জুবিন ঘোষের স্মৃতিকথা: সুনীলদা বললেন- “ময়দানে দেখা হবে”

Post date: Oct 10, 2014 4:47:20 AM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

শৈশব থেকেই বই পড়ার নেশা যখন আমায় ছেয়ে ধরে তখন আমার সময়গুলো কাটত রাণাঘাটের দোতলার বিশাল বারান্দা আর তিন তলার ছাদে যাবার সিঁড়িতে । গমগমে সারা বাড়ির এই নিভৃত জায়গাগুলোই হয়ে উঠেছিল আমার বাঙ্গালা বা ডেনকালির জঙ্গল । খুব আশ্চর্যের কথা আমার অক্ষর শিক্ষা কিন্তু বর্ণপরিচয় থেকে হয়নি, হয়েছিল দেশ পত্রিকায় বেরোনো অরণ্যদেবের পাতা থেকে । এর পর একে একে বিদেশি অনুবাদ থ্রিলার, জুর্ল ভার্ন, আলফ্রেড হিচকক, মার্ক টোয়েন সঙ্গে গোগোল, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ফেলুদা । এরপরই কোনো একদিন আমি পেয়ে গেলাম পাণ্ডব গোয়েন্দা থেকে কাকাবাবুতে উন্নিত হবার দিশা । আমাকেও কাকাবাবু পেয়ে বসল। সুনীলের সঙ্গে নয় আমার প্রথম পরিচয় রাজা রায়চৌধুরীর সঙ্গে । এরসঙ্গে সঙ্গেই আমার বারান্দাটা ক্রমশ বদলে যেতে থাকল, কখনও মিশর কখনও অন্য কিছু । তখন থেকে বহুদিন মনের ভিতরে চরিত্র হিসেবে সুনীল নয় কাকাবাবুই ছিলেন সুনীলের একমেবাদ্বিতীয়ম অস্তিত্ব । আমার চরিত্র গঠনে সন্তুকে বলা কাকাবাবুর শিক্ষাগুলোই তখন আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেছি । কিশোর সাহিত্য হিসেবে কাকাবাবুর মাধ্যমে শিশুমনের আদর্শ ও মানবিক গঠনের বেশ কিছু ভূমিকা যে সত্যি সুনীল’দা রেখে গেছেন সেই কথা অনস্বীকার্য । সুনীলের মানসিক দৃঢ়তা, মানবিকতা, আদর্শ সবকিছুই তিনি প্রতিফলিত করেছেন তার এই কাকাবাবু চরিত্রে । যেহেতু আমার সময়কালে নেতাজী, গান্ধীজী বা রবীন্দ্রনাথ পাঠ্যপুস্তক ও স্কুলে-পাড়ায় জন্ম-জয়ন্তীতেই আটকে ছিল তাই একদিকে আদর্শ মানুষ হিসেবে কাকাবাবু, অন্যদিকে বাঙালির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদৃপ্ততার এবং বাঙালির স্মার্টনেসের প্রতীক হিসেবে সত্যজিতের প্রদোষ মিত্র-দের সামনে রেখেই আমার কৈশর যাত্রা । এরপর একের পর এক দেশ ও আনন্দমেলার পাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প পড়ে চলা । ছোট থেকেই কবিতার দিকে ছিল আমার অসীম ঝোঁক । দেশের পাতা আর পাঠ্য পুস্তকই যদিও ছিল আমার কবিতা পড়ার প্রথম উৎসস্থল । বুঝতাম না বুঝতাম পড়ে ফেলতাম ।

সুনীল’দা বললেন কৃত্তিবাসের দপ্তরে একদিন এসো, আলাপ করব, একই কথা পিনাকীদাও বললেন । ভয় হোক যে জন্যই হোক আমার আজও যাওয়া হয়নি । কবিতা গেছে, কবিতা এসেছে । আমার পাঠ এগিয়েছে । সুনীল সম্পর্কে জেনেছি নানান ব্যক্তিগত প্রবন্ধে । তার আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছে ক্রমশ । শিখেছি কীভাবে ভালবাসতে হয় সবাইকে । কীভাবে সবাইকে নিয়ে চলতে হয় । যে কেউ লেখা চাইলে তাকে ফেরাতে নেই । নিজেকে মাটির কাছাকাছি কীভাবে রাখা যায় । এক অনন্ত ভালোবাসার দুই পথিকৃৎ দেবকুমার বসু ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । সদা হাস্য, জ্ঞানভাণ্ডার । টুকরো টুকরো ভাবে সেই আদর্শগুলোই আমার পাথেয় । রাজা রায়চৌধুরী, ব্যক্তি সুনীল’দা, ও লেখক-কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্রমশ মিশে যায় আমার জগতে । রবীন্দ্রনাথ নন, সুনীলই আমার রোল মডেল শৈশব থেকে আজও ।

