সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন হতে পারছে না: আহমাদ মাযহারের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Nov 4, 2013 5:44:48 PM

প্রকাশিত বই: কবিকথন-শামসুর রাহমানের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার - শুদ্ধস্বর। আধুনিকতা: পক্ষ বিপক্ষ - অনন্যা। আবদুল মান্নান সৈয়দ : সর্বস্বত্তানিমগ্ন সাহিত্যিক - পাঠক সমাবেশ। বাংলাভাষার সেরা রূপকথা - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- বিউটিবুক হাউস। জাদুর আপেল - কথা প্রকাশ । বাংলাদেশের নির্বাচিত রম্যরচনা ও গল্প - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র । উপেন্দ্রকিশোরের ছোটদের সেরা গল্প -বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। অবনঠাকুরের ছোটদের তিনটি সেরা গল্প -বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ছোটদের আরব্য রজনীর সেরা গল্প - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কিশোর বিশ্বসাহিত্য সংগ্রহ - চারুলিপি প্রকাশন। আমার উপেক্ষিত কবিতাগুলো - সংবেদ।

দুপুর মিত্র: আপনি দীর্ঘদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করেছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে আপনি দেখেছেন। কণ্ঠস্বর পত্রিকার সেই ষাটের দশকের সায়ীদ স্যার আর বর্তমান বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফান্ডে গড়ে ওঠা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সায়ীদ স্যার।মিল-আমিলগুলো কি কি ?

আহমাদ মাযহার: হ্যাঁ, দীর্ঘদিন, প্রায় ১৭ বছর আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নানা দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। এই দীর্ঘ সময় ধরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি। তাঁর রয়েছে ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব। নিজের মধ্যে যেমন বিপুল প্রাণশক্তিকে ধারণ করেনতেমনি অন্যদেরও বিশেষ করে তরুণদের পারেন উজ্জীবিত করতে। এটাই তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বিশিষ্ট দিক। তরুণ বয়স থেকেই তিনি সাহিত্যোজ্জীবিত মানুষ। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রীতি আর সাহিত্যের সরসতার সঞ্জীবনে তিনি পরিণত হয়েছেন প্রসন্নহৃদয় ব্যক্তিতে।তাঁর অন্তর সবসময় উৎসাহে অস্বস্ত, অস্থির। সাহিত্য-আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব দানের পেছনে ছিল তাঁর সেই উৎসাহী হৃদয়ের তাড়না। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার প্রেরণা তাঁর দুর্মর! ফলে সাহিত্য পত্রিকা বার্ধক্যের কর্ম নয় জেনেও পত্রিকা সম্পাদনা থেকে বিরত হতে পারেননা। ষাটের দশকে, তাঁর যৌবনের কালে, চেয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার সাহিত্যের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে আলাদা একটা সাহিত্য রুচি গড়ে তুলতে। তিনি নিজে ঐ সময়ের নাম দিয়েছিলেন ‘আগন্তুক ঋতু’। যুগপৎ আদর্শ ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের প্রতিভূ ছিল সেসাহিত্যের আন্দোলন। তিনি ছিলেন অবক্ষয়ার্ত বেদনাতুর দলের নেতৃত্বে। গদ্যে এক ধরনের শৈল্পিক পরিচর্যা তাঁর সম্পাদিত কণ্ঠস্বর পত্রিকার পৃষ্ঠায় দেখা গিয়েছিল। অর্থাৎ মননশীলতার সঙ্গে শৈল্পিক সংরাগ উভয়কে যাচ্ঞা করেছিল কণ্ঠস্বর পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলো। নতুনঅবক্ষয়িত ধারার লেখকদের সনাক্ত করা যাচ্ছিল কণ্ঠস্বরের পাতায়। ঐ পত্রিকায় তরুণ লেখকেরা আক্রমণ করছিল প্রবীণ লেখকদের নানা অন্তসারশূন্যতাকে। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের একটা উজ্জ্বল মুখপত্রে পরিণত হয়েছিল কণ্ঠস্বর। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সেসময়ের কাজে ছিল তারুণ্যের উন্মত্ততা। আমি তাঁর সে সময়ের কাজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, যদিও সেই সময় থেকে অনেক দূরে এসে অনুভব করা যায় যে, সেই সাহিত্য আন্দোলনের কিছু বড় সীমাবদ্ধতাও ছিল। তবে ঐসব সীমাবদ্ধতা কণ্ঠস্বরের উজ্জ্বলতাকে ঢেকেদিতে পারবে না।

