লেখালিখিটা যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা তো জানেনই কেন লিখছেন: মলয় রায়চৌধুরীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Oct 22, 2013 6:11:48 AM

মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯ সনের ২৯ অক্টোবর। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সর্বোপরি হাংরি আন্দোলন --Hungryalism-- তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক। প্রচণ্ড বৈদুতিক ছুতার কবিতাটির জন্যগ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। শয়তানের মুখ, জখম, ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস,নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র,কৌণপের লুচিমাংস অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্যাডিশ গ্রন্থের অনুবাদ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ২০০৩ সালে অনুবাদের জন্য দেয়া সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার সহ বহুলিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ।

দুপুর মিত্র: একেবারেই প্রথম জিজ্ঞাসা মেনিফেস্টো দ্বারা সাহিত্য নির্মিত হয় বলে মনে করেন কি?

মলয় রায়চৌধুরী: বেশিরভাগ লেখকের ম্যানিফেস্টো থাকে মগজের ভেতর । অনেকে একত্রিত হয়ে লেখালিখি করতে চাইলে প্ল্যন অব অ্যাকশান থাকলে সুবিধা হয়; ভারতের যেমন লিখিত সংবিধান আছে অথচ গ্রেট ব্রিটেনের নেই । আমার মনে হয় যাঁরা কোনো সাহিত্যআন্দোলনে ছিলেন না তাঁরাই আমাকে এই ধরণের প্রশ্ন করে এসেছেন সেই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকে । সাহিত্য এখন সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংঘর্ষের ব্যাপার ; তা আর উনিশ শতকের একা-একা সাধনা করার প্রক্রিয়া নেই । হাংরি আন্দোলনের ইশতাহার কেবলকবিতায় সীমাবদ্ধ ছিল না । রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে যে দুটো ইশতাহার প্রকাশিত হয়েছিল তা ভারতের প্রেক্ষিতে বলা যায় প্রফেটিক । হাংরি আন্দোলনের কয়েকটি ইশতাহার যে ভারতের সমাজকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল তা প্রশাসনের সেই সময়েরপ্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট । তার মানে ম্যানিফেস্টো জরুরি ছিল ।

দুপুর মিত্র: সুবিমল মিশ্রের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা আর আপনার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পার্থক্য করতে বললে কিভাবে করবেন।

মলয় রায়চৌধুরী: কোনো তফাত নেই । তবে সুবিমল মিশ্র তা কেন্দ্রিত রেখেছেন সাহিত্যে । হাংরি আন্দোলন প্রতিটি ক্ষমতাকেন্দ্রকে আক্রমণ করতে চেয়েছিল --- ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে তো বটেই । একটা কথা বলা দরকার । প্রতিষ্ঠান শব্দটাএসট্যাবলিশমেন্টের বাংলা বলে মনে করা হয় । কিন্তু ক্ষমতাপ্রতাপ ব্যাপারটি তো কোনো ইন্সটিটিউশান নয় । তা বিমূর্ত । পরস্পরবিরোধী শক্তিরাও হাতে হাত মিলিয়ে ব্যক্তি-একককে কোনঠাসা করে তুলতে পারে । যেমন উদারীকরণের পর উপজাতিদের অঞ্চলগুলো দখলকরার জন্য করা হচ্ছে, কেননা সেই অঞ্চলগুলোয় মাটির তলায় রয়েছে খনিজবস্তু ।

দুপুর মিত্র: আপনাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে পাল্টা মিডিয়া গঠন প্রক্রিয়া বললে আপনি কি মেনে নেবেন।

মলয় রায়চৌধুরী: ক্ষমতার আস্ফালন প্রদর্শন ও প্রয়োগের জন্য প্রযুক্তির এই যুগে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঠিকই । তবে আমার উত্তর ওই আগের দুটি প্রশ্নের জবাবে বোঝাতে পেরেছি বোধ হয় । হাংরি আন্দোলন কোনো ইন্সটিটিউশান ছিল না । আমাদের কোনোহেডকোয়ার্টার হেডঅফিস পলিটব্যুরো হাইকমাণ্ড সম্পাদকের দপতর জাতীয় ব্যাপার ছিল না । যে কেউ হাংরি বুলেটিন যেখান থেকে ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারতেন । হাংরি আন্দোলন কারোর প্রায়ভেট প্রপার্টি ছিল না ।

দুপুর মিত্র: মার্কসীয় প্রতিষ্ঠানকেও কি এই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে?

