ত্রিদিব মিত্র'র কবিতা
Post date: Mar 14, 2011 6:55:49 AM
ত্রিদিব মিত্র : হাংরি আন্দোলনের দ্রোহপুরুষ
সুবিমল বসাক লিখিত
হাংরি আন্দোলনের দ্রোহপুরুষ ত্রিদিব মিত্র এবং তাঁর তদানীন্তন প্রেমিকা আলো মিত্র ( যাঁকে তিনি পরবর্তীকালে বহু ঝড়-জলের পর বিয়ে করেন ) সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় বিশেষ লেখালিখি দেখতে পাওয়া যায় না, তার কারণ আন্দোলনকারীদের কয়েকজন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, ষাটের সেই টালমাটাল সময়ে, যাতে এই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি বিশেষ বিজ্ঞাপিত ও প্রচারিত না হন। হাংরি জেনারেশন কেবল একটি পত্রিকা হয়ে থেকে যেত ত্রিদিব ও আলোর অবদান ছাড়া। তা যে আন্দোলন হতে পেরেছে তার কারণ এঁদের দুজনার অভাবনীয় তৎপরতা।কালীদা, যিনি খালাসিটোলা ভাটিখানার মালিক বা ম্যানেজার ছিলেন, বলেছিলেন যে আলো মিত্রের আগে আর কোনো মহিলা খালাসিটোলায় ঢোকার সাহস করেননি।
ষাটের দশকে যা নতুন-নতুন কার্যকলাপ সাহিত্যিকরা আরম্ভ করেছিলেন তা ত্রিদিব মিত্র ও আলো মিত্রর মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁরাই প্রথম পোস্টকার্ডে কবিতা, পুস্তিকার আকারে কবিতা, রঙিনকাগজে কবিতা, ভাঁজকরা কাগজে কবিতা আরম্ভ করেছিলেন।তাঁরাই প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিতে কবিতা পাঠের আয়োজন করেছিলেন। তাঁরাই প্রথম খালাসিটোলা নামে কলকাতার বিখ্যাত ভাটিখানায়, জীবনানন্দ দাশের জন্মদিনে, পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠান করেছিলেন।খালাসিটোলায় কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানও তঁদের অবদান। তাঁরা দুজনে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন; ইংরেজিতে 'ওয়েস্ট পেপার' ও বাংলায় 'উন্মার্গ' । তাঁদের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে পত্রিকার এরকম নাম রাখার কথা কেউ চিন্তা করতে পারতেন না। বস্তুত, তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপ্লব ঘটে গিয়েছে পশ্চিমবাংলায়।
মলয় রায়চৌধুরী ও দেবী রায় যে-সমস্ত মুখোশ হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিলি করার জন্য ছাপিয়েছিলেন, জোকার দানব পশু পাখি মিকিমাউস দেবী-দেবতা ইত্যাদি, সেগুলি এনারা দুজনে পৌঁছে দিয়ে আসতেন তখনকার মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্ণধারদের, সংবাদপত্র-মালিকদের , যার জন্য যথেষ্ট বুকের পাটা দরকার। এনারা দুজনে কাঁধে মই নিয়ে কলকাতা ও হাও্ড়ার কলেজ ও অন্যত্র হাংরি আন্দোলনের পোস্টার সাঁটতেন; পোস্টার এঁকে দিতেন অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ।হাংরি আন্দোলনের পূর্বে কবিতার পোস্টারের ধারণা কলকাতার সাহিত্যিকদের ছিল না।
ত্রিদিব মিত্রের জন্ম হাওড়ার অভিজাত পরিবারে, ১৯৪০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষার পর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে পালান , এবং চল্লিশ দিনের যে হোলি উৎসব মথুরা ওবৃন্দাবনে হয়, তাতে অংশ নিয়েছিলেন। যাঁরা ওই উৎসবে কখনও অংশ নিয়েছেন তাঁরাই কেবল জানেন ব্যাপারটা কত আনন্দদায়ক ও উৎশৃঙ্খল। তিনি ছিলেন ফর্সা ও সুপুরুষ, এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ক্রুদ্ধ ও সমাজ সম্পর্কে বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল, যা লাঘব হয় হাংরি আন্দোলনে যোগ দেয়ার মাধ্যমে।
ত্রিদিবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল খালাসিটোলার ভাটিখানায়।তারপর আমার মাধ্যমে মলয়ের সঙ্গে ও অন্যান্যদের সঙ্গে। মলয়ের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে ওঠে ত্রিদিবের এবং সেকারণেই ত্রিদিবের পত্রিকা দুটি হাংরি আন্দোলনের অভুমুখ হয়ে ওঠে।ওর পত্রিকা প্রকাশিত হলেই আমরা দল বেঁধে খালাসিটোলায় অনুষ্ঠান করতাম; তারপর বাইরে বেরিয়ে কলকাতার পথে অনেক রাত পর্যন্ত চরে বেড়ানো; কখনও বা গাঁজার পুরিয়া ম্যানেজ করে রামকৃষ্ণ ঘাটে সারা রাত। পকেটে টাকা থাকলে বেপাড়ায়। ত্রিদিবের সুপুরুষ চেহারার জন্য ওর খাতির হত বেশি, গালও টিপে দিত কেউ-কেউ।
পেটে মদ পড়লেই ত্রিদিবের কন্ঠ থেকে কথা ছুটতে শুরু করত; অন্য সময় ও একেবারে চুপচাপ, কারোর সঙ্গে তখন কোনো কথা বলত না।একেবারে ফালগুনী রায়ের বিপরীত চরিত্র।আমরা কফিহাউসে একত্রিত হলেও অত্যধিক কথাবার্তায় বিরক্ত ত্রিদিব সাধারণত কফিহাউসে যেত না। যেত তখনই যখন হাংরির কোনো বুলেটিন বা মুখোশ বা পোস্টকার্ড বা ফোল্ডার বিলি করার থাকত, কিংবা কফিহাউসের সিঁড়ির দেয়ালে পোস্টার লাগাবার থাকতো। অনেকে পোস্টার ছিঁড়ে দিতো বলে ত্রিদিবের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি রুখতে হতো আমাদের।
ত্রিদিব ও তার প্রেমিকার হাংরি তৎপরতার কারণে হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও, ত্রিদিব নিজের লেখালিখিকে অবহেলা করেছে, যখন কিনা অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীরা সে-সময় নিজেদের লেখায় মনোনিবেশ করেছেন।