পরিণততর বয়সে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অনুভব করলেন যে সত্যিকারের মননশীল, রসিক ও কার্যকর মানুষ ক্রমশ কমে যাচ্ছে সমাজ থেকে। এই অনুভব তাঁকে হতাশ ও নিশ্চেষ্ট করে ফেলতে পারে নি। এর প্রতিকারের জন্য তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে শুরুকরলেন বই-পড়া আন্দোলন। তিনি মনে করেছেন যে জ্ঞান ও আনন্দের মধ্য দিয়ে যে-মানুষটির হৃদয় প্রস্তুত হয় সে ব্যক্তিটি সমাজে একজন সক্রিয় ও ইতিবাচক মানুষ হিশেবে প্রতিভাত হয়! কোনো আদর্শবিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের দীক্ষাক্ষেত্র নয় কেন্দ্র। বরং কেন্দ্রকিশোর-তরুণ মুখগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলতে চায় যারা সন্ধান করবে উচ্চ আদর্শ ও উচ্চ মূল্যবোধকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচি অন্যান্য বইপড়া সংক্রান্ত আন্দোলনগুলোর চেয়ে এখানেই পৃথক। অন্তত আমি তাঁর সঙ্গে থেকে এমনটিই বুঝেছি। গতানুগতিকসাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এর পার্থক্যও ছিল লক্ষণীয়। আর দশটা এনজিওর মতো কাজ করতো না বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। মুক্ত মনে কথা বলবার একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট ছিল কেন্দ্র। একজন মননশীল তরুণের জন্য যে সাংস্কৃতিক পরিম-ল কাক্সিক্ষতবিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ক্রমশ সৃষ্টি করে চলছিল সেই পরিবেশ। সঙ্গত কারণেই প্রথমদিকে এই সংগ্রাম ছিল অনেক দুঃসহ। বিদেশি নয়, দেশের খুব স্বল্পসংখ্যক বিত্তবান মানুষের সামান্য সহায়তার ওপর নির্ভর করে এগিয়ে চলছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। এর সাংগঠনিকতায় ঘটেছিলঅনেকের আত্মত্যাগের সমাহার। অনেকগুলো ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র হয়ে উঠছিল সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের উৎস। আমি কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম ঐ পর্বে। আমার নিজের মানসপৃথিবী গড়ে উঠেছিল কেন্দ্রের ঐ সাংস্কৃতিক পরিম-ল থেকেই! আমি গ্রামীণ পটভূমির নি¤œবিত্তপরিবারের সন্তান বলে তখনকার ঢাকার উন্নত সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত হবার সুযোগ গ্রহণের উপায় খুঁজে পাই নি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রই আমাকে কার্যকরভাবে এই পরিম-লে প্রবেশের দ্বার খুলে দিয়েছে। ওখানে গিয়েই আমি উচ্চ মানের বিপুলসংখ্যক বই-পত্রিকা পড়বারসুযোগ পেয়েছি, বিচিত্র সংগীতের আস্বাদ গ্রহণের সুবিধা পেয়েছি, পেয়েছি বিশ্বসেরা চলচ্চিত্র উপভোগ করবার অগ্রাধিকার! সবচেয়ে বেশি যেটা পেয়েছি তা হলোÑ সপ্রাণ, রসিক, সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষায় কম্পমান, আদর্শে উজ্জীবিত ও স্বাপ্নিক অনেক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ- পরিচিত হবার সহজ পরিবেশ। অসম অবস্থানে থেকেও সামর্থ্যবান মানুষদের পঙ্ক্তিভুক্ত হয়ে কথা বলবার সাহস অর্জন করেছিলাম আমরা। আমাদের সমসাময়িকেরা যারা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেতেন তাঁদের ব্যক্তিত্বগঠনে বই-পড়া নয় কেবল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এইঅবদানটিকেই আমার কাছে সবচেয়ে বড় মনে হয়।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মীদের মধ্যে তখন অনেকটা মিশনারিদের মতো আবেগ কাজ করত। মনে আছে এনজিওদের নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল বলে দীর্ঘকাল এমনকি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নাম এনজিও ব্যুরোতেও রেজিস্ট্রি করতে যায় নি। প্রথম দিকে কেন্দ্র পরিচালনার অর্থ সংগ্রহছিল খুবই কঠিন। বেসরকারি খাত তখনও এখনকার মতো এত বড় হয় নি। কথায় কথায় স্পন্সর পাওয়া যেত না। যাদের কিছু অর্থবিত্ত ছিল তাদের মধ্যে সমাজকর্ম বলতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দেয়া আর স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার অর্থপ্রদানের রীতি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেউৎসাহ ছিল বিরল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে যে পরিচিতি ছিল তার সুবাদে কিছু ধনশালী ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেছিল। তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই তখন প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। তাঁরাও কারো কারো সঙ্গে তাঁরযোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের কাছ থেকে যা পাওয়া যেত তার পরিমাণ ছিল খুবই কম। ফলে অনেক দুর্ভোগের মধ্যে কেন্দ্রের কর্মীদের কাজ করতে হতো। অনেকেই বিভিন্ন কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন যাঁরা পরিপূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রম দিতেন সেখানে। ফলে স্বল্পব্যয়ে অনেককিছু করে ফেলতে পারতাম আমরা। যাঁরা অর্থ দান করতেন তাঁরা পরিমাণে খুব অল্প দিতেন বলে তখনও বিনিময় প্রত্যাশা করতেন না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তখন যাঁরা অর্থসহায়তা করেছিলেন তাঁদের অনেকেরই হয়তো পরিচয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দীর্ঘ ১৭ বছর কাজ করলেও কিছু অস্বস্তিকর কারণে এক পর্যায়ে আমার পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে কেন্দ্রের দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার অল্পকাল পরেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখনকার বিবেচনায় বড়সড় বিদেশি অনুদান পায়। স্থানীয় ব্যক্তিপর্যায়ের অংশগ্রহণের চেয়ে বিদেশি ও সরকারি বড় অনুদানসহযোগিতাকে গুরুত্ব দেয়। সুযোগ আসে বিরাটাকায় ভবন নির্মাণের। কেন্দ্রের সদ্য নির্মিত বহুতল ভবনটি তারই নিদর্শন। কেন্দ্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে না থাকায় ভবন নির্মাণ সম্পর্কে আমার কোনোভূমিকা রাখবার কোনো রকম অবকাশ ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে সবচেয়ে দুঃসময়ে ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদানে নির্মিত কেন্দ্রের স্থাপত্য নিদর্শনটি ধ্বংস করে এই বিশাল ভবন নির্মাণের উদ্যোগের আমি মৌখিকভাবে বিরোধিতা করেছিলাম। আমি মনে করি নানাজনেরআন্তরিক অংশগ্রহণে নির্মিত ভবনটিকে অক্ষত রেখে এখানে নতুন ভবনটি নির্মাণ করা উচিত ছিল। ঐ ভবনটি ভেঙে নতুন করে ভবন নির্মাণ করায় প্রাথমিক সময়ের মানুষের নিস্বার্থ সহযোগিতাকে সুবিধার অনুকূলে অপমান করা হলো বলে আমি মনে করি। সব মিলিয়েনতুন অর্থবিত্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আর্থিক ভিত্তিকে দৃঢ়তর করলেও চেতনাগত দিক থেকে রিক্ততর করেছে। যেমন কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি পরিচালিত হয় বিদেশি অর্থসহায়তায়। এই সহায়তায় পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ভাবমূর্তি বাড়ালেও কেন্দ্রকে তারসত্যিকারের উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে দেবে।

