দেবীপ্রসাদের স্মৃতিকথা বুড়িগঙ্গার সাতকাহন

Post date: Nov 28, 2014 4:58:09 PM

‘নদী হচ্ছে চলমান রাজপথ, আমরা কোথায় যেতে ইচ্ছা করি তারই দিগনির্দেশনা দেয়’

ব্লেইজ প্যাস্কাল (১৬২৩ – ১৬৬২) - থটস

কি নেই আমাদের? বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, এটি একটি বহুল উচ্চারিত প্রশ্ন (?), আবার - এটি তেমনই একটি বহু্ল আলোচিত উত্তর (!) সত্যিতো! কী নে-ই আমাদের? কথার পৃষ্টে অনেক কথা আসে। মন্দ জনে বলবে – ‘যা নেই তা নেই’। কিন্তু, আমাদের কি আছে, কি নেই – তা-ই আমরা জানিনা। জানতে চাইনা। নকশীকাঁথা বুনার মতো করে আমরা কেবল কথার মালা সাজাই। আমাদের ইতিহাস আছে, বর্তমানে তার কোন কদর নাই।

এটা গল্প নয়, স্মৃতিচারণ। মনেপড়ে, আমরা পুরো একটা দিন কাটিয়েছিলাম এক ভাসমান নৌকায় – বুড়িগঙ্গায়– ম্যারি এন্ডারসনে। বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে গ্রমনপিপাসু কিছু মানুষের আলাপচারিতা। মূলতঃ ‘গঙ্গাবুড়ী’ নিয়ে কিছু কথা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা ‘কি-ও-কেন’ এ লেখার প্রধান উপজীব্য।

মনেহয়, এইতো সেদিন। কিন্তু না। এখন আর তা ওখানে নেই। ১৯৯১-এর দিকে এক রৌদ্রস্নাত শীত-সকালে - কোনোভাবেই সেটা আমাদের নৌকা বিহার ছিলোনা। ছিলো নৌকাবিলাস। পাঁচ পরিবার মিলে জনাদশেক লোক সারাটা দিনের জন্য গেছি সেখানে। পঞ্চ নদীর পানি মিশে আছে যেখানে – বুড়িগঙ্গা তার নাম।

বুড়িগঙ্গার উতপত্তি নিয়ে নানা কথা আছে। বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর একটি শাখানদী। সাভারের দক্ষিনে ধলেশ্বরী নদী থেকে বেড় হয়ে ফতুল্লার দক্ষিনে আবার ধলেশ্বরীতে পড়েছে। এটি ৩০ মাইল দীর্ঘ ও প্রায় ৬ মাইল প্রস্থ ভূখণ্ডকে একটি দ্বীপাকারে পরিণত করেছে। এর নাম পারজোয়ার। ১৯টি নদী খাল নিয়ে ঢাকা জেলা।

১৮৪০ সালে লেখা জেমস টেলরের ‘টপোগ্রাফী অব ঢাকা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, মিনার ও বৃহৎ অট্টালিকা শোভিত ঢাকা শহর তখন পাশ্চাত্যের ভেনিসের জলোত্থিত নগরী বলে প্রতীয়মান হত। বুড়িগঙ্গাই গঙ্গানদীর মূলধারা। আজ তা ধলেশ্বরীর শাখায় পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গার উত্তর দিকে ঢাকা অবস্থিত।

নাজির হোসেন তাঁর ‘বুড়ি গঙ্গা’ নিবন্ধে লিখেছিলেন – ‘একদিন এ নদী ছিল কর্মমুখর। পৃথিবীর কত জায়গা থেকে আসতো সওদাগর, পরিভ্রাজক এই নদী পথে। - থাকতো শাহী বজরা আর থাকতো সহস্র নাওয়ারা (নৌবহর)।‘ আজতো আরও বেশী থাকার কথা। কিন্তু, নেই কেন?

