অমর মিত্রের স্মৃতিকথা: এই জীবন

Post date: Oct 10, 2014 5:37:19 PM

(আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ফর্ম বাংলা ভাষায় তেমন চর্চিত নয়। আবার এখানে কিছু কুসংস্কারও রয়েছে। যেমন মনেই করা হয় কেবল বুড়োদের স্মৃতি থাকে। তরুণদের নয়। মানে বুড়ো লেখকরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখবে। তরুণরা এটা লিখবে না। কিন্তু এটা তো জাস্ট একটা সাহিত্যের ফর্ম। যে কোন সময় যে কোন বয়সে যে কেউ- এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে পারে।

এবার আমার টার্গেট এই স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেওয়া। এখন থেকে অলস দুপুর ওয়েব ম্যাগাজিনে যে কোনও বয়সের যে কোনও লেখকের স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী ছাপা হবে। অলস দুপুর ওয়েবম্যাগে সকলের স্মৃতিকথা লেখার আহ্বান জানাচ্ছি। স্মৃতিকথা লেখার ভেতর দিয়ে মিথ্যা বা ভুয়ো আত্মজীবনী লেখার জায়গাটাও কমে আসবে।

আসুন আমরা স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লেখার প্রচলিত বা প্রথাগত ফর্মটাকে ভেঙে দেই।-দুপুর মিত্র)

আমার জন্ম ১৯৫১সালের ৩০শে আগস্ট, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি ধূলিহর গ্রামে। ধূলিহর গ্রাম তখন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা জেলায়, অধুনা বাংলাদেশের সাতক্ষিরে উপজেলায়। সাতক্ষিরে শহর থেকেদু-আড়াই কিলো মিটারের বেশি হবে না। দেশ তখন ভাগ হয়ে গেছে। যতটা শুনেছি বা আমার অগ্রজ মনোজ মিত্রর লেখায় পড়েছি বাবা ছিলেন ওই গ্রামের প্রথম বি,এ, পাশ। ডিস্টিংশন ছিল তাঁর। অঙ্কবাদ দিয়ে সাহিত্যের বিষয়, ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত আর ইতিহাস দর্শন –এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় লেটার মার্কস পেয়েছিলেন। তাঁর সেই মার্কশিট আমি দেখেছি। সেই ধূলিহর-এ একটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপনকরেন বাবা। সেই ইস্কুলে আমি ২০০০সালে গিয়েছি। পরিচয় পেয়ে ইস্কুলের হেড মাস্টার মোজাহার শানা ইস্কুল ঘরে বসিয়ে আলমারি খুলে ১৯৩৮ সালের রেজিস্টার বের করে আমার বাবার স্বাক্ষরদেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন ১৯৪৪-এ আমার বড়দা( মনোজ) এবং মেজদা( মেজকাকুর বড় ছেলে রণজিৎ) যে ওই ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল আডমিশন রেজিস্টার খুলে তা দেখিয়েছিল। দেখতে দেখতেআমি আমার জন্মের আগের পৃথিবীতে পৌঁছে গিয়েছিলাম যেন।

খুলনা জেলা এমনিতেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত, ভাগাভাগির সময় ইন্ডিয়ায় ছিল তিনদিন, তারপর মুর্শিদাবাদ এল ইন্ডিয়াতে, খুলনা গেলপাকিস্তানে। এই ঘটনাই বুক ভেঙে দিয়েছিল ওখানকার মানুষের। হ্যাঁ, আমাদের সাতক্ষিরে ছিল অসাম্প্রদায়িক এলাকা। দাঙ্গার কথাতেমন শুনি নি, যা হয়েছিল নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা কলকাতায় ছেচল্লিশের ১৪-১৫-১৬ই আগস্ট, ভাগলপুরে, ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। এখন শুনতে পাই সেই অসাম্প্রদায়িক খুলনা সাতক্ষিরে সাম্প্রদায়িকতার আখড়া। ধর্মীয় মৌলবাদীদেরআশ্রয়স্থল।

