দশক দিয়ে আমি সাহিত্য বিচার করতে চাই না: মুক্তি মণ্ডলের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Sep 19, 2012 6:01:34 AM

প্রকাশিত বই: উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি, পুষ্পপটে ব্রাত্য মিনতি

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

মুক্তি মণ্ডল: এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব সহজ না, কবিতাকে শিল্পমাধ্যম হিসেবে খুব উচ্চতর স্তরের মনে করি, এবং এ মাধ্যমেই নিজের অনুভবকে প্রকাশ করার চেষ্টা করি, যে কারণে কবিতা লিখি। সমাজে ও রাষ্ট্রের যে কাঠামোর ভেতর বসত করি, আরও যেসব নিয়ম-নীতি-নৈতিকতার ঘেরাটোপে প্রতিদিন বেড়ে উঠি – এই বেড়ে উঠার ভেতর উক্ত কাঠামোবদ্ধ সামাজিকতা ও নীতি-নৈতিকতাকে অস্বীকার করে অন্য আর এক কাঠামো গড়ে তোলার অভিপ্রায়েই কবিতা তৈরির পায়তারা বলতে পারেন, যেখানে এক প্রাণের সাথে আর এক প্রাণের মিলন ও বিচ্যুতির স্বপ্নজাল বিস্তৃত, সেসবের অনন্য চিত্রায়ণের ভেতর দিয়ে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকা আর তারই আলোড়নে ব্যক্তির বিকশিত সত্ত্বার দৃষ্টি দিয়ে নিজেকেই বারবার ফিরে ফিরে দেখার ভেতর দিয়ে অন্যকে দেখার জন্য নিজেরকেই বারবার প্রকাশ করার জন্য লিখি, বলা যায় লেখার চেষ্টা করি। আমি মনে করি কবির দৃষ্টিভঙ্গি দূরবীণের মতো হওয়া দরকার, যে কোন এঙ্গেল থেকে যাতে অবলোকন করা যায়, পর্যবেক্ষণ করা যায়, দৃশ্য এবঙ দৃশ্যের অর্ন্তগত বিষয়সমূহ যাতে ছেঁকে তোলা যায়। এইসব দৃশ্যের নানাবিধ সামাজিক মোড়ক উন্মোচন, বা ভাঙন, বা ব্যক্তির নৈর্ব্যক্তিক সংলগ্ন নিবিড়তার চুয়ে পড়া আলো, বা আঁধার যেন উঠে আসে শ্রেণি বিশেষে, উক্ত দৃশ্যের চিহ্ন, অবয়ব এক নাও হতে পারে, বহুবিধ রঙে সজ্জিত থাকতে পারে, এর সঙ্গে জীবনাচরণের নিগূঢ় সম্পর্ক, অভিজ্ঞতার সহমর্মিতা ভিন্ন হতে পারে, এজন্য, আমার মনে হয়, কবির দৃষ্টি যেন, বিবৃত দৃশ্যসমূদয় তুলে আনতে পারে, এগুলো তুলে আনার জন্যই লিখি।

দু: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

মু: লেখালেখির জন্য অবশ্যই প্রস্তুতির ব্যাপার আছে, শিল্পমাধ্যমের যে কোন শাখায় কাজ করতে গেলে তো ওই শাখার আদ্যপ্রান্ত সম্পর্কে একটা বোঝাপড়ার দরকার আছে, ধারাবাহিকভাবে ওই মাধ্যমটি কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমানের আদলে এসেছে – সে সব বিষয়ে পঠন-পাঠনের যেমন দরকার আছে তেমনি স্বদেশ-বৈদেশে ওই মাধ্যমটির গড়ন ও পরিবর্তনের ধারাগুলো বিষয়ে সম্যক একটা ধারণার প্রয়োজীয়তা আছে। এগুলো সম্পর্কে জানার কশেশই প্রস্তুতি পর্যায় বলে মনে হয়, যদিও এই প্রক্রিয়া একজন লেখকের সারা জীবনই করে যেতে হয়, এরই অংশ হিসেবে প্রথমত, নিজের বেড়ে উঠা পরিমণ্ডলকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করাটাই একজন লেখকের প্রাথমিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ধরা যেতে পারে, এটা সবার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তারপর তার চৌপাশ। এরপর দেশ-বিদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করা; সেটা পাঠের মাধ্যমে ও অন্যান্য মাধ্যমেও হতে পারে। এর পর নিজের অভিজ্ঞতার সাথে উক্ত জানা-বোঝা অনুভবের সংমিশ্রণ করে তাকে অনন্য করে তোলা এবং তা লেখার ভেতর চালান করে দেয়া। এগুলোই একজন লেখকের জীবনযাপনের অংশ।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