বুড়িগঙ্গাকে ‘গঙ্গা বুড়ী’ ডাকলো আমার বড় মেয়ে (৫)। এই নিয়ে – আসর যখন হাস্যরস মুখর। প্রসঙ্গতঃ মনে পড়লো – কালিকাপুরাণে এর উল্লেখ আছে। লেখা আছে, “নাটকশৈলে একটি সরোবর আছে, উহার মধ্যদেশ হইতে – গঙ্গার ন্যায় ফলদায়িনী বৃদ্ধগঙ্গানদী উদ্ভূত হইয়াছে।“

স্বনামধন্যা শীতলক্ষ্যা। শীতল আর লক্ষ্মী এই দুই বিশেষণেই শীতলক্ষ্যার নামকরণ। হিন্দু পুরাণে আছে – শীতলক্ষ্যা কেমন করে বুড়ী গঙ্গার রূপ নিয়ে নিজেকে ব্রহ্মপুত্রের সামনে উপস্থাপন করল। আর- ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি একস্রোতে মিশে গেল। আজ শীতলক্ষ্যার শীতলতা নেই – লক্ষ্মীরও হয়েছে বিদায়।একসময় ডেভিড কোম্পানি শীতলক্ষ্যার পানি দিয়ে সোডা ওয়াটার বানাত। এখন – পড়ে আছে ইতিহাসের বিশীর্ণ কঙ্কাল।

হায় শীতলক্ষ্যা! মুন্সীগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ আসছিলাম। শীতলক্ষ্যার পচা দুর্গন্ধে অসহ্য ঠেকেছে। কি আর বলবো, নদীতে ভ্রমনতো স্বাস্থ‍্যকর হবার কথা। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নদীপূজা করে - বিশ্বাস করে মহাতীর্থ ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জল এসে মিশেছে শীতলক্ষ্যায় – মানে, গঙ্গায়।

প্রচলিত সংস্কার মেনে তাঁরা মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে মঙ্গলব্রত উৎসব পালন করে। এই পুণ্য তিথিতে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় মঙ্গলব্রত উৎসব পালন উপলক্ষে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে ভক্তরা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শীতলক্ষ্যায় ১০০১টা ঘৃত প্রদীপ প্রজ্বলন করে নদীতে ভাসায়।

১০ ফেব্রুয়ারির ‘প্রথম আলো’তে পাপ্পু ভট্টাচার্যের তোলা ছবি সহ এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি লিখেছে – ‘সন্ধ্যার পর শত শত ভক্ত মাঘী পূর্ণিমার রাতে নদীতে মঙ্গল প্রদীপ ভাসালে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়’। এতে করে – আর কিছু না হোক – নদীর প্রতি যদি মানুষের একটু দরদ আসে – তার ফলে গণসচেতনতা যদি এতোটুকুও বাড়ে - তাতেই বা মন্দ কি!

কোথাও যাইনি। কোথাও থামিনি আমরা। এদেশে –ইতিহাস কথা বলে। প্রতিটি আনাচেকানাচে ইতিহাসের উপাদান (places of historical interests) - আমরা শুধু – ভেসেছি, দেখেছি, কথা বলেছি – যে যা জানি, যতটুকু জানি – তা নিয়ে। ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন - একই প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। কেন এমন হল? রসুল বলছিল – দক্ষতার কথা। দক্ষতাটাই আসল।

আমি বললাম, না। সক্ষমতার জন্য আগে মানুষকে অবশ্যই যোগ্য হতে হয়। সাথে অজ্ঞতা থাকলে দক্ষতা ফোটেনা। ভেদবুদ্ধি না থাকলে চলেনা। এটা একধরণের ‘উন্নয়ন শিক্ষা’। তবে, যোগ্যতার প্রশ্নটি সবার আগে – অযোগ্য লোক – কোনও কাজেই ভালনা। অযোগ্য কাউকে দক্ষতা দিলে সে তার অপপ্রয়োগ ঘটায়। তার উদাহরণতো অনেক। তাই, ‘তুমি কি?’-র আগে ‘তুমি কে?’ -

একজন বিদেশিনী হ্যানিকেনে গলা ভিজিয়ে তাঁর ব্যাগ থেকে মারল্-বরো নিয়ে মাত্র ধরাল – ধোঁওয়া বৃত্তাকারে উপরে বিচিত্র কীসব ত্রিমাত্রিক শব্দাবলী সৃষ্টি করছিলো – জানিনা। শুধু, যাবার সময় ঐ মহিলা গজগজ করছিলেন yesterday 70-taka ‘no change’ ... today 80-taka ‘no change’...

