প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা একটা মিথ বলেই আমার মনে হয়: ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Apr 29, 2014 3:45:44 AM

প্রকাশিত বই: বিকেলে হ্রদের ধারে, জিরাফের বাগান।

দুপুর মিত্র: আপনি কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেছেন?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: প্রথমে কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল। সুদীর্ঘ চাকরি জীবনের দ্বিপ্রহরে ছেদ পড়ে যায় কাব্যচর্চায়। এখন শীতের বিকেলে রোমন্থন করি ফেলে আসা সময়, হারিয়ে যাওয়ামুখ। বসি চাঁদমারির মাঠে, উড়িয়ে দিই ভুলগুলো ছেঁড়া কাশফুলগুলো। এই সময়ে আন্তর্জাল বিপ্লব ঘটে যায় আমার এবং সমসাময়িক অনেকের জীবনে। ইংরেজি কি বোর্ডে বাংলা টাইপে স্বচ্ছন্দ হয়ে যাই এবং অর্কুট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ি সাহিত্যিক কবি পাঠকবর্গের কাছে পারস্পরিক ভালবাসার জগতে। বিগত পাঁচ ছয় বছর ধরে নিয়মিত লিখছি। কিছু লেখা ছাপাও হচ্ছে।

দুপুর মিত্র: আপনার সবচেয়ে সফল কাজ কোনটা?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: এখনও পর্যন্ত ‘বিকেলে হ্রদের ধারে’ নামক কবিতার বইটি।

দুপুর মিত্র: আপনি কি বিশেষ কোনও পাঠককে সামনে রেখে লিখেন না বিশেষ অডিয়েন্সকে?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: আমি মূলত লিখি নিজের আনন্দে। তবে পৌছতে চেষ্টা করি যত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে সম্ভব। বাংলা ভাষা পড়তে ও বুঝতে এমন যে কোন ব্যক্তিই আমার নিশানা পাঠক।

দুপুর মিত্র: সাহিত্যের কি সামাজিক বাধ্যবাধকতা আছে? এ নিয়ে আপনার ভাবনা কি?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: আমি মনে করি আছে। আমি মনে করি সাহিত্য বিশেষত কবিতা প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে সমাজকে তুলে ধরবে। সমস্যা এবং অবক্ষয়কে দেখাবে। একই সঙ্গে একটা সমাধানের ইঙ্গিতও দেবে। একটা ইউটোপিয়া বা আদর্শ ব্যবস্থা তথা মনোবৃত্তির কথাও বলবে। হয়ত তা অবাস্তব, কিন্তু তা ভালো। এই ভালোটা যদি কবির চিন্তায় থাকে তাহলে পাঠকের মননেও তার প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। সম্পূর্ণ আদর্শ ব্যবস্থাপনা তথা মনোবৃত্তিতে পৌঁছন সম্ভব না হলেও অন্তত কিছুটা কাছাকাছি তো পৌঁছন যেতেই পারে।

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: আমি জানি না কবি হয়ে উঠতে পেরেছি কিনা। তবে কবি হয়ে ওঠা আমার কাছে এক আধো ঘুমের স্বপ্ন যা পুরোপুরি ধরা দেয় না অথচ নিয়ে যায় অন্য এক জগতে যেখানে পারিপার্শ্বিক দৃশ্য আর শব্দ মিলিয়ে যায়। এক নতুন জগতে পৌঁছে যেতে পারি অনায়াস অভিযানে।

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: কি করলে কবিতা হয় কোনটা কবিতা অথবা তা নয় কে বলবে! কে বলবে কখন কোন সুর বাজে মনে, আলতো পায়ে নূপুর নিক্বণে কোন শব্দ ছুঁয়ে গেল মন।কখন ঢাকনা খোলে শব্দ ও দৃশ্যের। অনুভূতিগুলো সতেজ রাখি, চোখ মেলে দেখি, কান পেতে শুনি। অনুভূতির পারদ ওঠানামা করে। অবাধ্য কলম পাতার শূন্যতাকে পূর্ণ করে আঁকতে থাকে ছবি। কবিতা বললে ভালো। নয়তো কিছু নয়।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতা একাধিক। আমি যেমন ধ্রুপদী লেখা যথা রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ ইত্যাদির প্রভাব প্রচুর মাত্রায় দেখি-একটু আঙ্গিক পালটে বলার চেষ্টা দেখি- তেমনি খুব সোজা ভাবে বলা কথাও নজরে আসে। দেখি অ্যান্টি কবিতার প্রভাব-নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষাও নজরে আসে। আবার সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য কথার চাষে বাজিমাতের চেষ্টাও নজরে আসে। সেই অর্থে কোন বিশেষ কবি, কবি গোষ্ঠী বা ঘরানা এই মুহূর্তে রাজত্ব করছে বলে মনে হয় না। হয়ত একটা থিসিস অ্যান্টিথিসিসের পর্যায় চলছে। সিন্থেসিস আসতে কিছুটা দেরী।