ধূলিহরের ডাক নাম ধুরোল। আমরা ছিলাম সাধারণ রায়ত। খুব বেশি জমি ছিল না মনে হয়, আবার কমও ছিল না। আমার ঠাকুরদা ছিলেন অসুস্থ মানুষ। অল্প অল্প মনে আছে ভোরে ঘুম থেকেউঠে হাতনেতে রাখা নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে তিনি বসতেন। বসেই থাকতেন। মাঝে মধ্যে মাছের খারা হাতে বাজারে যেতেন। বাজারটা কাছে পিঠেই ছিল। আমার কিছু মনে নেই। মনে আছে অনেকগুলিপুকুরের কথা, বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর, সেই পুকুরে জল ছিল না বেশি, পুকুরের ওপারে আমার ছোট কাকিমার মামার বাড়ি, ধর বাড়ি। মনে আছে, একবার ওই বাড়ির কেউ একজন বৃদ্ধ মারাগিয়েছিলেন। মায়ের সঙ্গে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। বাঁশের চালিতে শোয়ান রয়েছে মৃত দেহ। আর রোখ ছেড়ে কাঁদছে নানা বয়সের নারী। সেই কান্নার কথা মনে গেঁথে আছে আমার। ওই বোধ হয়প্রথম মৃত্যু দর্শন। কোন সাল হবে তা? চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বোধ হয়। আর একটি কথা মনে আছে, সেই বয়সের কথা, একটি চার পাঁচ মাসের নষ্ট হয়ে যাওয়া ভ্রুণ আমি কার কার সঙ্গে গিয়ে যেন বাড়িপিছনের বাগানে পুতে দিয়ে এসেছিলাম। আমি সঙ্গে ছিলাম। সে ছিল মেঘময় দিন। বাগানে বা বাদাড়ে ছিল বড় বড় মানকচু গাছ। মানকচুর পাতা হয় মস্ত। বর্ষায় ওই পাতা মাথায় দিয়ে গরিব চাষাকেআত্মরক্ষা করতে দেখেছি। হ্যাঁ, ওই ভ্রুণ মাতৃগর্ভের আশ্রয়ে ন’মাস কাটাতে পারলে আমার একটি ভাই হত। কতকালের কথা, মনে আছে। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম সেই মানুষের আকৃতি পাওয়াভ্রুণটিকে। তখন ভ্রুণ নষ্ট হয়ে যাওয়া আর শিশু মৃত্যু ছিল সাধারণ ঘটনা যেন। মায়েরা ছিলেন সবংর্সহা। আমার একটি দিদি ছিল, তাকে আমি দেখি নি। তার জন্য মাকে কাঁদতে দেখেছি। নাম ছিলডিলডিল। আমার মা, আমার মেজদা উদয়ন বলতেন সে ছিল খুব সুন্দর। এপারে বেলেঘাটার বাসায় সে মারা গিয়েছিল কদিনের জ্বরে। আমার কেন তার কথা মনে নেই, আমি জানি না। আসলেপার্টিশন হওয়ার পর আমাদের পরিবার ঠিক করতে পারছিল না কোথায় থাকবে। ধূলিহরের সাতপুরুষের ভিটে ছিল, সাতক্ষিরে পার হয়ে সীমান্তের এপারে বসিরহাট শহরের লাগোয়া দন্ডীরহাট গ্রামেজমি কেনা হয়েছিল কবে তা আমি জানি না। বেলেঘাটার বাসায় খুব জলকষ্ট ছিল শুনেছি। এসবের সন তারিখ আমার খোঁজে নেই। শুধু এক একদিন মায়ের নিঃশব্দ অশ্রুপাত দেখেছি আমি আনেক বড়হয়েও। ডিলডিল আর সাহেব। সাহেব ছিল আমার বড়দার পরেরজন। আমার জন্মের আগে জন্মে চলে গিয়েছিল। সেই শিশু রূপের জন্যই ছিল সাহেব।

