কবে যে পন্ডিত আর অধ্যাপকদের গন্ডী পেরিয়ে আবারও কবিতা-প্রবণ অন্য মানুষেরা আসবেন কবিতার কাছে: বিপুল চক্রবর্তীর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Feb 15, 2014 5:39:15 PM

বিপুল চক্রবর্তীর জন্ম ২৫ শে মার্চ ১৯৫৫ সালে, দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। পিতা রমানাথ চক্রবর্তী এবং মাতা ঊমারানী চক্রবর্তী। প্রথম কবিতার বই -তোমার মারের পালা শেষ হলে, ১৯৮০। পরবর্তী কবিতার বই আমি দেখছি ১৯৮২, ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় ছেলের ঠোঁটে আকন্দের দুধ।

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

বিপুল চক্রবর্তী: আমার সমস্ত কান্না চলে যায় সৌন্দর্যের দিকে... 'আপনি কেন কবিতা লেখেন', আপনাদের এ প্রশ্নের উত্তর লিখতে বসে প্রথমেই আমার লেখা উপরোক্ত এই ছত্রটির কথা মনে পড়ল । এই ছত্রটি আমার যে লেখার অন্তর্গত সে লেখাটি যখন প্রকাশিত হয়, মনে আছে, বন্ধুরা অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কী ভাবে এক রক্তার্দ্র স্বদেশে দাঁড়িয়ে আমি এ কথা লিখতে পারি ।তাদের সবিনয়ে আমি বলেছিলাম ঐ লেখাটিরই আরও পরের একটি ছত্র, আমার সমস্ত কান্না চলে যাক সৌন্দর্যের দিকে । তার বেশি আমি আর কিছু বলতে পারিনি । আমি এ রকমই । সময়টা সত্তরের দশক, যখন লেখালিখি শুরু করি । মনে পড়ে, সব মানুষের জন্য এক সুসহ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম আমরা । এক অনির্বাণ আদর্শবাদের উন্মেষ হয়েছিল আমার সেই বয়সে । আজকের পৃথিবী অন্য এক পৃথিবী যেন। তবু কেন যে আজও আমার কলম লিখতে ভালোবাসে, তুমি যতই জ্বালাও দাবদাহে / আমার শাখা সবুজ গানই গাহে । আর কী লিখতে পারে আমার কলম, আর কী লিখতে পারি আমি।আমি এ রকমই । কবে যে পন্ডিত আর অধ্যাপকদের গন্ডী পেরিয়ে আবারও কবিতা-প্রবণ অন্য মানুষেরা আসবেন কবিতার কাছে। পথ হাঁটতে হাঁটতে এ কথা জেনেছি যে কবিতা একটি প্রবণতা। সমর্থনও পেয়েছি এ ভাবনার । সমর্থন পেয়েছি লালনে । রামপ্রসাদে । সমর্থন পেয়েছি মণি-মুক্তোর মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলার লোক-কবিতার অজস্র ছত্রে । কেবলই আমাদের মতো শহুরে কলেজ-পড়ুয়া বা কলেজ-পড়ানো মানুষ নয়, কবিতায় চাই অন্য মানুষও । একজন নাবিককে চাই । একজন কৃষককে চাই । এ রকম আরও আরও মানুষ চাই । তাদের অভিজ্ঞতাকে চাই । তাদের ভাষা, তাদের অভিব্যক্তিকে চাই । আমি সামান্য একজন । কিন্তু, এ কথা জেনে গিয়েছি যে আমি কবিতা-প্রবণ একজন । আর তাই আমি কবিতা-প্রয়াসী একজন ।

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার?

বিপুল চক্রবর্তী: কুষ্ঠ ও গীতগোবিন্দের পাশে, মাথানিচু... 'কবিতা লেখার জন্য একজন কবির ঠিক কী ধরণের প্রস্তুতি দরকার', আমি জানি না । কুষ্ঠ ও গীতগোবিন্দের পাশে, মাথানিচু দাঁড়িয়ে থাকি । কাশী বা বৃন্দাবনে, গঙ্গাপাড়ের দিগন্তরেখার মতো শাদা থান পরা সারি সারি মেয়েদের পাশে, চুপ, দাঁড়িয়ে থাকি । বাউলের দরবেশের তাড়িত গানের পাশে, গেরিমাটি আর আধুনিক গেরুয়ার আশ্চর্য বিরোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি । শুনি লালন, অবোধ মন! তোরে আর কী বলি । শ্মশানের ছাই ওড়ে যেদিকে তাকাই, হরিজনবস্তি জ্বলে । রূপ কানোয়ার জ্বলে যায় এই বর্ণ-অপরিচয়ের দেশে । তবু, তাদেরই খোঁপায়, দেখি, গোঁজা থাকে প্রান্তরের পলাশ শিমুল । কটিবন্ধে বাঁশি আর মোরগের রঙিন পালক । আর, সেই আদিবাস থেকে, একদিন শুকনো পাতারা ওড়ে – উড়তে উড়তে শহরের পিৎসা-হাট শপিংমল-কে ঘিরে জড়ো হয় । দেখি । দেখি । দেখি আর দেখি । আর তারপর, হঠাৎই লিখে ফেলি, তোমাকে ডাকছে আজ তোমার প্রাচীন / তোমাকে ডাকছে আজ তোমার অস্ফুট । কথা ভাঙি । কবিতা কোথায় । সুর ভাঙি । কোথায়, কোথায় তোর গান ।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার ভাল লাগে এবং কেন?

