তরুণ কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Apr 24, 2012 7:53:19 AM

স্বকৃত নোমানের প্রকাশিত উপন্যাসগুলো হল "নাভি", "ধুপকুশী" "জলেস্বর" "রাজনটী" "বেগানা"। এই অনলাইন আলাপে বাংলাদেশের সমকালীন উপন্যাস চর্চার হাল-হকিকত বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।

দুপুর: আপনি কি ফ্রি আছেন?

স্বকৃত: আছি। বলুন।

দু: একটা অনলাইন আলাপ চালান যায় যা ওয়েবম্যাগে প্রকাশিত হবে।

স্ব: যায় বটে

দু: আপনি কেন উপন্যাস লিখেন ?

স্ব: প্রথমত, নিজের ভেতর ভাবের যে ফেনিল তরঙ্গ বয়ে চলে তার প্রকাশের জন্য। দ্বিতীয়ত, কেন জানি মনে হয়, পৃথিবীতে আমার কিছু করার আছে। কিন্তু কী করবো? ভেতর থেকে কেউ যেন বলে, উপন্যাস লিখ। তাই লিখি।

দু: তারমানে আপনার উপন্যাস আসলে ভাবমূলক?

স্ব: মোটেই না। কারণ, ভাব তো আমার ভেতরটাতে ঘুর্ণি তোলে। আমি যাদের নিয়ে লিখছি তাদের চরিত্র তো ভাবমুলক নাও হতে পারে। আমি যদি আমার ভাব তাদের উপর আরোপিত করি, তাহলে তো উপন্যাস হবে না।

দু: তার মানে উপন্যাস কোনটা এরকম একটা সংজ্ঞা আপনার ভিতরে আছে। সেটা কি জানতে পারি?

স্ব: উপন্যাসের একটা চিরায়ত কাঠামো তো আছেই। যে কাঠামোতে লিখে গেছেন আমাদের পূর্বজ কথাকারগণ। যে কাঠামোতে লিখলে আমরা বলতে পারি- এই, এটিই হচ্ছে উপন্যাস। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, দস্তয়ভস্কি, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, অমিয়ভূষণ, ওয়ালিউল্লাহ, ইলিয়াস, মার্কেজ- এঁদের উপন্যাস। উপন্যাস লিখতে গেলে সেই কাঠামোটাকে তো সামনে রাখতে হয়। তবে হুবুহু যে ওটাকে অনুসরণ করতে হবে তা নয়। একটু এদিক-সেদিক হবে, ভাঙাগড়া হবে। ভাঙতে ভাঙতে গড়তে গড়তে উপন্যাস হয়ত তার নতুন কাঠামোয় দাঁড়িয়ে যাবে।

দু: আপনি আপনার লেখায় কাদের প্রভাব বেশি দেখতে পান। বা সচেতনভাবে কাদের উপন্যাসের কাঠামোকে অনুসরণ করেন বা আপনি কাদের মত উপন্যাস লিখতে পারলে বেশি খুশি হতেন?

স্ব: আমি আমার লেখায় আমার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই। মাঝেমধ্যে আমাকে সরিয়ে দিয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস- ভাইরাসের মতো এঁরা হানা দিতে চায়। কিন্তু ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারে না। আর কারো উপন্যাসের কাঠামোকেই অনুসরণ করি না। চিরায়ত সংজ্ঞা বা কাঠামোটাকে সামনে রেখে নিজের মতো করে একটা কাঠামো সৃষ্টি করি। এবং আমাকে অন্যদের মতো উপন্যাস লিখতে হবে কেন? আমি আমার মতো লিখতে চাই। যে উপন্যাসটা লিখব বলে আমি খোয়াবের ভেতর দেখি কিংবা জাগরণে কল্পনা করি সেই উপন্যাসটা লিখতে পারলে খুশি হতাম। এতই যে, হয়ত আত্মহত্যাও করে ফেলতাম। কারণ, তখন আমার আর চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু থাকত না।

দু: আপনি বলছেন যে আমি আমার লেখায় আমার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই। সেই প্রভাবগুলো কি ?

স্ব: সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কয়েক শ পৃষ্টার দরকার হতে পারে। তবে, সংক্ষেপে এটা বলা যায় যে, বিশ্বভূগোলের প্রকৃত পৃষ্ঠাগুলো পাঠক করে প্রজ্ঞার যে কণাগুলো আমার ভেতরে জমা হয়েছে, তাতে ‘আমার প্রজ্ঞা’ বলে একটা কিছু দাঁড়িয়েছে বা হামাগুড়ি দিচ্ছে। সেটিই আমি। সেটির প্রভাবই আমার প্রভাব।

দু: বিশ্বভূগোলের সেই প্রকৃতপৃষ্ঠা কোনগুলা?

