কবিতা এখন অনেক বেশি জড়তাহীন, অসংকোচ, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং অনেক বেশি 'গ্রহণে সক্ষম' ও বহুগামি: কবি সুহৃদ শহীদুল্লাহর সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 25, 2012 7:46:55 AM

প্রকাশিত বই: ঈশ্বরের অটোবায়োগ্রাফি (২০০১),আমার যুদ্ধাপরাধের কাহিনীসকল (২০০৭), জলপাই, স্নেহ ও শর্করা (২০১২)

অন্যতম সম্পাদক: শিরদাঁড়া

দুপুর মিত্র: 'জলপাই, স্নেহ ও শর্করা' বইটি নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

সুহৃদ শহীদুল্লাহ: 'জলপাই, স্নেহ ও শর্করা' আমার কবিতার বই। এর বাইরে বইটি নিয়ে আমার আর কোনো মন্তব্য নেই।

দু: কবিতা লিখতে গিয়ে আপনি কাকে বেশি অনুসরণ করার চেষ্টা করনে এবং কেন?

সু: কাউকে অনুসরণ করলে আর নিজে লিখতে আসলাম কেন? পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত অলিখিত থাকা কবিতাগুলোর কিছু কিছু নিজে লিখব বলেই তো কবিতা লিখি। যদি অনুসরণই করতে চাইতাম তাহলে তো নিজে না লিখে 'অনুসরণযোগ্যদের' কবিতা পড়ে আর রবি বাবুর গান শুনে শুনে একটি সফেদ সুশীল ও সম্পূর্ণ সামাজিক জীবন কাটাতে পারতাম। আমার কবিতা সাক্ষী: "অতটা সামাজিক নই বলে সুশীলা আমার নয়"।

তবে অনুপ্রেরণার কথা যদি বুঝিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং হইও। সেক্ষেত্রে ঋণ অনেকের কাছেই। একেবারে নাম না জানা কবির বিচ্ছিন্ন পংক্তি থেকে শুরু করে গতকাল যিনি লিখতে এসেছেন তাঁর কবিতা থেকেও অনুপ্রাণিত হই, যদি সেসব লেখায় অনুপ্রাণিত করার শক্তি থাকে। শুধু কবিতার কথাই বা বলি কেন। সব ধরনের লেখা পড়েই অনুপ্রাণিত হই। আর চিত্রকলা ও সিনেমা এবং অবশ্যই গান। শেষের দুটোর ব্যাপারে আমি যথেষ্ট 'রুচিহীনও'। মানে সবধরনের সিনেমা আমি যেমন দেখতে পারি, শুনতে পারি সব ধরনের গান বা সংগীতও- একেবারে মমতাজ থেকে ভীমসেন যোশি পর্যন্ত। সম্প্রতি যেমন খুব শুনছি বিজয় সরকারের গান। এসব থেকে অনুপ্রেরণা পাই। আর অনুপ্রেরণা পাই তথাকথিত অসাহিত্যিক উৎস থেকে। যেমন, মানুষের গল্প বলা শুনে। লিখিত গল্পের চেয়ে এগল্পগুলোর আবেদন আমার কাছে বেশি মনে হয়।

দু: প্রধান কবি বিশেষ করে, ছোট কবি, বড় কবি এই বিভাজনগুলো করা উচিত কিনা ? উচিত হলে কেন?

সু: একজন কবির জন্য এই গ্রেডিং লাগে না। লাগে অকবিদের জন্য এবং কবিতা ব্যবসায়ীদের জন্য। যেমন, সাহিত্য সাময়িকীতে কার কবিতাটি প্রথমে বা 'সেরা কোনায়' যাবে এটাও ভাবতে হয় সাহিত্য ব্যবসায়ীদের। বেশিরভাগ ''প্রগতিশীল' দৈনিক যেমন শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর এরকম একটি সংকটের মুখে পড়েছিল। তারপর থেকে অনেককে দেখেছি একই সমান্তরালে আল মাহমুদ আর সৈয়দ শামসুল হক বা নির্মলেন্দু গুণকে ছেপে ব্যবসা ঠিক রাখতে। মিডিয়ার সব সময় স্টার এর প্রয়োজন পড়ে। আর একটি দলের প্রয়োজন হয় এই গ্রেডিং ব্যবসার-অসৃষ্টিশীল অধ্যাপকদের জন্য। তা না হলে ছাত্রদের কাছে বিলিকৃত চোথা/নোট ততটা বিদগ্ধ হয় না যে!