আমার এই বক্তব্যটিকে একটু পরিষ্কার করি। কেন্দ্রের লক্ষ্য ছেলেমেয়েদের ভালো, উন্নত ও মননশীল বই পড়ানো। সেরকম নির্বাচিত বই থাকলে সদস্য সংখ্যা কমে যাবে। সুতরাং সদস্যসংখ্যা ধরে রাখবার জন্য ২/৩ জন জনপ্রিয় লেখকের বই বেশি পরিমাণে রাখতেই হবে।একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির পক্ষে খুব বেশি বই বহন করা সম্ভব নয়। ফলে ঐ জনপ্রিয় লেখকদের বই একই শিরোনামের অনেকগুলো কিনতে গেলে যে জায়গা দখল করছে তা অন্য বই কেনার সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে। অথচ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্য ভালো বই পড়ানো।

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে ভালো বই বেশি পড়ানোর সত্যিকারের সুযোগ নেই বলে এ নিয়ে আমার তেমন উচ্ছ্বাস নেই। তবে এর একটা ভালো দিকের কথা না বললেই নয় যে বাংলাদেশে কোনো কালে বইপড়ার এমন ব্যবস্থা থাকবে তা ভাবা যেত না। কেন্দ্রের এইকর্মসূচির জন্য ভাবা যাচ্ছে। শহরগুলোর চেয়ে মফস্সলে এর হয়তো কিছু ইতিবাচক প্রভাবও পড়বে। জনপ্রিয় বই ছাড়াও কিছু ভালো নির্বাচিত বই তো সেখানে রয়েছে! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশিত ভালো বইগুলোও তো রয়েছে। এটুকুর গুরুত্বকেও আমি বিবেচনায়রাখতে চাই!