তারপর, গডগড করে চলে গেলেন। বুঝলাম! এটাতে পর্যটনের ভূত আছর করেছে। কিছু বলার যো আছে কাইকে? – আমরা কিছু ছিঁচকে চোরের দল এভাবেই দেশ ও দশের বারোটা বাজিয়ে চলেছি। কোনোভাবে – মুখ দেখাবার উপায় নেই, মুখ লুকানোর জায়গা নেই।

Los Angeles-এ অভিবাসন গ্রহণকারী ফারুখ সাহেব আমাকে বলেন – ‘আমাদের মানুষ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত করবেন না - Our people are individually coward and collectively cruel’ - - - মানে? - সব কথার সবসময় মানে খুঁজতে হয়না। বুঝে নিতে হয় – মনে মনে। সব কথার মানে প্রকাশ করতে হয়না। FREEDOM OF EXPRESSIONS permits us to exercise independence, but not freedom.

আমরা বাঙালী, এক ঘণ্টা কথা বল্লেও এর তাৎপর্য যে কি – তা বোঝা মুশকিল। রসুল একটা মজার গল্প বললো। দুটি ছেলেকে সে আরামবাগের একটা প্রিন্টিংপ্রেস থেকে এনে কাজ করানোর আগে চেয়েছিল – একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে। তারপর কাজ করাবে। উল্টে, কি করে – তারা তাঁকে শিখিয়ে ছেড়েছে। রসুল বলছিল – এটা নাকি ছিল তাঁর জীবনের শিক্ষা।

একটি ঐতিহাসিক ক্রূরতার প্রসঙ্গ এল। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা / স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে লালবাগ কেল্লার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন ১৬৭৮ সালের পরে কেল্লা আওরঙ্গাবাদের দক্ষিণ ফটক নাকি গ্রাস করে নিয়েছিল বুড়িগঙ্গা। এক সুবেদারের পালতোলা বজরা তলিয়ে গিয়েছিল বুড়িগঙ্গায়। আগে – নাকি লোকে নদীকে চিনি-বাতাসা-পান ভেট দিতো – যাতে এর রোষানলে না পড়ে।

আর – ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলে – মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মুহম্মদই বেগ বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। সিরাজের মা আমিনা বেগম এবং খালা ঘষেটি বেগমকে জিঞ্জিরার এক প্রাসাদে বন্দি করে রাখে। তারপর, এই মীরনের নির্দেশে একদিন তাঁদেরে নৌকায় তুলে এনে বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে মারা হয়। আজও লোকে দেখতে চায় – স্থানটি কোথায়?

সকালে- বেলা ১১ টায় সেখানে জলখাবার খেতে দিয়েছে সবাইকে। এ নিয়েও বলাবলি করছে সবাই। পাগলার ঘাটে কি অনেক পাগল! – হয়তো হবে, অথবা- হয়তো নয়। শিশুমন খোঁজে ফিরে অনেক উত্তর। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খুঁজে পেয়েছে তাদের নির্ভয় খেলার স্থল ডেকের রেলিং ঘেরা একপাশে। ম্যারি এন্ডারসন! আগে ছিল, নারায়ণগঞ্জের পথে পাগলায় স্থায়ী নোঙ্গর করা একটি বোট।

