আবিদ আনোয়ারের স্মৃতিকথা: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্নে কার্জন হল এলাকায় দু’টি ঘটনা

Post date: Oct 7, 2014 5:28:27 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

[বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে ভারতের পলাশী ক্যাম্পে আংশিকভাবে ও পরে চাকুলিয়া ক্যাম্পে পূর্ণাঙ্গভাবে কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি ৩ নং সেক্টরের অধীনে কিশোরগঞ্জ-এলাকায় যুদ্ধ করেছি। ধূলদিয়া রেলসেতু অপারেশনে আমার সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে একজন পাটুন কমান্ডার থেকে উন্নিত হয়ে পেয়েছিলাম আঞ্চলিক কমান্ডারের পদমর্যাদা। ভাঙা রেলসেতুর পারে পরবর্তী যুদ্ধ পরিচালনার স্বীকৃতিস্বরূপ যুদ্ধের পর সমগ্র কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের অধিনায়ক (ক্যাম্প কমানড্যান্ট)-এর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমার আগে অল্প কিছুদিনের জন্য সেই দায়িত্বে ছিলেন পর্যায়ক্রমে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও লেফটেন্যান্ট সাদেক। তখন আমি কাজ করেছি পরপর এদের দুজনেরই টু-আই-সি হিসেবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্নে কার্জন হল-এলাকায় আমরা যেসব দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছি, তা ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে, কারণ তখন আমরা ছিলাম নিরস্ত্র। ধরা পড়লে মৃত্যু ছিলো অবধারিত।- আবিদ আনোয়ার]

শেখ ফজলুল হক মণি, আ স ম আবদুর রব, তোফায়েল আহমদ, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শেখ শহীদুল ইসলাম, মার্শাল মণি প্রমুখ ছাত্রলীগ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দের নির্দেশে হাইকোর্টসংলগ্ন আবদুল গনি রোডের মোড়ে স্থাপিত পাক-সেনাদের ক্যাম্পের কাছেই, দিনের বেলায়, বলতে গেলে তাদের নাকের ডগায়, এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালিত হয় মার্চ মাসের ১৩ তারিখে কার্জন হল এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় তখন অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ছিলো, কিন্তু ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের রাজনীতিসচেতন আমরা অনেকেই হল ছাড়িনি।

কার্জন হল চত্বরে অবস্থিত রসায়ন বিভাগ, প্রাণরসায়ন বিভাগ, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগের সবগুলো গবেষণাগার ও স্টোর ভেঙে বোমা তৈরির উপযোগী সব রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে যেতে উল্লিখিত ছাত্রনেতারা দুটি পিক-আপ ভ্যান নিয়ে আসেন দুপুরবেলা। রাসায়নিক পদার্থ চিনতে সক্ষম এমন কয়েকজনকে তাঁরা নির্দেশ দেন মূল অপারেশনে অংশ নিতে। রসায়ন বিভাগের আমি নিজে, জনাব আলাউদ্দিন আহমেদ (যার পরিচয় আগে উলেখ করেছি), ছাত্রলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া (বর্তমানে ন্যাটো সদর দপ্তরে কর্মরত), প্রাণরসায়ন বিভাগের জনাব আনোয়ার হোসেন (কর্নেল তাহের-এর ছোটভাই এবং বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চান্সেলর) এবং অন্য কয়েকজন মিলে এই অভিযান সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করি। আমরা সবাই ছিলাম ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র এবং অনার্স কিংবা এমএসসি-র শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত। আমরা সেসময় নিরস্ত্র হলেও সেই ঘটনাটিকে অবহিত অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অপারেশন বলে গণ্য করেন। কার্জন হল এলাকার সবগুলো ল্যাবরেটরি ও স্টোর থেকে নেতাদের নিয়ে-আসা দুটি পিক-আপ ভ্যান বোঝাই করে আমরা তেরপল দিয়ে ঢেকে দিই। সন্ধ্যা ৬টায় পূর্বঘোষিত কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হলো জিঞ্জিরার এক গোপন আস্তানায় যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং-বিদ্যায় পারদর্শী ছাত্রনেতা হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে বোমা তৈরি হতো।

