের ন্যায় একে অপরকে অনুসরন করে থাকে
ইহাই গ্রন্থ যা স্পন্দিত চলাচলমাত্র
চিৎশক্তি, আনন্দশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তিই এই চলাচল
অর্থাৎ যে কোন গ্রন্থপঠনই পাঁচটি চলাচল
স্থূল, সূক্ষ, কারনগত, মহাজাগতিক এবং সাক্ষীগত
গ্রন্থপাঠ অতএব সাক্ষী হয়ে ওঠা ছাড়া কিছু নয়
আর প্রতিটি দেখে নেওয়া আর কিছু নয়--
নিজের হারিয়ে যাওয়া পরিচয়টি
খুঁজে পাওয়া ছাড়া
অর্থাৎ সাক্ষী হয়ে ওঠাই স্মৃতি যা সমূহ প্রায়শ্চিত্তের দিকে
অর্থাৎ মন্ত্রের দিকে আমাদের নিয়ে যায়
মন্ত্রই হয়ে ওঠে ঈশ্বর আর মন্ত্র এই গ্রন্থ আবৃত্তিমাত্র
সমূহ ঈশ্বর তবে আর কিছু নয় -- মন্ত্রতনুময় আত্মনির্মানমাত্র
আর এইহেতু তীর্থ শব্দের অর্থ গ্রন্থ
তীর্থকর শব্দের অর্থ শাস্ত্রকার
আর যিনি গ্রন্থ অধ্যাপনা করেন
তিনিই আনন্দতীর্থ
যে আনন্দময় হয়ে থাকেন এহেন সংখ্যাতীত প্রার্থনার দ্বারা --
সকল ধর্ম
ও তাহাদের আচরনবিধি ত্যাগ করে
তুমি তোমার প্রকৃত অনুভবের কাছে এসো
দূঃখ করোনা
ঐ অনুভবই তোমার আশ্রয় হবে
ও তোমাকে সকল পাপ হতে পরিত্রান করবে
জেন, এ জগতের সকলই সকলের আলিঙ্গনে থাকে বলে
গতিবিধি সম্ভব
পর্বতসমূহ নদীবাহু প্রসারিত করেই সমুদ্রকে
ও সমুদ্রসমূহ মেঘবায়ু প্রসারিত করে পর্বতকে আলিঙ্গন করে থাকে
এই আলিঙ্গনগুলিই জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্ম চক্র হয়ে থাকে
অর্থাৎ আলিঙ্গনই শাস্ত্রবিধ একমাত্র কর্ম
যিনি শতবৎসর বেঁচে থাকতে ইচ্ছুক
তিনি এমতো আলিঙ্গনের ভিতরেই বেঁচে থাকতে আকাঙ্খা করেন
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি মহান
আমাদের মন উহাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ
ও আমাদের উপলদ্ধি মনের থেকে মহানতর হলেও
আমাদের অনুভবটিই শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে চিরকাল
স্বধর্ম আর কিছু নয় এই অনুভবের আলিঙ্গনটি ছাড়া
এই স্বধর্মহেতুই কর্মে অকর্ম ও অকর্মে কর্ম দর্শন সম্ভব
ইহাই বিজ্ঞান যা জ্ঞানমাত্র নয়
ইহাই বিজ্ঞান যা কেবল হয়ে জানা
অনুভবই বিম্ব ও আমাদের উপলদ্ধি
মন ও ইন্দ্রিয়গুলি তাহার প্রতিবিম্বমাত্র
যার নিজের অনুভূতিই নিজের কাছে প্রত্যক্ষ নয়
তার এমতো দর্শন সিদ্ধ হয়না
যাহারা অনুভূতির উপর সংযম অভ্যাস করেন
তাহারাই এমতো দর্শনের অধিকারী হয়
যে কোন অনুভবই অজ্ঞতার মহাশত্রু
কেননা এই অনুভবহেতুই উপলদ্ধি হয়
যে কোন আশঙ্কার সীমা আঘাত পর্যন্ত
আর তাহার পর আমরা সকলেই মৃত্যুঞ্জয়
ক্ষনিক ও অনন্ত
যেভাবে সলতেটি কেটে দিলে দীপশিখা আরো উজ্জ্বল হয়
অনুভূতির সকল সংযম
আমাদের সমূহ অন্ধকারের মধ্যে ভিতর দীপ্যমান করে
তবু যেভাবে আগুন যতই উজ্জ্বল ও তিমিরনাশী হোক
সে যেমন নিজেকেই দহন করে
ও অতিক্রম করে যায় সকল বিভা
অনুভব তা যতই অজ্ঞতানাশী হোক
সে আসলে নিজেকেই নিঃশেষ করে
ও অতিক্রম করে যায় নিজেকেই
অর্থাৎ আমাদের প্রতিটি অনুভবই বিবর্তিত হয়
ও হয়ে উঠে প্রজ্ঞাশক্তি
যেভাবে সমুদ্রে গমন করে করপুটে জল গ্রহন করে বলা কঠিন
ইহা গঙ্গার জল
ইহা যমুনার জল
ইহা নর্মদার জল
ইহা গোদাবরীর জল
তার চেয়েও বেশি কঠিন এ জগৎ অবলম্বন করে বিশ্লেষন করা
ইহা স্পর্শ
ইহা বেদনা
ইহা সংজ্ঞা
ইহা চেতনা
আমাদের অনুভবগুলির ভিতরেই ইহারা বিশ্লিষ্ট ও উপলদ্ধ হয় --
কোন বিকল্পই কোন কিছুকে নস্যাৎ করেনা
বরং তাকে বিস্তৃতই করে
যেহেতু আমাদের কোন অভিজ্ঞতাই
এই অনুভবগুলি ব্যাখ্যা করার মতো যথেষ্ট হয়না
এই অনুভবগুলিই আমাদের অভিজ্ঞতাগুলির উপাস্য হয়ে থাকে
এই উপাসনাই মধ্যপন্থা
যা সততই সকল বচন ও ধারনার অতীত হয়ে থাকে
অর্থাৎ মধ্যপন্থার ভিতরেই প্রকৃত দৃশ্যমান
ও উপলদ্ধ হয়ে থাকে সকল পথ
অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত ঐক্যের মতো প্রকৃত পার্থক্যগুলিও
বুদ্ধির অতীত হয়ে থাকে
আমি আর আমার শরীর যেমন এক নই
পৃথকও নই
সকল ঐক্য ও পার্থক্য এরকমই রহস্য হয়ে রয়ে যায়
অর্থাৎ একের শূন্যতা -- সকলেরই শূন্যতা হয়ে রয়ে যায়
রূপ শূন্য ও শূন্যতাই রূপ -- হয়ে থাকে
গতি ও স্থিতি বলে কিছু থাকেনা কখনো
যা অতিক্রম করে এসেছি আর যা অতিক্রম করা হবে
এই দুই পারস্পারিক সাপেক্ষতা ছাড়া
তৃতীয় কোন -- অতিক্রম করা হচ্ছে -- এমতো গতি অবস্থা থাকে না
আমরা প্রকৃত অর্থে কোন কিছুই অতিক্রম করে আসি না
এবং অতিক্রম্য সেইহেতু কিছুই থাকে না
আর যেহেতু গতি অবস্থা থাকে না
তার সাপেক্ষে স্থিতিও থাকেনা কখনো
গতি ও স্থিতির এহেন দৃষ্টিশূন্যতাই হয়ে ওঠে-- প্রজ্ঞা
যাহার ভিতরে টের পেয়ে যাই
দর্শনহীনতাই আমাদের প্রকৃত দর্শন
যা কিছু গতির অতীত
তাহাই অনুসরনযোগ্য ও আমাদের প্রকৃত গন্তব্য
আমাদের প্রকৃত পুষ্টি আসে
যা কিছু আহার্য হয়না কখনো -- তা থেকে
এই প্রজ্ঞাই প্রেম
এইহেতু যাহারা প্রেমিক তাহারাই গৃহহীন হয়ে থাকে
কেননা উহারা গৃহের অধিক হয়ে থাকে চিরকাল
আসলে গৃহ -- হিংসার ভিতরেই সংগৃহীত হয়ে থাকে
খাদ্য-বস্ত্র-পানীয়-তৈজস হিংসার ভিতরেই সংগৃহীত হয়
হিংসাই সংসার
আর প্রেমের ভিতরেই এহেন উপলদ্ধি ঘটে থাকে
এইসব হিংসা-ঘৃনা-ক্রোধ-ভ্রম সংযত করা যায়না কখনো
কেননা উহাদের অস্তিত্বই নেই
প্রেমের অনুভবটিও
জলের উপর ভাসমান চাঁদের মতো হয়ে থাকে
উহা আছে অথচ নেই
উহাকে স্পর্শ করার যে কোন প্রচেষ্টাই তবু
শতসহস্র তরঙ্গে উজ্জ্বল করে তোলে সে জ্যোৎস্নাকে
এই প্রেম হেতুই
আমাদের শতসহস্র জন্ম
শতসহস্র মুদ্রা
শতসহস্র মৃত্যু
হতে পারে
যা আছে অথচ নেই
আর এইহেতু জন্ম-মৃত্যু-মুদ্রা নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্নই
জন্ম-মৃত্যু-মুদ্রা নিয়ে হয়না কখনো
লতা উর্দ্ধে যায়
কিন্তু অবলম্বন না পেয়ে ফিরে এলে যেমন নিজেকেই জড়ায়
আমাদের সকল বচনগুলি
এমতো উপলদ্ধির দিকে যায়
এবং জটিলতর হতে থাকে সেইভাবেই
যিনি শূন্যতাকে জেনেছেন
তাহার নিকট এ সকল ধারনা ও বানীর
ততটুকুই প্রয়োজন
মহাপ্লাবনের সময় ক্ষুদ্র জলাশয়ের প্রয়োজন যতটুকুমাত্র থাকে
চোখ,কান,নাক,জিহ্বা,ত্বক -- আমাদের একইরকম জ্ঞান দেয় না
আমাদের প্রত্যক্ষগুলি,যুক্তি ও শব্দ -- একই রকম প্রমানের কাছে
পৌছায় না
আসলে প্রবৃত্তিগত কর্মগুলি ধর্ম হয়না কখনো
কেননা অপূর্বতাই ধর্মের লক্ষন
যা আগে দৃষ্ট হয়নি
বলা হয়নি
প্রবৃত্তিগতভাবে অনুভূত হয়নি
তাহাই দেখা,বলা ও অনুভব করাই -- ধর্ম
আর এইহেতু বন্ধনের দিকে নয়
ধর্ম আমাদের বিভিন্ন রকম মুক্তির দিকে নিয়ে যায় চিরকাল
অর্থাৎ মন্দিরের ভিতরে আমাদের জন্ম প্রার্থিত হলেও
মন্দিরের ভিতরেই আমাদের মৃত্যু
প্রকৃত ধর্মে প্রার্থিত হয়না কখনো
তাহাই শূন্যতা ধর্ম ও শূন্যতা আলাদা কিছু নয়
যেখানে দ্রষ্টব্য,শ্রতব্য এবং জ্ঞাতব্য কিছুই থাকেনা
যেখানে দ্রষ্টব্য,শ্রতব্য এবং জ্ঞাতব্য থাকে--তাহা ভ্রম
তাহা সসীম
ও অল্প হয়ে থাকে চিরকাল
শূন্যতাই অমৃত, অল্পই মৃত্যু
জগৎ শূন্য
কেননা জগতে কোন কিছুরই নিরপেক্ষ
ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই
সব কিছুই জগতে একে অপরকে পেয়ে উৎপন্ন
অদ্বয়কে এইহেতু দ্বৈততার সাহায্য ছাড়া বোঝা যায় না
আমাদের একটি বৃত্ত আঁকতেই হয় শূন্যতা বোঝানোর জন্যে
আছে এবং নেই -- এই অবস্থা উপলদ্ধিই সত্য
যা প্রশান্তি অতএব শূন্যতা হয়ে থাকে
যদিও দহনশক্তিকে আগুনের স্বভাব বলা হয়
তবু এই দহন অনুভবের জন্যে
অপর দাহ্য শরীর আবশ্যিক শর্ত হয়ে থাকে চিরকাল
আর ইহা অনুসরন হেতু উপলদ্ধ হয়
জগতে সকল বস্তুর কেবল পরভাব রয়েছে
ইহাই শূন্যতা ও তার প্রথম তাৎপর্য
সাপকে যেভাবে সঠিক অংশে শক্ত করে ধরতে না পারলে
কোন ব্যক্তি দংশিত ও মৃত হয়
নতুবা সে শ্রেষ্ঠ সাথী হয়ে ওঠে সমূহ খেলার
এহেন শূন্যতাকেও
সঠিক তাৎপর্যে উপলদ্ধি করতে পারলে বলা যায়
সুখ ও দূঃখ উভয়েই নিঃস্বভাব
তাই উহাদের নিরোধ সম্ভব
সকলই শূন্য -- এই কথাটি মাটি, জল, আগুন, বায়ু
অথবা কন্ঠে, ওষ্ঠে, জিহ্বাতে, দন্তমূলে, নাসিকাতে
অথবা কি হেতু, কি প্রত্যয় সমাহার অতিরিক্ত অন্যকিছু --
কোথাও স্বভাবত বিদ্যমান নয়
আর সেই হেতু এই শূন্যভাবকে
অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না
অস্ত্র ছেদন করতে পারে না
বায়ু শূস্ক করতে পারে না
জল দ্রবন দ্বারা কর্দমাক্ত করতে পারে না
ইহাই শূন্যতা
যা কোনপ্রকার খন্ডন ও মন্ডনের অভিলাষী নয়
দেহচক্ষু-দেবচক্ষু-জ্ঞানচক্ষু-ধর্মচক্ষু
যখন শূন্যতার মধ্যে বিলীন হয়
তখনই প্রজ্ঞাচক্ষু উদ্ভাসিত হয় ও উপলদ্ধি হয়
একে অপরের সাপেক্ষে
জগতে সকল কিছুরই নিজের পথটি আছে
অসীম স্বাধীনতার ভিতরে মুক্ত হবার
সকল কিছুরই নিজের নৈঃশব্দটি আছে অনন্তের মহাকাব্যটি রচনা করবার
প্রকৃত অর্থে কোথাও কোন বন্ধন নেই
মুক্তিও নেই সেইহেতু
তবু কর্ম ছাড়া এহেন উপলদ্ধি সম্ভব হয় না
অর্থাৎ আমাদের প্রতিটি ক্রিয়াই সর্বক্রিয়া
আর সেইহেতু কোন ক্রিয়াই ব্যক্তিগত হয় না
কোন ক্রিয়া ব্যক্তিগত বলার অর্থ দুঃখে পরিপুর্ন হওয়া
প্রতিটি কর্মই জ্ঞানের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ
শ্রবন-মনন-নিদিধ্যাসনের সমাবেশই জিজ্ঞাসা
জ্ঞান আর কিছু নয় এই জিজ্ঞাসামাত্র
একটি জিজ্ঞাসা থেকে অপর একটি জিজ্ঞাসার কাছে পৌঁছানোই
জ্ঞানের প্রকৃত পথ
জ্ঞান সেইহেতু অনন্ত ছাড়া কিছু নয়
জ্ঞানই কর্ম ও ভক্তি
কেননা কর্ম আসলে জিজ্ঞাসারই অনিবার্য পরিনাম
আর ভক্তি জিজ্ঞাসার প্রতি উৎসর্গিত হয়ে যাওয়া মাত্র
জিজ্ঞাসাই সেইহেতু একমাত্র তপস্যা
জিজ্ঞাসাই পরম সংযম যাকে বৈরাগ্যও বলা যায়
জীব নিত্যমুক্ত আর সেইহেতু জিজ্ঞাসার অধিকারী
যে কোন জিজ্ঞাসারই ষোলটি মুদ্রা থাকে
জলের বুকে যে ঢেউ জাগে,স্থিত হয়, ভাঙ্গে
তাহাও কম্পিত হয় ষোলটি মুদ্রায়
যদিও বর্ন থেকে অক্ষরে,
অক্ষর থেকে শব্দে
শব্দ থেকে বাক্যে
প্রভূত গতিবিধির শর্ত ছাড়া কোন গ্রন্থ সম্ভব হয়না কখনো
তবু একটী গ্রন্থকে আমরা স্থিরই বলে থাকি
পৃথিবীর সকলই এইভাবে স্থির মনে হলেও
ঐ গ্রন্থের মতো -- সকলই প্রবাহশীল
মন্দিরের প্রদীপশিখাটি অচঞ্চল মনে হলেও
প্রকৃত ধর্মে, উহা প্রতিক্ষনেই প্রবাহমান
প্রতিটি ক্ষনেই উহা আসলে ষোল কলার ধারাবাহিকতা ও বিচ্ছেদ
যা রূপ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে
এই রূপগুলি কর্মচঞ্চলতা ও তাহাদের সমন্বয়মাত্র
যা ছন্দ বলে খ্যাত হয়ে থাকে
এই ছন্দের কারনেই
প্রতি সমন্বয় প্রতি সমন্বেরই অনুসারী হয় চিরকাল
অর্থাৎ এই সমন্বয়গুলি সমন্বয়ের জন্যেই ঘটে থাকে
এই সমন্বয়গুলির অতীত কোন আকাঙ্খা থাকে না
মুক্তি এইভাবে মুক্তির জন্যেই ঘটে থাকে
মুক্তির জন্যে কোন আকাঙ্খা, প্রকৃত প্রস্তাবে, থাকে না
জন্মক্ষন ও মৃত্যুক্ষনগুলির কোন দর্শন থাকে না
কেননা উহাদের নিরপেক্ষ তৃতীয় কোন দর্শক থাকে না কখনো
আমাদের সকল রচনাই
বিভ্রম থেকে দর্শনহীনতার দিকে চলে যায় চিরকাল
এইসব দর্শনহীনতার ভিতরে তবু
একটি ক্ষনের ভিতরে অপর ক্ষনের অনুভব রয়ে যায়
ইহাই জীবন ও তাহার সকল যাপন
একটি মুহুর্তের ভিতর
আর একটি মুহুর্তের অনুভব রয়ে যায় চিরকাল
ক্ষনই অনন্ত
একটি ক্ষনের দৃষ্টিপাত
তোমাকে চিনিয়ে দিতে পারে তোমার দেশ
ও তাহার সকল ভূমি
ইহাই অনন্ত ও শূন্যতা
আকাশ যে ভাবে বাধার অনুপস্থিতিমাত্র নয়
আকাশ ধারক
সেইহেতু
সকল মৃত্তিকা আকাশেই স্থিত হয়
বায়ু আকাশেই স্থিত হয়
সকল অর্থ আকাশেই স্থিত হয়
এই আকাশই স্মৃতি যা সংহিতা ও বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে
অঙ্কুর প্রকট হলে -- বীজ ধংস হলেও
এই আকাশের কারনেই রয়ে যায়
আসলে যা তত্ত্ব
তা অনপেক্ষভাবে সৎ নয়
অসৎ নয়
সৎ ও অসৎ নয়
সৎ অথবা অসৎ-ও নয়
তা আত্ম
অনাত্ম
আত্ম ও অনাত্ম,
আত্ম অথবা অনাত্মও নয়
প্রকৃত তত্ত্ব এ সকলের অতিবর্তী বলেই
তাহা অদ্বৈত
ও তাহা উপলদ্ধিই শূন্যতা উপলদ্ধি হয়ে থাকে
চরম প্রশ্নগুলির উত্তর সেইহেতু নৈঃশব্দই
কেননা নৈঃশব্দই সাক্ষী
সত্য এইভাবে কোন চরম কোটির বিষয় হয় না কখনো
কবিতাই প্রসঙ্গ হয়
উপায় হয় একমাত্র
এহেন উপলদ্ধির
কবিতাই সেই দ্বন্দ্বিক পদ্ধতি যা এই শূন্যতা প্রতিপাদন করে
আর অদ্বয় পরমার্থের উপলদ্ধি
সম্ভব হয়
এই কবিতা হেতুই উন্মোচিত হয়
আমাদের সকল বিচার
প্রমান ও অপ্রমান
এক স্ব-আরোপিত সংবৃতিমাত্র
যেখানে আমাদের যুক্তিই বিচারক ও অপরাধী -- দু-ই হয়ে থাকে
অর্থাৎ বিচারক-অপরাধী
অস্তি-নাস্তি
নিত্য-অনিত্য -- এ সকল শব্দের
সফল ব্যবহার জগতে হয়না
কেননা একে অপরের সাপেক্ষেই উহারা অর্থপূর্ন হয়
কিন্তু পরম তত্ত্ব এভাবে নির্ধারিত হয়না
জগতের সকলই এইভাবে দুটি চরম অন্তে বিভক্ত হয়না কখনো
সকলই আলো ও অন্ধকারমাত্র নয়
সকলই শব্দ ও নৈঃশব্দমাত্র নয়
ইহাই শূন্যতা
যা সাক্ষাৎ ধ্যানের বিষয়ই হয় থাকে
আমাদের ধ্যান সমস্তই সম্যকরূপে উপলদ্ধি করতে পারে
কিন্তু নিজেকে পারেনা -- ইহাই শূন্যতা
যেমন অসিধারা সকল বস্তুই ছেদন করতে পারে
শুধু নিজেকে পারে না
তবু ঘট চিন্তা করলে যেভাবে মৃত্তিকাও চিন্তিত হয়ে থাকে
মন চিন্তা করলে সকলই চিন্তিত হয়ে থাকে
অসিধারা চিন্তা করলে -- করুনাও
এভাবেই অগ্নিতে মনি ও মনিতে অগ্নি চিন্তিত হয়ে থাকে
আর এই মননের ভিতরে
তাহারাই হয়ে ওঠে প্রকৃত অতিমানব
ক্ষীপ্র বাঘিনী যেভাবে তুলে নেয় শাবক তার দাঁতে
যা কঠোর হয়না কখনো ক্ষতচিহ্নের মতো
আলগাও হয়না কখনো সে দন্তবেষ্টনী
শাবকটির ভূপতনের মতো
যাহারা তুলে নেয়
সমূহ দর্শনগুলিকে ও প্রতিপালন করে সেইভাবে
অর্থাৎ প্রতিটি ভেদ ও অভেদ সর্প ও তাহার কুন্ডলীর ন্যায়
অশ্ব যেমন লোম সকল কম্পিত করে শ্রমাদি দূর করে
স্বরচিত সকল আন্দোলন ও জটিলতা
সকল বিভ্রম মুক্ত করে
সকল মহাভয় হতে পরিত্রান করে আমাদের
জ্ঞানের ভিতরে থাকে
একটি জেগে থাকা
একটি স্বপ্ন
একটি স্বপ্নহীন সুপ্তি
আর একটি চতুর্থ অবস্থা যাকে তূরীয় বলা যেতে পারে
প্রতিটি জাগ্রত অবস্থাই প্রতিষ্ঠিত হতে চায়
কোন না কোন স্বপ্নের কাছে
যার ভিতরে মুছে যায় তাহার শরীর
শুধু চৈতন্য থাকে
প্রতিটি স্বপ্নই আবার পৌঁছাতে চায়
একটি গভীর সুপ্তির ভিতরে
যাহার ভিতরে স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না
সকল শরীর আর চৈতন্যের বোধও -- থাকে না
সকল দুঃখ ও বেদনাগুলি
থাকে না সেখানে
যখন ফিরে আসি পুনরায়
জাগ্রত অবস্থার কাছে
বলি -- কিছুই জানি না
শুধু জানি এ ঘুম আনন্দময়
এ শূন্যতা
যাহার ভিতরে
ইন্দ্রিয় থাকে না
মন থাকে না
বুদ্ধি থাকে না
অনুভব থাকে না
জন্ম থাকে না
মৃত্যু থাকে না
আত্মা থাকে না
অনাত্মাও -- থাকে না
ইহাদের অতীত কোন তূরীয় অবস্থা শুধু, আনন্দময়, থাকে
আনন্দময়, সেইহেতু, হয়ে থাকি সকলেই
এই আনন্দের কারনেই কোন অন্ন আমাদের কাছে অনন্ন হয় না
এই আনন্দহেতুই একটি আকাশ বহন করে সমূহ ঘাসেদের
একটি ঘাসের কোমল অগ্রভাগেও বাহিত হয় সমুদয় আকাশ
এই আনন্দহেতুই উহারা কেউ একে অপরের চেয়ে অধিক পূর্ণ নয়
সকলই আনন্দময় -- পৌরুষ,নারীত্ব,শৈশব,বার্দ্ধক্য -- সকলই আনন্দময়
আনন্দ -- শ্রমিকের নির্মানে,ভবঘুরের পদচারনায়,অরন্যের নৈঃশব্দেও
আনন্দ -- মাটির গন্ধে,মোটর বাহনে,অগ্ন্যুৎপাদনে,অগ্নিনির্বানেও
আনন্দ -- সন্তান উৎপাদনে,পশুবলিতেও,বিদেশ পরিভ্রমনে,স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেও
আনন্দ -- পাখির ডাকে,কলের গানেও,শল্যচিকিৎসা যন্ত্রে,হারপুনেও
আনন্দ -- মুক্ত সমুদ্র ভ্রমনে,উপনিবেশ স্থাপনে,বিমান উড়ানে,ক্ষেপনাস্ত্র উড়ানেও
আনন্দ -- শত্রুর মৃতদেহ গননে,আত্মহননেও,উনুনে অগ্নিসংযোগে,চিতাতেও
আনন্দ -- রক্তপাতে,পুন্যস্নানেও,বস্তুবাদে,আধ্যাত্মিকতাতেও
আনন্দ -- ঐক্যে,প্রতিবাদে,কাব্যমন্ডনে,কাব্যখন্ডনেও
এই আনন্দই পূর্নত্ব
অর্থাৎ এই জগতের সকলই পূর্ন
এই পূর্নের পূর্নত্ব গ্রহন করলে পূর্নমাত্রই অবশিষ্ট থাকে
এই পূর্নতাহেতু সকল প্রচেষ্টাই পরম বিভ্রম
যা তবু আনন্দময় হয়ে থাকে আমাদের কাছে
ইহাই শূন্যতা
অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেছে -- একথা বললে
যেমন ব্যভিচারীর মনে হয় অভিসারের সময় হয়েছে
বেদজ্ঞের মনে হয় সদাচরনের সময় হয়েছে
এবং চোরের মনে হয় পরস্ব হরনের সময় হয়েছে
নারীর একই মৃতদেহে যেমন
কামুক পরিব্রাজক ও কুকুরের তিনভাবে বিকল্প বুদ্ধি জন্মায়
যে কোন মন্ত্র
যে কোন সূত্র
যে কোন বর্ননা সেভাবে
তিনটি বিকল্পই হয়ে থাকে
অতএব মধ্যপন্থাও অবলম্বন করা যায়
মধ্যপন্থাই চিরন্তন
উহা আমাদের বোধগম্যতার পরিসর কোথায় থেমে আছে
তা দেখিয়ে দেয়
মধ্যপন্থাই সর্বোচ্চ সত্য
মধ্যপন্থা যে জানে
সে-ই পৌঁছায় একদিন
কোন তীরে না ঠেকে
প্রকৃত মোহনায়
এই মধ্যপন্থাহেতুই সিদ্ধ হয়
যা কিছু বিশুদ্ধ তা নির্দিষ্ট হয়না কখনো
আর এইহেতু
আমি ভাবি সেই দিনটির কথা -- বাক্যটি উচ্চারনে টের পেয়ে যাই
এখানে সেই -- শব্দটি
শূন্যবীজমাত্র
ইহাই জ্ঞান
অজ্ঞান জ্ঞান থেকে পৃথক কিছু নয়
উহা জ্ঞানেরই শরীরমাত্র
আসলে সামগ্রিক দর্শন ব্যতিরেকে কোথাও কোন অরন্য থাকেনা
অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে যদিও ক্ষুদ্রত্ব কোথাও নেই
ক্ষুদ্রত্বের ধারনা তবু সকল ধ্যানের প্রারম্ভে প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে
খড়কুটোর আবর্তনই আকাশের ধারনা নির্মান করে থাকে
সকল চিন্তার মুদ্রাই নির্দেশ করে তাহাদের অতীত প্রজ্ঞাকে
প্রজ্ঞা
যাহা সকল ধারনা শূন্য
তাহাই একমাত্র দূর করে থাকে অবিদ্যাকে
আর এই প্রজ্ঞা
শুধুমাত্র নৈঃশব্দের ভাষাতেই প্রকাশ্য ও স্বাধীনতার ভিতরে অনুভূত
স্বাধীনতা আর কিছু নয় বেদনা থেকে মুক্তি ছাড়া
যদিও প্রতিটি অসুস্থতারই এক নিজস্ব সৌন্দর্য আছে
প্রতিটি মৃতদেহই
ধীরে ধীরে নিজেকে খোলে প্রস্ফুটিত ফুলের বিপরীত মুদ্রায়
আর অন্যতর রহস্য খোলে ঈশ্বরের বাগানের
আসলে প্রকৃতির অনুসারী হলে ত্যাগ, ভোগ এবং মুক্তি -- সকলই ঘটে
আসলে যথেষ্ট মুক্ত হতে না পারলে ভোগ সম্ভব হয়না কখনো
বরং ভোগ্য হতে হয় ভোগেরই
বিষ যা সততই হননশীল, প্রকৃত ব্যবহারে, জীবনদায়ীও হয়
শরীরের প্রকৃত ব্যবহারে শরীরই হয়ে ওঠে এমতো মন্ত্র--
আমি শিব
আমার শরীরই সতী
আমি শব
আমার শরীরই মহাকালীর উল্লাস
ফলতঃ আমি নাদ
আমিই বিন্দু
আমিই সে
অর্থাৎ আমি অহংকার হই না কখনো
আসলে একটি প্রকৃত আলিঙ্গনই সহস্র পাপড়ি বিশিষ্ট আগুন
ও তার সকল মধু হয়ে থাকে
যার সাথে প্রকৃত খেলায় আমাদের বাঁধনগুলি থাকে না কখনো
পুড়ে যায়
শরীরই সংসার ও নির্বান
এমন কোন শরীর নেই যা আনন্দের ধারক নয়
এমন কোন আনন্দ নেই যা শরীরময় নয়
দেখো,শরীরই বিনত হয়, পরিনত মৃতদেহ হয়
কুকুরেরা আসে
উহা ভক্ষনের তরে সমূহ লড়াই চলে একে অপরের সাথে
আর মৃতদেহ উঠে আসে আরবার
শিশুর করতালি ও হাস্যে চেয়ে দেখে সমুদয় কুকুরের খেলা
যেভাবে শরীরেই স্থিত হয় যা কিছু অতীত শরীরের
মাটিতেই স্থিত হয় সমূহ আকাশ
ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় স্পর্শ করা যেতে পারে ধর্মমেঘ
যার দিকে প্রথম পদক্ষেপটি প্রমুদিত, দ্বিতীয়টি বিমলা,
তৃতীয়টি প্রভাকরি, চতুর্থটি অগ্নিময়, পঞ্চমটি বাসনাবিজয়ী
ষষ্ঠটি অভিমুখী, সপ্তমটি অতিবিস্তৃত
অষ্টমটি অচল, নবমটি সাধুমতি হয়ে থাকে
অর্থাৎ ধর্মমেঘ এইভাবে দশম ভূমিস্পর্শমুদ্রাটি ছাড়া কিছু নয়
যা শূন্য-অতিশূন্য-মহাশূন্য ও সর্বশূন্য অর্থাৎ
যা আনন্দ-পরমানন্দ-বিরামানন্দ ও সহজানন্দ
চাঁদের ষোলটি মুদ্রার ভিতরে
প্রথম পাঁচটি আনন্দ
পরের পাঁচটি পরমানন্দ
পনেরোতম মুদ্রাটি পর্যন্ত বিরামানন্দ তারপর
এবং ষোলতম মুদ্রাটি সহজানন্দ অর্থাৎ
মহাসুখ হয়ে থাকে
এই মহাসুখের ভিতরে
আমার হৃদয়ই উহার গুহা
ও আমার মেরুদন্ডই তাহার সুমেরু পর্বত বলে
অনুভূত হয়ে থাকে
প্রতিটি অনুভবই আমার ছায়া
প্রতিটি অনুভবই আমার প্রকৃত স্মৃতি
যোগীর কাছে অনুভবই যোগিনী
সন্ন্যাসীর কাছে সন্ন্যাসিনী
কবির কাছে তার কাব্য
যেভাবে বিষের দ্বারা বিষ যন্ত্রনার উপসম ঘটে
কাঁটার সাহায্যেই কাঁটা তোলা যায়
মন্ত্রের সাহায্যেই মন্ত্রকে অতিক্রম করা যায়
আবেগের ভিতর দিয়েই আবেগকে
অনুভবের ভিতর দিয়েই অনুভবকে
ও এই জগৎকে আরো বেশি জাগতিক করে তোলার ভিতর দিয়েই
অতিক্রম করা যায়
সমস্ত অস্তিত্ত্ব -- অতিক্রম করা যায়
রূপ? ইহা দর্শনের দ্বারাই বিকৃত হয়
রস? ইহা রসনার দ্বারাই বিকৃত হয়
স্পর্শ? ইহা ত্বকের দ্বারাই বিকৃত হয়
গন্ধ? ইহা ঘ্রানের দ্বারাই বিকৃত হয়
আত্মা? আত্মার ধারনার দ্বারাই বিকৃত হয়
আমি? ইহা জ্ঞানের দ্বারাই বিকৃত হয়
মন্ত্রের প্রকৃত কোন অর্থ থাকে না কখনো
প্রকৃত মন্ত্র সেইহেতু মুখে উচ্চারিত ও কর্ণে শ্রুত হয় না
মনের দ্বারাই এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়
হৃদয়ের দ্বারাই উহা শ্রুত হয়
মন্ত্রের এহেন অর্থহীনতার সতত শ্রবনই
আমাদের মুক্ত করে আমাদের বাসনাগুলি থেকে
প্রস্তুত করে তোলে আমাদের
মহাসুখের জন্যে
এই শ্রবনের ভিতরেই সব চিরপ্রস্ফুটিত
শ্রবন হতেই পৃথিবী ও আকাশ
শ্রবনই দূঃখের নিরোধ
শ্রবনই অন্ধের পথ
শ্রবনের ভিতরেই অসীম সমুদ্রেরা সব হয়ে ওঠে দুহাতের অঞ্জলি
এই শ্রবনই সন্তানহীনা নারীর সন্তান, পঙ্গুর হস্তপদ
পুস্পপত্রহীন বৃক্ষের শোভা, জলহীন পুস্করিনীর পূর্ণতা
রূপহীন নারীর রূপ, বীর্যহীনের সৃষ্টিশীলতা
বিগ্রহহীন মন্দিরের পবিত্রতা, মন্দিরহীন ঈশ্বরের শ্রদ্ধা
ডানাহীন মৌমাছির উড়ান, মৃতবীজের ডানা
প্রদীপহীন শিখা ও শিখাহীন আরতিপ্রদীপ
এই শ্রবনই প্রজ্ঞা
যা আমাদের মাতা
কেননা ইহাই বিশ্বপ্রসবিনী
যা আমাদের ভগীনি
কেননা ইহাই পরম ও আপাত আনন্দের সীমারেখা হয়ে থাকে
যা আমাদের ধোপানী
কেননা ইহাই পরম আনন্দের ভিতর আমাদের ধৌত-শুদ্ধ করে থাকে
যা আমাদের নর্তকী
কেননা ইহাকে বর্ননার কোন ভাষাই যথেষ্ট সুস্থির হয়না কখনো
যা আমাদের ডোম্বি
কেননা ইহা আমাদের বোধ ও অভিজ্ঞতার বাইরে রয়ে যায় চিরকাল
অতএব স্থির হও,দেখো --
একটি শূন্য বিন্দুর ভিতরে সমবেত সকল ঈশ্বর
এহেন স্থিরতা পরিনত হলে ঐ বিন্দু বিস্ফারিত হয়
ও ঈশ্বরমন্ডলী ধাবিত হয় সকল জীবের দিকে
সকল জীব এভাবেই প্রাপ্ত হয় সকল ঈশ্বর
প্রতি দেহ প্রতি দেবতা
এহেন স্থিরতার ভিতরে দৃশ্য প্রসারিত করো আরো
দেখো, দেবতারা ফিরে আসেন
ঐ বিন্দুতে আবার
দেবতামন্ডল এভাবেই কেন্দ্রীভূত ও বিস্ফারিত হন বারবার
অনুভব করো
এই দৃশ্য উপভোগই ধ্যান
তাহার সকল আচরন
ও সকল অন্তর্দৃষ্টির উন্মুক্তি হয়ে থাকে
অনুভব করো
আমরা সকলেই বুদ্ধ
সকলেই ভিক্ষু
মাতৃগর্ভের দশমাসই আমাদের দশভূমির সাধনা ও অতিক্রমন
ক্ষুধার ধ্বনিই আমাদের বীজমন্ত্র
যা আমাদের সকল নির্বানের উৎসারক হয়ে থাকে
অতএব
মুক্ত হও যে কোন প্রচেষ্টা হতে
উহা উপমার ব্যবহারের মতো হয়ে থাকে চিরকাল
যতটুকু সত্য উহা প্রকাশিত করে
আবরিত করে তার বহুগুন
দেখো, এ জগতের সকলই আত্ম-পূর্ণ
অতএব দৃষ্টিশূন্য হও
পূর্ণতার যে কোন সাধনাই এই দৃষ্টিশূন্যতার অনুসারী হয়ে থাকে
কোথাও কোন মল নেই, মুত্র নেই, শত্রু নেই, মিত্র নেই
সুস্থতা নেই, অসুস্থাও নেই, মোহ নেই, মোহমুক্তিও নেই সেইহেতু
ইহাই আধ্যাত্মিক,আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক শান্তি
যা অদ্বয় অর্থাৎ শূন্য হয়ে থাকে
এই শান্তির ভিতরে অনুভব করো
আমাদের প্রতিটি ভাবনা ভাবনাহীনতারই হয়ে থাকে
আসলে কোন কিছু জেনে ফেলাই
তা নিয়ে ভাবনার পরিসমাপ্তি
কাউকে জেনে ফেলাই তাকে নিয়ে ভাবনার পরিসমাপ্তি
আগুনকে জেনে গেলে আগুন নিয়ে ভাবনা থাকেনা কোথাও
তখন সকলই অগ্নিময় হয় -- ইহাই শূন্যতা
আকাঙ্খাকে জেনে গেলে আকাঙ্খা নিয়ে ভাবনা থাকেনা কোথাও
তখন সকলই আকাঙ্খাময় হয় -- ইহাই শূন্যতা
জয়ীকে জেনে গেলে জয় নিয়ে ভাবনা থাকে না কোথাও
তখন সকলই জয় হয় -- ইহাই শূন্যতা
আকাশকে জেনে গেলে আকাশ থাকে না কোথাও
তখন সকলই আকাশ হয় -- ইহাই শূন্যতা
এই শূন্যতার ভিতরেই উদিত হয়
এইসব আকাশ-জয়-আকাঙ্খা-আগুন
কেননা উহারা তোমাকে এমতো কবিতার কাছে নিয়ে যাবে--
আমরা যেন একে অপরকে বিদ্বেষ না করি
আসলে তোমার নিজস্ব দর্শনটি তৈরি করাই কবিতার কাজ
কেননা উহাই তোমাকে এই শূন্যতার দিকে নিয়ে যাবে
যেভাবে আমরা আলো জ্বালাই -- আলোকে খোঁজবার জন্যে নয়
কবিতাও প্রজ্জ্বলিত হয় সেইভাবে
এই শূন্যতাকে উদযাপন করবার জন্যেই
অতএব স্থিত হও
আকাশের কাছে
দেখো
কেমন ঘটে যাচ্ছে সূর্যদয়,সূর্যাস্তও
তোমার কোনরকম কর্মচঞ্চলতা ছাড়াই
ভাবো
পৃথিবীর আবর্তনের সাপেক্ষেই এইসব উদয়-অস্ত অস্তিত্বশীল
এইসব আবর্তনের ভিতরে আবর্তনশীল তুমিও
অথচ এইসব আবর্তনের অতীত সব আকাঙ্খা
আশ্চর্য সব ডানার জন্ম দেয় তোমার ভিতরে
আশ্চর্য সব তীর্থযাত্রার
নৈঃশব্দের ভিতরে,প্রকৃত স্থিরতার ভিতরে
বোঝা যায়
আমাদের ভিতর হতে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য আশ্চর্য হাঁসেরা সব
অনুভব করো
তোমার শ্বাস প্রশ্বাসের ধ্বনি এইসব হাঁসেদের ডানার চঞ্চলতামাত্র
শরীরের মুদ্রা এইসব হাঁসেদের উড়ে যাবার ভঙ্গীমা ছাড়া কিছু নয়
অনুভব করো
এইসব হাঁসেদের পালকগুলি মায়াময় তুলে
গাছেদের পাতাগুলি আন্দোলিত করে
কে অন্বেষনরত থাকে?