স্ব: যে গ্রন্থগুলো পড়ে আমরা ঋদ্ধ হই সেগুলোর কথাই বলছি। সেটা হতে পারে হোমারের ইলিয়াড, হতে পারে গ্যাটের ফাউস্ত, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল কিংবা লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা, হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড, ওয়ার এন্ড পিস, অলীক মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি শত শত।

দু: আচ্ছা আপনি কি মনে করেন আমাদের দেশে উপন্যাস চর্চায় বিষয় বৈচিত্র্য খুবই কম?

স্ব: একেবারেই কম। বৈচিত্র্যের দিকে যেতে কেন যেন ঔপন্যাসিকরা ভয় পান।

দু: তারমানে আপনি মনে করেন উনিশ শতকের উপন্যাস চর্চার জায়গা থেকে বাংলা উপন্যাস খুব কমই বের হতে পেরেছে?

স্ব: আপনি সম্ভবত বিশ শতকের কথা বলতে যাচ্ছেন! উনিশ শতকে তো বাংলায় উপন্যাস ছিলই না বলতে গেলে। বাংলা উপন্যাস তো শুরু হলো বঙ্কিমের হাত ধরে। বিশ শতকের কথা বলতে গেলে, উপন্যাস তো বিশ শতকেই লেখা হয়েছে। একুশ শতকে তো আমরা সেরকম প্রভাববিস্তারি কোনো উপন্যাসের দেখা পাচ্ছি না। আমাদের ঔপন্যাসিকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আপনি সম্ভবত বিশ শতকের কথা বলতে যাচ্ছেন! উনিশ শতকে তো বাংলায় উপন্যাস ছিলই না বলতে গেলে। বাংলা উপন্যাস তো শুরু হলো বঙ্কিমের হাত ধরে। বিশ শতকের কথা বলতে গেলে, উপন্যাস তো বিশ শতকেই লেখা হয়েছে। একুশ শতকে তো আমরা সেরকম প্রভাববিস্তারি কোনো উপন্যাসের দেখা পাচ্ছি না। আমাদের ঔপন্যাসিকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

দু: এখনকার উপন্যাস চর্চার সমস্যা তাহলে কি মনে হয়?

স্ব: বাংলাদেশে বর্তমানে উপন্যাস চর্চার সমস্যা যেটা মনে হয় সেটা হচ্ছে, তাড়াহুড়ো। সবার মধ্যে এক ধরণের তাড়াহুড়ো টের পাওয়া যায়। এই তাড়াহুড়োর কারণে দেখা গেল কেউ একটা ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস লিখছেন, সেখানে দেখা গেল ইতিহাস থেকে হুবহু পৃষ্ঠাটাই তুলে দিলেন। তাড়াহুড়োর কারণে উপন্যাসের ভাষার কোনো গভীরতা নেই, বিষয়ের বৈচিত্র নেই, আঙ্গিকে নিরীক্ষা নেই। তদুপরি যে কাজ হচ্ছে না তা নয়। হচ্ছে। তবে হওয়ার মাত্রাটা খুবই কম।

দু: বাংলাদেশের বর্তমান উপন্যাস চর্চার মেইনস্ট্রিম ধারা কোনটি বা আপনার মতে কোনটি হওয়া উচিত ছিল?

স্ব: বাংলাদেশে তিন ধারার উপন্যাস চর্চা চলছে। এক. মূলধারা, দুই. জনপ্রিয় ধারা ও তিন. সংশয়ী ধারা। শেষোক্ত ধারার ঔপন্যাসিকরা ঠিক করতে পারছেন না আসলে কোনদিকে যাবেন। এ তিনটি ধারার ঔপন্যাসিকদের আপনি নিশ্চিয়ই চিনতে পারবেন। সুতরাং খোলাসা করে বলার দরকার নেই যে, এটিই মূল ধারা।

দু: আপনার কি মনে হয় বাংলা উপন্যাসে এখন এনজিও ইস্যু প্রবেশ করেছে বা জোর করে প্রবেশ করান হচ্ছে?

স্ব: না, পাঠযোগ্য উপন্যাস যে কটি বের হয় সেগুলো পড়ে মনে হয়নি।

দু: ধন্যবাদ দাদা, আপনাকে সময় দেবার জন্য।

স্ব: আপনাকেও।