সমসাময়িক সবই উল্লাস আর ফুর্তির কবিতা: সরসিজ আলীমের সাথে অনলাইন আলাপ

Post date: May 29, 2014 5:02:24 PM

 

প্রকাশিত বই: পাতাটি যতই মেজাজ দেখাক, একঝাঁক পাখি ডাকাডাকি, বাঙালি আর বাউল পরান থৈথৈ জল, ঝমঝমানো, ঘৌড়দৌড় ও কুমীরের ডিমবসতি

 

দুপুর মিত্র:  ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়ার গঠন প্রক্রিয়া চলছে বলে আপনি মনে করেন কি? এখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয়গুলোকে কিভাবে দেখবেন। বা লিটলম্যাগের প্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা যায় কিনা?

 

সরসিজ আলীম:  ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ ইত্যাদির মাধ্যমে একটা পাল্টা মিডিয়া গঠন করার সুযোগ হয়তো ছিলো, কিন্তু এখন আর নেই। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। পাল্টা মিডিয়াতে আপনি মুক্তমত ও মতামতের বিকাশ ঘটাতে চাইবেন তো? রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির গণবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষের প্রতিবাদী শক্তির বিকাশ ঘটাতে চাইবেন তো? রাষ্ট্রের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও গঠনমূলক একটি সোচ্চার কণ্ঠকে সংগঠিত করতে চাইবেন তো? একটি মিথ্যাকে ঐশ্বরিক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে দিয়ে সত্য বানিয়ে দেবার মারাত্মক প্রবণতাকে রুখে দেবার দায় নেয়াটি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বিষয় হতে পারে কি? তাহলে আপনাকে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গিকার নিয়ে এগিয়ে যাবার পথ হচ্ছে সত্যকে দেখিয়ে দেবার যথেষ্ট যুক্তি ও প্রমাণ দাঁড় করানো। এই যুক্তি ও প্রমাণ দিতে গেলেই আপনাকে প্রচলিত প্রথা, প্রবণতা, ভক্তি, অভ্যস্ততা ও ভান-ভনিতার বিরুদ্ধে লিখতে হবে। অনলাইনের লেখালেখিতে ৫৭ ধারার অস্ত্রের কারণে এটা আর সম্ভব নয়। অনলাইনের লেখালেখির কারণে যে কোন অভিযোগ আমলে নেয়া হবে, আদালতের আদেশ ছাড়াই গ্রেফতার হবেন, নির্দোষ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত জামিন পাবেন না। আর আপনি ন্যায় বিচার পাবেন বলেও মনে হয় না। সমাজকে ও বিচারিক কার্যক্রমকে বিভ্রান্ত করার জন্য রয়েছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রচারণা।এরপর সাজার বিষয়টা ভাবেন, সর্বনিম্ন ৭ বছরের জেল আর অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা।এইসব মাথায় নিয়ে কাজ করতে চাইলে বিপ্লবী পথ তৈরি হয়ে যেতে পারে।

ওয়েব ম্যাগ, ব্লগ অবশ্যই লিটলম্যাগের প্রতিস্থাপন হিসেবে ভাবা যেতো। সেটা অনেক বড় একটা সুযোগ তৈরি করে দিতে পারতো।

 

দুপুর মিত্র: লিটলম্যাগের সাথে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্পর্ক থাকতেই হয় বলে মনে করেন কি? হলে কেন?

 

সরসিজ আলীম:  রাত দুপুরে আপনার খুব ইচ্ছে হলো আপনি গলা ছেড়ে গান গাইবেন বা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিবেন, সেটা অবশ্যই সাউন্ডপ্রুভ ঘরে বসে নয়। জানালা-দরোজা খোলা থাকবে, হু হু করে বাতাস ঢুকবে, জোছনারা নাচানাচি করবে, এটা কি আপনার ঘুমের বাসিন্দারা মেনে নিবে? পড়শীরাও? তাহলে আপনাকে খোলা মাঠে যেতে হবে। আর ঘরে বসে তখন কেবল ভক্তি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া সম্ভব।

 

দুপুর মিত্র: আপনার কাছে কবি হয়ে ওঠা বিষয়টা কি?

 

সরসিজ আলীম:  অন্তর্জগতকে নির্মাণ করা যাতে বহির্জগতের বিবিধ পরিশীলিত বোধকে আলোড়িত করতে পারে। এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছানো, যেখানে সচেতন মানুষদের নিজস্ব ভাবনাকে গতিশীল করবে।মানবিক স্তরকে উন্নত করার জন্য প্রভাব তৈরি করা, যেভাবে সমাজ-সংসারের মানুষ ও অন্যান্য প্রকৃতি নিরাপদ বোধ করবে।আর কোন বিশেষ ব্যক্তির কবি হয়ে ওঠার বিষয়টা তার নিষ্ঠা, আগ্রহ ও চর্চার উপর নির্ভর করে, নয় কি?

 

দুপুর মিত্র: কবিতা কি?

 

সরসিজ আলীম:  যে শব্দরাজি বোধ ও অনুভূতির আঁচে রুটির মতো ফুঁলিয়া ওঠে, মনে পরিতৃপ্তি ও পুষ্টি দান করিয়া থাকে, তাহাকে কবিতা বলে।

ধরেন, ঝড়ে ঘুঘু পাখির ডিমসহ বাসাটি একটি জলাশয়ে ডুবে গেলো, জলের তলে বসে ডিম দু'টি যে কান্না বা গান করতে শুরু করলো, সেটির ভাষা দান করা কবিতা।শিল্পের একটি বিশেষ ভাষা উচ্চারণের মাধ্যম কবিতা।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বাংলা কবিতার প্রবণতাগুলো কি?