তোমারই প্রানবায়ু
তুমি পূর্ণ
সেইহেতু তোমার যাবতীয় সুস্থিরতা
ও অস্থিরতা যথাযথভাবে আছে
তোমার যাবতীয় পাপ ও পূন্য
শোন,তৃপ্ত হয়ে উঠছে পাখিদের গান
উহারা ধীরে ধীরে তুলে নিচ্ছে তোমার সকল নিঃসঙ্গতা
আহার্য হয়ে উঠছে তোমার সকল ক্লান্তি সে গানের কাছে
এই ব্যপ্ত তৃপ্তির ভিতরে
ধীরে অতিধীরে বুঝে নাও
ভাবো, এইসব রহস্যকথা
আসলে যা কিছু ভাবা যায়, যা কিছু করা যায়
তাহা ভাবা ও করাই -- কর্তব্য
যা কিছু ভাবা যায়না,করা যায় না
তাহা না ভাবা ও না করাই -- কর্তব্য
প্রকৃত অর্থে আমরা কেউ জ্ঞানী ও মূর্খ
পবিত্র ও অপবিত্র হই না
যে যার কর্তব্যটুকু সম্পাদন করি মাত্র
আসলে যখন অজ্ঞানতা থাকে না, জ্ঞানও থাকে না
আর কর্তব্য
এই জ্ঞান ও অজ্ঞানকে অতিক্রম করা মাত্র
আমাদের কোন শরীর নেই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া
যা কিনা আমাদেরই শরীর
আমাদের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই শরীর ছাড়া
যা কিনা আমাদেরই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া শরীর হয়না
শরীর ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গও হয়না কখনো
তবু আমার শরীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গমাত্র -- বলি না
ইহা যেন অন্য কিছু -- তা-ও বলি না কখনো
অনুভব,আবেগ,মন,দর্শন -- এসব শরীরের অর্থাৎ শূন্যতারই মতো
তুমি চাঁদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করো
তোমার দর্শন অন্ধই হয়ে থাকে যতক্ষন না চাঁদ ওঠে
চাঁদ ডুবে গেলে আবার তোমার অঙ্গুলি নির্দেশ অন্ধই থেকে যায়
আসলে আমাদের প্রকৃত দর্শনটি এই --
কোথাও কোন চাঁদ নেই,আঙ্গুলও
দর্শনের মুক্তিই আকাশ
সকল আড়ালের অনুপস্থিতিই ইহাকে বর্ননা করে
আড়ালের অনুপস্থিতিই আকাশ নয়
আড়াল আকাশ নয়
আড়ালের বর্ননা আকাশ নয়
আড়ালের অনুপস্থিতির বর্ননাও আকাশ নয়
আবার আড়াল, আড়ালের বর্ননা, আড়ালের অনুপস্থিতির বর্ননা ছাড়াও
আকাশের বর্ননা সম্ভব হয়না কখনো
যেহেতু সকলেই এইভাবে একে অপরকে পেয়ে উৎপন্ন হয়
আমি আছি কি নেই দেখতে গিয়ে আমরা নিজেকে দেখতে ব্যর্থ হই বারবার
আসলে আমাদের আত্মপরিচয় থাকেনা
পরিচয়হীনতাও
আসলে আত্মার ধারনা আমাদের মুক্তি দেয় না কখনো
তা শুধু আমাদের বদ্ধতার পরিসরকেই ব্যপ্ত করে
পরমাত্মার ধারনা
একটি ছোট স্বার্থপরতাকে একটু বড় করে মাত্র
শূন্যতাই সেই প্রকৃত মুক্তি যাহার ভিতরে
সকলেই ধ্বংসের অতীত হয়ে থাকি
জন্মের অতীত, মৃত্যুর অতীত
অর্থাৎ অনন্ত হয়ে থাকি
শূন্যতার ভিতরে দন্দ্ব -- দন্দ্ব হয়না
শূন্যতার ভিতরে প্রতিবাদ -- প্রতিবাদ হয়না কখনো
শূন্যতায় বিশ্বাস -- বিশ্বাস হয়না কখনো
তবু শূন্যতায় বিশ্বাস --অর্থাৎ শূন্যতা আছে
কোন কিছু আছে -- অর্থাৎ শূন্যতা আছে
কোন কিছু নেই -- ঘটে না কখনো অর্থাৎ শূন্যতাহীনতা ঘটে না কখনো
একে অপরের সাপেক্ষে মায়া হয়ে রয়ে যাই আমরা সকলেই
আর এই মায়াহেতু একে অপরের কাছে এই মন্ত্র উচ্চারন -- রয়ে যায়
অহম অন্নম অহম অন্নম অহম অন্নম
আমি শূন্য আমি শূন্য আমি শূন্য
অহম অন্নম আমি শূন্য অহম অন্নম আমি শূন্য অহম.........
১
মেঘের অন্ধকার আছে।বৃষ্টিও।
বসে আছ।একা।একবুক অন্ধকার।
কাঁদবে না ?
২
বৃষ্টি পড়লেই মনে হয়
চলে যেতে হবে...
মাটি হয়ে ধুয়ে ধুয়ে
আমাকেও চলে যেতে হবে কোথাও...
৩
যে শিশুটি এইমাত্র জন্ম নিলো সে জানে না
এই আকাশের সাথে মাটির সাথে ওর পার্থক্য কি
তোমার শরীরের সথে ওর শরীরের
ওকে খুশি করার জন্যে এই যে তোমরা গান বাঁধছ
প্রার্থনা করছ ওর ভাল থাকা লক্ষ্য করে
ও জানে না -- বোঝেনি এখনো
ওর জন্মের আয়োজনে নেচেছিল ভাষা
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল মানুষের মুখ
৪
শিশুটি জিভে তুলে নিয়েছ একটিমাত্র ধ্বনি
শিশুটি মুখে তুলে নিয়েছে মাটি ছাই জল
ও স্পর্শ করছে তোমাদের শরীর
আর বলে চলেছে -- মা , মা...
ওর এই উচ্চারনের কাছে সব কিছু কেমন নির্বাক
তোমরাও নতুন হয়ে উঠছ
খুশী হয়ে উঠছ এই পরিচয়ের কাছে
৫
এত যে খেলা ছড়িয়ে যাচ্ছে তোমার সমস্ত ঘর জুড়ে
তা তোমার কতটুকু
অথচ সাজিয়েছিলে কত খেলার উপকরণ
সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে খেলতে চেয়েছ ওর সাথে
পারনি। অবাক হয়েছি।জানতে চেয়েছ
কী অত খেলা ওর
বোঝনি কখনো
তোমার কল্পনার চেয়েও দূরাগত নক্ষত্রের নীল
খেলে বেড়ায় ওর সাথে
৬
তোমার সন্তান হেঁটে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে
তোমার সন্তান হেঁটে যাচ্ছে ঠাকুরঘরের দিকে
স্নানঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ও
ঘরগুলির ব্যবহারের কাছে ওর বিস্ময়
ঘরগুলির ব্যবহারের কাছে ওর সরলতা রেখে
ও ফিরে আসছে
ঘুরে ঘুরে আসছে ও শুধু তোমারই কাছে
৭
আনমনে খেলছে ও
কী এক অনুপম সুরে তন্ময়
গান গাইছে -- তালে তালে দুলে উঠছে ও
এইসুর আর তালের কাছে
পরম শব্দের মত ঘন হয়ে এসেছে আকাশ
তুমি দেখছো আর প্রার্থনা করছো -- আমাকেও সঙ্গী কর
হে আকাশ হে পরম হে আমার সন্তান
৮
কখনো তোমাকে প্রমান করতে পারিনি
তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে যারা বলেছিলো আমরা তোমারই সন্তান
তারা আজ মৃত।
শুধু বিশ্বাস থেকেই একটি সফল আলিঙ্গন সম্ভব বলে
আজও দুহাত বাড়িয়ে রয়েছি।
৯
সমস্ত হারিয়ে ফেলবার মধ্যে এক পাওয়া আছে
সব ফেলে আসবার মধ্যে কিছু নিয়ে আসা আছে
ঠিক বোঝানো যায় না
এই যে সারা আকাশময় ছড়িয়ে আছে তোমার চোখের জল
আর আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি আমাদের হাত
এক প্রাপ্তি ঘটে যাচ্ছে কোথাও
ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না
১০
একটি পতঙ্গ কেঁপে উঠছে শিখার কাছে
একটি পাখী কেঁপে উঠছে সুরের কাছে
তুমি দেখছো।লক্ষ্য করছো সব
আর হেঁটে যাচ্ছ।
তোমার পথের দিকে চেয়ে আমরা প্রার্থনা করছি
আমাদের প্রার্থনার ভিতরে কেঁপে উঠছে একটি পতঙ্গ একটি পাখী
তুহিন তৌহিদ এর কবিতা
হাড়ঘাস, হাড্ডিবৃক্ষ, মাটি
মাটির ভেতর থেকে ঘাসশিশু সবুজ হাসিতে মাথা তুলে- আমাদের হাড়ঘাস- বৃক্ষদের দেখে কখনো কী বুঝি এগুলো আমাদের পূর্বপুরুষের রক্তমাংসহাড্ডি থেকে বেড়ে ওঠা হাড্ডিবৃক্ষ- মাটি কাউকেই বিভাজিত করে না কখনো- বাতাস জানে না কাকে বিভাজিত করবে সে- আর পানি ও আগুন বুকে নিয়ে কাউকেই আলাদা করে না- মানুষ মানুষকে বিভাজিত করে- ফুল থেকে ছিঁড়ে ফেলা পাপড়ি সে নিজেকে হারায়- মানুষ মানুষকে ভাঙে- তার উত্থানের সিঁড়ি করতে নিজে দলিত মৃত্তিকা হয়ে যায়- মাটিতে আমাদের হাড্ডিবৃক্ষ, হাড়ঘাস- অন্তিম নিবাস
ঘুনপোকা
ঘুনপোকা প্রকাশ্যে খায় না
তার খাওয়ার শব্দে কারো ঘুমও ভাঙে না
অথচ যখন আকস্মাত ভেঙে পড়ে অনিন্দ্য অবয়ব
বলি, ঘুনপোকা খেলো
শহরের সুদৃশ্য প্রাসাদ থেকে এককালে বৃদ্ধ ইট খসে
ডোবা ও পুকুরে জমা হয় শ্যাওলা ও ময়লার স্তুপ
আর যে বকটি
নিয়মিত আসতো সে কচুরিপানার ঝোপে
সে তখন চলে যায় দূরের আকাশ ঘেঁষে
বয়স্ক গাছের পাতা ঝরে
গ্রামের রাস্তার পুরাতন লোহার সেতুটি
আচানক ভেঙে পড়ে-
ঘুনপোকা
নিঃশব্দে খেয়ে চলে
প্রেম
পিপাসাকে প্রেম বলি- পিপাসাই প্রেম
গ্লাসভর্তি বেদনাকে পান করা, প্রেম
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে
অঘুমে সমস্ত রাত পার করা, প্রেম
সভায় আড্ডায় বসে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া আগুন হাওয়ায়, প্রেম
সব দিয়ে কোনো কিছু না পাওয়াই প্রেম
অন্যকারো আলিঙ্গন, বৃষ্টিস্নাত ময়লা মাটিতে
সোহাগে ছড়িয়ে পড়া, প্রেম
যা মূলত নেই, সেই মরীচিকা, প্রেম
সুদাসলে সব চলে যায়
ধার করা এই সুখগুলোতো পাখির মতো
একটি গাছে বাসা বাঁধে- ঝড় আসলে থাকে না আর
নীড় ভেঙে যায়- নীড়ের খোঁজে অন্য কোথাও
এমনি হয় ভুলে ভরা একটি জীবন বেছে নিলে
সুখগুলোতো পাখির মতো- উড়ে গেলে
ছিন্ন পালক পড়ে থাকে পরিত্যক্ত প্রাচীন নীড়ে
আমরা এদের দুঃখ বলি- জেনে গেছি
ধার পরিশোধ করতে গেলে সুদাসলে সব চলে যায়
বিচ্ছিন্নতা
বৃষ্টিকে কান্না বলি না- বৃষ্টি কার জন্য কাঁদে?
আকাশতো নীলাভ পাথার- কেবল তাকিয়ে থাকে
যেমন বৃরো থাকে শুধু তাকিয়ে
যেমন নদীরা নিজ স্রোতে বয়ে যায়
পাখিগুলো উড়ে যায়- গাছের একান্ত খুপে
যথারীতি হয়ে যায় বেনামী পালক
বস্তির অস্তির বুক ভেদ করে উঠে আসা দালানে বাজতে থাকে গান
মানুষ নিজের মতো হাঁটে আর
যে দাঁড়িয়ে থাকে জানালায় চেয়ে
তার জন্য বাতাস কি সহমর্মী হয়?
সবকিছু নিজ স্রোতে
বৃষ্টি ঝরার শব্দে কারো পায়ে নূপুর বাজে না।
মার্বেল
ছোটবেলায় মার্বেল খেলতাম। মার্বেল বন্ধুদের সাথে খেলা আর ঘুরাঘুরিতে কেটে যেতো সারাদিন। রাত হলে মার্বেলগুলো প্রজাপতি হয়ে যেতো- আমি পেছন পেছন ছুটতাম মাঠঘাট পেরিয়ে বহুদুর...
হাত থেকে ছুঁড়ে দেয়া মার্বেল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যেতো গর্তে; ছোটবেলায় এভাবে খেলে কখনো মনেই হয়নি একদিন মার্বেলের পরিণতি মেনে নিতে হবে- তারপর
গড়াতে গড়াতে
গড়াতে গড়াতে
পড়ে যাব একদম গভীর গর্তে-পাতালে।
মার্বেল নিয়ে মানুষের খেলা করার কোন অধিকার নেই, বরং মার্বেলের আছে
মানুষকে নিয়ে খেলার অধিকার।
একটি চিঠির শেষ ক’টি ছত্র
তারপর আর ফিরে তাকিও না। বিভ্রমের বিলাস যদিও আমার জীবনময় একটি বিভ্রম আমি কখনো করি না; আকাশের টেংকি থেকে আলকাতরা ঝরে যখন সমস্ত উদ্যানে ছড়িয়ে পড়ে আর পিঁপড়াগুলো সারিবদ্ধ হাঁটাহাঁটি বাদ দিয়ে গুহায় লুকায়- তখন কী তারা ভাবে তাদের পায়ের ছাপ রেখে যাওয়া পথের বিষয়ে? যে সকল হরিণেরা সবুজের প্রান্তর ছেড়েছে তারা আর কখনোই আসবে না- জেনেও আকুল এক উদাসী আভায় মাঠ চেয়ে থাকে বনের সমীপে
এটিএম বুথ
গলির প্রত্যেক মোড়ে সেজে গুজে দাঁড়িয়ে আছেন
কেমন রূপসী তিনি, রঙ-চঙ আলোঝলমলে
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হাতে
ঘঁষলেই ফোটে ওঠে কাঙিখত মুকুল।
অবগুণ্ঠনে ঢেকে দিলে তিনিও লাজুক
অপোয়
অতঃপর অন্য কেউ
ঘোমটা সরিয়ে ছুঁয়ে দিলে ভুলে যান অতীতের স্মৃতি
ভিষণ নির্মোহ তিনি- কারো কোনো স্পর্ষে তার অসম্মতি নেই।
আসতে না আসতেই চলে গেলে
আসতে না আসতেই চলে গেলে, তোমার আসার শব্দ শুনার জন্য এই অদৃশ্য মঞ্চে আমি কয়েক শ’ বছর পার করলাম- আমার পায়ের সবগুলো আঙ্গুল বৃরে শিকড় হয়ে মাটির অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে- আমার চারপাশে ঘুর্ণমান কয়েকটি প্রজাপতি জানিয়েছে তুমি আসছো, আর তুমি এসেই চলে গেলে
এখনো বাতাসে তোমার ঘ্রাণ, বোধের গভীরে কষ্টের মতো সুখের অনুরণন, ষ্পর্শের কোমাল দাগ, তোমার কূজনের মুখরিত বাতাস এখনো বইছে, আর তুমি আসতে না আসতেই চলে গেলে।
না হয় একটু দাঁড়াতে- জাদুর তুড়িতে চারপাশে একে দিতে আলোর ম্যাজিক; নিঃশব্দের বাগানে ফুটাতে শব্দের গোলাপ- না হয় নীরবে লিখে যেতে অসংখ্য কবিতা। আসতে না আসতেই হাত থেকে ছিটকে পড়া মার্বেলের মতো আচানক দৃশ্যান্তর- তোমার আসার কথা, আর অন্তহীন অপেক্ষার শেষে ভোরের মুখ দেখার কথা আমার। তুমি এসেছো, অথচ আসতে না আসতেই চলে গেছো
এক জনমে মরা শামুকের ভাঙ্গা খোলসে আর কতো পা কাটবো? আমিও কি বেদে হয়ে দূরের ঘাটে ঘাটে ভিড়াইনি নায়ের নোঙ্গর? আর রাত্রি দ্বীপ্রহরের অবসন্ন কাতরতা নিয়ে অসম্ভব বিষে নীল হইনি কখনো? তুমি তার কিছুই দেখোনি। নিঃসঙ্গতার কাঠের ক্রুশে আমি আজো ঝুলন্ত জেসাস। জগৎ যেখানে কারবালা- তৃষ্ণার তট, তৃষ্ণাই বাস্তবতা। তোমার আসার কথা- তোমার আশার কথা নয়
আত্মজৈবনিক
কৈশোরে একবার ইঁদুর মারতে গিয়েছিলাম। আমাদের উঠানের ধানের পারা থেকে বের হয়েছিলো ইঁদুরটি যখন দৌড়ে উঠানের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাচ্ছিল, আমরা তখন ছয়জন লাঠি হাতে তার পিছনে। প্রাণ বাঁচানোর সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে ইঁদুরটি আমাদের বারান্দায় উঠলো। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে শেষবার আমাদের দিকে সে ঘুরে তাকালো। মুহুর্তেই কয়েকটি লাঠির আঘাত পড়লো তার ওপর। কচুরিপানার ডাটার মতো ফুলে উঠলো সে। আমি তার গায়ে আমার লাঠিটি ছড়িয়ে দিলাম। কিছুণের মধ্যে মরা ব্যাঙের মতো ইদুঁরটি উল্টে গেলো
সবাই যখন ইঁদুর মারার কৃতিত্ব ভাগাভাগি করছে, আমি তখন ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে আমাদের ঘরের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে দূরের মাঠে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কণ্ঠ এতোটাই ভারি হয়ে গিয়েছিলো যে কথা বলতে পারছিলাম না। আমি কি কাঁদছিলাম? আমাকে গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করে আমার মা পেছনে এসে দাঁড়ায়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? আমি বিড়বিড় করে বললাম, ইঁদুর ... ইঁদুরটি খুব একা ছিলো। মা বললেন, এটুকু সহ্য করতে না পারলে ডাক্তার হবে কি করে? আমার মায়ের ধারণা ডাক্তার হতে মনটা খুব শক্ত হতে হয়।
মা, আমি হয়তো এজন্য ডাক্তার হতে পারিনি। ইঁদুর মারতে যাওয়া আর পাঁচ জনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে সেদিন আমি নিজের ভেতরে অন্য এক মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। আর নিজের ভেতরের উত্তাল সমুদ্রের গর্জন শুনে প্রথমবার আঁতকে উঠেছিলাম।
এখন পৃথিবীর অজস্র ধানের পারা থেকে শত শত ব্যাথিত ইঁদুর বেরিয়ে পড়ে। আমি তাদের চিৎকার- অন্তিম আর্তনাদ শুনি। নিজের হাতের লাঠি ছড়িয়ে দেই তাদের ওপর। মা, বিশ্বাস করুন সেই অসহায় ইঁদুরটির মতো আরো অসংখ্য নিঃসঙ্গ, দুর্বলকে রা করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে আমি এখনো পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে একাকী কাঁদি- যেনো এটা নির্ধারিত, আমার দুর্লঙ্ঘ নিয়তি।
মেহেদি রাসেল এর কবিতা
ইন্দ্রিয়জ
পড়ন্ত বেলার রোদ পায়ে দলে
তুমি হেঁটে যাচ্ছ প্রান্তরের দিকে
ওদিকে
শুন্যতার দিগন্ত।
আকাশঘেরা।
গোধূলি ক্রমশ নামছে........
সন্ধ্যার প্রাক্কালে,
যেসব পতঙ্গ উড়েছিল
লোভী পাখিদের নিশানায়,
সেইসব পাখিদের চোখ আমার।
মাংসের ব্যঞ্জন আর নধর মোরগ
ভালবাসতেন পিতামহ----
ফলে, এই যাত্রা,
বালুচরে অজস্র চিলের চতুর চক্ষু নিয়ে
দেখছি-
নিরিবিলি জোছনায়
পরাজিত পথচারী এক ,
মাংসের নন্দনে ক্ষুধার্ত।
মাতাল ৩
আমাকে পেরুতে হবে আলো-
যেখানে তোমার পোশাক বিভ্রম তৈরি করে
প্লেটে প্লেটে কাটাচামচ আর ছুরি
খাবার টেবিল মানেই হত্যার উৎসব-
মদের পেয়ালা হাতে সুবক্ষ তরুনী।
যেন তাকে পান করাবার অপেক্ষায় স্থির
পানশালায় তবু পুরনো দুঃখের স্মৃতিতে
খুনি হয়ে ওঠে পুষ্পের প্রেমিক
অবলীলায় পিছে ফেলে যায় গ্লাস
অপেক্ষারত উষ্ণ তরুনী
আর ভাংতি পয়সার মমতা।
এলিজি
তোমার জন্য লিখছি এই সন্ধ্যার নৈঃশব্দ
শহরের কোলাহল, রিকশার ঘন্টি, হকারের ডাকের ভেতর
অপসৃয়মান বেশ্যার প্রতি ইঙ্গিত, এসবই এখন দূরের।
শুধু নির্জনতার একটি বল্লম তেমার নিকটে পড়ে আছে।
দীর্ঘরাত্রিবাসের পর প্রেমিকার প্রতি বিতৃষ্ণা
আর তার ভেজা চুলের ঐশ্বর্য্য চিরকালই পুরুষের প্রেরণা
নিজস্ব রমনী ভেবে গণিকার আশ্রয়ে
নিশ্চিন্ত নির্ভরতা পায়না সবাই।
যে পায় সে ভাগ্যবান, ঈশ্বর তার বেদনা জানেন।
নিমফুলের নরম গন্ধ ছিল তোমার শরীরে
আর নৈঃশব্দের বল্লম, সেটিও স্নিগ্ধ, শিশিরভেজা।
শিকার
নিবেদনের ভাষা আমার নেই
কিংবা কোনো যৌথতার দায়বদ্ধতা
কেবল রয়েছে এক নিজস্ব নদীর ধারণা
ভাঙনের প্রারম্ভেই যে নিজের বসতিকে বেছে নেয়।
যেখানে শব্দ, সেখানে নৈঃশব্দ ও থাকে
ফলে এই ভাঙন, মৃদু আর অনুচ্চারিত।
ধ্বনির পঙ্কিল আবর্ত ব্যাপৃত হলে
আমি চলে যাবো মৌনতার দিকে
যেখানে তোমার চোখের গভীর সম্মোহন
আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে আবার ডোবাবে
রক্তচু মাছরাঙা যেমন দীর্ঘ প্রতীক্ষায়
একাগ্র শিকারের ধ্যানে তার
মাছটিকে পাবে।
মাসুদ খানের কিছু বাছাই কবিতা
১.
বৃষ্টি-২
বৃষ্টি হচ্ছে
বিদেশে
আরো কত কত আবছা ব্রহ্মদেশে, রঙ্গপুরে,
ব্যাপিত বগুড়াবর্ষে,
অনেক নিম্নের দেশে, ম্লেচ্ছাবর্তে,
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা
বিকালের ব্রহ্মদেশে,
বৃষ্টি হচ্ছে।
এবং উপর্যুপরি এই বিজলিশাসনের নিচে
এই বৃষ্টিনির্ধারিত তৃতীয় প্রহরে
দেশে দেশে কত রাঙা ও রঙিন জাতি
অস্পষ্ট গঠন নিয়ে ফুটে উঠছে উৎফুল্ল ভেকের মতো
অজানা উৎক্ষেপে।
বৃষ্টি আর বিদ্যুতের এই সহিংস প্ররোচনাক্রমে
চূড়ান্ত প্রশ্রয়ে
প্রলোভনে
বৃষ্টির প্রবল ঘোর আর
ঘূর্ণির ভেতর
বাতাসের অন্ধকারে
পূর্বাঞ্চলে
আকাশের নিচে
একাংশে, বিশাল ফাঁকা মাঠে
বিস্তারিত কচুখামারের আড়ালে আড়ালে
প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে জায়মান নতুন-নতুন সব রাষ্ট্র
ডানাভাঙা উত্থানরহিত কত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র
তাদের ময়লা মানচিত্র
এবং অস্থির কাঁপা-কাঁপা ত্রেফল
অশোধিত আইন এবং সব অসহায় খর্বকায় ন্যায়পাল
এবং অপরিষ্কার কিছু কুচকাওয়াজসমেত জেগে উঠছে শুধুই
শুধু যমনির্দিষ্ট নিয়তি নিয়ে।
এইবার রাত্রি সমাপ্তির দিকে প্রবাহিত। এখন বৃষ্টিও নিভুনিভু-প্রায়।
ওইসব কথিত উল্লাসশীল জাতি আর বিকাশচঞ্চল রাষ্ট্র আর
তাদের শরীরে
গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে স্ফুটমান আর সদ্যফোটা কত-না বর্ণাঢ্য ধর্মরাজি
সবসহ অচিরে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
ভোরের আলোয়। বিস্তারিত কচুপ্রান্তরের আড়ালে আড়ালে।
২. একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার
বনের কিনারে বাস, এক ছিল রূপবর্ণদাসী
আর ছিল, বনে বনে একা ঘোরে, সেই এক বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয় যেন বন্য মোম, নিশাদল-মাখা, বন্য আলোর বিদ্রূপ
রাতে মধ্যসমুদ্রে আগুন-লাগা জাহাজের রূপ
অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে_
দূর থেকে তা-ই দেখে কত রঙ্গে, কতরূপ ছলে ও কৌশলে
বেহুঁশ হয়ে যে যায়-যায়-প্রায় কত যে বামন গিরিধারী
আর যত অন্য-অন্য অর্বাচীন বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয়, বুনো সুর, বুনো তান, আর উপমান অরণ্যশোভার।
আঁচলে কূজন আঁকা তার, সেই বহুবল্লভার।
বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তারা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।
৩. একটি ভোরবেলা : সদ্য খসড়া-করা
ভোরের বাতাস আজ উন্নত দেশের
কাগজি টাকার মতো সপ্রতিভ_
একটানা সতেজ কখনো, কখনো-বা থেমে থেমে।
আর এই প্রভাতবেলায়
লালায়
রেশমসূত্রের গ্রন্থনায়
গাছে গাছে এখন গ্রন্থিত হয়ে আছে
প্রবন্ধের পাতার আকারে বহু উড়ন্ত জটিল পাতা
স্থগিত হয়ে থাকা কাণ্ডে, কাণ্ডজ্ঞানে,
অবাক বিন্যাসে যথা নদীর ওপারে।
কিছুক্ষণ আগেই এই তো
বেশ কিছু স্ফূর্তিশীল পাখি ও পতঙ্গ
তোলপাড় করছিল পৃথিবীর গাছে গাছে।
আকাশ তাদের জব্দ করে নিয়ে চলে গেছে অনেক উঁচুতে
মাখন-রাঙানো মেঘরাজ্যে
ওই ঝুরঝুর ঝরে পড়া চিকচিকে সোনালি চিনির দেশে_
মেঘে মেঘে প্রচারিত আজ তাই অনেক অচেনা কোলাহল।
অগ্রহায়ণের এই ভোরবেলা
দৃশ্য আর ঘটনার এই যে অসহ্য অতর্কিত রূপ
এসবের অন্তরালে, নিসর্গের কোন্ অভিপ্রায়,
সে-কোন্ প্রবাহে, ছকে, সে-কেমন ভাষ্যে, ব্যঞ্জনায়
কীভাবে যে মীমাংসিত হয়ে আছে!
ভোগী মানুষের অন্নগত প্রাণ আর
ব্যসনব্যঞ্জন উপলব্ধি দিয়ে যতদূর বোঝা যায়, বুঝি,
বুঝতে প্রয়াস পাই,
যতভাবে অনুভব করা যায়, করি।
আজ অগ্রহায়ণের এই তাক-লাগানো প্রভাতবেলা_
একা আমি বসে বসে ওইসব পাখিহারা স্তব্ধ গাছে গাছে
একটু একটু করে পাখি আর মৌমাছি মেশাই,
একটির পর একটি মৌচাক বসিয়ে যাই ডাল থেকে ডালে_
কিছুটা বিশেষ্য করে তুলি।
৪. তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।
আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে..., কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়!
এ-মধুদিবসে আকাশে বাতাসে জাগে
ঘর ছাড়বার একটানা প্ররোচনা।
হারিয়ে পড়তে নদী মাঠ বায়ু ডাকে
ঘরে ঘরে তাই গোপন উন্মাদনা।
জগতের যত সংসারছাড়া লোক
ঘুরে ফিরে শেষে সরাইখানায় স্থিত।
এ-স্নেহবর্ষে তুমি কি চাও যে, হোক
ঘরছাড়া ফের ঘরেই প্রতিষ্ঠিত?
হারানো মানুষ সেই কত কাল ধ’রে
স্বজনের ভয়ে দেশ থেকে দেশে ঘোরে।
স্বজনেরা তবু নানান বাহানা ক’রে
বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে!
স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়।
স্বজন যখন নিরাশাদ্বীপের পথে
হারানো খুঁজছে নতুন এক অধ্যায়।
৫. ছক
দশটি পথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, য়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুন রাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।
একদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারে মা কুড়িয়ে পেলেন আমার ভাইকে (আমি তখনো আসিনি আমার এই মায়ের কাছে)। কিন্তু কিছুকাল পর আমার সেই ভাই হঠাৎ গেল হারিয়ে। তারপর থেকে মা আমার ওই পথমোহনায় বসে তীব্র পুত্রশোকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।
একবার, গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা। মা-র কাছে সব শুনে বললেন, ‘কোথাও তো কিছু হারায় না মা এই মহাবিশ্বে! যাও খুঁজে দ্যাখো।’ তারপর থেকে মা আমার উড়ে উড়ে বিশ্বসংসার তোলপাড় করে খুঁজে ফিরেছেন তার
সন্তানকে। শেষে সপ্ত-আকাশের পরপারে আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে, এবং তার সন্তানকেই পেয়েছেন মনে করে, উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই মর্ত্যরে ধুলায়। আমি তখন সাত আসমানের ওপারে অনন্ত নত্রকুঞ্জের ঝাড়জঙ্গলের ধারে সোনালি খড়ের গাদায় বসে অনাথ শিশুর মতো কাঁদছিলাম একা একা, মাকে হারিয়ে।
দিন যাবে, মাস যাবে, ঘুরে আসবে বছর...
একদিন হয়তো আবার হারিয়ে যাব আমি এই নতুন পাওয়া মায়ের কাছ থেকে আর আমাকে খুঁজে পাবেন অন্য এক মা। তারও হারিয়েছে
সন্তান। আমাকে পেয়ে ভাববেন, খুঁজে পেয়েছেন তারই হারানো ছেলেকে।
এইসব অনন্ত বিভ্রম আর বন্ধন
এই যে নিখিল ভুলবোঝাবুঝি
লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা আর হারানো-পাওয়া খেলা
এইসব নিরন্তর মায়া ও ম্যাজিক...
সবকিছু অমীমাংসিত রেখে দিয়ে,
কাটাকুটি ময়লা ডুপ্লিকেট নকশা একখানা জগৎসংসারের,
তা-ই মেলে ধরে অবাক উদাস হয়ে বসে আছেন জরিপকর্তা।
নকশাটাতে একপাশে লেখা_ স্বাক্ষর/- অস্পষ্ট
নিচে তার চেয়েও অস্পষ্ট একটা সিল...
৬. শৈবালিনী
স্রোতে শুধু ভেসে চলো তুমি ওগো শৈবালিনী, শৈবালিকা, জলজা আমার
তুমি, তুমি ধর্মে মৎস্য, জাতিতে শৈবাল, আর স্বভাবে যে সৌদামিনী তুমি...
তুমি ঊর্মি-রাশির জাতিকা
ঊর্মিসঙ্গে ভেসে চলাতেই হয় তব ধর্ম, আনন্দ তোমার।
তুমি মাছ হয়ে যাবে, নাকি
হবে কোনো জলজ উদ্ভিদ_
এতকাল পর এই দ্বিধা আজ, শৈবালিনী, জাগছে তোমাতে
মুহুর্মুহু বিজলিবিলাসে।
ফোটে ফুল, আস্তে আস্তে, ফোটে তার বিবিধ ব্যঞ্জনা
আবার হারিয়ে যায় জলে সেই ফুল, সেই জলজ রচনা
জল থেকে জলান্তরে...বহু নাম জাগে পথে পথে,
সর্ব নাম ফের বদলে বদলে যায় স্রোতে।
বহুলনামিনী তুমি বহুলচারিণী বহু-আকারিণী জলজা আমার
তুমি, তুমি ধর্মে মৎস্য, জাতিতে শৈবাল,
স্বভাবে বিদ্যুৎ-লতা তুমি...
তুমি ঊর্মি রাশির জাতিকা, ঊর্মিসঙ্গে ভেসে চলাতেই হয় তব ধর্ম ও সাধনা
তোমাতে ক্ষণেই জাগে মাছের স্বভাব, ক্ষণেই তো ফের শিকড়বাসনা...
৭. জ্বরের ঋতুতে
তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধস-নামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট...ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে...সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উতরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নাই, তাপাঙ্ক নাই...তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন বীর্যতরল।
তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। কেবল তাদের কিছুটা কদাকার দেখায়_কিছুটা করালী, কিছুটা পিশাচীর মতো।
যত রূপসী তত কদাকার...
একসময় মাথাফাটা থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চ’ড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি প্রিয়তরা পিশাচী আমার।
জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস
মিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা রেতঃনির্যাস।
৮. বীতকৃত্য
যেইদিন বৃক্ষ ত্যাগ করবে তার বৃধর্ম
মিষ্ট নয়, ফল হবে কটু বা কষায়
আর সোজা না ফেলে সে ফল ফেলবে তির্যক ভঙ্গিতে...
যেইদিন আম্রবৃক্ষে জাম হবে, তাম্রবৃক্ষে সিসা...
দস্যুকে তো শীলাচারী হলে চলে না
তবুও যেদিন সে দস্যুতা ত্যাগ ক’রে
হয়ে উঠবে সুশীল, পাদ্রি ও পরার্থপর
বকেরা যেদিন মশগুল হবে মৎস্যমঙ্গলচিন্তায়...
যেদিন আয়না পরিত্যাগ করবে তার আর্শিধর্ম
দেবে না তো আর কোনো প্রতিবিম্ব
পাহাড় দেবে না প্রতিধ্বনি...
আর যত শীল ও দুঃশীল গতি অগতি কুশল অকুশল
আর যত অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি, বারো রকমের বন্ধনযাতনা
সংসার সন্ন্যাস মো মোহ কাম কৃত্য ঘাম মূত্র বীর্য ধর্মাধর্ম পুরীষ পৌরুষ
সব একাকার হবে যেইদিন
সেদিন কোথায় কোন দূরে নিয়ে যাবে গো আমায়
ধর্মহারা বীতকৃত্য সূত্রহীন পুরীষবিহীন...
৯. নির্বাসন
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে আকাশ ঢাকা
গায়ে তার জ্বলে কোটি-কোটি প্লাংক্টন
তারই মাঝে একা একটি শ্যামলা মেঘে
সহসা তোমার মুখের উদ্ভাসন।
হয়তো এখন আকাশ নামছে ঝেঁপে
মেঘ ও মেঘনার ছেদরেখা বরাবরে
ঝাপসা একটি মানুষীর ছায়ারূপ
ঝিলিক দিয়েই মিলাচ্ছে অগোচরে।
দূর গ্রহে বসে ভাবছি তোমার কথা
এতটা দূরে যে, ভাবাও যায় না ভালো
ভাবনারা হিম-নিঃসীম ভ্যাকুয়ামে
শোধনে-শোষণে হয়ে যায় অগোছালো।
অথচ এখানে তোমারই শাসন চালু
তোমার নামেই বায়ু হয়ে আমি বই
তোমারই আবেশে বিদ্যুৎ জাগে মেঘে
তোমার রূপেই ময়ূর ফুটেছে ওই।
মধুকর আজ ভুলে গিয়ে মাধুকরী
রূপ জপে তব কায়মনোগুঞ্জনে।
মনন করছে তোমারই বিম্বখানি
ধ্যানে ও শীলনে, স্মরণে, বিস্মরণে।
গন্ধকের এই গন্ধধারিণী গ্রহে
তটস্থ এক বিকল জীবের মনে
ক্ষার, নুন, চুন, অ্যাসিড-বাষ্প ফুঁড়ে
চমকিয়ে যাও থেকে-থেকে, ক্ষণে ক্ষণে ।
১০. শূন্য
নিখিলের হঠাৎ-বিগড়ে-যাওয়া সে-কোন গোপন সংখ্যামেশিনের থেকে
অচেনা অসুখের মতো, অজ্ঞাত গজবের মতো গলগল করে বেরিয়ে আসছে সব শূন্য।
সাধের মেশিন থেকে আশা ছিল বেরিয়ে আসবে কত-না বিচিত্র অঙ্ক আর সংখ্যা
আর ভরে যাবে এই দুখিনী দুনিয়া! তা নয়, কেবলই শূন্য।
তা-ও শূন্যগুলি সব দশমিকের ডানে বসা একটানা শূন্যের সিরিজ_
অর্থহীন উদ্বৃত্ত বন্ধ্যা ও হাহুতাশময়!
এক মহামেশিনের বিপুল ববিন থেকে, গোপন ও প্রকাশ্য সব স্লট থেকে
চিরতরে ছাড়া পাওয়া যেইমতো মাইল-মাইলব্যাপী সুতার বহর
সেইমতো এইসব খরস্রোতা শূন্যের নহর...
অন্য কোনো অঙ্ক নাই সংখ্যা নাই শুধু শূন্য উপচে উপচে আসা
লাফাংগার মতো লাফাতে লাফাতে আর গড়াতে গড়াতে আসা
বহরে বহরে পাতা আর পাতার বাহার করতে করতে আসা
ইঁদুর ও ভোঁদড়ের ভঙ্গি ধ’রে লীলা আর লাস্য করতে করতে আসা
চিকা আর চামচিকার মতো হাস্য ও রহস্য করতে করতেই
দিল্মে চাক্কুমারা পাগলা ও ভোলাভালা হাক্কু ও হাহাকার করতে করতে আসা
দশমিকের ডানে-বসা কানে-ঠসা কালা-নুলা নেলাফেলা খাটাশ-খবিশ নষ্ট-ভ্রষ্ট
ডাহা-ডাহা যত শূন্যের দল ভয়াবহ শূন্যের কাফেলা..............................