কার্জন হলে আমরা যে-কাজটি করার দায়িত্ব পেয়েছিলাম তা খুব গোপনে করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। ফজলুল হক হল ও ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল)-এর মধ্যবর্তী পুকুরের দক্ষিণপারে সেমি-পাক্কা কিছু কোয়ার্টারে তখন বসবাস করতেন কার্জন হল এলাকার সব স্টোর-কিপার ও পিয়ন-দারোয়ান। স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত অন্যান্য বাঙালির মতো তারাও পাকিস্তানিদের ভাষায় আমাদের সেই নাশকতামূলক’(!) কাজটিতে অংশগ্রহণ করার জন্য আমাদের ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেন। তাঁদের কাছে রক্ষি চাবি দিয়ে স্টোর ও গবেষণাগার খুলে দিয়ে তাঁরা আমাদের কাজে সহায়তা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না-পারে সেজন্য দরজার কড়া ও তালাগুলো তারা নিজেরাই নানা উপায়ে ভেঙে ফেলেন।

গোপনীয়তা রার সব চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হলো কারণ প্রকাশ্য দিবালোকে এ-কাজ করা হয়েছিলো এবং অনেক পাকিস্তানসমর্থক ছাত্রশিক্ষক তা প্রত্যক্ষ করেছিলো এ-কথা বলাই বাহুল্য। মার্চের ১৯ তারিখে রাতের বেলা ডাকসু ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের কাছে জরুরি খবর পাঠালেন সে-কাজে আমরা যারা জড়িত ছিলাম তারা সবাই যেন হল ছেড়ে চলে যাই। কারণ আমাদের সবার নামের তালিকা তৈরি হয়ে গেছে এবং রেজিস্ট্রার অফিস থেকে আমাদের ছবিও সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশ-মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে মৃত্যু অবধারিত-তা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হোক কিংবা গুলি করেই হোক।

পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কার্জন হল এলাকায় আমাদের অন্য একটি অপকর্মও (!) উল্লেখের দাবি রাখে এবং তার চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে কার্জন হলের মূল ভবনের সামনের দেয়ালে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ১৬ তারিখ আমরা ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের কিছু ছাত্র মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সন্ধ্যার পর কারফিউর সময় কার্জন হল ও হাইকোর্টের মাঝখানকার রাস্তা দিয়ে আবদুল গণি রোড কিংবা সচিবালয় এলাকা থেকে পাকসেনাদের যে টহল গাড়ি আসে তার জন্য গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরি করতে হবে-এমনভাবে কাটতে হবে যেন গাছটি পড়ার মূহুর্তে পাকসেনাদের একটি টহলগাড়িতে পড়ে এবং কিছু মিলিটারি মারা পড়ে! আমাদের কিছু উর্বর (!) মস্তিস্কের সেই মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অবশ্য পুরোপুরি সফল হয় নি। তবে, গাছ কেটে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরির কাজটিতে আমরা সফল হয়েছিলাম। সেটিও ছিলো একটি দুঃসাহসের কাজ কারণ খুব কাছেই হাইকোর্টের মাজারের সামনে ছিলো পাকসেনাদের ক্যাম্প।

হাইকোর্টের দিকের একটি ইউক্যালিপটাস গাছকে কাটার জন্য টার্গেট করা হলো কারণ সেটি এমনিতেও কিছুটা কার্জন হলের দিকে ঝুঁকে ছিলো এবং কার্জন হলের দিককার একটি মেহগনি গাছের ডালের খুব কাছাকছি তার বিস্তার ছিলো। নিজেদের কয়েকজনের টাকায় নাইলনের মোটা দড়ি এবং দুইপাশে কাঠের বাঁট-লাগানো ছোট দুহাতী করাত কিনে আনা হলো বংশালের একটি হার্ডওয়্যার দোকান থেকে। অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে আমাদের মধ্য থেকে একজন দু গাছীকে নাইলনের দড়ি হাতে উঠিয়ে দেওযা হলো ইউক্যালিপটাস গাছের প্রায় ডগায়। সেখানে দড়ি বেঁধে তার বাকি অংশ সে ঢিল দিয়ে ফেললো কার্জন হলের দিককার মেহগনি গাছের ডালে। কাজ সেরে ফিরে আসলে সে উঠলো সেই মেহগনি গাছে। সেখান থেকে রশি ছেড়ে ধরিয়ে দিলো কার্জন হলের দেয়াল-প্রাচীরের ভেতরদেশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে-থাকা আমাদের হাতে।