কেবলমাত্র দুটি কবিতা-পুস্তিকা রেখে গেছেন ত্রিদিব -- ঘুলঘুলি ও প্রলাপ-দুঃখ । ঘুলঘুলি ছিল ফোল্ডারের আকারে এবং প্রলাপ-দুঃখ ছিল ৪৮ পৃষ্ঠার, ল্যাকভার্নিশহিন কালো রঙের মলাট, কাভারে ত্রিদিবের কোমর পর্যন্ত নেগেটিভ ছবি -- শুয়ে আছে ঘাসের ওপর, হাতে সিগারেট। গণেশ পাইন এঁকে দিয়েছিলেন ওর প্রলাপ-দুঃখ বইটির প্রচ্ছদ। বইটি প্রকাশের পরও ত্রিদিব সেইভাবে প্রচার করেনি, যখন কিনা হাংরি বুলেটিন সে পৌঁছে দিত সকলের টেবিলে বা বাসায় বা দপতরে।
ফালগুনী রায়ের মতই একলা থাকতে ভালো বাসত ত্রিদিব মিত্র।নিস্পৃহ ছিল নিজেরই লেখালিখির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে।তার কিংবদন্তি গড়ে ওঠে মূলত আলোর সঙ্গে ওই ষাটের দশকে লিভ-ইন, তা সত্তেও অবাধ যৌনতা, বেশ্যাদের মধ্যে বিস্ময়কর পপুলারিটি, কাঁচা মাছ ও কাঁচা মাংস খাবার জন্যে একগুঁয়ে লোভ, ঘনঘন সিগারেট খাওয়া (অধিকাংশ সময়ে গাঁজা বা চরস দিয়ে), টিপিকাল হাওড়ার কথ্যভাষায় কথা বলার ঝোঁক, জীবনানন্দের কবিতা আওড়াতে থাকা, খালি গায়ে রাস্তায় হাঁটা।
ব্যাংকশাল কোর্টে যখন মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে কেস চলছিল তখন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কারোর টিকিটি দেখা যেত না ।শৈলেশ্বর আর সুভাষ তো রাজসাক্ষী হয়ে গিয়েছিল, এবং সে-বাবদ টাকাও পেয়েছিল সরকারের কাছ থেকে। আমি যেতাম আর যেত ত্রিদিব ও আলো; অনেক সময়ে ফালগুনী রায়।
এতদিন ধরে আমরা গাদাগাদা বই পেয়েছি: ফুলের বই, পাখির বই, সেলাইয়ের বই, রান্নার বই, ছবি লেখার বই, ঘরকন্নার বই, ডেবিটক্রেডিটের বই, পোস্টাপিসের বই, সমাজতত্বের বই, শাক-সব্জি ফলানোর বই, গানের বই, প্রাপ্তবয়স্কের বই -- এই নানা ধরণের বই; তেমনি এতদিন ধরে পেয়ে এসেছি যন্ত্রণার কবি, হতাশার কবি, প্রেমের কবি, মুক্তি-যুদ্ধের কবি, নিসগৈর কবি, জনপদ কবি, রোমান্টিক কবি, মৌমাছির কবি -- এমন ধারা অনেক। জীবনের কবি । সারপ্রাইজিং ব্যাপার। ত্রিদিবের লেখালিখি জীবনের সঙ্গে অমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বলেই তার রচনা অমোঘ, দোষময় ও কলঙ্কিত।মনে পড়ে, বিষ্ণুপুর শহর থেকে তিন মাইল দূরে ব্রীড়াবতী নদীতে আমি, মলয়, সুবো আর ত্রিদিব বেশ কয়েক ঘন্টা সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে স্নান করেছিলাম; বহু চাষি সেসব দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার পরেও, চাষিদের দৌলতে, বালির চড়ায় মহুয়া টেনে পড়েছিলাম আমরা।
প্রলাপ-দুঃখ কাব্যগ্রন্হে ত্রিদিব দেখিয়েছে মুদ্রার অপরপিঠ।একথা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাহিত্যের কমিটমেন্ট ও রাজনীতির কমিটমেন্ট এক নয় । রাজনীতির কমিটমেন্ট বিধানসভার-লোকসভার বাইরে ভেতরে আলাদা হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে একবার কমিটেড হয়ে গেলে তার আর ফেরার উপায় থাকে না, বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া।
মলয় লেখালিখি দুই দশকের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিল, যে কারণেই হোক, জানি না। ত্রিদিবও মলয়ের সঙ্গে লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু আর ফেরেনি, এমনকি আমাদের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি।এমনই তার ঘৃণা ও ক্রোধ। সে কাউকে ক্ষমা করেনি। ফালগুনী তবু ক্ষমা করে দিয়েছিল শৈলেশ্বর ও সুভাষকে, ত্রিদিব করেনি। ত্রিদিবের মতে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকে দূষিত করে দিয়েছিল এই দুইজনের কার্যকলাপ।
( রচনা: ৯ মে ১৯৭২ )
হত্যাকাণ্ড
আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফঁদাই পড়তে হচ্ছে
মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে
চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের
ধ্বস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়
আমার মিথ্যে জিভ থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফঁড়ে
ঝলসা দিচ্ছে মানু-বাচ্চাদের
তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান
আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ
প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কঁদে উঠেছিলাম আমি
চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার
চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে
আমি দানব না যিশুকৃষ্ট বুঝতে না পেরে
রেস্তঁরায় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা
আজ আর কোনো রাস্তা খঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার
সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে
সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়
সব জীবনের মথ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা
আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু
অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়া
কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান
কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে
ভয়ে কঁচকে গিয়েছিল তার চোখ
অন্ধ চোখে কঁদে উঠেছিল মাথা নিচূ করে
এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে
নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর
আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে-আমার ভালবাসা
ভয় আর ভালবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে
বঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর
ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়
সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়
বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ
সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যের বেতারে
টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু
এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়
রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি
আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য 'টোপ'
নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে
খেলতে চাইলাম চাতুরী
তোমার প্রতারণা থেকে ভালবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম
আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা
আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা
আমার দিব্যজ্যোতি আমার আম্ধকার
আমার চারধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার
চলছে মানুষের
আমি বুঝতে পারছি মানুষ মানুষকে ভালবাসতে পারছে না
....মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালবাসেনি
উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্ধ লাশ
আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে
আমার ধর্ম কি মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে
আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে
স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু
পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা
অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটৈ ক্ষুরধার ভালবাসা
আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি
প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমত
অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান
কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু
আমার ভালবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি
অসুস্হ ভালবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য
মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও
আমার সকল উত্তাপ জযো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক
ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা
আগুনের হল্কা চুঁড়ে দিলে আমার গায়ে
শিশুর মত হেসে উঠলাম আমি
পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর
আকাশ ঘঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ
স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে
ওঃ
আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল
আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না
নিজেকেও তেমন করে ভালবাসা হল না আমার
এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি
এক সঙ্গেই হাসছি আর হাসছি না
ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি - অক্লান্ত আওয়াজ - আঁকাবাঁকা টানেল -
লুপ - পরিসংখ্যান - ক্ষুধা - মহব্বৎ - ঘৃণা -
কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের
আত্মাকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও
বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে
আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে
মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ ওব্দি
ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমিওঠা চোখে
মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার
কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালবাসা আমার অসহায়তা
মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে
অক্ষম আর আঊর্ব স্বাধীনতা
মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে
অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা
ওঃ আমি কোনো দিনই ভালবাসতে চাইনি
আঃ..................................আঃ
কলজে গঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়
বুকের ভেতর ইনজিনের চাপা ক্রোধ
রক্তের উত্তেজনে থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা
অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রণাম রেখেছিল সুবো
তিন মাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ
মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি
ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে
আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়
ভাঁটার সঙ্গে সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতদিন চিনতে পারেনি
আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খঁজে পাচ্ছি না নিজের
"মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই" বলতে ককিয়ে উঠেছিল
৩৫২ কোটি মানুষ তায় ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা
ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন
কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে
আমার ।
তাদের অজান্তেই...
(১৯৬৩ সালে শিবপুরের পুরানো বাড়িতে থাকাকালীন রচিত, এবং মলয় রাচৌধুরী সম্পাদিত 'জেব্রা' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত । )