মাথা থাকা দরকার কবির: ঋষি সৌরকের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jan 24, 2013 1:13:37 PM

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

ঋষি সৌরক: প্রথম প্রথম কবিতা লিখতাম বাবা লিখত বলে এবং দিদিরা আবৃত্তি করত বলে । আমার সব দিদিই দুর্ধর্ষ আবৃত্তিকার। ঠাকুমা আমাকে ইন্সপায়ার করেছিল কবিতা লেখার জন্যে এব‌ং বাবা ডিমোটিভেট করত হরদম্‌, কারণ কবিতা লেখা উচ্ছ্বন্নে যাবার সস্তা পথ বলে বাবা ভাবত।

একদিন জোর করে বসলাম কবিতা লিখতে কারণ আমার কিছু বন্ধু কবিতা লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিল। বাংলা হার্ড মিউজিকের প্রতি বরাবরই একটা নেশা ছিলো আমার, ওদের কথা আর রিদম্‌ আমাকে পেয়ে বসল, একটা ফ্যান্টাসির জগত তৈরি হল, গৃহপালিত প্রেম উসকে দিল কবিতার মিথ। তারপর অনেক পথ পেরিয়ে অনেক ঋতু পেরিয়ে ইমোশনের ফ্লেভার পেরিয়ে ‘লে খা লে খা খেলা’ (‘লেখা বা ওইরকোম কিছু গাঢ়স্থ্য প্রো-Bad’ ক্রুশিয়াল৩ ’১৩) টা আমার গ্রিপে। অনেকটা ইনপ্যুট-আউটপুটের মতো হয়ে গ্যাছে, এখন আর লেখা হয় না খেলাও হয় না প্রডাকশন হয়, আর যেখানে উৎপাদন আছে সেখানে লাভ-ক্ষতি বাণিজ্য আমদানি-রপ্তানি চলে আসে। এর মেরিট এবং ডিমেরিট দুটোই আছে বলাবাহুল্য –তাই কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি, স্যারেণ্ডার ।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

ঋষি সৌরক: আরাম। আরাম দরকার। যেটাকে আমরা তৃপ্তি বলি বা স্যাটিসফিকশন সেটা দরকার। একটা পরিবেশ বা মহল যেটা আমার চাহিদার সঙ্গে যায় সেটা পেলেই কুলকুলিয়ে পরিত্রাণ বেরিয়ে আসে। কবিতা সত্যিই একটা খেলা। উই প্লে পোয়েমস -কবিতা একটা আনস্ট্রাকচার্ড আবহ (স্ট্রাক্‌চার কি এবং আনস্ট্রাকচার কি কোনো স্ট্রাক্‌চার? এসব নিয়ে একদিন তর্ক হবে),অমনযোগের পত্রলেখাছাপ। এই যে মন এই মন কিন্তু মাথারই একটা সেণ্ট্রাল অংশ, আসলে মাথাই সব। মাথা থাকা দরকার কবির, সেই মাথা থেকে স্নায়বিক উত্তেজনাগুলো মুঠোবন্দী করার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কবিতা দ্য ইউনিভার্সাল লাইসেন্স। আরাম তখনি হবে যখন ব্যথা থাকবে ক্ষিদে থাকবে, প্রাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক ক্ষিদে। চরম ত্যাগের আগে তাই পরম ভোগ অপরিহার্য – এই দুইয়ের সমন্বয়ই কবিকে কবি বা ব্যবসায়ী বানিয়ে দেয় ক্ষিদে অনুযায়ী। ক্ষিদেটাই ...... (ফাঁক পুরন করুন)

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন? ০৪. সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