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই-পড়া কর্মসূচিকেও আমি বিরাট উপকারী কর্মসূচি বলে মনে করি। স্কুল ও কলেজ কর্মসূচির জন্য যে বইগুলো নির্বাচন করা হয়েছে তা যথেষ্ট চিন্তা ও বিবেচনার পরই করা হয়েছে। নানাভাবে অর্থ আসছে বলে কর্মসূচির পরিধি শনৈ শনৈ বাড়ছে।আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একসময় গুণগত মানের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিলেন। এখন প্রতিষ্ঠানের আয়তন বৃদ্ধির গৌরব ও সংখ্যাপ্রেমে উৎফুল্ল! বেশি ছেলেমেয়ের হাতে বই তুলে দিলে হয়তো বেশি কাজ হবে এই প্রত্যাশা এখন তাঁর। এতে যে কেন্দ্রের উদ্দেশ্যটা মরে গিয়ে কর্মসূচিরবড়ত্বটাকে সামনে এনে গোটা কর্মসূচিটাকেই প্রায় অর্থহীনতায় পর্যবসিত করে তুলতে যাচ্ছে তা অনুভব করতে পারছেন না তিনি। যদিও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণে এখনও স্পন্সরদের নির্লজ্জতা মাত্রা অনেক কম তা সত্ত্বেও আমার মনে হয় বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের কর্মসূচির আওতায় আসা লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ক্রমশই পরিণত হচ্ছে স্পন্সরদের শিকারে। এই বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে কোনো আদর্শিকতার দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। বই নিয়ে আলোচনা ও অনুষ্ঠানাদি আয়োজনের সাংগঠনিকতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল মানুষেরসঙ্গে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে যে মননশীলতার চর্চা হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছিল সেটা এই সংখ্যার বিপুলতার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। তবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পর্কে আমি এ কথা বলতে পারি যে তিনি অন্যের বিশেষজ্ঞতা নিয়ে চলেন না। বরং চলেন বিশেষজ্ঞতাকেনিজে আত্মস্থ করে। এর ফলে সকল সফলতা ও ব্যর্থতার দায় গিয়ে তাঁর ওপরই বর্তায়। তিনি ছাড়া কেন্দ্রের ব্যাপারে অন্য সকলের ভূমিকা সাধারণ উপকরণের অতিরিক্ত কিছুমাত্র নয়। এ ছাড়াও সবচেয়ে যেটা বড় দিক সেটা হলো, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাংগঠনিকতায়গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেয়ে বিশেষের বিবেচনা গুরুত্ব পায় বেশি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন উদ্ভাবনার শক্তি বেশি মানুষের থাকে না। উদ্ভাবক যা বলবেন তা-ই গুরুত্ব পাবে বেশি। তবে সেই উদ্ভাবনাকে বাস্তবায়নের ক্ষমতাও কেবল থাকবে উদ্ভাবকেরই! অন্যের উদ্ভাবনা সেখানে কখনও যদি গৃহীত হয়েও থাকে তা হয় ব্যতিক্রমী ঘটনা। অন্যের উদ্ভাবনা তিনি গ্রহণ করেন নিজের ধারণা ও উপলব্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে। এ রকমটি যেমন আগেও ছিল তেমনি এখনও আছে। কেন্দ্রের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা সব সময়ই ছিলেনআবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ধারণাসমূহ বাস্তবায়ন প্রচেষ্টার প্রায় অন্ধ-সমর্থনকারী। বোর্ডসদস্যগণ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মধ্যেকার শুভচেতনার সমর্থক হিসাবে ভূমিকা পালন করেন মাত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো উদ্যোগকে তখনই বিরত করেন যখনকোনো পরিকল্পনার ব্যর্থতা খুব বড় হয়ে দেখা দেয়ার আশঙ্কা অনুভব করেন। যদি কোনো দিন ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে গবেষণা হয় তাহলে দেখা যাবে কী বিপুল পরিমাণ নতুন নতুন পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে যাকে অল্প প্রয়াসের মধ্যেই আবার বিনা নোটিশেপরিত্যাগও করা হয়েছে। সে-কারণে ট্রাস্টি বোর্ডের সিদ্ধান্তসমূহ শেষ পর্যন্ত যতটা না সম্মিলিতভাবে বোর্ডের সিদ্ধান্ত তার থেকে অনেক বেশি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নিজের। সেই সূত্রে সবসময়ই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সকল সাফল্যের গৌরব ও ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ততাঁরই ওপরে বর্তায়! প্রশ্ন উঠতে পারে কর্মীদের ভূমিকা নিয়ে। আমার পর্যবেক্ষণে তাঁরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বপ্নের সামান্য অংশমাত্র, এর বেশি কিছু নয়! সে-কারণেই সুদীর্ঘ কালেও কেন্দ্রের সামগ্রিক পরিসরে এমন কোনো কর্ম-সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি যার দ্বারা কেন্দ্রকেউন্নত একটি প্রতিষ্ঠান বলে মনে হবে! এককভাবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের বাইরে বলতে গেলে কেন্দ্রের নিজস্ব কোনো সামর্থ্যই এখনও গড়ে উঠতে পারে নি!