 

সরসিজ আলীম:  রুল টানা কাগজে গদ্য লেখা, ঐশ্বরিক বন্দনা নয়, রাষ্ট্রীয় সভাসদের বন্দনা নয়, প্রকৃতির বন্দনার মধ্যে দিয়ে আত্মবন্দনা।শৈল্পীক প্রবণতা হতে পারে, বিমূর্ততা, পরাবাস্তবতা ও প্রতীকি নির্মাণ থেকে বাহ্যিক হয়ে ওঠা। ভাবনার মধ্যে গড়াতে গড়াতে গুড়িয়ে যাওয়া। বাহ্যিক প্রবণতা হচ্ছে, আত্মবিলাপকে কবিতা বলে প্রচার চালানো।

 

দুপুর মিত্র: সাহিত্য আন্দোলন কি কবিতাকে পরিবর্তন করে?

 

সরসিজ আলীম:  সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে উদ্দেশ্য ও অঙ্গিকার জড়িত, তাহলে কবিতা পরিবর্তন হতে বাধ্য। পরিবর্তনের জন্য কবিতা, কবিতার জন্য পরিবর্তন_ এমন স্লোগান উঠতেই পারে।সমাজের মানুষের প্রতি বিশেষ দায় নিজ মনে স্বীকার করলে ব্যক্তিও এই আন্দোলনের অংশ। এখানে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই, আমরা কি আন্দোলন বলতে কি জোটবদ্ধতাও বলছি? তবে সমাজে এমন একটি শক্তি সক্রিয় থাকা দরকার, যার প্রভাবে মুক্তচর্চার অবাধ ক্ষেত্র বজায় থাকে।

 

দুপুর মিত্র: আপনি কিভাবে কবিতা লিখেন?

 

সরসিজ আলীম:  মাইক্রোসফ্ট অফিস ওয়াড ফাইল অপেন করি আর কি-বোর্ড চেপে লিখতে শুরু করি।আমি কি কি চাই, তার একটি তালিকা তৈরি করতে থাকি।আমার কবিতা হচ্ছে চাহিদাপত্র। সময় ও পরিস্থিতির কারণে এই চাহিদারও পরিবর্তন হয়, তাইতো আমার তালিকা করাও শেষ হয় না। তাইতো লিখতেই আছি।

 

দুপুর মিত্র: সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?

 

সরসিজ আলীম:  অস্থির ও ভোগবাদী। তালেবান শিবিরের একজন কবি নারী ও শিশুর খুনের বদলে রাষ্ট্র দখলের স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লিখছে। আল কায়েদা নারীকে যৌন জিহাদী হিসেবে পেতে চাইছে, আল কায়েদার এক কবি সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। বোকো হারামের কোন কবি ইস্কুল বালিকাকে অপহরণ করে তার বালিকার মধুর স্বপ্ন নিয়ে কবিতা লিখছে।মার্কিন কোন তরুণ কবি পর্নোনায়িকাকে দেখে উত্থিত শিশ্ন দিয়ে কবিতা লিখছে। সবই উল্লাস আর ফুর্তির কবিতা।

আপনার প্রশ্নে আমি ঘেমে উঠেছি, তাই ঘাম মোছার জন্য বানিয়ে এগুলো বললাম। সমসাময়িক বিশ্ব কবিতা পাঠের সুযোগ আমার কম।

 

দুপুর মিত্র: আপনার লেখালেখির শুরু কবে থেকে?

সরসিজ আলীম:  ১৯৮৩ থেকে। লিরিক লেখার চেষ্টা করতাম।

 

দুপুর মিত্র: আপনি কেন কবিতা লিখেন?

সরসিজ আলীম:  দুপুর মিত্রের সাথে পরিচয় হবে, দুপুর আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করবে, তাই লিখি।আমার কণ্ঠ আছে, সেই কণ্ঠ ছড়িয়ে যাক আমি চাই। আমার কিছু ভাষা আছে, সেই ভাষা সবার হয়ে বন্ধন তৈরি করুক, সেটা আমি চাই।

 

দুপুর মিত্র: আপনি সাধারণত কোথা থেকে কবিতা লেখার বিষয় খুঁজে নেন?

সরসিজ আলীম:  বস্তু জগত থেকে, বায়ুমণ্ডল থেকে, অপার জলরাশি থেকে, মানুষের অসংখ্য চিৎকার থেকে ও খুব নিভৃত গোপন থেকে।

 

দুপুর মিত্র: কবিতা লেখার জন্য একজন কবির কি ধরণের প্রস্তুতি দরকার বলে মনে করেন?

সরসিজ আলীম:  লেখালিখির জন্য তিনটি জনমের প্রয়োজন হয়, এক জনম জীবন-সংসার ভোগ করবে, এক জনম পাঠ ও প্রস্তুতিতে বিভোর থাকবে, আরেক জনম শুধুই লিখে যাবে।যে মহান ব্যক্তি এই তিন জনমের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে সেই লেখক হবে। বিশ্বের সকল নির্বাচিত ও অনির্বাচিত বিষয়ে পাঠ ও উপভোগ করা একজন কবির প্রস্তুতির অন্যতম বিষয় হতে পারে।অপ্রাতিষ্ঠানিক কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ধারণার শিক্ষা ও সাহচর্য প্রয়োজন পড়বে আপনার।