বিপুল চক্রবর্তী: কোন্‌ প্রদীপের কতখানি আলো / আঁধারের দেশে আমাকে সাজাল... 'সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার ভালো লাগে এবং কেন ভালো লাগে', এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সত্যিই কঠিন । সময়কে আমি দশক বা শতক দিয়ে ভাগ করতে ভালোবাসি না । সময়কে আমি একজন কবি বা কয়েকজন কবিকে দিয়ে চিনতেও ভালোবাসি না । বরং বহু কবির বহু বর্ণের কবিতা সাজিয়ে একটা বড় সময়ের কথা ভাবতে ভালো লাগে । যেমন, মজা করে যদি বলি, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী থেকে বিপুল চক্রবর্তী, একটা সময় । হা হা হা হা । অবিরত আমাদের প্রপিতামহের রক্ত বয়ে চলেছি আমরা । কিন্তু পুনরাবৃত্তি নয়, তা রচনা করে চলেছে জীবনের নতুন নতুন পর্ব । রচনা করে চলেছে পর্ব থেকে পর্বান্তরের।

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনার খারাপ লাগে এবং কেন?

বিপুল চক্রবর্তী: নটে-গাছটিকে যারা নটে-শাক বলে শুধু জানে... 'সমসাময়িক কাদের কবিতা আপনার খারাপ লাগে এবং কেন খারাপ লাগে', এ প্রশ্নের কী উত্তর লিখি, বলুন তো ! অনেকে আছেন, যারা বর্ণমালার প্রথম বর্ণ থেকে প্রলাপ বকতে শুরু করেন, তাদের কথা না হয় ধরছি না । কিন্তু আরও অনেকেই, দেখি, খুব ‘গভীর’ কিছু লিখবেন ভেবে অনেক জটিলতা তৈরি করেন – অনেক ‘সংকেত’ তৈরি করার চেষ্টা করেন । অননুভূত সেইসব শব্দশরীর সত্যিই কোনও কাজে আসে কিনা, আমি জানি না। ক্লান্ত লাগে। খারাপ লাগে ।

দুপুর মিত্র: নব্বই ও শূন্য এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

বিপুল চক্রবর্তী: রাস্তা পেরিয়ে রাস্তা... 'নব্বই ও শূন্য, এই দুই দশককে আপনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন । এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী', এই প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে মনে হয় । আমাদের এই ছোট্ট আলোচনার অনুষঙ্গে, দশক নিয়ে ( তা সে যে দশকই হোক ) আমি ইতোমধ্যে আমার মত প্রকাশ করেছি ।

দুপুর মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়?

বিপুল চক্রবর্তী: জননীভাষার কাছে এসেছি ভূমিকাহীন... 'পশ্চিমবঙ্গের কবিতা আর বাংলাদেশের কবিতার ফারাকটা কোথায়', জানি না । বা, বলা ভালো, তেমন কোনও ফারাক খুঁজে পাই না । যে শ্রদ্ধা যে ভালোবাসা নিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়েছি, সেই শ্রদ্ধা সেই ভালোবাসা নিয়েই উচ্চারণ করেছি শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের অজস্র কবিতা ।

দুপুর মিত্র: ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে?

বিপুল চক্রবর্তী: পাখি ওড়ে, তুমি ভাবো মেঘ / মেঘ ওড়ে, আমি ভাবি পাখি... 'ব্লগ সাহিত্যকে কি বিশেষ কিছু দিচ্ছে', এ প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায় ? এখনই তেমন কিছু বলা যায় কি ? জানি না, জানি না । সত্যিই জানি না।

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি? হলে কেন না হলে কেন নয়?

বিপুল চক্রবর্তী: মুক্তপক্ষ মেঘেদের চলাফেরা দুই চোখে নিয়ে... 'লিটলম্যাগের চাইতে ব্লগ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয় কি, হলে কেন না হলে কেন নয়', এমন একটি প্রশ্নের প্রত্যাশাই করিনি আমি । সময়ের নির্দেশে ‘লিটলম্যাগ’ একদিন পথ হাঁটা শুরু করেছিল। সময়ের নির্দেশেই বুঝি বা ‘ব্লগ’ আজ পথ হাঁটছে । ইতিহাসের একই পথের দুই যাত্রীকে এ ভাবে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা কেন তবে.........