আমাদের সেই সাতপুরুষের ভিটে ধূলিহরের কথা কম মনে নেই। এপারে দন্ডীরহাটে বাড়ি হবে কিংবা হয়েছে, কলকাতায় বাসা নেওয়া হয়েছে কিংবা হয় নি। শুনেছি বেলেঘাটায় আদরের কন্যারমৃত্যুর পর বাবা সকলকে হয় ধূলিহর কিংবা দন্ডীরহাটে পাঠিয়ে দিয়েছিলে। বাবা কাকারা মিলে তিন ভাই। আমাদের ছিল একান্নের সংসার। ছোটকাকা ছিলেন ল,এম,এফ ডাক্তার, ক্যাম্বেল মেডিকালকলেজ ( বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিকাল কলেজ) থেকে পাশ। ধুরোলে তাঁর খুব পশার ছিল। ডাক্তার হিসেবে তিনি গুনী ছিলেন, রোগ নির্ণয় করতে পারতেন খুব ভাল। তিনি বহুদিন ওপারেছিলেন, ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় এদিকে চলে আসেন চিরকালের মতো। আমার খুব মনে পড়ত ধুরোলকে। বড় বড় মানকচু পাতার নিচে শুয়ে থাকল সেই না জন্মান শিশু। সেইছিরছিরে বৃষ্টি, মেঘ। আমি কিছুই বুঝি না। আমার কোনও কষ্ট ছিল না তখন। যত কষ্ট এই লিখতে বসে, এই এখন।

২.

