কবিতার ক্ষেত্রে আমি অনেকটা দৈবে বিশ্বাসী: জাহানারা পারভীনের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 6, 2014 10:22:46 AM

জন্ম : ৩০ মে ১৯৭৫, বাংলাদেশ। পেশা: সাংবাদিকতা । প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: নোঙরের গল্প বাঁচাচ্ছি (২০০২) বর্নায়ণ ।  নিদ্রা সমগ্র (২০০৫) সময় প্রকাশন। মা হাওয়ার সন্তান (২০০৯) সময় প্রকাশন।  জলবৈঠক (২০১০ ) সময় প্রকাশন। প্রবন্ধ : রিলকে নৈঃশব্দে ও নিঃসঙ্গতায়।

কবিতার জন্য পেয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃত্তিবাস পুরস্কার ২০১১, জাতীয় কবিতা পরিষদের শামসুর রাহমান সম্মাননা (২০০৭)। শব্দগুচ্ছ পুরস্কার (২০১২), ছোটকাগজ চৈত্রসংক্রান্তি সম্মাননা (২০০৭)।  

 

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গা থেকে লোককে কিভাবে দেখবেন?

 জাহানারা পারভীন: লিটলম্যাগ শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী। সময়ের প্রয়োজনেই জন্ম এর । প্রতিষ্ঠানের গতানুগতিকতা, আপোষ, সীমাবদ্ধতার কারনে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠাবিরোধিতার প্রসঙ্গ ওঠে।লিটলম্যাগ তার প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ধর্মকে মেনে চলতে চাইলেও এখন অনেক লিটলম্যাগেও প্রতিষ্ঠানের ছায়া পড়ছে।

 

দুপুর মিত্র: ওয়েব ম্যাগ,ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়ার গঠন প্রক্রিয়া চলছে বলে আপনি মনে করেন কি? এখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখবেন। বা লিটলম্যাগেরপ্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা যায় কিনা?

জাহানারা পারভীন: আপনি যদি দৈনিকের সাহিত্য পাতাকে মিডিয়া বলে বিবেচনায় রাখেন তাহলে বলা যায়-মিডিয়া সাহিত্য নিয়ে যা করছে তা মোটেও প্রকৃত সাহিত্যচর্চা নয়। সাহিত্য নিয়ে যে দলাদলি চলছে তার বিপরীতে ব্লগ, ওয়েব ম্যাগের জন্ম আসলে এক প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই প্রতিক্রিয়া জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। আগের চেয়ে ব্লগে লেখার চর্চাও বাড়ছে। মত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আমি ব্লগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় তা লিটলম্যাগের প্রতিস্থাপন হয়ে উঠকে কী না সন্দেহ। আর আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার কারণে মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা আছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। ওয়েব ম্যাগ, লিটল ম্যাগের জায়গা দখল করতে পারলে নতুন নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হত পাঠকের।

 

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? হলে কেন?

জাহানারা পারভীন: লিটলম্যাগের জন্ম একটা দ্রোহ থেকে। তারুন্যের দ্রোহ। প্রথা ও শেকল ভাঙার দ্রোহ। নতুন কিছু করার ইচ্ছে থেকে তৈরী এর। লিটলম্যাগ কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। হতে চায়নিও। তাই প্রতিষ্ঠানেরবিরোধিতা থাকতেই পারে।

 

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

জাহানারা পারভীন: কবি আসলে হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ বলেছেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কথাটা ১০০ ভাগ খাঁটি। এই কেউ কেউ আসলে কবি হয়ে ওঠেন। একটা সময়ে হয়ত ১০০ জন লিখছেন। এই এতজনের মধ্যে ২ জন  বা ৪ জন হয়ত কবি হয়ে ওঠেন। প্রতিভার সাথে চর্চা, সাধনা সময় ও চারপাশের পৃষ্ঠপোষকতাতেই তৈরি হয় একজন কবি।

 

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

জাহানারা পারভীন: কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয় না। কবিতা কবির সৎ উচ্চারণ। প্রকৃত কবির কবিতা তার আয়না। আমার কাছে কবিতা আমার বিশ্বাস, চিন্তা শিল্পভাবনা, জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ। কবিতা সেই সংকেত যে সংকেত নিজেকে,সমাজকে চারপাশকে চিনতে সাহায্য করে। পাশাপাশি নির্মান করে আত্মঘাতি দূরত্ব। জীবনের সাথে জীবনের,নিজের সাথে নিজের।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতারপ্রবণতাগুলো কি?

