লাবণ্য প্রভার তিনটি গল্প

Post date: Mar 14, 2014 6:20:31 PM

বিষ-কাটালি

এমন নিশিন্ধারা পথ দিয়ে হেঁটে যেতে তাদের ভয় হয়। কেননা তারা সর্বক্ষণ ভয়ের মধ্যেই বসবাস করে। বড় হুজুর স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহর পরাক্রম শক্তিকে ভয় করো। রসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মহান ও পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেছেন, আমার ইজ্জত ও জালালের কসম। আমার বান্দার জন্য আমি দুটি নিরাপত্তা ও দুটি ভয় একত্র করবো না। পৃথিবীতে সে যদি আমার থেকে নির্ভয় হয়ে যায় তবে আমি তাকে সেদিন ভীত করবো, যেদিন আমার বান্দাদের সমবেত করবো। আর সে যদি পৃথিবীতে আমাকে ভয় পায়, তবে সেদিন তাকে নিরাপত্তা প্রদান করব-যেদিন আমার বান্দাদের একত্রিত করা হবে।’ বড় হুজুরের কথায় তারা ভয় পায়। দুনিয়াতে তারা এমন কিছু করতে চায় না যাতে আখেরাতে ভয় পেতে হয়। তাই তাদের পিতা-মাতারা তাদের আখেরাতের শিক্ষায় শিতি করতে মক্তবে পাঠায়। আগে তো আখেরাতের কাজ, তারপর না হয় দুনিয়ার কাজ করবে। তাই বেলা উঠার আগেই তারা ছুটে মক্তবের দিকে। মক্তব শেষ করে তারা বিদ্যালয়ে যায়।

আখেরাতের ভয় পেতে পেতে তাদের মনের ভেতর ভয়টা দৃঢ় হয়ে বসে যায়। আললাহর দুনিয়ার যা কিছু অদেখা , যা কিছু অজানা তার সমস্ত কিছুতে তাদের ভয় লাগে। ভয় তাড়াতে তাই তারা

দলবদ্ধ; ঘনবদ্ধ হয়ে মক্তবের দিকে যায়। ভোর রাতের এই সময়টায় এই পথটা প্রায় অন্ধকার থাকে। না রাত না দিনের আলোয় গাছ পালা, আকাশ, এমনকি নিজের শরীরকেও অচেনা লাগে। তবু তারা হাঁটে। ভয় তাড়াতে কলরব করে। সম্মিলিত বালক-বালিকাদের সমস্বর কলরবে পথ ও পথের দু’ধারের নির্জনতা ভঙ্গ হলে বিরক্ত পণিীরা ডানা ঝাঁপটায়; কাঠ বেড়ালী তার কোটর ছেড়ে বাইরে আসে। গ্রীবা বাঁকিয়ে বালক-বালিকাদের চলমান স্রোত দ্যাখে।

বালকদের পরনের পাঞ্জাবীর ঝুল হাঁটুর নিচ অবধি, আর সালোয়ার গোড়ালির ঠিক ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরুষ মানুষের টাখনুর নিচে কাপড় পরা হারাম। এতে অহঙ্কার প্রকাশ পায়। অহঙ্কারী ব্যক্তিকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।, বড় হুজুরও না। তাই তারা মাথায় টুপি দিয়ে আদব লেহাজের সঙ্গে বড় হুজুরের সামনে যেতে চায়। বালিকাদের মস্তক লাল-সাদা উড়নায় আচ্ছাদিত- এক গাছা চুলও যাতে দেখা না যায় এমন নির্দেশ আছে বড় হুজুরের। কোনো পরপুরুষ চুল দেখে ফেললে একেকটা চুল একশ’ একটা সাপ হয়ে দংশন করবে কবরের মধ্যে। বালিকারা যাতোটা না সাবধান তার চেয়ে অধিক সতর্ক তাদের জননীরা। ভালো করে মস্তক আচ্ছাদিত করে তাবেই তারা কন্যাদের মক্তবে পাঠান। বালক-বালিকাদের বেশির ভাগেরই পা খালি। যদিও কারো কারো পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল আছে। মক্তবে প্রবেশ করার পূর্বে তারা টিপকলে ভালো করে পা ধুয়ে নেয়।

বালক-বালিকাদের দল হাঁটে...

তাদের এই ধাবমান স্রোত যেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ক্রমপ্রবাহিত; গন্তব্যে না পৌঁছানো অবধি তাদের পদপে থামবে না কোনোদিন। ডানদিকে প্রাইমারী ইস্কুল, বামদিকে বসতভিটার চম্পাকলার বাগান আর গাঁয়ের একমাত্র কলেজটিকে পেছনে ফেলে তারা হাঁটতে থাকে। গন্তব্য পশ্চিমপাড়ার বড় হুজুরের বাড়ি।

বাঁশঝাড়, বনঝোঁপ, শ্যাওড়া আর খসখসে পাতার ডুমুর গাছ তাদের স্বাগত জানায়; স্বাগত জানায় রাস্তার দু’ধারে সদ্য রুয়ে যাওয়া কিছু শিরীষ-শাবকও। বুকে রেহাল, আমছিপারা আর রঙিন গিলাফে ঢাকা কোরান-শরীফ নিয়ে তারা ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে।

পথিমধ্যে গ্রামের একমাত্র কবরস্থান পার হওয়ার সময় তারা সমস্বরে উচ্চারণ করে, আস সালামু আলাইকুম ইয়া আইয়্যু হাল কবরু; হে কবরবাসী, হে আমদের দাদা পইরদাদা আপনারা বেহেশত নসীব হোন; আপনারা শান্তিতে থাকুন; আল্লাহর ফেরেশতারা আপনাদের উপর অবিরাম শান্তি বর্ষণ করুন। বালকের দল দ্রুত হাঁটে, তাদের সঙ্গে পা মেলাতে পারে না বালিকারা। কেননা তাদের মাটির ওপর জোরে হাঁটতে বারণ আছে।

এবার বোধহয় শীতকালটা একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়বে। কেননা হেমন্তের শেষ দিকের হাওয়ায় এইবার খুব তাড়াতাড়িই জলীয়ভাব চলে এসেছে, একটু যেন বেশিই। তাদের শীত শীত লাগে। এই শীত আসলে আবহাওয়ার জন্য নাকি ভয়ের জন্য ঠিক বোঝা যায় না। তাদের শীতভাব আরো প্রকট হয় সড়কের ওপর আড়াআড়ি পড়ে থাকা বাঁশটি দেখে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত নেমে গিয়ে কোমরের কাছে স্থির হয়; পদপে শ্লথ হয়ে আসে।

কেউ ওই বাঁশের ওপর দিয়া যাইবি না’ মাতব্বরপুত্র শামসুলের কথায় তারা থমকে দাঁড়ায়।

বাবলু এগিয়ে আসে। বাঁশ ডিঙাতে উদ্যত হয়। শামসুল তাকে টেনে রাখে । কইলাম না কেউ ওই বাঁশের ওপর দিয়া যাইবি না।

বাবলু প্রতিবাদ করে।

ক্যান কি হইব?’

বাঁশ উপরে উঠাইয়া নিয়া যাইব। রহিমরে ওই বাঁশই তো উঠাইয়া নিছিল।’

রহিম ক্যাডা, ওই যে গরুর রাখাল; গরুর পারা খাইয়া মরল!

হয়, তয় গরুর পারায় মরে নাই; মুখ দিয়া রক্ত উইঠা মরছে!

পথের মধ্যে পইরা থাকা বাঁশ ডিঙ্গাইতে গেছিল, হেই বাঁশ তারে উঠাইয়া নিছিল। বাবলুর বলার ধরণে বালক বালিকার দল ভড়কে যায়। ‘হেইদিন সড়কে কোনো মানুষ ছিল না। ঠিক দুপুর বেলা সূর্যটা যখন ঠিক মাথার উপর তখন রহিম্যা এই পথ দিয়া যাইতেছিল। রহিম্যা দ্যাখে রাস্তায় বাঁশ পইরা আছে । রহিম্যা দেহে, গরুগুলান আর আগায় না। সে হেট্ হেট্ কইরা অনেকণ ধইরা গরুগুলিরে দাবরানি দেয়। একটাও নড়ে না। রহিম্যা তারপর হাতের পাচুন দিয়া গরুগুলার পাছার মধ্যে ইচ্ছামতো পিটাইল; তাও তারা নড়ে না। রহিম্যা রাগের চোটে নিজেই বাঁশের উপর দিয়া পার হইতে নেয়। যেই না হেয় এক পাও বাঁশের ওইপাড়ে দিছে অমনি বাঁশটা খাড়া হইয়া যায়। রহিম্যাও লগে লগে সাতফুট উপরে উইঠা যায়। তারপর আছাড় খাইয়া মাটিতে পড়ে। গরুগুলান তখন আথাইল্যা-পাথাইল্যা দৌঁড়াইতে থাকে।

আর নাকমুখ দিয়া রক্ত বাইর অইয়া রহিম্যা দাফরাইতে দাফরাইতে মইরা যায়।’

শামসুলের এই কথায় কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। বাবলুর খুব রাগ হতে থাকে শামসুলের ওপর। সব সময় বানাইয়া বানাইয়া কথা কয়, ঠিক অর বাপের মতো হইছে। সব সময় এমনসব কথা বলে যে সহজ সরল মানুষরা তাই বিশ্বাস করে। বাবলুর ইচ্ছা হয় শামসুলরে একটা ঘুষি মারে। কিন্তু না , এখন সে আল্লাহর ঘরে যাচ্ছে, তাই মারামারি করা ঠিক হবে না। তাছাড়া ওতো আর স্কুলে যায় না। তাইলে না বুঝতে পারত এই পৃথিবীতে কোনো কিছু কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না। বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করা না হলে কোনো জড় পদার্থকে নড়ানো যায় না।

আমগো ডর দেহানোর লিগা তুই এইসব গপ করস, না! তুই নিজে চোে দ্যাখছস!’

বাবলুর এই প্রশ্নে অন্য বালকরা যেন একটু সাহস পায়। তারা সমস্বরে বলে উঠে, হ, হ, তুই দ্যাখছস!

না।

তাইলে কে দ্যাখছে? তর আব্বায়?

না ।

তর চাচায়!

না ।

রহিমের বাপ!

না ।

তুইও দেহস নাই, তর আব্বাও দ্যাহে নাই, তর চাচাও দ্যাহে নাই, রহিমের বাপও দ্যাহে নাই, তয় দেখল কে!

জানি না, তয় আব্বারে কইতে শুনছি।

অ। ওই তরা শাসমুলের কথায় কান দিস না। ল বাঁশেরও উপর দিয়াই যাই।

বাবলুর অভয় সত্ত্বেও কেউ নড়ে না, কেউ বাঁশের উপর দিয়া যায় না। বালক-বালিকারা একজন একজন করে ‘কুল হু আল্লাহ পড়তে পড়তে বাঁশের গোড়ার দিক দিয়ে পার হয় আর আড়চোখে বাঁশের দিকে চেয়ে থাকে। তাদের মনে হতে থাকে এই বুঝি বাঁশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ধরে ফেলবে।

বাঁশ পার হয়ে তারা রূদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মক্তবে হাজির হয়।

২.