সকলে মিলে ঠিক করলাম এখন রাস্তা পার হয়ে দুজন যাবে করাত দিয়ে হাইকোর্টের দিককার ইউক্যালিপটাসের গোড়া কাটতে। আমরা এপার থেকে দড়িতে টান লাগাবো যেন গাছটি রাস্তার ওপর আড়াআড়িভাবে এসে পড়ে এবং চেষ্টা চালাবো যেন পাকসেনাদের কোনো টহলগাড়ি রাস্তার এ-অংশ পাড়ি দেয়ার সময় তার ওপর গাছটিকে ফেলতে পারি। করাত নিয়ে দুজন গাছের গোড়ায় গিয়ে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাটা শুরু করলো উত্তরদিক থেকে অর্থাৎ যেদিকে আমরা গাছটিকে ফেলবো তার বিপরীত দিক থেকে। আমরা এপারে দাঁড়িয়ে করাত চালানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। করাতীদের বলে দেওয়া হয়েছিলো কোনো টহলগাড়ি কাছাকাছি এসে পড়লে যেন করাত চালানো বন্ধ রাখে কারণ গাছ কাটার শব্দ শুনতে পারলে ওরা ধরা পড়বে পাকসেনাদের হাতে। ওরা তাই করলো।

তৃতীয় গাড়িটি কার্জন হলের বোটানিকেল গার্ডেন এলাকার মাঝামাঝি এসে গেলে গাছের গোড়া থেকে আমরা মটমট শব্দ শুনতে পেলাম এবং আমাদের হাতের দড়ির টান খেয়ে কয়েক মূহুর্তেই আড়াআড়িভাবে গাছটি রাস্তায় পড়ে গেলো। পাকসেনাদের টহলগাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে থমকে গিয়ে বুঝতে পারলো কিছু দুস্কৃতিকারীর (!) কাজ এটি। ওরা কার্জন হল ও পুরানো হাইকোর্ট ভবন দুদিকেই অজস্র গুলিবর্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু ভাগ্যিস কারো গায়ে লাগেনি। আমরা দৌড়ে পালিয়ে গেলাম কার্জন হলের মূল ভবনের পেছনে তখনকার জিওলজি ভবনের দিকে

দুটি টহলগাড়ি ইতোমধ্যে চলে গেছে। তৃতীয় গাড়িটি কার্জন হলের বোটানিকেল গার্ডেন এলাকার মাঝামাঝি এসে গেলে গাছের গোড়া থেকে আমরা মটমট শব্দ শুনতে পেলাম এবং আমাদের হাতের দড়ির টান খেয়ে কয়েক মূহুর্তেই আড়াআড়িভাবে গাছটি রাস্তায় পড়ে গেলো। পাকসেনাদের টহলগাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে থমকে গিয়ে বুঝতে পারলো কিছু দুস্কৃতিকারীর (!) কাজ এটি। ওরা কার্জন হল ও পুরানো হাইকোর্ট ভবন দুদিকেই অজস্র গুলিবর্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু ভাগ্যিস কারো গায়ে লাগেনি। আমরা দৌড়ে পালিয়ে গেলাম কার্জন হলের মূল ভবনের পেছনে তখনকার জিওলজি ভবনের দিকে এবং ওপারের করাতীরা পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক দৌড়ে চলে গেলো পুরানো হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রাচীন আমলে তৈরি একটি জরাজীর্ণ মসজিদ ভবনের আড়ালে, যার কাছেই তিন জাতীয় নেতার সমাধিস্থল; এখন সে-স্থানটিকে দোয়েল চত্বরনাম দেওয়া হয়েছে। পালাতে-পালাতে টের পেলাম কারো গায়ে না-লাগলেও আমাদের প্রায় শরীর ঘেঁষে অজস্র গুলি গিয়ে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে কার্জন হলের মূল ভবনের সামনের দেয়াল। পরের দিন সেখানে গিয়েও তা-ই দেখলাম এবং দেয়ালের তি হয়েছে কি না এবং মেরামতের প্রয়োজন আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য বেনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগে একটি চিঠি পাঠালাম। কিন্তু তারা পরীক্ষা করেছেন বলে মনে হয়নি কিংবা পরীক্ষা করলেও দেয়ালের কোনো তি হয়নি বলে এখনও কোনোকিছু করা হয়নি।