মু: আমার সময়ে অনেকের লেখাই ভাল লাগে। যাদের লেখার ভেতর বহুরৈখিক ব্যঞ্জনা কালের সীমাকে অতিক্রম করার অনুভব এনে দেয়। সামাজিকতার চিহ্ন ভেঙে দিতে প্ররোচণা দেয়। নাম বলে কৌতুক করতে চাই না। বির্তকও করতে চাই না। এদের সংখ্যা খুব বেশি না। হাতের কর গুণে গুণে হয়ত বলতে পারব। কিন্তু আমি বলবো না। বলতে বাধ্য না বলে।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

মু: যারা চরণ মিলিয়ে ছন্দের চর্চা করে; বালের সাথে তাল মিলিয়ে কবিতা লেখে, এরা বাবার জুতো পায়ে দিয়ে বাবার মতন অভিনয় করে। বাবা সাজে। এদের কবিতা খারাপ লাগে। পারত পক্ষে এদের লেখা না মাড়ানোর চেষ্টা করি।

দু: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

মু: দশক দিয়ে আমি সাহিত্য বিচার করতে চাই না। করিও না। নব্বই এর কবিতা, শূন্যের কবিতা এসব ভাগ বাটোয়ার ভেতর আমি নাই। আমার কাছে মনে হয় তিরিশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি নব্বই ও শূন্যও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে সামনের দিনে। শূন্যের কবিতা – মানে সামনের দিনে কবিতা বহুরৈখিক ও রূপকথার দিকে মোড় নিবে। কবিতায় বাদলের সাথে আদল মিলিয়ে করে খাওয়ার দিন আর থাকবে বলে মনে হয় না। এই ধরণের আবাল পরিস্থিতি শূন্য ও নব্বই দশকের লেখকরা হয়ত এড়াতে পেরেছে বলে মনে হয়।

দু: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

মু: পশ্চিশবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের কবিতার ফারাক আছে। এই ফারাক তৈরি করেছে স্বরের স্বতন্ত্র্যতা ও সামাজিক-রাজনৈতিক-ভূপ্রকৃতি। সাহিত্যের যে রাজনৈতিক জটাজাল আছে মানে ভাল-মন্দ তৈরির ঘেরাটোপ – এই ঘেরাটোপও ফারাক তৈরিতে সহায়তা করছে।

দু: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

মু: ব্লগ সাহিত্য দৈনিক ও লিটলম্যাগের যে এলিটপনা, যে মাতবরীভাব তা একদম গুড়িয়ে দিয়েছে। ব্লগে একজন পাঠক নিজের মত করে কথা বলতে পারে। ব্লগে অনেক নামী-দামী ( যাদের তৈরি করেছে সাহিত্যের রাজনৈতিক ঘেরাটোপ, দৈনিক ও লিটলম্যাগ) লেথকদের নাস্তানাবুদ হতে দেখেছি। এখান থেকেই অনেক লেখকের সাথে আমার চেনা-জানার সুযোগ হয়েছে। যেটা দৈনিক ও লিটলম্যাগ দিতে পারেনি। দিতে না পারা কারণ ওইসব প্রতিষ্ঠান ভাই-বেরাদার এন্ড কোম্পানি। নতুন কারো ওই সুড়ঙ্গে ঢুকা প্রায় অসম্ভব। এই রূঢ় চোয়াল ব্লগ ভেঙে দিয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমি অনেক ভাল লেখকের সাথে পরিচিত হতে পেরেছি ব্লগের সাহিত্য পাঠ করে। ব্লগ সামনের দিনে আরও সোচ্চার হয়ে উঠবে বলে মনে করি। এর ফলে সম্পাদক নামের ভাড় যারা আছে তাদের মাতবরি কমতির দিকে যাবে। সুতরাং ব্লগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দু: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

মু: এর উত্তর আগের প্রশ্নেই চলে এসেছে।

দু: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মু: দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য আমি পাঁচ-সাত বছর পড়ি না। বলতে পারব না।