বাঁশকাটালি গ্রামের বালক-বালিকারা প্রতিদিন এমনভাবেই বড় হুজুরের বাড়িতে আরবি পড়তে যায়; তাদের মনের ভেতরে গেঁথে থাকে ভয়; বাঁশ ঝাড়ের ভয়; শিমুল গাছের ভয়; শিমুল ফুল ফুটলে ওই লাল রঙের ভয়। ভয় লাগে বড় হুজুরের কাছে পড়তেও। কেবল ছোট হুজুরকে তারা ভয় পায় না।

সত্তুরের দশকের শেষভাগে দুনিয়া জোড়া মানুষ যখন ভয়কে অতিক্রম করতে শিখছে তখনও এই বাঁশকাটালি গ্রামের বালক-বালিকারা বুকের গহীনে অদেখা-অচেনা ভয় নিয়ে বড়ো হতে থাকে। বালক-বালিকাদের অনেকেই তখন প্রইমারি ইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছে, বিজ্ঞান বইয়ের ‘এসো নিজে করি’ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞাত হয়েছে। ছোট হুজুর পড়ার ফাঁকে তাদের কাছে জানতে চান ‘বলতো পৃথিবী ঘোরে না, সূর্য ঘোরে?’ আরবী পড়তে এসে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তারা কখনো ভাবেনি। তাদের বিস্ময়ের ঘোর না ভাঙতেই বাবলু জবাব দেয়, পৃথিবী ঘোরে। পৃৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। পৃথিবী একটা গ্রহ। এইরকম আরো গ্রহ নিয়া সৌরজগৎ। সবচেয়ে কাছের বুধ আর সবচেয়ে দূরের প্লুটো।

শাসসুল প্রশ্ন করে, বুধ কি? বুধবার?

না, ওইটা একটা গ্রহের নাম। বৃহষ্পতি, শুক্র, শনি , মঙ্গল নামেও গ্রহ আছে।

গ্রহ, সৌরজগৎ অপার বিস্ময় নিয়ে বালক-বালিকাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

ছোট হুজুর খুশী হয়ে বাবলুকে একটা লজেন্স দেন। এইটা ছোটো হুজুরের পড়ানোর একটা টেকনিক। যে যে পড়া পারে তাদের জন্য প্রতিদিনই একটা করে লজেন্স বরাদ্দ তো থাকেই। আর যে পড়ার বাইরে জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা বলতে পারে তার জন্য থাকে বাড়তি উপহার। পৃথিবী একটি গ্রহ আর সেই গ্রহটি সুর্যকে কেন্দ্র করে তার চারদিকে ঘোরে- এরকম সিদ্ধান্তে যখন সম্মিলিত বালক-বালিকারা ঐকমত্যে পৌঁছায় ঠিক তখনই বড় হুজুরের বজ্রনিনাদে তাদের পিলে চমকে উঠে।

খামোশ! খোদার ওপর খোদগারি। মোকাররম তুমি এইসব আজগুবি কথা পোলাপানরে শিখাইবা না। আজ থেকে তোমাকে এদের আর পড়াতে হবে না।

ছোট হুজুর মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে তিনি বরেন, যাও, ঘরে গিয়া দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ো, খোদার কাছে মাফ চাও এইসব কথা পোলাপানরে শিখানোর জন্য। আর ভালো করে শুনেরাখো, তোমারে যেন কলেজের পোলাপানের সঙ্গে মিশতেনা দেখি। ছোট হুজুর কোনো কথা না বলে চলে যান। বালক-বালিকারা অসহায় ভঙ্গিতে বসে সুর করে পড়তে থাকে- আলিফ ইয়া যের ই নুন যবর নাম ইনা, বা ইয়া যের বি নুন যবর না বিনা, তা ইয়া যের তি নুন যবর না তিনা...

বড় হুজুর ঘরময় অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। কী যেন বলতে চান তিনি।

পড়া থামা।

মুহূর্তে ঘরের মধ্যে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে আসে।

শোন! পৃথিবী কখনো ঘোরে না, পৃথিবী স্থির, ঘোরে সূর্য। এই পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘেঅরে, চন্দ্র ঘোরে। আল্লাহ মহান। তিনি অপার সৌন্দর্য্যরে আধার। রাতের আকাশের সৌন্দর্য্যরে জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন অজস্র তারকারাজি।

বড় হুজুরের চেহারা থেকে নূরানি ঝরতে থাকে। তারা মুগ্ধ হয়। তাদের মুগ্ধ নয়নের সামনে ধীরে ধীরে বড় হুজুরের মুখ লাল হয়ে যায়। একসময় ডাবল জালিবেত দিয়ে তিনি সামনের নিচু টেবিলটাতে সজোরে আঘাত করেন।

কে কইছিল পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে?

ভীত বালক-বালিকা কেউ মাথা তোলে না। বাবলুই এগিয়ে গিয়ে বলে, আমি কইছিলাম। বিজ্ঞান বইয়ে লেখা আছে।

বড় হুজুর আসন ছেড়ে উঠেন, বাবলুর সামনের চুল ধরে টেনে আনেন। তারপর পা থেকে শরীরের সর্বত্র জালিবেতের চিহ্ন আঁকতে থাকেন। বাবলু কাঁদে না, কোনো শব্দ করে না। কেবল বালিকারা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে। অজ্ঞান হয়ে বাবলু মাটিতে গড়িয়ে পড়লে বড় হুজুর ক ছেড়ে যান।

থমকে থাকা বাঁশকাটালি গ্রামে তখন একমাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় ‘বিষ-কটালি’।

বিষ-কটালি বায়ে যা, মাথার বিষ নিয়া যা... গোল গোল হাওয়ার ঘূর্ণি দেখলেই ছোটরা এমন করে গেয়ে উঠে। সে ঘুর্ণি মাটি থেকে ওঠে, পাতা, ময়লা কতোদূর পর্যন্ত উঠিয়ে নেয়। ঘূর্ণির জোর বেশি থাকলে মানুষও উঠে যায় উপরে। বাঁশকাটালি গায়ের মানুষ বিশ্বাস করে, গাঁয়ে কোনো বালা-মুসিবত আসার আভাস পেলেই পাহাড়-জয়নগর থেকে বিষ-কটালি নেমে আসে। হাওয়ারা ছোটো ছোট গোল গোল হয়ে তাদের গাঁয়ের মাটি নিয়ে যায়; বালা মুসিবত নিয়ে যায়। বাবলুকে যখন বড় হুজুর মেরে অজ্ঞান করে দেন ঠিক সেই সময় বাঁশকাটালি গাঁয়ে ‘বিষ-কটালি’র আবির্ভাব হয়। গাঁয়ে ফিসফিসানি সোর ওঠে। কেমন কান্নার মতো সেই সোর। গায়ে বিষ কটালির আবির্ভাব হয়েছে, এ খবরে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হলেও তেমন কোনো বিকার নেই খালেক ডাক্তারের একমাত্র কন্যা রাণু বেগমের।

৩.

জলেতে গড়িয়ে পড়ে জলের কাঁকন

শীতল পুষ্করণীর ঠিক মধ্যেখানে ভুস করে জেগে ওঠে আঠারো ঊনিশ বছরের এক নারী; জলকন্যা। সেই নারী জলের মধ্যে ডুব সাঁতার দেয়। মাঝে মধ্যে মুখ তুলে নিঃশ্বাস নেয়ার সময় তার ধবধবে সাদা মুখখানি দেখা যায়। তার পায়ের ঘাই লেগে বেজে উঠে সহস্র নূপুর; জল সঙ্গীত। তার দীঘল কালো চুল য্যানো কালো সোঁত। জলকন্যা জলের মধ্যে বিণুনি কাটে। জলকন্যা পুষ্করণীর কিনারে বসে পায়ের পাতা মাঞ্জন করে। এ দৃশ্যে প্রবীণেরা দেয়াল তুলে দাঁড়ায়।

ও মেয়ে জলের মধ্যে এতোণ থাকন ভালা না।’

ও কন্যা তোমার গায়ের গন্ধে জীনেরা তো আকুল হইব।’

রূপসী রাণু বাঁশকাটালি গ্রামের গর্ব। কেননা মেয়েদের মধ্যে একমাত্র সেই কলেজে পড়ে। তবে তাকে নিয়ে গর্ব করার বিপরীতে গায়ের মানুষ সবসময় কাঁটা হয়ে থাকে ভয়ে। এই বুঝি তাদের রাণুরে জিনে ধরল।

খালেক ডাক্তারের একমাত্র মেয়ে সে। খালেক ডাক্তার আসলে কোনো ডাক্তার নয়, তিনি বাজারে একটি ডিসপেনসারি চালান। আর ছোটো-খাটো জ্বর-জারি হলে ওষুধপত্র লিখে দেন। তাঁর খুব ইচ্ছা মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। গ্রামে মেয়েদের জন্য ডাক্তার খুব দরকার। প্রসব জটিলতায় যখন মেয়েরা কষ্ট পায় তখন তাদের আলাহকে ডাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। পিতার উৎসাহে রাণু বেগম পড়তে থাকে। ‘এফারা প্লাস আর হেফারা মাইনাস।’ কিন্তু মানুষের মনের ডর যেন যায় না। এমন আগুনের মতো রূপ! জিনের নজর তো পড়বই পড়ব। সেদিন কলিম শেখের তেরো বছরের মেয়েটিকে জিনে ধরল! সেই মেয়ে খিলখিল করে হাসে। পুরুষের গলায় কথা বলে। আর বিনবিনিয়ে কানতে থাকে। ক্যামনে ক্যামনে মগডালে উইঠ্যা যায় টেরও পায় না কেউ! একথা ভাবতেই তাদের গায়ে কাঁটা দেয়। তারা থু থু করে বুকের মধ্যে ভয় তাড়ানোর থুতু দেয়। রাণু বেগমরে প্রতিদিন কলেজে যাইতেই হইব! যেই পথ দিয়া সে যায় সেই পথেই তো শতবর্ষী শিমুল গাছটার মধ্যে জিন-পরীদের আস্তানা! তিনারা সুযোগের অপোয় থাকেন। একলা হলে তো কথাই নেই, দলবদ্ধ লোকের মধ্যেও যে সবচেয়ে পেছনে থাকে তারই ঘাড় মটকে দেন। দেখা গেছে কথা বলতে বলতে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন আর পেছনের সঙ্গীটি অজ্ঞান হয়ে গেছেন! খালেক ডাক্তার নিজেও একথা জানেন। এই তো সেদিন একটু রাতই হয়ে গেছিল তার ডিসপেনসারি থেকে ফিরতে। সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তার সাইকেলের আগে আগে কালো রঙের বেড়ালটি মিঁউ মিঁউ করতে করতে আসতে থাকে। একসময় বাঁশঝাড়ে ঝিলিক মেরে মিলিয়ে যায়। খালেক ডাক্তার বলেছেন, এটা তার মনের ভুলও হতে পারে। তবে বাঁশঝাড়ে প্রায়ই যে আগুনের শিখা জ্বলতে দেখা যায় তা তো আর ভুল না! ওটাতো তিনাদেরই কাজ! সত্যি সত্যি কেউ যদি আগুন ধরইয়া দিত তাইলে তো পুরা বাঁশ ঝাড়ই পুইরা যাইত! তবু খালেক ডাক্তার তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েন না। আর বাঁশকাটালি-কন্যা রাণু বেগম ওই পথ দিয়া দুইবার কলেজে যাওয়া আসা করে।

এখন অন্তত তার কলেজে যাওয়া বন্ধ করা উচিত। বাঁশকাটালিতে শিমুলের ফুল ফুটেছে। ঝাঁকড়া শিমুল লাল ফুলে বাউরি হয়েছে।

রাণু বু তুমি যে ওই পথ দিয়া আসা যাওয়া করো, তিনাদের দ্যাখছো? তিনারা নাকি ওইখানে নাচানাচি করেন?