আমার ছেলেবেলার অল্প অংশে ধূলিহর, বাকি অংশে কলকাতার বেলগাছিয়া আর ২৪পরগনার বসিরহাটের লাগোয়া দন্ডীরহাট গ্রাম। বেলগাছিয়ার বাসা নিয়েছিলেন বাবা সেই ৫৬-৫৭ সালে। আরদন্ডীরহাটে আমাদের একান্নবর্তী সংসার গড়ে ঊঠল। সেখানে লম্বা দালান, দুদিকে দুটি বারান্দা, সামনে পিছনে, পুবে পশ্চিমে। সেই বারান্দায় ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র চেয়ারে বসে থাকতেন। তিনবিঘে জমির উপর বসতভিটে। তার সীমানা ঘিরে নারকেল গাছ। এছাড়া হিম সাগর আমের গাছ অনেক, পুকুরপাড়ে শিউলি ফুলের গাছ। একটি জাম গাছ, লিচু ছিল না মনে হয়। সেই বাড়িতেপাকিস্তানের ধূলিহর থেকে লক এসে থাকত প্রায়ই। আবার বেলগাছিয়ার বাসা ছিল যেন একটি স্টেশন। এখানে কতলোক এসে যে আস্তানা গেড়ে তারপর নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে চলে গেছে। যেহেতুসাতক্ষিরে ধূলিহর সীমান্তের অতি নিকটে, সেই কারণে ঐ অঞ্চলের লোক সময় করে দেশ ছাড়তে পেরেছিল মনে হয়। খুলনা জেলা এমনিতেই ছিল হিন্দু অধ্যুষিত, ভাগাভাগির সময় ইন্ডিয়ায় ছিলতিনদিন, তারপর মুর্শিদাবাদ এল ইন্ডিয়াতে, খুলনা গেল পাকিস্তানে। এই ঘটনাই বুক ভেঙে দিয়েছিল ওখানকার মানুষের। হ্যাঁ, আমাদের সাতক্ষিরে ছিল অসাম্প্রদায়িক এলাকা। দাঙ্গার কথা তেমন শুনিনি, যা হয়েছিল নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ বা কলকাতায় ছেচল্লিশের ১৪-১৫-১৬ই আগস্ট, ভাগলপুরে, ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। এখন শুনতে পাই সেই অসাম্প্রদায়িক খুলনা সাতক্ষিরেসাম্প্রদায়িকতার আখড়া। ধর্মীয় মৌলবাদীদের আশ্রয়স্থল। যাক সে কথা, আমি বলি ছেলেবেলার সেই দন্ডীরহাট গ্রাম আর ছেলেবেলার কলকাতার কথা। কলকাতার বেলগাছিয়ায় যে ইন্দ্র বিশ্বাস রোডেআমাদের বাসা বাড়ি, সেখানে মস্ত টালা পার্ক। আগে যার নাম ছিল জিমখানা গ্রাউন্ড। একটা সময়ে বেঙ্গল জিমখানা নামের একটি ক্লাব কলকাতার ক্রিকেট ও ফুটবলে যে কোনো একটি ডিভিশিনেখেলত। আমি ক্লাস ওয়ান-টু পড়ি নি, একেবারে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছিলাম বেলগাছিয়ার মনোহর একাডেমিতে। তখন কলকাতার পাড়ার ইস্কুলগুলো ভাল ছিল। আমাদের ইস্কুলে ধনী দরিদ্র একসঙ্গেপড়ত। আমার সহপাঠী দীপকের বাবা ছিল ছুতোর মিস্ত্রি, তাদের পদবী ছিল সূত্রধর। জয়নাথ রায়ের বাবা আইসক্রিম গাড়ি ঠেলত। জয়নাথ ছিল অতি মেধাবী ছাত্র। সে পরে অনেক বড় চাকরিতেঢোকে। ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেত জয়নাথ। নকশাল বাড়ির আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিল, জেল খেটেছিল। সে খুব সম্ভবত ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিল। যখন আমি দেশ পত্রিকায় প্রথম লিখি সেই১৯৮৩তে, সেই গল্প পড়ে জয়দেব আমার বাড়ি এসেছিল একদিন সকালে। সে ছিল এক অমলিন শ্যামলা বালক, আমি ইস্কুলের কথা বলছি। আমাদের আর দুই সহপাঠীর বাবার মিষ্টির দোকান ছিলবাজারে। কিন্তু এখন বুঝি সেই দোকানটি ছিল বিষণ্নতায় ভরা। পূঁজিপাটা ছিল না তেমন। এপাড়ার জলধর মিষ্টান্ন ভান্ডারের দাঁড়াতেই পারত না। সেই দোকানের নিমকি আর হালুয়াতে ছিল আমারঅমোঘ আকর্ষণ। সেই মিষ্টির দোকান কবে ঊঠে যায় মনে নেই। মনে পড়ে তার শো-কেসে কিছুই নেই, শুধু শূন্য গামলা আর পুরোন রসের তলানি। আমাদের সেই দুই সহপাঠীর একজন কাশীনাথহয়েছিল ট্রাম কোম্পানির ড্রাইভার। আর বিমলকে দেখতাম বাজারে শব্জি নিয়ে বসত। ক্লাসের এক সহপাঠীদের ছিল জাহাজ। তাদের এপাড়ায় মস্ত চারতলা বাড়ি। সেই বাড়ির গায়ে ধবধবে শাদা রঙ।সে আমার পাশে বসত। এক সহপাঠীর বাবা স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক। একজনের বাড়ি পাইকপাড়া যেতে মন্মথ দত্ত রোডে মস্ত জাহাজের মতো। বাড়িতার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।এই সব বন্ধুদের কথা বলার মানে ধনী দরিদ্র একসঙ্গে এক ক্লাসে পড়া। মারামারি, ভালবাসাবাসি সব একসঙ্গে। ফুতবল ক্রিকেট একসঙ্গে। এখন তেমন হয় না। গত তিরিশ- পঁয়তিরিশ বছরে এইটাহয়েছে। ভাগ হয়ে গেছে সব ভাগ হয়ে গেছে। পাড়ার ইস্কুলে গরিব বস্তিবাসী পড়ে। আর যে বাপ মার ক্ষমতা আছে, তারা তাঁদের ছেলেকে সুসভ্য দূরের ইস্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। ইংলিশ ইস্কুলেপাঠিয়ে দিয়েছেন। ধনীর ছেলে গরিবের ছেলের সঙ্গে মেশে নি, বরং দূরে থেকে ঘৃণা করতে শিখেছে কেউ কেউ। কেন এমন হল ? পরিকল্পিত ভাবে বিদ্যা-ব্যবসার ফলাও প্রসার ঘটল। পাড়ারইস্কুলগুলো শেষ হয়ে গেল।