এটি কোন প্রমোদতরী নয়! বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ সংস্থার একটি ভাসমান ভেসেল। ভি,আই,পি টার্মিনালে এটিকে একটি রেস্তোরাঁ ও বারে রূপান্তরিত করেছিল এঁরা। পর্যটনের ব্যাবস্থাপনায় পরিচালিত – এটিতে বিহার করা না-গেলেও, সেখানে পানাহারের সুব্যবস্থা ছিল। বিশ্রাম বা শয়নের জন্য রুমও ছিল।

ভাড়াটা একটু বেশী। প্রতি ঘণ্টায় ১০ মার্কিন ডলার বা, তার সমতুল্য টাকা। আর, রাত্রিবাসের জন্য গুনতে হতো ৫০ মার্কিন ডলার বা, তার সমতুল্য টাকা। রাতের কথা জানিনা, দিনের বেলায় ওখানে ভিড় লেগেই থাকতো। যদিয়ো, রীতিমতো আগে ভাগে বুকিং দিয়ে স্থান সংরক্ষণ করতে হতো।

তাতেইবা – কম কি? – পর্যটক আকর্ষণের জন্য এরকমতো হতেই পারে। নদীর পাড়ে সবার সবসময়ই ভাল লাগে। যতীন্দ্র মোহন রায়ের লেখা ‘ঢাকার নদনদী’-তে বলা হয়েছে, একসময় – বুড়িগঙ্গা বংশী নদীরই সম্প্রসারণমাত্র ছিল। নদীর গতি সবসময় পরিবর্তনশীল। বাংলাদেশ এক সুপ্রাচীন জনপদ। কোথায় ছিল – কোথায় এসেছে। এর নদী বাহুল্যও নূতন নয়। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার নদী সংখ্যা ১৯৯৯–২০০০-তে বিষদ বলা আছে।

প্রসঙ্গত বলি - ওই ম্যারি এন্ডারসন, তারপাশেই পাগলা পোর্ট ও বিনোদন পার্ক। আমরা সেখানে গেছিলাম অবসর কাটাবো বলে। খাবো – দাবো – আনন্দ করবো। কিন্তু, সব মিলিয়ে আমার ভাল লাগলোনা। বিনোদন অর্থে বিনোদন সম্ভব হলোনা। সব থেকেও কিসে যেন কি নেই।

ওখানে আমরাতো কতবার গেছি। সবসময়, একই রকম বোধ কাজ করেছে। সব থেকেও – কি যেন নেই। - এটাই যেন আমরা সেবার পুনর্বার উপলব্ধি করলাম। সেখানে অনেক খুঁজেছি – একটা অন্তত সুসজ্জিত ঢাকাই নবাবী বজরা, বা গহনার নৌকো নেই। নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’-য় পড়েছি, সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধের কথা। ফরাশগঞ্জ থেকে বাবুবাজার ৩ মেইল দীর্ঘ বাঁধটির পুনর্নির্মাণ হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর।

১৮৬৪ সালে নাকি ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকাবাসীদের সকাল ৯টার আগে ও বিকেল ৩টার পর ঘাটে স্নান করা নিষেধ বলে ফরমান জারী করেছিলেন। কারণ, উনিশ শতকে লোকদের ঘুরে বেড়াবার প্রধান জায়গা ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে বাকল্যান্ড বাঁধে। অদূরে নাকি লেডিস পার্ক ও পামগাছ শোভিত করোনেশন পার্ক ছিল। নদীর হাওয়া এখন দুষিত। শহরবাসীর গা জুড়বার জন্য নদীর হাওয়া খেতে যাওয়া এখন এক দুঃস্বপ্ন। এসব কথা মনে আসে।

কাকের উতপাতে সব্বাই অতিষ্ঠ। আজ – আমাদের নগরপিতা কত কিছুইনা-করছেন আমাদের জন্য! বর্জ্য নিষ্কাশনতো দূরের কথা, ঠিকমতো মশাটা মারতে পারলেও হয়তো একটুকু ধন্যবাদ দিতে পারতাম। পরিশেষে, আমরাই এটি আবিষ্কার করলাম – সমন্বয়হীনতা, সুচিন্তা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব।