দু: আপনার সমসাময়িক বাংলাদশেরে কবিতায় কোনও ধারাকে কি আপনি দেখতে পান? পেলে সেটা কোনটা? না পেলে কেন?

সু: সমসাময়িক বলতে যদি বর্তমান সময়টাকে বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে, যতটুকু বুঝি এই সময়ে বাংলা কবিতার তেমন কোনো ধারা নেই। এবং এটাই এসময়ের কবিতার সবচেয়ে বড়ো ধারা বা শক্তি। হাজার রকমের কবিতা লেখা হচ্ছে এখন। কবিতা নিজে থেকে তার সতীত্ব-র ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাই কবিতা এখন অনেক বেশি জড়তাহীন, অসংকোচ, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী এবং অনেক বেশি 'গ্রহণে সক্ষম' ও বহুগামি।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?

সু: সমসাময়িক বলতে কাদের বুঝিয়েছেন জানি না। এযাবৎ যত কবির কবিতা পড়েছি, দেশের এবং ভিন দেশের, তাঁদের সবাইকে আমার সমসাময়িক মনে হয়। আর পছন্দের কথা যদি বলেন তাহলে এমন একজনও কবি পাইনি যার সব কবিতাই ভালো লেগেছে বা সব লেখাই খারাপ লেগেছে। সেটা সম্ভবও নয়। আমার মনে হয় একজন কবি তার সময়ের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কবিতাটি যেমন লিখতে পারেন তেমন একই কবি লিখতে পারেন নিকৃষ্টতম লেখাটিও। এভাবে লেখার দিক থেকে ভাবলে ভালো লাগা লেখাতো অনেক। আসলেই অনেক। তবে খুব সম্প্রতি পড়া কয়েকটি লেখার কথা এখানে বলে রাখা যায়: শান্তুনু চৌধুরির 'পুষা' আর গৌতম চোধুরির 'বাজিকর ও চাঁদবেনে'। আরেকটি বইয়ের কথাও সবিনয়ে বলে রাখতে চাই: কবি শাম সোলমানের প্রথম কবিতার বই 'ক্রুর উপকথার ঝুলি'। জীবন যাপনের অস্তিস্ত্ববিন্দুগুলোকে মিলিয়ে দিয়ে এবং তারচেয়ে বেশি না মিলিয়ে এই বইয়ের কবিতাগুলো পাঠককে চ্যালেঞ্জ করে নিরাভরণের শক্তি পরখ করতে। আমরা গর্বিত যে, শিরদাঁড়া থেকে বইটি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছি।

দু: সমসাময়কি কাদরে কবিতাকে আপনার বেশি খারাপ লাগে এবং কেন ?

সু: এই প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় আগেরটাতেই আছে।

দু: আপনি আর আহমদে নকীব ভাই মিলে বুকাউস্করি প্রথম সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছেন। এর পিছনে আপনাদের কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি?

সু: আমার যেকোনো অনুবাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে লেখাগুলোকে ভালোভাবে পড়তে চাওয়া। সেক্ষেত্রে বুকাউস্কি কেন? খেয়াল করলে দেখবেন খুব কাছাকাছি সময়ে আমি গ্রেগরি করসো এবং ডায়ানা ডি'প্রিমা সাক্ষাৎকার এবং কবিতাও অনুবাদ করেছি। শিরদাঁড়া করতে গিয়ে প্রান্তিকতার উপর একধরনের ঝোঁক চলে আসে। বুকাউস্কিসহ উপরে যাদের নাম বললাম তাঁরা সব একটি বিশাল সময়ের প্রান্তিক চরিত্র। বিট জেনারেশন বললে উপমহাদেশে গিন্সবার্গের ছায়া অতিক্রম করতে পারি না আমরা। কিন্তু কবিতার ঐ সময়টা নির্মাণে আরো অনেকের সাথে বুকাউস্কি, করসো, ডিপ্রিমার গুরুত্ব অনেক। এরা নিজেরা নিজেদের কাজ দিয়ে অনেকটা দানবিক। কিন্তু খুব বেশি পঠিত নন আমাদের এখানে। সেই চিন্তা থেকেই অনুবাদ করা। এবং এই চিন্তা প্রথম এসেছিল নকীব ভাইয়ের মাথা থেকে। প্রথম কাজটা শুরুও করেছিলেন নকীব ভাই, কবি আহমেদ নকীব।