দুপুর মিত্র: ইত্তেফাকে ‘সাজ্জাদ শরিফের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ ও আমাদের সেই সময়ের কথা- নামে ফেসবুকে একটা নোট লিখেছেন। সেখানে আপনি উল্লেখ করেছেন উনার সাক্ষাতকার নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। সাহিত্যে তার তেমন কোনও অবদান না থাকার পরওউনি একটা কিছু করলেই তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় কেন?

আহমাদ মাযহার: সাজ্জাদ শরিফের সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্ক হবার কারণ আমি আমার ফেসবুকের ‘মাই নোটস্’-এর আপনার উল্লিখিত নোটেও বলেছি। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে সাজ্জাদের একটা নিজস্ব উপলব্ধি আছে। ওর অনেক বিবেচনার সঙ্গে আমি একমত না হলেওওর মতের আমি মূল্য দিই! বিচিত্র বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গভীর উপলব্ধিময় পাঠ আছে ওর। সাহিত্য দর্শন শিল্পকলা সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে ওর যে অনুভব আছে তার ভিত্তিও কম মজবুত নয়! সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তার সেই নিজস্বতার ছাপ স্পষ্টভাবে টের পাওয়া গিয়েছিল।ওর দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা ভিন্নতা ও বক্তব্য প্রকাশের বলিষ্ঠতা এবং প্রকাশে শৈল্পিক রুচিময়তা ওর সব ধরনের রচনাকর্মকেই উজ্জ্বলতা দেয়! ফলে অতিপ্রচল ভাবনার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওর পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এটাই প্রধানত তার বক্তব্য সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টিরকারণ। সংখ্যাগত দিক থেকে অবশ্য সাজ্জাদ শরিফ অকিঞ্চিৎকর হলেও ক্ষমতাকাঠামোর যেখানটাতে ওর অবস্থান তাতে খুব সহজেই শনাক্তির সামাজিক আঙুল ওইটুকু অবদানকেই নির্দেশ করে ফেলতে পারে। ওর কর্মক্ষেত্র যদি এখনকার দিনের সবচেয়ে প্রভাবশালীমাধ্যম না হতো তাহলে হয়তো ওর এইটুকু অবদানকে এতটা লক্ষযোগ্য মনে হতো না। কিন্তু ওর সৃষ্টিকর্মের প্রতি যে সমীহ সাহিত্যমহলে দেখা যায় তা সে নিজের ব্যক্তিগত যোগ্যতায় অর্জন করেছে বলেই আমি মনে করি! ও যে-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার সাফল্য ও সেইসাফল্যে তার নিজের ভূমিকার যুগপৎ প্রভাবের মধ্য দিয়ে এটা অর্জিত হয়েছে।

দুপুর মিত্র: আপনি বইয়ের জগৎ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন অনেকদিন হল। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এটি সম্পাদনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশিত বই, বইয়ের বাজার, সে সবের মান, প্রকাশকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক কিছুই আপনি বলতেগেলে নতুন করে রিড-আউট করতে বাধ্য হয়েছেন বা করেছেন। এসব নিয়ে কিছু বলবেন?