রাণু হাসে।

হাসো ক্যান, ওই যে বাঁশঝাড়ের আগুন তো সবাই দ্যাখছে, আমিও দেখছি।

খোকনের প্রশ্নে রাণুর আর উত্তর না দেয়ার উপায় থাকে না।

ওইখানে বছর বছর পাতা পঁইচা গ্যাস হইছে, সেই গ্যাসে আগুন জ্বলে; তারে আলেয়া কয়।

তুমি জানলা কেমনে!

মকবুল স্যার কইছে।

মকবুর স্যার, ওই যে শহর থিকা প্রতি সপ্তাহে আসে?

হ।

তবু বুবু তুমি আর কলেজে যাইও না। সবাই কয় তোমারে নাকি একদিন ঠিকই জিনে ধরব। তুমি আর কলেজে যাইতে পারবা না।

ধূর বোকা আমারে জিনে ধরব ক্যান! আমি আয়তুল কুরসি জানি, সুরা নাস জানি , সুরা ইয়াসিন জানি। বাড়ি থিকা বাইর হওনের আগে আমি আয়তুল কুরসি পইড়া তিনবার শরীরে ফুঁ দিয়া শরীর বন্ধ করি। জিন ক্যামনে আইব আমার কাছে!

এই বলে রাণু জলের মধ্যে গড়িয়ে যায়। রাণু আর জল, জল আর রাণু একাকার। এই মেয়েকে জিনে ধরবে কি! এই মেয়ে নিজেই তো জলের পরী!

৪.

বাঁশকাটালি গ্রামে যে অদ্ভূত নিস্তব্ধতা ছিল তা আজ ভোরেই কেটে গেছে। গাঁয়ের এখানে সেখানে ছোটোখাটো বিষ-কটালি অনেকেই দেখেছে। এখন তো বিষ-কটালির সময় নয়। আর কদিন পরেই শীত আসবে। কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে যাবে গোটা গ্রাম। আজ আবার হাট বার। তাই বিষ-কটালিকে পাশ কাটিয়ে তারা পসরা সাজায়। পালানের তরিতরকারি আর চম্পাকলার কাঁদি নিয়া মূল বাজার পেরিয়ে যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানেই বসে যায়। খালেক ডাক্তার আজ ডিসপেনসারিতে যাবেন না। আজ তিনি ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। কাছারি ঘরে গপসপ করবেন।

তখন সন্ধ্যা হয় হয়। হাট ফেরৎ মানুষেরা খালেক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে আসে। এরমধ্যে মেম্বারের ডানহাত রুস্তমও আছে। রুস্তম কথায় কথায় হাতের লাঠিটা ঘোরালে খালেক ডাক্তার বিরক্ত হন। কথা কওনের সময় লাঠি ঘুরাও ক্যান রুস্তম! ঠিক সেই সময় বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলি কণ্ঠের তীè কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে। খালেক ডাক্তারের ছোট ছেলে খোকন দৌঁড়ে আসে, রাণু বু কথা কয়না ! চোখ দুইটা টকটকা লাল!

ও বুবু তর চুল আউলা ক্যান?’

ও বুবু তর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ ক্যান?’

ও বুবু তুই ক্যান ভরসন্ধ্যা বেলা শিমুল তলায় গেলি!’

খালেক ডাক্তার মেয়েকে ভালো দেখেন। অনেক কিছুই দেখেন যা তার ছেলে খোকন দেখতে পায়না। রাণুর গলার কাছে কালশিটে দাগ কিংবা কাদামাটি লাগা আঁচলের তলায় হয়তো লুকিয়ে রেখেছে ছেঁড়া ব্লাউজটা।

খালেক ডাক্তার থম মেরে যান। তিনি ঘর থেকে বের হন । কাছারি ঘরে যান। তারপর উদগ্রীব গ্রামবাসীদের জানান তার মেয়েকে জিনে ধরেছে। সেই সঙ্গে এও বলে দেন কালই তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন।

খোকন ঠিক বুঝতে পারে না রাণু বু’ কে জিনে ধরে ক্যামনে? সে তো সুরা নাস জানে, সুরা ইয়াসিন জানে। ওই পথ দিয়া যাওয়ার সময় তিনবার ‘আয়তুল কুরসী’ পড়ে শরীর বন্ধ করে। তাইলে কি আইজ সে শরীর বন্ধ করতে ভুলে গেছিল!

রাণুকে যে জিনে ধরবে এরকম বিশ্বাস পূর্ব থেকেই বাঁশকাটালি গ্রামের মানুষদের ছিল। কিন্তু তাই বলে এতো তাড়াতাড়ি যে তা ঘটবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবে নাই। রাণুকে তারা ভালবাসত বলেই না এতোকথা বলেছে! বুকভরা হাহাকার নিয়ে তারা খালেক ডাক্তারের বাড়ি ছাড়তে উদ্যত হয়। এমন সময় মাতব্বর পুত্র শামসুল উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে যা বলে তার তরজমা করলে দাঁড়ায়, ছোট হুজুররে পরীরে ধরছে।

মোকাররম রে পরীতে ধরছে!

হ, ওই শিমুল তলা দিয়া আসবার সময় তারে পরীতে ধরে। তারপরই বাড়িতে আইসা দাড়ি কামাইয়া ফ্যালে । বড় হুজুর তারে ঘরের ভেতর রাইখ্যা তালা মাইরা দিছে যাতে বাইর হইতে না পারে। ছোট হুজুর নাকি কলেজে ভর্তি হইতে চায়!

একদিনে এতো গুলো ঘটনা বাঁশকাটালির মানুষদের বিহ্বল করে ফেলে।তাদের গাঁয়ে নিশ্চিত আলাহর গজব নাজিল হয়েছে! গম্ভীর মুখে লোকজন যার যার বাড়ি ফিরে যায়- পরিবার পরিজনদের সুরতি রাখতে। একসময় তারা ঘুমের উদ্যোগ নেয়।

প্রবীণ-প্রবীণারা বাকরুদ্ধ। স্খলিতাবসনা ভার্যাগণ আজ আর ব্রীড়াবনত হয় না। শিশুদের ক্রন্দন ধ্বনিও নাই। তারা যেন এক জন আরেকজনের নিঃশ্বাস পতনের শব্দও শুনতে পাচ্ছে! আধো ঘুম আধো জাগরণে তারা শুয়ে থাকে। সারাদিনের স্নায়ুর চাপে গ্রামবাসীর তখন সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছে কিংবা তারা ঘুমিয়ে যায়। ঠিক সেই সময় পূর্বপুরুষরা সার বেঁধে গায়ে ঢুকতে থাকেন। তারা বিলাপ করেন। পিতামহীদের বিলাপে বাশঝাড়ে ঝড় উঠে। মাতামহীদের বিলাপে আসমানে মেঘে মেঘে ঘর্ষণ লাগে। পিতামহ প্রপিতামহ দুই হাত তুলে তাদের উত্তরপুরুষদের জন্য প্রার্থনা করেন। আসমানে ঝিলিক দেয় বিদ্যুৎ রেখা। একখণ্ড অগ্নিগোলক স্থির হয় শিমুল গাছের শীর্ষে। পিতামহী-মাতামহী-পিতামহ-প্রপিতামহদের চোখের সামনে লাল ফুলের শিমুল বৃক্ষ পুড়ে যেতে থাকে...

জ্যোৎস্নাগ্রামের অলৌকিক নার্সারি

হাতের তালু এখন বিধবার সিঁথির মতো শাদা; ধূ ধূ পদ্মার চর। শুকুর আলী নড়ে না। থম মেরে বসে থাকে। ঘন কুয়াশার মতো একটা আস্তরণ তাকে ঘিরে ধরে। কুমারীর স্তন-চূড়ার মতো নিকষ অন্ধকারে ঘোর লাগে। এমনই সে ঘোর যেন কোনোদিন বের হতে পারবে না সে এর মধ্য থেকে।

তিনি দাঁড়ালেন তার সম্মুখে; দুনিয়া আলো করে। অতঃপর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, নাও। সে হাত বাড়ায়। তিনি বলেন, যাও, ঘরের বাতায় পুঁতে রাখো।

সে নীরবে সম্মত হয়।

কী দিলেন তিনি?- তা দেখবার জন্যই হাত খুলে সে।

নেই।

কিছু নেই।

বেকুব বনে যায় সে। ভ্যাবলার মতো বসে থাকে হাঁটু ভাঁজ করে। কিন্তু পরণেই কোনো এক অলৌকিক ইশারায় তার চোখে-মুখে একটা অস্পষ্ট হাসির ঝিলিক দেখা দেয়।

দুই.

এটিই শুকুর আলীর নার্সারি; অলৌকিক। যার জন্ম হয়েছে সেদিনের সেই স্বপ্ন দেখার পর। জ্যোৎস্নাগ্রামের বিস্ত্রীর্ন চরে সে এই নার্সারি গড়ে তুলেছে। এখানে কারো কোনো অংশীদারিত্ব নেই। একটি গাছে হাত দেবে এমন মানুষ এই তল্লাটে নেই। এমনকি নার্সারির ভেতরেও কারো প্রবেশ অধিকার নেই। সারাদিনমান সে একটি একটি করে গাছের পরিচর্যা করে। আত্মীয় পরিজনহীন, সহায়-সম্বলহীন শুক্কুর আলী যখন দীর্ঘদিন অর্ধাহার আর অনাহারে কাটাচ্ছিলো তখনই তিনি দেখা দিরেন স্বপ্নে। কপাল ফিরে গেছে তার। পরিশ্রমী শুকুর গাছেদের পরিচর্যা করে, মাটির ঢেলা ভাঙে, আগাছা সরায়। বড়ো পয়মন্ত তার হাত। লোকে বলে, শুকুর যদি এক গাছের ডাল আরেক গাছেও লাগায় তাতেও ফল ধরবে। তবে সে এখন কেবল নার্সারির নয়, সুন্দরী জুলেখা বিবিরও অখ- জমির মালিক। আর এই জমিনও সে পতিত রাখতে চায় না। গেলবার ভরা পূর্ণিমায় তাদের গ্রামে ইসলামি জলসা হলে চর-কাশিমপুর থেকে ছোট হুজুরকে আনা হয়েছিল। তিনি বলেন, স্ত্রীলোকেরা হলো চাষের জমিন। শোন মিয়ারা, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমি তোমাদের স্ত্রীদেরকে জমিন করিয়া দুনিয়াতে পাঠাইছি। তোমরা যেমন ইচ্ছা চাষ করো। হাদিস শরীফেও লেখা আছে, স্বামীর যদি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করতে ইচ্ছা হয়, স্ত্রীর বাধা দেওনের মতা নাই। সে যদি চুলার পাড়ে রন্ধনরত থাকে, তারপরও তাকে স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করতে হইবো।’ হুজুরের এই কথা তার মনে লাগে। কিন্তু জুলেখা যখন চুলার পাড়ে বইসা খইলসা মাছের বিরন করে, তখন সে নিজেই তার পাতিলের মধ্যে খইলসা মাছ হয়ে যায়। আর জুলেখা সুন্দরীর মন-জালের ভেতর সে কেবলই লাফাতে থাকে। সে যখন বাঁশের নাড়–নি দিয়া দুধ নাড়ে, তার তখন বাঁশের নাড়–নি হতে ইচ্ছা করে। ভাবতে ভাবতে সে মনের আনন্দে জুলেখা-নগর চাষ করতে থাকে;নিড়ানি দেয়, আগাছা সাফ করে। হাত-ঠোঁট-জিহ্বা কোনো প্রত্যঙ্গই সে অব্যবহারে রাখে না।

