‘কেচ্ছা’ থেকে ‘গল্প’ কে আলাদা করার কাজটাই প্রথম পরীক্ষা একজন নবীন গল্পকর্মীর: সুমন সুপান্থের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: Jun 26, 2012 5:50:03 AM

প্রকাশিত বই: ভ্রমান্ধ দৃশ্যের বায়স্কোপ

দুপুর মিত্র: আপনি কবি এবং গল্পকারের মাঝে কোনটিতে নিজেকে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন?

সুমন সুপান্থ: একেবারে সিরিয়াস ধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে কিছুটা দ্বিধান্বিত আছি, আগেই বলে নিই। লেখালেখির সুবাদে নিজেকে একেবারে লেখক ভেবে বসা, আর সেইসুত্রে আবার সাক্ষাৎকার দেয়ার মতো যোগ্য আমি যে নই___ এটা তোমাকে, দুপুর, আগে নিশ্চিত হতে বলি, আর এই লেখার পাঠকদেরও; যদি আদৌ কেউ থাকেন।

এই এক প্রশ্নে আমি দ্বি-খন্ডিত। আমার কবি বন্ধুরা যখন এইসব লেখালেখি নিয়ে কথাটথা বলেন, সঙ্গে আমার কিঞ্চিতকর লেখালেখি নিয়েও, তারা আমাকে কবি হিসেবেই বিবেচনা করে ধন্য করেন দেখি। আবার গল্পকার অগ্রজরা, বন্ধুরা যখন বলেন , ‘তোমার ক্ষেত্র তো গল্পই’ , অস্বীকার করছি না দুপুর আমি নিজেও এক ধরণের ( যুগপৎ) পুলক ও সিদ্বান্তহীনতায় ভুগি তখন।

আর সব ভেবে টেবে বলি, এখন যেমন জানাচ্ছি ___ কবিতা আমাকে দিয়ে লেখিয়ে নেয়। আর আমি নিজে লিখতে চাই গল্প।

দু: সাম্প্রতিক কবিতা চর্চার বিষয়ে কিছু বলুন।

সু: আমার পক্ষে পুরো একটা সময়ের কবিতাচর্চা নিয়ে বলাটা দুঃসাহসেরই বটে। তবে কবিতা নিয়ে , সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে আমার আশাবাদ প্রবল। ৮০, ৯০ র কবিতা আমাদের কবিতার একটা বাঁক দেখিয়ে দিয়েছে__ সন্দেহ নেই।

দু: সাম্প্রতিক গল্প চর্চা বিষয়ে কিছু বলুন।

সু: এখানে আমি একটু হতাশই। ৬০’র মতো একটা ফলবান গল্প-দশক থাকার পরও, আরো পরে ৮০/৯০। আমাদের গল্পচর্চা, মানে আমার নিজের সময় যদি বলেন, এই শূণ্য দশক সেই অর্থে গল্পে বা কথা সাহিত্যেই উল্লেখযোগ্য কাজ দেখছি না। মানে সেই ৬০’র ধারাবাহিকতায়, কিংবা ৮০/৯০’র উত্তর দশকের হিসেবে। একটা ছোট কাগজ সম্পাদনা করা সুত্রে দেখেছি, যে পরিমান কবিতা পাওয়া যায়, সেই তুলনায় তরুণদের কাছ থেকে গল্প বা গদ্য পাওয়া দুরহ। পরিশ্রমবিমুখতা, ‘লেখা’কে উপরিতল থেকে দেখতে চাওয়াটা ই এইসবের কারণ বলে মনে হয়। এমন কি কবিতাতেও টানা গদ্যে লেখার একটা প্রবনতা যে সর্বপ্লাবী, এর মুলে মূলত ছন্দচর্চাকে এড়িয়ে , পরিশ্রমকে এড়ানোরই কৌশল বলে মনে হয়।

দু: সমসাময়িক কাদের কবিতাকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং কেন?

সু: এইভাবে আলাদা আলাদা করে নাম ধরে বলছি না। অনেকের কবিতাই ভালো লাগে। কেন লাগে সেটা ব্যাখ্যা করা আমার অল্প জ্ঞানে সম্ভব না মনে হয়।

দু: সমসাময়িক কাদের গল্পকে আপনি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এবং কেন?

সু: এই দুটি প্রশ্নই ( আগেরটাও ) একটু গোলমেলে। মানে সমসাময়িক বলতে কাদের বুঝাচ্ছ ? যারা আমার সময়ে লেখালেখি শুরু করেছেন ? না যারা এখনো গল্পচর্চায় সচল ? সেই অর্থে মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, ইমতিয়ার শামীম, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তাফা কামাল, অদিতি ফাল্গুনী, আকমল হোসেন নিপু, রাখাল রাহার গল্প আলাদা মনোযোগ দাবী করে সন্দেহ নেই। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, সেলিম মোরশেদদের কাজের চেয়ে ইশতেহার আগে চোখে লাগে বলে সাহিত্যের রস মেলা ভার হয়ে যায় এঁদের লেখায়।

হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কায়েস আহমেদ এঁদের পর শহিদুল জহির আমাদের গল্পে একটা মাত্রা নির্ধারন করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। আর মামুন ভাইর গল্প তো ন্যারেশনের এমন ভঙ্গি দিয়েছে আমাদের, বহু বছর আমরা এটা ভাঙিয়ে খেতে পারবো। হা হা হা...

আমার তো মনে হয়, আমরা যারা পরের প্রজন্মের গল্পকার, তাদের জন্য এই সকল মেধাবী গল্পকারদের ছাড়িয়ে যাওয়া, গল্পচর্চায় তাঁদের অতিক্রম করাই একটা বিস্ময়ের কাজ হবে। গল্পে আমাদের অগ্রজদের কাজ ফেলনা নয় কোনও ভাবেই।

দু: আপনি কবিতায় ঠিক কি করার চেষ্টা করেছেন বা করেন এবং কেন?

সু: ওই যে বললাম, কিছু ভেবে কবিতা লিখি না। কবিতা আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।

দু: গল্পে আপনি ঠিক কি করার চেষ্টা করেন এবং করেন?

সু: হুম, গল্পে আমার একটা সচেতন আর গোপন চেষ্টা আছে হয়তো। ঠিক নিরীক্ষার নামে অবস্ট্রাক্ট হয়ে না ওঠা যেমন, তেমনি আবার সস্তা চটুল প্রেম সেক্স এইসবকে পুঁজি করে গল্পের নামে ‘কেচ্ছা’ ফাঁদার যে উঠতি দল, আমার এইসব দিকভ্রান্ত বন্ধুদের হল্লার বাইরে থাকার গোপন এক অভিলাষ যে নাই, তা বলি কি করে! আমার তো মনে হয় কেচ্ছা আর রুপকথার এই বঙ্গদেশে ‘কেচ্ছা’ থেকে ‘গল্প’ কে আলাদা করার কাজটাই প্রথম পরীক্ষা একজন নবীন গল্পকর্মীর।

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ দুপুর ।