আর ওই যে বিকট বেঢপ অতিকায় এক শূন্য,
ওটাই পালের গোদা, আন্ধা-কালা কাফেলাসালার...
এসব কি স্রেফ বিগড়ে-যাওয়া সেই গূঢ় মেশিনের ঋতুবিভ্রম!
দশমিক-পরবর্তী শূন্যের প্রবাহ হয়ে মহাশূন্য ভরে ফেলছে ক্রমে
এমনিতেই জড়ের দুর্বহ দায়ভার
তদুপরি শূন্যের শাসন, অত্যাচার
কোথায় পালাবে তবে প্রাণ!
প্রাণী সব করে রব, ভয়ে_
বদ্ধ ও তটস্থ প্রাণিকুল
ফাজা আলাহুম কা’স ফিম্মাকুল।
ইতিমধ্যেই যে শূন্যস্থানগুলো তৈরি হয়ে আছে
সেগুলো তো পূরণ হচ্ছেই না, বরং তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন শূন্যস্থান
মহাশূন্য আরো মহা শূন্য হচ্ছে...
অবশেষে একসময় শূন্যস্থান দিয়েই, যাঃ, পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে
খসখসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, দিনদুনিয়ার।
১১. নলজাতক
যদি আমি অর্জন করে থাকি দশপারমিতা, তবে এই বনে যত নল আছে সমস্তই গ্রন্থিশূন্য ও একচ্ছিদ্র হোক, যাতে নলের ভেতরে জাতকদের জন্ম, বর্ধন ও বিচরণ হয় অতি অনায়াস। অতঃপর একদিন দুপুরে, নুইয়ে ফেলে মোটা-মোটা নলখাগড়া অগণন, নলের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসুক সারা গায়ে নালঝোলমাখা কালো-ধলো সরল- ও কোকড়া-চুলো গমরঙা তামাটে কপিশ অগণিত রৌদ্রদিগম্বর ন্যাংটা নলজাতক। ভরে যাক নিস্তরঙ্গ এ-অরণ্য অক্ষৌহিণী দাপুটে দামাল শিশুবাহিনীর উত্তাল তরঙ্গরঙ্গে...
১২. ইতিহাস
কী করে সম্ভব তবে পৃথিবীর সঠিক ইতিহাস? কারণ, যিনি লিখেছেন, তিনি কে এবং কোথায়? কোন্ সময়ে, কোন্ অবস্থানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশ্যে লিখছেন, সে-সবের ওপর নির্ভর তার ইতিহাস। আর তা ছাড়া বিষয়টি বিষয়ীগত, সাবজেকটিভ।
তবে কি সত্যিই অসম্ভব সঠিক ইতিহাস?
_না। ভূমণ্ডল হতে এ যাবৎ যত আলো বিকীর্ণ হয়ে চলে গেছে সে-সবের মধ্যেই মুদ্রিত হয়ে আছে পৃথিবীর ইতিহাস, কালানুক্রমিক। অর্থাৎ পৃথিবী হতে বিচ্ছুরিত আলোর ইতিহাসই পৃথিবীর ইতিহাস। আর তা-ই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস, কেননা তা লিখিত প্রাকৃতিকভাবে। এই নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে বসে দূরবীণ দিয়ে সেগুলি টুকে নিচ্ছে হয়তো-বা কেউ কেউ-আমরা জানি না।
তবে সে-ও কি হবে সঠিক ইতিহাস? কেননা, ইতিহাসের সেই সব অধ্যায়, যেগুলি কালো এবং অন্ধকার? সব আলো শুষে নিয়ে নিয়ে যেগুলি কালো ও কলঙ্কিত হয়ে পড়ে আছে? যেগুলি থেকে কোনোকালেই আর বের হয়নি এবং হচ্ছে না কোনো আলো? সেইসব?
তা ছাড়া সেই সব মানুষদের ইতিহাস, যারা কালো এবং কালচে তামাটে?
-হয়তো-বা দূরবীণে ঝাপসা হয়ে ধরা পড়ছে তাদের ইতিবৃত্ত, ঝাপসা মুদ্রিত হচ্ছে তাদের ইতিহাস-যেহেতু তারা যথাক্রমে কৃষ্ণ এবং ঊনকৃষ্ণ, যেহেতু তারা খুবই সামান্য আলো দিতে পারে বলে পৃথিবীতে প্রচারিত, বিচ্ছুরণে তারা প্রায় অম বলে প্রচারিত।
তাহলে কি কালো ও তামাটে মানুষদের ইতিহাস নিরন্তর ঝাপসাই থেকে যায়!? পৃথিবীতে!? এবং প্রকৃতিতে!? আলো নেই, তাই ইতিহাসও নেই!?
১৩. প্রত্যাখ্যান
হঠাৎ মায়ের স্তন্য থেকে, আজই, উৎখাত হয়েছে শিশু
ঘুরে ফিরে বারে বারে যায় তবু মায়ের নিকট
বকা খায়, কিছুটা অবাক হয়, তবু শিশু যায়...
অবুঝ কী আর বোঝে কী-বা অর্থ হয় এই উৎখাতলীলার!
কী-বা এর বিন্দু ও বিসর্গভাব
কিছুই পারে না বুঝতে মায়ের স্বভাব
শুধু ভাবে-মায়ের কৌতুক তবে এতটা নিষ্ঠুর!
মাতা কেন হয় আজ এতটা বিমাতা
এই খরাঋতুতে হঠাৎ?
ভেবে একা কষ্ট পায়, নিঃসহায়, ফের তবু যায়
শিশু ফের বকা খায়, আবার অবাক হয়, তবুও সে যায়...
কেঁদে কেঁদে অবশেষে বোবা অভিমানে
অবশ ঘুমিয়ে পড়ে মাটির শয়ানে।
শুধু তার পিপাসার ধ্বনি এসে লাগে কানে
থেকে থেকে, এই মহিমণ্ডলের এখানে ওখানে।
১৫. নিঃসঙ্গ
লক্ষ-লক্ষ মাইল উঁচুতে, মহাকাশে,
জনমানববিহীন ভাসমান একটি স্পেস-স্টেশনে পোস্টিং পেয়ে
এসে জয়েন করেছে একজন নভো-স্টেশনমাস্টার।
একদিন একটি রকেট এসে প্রচুর বোঁচকা-বুঁচকিসহ তাকে নামিয়ে দিয়ে,
ফুয়েল-টুয়েল নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কোন আসমানের ওপারে...
সে-ও কতদিন আগে!
মৃত্যুরও অধিক হিম আর নির্জনতা...
মানুষটি একা-একা থাকে, খায়, ঘুমায়_ওজনহীন, নিঃসাড়, নির্ভার...
মাঝে মাঝে নভোপোশাক পরে বাইরে সাঁতার কেটে আসে শূন্যে,
তখন সে বাঁধা থাকে অ্যালুমিনিয়ামের লম্বা লাঙুলে, স্টেশনের মাস্তুলের সঙ্গে।
দুঃখে-অভিমানে কখনো কখনো গিয়ে হেগেও আসে মহাকাশে
জ্বলজ্বল করতে থাকে তার সেই স্বচ্ছ-সুগন্ধ পুরীষপিণ্ড,
স্ফটিকের মতো ফোঁটা-ফোঁটা মূত্ররাশি
কাছে-দূরে কোত্থাও কেউ নাই,
কোনো প্রেত-প্রেতিনী, অথবা কোনো যম-যমী, জিন-পরি, ভগবান-ভগবতী,
ফেরেশতা-ইবলিশ কাঁহা কিচ্ছু নাই, কেউই ঘেঁষে না কাছে, যে,
তার সঙ্গে একটু কথা বলবে, কফি খাবে...
এমনকি মানুষটা যে একটু ভয় পাবে, তারও উপায় নাই...
নিজের সঙ্গেই তাই নিজেরই মিথুন ও মৈথুন, খুনসুটি, হাসাহাসি, সাপলুডু খেলা
কেবল রজনীস্পর্শা, ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী ফুটে থাকে অবাধ, অনন্তরায়,
বহুকাল দূরে...
১৬. যোগাযোগ
ওই বাতবিতাড়িত মেঘমালা, বিজলি-জাগা মেঘের স্তবক,
তারই সাথে জাগে খর বজ্রের গমক
বজ্রের হাঁকের মধ্যে শুনছ তুমি গায়েবি অনুশাসন, বোবা ও সুদূর।
ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে শ্রবণ করছ হে মহামণ্ডলের সুর।
সবগুলি ইন্দ্রিয় নিভিয়ে দিয়ে তুমি
গুরু গন্ধতেলের প্রদীপ জ্বেলে জেগে থাকছ, ভাসছ, একা-একা
তুলার মতন নিরপে, ধ্র“ব, অবন্ধন...
জ্বালিয়ে রেখেছ শুধু একাকী শ্রবণ!
শ্রব্যাশ্রব্য বহু কিছু ধরা পড়ছে শ্র“তিতে তোমার!
তোমার শ্রাবণ জ্ঞান থেকে আজ কিছুটা প্রসাদ
কিছুটা দ্রবণ যত্নে ঢেলে দাও শ্রবণে আমার
বেঁচে উঠি, এবং উৎপুচ্ছ হই, মেতে উঠি শ্রাবণ উৎসবে।
বাগিন্দ্রিয় বাগ্বিরুদ্ধ হোক এইবার
স্বাদরুদ্ধ স্বাদেন্দ্রিয়!
শ্রুতি ছুঁয়ে যাক শ্রুতি, হৃদিতে মিশুক হৃদি, শ্রবণে শ্রবণ...
যোগাযোগ হোক একদম সরাসরি, সোজা ও সহজ!
১৭. দমকল
উন্মাদ উঠেছে গাছে, তরতর ক’রে, ছাড়া পেয়ে পাগলাগারদ।
নামে না সে কিছুতেই, যতণ-না ওই খর্বকায়া নার্সটি এসে
মিনতি করে না-নামায় তাকে।
নার্স আসে দ্রুত, দমকলের মতন
কী-কী যেন বলে হাত নেড়ে নেড়ে,
তাতে খুশি হয়ে নেমে আসে উঁচু ডাল থেকে বিমুগ্ধ পাগল-
ঝোলের আনন্দে যেইভাবে নেমে আসে কইমাছ, পাতে
ক্রমিক সংখ্যার মতো সহজ স্বচ্ছন্দে।
ঝিলমিল করে বয়ে যায়, সেবিকার বোধে, পাগলের বিকল বিবেক।
উন্মাদ আবার ফিরে যাবে আজ উন্মাদ-আশ্রমে
ধর্মগণ্ডিকায় মাথা রেখে নির্বিকার নিয়ে নেবে
তেরোটি ইলেকট্রিক শক
তেরোবার স্বীকারোক্তি, স্বাস্থ্যযাজকের শান্ত সুধীর নির্দেশে।
১৮. আতাফল
এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু ছায়াচ্ছন্ন দেশে দেশে।
দেখতে যেন-বা এক সবুজ গ্রেনেড
আবার কিছুটা বটে হৃৎপিণ্ডের মতো_
অভ্যন্তরে বারুদের তোলপাড়-করা ঘ্রাণ, আর
সুস্বাদ! অচিন্তনীয়।
শৈশবে যেখানে থাকতাম, নিকটেই ছিল এক পরিত্যক্ত ভিটাবাড়ি। প্রাচীন উদ্ভিদ আর লতাগুল্মে ভরা। একদিন গোধূলিবেলায়, পিতামহ, ঘুম থেকে সহসাই জেগে উঠে, অনেকটা রহস্যের নায়কের মতো গেলেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই ভিটায়। হাওয়ায় আন্দোলিত পোড়ো ভিটা। বহু গাছগাছালির মধ্য থেকে গোপনে একটি গাছকে দেখালেন। সাধারণ একটি গাছ। কিছু ফল ঝুলে আছে তাতে। দেখতে অনেকটা গ্রেনেডের মতো। মেওয়াফল। আতা-মেওয়া। পিতামহ বললেন_এগুলা বেহেশতের ফল। একমাত্র স্বর্গজাত ফল, যার নমুনা দেখানো হয়েছে দুনিয়ায়। চুপচাপ দেখে নে। বলামাত্র আমার এবং পিতামহের সর্বাঙ্গ হাউই তুবড়ির মতো একসঙ্গে শিহরিত।
পিতামহের বিরল-বসন্ত-চিহ্নিত ফর্সা অবয়ব আর লম্বা-লম্বা গোধূলিরঙের দাড়ি, আমাকে, আমার শিহরনগুলোকে আচ্ছাদিত করে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল একটানা প্রবল হাওয়ার ভেতর।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে পরিষ্কার হারাবতী নদীর ওপার।
অস্তরেখা বরাবর ওই যে উঠছে জেগে সুদূর কদলীবন। তারই ফাঁকে ফাঁকে
একা-একা রূপকথা হয়ে ওই ঘুরছে এক গেরিলা কিশোর_সহযোদ্ধারিক্ত,
পরিবার-পরিজন থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন,
পাক খেয়ে খেয়ে শুধু হারিয়ে হারিয়ে
একেবারে একা হয়ে যাওয়া এক গেরিলা কিশোর_
ডান হাতে আতাফল, বাঁ-হাতে গ্রেনেড,
বাম কানে ছোট্ট রিং, কাঁধে কালাশনিকভ, গায়ে ইস্পাতরঙের
জ্যাকেট, গলায় বুলেটের মালা, মাঝখানে হৃৎপিণ্ড_
সব আলপিনে আলপিনে গাঁথা।
অস্তমাখা দূরের কদলীবনে ভিনদেশী গেরিলা কিশোর।
কথা বলে ঝটপট, অবিকল সন্ত্রাসের বাগ্বিধিতে।
অন্য কোনো ভাষা নেই, কোনো বিধি নেই বনভূমে ওই বাগ্বিধি ছাড়া_
আর সন্ত্রাসের বিপরীতে মুহুর্মুহু অপরূপ সন্ত্রাস...
প্রতিটি সন্ত্রাস প্রণয়নশেষে, বারবার, আঁজলা ভরে জল খায়
আর পাক খেয়ে খেয়ে হারিয়ে হারিয়ে
একদম একা হয়ে যায় এই গেরিলা কিশোর,
সন্ত্রাসশিল্পের রচয়িতা।
আর এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু ছায়াচ্ছন্ন দেশে দেশে
অস্তমাখা কাতর গ্রেনেডফল। অভ্যন্তরে বারুদের মৌ-মৌ ঘ্রাণ, আর
সুস্বাদ! অচিন্তনীয়।
পক্ষান্তরে, গ্রেনেড_অপূর্ব এক ইহফল।
গ্রেনেড_কিছুটা উগ্র কিন্তু চমৎকার এক ইহফল।
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রোজ্জ্বল দেশে দেশে।
অভ্যন্তরে কোনো এক দুর্লভ ফলের মাতাল-করা ঘ্রাণ।
বিদেশী অরণ্য আজ আতায় গ্রেনেডে তোলপাড় এই গোধূলিবেলায়।
ভিনদেশী গেরিলা কিশোর
তার ডান হাতে আতাফল, বাঁ-হাতে গ্রেনেড এবং
মাঝখানে হৃৎপিণ্ড_এভাবে ভারসাম্য রেখে রেখে
টালমাটাল পায়ে স্বর্গসড়কের সেই মহাবিপদ্জনক সাঁকো
পার হয়ে সর্বাগ্রে, দুর্লভতর এক ইহফলের স্মারকবার্তা নিয়ে
স্বর্গদ্বারে করাঘাত...
অনেক পেছনে পড়ে থাকে পুণ্য যাত্রীদল।
তারা আতঙ্কজনকভাবে পেছনে।
আর এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু রৌদ্রচ্ছায়াময় দেশে দেশে।
১৯. বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা
মেঘ থেকে মেঘে লাফ দেবার সময়
তূরীয় আহাদে দ্রুত কেঁপে-বেঁকে
একটানে একাকার যখন বিজলিসূত্র, ওই ঊর্ধ্বতন
মেঘের আসনে এক ঝলক দেখা গেল তাকে
আলোকিত ঘনকের আকারে।
তাকে ডাক দেবো-দেবো, আহা কী বলে যে ডাক দেই!
জন্ম এক রুদ্ধভাষ জাতিতে আমার_
মুহূর্তে মিলিয়ে গেল অপর আকারে।
দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন_
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।
যেই দেখি আর ডাক দিতে যাই প্রিয়, অমনি
তোমার সমস্ত আলো, সকল উদ্ভাস
হঠাৎ নিভিয়ে নিয়ে চুপচাপ অন্ধকার হয়ে যাও।
আবার উদ্ভাস দাও ক্ষণকাল পরে_
এইরূপে খেলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমারই সাহিত্যে আহা এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
এরপর থেকে একে একে এক উচ্চতর জীবের বিবেক
প্রথমে প্রয়োগ করে দেখি,
মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি আকারে ও নিরাকারে।
এক অতিকায় জট-পাকানো যন্ত্রের
আগ্রহ সাধন করে দেখি,
তা-ও তিনি ছড়িয়ে পড়েন সেই আকারে নিরাকার;
আকাশে আকাশে মেলে রাখা তার কী ব্যাপক কর্মাচার,
একটির পর একটি গ্রহ আর জ্বালানি-জংশন সব
অতর্কিতে নিভিয়ে নিভিয়ে প্রবাহিত হন তিনি।
একদা মণ্ডলাকার ছিলে জানি
আজ দেখি দৈবাৎ ধর্মান্তরিত, ঘনকের রূপে!
ঘনক তো গোলকেরই এক দুরারোগ্য সম্প্রসার।
তবুও তো ধর্ম রা পায়। রতি, সাধিত হয় তবু।
গোলকত্ব পরম আকার
গোলকতা যথা এক অপূর্ব বিহেভিয়ার, প্রায়-
নিরাকারসম এক নিখুঁত আকার।
শৈশবের কালে, এক আশ্চর্য মশলা-সুরভিত
গুহার গবাপথে আচম্বিতে ভেসে উঠেছিল মেঘ,
যার বাষ্পে বাষ্পে কূটাভাস।
কিছুতেই পড়তে পারি নাই সেই মেঘ
আমরা তখন।
বিব্রত বাতাস তাকে, মেঘে মেঘে সংগঠিত ক্ষণ-ক্ষণ-আকৃতিকে,
ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যাচ্ছে কত বিভিন্ন প্রদেশে।
নিরাকৃত হতে হতে প্রায়, ওই তো ব্যক্ত হচ্ছেন ফের আকারে আকারে।
ধর্মচ্যুত হতে হতে প্রায়, ফের প্রচারিত হন ধর্মে ধর্মে।
আহা, ধর্ম হারালে কী আর থাকে তবে এ ভুবনে!
ঘনক যে গোলকেরই এক নিদারুণ তাপিত প্রসার।
বৃহৎ, অকল্পনীয় এক জড়সংকলন। বড় বালিপুস্তকের মতো_
তারই মধ্যে অকস্মাৎ একটু প্রাণের আভা। মাত্র তার একটি পৃষ্ঠায়।
এই সংকলনের ভূমিকাপত্রটিও নেই। ছিন্ন। সেই প্রধান সংঘর্ষে।
নিষ্ক্রান্তিদিবসে, অতঃপর, ওই গুহামুখে পড়ে থাকে
এ বিপুল জড়সংকলনের ছেঁড়া ভূমিকাপৃষ্ঠাটি,
অর্থাৎ সেই যে প্রথম ক্যাজুয়াল্টি, নিখিলের_
ওই গুহাপথে, নিষ্ক্রমণকালে।
একবার মাত্র দেখা হয়েছিল কায়ারূপে
ঝাপসা, ছায়া-ছায়া!
তা-ও বিজলির দিনে, তা-ও মেঘের ওপরে
উলম্ফকালীন।
এরপর থেকে শুধু ভাবমূর্তি...
যেদিকে তাকানো যায়
কেবলই, উপর্যুপরি ভাবমূর্তি ঝলকায়।
মাঠে মাঠে স্প্রিং স্ক্রু আর নাটবোল্ট ফলেছে এবার সব জং-ধরা।
সে-সব ভূমিতে হাঁটু গেড়ে গলবস্ত্র হয়ে পরিপূর্ণ দুই হাত তুলে
যাচ্ঞামগ্ন সারি সারি সম্প্রদায়_তারা অসবর্ণ, তারা
লঘিষ্ঠ-কলহরত বিড়ালের আধো-আলো-আঁধারি বাচন ও কণ্ঠস্বর
কেড়ে নিয়ে দ্রুত নিজ কণ্ঠে কণ্ঠে গুঁজে দিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে যায় তারা।
তেজের অধিক তেজ
বাক্-এর অধিক বাক্স্ফূর্তি তুমি,
গোলকে স্ফুরিত হয়ে এসো পুনর্বার
পূর্বধর্ম ধারণ ক’রে সরাসরি উত্তম পুরুষে।
আর
কত অর্থ যে নিহিত করে রাখো বীজাকারে
সেইসব ভাসমান বাক্যের অন্তরে,
দৃশ্যত যা অর্থহীন অতি-অর্বাচীনদের কাছে।
সংকটে সংকটে, সর্ব-আকারবিনাশী
দহন দলন আর দমনের দিনে
আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই
চতুর্দিক থেকে একসঙ্গে আর
বৃক্ষে বৃক্ষে আর দ্রব্যে দ্রব্যে আর ভূতে ভূতে সর্বভূতে
মুহুর্মুহু উদ্ভাস তোমার, এক অবধানপূর্ব রহিমের রূপে।
ঘনক তো গোলকেরই এক অপূর্ব অপিনিহিতি।
এইরূপে লীলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি দূরের রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
২০. সখাসংগীত
উদ্গান।
এই উদ্গান সখার উদ্দেশে।
অদেখা অচেনা এক সখার জন্যে আকাঙ্খা_
যে রঙিন। যে বহুদূর।
দূর কোনো অজানায় যার অবস্থান।
এবং যার কাছ থেকে, থেকে থেকে, অনিয়মিতভাবে, ভেসে আসে
কখনো সন্দেশ, কখনো সন্ধ্যাবাতাস,
কখনো উস্কানি, কখনো সমর্থন,
কখনো আনুগত্য, কখনো-বা অভিভাবকত্ব, মৃদু;
কখনো-বা রৌদ্রঢালা দিগন্তবিস্তৃত ঔপনিবেশিকতা।
আর কিছু বাক্য কিছু গান
কিছু রূপ কিছু প্রাণ_
এইসব আর যা যা ভেসে আসে...
সুরশলাকার মসৃণ কাঁপনের মতো করে কেঁপে কেঁপে
বাতাসে মিহি তরঙ্গ তুলে ভেসে আসে...
আমার সখারা দূরের, অনেক দূরের শহরে থাকে।
শুধু
একটি সখার নদীর কিনারে বাস
বিদেশী নদীর রাংতা-মোড়ানো বাঁকে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
এবেলা আমার গৃহ নাই কোনো সখা,
কী যে ঘোর গৃহতৃষ্ণা জাগছে তাই।
মনে করি, যাব তোমাদের দেশে চলে
নাকি
তুমিই আমাকে অধীনে তোমার ধীরে ধীরে টেনে নেবে?
তোমার অধীনে, অধিগ্রহণে আর শাসনের নীচে
একদিন জানি আমাকেও তুমি ধীরে ধীরে টেনে নেবে।
আমাকে তোমার পালনের, অভিভাবনের ছায়া দিয়ে
পুরোপুরি দেবে ঢেকে।
আহা
এমন সোনালি বন্ধুর খোঁজ পেলাম যে কোত্থেকে!
তোমাদের দেশে সন্দেশতে থেকে
হাওয়া এসে লাগে থেকে থেকে এই দেহে।
অচেনা পুলক শিহর তুলছে পালকে।
সন্ধ্যার কালে বার্তা পাঠালে রূপকে ও সংকেতে;
কিছু তার পাই ডাকে
আর কিছু আসে হঠাৎ দমকা তথ্যপবনে ভেসে।
তথ্যপবনে বন্ধু আমার সন্দেশ পাঠিয়েছে।
বোধ করি এই হাওয়াটা প্ররোচনার।
হঠাৎ খেয়ালে বদ্লে ফেলে দি’ এসো
পরস্পরের আগুন আর অঙ্গার_
প্রেরিত বার্তা উস্কিয়ে যায় এইসব অভিলাষ।
আমার সখার নদীর কিনারে বাস।
অদেখা অজানা বন্ধু আমাকে
জড়িয়ে ফেলছে অচেনা স্মারকে...
এবেলা আমার কেউ নেই পৃথিবীতে
কী যে আত্মীয়-পিপাসা জাগছে প্রাণে!
টানায়, পড়েনে, লীলায়, অবলীলায়
অমান্য করি প্রকাশ্যে ভেদরেখা
তোমাকেই তবে করে ফেলি আত্মীয়
আজিকে আমার বন্ধুর গায়ে রঙিন উত্তরীয়।
তোমার অধীনে, অধিগ্রহণে, আর শাসনের নীচে
একদিন জানি আমাকেও ঠিক ধীরে ধীরে টেনে নেবে।
আমাকে তোমার পালনের, অভিভাবনের ছায়া দিয়ে
পুরাপুরি দেবে ঢেকে।
তার আগে সখা নিজে
খুব অনুগত আর দ্রবীভূত থাকুক একটি দিন
আমার এই রচনায়
এই প্রশাসনে, প্রহারে এবং আজ্ঞা-অনুজ্ঞায়।
শুধু
একটি দিবসে সুশীল বালক থেকো,
পরদিন থেকে ধীরে ধীরে তুমি অবাধ্য হয়ে যেয়ো।
কিংবা না হয় হয়ে থেকো তারও পরে
জটিল আর দুর্বোধ্য অনেক দিন।
শুধু একদিন
আমার বন্ধু আমারই প্রভাবে আমার এই রচনায়
ছায়াসহ উড্ডীন।
ভিন্ন ভুবনে ভিন্ন নদীর বাঁকে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
উৎসভূমিতে ভূমিধস নামে, আর
একে একে সব অবলম্বন হচ্ছে প্রত্যাহার।
বাকল লুপ্ত, ভাঙা-ভাঙা ডাল, মরিচা-প্রাচীন দেহ,
পাখিপল্লবহারা_
তবুও যে এই দারুণ দূষণদিনে
দাঁড়িয়ে রয়েছি ধুধুতর নির্জনে_
শুধু তোমারই সমর্থনে।
তোমার পাঠানো এই ধরনের বিরল সমর্থনে।
এ রচনাটিও পুনর্বাসিত তোমারই উদ্ভাসনে।
আমার বন্ধু নদীনির্দেশ করে।
থমকে-যাওয়া অনেক প্রকার নদীকে সচল করে।
তোমার আমার সরল সূত্র, সহজ বাক্যগুলি
চাপা পড়ে আছে নিস্তারহীন তথ্যজটের নিচে।
ফুরিয়ে যাবেই একদিন ঠিক আবর্জনার দিন_
তেড়েফুঁড়ে যত জট আর জঞ্জাল
আমাদের কথা আলো দিয়ে যাবে জোনাকি-পরিভাষায়।
ঠিক একই দিনে একই ক্ষণে
তুমি আমি মিলে উধাও উড়ালে
চলে যাব এই দেহ ছেড়ে, এই যৌথরচনা ফেলে।
আশেপাশে কত জরুরি ভাণ্ড, মহান কীর্তি,
গুরুত্ববহ স্থাপনাসমূহ আর,
কথিত সিভিল দুনিয়ার।
ভাণ্ড ভেঙে ফেলে, স্থাপনা উল্টিয়ে, যত
কীর্তি একাকার কীর্তি গড়াগড়ি যাবে...
মারণে উচাটনে কালের সন্ত্রাসে, যত
বিরামচিহ্নের প্রভাবে প্রটোকলে প’ড়ে
ঊহ্য হয়ে যাব আমরা একদিন ধীরে
সন্ধ্যানদীতীরে সন্ধ্যাভাষাকূলে
রঙিন মেঘেদের সন্ধ্যাচ্যানেলের ভিড়ে।
তুমি আমি মিলে, প্রস্থান থেকে প্রস্থানে যাওয়া-কালে
পাল্টিয়ে যাব এক এক করে
রং-রূপ-ভাষা, ঘটনার_
দৃশ্যের থেকে দৃশ্যের।
রেডিও ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় চেপে,
হোক হঠকার, তবু একদিন ডানা
ভাসাব বহির্বিশ্বে।
ঠিক একই দিনে একই ক্ষণে
তুমি আমি মিলে উধাও উড়ালে
চলে যাব এই দেহ ছেড়ে, এই যৌথরচনা ফেলে।
অদেখা অচেনা বন্ধু আমাকে
জড়িয়ে ফেলছে রঙিন স্মারকে...
তুমি আমি মিলে, প্রস্থানকালে, চলো
যথাযথভাবে নদীনির্দেশ করে যাই
থমকে রয়েছে অনেক প্রকার নদী।
বড় বড় সব উত্থানগুলি আজ
স্তব্ধ নদীর কিনারে অবস্থিত।
স্তব্ধ নদীকে করে দিয়ে যাই চলো
একটি তুড়িতে সচল, কল্লোলিত।
ভিন্ন ভুবনে ভিন্ন নদীর বাঁকে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
যুগ যুগ ধরে আড়ালে আড়ালে
নদীর সূত্রে, মেঘের চ্যানেলে
বিছিয়ে চলেছি আমাদের যোগাযোগ।
এই কবিতাটিসহ
সখাকে, আমাকে, নদীর আলোকে বিবেচনা করা হোক।
২১. সার্কারামা
আজ এক রুগ্ন অগ্নিকুণ্ডের কিনারে বসে আছি জবুথবু
চারদিকে চলমান সার্কারামা
ছবিগুলি খুব দ্রুত নাচতে নাচতে আসে আর যায়।
কুড়ি ল বর্ষ আগে প্রকৃতির লোহিততন্ত্রে-তন্ত্রে তীব্র দাহ
অণ্ড-আত্মা থেকে দ্রুত প্লাবনের বেগে ঢেলে ফেলে জন্মশুক্র
এত বাঁধ, এত যে বিন্যাস,
শুক্রগতি থামছে না তবু
উর্ধ্ব থেকে প্রতিহত হয়ে আসে প্রতিনিধি, অগ্নিকোণে।
রেতঃস্রোতে অবিরল তাপ ঢালে সপ্তবহ্নিজাল
অসহ্য অসহ্য এত বর্ণবিকিরণ, এত বহুতল হীরকের সন্ত্রাস
এত বাষ্প, গন্ধ, পঞ্চভূতের এতটা পচন ও মন্থন!
স্রোতে ঘোরে মহাচক্র
চক্রে চক্রে পাপ, পুঞ্জীভূত ফেনা
ফেনা থেকে প্রাচীন ডুবোপাহাড়ের মতো
তীব্র জলধ্বনিসহ ঘুরে ঘুরে উঠে আসে নতুন কিরণ
গনগনে নতুন কীটাণু
সদ্যোজাত ছেচল্লিশ লাল ক্রোমোজমের উল্লাস।
বনবৃক্ষে বাড়বাগ্নি জ্বলে
ধুম্রপাকে হারিয়ে ফেলে পথ
উচ্চ স্বরে কাঁদতে থাকে ব্যাঘ্র ও ম্যামথ।
নদীর জলে ওড়ে ভস্ম, ওরে মৎস্য, কোথায় যাবি তুই
বাইসনেরা ধুলায় গড়ায়
পক্ষীরা সব পক্ষ গুটায়
দিসনে ঠোকর, পুড়বে কেবল পুড়বে রে চঞ্চুই।
হিংস্র নখরা বিকট দন্তুর
অতিকায় সব প্রাচীন জন্তুর
চিৎকার শোনা যায়
কাতরায়, তারা কাতরায়
শুধু আলকাতরার জলাশয়।
অরেঞ্জ নদীর তীরে নামল রাঙা প্রমিথিউস
মৃত্তিকা-স্তর কাঁপল মৃদু-মৃদু
অরেঞ্জ নদীর তীরে
ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত রঞ্জিত সব মানুষ।
রাত্রিগস্ত দুই ঈশ্বর মাদুরে ঝিমাতে থাকে
মাটির পাত্রে অস্থিপোড়ানো অঙ্গার, কার্বন
বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে এক নারী বৈতরণীর বাঁকে
ওই অবিনাশী পৃথিবীর মতো আইবুড়ো, কার বোন?
হাম্মুরাবি ভেসে ভেসে আদিকৃত্যে যায়
উঁচিয়ে রাখা তর্জনীতে তার
একটি ফড়িং উড়ে উড়ে শুধু বসতে চায়।
ঝাঁক বেঁধে মাঠে ভ্যান্ডালদল নামে
দষ্ট ফসল চিৎকার ছোঁড়ে দীর্ঘে এবং বামে
সাদা হিংসায় গতি থমকায়
প্রবাহিত মানুষের।
শস্যকীটের লাল থেকে ঝরে তেজ
পানকৌড়ির দিকে তেড়ে আসে বন্যবহ্নিলেজ।
সহসা শূন্যে সালফার-মুঠি উড়ে যায় ক্রীতদাস
বায়ুমণ্ডল পুড়ছে খুব তখন
আকাশে আকাশে রক্তকাণ্ড, হঠাৎ বিস্ফোরণ
ক্রীতদাস ফেটে বীজাণুর মতো অংখ্য ক্রীতদাস
আকাশের থেকে হাঁস ভেসে আসে হাঁস।
আকাশের থেকে হাঁস নেমে আসে হাঁস
মধ্যরাত্রে বুদ্ধ জড়ায় গাত্রে
পশমীর মতো ছাইরঙা সন্ন্যাস।
আকাশের থেকে হাঁস ভেসে আসে হাঁস।
সার্কারামায় আসে উপসংহার
স্থিত গৌতমও গতির আহার, বোধির পাশেই অগ্নিপাহাড়
জ্বালামুখে জ্বলে মানুষের স্নায়ু, মগজ এবং স্নেহ
নিথর রেটিনা ধরে রাখে সাত রশ্মির মৃতদেহ।
গড়িয়ে নেমে আসে খঞ্জ লুসিফার
কাঁধের ডানে বামে আণব শীতকাল
চুলের হিসহিসে পতিত ইতিহাস
অন্ধকার দিয়ে গঠিত প্রস্তর।
জাগছে কালে কালে ইচ্ছা অদ্ভুত
ধাতব মুদ্রার, বিরামচিহ্নের।
মেঘের কশ বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসে
গড়িয়ে নেমে আসে খঞ্জ লুসিফার
অন্ধকার দিয়ে গঠিত শিলাকাল
প্রতিদ্বন্দ্বিতা টোটেম ও মনীষার।
এইবার এই অবেলায়, হে জ্ঞাতি, হে রহস্যের উপজাতি,
অন্তহীন শিবলিঙ্গের প্রহরী,
গলমান গ্রাফাইট-স্তরের ওপর গড়াগড়ি দাও
পুনর্বার পাপ করে ফিরে এস
পুনর্বার মুদ্রণযন্ত্র ভেঙে ভূমিসাৎ করে দাও হে অর্জুন
স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাধ, স্মরণকালের হে অবিস্মরণীয় ব্যাধি।
পঞ্চভূতের শাসিত নিয়তি
পৃষ্ঠদেশের ত আর তি
তীব্র ক্ষুধা ও খাদ্যের গতি
বিস্মৃত হও, বিস্মৃত হয়ে যাবে।
বৃত্ত ঘোরে মহাবৃত্ত
বিনাশ, মহামারী নৃত্য
মনুকুলের শেষকৃত্য
প্রাণী এবং পতঙ্গের সাথে।
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া!
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় ...... ....... .....
শ্রবণ বধির ...... ....... ....... ....... .......
শ্রবণ ...... ....... ....... ....... ....... ......
২২. নাট্যমালা, তামাশাপ্রবাহ...