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: অবশ্যই করে। তবে তার প্রভাব তখনই পড়বে যদি সে আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে।

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: আমি কবিতা লিখি না, কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। তবে ইনপুট যে কোন জিনিষ হতে পারে। কোন খবর, কোন সাহিত্য, কোন ফিল্ম, কোন প্রবন্ধ, কোন ভাস্কর্য, কোন আকা ছবি, আকাশ, বাতাস, মাটি, ঝড়, সমুদ্র, পাহাড় – যা খুশি তাই। নিজের ভাবনা একটা আকার পেতে শুরু করে। তখন সময়ে সময়ে একই বিষয়ের ওপর বেশ কিছু কবিতা পড়ে নিই। কিছু বিদেশি কবিতাও পড়ি। তারপর সব বন্ধ করে কাগজ কলম নিয়ে বসি। যেটুকু নির্যাস আউটপুট তৈরি হয় তা হয়ত ইনপুটগুলোর থেকে আলাদা।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: একটা ইমোশনের ফারাক দেখতে পাই। বাংলাদেশের কবিতায় ইমোশন অনেক বেশি।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: অবশ্য নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। লেখকদের জন্য পদচারণার নতুন অঙ্গন সৃষ্টি করছে।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: হ্যাঁ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে বসে মাউস ক্লিক করে ব্লগে পৌঁছে যাওয়া লিটলম্যাগের কাছে পৌঁছনর থেকে অনেক সহজ। অবশ্য কিছু মানুষ কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী নন। তাঁদের উপায় থাকে না। কিন্তু আগামীদিনে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাবে। প্রতিটি সাক্ষর মানুষের কাছে কম্পিউটার ক্রমশ আবশ্যিক হয়ে উঠছে।

দুপুর মিত্র: ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়ার গঠন প্রক্রিয়া চলছে বলে আপনি মনে করেন কি? এখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখবেন। বা লিটলম্যাগের প্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা যায় কিনা?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: হ্যাঁ। তবে এই প্রক্রিয়াটা যতটা চেষ্টাকৃত ঠিক ততটাই অনায়াস। এটা হতেই হবে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মাধ্যমে নতুন প্রাতিষ্ঠানিকতা উৎপাদন করার চেষ্টা বলাযেতে পারে। আমি পরস্পরকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখতে চাই। লিটলম্যাগের গুরুত্ব কমলেও তা বিলুপ্ত হবে না। দিনের শেষে ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখা বা অন্যের লেখা পড়ার আনন্দের তুলনা হয় না। খবর নিলে হয়ত দেখবেন ব্লগ ইন্টারনেট ফেসবুকের প্রভাবে হয়ত লিটলম্যাগের প্রচার বেড়েছে বা বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু আগে যে কথা বলেছি সেই প্রেডিকশন এখনও করছি। ব্লগের জনপ্রিয়তা লিটলম্যাগকে ছাড়িয়ে যাবে, কিন্তু বিনাশ করতে পারবে না।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? হলে কেন?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা একটা মিথ বলেই আমার মনে হয়। লোককে দলে টানার জন্য এই সব কথা।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত: মাঝে মাঝে দৈনিকের সাহিত্য পড়লে চমকে যেতে হয়। কিন্তু আমি যে দৈনিক কাগজগুলো রাখি সেখানে কবিতা থাকে না। দৈনিকে দৈনিক কবিতার পাতা থাকলেকবিতার জনপ্রিয়তা আরও বাড়ত।