দু: বুকাউস্কি সাক্ষাৎকাররে এক জায়গায় বলেছেন, আমার মনে হয় না সর্ম্পূণ স্বাভাবিক অবস্থায় আমি একটা কবিতা লিখছি। একজন কবি হিসেবে আপনার কি মনে হয়? কবিরা কি অস্বাভাবকি অবস্থায় কবিতা লিখেন?

সু: একেক জনের কাছে স্বাভাবিক অবস্থার মানে তো একেক রকম। অস্বাভাবিক অবস্থারও তাই। আমি আমার কথা বলতে পারি। কবিতা লেখার জন্য আলাদা ভাবে আমাকে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক হতে হয় না। আমার বেশির ভাগ কবিতা হয় হাঁটতে হাঁটতে লেখা নয়তো বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগের সময়টুকুতে লেখা। এখানে লেখা বলতে আক্ষরিক অর্থে লেখা নয় রচনা বলতে পারেন। আমার বেশির ভাগ লেখা আগে সম্পূর্ণভাবে মাথায় তৈরি হয় তারপর সুযোগ বুঝে খাতায় বা কম্পিউটারে টুকে রাখি। আর কবিতা ভাবার জন্য আলাদা কোনো সময় বা স্থান নেই আমার। কমোডে বসে রচিত আমার দু'একটি কবিতার কথাও মনে পড়ছে এখন।

দু: রবিউল করিম, মজনু শাহ, মুজবি মহেদী, লাকু রাশমন ও আপনি মিলে শিরদাঁড়া শুরু করছিলেন। এরপর রবিউল করিম, মজনু শাহ ও মুজিব মেহদী আর থাকেন নি। এর শুরুর উদ্দেশ্যটা কি ছিল? এরপর ভাঙনগুলো কেন হল? আহমদে নকীব ও আপনি মিলে শিরদাঁড়া বরে করছিন। এখন এসব নিয়ে কি ভাবছেন?

সু: শিরদাঁড়া ভেঙেছে নাকি? জানি না তো! যাইহোক, অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে। একে একে উত্তর দিই। তার আগে ছোট একটি সংশোধনী, লাকু রাশমন শুরু থেকে ছিলেন না, দু'তিন সংখ্যার পরে যোগ দেন। এই যে, পরে যোগ দিলেন, এখান থেকেই শিরদাঁড়ার প্রবণতাটাকে বুঝতে পারবেন।