বিষয়ীরা মত্ত হয়ে আছে কামিনী-কাঞ্চনে। বাইরে টালির ঘরের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে এক বিশাল বুদবুদ। ভাঙা ছাদে বসে তাকে ধরবার চেষ্টা করছে একটি বানর। বানরের চোখে রঙিন সানগ্লাস, মাথায় রঙিন ক্যাপ। মাটির দেওয়ালে ঝুলছে বিড়াল-হারানোর বিজ্ঞপ্তি-ভেজা বিড়াল। হারিয়ে গেছে। মোল্লাবাড়ির বিড়াল-দু-চার হরফ আরবিও জানত। মাটির দাওয়ায় বসে ছোট ভাইকে নজরফোঁটা লাগিয়ে দিচ্ছে একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম সম্ভবত হৈমবালা, তবে আয়শাও হতে পারে। রোদেলা আকাশ, তার মধ্যেই ফের বৃষ্টি ঝরছে। বাচ্চারা ছড়া কাটছে-রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে। বড়রাও যোগ দিয়েছে তাতে। রোদ বাড়ছে, তাই রোদের চশমাও বাড়ছে-এটা না-হয় বোঝা গেল; কিন্তু টুপিও বাড়ছে, শুঁড়িখানাও বাড়ছে-এটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। মাথা ঘামাচ্ছেন, কিন্তু কূলকিনারা হচ্ছে না। এদিকে আনারস পচে যাচ্ছে অতিবর্ষণে। দুর্নীতি কিংবা দেশপ্রেম-কোনোটাই কারো একচেটিয়া নয় বলে ফতোয়া দিচ্ছেন কেউ কেউ। কী এক অচেনা আকর্ষণে পর্বতের দিকে ধেয়ে চলেছে মেঘেরা, আর শেরপারা। মেঘেরা আকাশ দিয়ে, শেরপারা নিচের এবড়োথেবড়ো জমিন দিয়ে। পেছন-পেছন ছুটে আসছে তাদের বউবাচ্চারা। যেতে দিতে চাইছে না তারা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রাজার প্রিয় কবুতরটির ভীষণ অসুখ। কবুতরের জানের ছদকা হিসাবে জোড়া মহিষ কোরবানি দিচ্ছেন রাজা। একেই কি বলে ‘কবুতরের কল্যাণে মোষ বলি?’ হয়তো-বা। প্রচুর বাতাসা উড়ছে আজ খর্খরে বাতাসে। ছেলেটির মন ভেঙেছে মেয়েটি। মন ভাঙা তো মসজিদ ভাঙার শামিল। কীভাবে পারল সে!-মনভাঙা ছেলেটি ভাবছে সেটাই। বিদেশ-বিভূঁইয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে ছেলে মারা গেছে। খবর আসেনি, তবে খবর হয়ে গেছে ঠিকই মায়ের মনে। ‘বিদেশে বিপাকে যার পুত্র মারা যায়, পাড়াপড়শি জানার আগে জানে তার মায়।’ এই যে আমি মরে গেছি বিদেশ-বিভূঁইয়ে, মা-র মন হয়তো জানছে ঠিকই। আচ্ছা, কবরে মা-র মনও কি পচে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে? মা শূন্য হয়ে গেছেন, আমিও মিলিয়ে যাচ্ছি শূন্যে। হয়তো নতুন এক মা, নতুন এক আমি এসে যাচ্ছে পৃথিবীতে। প্রকৃতি তো শূন্যতা সহ্য করে না বেশিক্ষণ। পূজারির কী এক কথায় খুব চটেছে পুরোহিত। রাগে তার টিকি আস্তে-আস্তে কেমন খাড়া হয়ে উঠছে। ভোটপ্রার্থীরা পাড়ায়-পাড়ায় তো বটেই, এমনকি বেপাড়ায় গিয়েও ভোট না চেয়ে দোয়া চাইছে। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন টিপ্পনি কেটে উঠল-‘মজা মারবে ফজা ভাই/আমাগো খালি ঘুম কামাই।’ নেতার এক চেলা এক তরুণী বারবণিতার তির্যঙ্নেত্রী মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে তির্যক চোখে। বণিতাটি বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলছে, ‘মানুষে খালি নজর দেয়! বালাই ষাট!’ আবার বলছে, ‘যার-যার বাচ্চা, তার-তার কাছে আচ্ছা।’ আর ওই যে প্রেমিক-প্রেমিকা-যুগল, ওদের প্রণয় কিছুতেই মেনে নিচ্ছে না সমাজ। সমাজ বড় কড়া। তাই ওরা এক মরণে দুইজন মরবার পরিকল্পনা করছে। ওদের নিয়েই তো গান বেজে চলেছে যুগ-যুগ ধরে-‘এক মরণে দুইজন মরে/এমন মরা মরে কয়জনে//’। মরার পরে তাদের লাশ নাকি কেউ সৎকার করবে না, নদীতে ভাসিয়ে দেবে। দিক। নদী তো সর্বগ্রাহী, সর্বংসহা, সর্বসা সর্বসাক্ষী । তবে পানিতেও ওরা ভাসতে থাকবে, ভেসে চলবে যুগ-যুগান্তর। প্রেমের প্লবতাশক্তি খুব তীব্র। ফের বেজে উঠবে গান, ঢেউ তুলে আকাশে-বাতাসে-প্রেমের মরা জলে ডোবে না.../ও প্রেম করতে একদিন, ভাঙতে দুইদিন, এমন প্রেম আর কইরো না দরদী//। ওই যে একজন গ্রহণ-লাগা নারী, নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগছে, ভুগছে নিকষ-কালো অন্ধকারে। সুখী ও স্বচ্ছল মানুষেরা উঁকি দিচ্ছে তার ঘরে। তারা অর্থকষ্টে ভোগা দেখছে। কে যেন বলেছিলেন, অর্থকষ্ট এমনই এক কষ্ট, যা অন্যসব কষ্টকে কাছেই ভিড়তে দেয় না। কে বলেছিলেন যেন! এরই মধ্যে আবার সমস্ত ভোগবিলাসের চূড়া দেখা শেষ হয়েছে কারো কারো! চূড়ান্ত বিবমিষা জেগেছে এখন তাদের। রাজা হওয়ার পর যেমন সন্ন্যাসী হতে ইচ্ছা করে, তেমনই ইচ্ছা করছে তাদের। ভোগবৃরে মূল হচ্ছে প্রবৃত্তি; আর ফল, নিবৃত্তি। প্রবৃত্তির নিবৃত্তি ঘটে ভোগ সম্পন্ন হলে। শোনা যায়, ভোগ তার চূড়ান্ত চরিতার্থতা পেয়ে আসছে পরাক্রমীদের মাধ্যমে। মাইট ইজ রাইট। আদিকাল থেকেই নাকি তা-ই। আগে মতা ভোগ করত ক্ষত্রিয়রা, ব্রাহ্মণদের সহযোগিতায়, তাদেরই সাথে সহজীবিতায়। এখন বৈশ্যদের ভোগের কাল। আর ভোগের ভাগাভাগি? ক্ষত্রিয়দের সাথে। তবে যুগ পাল্টে দেবার চেষ্টা হয়েছিল। শুদ্রযুগ কায়েমের চেষ্টা। সফল হয়নি। পরে হবে হয়তো-বা। তখন কি আবার সহজীবিতা হবে বৈশ্যদের সঙ্গে? কি জানি! তা কী করে হয়? কিন্তু কেমন যেন ওরকমই একটা গন্ধ, ওরকমই একটা আলামত! যেটাই হোক, হোক গিয়ে। আপাতত কারখানার প্রোডাকশন লাইনে এক বিপুল কনভেয়ার বেল্টে চড়ে দ্রুত ভেসে আসছে নাটবোল্টবিজড়িত একেকটি কিম্ভূত-কিমাকার গিয়ার। শ্রমিকরা ঠুলি-আঁটা চোখে আফিম-খাওয়ানো বলদের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেকজন একেক নাটে টাইট দিয়ে চলেছে ক্রমাগত। ওইসব বিচিত্র গিয়ার একসাথে জোড়ামোড়া লেগে কী-না-কী-এক অতিকায় অদ্ভুতকিম্ভূত কলকব্জা হয়ে না-জানি কোথায়-না-কোথায় চলে যাচ্ছে, মানুষগুলি জানে না কিছুই। জানার দরকারও নাই। টাকাই আসল কথা। কে বলেছে ‘অর্থই অনর্থের মূল’? কত টাকা, কেন টাকা, কী টাকা, কেমন টাকা, রং কী, জাত কী, অতশত জানার টাইম কোথায়? টাইম ইজ মানি, মানি ইজ গড, অ্যান্ড ইন গড উই ট্রাস্ট; দ্যাট্স অল। এমনিতেই টাকা এক কাগজি প্রতীক, এক প্রায়-ভার্চুয়াল-রিয়ালিটি, তার ওপর ফের তা নাকি আরও প্রতীকী হচ্ছে, আরও ভার্চুয়াল হচ্ছে। শালার প্রতীকস্য প্রতীক, ভার্চুয়ালের ভার্চুয়াল! হাতে-হাতে-র বদলে অনলাইনে-টাকার চলাচল, লেনদেন, বলাবল যাচাই, সবকিছু। শিঘ্রি নাকি অদৃশ্য হতে যাচ্ছে টাকা। ভুতের মতো, জ্বিনের মতো, কিংবা ঈশ্বরের মতো। ঈশ্বরের মহিমা পাবার জন্যেই নাকি এরকম বেপরোয়া ও অদ্ভুত হয়ে উঠছে সে। অদৃশ্য, কিন্তু অসীম মতাধর। খেল দেখাবে, লীলা চালাবে, আড়াল থেকে। অবশ্য দুর্জনদের, দুর্যোধনদের কেউ-কেউ বলছে, ‘ওরকম তো গুয়েরও অসীম ক্ষমতা; এই যে গু, কেমন নরম (মাঝে-মাঝে অবশ্য কর্কশও হয়), ক্ষীরের মতো, অথচ পারা দিলে পা কেটে যায়; গুয়ে বাড়ি দিলে গুজব ছিটকায়, এমনভাবে যে, ঘটবার আগেই ঘটনা রটে যায় তামাম দুনিয়ায়। (ঘটনা ঘটনা হয় যখন তা ঘটে/রটনা রটনা বটে যখন তা রটে//)। একমাত্র গুয়ের প্রভাবই স্থায়ী ও নিত্য, আর সব অনিত্যপ্রায়।’ তো? তাতে হলোটা কী? ধ্যাত্তেরি, ভাল্লাগে না আর। একদম ফেড-আপ। একেবারে ৩৬০ ডিগ্রি ফেড-আপ। এত যুক্তি-তর্ক-আর্গুমেন্ট! কী হয় এত যুক্তি-তর্কে? এশেকে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ওদিকে লীলাকারগণ চালিয়েই যাচ্ছে নিত্যলীলা। নিত্য ধরে ধরে লীলা, ফের লীলা ধরে ধরে নিত্য...। আড়বাঁশি বাজিয়েই চলেছে কলির কৃষ্ণকুল। সুরের সম্মোহে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়িমরি ছুটছে গোপ-গোপিনীরা। ধাবনধর্মই নাকি এ-যুগের ধর্ম। টাকাই এ-জমানার ঈশ্বর (দুঃখিত, কথাটা বোধহয় আগেও বলা হয়েছে একবার)। সকাল হতে-না-হতেই নানা জাতের সব ইঁদুর বাঁশির চুম্বকটানে মন্ত্রচালিতের মতো বিচিত্র বাক্শো ও খোঁড়ল থেকে, খোপ ও খুপড়ি থেকে, গর্ত ও গহ্বর থেকে, চতুর্দিক থেকে বেরিয়ে নানান পথ ধরে হুলুস্থুল করে ছুটে এসে শেষে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা জালে, ফাঁদে। কৃষ্ণের হাজার গোপিনী, রাধার কৃষ্ণ ভিন্ন আর কেউ নাই। মূরলিধরেরা ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, উই আর আলফা, অ্যান্ড উই আর ওমেগা, উই আর অল। প্রলেতারিয়েতেরও নাকি রূপান্তর ঘটছে এই জমানায়। ধারণ করেছে বাহারি এক নাম-প্রিক্যারিয়েত। পাচ্ছে অদ্ভুত-বিচিত্র-বাহারি সব কাজ। মানুষ পর্যবসিত হচ্ছে রকমারি সংখ্যায়। সংখ্যাদের নির্বিকার বুকে ধরে থাকছে বিচিত্র সব কার্ড, হরকিসিম সব দলিল। সংখ্যার নিরঙ্কুশ শাসন, সংখ্যার অকহতব্য অত্যাচার...সংখ্যা ও কার্ডের কাঁটাতারে একেবারে জড়িয়ে-মড়িয়ে আচ্ছামতো আটকা-পড়া নিস্তারহারা প্রাণ-জেরবার মানুষ। সারা জাহানকে পুরাদস্তুর কয়েদখানা বানানোর প্রকল্প প্রায় শেষ। কয়েদির সারা শরীর ও মন জুড়ে ঝুলছে খালি নম্বর আর নম্বর, কার্ড আর কার্ড। কয়েদি খালাস পাবে ওই একবারই...তখন ওই নম্বর-টম্বর, কার্ড-ফার্ড সব খুলে ফেলে পুরা দিগম্বর হয়ে দে দৌড়, ঝেড়ে দৌড়, দৌড় দৌড়...দিগন্তের পানে...তো ওইখানেও আরেক জ্বালা, ভূগর্ভস্থ আরেক কারাগার! তবে রগড় আছে। সেখানে আরেক‘মনোমোহন বশীকরণ রাধারমণ রায়/মদ্যসহ আড্ডা মারে, অট্টহাস্যে বলে,/রগড় যদি বুঝতে চাস, মাটির তলে আয়//।’ কাঁটাতারের এত-এত জটাজটিল জট, গিঁট ও গিট্ঠু...মাঝে-মাঝে অতিচালাক শিয়ালও ফাঁদে পড়ে, ছাড়ে উপর্যুপরি ত্রাহি আওয়াজ। সেরকম কিছু আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কেউ-কেউ বলছে, শিয়াল হচ্ছে হাইপার-অ্যানিম্যাল, আবার কেউ বলছে, হাইপো-...। ক্যারক্যার আওয়াজ উঠছে। ও কিছু না, ইতিহাসের ব্যাকল্যাশের শব্দ। থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার, জ্বরাঙ্ক, প্রেষাঙ্ক সব ওঠানামা করছে একযোগে। রক্তমোণ হচ্ছে। ঘোরতর। ধস নামবে নাকি একেবারে! শোনা যাচ্ছে সাজ-সাজ রব, থেকে-থেকে মারণকলের কলরব। মহাহুলুস্থুল। কৃতশপথ শত্রুরাও মিত্র হচ্ছে, আবার পরম মিত্রদেরও কেউ-কেউ শত্রু। শাকাহারীরা কি হয়ে উঠছে বেঘোর মাংসাশী? আর মাংসাশীরা নীরব নিরীহ তৃণভোজী? কে জানে! তবে এই যে শো চলছে, অভিনীত হয়ে চলেছে এই যে নাট্যমালা, তামাশাপ্রবাহ, এ নাকি চলতেই থাকবে নিরন্তর। কোনো দাঁড়ি-কমা-বিরামচিহ্ন নাই নাকি এর। মনে হচ্ছে, কে যেন নেপথ্য থেকে বলছে-দ্য শো মাস্ট গো অন। ইট ওন্ট্ স্টপ। নো ওয়ে, নেভার। এইসব গায়েবি আওয়াজ নাকি আগে শোনা যেত, কেউ-কেউ বলেন সেমেটিক, কেউ-কেউ বলেন আর্যভাষায়। এখন শোনা যাচ্ছে পরিষ্কার ইয়াংকি জবানে। ভরকেন্দ্র সরে সরে যাচ্ছে আওয়াজের, ওঙ্কারের। পূর্ব থেকে পশ্চিমে। তবে আস্তে-আস্তে কি আবার সরে যাবে পশ্চিম থেকে সুদূর পূর্বে, কালের আহ্নিক-বার্ষিকের নিয়ম মেনে?
তানজিম ইসলাম
দেহজ মেঘের কামনামা
পুরোনো চিঠি দেখার মতন ঝাপসা স্রোতগুলো
কখন কী করে শরীরে উঠে আসে কখন কী করে অদ্ভুত শব্দ বাজায়
কীভাবে যে নদী বানায় শরীরের তলদেশে
যৌনতামুখর চিঠি পড়ার শিহরণ নিয়ে জেগে ওঠে ফুল
দেহজ ফুলের গন্ধ এমনভাবে মায়া বাড়ায়
যেন শহরের মায়াফ্যাক্টরিতে বোকা কিশোরের চোখের কাঁপন
যেন আহাজারি করে কাগজের রংধনু তৈরি হওয়া ফাঁকা আকাশে
রংধনুর জন্য প্রস্তুত আকাশের দরকার হয় আর
আকাশের পরিকল্পনা দেখে দেহজ মেঘ
দেহকে বৃষ্টি ভারাক্রান্ত করে তুলে সে মেঘ
দেহের অভ্যন্তরে দেহ দিয়ে আরেক নদী করে তুলেছে
পুরাতন চিঠির দলিলেই যার ইতিহাস
গত শতাব্দীতে প্রাচীন ভারতবর্ষে যে এক ফালি নদী শাসন করেছে
দেহজ মেঘের কামনামায়...
কায়সার হেলাল এর কবিতা
লগ্ন-চরিত
(...হঠাৎই তুমি জানিতে চাও-
"গোধুলি লগ্ন অমন থম মারিয়া থাকে ক্যান?"...)
এহেন কথনক্রিয়ায় কস্তুরিগন্ধা সন্ধ্যায়
শরীর মেহনে চৌকাঠ লাগোয়া তুলসি
কাঁপিয়া উঠে, মৃদু শৃঙ্গার নিনাদ চলে
আবহমান কাল ব্যাপিয়া।
এমতেই সৃষ্টোৎশব যবে শুরু হইলো,
আর থামিলো না।
কালপ্রান্তে হৃদ-দেহ যবে মত্ত হইবে
লীন হইবার খেলায়,
শৃঙ্গার নিনাদ ক্রমে র্আতনাদরুপ পাইবে,
অতঃপর এইসব জানিয়াও-
রতিমগ্নতা ভুলাইয়া দেয়
লোকোত্তর দৃকপাত।
(এবং এইসব শৃঙ্গারকথন ক্রমাগত আমাদিগকে
লগ্নাক্রান্ত আবেশে ফেলিয়া দেয়, ফলতঃ তুমি
তোমার প্রশ্নোত্তর অকস্মাৎ পাইয়া যাও)
মাতুলানি সমাচার
(কদম্ববৃক্ষসখা স্বঘোষিত এক শ্রীকৃষ্ণের কল্পপ্রেমে বাধা পড়তে গিয়ে
কোন এক পাহাড়ি শ্রীমতি রাধার শিকে না ছেঁড়া সত্ত্বেও চাটগাঁ মহকুমার
ননদিনীর হাটের ব্রাম্মনপাড়ায় মৃত্তিকানির্মীত অরুপসাগর বেদিতে
চারকোলে কে বা কারা লিখিত বিচ্ছিন্ন লোকশ্রুতির সমন্বিত কাব্যরুপ)
তুমি কি আমারে চাতক বানাও,
নাকি নিজেই চাতক হয়া যাই মেঘ দেইখা আসমানে!
আমারে মেঘপংখী কইরে কি লাভ তোমার শ্রীমতি রাধা?
নাকি আমিই বুঝিনা মেঘপংখী হওনের নিদারুন
যন্ত্রনা, কি জানি, তবু...
এখোন এইভাবে বরং ভালা থাকি,
মাঝে-মইদ্দে সাধারন জল খায়া তেষ্টা মজাই,
তাই কই আমারে চাতক না বানায়া ভাসায়ে
দ্যাও পদ্মদিঘির জলে, তবু, সেই ভালা
বাঁইচা থাকি পদ্ম-পানা মাখামাখি...
বরিষন-জাতক হইলে কই পামু মেঘের জল শ্রীমতি রাধা?
অই পাড়ার আবেদীন, বন্ধু ফখরা- অরা ব্যাবাকতে
পাইলো মেঘ, দেখা হইলেই অরা মেঘ না চাইতে
বৃষ্টির গপ্পো শুনায়...আর আমি...
কি সাধে যে ক্যান একদিন ভুল কইরা তোমার
কালা কেশ পানে তাকাইছিলাম,
ক্যান যে সিঁথিরে ভাবছিলাম রংধনু,
ক্যান যে তোমারে কইছিলাম আমারে মেঘ দ্যাও শ্রীমতি রাধা...
এক বড়ো পোকা য্যান পরান খায় কুঁইড়া কুঁইড়া,
হাঁড়-মগজ-চামড়ায় য্যান কালশিট্টা দাগ ঘুর্নিবাতাসের...
নাকি আমিই চাতক হয়া যাই মেঘ দেইখা আসমানে,
নয়তো কালা বরন মায়ায় যে মেঘ থাকে তা ক্যামতে
জানুম আমি, তোমার আঁচে য্যান পুইড়া যায় শইল আমার...
তবু আঁজলা ভইরা মেঘজল ঢালতে গিয়া ছলে উস্কায়া
দিলা আংরার আগুন, অনভ্যাইসা পোলা ক্যামতে জানবো
আংরার শোধন কি কইরে হয়?
সুমায় পার করনের আপন আপন মাইনষ্যার এই দুইন্যায়
কেউ কিছু হয়া গেলে কারো কিচ্ছু যায়-আসেনা...
তবু চাতক হয়া যাই, আমার এই চাতকরুপ ক্যামতে
বুঝাই তোমারে শ্রীমতি রাধা?
পঞ্চশর অথবা নীপশুল
(......এটাতো তবু ঠিক যে এক গোপিনী যমুনায় জল আনতে গ্যালে
আড়ালের হ্যামিলনকে দেখে হেসেছিলো ভয়ানক অট্টহাস্য, যেহেতু
সে বাঁশিতে শুনেছিলো- ‘বুকফুলে চেয়ে থেকে নেয়ে উঠি রতিঘামে’
নামক গানের ভুলবাদন......)
এইসব ঘুমফুল
আর ফুলযাপনের কাল
আষাঢ়স্য নীপশুলে পতনফোঁটা জল
উতলা যমুনায় কতেক বাদাম তোলা নাও
নীপবান্ধব কালাচান্দের চেয়ে থাকা
চেনা ভেজা পথ, কলসি কাংখে
গোয়ালিনীর দল ফিকে থেকে ক্রমশ দৃশ্যমান...
ভাবে মগ্ন গদাধর ঘাঁড় ঘুরিয়ে পুনরায়
চেয়ে থেকে থুতনীতে রেখে হাত-
হাওয়ারেই’বা কেমনে দোষ দিবো, বলে মুরারী-
তবুও তো রাধা বলে তাঁর হাওয়ায় খসলো বসন!
তবে ক্যান তাঁর অমন বুকফুল প্রদর্শন?
তবে কি বেজেছে বাঁশির ভুলবাদন?
ওহে বড়ায়ী...বল তুই, কি চাতুরী খ্যালে চন্দ্রবদন!
সোনা রঙ জল
...সোনা রং জলে ডুইবা থাকি, এতসব যন্ত্রনারে পায়ে ঠেইলা দিতে এরচে ভালা দাওয়াই আর কি আছে জগতে? আর তামাকি সাঁঝের পাঙ্খায় ভর কইরে নিত্য ভাসি শুন্যে। বৈষয়িক সাপের ছোবল এড়াইতে চাইলে ভালা ওঝা হওন চাই, তাই বিষ পুষতাছি সর্বাঙ্গে অথবা শিক্ষানবিশী কালযাপন কইরে শিইক্ষা নিই কি উপায়ে বিষ পুষন লাগে। সাপের বিষ থিকাও কতেকগুন বলশালী এইসব বিষে শান দিই নিয়ম কইরে, য্যান, প্রতি দংশনেই পটল তুলে বিষয়-সাপ, য্যান, এইমতে আমার হাঁসিই হয় এমুন ছড়াইন্না যে দিগন্ত খুঁইজা গর্ত পাইবোনা সূর্য ডুবার লিগা।
সোনা রঙ জলে মইজা থাকি, এইটা শুধুই মুদ্রার স্বাস্থ্যোন্নতির উপ্রে নির্ভরশীল বইলা যখোন মুদ্রার গতরে স্বাস্থ্যকর বাতাস বয়া যায়, গোশতের আঁশ টাইনা বাইর করি দাঁতের ফাঁক গইলে। চুমুকের অব্যবহিত সুমায় ক্ষেপনের পরে জিহবা জুইড়া জাইগা থাকে সোনা-সোয়াদ, য্যান ভাল্লাগে এইসব অস্পষ্ট ধুসর দৃষ্টি ফেইলা তন্দ্রোপভোগ...
চেতনার গেলাসে কেমন মদ আঁটে?
১.
...দেখতে সুন্দর অথচ পানে আরাম নাই, বদহজমের সমুহ সম্ভাবনা থাকে এইরকম আরোপিত, কৃত্রিমভাবে জাঁক দিয়া পাকানো 'মদ'র তুলনায় নিজের মধ্যে স্বতস্ফুর্ত সৃষ্ট 'মদ' পরিবেশন এবং সেবন হাজারগুন উত্তম।
(খেয়াল করিলে দেখা যাইবেক যে এইখানে একটা সংকট ক্রিয়াশীল, তা ধরতে পারার জন্যে নিজ চেতনা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করিতে হইবেক; এইসব দ্বিধা-ত্রিধা-বহুধা অথবা অনন্তধা আত্মউপলব্ধির জায়গাকে সংশয়বাদী কইরে তুলে। তাহা সত্ত্বেও এইসব সংকট-সমুহ জ্ঞানবান্ধব সংকট হিসেবে চিহ্নিত কইরে নিজস্ব মাগজিক ধারনার সর্বোচ্চ পর্যায়কে ‘ঈশ্বর’ বলিয়া মানিয়া লইতে হইবেক, যদিও এই ‘ঈশ্বর’র লগে শরিয়তীগো তথাকথিত অস্তিত্তশীল ‘ঈশ্বর’র মিল নাই, এই ‘ঈশ্বর’ আসলে অনন্তধা বা অনন্তদশার ‘শেষ’ ধাপ, পুরোষত্তম থেকে পুরোষত্তমে যা নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তনশীল, কেননা প্রথমত মানিয়া লইতেই হইবেক যে মাগজিক ধারনার কোন ঐক্য নাই...)
এবং এইরকম 'মদ'ই পরিবেশন করা উচিত যেন সুড়িখানায় লোকে অনন্ত যাত্রা করে। এমন যেন না হয় যে লোককে ঠেসে খাওয়ানোর প্রয়োজনে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। ফুল ফুটলে পতংগ ডেকে আনতে হয়না; ফুল কর্তৃক নির্দিষ্ট মাত্রার অদৃশ্য তরংগ পরিবেশনই পতংগের আকৃষ্ট হওনের কারন...
২.
...গন্ডুষের জল শুন্যে উড়ে গ্যালে আমার পা জোড়া ক্রমাগত ব্যাথার প্রলাপ গায়। বিকেলের সোনা রোদ ফিকে হতে হতে যখোন হাঁটিনি দু'ক্রোশ, সেখানে ধুলোর প্রলেপ ফূঁড়ে বেরোয় জলপুর্ন ফোসকার ছইয়ালা নাও...
বর্ণাক্রমন
এইরকম 'প', 'র', 'জ' কিংবা 'ক' এর মতোন বহু র্বন ছুটে গ্যাছে জৈবনিক বর্ণমালা থেকে।যেমন ছুটে যায় ধনুক থেকে তীর। এইসবে তাই ইস্তফা, আর কোন সংযোজন চাইনে, যোগে কেবলি বিয়োগের আশংকা। অথচ ইদানিং কেমন যেনো দিবাস্বপ্নে, ভাতঘুমে অথবা রাতঘুমে ঠিকই সংযোজিত হতে চাওয়া কিছু বর্ণ ঝলকে যায়। কখনো কখনো সেই পুরনো বর্ণরাও মিছিলে মিছিলে খুঁচিয়ে খায়, দহনে পোড়ায় মগজ।
র্বনগুলো বেশ পিচ্ছিল ছিলো নাকি আমার হাতে কোন ছাই ছলিো না- এমতো র্ব্যথতার হিসেব কষতে কষতে উদ্বেগহীন ফ্যাকাশে রাস্তায় সেই বরাবরের মতোনই নেমে পড়ি। হতাশা ঢাকার জন্যে এরচে ভালো দাওয়াই বোধকরি আমার নিকট কোন অতীতকালেই ছিলো না, অথচ এখন এখানেও দহন। অচেনা বর্ণমালাদের ভীড়ে হয়তো তাড়িত হই, আবার এও হতে পারে যে এতসব র্বনশ্রী একপ্রকার মায়াগুঁড়ো, যা নিরবচ্ছিন্ন ভেসে বেড়ায় কোন উনুন খুঁজে নিতে, যেনো তুষের মতোন ফুঁসে উঠবে বর্ণ-উণুণ। আর চোখ-ধাঁধানো অস্পৃশ্য বিলাসী বর্ণেরা মুচকি হেসে উঠোন দেবে পাড়ি। অধরা পুরনো-নতুন এইসব বর্ণে বর্ণাক্রান্ত দিনাতিপাতে এখন বলপ্রয়োগে প্রাপ্ত ঘুমযাপনই বেশ লাগে।
আহা!!! বেশ লাগে!!!
সুমন ধারা শর্মা এর কবিতা
প্রান্তিক
গ্লুকোজের ড্রিপ তাড়াতাড়ি
যে স্বপ্ন বিভীষিকাময়
সে সাক্ষ্য আড়ি পাতে নাকি ?
আসলে আমার বড়ো ভয়
রাস্তার বড়োসড়ো গাড়ি
খুঁজেপেতে শিস দিয়ে যায় ।
যে অক্ষিকোটরের কথা
কর্কশ চাবুকের শ্লেষ
একথাও লেখা হয়ে যাও
আরকেটু বেশি দরাদরি
প্রান্তিক হিসেবের টাকা
খাপছাড়া জানে বিশবাঁও ।
অন্তর্বর্তী
মারা যাওয়ার পরে
সেসব মোটরগাড়ি গ্যারাজের বাইরে পড়ে থাকে
ধুলো জমে উঠলেই একটা বৃষ্টির
প্রতীক্ষা করে বাতিল বনেট।
আরো যেসব শব্দ ওগরায় দামি এঞ্জিনটা ,
প্যারাশুটে নেমে আসা ঈশ্বর জানেন,
তোকে আজ আমার মতোই পোড়াবে মানুষ ।
ফাটা টায়ারের চটি পরে যে লোকটা
আইসক্রিম খাবে,
সে ও জানবে না, এই টায়ারের তলায় পড়ে
লোকটা কাতরাচ্ছিল।
হাসপাতালের বিল মেটানোর পর
বুকের বোতাম খুলে
বহুরাত নিশ্বাস নেয়নি ভিট্রিফায়েড টালিগুলো।
শক্ থেরাপি
সারিবদ্ধ কুয়াশা পাতকুয়ো থেকে
দড়িবাঁধা বালতির সঙ্গে উঠে এলে
বাতিল জামা গায়ে ঘুমোচ্ছে যে রাত,
তার সিগারেটের শেষ কাউন্টারের দাবীদার হতে
একটা পাঁচিল টপকাতে হয়
বাধা-বিপত্তিজনিত টাটকা লাশের চওড়া বুকে
ম্যাগটের বাসস্থান। খর্বাকৃতির সেইসব
লেটলতিফের কালো গাড়ি পাশ ফিরে হুশ্ করে
চলে যায়।
ছেঁড়া আস্তিন গুটোনো কঙ্কালটা
হাড়ের স্ট্রাকচার থেকে বেড়িয়ে আসতে চায়,
যখন বিপাশা নাচছে, কোমরে ফুলকির ম্যাজিক
চারদিক ওগরাচ্ছে ধোঁয়া আর
কন্ডোম খাচ্ছে নিয়নের দ্বৈত-ভূমিকাগুলো
শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি
মামুন মুস্তাফা
মধ্য পর্ব : ৩১
আমাদের ঘরগুলো নিমেষে হাওয়া হয়ে গেলো। আমাদের ব্যস্ততা ক্রমশ ম্রিয়মান হয়ে যায়। বাড়ন্ত দুপুরে ঘেরা গল্পগুলো ফিকে হয়ে আসে স্মৃতির মগজে। তখনও নায়িকার স্বপ্নবোনা রাতগুলো চিত্রনাট্য রচে রূপালী পর্দার! দোলনায় শিশু... ঊনুনে বিন্নি ধানের খৈ... সফল কৃষক মাড়িয়ে আসবে সকল প্রজাতির শস্য...এ কাহিনীর অপর পিঠে দাঁড়িয়ে শহুরে বণিক;- দর্শক আতঙ্কগ্রস্ত হয়, নাগরিক দরপত্র কেড়ে নেবে কৃষকের বসত? এমন দৃশ্যের কাছে প্রাচীণ বসতভিটায় ধরে থাকে কিছু হলদে ফুল। সেখানে পরজীবী প্রজাপতি ওড়াউড়ি শেষে জেনে যায় ভেঙে পড়া অসুস্থতায় এখনও কিছু জীবন গোপন প্রবণতা ধরে রাখে, শুকনো নদীর জলে দাঁড় টেনে চলে...
মধ্য পর্ব : ৩২
আর একটি কথার পিঠে খুলে যায় শনিবারের দরজা। বিছানায় মেঘবালিকা ছড়িয়ে দিয়েছে তার অবিন্যস্ত চুলের উদাসীনতা! ধ্রুপদী সময়ের কাছে বাঁধা মানবিক সম্পর্কগুলো। দয়িতা এরপরেই রেখেছে পা চৌকাঠে;- শনিবারের অন্তর্বর্তী গল্পগুলো আর কোনদিন জমে ওঠেনি। সকালবেলার পাখি ডেকে ডেকে ফিরে গেছে...জন্মসূত্রে যদিও ফিরে আসে অনেক স্তন্যপায়ী জীবন, তবু মনোজগতের রহস্য বেড়ে গেছে...ব্যক্তিজীবনের বৃত্তগুলো আপন সৃষ্টিতে নিমগ্ন...অথচ সৃষ্টি শেষে পড়ে থাকা বিচ্ছিন্নতাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায় কাগজবিক্রেতা! ওই ধ্বংসাবশেষ পড়ে হেসে ওঠে কারখানার শ্রমিক, মানুষের অক্ষমতা নিয়েছে কেড়ে তার মজুরি। ক্ষণজীবী হয়েছে শুধু যাপিত জীবনের গার্হস্থ্যবেলা...
সুন্দর সুন্দর!
তারেক মাহমুদ
পাখির মতো কী চমৎকার ডানা মেলে
উপড়ে উঠে যাচ্ছে সুন্দর সফলতা
যানযটে শুয়ে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন
কী সুন্দর হাইরাইজ
বৃক্ষ কেটে গোড়াটি রেখে গেছে কোন এক সাহসী বনদস্যু
কাটা বৃক্ষের মূল পড়ে আছে সুন্দরম কেদারার মতো
পার্কের মলিন ঘাসে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে
প্রতিভাবান ব্যর্থতার সুখ
আহাহা জগতের চাইতেও জীবন কী ভয়ংকর সুন্দর!
হাদিউল ইসলাম এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
১. প্রবণতা
গাছ থেকে আপেল গড়িয়ে পড়লো মাটিতে
তা-ই কুড়িয়ে নিয়ে কিভাবে কেন পড়লো
এই ভাবনায় বুঁদ হয়ে গেলো নিউটন
কোত্থেকে এক ঘুড়ি সুতো ছিঁড়ে উড়তে উড়তে পড়ে যাচ্ছে দেখে
আমাদের ছোট ভাই ধরবে বলে দিলো ভোঁ দৌড়
তার ভেতর বিশ্বজয়ের প্রবণতা
আমাদের বড় ভাই-তার এসবের ভাবনাই নেই
কেননা তার মাথায় মগজের বদলে
এক দলা অনুর্বর মাটি
আমাদের পিতা পড়ে যাবেন, এই ভয়ে
সর্বদা লাঠিতে ভর করে চলেন, কেননা তিনি জানেন
পড়ে গেলে কেউ কুড়িয়ে নেবেনা ফেলে দেওয়া ছাড়া
সেদিন টোকা দিতেই তুমি গড়িয়ে পড়লে
পড়ে গিয়েই খুলতে থাকলে মেলতে থাকলে গোলাপ ফুল
পদ্ম জবা ডালিয়া সূর্যমুখী এমনকি ছোট্ট বকুল
আমি নিউটন নই, আমাদের ছোট বড় ভাই নই
এমনকি আমাদের পিতাও নই
কিন্তু তাতে কি, তবু তুমি হাঃ হা হিঃ হি...
২. ধ্রুপদী স্বপ্নের বিমর্ষ স্তবক
বহু ধ্রুপদী স্বপ্নের বিমর্ষ স্তবক
আজ পড়ে আছে। বিস্তৃত শোকের আবহাওয়ায়
লোবানের গন্ধ ওড়া অনুভূতি। প্রিয়রা বাকল খুলে
দাঁড়িয়েছে শীত শীত গায়ে। যেনো চতুর্দশীর চোখে হঠাৎ
কোনো যুবকের মুখ বিম্বিত হবার প্রথম বিস্ময়।
নওশিনের পিতার বুকে অম ক্রোধের ঘৃণা এক দলা থুথু
বুঝি ছুঁড়ে দেবে, তাই শংকিত সুধীজন থাকে দূরে দূরে
চর্তুদিকে পোড়োমন। মানুষ সব বালিতে মুখ গোঁজা উটপাখি
কী গল্প আজ লুকোতে চায় অজর বসন্ত
কোন্ স্বপ্ন আজ ঠোঁটে গেঁথে কাক উঠে যেতে চায় মগডালে!
৩. কোথাও দৃশ্য হয়ে আছো
কোথাও দৃশ্য হয়ে আছো
গার্লস স্কুল ছুটি হলে শহরময় যে রোদ হট্টিটি চঞ্চল
কোথাও তেমন প্রক্ষাপটে আছো
গাঢ়তর অভিমানে
বললতা সেনের হারানো বোন হয়ে গেলে
আমি ন্যুব্জ, রদ্যাঁর ভাবুক
স্বপ্নে পাওয়া চোখ দু’টি দালি’র গলে যাওয়া ঘড়ি
সাজানো ফলের দোকানে দোকানে যে মুগ্ধতা
তারও অধিক চমৎকার কোথাও দৃশ্যতঃ আছো
হাস্নাহেনাগন্ধী জোছনায় কোথাও উঠোনে হাঁটছো ভেবে
আমি দূর অন্ধকার থেকে প্যাঁচা হয়ে নামি
পৃথিবী তো উল্টে গেলো এহেন তোমার জন্য
স্মৃতিতে এবার বেশ সিলিকন হলো
হঠাৎ গুলির শব্দে হতবুদ্ধি পাখি হলো মন।
৪. এখন লুকিয়ে রাখি তার নাম
এখন লুকিয়ে রাখি তার নাম হিবি জিবি টানের ভেতর
ফসল ডুবিয়ে বন্যা যেরকম সৌন্দর্য রচনা করে
অনুজ্জ্বল মর্মে ভরে ওঠে আমার সকল খাতা
রক্তকরবীর বুকে স্থিতিশীল বিষ।
সে এখন দুধেল ধানের বাকলে বাকলে
সবুজ ফড়িং...
এখন লুকিয়ে রাখি তার নাম হিবি জিবি টানের ভেতর
এখন বেড়ালচোখে দেখি তার নাম অঙ্কিত আঁধারে ...
৫. শোক বই ভরে ওঠে
ডাকে বিমূর্ত কোকিল বসন্তবিহীন
মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডে আমি নাচি
ফলত: দাক্ষিণ্য মেনে পায়রার অহংকারী গ্রীবা
শোক বই ভরে ওঠে জোনাকি স্বাক্ষরে
রোদ মেঘ আর এক প্রজাপতি
হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা
হাসি তার কোন হয়ে দারুন চিত্রিত হয় বান্ধব মহলে
ডাকে বিমূর্ত কোকিল বসন্তবিহীন
ধুলোরা সোনার ধুলো, আমি নাচি
আর মুগ্ধ দেখি, শোক বই ভরে ওঠে জোনাকি স্বারে
৬. বৈষয়িক
প্রত্যহ হৃদয় ভাংতি করে
দু’হাতে খরচ করি
এভাবে ফতুর হতে গিয়ে
গোলাপের কম্পন, পাখির ছায়া
আর ঊর্মিমালা আমি কিনে ফেলি।
প্রত্যহ হৃদয় ভাংতি করে
দু’হাতে খরচ করি
এভাবে ফতুর হতে গিয়ে
তবু আমি দরদাম করি
আনাজপাতি তেল নুন মরিচের...
৭. এই মন
এই মন ব্যথাতুরা
বড় শোকতুরা এই মন
ন্যুব্জ হয়ে আছে ভাঙ্গন প্রবণ নদীর কিনারে
এই মন শিহাব বাপ্পী শিশু নওশিন
ভাসা ও ডুবার দোলাচলে তৃষা
এই মন সনি
দু’হাতে এতো কালিও কেউ মাখে? আহা চূর্ণকাল
পাগলা গারদে বন্দি এই মন
এই মন পেয়ে গেছে আজ
পায়ের কাছে নিজস্ব ছায়ার সন্ন্যাস
৮. নগ্ন রেল ক্রসিং
নিজ দায়িত্বে জীবন পারাপার করুন
এখানে লাইনম্যান নেই!
দূর্দৈবের রাজপথে
আমার গা ছমছম করে, আমার পা নড়বড়ে হয়ে
প্রচলিত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয়ে যায়
নিষ্কলুষ জীবন তবু পারাপার এতো যে কঠিন
সংবিধান সমুখে রেখে
হাতড়ে ফিরি অস্তিত্ব আমার!
৯. এখানে চাঁদের হাট
এখানে চাঁদের হাট
একুরিয়ামে বর্ণালী মাছের কোরিওগ্রাফিদিন
মাছের মচ্ছবে আমি প্রাণ পাই
প্রাণে আমি ব্যথা পাই জলতলে গুড়ি গুড়ি নুড়ি
চোখে সিলিকন, দেখি লাস্যময় অঙ্গগুলি
পিপাসার আগে আগে হাঁটে
এইসব মাছের আঁশটে ঘ্রাণে
যদি বা শুকোয় গলা, ভালোলাগে
পিপাসার আগে আগে ঘুরে ফেরা পানপাত্রে
ঘোরে বা বেঘোরে আমি প্রাণ পাই, প্রাণে আমি ব্যথা পাই
১০. নির্বাক বাড়িওয়ালা
প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড়ে মার খাওয়া বিপর্যস্ত বাড়ির কঙ্কাল
সকালে উঠলো জেগে। নির্বাক বাড়িওয়ালা
পালানে খুঁজে পেলো
হারানো কৈশোরের পাশে মৃত মায়ের মুখচ্ছবি
শেষ তেষ্টা মিটানোর জল বেরিয়ে যাওয়া
ভাঙ্গা জালা।
আর ইসস্তত পড়ে আছে ছাইয়ের গাদায়
পাখির ভাঙ্গা ডিম
তবু কুড়িয়ে নিচ্ছে আরেক কিশোর-
প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড়ে মার খাওয়া বিপর্যস্ত বাড়ির কঙ্কাল
আজ সকালে জেগে উঠলো, আর
নির্বাক বাড়িওয়ালা খুঁজে পেলো
নিহত সন্তান, হাসপাতালের অবহেলিত বিছানা
নার্সের ফুরুৎ ফারুৎ, আগত নেতার গূঢ় ছদ্মবেশ-
দেখলো সে কেবলই গর্তের দিকে গড়াচ্ছে তার
ভাঙ্গাচোরা মন ...