মলয় রায়চৌধুরী: মার্কসবাদ সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত । তাই এর উত্তর দিতে পারলুম না । ভারতের সংসদে মার্কসবাদী দল যেমন অংশ নেয় তেমনই একদল মার্কসবাদী গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবে লিপ্ত । বহু মার্কসবাদী ভাবুক দর্শনটিআলোচনা করেন এবং তাঁরা ভোটে অংশ নেন না ।

দুপুর মিত্র: ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়ার গঠন প্রক্রিয়া চলছে বলে আপনি মনে করেন কি? এখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখবেন। বা লিটলম্যাগের প্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা যায় কিনা?

মলয় রায়চৌধুরী: মিডিয়ার সঙ্গে মিডিয়ারই মালিকদের দেয়া ওয়েব-পরিসরের তুলনা করা যায় না । তারা ইশারা করলে এক মুহূর্তে প্রতিটি ওয়েব পরিসরকে লোপাট করে দিতে পারে ; মনে হয় তা তারা করবেও যখন দেখবে নজরদারি কুলিয়ে উঠছে না । পৃথিবীরমিডিয়া টাইকুনদের অধিকাংশই মিলিটারি-ইনডাসট্রিয়াল রেজিমের মানুষ । ঢাকার রাস্তায় ব্লগ-লেখকদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা থেকে কিছুটা আইডিয়া অবশ্য হয় যে সেই দেশে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ক্ষমতা-প্রতাপের আস্ফালনকারীরা হল মৌলবাদীরা । কলকাতাররাজপথে নাস্তিক-আস্তিকের খুনোখুনি সম্পূর্ণ অ্যাবসার্ড । ভারতে যে ধর্মকেন্দ্রিক দাঙ্গা হয় তা রাজনৈতিক ; ধর্ম এখানে মিডিয়াকে হাতাতে পারেনি, রাজনীতির মূলস্রোতকেও পারেনি বলে তা প্রাতিষ্ঠানিক আস্ফালনের অস্ত্র হয়ে ওঠেনি আপাতত । পশ্চিমবঙ্গে ইনটারনেটেরপ্রসার বেশ দেরিতে হয়েছে ; লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরকে তার পক্ষে দখল করা সম্ভব নয় । লিটল ম্যাগাজিন হল মাইক্রোলেভেল আস্ফালনের ও ব্যক্তি-এককের প্রতিস্ব-প্রকাশের এলাকা ।

দুপুর মিত্র: আপনি নিজে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এটি কি প্রতিষ্ঠানবিরোধি মনন গঠনে ব্যাহত করে বা আদৌ পেশার সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক-দু:সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় কি?

মলয় রায়চৌধুরী: আমি সরকারে চাকুরি করিনি । তার ফলে সরকারি পেনশনারদের পেনশান বাড়লেও আমার বাড়ে না । আমি প্রথমে পটল তুললে আমার স্ত্রী পেনশন পাবে কেবল ১২৫০ টাকা ( বারোশো পঞ্চাশ ) । হৌঈঊহৌঈ আমার প্রথমহৌঈহৌঈহৌঈহৌঈকুরি ছিলরিজার্ভ ব্যাংকে বস্তা ওই প্রথম চাকুরিতে আমার কাজ ছিল বস্তা-বস্তা কোটি-কোটি টাকার নোট পুড়িয়ে নষ্ট করানো । আমার উপন্যাস ''ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'' পড়লে জানা যাবে যে সেই সংস্হাতেই নিষিদ্ধ দলের বিপ্লবীরা চাকুরি করেও কী ভাবে তাঁদের বৈপ্লবিক কাজচালিয়ে যেতেন । বা নিম্নবর্গের কর্মীরা উঁচু বর্গের রাজনৈতিক দলের মোকাবিলা করার আঁক কষতেন ।