শিরদাঁড়া করার প্রথম চিন্তা এসেছিল গল্পকার রবিউল করিমের মাথায়। রবিউল ভাই মজনু শাহ এবং মুজিব মেহদীর সাথে এনিয়ে আলোচনা করেন। আমি যখন আলোচনায় যোগ দিই তখন চিন্তাটি বেশ জমাট বেঁধেছে। শিরদাঁড়ার প্রথম সংখ্যাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ শিরদাঁড়াকে বোঝার জন্য। সেটি যদি পড়ে থাকেন তাহলে বুঝবেন শিরদাঁড়া শুরু হয়েছিল প্রতিবাদের লক্ষে। সব রকম প্রাতিষ্ঠানিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রথম সংখ্যায় রবিউল ভাই লিখেছিলেন সাহিত্যের গুরুশিষ্যের অপরাজনীতি নিয়ে, মজনু ভাই লিখেছিলেন প্রকৃত শিল্পী ও কবিতার দায় নিয়ে যেখানে তিনি বলেছিলেন রাজা ক্যাম্বিসেসের দীর্ঘ ছায়ায় হেঁটে যেতে যেতে নিজেদের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে ধরা ছাড়া হয়তো আমাদের আর কোনো কাজ নেই এখন। আমি লিখেছিলাম ২০০১ জাতীয় নির্বাচনের পর 'সংখ্যালঘু' সম্প্রদায়ের নাগরিক নিরাপত্তা দিতে না পারা জাতি হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে। তবে সাহিত্য নিয়ে সবচেয়ে প্রতিবাদী লেখাটি ছিল মুজিবের। মুজিব তার আগ তখন পর্যন্ত বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী এবং কাগজে লিখতেন। সেই সব কাগজের সম্পাদকীয় নীতি এবং দক্ষতা নিয়ে ওর ভেতরে একধরনের ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছিল তখন। সেসবরেই বিস্ফোরণ ছিল ঐ লেখা। আমরা চারজন লেখক। চারজনই সম্পাদক। মুজিবের ঐ লেখা সাথে রবিউল ভাইয়ের লেখাটিও একধরনের সমীকরণ তৈরি করে দিল। এবং শিরদাঁড়ার প্রবণতাকে স্পষ্ট করে দিতে চাইল। প্রথম সংখ্যার আগে পর্যন্ত চিন্তা ছিল এরকম যে, সাহিত্য বা রাজনীতিতে আমরা যখন যে ভণ্ডামি দেখবো তার প্রতিবাদ করে লিখবো এবং অল্পসময়ের ভেতরে তা ছাপিয়েও ফেলবো। কিন্তু প্রথম সংখ্যার পরে আমরা অনেকটা সিরিয়াস হয়ে উঠলাম। শিরদাঁড়াকে সম্পূর্ণ সাহিত্যের লিটলম্যাগাজিন করতে হবে। রবিউল ভাই আগের চিন্তাতেই থেকে গেলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, বাকী আমরা তিনজন একই রকম ভাবছি তখন তিনি আমাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। পেছনে আরেকটি বড়ো কারণ ছিল, রবিউল ভাই সম্পাদিত কথাসাহিত্যের কাগজ 'ব্যাস'' এর প্রতি তাঁর ন্যায়সঙ্গত মমতাবোধ। শিরদাঁড়া-য় থাকলে রবিউল ভাইকে ব্যাস বন্ধ করে দিতে হতো। কেননা ব্যাস এমন অনেকের লেখা ছাপে যারা দৈনিকেও লিখেন। কিন্তু শিরদাঁড়া তো সেই প্রবণতারই বিরোধিতা করে। রবিউল ভাই চলে যাওয়ার পর লাকু রাশমন আমাদের সাথে যোগ দেন। তবে দুটো ঘটনার কোনো সংযোগ নেই। রবিউল ভাই থাকলেও হয়তো লাকু আমাদের সাথে যোগ দিতেন, সক্রিয় থাকতেন। শিরদাঁড়া-র এরকম গ্রহণের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, এখনও আছে।