জাহানারা পারভীন: দুই বাংলার সমকালীন কবিতার দিকে তাকালে দেখা যায় কবিতার অবয়ব ছোট হয়ে আসছে। ষাট বা সত্তরের বর্ণনাধর্মীতা থেকে বেরিয়ে সমকালকে অনকেটা অগ্রাহ্য করে অন্তর্গত আত্মমগ্নতার দিকে ঝুকছে। কিন্তু প্রকাশের সারল্য থেকে বেরিয়ে এলেও গভীরতর বোধের কাছে পৌছার আগেই পথ হারিয়ে ফেলছেন কউ কেউ।

 

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

জাহানারা পারভীন: এটি নির্ভর করে সেই সাহিত্য আন্দোলনে নেতৃত্ব কারা দিচ্ছেন? এবং সময়টা কোন সময়..হাংরি জেনারেশনের কথাই যদি বলি। সে সমযের তরুন কবিদের তা প্রভাবিত করেছিল।যাটের দশকের কণ্ঠস্বর সেই সময়ের কবিতায়,সাহিত্যে বলয় তৈরী করেছিল।

 

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

জাহানারা পারভীন: কবিতার ক্ষেত্রে আমি অনেকটা দৈবে বিশ্বাসী। যেন নাজিল হওয়ার মত কিছু। জোর করে কবিতা লেখারপক্ষে নই আমি। কখনো এমনও হয়েছে এক বসায় কয়েকটা কবিতা লেখা হয়েছে। কখনো এমন হয়েছে দিনের পর দিন একটা চিত্রকল্পও উকি দেয়নি। তখন লেখার জন্য কখনো লিখতে বসিনি। একটা লেখাকে নিজের মত করে তৈরী হতে দিতে হয়।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

জাহানারা পারভীন: বিশ্ব কবিতা বলতে তো সারাবিশ্বের কবিতা বোঝায়। একসময় বিশ্ব কবিতা বলতেই বোঝানো হত, ইউরোপের কবিতা, আমেরিকার কবিরাও উঠে আসেন আলোচনায়। প্রথম বিশ্বের কবিতা যেভাবে অনূদিত হয়ে আমাদের হাতে আসে। কিংবা সাহিত্য পত্রিকাগুলো তাদের নিয়ে মাতামাতি করে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক মেধাবী কবির লেখাও বিশ্বকবিতার পাঠকের হাতে পৌঁছে না। ল্যাটিন,আফ্রিকান বা পূর্ব এশিয়ার ক'জন কবির কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে আমার?

কদিন আগে মায়া এঞ্জেলো মারা যাওয়ায় আমি যতটা দুঃখ পেয়েছি,একই সময়ে মিডিয়ার আলোর বাইরে থাকা কোনো মিশরীয় বা চীনা কবির কথা হয়ত আমার চোখেই পড়ে না। তাই নির্বাসিত চীনা কবি বেই দাওয়ের কথা জানার বাইরে অনেক পাঠকের। তাই মান বিচার,প্রবনতা বিচারের আগে পুরোবিশ্বকবিতাকে জানান জরুরী। যদিও সমসাময়িক পাশ্চাত্য কবিতা থেকে প্রাচ্যের কবিতা আমাকে বেশি টানে।  

 

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

জাহানারা পারভীন: এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর হাতে অনেকটা সময় আসে। ক্লাস, কোচিং পড়াশোনার চাপ নেই। হাতে অখণ্ড অবসর। এই প্রথম এতটা ম্যারাথন সময় পাওয়া গেল। এই সময়েই রাজ্যের সাত পাচ হাজারো ভাবনা ভর করে মাথায়। তখনই একটু একটু করে লেখার শুরু। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে সম্পাদনা করেছি ছোটকাগজ অম্লান। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে পড়ার সময়েই লেখার মূল চর্চাটা শুরু হয়। 

 

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন? 

জাহানারা পারভীন: আমার কাছে কবিতা জীবনের সবচে শুদ্ধ বিষয়। শিল্পের সবচে উচ্চাঙ্গ শাখা। প্রতিটি মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে নিজের মুখোমুখি হয়। নিজেকে প্রকাশের জন্য কবিতার চেয়ে সেরা কোনোমাধ্যম আমার চোখে পড়েনি। একমাত্র নিজের মুখোমুখি দাড়িয়ে নিজের চিন্তাকে নিজের সাথে মেলাতেই কবিতা লিখি। কবিতার চেয়ে সৎ উচ্চারণ আর নেই। প্রকৃত কবির সততার মাধ্যম তার কবিতা। কবিতা আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়, নিজেকে আবিস্কারের উপায়।

 

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

জাহানারা পারভীন: নিজের অন্তর্জগৎ,ভাবনাই আমার কবিতার আতুরঘর। এই ভাবনাকে প্রভাবিত করে রাষ্ট্র, সময়,সমকাল,চারপাশের অসঙ্গতি,বৈষম্য। সমকালের পাশাপাশি, ইতিহাস, পুরাণও আমার লেখার উৎস।