আহমাদ মাযহার: আমি পাঠক হিশেবে নিজেকে খুব উচ্চমানের বলে দাবি করতে পারি না। কারণ মূলত বাংলাভাষায় প্রকাশিত বইয়ের ভুবনেরই আমি বাশিন্দা! কিন্তু এ-কথাও আমার মনে হয়েছে যে বাংলাভাষার সীমানায় আসা বিশ্বজ্ঞানের মাধ্যমেও উচ্চায়ত মনীষাঅর্জন সম্ভব যদি এর শক্তি ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। উন্নত প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজিভাষার বিস্তার আমাদের সমাজে যে বাড়ছে সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ নাই! কিন্তু এই ইংরেজি যতটা সাধারণ যোগাযোগের মাধ্যম ততটাউচ্চায়ত জ্ঞানের অনুকূল নয়। কারণ সাধারণভাবে ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে আসা জ্ঞান আমাদের চেতনাকে সত্যিকারভাবে জাগিয়ে তুলতে পারছে না। কারণ ইংরেজি কাজে আসছে কেবল ব্যবসায়ের ব্যবহারিকতায়। সাম্প্রতিক প্রয়োজনকে স্পর্শ করতে পারছে বলে মনেহচ্ছে আমাদের সমাজে ইংরেজির মাধ্যমে জ্ঞানের প্রভাব পড়ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইংরেজিবাহিত বৈশ্বিকতা কেবল দেখা যাচ্ছে জীবনযাপনের বাহ্যিক অনুষঙ্গে, অন্তর্গত জাতীয় চেতনায় তার প্রভাব পড়ছে কমই। বাংলা সমালোচনা যদি যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে তাহলেএইদিকে কাজ হবে। সেজন্য বাংলাদেশের লেখকদের বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনা বইয়ের জগৎ-এ ছাপতে চাই! সাহিত্যপত্রিকার অভাব বলে সাহিত্য-সমালোচনা হয় খুব কম। উন্নত সমালোচনা যেমন লেখকের সৃজনশীলতাকে ব্যাখা করে ও আস্বাদনে সহায়তাকরে তেমনি মূল্যেরও বিচার করে। সেটা আমাদের কম হওয়ায় সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন হতে পারছে না। এতে বঞ্চিত হচ্ছে তরুণরা। মুদ্রণ প্রযুক্তির উন্নতির ছোঁয়া বাংলাদেশে লাগলেও যথার্থ পুস্তক-প্রকাশনা সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি। আমরা এসব অনালোচিতঅনুষঙ্গগুলোকে আলোচনার আওতায় এনে পুস্তক প্রকাশনামানের উন্নয়নে এর প্রভাব রাখতে চাই! আমাদের প্রকৃত বইয়ের বাজার এখনও সন্ধান করা হয় নি। বই বিপণন-সংস্কৃতির মান গড়ে ওঠে নি এখনও। এই প্রসঙ্গগুলোকেও আমাদের বই-সমালোচনার আওতায়আনতে চাই! একটি উন্নত বইয়ের মান কী সে-সম্পর্কে প্রকাশকদের এমনকি লেখকদেরও প্রকৃত ধারণা না থাকায় আমাদের পুস্তক-প্রকাশনা ক্ষেত্রের উন্নতি হতে পারছে না। একটি মানসম্পন্ন বইয়ের জন্য প্রকৃত যে অর্থ বরাদ্দ করতে হয়, যে-রকম পেশাদারিত্ব দেখাতে হয়তা আমাদের প্রকাশনাভুবনে প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা লক্ষ রাখি সমালোচনায় পেশারিত্বের দিকগুলোও যেন উঠে আসে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে পুস্তক প্রকাশনায় বিষয়ের অনেক বৈচিত্র্য এলেও এবং কোনো কোনো বইয়ের মান খুব ভালো হলেও গড় ন্যূনতম মাননেমে গেছে। গড় মান নেমে যাওয়ার কারণে যে-সব ঊনতা দেখা যাচ্ছে সে-সব দিকেও বইয়ের জগৎ নজর দিতে চায়!

দুপুর মিত্র: আমি যদ্দূর জানি লোক সম্পাদক শামীমুল হক শামীম, শামীম রেজাÑÑইনারা বেশ আপনার নিকটের মানুষ। কিন্তু উনাদের লিটলম্যাগ কেন্দ্রিক নানা উদ্যোগ নিয়েও আপনি প্রশ্ন তুলেছেন যেমন লিটলম্যাগ সমন্বয় পরিষদ লিটলম্যাগ কর্মীসুলভ কাজ কিনাইত্যাদি। এসব নিয়ে কিছু বলুন।

আহমাদ মাযহার: আপনি ঠিকই বলেছেন যে লোক সম্পাদক কবি শামীমুল হক শামীম, কবি শামীম রেজা আমার নিকটের মানুষ। কিন্তু নিকটের মানুষ হলেও মতপার্থক্য থাকতে পারে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে এইটুকু শ্রদ্ধাবোধ আছে যে প্রত্যেকেই স্ব স্ব জীবনবোধেরআলোকে আমরা নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। ফলে মতপার্থক্যকে আমরা কেউ শত্রুতা মনে করি না। লিটল ম্যাগাজিন কী সে সম্পর্কে আমার উপলব্ধির সঙ্গে তাদের বিবেচনার যে পার্থক্য তা থেকেই আমি প্রশ্ন তুলেছি। এটা কোনো ব্যক্তিগত মনান্তর নয়! সে-কারণেআমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কোনো সমস্যা দেখা দেয় নি।

দুপুর মিত্র: আধুনিকতা:পক্ষ-বিপক্ষ (২০০১), ব্যক্তি সমাজ সাহিত্য (২০০৮), রবীন্দ্রনাথ নারী বাংলাদেশ (২০০৯), শিশুসাহিত্যের রূপরেখা (২০০৯), বাঙালির সিনেমা (২০০৯), ছড়াতত্ত্ব ছড়াশিল্প (২০১১)--এরকম অনেকগুলো সমালোচনা-প্রবন্ধ বিষয়ক বই আপনিলিখেছেন। বাংলাদেশের সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে আপনার মন্তব্য কি? অনেকের মতে আমাদের দেশে সমালোচনা সাহিত্যই গড়ে ওঠেনি। আপনিও কি তাই মনে করেন?