মজনু ভাইয়ের যাওয়াটা আরো অনেক পরে। সেটাও প্রায় দীর্ঘ আলোচনার পরে। তিনি তখন তরুণ কবিদের ভেতরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ঢাকা শহরে টিকে থাকার জন্য মনের বিরুদ্ধে তিনি কাজ নিয়েছেন একটি দৈনিকে। সেখানেও প্রতিদিন তরুণদের সাথে তাঁর কথা বার্তা হচ্ছে। যারা তাঁর লেখা আরো বেশি বেশি পড়তে চান। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন বলতে আমাদের সামনে তখন শুধু গাণ্ডীব, দ্রষ্টব্য, প্রতিশিল্প আর শিরদাঁড়া। দুয়েন্দে-র প্রথম সংখ্যাটি ততদিনে হয়েছে বোধ হয়। আরো হয়তো কিছু ছিল। যেমন, এখন মনে পড়ছে কুমিল্লা থেকে 'কোমলগান্ধার' নামে একটি কাগজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় তখন। কিন্তু তখনো ঢাকার বাইরের এই উদ্যোগগুলোর সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরি হয় নি। যা বলছিলাম, আমার অনুমান, মজনু ভাইয়ের উপর এসবই হয়তো একটি চাপ তৈরি করেছিল। লিটলম্যাগাজিনের সীমাবদ্ধতার দিকগুলো নিয়েও তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তিন তলার বারান্দায় বসে তিনি আমাদের এসব বিষয় নিয়ে বলছিলেন। সেদিন তিনি অনেকটা মানসিকভাবে তৈরি হয়ে এসেছিলেন যে, শুধু শিরদাঁড়া নয়, লিটলম্যাগাজিন বলতে তখন পর্যন্ত তাঁর যে বিশ্বাস ছিল সেসব থেকে তিনি সেদিন মুক্ত হবেন। হয়েও ছিলেন। মুজিব, লাকু আর আমি ছিলাম। খুব সম্ভবত রাফিও ছিলেন সেই আলোচনায়। নিশ্চিত করে মনে পড়ছে না। মুজিবও অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেই আলোচনা থেকে। কেননা আমি যখন সবাইকে বলি যে, আমি শিরদাঁড়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে চাই। তখন মুজিব প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমরা যদি নিজেদের এইভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখি তাহলে ২৫ বছর পরে আমাদের অস্তিস্ত্ব কতটা কোনঠাসা হয়ে যাবে বুঝতে পারছেন? যাইহোক, আমি বুঝতে চাইনি এবং শিরদাঁড়ার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সেই আলোচনার পর শিরদাঁড়া নিয়ে মুজিবের সঙ্গে আলাদা করে আর কোনো কথা হয়েছিল কিনা মনে নেই। হয়নি বোধ হয়। তবে দীর্ঘ বিরতির পর মুজিব আবার অন্যান্য সাহিত্যের কাগজে লিখতে শুরু করেন যার বিরোধিতা দিয়ে শিরদাঁড়া-র শুরু হয়েছিল। এভাবে মুজিবের সাথে স্বাভাবিক একটি বিচ্ছিন্নতা শুরু হয় এবং তা এখন পর্যন্ত ঐ অবস্থায় আছে।

মজনু ভাই এবং মুজিবের চলে যাওয়ার পেছনে কিছু ব্যাক্তি কেন্দ্রিক বিষয়ও হয়তো ছিল। লিটলম্যাগাজিনের পরিধিটি এমনিতে ছোট। ঐ ছোট পরিধির ভেতরেও ছিল নানা রকম ইগোর লড়াই। কোনো কোনো সম্পাদকের ভেতরে হয়তো একধরনের গুরুবাদী অহং এসেছিল; পরস্পরের সাথে খোলমন নিয়ে কথা বলার সংস্কৃতির অভাব ছিল, এখনও হয়তো আছে। কে কেমন লিখছে তার চেয়ে কখনো কখনো বড়ো হয়ে উঠছিল কে কার সাথে আড্ডা দিচ্ছে এরকম সব বিষয়। এসবও হয়তো নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে উনাদের সরে যাওয়ার পেছনে। মজনু শাহ ও মুজিব মেহদীর চলে যাওয়া শুধু শিরদাঁড়া-র একার ক্ষতি নয়। লিটলম্যাগ আন্দোলনের জন্যও একটি বড়ো ধাক্কা ছিল। শিরদাঁড়া-ও জন্য আরো বেশি কেননা আমাদের মধ্য থেকে উনাদের দুজনেরই অন্যান্য লেখকদের সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগটা বেশি ছিল। বিশেষত মজনু ভাইয়ের সাথে তরুণদের যে-যোগাযোগটি ছিল সেটা মিস করি এখনো। পাশাপাশি সত্যের খাতিরে বলা রাখা উচিৎ যে, শিরদাঁড়ার প্রাথমিক অবস্থায় সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন মুজিব। লেখা কম্পোজ থেকে শুরু করে, মেকাপ-গেটাপ, ট্রেসিং বের করা আর সেই ট্রেসিং বগলে করে প্রেস খুঁজে বেড়ানো সেসবে মুজিবের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। মজনু ভাই লেখা সংগ্রহ করার জন্য সময় দিতেন। আমি প্রয়োজন মাফিক অনুবাদ করতাম। লাকু রাশমন খুবই ইতিবাচকভাবে উদ্যোগটির সাথে নারীত্বের ডাইমেনশনটা যোগ করেছিলেন। লাকু যোগ দেয়ার পর উদ্যোগটি আরো বেশি মানবিক ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অনেক আড্ডা হতো তখন। আরেকটি জিনিস আমরা শুরু করেছিলাম। লেখা পড়ার জন্য বৈঠকি আয়োজন। সেই বৈঠকে পঠিত লেখার উপর যে আলোচনা হতো তার একটি সারসংক্ষেপ আমরা শিরদাঁড়ার পরের সংখ্যায় ছাপাতাম।