Alfred Hitchcock-এর THE BIRDS যারা দেখেছেন, তাঁরা অন্ততঃ একথা মানবেন যে কাঁকপ্রধান-ঢাকায় এতদিনে কাঁককে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দিলে – এই কাঁকই শহরটাকে পরিচ্ছন্ন রাখতো।

যেভাবে দ্রুত অবস্থার অবনতি হচ্ছে – আর, মানুষের উপর আস্থার স্থানটি ক্রমশ যেভাবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে – তাতে করে বনের পশু-পাখীকেও মানুষের সৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, জননিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার কাজে লাগাতে জানতে হবে বৈকি! আমি কর্নেল র‍্যাঙ্কের কুকুর দেখেছি ভারতে। তাঁদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হনূমান ও বানর সেনাও আছে। আমাদের অন্তত ইঁদুর শেয়াল বিড়াল-সেনা থাকলেও হতো।

আমরা ১৯৭১-এ গেরিলাযুদ্ধ করেছি – এটা আমাদের অনেক বড় সন্মানের স্থান। এরপর – আমরা ক্রমেই গরিলা হয়ে উঠতে লাগলাম। ছিলাম প্রো-শিক্ষিত, হয়ে গেলাম অশিক্ষিত- চোখ থেকেও অন্ধ, মূর্খ। এখন – নিজেদের খাবারে নিজেরাই বিষ মেশাই।

সেখানে বসেই – আমাদের আলোচনায় আসলো - বাকল্যান্ড বাঁধকে তিলোত্তমা করে গড়ে তোলার জন্য শুনেছি পাকিস্তান আমলের শেষদিকে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে একটা মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল। তার কি হল? –‘নদীর দুরবস্থা এই উপমহাদেশে সর্বত্র এক’। এখনো আমরা জানিনা – অনেক কিছু। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর যথাযথ প্রয়োগ সব্বাই দেখতে চেয়েছিল।

আমাদের কাজে ও চিন্তায় সমন্বয়ের বড় অভাব। একটির সাথে অন্যটি, কোনটির সাথে কোনটি ভাল যায় – তা আমরা সহজে মিলাতে পারিনা। আরেকটা ব্যাপার হোল এই যে আমাদের স্বদিচ্ছার বড় অভাব। আর, আমরা বোধহয় সঠিক অর্থে দেশদরদী নই। যদি হোতাম - আমরা এসব দাবী নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতাম।

আমাদের মতো অনেকেরই প্রশ্ন – ‘আমাদের উপমহাদেশের শহর বোম্বের মোহিনী মেরীন ড্রাইভের মতো নির্মল জল প্রবাহিত বুড়িগঙ্গার জন্যে একটা সুদৃশ্য বাকল্যান্ড রিভারাইন ড্রাইভ গড়ে তোলা যায়না’? – এই বুড়িগঙ্গার তীরেই মোঘল যুগে একদিন গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক নগরী ঢাকা। নাগরীরা তা কেমন করে ভুলে গেলেন?

‘একটির সাথে অপরটি সবসময় সম্পর্কযুক্ত’। পারটিকেল ফিজিক্সের ধ্যানজ্ঞান সবার থাকবে – এমন কোন কথা নেই। কিন্তু, মানসিক সাক্ষরতা আর সাধারণ জ্ঞান দিয়েইতো এর বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব। একজন বলছিল, ওপারে ইটভাঁটা – এপারে পার্ক! বা-হ-বাঃ! – আমাদের নদী – আমাদের সম্পদ। এখন-তো নূতন সমুদ্রসীমাও আমাদের অফুরান সম্পদ! এসব কথা সেদিনও আজকের মতো সেখানে বসেও আমরা উচ্চারণ করছিলাম।