জুলেখা বাদশাহর মেয়ে না হলেও তার ভারি অহঙ্কার। সেই অহঙ্কার ভাঙবে বলেই শুকুর প্রতিদিন নিয়ম করে নদীতে ছিপ ফেলে। চুলে গন্ধরাজ তেল মেখে দুই বেণী করে নদীর পাড় ধরে ঐ পথ ধরে ফিরে আসে ; বান্ধবীদের সঙ্গে।

কী মাছ ধরলো শুকুর ভাই?

জুলেখার বান্ধবীদের প্রশ্নে সে খালি হাসে। কিছু বলতে পারে না। ছিপ ফেলে বসেই থাকে। তবে একদিন সাহস করে ঠিকই বলে ফেলে মনের কথা। জুলেখাকে নয়, তার বাবাকে।

জুলেখারে আমি বউ করতে চাই।’

জুলেখার বাবা প্রথমে না না করে। কেননা শুকুর আলীর কোন ধানী জমিন নাই। ধানী জমিন না থাকলে মেয়ে খাবে কী? তবে সে শ্বশুররে বুঝায় তার ধানী জমিন না থাকলেও ফুলের জমিন আছে; না খেয়ে থাকবে না তার মেয়ে।

বিয়ে হয়ে গেলো; ভরা শ্রাবণের এক রাতে লাল চুড়ি, লালশাড়ি আর জুলেখার বাবাকে নগদ পাঁচহাজার টাকা দিয়ে। সেই থেকে এই জমিন তার; একান্তই নিজস্ব।

জুলেখা সুন্দরীর অহঙ্কার চূর্ণ হলো। সে কেবলই শুকুরের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। নিজেকে গলিয়ে দেয়, মিলিয়ে দেয় সংসারের মাঝে। ঘরের বেড়ায়, লাউয়ের মাচায়, কলপাড়ে, মুরগীর খোপে এমনকি ঘরের কোণে জালালি কবুতরের বাসায়। কোনো কিছুর অভাব নেই তার। ভাত- কাপড়-তেল-সাবান-সোহাগ- রান্ধনঘর-উঠান-বাইরবাড়ি, জবাগাছ-গন্ধরাজ গাছ- কী নেই তার! আর আছে শুকুরের মতো বলিষ্ঠ যুবকের ভালোবাসার ওম! খালি সুখ! আর সুখ। জুলেখার ভাতের পাতিল উপচে পড়ে সুখের ফেনা; দুধের হাড়ি উপচে পড়ে সুখ; তার গতর বেয়ে নামে সুখের ধারা। প্রতিদিনই লাবণ্যবতী হয়ে ওঠে সে । তার লবণকু- গভীর থেকে গভীরতর হয়।

কাকডাকা ভোরে শুকুর নার্সারিতে চলে যায়। তারও আগে সে জেগে ওঠে। জলের কলস পূর্ণ করে রাখে দরোজার পাশে; মাটির পৈঠায়। উঠান ঝাঁট দেয়; ঘর ঝাঁট দেয়। বাসি ঘর থেকে স্বামীকে কখনই যেতে দেয় না ;আর খালি মুখে তো নয়ই। রাত জেগে পিঠা বানায়- দুধ-চিতই, এলাকেশী, মুখসরা। সাজিয়ে দেয় দস্তরখানা পেতে। আহারে! স্বামী তার কতো খাটাখাটনি করে। সারাদিনে একবারও তাকে দেখতে পায় না। ফেরে সেই রাতে; শেয়াল ডাকার পর।

ততণ জুলেখা একা একা কী করে!

নকশীকাঁথায় ফোঁড় দেয়। ভরাট সুঁতার হাতপাখা বানায়। যতœ করে লেখে, যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলে না মোরে।’ স্বামীর জন্য রুমাল বানায়, জুলেখা+শুক্কুর লেখা থাকে রুমালের এককোণায় । আরো লেখে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।’ শুকুরের দেয়া রেশমি চুড়ি সময়ে অসময়ে বাজতে থাকে । জুলেখা বাড়ির ময়লা সাফ করে; যেন সারা পৃথিবীর ময়লা সাফ করে। সরু কোমর বাঁকিয়ে কল থেকে জল তুলে; যেন কল থেকে আবে-হায়াত তুলে। মিঠাজল য্যান আরো মিঠা হইয়া যায় জুলেখার পিতলের কলসে ঠাঁই পেয়ে। চাপকল থেকে জল তোলার সময় তার পেছন দিকে যে মোহময় ছন্দের সৃষ্টি হয় তা দেখে মুগ্ধ শুকুর। ঠাসবুনোট নিতম্বের এই উঠানামা তার ভালো লাগে।

সুখ! সুখ! সুখ!

ভাবতে ভাবতে সে ঢেলা ভাঙে। আনন্দের আতিশয্যে জুলেখা বার বার শীৎকার করে। নিতম্ব খানিকটা উঁচু করে শুকুরের গলা জড়িয়ে ধরে সে। কলস উপুর করে ঢেলে দেয় শরীরের কূপ থেকে সবটুকু জল।

তুমি এতো ভাল চাষী কেমনে হইলা ?

আমার পূর্বপুরুষ ভাল চাষী ছিল তাই। আমার বাবায় কইছে জমিনরে সোহাগ কইরা লাঙল ধরতে হয়। বাবারে কইছে দাদায়, দাদারে কইছে তার দাদায়। আমরা হইলাম জাতচাষী। দেখো গো দাদাজান, আমি কেমুন চাষী আমি জমিন চাষ করি, আমি জুলেখারে চাষ করি। জুলেখার মাটি আমারে কত যতœ কইরা সোহাগ কইরা ডাকে।

উপর্যুপরি হাল বেয়ে আনন্দিত শুকুর। সবটুকু নির্যাস ঢেলে দিয়ে জুলেখার ভেজা-লবণাক্ত শরীরের ওপর নিজেকে সঁপে দেয় সে। বেশ কিছুক্ষণ সেখানেই পড়ে থাকে। তারপর আলগোছে বালিশে মাথা রাখে। তখনও তাদের শরীর সম্পূর্ণ উত্তাপ হারায় না। জুলেখার ভরাট স্তন তাকে আবারও আহ্বান করে। সে এক এক করে জুলেখা-নগরের তীর্থস্থান ভ্রমণ করতে থাকে। সুখের তলানিটুকু সে যখন নিঙড়ে নিচ্ছে ঠিক সেই সময় জুলেখা স্বপ্নটির কথা বলে।

আসমান থেইকা চানটা য্যান নাইমা আসলো আমার কোলের মধ্যে। আমি বারান্দায় বইসা বইসা চানটারে কোলে লইয়া কি করমু- ভাবতেছিলাম। এমুন সময় মা আমেনায় আসে আমার কাছে। আমার চুল বাইন্ধা দেয়। চানটারে দেইখা মা আমেনায় খুব খুশি। কয়,জুলেখারে তোর তো পোলা অইব।

মা আমেনার কথা শুইনা আমার বুকটা সাথে সাথে টনটন কইরা উঠে। দুধের ভারে য্যান ফাইটা পড়তে চায়। লজ্জা লাগে। তা দেখে মা আমেনা আমারে আদর করেন। বলেন, শরমাস ক্যান? তুই মা হইবি।- এই কথা বইলা মা আমেনা উধাও হইয়া যান। আর আমারও ঘুম ভাইঙা যায়।

জুলেখা গো, বাদশার মেয়ে, না, করিম বকশের মেয়ে- তুমি জানো না কী আনন্দের সংবাদ তুমি আমারে আইজকা দিলা! এর লাইগাই তো আমি এতোদিন ধইরা বইসা রইছি। কবে এই সুখবর পামু আমি! আমার পরাণ ডা ভইরা গেলো তোমার কথা শুইনা। আমি যে কী সুখ পাইতেছি তা তুমি বুঝবা না। আমার ঘরে নবীজীর উম্মত আসতেছে। আমার ঘরে আল্লাহ্ পেয়ারা বান্দা আসতেছে। আহা! এই জন্যই বুঝি আইজ এতো উৎকৃষ্ট আছিলা তুমি!

খোদার কসম! এমুন খশি সে তার স্বামীরে কখনও দেখে নাই। সে আহাদে শুকুরের বুকের ভেতের নিজেকে লেপ্টে দিতে থাকে। তার শরীর থিকা বেহেশতি আতরের ঘিরান আসতে থাকে। স্বামীকে তার ফেরেশতা মনে হয়...

তিন

আজকের দিনটি অন্যদিনের মতো নয়; অন্যরকম।

আসমান-জমিন, আলো-হাওয়া সব অন্যরকম। জুলেখার শরীর নেচে উঠে। সে কলস নিয়ে বের হয় ঘর থেকে। শুকুর লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে।

হায়! হায়! কী করতাছ? তুমার কোন কাম করন লাগবো না। তুমি খালি আমার পোলার জন্য কুরান শরিফ পড়বা, আর আমার সুন্দর চেহারা দেখবা। দেখবা নুরের মতো পোলা হইব তুমার। তোমার কুরানশরিফ পড়া শুইনা সে তোমার পেটের ভেতর থিকা হাফেজ হইয়া বাইর হইব।

জুলেখাকে কিছুই করতে হয় না। সব কাঝ করে ময়নার মা। স্বামী তাকে নিয়ে এসেছে তার সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য। ময়নার মার আসল নাম সে জানে না। তবে তার আদর যতেœ সে খুশি হয়।। এতো আদর তো আম্মায়ও করে নাই! সে মাথায় তেল দিয়া দেয়, বেণী গেঁথে দেয়। ময়নার মাকে তার স্বপ্নে দেখমা আমেনার মতো লাগে। ময়নার মা বলে, নবীজির জন্মের পর তাকে মা হালিমা দুধ খাওয়াইছিল।

ক্যান মা আমেনার বুকে দুধ ছিল না?

আছিল।

তয়!