১১. শিক্ষা
বাতাসের গোয়ার্তুমি দেখে
আসন্ন সন্ধ্যায় লাল হলো এক মেয়ে
এই দৃশ্য দেখে অদূরে এক ছেলের মূর্খ হৃদপিণ্ড
হঠাৎ শিতি হলো
কিন্ত কোনো সার্টিফিকেটই পেলোনা...
১২ . একজন আগুনের কাছে
একজন আগুনের কাছে চেয়েছি উষ্ণতা
পালকের নিচে যেমন উষ্ণতা পাখিরা লুকিয়ে রাখে
বোদলেয়ারের কবিতায় যেরকম উষ্ণতা রয়েছে
তার বেশি নয় ।
আমার সোনার ধান বহু পুলকের হাওয়ায় দোলে
কিন্ত রাতে ভয়
পাছে শীত বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় হাত
কুয়াশা কাফন হয়ে প্রায়শঃ দেখায় ভয়
একজন আগুনের কাছে চেয়েছি উষ্ণতা
কামসূত্রে যেরকম উষ্ণতা রয়েছে, তার বেশি নয়...
১৩. কাক তাড়ুয়া
কাক তাড়ুয়া আসলে কোনো তাড়ুয়াই নয়
কাকেরা এ কথা জানে
তাই একাও আসতে পারে অনায়াসে
এমন কি কাক তাড়–য়ার মাথায় বিশ্রাম নিয়ে
মল ত্যাগ করে উড়ে যেতে পারে।
কাক তাড়–য়ার কাক শব্দটি কাক সমাজে না কি
বড্ড অপমানকর
তাই তারা নির্বিরোধ ডেকে আনে অন্যদের
কেননা চড়–ই বুলবুলি তাড়ুয়া তো নয়
এ হলো কাক তাড়ুয়া
কিন্ত কাক তাড়–য়া যে কোনো তাড়ুয়াই নয়
বিষয়টি ইদানীং ভাবছে অনেকেই
১৪. ঘুমের ভেতর
ঘুমের ভেতর আমি আজো মিথ্যে স্বপ্ন দেখলাম
এতো মিথ্যে আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে বর্ষা ও বসন্ত
যতোই বাঁশি বাজাই রাধা দূরে সরে যায়
গোপিনীরা রাধা সেজে আসে বলে
ঘুমের ভেতর আমি আজো ভুল স্বপ্ন দেখলাম
এতো যে ঘর বাহির মথুরা বৃন্দাবন করি
আইহনে মজিয়াছো না কি? দিন যায়-
সবুজ পাতারা হলুদ, করুণ ঝরে পড়ে উপরে আমার
গোপিনীরা রাধা সেজে এলে
ঘুমের ভেতর আমি আজো মিথ্যে স্বপ্ন দেখলাম
মাহফুজ পারভেজ এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
নাম
একটি আকাশ ঝুলে আছে বুকে-নীল
বেদনায় নিঃসীম
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বিরহ-বাতাস
ছিন্নভিন্ন নিশিদিন...
অন্তর্গত বলি তাকে
মিশে আছে হৃদয়ে-থাকবে চিরকাল
তার নাম রোদ্র ও বাদলে
চৈতন্যের প্রান্তে প্রসারিত হাহাকার...
তার নাম কি? কি নামে ডাকি?
তন্দ্রায় স্বপ্ন বা সমুদ্রে বিনীত নীল?
গোলাপ তোমাকে আর কোনো নামে ডাকবো না
তুমি তো গোলাপ...
আমাদের দ্রোহ ও সংগ্রামের রক্তাপ্লুত বাংলাদেশে...
এই শহরের কুটিল খঞ্জর মানে আজ আর কোন জট, জঞ্জাল বা শব্দ নয়:
তোমার ভ্রুকুটি, নারীদের ছল: ছলছল নদীর জঙ্গম...
তোমাদের এই শহরের চেয়ে বরং প্রকৃতি ভালো-
এই কথা বলছি, স্বীকৃতি দিচ্ছি, গারো পাহাড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম-তোমাদের স্বাক্ষী রেখে।
অরণ্য ও পাহাড়ের খোলামেলা সবুজ বাতসে ভাসিয়ে বিবৃতি
কচি পাতাদের প্রসারিত স্বপ্নময় হাতে হাত রেখে।
এতো শুভ্র এতো সুন্দর আকাশ আগে আর কখনো নোঙর করেনি আমার চোখে
আমি অনুভব করে-স্পষ্ট দেখে দেখে-বলছি: বরং এ প্রকৃতি ভালো
তোমাদের এই শহরের চেয়ে-
এখানে গাছেরা, পাতারা, ফুলেরা, প্রজাপতি ও পাখিরা
দিনরাত আমাকে জড়িয়ে ধরে গুঞ্জরিত গানে গানে কানে কানে বলে:
‘ভালো আছো’
‘ভালো আছো প্রিয়’
‘ভালো আছো তুমি প্রিয়তম যৌবনের সমারোহে’।
আমিও ধারণ করি যৌবন গোপন স্ফুলিঙ্গে অস্তিত্বের অবশেষে-
এ সত্য প্রকৃতি ছাড়া আর কেউ তো আমাকে জানায় নি ?
আর তুমি?
পাছে ভালোবেসে ফেলো-এই ভয়ে
পাছে ভালোবেসে ফেলি-এই ভয়ে
পালাতে পালাতে তোমার কৌমার্য আইবুড়ো হয়ে গেছে
এবং তোমার ভেতরেও যে একটি ভালোবাসার-প্রেমের শক্তি ছিল
সেটা বনসাই...সেটা ন্যানো হয়ে গেছে...নগরের কোনো নব্য-ধনী-বাড়ির শো-কেসে!
আমিও তো তোমারই নান্দনিক কফি পেয়ালার কালোর তরলের একটি ডুবন্ত মাছি হয়ে
শেষ পর্যন্ত ভালোবাসাই গুনগুন করেছিলাম-তোমার ঠোঁটে, কানে, অন্তরাত্মার দেয়ালে:
এই তীব্র প্রাকৃতিক সত্যকে কী সহজেই ‘ফেসবুক’-এর দেয়ালে ঝুঁলিয়ে দিয়ে
চমৎকার মাধুরী মাখানো শব্দে ও মুদ্রায় বললে:
‘ও কিছু না, সামাজিক যোগাযোগ, মামুলী ব্যাপার মাত্র’!
আর্থ-সামাজিক-নাগরিক তত্ত্বে নগর তোমার ভালোবাসা-প্রেমকে তুলেছে শেয়ার-বাজারে!!
অথচ আমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি,
মহাকালের দেয়ালে তোমাকে আঁকার জন্য ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছি
বৃরে অল্য ইঙ্গিতে নগর-নষ্টামীর বাইরের প্রকৃতি, অরণ্য, নীলিমার নীলে...
তারপরেও কী করে বলি: আমাদের অরণ্য-প্রকৃতি থেকে তোমাদের নগরই ভালো!
এখানে একটি তুচ্ছ জুঁই পোকাও স্বীকার করে না নগর-নগরশ্রেষ্ঠত্ব
প্রয়োজনে কাপে নয়, আমাকেও সঙ্গে নিয়ে সরাসরি চুমু দেয় কফি ফুলে-প্রাকৃতিক স্তনে...
তারপরেও কী করে বলি: আমাদের অরণ্য-প্রকৃতি থেকে তোমাদের নগরই ভালো!
বরং প্রকৃতি ভালো: তোমার আদিম ও সুন্দর প্রস্ফুটনে...
প্রকৃতি তার নিজস্ব সিফাত বা গুণের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতি মুর্হূতে আমাকে শিখাচ্ছে ভালোবাসা
আর আমি সর্বণ দিগন্তের কানে চিৎকার করে বলি: ‘ভালোবাসি’...
তোমাকে ভালোবাসবো-এত বড় দিগন্ত এখানে এই নগরে কোথায়?
বরং প্রকৃতি ভালো: তোমার আদিম ও সুন্দর প্রস্ফুটনে...
আমাদের দ্রোহ ও সংগ্রামের রক্তাপ্লুত বাংলাদেশে...
গান
পুনর্জন্মে ফিরে আসায় বিশ্বাস করি না, করি নি কখনও।
বিশ্বাসে বিশ্বাসে তোমার কাছেই ফিরে আসবো-এ কথা মানি
ধর্মের অমোঘ বিধানের মতো:
কেবল আমিই ছুঁতে পারি তোমার ভালোবাসার হাত।
যে তৃষ্ণার্ত পাখি এতো জল নিয়ে রাঙালো নিজের ডানা
সে তার পাখায় তোমার আকাশ ছাড়া তো উড়তে পারে না ?
এক নদী জল রাঙা করে
গোটা চাঁদ, রাত, সূর্য ও আকাশ রাঙা করে
রাঙিয়েছি নিজেকে-তোমাকে
নিজেদের শিরার শিউরে নিয়ে গেছি আমাদের প্রাণ-
আমি কেনো পুর্নজন্মের অপো করে ফুরাবো জীবন ?
তোমারই জন্য আমি তো গায়ক পাখি-কফি
কফি
আজকাল তুমি কফি খেতে ডাকো আর আমি প্রকৃতির কাছে চলে যাই:
তন্দ্রায় আচ্ছন্ন কফি ফুলের বাগানে বিনীত মৌমাছি আমি
উড়াই কফি-রঙা ঘুড়ি আকাশের গায়-
ওই তো রয়েছে পড়ে তোমার কফির কাপ
সুবিস্তীর্ণ নীলকাশ মাঝে যেন কালো পরী
উড়ে যাচ্ছে কফি নামের আড়ালে আমার ঘুড়ির সাথে...
পরীটির চোখ বারবার কালো কালি দিয়ে গাঢ় করে
ঠোঁট আরো লাল করে
চুলগুলো ঢেউখেলানো করে
হঠাৎ দুইটি ডানা সাদা রঙে মুছে দিয়ে
নীল লেপে দিচ্ছি চরাচরে...আকাশে...আমার আর পরীটির হৃদয়ে...
নীল আর কালোর ভেতরে কফি ঢেলে দিয়ে যখন তোমার হলুদ শাড়িটি
নীলিমার নীচে সবুজ উদ্ভিদে আল্ট্রা-ভায়োলেট বাতাসে উড়ে উড়ে
অ্যাকুয়া মেরিন পানিদের সঙ্গে সাঁতার কাটবে-
কী নামে ডাকবো তোমায়: রঙহীন-রঙের ‘রঙিলা পরী’ ?
তুমি যখন আমাকে কফি খেতে ডাকো
তন্দ্রায় আচ্ছন্ন আমি: রঙ-খেলায় বিনীত:
অথচ কফি কী করে বানাতে হয়-সেটাই
শেখা হলো না এখনো
শেখা হয়ে গেলো আকাশের গায়
তোমার উড়ালের সাথে কফি-রঙা ঘুড়ি উড়ানো...
আমার অনন্ত গান।
অভিষেক নাগ এর কবিতা
সূর্য মাখা ক্লান্ত সকালে,
স্বপ্ন, আশা, ও সমঝোতা নিয়ে...
এসে ছিলাম বদলে যেতে |
বদলে ফেলেছি অনেক কিছুই,
কিছু শূন্যস্থান ছাড়া|
স্মৃতির বোঝা নিয়ে ফিরছি একা...
চেনা মানুষ ও অচেনা পরিস্থিতির মাঝে |
-------------------
ডিম টোস্ট এর কিছু টুকরো
না তোমার চাহনি....বক্র....
আমি ঠিক কি চাই,
বুঝতে পারি না কিছুতেই!
একটার দাম ছ' টাকা
আর অন্যটা মরীচিকা|
--------------------------------
ভাবছি একটা কাব্য লিখি তোমার কাজল নিয়ে...
ভাবছি কিছু পংক্তি তে ধরি বিদ্যুত-সম হাসি|
ব্যর্থ হচ্ছি অনবরত,
বেরোয় না সেই সৃষ্টি...
এক পেট খেয়ে মুর্গ-বিরিয়ানি ,
মুখে পুরেছি জেলুসিল খানি ,
অম্বলে আজ হারিয়ে ফেলেছি ক্রিয়েটিভিটির পুষ্টি!
_______________________
ধন্যবাদ...
ধন্যবাদ তাদের... যারা করে তুলেছে,
প্রতি টি সন্ধ্যা কে রঙিন |
ধন্যবাদ তাদের.. যারা তারিফ করেছে
আমার প্রতিটি সৃষ্টির |
ধন্যবাদ সেই পাতায় ভরা গাছপালা,
সেই সোনালী রোদ্দুর মাখা সকাল গুলো কে|
ধন্যবাদ সেই সম্মতি মাখা হাসি,
সেই আবেগভরা কৃতজ্ঞতা কে |
ধন্যবাদ...
বেঁচে থাকার মুহূর্ত গুলি কে |
--------------------------------------
দেয়াল এর টিকটিকি টার দিকে চেয়ে রই
পরম কৌতুহল-এ....
ওই বিশাল বিস্তৃতি তে,
কিভাবে সে একা রাজত্ত্ব করছে |
চেয়ে রই ওই মনোযোগী মাকড়সার দিকে,
কিভাবে গড়ে তুলছে তিলে তিলে
জটিল জাল রাজ্য |
দেখছি এবং অনুভব করছি,
একা একা কাব্য লেখার আনন্দ |
_____________________________
কবিতারা সব শুয়ে আছে
ওই সঙ্কোচভরা কবরে..
সুররিয়াল আজ সুর হারিয়ে
চিত্কার করে, "বাবা রে!!"
শীতল দেয়াল, হলুদ বাতি ,
শ্যাওলা মাখা মেঝে
তারই মাঝে বিষাদ বাঁশি
পিন পিন করে বাজে...
সর্ব ঘটের কাঁঠালী কলা
থেঁতলে দিয়েছে কারা,
রক্তে রাঙানো canvas
যেন abstraction -এ ভরা...
_________________________
যখন লাগে না একটুও ভালো সুমন-নচির গান
তখনি আমার তোমাকে চাই....
যখন করে না ইচ্ছে খেতে তন্দুরি বা বাটার নান
তখনি আমার তোমাকে চাই....
যখন লাগে রাত্রি গুলো ভীষণ ভীষণ একা
তখনি আমার তোমাকে চাই....
যখন যায়না একটিও ভালো কবিতা বা গান লেখা
তখনি আমার তোমাকে চাই....
যখন ধরে না রথের মেলায় কেউ এসে দু'টি হাত
তখনি আমার তোমাকে চাই...
যখন পারি না প্রাণ খুলে আমি বলতে 'দিল কি বাত'
তখনি আমার তোমাকে চাই....
যখন আমি হেরে গিয়ে কাঁদি, হতাশায় মুখ ঢাকি
তখনি আমার তোমাকে চাই...
যখন আমি জিতে গিয়ে, পা বিজয়-মঞ্চে রাখি
তখনি আমার তোমাকে চাই...
হ্যা...শুধু তোমাকেই চাই....
যদি বলা হত লিখে যাও আজ শেষের কবিতা খানি...
যদি বলা হত সাদা কাগজে কেটে যাও শেষ দাগ,
লিখতাম শুধু তোমারি নাম....
বাকি কথা যেত হারিয়ে,
তোমাতেই ছিল কবিতার শুরু
তোমাতেই যাবে ফুরিয়ে.
________________________________
গ্রীশ্মের দুপুরে লাল ছোট ছোট
রাস্তায় পড়ে আছে অজস্র টমেটো
নিষ্ঠুর মানুষের পদচাপে পিষে
টমেটোর রস গেল রাজপথে মিশে
গ্রীশ্মের পরে শিত আসে চুপিসারে
টমেটোর স্থান হয় রান্নারই ঘরে
টমেটো কে পেয়ে আলু নাচে আহ্লাদে
দেখা হল দুইজনে বহুদিন বাদে
বেশিদিন এই সুখ হলনা কো স্থায়ি
টমেটোর খুন হল বিধি অনু্যায়ি
ছুরি এসে ঢুকে গেল মাংসালো পেটে
টমেটো কে করল সে দুই ভাগ, কেটে
তাই দেখে গোল আলু বলে একি হল!
টমেটো কে সে বড়ই বেসেছিল ভাল
টমেটোর দুখে তে আগুনে তে মিলিয়ে
ঝলসানো আলু দিল সব স্বাদ বিলিয়ে...
------------পাবলো নেরুদা-র "an ode to tomatoes" হইতে অনুপ্রাণিত
মন কথা
পল্লব শাহরিয়ার
ক.
রাজকন্যার ঘুম আজ আর কেউ ভাঙ্গায় না
মরা মাছেরা আজও অপেক্ষারত
ধস নামা পাথরে, জলের আলপনায়
আছে কত গল্প
নুড়ি পাথরের বুকের ভালোবাসাই দেয়
রঙধনুর খোঁজ।
খ.
ভোরের হাতে সব সমর্পন করে শুন্য হয়েছি।
একগুচ্ছ নতুন কবিতা
আশিক ইশতিয়াক
০১. যাপন
অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করি
প্রস্তাবঃ কানামাছি ভো ভো
বৈরাগ্যে শূন্য করি, রঙ কাড়ি
তামাশার
বুমেরাং যত বিদ্রুপের বাণ।
পরিচয়ঃ এই অন্ধ শ্রমিক
শাবল-গাঁইতি হাতে
খনি খুড়ে রাঙায় খুন।
আর কান না পেতেই শুনি
জল কেটে পালায় ভদ্দরলোকের জলযান
পরিহাসঃ প্রপেলার তো ঘুরবেই।
হাসি ঝুলাই
প্রমেয় প্রলম্বনঃ ঝুলাই ছাল ছিলা অবোধ হতে
মেটার্নিটির শীতল শল্য ছুরি অবধি ।
দেবালয়ে নাই দস্তখত,
শহরের পুরানো প্রেক্ষাগৃহে
মুখোস সমগ্র ছুড়ে
খুলি আকরিক
ঘামে জবজব হাপরের মত শ্বাসে
পৌনঃপুনিকতাঃ খুড়ে খনি রাঙাই খুন...
০২. ওয়াটার পার্কে যাই না, সমুদ্রে যাই
একজন বৃদ্ধ পোসাইডন
মাংসাশী সিংহাসন থেকে
তার কিশোর নাগরিকদের
শমন জারি করে বললেন,
তাজা লাল রক্তের বদলে
সিমেন্ট বেড়ার জল বাগান
দেয়া হবে। আপনারা প্রমোদ তীর্থে
চির নিমজ্জিত হোন।
কিন্তু এই আঁশটে তান্ডবের বিপরীতে
শহরের সীমাবদ্ধ আসমানে
মিথেন তোপে শোকার্ত মেঘ
ফুড়ে বেরিয়ে আসা পাখির
ছদ্মবেশে আমার মা
ডানা মেলে ডাকলেন
“আয়, আমার নোনা বুকে আয়”
আমি তাই সমুদ্রগামী।
০৩. সমুদ্র, আদিনিবাস
পরিত্যক্ত পোতাশ্রয়ে
পাতি না কান বন্দর বিভ্রমে;
বুকের গভীরে ডাকলে নীল, ডাকলে সমুদ্র
জানি ফিরতে হবে আদিনিবাসে।।
০৪. প্রবণতা:আত্নহনন
স্মরণে:সুমন প্রবাহন
একটা দড়িও তো হতে পারে
পেন্ডুলাম
যেমন আমার ঘরে ঝুলছে
অনন্তকাল
বয়সের কসম
আমি শান দেই না স্মৃতিতে
ঘড়ঘড়ে শ্বাসের মত ক্রনিক রাতে
ঘুনাক্ষরেও খুঁড়ি না প্রভাত
দরজায় কাঁদুক নিয়তি
আমি কারো মিনতি শুনি না
জড়ো করা অনুভূতির শব
ভেঙে ভেঙে উঠে আসি
চারপায়া পৃথিবী থেকে
যদি শূন্যে ঝুলে পড়ি??
অতঃপর অতটা পর আমি
আপন হব গোপনে
তোমাদের অন্ধকারে আমিও হব পেন্ডুলাম!
০৫. কিষাণীর সাথে ফারাওর প্রেম
স্মরণেঃ শান্তি সর্বংসহা
তোমার এপারে পৃথিবী পাংশু, নিরস ধূলোবালির
আর সময় একই স্রোতে বৃত্তবন্দী যদি
সভ্যতার সমবয়সী গোলকধাঁধায় তবে
আমিও পাল্লা দিয়ে হয়েছি অমর; নির্দ্বিধায় মাতি
রক্তে রক্তে মৃত্যুর উৎসবে
ভরপেট সুন্দরের দ্রবণ তবু
কালপঞ্জিকা এফোঁড়-ওফোঁড়ে উপুড় করেছি অভাব
হায় আমার বুভুক্ষু স্বভাব!
জানি আভিজাত্যের দাম্ভিক রথ তোমাকেও
পুণঃ পুণঃ পিষ্ট করেছে নির্মম সকল দ্রাঘিমায়;
কিন্তু ফসলের সূত্র মেনে অপ্রতিরুদ্ধ ছাত্রী তুমি
প্রকাশ নাও প্রাণের দাপটে, অটল অবিচল
যেভাবে আমি দেখেছি রুক্ষভুমির ‘পরে
চোখ না পারি ফেরাতে ফসলের মাঠ
তুমি তেমনই চিরহরিৎ কিষাণী।
বিপরীতে আমি শুধু আমি
ক্ষমাহীন ক্ষয়হীন বিরতিহীন
ফারাও ফারাও ফারাও ফারাও
শুধু মুখোশে মোড়কে বদলে
শতাব্দীর ডালা ভেঙে
ফিরে ফিরে আসি।
তুমি শান্তি তুমি সর্বংসহা
চেপে ধরো আমার মমিকৃত মুখ
তোমার দক্ষ আবাদী হাতে
চুমু খাও তোমার চিরলাল ঠোঁটে
ঐ অধর ধরে আছে যে শুদ্ধতার মন্ত্র
এই অভিশাপের সেখানেই নির্বাণ
আমি মানে তো আমার দখল আমার সাম্রাজ্যবাদ
আমায় লুট করে শেখাও সঙ্গম
শেখাও ভালবাসা অবশিষ্ট পৃথিবীতে
ভালবাসো, ভালবাসি
মানুষ ও তার সমগ্রের দিব্যিতে...
উত্তরা-বর্ষা, ২০১০
০৬. শূন্য প্রেক্ষাগৃহের নিয়তিবিহীন দর্শক
আইসো
এক মুখস্থ বই খুলে
রাখি তোমার কোলে
দেখাই কেমনে খুলে পাঁজর
বিচ্ছিন্নতার কানুন শেখাই
সম্পর্ক ছদ্মবেশে।
ফিতা ঘুরিয়ে প্রথম থেকে
একই চলচ্চিত্র দিচ্ছে ফাঁকি
শূন্য প্রেক্ষাগৃহে।
ইন্দিরা রোড-বর্ষা, ২০১০
০৭. যোনি
কখনো পেটুক পোকার বিশাল হা করা মুখ
কখনো গোলাপের গোপনতম কুঁড়ি
ফাঁদ ফিরিস্তিতে গন্ধম ধ্বনি
শত বিপত্তির ঘেরাটোপ পেরিয়ে জানি।
জন্মের কথা মনে পড়ে
মৃত্যুর ও,
পৃথিবীর প্রাচীন পথ সেই
প্রাগৈতিহাসিক জগদ্দল বিশ্বাস বাস্তবতায়
নির্বাণ নির্বাণ আকুতি তুলে
জখমে পাড়ি দেয় ভিক্ষুর দল
প্রেমিক সন্তাপে।
আর সিংহাসনই জানে
পাড় ঘেষে তার
কতটা শীৎকার ধরে মৃসন দেয়াল
ওহো জাদুঘর!
সে পৌরাণিক হাতকড়া
সে জন্মে মৃত্যুদন্ড দিয়ে
মৃতের ললাটে চুমুতে আঁকে জন্মের অবিকল ছাপ
আবারো সন্তাপ!
সবাই জানে
তার ভেতর এক ক্লান্ত গোক্ষুর,
কেউ কেউ কদাচিৎ খুঁজে পায়
যক্ষের ধন।
ইন্দিরা রোড-শীত, ২০১০
ভয়ানক নৈসঙ্গের ভিতর পাওয়া কাব্যগুলি-১
নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
০১.
সামনে কিছু নেই শূন্যতা
নতমুখজল থির হয়ে আছে
বাঁধানোঘাটের টানে অস্থিরমন
মনের ছায়ায় ঝরে গেছে দিন
যেপাতা সন্ধ্যা জ্বেলেছে ধীরে
তার সবুজঘ্রাণে লোকালয় একাকার
নতমুখিজল আধার অস্বীকার করে
হাতের ভাঙনে স্মৃতিচিহ্ন রোদ
রোদ আসে খুব ভোরে
সামনে কিছু নেই শূন্যতা আছে
সামনে আমি আছি নিজের কাছে
০২.
উপুড় ভাবনায় ক্ষয় হয় নিশা
নিশা রাত্রির যমজ
রোদের রেকাবে সাজানো সকাল
ক্ষয়িষ্ণুরাত স্মৃতিতে থাকে না
কাঁচের জানলায় ধূলির নকশা
আঙুলে ভেঙে দিই প্রকৃতির খাপ
উপুরশরীরে ক্ষয় করি পাপ
০৩.
ভোররাতে নিঃশব্দে আসে ট্রেন
থামে কুয়াশার কোল চিরে
ভিড় নেই যাত্রিদল শ্মশানের ছাই
শাদানিঃশ্বাসে স্বপ্ন পুড়ে দূরে
এইসব ভেবে ঘাসের ছায়ায় থাকি
ঘাস ছিঁড়ে চরাচর বিবর্ণজোনাকি
০৪.
আমি দেখলাম তাদের সৌকর্য
দেখলাম তাদের ভাবালুতা নির্লিপ্তসুর
আমি তাদের উন্মোচিত দেখলাম
তারা গোর খুঁড়ে নিঃসঙ্গ
তারা গোর খুঁড়ে ভোরের শরীরে
ভোরের শরীর ভৈরবীস্বপ্ন
আমি সপ্তবন্ধগানের কারুকাজ দেখলাম
তারা মূলত কাকে সমাহিত করবে
০৫.
আমি দেখছি তুমি এবং আমি
তুমি তাদেরই একজন
দেখছি একজন তুমি ঈশ্বর
আমি আমার নিজের ভিতর
তুমি পার্থিব আলোশেষ
তুমি ধীরসুররক্তলগ্নসন্ধ্যাবশেষ
তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হয় নি
আমি বিপরীতপ্রস্থান
এখন দাঁড়িয়ে হারিয়ে গিয়েছি ধান
০৬.
সে ফেনায়িত ঢেউ
একটি আঙুল ছুঁয়ে দেয় ফেনা
তার উষ্ণপাঁজর
সে ছিলো চিহ্নের শহর
তার নুন প্রতীক্ষারতপ্রান্তর
জীবন্ত অধীর
সমুদ্র হবে ভেবে আঙুল অস্থির
সে ফেনায়িত ঢেউ
সে এসেছিলো কেউ
০৭.
জানলাম সন্তরণ উত্তাল
তাকে ঠেলে দিলাম স্রোতে
সে জানলো না
তার ডুবে যাওয়া সুন্দর
প্রাণান্তকরজলকেলি শেষে ডুবে যাওয়া
সে ডুবে গেলো
ভেসে উঠলো দেহহীন
ভেসে উঠলো তার নখ
ভেসে উঠলো তার চুল আর অলক
০৮.
কানাকুয়াপাখিটি দেয়ালের ভুল
কবেকার চুনকাম
কামরাঙাগাছটির সবুজচুল
ধারাবাহীছত্রাক
বাহিরে দেয়ালের ভাঙাকাঁচে কানাকুয়া
খড়িমাটি দুআঙুলে পুরে দেয়ালে শোয়া
০৯.
তারা তখনও দাঁড়িয়ে
ঝড় তাদের বিভেদ করে গেলো শুধু
কুড়িয়ে নিলো আর
এইভুল চিরদিন চিরঅমর
এইভুলেই এইগাঁয়ে ছুটে আসে ঝড়
১০.
বাতিদান ঘুমিয়ে
জলে জলে ভেসে গেছে স্মৃতি
যেখানে আমরা অপেক্ষার ঘর
যেখানে আমরা অপঠিতঅক্ষর
সেইখানে কেঁপে উঠে খড় অকারণ
কারণ আছে ভাবি নি
একটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছি
আমরা দূরত্বের বিষয়
১১.
যদি আমরা তার মৃতশব্দ ধরে রাখি
যদি তার কাগজের হাতে জল না ছোঁয়াই
যদি তার পারিজাতে রক্ত না লাগাই
সে থাকবে পাথরের প্রাণ
সে থাকবে গাছের বল্কল
সে কাছে আসবে আর ছুঁয়ে দেবে
ছুঁয়ে দেবে সোমত্তআকাশ
তার বিবসন ত্বকে সবুজফড়িং
সে এসে তারপর চলে যাবে
১২.
আর ইহাই নিঃশ্বাস রূপে নামে
নিঃশ্বাস ধীরে নামে শতদল
হরিণের অতলান্তচোখে নামে চঞ্চল
জমজহাঁসের সন্তরণে মৃত্যু হয়ে নামে
আমাদের ঢেকে দেয় ধোঁয়ার চাদরে
এইপ্রাচীনসমতটশহরে আমরা থাকি
আমাদের বাড়িঘর ভাসে সাম্পান
আমাদের মাথার ভিতর জংধরা আযান
১৩.
আমরা তার পাখি উড়তে দেখি
কামরাঙাগাছে বসে মাছরাঙাপাখি
পদচিহ্নের পথ থমকে থাকে
এটা সবসময় সত্য
তার পাখি আসাযাওয়া নিরন্তর
সে বুক চেপে রাখে বুকপকেটে
হরিৎহাওয়ায় দুলে তার বাসনা
১৪.
হয়তো কোনোদিন এইদিনের মতো
এইহাওয়া এইকাঠবিড়ালিবিদ্যুৎ
আমি দেখবো ইন্দ্রজাল
মাকড়সাটি করবে সন্তরণ এঘরওঘর
আমার কাঁধে সুরম্যপাতাবাহার
হাতের ভাঁজে ডুমুরের ফুল
উরুতে শীতকাল
কেউ জানবে না ভেবে
রাতে জেগে খেয়ে নেবো ঘুম
নখচিরে জাগাবো রক্তনিঝুম
১৫.
যদিও অনেক দেরি হয়ে গেলো
যদিও পূর্ণ হলো না ঘুম
তাড়াতাড়ি করো
তাড়াতাড়ি পোড়ো
তাড়াতাড়ি উড়ো
আমরা আর ফিরে পাবো না
ফিরে পাবো না নিশ্চিত বন
এই নাও যাকিছু গোপন
১৬.
এখানে সে এনেছে সকলি
বাতাস কুড়িয়ে এনেছে বিপুল
এনেছে তন্দ্রাহত সুখের বকুল
পিঁপড়ার সারিপথে এনেছে
কোথাকার গুহাদ্বারে গিয়ে ফিরেছে
পৃথিবীকে একবার শূন্য করেছে সে
পূর্ণ করেছে শেষে
আমরা নেই তখন
তারাও নেই তখন
দূরে বনষ্পতির ঝাড় নিঝুমশালবন
১৭.
ইদানীং তারা জেনেছে সূর্যের চুম্বন
গহ্বরে নৃত্য আছে জেনেছে
তারা মুকবধিরপশুর মতো জেনেছে
সূর্য আর গুহাপুরাণ একাকার
এইশহরে ঘনায়মান বনের আকার
১৮.
ঘুমের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে স্বপ্নদল আসে
সম্ভাব্যসকলস্বপ্নের সুরে ডানার গন্ধ
বন্ধদরোজার ফাঁকে সূর্য
লাজলজ্জাহীনআলো সুন্দরবেশ
কাঠবিড়ালির গানে প্রলম্বিতপথ
পথের রেখায় ভাঁটফুল কাঁপে
পথের ওপারে খড়ের বাগান
বাগানে বাদামি গান
গান শেষে কিছু নেই ঝর্ণার জল
ঘুম ভেঙে চোখের কোলে রাতের কাজল
১৯.
রোদের রোঁয়াকে শীতকাল
তাদের দুজনে উদামভাসান
শীতের গায়ে ব্যাপকচাদর
চাদরের ভাঁজে চারকোল আছে
চারকোল আঁকে স্মৃতিরূপরেখা
এইবিষ এইঅমৃত প্রত্নগন্ধসুর
রোদের রোঁয়াকে ক্রমশ দুপুর
২০.
একটিমুখ দৃষ্ট হলো জলে
জলের তলায় কাদাগন্ধসুধা
এইমুখ কেউ দেখে নি কখনও আগে
একটিমাছ সাঁতরে এসে নিয়ে যায় মুখ
এইমুখ মাছের চোখেই হবে সুখ
২১.
যখন তারা এটা ধরলো কিছুই দেখা গেলো না
আমরা চোখবুজে দেখলাম ধানক্ষেত অনেকক্ষণ
এটা কী
এটা বিস্মৃতি
২২.
আমরা দেখার চেষ্টা করলাম
আমরা দেখলাম দৃশ্য
দৃশ্যান্তরে নিভে গেলো আলো
আলো কী
আলো কি চেতনা
আলো বুঝি আগুন
আলো অন্ধকারের সহোদরবোন
২৩.
দুইটিশিয়াল বিপরীতরাস্তায় ঘুরে
সন্ধ্যারাত ফুরিয়ে গেলে তারা যাবে
গন্তব্যের ঘ্রাণে বিবশস্মৃতি
জ্বলজ্বলে চোখ আছে নিখুঁতসন্ত
এইপারে বন আর ওইপারে পাড়া
শিয়ালেরা ঘুরে ঘুরে দেয় পাহারা
২৪.
আমাদের স্তিমিতচোখের সামনে সূর্যাস্ত
সূর্যাস্তের সুর অনেকমলিনম্রিয়মান
আকাশকে নীরবে দংশন করে তবে ফিরি
বাতি জ্বালি সূর্যের আকার
এটাও একধরনের পুজো
আরতি শেষ হয় না কখনও
সূর্যাস্তে শুরু হয় কেবল
২৫.
ফুলের বোঁটা ভালোলাগে
আরও কোমল নতজানুকাঁটা
শীতের কোলে জলের জোছনা ধোঁয়া
আমার ফুল বলতে তাকেই ছোঁয়া
২৬.
কালরাতে হাওয়া আমাকে জাগালো
একটিগাছ এবং একটিপাখির মতো আমি জেগে উঠলাম
বাতাস আমাকে ঘিরে ধরলো
বাতাসের আঙুলে আমি পাতা ও পালক খুলে দিলাম
আমার পাতা ও পালক প্রাণ পেলো
আমার জাগরণ আনন্দ হলো
২৭.
তারা একে একে বিবসন হলো
সামনের রাস্তায় দাঁড়ালো পাথরের পাশে
অনেকক্ষণ দাঁড়ালো এবং ভেংচি কাটলো
তারপর পাথর হয়ে গেলো
একটিকাঠবিড়ালিপাখি উড়ে এলো
পাথরের গায়ে গায়ে লাফিয়ে বেড়ালো
আর পাথর ভাস্কর্য হলো
২৮.
সাঁতার শেষে পাথরে বসলাম আমি
সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে
জলের রঙ দেখে পাথর ছেড়ে উঠলাম
জল আমাকে নিলো না
সহসা শীতকাল এলে তাকে নিলো
জল পুনর্বার রঙ পাল্টালো শাদা
জল হারালো তার কোমল
বরফ আর পাথর দোটানায় ফেলে দিলো
আমি চোখবুজে হলাম সঘনচক্রমন
২৯.
আমি স্ববর্ণ ধারণ করলাম ধীরে
তার স্তন চুষে নিলাম যা আছে অমরতা
আলতোহাতে তার দেহে ঢাললাম উষ্ণজল
এবং তার পদমূলে শুয়ে শিশু হয়ে গেলাম
৩০.
আমি গাছের কম্পনে হাত রাখলাম
গাছ দাবানল জানে
গাছের ডালে ছিলো কাঠবিড়ালি
তার সোনালিডানায় গল্পের সুখ
তাকে কাঁধে নিয়ে উড়ে গেলাম জলে
গাছ হাসলো নিঝুমগাছবনে
গাছ দাবানল জানে
তুহিন দাস এর তিনটি কবিতা
পোস্টকার্ড সিরিজ
১.
তুমি যদি না আসতে পারো, আমার শহরে -
অন্তত একটি চিঠির ভাঁজে তোমার গন্ধ পাঠাও
বেশ জ্বলুক রঙমশাল, বিচ্ছিন্ন পোড়াপুড়ি
ইদানীং পাল্টে যাচ্ছে তোমার কবিতা, শামুকের গুটি;
তার খোলসে ঢুকে পড়ছো তুমি।
: তোর চিঠি পেয়ে আমি বদ্ধপরিকর ;
আড়ালে প্রাণের মধ্যে থাকি - দিন
কয়েকে তোর জন্যে লিখবোই কবিতা।
আসলে খুকী! অনেক কাল ধরে নিজেকে অন্ধ ভাবি ;
নৈঃসঙ্গের কথা লিখতে ‘একাকী’ শব্দের
ব্যবহার চাই না -
তোর দিকে তাকালেই
যেমন বুঝতে পারিস
আমার এখন যথাযথ উত্তাপ-কিয়দংশ শীতলতা দরকার।
২.
আজ আমার অন্ধঘরে বারবার
বিপন্নপ্রায় টিকটিকির সংবাদ শিরোনাম শুনলাম -
মাঝে-মধ্যে তোমার পোস্টকার্ড ছুঁয়ে
পৌঁছলাম গরাদ পেরিয়ে মাঠের মধ্যে
হালকা বৃষ্টির নরম শরীর হাতড়ে-হাতুড়ে শরীর
স্বপ্নভঙ্গকালে কোথায় বৃষ্টি !
চাঁদরে গাঁথা সোনামুখী বেদনার সূঁচ!
: জীবন মানে শরীর? শরীর মানে জীবন?
তাহলে আজ জীবন এক্সরে মেশিনে শুইয়ে এলাম।
এত কী পড়িস? তুই কী ডাক্তার হবি? ইঞ্জিনিয়ার?
বন্ধুপিতাকে কবর দিতে মনে হলো
আমি যদি গোরখোদক হতাম!
জানি, তুই বলবি : ক্যামন কথা! পুরুষ তুমি?
খুকি, পৌরুষ ষাঁড়ের ধনুক হতে ছোঁড়া লাল তীর।
৩.
একদিন হাইওয়ে উধাও হয়ে যদি বিস্তৃত মাঠ ;
আমরাও পেতাম ঘোরগ্রস্ত লাটিম শৈশব।
হাড়ে হাড় বজ্জাত! এইবার কবিতা পাঠাও -।
: ইদানীং আমি মাঝে-মধ্যে হাওয়া হয়ে যাই ;
প্রিয় ঝোলা আমার অফিস করে -
আমি তখন কফিশপে-অপরিচিত রাগে
আগুনে ফাটছে কতগুলো বাঁশের গিঁট।
আটটায় বাস ; লেজ গুটিয়ে কবিতা পালায়, কুকারের শিস -
পদ্যের বদলে পুরনো এই চিঠিগুলো-ই আপাতত পড়িস।
মশিউর রহমান
মহাকাল
সবুজ পাতার গা ছুঁয়ে কিছু পাতা ঝরে পড়ে
সকালের গা ছুঁয়ে দুপুর, দুপুরের গা ছুঁয়ে বিকাল
বিকালের গা ছুঁয়ে সন্ধ্যা , সন্ধ্যার গা ছুঁয়ে রাত
রাতের গা ছুঁয়ে দিন, দিনের গা ছুঁয়ে কাল
কালের গা ছুঁয়ে কাল মহাকালে হারিয়ে যায় ।
ছানি পড়া চোখে দিনের অন্তিম কফিন শয্যা ,
সান্ধ্য আঁধারের আলো ছায়ায় শোকের মাতম ।
এক একটি ছোট বড় বৃক্ষ প্রার্থনায় মগ্ন
যেন গোরস্হানে মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন শ্রেনীহীন মুসল্লীর দল
শেষ মোনাজাত ।
পুকুরে একটি ঢেউ নেই অসম্ভব থমথমে চারপাশ একটি দিনের মৃত্যুতে
বাতাশের লেশও নেই চারদিকের গাছপালা চুপচাপ
শোকাচ্ছন্ন ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও ।
একই প্রকৃতির অঙ্গ সংগঠন আর একটি দিনের আগমনে প্রাণ চঞ্চল্য
স্বপ্ন দেখে, ভুলে যায় অতীতের জরা সামম্ভব্য নতুনের আলিঙ্গনে!