এতো সম্পদ আমাদের – কিন্তু, কি হোল? – সব নিয়ে আমাদের কেন এতো হেলাফেলা? – ‘হবেনা কেন?’ - - - ‘আমরা যে সব নবাবের বংশধর।‘ – আরেকজন বলল। যে জাতির আত্মসন্মান বোধ আছে, তাঁদের আত্ম-সমালোচনা একরকম সংস্কার। পাগলার পুল – ফতুল্লা। এটি মীর জুমলার একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য। এটির আজ এ দুরবস্থা - বালির নীচে চাপা পরতে চলেছে।

আর, ম্যারি এন্ডারসন! এটিরও আশপাশ এলাকা মোটেও ভাল ছিলোনা। নোংরা। ইট কঙ্কর কডডাবালি – দুই দিকেই কেবল বালিয়াড়ি। হয়তো তাই – শুকনো ভাবটা কাটাতে অনেকেই সেখানে গলা ভেজাতে যেতো। আর – সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভেজা গলায় একটু নৌকো ভ্রমণের ইচ্ছাতো হতেই পারে। তীরেইতো তরী! - অদূরে বাঁধা থাকতো স্পীডবোট। ভাড়া খাটার জন্য সদা সর্বদা তৈরি।

তবু, প্রশ্ন - ম্যারি এন্ডারসন কেন উঠে গেল? – পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাবে! প্রথমতঃ অলাভজনক, নজরদারীর অভাব, অব্যাবস্থাপনা, চুরি। পরে – পরিত্যাক্ত হয়। এরকম উদাহরনতো অনেক আছে। সব কথাতো এখানে বলা যাবেনা। বিদেশীদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুনেছি প্রকাশ্যে। কারু তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ ছিলোনা। যা হবার তাই হয়েছে। এমন করেই আমরা সব লোপাট করে চলেছি।

আমাদের আছে গৌরবোজ্জ্বল ভাষা আন্দোলন মুক্তি সংগ্রামের গৌরবপূর্ণ ঐতিহ্য, সুপ্রাচীন ইতিহাস ও তার ধারাবাহিকতা। ‘our people can perform their best when they are being challenged’ । সেই সাথে, খারাপ উদাহরণ সৃষ্টিতেও আমরা পিছিয়ে নেই। এত সুন্দর শহরটাকে বিশ্বের ২য় নিকৃষ্ট ভাগাড়ে পরিণত করেছিতো আমরাই! বেদখল বানিজ্য হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক কারবার।

‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ’ – আমরা শুধু মুখে বলি। দেয়ালে দেয়ালে তা লিখে দেয়া উচিত। ধর্ম আর কর্মে আমাদের ফারাক অনেক – দূর করার চেষ্টা নেই। আচরণ ও অভ্যাসে সুনাগরিক হবার শিক্ষা রাষ্ট্র দেয়না – কে দেয়? - পিতামাতা, শিক্ষক, সমাজ।

“পরিবেশ বাঁচাও, জীবন বাঁচাও”– পরিবেশ অধিদপ্তর ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ নামে এক কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলো। এঁদের শ্লোগান ছিল এটি - “পরিবেশ বাঁচাও, জীবন বাঁচাও”। নদী আমাদের প্রাণ। নদী আমাদের রুটিরুজির সংস্থান। নদী আমাদের সব কর্ম পরিকল্পনার মূলে থাকার কথা।

আমরা এত মূর্খ যে মূলটা হারিয়ে মুলোটা ধরে আছি। একসময় শুনেছি এ নদীতে তেজারতির নৌকা ভাসতো – জেলেরা নৌকায় বসে নদীর বুকে জাল ফেলে মহানন্দে মাছ ধরতো। আর, এখন! হতশ্রীর শেষ পর্যায়ে হতচ্ছাড়া হয়ে আমরা ঘুরিফিরি – ফ্লেক্সি করি, এধার মাল ওধার করি, রাত-বিরেতে ফেরি পারাপার করি - তাতে যদি দু’একপয়সা মিলে!

দেবীপ্রসাদ: লেখক, গবেষক ও জ্ঞানকর্মী। ইমেইলঃ deviprasad.mazumder@gmail.com