তখনকার দিনে বড় ঘরের মাইয়ারা বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়াইতো না। এর জন্য দাই মা খুঁইজা আনতে হইতো। হালিমা ছিলেন মোহাম্মদের দুধ মা। হালিমা আম্মা খুব পয়-পরিষ্কার ছিলেন। খুবই তমিজের মহিলা ছিলেন। থাকব না ক্যান? আল্লাহ্তো আগেই জানতো হালিমার বুকের দুধ খাইয়াই না তার পেয়ারা নবীজি বাঁইচা থাকবেন।’

তুমি এতো সুন্দর কইরা কথা কও কেমনে? আর এতো কিছু ক্যামনে জানো?’

জানতে হয়। যখন তোমার মতো কারো পয়লা পয়লা বাচ্চা হয়, যারে দেহনের কেউ থাকে না, সেইখানে আমারই ডাক পড়ে। আমার বুকের দুধ খাইয়া কতো বাচ্চা বাইচা আছে! তোমার বাচ্চারেও আমি দুধ খাওয়াবো।

না না তোমার খাওয়াইতে হইব না। আমার বাচ্চারে আমিই দুধ খাওয়াবো।

কী যে তুমি বলো, জুলেখা বিবি! তোমার ঘরে আল্লাহর পেয়ারা বান্দা আসতেছেন। তার জন্য তোমারে অনেক কিছু ছাড়তে হইব। তারে তুমি আল্লাহর পথে উৎসর্গ করবা।

কিন্তুক আমার তো মায়া লাগব।

মায়া করা মানে তো তারে কইলজার ভেতর ঢুকাইয়া রাখা না। মায়া করা মানে, তারে আল্লাহর শিক্ষায় শিক্ষিত করা। সেই শিক্ষা তুমি কেমনে দিবা? তোমার কি সব শিক্ষা আছে? নাই। এর লাইগা হেরে তোমার আলেমের কাছে পাঠাইতে হইবো।

জুলেখার মন ভারী হয়ে উঠে। সে তার সন্তানকে কীভাবে দূরে পাঠাবে?

রাতে স্বামী ফিরলে তার বুকের সঙ্গে লেপ্টে যেতে থাকে সে।

শোন, ময়নার মা আম্মায় কইছে আমার ছেলেরে নাকি এলেম শিক্ষার জন্য দূরে পাঠাইতে হইব।

ঠিকই তো কইছে।

তাইলে আমি কেমনে থাকুম?

বুকে পাথর বাইন্ধা থাকবা। আমি যদি পারি তো তুমিও পারবা।

এইটা কি কথা কও তুমি?

হ, ঠিকই কই। আর আমরা কালই আলেমের গ্রামে চইলা যাবো। সেইখানেই তোমার বাচ্চা হইব।

আলেমের গ্রাম! কুন খানে ।

নদী পার হইয়া সাত মাইল। তুমি কাপড় চোপর গুছাইয়া লও।

স্বামীর এই চেহারার সঙ্গে সে কোনদিন পরিচিত ছিল না। শুকুরের চোখে মুখে কী এক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। টকটকে জবাফুলের মতো ওই চোখ যেন কোন মানুষের নয়। একটা হিম স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যেতে থাকে।

চার

কোথায় যাচ্ছে সে সাজানো সংসার ফেলে! প্রাণ কাঁদে। বুকটা হু হু করে ওঠে। আর একটা কাঁটা খঁচখঁচ করতে থাকে বুকের মধ্যে। বাতাসেও ভেসে বেড়াতে থাকে মিহি কান্নার ধ্বনি । চারদিকে কেবল জল আর জল। কোনো কিনারা নাই।

পূবের আকাশটা তখন একটু একটু লাল । নৌকা তখন মাঝ নদীতে। জোয়ার নাকি ভাটা ঠিক বুঝা যায় না। জুলেখার ভেতর কলস ভেঙে গেল। ছায়া-শাড়ি ভেদ করে জলে ভিজে যায় পাটাতন। সে ময়নার মার হাত খামচে ধরে।

বিষ, আমার পেটে বিষ করতাছে। কোমর কাল কইরা নিতাছে। আমার পাও অবশ হইয়া যাইতাছে।

ময়নার মা অভিজ্ঞতায় বুঝে যায় জুলেখার প্রসব বেদনা উঠেছে।

নাও ভিরাও শুকুর মিয়া । জুলেখার বাচ্চা হইব।’

কোথায় ঘাট! কোথায় কি! শুকুর আরো জোরে নাও বাইতে থাকে সে।

শুকুর ঘেমে উঠে

জুলেখা ঘেমে উঠে

ময়নার মা ঘেমে উঠে

ঠিক সেই সময় নুন আর রক্তে মাখামাখি হয়ে পূবের আকাশটা লাল হয়ে উঠে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে একজন মানব সন্তানের আবির্ভাব হয়।

সে কি আল্লাহু আকবর বলে কি ক্রন্দন করে! জুলেখা জানে না। তবে স্পষ্ট দেখে, ময়নার মার ভরাট স্তন থেকে দুধ গড়িয়ে পড়ছে।

ময়নার মার পুষ্টু উলান থেকে দুধের ধারা নামছে। এতো দুধ! সে কখনও কারো বুকে দেখে নাই। এই গাঙ্গে যতো জল আছে তত দুধ আছে নাকি ময়নার মার বুকে! সে কি তার সন্তানের মুখে স্তনের বোঁটা তুলে দেয়! জুলেখা কি স্বপ্ন দেখছে!

পাঁচ.

এখন সন্ধ্যা নাকি রাত! ঠিক বোঝা যায় না। মনে হয় অনন্তকাল সে ঘুমিয়ে ছিল এই নৌকার ভেতর! জুলেখা কাউকে কোথাও দেখে না। না তার স্বামী, না সন্তান, না ময়নার মা। কোথায় তারা? তাকে ফেলে সবাই কোথায় চলে গেছে? সে কি তবে মরে গেছিল?

মরেই যদি গিয়ে থাকে তাহলে এখন কি সে বেঁচে আছে!

এতো অন্ধকার চারদিকে! সে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। দূরে কি আলোর মতো কিছু একটা দেখা যায়। জুলেখা উঠে বসে। রক্ত শুকিয়ে পরনের ছায়া শাড়ি চটচটে হয়ে আছে। বাতাসে জলের ঢেউ লেগে নৌকা বাড়ি খাচ্ছে পাড়ের সঙ্গে।

ময়নার মা আম্মা! জুলেখা ডাকে। কোন সারা নেই।

কই, আমার আদরে ধন!

কই, তুমি আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী!

সাড়া নাই। ছায়া আর শাড়ির কুণ্ডুলি পাকিয়ে সে ছইয়ের বাইরে আসে।

নাই। কেউ কোথাও নাই।

তার স্বামী, বাচ্চা কই গেল? জুলেখা নৌকা থেকে নামে। পাগলের মতো এগুতে থাকে সামনের দিকে। অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না । দূরে, ঐ আলোটিই আপাতত গন্তব্য তার। আলোটি ক্রমশ নিকটবর্তী হলে সে ফুলের গন্ধ পায়। বিস্তীর্ণ রজনীগন্ধা ফুলের জমিন ধরে সে হাঁটছে। তবু বুঝতে পারে না পারে না কোথায় আছে? কিংবা কোথায় যাচ্ছে। সে যে এখন শুকুর আলীর জ্যোৎস্নাগ্রামের অলৌকিক নার্সারির ভেতর দিয়ে হাঁটছে তাও জানে না।

ফুলের ক্ষেতের শেষ প্রান্তে একটি টিনের ঘর তার দৃষ্টিপথে বাধাগ্রস্ত হয়। খোলা দরোজা দিয়ে আলগোছে ভেতরে ঢুকে যায়। আর ভেতরে ঢুকেই যুগপৎ বিস্ময় আর আতঙ্কে নীল হয়ে যেতে থাকে।

জীবনের উদ্বাহু আস্ফালনে জড়ভরত মৃৎপাত্রগুলি একসঙ্গে ভেঙে গেল। দীর্ঘদিন তারা সহ্য করেছে রোদ-বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপট। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। ডাইনোসরের পরিত্যক্ত ডিমের মতো তারা পড়ে ছিল প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে। নিতান্ত অনাদরে, অবহেলায়। ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে হাজারে হাজারে রক্তমাংসের চারাগাছ। রহস্যময়তার প্রায়ান্ধকার প্রকোষ্ঠের দীর্ঘ যাবিত জীবন শেষে তারা মুক্ত। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে নড়াচড়া করতে থাকে। নির্বিষ সাপের মতো কেমন করে ঐ মৃৎপাত্রের ভেতর কুণ্ডুলি পাকিয়ে ছিল! অবাক বিস্ময়ে ভাঙা পাত্রগুলির টুকরোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

স্বল্প আলোয় জুলেখা দেখে পায় তারা দুলছে। প্রথমে সে ভেবেছিল ওগুলো নার্সারির চারাগাছ। কিন্তু চারাগাছগুলো তার দিকে এগুতে থাকলে বুঝতে পারে ওগুলো মানব সন্তান। কিন্তু কেন এভাবে তাদের পাতিলের মধ্যে রাখা হয়েছিল! চারাগাছের মতো! এই রক্তমাংশের চারাগাছ কবে থেকে এখানে বেড়ে উঠছিলো! কে জানে! মানব চারাগাছগুলো একটু আগেই মাটির পাতিল ভেঙে বাইরে এসেছে। দু’পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জুলেখার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে তারা এগিয়ে আসতে থাকে। তারা আসছে। হাতের তালুতে ভর দিয়ে; প্রায় উড়ে উড়ে । যেন প্রবল আক্রোশে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে তারা। জান্তব গোঙানির আওয়াজ পুরো ঘর জুড়ে এখন। তারা জুলেখাকে ঘিরে ধরে , কেউ কেউ টেনে ধরে তার শাড়ি, কেউ কেউ তার শরীর বেয়ে উঠতে চায়। জুলেখা ভয় পায়। তার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠে, পালাও! সে দৌড়াতে থাকে।

আর তার পেছন পেছন অসংখ্য পাতিল-শিশু আম্মা, আম্মা করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে, ঝাঁকে ঝাঁকে...