লাকু এবং আমি মিলে যখন শিরদাঁড়া প্রকাশনা অব্যাহত রাখলাম তখন সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছিলাম নকীব ভাই এবং কবি রথো রাফির কাছে থেকে। পরে নকীব ভাই আমাদের সাথে সরাসরি যোগ দেন। লাকু লন্ডনে পড়তে যাওয়ার পর মূলত নকীব ভাই-ই সবচেয়ে বেশি শ্রম এবং সময় দিয়েছেন শিরদাঁড়ার জন্য- আমার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। পাশাপাশি আব্দুস সামাদ টোকা এবং সাগর নীল খান এর নাম বলতেই হয়।

শিরদাঁড়া ভাঙেনি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন তাঁদের চিন্তা ও বিশ্বাস নিয়ে শিরদাঁড়ার সাথে ছিলেন। পরে যখন নিজেদের চিন্তায়/বিশ্বাসে পরিবর্তন এসেছে তাঁরা তাঁদের মতো করে সিদ্ধান্ত্ নিয়ে সরে গেছেন। কিন্তু তাঁরা এখনো শিরদাঁড়ার প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই আমি বিশ্বাস করি। কোনোদিন শিরদাঁড়া-র স্পিরিট এর সাথে আমার বিশ্বাস সাংঘর্ষিক হয়ে উঠলে আমিও হয়তো চলে যাবো। কিন্তু শিরদাঁড়া থাকবে নতুন কারো হাত ধরে- যদি তার থাকার দরকার হয়। একদিন আমরা জন্ম দিয়েছিলাম বলে শিরদাঁড়া-কে মেরে ফেলার অধিকারও আমাদের আছে আমি তা বিশ্বাস করি না।

দু: মার্কসীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সাথে লিটলম্যাগের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অমিল কোথায়?

সু: আরো অনেক কিছুর মতো মার্কসবাদ নিয়েও আমার জানা-শোনার ভয়ানক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এটি যেহেতু একটি রাজনৈতিক মতবাদ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অন্যতম লক্ষ হচ্ছে অপছন্দের প্রতিষ্ঠানকে হটিয়ে নিজেকে সে-জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা যাতে মানুষের জন্য মার্কসবাদীরা যা যা করতে চান তা করতে পারেন। সোজা কথায় ক্ষমতার দখল তাঁদের প্রয়োজন। অন্যদিকে লিটলম্যাগ কখনো নিজে ক্ষমতা হয়ে উঠতে চায় না। তার রয়েছে নিরন্তর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। এমনকি যখন তার গাঁয়ে প্রতিষ্ঠানের শ্যাওলা পড়ে, তখন নিজের বিরোধিতা করাটাও তার জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। তা না হলে লিটলম্যাগ হিসেবে তার মৃত্যুই আমাদের কাম্য হয়ে উঠে।

দু: গ্রুপ ভত্তিকি সাহত্যি র্চচা কি সম্ভব? হলে কিভাবে?

সু: এই প্রশ্নটি সাধারণত করা হয়ে থাকে উত্তরটি 'না' হবে ধরে নিয়েই। অনেকের শান্তির জন্য বলে রাখি, হ্যাঁ, উত্তরটি নেতিবাচকই। কিন্তু আরো কিছু কথাও বলে রাখতে চাই। গ্রুপভিত্তিক সাহিত্য চর্চা বলতে আসলে কি বুঝানো হয়ে থাকে? এমন কোনো গ্রুপ আছে নাকি যারা গ্রুপ সদস্যদের হাতে কবিতার বা গল্পের টেমপ্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলে, যাও, টেমপ্লেটটি পূর্ণ করে কবিতা/গল্প লিখে নিয়ে আসো? গ্রুপ কিংবা অ-গ্রুপ যাই হোক, নিজের লেখাটি নিজেকেই লিখতে হয়। একই রকম লিখবে বলে পৃথিবীর কোথাও কোনো গ্রুপ তৈরি হয় নি। এবং তা জেনেশুনেই এরকম প্রশ্ন করার একটি ফ্যাশন চালু আছে। সাধারণত লিটলম্যাগকে কেমন জব্দ করলাম ভাবনা থেকে এরকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়। আপনার প্রশ্নের সততাকে সম্মান জানিয়েই বলছি, লক্ষ করে দেখেছি, এসব প্রশ্ন আসে সেখান থেকেই যারা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি গ্রুপবাজি করে থাকেন।