পুবের আকাশে আলো, জানান দিচ্ছে ঘরে বাহিরে পাখী সমগ্র ,
একটি দিনের জন্ম ।
কালের আঁধার শরীরের আবরণ আস্তে আস্তে গেল খুলে ,
আবরণহীন শরীরের সৌন্দর্য সাবলীল
মন:মুগ্ধকর মৃদু শীতল বাতাশ অনুসন্ধিৎসু চোখে যৌবনের ছাপ
ঘাসের সৌন্দর্যেই চোখ আটকে যায কালে কালে বহুকাল ;
তবে কি আর জনমে দেখা হবে বুক পিঠ ঊরু হয়ে আপাদ মস্তক!
কিছু সকাল কিছু দুপুর কিছু বিকাল কিছু সন্ধ্যা কিছু রাত থেকে যায়
মহাকালের গলায় ঘন্টি বাঁধে ।
মৃদুল ভট্টাচার্য চয়ন এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
অতঃপর অন্ধকারেই বেঁচে থাকা
কবিতার কথকতা থেমে গেলে পরে
আমিও তোমার মতো বীজ বুনি প্রেমে;
স্বপ্নের গলা টিপে তৃতীয়ার ভীড়ে
মার্কিনী পুঁজিবাদে যীশু আসে নেমে।
যীশুদের বাইবেলে কবিকুল মেরে
সস্তিতে সুখে বাঁচে ইন্দ্রের দল;
গৌতম পত্নীরে রমোহন সেরে
অতঃপর পূত হয় গঙ্গার জল।
পুজো হয় অবিরত ধংসের মাঝে
দেবতার থালা ভরে প্রণামীর ভারে;
যমরাজও ফাঁকগলে পুরোহিত সাজে
লোভ-ভয় রাসলীলা সবিতো ওপারে।
ত্রিশুলের মায়াবলে গাঁজাখোর শিব
কৈলাস ধামে নাচে মহাদেব হ’য়ে;
কৃষ্ণের লীলা ভুলে মর্তের জীব
তারপরও বাঁচে শত অপঘাত স’য়ে।
রোজ রোজ গিলে সেই ধম্মের ঢেঁকি
অমানুষ ভর করে রক্ত কণায়;
হুমায়ুন আজাদেরা বলী হয় ঠিকই
স্বশব্দে চার্দিকে আঁধার ঘনায়।
কালক্ষণ
একটা অনুভূতিহীন বিকেল চাই
যখন তোমার স্পর্শস্মৃতি মনে ক’রিয়ে দেবে না নির্ঘুম নিরবতা
একটা অনুভূতিহীন সকাল চাই,
যখন সব স্নিগ্ধতা হতাশায় দিশাহীন হবে না শূন্য সমীকরণে
একটা অনুভূতিহীন রাত,
যখন ইচ্ছেমেঘেরা আকাশ ঢেলে দেবে না কবিতার ছেঁড়া পাতায়
একটা অনুভূতিহীন ভোর,
যখন রাত্রিক্লান্ত জড়তা মনে ক’রিয়ে দেবে না কোন ব্যর্থ দ্বৈরথ
অথবা, একটা অনুভূতিহীন দুপুর;
অন্তত একটা, একটা মুহুর্ত অনুভূতিহীন হোক।
দৃষ্টিভ্রমে যাপিতকাল
চোখ দুটো হররোজই ভুল সুরে গায়
গোধুলীর আবছায়া মৃন্ময়ী ভোর;
মৃত হরিণীর পাশে পড়ে থাকা রক্তের দাগে
নিভৃতে বাঁচে লাল স্বপ্ন।
কোনো এক অচেনা কিশোরীর রাতঘুমে
নিরন্তর যাওয়া-আসা।
ভাতঘুমেই অপেক্ষা ভোরের
ভুলভাঙা ভুলে একবার যদি জেগে ওঠে প্রাণ
তবে দেখো,আমিও পাবো অমরত্বের আস্বাদ।
নিরর্থক পাখিবিহার
এখনো তোমায় সেই নাম ধ’রে ডাকি
যে ডাক তোমায় আকুলতা দিতো প্রাণে;
রাতের পহরে রাগ কিবা অভিমানে
এখনো তোমার কপালেই চুমু আঁকি।
ভুলে গেছি পথ দ্বিধার ছড়ানো জালে
তুমিও তুলেছো তোমার বিছানো নুড়ি;
জলের পিয়াসে ঝরে গ্যাছে ফুলকুঁড়ি
কবিতারা বাঁচে আঁধারের সমকালে।
কবিতার ঠাঁই পাখিটার চেনা কোলে
পাখিটার চোখে শাওনমেঘের মাঠ;
হতাশার দিনে ভুলের রাজ্যপাট
নীলাকাশ তবু পাখিটার সম্বলে।
বৈরীতার সাথে দ্বৈরথ
পাথরে বন্দি মেঘ, ওপারে সমুদ্রবৎসল জলযান।
ঢেউ কিংবা নাবিক;
পার হ’য়ে ফের ভুলের সাগরে।
জলের নৈঃশব্দ শবদেহের অন্দরে এখনো ঠায়, নির্বিকার।
কালের আতিশয্য অথবা কালাতিপাতের যন্ত্রণাকাতর মাদকতা-
নিলাভ দ্বৈরথ পেরিয়ে অস্থিমজ্জায় গিয়ে মেশে;
ভোরের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুলুঢুলু চোখ,
নিমেষেই ম্লান স্বপনের আবছায়া হাতছানি,
ফানুসে বিভোর ধ্যানমগ্ন সপ্তর্ষির গেরুয়া বসন।
মহাকালের প্রগাঢ় ছায়া;
কোনমতে পাশ ফিরেই পুরোনো কালক্ষণ
নির্লোভ বৈরীতা ফিরে ফিরে আসে-
সময়ের ব্যর্থ গহ্বরে, প্রণয়ের প্রবল পীড়নে
-এখনো সাঁতার শেখা হ’য়ে ওঠেনি বন্ধু।
প্রিয়তমেষু
ফের যদি শিহরণ জাগে
কবিতার কোন একটি পঙ্তির কোমল পরশে,
বালিকা,তবে কল্পনায় যেও,
পুষ্পকরথে চেপে হারিয়ে যেও মেঘরাগে অথবা জলের উজানে
আমি যদিও,
বাঘবন্দি নিয়মে বাঁধা মানবীয় মূখর শরীর;
স্পর্শ ক’রি প্রেমের সিংহদর্জা,
যেখানে হাঁক ছাড়ে ছকবাঁধা কাঠের প্রহরী।
তুমি যেও,পাখিদের বিহারের পথে।
মৃগয়ায় যেতে বড়ো বাঁধে।
শিরদাঁড়া খাড়া ক’রে বেঁচে আছি ঘামের গন্ধ শুঁকে, তাই-
জিউসের নারীলোভী পুরুষত্ব আর মেনকার সাধের শরীর;
শিউরে উঠে এড়িয়ে যাই সযতনে।
অ্যাথেনার আহ্বানও ঠেলে দেই আকাশের নীল চেয়ে।
বালিকা,তোমার ছোঁয়ায় যদি সুখ ভ’রে তুলি মুঠোক’রে,
তোমার অনুভবে যদি অমরত্ব পাই আর সব বেহিশেবি পৃষ্ঠা উল্টে,
তবে ক্যানো ফের অসময়ে অশ্বমেধ?
তবে ক্যানো পাঁজর দু’ভাগ ক’রে
ভ’রে নেবো কুয়াশার অন্ধকার?
আজলা ভরা জল ফেলে,ক্যানো যাবো শিবের গাঁজনে?
তার চেয়ে চলো,
জ্যোৎস্নার আশ্রয়ে যাই
নয়তো
কবিতার আশ্রমেই চলো....
নীলাভ কাব্য
আমার কবিতা বিরহ আঘাতে
বেদনার নীলে বাঁচে
ছন্দে শব্দে নীলাকাশ গড়ি
নীলিমার নীল আঁচে।
অতীতের নীল ছুঁড়ে ফেলে দূরে
স্বপ্নের নীল ছুঁয়ে
নীল রঙা সুখ ধরা দ্যায় ঠিকই
দুঃখের নীলে ধুয়ে।
নীল পাখা মেলে প্রজাপতি গুলো
নীলাকাশ নীলে ঢাকে
বালিকারা নীল ওড়না উড়ায়ে
নীল প্রেম চোখে আঁকে।
নীল জোস্নায় মূক হোয়ে বসে
নীল ধ্রুবতারা মেখে
স্বপ্নে বিভোর নীলাকাশে উড়ি
নীল চোখে চোখ রেখে।
ঘৃণা নীলে মন অসহায় খুব
করুণার নীল মিশে
ভালবাসা সুখ ধুলায় লুটায়
স্বার্থের নীল বিষে।
চেতনার নীলে হাতেখড়ি দিয়ে
স্বপ্নেই কাঁপে বোধ
সত্যের নীলে বেঁচে রবে ঠিকই
বিপ্লব প্রতেশোধ।
সায়ন্তন গোস্বামী এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
হতোহস্মি শেষরাতে উঠে বসি
তোমার পুতুল-পুতুল আঙ্গুল নিয়ে ক্রীড়ারত আমি -
বড়ো ভুল ছিলো সে সব দিন ,
নিদ্রায়, দেখি বাবার শবে মূত্রত্যাগ
হতোহস্মি শেষরাতে উঠে বসি, নগ্ন হই
আরোহন করি বর্ণহীন শিলাখন্ড
মুক্তো , শুধু বেদানার মতো মুক্তো হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে যকৃৎ
আমি সহস্র কবিতা পুড়িয়ে ফেলি, উড়িয়ে দি
অমোঘ ভস্ম
অপরূপ হতে চাইনি একান্তে, তোমার নিভৃত
তলপেট বাঁক নিয়ে অদৃশ্য
বহুকাল , ফোঁটা-ফোঁটা হ্রেষাধ্বনি
আছড়ে পড়ে চানঘরের শ্যাওলা থেকে, আপন
হয়েও রোমকূপসমূহ ওষুধে চোবানো তুষারপাত;
চুম্বন নয়, পরিত্যাক্ত মন্দিরের চাতালে সুরাপান
আমায় মোহিত করে
বারান্দায় দাঁড়াই, দেখি সারা পাড়া
আলেয়া হয়ে ধাবমান, রাশি-রাশি বুনোফুল
এক বিশাল মৎস্যর হৃৎপিন্ডের আকারে উদ্বেল
বড়ো ভুল ছিলো সে সব দিন ।
পান্থশালা গমন
শালবন আজ ছোট হতে-হতে কুঠারে পরিবর্তিত ,
শেষ ধাতব তৃণটুকু সম্বল করে বেরিয়ে আসি ,
অশীতিপর রেললাইন তখন ময়ূরপুচ্ছ
তারই পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাবো অবহেলিত
পান্থশালায় , ভগবানের কাছে ।
এক মেঠো পথ থেকে আরেক মেঠো পথ ,
একসুরাপাত্র থেকে আরেক শঙ্খধ্বনির মাঝে
ভগবানের মুখে লাথি মেরে তুলে আনবো
নীলফুল , বৃন্তচ্যুত করবো ক্রমশ
দ্বিপ্রহরজাত নাভিমূল ।
বৃষ্টি মাথায় করে একে-একে পার হই
ধূলিসাৎ কোঠাবাড়ি, পালকের স্তূপ, মোহর ;
সন্ধ্যে নামার আগে মদ্যপ হব অকৃত্রিম
ভগবানের ঘাড় ধরে হিড়-হিড় করে
টেনে নিয়ে যাবো অন্ধকার জামরুল বাগানে
পোঁতা আছে অস্থাবরপ্রতিম ;
ঘাসে ছড়ানো নগ্ন দুটি পা না দেখে
পরিত্যাগ করি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রশ্বাস, পান্থশালায়ে
ভগবান অপেক্ষারত শুনি
বাঁ-হাতে ফেলে আসা পোয়াতি পুকুরে
ঢিল ছোঁড়ার শব্দ, ছলাৎ কলহ
স্তিমিত নিঃশ্বাস ।
প্রেম হয় জঙ্গলে
প্রেম হয় জঙ্গলে সাবেকী সবুজের চেয়ে
সবুজতর ছায়াতে ;
বৃষ্টি ও নিবিড় রাতের
খাওয়ার পর , প্রেম হয় কটেজে
ঝিঁঝির ডাকের মতো ।
বিরামহীন
বৃষ্টিতে সপ্ - সপে ভিজে
গিয়েছিলে চলে অশৌচ হওয়ার ভয়ে ;
বিরামহীন ।
তোমায়ে কত করে বলি , এখনো
নিভৃতি একিরকম বাধ্য , ভাসমান তরী
রাস্তার ধারে ছড়িয়ে আসা ফুলের পাপড়ি
উড্ডীয়মান ক্ষনের শরীর ।
ফোঁটা - ফোঁটা সঙ্গোপন
ঠোঁটে;
চূড় হই আমি ।
অবিরল স্রোতের ভয়ে,
চলে গিয়েছিলে শুষ্কতা দিয়ে ,
বিরামহীন ।
অর্বাচীন
অর্বাচীন তো নই
যে গ্রহণ দেখার ফাঁকে
চুম্বন করবো তোমায়ে ।
প্রত্যেকটি গ্রহণ এক-একটি
মাইল-ফলক দৃষ্টিবিনিময়ের ,
হেঁটে পার হই, যাই গভীরে ;
অতশত ভেবোনা তুমি ,
নই আসন্ন শীত
যে জড়িয়ে ধরবো অনুরাগে ।
পড়ন্ত বেলায়ে ,
পাখির কুজন হোক বা
নিবিড়তা ,
স্পর্শের আভাস না দিয়ে
চুম্বন করবো,
এমন অর্বাচীন নই আমি।
এত কি সয়
কুন্তল ঠিক্রে আঁধার নামে
ভাসমান হয় দ্বিপ্রহর
জলকণিকা থর-থর কাঁপে
বাষ্প কুসুম অগোচর ;
এত কি সয় ?
পেলব তুমি , অপ্রতুল
করুণ অমন চেয়ে থাকো
খন্ড-খন্ড সিক্ত হই
আঁজলা ভরে চোখ ঢাকো ;
এত কী সয় ?
দেখি কিনা তুমিই জানো
ঠোঁটের রক্ত মেঘ হয়ে যায় ,
ভেসে যায় বহুদূর
সেথায় নেই
কোনো চিতাকাঠ
নেই বুক ।
দেখি কিনা তুমিই জানো
শাপলা ভরা সকাল ,
মুহুর্মুহু ক্লান্ত করে
সূর্যের আড়াল ।
ঠোঁটের রক্ত মেঘ হয়ে যায়,
ভেসে যায় বহুদূর
সেথায় নেই
কোনো চিতাকাঠ
নেই বুক ।
তুমি কি নস্যাৎ করেছো আমায়
শরতের দুপূর কালো হয়ে বসলো ম্রিয়মাণ
নিজের সিঁথি ছুঁয়ে আমায় অনুভব করেছো জানি ,
আনমনা তুমি, বোধহীন জলের পাশে দাঁড়িয়ে
ওইটুকুই লাবন্য ।
তুমি কি নস্যাৎ করেছো আমায় ?......
গাঢ় ঘুমে স্পর্শ করোনি শরীর
অশত্থের শেকড় হয় তোমার প্রত্যঙ্গের বালুকণা
নির্মম হইনি, ভাবি শিয়রে রেখে যাবে
জুঁইফুলের পাত্র , অভ্র হওয়ার গদ্যে
তুমি পরিযায়ী অক্ষর
ওইটুকুই সারল্য ।
কপাট খোলা রেখে কবি
কপাট খোলা রেখে কবি
চলে গেছে আরো দূরে,সেথায়ে
গাছের পাতা শরীরে পড়ে
হয় বৃক্ষ, স্থায়ী ।
জৈব-অজৈব দীক্ষা অবহেলায়ে
সরিয়ে, প্রাগৈতিহাসিক
স্তন্যপায়ী জীবের ন্যায়
সন্তর্পণে নামে
শীতল জলাধারে;
কোমর ডুব জলে
ন্যুব্জ হয় দিন, ডাহুকের
ডাকে কবি ফিরে
পায়ে সম্বিৎ
কাঁদে ।
কবিতা বর্জন করে
কবিতা বর্জন করে তোমার কাছে
আসা, সে কি একান্ত হওয়া ?
সর্বকালীন রেখাপাত করে চলে যাওয়া ,
সে বড় ধৃষ্টতা ।
দোহারা মাটির রাস্তায়ে শুকনো ফল
কুড়োনোর মতন কয়েকটি মাত্র শব্দ
রেখেছি গন্ধকের কৌটোয়ে ,
যতই ভাবো সাত - পাঁচ ,
অন্তত একটিবার এসে ছুঁয়ে
যাবো তোমার গালের টোল ,
তবে দেরি করে ।
জলধি রায়
বালিকার মুখচোরা বেশবাস
বালিকার মুখচোরা বেশবাস, নিভৃত অন্তর্বাস,
আজ এই শহরের পাখি
পথ হারানো পথের বালু উড়িয়ে তাকে কাঁদাতো যে হাওয়া,
তাকে ডেকে নিয়ে গেছে অন্য কোনো অভিমান
এখন শহরের রাস্তায় একা একা হাঁটছে দুপুর—
আজ বালিকার লজ্জাশীলতার দিন । অন্তর্বাস ছুঁয়ে আছে চৌরাস্তার জল,
আর অঙ্গ তার সাড়া দেয় যদি ডাকে দূরের বিলাসী
বালিকার গোপন খেলার পাখি আর চলন্ত দুপুর...
সকলেই ঘুম ঘুম, জেগে আছে কেবল পায়ে চলার রাস্তাটি ।
এ-রাস্তা যেখানে সত্য, সেইখানে বাস করে বালিকার প্রেম—
কালো জল কাচনিয়া দুঃখকে ডাকছে নিরবধি...
হাঁটতে হাঁটতে শহরের উজানে বালিকার বাড়ি ।
এরপর, রাত্রিগুলি শুধু তার । অনুরাগী আয়নার ডাকে
বালিকার পোশাক থেকে ঝরে জল, নিঃসঙ্গ মৈথুনের পাপড়ি
খসে পড়ে রাত্রির হাওয়ায়...
যে-রাত্রে কবিতা লিখছে একজন মদখোর কবি
সৌমিত্র দেব এর তিনটি কবিতা
অসীম শূন্যতা
তোমাকে অসীম ভেবে কেন যেন খুব ভালো লাগে
অনেক দূরের কিছু হয়তো বা নাগালে পাবো না
কিন্তু সত্য এই কথা
সবারই সমাপ্তি আছে
এখনো অব্যর্থ নই তবু জানি সবারই যে সীমিত ক্ষমতা
যতই নির্মাণ করো ধু ধু নীল ধূসর শূন্যতা।
তুমি তো অধরা নও
হৃদয়ের ফিতা টেনে করেছি তোমার পরিমাপ
তারপরও দূরে যাবে
একান্তই সে তোমার পাপ।
তুমি তো লু হাওয়া নও
তুমি তো লু হাওয়া নও
শুধু শিহরণ
শিরিন প্রতিমা হয়ে ভেসে আসো তুষার বৃষ্টির দেশ থেকে
মাঝখানে কয়েক বছর
বিছানায় এপাশ ওপাশ
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া
মনে পড়ে সেই পাঠশালা
পাখির অভয়ারাণ্যে
আমাদের ছিল কিছু কথা,
জানি সব শেষ হয়ে গেছে
অথবা হয়নি শুরু কিছু
অর্থবহ হয় শুধু
জীবনের নিরর্থকতা ।
নিকট পড়শী
দেখা আর না দেখার মাঝে
নিকটে দূরত্ব থাকে দূরত্বে নিকট
দূর থেকে ছবি দেখা যায়
কাছ থেকে ছবি দেখা যায়
অনেক নিকটে গেলে ছবির ভেতরে কেঊ
মানুষের ছায়া খুজেঁ পায় ।
সেটা কি নৈকট্য না কি দূরত্বেরই অন্য কোন নাম
যে নামে ডাকলে দূরে ভেসে ওঠে ছবি
কাছে এসে ধরা দেয়
ছবির মানুষ ।
পাখি
নাজমীন মর্তুজা
আমার জানালার কাছ ঘেঁষে
খুব চুপচাপ বসে দুটো ঝড়ো-কাক
যেন সহস্র মৃত্যু জেতা প্রাণ
দাম্ভিক শক্তিতে অটল
মঙ্গায় দুর্ভিক্ষ দেখা চোখে
আতঙ্ক উত্তেজনায় উড়–-উড়– মনে
তাদের বিরহ ঘটনা জেগেছে অন্তরালে
আমার ভালোলাগার আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া দু’কামরার ঘরখানি
জল-জঙ্গলে আরণ্যক
তলকার মাটি
ধারালো জল চুপে-চুপে খেয়ে
চুরমার হয়ে যাওয়ার পথে...
সমীপে এসে মুখোশ খসে
অভিনয় ভেঙ্গে নিজেদের লুকায় কিসে
আমি বুঝেছি পাখিদ্বয়
তোমাদের চেঁচিয়ে হাত-পা ছোঁড়া
মাপাজোখা মুখভঙ্গি
নিজেদের সং সাজিয়ে রাখা
কণ্ঠে ভোর হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ
সেই শান-বাঁধানো পলিশ করা স্বর নেই
একটু কা-শব্দেই এস্রাজের আওয়াজ কেঁপে ওঠে
তোমাদের অতিশয্যমাত্রই
হৃদয়ের দারিদ্রের পরিচয় জাহির করে
তিলেক অভিনয় আমার মনকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে না
আমি ভুলেও কখনো চাই না শুনতে
জীবন সায়েরে অপরূপ নীলকণ্ঠের কাতরতা
উড়ে যাও পাখি
চেতনার সকল বদ্ধদ্বার খুলে
মরণকে দর্পভরে নিঠুর অবহেলা করে
আমি বেঁচে থাকতে চাই
নবজাত শিশুর স্বপ্নের চা গন্ধগান নিয়ে...
যুক্তবর্ণা
আরণ্যক টিটো
আপনি, যুক্তবর্ণ পছন্দ করেন না! বন্ধন শব্দটিকে লেখেন এইভাবে: বনধন ।
মুক্তবর্ণের শব্দমালায়
নতুন বিন্যাসে রচনা করেন বাকের বিভূতি, প্রেম!
আর
আমার সহজাত টান, যুক্তবর্ণে ...
বন্ধনে ...
যেমন, ন্ধ... এইখানে...
বর্ণে বর্ণে মাখামাখি, একে অপরের উপর চেপে থাকা, বলছে:
পড়ো, মিথুনের ভাষা!
চোখ চলে যায়
খাজুরাহো, টেরাকোটা, কোণারকে... দৃশ্যের হৃদয়ে শৈলী, কলা,
পাঠের আনন্দে নেচে ওঠা মন,
রিনিঝিনি শিহরনে টের পায়, সৃজনের শরীরচেতনা!
এখানেই আমি চির সনাতন! যুক্তবর্ণা, আমাকে তাগাদা দেয় যূথচারীতার দিকে
...
যুক্তবর্ণার শরীরচেতনায় তাহাকেই পেতে সাধ জাগে, ...
একগুচ্ছ নতুন কবিতা
আবু মকসুদ
তহবিলের ভোরগুলো
আমার তহবিলে নিত্যদিন জমা হয় ভোর, আত্মতৃপ্তির
ঢেকুর তুলে
আমি ধনী প্রকৃতিকে দেখি
বেয়াড়া মেয়ের ইশারা, পটুত্বের পাঠ শেষে
আমার তহবিলে বাদামী বিকেলগুলো
গায়ক পাখির মতো রাত্রি হয়ে আসে।
পুনর্জন্মের সাবেকী বিশ্বাস মরে গেলে
আলোবিদ্বেষী মাঝি লোকশ্রুতির আগল
খুলে লেখে মর্তের বাসনভাঙা গল্প।
আমার তহবিলে যুবতির ওড়নায়
সন্ধ্যাযুবকদের আর্তি জমা হলে
আমপাতা চাদরে বাজে মোহনমুরলী।
আমি বন্দনা করি আর আমার তহবিলে
শেখ লুৎফরের
মৃত্যুঞ্জয়ী এক চাঁদসওদাগর কৃষ্ণপক্ষের
চিঠি পৌঁছাবার দায়িত্ব নিয়ে ছাড়িয়ে যায়
প্রভুত্বের সকল স্তর, শুক্লপক্ষে সেই চিঠি
পড়ে আমি জেনে যাই, আমার যাবতীয়
তহবলি অতি তুচ্ছ, শুধু লুৎফরের ব্যাটাই সত্য।
আমার তহবলি গচ্ছিত রাখি তাঁর পায়ে, বিদগ্ধ জোনাক --
অভিভূত, এইবার শুরু হবে নৃত্যমুগ্ধ পূবের সকাল।
পোড়ে গেলে মধ্যরাত
অপেক্ষায় গাঢ় হতে থাকে ভিতর প্রকৃতি
শস্য-বিপাকে সূর্যাস্ত খুঁটে একাকী শালিক
বিপরীত স্টপেজে মুঠো ভর্তি মাটি নিয়ে
ডাকে রাতচরা পাখি, মধ্যরাত পোড়ালে
পাশ ফিরে শোয় দিনের ব্যর্থ গল্প
পাখির পাশের কলোনিতে থাকে সমাজ
অসীম সম্ভাবনার বীজ নিয়ে ডানা মেললে
শূন্যতায় স্মরণে আসে তিন ফোঁটা জন্মজীবন
যে ঝরনা নদী হয় তার বুকে জমা কষ্টের
কথা জানে চাঁদের পাড়ের গ্রাম ঢেউ পাশা
পিছু যদি তাড়া করে হলুদ লন্ঠন, বুঝি
জীবন কাঁধে নিয়ে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন।
যাবতীয় ভেদরেখা
দেখি প্রকৃতির দিব্য চোখে তার জলবিম্ব মুখ
তৃষ্ণার্ত পক্ষীকুল ঠোকরায় কার্নিশে ছড়ানো পাতা
নিশ্চিন্ত গাছেদের ডাল নিপুণ কুশলতায়
মুছে দেয় যাবতীয় ভেদ রেখা।
মনের খোলস খোলে সামনে এসে দাঁড়ালে
জমার খাতায় লেখা হয় সারিবদ্ধ দুপুর
হাতের তালুতে পাখির পালক আলগোছে
আশ্রয় পেলে, তৃষ্ণায় কাতর হয় নির্মেদ হৃদয়।
আগুন জ্বেলে যে পাখি উড়ে যায়, তার
ডানায় বেগুণি আর লালের সমন্বয় গঠিত
সম্পর্ক সময়ে কাটাকুটি হলে, অনাবিষ্কৃত
ঝরনা সংগোপনে জীবনের জল পান করে।
মধুর সঙ্গীত, শব্দ ভেঙ্গে জ্বলে লক্ষবাতি
অর্পূণ কবিতার রাত হঠাৎ ভোরে গড়ালে
অস্থিরতার প্রবল ঝড় আর যুগল শ্বাসের
শব্দ চূড়ান্ত স্পর্শময়তায় রংধনু ছুঁয়ে দেয়।
যুগলতায় আমরা বাজাই মোহন বাঁশি
নিত্যদিন পাখিডাকে শরীরে আগুন লাগে।
গদ্যের আপ্তকথা- ১
পালকের নরম বাতাস হৃদয়ে একটা তীক্ষ্ণ মোচড় দিলো, মাটির সিঁড়ি বেয়ে খানকিটা উপরে উঠে এলো বন্ধুতার আহ্বান। সাড়া দিতে গেলেই স্মৃতি হাতড়ানো, একদা বৃদ্ধ পিতা আকাশের সমস্ত রঙ নিজের শরীরে মাখার ব্যাকুলতা দেখালে, টবের সেই গাছগুলি জলরে অভাবে কেমন মিইয়ে যেতো। সময় পেছালে দেখা যায় পিছনের পুকুরে হাঁসের দুর্দান্ত মার্চপাস্ট, তখন অভাবের ফিরিস্তি শোনাতে দুপুর এলে সেই পিতা ঝিমানোর ভান করে পৌঁছাতে চাইতেন মনমরা সন্ধ্যায়। রাত্রিনামা প্রেমিকার মতো খন্ড খন্ড পাড়ায় অনেক শ্রাবন আসতো যেতো। পিতা পরস্পরবিরোধী নানান দৃশ্য দেখে দেখে টেবিলে ঝুকে গোছাতনে সাদা কাগজ এবং নানা রঙ পেন্সিল।
কালের কঙ্কাল আবিস্কারে সভ্যতা পাওয়া যায় এমন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে পিতা বহুকালরে জং-ধরা হাতিয়ার, বিদ্যুৎ ঝলকানির প্রয়োজনীয়তা অনুভবে ডেকে আনেন ভয়ঙ্কর দুর্যোগের দিন। রাস্তায় পা বাড়িয়ে পিতা পুরুষীয় বীজে কাটতে থাকনে নগরের মাথা, আমরা জানি সত্যগুলি কখনো আগুনে পোড়ে না, পপিতা এসব সত্যকে পোড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
পিতার ব্যথাহীন এই শরীরে উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট, অভাবের জাগতিক নিয়মে উবে গেছে বিষয়বুদ্ধির চিত্র, নিজেকে ভুলভ্রান্তিময় একসার কাগজ মনে করে অনুমানের দোলনায় দুলতে থাকেন। পায়ের নীচের মাটি ঘুর্ণিপাক খেতে থাকলে হঠাৎ আকাশের অবলম্বনে দীর্ঘ হতে থাকেন। ঊনাহারের হাত পুনরায় শক্ত হলে, সুতীব্র এক আশ্বাসে পিতার হৃদয় ভরে যায় ত্রাণে, দূরের উচ্ছ্বাসের কোলাহল ক্রমে ক্রমে জোরালো হতে থাকলে পাশের কেউ ফিসফিস করে যেন বলে উঠে ভালোবাসা আজো জীবিত আছে।
একগুচ্ছ নতুন কবিতা
মাহবুব হাসান
এই কবিতাটিকে
এই কবিতাটিকে শ্রাবণের আকাশের মেঘ থেকে টুকে
গ্রামবাংলার মেয়েদের আঁচলে তুলে দিলাম। তুমি মেঘ দেখে
গেয়ে ওঠো, আজি এ-রৌদ্র-মেঘের খেলায়...
আমি আটত্রিশ হাজার ফিট ওপরের নীলাকাশ দেখতে দেখতে কান্ত হয়ে
তোমার কবিতার আঁচলে মন রেখে ঘুমিয়ে পড়ি
বহুদেশি নরনারীর মাঝখানে।
তারা আকাশ দেখে না।
চোখে দেখে না তারা শ্রাবণের রৌদ্রখেলা,
বাতাসের হোলি-নাচ মেঘের গম্বুজে পড়ে না বিমানের ছায়া,...
তবু রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন কোনো এক-কালে
এই শ্রাবণের আকাশে আকাশে,
আকাশ দেখায় আমাকে তোমার মুখ
আর নয়নের জলে ভাসমান জীবনের অসুখ-বিসুখ;
আমি বিমানের পেটের ভেতরে কান্ত হয়ে ভাতঘুম দিই ;
ভাতেরা ঘুমায় না জানি, বর্ষায় জলমাপার টোয়া দেয়া স্মৃতির বাথানে
আমি সুপ্তির কোলে আলগোছে শুয়ে থাকি ;
বিমানবালারা হাসিভরা মুখে কেচে নিতে আসে
আমাদের কান্ত বেদনার রসটুকু ;
তাহাদের হাসির খোয়াব থেকে আমি
ছুটি নিতে বাইরের নীলে মন ছেড়ে দিই ;
নীল অনন্ত পাখি...,
ঈশ্বরপ্রতিম যেন,
দিঘীর কালো জলের কাজল এসে ছেয়েছে চারপাশ।
আমি নিরাকার মুখ মনে মনে এঁকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হই।
০৩/০৮/২০১০/ঢাকা
আরও একটি কবিতার জন্ম হোক
আরও একটি কবিতার জন্ম হতে যাচ্ছে বতিচেল্লির ভেনাসের মতো
নগ্ন-সুন্দর আর স্বাধীন। জন্ম-স্বাধীন কবিতার মগডাল থেকে একরত্তি
ভোর আলো-হাওয়া নিয়ে এসে বসলো পিঁড়ি পেতে আমাদের দিনানুদৈনিক
পান্তার পাতায়। কবিকে বললাম তোমার মন তো পড়ে আছে ধানীজমি আর
লোকমুখর হাটবাজারের খোলায়,
তুমি নাগরিকতার শিকল কেনো পরো?
কবি হাসেন স্বাধীনতা হাসে যেভাবে। উনিশ-শ’একাত্তরে একবার আমি
সেই হাসির বিদ্যুতে গোসল করে
নবজীবনকে উড়তে দেখেছিলাম ইকারুসের মতো রৌদ্রনীল-জ্যোৎস্নায়।
জ্যোৎস্না তো নীলিমারই সহোদরা,
আমাদের পরী-নারীদের পোশাক-আশাক,
আমাদের মনোবাসনার দীপাবলি। আমি একটি
কবিতার শরীর সৃষ্টি হতে দেখছি,
আমি ভাষার দাঁতের ফাঁকে দেখতে পাচ্ছি
কবিতার উপাদানের রক্তাক্ত পঙক্তিমালা -
সেখানে বেদানার মতো লুকোচুরি খেলা চলছে,
ভাঙাচোরা সময়ের নাভিমূলে মাইকেল জ্যাকসনের
শিশুদের নিয়ে করা গানের কলি নাচছে ত্রিভঙ্গ মুরারির মতো
আর মার্কিনি অর্থনীতির মাল্টিন্যাশনাল কালচারাল বিহেবিআর দেখতে পাচ্ছি সেখানে,
আমি দেখছি শোষক আর শাসিতের সম্মিলন
নক্ষত্রপল্লীর মতো নিজস্ব অরবিটে ঘুরপাক খাচ্ছে,
আমরা এখন বলতে পারি পৃথিবী মানুষের,
ধলোদের নয়, কালোদের নয়,
পীত ও হলুদাভদেরও নয় এ-পৃথিবী,
বাঙালি নামক মিশ্রদের কবজিতে যে স্বাধীনতা
গোত্তা খেয়ে পড়েছিলো ডিসেম্বরের শীতার্ত সকালে শিশিরভেজা ঘাসে,
সেখানে কবিতা ছিলো মুক্তিযোদ্ধার চেতনার ভাঁজে ভাঁজে,
আমি আরও কিছু কবিতার জন্ম দেখবো বলে
আশ্বিণ-কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পোষ-মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখের মতো
চক্রাকারে ঘুরছি, আর বুনছি বীজ
পৃথিবীর উর্বরতম মাটিতে ‘স্বাধীনতা’।
১৩ আগস্ট,শুক্রবার, ২০১০/ ঢাকা
ছাই দিয়ে মাখানো কবিতা
যে বুড়িটি সোনার ছাই দিয়ে প্রতিদিন মাজতো রূপাকাঁসার বাসন-কুশন
আমাদের পুকুরঘাটে বসে, সে এখন কাজ করে আমার বাসায়।
তার আর নেই সোনার ছাই,
বাসনকুশনও নেই রূপাকাঁসার।
এখন জীবনের সোনালি দিন
ঠুনকো কাচের বাসন আর পোরসিলেনে ভরা।
ঘড়া উঠে গেছে, ছাই গেছে ছাইগাদায়,
আমরা শহরে বন্দী
আমি কবে মুক্ত হবো এ-বন্দীদশা থেকে!!
১৪/০৮/১০/ঢাকা
রোদ ভেদ করে
রোদ ভেদ করে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নেমেছে
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এ-বৃষ্টি,
আজ ৩০ শ্রাবণ
আমাদের মনে বেদনার শীল পড়ছে শাদা ধবধবে,
ভাদ্দুরে তালের ঘ্রাণময় অপেক্ষার কাল গুনছি আমরা,
নরোম বাসনায় পাকা তাল
আমাদের রসনায় ফাল-পারা কৈ-এর মতো নাচায় মহাকাল ;
কারা যেন কালনেমি কাল হয়ে নামে আমাদের লোকবাংলায়
আমি এবং আমরা কি
তাল-পাকা ভাদ্দুরের দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকবো?
ফিরে যাবো পিতা-প্রপিতাদের শেকলপরা কালে?
স্মৃতির শৈশব ধরে রওনা হবো কি আমাদের গ্রামে?
বিল থেকে তুলে আনবো শাপলা-শালুক, কলমি ফুল সকালবেলায়?
বলো রোদ, গুড়িবৃষ্টি! বলো, বলো
আমি কি ফিরে যাবো তোমার খানায়?
১৪ অগস্ট, ২০১০/ ঢাকা
এ-জীবন খন্দকময়
নিষ্প্রদীপ মহড়ায় মাটির পৃথিবী আঁধারের চাদরে ঢাকা থাকলেও
আকাশ তার তারাদের জ্বালিয়ে দিয়ে আমাদের মনে
আলোর ইশারা দেয়, তুমি সেই আলো
তুমি সেই আলো
তুমি সেই আলো; প্রভুর মতো জ্বলছো
নিরবধিকাল ;
আর তুমি হে মাটির মানুষ,
কখনোই আঙুল তুলবে না তোমার অন্যের দিকে-
কারণ তুমি অপরাধী তোমার মনে কাছে, আর তা তুমি কখনোই জানতে চাওনি।
তুমি অন্যের দোষ ক্ষমা করে
নিজেকে সাজাও, প্রস্তুত হও ঈশ্বরের কাছে
তোমার জবান তুলে দিতে;
এখনই ভালো সময়;
এই ইবাদতেরকালে, আল্লাহর গুণ গাইবার শ্রেষ্ঠ সময়ে
তুমি লান্নত দেবার চেষ্টা করো না। আল্লাহ
দুর্বলের পাশে চিরদিন।
২০আগস্ট, ২০১০/ ঢাকা
আকাশের সৌন্দর্যবান তুমি
এক পশলা বৃষ্টি আমাকে ভিজিয়ে গেলো ভাদ্দুরের তালের বাশনায়
আমি বৃষ্টিস্নাত হয়ে ঢুকলাম এসে রোদের ভেতর, তুমি
আকাশ আমার, সোনারোদ এ-পৃথ্বীর, সুন্দরের
বাহন তুমি বাতাবি লেবুর রৌশনি ঘ্রাণ,
আমাকে পথের মাঝে এমনভাবে ফেলে গেলে কেন?
আমি কি আয়াত তোমার পড়িনি নিমগ্নচিত্তে!
আমি কি নিইনি নিশ্বাস বায়ু
তোমার? অবারিত আলোকমালা,
ঘাসের গালিচা
তো আমারই চিরদিনের শয্যা করেছি আমি,
শানবাধানো স্মৃতি আমার,
অমিয়ধারার প্রশ্নে কেন আমাকে গাঁথো অহরহ!!