সমস্যা হল যে যাঁরা আমার সাক্ষাৎকার নেন তাঁরা আমার বইপত্র পড়ে প্রশ্ন করেন না । ওই চাকুরিতে এত বেশি টেনশান ছিল যে আমি প্রথম সুযোগেই গ্রামীণ উন্নয়নের চাকরিতে ঢুকি । এই চাকুরিতে ঢোকার পরই আমি প্রকৃত ভারতীয় জীবনের সঙ্গে পরিচিত হই ; আমারকাজ ছিল গ্রামে-গঞ্জে চাষি তাঁতি জেলে ছুতার কামার কুমোরদের জীবিকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা আর তার ভিত্তিতে মাইক্রোলেভেল উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করা । শহুরে হবার কারণে অনেক কিছু তার আগে জানতুম না । শহরে বসবাস করে ম্যাক্রোলেভেলক্ষমতাপ্রতাপের সঙ্গে পরিচিত ছিলুম । কিন্তু অণুস্তর ক্ষমতাপ্রতাপের আস্ফালনের সঙ্গে পরিচিত হলুম গ্রামাঞ্চলে ঘোরাঘুরির চালকুরিতে । যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছিলুম তা থেকে লিখতে পেরেছিলুম ''নামগন্ধ'' উপন্যাস, আলুচাষীদের জীবন নিয়ে, ''নখদন্ত'' নামেরসাতকাহন, পাটচাষি আর চটকল-শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ।

দুপুর মিত্র: পোস্টমডার্নিজম একটি পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থারই নতুন পণ্যায়নের ক্ষেত্র। যেমন পোস্টমডার্নিজম আসার সাথে সাথে হারবাল বিভিন্ন সামগ্রীর পন্য হিসেবে দামি হওয়া শুরু করল যা আগে ছিল না ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে পওস্ট মডার্নিজম বা উত্তরআধুনিকতার বিচারদণ্ডে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়কে দেখা কি ঠিক হবে বলে মনে করেন?

মলয় রায়চৌধুরী: পোস্টমডার্নিজম নিয়ে আমার বইটা পড়ে এই প্রশ্নটি করলে ভালো হতো । আমি যে পোস্টমডার্ন ভাবনার কথা বলেছি তা লাতিন আমেরিকার কবি-দার্শনিক ফেদেরিকো দ্য ওনিসের ভাবনা । ফেদেরিকো দ্য ওনিস যখন পোস্টমডার্ন ভাবকল্পটির কথাবলেছিলেন তখনও ইউরোপে পোস্টমডার্নিজম নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়নি । যেমন ইসলাম বললে আমি কেবল সৌদি আরবের ব্যাখ্যায় নিজেকে সীমিত রাখি না । আমি ইরানের ব্যাখ্যাকেও গুরুত্ব দিয়ে ভাবি । একইভাবে আমি কী বলতে চাইছি তাকে বোঝা জরুরি ।আমেরিকানরা বা ইউরোপীয়রা কী বলছে তা দিয়ে আমাকে বোঝার প্রয়াস করা ভুল ।

দুপুর মিত্র: আমি মনে করি লেখার কপিরাইট রাখাটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র। এ দিকে কপিলেফট করে লেখা প্রকাশ করা, বা গান-চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় এই কপিলেফ্টের বিস্তৃতির সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?

মলয় রায়চৌধুরী: কপিরাইটের জন্ম পুঁজিবাদের গর্ভে । প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার কিছু করার নেই । এলেবেলে সবাই কপিরাইটের মালিকানার ঘোষণা করেন । এমনকি বিপ্লবী মার্কসবাদীরাও কপিরাওইটের মালিকানা ধরে রাখেন । ব্যাপারটা থাকবে । যাবে না কখনও ।রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট ধরে রাখার জন্য কত চেষ্টা করেছিলেন কর্তাব্যক্তিরা । আমি নিজে কপিরাইটের পরোয়া করি না ; আমার ছেলে-মেয়েও করে না । কিন্তু আমি নিজের টাকায় কবিতার বইও প্রকাশ করি না বলে যাঁরা প্রকাশ করেন, বলা বাহুল্য সবই লিটলম্যাগাজিন প্রকাশনা, তাঁরা কপিরাইট ধরে রাখতে চান আমার বইয়ের ।

দুপুর মিত্র: আপনি কি মনে করেন কবিতা সমাজে একটি ভূমিকা রাখে? যদি রাখে সেটা কিভাবে যদি না রাখে সেটা কেন?