শিরদাঁড়া-র দিকে যদি খেয়াল করে থাকেন, তাহলে দেখবেন, মজনু ভাই, মুজিব, লাকু এবং আমার লেখার ভেতরে কিন্তু কোনো মিল নেই। এখন যেমন মিল নেই নকীব ভাই এবং আমার লেখার মধ্যে। নিজেদের মতো করেই আমরা লিখে গেছি আবার একসাথে ম্যাগাজিনটি করতেও পেরেছি। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কিছু কিছু মানুষের আপাত গ্রুপ বিরোধিতা এসেছে আসলে একধরনের অসুস্থতা থেকে। বিচ্ছিন্নতার অসুস্থতা যা পুঁজিবাদী সংস্কৃতি আমাদের বোধে ঢুকিয়েছে। ব্যক্তির জয়গান গাইতে গাইতে আমরা ভুলে যাই যে, প্রয়োজনাতিরিক্ত বিচ্ছিন্নতা 'ব্যাক্তি'কে কোনো 'ব্যাক্তিত্ব' প্রদান করে না- স্বমেহনের আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া। স্বমেহনে 'রিলিজ' এর আনন্দ আছে হয়তো কিন্তু স্বমেহন সৃষ্টি করে না কিছু। যাইহোক, আমি যৌথতার সৃষ্টিতে বিশ্বাসী নই কিন্তু সৃষ্টিশীলতার যৌথতায় প্রচন্ড বিশ্বাসী। আমরা যখন সাহিত্যে লিটলম্যাগ করছি তখন খেয়াল রাখতে চাই সিনেমায় একই ধরনের চিন্তা-চেতনা থেকে কারা কাজ করছেন, চিত্রকলায় কারা চেষ্টা করছেন গ্যালারির প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে, প্রতিষ্ঠিত স্কুলিং থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন কারা কারা। আমি এইসব গ্রুপগুলোর সাথে সংলাপে যেতে খুবই আগ্রহী।

দু: একজন সৃষ্টিশীল মানুষ কি কোনও মেনিফেস্টোর আওতায় আসতে পারে?

সু: প্রত্যেক লেখকরই নিজস্ব একটি মেনিফেস্টো থাকে; প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য। সম্প্রতি অনলাইনে কবি রথো রাফি যেমন জীবনানন্দ দাশ এর বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে কবির মেনিফেস্টোর একটি স্কেচ দাঁড় করালে আমরা দেখলাম 'নির্জনতম' কবিরও একটি মেনিফেস্টো ছিল। এখন কোনো একটি বিশেষ সময়ে কয়েকজন কবির ব্যক্তিগত মেনিফেস্টো যদি কাছাকাছি এসে যায় এবং তাঁরা যদি একটি কমননেস এর জায়গা থেকে যৌথ ইশতেহার দাঁড় করাতে চান তাতে কোনো সমস্যা দেখি না। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি নিজে সেই খেলাতে যোগ দেবেন কিনা। আপনার নিজস্ব মেনিফেস্টো যদি ঐ যৌথতার সাথে না মিলে তাহলে আপনার খেলা আপনার নিজের। পথ তো হাজার রকমের। মেনিফেস্টোও তেমনি একটি পথ মাত্র।

দু: লিটলম্যাগের গ্রুপের তুলনায় দৈনিকের গ্রুপ সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বিতর্কিত হয়ে ওঠছে ও কোনও কোনও ক্ষেত্রে পেশি শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা চালাচ্ছে। আপনার কি এরকম মনে হয়? হলে কেন এমন হচ্ছে?