ঋষি সৌরক: ক্যান বলব? আমি যাদের নাম বলব না তারা যদি আমার লেখা না ছাপে? অনেকের লেখা ভাল্লাগে না তবু তাদের হাতে রাখতে হয় কারণ আমার তাদের দরকার তাদের আমাকে না। আর ভালো-খারাপ লাগাটা কি সত্যিই কারও কিছু যায় বা আসে ? আমার আগে আসত এখনও আসে। মাঝে মাঝে তবে সেরকম কিছু না। আসলে আজ আমি যেটা লিখছি কাল আমার নিজেরই ভালো লাগছে না বা লাগছে বা লাগছে না অনেক কিছু হচ্ছে। এক-একটা ইমোশনাল গোলোক ধাঁধাঁয় আবর্তন করছি আমরা, একটাকে ছেড়ে আরেকটাতে কত কবিতা লেখা হচ্ছে কত কবিতা লেখাই হচ্ছে না –আমি যে ফ্রেম এ আছি বা যে সিস্টেমে সেটাকে বাইরে থেকে কেউ দেখলে একরকম ভাবে অনুভব করবে আর ভেতরে ঢুকে দেখলে অন্যরকম। পাশে থাকা আর ভেতরে থাকার এই আপাত ফ্রেমবদল থেকে ভালো-খারাপ কন্ট্রাস্টের উৎপত্তি, ভালোর সাথে যে ইজ্জত মিশে থাকে তাতেও তো ভেজাল এর চাইতে খারাপ বলে কাউকে বেইজ্জত করে যদি তার টনক নড়ান যায় সেটা তো বেশি সম্মানের। পার্টিকুলার কাউকে ভালো কাউকে খারাপ বলার পক্ষপাতি আমি না, সব কবিতাই কিছু না কিছু শেখায় ওই যে ফ্রেম বল্লাম কবিতাগুলো এক-একটা ফ্রেমের রং-খবর-আনন্দ-বিষাদ নিয়ে আসে, তাই সব কবিতাতেই কিছু না কিছু খেলা থাকেই –যেগুলোকে আমি মিস্‌ করতে চাই না। কে বলতে পারে ২৬ বছর বয়সে যে কবিতাটিকে একেবারে ম্যাদামারা ইমম্যাচিওর্ড লাগছে ৬২ বছরে তাকেই ‘ও মাই প্রেসিয়াস’ বলে উথলে উঠবো না? আপাতত ২৬-৬২ এই জার্নিটা ফুল টু এনজয় করা আমার লক্ষ্যে-বাঁচতে চাই-কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ভালো-খারাপ এই শব্দগুলোকে ভালো বা খারাপ লাগাতে চাই না আর। র‍্যাদার দ্যান কন্ট্রাস্টগুলোকে আরাম করতে চাই।

দুপুর মিত্র: নব্বই –শূন্য-প্রথম এই তিন দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

ঋষি সৌরক: আমি প্রথম দশককে খুব সামনে থেকে দেখছি,আমি নিজেও প্রথম দশকের প্রোডাকশন এবং আমার সমবয়সী কবি বন্ধুরাও তাই। আমরা কয়েকজন বন্ধু তো রীতিমতো কবি হবার তাগিদেই কবিতা লেখা শুরু করলাম এবং আমাদের প্রথম দশকের জিনিস বানিয়ে দেওয়া হল। দশক বিভাজন ইত্যাদি নিয়ে অনেক ভ্যানতাড়া হয়েছে আমার কাছে শুধু দশক না যে কোনও বিভাজনই একটি ফুল্টু মজা, তা সে আবালবৃদ্ধবনিতা হোক ছাই নারী-পুরুষ ছাই কাস্ট হোক কিম্‌বা রিলিজিওন – এসব মানুষ মজা পাবার জন্যে করে চলছে, বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ধর্মের নিরিখে চরিত্রের নিরিখে ভাগাভাগির কোনো প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হয় না, আমরা কবিতা লিখে কেউ ভালোবাসার ধন কেউ পপুলার কেউ এম-ফিল কেউ বাবা কেউ ডন হতে চেয়েছি এবং আমরা হয়েছি। শূন্য দশকের কোনো কোনো লেখা নব্বইয়ের তো কোনটা প্রথমের ডেরিভেটিভ, সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক ইনফ্লেশন কবিতাকে কতটা অবিকৃত রেখেছে বা বিকৃত করেছে এবং তার প্রয়োজনীয়তা ফিউচার হিস্ট্রির সিলেবাসে থাকতেই পারে আমার মাথা-ব্যথায় নেই। কবিতা তো রইলই, যার যেটা করে আরাম হয় সে সেটা করবে।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