আহমাদ মাযহার: বাংলাদেশে সমালোচনা-সাহিত্যের গড় মান ভালো নয়। তবে ভালো লেখা যে একেবারে নেই তা নয়। মানসম্পন্ন সমালোচনার মূল্য দেয়া হয় না বলে অনেকেই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সমালোচনা লিখতে অনুপ্রাণিত বোধ করেন না। কবিতার বই নিয়ে যেগড়পড়তা সমালোচনা হয় তার উপজীব্য বিষয় কবির স্বতন্ত্র জগৎ সম্পর্কে পর্যালোচনা থাকে কমই। সমাজ-রাজনীতি ইত্যাদি যে-সব প্রসঙ্গ কবিতার অনুষঙ্গ হিশেবে বিবেচনা করা হয় তার দ্বারা কবিকে শনাক্ত করা যায় না। অর্থাৎ ঐসব আলোচনা এতটাই নির্বিশেষ যেআলোচ্য বিশেষ কোনো কবির নাম মুছে দিয়ে অন্য কোনো কবির নাম বসালেও আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না।

অনেকে সমালোচনাসাহিত্যের চর্চাকে দ্বিতীয় শেণীর কাজ মনে করেন যা ঠিক নয়। সে-কারণে সমালোচনাসাহিত্য যে একটি স্বতন্ত্র ও সম্পন্ন সংরূপ তা তাদের বিবেচনায় থাকে না। এ-কথা তারা বিবেচনা করেন না যে, সমালোচকের চৈতন্যের আলোয় আলোকিত টেক্সটস্বতন্ত্র এক সংরূপ হয়ে ওঠে। আমাদের সমালোচনাসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কৃতি কী কী তা নিয়ে কোনো নিবিড় জরিপ হয় নি। ফলে সমালোচনাসাহিত্যকে মোটাদাগে প্রবন্ধের আওতায় ফেলে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একধরনের গবেষণাকর্ম আছে যাকে সমালোচনা-সাহিত্যের অন্তর্গত বলে ধরে নেয়া হয় যার অধিকাংশই যথার্থ সমালোচনা-সাহিত্য হয়ে ওঠে না।

সমালোচনায় থাকে দুটি শক্তিমান বৈশিষ্ট্যÑÑএকটি ব্যাখ্যার ও আবিস্কারের, অন্যটি বিচারের। সমালোচনা-সাহিত্যে এই দুয়ের উপস্থিতি সমান গুরুত্বের সঙ্গে যেমন থাকে তেমনি থাকে সমালোচনা-লেখকের সৃজনশীলতা, দার্শনিকতা ও ব্যক্তিসত্তার প্রভাব। সব মিলিয়েসমালোচনা-সাহিত্য হয়ে-ওঠে স্বতন্ত্র এক সংরূপ। বাংলাভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব, শিবনারায়ণ রায়, আবদুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আহমদ ছফা প্রমুখের সমালোচনাকে এর নিদর্শন হিশেবেধরে নিতে পারি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্থিতিশীলতা সমালোচনা-সাহিত্যের ওপরেরও প্রভাব ফেলেছে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় যদি গণতান্ত্রিকতার মাত্রা লক্ষণীয় পর্যায়ে না থাকে ও জ্ঞানভিত্তিক চর্চা মূল্য না পায় তাহলে যথার্থ সমালোচনা-সাহিত্য গড়ে-ওঠা কঠিন। বাংলাদেশে অপরিণতরাজনৈতিক সংস্কৃতি বুদ্ধিচর্চার ওপর সরাসরি খবরদারি করে বলে এবং নানা পুরস্কার ও সুবিধাভোগের আওতায় বুদ্ধির চর্চা চলে বলে প্রকৃত বুদ্ধি-চর্চার বিকাশ বাংলাদেশে ঘটছে না। সর্বক্ষেত্রেই ভিন্ন সামর্থ্যের মূল্যে সমাজে যেভাবে ব্যক্তিবিশেষ মূল্যায়িত হচ্ছেনবুদ্ধিচর্চাকারীর মূল্যায়নের বেলাতেও ঘটছে তা-ই! সাহিত্য-সমালোচনাও রাষ্ট্রের এইসব দুষ্টগ্রহের প্রভাবে আচ্ছন্ন! প্রধানত সে-কারণেই শিল্পের মূল্যায়ন তার নিজ্স্ব মূল্যের নিরিখে হয় না, হয় নানা কার্যকারণের সূত্রে। সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে সমালোচনার ক্ষেত্রেও এইদৃশ্যই দেখব আমরা।

কোনো কোনো দিকে আমাদের সমালোচনা-সাহিত্যের অগ্রগতি অকিঞ্চিৎকর নয়। কবিতা-গল্প-উপন্যাসের সমালোচনায় কিছু উল্লেখযোগ্য কাজের কথা হয়তো আমরা স্মরণ করতে পারব। যদিও অপূর্ণতার ঘাটতির কথাও এর সমান্তরালেই অনুভব করব আমরা। বহুক্ষেত্রেতো সমালোচনা-সাহিত্য একেবারেই আলো ফেলে নি!

দুপুর মিত্র: ঘুমের বাড়ি (১৯৮৫), রূপের ঝিকিমিকি (২০১১) আপনার দুইটি বই ছোটদের কবিতা নিয়ে। হুমায়ুন আজাদ কিশোর কবিতা লিখেছিলেন। এর পর তেমন কাউকে কিশোর কবিতা বা ছোটদের কবিতা লিখতে দেখা যায় নি বা বই প্রকাশিত হয় নি তেমন।আমাদের এখানে ছোটদের কবিতা বা কিশোর কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনাটা কি?

আহমাদ মাযহার: ছোটদের জন্য আমার লেখা কবিতার বই তিনটি। ২০০১ সালে প্রজাপতি উড়ে যায় নামে আরেকটি বই বেরিয়েছিল আমার। বইটি এখন আর বাজারে নেই! আপনি হয়তো লক্ষ করেন নি যে, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে কিশোর-কবিতা লেখায়অনেককেই এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। সুতরাং হুমায়ুন আজাদই যে কিশোর-কবিতা লিখেছিলেন তা নয়। আরও অনেকেই লিখেছেন। শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন বাংলাদেশের কিশোর-কবিতার একটি সংকলনও সম্পাদনা করেছিলেন শিশুসাহিত্যিকদের দৃষ্টি এদিকটায়আকর্ষণের জন্য। ছোটদের জন্য লেখা আমার নিজের পদ্যরচনাগুলোর ঝোঁকও ছড়ার চেয়ে কিশোর-কবিতার দিকেই বেশি।

দুপুর মিত্র: আমার উপেক্ষিত কবিতাগুলো (২০১০) আপনার কবিতার বই। কিন্তু প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে সমালোচনামূলক বইই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা থেকে সমালোচনার দিকে আপনার ঝোঁক বেশি কেন?

আহমাদ মাযহার: আমার প্রথম দিককার সাহিত্য চর্চার যে নিদর্শন গ্রন্থরূপ পেয়েছিল তা ছিল কিশোর-কবিতা ও ছোটদের গল্প। অনুবাদ-রূপান্তরের কাজও করেছি প্রধানত ছোটদের জন্য। আমার প্রথম দিকের প্রকাশিত বইগুলোর বেশিরভাগই ছিল ছোটদের উপযোগী।ফলে ছোটদের লেখক হিশেবে আমার সামান্য পরিচিতি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। যদিও শুরু থেকেই আমি বিচিত্র ধরনের লেখালিখি করেছি। কবিতা তো বটেই, এমনকি বড়দের গল্পও লিখতাম। আমার নিজস্ব বিবেচনায় কবিতা লিখে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতাআমার নিতান্তই কম! ফলে কবিতায় মনোনিবেশ করা হয়ে ওঠেনি। নানা কারণে সাম্প্রতিক কালে ছোটদের জন্য সৃজনশীল লেখা তেমন হয়ে উঠছে না। বরং বিভিন্ন উপলক্ষে গদ্যরচনার আহ্বান বেশি আসে আমার কাছে। এরই প্রভাবে সমালোচনামূলক গদ্যরচনাই বেশিলেখা হচ্ছে। অবশ্য আমি অনুপ্রাণিত আবেগেই সমালোচনামূলক গদ্যও লিখে থাকি! সমালোচনা-সাহিত্যে নিবিষ্টভাবে কাজ করেছেন এমন মানুষ আমাদের এখানে বেশি নেই! এই অভাববোধও আমাকে এদিকে মনোযোগী হতে খানিকটা অনুপ্রাণিত করেছে। এই মাধ্যমে কাজকরতে গিয়ে অনুভব করেছি যে এতে ভালো কিছু করবার অনাবিল আনন্দ পাই আমি।