তুমি সোনারোদ আমার রুপের পৃথিবী আমার
সৌন্দর্যবান, আমাকে স্নাত করো
পারমানবিক বোধের তাওয়ায়,
আমাকে তোমার
নীলাকাশে ভাসাও স্বাধীন! নাচাও বৈশাখ
আমার ঝড়োবাতাস যেমন নাচে রুদ্ররূপ!
ধানের গন্ধের ভেতর ভরো আমাকে অগ্রহায়ণে-
পৌষ-মাঘে তুমি বাঘ হয়ে এসো
আমার খানায়, আত্মার খাঁচার মধ্যে
নিখিলকে জড়াও সোহাসের তাপে ;
তুমি কেন ফেলে গেলে আমাকে নিরালম্ব এই পৃথ্বীর মায়াজালে
অভিমানী জ্যোৎস্নার ঘেরাটোপে কেন আমাকে ভরলে নিরাকার,
রুপের পৃথিবী!!
০৭/০৯/১০/ ঢাকা
কবি
জাহেদ সরওয়ার
শরবিদ্ধ খরগোশ পড়ে আছে ঝোপে
দিকহীন, রক্তাক্ত-
তাকে কেউ সারাতে যেওনা
ক্ষতস্থানের রক্তে ভিজে যাক মাটি
শ্বাপদের দল আসুক রক্তের ঘ্রাণে
নেকড়েরা তুলে নিয়ে যাক তাকে দাঁতের ফাঁকে
ধারালো দাঁতের জগতে লেখা আছে তার জীবনী
শীতের রাতে তার আর্ত নগ্ন আত্মা কাঁপে
তবু প্রার্থনায় বুজে থাকে তার চোখ
শুয়ে শুয়ে ভাবে, জঙ্গল আর চিড়িয়াখানা ছাড়া
তার কোনো বাসস্থান নাই।
মুরারি সিংহ এর দুইটি নতুন কবিতা
বন্দুকের বিরুদ্ধে কিছু কথা
ফুলিয়ার তাঁতকে বিশ্বাস করে
এবার তবে কিছু কথা বলা যেতে পারে
বন্দুকের বিরুদ্ধে কিছু কথা
একটা শীতকাল
কিছু ঝরাপাতা কিছু হিম-হাওয়া
আর মনের ভিতর অনেকটা ফাঁকা নিয়ে
বসে আছি এক প্রাচীন শিব-মন্দিরের চাতালে
সামনের এঁদো-ডোবায় পাতিহাঁস চরছে
তার জলে গাছেদের ছায়া... আকাশের ছায়া...
পুকুর-পাড় ধরে একটা বাচ্চা
ছুটে যাচ্ছে... হাতে খেলনা-বল্...
ওই ছুটের কোনো তুলনা হয় কিনা
এখন আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না
বসে বসে শুধু তাকিয়ে আছি
আর দেখছি...
কেউ জানুক বা না জানুক আমি তো জানি
এসব কথা বলে আসলে আমি ঢেকে রাখতে চাইছি
নিজেরই বিষণ্ণতা ও একাকিত্ব
কার্তুজের ভিতরে আজ বারুদের বদলে
আহা... যদি ওই আনন্দের কোন অনুবাদ
ভরে দিতে পারতাম...
যারা শাসন চালাচ্ছে তাদের ভরসা বন্দুক
যারা শাসন ভাঙতে চাইছে তাদেরও...
আজ যখন আমার কলম বন্দুকের বিরুদ্ধে কিছু কথা লিখতে চাইছে
তখন বুঝে উঠতে পারছি না তা কার পক্ষে যাবে আর কার বিপক্ষে
ওই আকাশ... ওই পাখিসকল... ওই গাছেরা... মনুষ্যকুল...
দেহি পদপল্লব মুদারম...
না না এটা আপনি ঠিক করেননি কবি জয়দেব…প্রেমিকার মান-অভিমান হলে কিছু
নরম-সরম কথা হল...খানিক কাকুতি-মিনতি হল ... অবস্থা খুব খারাপ হলে উপহার
হিসেবে একটু-আধটু সোনাদানা... না... সেটাও মন্দ নয়… এ পর্যন্ত ঠিক আছে…
তাবলে একেবারে মেয়ে-মানুষের পা ধরা...না ... না... এটা কোনো রকমেই মেনে
নেওয়া যায় না…অবশ্য আপনাকে কেনই বা বলা…আপনি তো আর এই কুকথাটি লেখেননি…
স্বয়ং গোবিন্দ নাকি আপনার রূপ ধরে এসে আপনার পুঁথিতে একথা লিখে দিয়ে
গেছিলেন... সংবাদে প্রকাশ আপনি তখন তেল-টেল মেখে নদীঘাটে চান করতে
গেছিলেন ... তা ভালো... আর আপনি কী করেই বা স্বয়ং ভগবানকে একজন
গোপবালিকার চরণে মাথা নোয়াতে বলবেন... কবি হলেও হাজার হোক আপনিও তো সেই
ভক্ত-প্রাণ মানুষেরই দলভুক্ত ... অগত্যা কৃষ্ণকে পায়ে ধরে রাধার মান
ভাঙানোর কথা লেখার জন্যে শেষমেষ সেই নারায়ণকেই নেমে আসতে হল... তাতে করে
যেমন রাধার প্রেমের জয় ঘোষণা করা হল... সেই সঙ্গে জুটে গেল পদ্মাবতীর নরম
হাতের সেবাটাও...
একটি মাছির মত
কচি রেজা
আমি রোজ মরতে চাই, তুমিকি তোমাকে ফিরিয়ে নেবে!
অনেক হিমযুগ কেটেছে, পাথর ও হয়েছি একসংগে,
মনে আছে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা? এগুলো এখন রক্তগত
একনিমিষে তুমি শুধু ফিরে যাবার কথা বললে,
আমিতো দীর্ঘশ্বাসের ও ধ্যান করি,
একটি মর্মাহত নদীর জলে ডুবে যেতে চাই,
জলকি সেই মরণ যা ইশ্বরের বাণী !
তুমি আর দীর্ঘশ্বাস কোনটা বেশি লাল?
আজ থেকে মানবদেহের রক্তের ছুটি
সব তরলের নাম তুমি, সব শূণ্যতার নাম তুমি!
আজ অনেকদিন পর প্রকৃত ভাঙনের খোঁজে পাঁচটি মোমবাতি জ্বালাই,
মোমের আলোয় সমাধি ঘরে ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে
মানবের মুখের রেখা,
আজ কিছুতেই অন্ধকারের সংগে পেরে উঠছিনা আমি,
আমাকে চেপে বসে আছে জল আমি বুকের উপরে রেখেছি প্রার্থণা
অন্ধকারের গতিইকি আলোর গতি
একটি মুখের রেখা সমাধির মধ্যাকার্ষণ!
একটি মাছির মত উড়ে উড়ে অন্ধকারের উপর বসে আছি আমি!
৭ কার্তিক ১৪১৭
একগুচ্ছ নতুন কবিতা
গোঁসাই পাহ্লভী
শুয়োর নির্ণয় করে দেবে
গোপনে ঝরে পরে লজ্জার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে পাতারা
বাকলে মোড়ানো ইতিহাস বয়স পার করে শীর্ষ ডগায়।
তা দিয়ে তৈরি করা কুসুমের অন্তরে জবার জাবর কাটা
বার মাসই চক্রের ফাঁদে ঋতু হয় হারা অন্তের মাসি।
কত ভালোবাসি কতো ভালোবাসি!কতোর মধ্যে সংখ্যার ছোটাছুটি
শুয়োর নির্ণয় করে দেবে আসন ও সনে এই সব ভোটাভুটি ভোটাভুটি।
কালি
কালি কারো নাম নয়। কালি কালোর,সাদার এবং আরো যাবতীয় রঙের।
কালি কারো একার কুশল নয়
কালো কালির দাগ পড়ে যাওয়া কিংবা লাল সে কী ভালো!
কালোর অভাব হেতু ফুটে আছে লাল জিহ্বা সে কী জড় না জীবিত?
দূরত্ব কিংবা নিকটের মধ্যে নয়
যদি চাও নিথর হয়ে যাবো পাথর হয়ে যাবো
দূরত্ব কিংবা নিকটের মধ্যে নয়
মধ্যমা থেকেও এবার সাঁতরে চলে যাবো উত্তম কোনো ‘মা’-এর কাছে।
যে হস্ত প্রসারিত নয়-অবুঝ
কালের শরীর যে হাত স্পর্শ করে নি
ক্ষীণ আলোয় দক্ষিণা পাবে না-আশাহত তিব্বত
কারে সাথে রবে না আর সামান্য কুশল।
যদি চাও বিশাল হয়ে যাওয়া ভুলে যাবো
ভুলে যাবো পাকস্থলির নাম শুরুতেই
চাও যে আমরা যেন দন্তস্য ভুলে যাই
ভুলে যাই তালে ব স্বর রজনী
যেন ভুলে যাই কথা দিয়ে কথা বেঁধে দেয়া ব্যাথা!
স্বরাষ্ট্রকুমারী
অফুরন্ত কালি আছে কম্পিউটারে
আঙুলে আঙুলে আছে নৃত্যের নিয়তি
বিরতি রেখার ‘পর মধ্যাহ্ন ভোজন
আসমান আসামে যাবে আগত সন্ধ্যায়।
অসংখ্য কালি আছে সাদা মন্দিরে
হত্যার প্রতিশোধ নিতে দাঁড়িয়ে নাফতীর
তারা তারা তারা তারা তাঁরার মধ্যে তাড়া
ছুটি হ’লে আমি কল্কের মুখ খুঁজি।
অনবরত কালি ঝরে কলম কলব ছোঁয়া
দৃশ্য পাল্টাবে নির্দেশ তবু রঙ তার এক
মানুষের ভেতর বাহির পশুর রয়েছে কী বিবেক?
তার এক ব্রহ্মধ্বনি খোঁজে পায়ের তলায়।
একদা তোমার নাম কালীহীন ছিল
পাথর খোদাই অক্ষর ক্ষয়হীন লয়হীন খোদা
তালুতে তাবরীজ বীজ আজো অঙ্কুরহীন
বিনে পয়সায় গত রাতে প্রাসাদ প্রহ্লাদ দিল।
চোখের সামান্য কাজল সহ্য হলো না স্বরাষ্ট্রকুমারী
পুরুষহীন ধাম নেচে উঠে বৈকুন্ঠ সারি সারি মেরী
তারই মধ্যে জন্ম নিলো খোকাপুরুষ এক
কার্তিক কর্তার নির্দেশ তুমি এলে ধর্মপ্রসবিনী বক।
আঙুল মঙ্গল মায়া তাড়া করে ও ভাই রামানন্দ
প্রভাতে ভাত ফুটানোর সময়,উতলাবার নয়।
মধ্যাহ্নে ঘুমিয়ে পড়ে না যেন আমাদের শূন্য প্রনয়।
ক্রোধে পুড়িতেছে মাটি ও মদ
ক্রোধে পুড়িতেছে মাটি ও মদ
ক্রোধে পুড়িতেছে জয় ও বাঙলা
ক্রোধে পুড়িতেছে নারায়ণ তকদির
ক্রোধে পুড়িতেছে অক্ষর ও ক্ষয়
আমি ক্ষয় ও ক্ষতির হিসাব বুঝি না প্রভু
গনিতের জ্ঞান নিয়া গণনা করি না সতত...।
সব কিছু্র উপরেই শূন্যতা,নর্দমারও
জাবর কাটার কাজ
আটা ময়দার ভাজ
আলু-সবজির নিচেই নিশ্চল পটভূমি।
গোলাকার দেখলেই মনে পড়ে যায় পুকুরের রণনীতি
সঙ্গীত দিয়ে করা যুদ্ধের শুরুয়া নজরুল
জারুল ফুটলেই আমি কয়েকটা মানুষকেই টেনে তুলি শূন্যে।
সব কিছু্র উপরেই শূন্যতা,নর্দমারও।
অসম্ভব সত্যের দিন সমাগত
যদি শূন্যের ভেতরে আমি কোনো ভাবে ঢুকে যেতে পারি মনে রেখ
রেখার ভেতরে যা কিছু আছে সে তোমার হবে।
আমি আর বৃত্তের বাইরে নাইরে হে পাকস্থলি
স্থলে আজ জঙ্গল যাযাবর।-জীবনটা বোনটা হারিয়ে বন আজ নিজেই সুন্দরী সেজেছে।
কারো মুখোমুখি দাঁড়ানোর মানেই তার মুখের দিকে তাকানো।
বাকানো প্রস্থের গতির বিধান করা।
শিউলি তলার কাছে এই আশ্চর্য সত্য আজ আমি প্রকাশ করবো অনন্ত কাটার উপর দাঁড়িয়ে!
শূন্যের অধিক কিছু নই
এরপর আমি যদি কোনো কারনে নাই হয়ে যাই
কোনো কারনে আর আমার কথা বলতে না পারি.....
শূন্যের ঘর থেকে আমি বলে যেতে পারবো দশমিকের সূক্ষ্মতম প্রলাপ।
বিয়োগ ও যোগের গান আর গালিগালাজের জন্মকথা।
আ ও হা করে থাকা রামের রাজধানী কোথায় ছিলো?
জানা যাবে প্রলাপে। আলাপ সেখানে আমাদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দেবে
যেমন দেয় বৃদ্ধ মা তার যুবতী মেয়েকে যুবকের হাতে।
জানি আমরা তার মতো অভিজ্ঞ নই
শূন্যের অধিক কিছু নই।
একগুচ্ছ নতুন কবিতা
সরসিজ আলীম
খোয়াড় থেকে
গল্পের চল্লিশ ডাকাতকে আমরা চোখ বেঁধে দিয়েছি,
তাদের হাত বেঁধে দিয়েছি চল্লিশটি গাধার লেজে,
গাধাগুলোকে এবার ইচ্ছেমাফিক ছুটতে দিয়েছি,
গাধার পিছে পিছে ডাকাতগুলোও ছুটেই চলেছে।
গাধার তবে উন্মুক্ত প্রান্তর চেনা নেই, আর তাদের
অবাধ বুনো জঙ্গলের পথটাই তো চেনা-জানা নেই,
তারা পৌঁছে গেলো তাদের একমাত্র খোয়াড়টাতে।
খোয়াড়ের ভেতর তাদের কী যে উল্লম্ফন! চার পাও
ছুড়ছে, লেজ দিয়ে তুফান তুলছে, গলা-মাথা হৈহৈ
করে নাচাচ্ছে; এই সুযোগে ডাকাতগুলোর হাতের
বাঁধন খ’সে যায়, সবাই তারা নিজহাতে এবার উন্মুক্ত
করতে পারে তাদের চোখের বাঁধন, বাগে পেয়ে যায়
এবার গাধাদের পিঠ, খোয়াড়ের একছত্র মালিকানা।
গাধাদের পিঠে চ’ড়ে খোলা তলোয়ার হাতে নেমে
আসে আমাদের জনপদে ডাকাতের দল, মাথা কেড়ে
নিয়ে যায় আমার বিপ্লবীবন্ধু আর উঁচুগলা মানুষদের,
মস্তকগুলো উঠে আসে খাবারের টেবিলে, মস্তকগুলো
ফাটিয়ে সুস্বাদু মগজগুলো বের করে আনে আর তারা
খুবলে খুবলে খায়, তাদের নিত্যদিনের রুটিন আহার।
ছাত্রদের বুকের রক্ত গড়িয়ে যায় তাদের সুইমিংপুলে,
স্নানের উৎসবে মাতে, সাঁতার গড়ায় রক্তের ভেতর।
শ্রমিকের রক্তের উত্তাপে ভাসানো তাহাদের পান পাত্র,
তাহাদের রক্তে উল্লাস বইতে থাকে বয়ে বয়ে চলে।
খোয়াড়ের ছাদে, উঠোনে আর তাবৎ চারপাশ জুড়ে
কাক আর শকুনের মচ্ছব, নিরুপদ্রপ কোলাহল থাকে।
কাকেরা জনপদের মানুষদের চোখ তুলে খায়, আর
শকুনেরা মাথা ঠুকরিয়ে মগজ টেনে গিলে গিলে খায়।
আমাদের মানুষেরা রাস্তায় বের হ’তে সাহস করে না,
যারা ঘর ছেড়ে আসে চোখ বন্ধ ক’রে চলে একা একা,
মাথায় ছাতা নিয়ে চলে, মগজ আড়াল করে, মুখটাও।
১৬. ০৭.২০১০, ঢাকা।
চেয়েছি হাত অনলে
আমরা হয়তো রাখতে চেয়েছি হাত অনলে,
আর সাপেদের লেজে পা।
আমরা শিখেছি দূরন্ত রাখালের বাঁশিটি,
আমরা ধরেছি হাত এক দুপুরের
নদীতে ভাসিয়েছি সাঁতার এপার ওপার।
আমরা পাড়ার ছেলেরা সন্ধ্যেগুলোকে
ঢুকিয়ে দিয়েছি মায়েদের চোখের ভেতর,
মায়েদের চোখ উঠে যায় কপালে,
মায়েরা সব ঘরে ঘরে হারিকেনের আলো,
ভেজা চোখ গড়ায় রাতের বাতাসে।
কার্ল মার্কস সাগরে ভেসে সাঁতার শিখাচ্ছে
তাহার ছাত্রদের,
আগুনে নেমে আগুনের পথ পাড়ি দিতে
শেখাচ্ছে কার্ল মার্কস তার প্রিয় ছাত্রদের।
মেয়েটির হাতে হাত রেখে এক সাগর
অপর সাগর সাঁতার দিয়ে পাড়ি দেবার
শপথ করি বারবার,
আগুনের পথ পাড়ি দেবার শপথ করি বারবার।
কমরেড লেনিনকে আমরা সমাহিত করেছি,
কমরেড মাও জে দঙ দেওয়ালের পোস্টার
থেকে নেমে এসে সপ্ত সাগর পাড়ি দেয়,
পথে পথে আগুনের ব্যারিকেট ভেঙে ফেলে।
নকশাল চারু মজুমদারের বেশ ভুল হ’য়ে যায়,
কমরেড সিরাজ শিকদারের খানিক ভুল হ’য়ে যায়।
তবু আমরা বেশ বুঝতে পারি
চারু বাবু তোমার উঠোনে গল্প ক’রে যান,
সিরাজ শিকদার তোমার বালবাচ্চার খবর নিয়ে যান,
কমরেড হাত নেড়ে যান আমার দিকে সবার দিকে।
আমরা হয়তো রাখতে চেয়েছি হাত অনলে,
আর সাপেদের লেজে পা।
১৩.০৮.২০১০, ঢাকা।
ঈশ্বর
ঈশ্বরকে আমরা মাথায় করে রাখি,
ঈশ্বর আমাদের কাঁধে ব’সে থাকে,
পুরুষের বাবরি চুল ধ’রে ঝুলতে থাকে
পিঠের উপর।
মেয়েদের কাঁধে ব’সে চুলে বিলি কাটে,
কখনো খাটো চুলের মেয়েদের চুল ধ’রে
নেমে আসে পিঠের উপর,
দীঘল কেশের মেয়েদের নিতম্বের উপর
দোল খেলেন ঈশ্বর,
বোরকা পরা মেয়েদের বোরকার আড়ালে
সারা শরীরের উপর দৌঁড়-ঝাঁপ খেলেন।
ঈশ্বরের দীর্ঘ দাঁত ও শিং ছাপা হয়
প্রতিদিনের পত্রিকার পাতায়,
টিভি চ্যানেলগুলোতেও দাঁত ও শিংয়ের
বন্দনা চলছে অহর্নিশ।
ইঁদুরের গর্তে ব’সে তোমার দাঁত ও শিংয়ের
বন্দনা ক’রে যাচ্ছি হে ঈশ্বর!
ঈশ্বর হোয়াইট হাউজে থাকতেই পছন্দ
করেন অনেকটা সময়,
এখন বারাক ওবামার সাথে-পাছেই থাকেন।
মহান কার্ল মার্কসের সাথে তার
চিরকালীন শত্রুতা,
মার্কস এখন সমাধিতে শুয়ে শুয়েই
চার হাত-পা, বিশটি নখ, বত্রিশটি দাঁত,
দীর্ঘ চুল. দাড়ি. গোঁফের ধারালো অস্ত্রগুলো
সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে।
ইঁদুর ছানাগুলোকে ক্ষমা করো কার্ল মার্কস!
তোমার অস্ত্রগুলোর চেয়ে ঈশ্বরের
দাঁত ও শিং অনেক বেশি ধারালো ও কার্যকর
হে আমাদের মহান কার্ল মার্কস!
১৬.০৮.২০১০, ঢাকা।
দু’ হাটুর মাঝে মাথা
ঘাসেরা দু’ হাটুর মাঝে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,
কয়েকটি ব্যাঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পা ছড়িয়ে ব’সে পান চিবোচ্ছে,
পড়শির বাড়িতে বেড়াতে আসা মেয়েটি জল ঢেলে যাচ্ছিলো
ঝোপের ভেতর, বাতাসে ছপছপ আওয়াজ বইছে।
ঘাসেদের মাসের পর মাস পেটে-ভাতে বন্ধ হয়ে যায়,
রাস্তায় নামলে পুলিশের গুতা, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ,
গ্রেফতার, আর গুপ্ত হত্যা বা লাশ গুম।
মালিক কারখানা বন্ধ করে শেরাবখানা আর প্রিয় নারীর
সান্নিধ্যে বুদ হ’য়ে থাকে,
মহাশয়রা আঙুলে চাবির রিং ঘোরায়,
বৈদেশিক যড়যন্ত্রের ভেপু বাজায় কারাখানার মালিক নেতারা ।
এই শহরের কবিরা মাজারে মাজারে নান্দীপাঠ করে,
কর্পোরেট মিডিয়া হাউজগুলোতে তাদের আঙুল কেটে
রাখা আছে সম্পাদক আর পরিচালকের টেবিলের কলমদানীতে,
তাদের জিভগুলো ঝুলানো আছে সম্পাদক আর পরিচালকের
পিতার ছবির ললাটের উপর;
তার বিনিময়ে কবিরা পাচ্ছে নিয়মিত মোটা অঙ্কের মাসোহারা।
বাক্স-পোটরাদের সফরসঙ্গি হয়ে রাষ্ট্রীয় সফরেও যাচ্ছেন কবিগণ,
সফরের বাক্স-পোটরা দেখভালে বেশ দক্ষ ও বিশ্বস্ত কবিরা,
কবিদেরকে নিয়ে জাতি আজ গর্ব করতেই পারে!
এই শহরের কবিরা থাকতে পারতো প্রতিবাদের প্রথম কাতারে,
ঈস্রাফিলের ফুঁ উপেক্ষা ক’রে দাঁড়াতে পারতো বুক চিতিয়ে,
ঘাসেরা কবির বুকে মাথা রাখতে পারতো নির্দ্বিধায়,
কবির বুকে মাথা রেখে একটা রাত শান্তিতে ঘুম দিতে পারতো।
ওহে আগামী শতকের মহাজীবন,
তোমাদের পাড়ায় কবির ঘুড়ির উপর আকাশ খেলা করে,
ওহে গ্লিজ ৫৮১-জির মহাজীবন,
তোমাদের পাড়ায় কবির বট বৃক্ষের ছায়ারা নদীতে নাইতে নামে!
০২.১০.২০১০, ঢাকা।
এমন দিনে
বেশ ব্যস্ত সকালে হঠাৎ কোনদিন কোন অফিস রাস্তার মোড়ে
পুরাতন স্ত্রীর ফুলে ওঠা পেট সামনে এসে দাঁড়ায় আর তার
হলুদ হয়ে যাওয়া বত্রিশ দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কাক
উড়ে যেতে থাকলে মুখের মধ্যে জল্লাদখানার মাগুর মাছ
তোড়পাড় ক’রে ফেরে,
অথবা পুরাতন প্রকাশকের ফুঁসে ওঠা পেট কোন সাহিত্য সভায়
দুলতে দুলতে এসে হাজির হয় আর তার
দুধের বলক তোলা হাসি ছাপিয়ে কোথাও কাছে-পিঠে থেকে
ইঁদুর পঁচা গন্ধ হঠাৎ নাকে এসে লাগে,
লেখকেরা সবাই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সভাস্থলেই মুততে
শুরু করে।
এমন দিনে পাকা ধানে মই দিয়ে যাবে কেউ কেউ, আর
শস্যের ছড়ারা ঢুকে যাবে ইঁদুরের গর্তে,
বস্ত্রবালিকারা বকেয়া বেতনের দাবীতে সড়কে মহাসড়কে
ব্যারিকেট দিতে থাকবে,
সুন্দরবনের হরিণেরা মাকড়সার জালে ঝুলে থাকবে,
ছাল ছাড়াবে মাছিরা, আর মাংস খুবলে খুবলে খাবে
টিকটিকি আর বাদুড়েরা,
এমন দিনে বাঘেরা লোকালয়ে এসে জিভ দেখাবে, আর
হাবাগোবা ছেলেদের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারাবে,
সরকারি দলের ছাত্র শাখার ছেলেরা রাস্তায় রাস্তায়
বানরের নাচ দেখাবে, আর মেয়েরা খুঁজে নেবে রাতের বন্ধু,
এমন দিনে তেল-গ্যাসের গোপন চুক্তি ফাঁস হয়ে যাবার পর
সরকার বাহাদুর বেকায়দায় পড়বেন, আর
বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ অন্যায্য চুক্তি বাতিলের দাবিতে
বাজীতে রাখবে প্রাণ, অবশেষে হার হবে সেই জনতারই,
আর পরাজয়ের দুঃখগুলো চুপটি ক’রে ব’সে থাকবে
কাঁটাবনের বইয়ের হাটের ডালার ভেতর,
পড়শি ছাদে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা ক’রে ক’রে ঘরে ফিরে যাবে
আজো কলেজ পডুয়া তরুণী।
এমন দিনে সুলতানা নাসরিন ইভা তার আমেরিকা প্রবাসী
স্বামীর আদর পেয়ে যাবে অনলাইনে হঠাৎ, আর এমনি দিনে
এক বিকেলে বৃষ্টির কথা ভেবে দাঁড়াবে এসে উদাস দাওয়ায়।
০৪.১০.২০১০. ঢাকা।
প্রতিপক্ষ
একপক্ষ থালাবাটি ছোড়ে
অপর গোনে কড়িকাঠ
এক দেখে দিল্লি বহুদূর
পরপক্ষ ঘোরে হাইকোর্টের মাজার
একজন কালো বিল্লির গোঁফে তা
অপর দেখে আঁধার ঘরে বিলাইয়ের ছায়া
বিলাইয়ের ছায়াটি বাঘ হ’য়ে তেড়ে আসে
একজন আঁচল দুলিয়ে হাঁটে
একজন আঁচলখানি আর আঁচলে বাঁধা চাবি
চাবিতে আটা তেল-গ্যাস-পানি-বিদ্যূতের ঘর
আরেকজন লংমার্চ লংমার্চ
আরেকজন দাপুটে শ্বশুড়ির ভীতু বউ
আরেকজন বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপায়
আরেকজন তবে কমরেড চারুবাবুর চেলা
একজন পাশের বাড়ির খুব খুব শোরগোল
আরজনের ঘরের চালে চিল শকুনের পাড়া
একজনের জিভ তোলা বিশ্বব্যাংকের তাকে
অপরের জিভ রোদ্দুরে শুকায় আর তাহার
ছাল-বাকলটি বাতাসে বাতাসে ওড়ে
আহা! একজন ভালোবাসে কবিতা আর ফুল
অপরমানবী ঠোঁটে তুলে নেয় সাপের ছোবল
২৬.১০.২০১০, ঢাকা।
প্রতীক্ষা নদীর জন্য
নাসির আহমেদ
আমার একটি নদী ছিল শৈশবে
উচ্ছলতার স্রোত ছিল সেই কবে
তরঙ্গে ছিল দুরন্ত কী যে হাওয়া
স্রোতেই খুঁজেছি জীবনের চাওয়া-পাওয়া।
দুরন্ত ঢেউ ভেঙে ভেঙে গেছি সাহসের কাছাকাছি
নদীহীন আমি নাগরিক আজ, তৃষ্ণায় পোড়ামাছি।
কোথায় সাহস! কোথায় সে নদী? জীবন মুহ্যমান
কাতরাই আজ নদীহীন এই জীবনে নেই তো গান।
নদীই জননী পলিমৃত্তিকা সৃষ্টির আদিমাতা
নদীই প্রেমিকা হৃদয়ে বোনে যে স্বপ্ন-নকশিকাঁথা
যার নেই নদী সে মাতৃহীন জানে না স্নেহ কী প্রেম
হৃদয় কী করে হবে তার বলো প্রেমে নিকষিত হেম?
স্বদেশ এবং জননীর চেয়ে নদী নয় কিছুদূর
উথাল-পাথাল তারই উত্থানে জীবনের যত সুর
হৃদয়ে বাজায় নদীর ছন্দ সৃষ্টি-কাব্যকথা
নদীহীন আমি, আমাকে ঘিরেছে ভয়াবহ নীরবতা।
যারা খুন করে আমার নদীকে উজানে দিয়েছে বাঁধ
আমি করি সেই ঘৃণ্য খুনির নির্মম প্রতিবাদ।
ক্রমশ ধূসর পাণ্ডুরতায় ম্লান এ স্বদেশভূমি
প্রতিবাদী হোক মৃত্তিকা আর নিসর্গ-বনভূমি।
আমি নদী চাই, আমাদের চাই নিজস্ব প্রিয় নদী
জীবন স্থবির মরুময় জেনো, কখনও হঠাৎ যদি
মরে যায় নদী, সরে যায় প্রেম, জীবনটা ছায়াহীন
যার নদী নেই, সে মাতৃহীন, নেই ভালোবাসা ঋণ।
আমি বাংলার, বাংলা আমার, শত শত নদী যার
তার বুকে ঢালে তপ্ত বালুর মরা নদী হাহাকার!
যেসব ঘাতক দস্যুর দল নদীর হন্তারক
অভিশাপে পুড়ে ধ্বংস হবেই ‘মানুষ’ না ওরা ঘৃণ্য পাতক।
নদী থাকা চাই প্রতিটি জীবনে নিজস্ব প্রিয় একান্ত নদী।
নদীই জীবন বহমান স্রোত, যেন স্বাধীনতা বহে নিরবধি।
একটি অথই উচ্ছ্বল নদী ছিল যে আমার গতিময় শৈশবে
প্রতীক্ষা সেই প্রিয় তেঁতুলিয়া স্রোতে ফিরে যাব কবে।
২৬-১০-২০১০
জ্যোতি পোদ্দার এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
বীজতলা রজস্বলা হলেও এখনো কর্ষণ করিনি।
একটা লাল ঝুঁটিঅলা পায়রা
সীমানায় গেঁথে দিয়েছে
তেকোনা পতাকা।
আকাশ উপুড় করে ঢেলে দিলেও প্রস্তুত শ্যালো পাম্প।
শিরায় শিরায় বহতা নদী তের'শ নদীর বাংলাদেশ।
লাঙলের ফলায় সুখ
আহা!সুখ
আদিম সুখের লিঙ্গপুরাণ
বীজতলা রজস্বলা হলেও এখনো কর্ষণ করিনি।
ওম ওম বীজাধার তুমি
শক্তি রূপে সংস্থিতা
ওম শান্তি
ওম শান্তি
ওম শান্তি
১৯
দশ আঙুল গড়িয়ে পড়ে যায়
পড়ে যাচ্ছে
থাক থাক সবুজ রক্ত
জল পড়ে
পাতা মরে
সারি সারি পাতার লাশ
দাহ উৎসবে মত্ত শ্মশানপাড়া
কে করবে মুখাগ্নি ?
আগুন শলাকা নিয়ে কাঁপছে হরিশ্চন্দ্র
এমন কাঁপুনিই তো কেঁপেছিল সে রূহিদাসের
দাহকালে
এ কোন দাহকাল !
বৃদের চিৎকারের স্কেলে কর্পোরেট ম্যানেজার
টুকে নিচ্ছে শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধি সূচক
জল পড়ে
পাতা মরে
পাতার শরীরে বাণিজ্য বসতি কর্পোরেট প্যাটেন্ট।
২০
হাঁটতে হাঁটতে জেগে ওঠি ঘুমের ভেতর
স্বপ্নজাল ভেঙে খাঁন খাঁন কান
দেয়াল ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখে আমার অসহায় মুখ
ঢুলু ঢুলু ঘুম চোখ
এভাবে আর কতো দিন ?
সঙ্গমে কান্তদেহ
উৎপাদনহীন
আমি নেই আমার ভেতর
প্রজাপতি রঙ মুঠোভরে ছড়িয়ে দেই
আবির উৎসবে
আজ ফাগুয়া দিন
দোলযাত্রা
অথচ দেলাযাত্রা
আমাকে কোথাও পৌঁছে দেয় না
এভাবে আর কতোদিন উৎপাদনহীন
আমার ভেতর আমি’র হিজড়ে যাপন
২১
সারাদিন হেঁটে হেঁটে যে লিপস্টিক গ্রামে এসে পৌঁছেছি
সেখানে লিখেছি ঠোঁট
এঁকেছি দিনভর হল্লার সাত সতের
তোমাকে পাইনি (The number you are calling
can not be reached at this moment )
ক্ষুদ্র ঋণ সহায়ককে অবশ্য পেয়েছিলাম
সে-ই উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে
মানবিক উন্নয়ন সমিতির স্বপ্নবৃত্তান্ত
অতঃপর তিনি কহিলেন , ‘‘উন্নয়ন হউক’’
চরজীবিকায় তখন ফুটিল সেবাজারের উর্ধ্বগামী সূচক
এবং
তাহাতে দীপান্বিত হইল
এবং
তৎকালে লোকেরা সদপ্রভূর নামে কহিলেন
সাধু, সাধু সাধু
২২
প্লাবিত ঘর-গেরস্থালির কার্ণিশে পরতে পরতে
জমে উঠেছে
ইচ্ছে ডানার গেরুয়াবসন
শরীরে শরীর বাড়ে তোমার উন্মুখতা
নড়ে ওঠে
গেয়ে ওঠে
শিকেয় তুলে রাখা পিতামহের খরমজোড়া
মাটির ভাঁজে রোদ মেলেছে
ফুটে উঠেছে স্বপ্নপুঁজি
খরমপায়ে এগিয়ে চলা পথে
খোকার পায়ের চিহ্ন খুঁজি
শরীরে শরীর বাড়ে কার্ণিশে জমে বহতা নদীর পলি
২৩
আঁজলা ভরে রেখেছি মুখ ও মুখোশের চিত্রকলা
জলরঙের বিষন্নতা অথবা
শিল্পীর বাড়িঘর অথবা
ফাটবাড়ির খুনসুটির টরে লাগানো
মাধবী লতা অথবা হাঁটুর কাছে বেশ কায়দা করে
পরনের লুঙির মতো রোদ ও ছায়ার
যৌথ আলাপচারিতা ।
অথচ তোমাকে রাখতে পারিনি
যে আমি তোমার c/o এ নিত্য পারাপার
সেই আমি কিনা ধিঙ্গি ইউকিলিপটাস
সেই আমি কিনা টেরাকোটার মুখশ্রী
ঝুলে ঝুলে মেপে নিচ্ছি
জয়নুল গ্যালারির শিল্প বোদ্ধাদের
চৌকস পাঠ-সূত্র।
অথচ তোমাকে আঁকতে পারিনি
পারিনি তোমর সরল পাঠের পাটীগণিত
২৪
এ্যাকোরিয়াম জলে কুবের মাঝি ছুঁড়ে দিচ্ছে জাল
: খুড়ো ও খুড়ো মাছ পাইলাম কই ?
জলের ভেতর জল নাচে
নাচে রঙ্গিন মাছ
: খুড়ো ও খুড়ো , মাছ পাইলাম কই ?
২৫
আমার বিড়ালের কোন নাম নেই
বিলাই বিলাই বলে ডাকলেই
সীমানা প্রাচীর টপকে পড়শির পাতের এটোঁকাটা
চাটতে চাটতে চলে আসে আমার পায়ের কাছে
যেন সমর্পিত শিষ্য একলব্য
বিড়ালটি তিন শ
মানে বর্ণমালার ষ, স, শ দের নিয়ে
খেলতে দারুন ভালোবাসে
ওরাই ওর বন্ধুজন
ওদের নিয়েই এক বাটি দুধ সাবার
করে পাশ বালিশে দুপুরের নিদ্রা
আর তখন কিনা তুমি কুড়িয়ে তুলছো
কয়েক টুকরা বিদ্রুপ
একফালি ছায়া
কতিপয় হল্লা ?
২৬
স্টপেজে দাঁড়িয়ে যে আমি টিকিট কিনছে
মিরপুর টু মতিঝিল
সেই আমি কিন্তু আমি নই
আমার ডামি
সিনেমা থিয়েটারের এক্সট্রা আর্টিস্টদের মতো
নাগরিক চ্যার্লি চ্যাপলিন
শাড়ির ফলস্ পাড়
অথবা আদালত পাড়ায় উকিল সাহেবের
অথ্যে সাক্ষী হওয়া ছাড়া মার সেই আশি মানে
ডামি আমির বিশেষ কোন কাজ নেই
জনাব, লাগলে জায়গা থেকে আওয়াজ দিবেন
আপনার জন্যই আমাদের এত দূর আসা
কাছে থাকা ।
সেবাই আমাদের প্রার্থণা বাণিজ্য
২৭
এ্যাপ্রোন আপার সেবা বিষয়ক কাশে
আমি আমার সিকবেড নিয়ে
ঢুকি পড়ি
আমার আমিকে শূয়ে রেখে
মেপে নিচ্ছি
পালস্ বিট
ব্লাড প্রেসার
পোদ্দার বাড়ি পুকুর পাড়ে খেলতে খেলতে
যে মার্বেল দু'টি একদিন
হারিয়ে ফেলেছিলাম
সেই দুই এখন আমার কন্ট্র্যাক্ট লেন্স
একটি আলোর ভেতর ছোট গোল অন্ধকারের চাতার
অন্যটি কালোর ভেতর ছোট গোল সবুজ ছাতা ক্লিনিক
এ্যাপ্রোন আপার সাথে আমার আমিকে বদল করেই
ছুটতে থাকি সবুজ ছাতা ক্লিনিকের
ওর্য়াডে ওর্য়াডে
জিব কপাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে রোগীদের হাতে তুলে দেই
পরিবেশ বিষয়ক প্রেসক্রিপশন
পলাতক
অত্রি ভট্টাচার্য্য
পালাতে গিয়ে বুঝতে পারি পালানো কত শক্ত
তোমার কাছে পাথেয় চাই কয়েক ফোঁটা রক্ত
ধূ-ধূ এ মাঠ, প্রেমপ্রান্তর, ক্লাইভস্ট্রীটে চাঁদ
হারতে হারতে পরমায়ুর অর্ধেক বরবাদ
গেলাস ভরা অমৃত আর আংটি ভরা বিষ
বাতাস জুড়ে যাচ্ছে শোনা ঢোঁড়া সাপের বিষ
হৃৎস্পন্দন তোমার এখন ভীষণ অনুরক্ত
ভয় পেয়েছি পালাতে,তাই পালানো ভারি শক্ত
ঘড়ির কাঁটা সময় ভোলে, বিষাদ ভোলে স্মৃতি
যুদ্ধ ভোলে ভুলিয়ে দেয় অসীম সম্প্রীতি
সমস্ত ফুল শুকিয়ে গেল, গোলাপ কি আর বাঁচে?