একদিকে যখন আমার কৈশর গড়ে উঠছে রাজা রায়চৌধুরীর ছায়ায়, টুকটাক কবিতাও লিখতে শুরু করেছি, তখনও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেন আমার কাছে রাজা রায়চৌধুরীই রয়ে গেছেন মনের গভীরে । ২০০০ সালে ছাপা অক্ষরে নিজের প্রথম জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশের পর এক অসীম বড় ও ছোট পত্র-পত্রিকার রত্নরাজির সন্মুখীন হলাম । শুরুতেই অভিনব অগ্রণীর দিলীপ কুমার বাগ ও তার কিছু পরে একসময় বিশ্বজ্ঞানের দেবু’দার (দেবকুমার বসু) সান্নিধ্য পেলাম । এই দেবু’দাই আমায় কলকাতা চেনালেন । ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ ‘PEN’ এর এক সভায় প্রথম চাক্ষুস করি আমার রাজা রায়চৌধুরীর থুরি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে । ততদিনে কৃত্তিবাস এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেছে । আমি জেনে গেছি বাংলার তাবড় সব কবি সাহিত্যিকদের নাম, পত্রিকার নাম, লেখাও বেরোচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে মিশিয়ে । সেদিন সভায় শুধু মুগ্ধ হয়ে আমার ‘কাকাবাবু’কে দেখছিলাম । কয়েকটি সভায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে কবিতা পড়েছি । দেখেছি কী অসীম ধৈর্যে তিনি সারাক্ষণ সেই সভায় সবার কবিতা শোনেন । মাঝে মাঝে ঘাড় নেড়ে যান । কখনও অস্ফূটে বলেন ‘বাহ’ । হয়তো তার মধ্যেই মনের ভিতর তৈরি হচ্ছে কোনও গল্পের প্লট বা অসমাপ্ত ধারাবাহিকের পরবর্তী কিস্তি । একদিন একাদেমি থেকে বেরোনোর সময় সাহস করে সামনে দাঁড়িয়েই একটিপ প্রণাম করতে খুব ইচ্ছে করতে এগিয়ে পায়ে হাত ছোঁয়ালাম । মাথায় সহাস্যে হাত রেখে বললেন – “কী নাম তোমার? ” নাম বলে কবিতার খাতাটা অটোগ্রাফের জন্য বাড়িয়ে দিতে অটোগ্রাফ করতে করতে বললেন “কী করো?” । এবার সাহসটা বাড়িয়েই বললাম “শুধু কবিতা লিখি” । এর পরেই এক অদ্ভূত উত্তরের মুখোমুখি হলাম – হঠাৎ হাসিটা মিলিয়ে বললেন “তাহলে ময়দানে দেখা হবে।” সেই অটোগ্রাফটা ততক্ষণে আমার হস্তগত । তাতে যেন হঠাৎ একটা চ্যালেঞ্জের ছোঁয়া । ময়দানে দেখা হবে ... ময়দানে দেখা হবে ... । আমি বারবার হাত বুলিয়ে যাচ্ছি সেই অটোগ্রাফে । কবিতা লিখে যাচ্ছি , সকলের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে কিন্তু প্রতিদিন কবিতা লেখার মাঝে, আগে পরে সেই অটোগ্রাফটা খুলে দেখছি । প্রায়সই সেই মানুষটাকে নানা মঞ্চে দেখছি , দেখা হচ্ছে , কবিতা শুনছেন, ঘাড় নাড়ছেন, আস্তে আস্তে মুখ পরিচিতি ক্রমে নামটাও মনে রাখছেন । আমিও ক্রমশ বিভিন্ন বই-প্রবন্ধ-কবিতা পাঠে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি । ইতোমধ্যে ছয় বার কবিতা পাঠিয়েছি কৃত্তিবাসে । ছয়বারই কবিতা অমনোনীত হয়েছে । তবুও দমিনি । একটা সময় অবশেষে কৃত্তিবাসে ছাপা হল । সেই কৃত্তিবাসটা ডাকে যেদিন প্রথম হাতে পেলাম । শুধু তার গন্ধ শুকলাম । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকবার দেখলাম । সেবার কলকাতা বইমেলা । কৃত্তিবাস স্টলের বাইরে তিনি বসে আছেন । তাকে ঘিরে অসংখ্য মানুষ । এই দ্বিতীয়বার তাঁকে প্রণাম করতে এগিয়ে গেলাম । প্রণাম করতেই বললেন – “তোমার নাম জুবিন তো? কৃত্তিবাসে তোমার কবিতা আছে দেখেছ?” আমি হতচকিত । এই বিরাট মাপের মানুষ, যিনি আমার আদর্শ, তিনি আমার নাম কয়েকটি সভা সমিতিতে শুনেই মনে রেখেছেন ! এও-তো এক আদর্শ । সুনীল’দা বললেন কৃত্তিবাসের দপ্তরে একদিন এসো, আলাপ করব, একই কথা পিনাকীদাও বললেন । ভয় হোক যে জন্যই হোক আমার আজও যাওয়া হয়নি । কবিতা গেছে, কবিতা এসেছে । আমার পাঠ এগিয়েছে । সুনীল সম্পর্কে জেনেছি নানান ব্যক্তিগত প্রবন্ধে । তার আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছে ক্রমশ । শিখেছি কীভাবে ভালবাসতে হয় সবাইকে । কীভাবে সবাইকে নিয়ে চলতে হয় । যে কেউ লেখা চাইলে তাকে ফেরাতে নেই । নিজেকে মাটির কাছাকাছি কীভাবে রাখা যায় । এক অনন্ত ভালোবাসার দুই পথিকৃৎ দেবকুমার বসু ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । সদা হাস্য, জ্ঞানভাণ্ডার । টুকরো টুকরো ভাবে সেই আদর্শগুলোই আমার পাথেয় । রাজা রায়চৌধুরী, ব্যক্তি সুনীল’দা, ও লেখক-কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্রমশ মিশে যায় আমার জগতে । রবীন্দ্রনাথ নন, সুনীলই আমার রোল মডেল শৈশব থেকে আজও ।