আজ থেকে দশবারো বছর আগে রমনার বৈশাখি মেলা থেকে সপরিবারে আমি গিয়েছিলাম কার্জন হল এলাকায়। আমার কাসমেট রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাদের তখন ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট। তাঁর বাসায় বৈশাখি খাওয়া-দাওয়া সেরে কিছু লম্বা টুথপিক হাতে গিয়েছিলাম কার্জন হলের সামনের দেয়ালের কাছে। মজা করার জন্য আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের কাছে বললাম: একটা জিনিস দেখবে তোমরা? আমি এইসব টুথপিক দিয়ে কার্জন হলের এই দেয়াল ছিদ্র করতে পারবো! ওরা কিছু বুঝতে না-পেরে অবাক হয়ে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। উপর্যুপরি রঙের আস্তর পড়ে কিছুটা ঢেকে গেলেও আমার চেনা ছোটছোট গর্তগুলোতে টুথপিক ঢুকিয়ে দিলাম এবং সবগুলোতেই টুথপিকের পুরোটাই ঢুকে গেলো। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এগুলো কী জানতে চাইলে প্রথমে বললাম: এটি আমার ম্যাজিক!পরে সেখানে বসেই সবিস্তারে ওদের কাছে একাত্তরের মার্চ মাসের ১৬ তারিখের রাতের ঘটনাটি বললাম।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে স্বাধীনতার পর প্রকাশ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগকে অবহিত করেছি। তবে, সংখ্যায় অজস্র হলেও সম্ভবত গুলিগুলো বেশি ভিতরে ঢুকতে পারে নি এবং দেয়ালটি এখনও ঝুঁকিমুক্ত। কালের বিবর্তনে দেয়ালটি যেদিন ভেঙে যাবে কিংবা ভাঙা হবে সেদিন বেরিয়ে আসবে সোনালি রঙের কিছু বুলেট যার টার্গের্ট ছিলো আমাদের শরীর।

ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি-প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরিতে নিয়োগ-সংক্রান্ত কাজে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটনামের একটি কাগজের মূল্য অপরিসীম। কারো চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে সার্টিফিকেট-দাতাকে লিখতে হয় To the best of my knowledge, he/she did not take part any activity subversive of the state or of discipline” কিংবা বাঙলাভাষায় আমার জানামতে তিনি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কিংবা শৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজে জড়িত ছিলেন না।কার্জন হল এলাকায় একাত্তরের মার্চ মাসে আমাদের কাজগুলো সত্যিকার অর্থেই ছিলো রাষ্ট্রবিরোধী এবং শৃঙ্খলার পরিপন্থি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের ফলে সেসব কর্মকাণ্ড আজ চারিত্রিক ত্রুটির বদলে চিহ্নিত হয়েছে মহৎ কাজ হিসেবে। তাই আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর তথাকথিত রাষ্ট্রবিরোধী ও শৃঙ্খলার পরিপন্থিসেই কাজে অংশগ্রহণের ঘটনাকে অকাতরে অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারছি। বিজয়ের এই বুঝি সুফল। এরই নাম হয়তো স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু না-হলে কার্জন হল এলাকায় আমাদের নাশকতামূলক (!)কাজগুলোর পরিণাম আমাদের জীবনে কী বয়ে আনতো তা সহজেই অনুমেয়।

৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর কারো বুঝতে বাকি ছিলো না, যতই তিনি ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান না কেন, তিনি না-চাইলেও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্নে ছাত্রনেতাদের সেই নিরস্ত্র অপারেশন তাদের দূরদর্শিতার পরিচয়বাহী। ছাত্রসমাজ স্বাধীনতা অর্জনের সব চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মেই এগিয়ে ছিলো। বাংলাদেশের পতাকা তৈরি হয়েছে তাদের হাতে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিজহাতে সেই পতাকা উড়িয়ে, স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করে, স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিয়েছেন ছাত্রনেতারাই।