ছেলেবেলার সেই কলকাতা ছিল শান্ত। কলকাতায় ছিল লাল দোতলা বাস। লাল পাগড়ি পুলিশ ছিল অনেকদিন অবধি। তারপর তা কবে অবলুপ্ত হল মনে নেই। তখন কলকাতা শহরের ভিতরপ্রাইভেট বাস ঢুকতে পারত না। ট্রাম চলত দ্রুত গতিতে ঠং ঠং করতে। আমাদের তিনঘরের ফ্ল্যাটে তখন কত লোক। বাইরের লোক বেশি। মামারা ছিলেন কিছুদিন। সে ছিল আনন্দের দিন। মামাতদিদি বোন, খুড়তুতো দিদি বোনদের সঙ্গে বড় হওয়া। তা ছাড়া ছিল, মেজকাকার বন্ধু ফনীবাবু, দন্ডীরহাটের লোক, ধুরোলের লোক। প্যাসেজ রান্না ঘরে পযর্ন্ত বিছানা পড়ত। আমাদের বাসা ছিলবহুজনের আশ্রয়। ওপার থেকে উচ্ছিন্ন মানুষ তারা, যাবে কোথায় ? বাড়িতে তেমন জায়গা নেই তাই বাইরে ঘুরি। খেলার মাঠে ফুটবল পেটাই। সারাদুপুর ক্রিকেট। সন্ধের আগে কিং কিং, পিট্টু। কেমনএকটা বড় হওয়া বুঝিবা। আর এর ভিতরে এক একটা দিন যেন আসত রূপকথা হয়ে। টালা পার্কে চুনী গোস্বামী ক্রিকেট খেলতে এসেছেন মোহনবাগানের হয়ে। শ্যামসুন্দর মিত্র, দুর্গাশঙ্কর মুখারজিএসেছেন। এঁরা সব নামী খেলোয়াড়। এরাই হলেন বালকের রূপকথার রাজপুত্র। টালা পার্কে শীতের সময় আসত সার্কাস। অলিম্পিক সার্কাস, ওরিয়েন্টাল সার্কাস। একেবারে বাড়ির সামনে। রাতেবাঘের গর্জনও শোনা যেত। সেই শীতের আরম্ভে এসে তারা তিনটি মাস মাইক বাজিয়ে, আলোর ঝর্না বইয়ে, হাতি নিয়ে প্রচারে বেরিয়ে সরগরম করে রাখত সব। টিনে ঘেরা থাকত মাঠ।তার ছিদ্র দিয়েসিংহ আর ব্যাঘ্র দর্শন হতো। সার্কাস ছিল যে কী আনন্দময়। সেই টিয়াপাখির কামানদাগা থেকে গ্লোবের ভিতর মোটর সাইকেল চালানো। রেবা রক্ষিতের বুকের উপর হাতি নেওয়া বা ট্রাপিজেরছেলেমেয়েদের শূন্যে বিচরণ। সার্কাসের মেয়েরা আমাদের বড় করে দিয়েছিল তাদের পোশাকে। রঙ চঙ মাখা জোকার যখন সকালবেলায় মুদির দোকানে আসত সওদা করতে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে ধন্য হয়ে গিয়েছিলাম একদিন। সে কত জন্মের আগের কথা মনে হয় এখন। মনে পড়ে ফাল্গুন-চৈত্রে সার্কাস উঠে গেলে আচমকা পাড়াটা শূন্য হয়ে যেত। কী খালি লাগত তখন। একা একা ঘুরছিসার্কাস পার্টির ফেলে যাওয়া মাঠে। হু হু কান্না চলে এল নিজের ভিতরে। একা একা কাঁদতে লাগলাম। জোকার সেই বামন মানুষটি, হাতি ঘোড়া বাঘ সিংহের জন্য কাঁদতে লাগলাম আমি একা।