মৌমাছিরা বাঁধছে বাসা, স্বর্গের জ্ঞান গাছে
কিছুই হেথা পবিত্র নেই, ছিল না কোনো দিন
শুধু আমার কলমখানা আজও অমলিন
একাই লেখে স্বপ্নসুলভ তৃষ্ণা,বিনির্মাণ
সব হারানোর গান যে এসব সব হারানোর গান
পাথেয় কই, ফুরিয়ে গেছে সকল কপর্দক তো,
পালিয়ে যাওয়া শক্ত,আমার পালিয়ে যাওয়া শক্ত
সপ্তর্ষি বিশ্বাস এর একগুচ্ছ নতুন কবিতা
তোমার বন্ধ মুঠি
তোমার বন্ধ মুঠি এখনো আমারি জন্য ত্রি সংসার আগ্লে রেখেছে ।
হাত পাততে ভয় হয় তাই,
ভয় হয় ভিক্ষুবেশে দুয়ারে দাঁড়াতে।
প্রতি প্রাতে সূর্য্যদেব এসে দেখেযান তোমার এই অপচয় আর
প্রতিটি রাত্রি এসে বিরত করতে চায়
তোমাকে এ ছেলেখেলা থেকে –
তথাপি এ ত্রি সংসার তুমি কেবল আমারি জন্য
আগলে রেখেছো মুঠোকরে...
ভীত আমি — ভিতু আমি – কেবলি পালাতে চাই, তবু
নীরবে প্রতিটি ভোর তোমারি আলোর ডানা দিয়ে
চক্ষুদান করেযায় অন্ধ আমাকে ...
কবে তুমি নিজে এসে চুপে
খুলেদেবে বন্ধ মুঠি তব ?
মুক্তি দেবে এ ভীষণ দায়ভার থেকে?
০৩/১০/২০১০
তোমার সৃষ্টির পথ
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছে আকীর্ণ করি
মন্দির-মশজিদ আর নিদ্রাহীন পাপের প্রহরী।
কূটিল হিংসার জালে বেঁধেছে সে সহজের সরল বিশ্বাস,
যদিও সে অন্তরালে পদে পদে প্রবঞ্চিত তবু
নিষ্কম্প অঙ্গুলী তার লিখেচলে চেতনায় তুমুল সন্ত্রাস –
তোমার জ্যোতিষ্ক দেখে যে পথিক ধায়
সে যে চিরস্বচ্ছ , সহজ বিশ্বাসে সে যে চিরসমুজ্জল,
তথাপি দেখো সে আজ নিজের সত্যেরি কাছে নিজে অসহায় –
ফিরায় আহত মুখ সকল মন্দির আর মশজিদের থেকে
নিজেও নীরবে পোড়ে আপনারি অন্তর্গত তুমুল ঘৃণায়।।
০৩/১০/২০১০
তোমার হাতটি, প্রিয়...
একটি শব্দের মুখ এঁকেযাবো বলে
এতো শব্দ, এতো দাঁড়ি-কমা,
একটি চোখের চাওয়া লিখেযেতে চেয়ে
এতো মুখ, অনেক উপমা।
একটি দিবস চেয়ে এতো রাত ধরে
একা একা বহু পথে চলা,
একটি নৈঃশব্দ চেয়ে এতো সুর,গান –
জনান্তিকে এতো কথাবলা।
একটি নিবিড় রঙ খুঁজেপেতে চেয়ে
এতো রঙ, হিজিবিজি রেখা –
তোমার হাতটি, প্রিয়,ছুঁয়েযাবো বলে
এতো হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা।।
৫/১০/২০১০
বাদলা রাতে একলা পাগল
মেঘের ভারে আকাশ পরে নুয়ে
ঘনায় আঁধার বাঁশের পাতা ছুঁয়ে
বাদল মেঘে মাদল বাজে ঠিক
কার সে ঘুড়ি হারিয়ে দিগ্বিদিক
দেখলো চেয়ে তারার ঝিকিমিক।।
২
দিনগুলি যায় মেঘের মতন ভেসে
রাত্রি আসে রাতের ছদ্মবেশে
দিবস নিশি কিসের যেন খোঁজে
হারায় রোজই – কেবল নদী’ই বোঝে
এই হারানো নয় হারানো মোটে
এগিয়ে চলা সাগর পানে ছুটে।
৩
মেঘ ভেসে যায় – মেঘ ভেসে যায় বনে –
সে কোন অকূল সাগর সন্তরনে ...
আকাশ এবং তুমি’ই শুধু স্থির?
যায়না জানা। ডাক ওঠে ঝিল্লীর।
৪
নদীর পারে নেভে শ্মশান,চিতা –
আজো তোমায় প্রথম রাতের দ্বিধা
জড়িয়ে থাকে; তাই আসোনা ঘাটে ...
অন্ধকারে জোনাক সাঁতার কাটে।
৫
জড়িয়ে আনে চাঁদের দুচোখ ঘুমে,
বাঁশের ঝাড়ে কার যেন ফিস্ফাস ...
পথিক পেরোয় বাঁশের সরু সাঁকো,
সাঁকোর নীচে কঙ্গাবতীর লাশ
স্নান করে আজ উতল ধারা জলে
৬
জানিনা এই অচেনা সব ছবি
আমার কাছে পাঠায় সে কোন তারা ...
তাই নিতে হয় শব্দের রং-তুলি,
বাদ্লা রাতে নিঝুম ঘুমায় পাড়া।
৭
দূরের মাঠে শেয়াল ফেরে ডেকে
খাতা এবার গুটিয়ে নিতে হবে
সকল তারাই ডুব্লো একে একে
ঘুমিয়ে পড়ার সময় হলো তবে?
৩/১০/২০১০ –৮/১০/২০১০
ছোট্ট আমার মেয়ে
ছোট্ট আমার মেয়ে
বেড়ায় নেচে গেয়ে
ছোট্ট দাদা’র সাথে
আব্দারে ঝগড়াতে
সকাল দুপর কাটে
সূর্য্য গেলে পাটে
ঘুমায় দুজনাতে।
তখন সবই নিঝুম লাগে এতো
যেন এ এক নিঃস্ব হানাবাড়ি
যেযার কোঠায় নিজের মতন পোড়ে...
কেন যে রাত যায় না তাড়াতাড়ি ...
৩/১০/২০১০
সীমা : একটি প্রায় অনুবাদ কবিতা
যে সকল পথগুলি প্রতিটি সন্ধ্যায়
মিশে যায় আঁধারের গা’য়
তাদের কোন্টি ধরে আমার সকল চলা গিয়েছে ফুরিয়ে
আমি তা জানিনা।
সে কার ইঙ্গিত,হায়, রচেযায় আমাদের যাত্রাপথ গুলি ...
আমি কি পাথর তবে? আমি কি পুত্তলী?
সকলেরি সীমা আছে?
আছে কোনো ষ্পষ্ট পরিমাপ?
স্মরনই কী মুক্তি তবে? বিস্মরণই পাপ?
বইগুলি সারাদিন টেবিলে ছড়ায়
এলোমেলো ছায়া,
জানি এই রাশিকৃত পুঁথিদের ভিড়ে
একটি সে বই আছে যেটা
কোনোদিন পড়াই হবেনা।
একটি দিরজায় কবে
খিল এঁটে
চিরতরে এসেগেছো তুমি,
একটি দর্পণ আজো প্রতীক্ষায় একা জেগেআছে,
একটি শালিক পাখি তোমার এই ঘোড়ানিম গাছে
কোনদিনই ফিরবে না আর
সকল স্মৃতির ভিড়ে একটি সে স্মৃতি আছে যার
ছায়াতলে গিয়ে তুমি কোনোদিনই দাঁড়াবেনা আর ...
কোন্ দোর,কোন স্মৃতি,কোন পাখি, কোন গাছ তার
জানোনা কিছুই তবু সে কার নিয়মে
তোমাকেও ভুলেগিয়ে আলো হয় এই অন্ধকার।
৮/১০/২০১০
একটি দুয়ার
যে সকল পথগুলি গোধূলির অতলে হারায়
তাদের একটি পথধরে
তোমার সকল পথচলা
সুনিশ্চিত গিয়েছে ফুরিয়ে –
যদিও একদা তুমি সেইপথ ধরে
করেগেছো বহু আনাগোনা
অন্তরালে তুমি তার ঠিকানা জানোনা।
সকল স্মৃতির ভিড়ে একটি সে স্মৃতি আছে যার
ছায়াতলে গিয়েতুমি কোনোদিন দাঁড়াবেনা আর ...
কোথায়,কখন, কবে তুমি
বন্ধকরে এসেগেছো,চিরতরে,একটি দুয়ার...
৫/১০/২০১০
মাতাকে মনেপড়ে
মাতার স্মৃতি নিয়ে শরৎ আসে ফিরে মনের নদীতীরে শুভ্র কাশ
আকাশে ফেলে ছায়া অতল এ’কি মায়া গো মাতা তব এই পট্টবাস
সাজায় ধরণীকে সাজায় পাপীকেও বাজায় ঘাসে ঘাসে অমল গান
মাতার সাথে আসে শেফালী ফুলগুলি আহা সে ফুলগুলি পুণ্যবান
দেখোনি মুখ ঐ মেঘের নির্মাণে দেখোনি ঐ চোখ আকাশময়?
অন্ধ তুমি হায় রবে কী চরদিনই ব্রাত্য জন্ম এ এ ভাবে ক্ষয়
হবে কি দিনে দিনে হবে কি রাতে রাতে ছুঁয়েও দেখবেনা শেফালী ফুল?
ছেলেরা ভুলকরে তথাপি মা কভু কখনো না করেন কিছুই ভুল
আমিও ক্ষমা পাবো তুমিও ক্ষমা পাবে শুভ্রমেঘ লিখে বারতা ওই
মাতা যে এসেছেন বসাবে তাঁকে কোথা রেখেছো পেতে তাঁর আসন কই?
আসন পেতে রাখি এই যে ধূলো মাটী সেইতো হে মাতা তোমারি ক্রোড়
এই যে হাহাকার এই যে চীৎকার এসব সকলিতো তোমার সুর
তুমি যা দানকর তাতেই গানকরি তাতেই আগমনী ও বিসর্জন
তৃতীয় নয়নের বিভাতে ছুঁয়ে দিও ব্রাত্য জনেদের একটি ক্ষণ।। – ১২/১০/২০১
শ্লোক
চেয়েছো তুমি তাই লিখেছি শ্লোক এই শব্দ সে’ও তো তোমারি দান
আমিতো তৃণ শুধু আমিতো ধূলোবালি লিখিয়ে নাও তবু কত’যে গান
আঁকিয়ে নাও ছবি যেমন চাও তুমি তুমি’ই রং-তুলি জোগাও, হায়
তুমি না চাইলে হে দিবস যায় ভেসে ‘লিখবো’ বৃথা এই প্রতিজ্ঞায় ।।
– ১২/১০/২০০১
পুতুল নাচের ইতিকথা
কবিতার কাছে শরীরের বহু ঋণ –
কবিতারো আছে শরীরের কাছে দেনা,
যদি যায় রাত পরশের জাদুহীন
ভোরবেলা কেউ হয়েওঠে আনমনা ...
এখন শরৎ এসেছে আবার উড়ে,
শরৎ কখনো শরীরের ঋতু নয় ...
যতোই বোঝাই তবুও সেযায় ফিরে
হরিণীর খোঁজে ঘুরে ফেরে বনময়...
শরীর!শরীর!কুসুম, তোমার মন –
– নাই জেনে ওই ছোটোবাবু গেলো চলে,
পুতুল নাচের ইতিকথা কি গহন
ক্ষতহয়ে আজো রজনীর দেহে জ্বলে ...
মনেপড়ে সেই প্রথম পোড়ার দিন –
টেবিলে একাকী মোমবাতি যায় গ’লে।।
– ১৫/১০/২০০১
গান শুধু গান –
ভেঙ্গেযাবে, এভাবেই,সমূহ নির্মাণ,
কেবলি পাহাড় কিছু, সমুদ্রেরা, আর
গীতিবিতানের শেষে বাঊলের গান –
মেধা থেকে মুছেদেবে সমূহ আঁধার।
কেবল যেসব কথা এতাবৎ তুমি
বলেগেছো মনে মনে বৃক্ষদের কানে
যেসব মেঘের ছায়ে নুয়েছো আভূমি
প্রতি পদক্ষেপ তব তারা শুধু জানে।
সেতুগুলি ভাঙ্গে দেখো, চূর্ণ শিলালিপি
পায়ে ঠেলে চলেযায় অশ্ব, পদাতিক –
মেঘের নিগড়ে গড়া সব জলছবি
মুছেযায় – ঘুরেগেলে বাতাসের দিক...
ভেঙ্গেযাবে, এভাবেই,সমূহ নির্মাণ,
কথাগুলি ডুবেযাবে, গান শুধু গান –
– ১৫/১০/২০০১
ভাসান
মাতাকে ভাসিয়ে দিয়ে আজ
যখন ফিরবো একা ঘরে
মাতার হাতের কারুকাজ
তারা হয়ে জাগবে শিয়রে।
তারায় তারায় মুখ, মা’র
ছুঁয়েযাবে এ’চোখ আমার,
দুই চোখ ভেসেযাবে জলে –
একা একা আপন অতলে
গড়েনেবো পুনরায় মা’কে,
মা ছাড়া একলা ভয় লাগে –
১৭/১০/২০১০
এপার বাংলা ওপার বাংলা ...
আসলে তো সেতু এক,ভাষা,
কাঁটাতার বেড়া আর ভিসা –
পারহয়ে কাছাকাছি আসা ...
জ্বলে ওই দেখো শতভিষা।
তাই লাগে সবকিছু চেনা,
ভালবেসে শুধে যাই দেনা –
গানে গানে একে অপরের ...
ইতিহাসে ভুল ছিল বলে
এসেছি আরেক পারে চলে,
বেড়া ভেঙ্গে ফিরেযাবো ফের...
১৭/১০/২০১০
চাঁদ
চারিদিকে পাতা আছে ফাঁদ
তবু যাও, ছুঁয়ে দাও চাঁদ –
যদি তারা না’ও হও তবে
লহমায় আলোক ছড়াবে
জোনাকির মতো একা একা
পথিকের পথের কিনারে
হয়েছিল শবরীরো দেখা
দেবতার সাথে – নদীপারে –
চারিদিকে পাতা আছে ফাঁদ
তবু যাও, নিয়ে আসো চাঁদ।।
১৭/১০/২০১০
পাঠকদের প্রতি, ধন্যবাদের বদলে...
আমার আখর গুলি যদি
ছুঁয়েযেতে পারে তোমাদের
তবেই গোপন এক নদী
মোহনায় যেতেগিয়ে ফের
ডেকেনেবে সাথে করে জ়েনো
মনে মনে তোমাকে আমাকে
হতে পারে হয়তো এমনও
সাড়া দিয়ে আখরের ডাকে
একটি কবিতা নীল জলে
লিখেচলি আমরা সকলে
১৮/১০/২০১০
বিসর্জন
জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়
পঞ্চনদ উৎস শৃঙ্গ,বধ্যভূমে বিন্দু বিন্দু শ্যাওলার কণা
সুগঠিত আজও দৃঢ় দ্বিধাহীন মুষ্টিবদ্ধ খাঁড়া
দেউল্ প্রাঙ্গনে গাঁথা হাড়কাঠ নোনা রক্তে ভিজে
উপচার মূল্যপ্রাপ্ত অপরাহ্ন।সুদূরে মোহনা
প্রতি রাত্র নেশাচ্ছন্ন সিদ্ধাচার্য,প্রতিরাত্রে বলি
প্রতিদিন পুনর্জন্ম,প্রতিদিন নতুন ষোড়সী
বলিদান নিত্যকার্য পুনর্জন্ম আরো স্বাভাবিক
স্মৃতিগর্ভে সিদ্ধি নয়, পঞ্চনদ রক্তে স্ফীতকায়
ঊষাকালে জন্মলগ্ন সায়াহ্ন আঁধারে মেশে প্রাণ
কাপালিক মন্ত্রচ্যুত ,ছোলা মদ পু্নর্জন্ম হেতু
রূপান্তরক্রমে পুষ্প বিস্তারিত শবদেহ নারী
অচেতন নিত্যকর্মে উপলক্ষ্য লক্ষ্যে পরিণত
বৃথা যায় ইহজন্ম পরলোক অন্ধকারে ডোবে
আকার বন্ধন তীব্র,নিরাকার দৃশ্যে একাকার
বিস্মৃতি বিমূর্ত নয় পদে পদে শূচীবায় যথা
কোথায় সূর্যাস্ত আজ পূর্ণকুম্ভ নাগাল মেলেনা
প্রস্রবণ রক্তকায়া পিণ্ডদান অনিবার্য আজ
কিছুই কর্তব্য নয় শতজন্ম রক্তে ভেসে যায়
অনিত্যর শব দেহ পুণ্যলগ্নে মোহনা তর্পনে
সিদ্ধাচার্য ভেঙ্গে দাও গোলোক ধাঁধার আচরণ
নবমন্ত্রে পুণ্যতর ধবংসের সাধনা পুনর্বার
প্রসাদী মাংসের স্তুপ পুনর্বার জলে ভেসে যাক
৪৪ কবিতা
দুপুর মিত্র
প্রথম প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
বইটি বিক্রির জন্য নয়
কপিলেফ্ট। এই বইয়ের সমস্ত লেখা কপিলেফ্ট। এই বইটির যে কোন অংশ যে কেউ অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক উদ্দেশ্যে
মূল লেখক ও লেখাকে অবিকৃত রেখে লেখক ও প্রকাশকের অনুমতি ব্যতিরেকেই যে কেউ নকল এবং পরিবেশন করতে পারবেন।
এছাড়া বইটি কেবল মাত্র ই মেইলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করে যে কেউ বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পাবেন। ই মেইল ঠিকানা-
mitra_bibhuti@yahoo.com
প্রকাশক
দুপুর মিত্র
প্রচ্ছদ
কাঠের শরীর
লে আউট ও মুদ্রণ
ম্যাড হর্স, ১২৫, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: আমার বন্ধু আহসান হাবীবকে
উৎসর্গ
আমার মা
কল্যাণী রানী মিত্র
আমার বাবা
ভোলা নাথ মিত্র
ও আমার ছোট ভাই
আকাশ মিত্র – কে
১.
নদীঘাটেই তবু আসতে হবে কারো
নদীর বুক চিরে নিতে হবে তাকে রূপালি দানা
সন্ধ্যায় বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে গলা ছেড়ে দিতে হবে টান
জলকে শাসন করতে করতে নায়ককে পেতে হবে
স্নান করতে আসা জলকুমারী
স্টিমার আসবে দূর দেশ থেকে
ভিনদেশী দেবতার পায়ে হুমরি খেয়ে নিতেই হবে ধূলো
সমস্ত রাত সাইরেনের মতো কেঁদে কেঁদে ঘুমাবে
তীরবর্তী গ্রামের নিত্যনতুন শিশু
কারো কারো মনে পড়বে শৈশবে সাঁতার শিখতে এসে
ডুবে যাওয়া রঙধনু
আর
ক্রোধান্বিত মেঘ তাড়িয়ে বেড়াবে কাউকে এপার থেকে ওপার
২.
বড় রাস্তাগুলো হবার পর
এলাকাটির অনেক উন্নতি হয়েছে
অনেক দালানকোঠা হয়েছে
দোকান বসেছে
শিক্ষিত মানুষ এসেছে
এসেছে বিদেশী জিনিস
এই এলাকায় নতুন আসা লোকজন খুব খুশি
বড় রাস্তা দিয়ে চলে এসেছে অনেক সুখ
কেবল যারা এই এলাকার মানুষ
তারা বড় রাস্তার দিকে কখনোই যান না
তাদের ভয়
বড় রাস্তায় গেলে হারিয়ে যায় মানুষ
৩.
একদিন বুঝবে ট্রেন চলে গেলে শূন্য হয়ে থাকে স্টেশন
দোকানিরা পান মুখে দেয়
হকাররা জিরিয়ে নেয় কোথাও বসে
স্টেশন মাস্টার হেসে কথা বলে
স্টেশনের পাশে যে নদী
সে নদী থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসে
আশ-পাশের গাছগুলোতে পাখি এসে বসে
গান গায়
কেবল আমরা যাদের বলি স্টেশনের মানুষ
তাদেরই বুকটা খালি হয়ে যায়
বিষন্ন চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা
আর তাদের বাচ্চাদের চলে যাওয়া ট্রেনকে দেখিয়ে বলেন
ঐ যে দেখ আবার আসছে
৪.
আমার সন্তান যখন আমার
ঘাড়ে চড়ে ঘোড়া বানিয়ে বলতে থাকে
টগবগ টগবগ
তখন আমার নিজেকে খেলনা ঘোড়া করেই রাখতে ইচ্ছে করে
সারাক্ষণ
সারাটাজীবন
যে ঘোড়ায় চরে
একদিন সে জয় করবে সমস্ত রাজ্য
৫.
শহরে হেলিকপ্টার উড়ে আসলে
কতলোক উপরে তাকায়
যেন কত দিন ধরে তাদের ইচ্ছে উড়ে বেড়াবার
কতদিন ধরে ইচ্ছে তাদের মুক্ত হবার
আমাদের গ্রামেও একদিন হেলিকপ্টার উড়েছিল
তখন অবশ্য কেউ উড়ে বেড়াবার কথা ভাবেনি
ভেবেছিল কিছু খাবার পড়ুক
হেলিকপ্টারের জানালা থেকে
৬.
মা যখন তার বালকদের শরীর
সাবান দিয়ে পরিস্কার করিয়ে দেন
তখন আমার বালকবেলার কথা মনে পড়ে
মনে হয়
সমস্ত বালকদের আগামী দিন যদি
মায়েরা
এরকম সুন্দর-উজ্জ্বল-পরিষ্কার
করে দিতে পারতেন
৭.
আমাকে তোমার ফসলি ক্ষেতের
কাকতাড়ুয়া বানিয়ে নাও
আমি আজীবন তোমার আদরের পাশে
থাকতে চাই
আর তোমার ক্ষেতের ফসল দেখে রাখতে চাই
যেন কোন বিদেশী ছলাকলা এসে নষ্ট না করে ফসল
যেন তুমি ফসলকে জড়িয়ে ধরে
ঘুমিয়ে পড়তে পার
নিশ্চিন্তে
৮.
আবার তো দিন আসবে
আকাশ ভেদ করে গলে পরবে আলো
সে আলোয় দেখা যাবে
পৃথিবীর ঘর বাড়ি মানুষ জীবজন্তু সব
এবং তোমাকেও
আজ রাতটা অন্ধকার থাক
কালো নিকষ অন্ধকার
যেন পৃথিবীর কোন কিছুই দেখা না যায়
এমনকি আমাকেও
আজ রাতটা
শুধু পরস্পরকে বিশ্বাস করে ভালবাসতে চাই
কোন প্রকার বিচার বিবেচনাহীন
যেন তুমি আমার সাথেই লড়ছো
শহরে
গ্রামে
বন্দরে
একই স্বপ্নে আমরা
দীর্ঘদিন
৯.
কাশ্মীরকে ভূ-স্বর্গ বলা হয়
আমি সেই স্বর্গের দিকে তাকিয়ে আছি
আর ভাবছি
আমার মা যখন ছোট ছিলেন
তখনও কাশ্মীরে অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হত
এখন আমি যখন বড়
এখনও কাশ্মীরে অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়
আর কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে আমার বাবার মতো আমিও
ভাবি এখনও
আমার স্ত্রী আর সন্তানদের কথা
১০.
আমার তা মনে হয় না
অন্তত কৃষকের বাড়ির উঠোন দেখে
যে উঠোন শরতের আকাশের মতো স্বচ্ছ আর পরিষ্কার
সন্ধ্যা হলে যেখানে তারা ফোটে
কিষান-কিষানিরা গোল হয়ে বসে
গল্প জমে হাসিতে
গানে
কিচ্ছায়
আর ধান কাটা শেষ হলে
সমস্ত সোনা ঝরা ¯^cœ এসে জড় হয় উঠোনে উঠোনে
বাংলাদেশের সমস্ত সুন্দর
সমস্ত মানুষের আগামী সুদিন
উঠোনের উপর চিকচিক করে চলছে অজস্র বছর
আমার এরকম মনে হয়
১১.
এই যে চুপচাপ বসে আছে
খুব দূরে একা একটি শ্বেত-শুভ্র বক
দেখে মনে হয়
এত ধ্যানী এত শান্ত-স্নিন্ধ রূপ
কোথাও যাবে না পাওয়া
তাই আমিও মেলে রাখি চোখ
তার দিকে
হঠাৎ একটু উড়াল দিয়ে
যখন ডুবিয়ে দিল মুখ
জলের গভীরে
তখনও ঠিক টের পাইনি
এই ধ্যান এই শান্ত-স্নিগ্ধতা
এও এক কৌশল
শিকারের
১২.
আমার এখনো সাঁতার শেখার কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে আমার বাবা কীভাবে
আমার শরীর শক্ত করে ধরে সাঁতার শেখাতেন
কখনো একটু হাত ফসকে গেলেই
কেমন ছোট হয়ে যেত তার মুখ
সেই মুখ এখনো হঠাৎ মনে হলে
কেমন যেন সেই সাঁতার থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরার মতন
কোথাও চুপচাপ জড়সড় হয়ে যাই
কাজের গতি কমে যায় আমার
আর মনে মনে বলতে থাকি
বাবা এইতো আমি তোমার পাশেই আছি
১৩.
মানুষের ঘুমমুখ দেখলে কেমন চুপ হয়ে যাই আমি
ঘুমন্ত মানুষেরা শিশুর মতো পাপহীন জ্যোতির্ময় দেহে চোখ বুজে থাকে
মানুষের ঘুমমুখ আমার ভিতর ছড়িয়ে দেয় এক অদ্ভূত ভালবাসা
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি তাই ঘুমমুখের দিকে
ঘুমমুখ আমাকে জাগিয়ে রাখে সারারাত
আমি মিশে থাকি স্নিগ্ধতার ভিতর
জেনে যাই যে মানুষ রমণীকে ফুল দেবার আগে কেঁদেছিল
কিংবা কাউকে খুন করার আগে হেঁটেছিল সারারাত
সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে যে মানুষ একটু স্বস্তির মতো আশ্রয়ের জন্য
অথবা মুখ গুঁজে রাখে শীতল জলে
সেইসব মানুষেরাও অজান্তে আশ্রয় চায় ঘুমের কাছে
ঘুম তাকে অনেকক্ষণ ভুলিয়ে রাখে বেঁচে থাকা
ঘুম অনেকক্ষণ তাকে তার ভাবনার ভিতর, স্বপ্নের ভিতর,
প্রাপ্তির ভিতর বাঁচিয়ে রাখে
আমি তাই গোপনে ঘুমপাড়ানি মেয়ে বসিয়ে রাখি
মানুষের শিয়রের কাছে
আর তাকিয়ে দেখি পাপহীন জ্যোতির্ময় স্নিগ্ধ এক ঘুমমুখ
১৪.
আকাশে ওড়া চিল দেখে মনে হয় সবসময় সুন্দর সুন্দর
আর আড়ালে থেকে যায় তার হিংস্র শিকারি চোখ
সৌন্দর্য থেকে দূরে থাকাই বোধহয় ভাল
তাতে বিশুষ্ক মাঠ
দমকলের পেট থেকে টেনে হিঁচড়ে নিতে পারবে প্রাণবন্ত জল
সন্ধ্যা হলে
হাতমুখ ধুয়ে ঘরে যেতে পারবে সকল প্রাণিজগত
আর আমরাতো সবাই জানি
সৌন্দর্য বিমোহিত হয়ে
বেশিক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলে
জল আসে চোখে
১৫.
ধনীলোকদের বাসার সামনে
অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান থাকে
বাগান যত্নের জন্যে একজন মালি রাখা হয়
সেখানে বাহারি রকমের ফুল ফোটে
গরীব লোকদের বাসার সামনে
থাকে সবজির বাগান
বাসায় খাবার কিছু না থাকলে
তারা এখান থেকে তুলে নেন
রান্নার জন্য
১৬.
বস্তির যুবতি মেয়ে সুন্দর হতে পারে
এ ধারণা ছিল না
ধারণা ছিল না
অদ্ভুত কণ্ঠে সেও গেয়ে উঠতে পারে গান
বস্তির চেয়ারম্যান যে গানের মানে জানে না
উঠতি মাস্তান জানে না কাকে বলে হৃদকম্পন
শুধু জানে ওর শরীর ধরে কিভাবে টেনে নিতে হয় অন্ধকার ঘরে
আর আমিও কেবল জানি
বস্তির মেয়ে মানে খারাপ মেয়ে
১৭.
শহরে বড় বড় বিল্ডিং হবার পর
অনেক মানুষ হয়েছে
বিল্ডিংগুলো হবার কারণে
এলাকাটির চেহারাও পাল্টে গেছে
এখন অনেক উন্নত মনে হয়
কিন্তু শহরের যে জায়গার বিল্ডিংগুলো ছোট
একটা খুপরির মত
সে জায়গাগুলো আর সেখানকার মানুষগুলোকে
জঞ্জাল মনে হয়
একদিন হয়ত এই জঞ্জালগুলো এমনিতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে
কেউ টেরও পাবে না
১৮.
এই দুপুরে যে রোদ খিল খিল করে হেসে ওঠে বালির চরে
তা কি কোনো নতুন কৃষকের ভাষা
যে ভাষার হাসির আন্দোলনে ঝাপসা হয়ে আসছে
আয়েসি চোখ
আজ যেন তাকানোর জায়গা নাই কোথাও
আজ তাই ঘরের ভিতর শাড়ির কারচুপি লাগিয়ে যাচ্ছে গেরস্থের বউ
আর কৃষক একটি বিড়ি নিয়ে বসে বসে আঁকছে
লাল টুকটুকে তরমুজ ক্ষেতের স্বপ্ন
১৯.
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যে লোকটি
গান করে টাকা তুলে সংসার চালায়
মাঝে মাঝে মনে হয়
সেই লোকটিই কেবল জানে
শিল্প আর জীবন
এক ও অদ্বিতীয়
২০.
প্রকৃতির কাছে এলে
মানুষ অজান্তেই হয়ে উঠে
প্রাকৃতিক আর জীবন্ত
তা না হলে পার্কে
অবারিত প্রকৃতির কাছে এসে
যুবক-যুবতীরা চুমু খেত না
এভাবে
২১.
যে ঘটনাগুলোর সাথে বৃষ্টি জড়িত
সে ঘটনাগুলো প্রায়ই মনে পড়ে কেন জানি না
জানি না বৃষ্টির সাথে ঘটনার কি এমন সম্পর্ক
যেদিন তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলে
সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল খুব
আমার বাহিরে আর ভিতরে
২২.
আজ মাঝ নদীতে এসে মনে হলো
আমাদের চারপাশে কেউ নেই
বিশাল জল আর জলরাশি ছাড়া
আর আমি
নৌকা
নৌকার মাঝি ছাড়া
পৃথিবী সৃষ্টির সময়ও নাকি এরকম ছিল
আজ মনে হচ্ছিল আবার নতুন করে যদি
পৃথিবীটা সাজাতে পারতাম
২৩.
পুলিশের হাতে লাঠি-বন্দুক থাকার
মানে হচ্ছে দেশের খুব কম লোকই
প্রচলিত রাষ্ট্রের পক্ষে
২৪.
যে মেয়েটিকে পুতুল খেলতে দেখেছি ছোটবেলায়
সেই মেয়েটি আজো পুতুলই খেলে চলছে
গভীর মনোযোগে
২৫.
এতদূর সূর্য্য
তবু কত নির্ভরতা
মানুষের
২৬.
বিয়োগেও আনন্দ আছে
এ কথা শিশুটিও বোঝে
কেননা
গ্যাসবেলুন উড়িয়ে দিয়ে
সেও আনন্দে লাফিয়ে উঠে
২৭.
জলের নিচে যে আকাশ
সে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে
মাছ আর গাঙচিল
আর তার পাশে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে আমায়
চুপচাপ
প্রাচীন যুগের পাথুরে গড়া মূর্তির মতো
২৮.
চারিদিকে শুধু ধানের ক্ষেত
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ
শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে
এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের আনাচে কানাচে
দাঁড়িয়ে আছে যেসব কৃষক
তাদের আর ভালো লাগে না
দূর থেকে দেখে মনে হয়
এই সবুজের গা জুড়ে
বেশ কটি কীট ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে
অথচ এই সবুজকে জন্ম দিয়েছে তারাই
২৯.
শ্রমিকের মুখ আর পণ্যের মুখ এক নয়
কেননা শ্রমিকের অনেক শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে তৈরি হয় পণ্য
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
আর পণ্য হয়ে উঠে উজ্জ্বলসুন্দর
পণ্য ক্রমান্বয়ে দামি হয়ে উঠে
শ্রমিক কেবলই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়
শ্রমিক আর পণ্য ক্রমাগত সরে সরে যায়
দূরে
আরো দূরে
৩০.
আমার বান্ধবী যেদিন হেসে হেসে বলেছিল
পুষ্টিহীন রোগাক্রান্ত শিশুটি তাকে মা ডেকেছে
সেদিন আমিও বাবা হবার কথা ভেবেছি
পুষ্টিহীন রোগাক্রান্ত শিশুকে দেখে বার বার মনে হয়েছে
আমার একজন ভালো বাবা হওয়া প্রয়োজন
যেমন প্রয়োজন আমার বান্ধবীর
একজন ভালো মা হবার
৩১.
বাজারে কিছু কিনতে গেলে আমার মনে হয়
কেউ একজন আমাকে বিক্রি করার জন্য
দাম হাঁকছে
আমি আর কোনো কিছু কিনতে পারি না
কেবল বাজারের জিনিস দেখে
কোনো রকম ফিরে আসি ঘরে
৩২.
এই যে জনপদ
দূর থেকে দেখে মনে হয়
আকাশ নুয়ে নুয়ে বারবার চুমু খাচ্ছে তাকে
দিন যতই যাচ্ছে বড় হচ্ছে তত
এখানে রক্ত পিপাসু দানব আছে
খেটে খাওয়া পোড় খাওয়া মানুষ আছে
করুণ আর্তি আছে আহাজারি আছে
আছে সুখ আনন্দ উল্লাস
আছে অনেক অজানা ইতিহাস
আমি বলতে পারব না
এই জনপদেরই কোনো ভাঙ্গা ন্যুব্জ ঘরে হয়ত শুয়ে আছে কোনো বুড়ো
সেই বলতে পারবে তা
সেই বলতে পারবে আকাশ কেন বারবার চুমু খায়
এই জনপদকে
৩৩.
এই শহরে কত বন্ধু হলো
ঘোরা হলো কত অলি গলি পথ
কোনকোনদিন এই শহরে
সারাদুপুর সারারাত
ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছি
তবু চেনা হলো না এই শহর
এখানে এখনো একা বের হলে
আমি হারিয়ে ফেলি পথ
কোনদিনই চেনা হবে না বোধহয় এই শহর
৩৪.
ঘুরে ফিরে আকালের মাসে আমাদের দেশে ফাল্গুন আসে
আমরা কবিতা লিখি গান গাই
গাছে গাছে ফুল ফোটে
আনন্দের ফল্গুধারায় হেসে উঠে ফাল্গুন
আর চৈত্রের খাঁ খাঁ রৌদ্রের মতো হাসে
আমাদের গ্রামের মানুষের পেট
৩৫.
নদীর পাড়ে যে ঢেউ আছড়ে পড়ে
সুর আর বাজনা হয়
আমরা জানি না
নদী পাড়ের মানুষ জানে
সেই সুর আর বাজনা
কতখানি বেদনাময়
৩৬.
কৃষকের হাতে একদিন আমি শ্রেণীসংগ্রামের বীজ তুলে দিব
সেই বীজ দিয়ে কৃষক বীজতলা বানাবে
তারপর সমস্ত ক্ষেত ছড়িয়ে দিবে সেই বীজের চারায়
তারপর ফসল ফলবে
দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত জুড়ে ফলবে ফসল আর ফসল
কিষান-কিষানীরা
হাসতে-হাসতে
নাচতে-নাচতে
গাইতে-গাইতে
তুলবে সেই ফসল
আমি একদিন বাংলাদেশের সমস্ত কিষান-কিষানীর হাতে
তুলে দেব বীজ
শ্রেণী-সংগ্রামের বীজ
৩৭.
এই লাঙলে তার প্রপিতামহের শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার পিতামহের শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার পিতার শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে তার শরীরের দাগ আছে
এই লাঙলে কি তার ছেলের শরীরেরও দাগ থাকবে
৩৮.
সকাল বেলায় আয়নায় মুখ দেখে
যখন অফিসে যাই
তখন মনে হয়
আয়নাটি আমার সৌন্দর্য আটকে রেখেছে
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে
যখন আয়নার দিকে তাকাই
তখন মনে হয়
আয়নাটি আমার সৌন্দর্য ফেরত দিয়েছে
৩৯.
আজ আমি সেই ট্রাফিক
যার ইশারায় থেমে যাচ্ছে শহরের সমস্ত গতি
গাড়ি-রিক্সা-টেম্পু-বেবী সব
সাগরের গভীর থেকে ছুটে আসা এক নিঃসীম বেগের অজানা হাওয়া
যার আঘাতে তছনছ হয়ে যায় শহরের অলিগলি পথ
সেও থেমে যাচ্ছে আঙুলের একটুখানি ইশারায়
জ্বলে উঠছে লাল-হলুদ-নীল রঙের বাতি
কোথায় আছো শহরের আরাম?
আজ তোমাকে নিয়ে যেতে চাই ঘরে
যে ভিখিরি লম্বা কালো হাত ঢুকিয়ে দেন
প্রাইভেট কারের জানালার ভিতর
যে শিশুর কোমল চোখ পপকর্ন পপকর্ন বলে
তাকিয়ে থাকে ধনীশিশুর হাতে থাকা
আইসক্রিমের উপর
তার জন্য
আজ থামিয়ে রেখেছি শহরের সকল গতি
৪০.
আমি পাখিদের ভাষা বুঝি না
পাখিদের সমস্ত শব্দই আমার কাছে গান মনে হয়
কেননা পাখির গান ছাড়া
আমি তার অন্য কোন ভাষার সাথে পরিচিত নই
৪১.
গ্রাম থেকে যারা শহরে আসেন
কেমন যেন তাদের মুখের দিকে
তাকানো যায় না
কেমন উৎকণ্ঠা
আর নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয়
সারাক্ষণ তাকে যেন তাড়িয়ে বেড়ায়
যারা শহর থেকে গ্রামে যান
তাদের মুখগুলো অবশ্য
বেশ হাস্যোজ্জ্বল
মুক্ত মনে হয়
মনে হয়
কিছুটা সময়ের জন্য তারা
নিজেরা নিজেদের ফিরে পেয়েছেন
৪২.
উৎসব হলে
কত মানুষ দুলে ওঠে
কত প্রেম কত অনুরাগ
হেসে ওঠে
অনেকদিন পর
যেন অনেকদিন পর
তাদের উদোরে ঢুকেছে ভাত
আর কিছু মাংস
সেই ঘ্রাণ
রন্ধন-ঘ্রাণ
মুহুর্মুহু কেঁপে উঠে
আকাশে-বাতাসে
নববধূর শীৎকারে
উৎসবের ছায়ায়
উৎসব হলে
তোমাকেও বেশ ভালো মানায়
অনেক অনেকদিন পর
অভাবের সংসারে
৪৩.
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয়
কেউ একজন আমাকে
ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছে
বিছানার চাদর থেকে
ময়লা ফেলার মতো
প্রতিদিন ঘুমুতে গেলে মনে হয়
এখানেই আমাকে ঘুমুতে হবে
বালিশে শ্বাসরোধ করে হলেও
৪৪.
মুখোশের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ
এমনকি শিশু বাচ্চাদেরও
ওরা মুখোশ পরে ভয় দেখাতে এত আনন্দ পায়
আর বাবাদেরও ভয়ের অভিনয় করতে ভালোলাগে
ছোটবেলা থেকেই এমন মুখোশ-মুখোশ খেলা দেখতে
আমার ভাললাগে না
ভেবেছিলাম আমি আমার বাচ্চাকে
কখনও মুখোশ কিনে দেব না
কিন্তু যেদিন সে হালুম বলে
আমাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল
সেদিন থেকে
আমি নিশ্চিত
মানুষ ইচ্ছে করলেই মুখোশ থেকে
বেরুতে পারে ন