বানেছা বিবির উড়াল

বানেছা বিবি জল ঢালে গ্লাসে।

ভাদ্রের জলজ রজনীতে চাঁদটি একলা হয়ে গেলে তার তেষ্টা পায়। আঙরার মতো জ্বলছে তার বুকখানা। মরুভূমি মনে হয় নিজেকে। অথচ ফোরাত কতদূর সে জানে না। কেউ তাকে বলে না, বানেছা বিবি এই নাও তেষ্টার জল। তুমি পান করো। হাউস মিটাইয়া পান করো। এই জল পান করলে তুমি বিবি খাদিজার মতো মুহম্মদের দর্শন পাবে। এই জল আবে হায়াত। তুমি চির যৌবনবতী থাকবে। বানেছা বিবি মাটির সুরাহি থেকে জল ঢালে; আবেহায়াত ঢালে। সে চির যৌবনবতী থাকতে চায়; জিরানি বিবির মতো। জিরানি বিবি যার গায়ের গন্ধে মাতোয়ারা তার স্বামী। সে বুঝে না আজমত ক্যান জিরানি বিবিরে এতো ভালা পায়! সেও নারী, জিরানি বিবিও নারী। নারীতে নারীতে এতো কেন তফাৎ; কে জানে! যাই হোক সে আর বানেছা বিবি থাকতে চায় না; জিরানি বিবি হতে চায়।

ভাদ্রের এমন জল ধোয়া মিহিদানা রাতে তার ঘুম আসে না। পরতে পরতে জমে রাত ক্রমশঃ ভারী হয়। বাতাসে জলের গন্ধ! ঝিম ধরা! জলের গন্ধ তীব্র হলে আসমান থেকে দুধ গড়িয়ে পড়ে। আর সেই দুধ ধুয়ে দিতে থাকে গ্রামের সম¯ত গাছপালা, পশুপী, বকনা বাছুর, এমনকি ষণ্ডা কাসেমের প্রমত্ত ষাড়টাকেও । আর ধীরে ধীরে বঙ্গশের পাড় ধরে সীমানা বি¯তারী কালিয়ান গ্রামের সিক্ত জমিনেও ঢুকে যেতে থাকে। আর এতে ধুয়ে যায় সিকদার বাড়ির রান্ধন ঘরের রূপবান টিনের চাল, বড় ঘরের টালি, নিদান কালের জন্য জমা করে রাখা খড়ের স্তুপ; খড়ের স্তুপের মধ্যিখানে নিঃসঙ্গ পাকনা বাাঁশটিও। এমন জ্যোৎস্নাখুপী রাতে বানেছা বিবি আঁশ বটিতে কেটে ফেলা বাউশা মাছের মুণ্ডর মতো তড়পাতে থাকে। জন্মের তেষ্টা পায় তার। বিছানা থেকে নেমে ঘরের কোণায় মাটির ঢিবি ওপর বসানো সুরাহির থেকে জল ঢালে কাঁসার গেলাশে; তারপর এক ঢোঁকে গিলে ফেলে। সুরৎ করে একটা ঠাণ্ডা সাপ যেন তার ভেতরে সেঁধিয়ে যায়। এতো তেষ্টা কেন তার! সারা অঙ্গে এতো আগুনই বা কেন? শেষ বিকেলের পড়šত রোদে ফেটে যাওয়া ডালিম দেখে সেই যে তার শরীর জ্বলতে শুরু করেছিল, এখনও জ্বলছে ধিকি ধিকি। ডালিমের মতো তারও অমন ফেটে যেতে ইচ্ছে করছে। কী যেন তার তলপেটে ঘাই মারে! যেন কোটি কোটি মাছের ডিম ফেটে যাচ্ছে। সে জ্বলতেই থাকে; শুকনা আমকাঠের আগুনের মতো। তার উরুর নদী বেয়ে কষ নামতে থাকে। বুকের ভেতর উষাস জেগে উঠে। তার কান্না পায়। দরিয়ার ঢেউয়ের মতো উথাল পাথাল কান্নার গমকে সে কেঁপে উঠে।

আহারে! সিকদার বাড়ির বড় বউ কাঁদছে। বিনিয়ে বিনিয়ে। মিহি সুরে।

চিকন সেই সুর ভাসতে থাকে বাঁশ ঝাড়ে, লেবুবনে, করমচার ডালে। তারা ব্যথিত হয়। এমনকি বনবিবির কবরের ওপর গজিয়ে উঠা ঘাসও বেদনায় মলিন হতে থাকে। কেবল আজমত হয় না...

আজমতের কান্না ভাল লাগে না। বানেছা বিবিকে ভাল লাগে না। সে জিরানি বিবিরে ভালা পায়।

মাইয়া মাইনষের এতো ঢং কিসের? ঘরের বউ বলে জোছনার ঘিরান পায়। তর ঢং ঢাং সইয্য করার সময় আমার নাই।’ স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে বউকে। ‘তুই তো আর জিরানি বিবি না।

জিরানি বিবি! গঞ্জের উত্তর দিকে বঙ্গশের পাড়ে লগগি গেড়েছে। নৌকার জীবন তার। সূতানলী সাপ তার চুলের মালা! ‘আয় হায়!’ মিশির লাহান কালা শরীলে কত্তো জাদু! চিকন পিছলা কোমর য্যান জীওল মাছ। ধরলেই মনে হয় পিছলাইয়া যাইব! এক মাইল দূর থেইকাই আজমতের গায়ে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। বানেছা তো তার কাছে কিছুই না। ধলা চামড়া আর বিড়াল চোখের বানেছা য্যান পাইনসা; ভিজা খ্যাতা। জিরানি বিবির কালা চুলে গন্ধরাজ তেলের ঘিরান; নেশা ধরে। কই জিরানি বিবির তো কান্দনের বিমার নাই! বানেছা কান্দে ক্যান? আর চান্দের লগে কান্দনের কী সম্পর্ক?

দুই

চাঁদের সঙ্গে সখ্য বানেছা বিবির বহু পুরোনো। যেন বা তার জন্মেরও আগের সেই সম্পর্ক। সে চাঁদ ভালোবাসে, জ্যোৎস্না ভালোবাসে। তীব্র জ্যোৎস্নায় মেঘের সাথে চাঁদ উড়ে যেতে থাকলে তারও উড়াল দিতে ইচ্ছে করে। সেই শৈশবে খোলা উঠানে মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে সে দেখেছে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ‘চান্দ কেমনে উড়াল দেয়।’ নিঝুম রজনীর চাননি প্রহরে বাবা মাকে নিয়া বঙ্গশে কোষা ভাসালে সেও সঙ্গী হতো। নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখত। জল-নৌকা-বৈঠা; ছন্দ উঠে। যেন পুরাতন পৃথিবীর প্রথম ছন্দগুলো ঘুরে ফিরে আসে নয়া পৃথিবীতে। আর বানেছার মনে সেই সুর যেন গেঁথে আছে চিরদিনের জন্য। মাঝ নদীতে নৌকা চলছে ধীরে- আর তার সঙ্গে বিলম্বিত লয়ে পানকৌড়ির টুব্ টুব্ ধ্বনি তাকে শিহরিত করে। বানেছা পরী হয়ে যায়; চাঁদের সঙ্গে উড়াল দেয়। সেবার ভরা চান্দে বাওশার বিলে গ্রামের সব পুরুষমানুষ মৎস্য শিকারে বের হলে তারও চন্দ্র শিকারে যেতে ইচ্ছে করে। কাঞ্চনমালার দীঘিতে পূর্ণিমার আ¯ত চাঁদটা ডুবে আছে। আর দীঘি আলো করে থাকা লাল লাল শাপলা ফুলগুলো বাতাসে সাঁতার কাটছে। এমন পূর্ণিমা যেন তার জীবনে কখনো আসেনি। শরীরে একটু বেশিই ফুর্তি ছিল সেদিন। সে পায়ের নিচে মাটির তল পায় না । জোছনার নিরাই নিরাই আলোর মিহি নকশা পেরিয়ে বাইর বাড়িতে পা রাখে সে। বাংলা ঘরে আজ কেউ নেই। তাদের বাড়িতে অতিথ-মেহমান এলে বাংলা ঘরে থাকতে দেয়া হয়। বাংলা ঘর পর্যšত পৌছেই তার অস্ব¯তি শুরু হয়। কেবলই ভেজা ভেজা অনুভূতি। কেমন ভয় পায় সে! একই সঙ্গে কেমন আনন্দ! শরীরে এতো আনন্দ কেমন করে এলো সে ভেবে পায় না। কোথায় কোন বাগানে যেন হাজার হাজার রজনীগন্ধা ফুটে ওঠে। কোটি কোটি পাখির কলস্বর তাকে অভিনন্দন জানায়। আর দূর পরগনা থেকে একটা সুর ভেসে আসতে থাকে বাতাসে। সে দাওয়ায় বসে থাকে ঠাঁয়। ভোর না হওয়া অবধি। প্রতি পূর্ণিমার রাতেই সে পুষ্পবতী হয়েছে। আর চন্দ্রের অমা প্রাপ্তির অষ্টম দিনে তার বুকের ভেতর উষাস জাগে; হাহাকার লাগে।

আজও তার ভেতরে এমন উষাস জেগে ওঠে। আজমতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয়নি তার। আজও ষ্পষ্ট দেখতে পায় সেদিনটিকে। স্বাপ্নের মতো মনে হয় তা। তবে স্বপ্নের রেশ কেটে যায় মুহূর্তেই আজমতের কথা শুনে। বিয়ের রাতেই স্বামী তাকে বলে দিয়েছে, সে কেবল বিয়ে করেছে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। সে তাকে জিরানি বিবির কথা বলে। বানেছা গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। আজমত তার গায়ে হাত রাখলে সে কুঁকড়ে যেতে থাকে। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে যায়। সে তো আর জিরানি বিবি না। সে হেরে যায় জিরানি বিবির কাছে। আজমত বিরক্ত হয়। ঘর ছেড়ে চলে যায়। সে বুঝতে পারে না তার কী করণীয়। সে কেবলই জিরানি বিবি হতে চায়। জিরানি বিবি চুলে গন্ধরাজ তেল মাখে । সেও হাট থেকে গন্ধরাজ তেল কিনে আনে। সারাদিনের কাজ শেষে স্নান শেষে মাথায় তেল মাখে। জিরানি বিবির চিকনা কোমর। সে বেশি করে ধান ভানে কোমর পাতলা দেখানোর জন্য। বঙ্গশের সাদা মাটি দিয়া ঘর লেপে; ডুয়া লেপে। তার ফর্সা হাতে নীল কাঁচের চুড়ি ফুটে থাকে পদ্মের মতো। কাদা লেপা হাত দেখে সে নিজেই মুগ্ধ হয়। সে সন্ধ্যায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়না দেখে। আজমত কেন তার হলো না! সে কি এখনও জিরানি বিবি হতে পারে নাই? জিরানি বিবি কিভাবে হতে পারবে সে বুঝে না।

ও জিরানি বিবি! তুমি কেমনে পুরুষমানুষ ধইরা রাখো আমারে কইবা?

তিন

দিন তো ভালই কাটে তার, তবে রাত যেন কাটেনা ।

সন্ধ্যার পরই বানেছা বিবি গভীর সমুদ্রে নিপ্তি হয়। একলা সুনসান বাড়িতে স্বামীর অপোয় থেকে থেকে তার ঘুম পায়। ঠিক ঘুম হয় না। সে জেগে থাকে। সে ঘুমিয়ে থাকে। কিংবা জেগে জেগে ঘুমায়। অথবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জাগে। বাপের দেয়া আয়নার সামনে বসে বসে সে একশ’ বার চুল বাঁধে আর একশ’ বার খুলে। বেণী বাঁধে আর খুলে। চোখ ভরে কাজল দেয় আবার ভেজা গামছা দিয়ে মুছে ফেলে। হাতের আসমানি কাঁচের চুড়ি এক এক করে খুলে ফেলে। আবার পরে। রাইতের বেলা আয়নায় সামনের বসলেই তার দাদীর কথা মনে হয়। ‘রাইতের কালে আয়না দেখা ভাল নম্র- একথা দাদী তাকে বার বার বলেছে।

কী হয় দাদী?