মলয় রায়চৌধুরী: সমাজ বলতে কী বোঝায় ? উনিশ শতকের ভাবুকদের ব্যবহৃত বহু শব্দ আমরা প্রয়োগ করি যার অর্থ ঝাপসা হয়ে গেছে । নজরুলের সময়ে আমরা যে ক্ষুদ্র বঙ্গভাষী পরিসরকে সমাজ নামে অভিহিত করতুম তা আর নেই । এখন সমাজ বলতে যেমানব-গোষ্ঠিকে বোঝায় তা জটিল, অপরিমেয়, বিস্তৃত, সতত পরিবর্তনশীল, আইডেনটিটির অতীত, এক ধরণের বায়বীয় পিরামিডের অদৃশ্য কক্ষে বিভাজিত । ওই পিরামিডের কোনো-কোনো মমি কখনও-কখনও বেঁচে আছেন প্রমাণ করার জন্য লেখকদের কাজের দ্বারাআক্রান্ত হয়েছেন বলে হইচই করেন, তা সে কবিতা হোক, কার্টুন হোক, গদ্য হোক, পেইনটিং হোক । যারা হইচই করেন, তাঁরা নিজেদের জন্য সংজ্ঞা গড়ে নিয়ে সেই গোষ্ঠিটুকুকেই নিজেদের সমাজ মনে করেন । কবি, লেখক, পেইনটার, কার্টুনিস্টকে হেনস্তা করা হয় ।আমরা তো দেখলুম কয়েকজন বাংলাভাষার ব্লগারের গদ্য-পদ্যর জন্য ঢাকা-চট্টগ্রামে কী ভাবে আক্রান্ত হতে হল । পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তাঁদের রচনার সেরকম প্রতিক্রিয়া হল না ; অথচ দুই বাংলাই ঝাপসাভাবে বঙ্গসমাজের অন্তর্গত । রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, সময়, ইতিহাসইত্যাদি শব্দগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে । তাদের খাতিরে মডার্নিজমের গড়া সীমাগুলো আর নেই । ধর্মকেন্দ্রিক সমাজ যে তার কেন্দ্র আর পরিধি দুই মুছে ফেলেছে তা তো দু-একটি ধর্মের মানুষদের পারস্পরিক খুনোখুনি থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে ; দেখেশুনে মনে হয় যে তাদেরসমাজটাই লোপাট হয়ে গেছে ।

দুপুর মিত্র: আপনি কোন কোন কবি দ্বারা বেশি প্রভাবিত?

মলয় রায়চৌধুরী: আমি কী করে বলি আমি কোন কবির দ্বারা প্রভাবিত । সমালোচকরা বলতে পারবেন । বই পড়া নিয়ে আমার কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই । বালক বয়স থেকে যে বই পেয়েছি একধার থেকে পড়ে গেছি । আমার বাল্যস্মৃতি ''ছোটোলোকের ছোটোবেলা'' গ্রন্হেআমাদের বাড়ির আর বাবার দোকানের দুজন কাজের লোকের প্রভাবের কথা বলেছি ; শিউনন্দন কাহার আর রামখেলাওন সিং ডাবর । এনারা আমাদের বকুনি দিতেন তুলসীদাসের দোহা আর রহিম-দাদুর কোটেশানের মাধ্যমে । প্রতিবেশি শিয়া পরিবারের কুলসুম আপাফয়েজ আহমেদ ফয়েজের মাধ্যমে আর ওনার আব্বু গালিবের মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্ত করতেন । প্রথম স্কুল ছিল একটি ক্যাথলিক স্কুল যেখানে সপ্তাহে একবার সংলগ্ন চার্চে যিশুর বন্দনা গান গাইতে হতো । তারপর গেলুম ব্রাহ্ম স্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে । এই স্কুলেইবাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে শেখান গ্রন্হাগারিক উঁচু ক্লাসের ছাত্রি নমিতা চক্রবর্তী । স্বাভাবিক ভাবেই ব্রাহ্ম কবিদের আঁকড়ে আমার ভাষাযাত্রা ।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