সু: আপনার প্রশ্ন পড়ে মনে হচ্ছে, বিভিন্ন গ্রুপের সার্থকতা বুঝি লুকিয়ে আছে কে কতটা নিজেদের বিতর্কিত করে তুলতে পারে তার উপর। যাইহোক, এরকম কোনো গ্রুপ যদি পেশী শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করে থাকে তাহলে আমার জানা নেই। জানার রুচিও নেই। বাংলাদেশের প্রায় সব দৈনিক কাগজই দুর্বৃত্ত পুঁজির সেবাদাসী বা রক্ষিতা (কথাটি লিঙ্গ সংবেদি হলো না বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি)। সব লেখালেখি দিয়ে দিয়ে তারা এমন একটি পাঠক রুচি তৈরি করতে চায় যাতে তাদের পেছনের দুর্বৃত্ত বাবুদের সুশীল দেখায়। আবার একই সাথে বাবুদের তহবিলে যেন লাভের টাকাটাও যাই। এই যে একই সঙ্গে সুশীল এবং বাণিজ্য তৈরির প্রকল্প, সাহিত্যকেও সেখানে কাজে-কামে লাগানো হয়। বাণিজ্য যেহেতু, স্বভাব ধর্মানুযায়ি তা সম্প্রসারণশীল। বাজার দখলের একটি মরিয়া চেষ্টা তো সেখানে থাকবেই। আর বাংলাদেশে দখল আছে কিন্তু পেশীর ব্যবহার নেই এরকম ঘটনা তো বিরল।

আর লিটলম্যাগের গ্রুপ বলতে কী বুঝিয়েছেন? এক একটি লিটলম্যাগ ঘিরে যে গ্রুপ নাকি সব লিটলম্যাগ কর্মীদের নিয়ে একটি গ্রুপ? শুনুন, লিটলম্যাগ নিয়েও কিন্তু কম ছ্যাবলামি হয়নি বা হচ্ছে না এখানে। অনেকদিন পোষ্টার দেখি না কিন্তু লিটলম্যাগ মেলার নামে সার্কাস হয়েছে ঢাকায়। আবার সেই সার্কাসের প্যান্ডেলের দখল নিয়ে পান্ডাদের মধ্যে গন্ডোগোলও দেখেছি। লিটলম্যাগের নাম ভাঙ্গিয়ে কারা করছে এসব? দৈনিকের সাহিত্য পাতার সম্পাদকরা আর তাদেরই করুণাপ্রার্থী কবি-লিখিয়েরা যাদের কেউ কেউ ঘটনাক্রমে সাহিত্যের কাগজও করেন বটে। তাঁদের ভেতরে কারো কারো প্রধান যোগ্যতা শুনেছি বিজ্ঞাপন যোগাড় করা আর অন্যদের দিয়ে নিজের নামে সম্পাদকীয় লিখিয়ে নেয়া। এখন, আপনি যখন দৈনিকের গ্রুপ বলছেন তখন সেই গ্রুপের সাথে এই গ্রুপের ফারাক কোথায়? আমি তো বলবো কোনো ফারাক নেই। বরং স্বার্থযুক্ত যৌথতা আছে। এদের যৌথতার আরেকটি উদাহরণ খুঁজে পাবেন এদের 'পীর' ধরার প্যাটার্নটি খেয়াল করলে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যেমন ধানকাটার মরসুম শেষ হলে পীরদের আনাগোনা বেড়ে যায়। তেমনি এখন ঢাকাতেও কোলকাতা থেকে মৌসুমী পীরগণ আসেন। এবং ওনাদের আগমনকে ঘিরেই ঢাকাস্থ আশেকানরা বাৎসরিক সাহিত্য-ওরশ-মাহফিল বসান। সাহিত্য পুরস্কার থেকে শুরু করে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠ সবই ওই পীরদের সফরমোবরককে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে এখানে। সেখানে দলে দলে যোগদান করে অশেষ সোয়াব হাসিল করছেন অনেকেই। আয়োজনে, তথাকথিত লিটলম্যাগ সম্পাদক থেকে শুরু করে তাদের দৈনিকের ভাই-বেরাদার সবাই রয়েছেন। এখন এই অবস্থায় হুজুরদের কে কত কাছে যেতে পারবেন তা নিয়ে যদি একটু বচসা হয়, সেটাকে বাঁকা চোখে না দেখায় তো ভাল।