বালা মসিবত আহে।

আমার আয়না দেহনের লগে বালা মুসিবতের কী সম্পর্ক?

বুড়ি বলতে পারে না। তবু এক ঘেয়ে সুরে প্রতিদিনই তাকে সাবধান করে। বুড়ি মরে গেছে কবেই। তবু আয়না হাতে নিলেই তার বুড়ি এসে হাজির হয়।

অন্ধকার হতে হতে এখন অনেকটাই ফিকে। অষ্টমীর য়ে যাওয়া চাঁদ ম্রীয়মাণ আলোয় নিমের ছায়া পড়ে। মোমের আলোকেও তার কাছে জ্যোৎস্নাার মতো লাগে। চাঁদ ও মোমের সখীআলোয় সে আয়নায় মুখ রাখে। বিস্মিত হয়। আয়নায় মাতামহীর পাকনা চুল ঝিলিক দেয়। ‘বুড়ি মইরাও আমারে ছাড়স না কেন?’ বৃদ্ধার বলিরেখা সম্বলিত মুখটি স্পষ্ট হয়। সেই সঙ্গে একটা তীর্যক হাসি নাকি উৎকণ্ঠা বৃদ্ধার ঘোলাটে চোখে বানেছা ঠিক বুঝে না। আয়না থেকে বৃদ্ধার ছায়া মিলিয়ে গেলে এবার তার মুখটি ষ্পষ্ট হয়। সে নিজের মুখ দেখে, চাঁদ দেখে, জ্যোৎস্নার বাঘ দেখে।

আয়না ! আয়না! কও ছে দেহি ক্যারা বেশি সুন্দর? আমি না ঐ আসমানের চাঁন? আসমানের চান্দের কালা দাগ আছে আর আমার গালেও দ্যাখো কালা তিল আছে।

এই বলে সে নিজের ডান গালের তিলের ওপর তর্জনী রাখে। ময়েজ ভাই তাকে বলেছিল ওই কালো তিলের জন্য তাকে নাকি সিনেমার নায়িকার মতো লাগে। ময়েজ ভাই রূপচান্দা সিনেমা হলে ব্ল্যাকে টিকেট বিক্রি করে। তার জন্য প্রতি সপ্তাহেই সিনেমার টিকেট দিতে চায় ফ্রি ফ্রি। সে পাত্তা দেয় না। সে তার স্বামী আজমতের কথা ভাবে।

সারাজীবন ধরে সে কিসসার রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখে এসেছে। আজমতের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে আজমতকেই তার রাজপুত্র ভেবেছিল। আজও ভাবে। সিদ্ধাšত নিয়ে ফেলে এবার কিছুতেই আজমতকে সে জিরানি বিবির কাছে যেতে দেবে না।

কন্যা কী করো তুমি?

বানেছা অবাক হয় ।

কুমার!

হুম! কী করো তুমি?

তুমার কথা ভাবি। ভাইবা ভাইবা দেহ কালা করি। হাড় কালা করি।

এতো ভাবো ক্যান কন্যা? আমি তোমার অšতরে সারাণই থাকি।

আমি জানি। তাও আমার ডর লাগে। খালি মুনে হয় কুনদিন না তুমারে হারাই।

ঐ কথা বলে না কন্যা। যতদিন চন্দ্রসুরুজ আছে ততদিন আমি তুমার।

যতদিন চন্দ্র সুরুজ আছে ততদিন আমিও তুমার।

তাইলে তুমি এখন আমারে তুমার চওড়া সিনার মধ্যে লুকাইয়া রাখো।

আর আমি তুমার চুলের মধ্যে বাসনা তেল হইয়া মিশা থাকি।

যৈবতী কন্যা চুল খুলে দেয়। পাশার দান মেলে দেয় হাওয়ায়। সে রাজকুমারের সঙ্গে পাশা খেলে।

তুমার গালের তিলটা খুব সুন্দর!

নেও এইটা তুমারে দিলাম।

তোমার কপালের লাল ফোঁটাটাও আমারে দেও।

দিলাম।

তুমার ডালিমটা আমারে ছুঁইতে দেও।

বানেছা কেঁপে ওঠে। মনে হয় তার শরীর ভেঙে জ্বর আসছে। সে রাজপুত্রের দিকে এগিয়ে যায়। রাজপুত্রকে দুহাত দিয়ে আকর্ষণ করে তার দিকে।

কী করস এতো রাইতে? জাšতব একটা হুঙ্কারে বানেছা চমকে ওঠে। আজমত কখন এসে শুয়ে পড়েছে সে একটু টের পায়নি। আজমতের হুঙ্কারে ভয় পেলেও সে মরিয়া। আজমতকে সে আজ জয় করবেই। বানেছা তার ¯তন লেপ্টে দেয় আজমতের পিঠে; জ্যোৎস্না লেপ্টে দেয়।

সে মন্ত্রের মতো ফিস ফিস করে। এই দ্যাখো আমার দীঘল কেশ। এই কেশ দুইভাগ কইরা তুমারে বাইন্ধা রাখমু। এই দ্যাখো আমার হাতে আসমানি চুড়ি। ডালিম কুমার আমারে তুমার পঙ্খীরাজে চড়াও।’ বানেছা কদম ফুলের রোয়ার মতো ক্রমশঃ ফুলে উঠতে থাকে। আচমকা চুলে টান পড়ে তার। যেন তলপুকুরে ঘাপটি মেরে থাকা চুল প্যাঁচানি তাকে আটকে ফেলেছে। সে তড়পায়।

আয় মাগী আইজ তর জন্মের খায়েস মিটাইয়া দেই।’

বানেছার কানে কে যেন গরম লেই ঢেলে দেয়। আজমতের বুনো ঘোড়া তছনছ করে বানেছার পুষ্পের বাঁশ ঝাড়। ভাদ্রের বাতাস জোরে জোরে ধাক্কা দেয় বানেছার ঘরের জানালায়। আর জানালার সামনে ঝুলে থাকা টগরের ডাল মট মট করে ভেঙে পড়ে। আর সে দেখে তার মাতামহীর পাকনা চুল হাওয়ায় কেবলই উড়ছে.. .

চার

ঝড় থেমে গেছে অনেকণ। বানেছা বুঝে না সে এখন কী করবে? সে কি এখন জ্যোস্না গিলে ফেলবে? নাকি জ্যোৎস্না তাকে গিলে ফেলেছে ? কী জানি! সময় নেয় সে। নিজের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেয়। আজ আবার তার বালিকা বয়সের মতো চন্দ্র শিকারে বের হতে ইচ্ছে করে! কাঞ্চনমালার দীঘিতে চাঁদটা কি এখনও ডুবে আছে ? নাকি তার জীবনের মতো অমাবশ্যায় ঢেকে গেছে। তবু সে একবার তা নিজের চোখে দেখতে চায়। হায় চাঁদ! কোথায় সে! কৃষ্ণ কাফনে ঢেকে আছে গোটা দীঘি। একফোঁটা জলও নেই দীঘিতে! সে অবাক হতে চায়। কিন্তু হয় না। কেননা সে জানে পুকুরের ধাপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তল পুকুর থেকে একটু একটু করে জল উঠে আসতে থাকবে.. .

কাঞ্চনমালা পুকুরের প্রথম সিড়িতে পা রাখে। পাতাল ফুঁড়ে জল উঠে আসতে থাকে। সে পা রাখে দ্বিতীয় ধাপে। জল বাড়ে। কাঞ্চনমালা নামতে থাকে গভীর থেকে আরো গভীরে...

জোঁকের বাড়ি, বর্শা এবং নাগিনীর ফনা

বদ্ধ কাঁচের দেয়ালে ঘষা খেয়ে পিছলে যায় প্রাণীগুলোর শরীর। মেরুদণ্ডহীন শরীরটাকে বাঁকিয়ে আবার দেয়ালে ঘষা দেয়। টলটলে জলের ভেতর কালো কুচকুচে টোপা টোপা শরীর তাদের। সেদিকে তাকিয়ে বিজাতীয় ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠে পারভীনের। বাসরঘরে ফুল নয়, লতাপাতা নয়। ঘরভর্তি ১২/১৪টা আজব প্রাণীভর্তি কাঁচের বয়াম। আতঙ্ক আর ঘৃণায় তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। , কি এই গুলা?

নতুন বউয়ের অজ্ঞতায় যেন খুবই আনন্দ পায় কদমরসুল। গ্রামের মাইয়া হইয়া জোঁক চিন না! এইগুলা হইল জোঁক। কবিরাজী ওষুধ বানাইতে হয়...। কদমরসুল বাক্যটা শেষ করে না। এ এলাকায় কবিরাজ হিসেবে কদমরসুলের খুবই নামডাক। এটা পারভীনও জানে। জানে তার মতো আরো অনেকেই। অনেক বড় কবিরাজের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে এটা সে ভাল করেই জানে। কিন্তু জানলে কি হইব। ঘরের মধ্যে এমুন বিদঘুইট্যা প্রাণীর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে তা কি সে জানত?

পারভীন আরেকবার ভালো করে বয়ামগুলোর দিকে তাকায়। গা ঘিনঘিনে ভাব তৈরি হয় তার ভেতর। এইগুলা জোঁক ? ছি! এতো বড় জ্ঁোক হয় নাকি! ‘এ গুলান দিয়া কি হয়?’ কদমরসুল পারভীনের কানে কানে জোঁক রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে। নতুন বউয়ের কান গরম হয়ে যায়। আর একবার সে জোঁকভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকায়। মনে মনে সিদ্ধাšত নিয়ে ফেলে সে। এদের সে সরাবেই।

জোঁকগুলা এইখানে রাখন যাইব না।’ পারভীনের দৃঢ় কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে যায় সে।

ক্যান এই ঘরে থাকলে অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে। এই গুলারে তুমি ঐ ঘরে থুইয়া আসো।

এইডা কি কও তুমি? এই গুলাই তো আমাগো জীবন। অন্যঘরে রাখরে চুরি হইয়া যাইব।

কেউ তোমার ঐ জোঁক চুরি করতে আইব না। আর তুমিও এই জোঁকের ব্যবসা ছাইড়া দেও। দুনিয়াতে কতো কাম আছে। তা না জোঁকের ব্যবসা।’

আমার জোঁকের ব্যবসা না। আমি হইলাম কবিরাজ।’

ঐ একই হইল। মাইনষে জিগাইলে কওন যাইব না কি কবিরাজী করো তুমি।’

বাসরঘরে এই রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না সে। নতুন বউ এতো কথা কয়! কদমরসুল মুখে কিছু বলে না। বয়ামগুলো একটা একটা করে পাশের ঘরে রেখে আসে। খুব কষ্ট হয় তার। এতোদিন তারা একসঙ্গে ছিল। এখন বলে অন্য ঘরে রাখতে অইব। মাইয়া মানুষের স্বভাবই এমুন। স্বামীর ভালোবাসার কোন কিছু সহ্য করতে পারে না। খালি মনে হয় তার জিনিসে অনে ভাগ বসাইছে। আলায় বাঁচাইছে তার মা বইন নাই। নইলে পয়লা রাইতেই কইত তোমার মা বইনের লগে থাকুম না।