মলয় রায়চৌধুরী: এই ''হয়ে ওঠা'' ব্যাপারটা ঠিক কী ? এই শব্দবন্ধ কবে প্রবেশ করল বাঙালির অভিব্যক্তি-পরিসরে ? আমাদের পরিবারে কেউই এই চিন্তায় পীড়িত ছিলেন না যে মানুষকে কিছু একটা ''হয়ে উঠতে'' হয় । পাটনা শহরের ইমলিতলা পাড়ায়, যেখানে আমরাথাকতুম, জীবিকাটাই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি । কানাগলির বস্তিতে যারা থাকত তারা ছিল চোর পকেটমার দিনমজুর ইত্যাদি । দাদার বন্ধু বদ্রি দাদার বয়সে পৌঁছে ওর বাবার পেশা রপ্ত করেছিল বলে পাড়ার সবাই ওকে বদ্রি পাটিকমার নামে ডাকত । ইমলিতলা পাড়ায়সচরাচর বাবা-জেঠার বাঙালি বন্ধুবান্ধবরা আসতেন না । দরিয়াপুর পাড়ায় নতুন বাসায় যাবার পর বাবার বন্ধুরা প্রশ্ন করতেন বটে, ''বড়ো হয়ে কী হতে চাও'' ? আমার কাছে এর কোনো উত্তর থাকত না, কেননা আমি জানতুমই না যে কোন জীবিকায় ঢুকবো । কেউযে কবি ''হয়ে ওঠে'' এই ভাবনাটাই ছিল অ্যাবসার্ড । কবিতা লিখতে আরম্ভ করেও কখনও মনে হয়নি যে রবীন্দ্রনাথ কবি ''হয়ে উঠতে'' চেয়েছিলেন ।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

মলয় রায়চৌধুরী: কবিতা কি এর উত্তর আমি জানি না । তবে স্কুলে-কলেজে তার যে সংজ্ঞা মুখস্ত করেছিলুম তা যে কবিতা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না এটুকু কবিতা লেখার শুরুতেই আবিষ্কার করি । তাছাড়া কবিতার সজ্ঞা সারাজীবন একই থাকেনি । তা সততপরিবর্তিত হতে থেকেছে । সবাই একই কারণে লেখেন না । প্রতিটি লেখাই একই কারণে রচিত নয় । একই লেখক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়সে একই কারণে লেখেন না । কবিতারূপে একজন লোক যা উপস্হাপন করে তাতে সেকারণেই সতত বাঁকবদল ঘটতে থাকে । 'প্রচণ্ডবৈদ্যুতিক ছুতার' রচনাটি আমার কাছে কবিতা ছিল, যখন লিখতে শুরু করেছিলুম ; অনেকের কাছে সেসময়ে তা কবিতা হিসাবে গণ্য হয়নি । অথচ এখন রচনাটি কবিতারূপে গণ্য হয়েছে আর তা পিএইচ ডি, এম ফিলের বিষয়বস্তুও হয়েছে । এখন কিন্তু হাজার চেষ্টাকরেও আমি ওই কবিতাটি লিখতে পারব না । এখন আমি যে ধরনের কবিতা লিখছি, যেমন 'ডেথমেটাল' বা 'মর মুখপুড়ি', তেমন কবিতা আমি পাঁচ-সাত বছর আগে লিখতে পারতুম না । নব্বুই দশকে একেবারে অন্যরকম, প্রায় কমপ্লেক্স, কবিতা লিখেছি, যেমন'হাততালি', তা আর লিখতে পারব না । আমি বোধহয় সনাতন সময়ের সংস্কৃত কবিদের মতন, যাঁরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যকে অবিরাম বোঝার চেষ্টা করতেন । চারটি বেদের কোনোটিতে তাই 'ঈশ্বর'-এর প্রসঙ্গ নেই ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতা ও বিশ্ব কবিতার জায়গাগুলো নিয়ে কিছু বলুন?

মলয় রায়চৌধুরী: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতা সম্পর্কে এবং বর্তমান বিশ্বের কবিতা সম্পর্কে বিশেষ বলতে পারব না । স্বাস্হ্য ভালো নয় বলে তেমন পড়াশুনা আর করতে পারি না । বই কিনতে টাকাকড়িও লাগে প্রচুর এখন । কলকাতায় যখন ছিলুম তখন তরুণকবিরা বাড়িতে এসে বই-পত্রিকা দিয়ে যেতেন । আমিও ব্রিটিশ লাইব্রেরি আর স্হানীয় লাইব্রেরিগুলোতে গিয়ে বই নিয়ে আসতুম । মুম্বাইতে থাকি শহরতলিতে, গ্রন্হাগার অনেক দূরে, এই বয়সে বাসে-ট্রেনে চাপা অসম্ভব । সেভাবে আর বইপত্র পাই না । যেটুকু পড়ি তারসবটুকুই বলতে গেলে ইনটারনেটে । তরুণ-তরুণীরা দুই বাংলাতেই উদ্দীপনাময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন-- বেশ আহ্লাদিত হই তাঁদের কবিতা পড়ে । অনেক সময়ে মনে হয়, আমি কেন এরকম লিখতে পারলুম না, শব্দ-বাক্য সবই তো ছিল ।