ঋষি সৌরক: আমি কবিতা খুব বেশি পড়িনি, তাই মাতব্বোরের মতো মন্তব্য করাটা ঠিক হবে না। এদিক-ওদিক যা পোড়েছি তার ওপোর ভরসা করে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের কবিতা দিনে দিনে ভাঙছে প্রচুর নতুন কাজকর্ম হচ্ছে হাজারটা লিট্‌ল ম্যাগ হয়ে গিয়ে এ ওর থেকে কম্পিটিশনে জিতবার জন্য কোঁত পেড়ে পেড়ে নতুনত্ব আনতে চাইছে, কখনো আসছে কখনো ঘেঁটে ঘ হোয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কিন্তু বেশ সিরিয়াস, কবিতা সেখানে একটা বংশানুক্রোমিক প্যাশোন, একটা আল্টিমেট ভালোবাসা – রিস্ক নিতে তাদের বাধছে, কাঁচাপাকা আবেগের বাহুল্যে কবিতাকে এক অন্যরিয়েল মাত্রায় নিয়ে গ্যাছে! পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কবিতাকে কস্‌মোপলিটন বৈচিত্র্য কর্পোরেট সামগ্রী বানিয়ে নিতে পেরেছে, বাংলাদেশের কবিতা অনেক বেশি রেওয়াজি, জীবনানন্দ প্রভাবিত। এটা একটা লে-আউট মাত্র, বাংলাদেশের কিছু তরুণ কবির কবিতায় চলতি সেই রেওয়াজের বাইরে বেরিয়ে আসার রিস্ক আমি দেখেছি। কি জানেন তো কবিতাটা বাঙ্গালিদের রক্তেই থাকে !

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

ঋষি সৌরক: হ্যাঁ প্রচুর কিছু দিচ্ছে। অল্পসময়ে অল্পখাটুনিতে অল্পমূলধনে অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যে পোঁছে দিচ্ছে অকাতরে। খুব সুবিধার জিনিস।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

ঋষি সৌরক: অব্‌ভিয়াসলি মনে হয়। লিট্‌ল ম্যাগ করা মানে তো ঘরের খাওয়া কিন্তু বোনের তাড়ানো, মানে কাঁচকলা, সাহিত্য-ফাহিত্যের নামে পকেট খালি সময় নষ্ট, কে আর টাকা দিয়ে লিটল ম্যাগ কেনে? কতোটাই বা উদ্যোগ নেওয়া হয় লিটল ম্যাগগুলোকে প্রমোট করার ইন্সপায়ার করার জন্যে, একটা নেগলিজেন্সি তো ছাপাই থাকে লিটল ম্যাগের ফ্রন্ট পেজে। লোককে বারবার বলতে হয় কিনুন দাদা কিনুন দিদি, আমাদের মধ্যবিত্ত অহংকার ফিউজ হয়ে উড়ে যায়। আমাদের অপমান হয় আমাদের লজ্জা লাগে, দিনের শেষে না বেচা বই বগলে ফোতুর চিত্তে আমরা বাড়ি ফিরি ক্লান্ত হরিদাসের মতো। এ বালের দেশে আকর্ষণ ও তৃপ্তি এই দুটো ওয়ার্ড খুব ম্যাটার করে, মানুষের হনমোন স্টিমুলেট করতে জানতে হবে, আদারওয়াইজ যারা ওই ছাহিত্তো ছাহিত্তো বোলে চেল্লায় তারাই মুখ ঘুরিয়ে পালায়। এর থেকে ঢের ভালো বাবা ব্লগ করো, সহজ এবং অপশনপ্রবণ, গোটাটাই আরামের এবং আনন্দের,খরচা-পাতির গহ্যা নেই –ধীরে সুস্থে উই ক্যান ডু ইট। ডিমেরিটস বলতে সুলভতার ডিমেরিটস, মানুষ কষ্ট করে পড়তে কষ্ট পায়। তাতে কিছু আসে যায় না, যারা পড়বার তারা পড়বে, যারা পড়বে না তারা অলওয়েজ লাইক করবে। মোদ্দা কথা ব্লগের সুবিধা নিঃসন্দেহে বেশি চাপ কম ।

দুপুর মিত্র: দৈনিকে সাম্প্রতিক সাহিত্য বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ঋষি সৌরক: দৈনিক মানে কি খবরের কাগজ বলছেন ? খবরের কাগজে তো লোকে অর্ডারি লেখা লেখে। সময়ে সময়ে মানুষের মধ্যে যে ভাবনা-চিন্তাগুলো চলতে থাকে অর্ডারের মাধ্যমে ভাবনার বা লেখার ইচ্ছেটা চাড় পেয়ে ওঠে, ফলে সুবিধেই হয়। দৈনিকে লেখা এক-ধরনের সু-প্র্যাক্টিস যেটা লেখার আর্জটা কে মোলায়েম করে। যেসব দৈনিক পয়সা দেয় তাদের জন্য প্র্যাক্টিসের ইচ্ছেটা বেড়ে যায়। তবে মাঝে মধ্যে ইচ্ছে না করলেও যখন লিখতে হয় তখন সেটা ইল্লিগাল জায়গায় পৌঁছে যায় ।