কদম রসুল অবশ্য আগে কবিরাজী করতনা। পুরোদস্তুর কবিরাজ হিসেবে কদমরসুলের অভিষেক হয় এই হরিণহাটা গ্রামেই। আগে শহরে ও¯তাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকত সে। ও¯তাদ তাকে শেখায় কেমন করে কথা বলবে। কেমন করে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে থাকতে হবে। প্রশিণ পর্ব শেষ হলে সে পসরা নিয়ে বের হয়। চৈত্রের মধ্যাহ্নে সবাই যখন ভাতঘুম যাচ্ছিল: সেই বিরাণ দুপুরে হরিণহাঁটার লোকজন প্রথম দেখে কদমরসুলকে। ডিএনডি বাঁধের ওপর দিয়ে গ্রামের যে একমাত্র সড়কটি চলে গেছে তার পাশে চট বিছিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে সে। একপাশে একটি টিনের বাক্স। তার ওপর চায়ের ফাস্ক। অন্য পাশে ছোটবড় বেশ কিছু কাঁচের বয়াম। বয়ামের ভেতর অ™ভুত দর্শন প্রাণী। তাদের পিচ্ছিল শরীর কাঁচের বয়ামে ঘষা খায়। নদীর পাড়ে গ্রাম হওয়া সত্ত্বেও তারা এমন প্রাণী দেখেছে কিনা মনে করতে পারে ন। কেননা তাদের দেখা কোন প্রাণীর সঙ্গেই এগুলোর মেলে না। লোকজন ফিসফিস করে।

কী এগুলা! দেখলেই শরীর গুলাইয়া ওঠে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ কদমরসুলকে প্রশ্নও করে। কদমরসুল নির্বিকার। কারো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না সে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফাস্ক থেকে চা ঢালে। আদা চা। লোকজন বিরক্ত হয়।

‘কেমুন আজব মানুষ। কথা কইলে উত্তর দেয় না। চলো যাই গা।’

আসলে সে অপো করছিল ভিড় বাড়ার জন্য। কম লোকের মধ্যে কাজ করে আনন্দ পায় না সে। লোকগুলোর চরম ধৈর্যচু্যুতি ঘটলে সে কথা বলে ওঠে। তবে খুব উচ্চস্বরে নয়। তার অনুচ্চস্বরও সকলে শুনতে পায়। পাতলা হয়ে যাওয়া ভিড় আবার জমে উঠে। জমতে জমতে কদমরসুলকে ঘিরে এক দূর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে সবাই। যেন তার কথা দেয়াল ভেদ করে বাইরে যেতে না পারে। ধীরে ধীরে দিনের আলো কমে আসে। ম্রীয়মান হয়। সেই আলোয় জমে উঠে কদমরসুলের ব্যবসা। আজ একটু তাড়াতাড়িই চলে এসেছে সে। ১ম দিন বলে কথা। কাল এমনসময় আসবে যেন অন্ধকার নামতে দেরি না হয়। সে জানে দিনের আলোয় গোপন কথা খুব একটা জমে না। মানুষ গোপন কথা শুনতে চায় আড়ালে, অন্ধকারে। পুরুষ মানুষের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা নিয়ে ব্যবসা তার। সে জানে পুরুষ মানুষ যতো হম্বিতম্বিই করুক না কেন মাইয়া মাইনষের কাছে ভিজা বিলাই। আর কোন পুরুষ মানুষ যদি বউকে খুশী করতে না পারে তাইলে তো কথাই নাই। আর এ কথাটা ফরিদা তাকে ভালই শিখিয়ে দিয়েছে। ও¯তাদ মরে যাওয়ার সময় তাকে কথা দিয়েছিল জোঁকগুলোকে এবং তার মেয়ে ফরিদাকে দেখেশুনে রাখবে। আহা ফরিদা। রাইতের বেলায় মাথায় কদুর তেল দেয়। তারপর অনেকণ ধরে চুল আঁচড়ায়। বেণী করে, খোলে। আবার বেণী করে। কদমরসুলের খুব ইচ্ছে হয় তার মাথায় একটা গোলাপ ফুল গুঁজে দেয়। কিন্তু ফরিদার সামনে গেলেই সে দুধের শিশু। একটা কথাও বলতে পারে না। ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে তাকে চোরের মতো দেখতে থাকে। ‘কী অমন হাবলার মতো খাড়াইয়া রইছ ক্যান? পাতিলে ভাত তরকারী আছে খাইয়া লও। ’

এই রকম সম্ভাষণ সে প্রতিনিয়তই পায়। তাই কিছু মনে করে না সে। নিজেই ভাত বেড়ে খায়। আর ফরিদা চকির ওপর বসে আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুখ দ্যাখে। কদমরসুল বুঝে মুখ দেখার জন্য আয়নাটা ছোট হয়ে গেছে। কালই একটা বড় আয়না কিনে আনবে বাজার থেকে। মুখ ফসকে বেরিয়েও যায় সেকথা।

কাইলই তোমার লিগা একটা বড় আয়না কিনা আনমু।

লাগব না তুমার আয়না।

কদম রসুল বুঝতে পারে না আকস্মিক ফরিদার কী হলো? কদিন আগেও তো সে তার সঙ্গ পাওয়ার জন্য উতলা থাকত। মনে হয় একা একা বাড়িতে থাকে তাই রাগ হইছে।

কদম রনসুর খাওয়া ফেলে ফরিদার কাছে গিয়ে বসে। মিনমিন করে বরে দেরী হইছে বইলা রাগ করছ? কাইর থিকা রাইত ৮টার মধ্যে বাড়ি ফিরুম।

ফরিদা যেন বিরক্ত হয়।

রাইত ৮টার মধ্যে বাড়ি ফিরন লাগব না। তুমি সরো। তুমার শরীল থিকা জোঁকের গন্ধ আহে।

লবণ পরা জোঁকের মতো চুপসে যায় কদম রসুর। ফরিদার উধত যৌবনের কাছে ম্রীয়মান। অচল। আ¯েত আ¯েত সে সরে যায়। ফরিদা শেষ ঝারে।

ধীরে ধীরে কদমরসুলের প্রতি ফরিদার আগ্রহ কমতে থাকে। তা যে কতোটা তা ঠিক ঠাহর করতে পারে না।

সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে তার একটু রাতই হয়ে গেছিল। অমাবস্যার ঘুটঘুইট্যা অন্ধকার। পথে দুইতিনবার উস্টা খায়। চেনা পথে এমন উস্টা সে কখনও খায়নি। একটা বেড়াল তার পেছন পেছন মিঁও মিঁও করতে করতে আসছে অনেকণ ধরে। সে গা করে না। তবে বাড়ির কাছে বাঁশঝাড়টার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ শরীরে কাঁটা দেয়। একটা ঝিলিক দিয়া বিড়ালটা বাঁশঝাড়ের মাথায় উঠে যায়। কদম রসুলের এরপর কিছু মনে নেই। কিভাবে যে বাড়ির ভেতর ঢুকে বলতে পারবে না। বাড়িতে ঢুকেও তার অবাক হওয়ার পালা যেন শেষ হয় না। সারাবাড়ি অন্ধকার। কোথাও ফরিদা নেই। কদমরসুল দুইটা ডাক দেয়। রাতে উথাল পাথাল জ্বর নামে। খবর নেই। খুব কাšত বোধ করতে থাকে সে। কোনমতে শুয়ে পড়ে। সারারাত জ্বর ছিল, না ঘুম ছিল জানেনা কদম রসুল। সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখনও ফরিদাকে কোথাও দেখা যায় না। ফরিদা কোথায় যেতে পারে ভেবে পায়না সে। আশে পাশে কারো বাড়িও তো সে যায় না? কেউ কি তার বাড়িতে আসে? কিভাবে বলবে সে? একটা অস্ব¯তি তার গলায় আটকে থাকে। ফরিদা নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কদম রসুল প্রথম প্রথম কয়েকদিন কাজে যায় না। কিন্তু পেটে খিদের মরণ টান। ফরিদার শরীরের নেশার চেয়েও তীব্র। ।

কদম রসুল এখন আর বাজারে যায় না বাড়িতেই ওষুধ দেয়। লোকের আনাগোনা বাড়ে। নারী পুরুষ সবাই আসে তার কাছে। তার একলা একাকি জীবন দেখে তার কাছে নিয়মিত আসা যাওয়ায় করা কেউ কেউ তার বিয়ের ব্যব¯থা করে। পারভিনকে তারাই ঠিক করে। বিয়ের আগে সে একবার দেখেছিল পারভীনকে। অবিকল ফরিদার মতো লাগে তাকে। তাই বিয়েতে রাজী হয়। গেল চান্দের পরের চান্দে কদমরসুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ের রাতে ছিল ভরা পূর্ণিমা। আজ চান্নি প্রহরে পারভিনকে দেখে তার আঁশ যেন মেটে না। তাই পারভীনের কোন কথাকেই সে উপো করতে পারে না।

একটা একটা করে বয়ামগুলো পাশের ঘরে রাখা শেষ করে সে যখন পারভীনের কাছে ফিরে আসে তখন সে গভীর ঘুমে অচেতন। কদমরসুলও তাকে জাগায় না। আলগোছে পাশে শুয়ে পড়ে। অবাক কাণ্ড! পারভীন তাকে জড়িয়ে ধরে। সে ভাবে ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে ধরেছে। ততোণে পারভীন তাকে জাগাতে শুরু করেছে। সেও সাড়া দিতে চায়। নাগিনীর ফোঁস ফোঁস শব্দে ঘর ভরে যায়। সেই শব্দ তারপর ঘর উপচে বেড়ার ফাঁক দিয়ে শূন্যে উড়াল দেয়। আর কদমরসুলও চায় নাগিনীর উধ্যত ফ বর্শা দিয়ে ফালা ফালা করে দিতে । কিন্তু বর্শাটা কোথাও খুঁজে পায় না সে। এদিকে নাগিনীর ফোঁস ফোঁস বাড়তেই থাকে। কদমরসুল সারা ঘরে কোথাও বর্শা খুঁজে না পেযে অবশেষ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাইরে কোথাও বর্শাটা আছে কিনা তাই দেখতে। সেরাতে কদমরসুল কোথাও বর্শা খুজে পায় না। পরদিন সকালে তাকে দেখা যায় আমগাছে ঝুলছে। এর কিছুদিন পরে হরিণহাটা গ্রামের মানুষ দেখে পথের ধারে আবার জোঁকের বয়াম। আর আপাদম¯তক মুখ ঢেকে বসে আছে এক নারী। এই নারী কিছুই বলে না। কারো কাছে জোঁক রাখার বৃত্তাšতও বলে না। সকালে রা¯তার ধারে বসে থাকে। রাতে চলে যায়। কোন কথা বলে না। তবু থাকে ঘিরে থাকে হাট। আর কদমরসুল আমগাছের ডালে ঝুলতে ঝুলতে দেখে রাতে খাটে বসে পারভিন চুলে কদুর তেল দেয়। পা নাচায়। নাগিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করে। কেউ একজন বর্শা নিয়ে আসে। কদমরসুল অন্ধকারে শুধু তাই দেখতে পায় না।