দুপুর মিত্র: সাম্প্রতিক সময়ে আপনার লেখালেখি নিয়ে কিছু বলুন।

মলয় রায়চৌধুরী: ২০০০ সালে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পর এত বেশি ওষুধ খেতে হয়েছিল যে আরথ্রাইটিসের কবলে পড়ে গিয়েছিলুম । সারতে কয়েক বছর লেগে গেল । বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠা ব্যবহার করা মুশকিল হয়ে গেল । দুই-আঙুলে লেখার চেষ্টা করতুম কিন্তু মগজ তো চলেআঙুলের চেয়ে দ্রুত । লেখা বন্ধ হয়ে গেল ক্রমশ । মন খারাপ হয়ে গেল । বসে থাকতুম চুপচাপ । কেদার ভাদুড়িকে দেখতুম, লিখতে পারছেন না বলে এক তরুণ কবিকে ডিকটেশান দিচ্ছেন আর সে লিখে নিচ্ছে । আমার সামনে কেউ বসে থাকলে আমি লিখতে পারি না ।আমার মেয়ে এসেছিল বিদেশ থেকে । আমার দুরাবস্হা দেখে ও আমাকে এক আঙুলে কমপিউটারের চাবি অপারেট করতে শেখাল । সেই থেকে আমি কমপিউটারে লিখি । কলম ধরে আর লিখতে পারি না । কলমে লেখার সময় শব্দ আর বাক্যের ব্যাংক রাখতুম একটাখাতায় যা পরে গদ্য বা পদ্য লেখার সময়ে ব্যবহার করতুম । কমপিউটারে সরাসরি লিখি, পরে রদবদল করতে থাকি, যখন যেমন ইচ্ছে হয় । কবিতা বা গদ্য সবই গুগল ড্রাইভে স্টক করে রাখি । কেউ চাইলে, যদি থাকে, সেখান থেকে পাঠিয়ে দিই । কিন্তু একটানাবেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না । কমপিউটারে লেখার ফলে ভাবনাগুলোকে বা শব্দ-বাক্য ইত্যাদি মগজেই ধরে রাখি । ভুলেও যাই, মনে করতে পারি না । যদি মনের মতন বাক্য এসে পড়ে মাথায় তাহলে কমপিউটার খুলে বসে পড়ি যাতে হারিয়ে না যায় । এখন একটাউপন্যাস লিখছি পঞ্চাশ-ষাট দশকের সময়টা নিয়ে, দুই ভাই অনিকেত সিংহ আর রাহুল সিংহের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে , নাম রেখেছি ''রাহুকেতু'' । ফলে কবিতা লেখার তেমন সময় হচ্ছে না ।

দুপুর মিত্র: আপনার কবিতা লেখার শুরুটা নিয়ে যদি বলতেন।

মলয় রায়চৌধুরী: আমি কবিতা লেখা আরম্ভ করি ১৯৫৯-৬০ নাগাদ । কেবল কবিতা বললে ভুল হবে, লেখালিখি আরম্ভ করি ওই সময় থেকেই । আমার মনে হয় আমি লেখালিখি শুরু করেছিলুম প্রাকযৌবনের উচ্ছৃঙ্খল সাহিত্যপাঠ, বঙ্গসংস্কৃতিতে আউটসাইডারবোধ, পারিবারিক গোঁড়ামি আর সাবর্ণ চৌধুরী ক্ল্যানের চাপানো সীমালঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে । তারপর চাকুরিসূত্রে সারা ভারত চষে বেড়িয়েছি আর আমার মতনই বদলাতে থেকেছে চারিদিকের সব কিছুই । কিন্তু আমি কেন লিখি, এই অমূলক প্রশ্নটা আমার কোনো ভারবাহীজিজ্ঞাসাবোধের অন্তর্গত ছিল না যদিও, একটা দার্শনিক সমস্যা হিসেবে প্রতিনিয়ত আমাকে এমনভাবে চিন্তিত রেখেছে যে, প্রশ্বহীনতা, চিন্তাহীনতা, এমনকি চেতনাবোধ গুলিয়ে ফেলেও, আমার লেখার সম্ভাবনা থেকে, লিখিত পাঠবস্তু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার, কোনোসদুত্তর পাই না । আমার মধ্যে আমার লেখার প্রক্রিয়াটি নিজে, ওই প্রশ্নটির সঠিক উত্তর । আমি কেন লিখি, এই সমস্যাটি, সারা জীবন একই দার্শনিকতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না, কেননা, একজন মানুষের মানসিক অবস্হানগুলোর সুস্পষ্ট জলবিভাজক থাকে না। যাঁরা মার্কসবাদী, গান্ধিবাদী, রামকৃষ্ণ অথবা শ্রীঅরবিন্দে বিশ্বাসী, কিংবা রাজ্য সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন, তাঁদের, মনে হয়, এই সমস্যাটির হাঙরের হাঁ-মুখে পড়তে হয় না । লেখালিখিটা যাঁদের ব্যবসা, তাঁরা তো জানেনই কেন লিখছেন ।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

মলয় রায়চৌধুরী: কবিতা লেখার বিষয় আর হয় না বলেই মনে হয় আমার । উনিশ শতকে আর বিশ শতকের প্রথম দিকে হতো । আমি তো দেখি জীবনানন্দ কবিতার প্রথম লাইনটি থেকে দু-তিনটে শব্দ নিয়ে কবিতার নামকরণ করেছেন । সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সময়ে ছিল ; 'মেথর' নিয়ে কবিতা লিখতে হবে ভেবে নিয়ে প্রথমে শিরোনাম লিখলেন , তারপর কবিতাটি লিখতে বসলেন । এখন আর কবিতার বিষয় নামক কেন্দ্র থাকে না । কবির চেতনার রোঁয়া উড়তে থাকে কয়েকটা শব্দ বা বাক্য বা ছবি নিয়ে আর তা থেকে তিনি এগিয়ে যান ।আমিও সেভাবেই এগোই । হঠাৎ একটা রোঁয়া উড়তে থাকে ; যদি ধরে ফেলতে পারি তাহলে শুরু করি । কখনও অবশ্য এক সিটিঙে লেখা সম্ভব হয় না । লিখে ফেলার পর, হয়ত এক দিনেই কমপ্লিট করি, কখনও বা কয়েক মাস লেগে যায় একটা কবিতা লিখতে । অনেকসময়ে অর্ধেক লিখে তারপর রোঁয়াটা যদি হারিয়ে ফেলি, তাহলে ডিলিট করে দিই ; কেননা তা না করলে অসুস্হ বোধ করতে থাকবো ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মলয় রায়চৌধুরী: সাহিত্যে, এই 'ভালোলাগা' ব্যাপারটা কি হয় ? জেমস জয়েস বা মার্সেল প্রুস্ত বা এজরা পাউন্ড পড়তে অনেকেরই 'ভালো' লাগবে না, কিন্তু তাঁদের কারণেই তাঁদের ভাষা আজ অত উন্নত । বর্তমানে তিনজনের কবিতায় আমি পর্যদুস্ত হই, পড়ে থ হয়ে যাই ।এঁরা তিনজনই মহিলা কবি : মিতুল দত্ত, যশোধরা রায়চৌধুরী আর শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী ।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মলয় রায়চৌধুরী: আমি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র বহুকাল পড়ি না । তার কারণ ওগুলো পড়লে মনে হবে যেন পশ্চিমবঙ্গ রসাতলে চলে গেছে । বস্তুত সারা ভারতে যা ঘটছে পশ্চিমবঙ্গেও তাই ঘটে চলেছে । কিন্তু পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদিসংবাদগুলো চলে এসেছে প্রথম পৃষ্ঠায়, তিন-চার ইঞ্চ ফন্টসাইজের হেডলাইন দিয়ে । দেশ পত্রিকাও প্রায় তিন দশক পড়ি না । প্রচুর লিটল মভাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে আজকাল । তাই, আমার মনে হয়, দৈনিকরা কোন কবিতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে ইত্যাদি চিন্তা করার কোনোদরকার নেই । লিটল ম্যাগাজিন লেখকরা তো এখন আর দৈনিকের বিশেষ পরোয়া করেন না ; যে যা ইচ্ছে, যেমনভাবে ইচ্ছে লিখছেন । আমাদের সময়ের চেয়ে তাঁরা যথেষ্ট বোল্ড । তুমি যদি স্বাগতা দাশগুপ্তের কবিতা না পড়ে থাকো তাহলে খুঁজে পেতে পোড়ো ।